রক্তাক্ত অরল্যান্ডো, স্তম্ভিত বিশ্ববিবেক
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ১৪ জুন, ২০১৬, ০৯:৩৩:৪৮ সকাল
গত বছরের ১৩ নবেম্বর সন্ত্রাসী হামলায় রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাজপথসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। নিহত হয়েছিলেন দেড় শতাধিক। আহতের সংখ্যা দুশ’রও অধিক। যা ২০০৪ সালে স্পেনের মাদ্রিদে ট্রেনে বোমা হামলার পর ইউরোপের মাটিতে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সের মাটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। কিন্তু থেমে নেয় গোটা বিশ্বেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ঘটনা। ঝড়ছে প্রতিনিয়ত তরতাজা প্রাণ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গত ১০ জুন অরল্যান্ডোর এক কনসার্টে গুলিতে ২২ বছর বয়সী পপসঙ্গীত শিল্পী ক্রিস্টিনা গ্রিমি নিহত হওয়ার একদিন না পেরোতেই নৈশকাবে গুলিবর্ষণে প্রাণহানির ঘটনায় বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত ও মর্মাহত।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত ১২ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডো শহরে পালস নামক সমকামীদের একটি নাইট ক্লাবে বন্দুকধারীর সন্ত্রাসীর হামলায় কমপক্ষে ৫০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫৩ জন। ওই হামলায় হামলাকারীও নিহত হয়েছেন। হামলাকারী ওমর মতিন (২৭) এবং তার বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে ১০০ মাইল দূরে ফোরিডার সেইন্ট লুসিয়াতে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ওমর মতিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারি আফগান বংশোদ্ভূত। গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, প্রাথমিকভাবে এটিকে সন্ত্রাসী হামলা বলেই মনে করা হচ্ছে। গোয়েন্দারা মনে করছেন, এই হামলা ইসলামি চরমপন্থীদের দ্বারা ঘটতে পারে। প্রত্যদর্শী অ্যানথনি টরেস বলেন, তিনি মানুষকে চিৎকার করতে শুনেছেন, নাইট ক্লাবের অনেকে হয়তো নিহত হয়েছেন। নাইট কাবটিতে শতাধিক লোক আনন্দ করছিলেনÑ এমন সময় ওই হামলাকারী কাবে হামলা চালায়।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার প্রায় তিন ঘণ্টা পর তারা পালস ক্লাব নামে ওই নাইট কাবটির ভেতরে ঢুকে আক্রমণকারীকে হত্যা করে। পুলিশ আরো জানায়, বন্দুকধারী লোকটির হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল ও হ্যান্ডগান ছিল এবং সে নাইটকাবের ভেতরে অনেককে পণবন্দী করেছিল। নিহত হওয়ার আগে পুলিশের সাথে তার গুলিবিনিময় হয়। পুলিশ বলছে, বন্দুকধারী একা ছিল এবং সে স্থানীয় কেউ নয়। তিনি জানান, বেশ কিছু সন্দেহজনক বস্তত ক্লাব ও হামলাকারীর গাড়িতে পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, হামলাকারী বেশ প্রস্তুতি নিয়ে হামলা চালিয়েছে।
গত ১১ জুন অরল্যান্ডোতে লাইভ কনসার্টে গুলির রেশ কাটতে না কাটতেই এ হামলা চালানো হলো। একদিন আগেই ফোরিডাতে এক গায়িকাকে গুলি করে হত্যা করে এক দুর্বৃত্ত। পরে সে নিজেও আত্মহত্যা করে। অরল্যান্ডোতে লাইভ কনসার্টের স্থান থেকে পালস নাইট ক্লাবের দূরত্ব চার মাইল।
পুলিশ বলছে, এটি ‘সন্ত্রাসী হামলা’ ছিল। প্রত্যদর্শীরা জানান, এই হামলায় অন্তত আরো ৫৩ জনের মতো আহত হয়েছেন। অরল্যান্ডোর পুলিশ প্রধান জন মিনা বলেন, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা তারা বলতে পারছেন না। পরে জানা যায়, কমপক্ষে ৫০ জন নিহত হয়েছেন। ৫৩ জনকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এদিকে অরল্যান্ডে ট্রাজেডির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারি মুসলিমদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়নি। তবে ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো শহরে সমকামীদের একটি নাইট ক্লাবে হামলাকারী সেই ব্যক্তি মুসলিম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। মার্কিন মুসলিম নেতারা এ ঘটনার নিন্দা জানাতে মোটেই বিলম্ব করেন নি।
গত ১১জুন রাতে ওই নাইট ক্লাবে এক বন্দুকধারীর গুলিতে ৫০ জন নিহত হওয়ার পর রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ রাজনৈতিক নেতারা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এগিয়ে এসেছেন। যেকোনো ধরনের বিদ্বেষমূলক তৎপরতা প্রতিরোধে সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, নিউইয়র্কসহ বড় বড় নগরে সমকামীরা নিজেদের মধ্যে সংহতি ও সমবেদনা জানিয়েছেন। নিউইয়র্কের ইস্ট ভিলেজ এলাকায় দিনভর ছিল সমব্যথীদের সমাবেশ। সমকামীরা বলেছেন, স্রষ্টাপ্রদত্ত জীবন তাঁরা যাপন করে যাবেন।
জানা গেছে, অরল্যান্ডের এই হতাহতের ঘটনার স্মরণে ১২ জুন সাড়ে সাতটায় দ্য কাউন্সিল অব দ্য সিটি অব নিউইয়র্ক অফিস অব ডানিয়াল ড্রমের উদ্যোগে এ মোমবাতি প্রজ্বালন এবং স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। বক্তব্য রাখেন কাউন্সিলম্যান ডানিয়াল ড্রম। তিনি বলেন, ‘সাদা বা কালো, কে কোনো ধর্মের তা বড় কথা নয়; আমরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসীদের কোনো বন্ধু নেই, তারা সমাজ-পরিবার ও দশের শত্রু। তাই তাদের বিরুদ্ধে এখনই যুদ্ধ শুরু করতে হবে।’
মুসলিমদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার অ্যাটর্নি আলী নাজমি বলেন, একটি ঘটনার জন্য পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না। সন্ত্রাসী শুধুই সন্ত্রাসীই। তাদের কোনো ধর্ম নেই। অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা মুসলমানরা সন্ত্রাসকে সম্পূণরূপে ঘৃণা করি। কারণ, ইসলাম হত্যা ও নাশকতাকে প্রশ্রয় দেয় না।’
মূলত অরল্যান্ডো ট্রাজেডির পর পুরো যুক্তরাষ্ট্রে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। হৃদয়বিদারক এ ঘটনাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের এই মনোনয়নপ্রত্যাশী অরলান্ডোর ঘটনায় মুসলমানদের নিয়ে আরেকবার বিরূপ মন্তব্যের খেলায় মেতে উঠেছেন।
অরলান্ডো হামলার ঘটনা ঘটে স্থানীয় সময় ১১ জুন রাত ২টার দিকে। এর মাত্র তিন ঘণ্টা পর ভোর ৫টায় এক টুইটারবার্তায় হামলার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের যোগসূত্র খোঁজা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখনো হামলার কারণ সম্পর্কে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমগুলো তেমন কিছুই জানায়নি। অরলান্ডোর ঘটনাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার টুইটবার্তায় ট্রাম্প বলেন, হিলারিকে প্রেসিডেন্ট করলে মার্কিনিদের আরো বেকায়দায় পড়তে হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোর সমকামী নাইটক্লাবে এক মুসলিম তরুণের গুলীতে অর্ধশত মার্কিনি নিহত হওয়ার পর নিজেকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছেন রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতেই তার মুসলিম বিদ্বেষের বিষয়টি আবারও দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে শুরু করে মার্কিন রাজনীতিকরা ওই হামলায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তবে ব্যতিক্রমী এক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলে সমালোচিত ট্রাম্প তার টুইটার একাউন্টে লিখেছেন, ‘চরমপন্থী ইসলামি সন্ত্রাসবাদ সঠিকভাবে বুঝতে পারার জন্য (নিজেকে) অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি অভিনন্দন চাই না। আমি চাই কঠোরতা ও নজরদারি। আমাদের চতুর হতে হবে।’
অপর দিকে এই মর্মান্তিক হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবারও বিতর্ক দানা বেধে উঠেছে। এই হামলার জন্য মুসলিম জঙ্গীদের দায়ি করা হলেও এতে ভিন্নমত বেশ প্রবল। তারা অপরাধীকে অপরাধী হিসাবেই দেখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছেন। ব্যক্তির অপকর্মের দায়ভার গোটা সম্প্রদায়ের উপর দিতে চাচ্ছেন না তারা। এদিকে এই হামলার পর অভিযুক্ত ওমর মতিনের পরিবারও মুখ খুলেছে। তার নিকটাত্মীয়রা বলছেন, তিনি ততটা ধর্মপরায়ণ ছিলেন না। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। তবে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ওবামা কি এখনো চরমপন্থী ইসলামি সন্ত্রাসবাদ কথাটি বলবেন না? সেটা না করলে তার অবিলম্বে লজ্জাজনকভাবে পদত্যাগ করা উচিত।’
উল্লেখ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ওই হামলাকে ‘সন্ত্রাসবাদী এবং বিদ্বেষপ্রসূত কাজ’ বলে মন্তব্য করেছেন। ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনও একে সন্ত্রাসবাদী এবং বিদ্বেষপ্রসূত কাজ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে তারা কেউই ইসলামি সন্ত্রাসবাদী শব্দটি ব্যবহার করেননি।
অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ওরল্যান্ডোতে সমকামীদের নাইটক্লাবে চালানো সন্ত্রাসী হামলার জন্য ক্ষমা চাইলেন হামলাকারীর বাবা। ১২ জুন হামলাকারী ওমর সিদ্দিক মতিনের বাবা মীর সিদ্দিক মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজকে এসব কথা বলেন।
মীর সিদ্দিক বলেন, ‘আমার ছেলের কৃতকর্মের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এই পুরো ঘটনার জন্য আমরা ক্ষমা চাইছি। তার ওই কর্মকান্ড সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। ওই ঘটনায় পুরো দেশের সঙ্গে আমরাও স্তম্ভিত।’
ছেলের চালানো সন্ত্রাসী হামলা সম্পর্কে মীর সিদ্দিক বলেন, ‘এর সঙ্গে ধর্মেও কোন সংযোগ নেই।’ হামলার কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, তার ছেলে কয়েক মাস আগে মিয়ামিতে দুজন পুরুষকে চুম্বনরত অবস্থায় দেখে ভীষণ রাগান্বিত হয়। ওমরের বাবার ধারণা, ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ওমর ওই হামলার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।
এদিকে, মার্কিন মুসলিমরাও ওই সন্ত্রাসী হামলার পর স্তম্ভিত। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের অধিকারের বিষয়ে কাজ করা সবচেয়ে বড় সংগঠন দ্য কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস মার্কিন মুসলিমদের ওই সন্ত্রাসী হামলায় আহতদের জন্য রক্তদান করার আহ্বান জানিয়েছে।
সংগঠনটির ওরল্যান্ডোর আহবায়ক রাশা মোবারক বলেন, ‘আমরা ওই ভয়াবহ হামলার নিন্দা জানাই এবং ওই হামলার নিহত এবং আহতদের পরিবারের প্রতি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি। মুসলিমরা আমাদের সহ নাগরিকদের পাশে রয়েছে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডের সহকামীদের নাইট ক্লাবে হামলায় হতাহতের ঘটনায় গোটা বিশ্ববিবেকই এখন স্তম্ভিব। কোন শান্তিপ্রিয় মানুষ এই বর্বরোচিত ঘটনা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না। এই হামলার বিরুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্ববিবেক বেশ সোচ্চার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে অপরাজনীতিও শুরু হয়েছে মার্কিন মুলুকে। ঘটনার কোন প্রকার তদন্ত ছাড়াই বিশেষ একটি সম্প্রদায়কে দায়ি করা হচ্ছে। ফলে আসন্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই ঘটনাকে পুঁজি করা হবে বলে মনে করা করছেন আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল। ফলে মার্কিন নির্বাচন পরিস্থিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। যা কখনো কাম্য নয়।
বিষয়: বিবিধ
১০৭৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
http://occupydemocrats.com/2016/06/13/fbi-parents-of-orlando-shooter-hes-not-a-terrorist-just-an-american-homophobe/
মন্তব্য করতে লগইন করুন