মুখে আল্লাহ-রাসুল (সা.) সবে বলো
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ২০ মে, ২০১৬, ০৩:১১:৪৩ দুপুর
বাংলা পল্লীগীতির অন্যন্য প্রতিভা মরহুম শিল্পি আব্দুল আলীম। তিনি তার সুরেলা কন্ঠে গ্রাম বাংলার বাস্তবচিত্র অঙ্কন করতে বেশ সফল ও সার্থক হয়েছিলেন। তিনি শুধু পল্লীর লোকগাঁথা নিয়েই সঙ্গীত পরিবেশন করেন নি বরং অনেক আধ্যাত্মিক সঙ্গীতও তার সঙ্গীত প্রতিভায় স্থান করে নিয়েছে এবং আধ্যাত্ববাদীদের অধ্যাত্মিকতায় এক নতুন মাত্রা দান করেছে। এসব অধ্যাত্মিক গানের মধ্যে অতিজনপ্রিয় গান হলো ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি নায়িরো গো তোলরে তোল, মুখে আল্লাহ-রাসুল (সা.) সবে বলো’। মূলত এই গানটি প্রয়াত পল্লী শিল্পি আব্দুল আলীমের অতিজনপ্রিয় গান, যা আধাত্মচেতনায় মানুষের মনকে আন্দোলিত করে। তিনি নায়রীদের জন্য পাল্কী সাজানোর কথা বললেও তার পাল্কীটা আসতে দেরী হয়নি। হারানো বছর খ্যাত ১৯৭৬ সালে তিনি এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিজেই সেই আধ্যাত্মিক পাল্কীর অভিযাত্রী হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কিন্তু তার কথাগুলো তো এখনও রয়েই গেছে। আর এটাকেই তার সার্থকতা বলতে হবে।
প্রয়াত পল্লী শিল্পি আব্দুল আলীম বিভিন্ন ধরনের গানেই গন্ঠ দিয়েছেন। পল্লীগীতি আর আধ্যাত্বিক ছাড়াও তিনি ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি ও লোকগীতিসহ বিভিন্ন ধরনের গানে কন্ঠ দিয়েছেন। এমনকি তিনি বিভিন্ন আধুনিক ও রোমান্টিক গানেও কন্ঠ দান করে বেশ সফলতা পেয়েছেন শ্রোতাদের কাছে। তার এমনই একটি উল্লেখ্যযোগ্য গান হচ্ছে, ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলা নেব সখী তোমার কানের সোনা .....’।
মূলত গানটি প্রেম ও প্রণয়কে কেন্দ্রীক। যদিও গানের কথা মালায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারটা ব্যহত হয়েছে এই জন্য যে, সব সখীর ঘাটপারটা যদি একমতই হয়, তাহলে বিশেষ কারো ক্ষেত্রে আলাদা হবে কেন ? আর এখানেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সমতা ও সাম্যের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। যাহোক গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও সমাজিক ন্যায়বিচার দিয়ে তো আর প্রেম-প্রণয়ের পাঠশালা চলে না। সে জন্যই গানের রচয়িতা বোধহয় মনের মাধুরী মিশিয়ে গানের কথাগুলো সুনিপুনভাবে সাজিয়েছিলেন। আর কিংবদন্তী কন্ঠ শিল্পি আব্দুল আলীম সহশিল্পির সমন্বয়ে গানটি সুন্দর, সার্থক ও শ্রোতাদের কাছে বেশ হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন এবং শিল্পিকে তা অমরত্মও দিয়েছে। তাই গানটি গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও বেশ সার্থকই বলতে হবে।
যাহোক প্রেম, প্রণয় ও অভিসারে গণতন্ত্রিক চেতনা ও প্রচলিত আইনকানুন প্রযোজ্য না হলেও বর্তমান বিশ্ব কিন্তু গণতান্ত্রিক চেতনার বিশ্ব। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনার চর্চা হয়। যদিও কোন ক্ষেত্রেই তা ত্রুটিমুক্ত নয়। আর যেসব দেশে এখনও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হয়নি, সেসব দেশে গণতন্ত্রের পালে হাওয়া লাহতে শুরু করেছে। তাই আগামী দিনের বিশ্বটা যে একেবারে গণতান্ত্রিক বিশ্ব তা অনেকটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। তাই রাষ্ট্র, সরকার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চাটা থাকা খুবই জরুরি। আর আমাদের দেশের ক্ষেত্রে তো তার অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় নামই হচ্ছে ‘ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। তাই বিশ্ববাসী আমাদের কাছে উদার নৈতিক গণতন্ত্রই আশা করে। এতে আমাদের দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে, তা রীতিমত হতাশাব্যাঞ্জকই বলতে হবে।
আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সাম্য-ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালে মরণপন মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। অগণিত তাজা প্রাণের বিনিময়ে আমরা বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হই। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রান্ত হলেও আমরা বোধহয় এখনো সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। দেশের গণতন্ত্র তো এখনো মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি বরং আগে যে অবস্থানে ছিল তা থেকেও অনেকটাই অবনোমন ঘটেছে। সম্ভাব্য কেয়ারটেকার সরকার প্রধান বিশেষ দলের অনুগ্রহভাজন হওয়ার অভিযোগে সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকারকে উৎখাত করে জরুরি সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়েছিল। অথচ এ সরকারও দলবাজীর উর্দ্ধে ছিল বলে মনে করার কোন কারণ নেই। কিন্তু সে সরকারের অধীনেই নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হয়েছিল বর্তমান ক্ষমতাসীনরা। এ জাতির চরম দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, যারা দলবাজীর অভিযোগে ১/১১ এর প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। তারাই আবার দলীয় সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না জুড়ে দিয়েছে। তা তাদের আদর্শিক দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করে।
আমাদের দেশে যে ধরনের গণতন্ত্র চালু আছে বিশ্বের কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের গণতন্ত্র চালু নেই। অবশ্য এজন্য ক্ষমতাসীনরা বেশ গর্বইবোধ করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৩ টি আসনে কোন ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া গেল না। ফলে সরকার দলীয় প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়ে বিনা ভোটেই জাতীয় সংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল। এ ঘটনা তাবৎ গণতান্ত্রিক বিশ্বে এক নজীবিহীন ঘটনা। যেসব আসনে নামমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো সে সব আসনে ভোটারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা না গেলেও অশরীরি ভোটাররা ভোট দিয়ে বাক্স ভর্তি করলেন। কিন্তু কেউ টেরও পেলেন না। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে শুধুমাত্র রাজধানীর ২৯ টি কেন্দ্রে কোন ভোটার ভোট প্রদান না করলেও নির্বাচন কমিশনের তেলেসমাতীতে ভোটের বাক্সে ভোটের অভাব হয়নি। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন বলে কথা।
দেশে এখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। আর চলমান এ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির কতখানি প্রতিফলন ঘটছে, তা কারোরই অজানা নয়। সরকার দলীয় প্রার্থীর কর্তৃক বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্যকরণ, এজেন্টদের মারধর, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও ব্যাপক সহিংসতা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। স্বাধীনতার পর যতগুলো ইউপি নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে সর্বাধিক প্রাণঘাতি নির্বাচন একটি। নির্বাচনের নামে সরকারি দলের চর দখলের এ নির্বাচনে প্রভূত সংখ্যক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকার পক্ষ রক্তাক্ত এই নির্বাচন ইতিহাসের সবচেয়ে ভাল নির্বাচন বলে দাবি করছে। তার সাথে কোরাস গাইতে শোনা যাচ্ছে মেরুদন্ডহীন দলদাস নির্বাচন কমিশনকে। নির্বাচন কমিশনের ন্যুনতম সৌজন্যবোধ থাকলে অন্তত এমন আসার দাবি কোন ভাবেই করতে পারতো। যা এ জাতির জন্যই দুর্ভাগ্য বলতে হবে।
আসলে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ও তৎপরবর্তী কোন নির্বাচনই দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এসব নির্বাচন শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন ও নির্বাচন কমিশনের কাছেই গ্রহনযোগ্য হয়েছে। যদিও সরকার পক্ষ এটিকে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলে দাবি করেছিল। কিন্তু নতুন করে শপথ নেয়ার পর তারা সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এখন তারা এই বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে ভিত্তি ধরেই ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কথা বলছে। ২০৪১ সালের কথাও তাদের মুখে সোভা পাচ্ছে। এমনকি তারা কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার দিবাস্বপ্নে বিভোর। যদি অতীত ইতিহাস বলে ভিন্নকথা। কারণ, ক্ষমতা কারো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। মূলত ৫ জানুুয়ারি নির্বাচনের পর দ্রুত সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল তাগিদ দিলেও সরকার নানা অজুহাতে সরকার তা পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছে এবং তা এখ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থানকে জোরালো ভাবে সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলূল করিম সেলিমে বক্তব্যেও মাধ্যমেই তার অসারতা প্রমাণিত হয়। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আমরা কখনোই মেনে নেবে না’। এতে প্রমাণিত হয় সরকার এর আগে যা বলেছিল তা মোটেই বস্তুনিষ্ঠ ছিল না। সম্প্রতি বিষয়টি আরও পরিস্কার করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। বাংলাদেশে নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র তার আগের অবস্থান বহাল রেখেছে উল্লেখ করে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায় বাংলাদেশের মানুষ একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করুক। নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র তার আগের অবস্থানে অটুট রয়েছে। এতে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
গত ১৮ মে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে এসব কথা বলেন মুখপাত্র জন কিরবি। বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখ করে কিরবি বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার মতো আমরা বাংলাদেশেও মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা ও সংবাদ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেখতে চাই।
গাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন যে, বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অত্যন্ত সু-স্পষ্ট। গত ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল। আর সেটি ছিলো একতরফা নির্বাচন। নির্বাচনের পরই বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য তাগাদা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে এ বিষয়টিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী? কারণ, সরকার ইতোমধ্যে দুই বছর পার করেছে। দেশে এখন সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের কোনো স্বাধীনতা নেই, বিচাবর্হিভূত হত্যাকান্ড চলছে। যুক্তরাষ্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার-বিষয়ক প্রতিবেদনেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এ ইস্যুতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র কী অবস্থান নিয়েছে? সম্প্রতি দুজন সহকারি সেক্রেটারি বাংলাদেশ সফর করেও এসেছেন।
জবাবে জন কিরবি বলেন, 'আমরা এখনো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চাই। আমরা এখনো দেখতে চাই বাংলাদেশের মানুষেরা একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাতে অংশ নিতে পারে। আমরা আরো দেখতে চাই বাংলাদেশেও মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা এবং গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আর এসব ব্যাপারে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সত্যিকার অর্থে আমাদের আগের অবস্থান এখনো রয়ে গেছে, এটার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।' যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারত এখনও ক্ষমতাসীনদের উপর তাদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। যা ভারতের মত বৃহত্তর প্রতিবেশীর জন্য মোটেই বিজ্ঞচিত বা দুরদর্শী সিদ্ধান্ত নয়। একটি রাষ্ট্রের জনমতের বিরুদ্ধে কোন সরকারকে সমর্থন সংশ্লিষ্ট প্রতিবেশীর জন্য আত্মঘাতিও হতে পারে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন।
মূলত একদেশদর্শী পররাষ্ট্রনীতি, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস এবং বিরোধী দলের উপর নানা অজুহাতে দলনপীড়নের কারণে বাংলাদেশ এখন কুটনৈতিকভাবে অনেকটাই একঘরে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের তীর্ষক সমালোচনা করলে সরকার তা কোন ভাবেই আমলে নিচ্ছে না। সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দন্ডিত দেশের ইসলামভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতার প্রাণদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। এই বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বিচারের মান নিয়ে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন তুলে ধরে কিছু সুপারিশ মালা পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার রহস্যজনক কারণেই এসব সুপারিশ আমলে নেয়নি। ফলে এই ত্রুটিপূর্ণ আইনেই বিচার করে ২ টি রাজনৈতিক দলের ৫ জন শীর্ষনেতাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
প্রাণদন্ড কার্যকরের ঘটনায় জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উদ্বেগও জানানো হয়েছে। এমনকি পাকি¯াÍনের সংসদে নিন্দা প্রস্তাব পাশ এবং এই দন্ড কার্যকরের ফলে তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের মত চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিষয়ে পাকিস্তানের দূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদও জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। পাকিস্তানও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এমনকি জামায়াতের আমীর নিজামীর বিচার ও দন্ড কার্যকর ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির লঙ্ঘন বলে দাবি করে তা জাতিসংঘে তোলার হুমকীও দিয়েছে পাকিস্তান। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও পাল্টা হুমকী দিতেও মোটেই কসুর করেন নি। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান বিষয়টি জাতিসংঘে তুললে তারা ১৯৭১ সালের ক্ষতিপুরুণ কাছে দাবি করবেন। মূলত আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে একথা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার জন্য আমাদেরকে পেছনেই তাকাকে হবে।
