ইসলাম ও যৌনসমস্যা নিয়ে খোলা মেলা আলোচনা

লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ০৪ আগস্ট, ২০১৭, ১১:০২:৫৮ রাত



পাক সংক্রান্ত চিরন্তন ধারণা

পাশ্চাত্যের মনস্তাত্বিক বিশেষজ্ঞরা ধর্মের বিরুদ্ধে একটি অপবাদ দিয়ে থাকে যে, উহা মানুষের জীবনীশক্তিকে নির্মূল করার শিক্ষা দেয় এবং পরিশেষে তাকে চিরন্তন পাপবোধের এমন গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত করে দেয় যে, যেখানে থেকে সে প্রতিটি কাজকেই পাপের কাজ বলে মনে করতে থাকে। আর তখন তার সামনে প্রায়শ্চিত্তের একটি মাত্র পথই খোলা থাকে –সে পথটি হলো জীবনের সকল আনন্দ ও খুশীকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা। তাদের এ দাবীর সমর্থনে তারা এ-ও বলে থাকে যে, ইউরোপ যতদিন ধর্মের অক্টোপাসে বন্দী হয়ে রয়েছে ততদিন মূঢ়তার গভীর অন্ধকার চতুর্দিক থেকেই তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছিল। কিন্তু যখন তারা ধর্মীয় স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্তিলাভ করে তখন তাদের আশা-আকাংখায় উন্নত চিন্তাধারার অবরুদ্ধ সয়লাব পুনপ্রবাহিত হতে শুরু করে এবং শুষ্কভূমিতে আবার বসন্তের আবির্ভাব ঘটে।

ধর্মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন

মনস্তাত্বিক পণ্ডিতরা বেশীর ভাগ সময়ে প্রশ্ন করে বসে: তোমরা কি আমাদেরকে ধর্মেরদিকে ফিরে যেতে বল? তোমরা কি আমাদের প্রগতির পথে পুনরায় ধর্মীয় বিশ্বাসের পাহাড় রচনা করতে চাও? তোমরা কি কামনা কর যে, আমাদের প্রতিশ্রুতিশীল প্রজন্মকে পদে পদে বাধা দিয়ে নির্জীব পাষাণ করে তুলবো? নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের লোকদের এই হলো মৌলিক প্রশ্ন। কিন্তু যেহেতু এখানে ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, বরং একমাত্র ইসলামই আমাদের আলোচ্য বিষয়। সেহেতু আমরা তাদের ধারণা সঠিক, না ভুল সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। বরং যৌন সমস্যা সম্প্ক ইসলামের দৃষ্টিভংগি কি সে সম্বন্ধে আলোচনা করার পূর্বে দেখব, যৌন স্পৃহার দমন (Sexual Repression) বলতেই বা কি বুঝায়? কেনা দেখা যায়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই এর ভুল অর্থ করে এবং বিভিন্ন অবস্থায় একে খাপ খাইয়ে নেয়ার ব্যাপারেও ভুল পথ অনুসরণ করে।

যৌন স্পৃহা দমনের সঠিক মর্ম

যৌন স্পৃহা দমন (Sexual Repression) যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকার নাম নয়। বরং যৌন ক্রিয়াকে জঘন্য ও চরম ঘৃণার্হ কাজ বলে মনে করাই হচ্ছে এর সঠিক অর্থ। -এতদূর জঘন্য ও ঘৃণার্হ বলে মনে করা যে, কোন সভ্য বা ভদ্র ব্যক্তিই এর কল্পনা করাকেও পাপ বলে বিশ্বাস করে। এই অর্থে যৌন স্পৃহা দমন মানুষের অজ্ঞাতসারে এক প্রকার উপলব্ধি হিসেবে বিরাজ করতে থাকে; যৌন ক্রিয়ার বারবার পুনরাবৃত্তিও উহাকে নির্মূল করতে পারে না। যে ব্যক্তি যৌন স্পৃহা দমনের শিকার হয় সে প্রকৃতির হাতে বন্দী হয়ে যৌন ক্রিয়ায় তো অবশ্যই লিপ্ত হয়। তবে উহাকে অপবিত্র ও লজ্জাকর মনে করেই লিপ্ত হয়। এমন ব্যক্তি যদি প্রতিদিন বিশ বারও এই ক্রিয়ায় লিপ্ত তবুও সে যৌন রোগী বলে সাব্যস্ত হবে। এবং যখনই সে এই ক্রিয়ায় লিপ্ত হবে তখন তার মনে এই দ্বন্দ্ব উপস্থিত হবে যে, তার করণীয় কি ছিল এবং সে কী করে ফেলেছে। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সংঘটিত এই মানসিক দ্বন্দ্বের ফলে বিভিন্ন মনস্তাত্বিক বিভ্রাট ও ব্যাধি সৃষ্টি হতে থাকে।

ফ্রয়েডের সাক্ষ্য

কেউ যেন এরূপ ধারণা না করে যে, যৌন স্পৃহা দমন কিংবা উহাকে বর্জন করার এই সংজ্ঞা গ্রন্থকার নিজেই মনগড়াভাবে উপস্তাপিত করেছেন।এরূপ ধারণা সঠিক নয়। কেননা যৌন স্পৃহা দমনের এই সংজ্ঞা ও অর্থ ফ্রযেডের নিকট থেকেই গ্রহণ করেছি –যে সারা জীবন ধর্মকে এই বলে বিদ্রূপ করেছে যে, উহা মানুষের কর্মশক্তিকে নির্মূল করে দেয় এবং যাবতীয় কাজ ও কর্ম-চাঞ্চল্য থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। সে তার Three contributions to sexual Theory’ নামক গ্রন্থের ৮২ পৃষ্ঠায় বলেছে: “যৌন স্পৃহা দমন ও যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকার মধ্যে –যাকে এ কাজের অস্থায়ী বিরতি বলা চলে –পার্থক্য করা প্রয়োজন।”

ইসলামের দৃষ্টিভংগি

যৌন স্পৃহার দমন যৌন ক্রিয়াকে অত্যন্ত ঘৃণার্হ মনে করার অনিবার্য ফল; এর সাথে যৌন ক্রিয়ার অস্থায়ী বিরতির কোন দূরতম সম্পর্কও বর্তমান নেই। -একথা শোনার পর এখন আসুন, এ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি কি তাও আমরা যাচাই করে দেখি।

ইসলাম মানুষের প্রকৃতিকে সমর্থন করে

একমাত্র ইসলাম ছাড়া দুনিয়ার এমন কোন ধর্মকেই যা মানুষের প্রাকৃতিক প্রেরণা ও সহজাত প্রবৃত্তিকে পবিত্র বলে সাব্যস্ত করে এবং উহার যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা করতে অগ্রসর হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:

(আরবী***********)

“মানুষের জন্যে চিত্তাকর্ষক নারী, সন্তান-সন্ততি, সোনা-রূপার স্তুপ, চিহ্নিত অশ্ব, চতুষ্পদ জন্তু এবং চাষযোগ্য ভূীমকে অত্যন্ত আনন্দদায়ক বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে।” –(সূরা আলে ইমরান: ১৪)

আল্লাহর এই বাণী মানুষের মনের আনন্দদায়ক সবকিছুকে উল্লেখ করে উহার বাস্তবতাকে সম্পূর্ণরূপেই সমর্থন করছে। এই আয়অতে না উহার কোনটির বিরুদ্ধে আপত্তি তোলা হয়েছে, না মানুষের প্রবৃত্তি ও প্রেরণাকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে।

প্রবৃত্তির দাসত্বের প্রতি ভর্ৎসনা

একথা ঠিক যে, ইসলাম প্রবৃত্তির দাসত্বকে কখনো পসন্দ করে না এবং মানুষ এ ব্যাপারে অত্যধিক ঝুঁকে পড়ুক –এটাও ইসলামেরকাম্য নয়। কেননা এরূপ হলে জীবনের সমস্ত নিয়ম-কানুনই ব্যর্থ হতে বাধ্য। মানুষের লক্ষ্য হলো সার্বক্ষণিক প্রগতি ও কল্যাণ। কিন্তু মানবতার উপর কুপ্রবৃত্তি ও জৈবিক লালসার শাসন যতদিন অব্যাহত থাকবে ততদিন এই কল্যাণের আশা করা নিছক বাতুলতা মাত্র। কেননা এটা মানবীয় শক্তিসমূহের উৎসকেই ধ্বংস করে দেয় এবং মানুষকে পশুত্বের সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে দেয়।

প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ ও যৌন স্পৃহা দমনের মধ্যে পার্থক্য

ইসলাম কখনো চায় না যে, মানুষ অধপতনের শেষ সীমায় পৌঁছুক এবং পাশবিকতার শিকারে পরিণত হোক। কিন্তু এই মহান উদ্দেশ্য ও যৌন স্পৃহা দমন তথা জৈবিক প্রেরণাকে নির্মূল করার মধ্যে আসমান-জমিনের পার্থক্য বর্তমান। যৌন স্পৃহা দমনের নামে যৌন স্পৃহা এবং উহার সংশ্লিষ্ট প্রবৃত্তির লালসা ও জৈবিক প্রেরণাকে ঘৃণিত ও অপবিত্র মনে করে চিরপ্রচলিত পবিত্রতা ও আত্মিক উন্নতির মূলে যে কুঠারাঘাত করা হচ্ছে তা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না।

সামাজিক কল্যাণ ও প্রবৃত্তি

মানুষের আত্মিক পবিত্রতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইসলাম নীতিগতভাবেই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে সমর্থন করে। অজ্ঞাতসারে উহাকে নির্মূল করার শিক্ষা ইসলাম কখনো দেয় না বরং বাস্তব জীবনে উহার কার্যকারিতাকে পুরোপুরিই সমর্থন করে যাতে করে এক যুক্তিসম্মত গণ্ডির মধ্যে মানুষ আনন্দ ভোগ করতে পারে অথচ অন্য কোন ব্যক্তি বা সমাজ তার কারণে দুঃখত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বস্তুত এ সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, যে ব্যক্তি সদাসর্বদা কামরিপু চরিতার্থ করার পেছনে লেগে থাকে তার যাবতীয় দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতা অনেক আগেই নিশেষ হয়ে যায়। জৈবিক লালসার রঙীন বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে সে অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। প্রবৃত্তি লালসা ছাড়া অন্য কিছ সে চিন্তাই করতে পারে না।

যখন কোন সমাজের সকল মানুষের যোগ্যতা ও শক্তি-সামর্থ এই জৈবিক লালসা চরিতার্থ করার পেছনে ব্যয়িত হতে থাকে তখন সেই সমাজটিই ব্যধিগ্রস্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। কেননা আল্লাহ প্রদত্ত আইন-কানুনের বিরোধিতা করে এই নির্বোধ ব্যক্তিরা নিজেদের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে সমস্ত বিভাগ গঠন করার পরিবর্তে কেবলমাত্র একটি তুচ্ছ বিভাগের জন্যেই উহাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে পারিবারিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং সমাজ জীবনে নেমে আসছে দারুণ অস্থিরতা ও বিপর্যয়। অতপর সমাজ জীবনের যে অবস্থা ঘটে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

(আরবী**********)

“তুমি তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ ধারণা করছো অথচ তাদের মন বিভিন্নমুখী।” –(সূরা আল হাশর: ১৪)

এই অবস্থা একটি জাতির ঠিক তখনই উপলব্ধি করা যায় যখন অন্য কোন জাতি তাদেরকে আক্রমণ করে জগতের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত হয়। আধুনিক ফ্রান্সের ইতিহাস দ্বারা ইহা অকাট্যরূপে প্রমাণিত হয়।

ইসলাম মানুষকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে না

ইসলাম মানুষের জীবনে যে কিছু সংখ্যক শর্ত আরোপ করেছে তার উদ্দেশ্য হলো: ব্যক্তিগত স্বাধীনতা যেন অন্য কোন ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজের কোন প্রকার ক্ষতিসাধন না করেই জীবনের সকল প্রকার আনন্দ উপভোগ করতে পারে। শুধু এখানেই শেষ নয়, ইসলাম অত্যন্ত স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মানুষকে আনন্দ লাভ করার জন্যে আহ্বান জানাতেও দ্বিধা করেনি। কিছু সংখ্যক আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করুন:

(আরবী*********)

“(হে মুহাম্মাদ!) তাদেরকে বলুন, আল্লাহর সেই সৌন্দর্যকে কে হারাম করে দিল যা তিনি তার বান্দাদের জন্যে বের করে দিয়েছেন এবং আল্লাহর দেয়া পবিত্র জিনিসগুলোকেই বা কে নিষিদ্ধ করেছিল?” –(সূরা আল আ’রাফ: ৩২)

(আরবী*********)

“এবং দুনিয়া থেকে তোমার নিজের অংশ ভুলে যেয়ো না।” –(সূরা আল কাসাস: ৭৭)

(আরবী********)

“আমি তোমাদেরকে যে পবিত্র বস্তু দিয়েছি তা আহার কর।” –(সূরা আল আ’রাফ: ১৬০)

(আরবী********)

“আহার কর, পান কর এবং সীমালংঘন করো না।” –(সূরা আল আ’রাফ: ৩১)

যৌন স্পৃহার গুরুত্ব

ইসলাম এতদূর স্পষ্ট ভাষায় যৌন সম্পর্কের গুরুত্বকে স্বীকার করে যে, বিশ্বনবী (স) এরশাদ করেন:

(আরবী********)

“তোমাদের দুনিয়ায় আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় হলো সুগন্ধি ও স্ত্রী জাতি, আর আমার চোখের জন্যে শীতলকারক হচ্ছে নামায।” [তাফসীরে ইবনে কাসীর]

এই হাদীসে স্ত্রী জাতিকে দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধির সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। অধিকন্তু যে নামায আল্লাহর নৈকট্যলাভের সবচেয়ে বড় মাধ্যম তার সাথে সাথেই এই স্ত্রী জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আরেকটি উপলক্ষে হযরত বিশ্বনবী (স) যখন বলেছিলেন: “স্ত্রীর সাথে মিলিত হলেও মানুষকে সওয়াব দেয়া হয়।” তখন মুসলমানগণ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন: “কামরিপু চরিতার্থ করলেও কি মানুষ সওয়াব পায়?” হযরব বিশ্বনবী (স) তখন উত্তরে বলেছিলেন: তোমরা কি এটা দেখ না যে, কেউ যদি অবৈধ পন্থায় এই কামরিপ চরিতার্থ করে তাহলে তার পাপ হয়, তাহইতো যখন সে বৈধ পন্থায় উহা চরিতার্থ করে তখন তার সওয়াব হয়।” [আল মুসলিম]

মোটকথা, ইসলামী বিধান অনুযায়ী ‘যৌন স্পৃহা দমন’ নামে কোন প্রকার দমনই থাকতে পারে না। তারণ্যের উচ্ছলতায় যখন যৌন স্পৃহা পুরোমাত্রায় জাগ্রত হয় তখন উহাকে নিকৃষ্ট বলার কোন কারণ থাকতে পারে না। আ এমন কোন প্রয়োজনও নেই যে, যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করাকে ঘৃণিত কাজ বলে মনে করবে এবং উহাকে দুর্বল বা নির্মূল করার জন্যে সচেষ্ট হবে।

তরুণদের নিকট ইসলামের দাবী

ইসলাম তরুণদের নিকট একটি মাত্র দাবী করে। আর সেটি হলা: নিজ নিজ যৌন স্পৃহাকে গলাটিপে মারার পরিবর্তে উহাকে লাগাম পরিয়ে দিতে হবে, নিজের ইচ্ছা ও মননশক্তির সাহায্যে উহাকে সুনিয়ন্ত্রিত করে কাজে লাগাতে হবে। অন্য কথায়, যেন স্পৃহাকে নির্মূল বা দমন করে রাখার পরিবর্ত উহাকে চরিতার্থ করার যথোপযুক্ত ও যুক্তিসম্মত সুযোগ না হওয়া পর্যন্ত উহাকে স্থগিত করে রাখতে হবে। এই প্রকার সাময়িক বিরতি ফ্রয়েডের মতেও ‘যৌন স্পৃহা দমনের’ সমার্থক নয়। এতে করে যৌন স্পৃহা দমনের ফলশ্রুতি স্বরূপ যে দৈহিক দিক হলো শিরা-উপশিরায় বিভিন্ন অসুবিধার সৃষ্টি হওয়া এবং মানসিক ক্ষতির দিক হলো নানা প্রকার মনস্তাত্বিক বিকার ও ব্যধির সূত্রপাত হওয়া।

প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার মূল লক্ষ্য

ইসলাম প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার যে দাবী করছে তা নিছক কোন প্রশাসনিক ফরমান নয়; বরং তার পেছনে রয়েছে গভীর প্রজ্ঞা ও প্রভূত কল্যাণ। উহার লক্ষ্য জীবনের আনন্দ ও স্ফূর্তি থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা নয়। বরং সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপনের জন্যে মানুষকে উপযুক্তরূপে গড়ে তোলা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, যে জনগোষ্ঠী কুপ্রবৃত্তি ও জৈবিক লালসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং প্রয়োজনের মুহূর্তেও আমোদ-প্রমোদ ও জৈবিক ভোগ-বিলাস বর্জন করতে ব্যর্থ হয়ে যায় সে জনগোষ্ঠীর নিকট থেকে নেতৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়। অনুরূপভাবে বিশ্বের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সাফল্য ও নেতৃত্ব কেবল সেই জাতিই লাভ করে যারা যাবতীয় বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করার ক্ষমতা রাখে এবং দরকারবোধে আমোদ-প্রমোদ ও আনন্দ-উল্লাসকে শুধু ঘন্টা বা দিন নয় বরং বছরের পর বছর ধরে বর্জন করে চলতে পারে। ইসলামে রোযার বিধান এ জন্যে করা হয়েছে।

বিভ্রান্তির শিকার ও ইসলাম

কিছু সংখ্যক “স্বাধীনচেতা” লেখক-লেখিকা রোযা সম্পর্কে এমন ভংগিতে কথা বলে যে, মনে হয় তারা গভীল কোন তত্ত্ব বা রহস্য আবিষ্কার করে ফেলেছে। এরা বলে: “রোযা-কি যে এক ধোঁকা। কিছু অর্থহীন হুকুমের অজুহাতে মানুষকে পানাহার থেকে বঞ্চিত রাকার অর্থ কি? বিশেষ করে যখন সে হুকুমের মধ্যে যুক্তির কোন বালাই নেই এবং উহার অনুসরণ কোন কল্যাণকর উদ্দেশ্যও সাধিত হওয়ার কোন পথ নেই।”

বিভ্রান্তির চরম প্রেমিক এই সকল ব্যক্তির নিকট আমাদের নিবেদন: তারাই বা কেমন লোক যারা কোন মহান উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যে মাত্র কয়েকটি ঘন্টার জন্যেও নিজেদের জৈবিক লালসার মুখে লাগাম পরাতে পারে না। প্রবৃত্তির এই সকল দাসানুদাস কস্মিনকালেও মানবতার কোন কল্যাণ করতে পারে না। যারা নিজেদের আনন্দ-স্ফূর্তিকে ক্ষণিকের জন্যে বর্জন করতে অপারগ তারা কখনো হকের সহযোগিতা ও বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যেও অদম্য সাহস, সহিষ্ণুতার প্রয়োজন তা দেখাতে পারে না। এবং পারে না বলেই ধ্বংস তাদের জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

সমাজতন্ত্রীদের তেলেসমাতি

রাশিয়ার সমাজতন্ত্রীরা যদি নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রাণান্তকর বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার উপযুক্ততা অরজন করতে না পারতো তাহলে স্টেলিন গ্রাডে কখনো একযোগে লড়া করতে সক্ষম হতো না। কিন্তু একথা জানা সত্ত্বেও ইসলামী দুনিয়ায় যে সকল সমাজতন্ত্রী অত্যধিক সোচ্চার তারা রোযা এবং অন্যান্য ইসলামী অনুষ্ঠান নিয়ে উপহাস করে থাকে। যার একমাত্র লক্ষ্য হলো প্রবৃত্তিকে সুনিয়ন্ত্রিত করা। এ কোন আজব কাণ্ড যে, সমাজতনেত্রর ধ্বজাধারীরা তাদের রাষ্ট্রের অর্থাৎ তাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শাসনক্ষমতার জন্যে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করার জন্যে সচেষ্ট; অথচ যখন রাষ্ট্র ও সমস্ত প্রাণীজগতের স্রষ্টা আল্লাহর নামে উক্ত প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করার দাবী করা হয় তখন তারা একেবারে অস্থির ও মতিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং বেশ হৈচৈ শুরু করে দেয়।

অনুগ্রহ ও ক্ষমার দ্বীন

একথাও বলা হয় যে, ধর্ম তার অনুসারীদের মনে চিরন্তন গোনাহগার হয়ে থাকার ধারণাকে বদ্ধমূল করত তাদের জীবনকে নিরানন্দ ও তিক্ততায় ভরে দেয়। আর এই গোনাহর ধারণা একটি শক্তিশালী ভূত হয়ে তাদের মন ও মস্তিষ্কের উপর সওয়ার হয়ে বসে। কোন কোন ধর্মের ক্ষেত্রে কথাটি সঠিকও হতে পারে; কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে কথাটি আদৌ প্রয়োজ্য নয়। কেননা ইসলাম এমন একটি দ্বীন যাতে শাস্তি ও জাহান্নামের চেয়ে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে অনেক বেশী।

পাপের সঠিক ধারণা

ইসলামের মতে পাপ এমন কোন ভূত নয় যা সর্বদা মানুষের স্কন্ধ সওয়ার হয়ে থাকবে। এবং এমন কোন চিরন্তন ছায়া বা অন্ধকারও নয় যার গণ্ডিতে মানুষ সারা জীবন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘুরতে থাকবে এবং বাইরে বেরুবার কোন পথই খুঁজে পাবে না। হযরত আদম (আ)-এর যে ত্রুটিটুকু হয়েছিল তা উন্মুক্ত তরবারির ন্যায় মানুষের মাথার উপর ঝুলন্ত অবস্থায় নেই এবং উহার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্যে আমাদের অতিরিক্ত কোন প্রায়শ্চিত্তেরও প্রয়োজন নেই। আল্লাহ বলেন:

﴿الٓمّٓ ‌ۚ‏﴾

১.) আলিফ লাম মীম।১

১) এগুলো বিচ্ছিন্ন হরফ।{audio}audio/001.mp3{/audio} কুরআন মজীদের কোন কোন সূরার শুরুতে এগুলো দেখা যায়। কুরআন মজীদ নাযিলের যুগে সমকালীন আরবী সাহিত্যে এর ব্যবহার ছিল। বক্তার বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সাধারণত এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল। বক্তা ও কবি উভয় গোষ্ঠীই এ পদ্ধতির আশ্রয় নিতেন। বর্তমানে জাহেলী যুগের কবিতার যেসব নমুনা সংরক্ষিত আছে তার মধ্যেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সাধারণভাবে ব্যবহারের কারণে এ বিচ্ছিন্ন হরফগুলো কোন ধাঁধা হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এগুলো এমন ছিল না যে, কেবল বক্তাই এগুলোর অর্থ বুঝতো বরং শ্রোতারাও এর অর্থ বুঝতে পারতো। এ কারণে দেখা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমকালীন বিরোধীদের একজনও এর বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়নি। তাদের একজনও একথা বলেনি যে, বিভিন্ন সূরার শুরুতে আপনি যে কাটা কাটা হরফগুলো বলে যাচ্ছেন এগুলো কি? এ কারণেই সাহাবায়ে কেরাম ও নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এগুলোর অর্থ জানতে চেয়েছেন এ মর্মে কোন হাদীসও উদ্ধৃত হতে দেখা যায়নি। পরবর্তীকালে আরবী ভাষায় এ বর্ণনা পদ্ধতি পরিত্যক্ত হতে চলেছে। ফলে কুরআন ব্যাখ্যাকারীদের জন্য এগুলোর অর্থ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে একথা সুস্পষ্ট যে, কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করা এ শব্দগুলোর অর্থ বুঝার ওপর নির্ভরশীল নয়। অথবা এ হরফগুলোর মানে না বুঝলে কোন ব্যক্তির সরল সোজা পথ লাভের মধ্যে গলদ থেকে যাবে, এমন কোন কথাও নেই। কাজেই একজন সাধারণ পাঠকের জন্য এর অর্থ অনুসন্ধানে ব্যাকুল হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

﴿ذٰلِكَ الۡڪِتٰبُ لَا رَيۡبَ‌‌‌ۖ ‌ۚ‌ۛ فِيۡهِ‌‌ۚ‌ۛ هُدًى لِّلۡمُتَّقِيۡنَ ۙ‌‏﴾

২.) এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই।২ এটি হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকী’দের জন্য৩

২) এর একটা সরল অর্থ এভাবে করা যায় “নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহর কিতাব।” কিন্তু এর একটা অর্থ এও হতে পারে যে, এটা এমন একটা কিতাব যাতে সন্দেহের কোন লেশ নেই। দুনিয়ায় যতগুলো গ্রন্থে অতি প্রাকৃত এবং মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞান বহির্ভূত বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো সবই কল্পনা, ধারণা ও আন্দাজ–অনুমানের ভিত্তিতে লিখিত হয়েছে। তাই এ গ্রন্থগুলোর লেখকরাও নিজেদের রচনাবলীর নির্ভুলতা সম্পর্কে যতই প্রত্যয় প্রকাশ করুক না কেন, তাদের নির্ভুলতা সন্দেহ মুক্ত হতে পারেনা। কিন্তু এ কুরআন মজীদ এমন একটি গ্রন্থ যা আগাগোড়া নির্ভুল সত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ। এর রচয়িতা হচ্ছেন এমন এক মহান সত্তা, যিনি সমস্ত তত্ত্ব ও সত্যের জ্ঞান রাখেন। কাজেই এর মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। মানুষ নিজের অজ্ঞতার কারণে এর মধ্যে সন্দেহ পোষণ করলে সেটা অবশ্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা এবং সেজন্য এ কিতাব দায়ী নয়।

৩) অর্থাৎ এটি একেবারে একটি হিদায়াত ও পথ নির্দেশনার গ্রন্থ। কিন্তু এর থেকে লাভবান হতে চাইলে মানুষের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক গুণ থাকতে হবে। এর মধ্যে সর্বপ্রথম যে গুণটির প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, তাকে “মুত্তাকী” হতে হবে। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা তার মধ্যে থাকতে হবে। তার মধ্যে মন্দ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ও ভালোকে গ্রহণ করার আকাঙ্খা এবং এ আকাঙ্খাকে বাস্তবায়িত করার ইচ্ছা থাকতে হবে। তবে যারা দুনিয়ায় পশুর মতো জীবন-যাপন করে, নিজেদের কৃতকর্ম সঠিক কি না সে ব্যাপারে কখনো চিন্তা করে না, যেদিকে সবাই চলছে বা যেদিকে প্রবৃত্তি তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অথবা যেদিকে মন চায় সেদিকে চলতে যারা অভ্যস্ত, তাদের জন্য কুরআন মজীদে কোন পথ নির্দেশনা নেই।

﴿ الَّذِيۡنَ يُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَيۡبِ وَيُقِيۡمُوۡنَ الصَّلٰوةَ وَمِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ يُنۡفِقُوۡنَ﴾

৩.) যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে,৪ নামায কায়েম করে৫ এবং যে রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।৬

৪) কুরআন থেকে লাভবান হবার জন্য এটি হচ্ছে দ্বিতীয় শর্ত। ‘গায়েব’ বা অদৃশ্য বলতে এমন গভীর সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা মানুষের ইন্দ্রিয়াতীত এবং কখনো সরাসরি সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে না। যেমন আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী, ফেরেশতা, অহী, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি। এ গভীর সত্যগুলোকে না দেখে মেনে নেয়া এবং নবী এগুলোর খবর দিয়েছেন বলে তাঁর খবরের সত্যতার প্রতি আস্থা রেখে এগুলোকে মেনে নেয়াই হচ্ছে ‘ঈমান বিল গায়েব’ বা অদৃশ্যে বিশ্বাস। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আয়াতের অর্থ হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি অনুভব করা যায় না এমন সত্যগুলো মেনে নিতে প্রস্তুত হবে, একমাত্র সে-ই কুরআনের হিদায়াত ও পথ নির্দেশনা থেকে উপকৃত হতে পারবে। আর যে ব্যক্তি মেনে নেয়ার জন্য দেখার, ঘ্রাণ নেয়ার ও আস্বাদন করার শর্ত আরোপ করে এবং যে ব্যক্তি বলে, আমি এমন কোন জিনিস মেনে নিতে পারি না যা পরিমাণ করা ও ওজন করা যায় না—সে এ কিতাব থেকে হিদায়াত ও পথ নির্দেশনা লাভ করতে পারবে না।

৫) এটি হচ্ছে তৃতীয় শর্ত। এর অর্থ হচ্ছে, যারা কেবল মেনে নিয়ে নীরবে বসে থাকবে তারা কুরআন থেকে উপকৃত হতে পারবে না। বরং মেনে নেয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই তার আনুগত্য করা ও তাকে কার্যকর করাই হচ্ছে এ থেকে উপকৃত হবার জন্য একান্ত অপরিহার্য প্রয়োজন। আর বাস্তব আনুগত্যের প্রধান ও স্থায়ী আলামত হচ্ছে নামায। ঈমান আনার পর কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত হতে না হতেই মুয়াযযিন নামাযের জন্য আহবান জানায় আর ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি বাস্তবে আনুগত্য করতে প্রস্তুত কি না তার ফায়সালা তখনই হয়ে যায়। এ মুয়াযযিন আবার প্রতিদিন পাঁচ বার আহবান জানাতে থাকে। যখনই এ ব্যক্তি তার আহবানে সাড়া না দেয় তখনই প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি এবার আনুগত্য থেকে বের হয়ে এসেছে। কাজেই নামায ত্যাগ করা আসলে আনুগত্য ত্যাগ করারই নামান্তর। বলা বাহুল্য কোন ব্যক্তি যখন কারোর নির্দেশ মেনে চলতে প্রস্তুত থাকে না তখন তাকে নির্দেশ দেয়া আর না দেয়া সমান।

ইকামাতে সালাত বা নামায কায়েম করা একটি ব্যাপক ও পূর্ণ অর্থবোধক পরিভাষা একথাটি অবশ্যি জেনে রাখা প্রয়োজন। এর অর্থ কেবল নিয়মিত নামায পড়া নয় বরং সামষ্টিকভাবে নামাযের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করাও এর অর্থের অন্তর্ভুক্ত। যদি কোন লোকালয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি নিয়মিতভাবে নামায পড়ে থাকে কিন্তু জামায়াতের সাথে এ ফরযটি আদায় করার ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সেখানে নামায কায়েম আছে, একথা বলা যাবে না।

৬) কুরআনের হিদায়াত লাভ করার জন্য এটি হচ্ছে চতুর্থ শর্ত। সংকীর্ণমনা ও অর্থলোলুপ না হয়ে মানুষকে হতে হবে আল্লাহ‌ ও বান্দার অধিকার আদায়কারী। তার সম্পদে আল্লাহ‌ ও বান্দার যে অধিকার স্বীকৃত হয়েছে, তাকে তা আদায় করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যে বিষয়ের ওপর সে ঈমান এনেছে তার জন্য অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করার ব্যাপারে সে কোন রকম ইতস্তত করতে পারবে না।

﴿ وَالَّذِيۡنَ يُؤۡمِنُوۡنَ بِمَآ اُنۡزِلَ اِلَيۡكَ وَمَآ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِكَ وَبِالۡاٰخِرَةِ هُمۡ يُوۡقِنُوۡنَ ﴾

৪.) আর যে কিতাব তোমাদের ওপর নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন) এবং তোমার আগে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিল সে সবগুলোর ওপর ঈমান আনে৭ আর আখেরাতের ওপর একীন রাখে।৮

৭) এটি হচ্ছে পঞ্চম শর্ত। অর্থাৎ আল্লাহ‌ অহীর মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পূর্ববর্তী নবীগণের ওপর বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন দেশে যেসব কিতাব নাযিল করেছিলেন সেগুলোকে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। এ শর্তটির কারণে যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য বিধান অবতরণের প্রয়োজনীয়তাকে আদতে স্বীকারই করে না অথবা প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করলেও এজন্য অহী ও নবুওয়াতের প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না এবং এর পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া মতবাদকে আল্লাহর বিধান বলে ঘোষণা করে অথবা আল্লাহর কিতাবের স্বীকৃতি দিলেও কেবলমাত্র সেই কিতাবটি বা কিতাবগুলোর ওপর ঈমান আনে যেগুলোকে তাদের বাপ-দাদারা মেনে আসছে আর এ উৎস থেকে উৎসারিত অন্যান্য বিধানগুলোকে অস্বীকার করে –তাদের সবার জন্য কুরআনের হিদায়াতের দুয়ার রুদ্ধ। এ ধরনের সমস্ত লোককে আলাদা করে দিয়ে কুরআন তার অনুগ্রহ একমাত্র তাদের ওপর বর্ষণ করে, যারা নিজেদেরকে আল্লাহর বিধানের মুখাপেক্ষী মনে করে এবং আল্লাহর এ বিধান আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকটি মানুষের কাছে না এসে বরং নবীদের ও আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমেই মানুষের কাছে আসে বলে স্বীকার করে আর এই সঙ্গে বংশ, গোত্র বা জাতি প্রীতিতে লিপ্ত হয় না বরং নির্ভেজাল সত্যের পূজারী হয়, সত্য যেখানে যে আকৃতিতে আবির্ভূত হোক না কেন তারা তার সামনে মস্তক অবনত করে দেয়।

৮) এটি ষষ্ঠ ও সর্বশেষ শর্ত। আখেরাত একটি ব্যাপক ও পরিপূর্ণ অর্থবোধক শব্দ। আকীদা-বিশ্বাসের বিভিন্ন উপাদানের সমষ্টির ভিত্তিতে এ আখেরাতের ভাবধারা গড়ে উঠেছে। বিশ্বাসের নিম্নোক্ত উপাদানগুলো এর অন্তর্ভুক্ত।

একঃ এ দুনিয়ায় মানুষ কোন দায়িত্বহীন জীব নয়। বরং নিজের সমস্ত কাজের জন্য তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে।

দুইঃ দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থা চিরন্তন নয়। এক সময় এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং সে সময়টা একমাত্র আল্লাহই জানেন।

তিনঃ এ দুনিয়া শেষ হবার পর আল্লাহ‌ আর একটি দুনিয়া তৈরি করবেন। সৃষ্টির আদি থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মানুষের জন্ম হয়েছে সবাইকে সেখানে একই সঙ্গে পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। সবাইকে একত্র করে তাদের কর্মকাণ্ডের হিসেব নেবেন। সবাইকে তার কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন।

চারঃ আল্লাহর এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সৎলোকেরা জান্নাতে স্থান পাবে এবং অসৎলোকদেরকে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে।

পাঁচঃ বর্তমান জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অসমৃদ্ধি, সাফল্য ও ব্যর্থতার আসল মানদণ্ড নয়। বরং আল্লাহর শেষ বিচারে যে ব্যক্তি উত্‌রে যাবে সে-ই হচ্ছে সফলকাম আর সেখানে যে উত্‌রোবে না, সে ব্যর্থ।

এ সমগ্র আকীদা-বিশ্বাসগুলোকে যারা মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি, তারা কুরআন থেকে কোনক্রমেই উপকৃত হতে পারবে না। কারণ এ বিষয়গুলো অস্বীকার করা তো দূরের কথা এগুলো সম্পর্কে কারো মনে যদি সামান্যতম দ্বিধা ও সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে মানুষের জীবনের জন্য কুরআন যে পথনির্দেশ করেছে সে পথে তারা চলতে পারবে না।

﴿ اُولٰٓٮِٕكَ عَلٰى هُدًى مِّنۡ رَّبِّهِمۡ‌ وَاُولٰٓٮِٕكَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ﴾

৫.) এ ধরনের লোকেরা তাদের রবের পক্ষ থেকে সরল সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারা কল্যান লাভের অধিকারী।

)

﴿اِنَّ الَّذِيۡنَ كَفَرُوۡا سَوَآءٌ عَلَيۡهِمۡ ءَاَنۡذَرۡتَهُمۡ اَمۡ لَمۡ تُنۡذِرۡهُمۡ لَا يُؤۡمِنُوۡنَ‏﴾

৬.) যেসব লোক (একথাগুলো মেনে নিতে) অস্বীকার করেছে, ৯ তাদের জন্য সমান – তোমরা তাদের সতর্ক করো বা না করো, তারা মেনে নেবে না।

৯) অর্থাৎ ওপরে বর্ণিত ছয়টি শর্ত যারা পূর্ণ করেনি অথবা সেগুলোর মধ্য থেকে কোন একটিও গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

)

﴿ خَتَمَ اللّٰهُ عَلَىٰ قُلُوۡبِهِمۡ وَعَلٰى سَمۡعِهِمۡ‌ؕ وَعَلٰٓى اَبۡصَارِهِمۡ غِشَاوَةٌ‌ۚ وَّلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيۡمٌ ﴾

৭.) আল্লাহ তাদের হৃদয়ে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন।১০ এবং তাদের চোখের ওপর আবরণ পড়ে গেছে। তারা কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।

১০) আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছিলেন বলেই তারা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল – এটা এ বক্তব্যের অর্থ নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যখন তারা ওপরে বর্ণিত মৌলিক বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং নিজেদের জন্য কুরআনের উপস্থাপিত পথের পরিবর্তে অন্য পথ বেছে নিয়েছিল তখন আল্লাহ‌ তাদের হৃদয়ে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছিলেন। যে ব্যক্তি কখনো ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন তিনি অবশ্যি এ মোহর লাগার অবস্থার ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকবেন। আপনার উপস্থাপিত পথ যাচাই করার পর কোন ব্যক্তি একবার যখন তাকে প্রত্যাখ্যান করে তখন উল্টো পথে তার মন-মানস এমনভাবে দৌড়াতে থাকে যার ফলে আপনার কোন কথা আর তার বোধগম্য হয় না। আপনার দাওয়াতের জন্য তার কান হয়ে যায় বধির ও কালা। আপনার কার্যপদ্ধতির গুণাবলী দেখার ব্যাপারে তার চোখ হয়ে যায় অন্ধ। তখন সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয় যে, সত্যিই তার হৃদয়ের দুয়ারে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

)

﴿ وَمِنَ النَّاسِ مَنۡ يَّقُوۡلُ اٰمَنَّا بِاللّٰهِ وَبِالۡيَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَمَا هُمۡ بِمُؤۡمِنِيۡنَ ﴾

৮.) কিছু লোক এমনও আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ও আখেরাতের দিনের ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মু’মিন নয়।

)

﴿ يُخٰدِعُوۡنَ اللّٰهَ وَالَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا‌ۚ وَمَا يَخۡدَعُوۡنَ اِلَّآ اَنۡفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُوۡنَ ؕ‏﴾

৯.) তারা আল্লাহর সাথে ও যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে ধোঁকাবাজি করছে। কিন্তু আসলে তারা নিজেদেরকেই প্রতারণা করছে, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।১১

১১) অর্থাৎ তাদের মুনাফেকী কার্যকলাপ তাদের জন্য লাভজনক হবে – এ ভুল ধারণায় তারা নিমজ্জিত হয়েছে। অথচ এসব তাদেরকে দুনিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং আখেরাতেও। একজন মুনাফিক কয়েকদিনের জন্য দুনিয়ায় মানুষকে ধোঁকা দিতে পারে কিন্তু সবসময়ের জন্য তার এই ধোঁকাবাজি চলতে পারে না। অবশেষে একদিন তার মুনাফিকীর গুমোর ফাঁক হয়ে যাবেই। তখন সমাজে তার সামান্যতম মর্যাদাও খতম হয়ে যাবে। আর আখেরাতের ব্যাপারে বলা যায়, সেখানে তো ঈমানের মৌখিক দাবীর কোন মূল্যই থাকবে না যদি আমল দেখা যায় তার বিপরীত।

﴿ فِىۡ قُلُوۡبِهِمۡ مَّرَضٌۙ فَزَادَهُمُ اللّٰهُ مَرَضًا‌ؕ وَّلَهُمۡ عَذَابٌ اَلِيۡمٌۙۢ بِمَا كَانُوۡا يَكۡذِبُوۡنَ‏﴾

১০.) তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ‌ সে রোগ আরো বেশী বাড়িয়ে দিয়েছেন,১২ আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

১২) মুনাফিকীকেই এখানে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর আল্লাহ‌ এ রোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, একথার অর্থ হচ্ছে এই যে, তিনি কালবিলম্ব না করে ঘটনাস্থলেই মুনাফিকদেরকে তাদের মুনাফিকী কার্যকলাপের শাস্তি দেন না বরং তাদেরকে ঢিল দিতে থাকেন। এর ফলে মুনাফিকরা নিজেদের কলা-কৌশলগুলোকে আপাতঃ দৃষ্টিতে সফল হতে দেখে আরো বেশী ও পূর্ণ মুনাফিকী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে থাকে।

)

﴿ وَاِذَا قِيۡلَ لَهُمۡ لَا تُفۡسِدُوۡا فِىۡ الۡاَرۡضِ قَالُوۡٓا اِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُوۡنَ‏﴾

১১.) যখনই তাদের বলা হয়েছে, যমীনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা একথাই বলেছে, আমরা তো সংশোধনকারী।

)

﴿ اَلَا ٓ اِنَّهُمۡ هُمُ الۡمُفۡسِدُوۡنَ وَلٰكِنۡ لَّا يَشۡعُرُوۡنَ﴾

১২.) সাবধান! এরাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।

)

﴿ وَاِذَا قِيۡلَ لَهُمۡ اٰمِنُوۡا كَمَآ اٰمَنَ النَّاسُ قَالُوۡٓا اَنُؤۡمِنُ كَمَآ اٰمَنَ السُّفَهَآءُ‌ؕ اَلَآ اِنَّهُمۡ هُمُ السُّفَهَآءُ وَلٰكِنۡ لَّا يَعۡلَمُوۡنَ‏﴾

১৩.) আর যখন তাদের বলা হয়েছে, অন্য লোকেরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আনো ১৩ তখন তারা এ জবাবই দিয়েছে- আমরা কি ঈমান আনবো নির্বোধদের মতো?১৪ সাবধান! আসলে এরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা জানে না।

১৩) অর্থাৎ তোমাদের এলাকার অন্যান্য লোকেরা যেমন সাচ্চা দিলে ও সরল অন্তঃকরণে মুসলমান হয়েছে তোমরাও যদি ইসলাম গ্রহণ করতে চাও তাহলে তেমনি নিষ্ঠা সহকারে সাচ্চা দিলে গ্রহণ করো।

১৪) যারা সাচ্চা দিলে নিষ্ঠা সহকারে ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদেরকে উৎপীড়ন, নির্যাতন, কষ্ট ও বিপদের মুখে নিক্ষেপ করছিল তাদেরকে তারা নির্বোধ মনে করতো। তাদের মতে নিছক সত্য ও ন্যায়ের জন্য সারা দেশের জনসমাজের শত্রুতার মুখোমুখি হওয়া নিরেট বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা মনে করতো, হক ও বাতিলের বিতর্কে না পড়ে সব ব্যাপারেই কেবলমাত্র নিজের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।

)

﴿ ‌ۖوَاِذَا لَقُوۡا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا قَالُوۡآ اٰمَنَّا‌ۖ ‌ۚ وَاِذَا خَلَوۡا اِلٰى شَيٰطِيۡنِهِمۡ قَالُوۡآ اِنَّا مَعَكُمۡۙ اِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَهۡزِءُوۡنَ﴾

১৪.) যখন এরা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয়, বলেঃ “আমরা ঈমান এনেছি”, আবার যখন নিরিবিলিতে নিজেদের শয়তানদের১৫ সাথে মিলিত হয় তখন বলেঃ “আমরা তো আসলে তোমাদের সাথেই আছি আর ওদের সাথে তো নিছক তামাশা করছি।”

১৫) আরবী ভাষায় সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক ও স্বৈরাচারীকে শয়তান বলা হয়। মানুষ ও জ্বিন উভয়ের জন্য এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কুরআনের অধিকাংশ জায়গায় এ শব্দটি জ্বিনদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও কোন কোন জায়গায় আবার শয়তান প্রকৃতির মানুষদের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্বাপর আলোচনার প্রেক্ষাপটে এসব ক্ষেত্রে কোথায় শয়তান শব্দটি জ্বিনদের জন্য এবং কোথায় মানুষদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে তা সহজেই জানা যায়। তবে আমাদের আলোচ্য স্থানে শয়তান শব্দটিকে বহুবচনে ‘শায়াতীন’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখানে 'শায়াতীন' বলতে মুশরিকদের বড় বড় সরদারদেরকে বুঝানো হয়েছে। এ সরদাররা তখন ইসলামের বিরোধিতার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছিল।

)

﴿ اللّٰهُ يَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ وَيَمُدُّهُمۡ فِىۡ طُغۡيٰنِهِمۡ يَعۡمَهُوۡنَ‏﴾

১৫.) আল্লাহ এদের সাথে তামাশা করছেন, এদের রশি দীর্ঘায়িত বা ঢিল দিয়ে যাচ্ছেন এবং এরা নিজেদের আল্লাহদ্রোহিতার মধ্যে অন্ধের মতো পথ হাতড়ে মরছে।

)

﴿ اُولٰٓٮِٕكَ الَّذِيۡنَ اشۡتَرَوُا الضَّلٰلَةَ بِالۡهُدٰى فَمَا رَبِحَتۡ تِّجَارَتُهُمۡ وَمَا كَانُوۡا مُهۡتَدِيۡنَ﴾

১৬.) এরাই হিদায়াতের বিনিময়ে গোমরাহী কিনে নিয়েছে, কিন্তু এ সওদাটি তাদের জন্য লাভজনক নয় এবং এরা মোটেই সঠিক পথে অবস্থান করছে না।

)

﴿ مَثَلُهُمۡ كَمَثَلِ الَّذِىۡ اسۡتَوۡقَدَ نَارًا‌ۚ فَلَمَّآ اَضَآءَتۡ مَا حَوۡلَهٗ ذَهَبَ اللّٰهُ بِنُوۡرِهِمۡ وَتَرَكَهُمۡ فِىۡ ظُلُمٰتٍ لَّا يُبۡصِرُوۡنَ﴾

১৭.) এদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন এক ব্যক্তি আগুন জ্বালালো এবং যখনই সেই আগুন চারপাশ আলোকিত করলো তখন আল্লাহ‌ তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিলেন এবং তাদের ছেড়ে দিলেন এমন অবস্থায় যখন অন্ধকারের মধ্যে তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না।১৬

১৬) যখন আল্লাহর এক বান্দা আলো জ্বালালেন এবং হককে বাতিল থেকে, সত্যকে মিথ্যা থেকে ও সরল সোজা পথকে ভুল পথ থেকে ছেঁটে সুস্পষ্টরূপে আলাদা করে ফেললেন তখন চক্ষুষ্মান ব্যক্তিদের কাছে সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো সুস্পষ্ট দিবালোকের মতো। কিন্তু প্রবৃত্তি পূজায় অন্ধ মুনাফিকরা এ আলোয় কিছুই দেখতে পেলো না। “আল্লাহ তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিলেন” – বাক্যের কারণে কেউ যেন এ ভুল ধারণা পোষণ না করেন যে, তাদের অন্ধকারে হাতড়ে মরার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। যে ব্যক্তি নিজে হক ও সত্যের প্রত্যাশী নয়, নিজেই হিদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহীকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে এবং সত্যের আলোকোজ্জ্বল চেহারা দেখার আগ্রহ যার মোটেই নেই, আল্লাহ‌ তারই দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেন। সত্যের আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে নিজেই যখন বাতিলের অন্ধকারে হাতড়ে মরতে চায় তখন আল্লাহও তাকে তারই সুযোগ দেন।

﴿ صُمٌّۢ بُكۡمٌ عُمۡىٌ فَهُمۡ لَا يَرۡجِعُوۡنَ ۙ‏﴾

১৮.) তারা কালা, বোবা, অন্ধ।১৭ তারা আর ফিরে আসবে না।

১৭) হক কথা শোনার ব্যাপারে বধির, হক কথা বলার ক্ষেত্রে বোবা এবং হক ও সত্য দেখার প্রশ্নে অন্ধ।

)

﴿ اَوۡ كَصَيِّبٍ مِّنَ السَّمَآءِ فِيۡهِ ظُلُمٰتٌ وَّرَعۡدٌ وَّبَرۡقٌ‌ۚ يَّجۡعَلُوۡنَ اَصَابِعَهُمۡ فِىۡٓ اٰذَانِهِمۡ مِّنَ الصَّوٰعِقِ حَذَرَ الۡمَوۡتِ‌ؕ وَاللّٰهُ مُحِيۡطٌۢ بِالۡكٰفِرِيۡنَ﴾

১৯.) অথবা এদের দৃষ্টান্ত এমন যে, আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। তার সাথে আছে অন্ধকার মেঘমালা, বজ্রের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমক। বজ্রপাতের আওয়াজ শুনে নিজেদের প্রাণের ভয়ে এরা কানে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। আল্লাহ‌ এ সত্য অস্বীকারকারীদেরকে সবদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছেন। ১৮

১৮) কানে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে এরা ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাবে – এ ধারণায় কিছুক্ষণের জন্য ডুবে যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এভাবে তারা বাঁচতে পারবে না। কারণ আল্লাহ‌ তাঁর সমগ্র শক্তি দিয়ে তাদেরকে ঘিরে রেখেছেন।

﴿ يَكَادُ الۡبَرۡقُ يَخۡطَفُ اَبۡصَارَهُمۡ‌ؕ كُلَّمَآ اَضَآءَ لَهُمۡ مَّشَوۡا فِيۡهِۙ وَاِذَآ اَظۡلَمَ عَلَيۡهِمۡ قَامُوۡا‌ؕ وَلَوۡ شَآءَ اللّٰهُ لَذَهَبَ بِسَمۡعِهِمۡ وَاَبۡصَارِهِمۡ‌ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلٰى كُلِّ شَىۡءٍ قَدِيۡرٌ‏﴾

২০.) বিদ্যুৎ চমকে তাদের অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যেন বিদ্যুৎ শীগ্‌গির তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেবে। যখন সামান্য একটু আলো তারা অনুভব করে তখন তার মধ্যে তারা কিছুদূর চলে এবং যখন তাদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায় তারা দাঁড়িয়ে পড়ে।১৯ আল্লাহ চাইলে তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি একেবারেই কেড়ে নিতে পারতেন।২০ নিঃসন্দেহে তিনি সবকিছুর ওপর শক্তিশালী।

১৯) প্রথম দৃষ্টান্তটি ছিল এমন সব মুনাফিকদের যারা মানসিক দিক দিয়ে ঈমান ও ইসলামকে পুরোপুরি অস্বীকার করতো কিন্তু কোন স্বার্থ ও সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। আর এ দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি হচ্ছে সন্দেহ, সংশয় ও দ্বিধার শিকার এবং দুর্বল ঈমানের অধিকারীদের। এরা কিছুটা সত্য স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু সেজন্য বিপদ-মুসিবত, কষ্ট–নির্যাতন সহ্য করতে তারা প্রস্তুত ছিল না। এ দৃষ্টান্তে বৃষ্টি বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। ইসলাম বিশ্বমানবতার জন্য একটি রহমত রূপে আবির্ভূত হয়েছে। অন্ধকার মেঘমালা, বিদ্যুৎ চমক ও বজ্রের গর্জন বলে এখানে সেই ব্যাপক দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ ও সংকটের কথা বুঝানো হয়েছে ইসলামী আন্দোলনের মোকাবিলায় জাহেলী শক্তির প্রবল বিরোধিতার মুখে যেগুলো একের পর এক সামনে আসছিল। দৃষ্টান্তের শেষ অংশে এক অভিনব পদ্ধতিতে এ মুনাফিকদের এ অবস্থার নক্‌শা আঁকা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাপারটি একটু সহজ হয়ে গেলে তারা চলতে থাকে আবার সমস্যা-সংকটের জট পাকিয়ে গেলে অথবা তাদের প্রবৃত্তি বিরোধী হয়ে পড়লে বা জাহেলী স্বার্থে আঘাত পড়লে তারা সটান দাঁড়িয়ে যায়।

২০) অর্থাৎ যেভাবে প্রথম ধরনের মুনাফিকদের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সেভাবে আল্লাহ‌ তাদেরকেও হক ও সত্যের ব্যাপারে কানা ও কালায় পরিণত করতে পারতেন। কিন্তু যে ব্যক্তি কিছুটা দেখতে ও শুনতে চায় তাকে ততটুকুও দেখতে শুনতে না দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। যতটুকু হক দেখতে ও শুনতে তারা প্রস্তুত ছিল আল্লাহ‌ ততটুকু শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি তাদের আয়ত্বাধীনে রেখেছিলেন।

)

﴿ يٰٓاَيُّهَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّكُمُ الَّذِىۡ خَلَقَكُمۡ وَالَّذِيۡنَ مِنۡ قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُوۡنَ ۙ‏﴾

২১.) হে মানব জাতি।২১ ইবাদাত করো তোমাদের রবের, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বে যারা অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের সবার সৃষ্টিকর্তা, এভাবেই তোমরা নিষ্কৃতি লাভের আশা করতে পারো।২২

২১) যদিও কুরআনের দাওয়াত সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতির জন্য তবুও এ দাওয়াত থেকে লাভবান হওয়া না হওয়া মানুষের নিজের ইচ্ছা প্রবণতার ওপর এবং সেই প্রবণতা অনুযায়ী আল্লাহ‌ প্রদত্ত সুযোগের ওপর নির্ভরশীল। তাই প্রথমে মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে কোন্‌ ধরনের লোক এ কিতাবের পথনির্দেশনা থেকে লাভবান হতে পারে এবং কোন্‌ ধরনের লোক লাভবান হতে পারে না তা সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তারপর এখন সমগ্র মানবজাতির সামনে সেই আসল কথাটিই পেশ করা হচ্ছে, যেটি পেশ করার জন্য কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল।

২২) অর্থাৎ দুনিয়ায় ভুল চিন্তা-দর্শন, ভুল কাজ-কর্ম ও আখেরাতে আল্লাহর আযাব থেকে নিষ্কৃতি লাভের আশা করতে পারো।

﴿ الَّذِىۡ جَعَلَ لَكُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَآءَ بِنَآءً وَّاَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزۡقًا لَّكُمۡ‌ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰهِ اَنۡدَادًا وَّاَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ‏﴾

২২.) তিনিই তোমাদের জন্য মাটির শয্যা বিছিয়েছেন, আকাশের ছাদ তৈরি করেছেন, ওপর থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে সব রকমের ফসলাদি উৎপন্ন করে তোমাদের আহার যুগিয়েছেন। কাজেই একথা জানার পর তোমরা অন্যদেরকে আল্লাহর প্রতিপক্ষে পরিণত করো না।২৩

২৩) অর্থাৎ যখন তোমরা নিজেরাই একথা স্বীকার করো এবং এ সমস্তই আল্লাহ‌ করেছেন বলে তোমরা জানো তখন তোমাদের সমস্ত বন্দেগী ও দাসত্ব একমাত্র তাঁর জন্য নির্ধারিত হওয়া উচিত। আর কার বন্দেগী ও দাসত্ব তোমরা করবে? আর কে এর অধিকারী হতে পারে? অন্যদেরকে আল্লাহর প্রতিপক্ষ বানাবার অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের দাসত্ব ও বন্দেগীর মধ্য থেকে কোনটিকে আল্লাহ‌ ছাড়া অন্যদের সাথে সম্পর্কিত করা। সামনের দিকে কুরআনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যাবে। তা থেকে জানা যাবে, কোন্‌ ধরনের ইবাদাত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, যাতে অন্যদেরকে শরীক ‘শিরক’ –এর অন্তর্ভুক্ত এবং যার পথ রোধ করার জন্য কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।

﴿ وَاِنۡ کُنۡتُمۡ فِىۡ رَيۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰى عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَةٍ مِّنۡ مِّثۡلِهٖ وَادۡعُوۡا شُهَدَآءَكُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ كُنۡتُمۡ صٰدِقِيۡنَ‏﴾

২৩.) আর যে কিতাবটি আমি আমার বান্দার ওপর নাযিল করেছি সেটি আমার কিনা- এ ব্যাপারে যদি তোমরা সন্দেহ পোষণ করে থাকো তাহলে তার মতো একটি সূরা তৈরি করে আনো এবং নিজেদের সমস্ত সমর্থক গোষ্ঠীকে ডেকে আনো – এক আল্লাহকে ছাড়া আর যার যার চাও তার সাহায্য নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে এ কাজটি করে দেখাও।২৪

২৪) ইতিপূর্বে মক্কায় কয়েকবার এ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছিল, যদি তোমরা এ কুরআনকে মানুষের রচনা মনে করে থাকো তাহলে এর সমমানের কোন বাণী রচনা করে আনো। এখন মদীনায় এসে আবার সেই একই চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। (দেখুন সূরা ইউনূস ৩৮ আয়াত, সূরা হুদ ১৩ আয়াত, সূরা বনী ইসরাঈল ৮৮ আয়াত এং সূরা তূর ৩৩-৩৪ আয়াত)।

﴿ فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَلَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوۡا النَّارَ الَّتِىۡ وَقُوۡدُهَا النَّاسُ وَالۡحِجَارَةُ‌ۖ ‌ۚ اُعِدَّتۡ لِلۡكٰفِرِيۡنَ﴾

২৪.) কিন্তু যদি তোমরা এমনটি না করো আর নিঃসন্দেহে কখনই তোমরা এটা করতে পারবে না, তাহলে ভয় করো সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর,২৫ যা তৈরি রাখা হয়েছে সত্য অস্বীকারকারীদের জন্য।

২৫) এখানে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ সেখানে দোজখের ইন্ধন কেবল তোমরা একাই হবে না বরং তোমাদের সাথে থাকবে তোমাদের ঠাকুর ও আরাধ্য দেবতাদের সেই সব মূর্তি যাদেরকে তোমরা মাবুদ ও আরাধ্য বানিয়ে পূজা করে আসছিলে। তখন তোমরা নিজেরাই জানতে পারবে খোদায়ী করার ও উপাস্য হবার ব্যাপারে এদের অধিকার কতটুকু।

)

﴿ وَبَشِّرِ الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوۡا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِىۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهَارُ‌ؕ ڪُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡهَا مِنۡ ثَمَرَةٍ رِّزۡقًا‌ۙ قَالُوۡا هٰذَا الَّذِىۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ‌ؕ وَاُتُوۡا بِهٖ مُتَشَابِهًا‌ؕ وَلَهُمۡ فِيۡهَآ اَزۡوٰجٌ مُّطَهَّرَةٌ ‌ۙ وَّهُمۡ فِيۡهَا خٰلِدُوۡنَ﴾

২৫.) আর হে নবী, যারা এ কিতাবের ওপর ঈমান আনবে এবং (এর বিধান অনুযায়ী) নিজেদের কার্যধারা সংশোধন করে নেবে তাদেরকে এ মর্মে সুখবর দাও যে, তাদের জন্য এমন সব বাগান আছে যার নিম্নদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে ঝর্ণাধারা। সেই বাগানের ফল দেখতে দুনিয়ার ফলের মতই হবে। যখন কোন ফল তাদের দেয়া হবে খাবার জন্য, তারা বলে উঠবেঃ এ ধরনের ফলই ইতিপূর্বে দুনিয়ায় আমাদের দেয়া হতো।২৬ তাদের জন্য সেখানে থাকবে পাক-পবিত্র স্ত্রীগণ২৭ এবং তারা সেখানে থাকবে চিরকাল।

২৬) অর্থাৎ এ ফলগুলো নতুন ও অপরিচিত হবে না। দুনিয়ায় যেসব ফলের সাথে তারা পরিচিত ছিল সেগুলোর সাথে এদের আকার আকৃতির মিল থাকবে। তবে হ্যাঁ এদের স্বাদ হবে অনেক গুণ বেশী ও উন্নত পর্যায়ের। যেমন ধরুন আম, কমলা ও ডালিমের মতো হবে অনেকগুলো ফল। জান্নাতবাসীরা ফলগুলো দেখে চিনতে পারবে – এগুলো আম, এগুলো কমলা এবং এগুলো ডালিম। কিন্তু স্বাদের দিক দিয়ে দুনিয়ার আম, কমলা ও ডালিমকে এর সাথে তুলনাই করা যাবে না।

২৭) মূল আরবী বাক্যে ‘আযওয়াজ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে ‘যওজ’। এর অর্থ হচ্ছে ‘জোড়া’। এ শব্দটি স্বামী ও স্ত্রী উভয় অর্থে ব্যবহার করা হয়। স্বামীর জন্য স্ত্রী হচ্ছে ‘যওজ’। আবার স্ত্রীর জন্য স্বামী হচ্ছে ‘যওজ’। তবে আখেরাতে ‘আযওয়াজ’ অর্থাৎ জোড়া হবে পবিত্রতার গুণাবলী সহকারে। যদি দুনিয়ায় কোন সৎকর্মশীল পুরুষের স্ত্রী সৎকর্মশীলা না হয় তাহলে আখেরাতে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ঐ সৎকর্মশীল পুরুষটিকে অন্য কোন সৎকর্মশীলা স্ত্রী দান করা হবে। আর যদি দুনিয়ায় কোন স্ত্রী হয় সৎকর্মশীলা এবং তার স্বামী হয় অসৎ তাহলে আখেরাতে ঐ অসৎ স্বামী থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে কোন সৎপুরুষকে তার স্বামী হিসেবে দেয়া হবে। তবে যদি দুনিয়ায় কোন স্বামী-স্ত্রী দু’জনই সৎকর্মশীল হয় তাহলে আখেরাতে তাদের এই সম্পর্কটি চিরন্তন ও চিরস্থায়ী সম্পর্কে পরিণত হবে।

)

﴿ ۞ اِنَّ اللّٰهَ لَا يَسۡتَحۡىٖۤ اَنۡ يَّضۡرِبَ مَثَلاً مَّا ‌بَعُوۡضَةً فَمَا فَوۡقَهَا‌ؕ فَاَمَّا ‌الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا فَيَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّهِمۡ‌ۚ وَاَمَّا الَّذِيۡنَ ڪَفَرُوۡا فَيَقُوۡلُوۡنَ مَاذَآ اَرَادَ اللّٰهُ بِهٰذَا مَثَلاً‌ۘيُضِلُّ بِهٖ ڪَثِيۡرًا وَّيَهۡدِىۡ بِهٖ كَثِيۡرًا‌ؕ وَمَا يُضِلُّ بِهٖۤ اِلَّا الۡفٰسِقِيۡنَ ۙ‏﴾

২৬.) অবশ্য আল্লাহ‌ লজ্জা করেন না মশা বা তার চেয়ে তুচ্ছ কোন জিনিসের দৃষ্টান্ত দিতে। ২৮ যারা সত্য গ্রহণকারী তারা এ দৃষ্টান্ত –উপমাগুলো দেখে জানতে পারে এগুলো সত্য, এগুলো এসেছে তাদের রবেরই পক্ষ থেকে, আর যারা (সত্যকে) গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় তারা এগুলো শুনে বলতে থাকে, এ ধরনের দৃষ্টান্ত –উপমার সাথে আল্লাহর কী সম্পর্ক? এভাবে আল্লাহ‌ একই কথার সাহায্যে অনেককে গোমরাহীতে লিপ্ত করেন আবার অনেককে দেখান সরল সোজা পথ।২৯

২৮) এখানে একটি আপত্তি ও প্রশ্নের উল্লেখ না করেই তার জবাব দেয়া হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য সুস্পষ্ট করার জন্য মশা, মাছি ও মাকড়শা ইত্যাদির দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। বিরোধীরা এর ওপর আপত্তি উঠিয়েছিল, এটা কোন্‌ ধরনের আল্লাহর কালাম যেখানে এই ধরনের তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসের দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে? তারা বলতো, এটা আল্লাহর কালাম হলে এর মধ্যে এসব বাজে কথা থাকতো না।

২৯) অর্থাৎ যারা কথা বুঝতে চায় না, সত্যের মর্ম অনুসন্ধান করে না, তাদের দৃষ্টি তো কেবল শব্দের বাইরের কাঠামোর ওপর নিবদ্ধ থাকে এবং ঐ জিনিসগুলো থেকে বিপরীত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সত্য থেকে আরো দূরে চলে যায়। অপর দিকে যারা নিজেরাই সত্য সন্ধানী এবং সঠিক দৃষ্টিশক্তির অধিকারী তারা ঐ সব কথার মধ্যে সূক্ষ্ম জ্ঞানের আলোকচ্ছটা দেখতে পায়। এ ধরনের জ্ঞানগর্ভ কথা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হতে পারে বলে তাদের সমগ্র হৃদয় মন সাক্ষ্য দিয়ে ওঠে।

﴿ الَّذِيۡنَ يَنۡقُضُوۡنَ عَهۡدَ اللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِيۡثٰقِهٖ وَيَقۡطَعُوۡنَ مَآ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ يُّوۡصَلَ وَيُفۡسِدُوۡنَ فِىۡ الۡاَرۡضِ‌ؕ اُولٰٓٮِٕكَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ‏﴾

২৭.) আর তিনি গোমরাহীর মধ্যে তাদেরকেই নিক্ষেপ করেন যারা ফাসেক, ৩০ যারা আল্লাহর সাথে মজবুতভাবে অঙ্গীকার করার পর আবার তা ভেঙ্গে ফেলে,৩১ আল্লাহ যাকে জোড়ার হুকুম দিয়েছেন তাকে কেটে ফেলে৩২ এবং যমীনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে চলে।৩৩ আসলে এরাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।

৩০) ফাসেক তাকে বলে যে নাফরমান এবং আল্লাহর আনুগত্যের সীমা অতিক্রম করে যায়।

৩১) বাদশাহ নিজের কর্মচারী ও প্রজাদের নামে যে ফরমান বা নির্দেশনামা জারী করেন আরবী ভাষায় প্রচলিত কথ্যরীতিতে তাকে বলা হয় ‘আহদ’ বা অঙ্গীকার। কারণ এই অঙ্গীকার মেনে চলা হয় প্রজাদের অপরিহার্য কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এখানে অঙ্গীকার শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহর অঙ্গীকার অর্থ হচ্ছে, তাঁর স্থায়ী ফরমান। এই ফরমানের দৃষ্টিতে বলা যায়, সমগ্র মানবজাতি একমাত্র তাঁরই বন্দেগী, আনুগত্য ও পূজা-উপাসনা করার জন্য আদিষ্ট ও নিযুক্ত হয়েছে। ‘মজবুতভাবে অঙ্গীকার করার পর’—কথাটি বলে আসলে হযরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টির সময় সমগ্র মানবাত্মার নিকট থেকে এ ফরমানটির আনুগত্য করার যে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সূরা আ'রাফ-এর ১৭২ আয়াতে এই অঙ্গীকারের ওপর তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।

৩২) অর্থাৎ যেসব সম্পর্ককে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত করার ওপর মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কল্যাণ নির্ভর করে এবং আল্লাহ‌ যেগুলোকে ত্রুটিমুক্ত রাখার হুকুম দিয়েছেন, তার ওপর এরা অস্ত্র চালায়। এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটির মধ্যে রয়েছে অর্থের অশেষ ব্যাপকতা। ফলে দু’টি মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে যে মানবিক সভ্যতা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিশাল জগত তার সমগ্র অবয়বও এই অর্থের আওতাধীন এসে যায়। সম্পর্ক কেটে ফেলার অর্থ নিছক মানবিক সম্পর্কচ্ছেদ নয় বরং সঠিক ও বৈধ সম্পর্ক ছাড়া অন্য যত প্রকারের সম্পর্ক কায়েম করা হবে তা সবই এর অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ অবৈধ ও ভুল সম্পর্কের পরিণতি এবং সম্পর্কচ্ছেদের পরিণতি একই। অর্থাৎ এর পরিণতিতে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ হয় এবং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা হয় ধ্বংসের মুখোমুখি।

৩৩) এই তিনটি বাক্যের মধ্যে ফাসেকী ও ফাসেকের চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ‌ ও বান্দার মধ্যকার সম্পর্ক এবং মানুষ ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন বা বিকৃত করার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে বিপর্যয়। আর যে ব্যক্তি এ বিপর্যয় সৃষ্টি করে সেই হচ্ছে ফাসেক।

)

﴿ كَيۡفَ تَكۡفُرُوۡنَ بِاللّٰهِ وَڪُنۡتُمۡ اَمۡوٰتًا فَاَحۡيٰڪُمۡ‌ۚ ثُمَّ يُمِيۡتُكُمۡ ثُمَّ يُحۡيِيۡكُمۡ ثُمَّ اِلَيۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ﴾

২৮.) তোমরা আল্লাহর সাথে কেমন করে কুফরীর আচরণ করতে পারো। অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদের জীবন দান করেছেন। অতঃপর তিনি তোমাদের প্রাণ হরণ করবেন এবং অতঃপর তিনি তোমাদের জীবন দান করবেন। তরাপর তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরেযেতে হবে।

)

﴿ هُوَ الَّذِىۡ خَلَقَ لَكُمۡ مَّا فِىۡ الۡاَرۡضِ جَمِيۡعًا ثُمَّ اسۡتَوٰىٓ اِلَى السَّمَآءِ فَسَوّٰٮهُنَّ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ‌ؕ وَهُوَ بِكُلِّ شَىۡءٍ عَلِيۡمٌ ۙ﴾

২৯.) তিনিই পৃথিবীতে তোমাদের জন্য সমস্ত জিনিস সৃষ্টি করলেন। তারপর ওপরের দিকে লক্ষ করলেন এবং সাত আকাশ বিন্যস্ত করলেন৩৪ তিনি সব জিনিসের জ্ঞান রাখেন। ৩৫

৩৪) সাত আকাশের তাৎপর্য কি? সাত আকাশ বলতে কি বুঝায়? এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া কঠিন। মানুষ প্রতি যুগে আকাশ বা অন্য কথায় পৃথিবীর বাইরের জগত সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ ও ধারণা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিভিন্ন চিন্তা ও মতবাদের অনুসারী হয়েছে। এ চিন্তা ও মতবাদগুলো বিভিন্ন সময় বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই এর মধ্য থেকে কোন একটি মতবাদ নির্দেশ করে তার ভিত্তিতে কুরআনের এই শব্দগুলোর অর্থ নির্ণয় করা ঠিক হবে না। তবে সংক্ষেপে এতটুকু বুঝে নিতে হবে যে, সম্ভবত পৃথিবীর বাইরে যতগুলো জগত আছে সবগুলোকেই আল্লাহ‌ সাতটি সুদৃঢ় স্তরে বিভক্ত করে রেখেছেন অথবা এই বিশ্ব-জাহানের যে স্তরে পৃথিবীর অবস্থিতি সেটি সাতটি স্তর সমন্বিত।

৩৫) এই বাক্যটিতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। এক, যে আল্লাহ‌ তোমাদের সমস্ত গতিবিধি ও কর্মকান্ডের খবর রাখেন এবং যার দৃষ্টি থেকে তোমাদের কোন গতিবিধিই গোপন থাকতে পারে না তাঁর মোকাবিলায় তোমরা কুফরী ও বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করার সাহস কর কেমন করে? দুই, যে আল্লাহ‌ যাবতীয় সত্য জ্ঞানের অধিকারী, যিনি আসলে সমস্ত জ্ঞানের উৎস তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে মাথা কুটে মরা ছাড়া তোমাদের আর কি লাভ হতে পারে! তিনি ছাড়া যখন জ্ঞানের আর কোন উৎস নেই, তোমাদের জীবনের পথ সুস্পষ্টভাবে দেখার জন্য যখন তাঁর কাছ থেকে ছাড়া আর কোথাও থেকে আলো পাওয়ার সম্ভাবনা নেই তখন তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মধ্যে তোমরা নিজেদের জন্য এমন কি কল্যাণ দেখতে পেলে?

﴿وَاِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلٰٓٮِٕكَةِ اِنِّىۡ جَاعِلٌ فِىۡ الۡاَرۡضِ خَلِيۡفَةً‌ؕ قَالُوۡٓا اَتَجۡعَلُ فِيۡهَا مَنۡ يُّفۡسِدُ فِيۡهَا وَيَسۡفِكُ الدِّمَآء‌َۚ وَنَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ‌ؕ قَالَ اِنِّىۡٓ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ‏﴾

৩০.) আবার৩৬ সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের৩৭ বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি৩৮ নিযুক্ত করতে চাই।” তারা বললো, “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত করবে?৩৯ আপনার প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করেই যাচ্ছি।”৪০ আল্লাহ বললেন, “আমি জানি যা তোমরা জানো না।” ৪১

৩৬) ওপরের রুকু’তে আল্লাহর বন্দেগী করার আহবান জানানো হয়েছিল। এ আহবানের ভিত্তিভূমি ছিল নিম্নরূপঃ আল্লাহ‌ তোমাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তাঁর হাতেই তোমাদের জীবন ও মৃত্যু। যে বিশ্ব-জগতে তোমরা বাস করছো তিনিই তার একচ্ছত্র অধিপতি ও সার্বভৌম শাসক। কাজেই তাঁর বন্দেগী ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি তোমাদের জন্য সঠিক নয়। এখন এই রুকূ’তে অন্য একটি ভিত্তি ভূমির ওপর ঐ একই আহবান জানানো হয়েছে। অর্থাৎ এই দুনিয়ায় আল্লাহ‌ তোমাদেরকে খলীফা পদে অভিষিক্ত করেছেন। খলীফা হবার কারণে কেবল তাঁর বন্দেগী করলেই তোমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না বরং এই সঙ্গে তাঁর পাঠানো হিদায়াত ও নির্দেশাবলী অনুযায়ী জীবন যাপনও করতে হবে। আর যদি তোমরা এমনটি না কর তোমাদের আদি শত্রু শয়তানের ইঙ্গিতে চলতে থাকো, তাহলে তোমরা নিকৃষ্ট পর্যায়ের বিদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে এবং এ জন্য তোমাদের চরম পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।

এ প্রসঙ্গে মানুষের স্বরূপও বিশ্ব-জগতে তার মর্যাদা ও ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসের এমন অধ্যায়ও উপস্থাপন করা হয়েছে যে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার দ্বিতীয় কোন মাধ্যম মানুষের করায়ত্ত নেই। এই অধ্যায়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত লাভ করা হয়েছে তা প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যায়ে মাটির তলদেশ খুড়ে বিক্ষিপ্ত অস্থি ও কংকাল একত্র করে আন্দাজ –অনুমানের ভিত্তিতে সেগুলোর মধ্যে সম্পর্কে স্থাপনের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত থেকে অনেক বেশী মূল্যবান।

৩৭) এখানে মূল আরবী শব্দ ‘মালাইকা’ হচ্ছে বহুবচন। একবচন ‘মালাক’। মালাক –এর আসল মানে “বাণীবাহক।” এরই শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে ‘যাকে পাঠানো হয়েছে’ বা ফেরেশতা। ফেরেশতা নিছক কিছু কায়াহীন, অস্তিত্বহীন শক্তির নাম নয়। বরং এরা সুস্পষ্ট কায়া ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অধিকারী। আল্লাহ‌ তার এই বিশাল সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় তাদের খেদমত নিয়ে থাকেন। তাদেরকে আল্লাহর বিশাল সাম্রাজ্যের কর্মচারী বলা যায়। আল্লাহর বিধান ও নির্দেশাবলী তারা প্রবর্তন করে থাকেন। মূর্খ লোকেরা ভুলক্রমে তাদেরকে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও কাজ-কারবারে অংশীদার মনে করে। কেউ কেউ তাদেরকে মনে করে আল্লাহর আত্মীয়। এ জন্য দেবতা বানিয়ে তাদের পূজা করে।

৩৮) যে ব্যক্তি কারো অধিকারের আওতাধীনে তারই অর্পিত ক্ষমতা-ইখতিয়ার ব্যবহার করে তাকে খলীফা বলে। খলীফা নিজে মালিক নয় বরং আসল মালিকের প্রতিনিধি। সে নিজে ক্ষমতার অধিকারী নয় বরং মালিক তাকে ক্ষমতার অধিকার দান করেছেন, তাই সে ক্ষমতা ব্যবহার করে। সে নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করার অধিকার রাখে না। বরং মালিকের ইচ্ছে পূরণ করাই হয় তার কাজ। যদি সে নিজেকে মালিক মনে করে বসে এবং তার ওপর অর্পিত ক্ষমতাকে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে থাকে অথবা আসল মালিককে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে নিয়ে তারই ইচ্ছে পূরণ করতে এবং তার নির্দেশ পালন করতে থাকে, তাহলে এগুলো সবই বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য হবে।

৩৯) এটা ফেরেশতাদের আপত্তি ছিল না। বরং এটা ছিল তাদের জিজ্ঞাসা। আল্লাহর কোন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করার অধিকারই ফেরেশতাদের ছিল না। ‘খলীফা’ শব্দটি থেকে তারা অবশ্যি এতটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, পরিকল্পনায় উল্লেখিত সৃষ্টজীবকে, দুনিয়ায় কিছু ক্ষমতা-ইখতিয়ার দান করা হবে। তবে বিশ্ব-জাহানের এ বিশাল সাম্রাজ্য আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বের আওতাধীনে কোন স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন সৃষ্টজীব কিভাবে অবস্থান করতে পারে—একথা তারা বুঝতে পারছিল না। এই সাম্রাজ্যের কোন অংশে কাউকে যদি সামান্য কিছু স্বাধীন ক্ষমতা দান করা হয় তাহলে সেখানকার ব্যবস্থাপনা বিপর্যয়ের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে, একথা তারা বুঝতে চাইছিল।

৪০) এই বাক্যে ফেরেশতারা একথা বলতে চায়নি যে, খিলাফত তাদেরকে দেয়া হোক কারণ তারাই এর হকদার। বরং তাদের বক্তব্যের অর্থ ছিলঃ “হে মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ! আপনার হুকুম পালন করা হচ্ছে। আপনার মহান ইচ্ছা অনুযায়ী সমস্ত বিশ্ব-জাহানকে আমরা পাক পবিত্র করে রাখছি। আর এই সাথে আপনার প্রশংসাগীত গাওয়া ও স্তব-স্তুতি করা হচ্ছে। আমরা আপনার খাদেমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং আপনার তাসবীহ পড়ছি তাহলে এখন আর কিসের অভাব থেকে যায়? একজন খলীফার প্রয়োজন দেখা দিল কেন? এর কারণ আমরা বুঝতে পারছি না। (তাসবীহ শব্দটির দুই অর্থ হয়। এর একটি অর্থ যেমন পবিত্রতা বর্ণনা করা হয় তেমনি অন্য একটি অর্থ হয় তৎপরতার সাথে কাজ করা এবং মনোযোগ সহকারে প্রচেষ্টা চালানো। ঠিক এভাবেই তাকদীস শব্দটিরও দুই অর্থ হয়। এক, পবিত্রতার প্রকাশ ও বর্ণনা এবং দুই, পাক-পবিত্র করা।)

৪১) এটি হচ্ছে ফেরেশতাদের দ্বিতীয় সন্দেহের জবাব। বলা হয়েছে, খলীফা নিযুক্ত করার কারণ ও প্রয়োজন আমি জানি, তোমরা তা বুঝতে পারবে না। তোমরা নিজেদের যে সমস্ত কাজের কথা বলছো, সেগুলো যথেষ্ট নয়। বরং এর চাইতেও বেশী আরো কিছু আমি চাই। তাই পৃথিবীতে ক্ষমতা-ইখতিয়ার সম্পন্ন একটি জীব সৃষ্টি করার সংকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

﴿ وَعَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى الۡمَلٰٓٮِٕكَةِ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِىۡ بِاَسۡمَآءِ هٰٓؤُلَآءِ اِنۡ كُنۡتُمۡ صٰدِقِيۡنَ‏﴾

৩১.) অতঃপর আল্লাহ‌ আদমকে সমস্ত জিনিসের নাম শেখালেন৪২ তারপর সেগুলো পেশ করলেন ফেরেশতাদের সামনে এবং বললেন, “যদি তোমাদের ধারণা সঠিক হয় (অর্থাৎ কোন প্রতিনিধি নিযুক্ত করলে ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হবে) তাহলে একটু বলতো দেখি এই জিনি।কোন বস্তুর নামের মাধ্যমে মানুষ তার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে থাকে, এটিই হয় মানুষের জ্ঞান লাভের পদ্ধতি। কাজেই মানুষের সমস্ত তথ্যজ্ঞান মূলত বস্তুর নামের সাথে জড়িত। তাই আদমকে সমস্ত নাম শিখিয়ে দেয়ার মানেই ছিল তাঁকে সমস্ত বস্তুর জ্ঞান দান করা হয়েছিল।

﴿ قَالُوۡا سُبۡحٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَ

“তখন আদম তাঁর প্রভু পরোয়ারদেগারের নিকট থেকে কিছু কথা শিক্ষা করে তাওবা করে এবং তিনি উহা কবুল করেন।” –(সূরা আল বাকারা: ৩৭)

অর্থাৎ স্বীয় ত্রুটি মার্জনার জন্যে হযরত আদম (আ)-কে কঠিন রসম-রেওয়াজের কোন স্তর অতিক্রম করতে হয়নি; বরং এদিকে তিনি সর্বান্তকরণে তাওবা করলেন এবং ঐদিকে আল্লাহ তা মঞ্জুর করে নিলেন।

আল্লহর অনুগ্রহ ও বনি আদম

আদি পিতা হযরত আদম (আ)-এর ন্যায় তাঁর সন্তান-সন্ততিদের উপরও আল্লাহর অনুগ্রহ চিরন্তনভাবেই বর্তমান। হযরত আদম (আ) যেমন তার ত্রুটির পরেও আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হননি তেমনি তার সন্তান-সন্ততিরাও গোনাহ করে বসলে তাঁর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় না। কেননা আল্লাহ পাক তাদের স্বাভাবিক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং এ কারণে তিনি তাদের উপর ততটুকু বোঝা অর্পণ করেন যতটুকু তারা সহজেই বহন করতে সক্ষম। আল্লাহ এরশাদ করেন:

(আরবী********)

“আল্লাহ কোন প্রাণীর উপর তার ক্ষমতার চেয়ে অধিক দায়িত্বভার অর্পণ করেন না।” –(সূরা আল বাকারা: ২৮৬)

হযরত বিশ্বনবী (স) বলেন: (আরবী********)

“সকল মানুষ (বনি আদম) ভুলকারী। এবং ভুলকারীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা (তাদের পাপের কারণে লজ্জিত হয়ে) তাঁর নিকট তাওবা করে।” –[তিরমিযী]

আল্লাহর অনুগ্রহের ব্যাপকতা

পবিত্র কুরআনে আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহ ও ক্ষমা সম্পর্কে অসংখ্র আয়াত বর্তমান। আমরা এখানে একটি মাত্র উদাহরণ পেশ করছি:

(আরবী********)

“আর তোমরা দৌড়ে চল সেই পথে যে পথ যাচ্ছে তোমাদের প্রভু পরোয়ারদেগারের ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে –যার প্রশস্ততা হচ্ছে জমিন এবং সমস্ত আসমানের ন্যায়; আর যা তৈরী করে রাখা হয়েছে সেই সকল মুত্তাকীদের জন্যে যারা তাদের সম্পদ ব্যয় করে সুখে-দুঃখে সর্ব অবস্থায়, যারা গোস্বা হজম করে এবং মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়। আল্লাহ এই সকল নেক লোকদেরকে ভালোবাসেন। আর যাদের অবস্থা এই যে, কেউ কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন গোনাহ করে নিজেদের উপর জুলূম করলে সঙগে সংগেই তাদের আল্লাহর কথা স্মরণ হয় এবং তাঁর কিনট তাদের অপরাধের জন্যে ক্ষমা চায়; কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে তাদের অপরাধ ক্ষমা করতে পারে এবং তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মকে অব্যাহত রাখে না। -এই সকল লোকের প্রতিদান তাদের রবের নিকট এই যে, তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন এবং এমন উদ্যানে তাদের প্রবেশ করাবেন যার নিম্নদেশ থেকে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে এবং সেখানে তারা অনন্তকাল বসবাস করবে। সৎলোকদের জন্যে কতই না সুন্দর এই পুরস্কার।” –(সূরা আলে ইমরান: ১৩৩-১৩৬)

এই আয়াত দ্বারা পরিষ্কারভাবে অবগত হওয়া যায় যে, আল্লাহর অনুগ্রহ কত ব্যাপক, তার রহমত কত অপরিসীম। তিনি বান্দার শুধু তাওবাই কবুল করেন না, বরং তিনি গোনাহর সামান্যতম স্পর্শ থেকেও বান্দাকে পাক-পবিত্র করে একান্ত নিজ অনুগ্রহে মুত্তাকী ও নেক্‌কারদের মনোনীত দলের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।

আল্লাহর অনুগ্রহের এক বিস্ময়কর দিক

প্রশ্ন এই য, এমন দয়ালু ও স্নেহশীল আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমা সম্পর্কে কারুর অন্তরে বিন্দু-বিসর্গ পরিমাণ সন্দেহ থাকতে পারে কি? আল্লাহ এই সীমাহীন অনুগ্রহে যে বিশ্বাসী তার কোন মানসিক হতাশা বা নৈরাশ্য থাকতে পারে না। এই বিশ্বাসই তাকে বলে দেয়: সে কোন চিরন্তন গোনাহগার নয়। তার প্রভুর অনুগ্রহে যে কোন মুহূর্তেই সে গোনাহমুক্ত হয়ে পবিত্র হতে পারে। (দাগী আসামীর মত মোহরাঙ্কিত পাপী হয়ে তাকে থাকতে হয় না।) যখনই সে গোনাহর জন্যে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তখনই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তার অনুগ্রহের ছায়ায় স্থান দান করেন। এই ক্ষমা ও অনুগ্রহলাভের জন্যে প্রকৃত অনুতাপ ও লজ্জা ছাড়া অন্য কোন শর্ত নেই। এ কথাটি এতদূর স্পষ্ট যে, এর সমর্থনে কোন সাক্ষ্যের প্রয়োজন নেই; তবুও আমরা এই প্রসংগে বিশ্বনবী (স)-এর একটি মূল্যবান হাদীস এখানে উল্লেখ করছি:

“যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি: তোমরা যদি গোনাহ না করতে তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেন এবং তোমাদের স্থলে এমন লোকদেরকে আনতেন যারা গোনাহ করার পর ক্ষমাপ্রার্থী হতো, আর তাদেরকে মা করে দিতেন।” –[মুসলিম]

মনে হয়, মানুষের গোনাহখাতা মাফ করাই যেন আল্লাহ পাকের একান্ত কাম্য। পবিত্র কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়অতও এই প্রসংগে প্রণিধানযোগ

﴿ مَّا يَفۡعَلُ اللّٰهُ بِعَذَابِكُمۡ اِنۡ شَكَرۡتُمۡ وَاٰمَنۡتُمۡ‌ؕ وَكَانَ اللّٰهُ شَاكِرًا عَلِيۡمًا﴾

আল্লাহর কি প্রয়োজন তোমাদের অযথা শাস্তি দেবার, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকো।এবং ঈমানের নীতির ওপর চলো? আল্লাহ‌ বড়ই পুরস্কার দানকারী ও সর্বজ্ঞ। (সূরা আন নিসা: ১৪৭)

এটা নিশ্চিত যে, আল্লাহ মানুষকে কখনো দুঃখ-কষ্টে পতিত অবস্থায় দেখতে চান না;’ –চান মানুষকে তার সীমাহীন রহমত ও মাগফেরাতের পরশে সৌভাগ্যবান করে তুলতে।

বিষয়: বিবিধ

১৪৭৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383746
০৮ আগস্ট ২০১৭ বিকাল ০৫:৩১
হতভাগা লিখেছেন : স্ত্রী যদি যৌন মিলনে টাল বাহানা করে সব সময় তাহলে স্বামী কি তাকে ভরণপোষণ কমিয়ে দিতে পারবে ?

সে ক্ষেত্রে স্বামী কি তার যৌন আকাঙ্খা পর্ণ ছবি দেখে বা মাস্টারবেশন করে মেটাতে পারবে ?
383766
১২ আগস্ট ২০১৭ রাত ০৩:৪৮
জীবরাইলের ডানা লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনার এ প্রশ্ন মাসালার ব্যাপার এ পরিস্থিতি উপর নির্ভর করে। আপনি একজন মুফতীর কাছে শেয়ার করে ফয়সালা নিতে পারেন

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File