নির্বোধের শান্তনা

লিখেছেন লিখেছেন েমাবারক হােসন ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৩:৫৭:২০ দুপুর



কানু মন্ডল শখ করে নাতির নাম রেখেছিলেন রহমত আলী। কিন্তু ম্যাট্রিক দেবার আগে টেস্ট পরীক্ষায় অত্যন্ত গয়েরহ ফেল করায় হেড মাস্টার মহাশয় ফাইনাল পরীক্ষার আগে রহমত আলীরস্থলে তার নাম ফেলু মিয়া করে দেন। ক্ষোভে দুঃখে অভিমানে ফেলু কাঁদতে শুরু করে। হেড মাস্টার মশাই বলেন, কাঁদছিস কেনরে নির্বোধ!

--স্যার আমার দাদুর দেয়া নামটা বদলাইয়া দিলেন!

--নামটা তোর দাদু পরীক্ষামূলক ভাবে রেখেছিলেন। দশটি বিষয়ে ফেল করার পরেও তোকে যে ম্যাট্রিক দিতে দিচ্ছি এইতো অনেক।

ফেলুর খুব জেদ চেপে যায়। জীবনে কিছু একটা করে দেখাবে সে। এমন কিছু করবে যাতে তার রহমত নামটা ফিরে আসে। অনেক খাটাখাটুনী করে ম্যাট্রিক উতরে যায় সে। হেড মাস্টার মশাই বলেন, ওরে নির্বোধ, তোর নাম বদলে মান-সম্মান বাঁচানোতেই উনি সদয় হয়ে তোকে পাশ করিয়ে দিয়েছে।

কলেজে পড়ার সময় ফেলু সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টায় নেমে পড়ে। এক বন্ধু পরামর্শ দেয়,এই ফেলু তুই গান শেখ। তোর কন্ঠ তো বশির আহমেদের চেয়ে অনেক ভরাট। গান শিখে ফেললে কে জানে তুই হয়তো ফিলিমের প্লে ব্যাক সিঙ্গার হতে পারবি।

ফেলু প্রতিদিন সকালে উঠে গার্গল করে আদাজল খেয়ে লেগে পড়ে সংগীত চর্চায়। তার আ আ আ শুনে প্রতিবেশীরা ধমক দেয়।

--ঘরে বসে ব্যা ব্যা করছো বাপু। যাও খোলা মাঠে যাও।

ফেলু ভাবে নাহ এভাবে হবে না। প্রতিষ্ঠিত একজন সংগীত শিক্ষকের কাছে গানের তালিম না নিলে কাজ হবে না। খুঁজে পেতে আলতাফ মাহমুদের কাছে যায় গান শেখার ব্রত নিয়ে।

--ওস্তাদজী আমার খুব শখ আমি প্লে ব্যাক সিংগিং করবো।

--বড় শখ থাকা ভালো। তবে আগে গানটা শেখো।

--ওস্তাদজী একটা গান গেয়ে শোনাবো।

--বেশতো গাও।

--আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী; আমি কী ভুলিতে পারি!

--সে কী তুমি কবিতা পাঠ করছো কেন! সুর করে গাও।

--কেন ওস্তাদজী একটু সুরও কী ছিলো না!

--দেখো ভাই তোমাকে মিথ্যা বলে লাভ নেই। গানটা আসলে তোমাকে দিয়ে হবে না।

--ওস্তাদজী আমার হেডমাস্টার আমাকে নির্বোধ বলতেন। আমি কী সত্যিই নির্বোধ!

--গান না গাইলে তোমাকে কেউ নির্বোধ বলবে না। অন্য কিছু করো। নিশ্চয়ই সফল হবে।

ভগ্ন হৃদয় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফেলুর ভীষণ কান্না পায়। বন্ধুবান্ধব বলে, সাংবাদিক হইয়া পড় ফেলু । নাম-ডাক হইবো।

বুদ্ধিটা খুবই পছন্দ হয়। ফেলু চলে যায় এক পত্রিকা অফিসে। কেউ তাকে পাত্তা দেয়না। সবাই ব্যস্ত। কাঁদো কাঁদো চেহারা করে সে পত্রিকা অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন কাঁধে হাত রাখেন।

--কী হয়েছে ভাই; কাঁদছো কেন। কে মেরেছে-কে বকেছে!

--আমি সাংবাদিক হইতে চাই। খুব সাধ আমার।

--বেশতো। কজনই বা এতো আগ্রহ নিয়ে সাংবাদিক হতে চায়। চলো আমার সঙ্গে চলো।

সিরাজুদ্দীন হোসেন বলেন, তোমার গ্রামের কোন একটি সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন লেখো দেখি।

ফেলু পেন্সিল দিয়ে নিউজপ্রিন্টের কাগজে খস খস করে লিখতে শুরু করে। গ্রাম বলতে ঐ গ্রামের গরুর রচনাটি সে মুখস্ত করেছিলো। সুতরাং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গরুর রচনাটিই লিখে দেয়। গরুর ক্ষুরা রোগের সমস্যার কথা উল্লেখ করে এতে একটা প্রতিবেদনের চেহারা দিতে চেষ্টা করে।

সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রতিবেদন পড়েই চমকে ওঠেন। ক্রোধ সামলে বলেন, -ভাই ফেলু আমার মনে হয়; তুমি সাংবাদিকতা না করে সাহিত্যিক হবার চেষ্টা করতে পারো।

--কেন আমি কী নির্বোধ; হেড স্যারের কথাই কী সত্য!

--সাংবাদিকতা না করলে কেউ ধরতেই পারবে না যে তুমি নির্বোধ।

ফেলু মন খারাপ করে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকে। এক প্যাকেট কে-টু সিগ্রেট উজাড় করে তবে ঘরে ফেরে। বসে যায় শরত সাহিত্য সমগ্র নিয়ে। সাহিত্য সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে চেষ্টা করে। বন্ধুবান্ধব বুদ্ধি দেয়, একটু শরাব পান না করলে সাহিত্যিক হওয়া যায়না।

বেশ খানিকটা শরাব পান করে ফেলু চলে যায় শহীদুল্লাহ কায়সারের বাসায়। উনি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী চাও হে তরুণ!

--শরতচন্দ্র হতে চাই প্রিয় লেখক।

--তুমি তো শরতচন্দ্র হবার আগেই দেবদাস হয়ে গেছো। সকাল সকাল এসব কী!

--আমাকে ভুল বুঝবেন না। সাহিত্যিক হতে না পারলে আমি বাঁচবো না প্রিয় লেখক।

ফেলু সেই পত্রিকা অফিসে লেখা গরুর রচনাটি এগিয়ে দেয়। টুকটাক লেখার চেষ্টা করছি। আশীর্বাদ করবেন।

গরুর রচনা পড়ে অনেক কষ্টে হাসি আটকে শহীদুল্লাহ কায়সার বলেন, ভালো লিখতে গেলে পড়তে হয়। সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাসে দখল থাকতে হয়। তবে না সাহিত্যিক হতে পারবে।

--প্রিয় লেখক আমি কী নির্বোধ! হেড স্যার বলছিলেন আর কী!

--কিছু মনে করোনা ভাই। তোমার এই লেখাটা আপাততঃ বাস্কেটে ফেলে দাও। এটা কেউ না পড়লে নিশ্চয়ই তোমাকে নির্বোধ ভাববে না।

ফেলু একেবারেই মুষড়ে পড়ে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়। চিন্তা করে বাংলা সাহিত্যে পড়বে সে। চলে যায় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর কাছে।

--স্যার আমি সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী। সাহিত্য পড়তে চাই।

--মেঘনাদ বধ কাব্য কী পড়েছো!

--না স্যার এক পুরোহিত মশাই বলেছিলেন, মেঘনাদ বধ কাব্য আসলে রামায়ণের অবমাননা।

--পুতুল নাচের ইতিকথা পড়েছো।

--ছোট বেলায় অনেক পুতুল নাচ দেখেছি স্যার।

--আমার লেখা কবর নাটক কী পড়েছো!

--স্যার এখনও তো মরিনাই তাই কবরে যাওয়া হয়নাই।তবে শ্মশানে গেছি।

--বাবা ফেলু আমার মনে হয় তোমার বাংলা সাহিত্যে না পড়াটাই মঙ্গলজনক।

--কেন স্যার আমি কী নির্বোধ! হেড স্যার বলেছিলেন কীনা!

