বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের করণীয়

লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ২৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:৪১:৩৩ রাত



আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আলকুরআনের অনেক জায়গায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে তিনি যালেমকে পছন্দ করেননা। তিনি যালিমকে আখিরাতে কঠিন শাস্তি দিবেন। আর দুনিয়াতেও ফেরাউন-শাদ্দাদ, নমরুদসহ কিছু যালিমের করূণ পরিণতি এবং আদ-সামুদসহ বিভিন্ন জাতি ধ্বংস হওয়ার ঘটনা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আজকের যুগেও যারা সত্য ও ন্যয়ের পথে চলছেন তারা যালেমদের যুলমের শিকার হচ্ছেন। যালেমের এই ধরনের যুলমের শিকার শুধু অমুসলিমদের দ্বারা হচ্চেনা বরং পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশে কিছু মুসলিম শাসকের হাতেও চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অনেক সত্যপন্থী মানুষ। ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, ইরাক, বসনিয়াসহ পৃথিবীর নানাদেশে যখন অমুসলিমরা সরাসরি আক্রমণ করে তখন আমরা তা সহজেই দেখি এবং প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠি। কিন্তু মিশর, বাংলাদেশ, আলজেরিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে মুসলিম শাসকদের হাতে যখন মুসলমানেরা নির্যাতিত হয় তখন সে খবর খুব কম লোকই রাখে। পৃথিবীর মানুষগুলো না জানলেও আল্লাহ পাক জানেন কারা কিভাবে কাদের উপর নির্যাতন করছে এবং মাযলুমের ফরিয়াদ আল্লাহ শোনেন।

আল্লাহ তায়ালা অতিথী আবরাহার বাহিনীকে আবাবিল পাখি দিয়ে ধ্বংস করেছেন। ফেরাউন নদীতে ডুবে মরেছে। নমরুদ ক্ষুদ্র মশার কামড়ে নিহত হয়েছে। তিনি বর্তমান যামানার যালিমদেরকেও শায়েস্তা করতে পারেন। বদর যুদ্ধে ফেরেশতা পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তিনি এইভাবে কখন সাহায্য করবেন তা একান্তভাবে তাঁর ইচ্ছা। কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে মুসলমানদেরকেই হক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সাধনায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নানা ধরনের ঘাত প্রতিঘাত এবং যুলম নির্যাতন সহ্য করেই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হলে তাদেরকে আল্লাহর রাসুল (সা) এর সুন্নাহ এবং তাঁর সাহাবাদের আদর্শ থেকে সংকট ও প্রতিকুলতা মোকাবিলার জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। নিম্নে কুরআন ও হাদীস থেকে আমি কয়েকটি পয়েন্ট অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

১. আল্লাহর ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা: আল্লাহর বান্দাহ হিসাবে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য যেই ফায়সালা করেন তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এইভাবে যারা প্রশান্ত চিত্তে আল্লাহর সকল ফায়সালা গ্রহন করেন তাঁরা ক্বালবে সালীমের অধিকারী হন। আর যারা ক্বালবে সালীমের অধিকারী তাঁরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে ভাল-মন্দ সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। এই প্রসংগে আল্লাহ বলেন, এমন কোন বিপদ নেই, যা দুনিয়াতে বা তোমাদের নাফসের উপর নাযিল হয়, আর আমি একে পয়দা করার আগেই তা এক কিতাব (তাকদীরে) লিখে রাখিনি। এমনটা করা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ কাজ- (হাদীদ-২২) ।

২. আল্লাহর দরবারে ধরনা দেয়া: আল্লাহর বান্দাহরা বিপদ মুসীবতে পতিত হলে অন্য কারো কাছে ধরনা দেয়ার পরিবর্তে আল্লাহর কাছেই ধরনা দেয়। মূলত একজন মুমীন সংকটজনক সময়ে আল্লাহর সাহায্য চায়। যখন দুনিয়ার সকল শক্তি ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় তখন তারা ভড়কে না গিয়ে আল্লাহর কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করে। জাগতিক উপায়উপকরণের উপর নির্ভরশীল থাকেনা। তাঁরা নির্ভরশীল থাকে আল্লাহর রহমতের উপর। জাগতিক সহায় সম্পদ তাদের কম থাকলেও সবচেয়ে বড় অস্ত্র তাদের কাছে রয়েছে। আর তা হচ্ছে দোয়ার অস্ত্র। আল্লাহর রাসূল (স) এর ভাষায় দোয়া হচ্ছে মু’মিনের অস্ত্র। দুনিয়ার কোন শক্তি যত বড় অস্ত্র নিয়ে আসুক না কেন দোয়ার অস্ত্রের কাছে সব কিছু তুচ্ছ। আল্লাহ যদি ইচ্ছে করেন সকল অস্ত্রকে অকার্যকর করে দিতে পারেন। যা অতীতে অনেক সময় করে তাঁর কুদরত দেখিয়েছেন। তবে এর অর্থ এ নয় যে মু’মিনরা জাগতিক কোন উপায় উপকরণ ব্যবহার করবেনা- মু’মিনদেরকে সামর্থ্য অনুসারে জাগতিক উপায় উপকরণ ব্যবহার করতে হবে।

৩. সবরও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবেঃ সংকটজনক সময়ে অনেকে অস্থির হয়ে উঠেন। অস্থির হয়ে কোন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই শান্তভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ধৈর্য্য ও সাহসিকতার সাথেই বিপদসংকুল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে। আর নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পবিত্র অভ্যাস এই ছিল যে যখনই তিনি কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনই নামায আরম্ভ করতেন। আর সে নামাযের বরকতেই তাঁর যাবতীয় বিপদাপদ দূর করে দিতেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, মহানবীকে যখনই কোন বিষয় চিন্তিত করে তুলত তখনই তিনি নামায পড়তে শুরু করতেন। নামায এবং সবরের মাধ্যমে যাবতীয় সংকটের প্রতিকার পাওয়ার কারণ এই যে,এই দুই পন্থায়ই আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত সান্নিধ্য লাভ হয়।

৪. উগ্রতা প্রদর্শন কিংবা বাড়াবাড়ি না করা: ঈমানের দাবী হচ্ছে ময়দানে দৃঢ় থাকা কিন্তু কোন অবস্থাতেই উগ্রতা প্রদর্শন কিংবা বাড়াবাড়ি করা যাবেনা। কঠিন পরিস্থিতিতে ময়দানে দৃঢ় থাকতে হবে তবে কোন অবস্থাতে শত উস্কানীর মুখেও সীমালংঘন করা যাবেনা। অনেক সময় বিরোধী পক্ষ উস্কানী দেয় যেন সত্যপন্থীরা মেজাজের ভারসাম্যতা হারিয়ে একটু উগ্রতা প্রদর্শন করে। সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলতে হবে।

৫. মন্দের জবাব উত্তমভাবে দেয়া: আদর্শিক আন্দোলনের কর্মীরা মন্দের জবাব মন্দভাবে দেয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। এই প্রসংগে আল্লাহ পাক বলেন, (হে নবী!) সৎ কাজ ও অসৎ কাজ এক সমান নয়। আপনি অসৎ কাজকে ঐ নেক কাজ দ্বারা দমন করুন, যা সবচেয়ে ভালো। তাহলে দেখতে পাবেন যে, যার সাথে আপনার দুশমনি ছিলো, সে আপনার প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে। সবরকারী ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না। আর অতি ভাগ্যবান ছাড়া আর কেউ এ মর্যাদা লাভ করতে পারে না। যদি কখনো টের পান যে, শয়তান আপনাকে ওয়াসওয়াসা দিচ্ছে, তখনই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু শোনেন ও সব কিছু জানেন। (ফুসসিলাতঃ ৩৪-৩৬)।

