মরুর সিংহ ওমর মুখতার (রহ) Lion of the Desert

লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ০১ আগস্ট, ২০১৭, ০২:২৪:১৪ রাত



বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নড়বড়ে ওসমানীয় খেলাফতের যুদ্ধে পরাজয় আর জায়গা হারানো ছিল নিয়মিত ঘটনা।১৯১২ সালে “Italo-Turkish War” এ ওসমানীদের পরাজয়ের

পর লিবিয়ায় দখলদারিত্ব কায়েম করে মুসোলিনির

ইটালি।চলতে থাকে অসভ্যতা-বর্বরতা আর অন্যায়-

জুলুম । তপ্ত মুরুর বুকের অসহায় মানুষগুলো ধুকে ধুকে

মরছিল বিভিন্ন নির্যাতন ক্যাম্পে, তখন সিংহের মত

গর্জন করে মুসোলিনির কুকুরদের সামনে এসে

দাড়ালেন আল্লাহর এক বান্দা। তিনিই ওমর মুখতার

(রাহ), মরুর সিংহ।

১৮৬২ সালে উসমানীয় খিলাফতের অধীনস্ত আফ্রিকার

একটি ছোট শহরের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম।পড়েছেন

মসজিদ-মক্তবে। এরপর লিবিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে

পড়েছেন ৮ বছর।ছিলেন কোরআনে হাফিজ।প্রতি

সাতদিনে একবার সম্পূর্ণ কুরআন পড়ে শেষ করা ছিল

আজীবনের অভ্যাস।শিশুদের কে নিয়মিত তিনি কুরআন

শেখাতেন।

‘মরুর সিংহ’ উপাধি পেয়েছিলেন অল্প বয়সেই, সে

কাহিনীও বেশ মজার। একবার এক কাফেলার সাথে

সুদান যাচ্ছিলেন। যাত্রাপথের একটি সরু রাস্তা রোধ

করে একটি বিরাট সিংহ দাঁড়িয়েছিল। কাফেলার

সবাই আতংকিত হয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে সকলেই। অবশেষে সবাই

মিলে ঠিক করলো যে, সিংহটিকে একটি উট দেয়া

হবে; যাতে উটটি নিয়ে সে তাদের পথ ছেড়ে চলে যায়।

এই অবস্থায় তিনিই তার করণীয় ঠিক করে নেন। তিনি

তার শট গানটি নিয়ে ঘোড়ার উপর চড়ে বসলেন এবং

সিংহটির দিকে এগিয়ে গেলেন। সবার চোখ কপালে

উঠে গেল, কিছুক্ষণ পর তিনি সিংহটির মাথা নিয়ে

ফিরে এলেন! তার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে লোকেরা

তাকে উপাধি দেয় “সিয়েরানিকার সিংহ”।

১৯১১ সালের অক্টোবরে ইতালির ঔপনিবেশিক

সেনারা লিবিয়ার ত্রিপোলি শহরের সমুদ্রতীরে গিয়ে

পৌঁছে লিবীয়দের জানায়, হয় তারা আত্মসমর্পণ করবে

ইতালির কাছে, নয়তো পুরো শহর গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন ওমর মুখতার আর তার

বাহিনী। এর আগেও তিনি বনু সানুস গোত্রের সাথে

জোট বেঁধে প্রথমে ফ্রেঞ্চ এবং পরে ব্রিটিশদের

বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। মক্তব-শিক্ষক ওমর

মুখতারের নেতৃত্বে লিবীয়দের সশস্ত্র গেরিলা-যুদ্ধ

ইতালীয়দের চুড়ান্ত নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়ল।

মরুভূমিতে গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশলে তিনি ছিলেন

অনন্য।এছাড়া সমস্ত মরু এলাকা নখদর্পণে থাকায় তিনি

ইতালীয়দের কাছে হয়ে উঠেন মূর্তিমান আতংক।

লিবিয়ার ভয়াবহ মরুভূমির বুকে ইটালির দখলদারদের

উপর প্রায়ই মরু ঈগলের মত ঝাপিয়ে পড়তেন। সিংহের

মত দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন মুসোলিনির জালেম

অফিসারদেরকে। একসময় রোমে শুধু একটি নামই

উচ্চারিত হতো, মোস্ট ওয়ান্টেড ওমর মুখতার!

লিবিয়ার মুক্তিকামী মুসলমান বেদুঈনদের নয়নের মণি

হয়ে উঠেছিলেন এই সাদামাটা লোকটি।

সংঘর্ষ এড়াতে ইতালিয়ানরা তাকে উচ্চ পদ এবং

সম্পদের লোভ দেখায়। বিনিময়ে তাকে আত্মসমর্পণ

করে তাদের আনুগত্য মেনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।

এর জবাবে তিনি তার বিখ্যাত উক্তিটি করেন, “আমি

কোন মজাদার খাবার নই যে, কেউ চাইলেই আমাকে

গিলে ফেলবে। তারা আমার আদর্শ-বিশ্বাসকে

টলাতে যতই অপচেষ্টা করুক, আল্লাহ তাদের পরাজিত

করেই ছাড়বেন।”

তারা হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে যায়। পরবর্তী

অভিযানের শুরুতে তাকে আবার প্রস্তাব দেওয়া হয়,

তিনি যদি তার এলাকা ছেড়ে তাদের কাছে চলে

আসেন, তাহলে তিনি অর্থ-বিত্ত সহ বিলাসী জীবন

যাপনের সকল সুবিধা পাবেন। কিন্তু তিনি আবার এই

বলে প্রত্যাখ্যান করেন, “কখনোই না, আমার প্রভুর

সাথে মিলিত হওয়ার আগে আমি কিছুতেই এই মাটি

ত্যাগ করবো না। আমার কাছে মৃত্যুর চেয়ে প্রিয় আর

কিছুই নেই। আমি তো প্রতি মূহুর্তেই তার জন্য

অপেক্ষা করে আছি।”

বয়সের ভার তাকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এই মানুষটিই ছিলেন তার

দেশের মানুষের আশার কেন্দ্রস্থল। আধুনিক

অস্ত্রশস্ত্র সমৃদ্ধ হাজার হাজার সৈন্য আর

যুদ্ধবিমানের বিপরীতে তার ছিল কয়েকটি ঘোড়া,

সাধারণ রাইফেলধারী কিছু লোক, যারা পাহাড়ে

পাহাড়ে উপোস ঘুরে বেড়াচ্ছিল। উম্মাহর অন্যান্য

সাহসী সেনাপতিদের মতোই, তার শক্ত অবস্থান আর

তেজোদ্দীপ্ত কথায় লোকেরা তার পাশে জড়ো হতে

থাকে। তিনি ইতালিয়ানদের দূর্বল জায়গাগুলো খুঁজে

বের করে তাতে আঘাত হানতে শুরু করেন। যারা

ভেবেছিল, মুসলিম দেশগুলো দখল করতে কোন বেগই

পেতে হবে না, তারা এবার প্রচণ্ড ধাক্কা খেল।

ইতালীয় ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে মুখতারের প্রায় ২০

বছরব্যাপী লড়াই চালিয়ে যান।

শেষের দিকে বনু সানুস গোত্রের অনেক সহযোদ্ধারা

সাধারণ ক্ষমা,মাসিক স্যালারি ও ট্যাক্স থেকে

অব্যাহতির শর্তে ইতালীয়ানদের সাথে হাত মিলালেও

ওমর বিন্দুমাত্র টলেন নি। কেন তিনি যুদ্ধ চালিয়ে

যাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি শুধুমাত্র

ইসলামের জন্য যুদ্ধ করছেন। কাফিরদের দখলদারিত্ব

থেকে মুসলিম ভূমি রক্ষা করাকে তিনি ফরজ মনে

করতেন। আল্লাহর শত্রুদের সাথে তিনি কোন ধরনের

আপোষ করতে অস্বীকৃতি জানান।

অবশেষে ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এক অভিযানে

তার ঘোড়াকে গুলি করে হত্যা করা হলে তিনি বন্দী

হন। যে অফিসার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো সে

বলে, “তাকে যখন আমার অফিসে হাজির করা হয়,

তাকে অন্য সব মরুযোদ্ধাদের মতোই ভেবেছিলাম। তার

হাত ছিলো শিকলবদ্ধ। অবিরাম যুদ্ধ করতে করতে তার

শরীরের অনেক হাড়গোড়ই ভেঙ্গে গিয়েছিল। একারণে

তার হাঁটতেও খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু এত কিছুর পরও

তাকে কোন সাধারণ সৈনিকের মত লাগছিলো না।

তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং ধীর শান্ত কণ্ঠে

প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। তার চেহারায় সূর্যের মত

দ্যুতি আমার মনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল।

কথোপকথনের শেষ ভাগে আমার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করে।

আমি তাড়াতাড়ি জেরা শেষ করে তাকে পরের দিন

কোর্টে হাজির করার নির্দেশ দিই।”

ইতালীয়ানরা তাকে চিনতে পেরে অবাক হয়ে যায়।

তাকে বেনগাজীতে প্রেরন করা হয়।ইতালীয়ান

সেনাপ্রধান জিজ্ঞাসাবাদে তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি

যদি তোমার সহযোদ্ধাদের অস্ত্র ত্যাগ করার আদেশ

দাও,তবে তা কার্যকর হতে কতক্ষণ সময় লাগতে পারে?’

তিনি জবাবে বলেন, ‘আমার কিছুই করার নেই।আমরা,

মুজাহিদগণ আল্লাহর কাছে এই মর্মে প্রতিজ্ঞা

করেছি যে আমরা একের পর এক মৃত্যুবরণ করার আগে

পর্যন্ত যুদ্ধ করব। যতক্ষণ না পর্যন্ত তোমরা এই দেশ

ত্যাগ করবে অথবা আমি আমার দেহ ত্যাগ করবো,

ততক্ষণ আমি লড়াই চালিয়ে যাবো। মানুষের অন্তরের

গোপন কথাও যার অগোচরে নয় তার শপথ, যদি এই

মূহুর্তে আমার দুই হাত বাঁধা না থাকতো আমি খালি

হাতেই তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম।’

ইতালীয়ানরা তাকে মুক্তির বিনিময়ে মুজাহিদদের

কাছে যুদ্ধ বন্ধ করার চিঠি লিখতে বললে তিনি সেই

বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন, "যেই শাহাদত আঙ্গুলি

দিয়ে আমি প্রতিদিন সাক্ষ্য দেই যে এক আল্লাহ

ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই। সেই আঙ্গুল মিথ্যার কোন

কথা লিখতে পারবে না। আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর

কারো কাছে আত্মসমথর্পণ করি না। আমরা হয় জিতি,

না হয় মরি।"

তার চারিত্রিক দৃঢ়তায় জেলারগণ পর্যন্ত অবাক হয়ে

গিয়েছিল।

উমার মুখতারের কোর্ট মার্শাল বেনগাজিতে হয়।

বিচার শুরু হওয়ার আগে থেকেই কোর্টের বাইরে

ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত রাখা হয়েছিল!

ট্রাইব্যুনালে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি কার

বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ?

ওমরঃ ইতালীয়ান শাসকের।

প্রশ্নঃকয়টি যুদ্ধে অংশ নিয়েছ?

ওমরঃ অনেক,সঠিকভাবে বলতে পারব না। তাছাড়া

যেগুলোতে অংশ নেই নি, সেগুলোও আমার

নির্দেশনায় হয়েছে।

প্রশ্নঃতুমি কি (যুদ্ধে) গুলি চালিয়েছ?

ওমরঃ হ্যা, অনেকবার।

প্রশ্নঃতুমি কি সকল যুদ্ধবন্দীদের হত্যার হুকুম

দিয়েছিলে?

ওমরঃ আমি তা দিইনি।

প্রশ্নঃতোমার সাথে কি তোমার রাইফেল ছিল (বন্দী

হওয়ার সময়)?

ওমরঃএকটি রাইফেল ও ছয়টী কার্টিজ ছিল।

তখন প্রসিকিটিং কাউন্সিল (কর্নেল বেডেন্ডো) রায়

পাঠ করেন,

‘তুমি কোন সৈনিক নও,বরং ডাকাত যে সর্বদা

আত্মগোপনে থেকেছে।তুমি পাবলিক হেয়ারিং এ

মিথ্যা বড়াই করেছ এসব যুদ্ধে অংশ নেয়ার কথা বলে।

আসলে আমাদের প্রসিদ্ধ বিমানবাহিনী তোমাকে

তোমার গুহা থেকে বের করে নিয়ে এসেছে।

জিজ্ঞাসাবাদের সময় তুমি তোমার চশমা ফিরে

চাওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছ।পক্ষান্তরে আমি বিশ্বাস

করি না যে, তোমার পড়ায় উৎসর্গ করার মত হায়াত

অবশিষ্ট আছে।তোমার নিজের কৃতকর্মের জন্যে কোন

আক্ষেপ নেই।তোমার দেশবাসীকে এরকম দুরবস্থায়

নিমজ্জিত করার জন্যে তুমিই দায়ী।কোর্ট তোমাকে

সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ,যা হল দেশের সার্বভৌম শক্তির

বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করার অপরাধে অভিযুক্ত করে

তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে।’

অনুবাদক রায় শুনালে ওমর শুধু একটি কথাই বলেন, “ইন্না

লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” (নিশ্চয়ই

আমরা আল্লাহর জন্যে এবং আল্লাহর কাছেই ফিরে

যাব;বাকারাঃ১৫৬)।

আটকের ৩ দিনের মধ্যে রায় এবং রায়ের পরেই ফাসি

কার্যকর করা হয়।সুলুখের একটি ক্যাম্পে জনসম্মুখে

তার ফাসি দেয়া হয় এবং তার ফাসির মাধ্যমে ভয়

দেখানোর জন্যে সেখানকার মুসলমানদের বলপূর্বক

ফাসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত করা হয়।

মৃত্যুর পূর্বে তিনি উচ্চারণ করেনঃ

ﻳَﺎ ﺃَﻳَّﺘُﻬَﺎ ﺍﻟﻨَّﻔْﺲُ ﺍﻟْﻤُﻄْﻤَﺌِﻨَّﺔُ ﺍﺭْﺟِﻌِﻲ ﺇِﻟَﻰٰ ﺭَﺑِّﻚِ ﺭَﺍﺿِﻴَﺔً ﻣَّﺮْﺿِﻴَّﺔً

“হে প্রশান্ত আত্মা।তুমি তোমার রবের নিকট ফিরে

যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।” (সূরা ফজর, ২৭-২৮)

প্রথম ছবিঃ আটকের পর ওমর আল মুখতার (রাহ)

দ্বিতীয় ছবিঃ লিবিয়ার দশ দিনারের মুদ্রায় তাদের

জাতীয় হিরো ওমর মুখতার (রাহ)

বিষয়: বিবিধ

৮৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File