তপ্ত মরুর নীচেই রয়েছে বিশাল জলরাশি?
লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ২৫ মার্চ, ২০১৬, ০৭:৩৯:১৪ সকাল
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) একবার আরবের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, উপচে পড়া সম্পদের প্রাচুর্য না আসা পর্যনন্ত, মরুভূমিগুলো আবার তৃণভূমিতে পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এবং মরুভূমির নদ-নদীগুলো আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। তিনি তাঁর জাতির লোকদের উদ্দেশ্যে আরো বলেছিলেন, আরব ভূমিতে প্রাচুর্য এত বিপুল পরিমাণে আসবে যে, সেখানে যাকাত নেয়ার মত কোন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মহানবী (সা.) যে সময়ে উক্ত ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন সে সময়ে আরবের মরুচারী নগ্নপায়ী লোকেরা ছিল নিতান্তই গরীব। অভাব-অন্টন ছিল তাদের নিত্যসাথী। কিন্ত আরবের এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আল্লাহ’র দেয়া অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের কল্যাণে সেখানে এখন অভাব বলতে কিছু নেই। মরুভুমির লোকেরা এখন যেন উপচে পড়া সম্পদ ও ঐশর্যের প্রাচুর্যে ভাসছে। তাই বলা যায়, মহানবীর ভবিষ্যৎবাণীর প্রথম অংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ? আরব ভূ-খণ্ডের বিশাল-বিস্তীর্ণ মরুভূমিগুলো কি সত্যিই পানিতে ভরে উঠবে? যতদূর চোখ যায় ধুধু বালুচর আর বালিয়ারিগুলো কি সত্যিই খাল-বিল, নদ-নদী ও তৃণভূমিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে? কিন্তু কীভাবে? একি বিশ্বাসযোগ্য?
কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ভবিষ্যৎবাণী অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য এবং মরুভূমিগুলো অবশ্যই জলময় তৃণভূমি ও নদ-নদী, খাল-বিলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে, সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। শুধু আরবের মরুভূমিই নয়, বিজ্ঞানীরা বলছেন, আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি, সুদানের খরাপীড়িত শুষ্ক অঞ্চল; যেখানে পানির অভাবে লোকেরা পশুর রক্ত পান করে সেই দারফুরের পানিশূন্য অঞ্চলগুলোও পানিতে ভরে উঠবে, সবুজ বন-বনানী ও নদ-নদীতে পূর্ণ হয়ে উঠবে; কেননা, প্রতিটি মরুভূমির নীচেই লুকিয়ে আছে বিশাল জল ভাণ্ডার, বিশাল বিশাল লেক, বড় বড় নদ-নদী ইত্যাদি।
বলাবাহুল্য, নাসার বিজ্ঞানীগণ এসব বিষ্ময়কর খবর আমাদের জানিয়েছেন গবেষণা রিপোর্ট ও সরেজমিন তদন্তের ভিত্তিতে, কোন আন্দাজ-অনুমাণের ভিত্তিতে নয়। ইতিমধ্যেই তারা মিশর ও সুদানে দুটি বিশাল প্রাচীন লেক ও নদীর সন্ধান পেয়েছেন। মরুভূমির বালির গভীর নীচে সেগুলো বিরাজমান।
নাসা’র এপোলো প্রোগ্রামের লুনার সাইন্স প্লানিং-এর সুপারভাইজার, বোস্টন ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রিমোট সেনসিং-এর পরিচালক প্রখ্যাত ভূ-তত্ত্ববিদ ড. ফারুক আল বাজ জানিয়েছেন, বিশ্বের যে কোন মরুভূমি এবং বিশেষ করে আরব বিশ্বের মরুভূমির তলদেশে এত বিশাল পানির মজুদ লুকিয়ে রয়েছে যে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। তিনি জানান, তারা মহাকাশ থেকে শক্তিশালী রাডারের সাহায্যে Ñ যে রাডার মরুভূমির বালির স্তর ভেদ করে তার গভীর নীচের চিত্র ধারণ করতে সক্ষম, সেই রাডার দিয়ে তারা পানির এই বিশাল মজুদ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি :
মধ্যপ্রাচ্য হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলগুলোর অন্যতম। জাতিসংঘের বিশ্ব পানি উন্নয়ন সংস্থার রিপোর্টে পানির দু¯প্রাপ্যতার বিচারে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের নাম উল্লেখ করা হয়, যার ৬টিই মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত। আবার এই ৬টির মধ্যে ৩টিই শীর্ষ-১০ এর একেবারে উপরে অবস্থান করছে। এছাড়া ডড়ৎষফ ডধঃবৎ ঈড়ঁহপরষ ২০০২ সালের এক রিপোর্টে আশংকা প্রকাশ করা হয় যে, ২০২৫ সাল নাগাদ পানির সহজলভ্যতা ৫০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের মরু অঞ্চল সমূহের ভূগর্ভে লুকায়িত জলভাণ্ডার পানির এই দু¯প্রাপ্যতাকে অনেকটা লাঘব করতে পারে।