৬. আর্থিক কুরবানী পেশ করা: সংকটজনক মুহূর্তে অনেক সময় আর্থিক সংকট দেখা দেয়। যারা আহত হয় তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। যারা কারাবন্দী হন তাদের পরিবারের খোঁজখবর রাখতে হয়। আবার যারা শহীদ হন তাদের পরিবার পরিজনের প্রতিও দায়িত্ব থাকে। মিথ্যা মামলার কারণে আইনী লড়াইয়ে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। এছাড়া আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গও নানাভাবে আর্থিক সংকটে পতিত হয়। এমতাবস্থায়ও আল্লাহর পথে মালের কুরবানী দেয়ার নজরানা পেশ করতে হয়। তাবুক যুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা) তাঁর সকল সহায় সম্পদ আল্লাহর রাসুলের সামনে হাজির করেন। হযরত উমর (রা) তাঁর সম্পদের অর্ধেক দান করেন। আর হযরত উসমান বিপুল পরিমাণ সাদকা করেন। এইভাবে ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, সংকটকালে মুমীনরা দান খয়রাত বেশী বেশী করতো। কেননা সংকটকালে দান করা বা ভূমিকা পালন করার সাওয়াব আর সংকট উত্তরণ হওয়ার পরে দান করা বা ভূমিকা পালনের সাওয়াব এক নয়।

৭. পরস্পর বিবাদে লিপ্ত না হওয়াএবং আভ্যন্তরীণ শৃংখলা নষ্ট না করাঃ কঠিন মুহূর্তে পর্যালোচনা বেশী হয়। এই সময় বিপদের কারণ নিয়ে অনেক সময় পরস্পরের প্রতি দোষ দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণে মত পার্থক্য দেখা দেয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে কোন অবস্থাতেই পরস্পরের বিবাদে লিপ্ত হওয়া যাবেনা এবং অভ্যন্তরীণ শৃংখলা নষ্ট করা যাবনা। আমাদেরকে সব সময় আদর্শের প্রতি অনুগত থাকতে হবে। অনেক সময় মুসলমানদেরকে নেতৃত্ব শুন্য করার চেষ্টা করা হয়। সে সময় একদিকে নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থাকতে হবে অপরদিকে কখনও কোন কারণে ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও আদর্শের প্রতি কমিটমেন্ট রার ক্ষেত্রে কোন ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবেনা। কেননা ইসলাম ব্যক্তি নয় বরং আদর্শের প্রতি অনুগত থাকতে নির্দেশ দেয়।

৮. বিশ্বাস করতে হবে যে নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পথে যারা চলে তারাই বিজয়ী হবে: আদর্শের বিজয়ের ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয় থাকতে হবে। এই প্রসংগে আল্লাহ বলেন, আল্লাহ লিখে দিয়েছেন যে, আমি ও আমার রাসূলই বিজয়ী হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই শক্তিশালী ও জবরদস্ত । তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যা, যারা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান রাখে তারা ঐসব লোককে মহব্বত করে যারা আল্লাহ ও র্তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করেছে- তারা তাদের পিতা হোক বা পুত্র হোক বা ভাই হোক বা আত্মীয় হোক। তাঁরাই ঐসব লোক, যাদের দিলে আল্লাহর ঈমান কায়েম করে দিয়েছেন এবং নিজের প থেকে একটি রূহ দান করে তাদেরকে শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন বেহেশতে প্রবেশ করাবেন, যার নিচে ঝরনাধারা বহমান। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হয়েছে। তারা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রাখো যে, আল্লাহর দলই কামিয়াব হবে-(সূরা মুযাদালাহ ২১-২২)।

৯. সর্বাবস্থায় সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে চলতে হবে: দুর্বলচেতা মানুষ সংকটকালে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথ ছেড়ে দিতেও কার্পণ্য করেনা কিন্তু বিজয় দেখলে আবার ঈমানদারদের সাথেই থাকতে চায়। এই প্রসংগে আল্লাহ বলেন, মানুষের মধ্যে কেউ এমনও আছে যে বলে, আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। কিন্তু যখনই আল্লাহর (প্রতি ঈমান আনার) কারণে তাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে, তখন লোকদের চাপিয়ে দেওয়া পরীক্ষাকে সে আল্লাহর আযাবের মতো মনে করে নিয়েছে। এখন যদি আপনার রবের পক্ষ থেকে বিজয় ও সাহায্য এসে যায় তাহলে এ লোকটিকেই বলবে, আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। দুনিয়াবাসীর মনের অবস্থা কি আল্লাহ ভালোভাবে জানেন না? আল্লাহ তো অবশ্যই অবশ্যই যাচাই করে দেখবেন যে, কারা ঈমান এনেছে, আর কারা মুনাফিক (আনকাবুতঃ ১০-১১)।

১০. কোন অবস্থাতেই হতাশ কিংবা মনোবল হারানো যাবেনা: আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাহদেরকে হতাশ হতে নিষেধ করেছেন। আমাদেরকে আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে এবং আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল রাখতে হবে। জনসংখ্যা বা বস্তুগত কোন ধরনের সহায় সম্পদের উপর নির্ভরশীল হয়ে গর্ব অহংকার প্রকাশ পায় এমন কোন কথা বা কাজ করা যাবেনা। হোনাইন যুদ্ধের সাময়িক পরাজয়ে এই শিক্ষাই নিহীত রয়েছে।

১১. সুদুর প্রসারী চিন্তা ও ভিশনারী পরিকল্পনার অধিকারী হতে হবে এবং কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে:আল্লাহর রাসুল (সা) কর্তৃক মদীনা সনদ ও হুদাইবিয়ার সন্ধি এই ক্ষেত্রে বিরাট নজীর হয়ে আছে। তিনি অনেক সময় গন্তব্যস্থলের উল্টো পথে প্রথমে রওয়ানা করতেন। এইভাবে আল্লাহর রাসুল (সা) এর জীবন থেকে অনেক কৌশল জানা যায় যা আজকের সময়েও আমাদেরকে সংকটজনক সময়ে নির্দেশনা দান করে। মুতার যুদ্ধে আল্লাহর রাসুল (সা) পরপর তিনজন সেনাপতির নাম উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু চতুর্থ সেনাপতির নাম উল্লেখ করেন নাই। আল্লাহর রাসুল (সা) যেই তিনজন সেনাপতির নাম উল্লেখ করেছেন তাঁরা সবাই শহীদ হওয়ার পর সাহাবারা চতুর্থ সেনাপতি নিজেদের মধ্য থেকে নিয়োগ করেন।

১২. আমাদেরকে হাওয়ারীর দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং মাযলুমের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে : আল্লাহ পাক মাযলুমের কথা সরাসরি শোনেন; মাযলুমের ফরিয়াদ সাথে সাথেই কবুল করেন। তাই মাযলুমকে অসহায় মনে করার কোন কারণ নেই। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং মাযলুমের সাহায্য করেন। তিনি কখনও ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করেন। আবার কখনও আবাবিল পাখি বা ক্ষুদ্র একটি মশা দিয়েও যালিমকে শায়েস্তা করার মাধ্যমে মাযলুমের সহযোগিতা করেন। মাযলুমের হৃদয়ে দৃঢ়মনোবল সৃষ্টি করে হকের উপর অটল ও অবিচল রাখার মাধ্যমেও তিনি মাযলুমকে সাহায্য করে থাকেন।

আল্লাহ পাক মাযলুমের সাহায্য করেন তাই বলে কি আমাদের কোন করণীয় নেই? আমাদের অবশ্যই করণীয় রয়েছে। রাসুলে কারীম (সা) মাযলুমের সাহায্য করার জন্য সরাসরি নির্দেশ দিয়ে বলেছেন ’’ উনসুর আখাকা যালিমান আও মাযলুমান’’- এই হাদীসের আলোকে যালেম ও মাযলুম উভয়কে সাহায্য করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ আমরা মাযলুমকে সাহায্য করতে পারি কিন্তু যালেমকে কিভাবে সাহায্য করব? আল্লাহর রাসুল (সা) জবাবে বলেছেন যুলম থেকে বিরত রাখার চেষ্টার মাধ্যমেই যালেমকে সাহায্য করা যায়। যালেম যদি যুলম করার সময় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় তাহলে সে কম যুলম করবে আর এর ফলে তার কম পাপ হবে। আমাদের সমাজে অনেকই যালেমকে এত বেশী ভয় পান যে তারা যুলমের প্রতিবাদ করার সাহস পাননা। আর কেউ কেউ যালেমকে ঘৃণা করেন সত্য কিন্তু প্রকাশ্যে মাযলুমের সাহায্য করতেও ভয় পান। আর কেউ আছেন তারা নীরব থাকেন এরফলে যালেম যুলম করতে আরও বেশী উৎসাহিত হয়। আর কেউ আছেন যালেম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর থাকেন এবং মাযলুমকে সকল ধরনের সহযোগিতা করেন। আর কিছু মানুষ আছে তারা মাযলুমের পরিবর্তে যালিমকেই আরও বেশী যুলম করতে সাহায্য করেন।

আমার আফসোস লাগে আমরা কিভাবে যুলম দেখে নীরব ভূমিকা পালণ করি? মাযলুমের কান্নার আওয়াজ শোনেও না শোনার ভান করি? অথচ আমাদের হাওয়ারীর ভূমিকা পালন করার কথা ছিল। আমি মনে করি মাযলুমের কান্না শোনার পরও যদি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করি তাহলে একদিন আমাদেরকে জবাবদিহীর সন্মুখীন হতে হবে এবং নিজেদের বিবেকের কাছেও অপরাধী হয়ে থাকতে হবে আমরণ। হয়তবা এমন সময় আসবে তখন বর্তমানের ভূমিকার জন্য শুধু অনুশোচনা- কান্নাই করতে হবে। কিন্ত তা বেশী ফলদায়ক হবেনা। তাই সময়মত আমাদের করণীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে।

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মাযলুমের সাহায্যে কিভাবে অতীতে অনেকই ভূমিকা পালন করেছেন তার উল্লেখ আছে। হযরত ঈসা (আ) তৎকালীন শত্রুদের আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে যখন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন – মান আনসারি ইলাল্লাহ- আল্লাহর দ্বীন প্রচারে কে আমার সাহায্যকারী হবে? প্রত্যুত্তরে বারজন লোক আনুগত্যের শপথ করে এবং খৃস্টীধর্ম প্রচারে হযরত ঈসাকে সাহায্য করার ঘোষণা দেয়। তাঁরা হযরত ঈসার আন্তরিক বন্ধু হিসাবে ভূমিকা পালন করেন। আল-কুরআনের সুরা সফে তাঁদেরকেই ’’হাওয়ারী’’ হিসাবে উল্লেখ করা হয় (তাফসীর মাআরেফুল কুরআন)।

প্রত্যেক যুগে যেমনি যালিম থাকে তেমনি হাওয়ারীও থাকে। যালিমরা যুলম করে আর হাওয়ারীরা মাযলুমের পক্ষে ভূমিকা পালন করে। আর এটাই পৃথিবীর বাস্তবতা যে, রাতের পর দিন আসে এবং দিনের পর রাত আসে। মানুষের জীবনে কখনও সুখ আসে আর কখনও দুখ আসে। নদীতে কখনও জোয়ার আসে আবার কখনও ভাটা আসে। আকাশে প্রচন্ড ঘুর্ণিঝড় দেখা দিলেও তা এক সময় থেমে যায়। সব সময় ঘুর্ণিঝড় থাকেনা। সব সময় বাতাস একদিকে প্রবাহিত হয়না। বাতাসের গতি সব সময় সমান থাকেনা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর মুমীন বান্দাহদের সব সময় বিপদে রেখেই খুশী হন বিষয়টা এমনটি নয়। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাহদের আরও বেশী প্রিয়পাত্র বানাবার জন্য পরীক্ষা করেন। এই ক্ষেত্রে কাউকে একটু বেশী পরীক্ষা করেন আর কাউকে কম করেন। কাউকে বেশী সময় পরীক্ষায় রাখেন আর কাউকে কম সময়ের জন্য পরীক্ষা করেন। কাউকে পরীক্ষার সময় গায়েবী সাহায্য পাঠিয়ে দুনিয়াতেই উক্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেন। আর কাউকে পরীক্ষার সময় তাঁর দরবারে উঠিয়ে নিয়ে যান। তবে কাকে কখন কিভাবে পরীক্ষা করা হবে এবং উক্ত পরীক্ষার শেষ পরিণতি কি হবে তা শুধুমাত্র তিনিই জানেন।

অতীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের উপর যারা যুলম নির্যাতন করেছে তারা দুনিয়াতেই ধ্বংস হয়েছে কিন্তু আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দাহদেরকে রা করেন। ফেরাউন কর্তৃক হযরত মুসাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং হত্যা প্রচেষ্টার সময় ফেরাউন নদীতে ডুবে মারা যায় আর হযরত মুসা ও তাঁর অনুসারীদের জন্য বারটি রাস্তা করে আল্লাহ পাক তাদেরকে উদ্ধার করেন। হযরত আসিয়ার উপর নির্যাতন চলাকালে তিনি আল্লাহর কাছে শাহাদাতের প্রার্থনা করেন আল্লাহ পাক তাঁর দুআ কবুল করেন। আবার হযরত ঈসাকে শুলিবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হলে আল্লাহ পাক তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যান।

আল্লাহ পাক মাঝে মধ্যে তাঁর প্রিয় বান্দাহদেরকে শত্রুর হাত থেকে রা করেন। শত্রুর চোখের সামনে দিয়ে তাঁরা চলে যান কিন্তু তারা তাঁদেরকে দেখতে পাননি। আল্লাহ তায়ালা শত্রুদের চোখে পর্দা দিয়ে দেন। আল্লাহর রাসুল (সা) মদীনায় হিজরাতের সময় যখন সাওর গুহায় ছিলেন তখন ক্ষুদ্র মশার বাসা দিয়ে গর্তের মুখ ঢেকে দেন। ফলে শত্রুরা গর্তের মুখে মশার বাসা দেখে চিন্তাই করেনি যে উক্ত গর্তের ভিতর কেউ থাকতে পারে।

আল্লাহর প্রিয় বান্দাহরা আল্লাহর ফায়সালার প্রতি সব সময় সন্তুষ্ট থাকেন। আল্লাহ পাক তাদেরকে কোন বিপদাপদে পতিত করলে তাঁরা কখনও মন খারাপ করেননা কিংবা আল্লাহ অখূশী হতে পারেন এমন কোন উক্তি করেননা। এইভাবে যারা আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকেই আখিরাতে জান্নাত দান করবেন। আর কখনও কখনও দুনিয়াতেও তাদেরকে মহাবিজয় দান করেন। হযরত ইউসুফ, হযরত দাউদ, হযরত সুলাইমান দুনিয়াতেও রাজকীয় সম্মান ভোগ করেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে কোন একটি দেশে কেউ চিরদিন একই অবস্থানে থাকেননা। কেউ কখনও শাসক হয় আবার শাসিত হয়। কখনও যালিম হয় বা মাযলুম হয়। হিটলার তার মতার সময় অনেক নির্মম অত্যাচা চালায় কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে যে হিটলারের পরিণতিও কত করুন হয়েছে। হিটলারের শাসনেরও অবসান আছে। ফেরাউন – নমরুদ এর শাসনেরও শেষ ছিল।

বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যেসব দেশে মুসলমানেরা নির্যাতিত হচ্ছে সেসব দেশে সব সময় একই অবস্থা থাকবেনা ইনশাআল্লাহ। সময়ের আবর্তনে যেমনি রাতের গভীরতার পর সোবহি সাদেকের আলোক রশ্মি দেখা দেয়। অনুরুপভাবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যালিমদের পতন ঘটবে। আর মাযলুম মানবতা খুঁজে পাবে ন্যয় ও ইনসাফের সৌধের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি সুন্দর সমাজ। এই জন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য, হিকমাত ও সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা। জাগতিক উপায় উপকরণের পরিবর্তে আল্লাহর উপর ভরসা করে পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় প্রচেষ্টা চালানো। সর্বদায় হকের উপর অটল ও অবিচল থাকা এবং শত উস্কানী ও বাড়াবাড়ির সত্বেও সীমালংঘন না করা।

বিষয়: বিবিধ

২৬২০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

366777
২৩ এপ্রিল ২০১৬ সকাল ১০:৫৪
awlad লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File