আবারো দরজায় কড়া নাড়ছে রমাযান: কেমন চলছে আপনার প্রস্তুতি?
লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ ২১ এপ্রিল, ২০১৬, ০৮:১২:০৮ রাত
প্রত্যেকটি মুসলমানকে রমজান মাসের তাৎপর্য
সম্পর্কে সচেতন হওয়া চাই। তারা যেন শাবান মাস থেকেই
রমজানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এমনকি
তাদের কেউ কেউ যেন শাবান মাসের আগে রজব মাস থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
রমজানের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে নীচের পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার :
১. একনিষ্ঠভাবে তওবা করা :
তওবা করা সবসময় ওয়াজিব। তবে ব্যক্তি
যেহেতু এক মহান মাসের দিকে এগিয়ে
যাচ্ছে তাই অনতিবিলম্বে নিজের মাঝে ও
স্বীয় রবের মাঝে যে গুনাহগুলো
রয়েছে এবং নিজের মাঝে ও অন্য
মানুষের মাঝে অধিকার ক্ষুণ্ণের যে
বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো থেকে
দ্রুত তওবা করে নেয়া উচিত। যাতে করে
সে পূত-পবিত্র মন ও প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে এ
মুবারক মাসে প্রবেশ করতে পারে এবং
আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে মশগুল হতে
পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “আর
হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহ্র কাছে
তওবা কর; যাতে করে সফলকাম হতে
পার।” [২৪ আন-নূর : ৩১]
আল-আগার্র ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু
হতে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
( ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟﻨَّﺎﺱُ ﺗُﻮﺑُﻮﺍ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓَﺈِﻧِّﻲ ﺃَﺗُﻮﺏُ ﻓِﻲ
ﺍﻟْﻴَﻮْﻡِ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻣِﺎﺋَﺔَ ﻣَﺮَّﺓٍ ) ﺭﻭﺍﻩ ﻣﺴﻠﻢ ( 2702 )
“হে লোকেরা, আপনারা আল্লাহ্র কাছে
তওবা করুন। আমি প্রতিদিন তাঁর কাছে ১০০ বার
তওবা করি।” [হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম
মুসলিম (২৭০২)]
২. দোআ করা:
কিছু কিছু সলফে সালেহীন হতে বর্ণিত
আছে যে, তারা ৬ মাস আল্লাহর কাছে
দোয়া করতেন যেন আল্লাহ তাদেরকে
রমজান পর্যন্ত পৌঁছান। রমজানের পর পাঁচ মাস
দোয়া করতেন যেন আল্লাহ তাঁদের
আমলগুলো কবুল করে নেন।
তাই একজন মুসলিম তার রবের কাছে
বিনয়াবনতভাবে দোয়া করবে যেন আল্লাহ
তাআলা তাকে শারীরিকভাবে সুস্থ রেখে,
উত্তম দ্বীনদারির সাথে রমজান পর্যন্ত
হায়াত দেন। সে আরো দোয়া করবে
আল্লাহ যেন তাকে নেক আমলের
ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। আরো দোয়া
করবে আল্লাহ যেন তার আমলগুলো
কবুল করে নেন।
৩. এই মহান মাসের আসন্ন আগমনে খুশি
হওয়া :
রমজান মাস পাওয়াটা একজন মুসলিমের প্রতি
আল্লাহ তাআলার বিশেষ নেয়ামত। যেহেতু
রমজান কল্যাণের মৌসুম। যে সময়
জান্নাতের দরজাগুলো উন্মুক্ত রাখা হয়।
জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হয়।
রমজান হচ্ছে- কুরআনের মাস, সত্যমিথ্যার
মধ্যে পার্থক্য রচনাকারী জিহাদি
অভিযানগুলোর মাস। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( ﻗُﻞْ ﺑِﻔَﻀْﻞِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻭَﺑِﺮَﺣْﻤَﺘِﻪِ ﻓَﺒِﺬَﻟِﻚَ ﻓَﻠْﻴَﻔْﺮَﺣُﻮﺍ ﻫُﻮَ
ﺧَﻴْﺮٌ ﻣِﻤَّﺎ ﻳَﺠْﻤَﻌُﻮﻥَ ) [10 ﻳﻮﻧﺲ : 58 ]
“বলুন, এটি আল্লাহ্র অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়।
সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক । এটি তারা যা
সঞ্চয় করে রাখে তা থেকে উত্তম।” [১০
ইঊনুস : ৫৮]
৪. কোন ওয়াজিব রোজা নিজ দায়িত্বে
থেকে থাকলে তা হতে মুক্ত হওয়া :
আবু সালামাহ্ হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি
বলেন আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে
বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন:
ﻛَﺎﻥَ ﻳَﻜُﻮﻥُ ﻋَﻠَﻲَّ ﺍﻟﺼَّﻮْﻡُ ﻣِﻦْ ﺭَﻣَﻀَﺎﻥَ ﻓَﻤَﺎ ﺃَﺳْﺘَﻄِﻴﻊُ
ﺃَﻥْ ﺃَﻗْﻀِﻴَﻪُ ﺇِﻻ ﻓِﻲ ﺷَﻌْﺒَﺎﻥَ . ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ ( 1849 )
ﻭﻣﺴﻠﻢ ( 1146 )
“আমার উপর বিগত রমজানের রোজা বাকি
থাকলে শা‘বান মাসে ছাড়া আমি তা আদায়
করতে পারতাম না।” [হাদিসটি বর্ণনা করেছেন
ইমাম বুখারী (১৮৪৯) ও ইমাম মুসলিম (১১৪৬)]
হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
“আয়েশা (রাঃ) এর শাবান মাসে কাযা রোজা
আদায় পালনে সচেষ্ট হওয়া থেকে বিধান
গ্রহণ করা যায় যে, রমজানের কাযা রোজা
পরবর্তী রমজান আসার আগেই আদায়
করে নিতে হবে।” [ফাতহুল বারী (৪/১৯১)]
৫. রোজার মাসয়ালা-মাসায়েল জেনে
নেয়া এবং রমজানের ফজিলত অবগত হওয়া।
৬. যে কাজগুলো রমজান মাসে একজন
মুসলমানের ইবাদত বন্দেগীতে
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে সেগুলো
দ্রুত সমাপ্ত করার চেষ্টা করা।
৭. স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের সকল
সদস্যকে নিয়ে বসে রমজানের মাসয়ালা-
মাসায়েল আলোচনা করা এবং
ছোটদেরকেও রোজা পালনে উদ্বুদ্ধ
করা।
৮. যে বইগুলো ঘরে পড়া যায় এমন কিছু
বই সংগ্রহ করা অথবা মসজিদের ইমামকে হাদিয়া
দেয়া যেন তিনি মানুষকে পড়ে শুনাতে
পারেন।
৯. রমজানের রোজার প্রস্তুতিস্বরূপ শাবান
মাসে কিছু রোজা রাখা:
ﻋَﻦْ ﻋَﺎﺋِﺸَﺔَ ﺭَﺿِﻲَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻨْﻬَﺎ ﻗَﺎﻟَﺖْ : ﻛَﺎﻥَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ
ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻳَﺼُﻮﻡُ ﺣَﺘَّﻰ ﻧَﻘُﻮﻝَ ﻻ ﻳُﻔْﻄِﺮُ
ﻭَﻳُﻔْﻄِﺮُ ﺣَﺘَّﻰ ﻧَﻘُﻮﻝَ ﻻ ﻳَﺼُﻮﻡُ ، ﻓَﻤَﺎ ﺭَﺃَﻳْﺖُ ﺭَﺳُﻮﻝَ
ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﺍﺳْﺘَﻜْﻤَﻞَ ﺻِﻴَﺎﻡَ ﺷَﻬْﺮٍ ﺇِﻻ
ﺭَﻣَﻀَﺎﻥَ ، ﻭَﻣَﺎ ﺭَﺃَﻳْﺘُﻪُ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺻِﻴَﺎﻣًﺎ ﻣِﻨْﻪُ ﻓِﻲ ﺷَﻌْﺒَﺎﻥَ .
ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ ( 1868 ) ﻭﻣﺴﻠﻢ ( 1156 )
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত
যে তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে সিয়াম পালন
করতেন যে, আমরা বলতাম – তিনি আর সিয়াম
ভঙ্গ করবেন না এবং এমনভাবে সিয়াম ভঙ্গ
করতেন যে আমরা বলতাম – তিনি আর সিয়াম
পালন করবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে রমজান ছাড়া অন্য
কোন মাসের গোটা অংশ রোজা পালন
করতে দেখিনি এবং শাবান ছাড়া অন্য কোন
মাসে অধিক সিয়াম পালন করতে
দেখিনি।” [এটি বর্ণনা করেছেন আল-
বুখারী (১৮৬৮) ও মুসলিম (১১৫৬)]
ﻋَﻦْ ﺃُﺳَﺎﻣَﺔ ﺑْﻦ ﺯَﻳْﺪٍ ﻗَﺎﻝَ : ﻗُﻠْﺖُ : ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻟَﻢْ
ﺃَﺭَﻙَ ﺗَﺼُﻮﻡُ ﺷَﻬْﺮًﺍ ﻣِﻦْ ﺍﻟﺸُّﻬُﻮﺭِ ﻣَﺎ ﺗَﺼُﻮﻡُ ﻣِﻦْ ﺷَﻌْﺒَﺎﻥَ ،
ﻗَﺎﻝَ : ( ﺫَﻟِﻚَ ﺷَﻬْﺮٌ ﻳَﻐْﻔُﻞُ ﺍﻟﻨَّﺎﺱُ ﻋَﻨْﻪُ ﺑَﻴْﻦَ ﺭَﺟَﺐٍ
ﻭَﺭَﻣَﻀَﺎﻥَ ، ﻭَﻫُﻮَ ﺷَﻬْﺮٌ ﺗُﺮْﻓَﻊُ ﻓِﻴﻪِ ﺍﻷَﻋْﻤَﺎﻝُ ﺇِﻟَﻰ ﺭَﺏِّ
ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴﻦَ ﻓَﺄُﺣِﺐُّ ﺃَﻥْ ﻳُﺮْﻓَﻊَ ﻋَﻤَﻠِﻲ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﺻَﺎﺋِﻢٌ ) . ﺭﻭﺍﻩ
ﺍﻟﻨﺴﺎﺋﻲ ( 2357 ) ﻭﺣﺴَّﻨﻪ ﺍﻷﻟﺒﺎﻧﻲ ﻓﻲ " ﺻﺤﻴﺢ
ﺍﻟﻨﺴﺎﺋﻲ "
উসামাহ ইবনে যায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি
বলেন: “আমি বললাম : ইয়া রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমি আপনাকে
শাবান মাসের মত অন্য কোন মাসে এত
রোজা পালন করতে দেখিনি। তখন তিনি
বললেন: “এটি রজব ও রমজানের
মধ্যবর্তী মাস। এ মাসের ব্যাপারে মানুষ
গাফেল। অথচ এ মাসে বান্দাদের আমল
রাব্বুল আলামীনের কাছে উত্তোলন করা
হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে, রোজা
পালনরত অবস্থায় আমার আমল উত্তোলন
করা হোক।”[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম
নাসা’ঈ (২৩৫৭) এবং আলবানী একে ‘সহীহুন
নাসা’ঈ’ গ্রন্থে হাসান বলেছেন।]
এ হাদিসে শাবান মাসে রোজা পালনের
হেকমত (গুঢ় রহস্য) বর্ণনা করা হয়েছে।
সে হেকমত হচ্ছে- এ মাসে বান্দার
আমলগুলো উত্তোলন করা হয়। জনৈক
আলেম আরো একটি হেকমত উল্লেখ
করেছেন সেটা হচ্ছে- শাবান মাসের
রোজা যেন ফরজ নামাজের আগে সুন্নত
নামাজের তুল্য। এই্ সুন্নতের মাধ্যমে
ফরজ পালনের জন্য আত্মাকে প্রস্তুত করা
হয় এবং ফরজ পালনের জন্য প্রেরণা তৈরী
করা হয়। একই হেকমত রমজানের পূর্বে
শাবানের রোজার ক্ষেত্রেও বলা
যেতে পারে।
১০. কুরআন তেলাওয়াত করা
সালামাহ ইবনে কুহাইল বলেছেন: “শাবান
মাসকে তেলাওয়াতকারীদের মাস বলা হত।”
শাবান মাস শুরু হলে আমর ইবনে কায়েস তাঁর
দোকান বন্ধ রাখতেন এবং কুরআন
তিলাওয়াতের জন্য অবসর নিতেন।
আবু বকর আল-বালখী বলেছেন: “রজব
মাস হল- বীজ বপনের মাস। শাবান মাস হল-
ক্ষেতে সেচ প্রদানের মাস এবং রমজান
মাস হল- ফসল তোলার মাস।” তিনি আরও
বলেছেন: “রজব মাসের উদাহরণ হল-
বাতাসের ন্যায়, শাবান মাসের উদাহরণ হল-
মেঘের ন্যায়, রমজান মাসের উদাহরণ হল-
বৃষ্টির ন্যায়। তাই যে ব্যক্তি রজব মাসে
বীজ বপন করল না, শাবান মাসে সেচ
প্রদান করল না, সে কিভাবে রমজান মাসে
ফসল তুলতে চাইতে পারে?”
পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে একটিই প্রার্থনা, তিনি যেন আগত রমাযান মাসে সব গোনাহ-খাতা মাফ করে জান্নাতুর রাইয়ানকে আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দেন-আমীন!
বিষয়: বিবিধ
১৩৬৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন