তবুও সুখে আছি
লিখেছেন লিখেছেন জুবাইর জালালাবাদী ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৩:২১:২৭ দুপুর
গল্প-উপন্যাস যা কিছুই লিখা হয়, তার মধ্যে সমাজের
চিত্রটাই ফুটিয়ে তুলার চেষ্টা করা হয়। বিধায় কোন কাহিনী
যদি কারো জীবনে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার সাথে মিলে
যায় তাহলে তা সম্পুর্ন কাকতালীয়!!!!!
'
আমার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এক আলেম পরিবারে। তাই ছোট বেলা থেকেই ধর্মীয় পরিবেশে থেকে,
ধর্মীয় অনুশাষন মেনে চলে, লালিত পালিত হয়ে আমার বড় হয়ে উঠা। মন মানসিকতাও ঠিক সেভাবে তৈরী হয়ে উঠেছে।
আমার পর-দাদা রহঃ সমাজ সংস্কারক এক মহান বুযুর্গ ছিলেন। তিনি নিজ এলাকায় দাওয়াতের মাধ্যমে কুফর, শিরক, এবং বিদ'আত মুক্ত করেছিলেন। মুহতারাম দাদাজান রহঃ ও ছিলেন বড় মাপের বুযুর্গ আলেমে দ্বীন। ছিলেন আলেম সমাজের মুকুটহীন সম্রাট। দাদাজান রহঃকে টেকনাফ
থেকে তেতুলিয়া এমন কি অন্যান্ন মুসলিম দেশ সমুহের সর্বস্তরের ধর্মপ্রান মুসলমানগণ এক নামেই চিনে। নাম বললে
চিনবেনা এমন লোক পাওয়া কষ্টকর হবে। আমার মুহতারাম আব্বাজান ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ একটি মাদরাসার সুযোগ্য মুহাদ্দীস ও শিক্ষা সচিব। সর্বোপরি আমি নিজেও মহিলা মাদরাসায় পড়েছি।
তাই মনে করেছিলাম, কোন বিখ্যাত আলেম পরিবারে আমার বিয়ে হবে। কখনো ভাবিনি জেনারেল শিক্ষিত কারো সাথে আমার বিয়ে হবে। আমার ইচ্ছা না থাকা সত্বেও পিতা মাতার মন খুশি রাখতে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি হই। আমি আলেম পরিবারের মেয়ে,আর বিয়ে করব কিনা একটা জেনারেল ছেলেকে? আর বিয়ে করে নাকি আমাকে নিয়ে ইংল্যান্ড ও
চলে যাবে!!!! ভাবতেই কেমন যেন সংকোচ বোধ হচ্ছিল।
এমনিতেই এত জলদি বিয়ে করতে ইচ্ছা করছিল না। তারপর আবার বান্ধবীরা এসে বলল: কিরে ফাহমিদা ! তুই শেষ পর্যন্ত
একটা ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেকে বিয়ে করবি? আর পাত্র খুজে পাসনি? তাই সব কিছু মিলিয়ে খুবই বিরক্তি লাগছিল।
*
এরই মধ্যে আমার এক ভাবি এসে বললেন,
একটা বিষয় লক্ষ করেছো ফাহমিদা!! আমি
জেনারেল শিক্ষিত মেয়ে হয়েও একজন
আলেমকে স্বামী হিসেবে পেয়েছি, আর
তুমি আলেমা হয়েও জেনারেল শিক্ষিত
স্বামী পাচ্ছো! তবে মন খারাপ করার কিছু
নেই, তুমার হবু স্বামীকে দেখতে মুহাদ্দীস
সাহেবের মত মনে হয়। ভাবীর কথাগুলো
মোটেও ভালো লাগলো না। কেমন জানি
বিদ্রুপের গন্ধ পেলাম। মনটা আরো
বেশী খারাপ হয়ে গেল। বিভিন্ন দিক চিন্তা
করে এখন বিয়ে করতে মন চাচ্ছে না।
কিন্তু আব্বা আম্মার পছন্দ হয়েছে জেনে
আমিও বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দিয়েছি।
আর আব্বাও বিয়ের কথা বার্তা পাকা
করে ফেলেছেন। শুধু মাত্র বিয়ের তারিখ
ঠিক করা বাকি রয়েছে.আমার হবু শশুড় ইংল্যান্ড
থেকে আসার পর দিন তারিখ
চুড়ান্ত করা হবে। তাই কিভাবে বিয়েতে
অমত করবো ভেবে পাচ্ছি না।
বিয়ের তারিখ চুড়ান্ত হয়নি এজন্য ভাইয়াকে
এখনো বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি।
ভাইয়া চট্রগ্রামের এক মাদরাসায় দাওরায়ে
হাদীসে পড়ে। আমি আর ভাইয়া এক বছরের
ছোট বড়। আমার আর
ভাইয়ার সম্পর্কটা বন্ধুত্বপুর্ন। তাই ভাইয়ার কাছে
কল করলাম, ভাইয়াকে সব কিছু খুলে বললাম,
ভাইয়া কোন দিনই আব্বা আম্মার সিদ্ধান্তের
উপর দ্বিমত পোষন করেনি, তাই কি করবে
বুঝতে পারছিলোনা।
ভাইয়া আমাকে প্রচন্ড ভালবাসে তাই
আমার বিশ্বাস ছিল ভাইয়া আমার জন্য
কিছু একটা করার চেষ্টা করবে। ভাইয়া বললো
দেখি আমি ছুটি নিতে পারলে
দু একদিনের মধ্যেই বাড়িতে আসবো।
আমি ভাইয়ার আশ্বাসে অনেক আনন্দিত হলাম।
এবং ভাইয়ার বাড়িতে আসার
অপেক্ষা করতে লাগলাম।
দু দিন পর....
ফজরের নামাজান্তে কুরআন তেলাওয়াত
করছিলাম, এমন সময় কলিং বেল বেজে
উঠলো, আম্মা গেট খুলে অবাক হয়ে
গেলেন! ভাইয়ার মোবাইল আছে তা
আব্বা আম্মা কেউ জানেন না। আর
ভাইয়াও মাদরাসা বন্ধ না হলে বাড়িতে আসেনা। তাই
আম্মা ভাইয়াকে দেখে
অবাক হয়ে বললেন কিরে নয়ীম তুই
হঠাৎ চলে আসলি যে?
*
ভাইয়া বললেন, না এমনিতেই কয়েক দিন
ধরে বাড়ির কথা খুব বেশি মনে পড়ছিলো তাই
ছুটি নিয়ে চলে এলাম। আমি ভাইয়ার কন্ঠ
শুনে তাড়াতাড়ি তেলাওয়াত বন্ধ করে ভাইয়াকে
দেখতে গেলাম। আম্মার সামনে এমন ভাব
নিলাম যে ভাইয়া আসবে এটা আমি জানিইনা।
ভাইয়া আম্মার রুমে গিয়ে বসলো, আমি চা নাস্তা
বানিয়ে আনলাম, প্রায় একমাস পর এক সাথে
নাস্তা করলাম।
নাস্তা করে ভাইয়া ঘুমিয়ে গেল, দশটার দিকে
ঘুম থেকে উঠল। খাওয়া দাওয়ার সময় আম্মা
ভাইয়াকে আমার বিয়ের কথা জানালেন।
বিয়ের কথা ভাইয়াকে আগে কেন জানানো
হয়নি, তাই সে অভিমান করার ভান করলো।
আম্মা ভাইয়াকে সব কিছু বুঝিয়ে বললেন।
ভাইয়া বললো আচ্ছা ঠিক আছে বুঝলাম।
কিন্তু বিয়ে দিবেন ভালো কথা, জেনারেল
ছেলে কেন, আলেম পাত্র কি পাওয়া যায়
না? আম্মা বললেন, বাবারে এসব বুঝার বয়স
এখনো তোর হয়নি। সংসার জীবনে সুখ
শান্তির জন্য আর্থিক সচ্ছলতাও প্রয়োজন।
ভাইয়া বিনয়ের সাথে বললো, তাহলে কি নানা
তুমাকে আব্বার কাছে বিয়ে দেয়ায় তুমি সুখ
শান্তি পাওনি? আমরাও কি আমাদের যখন
যা প্রয়োজন তা পাইনি? আমিও কি মাদরাসায় লেখা
পড়া করে ভুল করতেছি? আমার উচিৎ নয় কি
কলেজ ভার্সিটিতে পড়া? আম্মা কিছুক্ষন চুপ
করে রইলেন, অতপর বললেন, এতো
প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই তোর
আব্বা আসলে জিজ্ঞেস করিস।
আব্বা ফজরেরপরে মাদরাসায় চলে গিয়ে
ছিলেন, বিকেলে আসলেন। ভাইয়া আব্বার
সাথে দেখা করল, আব্বা লেখা পড়ার খোঁজ
খবর নিলেন। মাগরিব পর আম্মা আব্বাকে ভাইয়ার
কথা গুলো রিপ্লে করে শুনালেন।
আব্বা ভাইয়াকে উনার রুমে ডেকে নিয়ে
পাশে বসিয়ে বললেন, তুমার আম্মা আমাকে
সব কিছু বলেছেন, তুমি সব কিছু জানোনা তাই
এমন প্রশ্ন
করেছো, বাবা মা সব সময়ই সন্তানদের সুখ
শান্তি চায়, আর তুমি যা বলেছো তাও বোনের
প্রতি অপরিসিম ভালবাসা থাকায় বলেছো।
তবে বাবা একটা কতা মনে রেখ, আমরা
জেনে শুনে তোমার বোনকে অপাত্রে
হস্তান্তর করবো না। আমরা ভালো করে
খোজ খবর নিয়েই বিয়েতে মতামত দিয়েছি।
ছেলে আলেম নয়
তা অবিশ্য ঠিক, তবে ধার্মিক। আচার ব্যবহার চাল
চলন লেবাস ইত্যাদী সব কিছু ঠিক আছে।
যতটুকু ইলিম শিক্ষা করা ফরজ তা জানা আছে। আর
তার পরিবারের সবাইও ধার্মিক।
*
ভাইয়া আব্বার কথা শুনে তাল মিলেয়ে বললো,
আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই করেন।
আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমার
বিয়ে এখানেই দেয়া হবে। এটাই মনে হয়
তাক্বদীরের ফায়সালা! ভাইয়ার ছুটি শেষ হলে
ভাইয়া মাদরাসায় চলে গেল।
এর আগে তো অনেক বার ই ভাইয়া বাড়ি
থেকে মাদরাসায় গেল, কিন্তু আমার মনতো
তেমন খারাপ হতো না। এবার ভাইয়া চলে যাওয়ায়
মন অনেক খারাপ হয়ে গেল।
যাওয়ার সময় কান্নাও চলে এলো। চোখের
পানি লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। ভাইয়া দেখে
ফেলল, আমাকে আদর করে বলল, কিরে
পাগলী এতে কান্নার কি আছে? আমি কি
একেবারে চলে যাচ্ছি? এইতো একমাস
পর বার্ষিক পরিক্ষার ছুটি হবে। তখনতো
বাড়িতে আসবো, এ কথা বলে আমায় শান্তনা
দিয়ে চোখের পানি মুছে দিল,সবাইকে সালাম
দিয়ে বিদায় নিয়ে মাদরাসার উদ্দেশ্যে চলে
গেল।
এক সপ্তাহ পর খবর এলো আমার হবু শশুর
আগামী সপ্তাহে দুই মাসের ছুটিতে দেশে
আসতেছেন। খবরটা শুনে আমার মন খারাপ
হয়ে গেল, আমি বুঝতে পারলাম, কয়েক
দিনের ভিতরেই আমার ঠিকানা পরিবর্তন হয়ে
যাবে। আমার নতুন একটি পরিচয় হবে। নিয়তির কি
নিষ্ঠুর খেলা!! আমাকে সেই বাড়িটিছেড়ে
চলে যেতে হবে যে বাড়িতে
আমি জন্মেছিলাম। যে বাসস্থানে আমি
প্রতিপালিত হয়েছি । যেখানে হেসে-
খেলে আমি বড় হয়েছি!!
আর যাচ্ছি এমন পরিবেশে যার সঙ্গে আমি
মোটেও পরিচিত নই। মিলিত হবো এমন
সঙ্গীদের সঙ্গে যাদেরকে আমি চিনিই না
তাদেরকেই আমার আপন করে নিতে হবে।
সবার মন জয় করে চলতে হবে। এতো দিন
স্বাধীনভাবে উঠা বসা চলা ফেরা করতে
পেরেছি। এখন প্রতিটি কদমে কদমে হিসেব
করে চলতে হবে। হোচট খেয়ে পড়ে
গেলে কেউ ধরতে আসবে? না কি হোচট
খেয়ে পড়ে যাওয়ায় কঠু কথা শুনতে হবে।
পান থেকে চুন খসলেই কি আমাকে কঠু কথা
শুনতে হবে? নাকি স্নেহ ভালবাসার পরশ দিয়ে
পানে চুন
লাগানো শিখানো হবে। ভুল হলে কি আদর
স্নেহ ভালবাসার সাথে ভুল সংশোধনের পথ
দেখিয়ে দেয়া হবে? নাকি ধমক খেতে
হবে? আমি কি পারবো সেই অপরিচিত
পরিবেশের
সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে? ইত্যাদী
ইত্যাদী নানাবিদ প্রশ্ন আমার মনে উকি দিতে
শুরু হলো। আর অজানা এক আতংক আমার মনে
কাজ করতে লাগলো।
০৮দিন পর আমার হবু শশুর দেশে আসলেন,
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হলো। আগামি
০৪-০২-১১ঈসায়ী রোজ শুক্রবার আমার
বিয়ে।
*
বিয়ের কেনা কাটা শুরু হলো, এদিকে আমার
বুকের হার্ডবিট বাড়তে লাগল, একে একে
শৈশবের মধুময় স্মৃতিগুলো মনে পড়তে
লাগলো। আহ,, কয়েক দিন পর সব কিছু
অতীত হয়ে যাবে, আমার জীবন থেকে!
মনে পড়লো ছোট বেলার এক করুন
কাহিনী।
আমার ফুফাতো বোন যুলফা আমাদের
বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। বাড়ির উত্তর
পাশে একটা পুকুর ছিল, বর্তমানে এটা বরাট করা
হয়েছে।
একিদিন ভাইয়া মাঝ পুকুরে সাতার কাটতে ছিল, তার
সাতার কাটা দেখে আমারও সাতার কাটতে মন
চাইলো, আমি যুলফাকে বললাম, চল আমরাও
সাতার কাটি, যুলফা বলল, আমিতো সাতার জানিনা,
আমি বললাম,
আমি তোকে শিখিয়ে দেব, আর আমরা
পুকুরের ঘাটে থেকেই সাতার কাটবো, পানির
গভীরে যাব না, যুলফা রাজি হয়ে পানিতে
নামলো, আমরা পুকুরের ঘাটেই সাতার
কাটতেছিলাম। হঠাৎ আমার পায়ের ধাক্কায় যুলফা
পানির গভীরে চলে গেল, সে গভীর
পানিতে পড়ে হাত পা ছুড়তে লাগলো, আর হাবু
ডুবু খাচ্ছিল। আমি ধরতে গিয়েও পারলাম না।
ভাইয়া যুলফার অবস্থা দেখে দ্রুত সাতার
কেটে এসে যুলফাকে ধরলো, যুলফা তার
বাহু দিয়ে ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরল, তার বোঝা
নিয়ে সাতার কাটার সাধ্য ভাইয়ার হল না। তাই দুইজনই
হাবু ডুবু খেতে লাগল, আমি অবস্থা দেখে
চিৎকার চেচামেচি শুরু করলাম, আম্মা চিৎকার
শুনে ছুটে এসে দৃশ্য দেখেই পানিতে ঝাপ
দিলেন। যুলফা ততক্ষনে বেহুশ হয়ে
ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়েছে। আর ভাইয়া এক
হাতে যুলফার চুল আর এক হাত দিয়ে সাতার কাটার
চেষ্টা করছিল। আম্মা দ্রুত গতিতে গিয়ে
যুলফাকে ধরে উপরে তুলে ঘরে নিয়ে
গেলেন।
ভাইয়া রাগ করে আমার দিকে তাকাতেই আমি
কান্না শুরু করে দিলাম। আমার চোখের পানি তার
মন মনের মত গলিয়ে দিল, আমি আম্মার
ভয়ে ঘরে যেতে চাইলাম না, সে অভয়
দিয়ে আমাকে ঘরে নিয়ে গেল, বহু চেষ্টার
পর
যুলফার হুশ ফিরে এলো, আম্মা মনে
করেছেন
ভাইয়া যুলফাকে নিয়ে গিয়েছে, তাই কঠোর
স্বরে বলে উঠলেন নয়ীম!! তুমি আমার
সামন
থেকে দুর হয়ে যাও। তুমি যুলফাকে নিয়ে
গিয়েছিলে ডুবিয়ে মারতে?
ভাইয়া আমার চোখের দিকে তাকিয়ে
দেখতে পেল এক আকুল আবেদন।
আমাকে বাচানোর জন্য, যে অপরাধ সে
করেনি, তাই সে মাথা পেতে নিয়ে চুপ করে
দাড়িয়ে রইলো। আর নিরবে আম্মার বকুনি
হজম করলো। রাতে যুলফার প্রচন্ড জ্বর
উঠলো।
*
ইশার পর আব্বা বাসায় আসলেন, যুলফার জ্বর
দেখে ডাক্তার নিয়ে এলেন, ডাক্তার ঔষধ
লিখে দিয়ে গেল। আব্বাও
ভাইয়াকে অনেক বকুনি দিলেন, আর বললেন,
নয়ীমের ঘরে কোন জায়গা নেই, ও আজ
গোদাম ঘরে থাকবে, তাকে ভাতও
দেবে না।
রাতে যখন খানা খেতে বসলাম, ভাইয়ার
কথা মনে পড়লো, আমার মুখ
দিয়ে লোকমা যাচ্ছিল না। দুই
লোকমা খেয়েই উঠে পড়লাম,
আম্মা আব্বাও দুই এক লোকমার বেশি খান
নি। খাওয়া দাওয়া শেষে যখন শুতে যাব,
তখন আমি আর সত্য গোপন
করে ভাইয়াকে কষ্ট দেয়া সহ্য
করতে পারলাম না।
আব্বা আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
ভাইয়ার কোন দোষ নেই আমিই
যুলফাকে নিয়ে গিয়েছিলাম।
যুলফা ডুবে যাচ্ছিল
দেখে ভাইয়া তাকে বাচাতে এসেছিল।
আব্বা আম্মা আমার কথা শুনে
একেবারে ত্ব হয়ে গেলেন।
আম্মা ধমক দিয়ে বললেন, তুমি এতক্ষন
দোষ
স্বীকার করনি কেন? আমি বললাম,
আমি কি জানতাম ভাইয়াকে এমন কঠিন
শাস্তি দেবে!! আব্বার নির্দেশ
পেয়ে আমি ভাইয়াকে গোদাম ঘর
থেকে নিয়ে এলাম, আমি ভাইয়ার
সাথে আবার খেয়ে নিলাম। সকালে যুলফার
জ্বর কমলো, যুলফাকে আমি সরি বললাম,
সে বলল, ধুত্তুরি তর কোন দোষ নেই,
শয়তান
আমাকে ডুবাতে চেষ্টা করেছিল,
পরে আমি ভাইয়ার শাস্তির
কাহিনী বর্ণনা করলাম।
এই কাহিনীর পর থেকে আমি লক্ষ করেছি,
যুলফা ভাইয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছে।
যতদিন ছিল, ভাইয়ার
সাথে বেশি খেলা ধুলা করত। আমি ভাইয়ার
স্নেহ ভালবাসার
কথা চিন্তা করে বালিশে মুখ
গুজে অনেক্ষন কাদলাম,
কেদে কেদে ঘুমিয়ে গেলাম।
যখনি একা হতাম তখন শৈশবের বিভিন্ন
স্নৃতি মনে পড়ত, মনে পড়ত আব্বা আম্মার
আদর স্নেহ শাষনের কথা! আর বালিশে মুখ
গুজে বালিশ ভিজাতাম। মাঝে মধ্যে ভাবী-
চাচীরা এসে শান্তনা দিয়ে যেতেন,
দিতেন বিভিন্ন উপদেশ,
আম্মা আব্বাতো প্রতিদিন বিভিন্ন দিক
নির্দেশনা দিতেন। এভাবেই আমার দিন
কাটতেছিল। অবশেষে বিয়ের দিন
ঘনিয়ে এলো, আগামী কাল আমার বিয়ে!!!
আত্নীয় স্বজনে বাড়ি ভরপুর, চাচাত, ফুফাত,
মামাত, খালাত, ভাই বোনেরাও এলো।
কেউই বাদ পড়লো না। শুধু
আসতে পারলো না মারিয়া আপু (খালাত
বোন) বিয়ের পরে ইংল্যান্ড চলে
গিয়েছে।
*
মাগরিবের নামাজ পড়ে আমরা সব বোনেরা
মিলে নাস্তা করলাম। নাস্তার সময় আমার
ফুফাত বোন তাযকিয়া বললো, কালতো ফাহমিদা
শশুর বাড়ি চলে যাবে। আর আমরা সবার ও
কোনদিন একসাথে জমা হওয়া সম্ভব নাও হতে
পারে। চল আজ আমরা সবাই মিলে গান গেয়ে
আনন্দ ফুর্তি করি। এক চাচাত বোন বলল, গান
গাইলে তো সবাই বকা দেবে, চল অন্য কিছু
করি।
তাযকিয়া আপা বলল, না বকা দেবে কেন?
আমরা তো না জায়েজ কিছু করবো না, যতটুকু
শরিয়তে জায়েজ আছে ততটুকুই করবো।
সবাই রাজি হলো, আমিও রাজি হলাম, প্রথমেই
তাযকিয়া আপা আমার বিয়ে নিয়ে নিজের
লেখা একটি গান দিয়ে অনুষ্টান শুরু করলেন।
কেউ হাড়ি পাতিল দিয়ে, আর কেউবা জগ উল্টা
করে আর কেউবা মগ দিয়ে, যে হাতের
কাছে যা পেয়েছে তা দিয়েই তবলা বাজাচ্ছিল।
হৈ হোল্লড় শুনে ছোট চাচ্চু চলে এলেন,
তাযকিয়া আপাকে বললেন, কি তাযকিয়া সবাইকে
নিয়ে এসব কি শুরু করেছো?
তাযকিয়া আপা সাথে সাথে বললেন, কই
না তো মামা আমরাতো কিছুই করছিনা, একটু
আনন্দ ফুর্তিই তো করছি মাত্র! আর এটাতো
না জায়েজ কিছু নয়, বিবাহ শাদির অনুষ্টানে এসব
করাতো জায়েজ আছে। চাচ্চু বললেন,
বুঝেছি তুমি অনেক বড় পাজি হয়ে গেছ, তুমার
সাথে পারা যাবে না!!!! আমি যাই বলে চাচ্চু চলে
গেলেন।
আবার গান গাওয়া আরম্ভ হল। কেউ পারুক আর
নাই পারুক সবাইকে গান গাইতে হলো।
অবশেষে সবাই মিলে আমাকে ধরল গান
গাওয়ার জন্য। কি আর করা! বাধ্য হয়ে আমিও
একটা গান গাইলাম। গানের ফাকে ফাকে সবাই
মেহেদি দিয়ে হাতও রঙ্গিন করে নিল, আমার
হাতকেও রঙ্গিন করে দেয়া হলো।
উল্লেখ্যঃ- ইসলামি শরিয়ত নিরস কোন ধর্ম নয়,
এতে আনন্দ-আহ্লাদেরও অনুমতি আছে।
যে গানে আল্লাহও রাসুলের গুনকীর্তন করা
হয়, যে গানের কথায় ইসলামি তাহযীব তামাদ্দুন
ফুটে উটে এবং সুকুমার বৃত্তি বিকশিত হয়,
সেসব গান জায়েজ আছে। তবে যৌন
আবেদনমূলক অশ্লীলতাপূর্ণ অরুচিসম্পন্ন
চরিত্র বিদ্বংসী গান গাওয়া ও শ্রবণ করা নিশ্চিত
রুপে অবৈধ ও হারাম।
বিবাহ শাদি ঈদ বৌভাত প্রীতিভোজ ইত্যাদী দফ
(তবলা) বাজানো জায়েজ। দফ এমন
বাদ্যযন্ত্রকে দফ বলা হয়, যার একদিক শক্ত
চামড়া দ্বারা আবদ্ধ থাকে আর অপর দিক
খোলা থাকে। তবে ঘুঙ্গুরপুর্ণ উভয়দিক
আবদ্ধ
ঢোল ও অন্যান্ন বাদ্যযন্ত্র সর্বাবস্থায় হারাম।
একসময় বাংলাদেশের গ্রাম গঞ্জে বিবাহ
শাদী ইত্যাদীর অনুষ্টানে মহিলারা নিজ নিজ
আঞ্চলিক ভাষায় গীত গাইতো, যার
মধ্যে অশ্লিলতা বা অপবিত্রতা কিছুই থাকত না।
আমার ধারনা, আলেম সমাজ আধুনিক যুগে
কানফাটা ভলিউম দিয়ে বিয়ে শাদিতে যে গান
পরিবেশন করা হয়, সেসব গান হারাম হওয়ার বিধান
ওয়াজ মাহফিলে বর্ণনা করার সাথে সাথে যা
জায়েজ আছে তার বর্ণনাও যদি দেন, তাহলে
হয়ত অনেক লোক জায়েজ পর্যন্ত সিমাবদ্ধ
থাকবে।
*
আজ আমার বিয়ে, তাই সকাল থেকে সবার
ব্যস্থতা বেড়ে গেল। সবাই আমার বিয়ে
নিয়ে হাসি খুশিতে মাতোয়ারা। আমিতো মহা
টেনশনে সময় কাটাচ্ছি। সবার উপরে বড্ড রাগ
হচ্ছিল। আমাকে এক অজানা পরিবেশে পাঠিয়ে
দিতেছে বলে ওরা মহা খুশিতে মেতে
উঠেছে।
ওদের কি আমার জন্য বিন্দু মাত্র মায়া দয়াও
নেই। আম্মাও হাসি খুশির সাথে সবার সাথে কথা
বলতেছে। আর ভাইয়াতো মহা আনন্দে এদিক
ওদিক ধৌড়া দৌড়ি করতেছে। আব্বার তো
কোন খোঁজ ঈ নেই।
আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে আমার আদরের ছোট্ট
বোন ফারিহা (৬ বছরের ছোট)। সে আমার
পাশে বসে কৌতুহল নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন
করতেছে। আর আমি উত্তর দিয়েই যাচ্ছি।
আজ কেন জানি ওকেই আমার সব চেয়ে
আপন মনে হচ্ছে!!! যদিও এর আগে আমি
তাকে খুব বেশি স্নেহ করিনি। আর তার কারনও
আছে। সে শুধু শুধুই আমার নামে আব্বা
আম্মার কাছে বিচার দিত। একটু ধমক দিলেই
পুরো বাড়ি কান্না কাটি করে মাথায়
তুলতো। সবাই মনে করত আমি না জানি কি
করেছি ওকে। আমি তাকে ছুইতে মরা বলে
ডাকতাম। এ নিয়েও অনেক বিচার সালিশ
হয়েছে। তবুও সে আমাকে অনেক
ভালবাসে। আমিও অনেক ভালবাসি।
আমার বিয়ে হয়ে যাবে শুনার পর থেকে
আমার প্রতি তার, আর তার প্রতি আমার ভালবাসা
অনেক গুন বেড়ে গিয়েছে।
আজ আমিও বুঝতে পারতেছি, আমি অনেক
অনেক ভালবাসি তাকে। আব্বা আম্মা ভাইয়া সবাই
তাকে বেশি আদর করত বলে আমার হয়ত
হিংসে হত। আমি রুমে একাকী বসে কাদছিলাম।
তাই সে আমার কান্না দেখে গেয়ে উঠল।
তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-
ছল-ছল চোখে চেয়ো না,
জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না।
ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু
বিদায়ের গান গেয়ো না,
শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।।
হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার
সারা জীবনের বেদনা,
আজো তবে শুধু হেসে যাও,
আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখি,
আজ শুধু হেসে যাও
আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
সে আমার পাশে বসে আরো বলতে লাগল,
যদি বউ সাজ গো, আরো সুন্দর লাগবে
গো...।
ইত্যাদী নানান গীত আর কবিতা শুনাচ্ছিল,
তার ফাজলামি আজ আমার কেন জানি খুব
ভালো লাগতেছিল। অবশেষে আমাকে
বিয়ের সাজে সজ্জিত করা হল। মুর্তির মত আমি
বসে রইলাম। সবাই আমাকে নিয়ে রং তামাশা
করতেছে। জুম্মার নামাজের পর আমার
আক্বদ হবে। আর আক্বদ মসজিদেই হবে।
তাই পুরুষরা সবাই মসজিদে চলে গেল।
*
বর যাত্রীরা যথা সময়ে এসে হাজির। পুরুষরা
মসজিদেই থেকে গেল, আর মহিলা যে ৫-৬
জন এসেছিল, তারা বাড়িতেই আসল।
নামাজ শেষে আরম্ভ হল, আমার আকদের
অনুষ্টান। বিয়ের আকদ সম্পন্ন করলেন,
মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লাম মুফতি নুহাইর
জালালাবাদী হাফিযাহুল্লাহ। উনার একটা বৈশিষ্ট হল,
উনি আকদ সম্পন্ন করার আগে মোহরের
বিষয়টি পরিষ্কার করে তার পর বিয়ে পড়ান। সে
অনুযায়ী পাত্র পক্ষকে জিজ্ঞেস করলেন
আপনারা কত টাকা মোহর দিবেন? বলা হল,
মোহরে ফাতিমী দেয়া হবে। হুজুর আবার
জিজ্ঞেস করলেন নগদ তো? বর পক্ষ
থেকে বলা হল, হ্যাঁ নগদ আদায় করা হবে।
এবার হুজুর বললেন, নবী দুহিতা ফাতিমা রাযিঃ এর
জন্য যে মোহর নির্ধারন করা হয়েছিল, তা
অনেকেই সুন্নত স্বরুপ অনুকরন করে
থাকে। নিঃসন্দেহে এতে সুন্নত আদায় হয়।
কিন্তু শুধুমাত্র একে সুন্নত ভাবা ভুল। কেননা
রাসুল সাঃ নিজের বিবাহের মোহর হাজার দু হাজার
দিরহামও নির্ধারন করেছেন, এবং এর থেকে
কমও করেছেন। ফাতিমা রাযিঃ এর বেলায়
৫০০দিরহাম (১৩১তোলা তিন মাশা) নির্ধারন
করেছেন।
উল্লেখ্যঃ= বিবাহের ক্ষেত্রে একটি
উল্লেখ যোগ্য বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে মোহর
নির্ধারণে। এর মূল কারণ মোহরের হাকীকত
সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং বিবাহকে কেবল পার্থিব
দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা। বিবাহের
একটা পারলৌকিক মহিমা আছে আর সে জন্য নর-
নারীর দাম্পত্য জীবন মধুময় হওয়া, পারস্পরিক
সম্পর্ক ভক্তি-শ্রদ্ধাপূর্ণ হওয়া এবং একে
অন্যের
প্রতি আন্তরিক ও বিশ্বস্ত থাকা একান্ত জরুরি।
মোহর নির্ধারণ মূলত সে লক্ষ্যেই। অর্থাৎ
এটা স্বামীর পক্ষ হতে নববধুকে প্রদত্ত
নজরানা।
মোহর কোন বিনিময়মূল্য নয় যে, এর
দ্বারা স্বামী তার স্ত্রীকে কিনে নেয়;
বরং এটা তার শরীআতপ্রদত্ত মর্যাদার
স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি প্রদান ব্যতিরেকে
বিবাহই হয় না। সুতরাং মোহরকে গুরুত্বের
সাথেই
দেখতে হবে। কোন ক্রমেই এর
মহিমাকে খাটো করার অবকাশ নেই।
পরিতাপের বিষয় হল মোহরের এ গুরুত্ব
সমাজের চোখে বলতে গেলে আর
অবশিষ্ট
নেই। এটাও এখন বাণিজ্যীকরণের শিকার। এ
নিয়ে বড় দর কষাকষি। এ ব্যাপারে দুই পক্ষ দুই
প্রান্তিক মানসিকতা পোষণ করে। পাত্র পক্ষ
চায় মোহর কত কম দিয়ে পারা যায়।
পাত্রীপক্ষের জিদ থাকে সর্বোচ্চ
পরিমাণের। এই দর কষাকষিতে অনেক সময়
বিবাহই ভেংগে যায়। আবার অনেক সময় উভয়
পক্ষই সর্বোচ্চ পরিমাণে একমত হয়ে যায়
কেবল বাহাদুরি ফলানোর লক্ষে।
মোটকথা মোহরের ক্ষেত্রে শিথিলতা ও
বাড়াবাড়ি দু’ রকম প্রান্তিকতাই ব্যাপক। মধ্যপন্থা
অবলম্বনের লোক বড় কম।
যারা মোহর কম দিতে চায় তারা একটি হাদীসের
মতলবি ব্যবহার করে।
বলা হয়েছে-
ﺇﻥ ﺃﻋﻈﻢ ﺍﻟﻨﻜﺎﺡ ﺑﺮﻛﺔ ﺃﻳﺴﺮﺓ ﻣﺆﻧﺔ
‘যে বিবাহে খরচা কম হয়, তাই বেশি বরকতপূর্ণ
হয়।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ৬৫৬৬)
তারা খরচা কম বলতে প্রয়োজনীয় খরচারও
সংকোচন বোঝাতে চায়। কিন্তু এটা একটা
মারাত্মক বিভ্রান্তি।
অনুরূপ বিবাহে খরচা কম করার মানে এ নয় যে,
মোহরের পরিমাণ নির্ধারণে স্ত্রীর মর্যাদার
বিষয়টাকেও অগ্রাহ্য করা হবে। বরং তার অর্থ
হচ্ছে স্ত্রীর যথাযথ মর্যাদা রক্ষার
সাথে স্বামীর পক্ষে যা আদায় করা সহজ
সেই
পরিমাণ মোহরের ধার্য করা।
সহজের প্রতি লক্ষ করতে গিয়ে যদি
স্ত্রীর
মর্যাদাকে উপেক্ষা করা হয় এবং এতটা কম মাহর
ধার্য করা হয়, যা স্ত্রীর পক্ষে সম্মানজনক
নয়,তবে তা স্ত্রীর মর্যাদাই খর্ব হয় না,
মোহর ধার্যকরণের শরয়ী বিধানটিরও মহিমা
ক্ষুণ্ণ হয় এবং বিধানটির কাঙ্খিত সুফলও হয় ব্যাহত।
সূচনাতেই যে স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি
যথাযথ
মর্যাদা প্রদর্শন করতে পারল না, পরবর্তীতে
উচ্ছ্বাসে যখন ভাটা পড়বে, সেই সঙ্গে
যুক্ত হবে নানারকম পারিপার্শ্বিকতা, তখন তার
পক্ষ হতে মর্যাদাপূর্ণ আচরণের কতটুকু আশা
রাখা যায়?
এ অবহেলাকে আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন
একজন মানুষ কিছুতেই স্বাভাবিক ভাবে নিতে
পারে না। কম-বেশি আত্মসম্মান বোধ সব
মানুষেরই আছে।
বিশেষত অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন
নিয়ে যে নারী জীবনের নতুন সফরের
সঙ্গীরূপে কাউকে বরণ করল, তার
পক্ষে তো এরূপ অন্যায্যতা সুখকর
হতে পারে না। এতে যে ধাক্কা সে খায়
তাতে তার পরবর্তী গতি আর স্বচ্ছন্দ হয় না,
অন্ততপক্ষে ছন্দময় তো নয়ই। একধরনের
জড়তা ও কুণ্ঠাভাব উভয়ের দিক থেকেই
থেকে যায়, যা তাদের পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়ে
ওঠার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
তাই বলি, মোহর নির্ধারণে একরোখা ভাবে
সহজতার প্রতি দৃষ্টি না রেখে পাত্রীর
মর্যাদাকেও বিবেচনায় রাখা বাঞ্ছনীয়। উভয়
পক্ষ হতেই উভয়ের প্রতি ন্যায্যদৃষ্টি কাম্য।
এটাই মোহর নির্ধারণের মধ্যপন্থা। মোহরের
কাঙ্খিত সুফল এরই মাধ্যমে পাওয়া যায়।
একদিকে সাধ্যানুযায়ী হওয়ার কারণে তা
পরিশোধ সহজ হয়, অন্যদিকে স্ত্রীর
পক্ষে সম্মান জনক হওয়ার কারণে তার
অন্তরে এটা রেখাপাত করবে, সে এর
মূল্যায়ন করবে এবং স্বামীর প্রতি স্বচ্ছন্দ
হবে। এভাবে পরিমিত মাহর নব দম্পতির মধ্যে
মাধুর্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত রচনা করবে।
এর বিপরীত প্রান্তিকতা হল মাত্রাতিরিক্ত
পরিমাণে মোহর নির্ধারণ। এটা যেমন
পাত্রী পক্ষের জেদের কারণে হয়,
তেমনি ক্ষেত্র বিশেষে পাত্র পক্ষেরও
তাতে আগ্রহ থাকে। এরূপ মোহর অধিকাংশ
পরিশোধ করা উদ্দেশ্য থাকে না। উদ্দেশ্য
কেবলই নাম ফলানো ও বাহাদুরি দেখানো এবং
ক্ষেত্র বিশেষে পাত্রপক্ষকে বেকায়দায়
ফেলা।
অর্থাৎ নিয়তই সহীহ নয়। আর আমলের সুফল
পাওয়ার জন্য নিয়ত সহীহ থাকা তো শর্ত।
এখানে নিয়ত যখন সহীহ নয়, তখন
মোহরের কাঙ্খিত সুফলেরও আশা রাখা যায় না;
বরং কুফল অনিবার্য।
আকদ সম্পন্ন হওয়ার পর উপস্থিত সবাইকে
খুরমা-খেজুর খাওয়ানো হল।
অতপর বর যাত্রী সহ আত্নীয় স্বজনরা
বাড়িতে আসলো, যথাসম্ভব সবার
মেহমানদারী করা হল।
এবার এলো বেদনা বিধুর বিদায়ের পালা!!!
বিদায়ের সে কী যে কষ্ট তা ভাষায় প্রকাশ
করার মত নয়। আমাকে যখন গাড়িতে তুলে
দেয়ার নেয়া হচ্ছিল, তখন আমি আম্মাকে
জড়িয়ে ধরে কাদছিলাম, আম্মার চোখ
থেকেও পানি গড়িয়ে পড়তেছিল, বিদায়ের
দৃশ্যটা বড়ই করুন। সবার চোখে আমি
বিদায়ী চাহনী লক্ষ করলাম। আমাকে গাড়িতে
উঠিয়ে দেয়া হল, গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সাথে
সাথেই বিদায়ী কষ্টটা চরম আকার ধারন করল।
গাড়ি গন্তব্যপানে চলতে লাগলো, আমার
চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল,
ফেলে আসা জীবনে স্মৃতি গুলো, কল্পনা
করতে লাগলাম আগত ভবিশ্যতের। এভাবেই
একসময় আমার শান্তি সুখের নতুন নীড়ে
এসে পৌছলাম।
*
পায়ের ঠক ঠক আওয়াজ,ঘোমটার
ফাঁক দিয়ে আঁড় চোখে তাকালাম। দেখলাম
একজন
লোকআসতেছে। তার বেশভুষা আর গঠন
দেখে বুঝলাম উনি আমার স্বামী।
উঠে গিয়ে পায়ে হাত
দিয়ে সালাম করলাম। থাক থাক বলে আমার
বাহুতে হাত দিয়ে তুলে বিছানায়
বসিয়ে দিলেন আমাকে। আর বললেন
তোমার নাম কি ?
খুব ইচ্ছা করছিল বলতে, আমার নাম
না জেনেই বুঝি আমাকে বিয়ে করেছেন।
বললাম: ফাহমিদা
সুন্দর নাম।
কিন্তু নামের অর্থ টা কি ?
মেজাজটা খারাপ হওয়ার উপক্রম।
বললাম:বুদ্ধিমতী
তিনি বললেন আমার
কাছে সাদিয়া নামটা অনেক প্রিয় আর
নামটার অর্থও ভালো তাই আজ
থেকে আমি তোমাকে সাদিয়া
বলে ডাকব।
নাহ !মেজাজটা আর ঠিক
রাখতে পারছি না।
বাসররাতে আমার স্বামী আমার নতুন
ভাবে আকিকা করতেছে।কারো মাথাই ঠিক
থাকার
কথা নয়।
একটু ভারাক্রান্ত স্বরে বললাম: আপনার
যেটা ভালো লাগে সেটাই ডাকিয়েন!
বুঝতে পারছি তোমার মনে হয় খারাপ
লাগছে?তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
ঘুম আসছিল না। রাত গভীর হওয়ায়
কিছুটা ঘুমিয়েও পড়ি।
বাসর রাতের করনীয়ঃ-
পুরুষ বাসর ঘরে প্রবেশ করে স্ত্রীর
কপালের
উপরিস্থিত চুল ধরে বিসমিল্লাহ বলে এই দুআ
পাঠ করা সুন্নাত-
ﺍَﻟﻠّﻬُﻢَّ ﺇِﻧّﻲْ ﺍَﺳْﺄَﻟُﻚَ ﺧَﻴْﺮَﻫَﺎ ﻭَﺧَﻴْﺮَ ﻣَﺎ ﺟُﺒِﻠَﺖْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ,
ﻭَﺃَﻋُﻮْﺫُ
ﺑِﻚَ ﻣِﻦْ ﺷَﺮِّﻫَﺎ ﻭَﺷَﺮِّ ﻣَﺎ ﺟُﺒِﻠَﺖْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ,
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা ওয়া
খাইরা মা যুবিলাত
আলাইহি, ওয়া আউযুবিকা মিন
শাররি হা ওয়া শাররি মা যুবিলাত
আলাইহি।
অতপরউভয়ে একসঙ্গে দুই রাকা‘ত
শুকরানা সালাত আদায় করবে এবং বলবে :
ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺑَﺎﺭِﻙْ ﻟِﻲ ﻓِﻲ ﺃَﻫْﻠِﻲ، ﻭَﺑَﺎﺭِﻙْ ﻟَﻬُﻢْ ﻓِﻲَّ، ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ
ﺍﺭْﺯُﻗْﻨِﻲ ﻣِﻨْﻬُﻢْ ﻭَﺍﺭْﺯُﻗْﻬُﻢْ ﻣِﻨِّﻲ، ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺍﺟْﻤَﻊَ ﺑَﻴْﻨَﻨَﺎ ﻣَﺎ
ﺟَﻤَﻌْﺖَ ﺇِﻟَﻰ ﺧَﻴْﺮٍ، ﻭَﻓَﺮِّﻕْ ﺑَﻴْﻨَﻨَﺎ ﺇِﺫَﺍ ﻓَﺮَّﻗْﺖَ ﺇِﻟَﻰ ﺧَﻴْﺮٍ .
'হে আল্লাহ, আপনি আমার জন্য আমার
পরিবারে বরকত দিন আর আমার ভেতরেও
বরকত দিন পরিবারের জন্য। আয় আল্লাহ,
আপনি তাদের থেকে আমাকে রিযক দিন
আর আমার থেকে তাদেরও রিযক দিন। হে
আল্লাহ, আপনি আমাদের যতদিন
একত্রে রাখেন কল্যাণেই একত্র রাখুন আর
আমাদের মাঝে যখন বিচ্ছেদ
ঘটিয়ে দেবেন তখন কল্যাণের পথেই
বিচ্ছেদ ঘটাবেন।'
স্ত্রীর
সঙ্গে প্রথমে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করবে, তার
পর যখনই সহবাস এর ইচ্ছা হয়, তখন
প্রথমে নিম্নোক্ত দু’আ
পড়ে নিবেঃ “
ﺑِﺴْﻢِ ﺍﻟﻠَّﻪِ، ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺟَﻨِّﺒْﻨَﺎ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥَ،
ﻭَﺟَﻨِّﺐِ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥَ ﻣَﺎ ﺭَﺯَﻗْﺘَﻨَﺎ
(বিসমিল্লাহি আল্লা-হুম্মা জান্নিবনাশ্-
শাইত্বানা ওয়া জান্নিবিশ্-শাইত
্বানা মা রযাকতানা)।
'আল্লাহ্র নামে। হে আল্লাহ!
আপনি আমাদের
থেকে শয়তানকে দূরে রাখুন
এবং আমাদেরকে আপনি যে সন্তান দান
করবেন
তার থেকেও শয়তানকে দূরে রাখুন।"
(উপরোক্ত দোয়া না পড়লে শয়তানের
তাছীরে বাচ্চার উপর কু-প্রভাব পড়ে।
অতঃপর
সন্তান বড় হলে, তার
মধ্যে ধীরে ধীরে তা প্রকাশ
পেতে থাকে এবং বাচ্চা নাফরমান ও
অবাধ্য হয়।
সুতরাং খুবই সতর্ক থাকা জরুরী।
শেষ রাতে ঘুমটা ভাঙ্গল গুন গুন আওয়াজে।
কান
খাড়া করে আওয়াজটা শুনতে
চেষ্টা করলাম। বুঝলাম কেউ কোরআন
পড়ছে।
তাকিয়ে দেখলাম আমার স্বামী। তার সমধুর
কন্ঠে কোরআন তিলাওয়াত শুনতে ভালই
লাগছিল। তাই একটু উঠে বসলাম।
আমাকে উঠে বসতে দেখে তিলাওয়াত বন্ধ
করে বললেন,
আসসালামু আলাইকুম। শুভ সকাল!
ঘুমটা কেমন হলো ?
জবাব দিয়ে বললাম : জীঁ ভাল হয়েছে।
এভাবেই কাটলো দিনটি।
পরদিন ওয়ালীমা হল.
বিবাহ ইসলামের অন্যতম
প্রধান সামাজিক বিধান
এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক গুরুত্বপূর্ণ
সুন্নত।
মানবসভ্যতার জন্য অপরিহার্য ও
অতি কল্যাণময় এ
ব্যবস্থাটিকে স্বভাবধর্ম ইসলাম খুবই
সহজসাধ্য
করেছে, যাতে এর কল্যাণ থেকে কেউ
বঞ্চিত না হয় এবং সর্বস্তরের মানুষই এর
সুফল
ভোগের সুযোগ পায়। সুতরাং এর জন্য খুব
বেশি আচার-বিচার, উদ্যোগ-আয়োজন ও
জাঁকজমকের দরকার হয় না। নেই কঠিন কোন
শর্ত ও নেই বিশাল কোন খরচ। খরচ
বলতে কেবল স্ত্রীর মোহর।
আর আচার-অনুষ্ঠান বলতে কেবল
সাক্ষীদের সামনে বর-কনের পক্ষ
হতে ইজাব-কবূল । ব্যস এতটুকুতেই বিবাহ
হয়ে যায়।
বাসর রাতের পর স্বীয় আত্মীয় স্বজন,
বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাংখী এবং গরীব
মিসকীনদের
তাউফীক অনুযায়ী ওলীমা খাওয়ানোর
আয়োজন করা সুন্নত।
ওলীমায় অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা খুব উচু
মানের খানার ব্যবস্থা করা জরুরী নয়।
বরং সামর্থানুযায়ী খরচ করাই সুন্নত
আদায়ের জন্য
যথেষ্ট।
ওলীমা করা সুন্নত ও পুণ্যের
কাজ বটে, কিন্তু বিবাহ সিদ্ধ হওয়ার জন্য
তা শর্ত
নয় । এছাড়া প্রচলিত কিছু কাজ কেবলই
জায়েয
পর্যায়ের। তা করা না করা সমান। করলেও
কোন
অসুবিধা নেই, না করলেও দোষ নেই।
কেননা বিবাহ শুদ্ধ হওয়া-
না হওয়া কিংবা উত্তম-অনুত্তম
হওয়ার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
কিন্তু আফসোস, মানুষ এমন কল্যাণকর অথচ
সহজসাধ্য একটা বিষয়কে চিন্তা- চেতনা ও
ব্যবহারিক
বাড়াবাড়ির কঠিন গেড়াকলে আবদ্ধ
করে ফেলেছে। যদ্দরুন সাধের বিবাহ আজ
রীতিমত একটি আতঙ্কের নাম।
আমার জীবন হয়ে উঠলো সুখময়। আমার
নতুন
ঠিকানা যেন এক সুখের নীড়। দিন
গুলো সুখে শান্তিতে কাটতে লাগল,
এর মাঝে উনি আমাকে উনার
তাবলীগে যাওয়ার বিভিন্ন
কাহিনী শুনাতেন। যে,আমি নিজেই খুব
অবাক
হয়ে যেতাম।
তিনি বললেন উনার আম্মা সব সময়
উনাকে নামাজের তাকিদ দিতেন।
তাবলীগে সময় লাগানোর কথা বলতেন, তাই
তিনি আমার শাশুড়ির সব চেষ্টাকে সফল
করে একদিন তাবলীগে চিল্লার উদ্দেশ্য
বের হলেন, চিল্লায় গিয়ে মনের
মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলো,
তিনি নামাজ
পড়া শুরু করলেন। বাড়িতে ফেরার পর উনার
আম্মু উনার মুখে দাড়ি দেখে অনেক
খুশি হলেন,
নামাজ ৫ ওয়াক্ত ফরজ হলেও
বাড়িতে এসে ৪ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন।
ফজরের নামাজ পড়তে পারতেন না খুব
আলসেমি লাগত। উনি বললেন আম্মু
প্রতিদিন ফজরের সময়
আমাকে ডাকতেন,শুনেও
জাগতাম না। আম্মু বুঝতেন
যে,আমি ইচ্ছা করেই উঠি না। তাই
আমাকে কাছে ডেকে পাশে
বসিয়ে বললেন:
দেখো তুমি এভাবে প্রতিদিন ৮
ঘন্টা করে ঘুমাও,তাহলে দিনের ৩ ভাগের ১
ভাগ তুমি ঘুমিয়ে কাটাচ্ছ। যদি তোমার
আয়ুষ্কাল ৬০ বছর ধরা হয়, তাহলে তুমি ৩
ভাগের এক ভাগ মানে ২০ বছর
ঘুমিয়ে কাটিয়েছো।
আল্লাহ তো তোমাকে এই দীর্ঘ সময়
ঘুমিয়ে কাটাতে পৃথিবীতে পাঠান নি।
আরোও অনেকগুলো ভাল ভাল কথা
শুনালেন।
এত ভালকথা শুনিয়েছিলেন
যে,শুনে আমার
চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমি ১ ওয়াক্ত
নামাজও কাঁযা করিনি। সর্বদাই ধর্মীয়
অনুশাসন মেনে চলি।
আজ আমি অনুতপ্ত নই,গর্ববোধ করি আমার
স্বামীর জন্য। সত্যিই আমি খুব ভাগ্যবতী।
আলেম স্বামী না পেয়ে তবুও সুখে আছি।
আসল কথা হলো, মাদরাসায় পড়াশুনা করলেই
কেউ ভদ্র হয়ে যায় না। আবার স্কুলে
পড়লেই
খারাপ হয়ে ওঠে না। একথা সত্য যে,
পরিবেশ মানুষকে সভ্যতা, ভদ্রতার
সবক্ব দেয়। কিন্তু কিছু দুর্ভাগা উত্তম
পরিবেশের
সৌভাগ্যকে উপেক্ষা করে ঠিকই
অসভ্য হয়ে ওঠে। আবার বিরূপ
পরিবেশে অবস্থান করেও অনেকে সেই
মহান পথের যাত্রী হয়ে যায়,
যে পথকে স্রষ্টা তাঁর প্রিয় বান্দাদের
জন্য নির্ধারণ করেছেন। সত্যি বলতে,
আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ছাড়া শত
চেষ্টা সত্ত্বেও কেউ সঠিক পথের
অনুসারী হতে পারবে না। হে আমার রব!
আমাদের সরল পথে চলার তৌফিক দান
করো।
*****সমাপ্ত*****
--------------- লেখকঃ জুবাইর জালালাবাদী
বিষয়: বিবিধ
২৪১৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লিখটা ভাল হয়েছে ধন্যবাদ ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন