ফাঁসির দণ্ডে বিচলিত নন আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ২৩ মার্চ, ২০১৬, ০৩:০১:৪৭ রাত





মতিউর রহমান আকন্দ

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্মানিত আমীর বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক ও প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। ১৯৮২-১৯৯০, ১৯৯১-১৯৯৬, ১৯৯৬-২০০১ সময় কালের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি মাঠে-ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি তার নিজ এলাকা পাবনার সাঁথিয়া থেকে ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে তিনি বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের একজন নেতা হিসেবে কর্মী গঠন, সমর্থক তৈরি ও দল পরিচালনার নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনে এক ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন তিনি। সারা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং সমগ্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার তৈরি কর্মীবাহিনী ইসলামী দাওয়াহ কার্যক্রমে বিশ্বব্যাপী ভূমিকা পালন করে চলেছে। তার রচিত সাহিত্য তরুণ ছাত্র যুব সমাজকে দ্বীনের পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য উদ্দীপ্ত করছে।

সদা বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, স্বল্পভাষী মাওলানা নিজামী অনর্থক ও অর্থহীন কথা বলা থেকে সব সময় বিরত থাকেন। সত্য-সঠিক ও যথার্থ পন্থা নিরূপণে তার পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তীক্ষè। তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রিয় নেতা, প্রিয় ব্যক্তিত্ব।

প্রায় পৌনে ছয় বছর যাবত এ সরকারের বন্দীশালায় তিনি বন্দী জীবন যাপন করছেন। একজন আইনজীবী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তার মামলা চলাকালে তার সাথে আমার সরাসরি বহুবার কথা বলার সুযোগ হয়। কারাভ্যন্তরে আইনী পরামর্শের জন্য তার সাথে অনেকবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। তিনি তার মামলা পরিচালনায় আইনী দিকনির্দেশনার পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান রাজনীতি, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে যে মূল্যায়ন ও নির্দেশনা প্রদান করেছেন তা আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।

১৬ মার্চ ২০১৬ কারাগারে তার সাথে সাক্ষাতের দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের দিন ১৫ মার্চ দুপুরে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তার আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় প্রকাশ করে। ৬ জানুয়ারি ২০১৬ মৌখিক রায় প্রকাশের পর ৬৯-তম দিনে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায় প্রকাশের পর সারা দেশে ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। আইন অনুযায়ী লিখিত রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ পিটিশন দায়ের করতে হবে। আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তার আপিল খারিজ করে দেয়া মামলার রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দায়ের করবেন কিনা, এ বিষয়ে তার দিক নির্দেশনার জন্য কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আমরা আইনজীবীগণ তার সাথে সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত হয়েছিলাম।

আমরা কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ততক্ষণে আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে তার বন্দী কুঠরি থেকে জেল কর্তৃপক্ষের একটি কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম সাদা পাজামা পাঞ্জাবি ও মাথায় সাদা জাল টুপি পরিহিত আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী চেয়ারে বসে আছেন। প্রায় ৭৫ বছর বয়সের এ বয়োবৃদ্ধ নেতা শারীরিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার মুখের দাড়িগুলো সম্পূর্ণ সফেদ রূপ ধারণ করেছে। সাদা পোশাক, সাদা দাড়ি, সাদা টুপি এ শুভ্র পোশাকে তাকে অসাধারণ সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমরা ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই দাঁড়িয়ে আমাদেরকে বুকে টেনে নিলেন। পিঠে হাত রেখে বুকে চেপে ধরে উচ্চারণ করলেন “বিনা যুদ্ধে শাহাদাত লাভ এ এক বিরল সৌভাগ্য”। কোলাকুলি করতে করতে তিনি কথাগুলো বলছিলেন। তার বুকের উষ্ণতা আমাদের হৃদয়ে এমনভাবে প্রবেশ করল যে, এক সীমাহীন আবেগ এবং অনুভূতিতে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল আমাদের গোটা শরীর।

এরপর চেয়ারে বসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে কি যেন বের করার চেষ্টা করলেন। লক্ষ্য করলাম হাতে আতরের শিশি। আতরের শিশির ছিপি খুলে আতর বের করে আমাদের হাতে লাগিয়ে দিলেন। নিজের হাতেও একটু লাগালেন। পাশে অপেক্ষমাণ কারা রক্ষীদেরকেও আতর প্রদান করলেন। এরপর একে একে আমাদের কুশল জানলেন। ৪৫ মিনিটের সাক্ষাৎকালে মামলার বিভিন্ন দিক ও দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি যে বক্তব্য পেশ করেন তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল :

১। অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে আমি আপিল করেছিলাম। আপিলের রায়ে আমাকে যে সাজা দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ অন্যায়। আমি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। পাবনার ধূলাউড়ি ও বাউসগাড়ির ঘটনায় আমাকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হয়েছে। অথচ ১৯৮৬ সালের আগে আমি ঐ এলাকায় কখনো যাইনি। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী কার্যক্রমে ঐ এলাকায় আমি প্রথম যাই। ঐ এলাকার জনগণ ১৯৮৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৫টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেন। ঐ ঘটনার সাথে আমার দূরতম সম্পর্ক থাকলে ঐ এলাকার জনগণ আমাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট প্রদান করত না। ঐ এলাকার লোকজন এবং বাংলাদেশের জনগণ আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে মনে করে অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ষড়যন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে ইসলামী আন্দোলনকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্যই আমার বিরুদ্ধে এগুলো সাজানো হয়েছে। এ ডাহা মিথ্যার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য রিভিউ পিটিশন দায়ের করতে হবে। আদালতে আখিরাতে আমি যেন আল্লাহর কাছে বলতে পারি, ন্যায়বিচারের জন্য আমি বিচারিক প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছি।

আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মামলার খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরে আমাদেরকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিভিউ পিটিশন দায়ের করার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি বলেন, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলে আমার রিভিউ আবেদন গৃহীত হবে, আমি খালাস পাব এবং জনগণের মাঝে ফিরে আসবো ইনশাআল্লাহ।

২। ঈমানদাররা কখনো হতাশ হতে পারে না : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, আল্লাহর উপর বিশ্বাসী ব্যক্তিগণ কখনো হতাশ হতে পারেন না। যারা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত তাদের হতাশ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, ‘তোমরা হতাশ হয়ো না, মন ভাঙ্গা হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো।’ কুরআনের এ শাশ্বত বাণী আমাদের সামনে থাকা অবস্থায় আমাদের হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন আশাবাদী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি এবং আশা করি যে, আল্লাহ চাইলে যে কোন সময় পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য পরিস্থিতি পরিবর্তন কোন বিষয়ই নয়।

৩। আমি একজন দা’য়ী ইলাল্লাহ হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করেছি : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আমি আমার বাল্যকাল থেকে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত থাকার চেষ্টা করেছি। আল্লাহর দ্বীনের আহ্বান পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে লেখালেখি ও গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, পল্লী এলাকায় আমি যখন মাদরাসায় লেখাপড়া করতাম ঐ অজপাড়া গাঁ থেকে আমি সাময়িকী প্রকাশের ব্যবস্থা করেছি, সেটা ছিল আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি উদ্যোগ। ছাত্রজীবনের সূচনালগ্ন থেকেই আমি দাওয়াতী কাজে সম্পৃক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। ১৯৬৯ সালের শিক্ষা আন্দোলনে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের সংগ্রামে আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী ভূমিকা পালনের প্রচেষ্টা চালিয়েছি।

৪। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বর্তমান বিশ্ব ও দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, বিদ্যমান সমস্যা বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে মোকাবিলা করতে হবে। ইসলাম বিরোধী অপশক্তি ইসলামী আন্দোলনকে জঙ্গিবাদ হিসেবে চিত্রায়িত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে তার জবাব দিতে হবে। যারা পত্রপত্রিকায় লেখনীর মাধ্যমে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী ব্যক্তিত্বদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে তা মোকাবিলা করতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই। নিজস্ব পত্রপত্রিকা, সাময়িকী, অনলাইন, ফেইসবুক ও ওয়েব সাইট ইত্যাদির মাধ্যমে লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।

৫। গণতন্ত্র না থাকলে সন্ত্রাসবাদের উত্থান হবে : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, গণতন্ত্র না থাকলে সেখানে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য। মানুষের মত প্রকাশের অধিকার যখন হরণ করা হয় তখন মানুষ বাধ্য হয়ে শক্তি প্রয়োগের পথে ধাবিত হয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বকে বুঝতে হবে গণতন্ত্র না থাকলে সেখানে নৈরাজ্য এবং সন্ত্রাস জন্ম নেয়।

বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে গণতন্ত্রের যে ধারা সূচনা হয়েছিল তা সম্পূর্ণরূপে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থার অবসান না হলে বাংলাদেশ ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হবে। তাই যে কোন মূল্যে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

৬। মহিলাদেরকে আত্মগঠন ও চরিত্র গঠনের দিকে মনোযোগী হতে হবে : আমীরে জামায়াত দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করলেন মহিলাদেরকে নিজেদের আত্মগঠন, চরিত্র গঠন, সন্তানদের গড়ে তোলা ও নিজেদের ঘরকে ইসলামের আলোকে আলোকিত করার দিকে নজর দিতে হবে। এটাই মহিলাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। আমি বিশেষভাবে এ দিকে নজর দেওয়ার অনুরোধ করবো।

৭। নেতৃত্বের সংকট হবে না : আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, বেছে বেছে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে এ সংগঠনকে নেতৃত্ব শূন্য করার যে ষড়যন্ত্র সরকার চালিয়ে যাচ্ছে তা কখনো সফল হবে না। এ সংগঠনে নেতৃত্বের সংকট হবে না ইনশাআল্লাহ। ইসলামী আন্দোলন মূলত নেতৃত্ব তৈরিরই আন্দোলন। এ আন্দোলন যত কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে তত দক্ষ, যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।

৮। আমি শহিদী মৃত্যু চাই : আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রত্যেকটি প্রাণীরই মৃত্যু আছে। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেকের মৃত্যুর সময়, তারিখ, স্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমার মৃত্যুর যে স্থান, সময় নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে তার আগে কিংবা পরে আমার মৃত্যু হবে না। মৃত্যু অনিবার্য। আমাকে যদি অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে অবশ্যই আমি শাহাদাতের মৃত্যু লাভ করবো। আর একজন মোমেন হিসেবে আমি শহিদী মৃত্যু কামনা করি। আমার বয়স হয়েছে। যে কোন সময় আমার মৃত্যুবরণ করতে হবে। আল্লাহ যদি আমাকে শহিদী মৃত্যু দেন সেটা হবে আমার পরম সৌভাগ্য। আমি শহিদী মৃত্যু কামনা করি। শহিদী মৃত্যু জীবনকে গৌরবান্বিত করে। তবে যে অপবাদ আমার বিরুদ্ধে রচনা করা হয়েছে এ অপবাদ নিয়ে আমাকে দুনিয়া থেকে বিদায় দেয়া হবে, এটা আমার জন্য কষ্টকর। সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো ঘটনায় আমাকে হত্যা করা আমার জন্য কষ্ট হলেও একদিন এ হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে গোটা জাতি জেগে উঠবে। এ জমিনে আল্লাহর দ্বীন বিজয় লাভ করবে ইনশাআল্লাহ।

৯। আমার শাহাদাত পরিবর্তনের সূচনা করবে : আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, আল্লাহ যদি আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন তাহলে আমার এ শাহাদাত বাংলাদেশের রাজনীতি ও জাতীয় জীবনে পরিবর্তনের সূচনা করবে। আমি কোন অন্যায় করিনি, কোন অপরাধের সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নাই। এর পরেও রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার যে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, তা অবশ্যই জাতির সামনে একদিন উন্মোচিত হবে। আমি স্বাধীনতার পর থেকে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এদেশেই ছিলাম, এদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছি, আমার দলের নেতৃত্ব দিয়েছি, পার্লামেন্টে নির্বাচিত সদস্য হিসাবে জনগণের পক্ষে কথা বলেছি, এ দীর্ঘ সময় আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। জামায়াতের অব্যাহত অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে এ সরকার আমার বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করেছে। আমাকে হত্যা করে ইসলামী আন্দোলকে দুর্বল করার যে অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে তা কখনো সফল হবে না। যে জমিনে শহীদের রক্ত ঝরে সে জমিনকে আল্লাহ তা’য়ালা ইসলামের জন্য কবুল করে নেন। এ আন্দোলনের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল হিসাবে আল্লাহ যদি আমাকে শহিদী মৃত্যু দান করেন তাহলে আমার রক্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবর্তনের ভূমিকা পালন করবে।

১০। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই : প্রকৃতিগতভাবে আমি একজন দুর্বল মানুষ। অথচ আমার বিরুদ্ধে বিশাল ষড়যন্ত্র। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই আল্লাহ যেন আমাকে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আল্লাহর দ্বীনের পথে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দৃঢ় ও অবিচল থাকার তাওফিক দেন। আমীন।

আমি আমার প্রিয় দেশবাসীর কাছে ছালাম জানাচ্ছি। যদি দেশবাসীর সাথে এ দুনিয়ায় আমার সাক্ষাৎ না হয় তাহলে সকলের সাথে দেখা হবে জান্নাতে।

সাক্ষাৎ শেষে আমীরে জামায়াত আমাদের সাথে আবারো কোলাকুলি করলেন। আমাদের কপালে সিজদার স্থানে চুমু দিলেন। বুকে টেনে ধরে আমাদেরকে আদর-স্নেহ করে মহান আল্লাহর কাছে প্রাণ খুলে দোয়া করলেন। কারাগারের ভিতরে প্রবেশের পূর্বে হাত তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন, দেখা হবে জান্নাতে। তিনি দৃষ্টি সীমার আড়ালে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা অপলক দৃষ্টিতে তার গন্তব্যপানে তাকিয়ে রইলাম।

লেখকঃ কেন্দ্রিয় কর্মপরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রিয় প্রচার বিভাগের সহকারী সেক্রেটারী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

মতিউর রহমান আকন্দ

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্মানিত আমীর বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক ও প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। ১৯৮২-১৯৯০, ১৯৯১-১৯৯৬, ১৯৯৬-২০০১ সময় কালের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি মাঠে-ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি তার নিজ এলাকা পাবনার সাঁথিয়া থেকে ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে তিনি বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের একজন নেতা হিসেবে কর্মী গঠন, সমর্থক তৈরি ও দল পরিচালনার নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনে এক ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন তিনি। সারা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং সমগ্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার তৈরি কর্মীবাহিনী ইসলামী দাওয়াহ কার্যক্রমে বিশ্বব্যাপী ভূমিকা পালন করে চলেছে। তার রচিত সাহিত্য তরুণ ছাত্র যুব সমাজকে দ্বীনের পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য উদ্দীপ্ত করছে।

সদা বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, স্বল্পভাষী মাওলানা নিজামী অনর্থক ও অর্থহীন কথা বলা থেকে সব সময় বিরত থাকেন। সত্য-সঠিক ও যথার্থ পন্থা নিরূপণে তার পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তীক্ষè। তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রিয় নেতা, প্রিয় ব্যক্তিত্ব।

প্রায় পৌনে ছয় বছর যাবত এ সরকারের বন্দীশালায় তিনি বন্দী জীবন যাপন করছেন। একজন আইনজীবী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তার মামলা চলাকালে তার সাথে আমার সরাসরি বহুবার কথা বলার সুযোগ হয়। কারাভ্যন্তরে আইনী পরামর্শের জন্য তার সাথে অনেকবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। তিনি তার মামলা পরিচালনায় আইনী দিকনির্দেশনার পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান রাজনীতি, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে যে মূল্যায়ন ও নির্দেশনা প্রদান করেছেন তা আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।

১৬ মার্চ ২০১৬ কারাগারে তার সাথে সাক্ষাতের দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের দিন ১৫ মার্চ দুপুরে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তার আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় প্রকাশ করে। ৬ জানুয়ারি ২০১৬ মৌখিক রায় প্রকাশের পর ৬৯-তম দিনে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায় প্রকাশের পর সারা দেশে ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। আইন অনুযায়ী লিখিত রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ পিটিশন দায়ের করতে হবে। আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তার আপিল খারিজ করে দেয়া মামলার রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দায়ের করবেন কিনা, এ বিষয়ে তার দিক নির্দেশনার জন্য কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আমরা আইনজীবীগণ তার সাথে সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত হয়েছিলাম।

আমরা কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ততক্ষণে আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে তার বন্দী কুঠরি থেকে জেল কর্তৃপক্ষের একটি কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম সাদা পাজামা পাঞ্জাবি ও মাথায় সাদা জাল টুপি পরিহিত আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী চেয়ারে বসে আছেন। প্রায় ৭৫ বছর বয়সের এ বয়োবৃদ্ধ নেতা শারীরিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার মুখের দাড়িগুলো সম্পূর্ণ সফেদ রূপ ধারণ করেছে। সাদা পোশাক, সাদা দাড়ি, সাদা টুপি এ শুভ্র পোশাকে তাকে অসাধারণ সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমরা ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই দাঁড়িয়ে আমাদেরকে বুকে টেনে নিলেন। পিঠে হাত রেখে বুকে চেপে ধরে উচ্চারণ করলেন “বিনা যুদ্ধে শাহাদাত লাভ এ এক বিরল সৌভাগ্য”। কোলাকুলি করতে করতে তিনি কথাগুলো বলছিলেন। তার বুকের উষ্ণতা আমাদের হৃদয়ে এমনভাবে প্রবেশ করল যে, এক সীমাহীন আবেগ এবং অনুভূতিতে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল আমাদের গোটা শরীর।

এরপর চেয়ারে বসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে কি যেন বের করার চেষ্টা করলেন। লক্ষ্য করলাম হাতে আতরের শিশি। আতরের শিশির ছিপি খুলে আতর বের করে আমাদের হাতে লাগিয়ে দিলেন। নিজের হাতেও একটু লাগালেন। পাশে অপেক্ষমাণ কারা রক্ষীদেরকেও আতর প্রদান করলেন। এরপর একে একে আমাদের কুশল জানলেন। ৪৫ মিনিটের সাক্ষাৎকালে মামলার বিভিন্ন দিক ও দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি যে বক্তব্য পেশ করেন তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল :

১। অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে আমি আপিল করেছিলাম। আপিলের রায়ে আমাকে যে সাজা দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ অন্যায়। আমি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। পাবনার ধূলাউড়ি ও বাউসগাড়ির ঘটনায় আমাকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হয়েছে। অথচ ১৯৮৬ সালের আগে আমি ঐ এলাকায় কখনো যাইনি। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী কার্যক্রমে ঐ এলাকায় আমি প্রথম যাই। ঐ এলাকার জনগণ ১৯৮৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৫টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেন। ঐ ঘটনার সাথে আমার দূরতম সম্পর্ক থাকলে ঐ এলাকার জনগণ আমাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট প্রদান করত না। ঐ এলাকার লোকজন এবং বাংলাদেশের জনগণ আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে মনে করে অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ষড়যন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে ইসলামী আন্দোলনকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্যই আমার বিরুদ্ধে এগুলো সাজানো হয়েছে। এ ডাহা মিথ্যার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য রিভিউ পিটিশন দায়ের করতে হবে। আদালতে আখিরাতে আমি যেন আল্লাহর কাছে বলতে পারি, ন্যায়বিচারের জন্য আমি বিচারিক প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছি।

আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মামলার খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরে আমাদেরকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিভিউ পিটিশন দায়ের করার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি বলেন, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলে আমার রিভিউ আবেদন গৃহীত হবে, আমি খালাস পাব এবং জনগণের মাঝে ফিরে আসবো ইনশাআল্লাহ।

২। ঈমানদাররা কখনো হতাশ হতে পারে না : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, আল্লাহর উপর বিশ্বাসী ব্যক্তিগণ কখনো হতাশ হতে পারেন না। যারা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত তাদের হতাশ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, ‘তোমরা হতাশ হয়ো না, মন ভাঙ্গা হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো।’ কুরআনের এ শাশ্বত বাণী আমাদের সামনে থাকা অবস্থায় আমাদের হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন আশাবাদী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি এবং আশা করি যে, আল্লাহ চাইলে যে কোন সময় পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য পরিস্থিতি পরিবর্তন কোন বিষয়ই নয়।

৩। আমি একজন দা’য়ী ইলাল্লাহ হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করেছি : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আমি আমার বাল্যকাল থেকে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত থাকার চেষ্টা করেছি। আল্লাহর দ্বীনের আহ্বান পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে লেখালেখি ও গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, পল্লী এলাকায় আমি যখন মাদরাসায় লেখাপড়া করতাম ঐ অজপাড়া গাঁ থেকে আমি সাময়িকী প্রকাশের ব্যবস্থা করেছি, সেটা ছিল আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি উদ্যোগ। ছাত্রজীবনের সূচনালগ্ন থেকেই আমি দাওয়াতী কাজে সম্পৃক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। ১৯৬৯ সালের শিক্ষা আন্দোলনে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের সংগ্রামে আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী ভূমিকা পালনের প্রচেষ্টা চালিয়েছি।

৪। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বর্তমান বিশ্ব ও দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, বিদ্যমান সমস্যা বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে মোকাবিলা করতে হবে। ইসলাম বিরোধী অপশক্তি ইসলামী আন্দোলনকে জঙ্গিবাদ হিসেবে চিত্রায়িত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে তার জবাব দিতে হবে। যারা পত্রপত্রিকায় লেখনীর মাধ্যমে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী ব্যক্তিত্বদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে তা মোকাবিলা করতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই। নিজস্ব পত্রপত্রিকা, সাময়িকী, অনলাইন, ফেইসবুক ও ওয়েব সাইট ইত্যাদির মাধ্যমে লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।

৫। গণতন্ত্র না থাকলে সন্ত্রাসবাদের উত্থান হবে : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, গণতন্ত্র না থাকলে সেখানে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য। মানুষের মত প্রকাশের অধিকার যখন হরণ করা হয় তখন মানুষ বাধ্য হয়ে শক্তি প্রয়োগের পথে ধাবিত হয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বকে বুঝতে হবে গণতন্ত্র না থাকলে সেখানে নৈরাজ্য এবং সন্ত্রাস জন্ম নেয়।

বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে গণতন্ত্রের যে ধারা সূচনা হয়েছিল তা সম্পূর্ণরূপে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থার অবসান না হলে বাংলাদেশ ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হবে। তাই যে কোন মূল্যে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

৬। মহিলাদেরকে আত্মগঠন ও চরিত্র গঠনের দিকে মনোযোগী হতে হবে : আমীরে জামায়াত দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করলেন মহিলাদেরকে নিজেদের আত্মগঠন, চরিত্র গঠন, সন্তানদের গড়ে তোলা ও নিজেদের ঘরকে ইসলামের আলোকে আলোকিত করার দিকে নজর দিতে হবে। এটাই মহিলাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। আমি বিশেষভাবে এ দিকে নজর দেওয়ার অনুরোধ করবো।

৭। নেতৃত্বের সংকট হবে না : আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, বেছে বেছে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে এ সংগঠনকে নেতৃত্ব শূন্য করার যে ষড়যন্ত্র সরকার চালিয়ে যাচ্ছে তা কখনো সফল হবে না। এ সংগঠনে নেতৃত্বের সংকট হবে না ইনশাআল্লাহ। ইসলামী আন্দোলন মূলত নেতৃত্ব তৈরিরই আন্দোলন। এ আন্দোলন যত কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে তত দক্ষ, যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।

৮। আমি শহিদী মৃত্যু চাই : আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রত্যেকটি প্রাণীরই মৃত্যু আছে। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেকের মৃত্যুর সময়, তারিখ, স্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমার মৃত্যুর যে স্থান, সময় নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে তার আগে কিংবা পরে আমার মৃত্যু হবে না। মৃত্যু অনিবার্য। আমাকে যদি অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে অবশ্যই আমি শাহাদাতের মৃত্যু লাভ করবো। আর একজন মোমেন হিসেবে আমি শহিদী মৃত্যু কামনা করি। আমার বয়স হয়েছে। যে কোন সময় আমার মৃত্যুবরণ করতে হবে। আল্লাহ যদি আমাকে শহিদী মৃত্যু দেন সেটা হবে আমার পরম সৌভাগ্য। আমি শহিদী মৃত্যু কামনা করি। শহিদী মৃত্যু জীবনকে গৌরবান্বিত করে। তবে যে অপবাদ আমার বিরুদ্ধে রচনা করা হয়েছে এ অপবাদ নিয়ে আমাকে দুনিয়া থেকে বিদায় দেয়া হবে, এটা আমার জন্য কষ্টকর। সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো ঘটনায় আমাকে হত্যা করা আমার জন্য কষ্ট হলেও একদিন এ হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে গোটা জাতি জেগে উঠবে। এ জমিনে আল্লাহর দ্বীন বিজয় লাভ করবে ইনশাআল্লাহ।

৯। আমার শাহাদাত পরিবর্তনের সূচনা করবে : আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, আল্লাহ যদি আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন তাহলে আমার এ শাহাদাত বাংলাদেশের রাজনীতি ও জাতীয় জীবনে পরিবর্তনের সূচনা করবে। আমি কোন অন্যায় করিনি, কোন অপরাধের সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নাই। এর পরেও রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার যে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, তা অবশ্যই জাতির সামনে একদিন উন্মোচিত হবে। আমি স্বাধীনতার পর থেকে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এদেশেই ছিলাম, এদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছি, আমার দলের নেতৃত্ব দিয়েছি, পার্লামেন্টে নির্বাচিত সদস্য হিসাবে জনগণের পক্ষে কথা বলেছি, এ দীর্ঘ সময় আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। জামায়াতের অব্যাহত অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে এ সরকার আমার বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করেছে। আমাকে হত্যা করে ইসলামী আন্দোলকে দুর্বল করার যে অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে তা কখনো সফল হবে না। যে জমিনে শহীদের রক্ত ঝরে সে জমিনকে আল্লাহ তা’য়ালা ইসলামের জন্য কবুল করে নেন। এ আন্দোলনের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল হিসাবে আল্লাহ যদি আমাকে শহিদী মৃত্যু দান করেন তাহলে আমার রক্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবর্তনের ভূমিকা পালন করবে।

১০। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই : প্রকৃতিগতভাবে আমি একজন দুর্বল মানুষ। অথচ আমার বিরুদ্ধে বিশাল ষড়যন্ত্র। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই আল্লাহ যেন আমাকে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আল্লাহর দ্বীনের পথে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দৃঢ় ও অবিচল থাকার তাওফিক দেন। আমীন।

আমি আমার প্রিয় দেশবাসীর কাছে ছালাম জানাচ্ছি। যদি দেশবাসীর সাথে এ দুনিয়ায় আমার সাক্ষাৎ না হয় তাহলে সকলের সাথে দেখা হবে জান্নাতে।

সাক্ষাৎ শেষে আমীরে জামায়াত আমাদের সাথে আবারো কোলাকুলি করলেন। আমাদের কপালে সিজদার স্থানে চুমু দিলেন। বুকে টেনে ধরে আমাদেরকে আদর-স্নেহ করে মহান আল্লাহর কাছে প্রাণ খুলে দোয়া করলেন। কারাগারের ভিতরে প্রবেশের পূর্বে হাত তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন, দেখা হবে জান্নাতে। তিনি দৃষ্টি সীমার আড়ালে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা অপলক দৃষ্টিতে তার গন্তব্যপানে তাকিয়ে রইলাম।

লেখকঃ কেন্দ্রিয় কর্মপরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রিয় প্রচার বিভাগের সহকারী সেক্রেটারী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

বিষয়: রাজনীতি

১১২৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

363329
২৩ মার্চ ২০১৬ সকাল ০৭:৫৭
চেতনাবিলাস লিখেছেন : ইসলামের প্রকৃত মুজাহিদ কখনোই মৃত্যুকে ভয় পায়না .শাহাদাতের মৃত্যুই তার স্বপ্ন | কাজেই আমার প্রিয় নেতা মাওলানা নিজামী যে একজন খাঁটি মুমিন তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কাফির আর নাস্তিকদের বন্ধু আওয়ামী সরকার তাঁকে হাজার বার ফাঁসি দিলেও এদেশের মুমিন মুসলমানদের হৃদয় থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ একবিন্দুও টলাতে পারবেনা | সুন্দর পোস্টের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ |

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File