মূলত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার বিচারের জন্য ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রস্তুত করেছিল। আর অভিযুক্তরা সবাই ছিলেন পাকিস্তানের উর্দ্ধতন সেনা কর্মকর্তা। এই তালিকায় কোন বেসামরিক ব্যক্তি বা বাংলাদেশীর নাম অন্তর্ভূক্ত ছিল না। এদের বিচারের জন্য বাংলাদেশের সংসদে ১৯৭৩ সালের ১৯ জুলাই একটি আইন পাশ করা হয়। এই আইনটির নাম দেয়া হয় ( International Crime Tribunal) Act-1973.,. এই আইনটি পাশ করার আগে ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই সংবিধান সংশোধন করা হয়। কারণ, এই আইনের অনেক বিধান সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সংঙ্গে সাংঘর্ষিক। পরবর্তী এক বছরে বিভিন্ন সময় পাকিস্তান ও ভারত, বাংলাদেশ ও ভারত এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অব্যাহত আলোচনা ফল হিসাবে উপমহাদেশের শান্তি ও সমঝোতার স্বার্থে এবং পাকিস্তান সরকারের ভুল স্বীকার এবং বাংলাদেশের জনগণের কাছে Forgive and forget -আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চুড়ান্ত আলোচনা শেষে একটি চুক্তির মাধ্যমে চিহ্নিত ১৯৫জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরকার সরণ সিং এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদ। এই চুক্তির ১৩, ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তানুযায়ি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তালিকাভূক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে ক্ষমা করে পাকিস্তানে ফেরৎ পাঠানো হয়।
আইনমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দন্ডকার্যকর ১৯৭৮ সালের পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বরং সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এই বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ্যাটর্নী জেনারেলের আত্মস্বীকৃতিও রয়েছে। তিনি সম্প্রতি বিচার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় এই বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে’। মূলত এ বিচারে অভিযুক্তরা সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং সাক্ষ্য আইনের সুবিধা তারা পাননি।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা। কোন নাগরিকের অধিকার হরণ কাঙ্খিত নয়। অপরাধীদের বিচার ও অপরাধের প্রতিবিধানও করতে হবে সর্বজনীন আইনেই। শুধুমাত্র প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে বিশেষ আইন তৈরি করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নাজেহাল করা হবে, তা কখনো কাম্য হতে পারে না। বিনোদনের জন্য প্রয়াত শিল্পি আব্দুল আলীমের গান ‘তোমার বেলা নেব সখী’র আবেদন থাকলে রাষ্ট্রীয় তার প্রয়োগ হবে আত্মঘাতি। কিন্তু রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই এর বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জামায়াত আমীরের প্রাণদন্ড কার্যকরের পর পাকিস্তান ও তুরস্ক যুগপৎভাবে প্রতিবাদ করলে সরকারকে শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘পাকিস্তান ও তুরস্ককে এক করা ঠিক হবে না’। এখানেও সরকারের অবস্থানটা রীতিমত আবেগ নির্ভর। কিন্তু প্রেম, প্রণয় ও উপাখ্যানে আবেগের স্থান থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় ও পররাষ্ট্রনীতে অনুরাগ-বিরাগের আশ্রয় নেয়া বা আবেগতাড়িত হওয়াটা বেশ আত্মঘাতি। মূলত গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাবেই নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। আর এর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব পড়বে জাতীয় জীবনে।
ক্ষমতার দম্ভে ও পেশীশক্তি নির্ভর হয়ে কাউকে কাউকে আধ্যাত্মিক পালকির অভিযাত্রী বানানো হচ্ছে। মানুষকে আল্লাহ-রাসুলের নামে আর্তনাদ করতে শোনা যাচ্ছে। ক্ষমতার মোহটা আমাদেরকে একেবারে হিতাহিত জ্ঞানশুণ্য করে ফেলেছে। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে, এই পালকি তো সবার জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিংবদন্তী কন্ঠ আব্দুল আলীম অন্যের পালকি সাজাতে সাজাতে নিজের পাল্কিটা এতো সন্নিকটে তা মোটেই ঠাহর করতে পারেন নি। কালের বিতর্বনে একদিন তা সবার দুয়ারে হাজির হবে। আমরা সলকেই তো এই পালকির অভিযাত্রী। দিব্য জ্ঞানীদের জন্য তা অবশ্যই শিক্ষনীয়।
বিষয়: বিবিধ
১১৮১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন