রিজার্ভের টাকা কী আদৌ উদ্ধার হবে ?

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ০৯ এপ্রিল, ২০১৬, ০১:২৩:৫৮ দুপুর



একথা কারো অজানা নয় যে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরি হয়েছে। মূলত এই প্রভূত পরিমাণ অর্থ চুরি করেছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। যার সাথে অনেক রাখব-বোয়াল জড়িত বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, এর মধ্যে ১৯.৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার শ্রীলংকা ফেরত দিলেও এখন পর্যন্ত তা বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝে পায়নি। ফিলিপাইন থেকে অর্থের একটি চালান আশার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সে কথারও সত্যতা পাওয়া যায়নি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৮১ মিলিয়ন ডলার রয়েছে ফিলিপাইনে।

এ ঘটনার সন্দেহভাজন ব্যবসায়ী কিম অং প্রথমে ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার, পরে ৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার ফেরত দেয় ফিলিপাইনের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট এএমএলসির কাছে। কিন্তু ফিলিপাইনের পত্রিকা বলছে, দ্বিতীয় দফায় আরো ৮৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা চুরি করে পাঠানো হয় ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ফেডারেল রিজার্ভের সন্দেহ হলে সেই অর্থের ছাড় আটকে দেয় ফিলিপাইন। পরে সে অর্থ ফেরত নেয় ফেডারেল রিজার্ভ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই বলেনি। বিষয়টি রহস্যজন কারণেই চেপে যাওয়া হচ্ছে মনে করছেন তথ্যভিজ্ঞমহল।

এদিকে সুইফট কর্তৃপক্ষ বারবার দাবি করছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে সুইফটের নেটওয়ার্ক হ্যাক হয়নি। এজন্য ব্যাংকগুলোকেই দায়ি করছে সুইফট কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারের রিজার্ভ ব্যাংকও বলে আসছে অর্থ চুরির ক্ষেত্রে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমসে অনুপ্রবেশের ঘটনার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে রিজার্ভ চুরির বিষয়টি এখনও রীতিমত রহস্যাবৃত। আর এই রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে বলেও মনে করা যাচ্ছে না। ফলে অর্থ উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে তো অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।

ঘটনা ঘটার পর সরকারের দায়িত্বশীলরা দেশের মানুষকে বারবার আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে চুরিকৃত টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবে। মূলত যারা দেশের হতদরিত্র মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ রক্ষণাক্ষনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তারা সে দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদত্যাগ করে তার দায়-দায়িত্ব শেষ করেছেন। হয়তো তিনি মনে করছেন, এতে তার পাপমোচন হয়েছে, কিন্তু হতদরিদ্র মানুষের অভিসাপ মোচন হয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এই পর্বত প্রমাণ ব্যর্থতার পর তো বাগারম্বর কম হয়নি। কিন্তু সবই নিষ্ফল হতে চলেছে।

রিজার্ভ লুটের সব অর্থ ফিরে পাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এমনটিই আশ্বাস দেয়া হয়েছিল ব্যাংকের পক্ষে। অর্থ ফিরিয়ে আনতে সব রকম পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পুরো অর্থই ফিরে পাব আমরা। এতদিন এরকম বক্তব্যই ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে। দায়িত্ব নিয়ে নতুন গভর্নর ফজলে কবির গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, অর্থ উদ্ধারই তার প্রথম কাজ। সেই বক্তব্যের ভোল পাল্টালো বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন বলছে, সব অর্থ ফিরে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। মূলত চুরি যাওযা কোন টাকায় আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে আপাত মনে করার কোন সুযোগ নেই বলেই দেশের মানুষ মনে করে। কারণ, বেড়ায় ক্ষেত খেয়েছে বলেই উদ্ধারের বিষয়টি ক্রমেই তিরোহিত হচেছ।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হওয়ার পর থেকেই চুপ করে থাকেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রভাবশালী কর্মকর্তা। ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেকোন বিষয়ে তার সরব উপস্থিতি ছিল। ঘটনা প্রকাশ হওয়ার দীর্ঘ একমাস পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রথম কথা বললেন তিনি। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, রিজার্ভ চুরি ও টাকা উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে এ পর্যন্ত যা করা হয়েছে, তার মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতির বিষয়টি খুবই সুষ্পষ্ট। এসবকে রীতিমত আইওয়াস বলতেই পুলকবোধ করছেন অভিজ্ঞমহল। টাকা উদ্ধারের সম্ভবনা তো আপাতত দেখাই যাচ্ছে না, হয়তো এ বিষয়টিও এক সময়ে শুণ্যে মিলিয়ে যাবে। এমনটা মনে করা অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না।

আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। দেশের শেয়ার মার্কেট থেকে লক্ষ-কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তা আমলেই নেননি। তিনি তো বিনিয়োগকারীদের ‘ফটকাবাজ’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছিলেন। ৪ হাজার কোটি টাকার হলমার্ক কেলেঙ্কারী হলো। বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী বললেন, তেমন কিছুই না। এবার যখন ১০ কোটি ৮ লাখ ডলালের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটলো তখনও তাকে বেশ নির্লিপ্তই মনে হলো। মনে হয় গায়ে মাখার মত কোন ঘটনায় ঘটেনি। ভাবটা এরকম যে, কোন কিছুতেই কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই। দেশটা বোধ হয় বেওয়ারিশ লাশে পরিণত হয়েছে।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা রীতিমত আৎকে ওঠার মত। জানা গেছে, বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থিক চুরি থেকে রক্ষা পেয়েছে। শুধুমাত্র ১০ কোটি ডলার নয়, আরো ১০০ কোটি ডলার বা বাংলাদেশী টাকায় ৮ হাজার কোটি টাকা চুরি হতে যাচ্ছিল। ভাগ্যটা কিছুটা হলেও সুপ্রসন্নই বলতে হবে যে, এই ১০০ কোটি ডলার রিলিজ করার অনুরোধটি যখন নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে যায়, তখন তারা এটি তাৎক্ষণিক ভাবে রিলিজ না করে সেটি আটকে দেয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কনফার্মেশন চায়। এর মধ্যে ১০ কোটি ডলার বা ৮০০ কোটি টাকা সাইবার চুরির খবর ফাঁস হয়ে যায়। ফলে সাইবার চোররা ঐ ৮ হাজার কোটি টাকা না নিয়েই চম্পট দেয়। আর বাংলাদেশও ৮ হাজার কোটি টাকা চুরি হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়।

মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকে হাত দেওয়ার ঘটনাতো এটিই প্রথম নয়। কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট এন্টিভাইরাস প্রতিষ্ঠান ‘ক্যাসপারস্কি’ ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তাদের যে বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে সেই রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশে এর আগে ১০ কোটি ডলার বা ৮০০ কোটি টাকা সাইবার চোররা লুট করেছে। বাংলাদেশে যে কোটি কোটি মোবাইল ব্যবহৃত হয় তার ২২ শতাংশই ‘ম্যালওয়্যার’ ভাইরাসে আক্রান্ত। ক্যাসপারস্কির রিপোর্ট মোতাবেক আক্রমণের এই সংখ্যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ। আক্রমণের এই তালিকায় রয়েছে, গণ চীন, নাইজেরিয়া, তানজানিয়া এবং ইরান।

উল্লেখ্য যে, ২০০৯ সালের পর এই পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠিত হয়েছে শেয়ার বাজার থেকে। শেয়ার বাজারের সর্বস্ব খুইয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ ব্যক্তি। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রæপ, যুবক, ডেসটিনি, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। স¤প্রতি জনতা ব্যাংকের এফডিআর চুরির ঘটনাও ঘটেছে। এখন পর্যন্ত এতো বড় লুণ্ঠনের দায়ে এক জনেরও শাস্তি হয়নি। এভাবে চুরি-ডাকাতি প্রশ্রয় পেয়ে লুটেরাগণ বেপরোয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে হাত বাড়াতেও কুন্ঠাবোধ করেনি এসব অপরাধী চক্র।

এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে দোষারোপ, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের ঘটনা ঘটলেও এর নেপথ্যে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। স¤প্রতি প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা গোপনে সমঝোতা করতে চেয়েছিল ফিলিপাইন। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঘটনাটির সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করা হলে তদন্ত সাপেক্ষে খোয়া যাওয়া অর্থের পুরোটাই ফেরত পাবে বাংলাদেশ। কেননা এ ধরনের কেলেঙ্কারির কারণে দোষী দেশ আন্তর্জাতিকভাবে কালো তালিকায় পড়ার বিধান রয়েছে।

এ বিষয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে একটি লিখিত প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলেন ১৭ ফেব্রুয়ারি। তবে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার আগে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকেই ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আমান্দো তাতাঙ্কো ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম ও রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) বরাত দিয়ে একাধিকবার তা গোপন রাখার অনুরোধ করেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সে সময়ের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে তাতাঙ্কো এবং ফেডারেল রিজার্ভের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টেলিকনফারেন্সও করেন।

পরবর্তীতে তারা এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অ্যান্টি মানি লন্ডারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর কাউন্সিল (এএমএলসি) ও আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্থার সঙ্গেও টেলিকনফারেন্স করেন। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম ও ফিলিপাইন এ ধরনের ঘটনাকে নন-পাবলিক ও হাই-কনফিডেন্সিয়াল বলে আখ্যায়িত করে তা সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষার অনুরোধ করে। ফিলিপাইনের গভর্নরের চিঠিতে বলা হয়, যেহেতু ৬ ফেব্রুয়ারির পরই ঘটনাটি সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জেনে যায়।

ফলে পুরো ঘটনার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং সে অনুযায়ী সমাধানের পথ খুঁজতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানানো হয়। এক্ষেত্রে ১৭ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে তাতাঙ্কোর লেখা ওই চিঠিতে একটি উদাহরণও দেওয়া হয়, সর্বশেষ কয়েক বছর আগে পেন্টাগনে বড় অঙ্কের অর্থ চুরির ঘটনা ঘটে। যা ওই দেশের অর্থমন্ত্রীকে জানানো হয় ঘটনার তিন মাস পর এবং তদন্ত ও সমস্যা সমাধানের কাছাকাছি যাওয়ার আরও তিন মাস পর তা সে দেশের প্রেসিডেন্ট ও সংসদকে অবহিত করা হয়।

এ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা না করলে আর্থিক খাতে মানুষের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। যা সে দেশের ব্যবসা-বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমন কি ভুক্তভোগী দেশ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যায়। আসলে ফিলিপাইন ও ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের এ ধরনের প্রস্তাব ও যুক্তি তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন সদ্য পদত্যাগী গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর একাধিক উপদেষ্টাকেও জানানো হয়। তবে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা হয় ৬ ফেব্রুয়ারির পরই।

যার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে এবং গোপনীয়তা রক্ষায় সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককেও নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) এবং অ্যাগমন্ট গ্রুপের আইন ও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের খোয়া যাওয়া অর্থের পুরোটাই আরসিবিসির কাছ থেকে জরিমানা আদায় করে বাংলাদেশকে ফেরতও দেওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছিল ফিলিপাইন ও ফেডারেল রিজার্ভ।

বাংলাদেশে উপর্যুপরি অর্থচুরি ও অর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনার বিষয়ে আৎকে ওঠার মত খবর প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। ব্যাংকিং খাতে বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার দিক সম্পর্কে উন্নয়ন অন্বেষণ নামে একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা জানায়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ (নন পারফরমিং লোন) ৮ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে এসে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে উপনীত হয়েছে। খেলাপি ঋণের এ হার ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর এসে বেড়ে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ উপনিত হয়েছে। এ ছাড়া খেলাপী ঋণ ও অবলোপণকৃত ঋণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ঋণ আদায়ে এ ব্যর্থতার জন্য ব্যাংকগুলোর অদক্ষতাকেই দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

উন্নয়ন অন্বেষণের প্রতিবেদন মতে, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় উচ্চ সুদ হার, অধিক তারল্য, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ হ্রাস-দেশের মোট বিনিয়োগের ওপর বর্তমানে চাপ তৈরি করেছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির যে স্থবিরতা বিরাজ করছে তা বেসরকারি বিনিয়োগকে প্রভাবিত করবে। যা জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে সংকুচিত করতে পারে। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ভেস্তে যেতে পারে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির মতে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে প্রতিবছরই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। অথচ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। যা বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতির অকার্যকারীতাকেই প্রমাণ করে। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ ধরা হয়েছিল। অথচ অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ।

অনুরূপভাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ধরা হলেও অর্থবছর শেষে মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। ঋণের বিস্তার ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির মধ্যে যোগসূত্র নির্দেশ করে ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’ বলেছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির শ্লথ গতি বিনিয়োগ হ্রাস করবে।

এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে নেওয়া নীতিসমূহ উচ্চ সুদের হার ও সুদের হারের ব্যবধান কমাতে এবং আর্থিক অন্তর্ভূক্তি ত্বরান্বিত করতে পারেনি। অন্যদিকে সরকারি ও ব্যক্তিখাতে ব্যাংকের ওপর অধিকৃত পরিচালন ব্যবস্থা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতা ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং ঋণ খেলাপির মতো সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ খাতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে। যা গত বছরের এই সময়ে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ ছিল। একইভাবে এ সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশে উপনীত হয়েছে। খাতটিতে গত বছরের একই সময় ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুদ্রানীতিতে ১৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল। যা আগের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ (১৫.৫ শতাংশ) কম। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের জুন থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে মুদ্রানীতিতে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

সম্পদের আয় হারের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্পদের আয় হার বিগত কয়েক বছরে ক্রমান্বয়ে কমছে। ২০১৫ সালে সম্পদের আয় হার হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। যা ২০১১, ২০১২ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে ১.৩ শতাংশ, ০.৬ শতাংশ ও .৮৮ শতাংশ হয়েছিল। এ ছাড়া ইক্যুইটির আয় হার- যা দ্বারা অংশীদারদের মুনাফা পরিমাপ করা হয়। ২০১৫ সালে তা ৬ দশমিক ৬১ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। যা ২০১৪ সালে ৮ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। সা¤প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুনাফাও হ্রাস পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা করেছে উন্নয়ন অন্বেষা।

উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে সরকার দেশের অর্থব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু দেশের হতদরিদ্র জনগণ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ফেরৎ পেতে আগ্রহী। সরকারের পক্ষে এ বিষয়ে বারবার আস্বস্ত করা হলেও এখন তারা ভিন্ন কথা বলছেন। তাই একথা বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ আছে যে, চুরি যাওয়া রিজার্ভের টাকা উদ্ধার করা করার বিষয়টি মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। তাই জনমনে হাজারো প্রশ্ন, ‘ চুরি যাওয়া টাকাগুলো কী আদৌ উদ্ধার হবে ?

বিষয়: বিবিধ

১২১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File