--বাংলা সাহিত্য না পড়লে কেউ তোমাকে নির্বোধ বলবে না।

ফেলু চিন্তা করে ইংরেজী সাহিত্য পড়া উচিত। তাহলে তো আর কোনভাবেই কেউ নির্বোধ বলতে পারবে না। অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার সঙ্গে দেখা করে সে তার ইংরেজী সাহিত্যে পড়ার আগ্রহের কথা জানায়।

স্যার গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করেন, শেক্সপীয়ার পড়েছো কী ফেলু!

--ঈশ্বরের দিব্যি স্যার; আমি ভালো ছেলে, সেক্স কিংবা পেয়ার এসব কোন কিছুই পড়িনি স্যার।

অনেক কষ্টে হাসি চেপে অধ্যাপক গুহ ঠাকুরতা বলেন, পি বি শেলীর কোন কবিতা পড়ার সৌভাগ্য কী হয়েছিলো!

--শেলী নামে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে আমাদের পাড়ায় ছিলো। ভালো ছেলে বলে ওকে নিয়ে কোন কবিতা লিখিনি স্যার!

--আচ্ছা একটা ট্রানসলেশান করো, আমি সাহিত্য পড়ছি।

--আই ইজ রিডিং লিটারেচার।

-- ফেলু আমার মনে হয় লিটারেচার না পড়ে তুমি অন্য কোন সাবজেক্টে পড়ো।

--স্যার আমি কী নির্বোধ! হেড স্যার বলছিলেন কীনা!

--হয়তো তুমি সাহিত্যে বোধহীন; অন্য বিষয়ে সামান্য বোধ নিশ্চয়ই আছে। একবার না পারিলে দেখো শতবার।

ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফেলু ইতিহাসের শিক্ষক ড আবুল খায়েরের কাছে যায়। খুলে বলে ইতিহাসে পড়ার আগ্রহের কথা।

ড খায়ের জিজ্ঞেস করেন, ওহে তরুণ বলো তো সোমনাথের মন্দির কে ভেঙ্গেছিলো!

--ঈশ্বরের দিব্যি সোমনাথের মন্দির আমি ভাঙ্গিনি। আমি স্যার শান্তিপ্রিয় মানুষ।

ড খায়ের বলেন, শান্তিপ্রিয় মানুষদের দর্শন পড়া উচিত। অনেক মৌলিক চিন্তা বিকাশের সুযোগ থাকে দর্শনের ছাত্রদের।

সময় নষ্ট না করে ফেলু দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের কাছে চলে যায়। জিসি দেব বাড়ীর সামনে বাগানে গাছের পরিচর্যা করছিলেন। ফেলু স্যারের পায়ে পড়ে যায়।

--স্যার আমাকে বাঁচান। দর্শন না পড়লে আমি বাঁচবো না।

--তা যুক্তিবিদ্যা পড়েছো!

--হ্যা স্যার। আপনি গাছ ছুয়ে আছেন, গাছ মাটি স্পর্শ করে আছে; অতএব আপনি মাটি স্পর্শ করে আছেন।

--আর কোন যুক্তি কী আছে তোমার পেটে!

--স্যার ছাগল ঘাস খায়, আমি ছাগল খাই; অতএব আমি ঘাস খাই।

--আসল যুক্তিটাই যখন বুঝতে পেরেছো তখন আর দর্শন পড়ার বৃথা চেষ্টা কেন!

--স্যার আমি কী নির্বোধ! আমাকে দিয়ে কী কিছু হবে না। হেড স্যার বলেছিলেন আর কী!

--আহা এতো ভেঙ্গে পড়ছো কেন! নির্বোধ হওয়াটাই এসমাজে আশীর্বাদ। বোধ থাকাটাই অবর্ণনীয় কষ্টের ব্যাপার। তুমি তো সৌভাগ্যবান হে!

বিষয়: সাহিত্য

১১২৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

358052
৩০ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ০৮:৫২
শেখের পোলা লিখেছেন : পড়েই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে৷ ভাল লাগলো৷ চালিয়ে যান৷ধন্যবাদ৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File