ভক্ত বলে কথা

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ১৯ মে, ২০১৬, ০৮:৩৪:৩৯ রাত



নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত আল্লাহ ও মুসলমানদের নিয়ে কটুক্তি করার কারণে গণপিটুনীর শিকার হয়েছেন। তাকে গণরোষ থেকে বাঁচানোর জন্যই স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান অভিযুক্ত শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করান বলে দাবি করা হয়েছে। কারো কৃত অপরাধের জন্য যেমন গণপিটুনী কাম্য নয়, ঠিক তেমনিভাবে একজন শিক্ষককে কান ধরানোও কাঙ্খিত নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একজন প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু শিক্ষকদের একথাও মনে রাখা উচিত; তারা হচ্ছেন জাতির জাগ্রত বিবেক। তাই কোন অবস্থাতেই তাদের পক্ষে আবেগপ্রবণ বা অতিউৎসাহী হওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষক বাবু শ্যামল কান্তি ভক্ত নিজের আবেগকে সংবরণ করতে না পেরে যে ঘটনার জন্ম দিলেন, তা গোটা শিক্ষক সমাজকেই কলঙ্কিত করেছে। মূলত ইসলাম নিয়ে বাবু ভক্তের কটুক্তি তার ব্যক্তিত্ব ও পদমর্যাদার সাথে সঙ্গতিহীন। তাকে যেকোন বিষয়ে মন্তব্য করার আগে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল।

এ ঘটনার পরই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে চাকুরী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, এ ঘটনার পর সারাদেশেই ‘কর্ণধরন’ উৎসব শুরু হয়েছে । শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠ-বস করার প্রতিবাদ স্বরূপ এমন ‘কর্ণধরন’ কর্মসূচী এখনও অব্যাহত আছে। কিন্তু গণপিটুনীর জন্য কী ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি। আসলে এর মাধ্যমে শিক্ষক সমাজের প্রতি গণমানুষের অকৃত্রিম শ্রদ্ধায় প্রকাশ পেয়েছে। যা বেশ গর্ব করার মত। কিন্তু যে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এমন শিক্ষক লাঞ্চনার ঘটনার ঘটলো তা নিয়ে কাউকে তেমন উচ্চবাচ্য করতে দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক যে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বোধ-বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতি নিয়ে কটুক্তি করার ধৃষ্ঠতা দেখালেন, সে বিষয়টি একেবারে ধামাচাপায় পড়ে যাচ্ছে। আত্মসচেতন মানুষের দুঃখবোধটা সেখানেই।

বিষয়টি এমন যে, এক শিক্ষার্থীকে গরুর রচনা লিখতে বালায় সে গরু নিয়ে লিখতে লিখতে এক পর্যায়ে গরুকে নদীতে নামিয়েছিল। এরপর রচনায় আর গরুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বরং রচনার পরবর্তী অংশ ছিল শুধুই নদী সম্পর্কিত। সম্প্রতি শিক্ষক লাঞ্চনার যে ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও বোধ ‘ধান ভানতে শীবের গীত’ পরিবেশন শুরু হয়েছে। আমরা ঘটনার মূলে না গিয়ে আগা নিয়ে টানা হেচরা শুরু করেছি। ফলে আগামী দিনেও এ ধরনের ঘটনা কোন ভাবেই ঠেকানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না। মূলত শিক্ষক লাঞ্চনার সাথে সংশ্লিষ্টদের যেমন বিচারের আওতায় আনা উচিত, ঠিক তেমনিভাবে ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করার কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককেও আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু যা শুরু হয়েছে তা কোন শুভ লক্ষণ বলে মনে করার কোন কারণ নেই।

সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্বপদে বহালসহ স্কুল কমিটিকে বাতিল ঘোষণা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। ১৯ মে সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সম্মেলন এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে আয়োজিত কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা জানান। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষকদের অপমান বরদাস্ত করা হবে না। এটা জাতির জন্য অপমানজনক। শিক্ষামন্ত্রী সম্মেলনে শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের ডিসির নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন পড়ে শোনান। এর আগে গত ১৩ মে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটুক্তি এবং শিক্ষার্থীকে মারধর করার অভিযোগে রারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যান্দির পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে গণপিটুনি দেয়ার পর কান ধরে উঠবস করানো হয়। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্তের কথা বলা হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে এ শিক্ষককে হেনস্তা করা হয়েছে।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদের মুখে তদন্ত কমিটির করে শিক্ষা অধিদপ্তর। ওই কমিটি পিয়ার সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনও করেছে। এদিকে পিটুনির শিকার শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ৪ অভিযোগে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্তের নোটিশ দিয়েছে।

আমাদের দেশে শিক্ষক লাঞ্চনার ঘটনা এই প্রথম নয়। দু-এক দিন আগেই আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর পুলিশের জলকামান নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। একজন কলেজ শিক্ষককে দিগম্বর করার ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মাহবুব উল্লাহর উপরও এর আগে হামলা ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বুয়েটের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমের উপরও হামলা করেছিল সন্ত্রাসীরা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা কতখানি সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছি, তা নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলেই বোঝা যায়। লাঞ্চিত শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীকে এমনভাবে কিলঘুষি মারলেন, যাতে তার চিকিৎসা করার প্রয়োজন হলো। শিক্ষার্থীর প্রতি একজন শিক্ষকের এমন আচরণ কতখানি যৌক্তিক ?

মূলত শিক্ষকরা পিতৃতুল্য। তিনি কী নিজের সন্তানকে এভাবে কিলঘুষি মারতে পারতেন? আমি নিজেও দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছি, আর প্রতিষ্ঠান প্রধানও ছিলাম। কখনো তো ছাত্রদের গায়ে হাত তুলে শাসন করতে হয়নি। তাই বলে আমার ছাত্ররা যে অবাধ্য ছিল এমনও না। শুধু ছাত্র কেন আমার অধিনস্ত শিক্ষক/কর্মচারিরাও আমার চোখের দিকে কখনো তাকাতেও সাহস করেনি। মূলত প্রতিষ্ঠান প্রধানদের হতে হয় প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্মন্ন। কিন্তু বাবু শ্যামল কান্তি ভক্ত যা করলেন তা তার ব্যক্তিত্ব ও পদমর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

শিক্ষক লাঞ্চনার ঘটনা নিয়ে মহল বিশেষকে বেশ তৎপর মনে হচ্ছে। এ জন্য সাংসদ সেলিম ওসমানকে অভিযুক্ত করে তাকে ক্ষমা চাওয়ারও আহবান জানানো হয়েছে। যদিও তিনি তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে কিছুই বলা হচ্ছে না। শিক্ষামন্ত্রী তার বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ম্যানেজিং কমিটি ভেঙ্গে দিয়েছেন। মূলত ম্যানেজিং কমিটি ভাঙ্গার কিছু নিয়ম-কানুন আছে। কারো এক কথায় বা কমিটিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার বিধান আমি কোথাও দেখিনি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে সুবিধা দেওয়ার জন্যই বোধহয় এমন করা হয়েছে। কারণ, আল্লাহ-রাসুল (সা.) এর সম্মানের চেয়ে শিক্ষকের সম্মানকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে মুসলিম প্রধান দেশে। ভক্ত বলে তো কথা!!!

বিষয়: বিবিধ

৯৪৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

369608
১৯ মে ২০১৬ রাত ০৮:৪৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : শিক্ষকদের যখন পিটান হয়েছিল তখন কিন্তু ভক্তরা....

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File