তবে নাসার মিশরীয় বংশোদ্ভুত মার্কিন বিজ্ঞানী ড. আল বাজ মনে করেন, মরু অঞ্চলকে যথাযথভাবে জানতে পারলে এবং এর সাথে জীবনকে মানিয়ে নেয়ার কৌশল আয়ত্ত করতে পারলে এর বুকে লুকিয়ে থাকা বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানোর বহু পথ বেরিয়ে আসবে।
এই সব মরুভূমি একদিন বাগান ছিল :
মহানবীর হাদীসটির প্রতি যদি আমরা আবারো লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো তিনি বলেছিলেন, আরব ভূমি আবার তৃণভূমি হবে এবং নদ-নদীগুলো আবার ফিরে আসবে। তাঁর এই ‘আবার’ শব্দটির ব্যবহার থেকে বুঝা যায় যে, আরবের নি¯প্রাণ মরুভূমিগুলো এক সময় তৃণভূমি ছিল, প্রাণময় সবুজ বৃক্ষ-লতা, বন-বনানী, নদ-নদী ও জলাশয়ে পূর্ণ ছিল! আর মহানবীর তিরোধানের প্রায় ১৪শ বছর পর বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের চূড়ায় অবস্থিত নাসার বিজ্ঞানী ড. আল বাজও তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে বলছেন একই কথা! ড বাজ বলেন, ‘যে জায়গাগুলোকে আজ আমরা মরুভূমি বলছি, আজ থেকে মাত্র ৫ হাজার বছর আগেও কিন্তু সেগুলো মরুভূমি ছিল না। ৫ থেকে ১১ হাজার বছর আগেও সেখানে ছিল সবুজ তৃণময় সমতল ভূমি, ছিল চমৎকার পরিবেশ। আজকের মরুভূমি সে সময় সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত ছিল, গাছপালা ছিল, বন ছিল, পশু-পাখি ছিল। সেখানে নদী ছিল, লেক ছিল, মানুষের বসবাস ছিল, ঘর-বাড়ি ছিল, বাগান ছিল, হাট-বাজার ছিল!
কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই জীবনময় জলযুগের পূর্বে সেখানে বিরাজ করছিল ড্রাই পিরিয়ড বা শুষ্ক যুগ। আবার তারও পূর্বে ছিল আদ্র যুগ বা জলযুগ। এ সময়টি ছিল ২৫ থেকে ৩৫ হাজার বছর পূর্বের সময়-কালের মধ্যে। এভাবে যত পেছনে যাওয়া যায় জলযুগ ও শুকনো যুগ চক্রাকারে আবর্তনশীল ছিল। সর্বশেষ দূরবর্তী সময়কালটি ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার বছর থেকে ৩ লাখ ২০ হাজার বছর পূর্বের সময়কালের মধ্যে। কালের গর্ভে এই চক্রটি অব্যাহত ছিল। এ সবই বিজ্ঞানীদের মত।
ড. আল বাজের বক্তব্য থেকে জানা যায়, বেশির ভাগ মরুভূমির নীচে যে পানির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে তার বেশির ভাগই অত্যন্ত পুরনো। যেমন মিশরের পশ্চিম অঞ্চলের মরুভূমির নীচে যে সব পানির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর বেশির ভাগই ৩০ হাজার বছরের পুরনো। এর মানে হচ্ছে, হাজার হাজার বছর ধরে ভূ-ত্বকের শীলা স্তরের ভিতর দিয়ে পানি মরুভূমির নীচের ভূগর্ভে জমা হচ্ছে এবং সেখানে অবস্থান করছে।
মরুভূমি নিয়ে ড. আল বাজের গবেষণা :
ড. আল বাজ তাঁর জীবনের ২৫টি বছর মরুভূমি নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় কাটিয়ে দিয়েছেন। মরুভূমির রহস্য উন্মোচনে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির অবস্থান নির্ণয়ে মহাকাশ ফটোগ্রাফিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তিনি পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর গবেষণা মানুষের এই ভুল ধারণা দূর করতেও সাহায্য করেছে যে, মরুভূমি মানব সৃষ্ট। তিনি মরু প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কীভাবে এর উৎপত্তি ও বিকাশ হয়। স্পেস ফটোগ্রাফি ব্যবহার করে ড. বাজ আজকের মরু অঞ্চলগুলোর প্রাচীন জলপ্রবাহের গতিপথ নিয়েও গবেষণা করেছেন, যা প্রবাহিত উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল সমূহ থেকে। তিনি দেখিয়েছেন, বেশির ভাগ পানির গমনপথ কিংবা পাথুরে নদীখাতগুলো ভূ-তলের শীলাস্তরের স্তরচ্যূতি ও ফাঁটল রেখার সাথে মিলিত হয়। শীলার স্তরচ্যূতি ও ফাঁটল সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলো হল সে সব স্থান, যেখানে ভূমিকম্পের প্রভাবে ভূ-পৃষ্ঠ সচল হয়, ভূতলের প্লেটগুলো পরস্পরের বিপরীতে চলাচল করে। তখন এদের মধ্যকার শীলা স্তচ্যূত হয় এবং ফাঁটল ও ভাঙনের শিকার হয়। শীলাস্তরের এই স্তরচ্যূতি ও ভাঙন প্রক্রিয়ার ফলে তার মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত বা নিষ্কাষিত ক্ষরিত হতে থাকে। এর ফলে শীলাগুলো নিজে নিজেই ক্ষয় হতে থাকে।
মরুভূমির উৎপত্তি বা বালুর উৎস :
মরুভূমির উৎপত্তি ও বালুর উৎস ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ড. বাজ বলেন, “আমার ধারণা ছিল আজকের মরু অঞ্চলে বালুর উৎপত্তি হয়েছিল বাতাসের মাধ্যমে। অর্থাৎ বাতাসই এগুলো বহন করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি যখন বালির রাসায়নিক গঠনের দিকে তাকালাম এবং এর সম্ভাব্য উৎসগুলো খতিয়ে দেখলাম। তখন বালির উৎস বা মরুভূমির উৎপত্তি সম্পর্কিত আমার সকল ধারণাই পাল্টে গেল। অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে আমি দেখতে পেলাম যে, মরুঅঞ্চলের বিশাল বালিরাশিকে বহন করে নিয়ে আসার জন্য বাতাস দায়ী নয়। বরং পানিই এগুলো বহন করে নিয়ে এসেছে।
তিনি আরো বলেন, জলযুগ গুলোতেই মরু প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রচন্ড বৃষ্টিপাত এবং পানি প্রবাহের কারণে শীলার ভাঙন শুরু হয়। সেসব ছোট ছোট পাথরখন্ড যখন পানির সাথে প্রবাহিত হয়, তখন সেগুলো অন্যান্য পাথরের টুকরোকেও আঘাত করে। পরস্পরের এই আঘাতের ফলে সেগুলো আরো চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে থাকে। উত্তাল নদীর তলদেশেই কিন্তু এই ভাঙন ও চূর্ণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এই চূর্ণ প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে নদীতে মাটি ও বালু জমতে থাকে এবং নদী ভরাট হয়ে হয়ে নি¯প্রাণ হয়ে যায়। এভাবে মাটি ও বালু স্তরের পর স্তর জমা হতেম থাকে। তখন এক পর্যায়ে নদী শুকিয়ে যায় এবং খরাচক্র বা উৎু পুপষব শুরু হয়। এই চক্রের পরিণতিতে যখন বিশাল বিশাল বালূরাশির জমা হয়, তখন বাতাস সেগুলোর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সেগুলোকে বালিয়ারির রূপ দেয় মাত্র। “সুতরাং মরু প্রক্রিয়ার শুরু হয় পানির মাধ্যমে এবং এটি আকৃতিপ্রাপ্ত হয় বাতাসের মাধ্যমে” Ñ ড. বাজ এভাবে উপসংহার টানেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই প্রক্রিয়াটি প্রমাণিত। পৃথিবীর যে কোন জায়গার মরুভূমির জন্যই এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, পৃথিবীর এসব নিম্নাঞ্চলগুলো, যেগুলো এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে এগুলো ছিল সেসব এলাকা, যেখানে দীর্ঘকাল পর্যন্ত পানি আবদ্ধ অবস্থায় বিদ্যমান ছিল। সেসব পানিই নদী তলের শীলাস্তর চুয়ে এখন ভূ-গর্ভে অবস্থান করছে।”
নাসার বিজ্ঞানী ড. বাজ এবং তার মহাকাশ থেকে শক্তিশালী রাডারের সাহায্যে ধারণকৃত মরুভূমির ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে, গবেষণা করে শুষ্ক মরুর নীচে প্রাচীন নদী ও লেক সমূহ আবিস্কার করতে সক্ষম হন। শুধু অনুমানই নয়, ড. বাজ ও তার সঙ্গীরা সম্ভাব্য জল ভান্ডারের অবস্থানগুলো নির্ণয় করে সেসব স্থানে কয়েকটি কুপও খনন করেন এবং সন্ধান পান তাদের কাক্সিক্ষত বিশাল বিশাল জলরাশির।
॥ মিশরের গুপ্তধন ॥
এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জলভান্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে মিশরের পশ্চিমাঞ্চলীয় মরুভূমিতে। লেক নাসের এবং লিবিয়ার সাথে মিশরের সীমান্তবর্তী এলাকার মাঝামাঝি ঐ জায়গাটির নাম শার্ক আল কুয়াইনাত। এখানে ৮২টি কুষা খনন করে যে বিশাল পানি সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে সতা দিয়ে ২ লাখ একর কৃষি জমিতে একশো বছর চাষাবাদের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে জানা গেছে।
লেখার শুরুতে আমরা মহানবীর যে হাদীসটির উল্লেখ করেছিলাম। নাসার বিজ্ঞানী ড. বাজ তাদের সদ্য আবিষ্কারের কথা বলতে গিয়ে মহানবীর ঐ হাদীসটির কথাও স্মরণ করেন। তিনি বলেন, মহানবীর ঐ ভবিষ্যৎ বাণীটিতে আজকের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত মহানবীর ঐ হাদীসটিতে মরুভূমির বৃত্তাকার পরিবর্তনশীলতার বর্ণনাও পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আরব ভূমি যে এক সময় সবুজ-শ্যামলিমায় পূর্ণ ছিল তার সুস্পষ্ট নির্দেশিকাও ঐ হাদীসটিতে রয়েছে।
ড. বাজ জানান, আরব উপ-দ্বীপের মধ্যে রাব আল খালি হচ্ছে সবচেয়ে বৃহত্তম মরুভূমি এবং পৃথিবীর বৃহৎ মরু এলাকার অন্যতম। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ অঞ্চলটি এক সময় নদ-নদী, খাল-বিল সমেত তৃণ-ভূমিতে পূর্ণ ছিল এবং এখানে বেবুন, হরিণ, ভেড়া, মেশ সহ সব ধরনের পশু-পাখি বিচরণ করতো। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, এখন আখিকার বনে আমরা যেসব পশু-পাখি দেখছি, সেসবই রাব আল খালিতে বিদ্যমান ছিল। এখন এটি যেমন বিরান ও প্রাণহীন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। তখন এরকম হাহাকারপূর্ণ অবস্থা ছিল না। বরং সে সময় এটি ছিল কোলাহল ও প্রাণ-প্রাচূর্যে পূর্ণ।
॥ বদলে যেতে পারে দারফুরের ভাগ্যের চাকা ॥
নাসার বিজ্ঞানীদের রাডারে সুদানের দারফুর এলাকার মরুভূমির নীচেও এক বিশাল ও প্রাচীণ লেকের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মরুভূমির তলদেশের ঐ বিশাল প্রাচীন লেক খরা ও দারিদ্র-পীড়িত দারফুরের ভাগ্যের চাকা বদলে দিতে পারে। হতে পারে পানির এক বিরাট উৎস। শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন মরুর বুকে লুকায়িত এই বিশাল জলভান্ডার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দারফুরের অধিবাসীদের জন্য এনে দিতে পারে তাদের চিরদিনের স্বপ্ন শান্তি ও সমৃদ্ধি।
নাসার বিজ্ঞানী ড. বাজ বলেছেন, “এর আগে মিশরের দক্ষিণ-পশ্চিমে যেমন প্রমাণ পাওয়া গেছে তেমনি দারফুরেও এক প্রাচীন লেকের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেখানে ভূগর্ভে বিশাল জল-ভান্ডারের মজুদ রয়েছে। উল্লেখ্য, মিশরের ঐ স্থানটি দারফুরের ঠিক উত্তরে অবস্থিত। নাসার পক্ষ থেকে রাডারের সাহায্যে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা সনাক্তকৃত ঐ বিশাল জলভান্ডারকে একটি “ম্যাগালেক” হিসেবে অভিহিত করেছেন। কেননা এর আয়তন হল ১৯ হাজার ১১০ বর্গ মাইল (৩০ হাজার ৭৫০ বর্গ কি: মিটার) যা কিনা লেবাননের চেয়ে তিনগুণ বড়।
এ প্রসঙ্গে ড. বাজ বলেন, “আমরা এটিকে “ম্যাগালেক” বলছি, কারণ এটি এত বড় যে বিশ্বাস করাই কঠিন। এর আকার ম্যাগাচুসেটস রাজ্য অথবা লেক এরি’র সমান।”
লেক এরি উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত এবং এটি বিশ্বের দশম বৃহত্তম লেক।
তিনি মনে করেন এত বিশাল জল ভান্ডারের আবিষ্কার দারফুরের দুঃখ মোচন করতে সক্ষম হবে এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে। উল্লেখ্য, গত ৪ বছরের যুদ্ধ ও সহিংসতায় এখানকার প্রায় ২ লাখ লোক নিহত ও ২০ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হতে বাধ্য হয়।
এ প্রসঙ্গে ড. বাজ বলেন, “বেশিরভাগ মানুষ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে যে, দারফুরের এই যুদ্ধ ও অস্থিতিশীলতা সহ এখানকার অধিবাসীদের সকল দুঃখ-কষ্টের মূলে রয়েছে পানির অভাব।”
তিনি বলেন, দারফুরের বহু উদ্বাস্তু যেসব স্থানে সেটেল হয়েছে। সেসব অঞ্চল এক সময়ে যাযাবরদের দখলে ছিল। ফলে পানি নিয়ে তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি। রেষারেষি ও সংঘাত বাঁধে। আপনি যদি তাদেরকে পর্যাপ্ত পানি দিতে পারেন, তাহলে তাদের আর সংঘাতের প্রয়োজন হবে না।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও দারফুরের সংঘাতের মূলে পানি ও খাদ্য সংকটকেই দায়ী করেন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) একবার আরবের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, উপচে পড়া সম্পদের প্রাচুর্য না আসা পর্যনন্ত, মরুভূমিগুলো আবার তৃণভূমিতে পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এবং মরুভূমির নদ-নদীগুলো আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। তিনি তাঁর জাতির লোকদের উদ্দেশ্যে আরো বলেছিলেন, আরব ভূমিতে প্রাচুর্য এত বিপুল পরিমাণে আসবে যে, সেখানে যাকাত নেয়ার মত কোন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মহানবী (সা.) যে সময়ে উক্ত ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন সে সময়ে আরবের মরুচারী নগ্নপায়ী লোকেরা ছিল নিতান্তই গরীব। অভাব-অন্টন ছিল তাদের নিত্যসাথী। কিন্ত আরবের এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আল্লাহ’র দেয়া অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের কল্যাণে সেখানে এখন অভাব বলতে কিছু নেই। মরুভুমির লোকেরা এখন যেন উপচে পড়া সম্পদ ও ঐশর্যের প্রাচুর্যে ভাসছে। তাই বলা যায়, মহানবীর ভবিষ্যৎবাণীর প্রথম অংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ? আরব ভূ-খণ্ডের বিশাল-বিস্তীর্ণ মরুভূমিগুলো কি সত্যিই পানিতে ভরে উঠবে? যতদূর চোখ যায় ধুধু বালুচর আর বালিয়ারিগুলো কি সত্যিই খাল-বিল, নদ-নদী ও তৃণভূমিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে? কিন্তু কীভাবে? একি বিশ্বাসযোগ্য?
কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ভবিষ্যৎবাণী অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য এবং মরুভূমিগুলো অবশ্যই জলময় তৃণভূমি ও নদ-নদী, খাল-বিলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে, সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। শুধু আরবের মরুভূমিই নয়, বিজ্ঞানীরা বলছেন, আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি, সুদানের খরাপীড়িত শুষ্ক অঞ্চল; যেখানে পানির অভাবে লোকেরা পশুর রক্ত পান করে সেই দারফুরের পানিশূন্য অঞ্চলগুলোও পানিতে ভরে উঠবে, সবুজ বন-বনানী ও নদ-নদীতে পূর্ণ হয়ে উঠবে; কেননা, প্রতিটি মরুভূমির নীচেই লুকিয়ে আছে বিশাল জল ভাণ্ডার, বিশাল বিশাল লেক, বড় বড় নদ-নদী ইত্যাদি।
বলাবাহুল্য, নাসার বিজ্ঞানীগণ এসব বিষ্ময়কর খবর আমাদের জানিয়েছেন গবেষণা রিপোর্ট ও সরেজমিন তদন্তের ভিত্তিতে, কোন আন্দাজ-অনুমাণের ভিত্তিতে নয়। ইতিমধ্যেই তারা মিশর ও সুদানে দুটি বিশাল প্রাচীন লেক ও নদীর সন্ধান পেয়েছেন। মরুভূমির বালির গভীর নীচে সেগুলো বিরাজমান।
নাসা’র এপোলো প্রোগ্রামের লুনার সাইন্স প্লানিং-এর সুপারভাইজার, বোস্টন ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রিমোট সেনসিং-এর পরিচালক প্রখ্যাত ভূ-তত্ত্ববিদ ড. ফারুক আল বাজ জানিয়েছেন, বিশ্বের যে কোন মরুভূমি এবং বিশেষ করে আরব বিশ্বের মরুভূমির তলদেশে এত বিশাল পানির মজুদ লুকিয়ে রয়েছে যে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। তিনি জানান, তারা মহাকাশ থেকে শক্তিশালী রাডারের সাহায্যে Ñ যে রাডার মরুভূমির বালির স্তর ভেদ করে তার গভীর নীচের চিত্র ধারণ করতে সক্ষম, সেই রাডার দিয়ে তারা পানির এই বিশাল মজুদ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি :
মধ্যপ্রাচ্য হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলগুলোর অন্যতম। জাতিসংঘের বিশ্ব পানি উন্নয়ন সংস্থার রিপোর্টে পানির দু¯প্রাপ্যতার বিচারে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের নাম উল্লেখ করা হয়, যার ৬টিই মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত। আবার এই ৬টির মধ্যে ৩টিই শীর্ষ-১০ এর একেবারে উপরে অবস্থান করছে। এছাড়া ডড়ৎষফ ডধঃবৎ ঈড়ঁহপরষ ২০০২ সালের এক রিপোর্টে আশংকা প্রকাশ করা হয় যে, ২০২৫ সাল নাগাদ পানির সহজলভ্যতা ৫০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের মরু অঞ্চল সমূহের ভূগর্ভে লুকায়িত জলভাণ্ডার পানির এই দু¯প্রাপ্যতাকে অনেকটা লাঘব করতে পারে।
তবে নাসার মিশরীয় বংশোদ্ভুত মার্কিন বিজ্ঞানী ড. আল বাজ মনে করেন, মরু অঞ্চলকে যথাযথভাবে জানতে পারলে এবং এর সাথে জীবনকে মানিয়ে নেয়ার কৌশল আয়ত্ত করতে পারলে এর বুকে লুকিয়ে থাকা বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানোর বহু পথ বেরিয়ে আসবে।
এই সব মরুভূমি একদিন বাগান ছিল :
মহানবীর হাদীসটির প্রতি যদি আমরা আবারো লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো তিনি বলেছিলেন, আরব ভূমি আবার তৃণভূমি হবে এবং নদ-নদীগুলো আবার ফিরে আসবে। তাঁর এই ‘আবার’ শব্দটির ব্যবহার থেকে বুঝা যায় যে, আরবের নি¯প্রাণ মরুভূমিগুলো এক সময় তৃণভূমি ছিল, প্রাণময় সবুজ বৃক্ষ-লতা, বন-বনানী, নদ-নদী ও জলাশয়ে পূর্ণ ছিল! আর মহানবীর তিরোধানের প্রায় ১৪শ বছর পর বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের চূড়ায় অবস্থিত নাসার বিজ্ঞানী ড. আল বাজও তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে বলছেন একই কথা! ড বাজ বলেন, ‘যে জায়গাগুলোকে আজ আমরা মরুভূমি বলছি, আজ থেকে মাত্র ৫ হাজার বছর আগেও কিন্তু সেগুলো মরুভূমি ছিল না। ৫ থেকে ১১ হাজার বছর আগেও সেখানে ছিল সবুজ তৃণময় সমতল ভূমি, ছিল চমৎকার পরিবেশ। আজকের মরুভূমি সে সময় সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত ছিল, গাছপালা ছিল, বন ছিল, পশু-পাখি ছিল। সেখানে নদী ছিল, লেক ছিল, মানুষের বসবাস ছিল, ঘর-বাড়ি ছিল, বাগান ছিল, হাট-বাজার ছিল!
কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই জীবনময় জলযুগের পূর্বে সেখানে বিরাজ করছিল ড্রাই পিরিয়ড বা শুষ্ক যুগ। আবার তারও পূর্বে ছিল আদ্র যুগ বা জলযুগ। এ সময়টি ছিল ২৫ থেকে ৩৫ হাজার বছর পূর্বের সময়-কালের মধ্যে। এভাবে যত পেছনে যাওয়া যায় জলযুগ ও শুকনো যুগ চক্রাকারে আবর্তনশীল ছিল। সর্বশেষ দূরবর্তী সময়কালটি ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার বছর থেকে ৩ লাখ ২০ হাজার বছর পূর্বের সময়কালের মধ্যে। কালের গর্ভে এই চক্রটি অব্যাহত ছিল। এ সবই বিজ্ঞানীদের মত।
ড. আল বাজের বক্তব্য থেকে জানা যায়, বেশির ভাগ মরুভূমির নীচে যে পানির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে তার বেশির ভাগই অত্যন্ত পুরনো। যেমন মিশরের পশ্চিম অঞ্চলের মরুভূমির নীচে যে সব পানির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর বেশির ভাগই ৩০ হাজার বছরের পুরনো। এর মানে হচ্ছে, হাজার হাজার বছর ধরে ভূ-ত্বকের শীলা স্তরের ভিতর দিয়ে পানি মরুভূমির নীচের ভূগর্ভে জমা হচ্ছে এবং সেখানে অবস্থান করছে।
মরুভূমি নিয়ে ড. আল বাজের গবেষণা :
ড. আল বাজ তাঁর জীবনের ২৫টি বছর মরুভূমি নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় কাটিয়ে দিয়েছেন। মরুভূমির রহস্য উন্মোচনে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির অবস্থান নির্ণয়ে মহাকাশ ফটোগ্রাফিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তিনি পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর গবেষণা মানুষের এই ভুল ধারণা দূর করতেও সাহায্য করেছে যে, মরুভূমি মানব সৃষ্ট। তিনি মরু প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কীভাবে এর উৎপত্তি ও বিকাশ হয়। স্পেস ফটোগ্রাফি ব্যবহার করে ড. বাজ আজকের মরু অঞ্চলগুলোর প্রাচীন জলপ্রবাহের গতিপথ নিয়েও গবেষণা করেছেন, যা প্রবাহিত উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল সমূহ থেকে। তিনি দেখিয়েছেন, বেশির ভাগ পানির গমনপথ কিংবা পাথুরে নদীখাতগুলো ভূ-তলের শীলাস্তরের স্তরচ্যূতি ও ফাঁটল রেখার সাথে মিলিত হয়। শীলার স্তরচ্যূতি ও ফাঁটল সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলো হল সে সব স্থান, যেখানে ভূমিকম্পের প্রভাবে ভূ-পৃষ্ঠ সচল হয়, ভূতলের প্লেটগুলো পরস্পরের বিপরীতে চলাচল করে। তখন এদের মধ্যকার শীলা স্তচ্যূত হয় এবং ফাঁটল ও ভাঙনের শিকার হয়। শীলাস্তরের এই স্তরচ্যূতি ও ভাঙন প্রক্রিয়ার ফলে তার মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত বা নিষ্কাষিত ক্ষরিত হতে থাকে। এর ফলে শীলাগুলো নিজে নিজেই ক্ষয় হতে থাকে।
মরুভূমির উৎপত্তি বা বালুর উৎস :
মরুভূমির উৎপত্তি ও বালুর উৎস ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ড. বাজ বলেন, “আমার ধারণা ছিল আজকের মরু অঞ্চলে বালুর উৎপত্তি হয়েছিল বাতাসের মাধ্যমে। অর্থাৎ বাতাসই এগুলো বহন করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি যখন বালির রাসায়নিক গঠনের দিকে তাকালাম এবং এর সম্ভাব্য উৎসগুলো খতিয়ে দেখলাম। তখন বালির উৎস বা মরুভূমির উৎপত্তি সম্পর্কিত আমার সকল ধারণাই পাল্টে গেল। অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে আমি দেখতে পেলাম যে, মরুঅঞ্চলের বিশাল বালিরাশিকে বহন করে নিয়ে আসার জন্য বাতাস দায়ী নয়। বরং পানিই এগুলো বহন করে নিয়ে এসেছে।
তিনি আরো বলেন, জলযুগ গুলোতেই মরু প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রচন্ড বৃষ্টিপাত এবং পানি প্রবাহের কারণে শীলার ভাঙন শুরু হয়। সেসব ছোট ছোট পাথরখন্ড যখন পানির সাথে প্রবাহিত হয়, তখন সেগুলো অন্যান্য পাথরের টুকরোকেও আঘাত করে। পরস্পরের এই আঘাতের ফলে সেগুলো আরো চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে থাকে। উত্তাল নদীর তলদেশেই কিন্তু এই ভাঙন ও চূর্ণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এই চূর্ণ প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে নদীতে মাটি ও বালু জমতে থাকে এবং নদী ভরাট হয়ে হয়ে নি¯প্রাণ হয়ে যায়। এভাবে মাটি ও বালু স্তরের পর স্তর জমা হতেম থাকে। তখন এক পর্যায়ে নদী শুকিয়ে যায় এবং খরাচক্র বা উৎু পুপষব শুরু হয়। এই চক্রের পরিণতিতে যখন বিশাল বিশাল বালূরাশির জমা হয়, তখন বাতাস সেগুলোর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সেগুলোকে বালিয়ারির রূপ দেয় মাত্র। “সুতরাং মরু প্রক্রিয়ার শুরু হয় পানির মাধ্যমে এবং এটি আকৃতিপ্রাপ্ত হয় বাতাসের মাধ্যমে” Ñ ড. বাজ এভাবে উপসংহার টানেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই প্রক্রিয়াটি প্রমাণিত। পৃথিবীর যে কোন জায়গার মরুভূমির জন্যই এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, পৃথিবীর এসব নিম্নাঞ্চলগুলো, যেগুলো এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে এগুলো ছিল সেসব এলাকা, যেখানে দীর্ঘকাল পর্যন্ত পানি আবদ্ধ অবস্থায় বিদ্যমান ছিল। সেসব পানিই নদী তলের শীলাস্তর চুয়ে এখন ভূ-গর্ভে অবস্থান করছে।”
নাসার বিজ্ঞানী ড. বাজ এবং তার মহাকাশ থেকে শক্তিশালী রাডারের সাহায্যে ধারণকৃত মরুভূমির ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে, গবেষণা করে শুষ্ক মরুর নীচে প্রাচীন নদী ও লেক সমূহ আবিস্কার করতে সক্ষম হন। শুধু অনুমানই নয়, ড. বাজ ও তার সঙ্গীরা সম্ভাব্য জল ভান্ডারের অবস্থানগুলো নির্ণয় করে সেসব স্থানে কয়েকটি কুপও খনন করেন এবং সন্ধান পান তাদের কাক্সিক্ষত বিশাল বিশাল জলরাশির।
॥ মিশরের গুপ্তধন ॥
এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জলভান্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে মিশরের পশ্চিমাঞ্চলীয় মরুভূমিতে। লেক নাসের এবং লিবিয়ার সাথে মিশরের সীমান্তবর্তী এলাকার মাঝামাঝি ঐ জায়গাটির নাম শার্ক আল কুয়াইনাত। এখানে ৮২টি কুষা খনন করে যে বিশাল পানি সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে সতা দিয়ে ২ লাখ একর কৃষি জমিতে একশো বছর চাষাবাদের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে জানা গেছে।
লেখার শুরুতে আমরা মহানবীর যে হাদীসটির উল্লেখ করেছিলাম। নাসার বিজ্ঞানী ড. বাজ তাদের সদ্য আবিষ্কারের কথা বলতে গিয়ে মহানবীর ঐ হাদীসটির কথাও স্মরণ করেন। তিনি বলেন, মহানবীর ঐ ভবিষ্যৎ বাণীটিতে আজকের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত মহানবীর ঐ হাদীসটিতে মরুভূমির বৃত্তাকার পরিবর্তনশীলতার বর্ণনাও পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আরব ভূমি যে এক সময় সবুজ-শ্যামলিমায় পূর্ণ ছিল তার সুস্পষ্ট নির্দেশিকাও ঐ হাদীসটিতে রয়েছে।
ড. বাজ জানান, আরব উপ-দ্বীপের মধ্যে রাব আল খালি হচ্ছে সবচেয়ে বৃহত্তম মরুভূমি এবং পৃথিবীর বৃহৎ মরু এলাকার অন্যতম। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ অঞ্চলটি এক সময় নদ-নদী, খাল-বিল সমেত তৃণ-ভূমিতে পূর্ণ ছিল এবং এখানে বেবুন, হরিণ, ভেড়া, মেশ সহ সব ধরনের পশু-পাখি বিচরণ করতো। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, এখন আখিকার বনে আমরা যেসব পশু-পাখি দেখছি, সেসবই রাব আল খালিতে বিদ্যমান ছিল। এখন এটি যেমন বিরান ও প্রাণহীন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। তখন এরকম হাহাকারপূর্ণ অবস্থা ছিল না। বরং সে সময় এটি ছিল কোলাহল ও প্রাণ-প্রাচূর্যে পূর্ণ।
॥ বদলে যেতে পারে দারফুরের ভাগ্যের চাকা ॥
নাসার বিজ্ঞানীদের রাডারে সুদানের দারফুর এলাকার মরুভূমির নীচেও এক বিশাল ও প্রাচীণ লেকের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মরুভূমির তলদেশের ঐ বিশাল প্রাচীন লেক খরা ও দারিদ্র-পীড়িত দারফুরের ভাগ্যের চাকা বদলে দিতে পারে। হতে পারে পানির এক বিরাট উৎস। শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন মরুর বুকে লুকায়িত এই বিশাল জলভান্ডার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দারফুরের অধিবাসীদের জন্য এনে দিতে পারে তাদের চিরদিনের স্বপ্ন শান্তি ও সমৃদ্ধি।
নাসার বিজ্ঞানী ড. বাজ বলেছেন, “এর আগে মিশরের দক্ষিণ-পশ্চিমে যেমন প্রমাণ পাওয়া গেছে তেমনি দারফুরেও এক প্রাচীন লেকের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেখানে ভূগর্ভে বিশাল জল-ভান্ডারের মজুদ রয়েছে। উল্লেখ্য, মিশরের ঐ স্থানটি দারফুরের ঠিক উত্তরে অবস্থিত। নাসার পক্ষ থেকে রাডারের সাহায্যে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা সনাক্তকৃত ঐ বিশাল জলভান্ডারকে একটি “ম্যাগালেক” হিসেবে অভিহিত করেছেন। কেননা এর আয়তন হল ১৯ হাজার ১১০ বর্গ মাইল (৩০ হাজার ৭৫০ বর্গ কি: মিটার) যা কিনা লেবাননের চেয়ে তিনগুণ বড়।
এ প্রসঙ্গে ড. বাজ বলেন, “আমরা এটিকে “ম্যাগালেক” বলছি, কারণ এটি এত বড় যে বিশ্বাস করাই কঠিন। এর আকার ম্যাগাচুসেটস রাজ্য অথবা লেক এরি’র সমান।”
লেক এরি উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত এবং এটি বিশ্বের দশম বৃহত্তম লেক।
তিনি মনে করেন এত বিশাল জল ভান্ডারের আবিষ্কার দারফুরের দুঃখ মোচন করতে সক্ষম হবে এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে। উল্লেখ্য, গত ৪ বছরের যুদ্ধ ও সহিংসতায় এখানকার প্রায় ২ লাখ লোক নিহত ও ২০ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হতে বাধ্য হয়।
এ প্রসঙ্গে ড. বাজ বলেন, “বেশিরভাগ মানুষ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে যে, দারফুরের এই যুদ্ধ ও অস্থিতিশীলতা সহ এখানকার অধিবাসীদের সকল দুঃখ-কষ্টের মূলে রয়েছে পানির অভাব।”
তিনি বলেন, দারফুরের বহু উদ্বাস্তু যেসব স্থানে সেটেল হয়েছে। সেসব অঞ্চল এক সময়ে যাযাবরদের দখলে ছিল। ফলে পানি নিয়ে তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি। রেষারেষি ও সংঘাত বাঁধে। আপনি যদি তাদেরকে পর্যাপ্ত পানি দিতে পারেন, তাহলে তাদের আর সংঘাতের প্রয়োজন হবে না।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও দারফুরের সংঘাতের মূলে পানি ও খাদ্য সংকটকেই দায়ী করেন।
বিষয়: বিবিধ
১৫০৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন