আহলান সাহলান মাহে রমযন
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ০৮ জুন, ২০১৬, ১২:৫৩:৪৫ দুপুর
আত্মশুদ্ধি, সংযম ও আত্মগঠনের মহিমান্বিত মাস পবিত্র মাহে রমযান। এই মহিমান্বিত মাসে সুবহে সাদেক থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থেকে সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। বস্তুত পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম সাধনা নয় বরং যাবতীয় পাপাচার থেকে নিজের নফস ও প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে দুনিয়াবি সকল লোভ-লালসা ও ইন্দ্রিয়পরায়নতার উর্দ্ধে থেকে একটি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানোয় রমজানের প্রকৃত শিক্ষা। আর যারা শুধু পানাহার পরিহার করে সকল পাপাচার থেকে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তার কথিত সিয়াম সাধনার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই বরং তারা তারা রীতিমত ভাগ্যবিড়ম্বিত। হাদিস শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে, নবী করীম (সা.) বলেছেন, কেউ যদি (রোজা রেখেও) মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু পানাহার ত্যাগ করা (অর্থাৎ উপবাস ও তৃষ্ণার্ত থাকা) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের উপর সিয়াম পালনকে ফরজ করে দিয়েছে। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে ‘সওম’ অন্যতম স্তম্ভ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামে হাকীমে এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের উপর সিয়াম সাধনাকে অত্যাবশ্যকায়ীয় করে দেয়া হলো, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছিল; যেন তোমরা আল্লাহভীতি (তাকওয়া) অর্জন করতে পার’ ( সুরা আল বাকারা-১৮৩)। হাদিসে কুদসীর বর্ণনা মতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘সিয়াম শুধু আমার জন্যই, আর আমিই এর যথার্থ প্রতিদান দিয়ে থাকি’। আর পবিত্র কালামে পাকের ভাষ্যমতে, এই মাসেই একটি মহিমান্বিত রাত রয়েছে, যার মর্যাদা হাজার রাতের চেয়েও উত্তম। সুরা আল ক্বদরে বলা হয়েছে, ‘ আমি এ (গ্রন্থ) অবতীর্ণ করেছি এক মর্যাদাপূর্ণ রাতে। তুমি কী জানো সেই (মর্যাদাপূর্ণ) রাতটি কী ? এই মর্যাদাপূর্ণ রাতটি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’। (সুরা আল ক্বদর-১-৩)
তাই পবিত্র মাহে রমযানকে কুরআনের মাসও বলা হয়। মুলত কুরআনের জন্যই এ মাসের মর্যাদা সর্বাধিক। আর ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরও সংঘঠিত হয়েছিল এই মহিমান্বিত মাসেই। আর এই ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যা মুসলামানদের বড় বড় বিজয়ের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। তাই সকল দিক বিবেচনায় পবিত্র মাহে রমযানের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আমাদেরকে পবিত্র মাহে রমজানের হক যথাযথভাবে আদায় করেই আল্লাহর সন্তষ্টির মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি অর্জন করতে হবে।
পবিত্র কালামে পাকের ভাষ্য থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, সিয়াম পালন শুধু উম্মতে মোহাম্মদীর উপর ফরজ করা হয়নি বরং পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও তা অত্যাবশ্যকীয় ছিল। তাই দেখা যায় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষেরা উপবাস ব্রত পালন করে থাকেন। ঈসা (আ.)-এর অনুসারীদের মধ্যেও রোযা রাখার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। বাইবেল বা New Testament- -এ উল্লেখ আছে : অর্থাৎ ঈসা (আ.) চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত্রি রোযা রেখে তারপর রোযা ভঙ্গ বা ইফতার করতেন। রোযাদারদের সম্পর্কে বাইবেলে: “And when he (Jesus) had fasted forty days and forty nights, he was afterward unhungered” (Mathew- 4: 2). পবিত্র রমজানের মর্যাদা ও পুরস্কার সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য হাদিস হলো-
১.প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)
২.হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতিত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)
৩.সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমযান মাসের রাতে এবাদত করে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করে কাটাবে তার পূর্বের সকল গোনাহ গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)
৪.অপর হাদিস হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, রোজা এবং কুরআন (কেয়ামতের দিন) আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমি তাকে (রমজানের) দিনে পানাহার ও প্রবৃত্তি থেকে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলায় নিদ্রা হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং আমার সুপারিশ তার ব্যাপারে কবুল করুন। অতএব, উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে (এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে)। (বায়হাকী)
পবিত্র মাহে রমজান সবর ও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতির মাস। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষুন্নিবৃত্তির কষ্ট যাতে সকল শ্রেণির মানুষ উপলব্ধি করতে পারেন, এই জন্যই সকলের জন্যই সিয়াম পালন ফরজ করা হয়েছে । বস্তুত সিয়াম সাধনের মাধ্যমে যেমন ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি ঘটে, তেমনি সিয়াম পালনকারী হয়ে ওঠেন আত্মসংযমী; হয়ে ওঠেন মানুষের প্রতি সহমর্মী ও সহানুভুতিশীল। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যাতে স্বাচ্ছন্দে সিয়াম সাধনা ও কিয়ামুল লাইল যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য সার্বিক সহযোগীতার করা মুসলমান হিসাবে আমাদের সকলেরই কর্তব্য।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পবিত্র মাহে রমজানের সম্মানে এবং রোজাদারদের সুবিধার্থে দ্রব্যমূল্য কমানো যৌক্তিক হলেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে অধিক মুনাফা লাভে সচেষ্ট রয়েছে। পবিত্র রমযান উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে দ্রব্যমূল্যের উপর সরকার ভর্তূকি প্রদান করলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে রমযান মাস আসার আগেই অসৎউদ্দেশ্যে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সিয়াম পালনে নানাবিধ প্রতিকুলতার মুখোমুখি হতে হয়। যা কখনো কাম্য হতে পারে না। দ্বীনের স্বার্থে ও দ্বীনদার মানুষের কল্যাণে এ বৃত্ত থেকে আমাদেরকে অব্যশ্যই বেড়িয়ে আসতে হবে। অন্যথায় আমাদেরকে একদিন আত্মশ্লাঘায় ভূগতে হবে।
মূলত পবিত্র রমযানের পবিত্রতা রক্ষা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নগ্নতা বন্ধ এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রেখে ও দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করে মানুষের জানমাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বও সরকারের। তাই রোজাদারদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর এ দায়িত্ব শুধুই সরকারের উপর চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়ানোও কাঙ্খিত নয় বরং যার যার অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব পবিত্র মাহে রমযানের পবিত্রতা রক্ষায় কাজ করে যেতে হবে। স্বানন্দচিত্তে স্বাগত জানাতে হবে এই মহিমান্বিত মাসকে। আসুন আমরা সমস্বরে উচ্চারণ করি, ‘ আহলান সাহলান মাহে রমযান’!!!
বিষয়: বিবিধ
৮৪১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন