আদালতের রায় কিভাবে কাযকর করা হয়।
লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ১৬ মার্চ, ২০১৬, ০১:৫৫:১০ রাত
প্রশ্ন : শরহে বেকায়া তৃতীয় খণ্ডের 'আদালতের কার্য প্রণালী' এবং হেদায়া তৃতীয় খণ্ডের 'কাযীর নিকট কাযীর পত্র' অধ্যায়ে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"কাযী কোনো জিনিসকে জাহেরিভাবে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিলে প্রকৃতভাবেও তা অবৈধ। অনুরূপভাবে কোনো কিছুকে বৈধ ঘোষণা করলে সেটা প্রকৃতভাবেও বৈধ।"
কিন্তু কুরআন এক জায়গায় বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করোনা এবং জেনেশুনে মানুষের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ দখল করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের নিকট মামলা রুজু করোনা।" (সূরা আল বাকার, আয়াত : ১৮৮)
---------------------------------------------------------------------------------
"তোমাদের একজন আরেকজনের চেয়ে অধিকতর বাকপটু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত হও যে সে সত্য বললো কিনা, অন্যথায় (অসত্য কথা বলে যা অর্জন করবে) তা আগুনের টুকরো মাত্র"।
এভাবে কুরআন ও হাদিস থেকে উপরোক্ত অভিমত ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় এবং উল্লেখিত উক্তি স্পষ্টতই কুরআন ও হাদিসের বিপরীত মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারছিনা। উক্ত বক্তব্যের কোনো সঠিক ব্যাখ্যা থাকলে লিখুন।
জবাব : আপনি ইমাম আবু হানিফার রহ. যে উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, তার মর্ম উদ্ধারে যে কিছু জটিলতা দেখা দেয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কারণে ইমাম শাফেয়ী রহ. এবং অন্যান্য ফকীহগণ, এমনকি ইমাম আবু হানিফার দুই শিষ্য (ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ) কোনো কোনো খুঁটিনাটি বিধি প্রণয়নে স্বীয় উস্তাদের এই মূলনীতির সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তবে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে ইমাম আবু হানিফার উক্ত মূলনীতি সম্পূর্ণ নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় এবং স্থান বিশেষে তার এমন ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে, যাতে সকল জটিলতার নিরসন ঘটে। ইমাম সাহেবের বক্তব্য, কাযীর বিচারের রায় জাহেরি ও বাতেনি উভয় দিক দিয়েই কার্যকর হয়ে যায়। অর্থাৎ তিনি যে জিনিসকে অবৈধ ও অচল ঘোষণা করবেন, তা অবৈধ গণ্য হবে এবং যে জিনিসকে বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত ঘোষণা করবেন, তা বৈধ বা হালাল সাব্যস্ত হবে, চাই মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হওয়ায় তা মূলত ভ্রান্ত রায়ই হোক না কেন। এ উক্তির প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করার জন্য প্রথমে মনে রাখা দরকার হানাফি ফকীহদের সর্বসম্মত বিঘোষিত মূলনীতি অনুসারে, এটা সব রকমের মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং শুধুমাত্র বিয়ে তালাক ও ক্রয় বিক্রয়ের শুদ্ধাশুদ্ধতা অথবা মালিকানা সংক্রান্ত এমন বিরোধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাতে মালিকানা নির্ণয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যকরণ, যথা ক্রয় বিক্রয় অথবা উত্তরাধিকারের উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত: 'জাহেরী' ও 'বাতেনী' শব্দদ্বয়ের সঠিক মর্ম ও অর্থ চিহ্নিত করতে হবে। কেননা এটা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা ছাড়া মূল বক্তব্যের যথাযথ তাৎপর্য বুঝা কঠিন হয়ে পড়ে।
আদালতের রায় জাহেরীভাবে কার্যকর হওয়ার অর্থ তো একেবারেই স্পষ্ট যে, আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হবে। উভয় পক্ষ তা মানতে বাধ্য ও জনসাধারণের নিকট তা গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বাতেনিভাবে কার্যকর হওয়ার বিষয়টা কিছুটা বিচার বিবেচনা ও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে বিশেষত, যখন আদালতের রায় মিথ্যা কিংবা ত্রুটিপূর্ণ সাক্ষের কারণে বাস্তবানুগ হয় না। ইমাম আবু হানিফার অভিমত এই যে, এই বাস্তব ত্রুটিসত্তেও আদালতের রায় জাহেরী ও বাতেনিভাবে কার্যকর হবে। বাতেনিভাবে কার্যকর হওয়ার ব্যাখ্যা কেউ কেউ এভাবে দিয়ে থাকেন যে, এই রায় আল্লাহর কাছেও কার্যকর হয়ে গেছে ধরে নেয়া হবে। ফলে এই ভ্রান্ত রায়ের সুযোগ নিয়ে কেউ যদি নিজের জন্য হারামকে হালাল অথবা হালালকে হারাম করে নিয়ে থাকে, তবে তার কোনো গুণাহ হয়নি এবং আখেরাতেও তার কোনো জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবেনা। কিন্তু ইমাম সাহেবের বক্তব্যের এই ব্যাখ্যা তার সমালোচকরা বা সমর্থকরা যারাই মনগড়াভাবে করে থাকুক না কেন, আমার জানা মতে ও ধারণামতে এ ব্যাখ্যা স্বয়ং ইমাম সাহেবের বরাতে যেমন কোথাও বর্ণিত হয়নি, তেমনি এটা সঠিক এবং সমীচিনও মনে হয়না, আর ইমাম সাহেবের মূল বক্তব্যের আলোকেও এটা অপরিহার্য সাব্যস্ত হয়না। ইমাম আবু হানিফার উপর তার বক্তব্যের এ ব্যাখ্যার কোনো দায়দায়িত্ব বর্তায় না। এতো বড় একজন মর্যাদাবান ধর্মীয় নেতা ও ইমামের ব্যাপারে এরূপ ধারণা করা কিভাবে সমীচীন হতে পারে যে, হালাল হারাম নির্ধারণের যে ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ, তা তিনি এ অর্থে আদালতের বিচারকের হাতে সোপর্দ করে দেবেন এবং জনসাধারণের বিবেক থেকে গুণাহের অনুভূতি ও হালাল হারাম বাছ বিচারের মনোভাব নির্মূল করার পথ এভাবে খুলে দেবেন?
ব্যাপারটা যদি সে রকম না হয়ে থাকে এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, সে রকম নয়, তাহলে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, এ উক্তির প্রকৃত মর্ম কি? আমার জ্ঞানমতে এ উক্তির সঠিক মর্ম ও তাৎপর্য নৈতিকভাবে এবং পরকালীন ফলাফল বিবেচনায় না এনে আদালতের রায়ের নিছক পার্থিব ফলাফলও আইনগত দিক যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে, এসব রায়ের কোনো কোনো বক্তব্য আমাদের অন্তর্নিহিত জীবনের অত্যন্ত স্পর্শকাতর অনুভূতি এবং নিরেট ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ও ধ্যান ধারণার সাথে জড়িত। এ দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করলে নিছক পার্থিব নিয়ম শৃংখলা ও আইনগত দিক দিয়ে আদালতের রায়ের একটা দিক জাহেরি তথা বাহ্যিক ও বস্তুগত এবং আরেকটা দিক বাতেনি তথা আভ্যন্তরীণ ও নৈতিক হয়ে থাকে। আমার মতে, ইমাম আবু হানিফার প্রবর্তিত জাহেরি ও বাতেনি এই দু'প্রকারের কার্যকারিতা উল্লেখিত ব্যাখ্যার আলোকেই বিবেচিত হয়ে থাকে।
আমি একটা উদাহরণ দ্বারা জাহের ও বাতেনের এই সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যাকে স্পষ্ট করে দিতে চাই। মনে করুন, সেলিম ও রোকেয়ার মধ্যে বৈবাহিক দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান কিনা, সেটা বিতর্কিত। ধরে নেয়া যাক আসলে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান, কিন্তু রোকেয়া অস্বীকার করছে, অথবা তালাকের মাধ্যমে চিরবিচ্ছেদ ঘটছে বলে দাবি করছে। আর নিজের দাবির সপক্ষে সে মিথ্যা সাক্ষীও হাজির করে দিচ্ছে। অপরদিকে সেলিম বিয়ে বহাল থাকার সপক্ষে কোনো সাক্ষ্য পেশ করতে পারছেনা। আদালত বিয়ে বহাল নেই অথবা তালাক দ্বারা বিচ্ছেদ ঘটে গেছে বলে রায় দিয়ে দিলো। এক্ষণে এ রায়ের একটা দিক তো স্পষ্টতই জাহেরি বা বাহ্যিক, যা বাস্তব জগতের সাথে সম্পক্ত। সেটি এই যে, এখন আর সেলিম রোকেয়ার ভরণ পোষণ ও আবাসনের জন্য দায়ি নয় এবং রোকেয়াও তা দাবি করার অধিকার রাখেনা। কিন্তু এ বিষয়টার আরো একটা দিক রয়েছে, যার সম্পর্ক অন্তর্নিহিত জগতের সাথে এবং যাকে ইমাম সাহেবের ভাষায় বাতেনি দিক বলেও অভিহিত করা চলে। এ দিকটা হলো রোকেয়ার সতীত্বকে স্পর্শ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখার বৈধ্যতা ও অবৈধতার এবং বিয়ে ও দাম্পত্য সম্পর্ক কার্যত বহাল থাকা না থাকার। রোকেয়া তার দাবি প্রতিষ্টার জন্য মিথ্যা সাক্ষ্যকে যেভাবে প্রয়োগ করেছে তা যে মহাপাপ এবং তার জন্য সে যে আখেরাতে আযাব ভোগ করতে বাধ্য, সে ব্যাপারে তো আদৌ কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম ইবনে হুমাম স্বীয় গ্রন্থ 'ফাতহুল ক্কাদীরে' বলেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"একটা অন্যায় দাবি উত্থাপন ও অন্যায়ভাবে তা প্রতিষ্ঠিত করার কাজ যে করে, সে এতো বড় গুণাহ করে, যার চেয়ে বড় আর কোনো গুণাহ হতে পারে না।"
কিন্তু আমি ইতিপূর্বেই বলেছি আখেরাতে কি পরিণতি হবে, না হবে, তা বাদ দিলেও, এখানে ইহলৌকিক বিচার বিবেচনার দিক দিয়েও হালাল হারাম সংক্রান্ত এমন কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন দেখা দেয়, যার সমাধান না করে উপায় থাকেনা। যেমন, সেলিম ও রোকেয়ার বৈবাহিক সম্পর্কচ্ছেদের পক্ষে আদালত যে রায় দিয়েছে চাই বাস্তবে সে রায় ভ্রান্তই হোক না কেন, তার পরে সেলিম রোকেয়ার সাথে স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে কিনা? যদি রাখে তবে আদালত তাকে ব্যভিচারি সাব্যস্ত করে তাকে ব্যভিচারের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি দিতে পারবে কিনা? সেলিম যদি এখন রোকেয়ার আপন বোনকে বিয়ে করে, তাহলে এক সাথে দুই সহোদরাকে বিয়ে করার দায়ে সে দোষি হবে কিনা? রোকেয়ার অন্য কারো সাথে বা অন্য কারো রোকেয়ার সাথে বৈবাহিক ও দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন আইনত ও শরিয়ত মোতাবেক অনুমোদিত কিনা? যদি অনুমোদিত হয়ে থাকে তবে কেন অনুমোদিত এবং না হয়ে থাকলে কেন নয়? তাছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে বিয়ের বৈধতা ও অবৈধতার কোনো প্রভাব পূর্ববর্তী বিয়ের উপর পড়বে কিনা?
সেলিম ও রোকেয়ার মধ্যে বিয়ের বিচ্ছেদ সংঘটনকারি আদালতের রায় সাস্তবিক পক্ষে ভ্রান্ত হলেও যেহেতু সেটা আদালতের সিদ্ধান্ত, তাই অন্তত:পক্ষে বাহ্যিকভাবে তা কার্যকর না হয়ে পরেনা। এখন যদি সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষের অথবা জনগণের মধ্য থেকে কেউ এই রায়ের আইনগত ও রাজনৈতিক কার্যকারিতাকেই চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে শুধু বিচার বিভাগ নয়, বরং গোটা প্রশাসন ব্যবস্থায় অরাজকতা ও বিশৃংখলা দেখা দেবে এবং এমন বিশৃংখল অবস্থার উদ্ভব ঘটবে, যেখানে কোনো সিদ্ধান্ত, নির্দেশ বা আইনই কার্যকর হওয়া সম্ভব হবেনা।আর যদি কেউ আদালতের সিদ্ধান্তটির বাহ্যিক কার্যকারিতা মেনে নেয়, কিন্তু বাতেনি তথা আভ্যন্তরীণ ও নৈতিক কার্যকারিতা না মানে এবং বিয়ে ভঙ্গের রায় বৃথা ও বাস্তবে অকার্যকর বলে আপন মনে ভাবতে ও প্রচার করতে থাকে, তা হলে সেই ব্যক্তি উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর কি সন্তোষজনক জবাব দেবে তা আমার বুঝে আসেনা। এরূপ ব্যক্তি যদি সেলিম হয় বা দ্বিতীয় স্বামীর পর্যায়ে থাকে, তাহলে সে বিবিধ জটিলতা থেকে মুক্ত কোন্ কর্মপন্থা অবলম্বন করতে সক্ষম হবে, তাও আমার অজানা। আমার মতে, এই সকল জটিলতার চূড়ান্ত সমাধান এবং সকল বিতর্ক অবসানের সর্বশেষ উপায় হলো ইমাম আবু হানিফার মূলনীতি অনুসরণ করা এবং আদালতের রায়কে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ-উভয়ভাবে কার্যকর মেনে নেয়া। এরপর আমরা সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারবো যে রোকেয়ার বৈবাহিক ও দাম্পত্য সম্পর্ক এখন সেলিমের সাথে সর্বোতভাবে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে তার বিয়ে হওয়া সম্পূর্ণ বৈধ। রোকেয়া যদি গুণাহ করে থাকে তবে তার পরিমাণ সে আখেরাতে অবশ্যই ভোগ করবে। ইমাম সাহেবের উক্তির দরুন তার পাপের বা পারলৌকিক শাস্তির কিছুমাত্র লাঘব হওয়া প্রমাণিত হয়না।
ইমাম আবু হানিফার নীতির যে ব্যাখ্যা আমি করেছি, তার আলোকে দেখলে এই নীতি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ও অখণ্ডনীয় বলে মনে হবে। এটি অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ও কল্যাণময় মূলনীতি। শরিয়তের আইন বিধি ও নির্দেশমালার বাস্তব প্রয়োগে যেসব জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, তা বহুলাংশে এর দ্বারা নিরসন করা সম্ভব। তাছাড়া কুরআন ও সুন্নাহর কোনো স্পষ্টোক্তি বা কোনো মূলনীতির সাথে এর কোনো বৈসাদৃশ্য বা বিরোধও নেই। বরঞ্চ হযরত আলীর একটি রায় থেকে এ নীতির পক্ষে অধিকতর সমর্থন পাওয়া যায়। রায়টি নিম্নরূপ :
এক ব্যাক্তি জনৈক মহিলাকে নিজের স্ত্রী দাবি করে আদালতে মামলা দায়ের করলো এবং স্বীয় দাবির সপক্ষে সাক্ষীও পেশ করলো। বিচারক হযরত আলী রা. সাক্ষী সাবুদের উপর নির্ভর করে পুরুষটির পক্ষে রায় দিলেন এবং তার দাবি সঠিক বলে মেনে নিলেন। মহিলাটি বললো : আমি আসলে তো তার স্ত্রী ছিলামনা কিন্তু আপনি যখন রায় দিয়ে দিয়েছেন তখন ঐ পুরুষটির সাথে আমার বিয়েও সম্পন্ন করুন, যাতে আমি তার জন্য বৈধ হয়ে যাই। হযরত আলী রা, বললেন, --------------- অর্থাৎ তোমার বিরুদ্ধে যে দু'ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়েছে, তারাই তো ঐ পুরুষটির সাথে তোমার বিয়ে সম্পন্ন করে দিয়েছে। এখন আর আনুষ্ঠানিক বিয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। এই মামলায় হযরত আলীর রা. কথা ও কাজ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আদালতের রায় জাহের ও বাতেন উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়ে যায়। আর এখান থেকেই ইমাম আবু হানিফার 'জাহেরি' ও বাতেনি কার্যকারিতা'র তাৎপর্যও বুঝা যায়।
মোটকথা, এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইমাম আবু হানিফার ঘোষিত নীতিতে বিরোধ ও বৈপরিত্যের প্রশ্ন তোলার কারণ ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে ইমাম সাহেবের সূক্ষ্মদর্শিতা এবং তাঁর প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতি না দিয়ে পারা যায়না।
প্রশ্ন : শরহে বেকায়া তৃতীয় খণ্ডের 'আদালতের কার্য প্রণালী' এবং হেদায়া তৃতীয় খণ্ডের 'কাযীর নিকট কাযীর পত্র' অধ্যায়ে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"কাযী কোনো জিনিসকে জাহেরিভাবে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিলে প্রকৃতভাবেও তা অবৈধ। অনুরূপভাবে কোনো কিছুকে বৈধ ঘোষণা করলে সেটা প্রকৃতভাবেও বৈধ।"
কিন্তু কুরআন এক জায়গায় বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করোনা এবং জেনেশুনে মানুষের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ দখল করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের নিকট মামলা রুজু করোনা।" (সূরা আল বাকার, আয়াত : ১৮৮)
---------------------------------------------------------------------------------
"তোমাদের একজন আরেকজনের চেয়ে অধিকতর বাকপটু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত হও যে সে সত্য বললো কিনা, অন্যথায় (অসত্য কথা বলে যা অর্জন করবে) তা আগুনের টুকরো মাত্র"।
এভাবে কুরআন ও হাদিস থেকে উপরোক্ত অভিমত ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় এবং উল্লেখিত উক্তি স্পষ্টতই কুরআন ও হাদিসের বিপরীত মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারছিনা। উক্ত বক্তব্যের কোনো সঠিক ব্যাখ্যা থাকলে লিখুন।
জবাব : আপনি ইমাম আবু হানিফার রহ. যে উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, তার মর্ম উদ্ধারে যে কিছু জটিলতা দেখা দেয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কারণে ইমাম শাফেয়ী রহ. এবং অন্যান্য ফকীহগণ, এমনকি ইমাম আবু হানিফার দুই শিষ্য (ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ) কোনো কোনো খুঁটিনাটি বিধি প্রণয়নে স্বীয় উস্তাদের এই মূলনীতির সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তবে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে ইমাম আবু হানিফার উক্ত মূলনীতি সম্পূর্ণ নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় এবং স্থান বিশেষে তার এমন ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে, যাতে সকল জটিলতার নিরসন ঘটে। ইমাম সাহেবের বক্তব্য, কাযীর বিচারের রায় জাহেরি ও বাতেনি উভয় দিক দিয়েই কার্যকর হয়ে যায়। অর্থাৎ তিনি যে জিনিসকে অবৈধ ও অচল ঘোষণা করবেন, তা অবৈধ গণ্য হবে এবং যে জিনিসকে বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত ঘোষণা করবেন, তা বৈধ বা হালাল সাব্যস্ত হবে, চাই মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হওয়ায় তা মূলত ভ্রান্ত রায়ই হোক না কেন। এ উক্তির প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করার জন্য প্রথমে মনে রাখা দরকার হানাফি ফকীহদের সর্বসম্মত বিঘোষিত মূলনীতি অনুসারে, এটা সব রকমের মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং শুধুমাত্র বিয়ে তালাক ও ক্রয় বিক্রয়ের শুদ্ধাশুদ্ধতা অথবা মালিকানা সংক্রান্ত এমন বিরোধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাতে মালিকানা নির্ণয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যকরণ, যথা ক্রয় বিক্রয় অথবা উত্তরাধিকারের উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত: 'জাহেরী' ও 'বাতেনী' শব্দদ্বয়ের সঠিক মর্ম ও অর্থ চিহ্নিত করতে হবে। কেননা এটা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা ছাড়া মূল বক্তব্যের যথাযথ তাৎপর্য বুঝা কঠিন হয়ে পড়ে।
আদালতের রায় জাহেরীভাবে কার্যকর হওয়ার অর্থ তো একেবারেই স্পষ্ট যে, আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হবে। উভয় পক্ষ তা মানতে বাধ্য ও জনসাধারণের নিকট তা গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বাতেনিভাবে কার্যকর হওয়ার বিষয়টা কিছুটা বিচার বিবেচনা ও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে বিশেষত, যখন আদালতের রায় মিথ্যা কিংবা ত্রুটিপূর্ণ সাক্ষের কারণে বাস্তবানুগ হয় না। ইমাম আবু হানিফার অভিমত এই যে, এই বাস্তব ত্রুটিসত্তেও আদালতের রায় জাহেরী ও বাতেনিভাবে কার্যকর হবে। বাতেনিভাবে কার্যকর হওয়ার ব্যাখ্যা কেউ কেউ এভাবে দিয়ে থাকেন যে, এই রায় আল্লাহর কাছেও কার্যকর হয়ে গেছে ধরে নেয়া হবে। ফলে এই ভ্রান্ত রায়ের সুযোগ নিয়ে কেউ যদি নিজের জন্য হারামকে হালাল অথবা হালালকে হারাম করে নিয়ে থাকে, তবে তার কোনো গুণাহ হয়নি এবং আখেরাতেও তার কোনো জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবেনা। কিন্তু ইমাম সাহেবের বক্তব্যের এই ব্যাখ্যা তার সমালোচকরা বা সমর্থকরা যারাই মনগড়াভাবে করে থাকুক না কেন, আমার জানা মতে ও ধারণামতে এ ব্যাখ্যা স্বয়ং ইমাম সাহেবের বরাতে যেমন কোথাও বর্ণিত হয়নি, তেমনি এটা সঠিক এবং সমীচিনও মনে হয়না, আর ইমাম সাহেবের মূল বক্তব্যের আলোকেও এটা অপরিহার্য সাব্যস্ত হয়না। ইমাম আবু হানিফার উপর তার বক্তব্যের এ ব্যাখ্যার কোনো দায়দায়িত্ব বর্তায় না। এতো বড় একজন মর্যাদাবান ধর্মীয় নেতা ও ইমামের ব্যাপারে এরূপ ধারণা করা কিভাবে সমীচীন হতে পারে যে, হালাল হারাম নির্ধারণের যে ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ, তা তিনি এ অর্থে আদালতের বিচারকের হাতে সোপর্দ করে দেবেন এবং জনসাধারণের বিবেক থেকে গুণাহের অনুভূতি ও হালাল হারাম বাছ বিচারের মনোভাব নির্মূল করার পথ এভাবে খুলে দেবেন?
ব্যাপারটা যদি সে রকম না হয়ে থাকে এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, সে রকম নয়, তাহলে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, এ উক্তির প্রকৃত মর্ম কি? আমার জ্ঞানমতে এ উক্তির সঠিক মর্ম ও তাৎপর্য নৈতিকভাবে এবং পরকালীন ফলাফল বিবেচনায় না এনে আদালতের রায়ের নিছক পার্থিব ফলাফলও আইনগত দিক যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে, এসব রায়ের কোনো কোনো বক্তব্য আমাদের অন্তর্নিহিত জীবনের অত্যন্ত স্পর্শকাতর অনুভূতি এবং নিরেট ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ও ধ্যান ধারণার সাথে জড়িত। এ দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করলে নিছক পার্থিব নিয়ম শৃংখলা ও আইনগত দিক দিয়ে আদালতের রায়ের একটা দিক জাহেরি তথা বাহ্যিক ও বস্তুগত এবং আরেকটা দিক বাতেনি তথা আভ্যন্তরীণ ও নৈতিক হয়ে থাকে। আমার মতে, ইমাম আবু হানিফার প্রবর্তিত জাহেরি ও বাতেনি এই দু'প্রকারের কার্যকারিতা উল্লেখিত ব্যাখ্যার আলোকেই বিবেচিত হয়ে থাকে।
আমি একটা উদাহরণ দ্বারা জাহের ও বাতেনের এই সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যাকে স্পষ্ট করে দিতে চাই। মনে করুন, সেলিম ও রোকেয়ার মধ্যে বৈবাহিক দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান কিনা, সেটা বিতর্কিত। ধরে নেয়া যাক আসলে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান, কিন্তু রোকেয়া অস্বীকার করছে, অথবা তালাকের মাধ্যমে চিরবিচ্ছেদ ঘটছে বলে দাবি করছে। আর নিজের দাবির সপক্ষে সে মিথ্যা সাক্ষীও হাজির করে দিচ্ছে। অপরদিকে সেলিম বিয়ে বহাল থাকার সপক্ষে কোনো সাক্ষ্য পেশ করতে পারছেনা। আদালত বিয়ে বহাল নেই অথবা তালাক দ্বারা বিচ্ছেদ ঘটে গেছে বলে রায় দিয়ে দিলো। এক্ষণে এ রায়ের একটা দিক তো স্পষ্টতই জাহেরি বা বাহ্যিক, যা বাস্তব জগতের সাথে সম্পক্ত। সেটি এই যে, এখন আর সেলিম রোকেয়ার ভরণ পোষণ ও আবাসনের জন্য দায়ি নয় এবং রোকেয়াও তা দাবি করার অধিকার রাখেনা। কিন্তু এ বিষয়টার আরো একটা দিক রয়েছে, যার সম্পর্ক অন্তর্নিহিত জগতের সাথে এবং যাকে ইমাম সাহেবের ভাষায় বাতেনি দিক বলেও অভিহিত করা চলে। এ দিকটা হলো রোকেয়ার সতীত্বকে স্পর্শ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখার বৈধ্যতা ও অবৈধতার এবং বিয়ে ও দাম্পত্য সম্পর্ক কার্যত বহাল থাকা না থাকার। রোকেয়া তার দাবি প্রতিষ্টার জন্য মিথ্যা সাক্ষ্যকে যেভাবে প্রয়োগ করেছে তা যে মহাপাপ এবং তার জন্য সে যে আখেরাতে আযাব ভোগ করতে বাধ্য, সে ব্যাপারে তো আদৌ কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম ইবনে হুমাম স্বীয় গ্রন্থ 'ফাতহুল ক্কাদীরে' বলেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"একটা অন্যায় দাবি উত্থাপন ও অন্যায়ভাবে তা প্রতিষ্ঠিত করার কাজ যে করে, সে এতো বড় গুণাহ করে, যার চেয়ে বড় আর কোনো গুণাহ হতে পারে না।"
কিন্তু আমি ইতিপূর্বেই বলেছি আখেরাতে কি পরিণতি হবে, না হবে, তা বাদ দিলেও, এখানে ইহলৌকিক বিচার বিবেচনার দিক দিয়েও হালাল হারাম সংক্রান্ত এমন কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন দেখা দেয়, যার সমাধান না করে উপায় থাকেনা। যেমন, সেলিম ও রোকেয়ার বৈবাহিক সম্পর্কচ্ছেদের পক্ষে আদালত যে রায় দিয়েছে চাই বাস্তবে সে রায় ভ্রান্তই হোক না কেন, তার পরে সেলিম রোকেয়ার সাথে স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে কিনা? যদি রাখে তবে আদালত তাকে ব্যভিচারি সাব্যস্ত করে তাকে ব্যভিচারের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি দিতে পারবে কিনা? সেলিম যদি এখন রোকেয়ার আপন বোনকে বিয়ে করে, তাহলে এক সাথে দুই সহোদরাকে বিয়ে করার দায়ে সে দোষি হবে কিনা? রোকেয়ার অন্য কারো সাথে বা অন্য কারো রোকেয়ার সাথে বৈবাহিক ও দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন আইনত ও শরিয়ত মোতাবেক অনুমোদিত কিনা? যদি অনুমোদিত হয়ে থাকে তবে কেন অনুমোদিত এবং না হয়ে থাকলে কেন নয়? তাছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে বিয়ের বৈধতা ও অবৈধতার কোনো প্রভাব পূর্ববর্তী বিয়ের উপর পড়বে কিনা?
সেলিম ও রোকেয়ার মধ্যে বিয়ের বিচ্ছেদ সংঘটনকারি আদালতের রায় সাস্তবিক পক্ষে ভ্রান্ত হলেও যেহেতু সেটা আদালতের সিদ্ধান্ত, তাই অন্তত:পক্ষে বাহ্যিকভাবে তা কার্যকর না হয়ে পরেনা। এখন যদি সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষের অথবা জনগণের মধ্য থেকে কেউ এই রায়ের আইনগত ও রাজনৈতিক কার্যকারিতাকেই চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে শুধু বিচার বিভাগ নয়, বরং গোটা প্রশাসন ব্যবস্থায় অরাজকতা ও বিশৃংখলা দেখা দেবে এবং এমন বিশৃংখল অবস্থার উদ্ভব ঘটবে, যেখানে কোনো সিদ্ধান্ত, নির্দেশ বা আইনই কার্যকর হওয়া সম্ভব হবেনা।আর যদি কেউ আদালতের সিদ্ধান্তটির বাহ্যিক কার্যকারিতা মেনে নেয়, কিন্তু বাতেনি তথা আভ্যন্তরীণ ও নৈতিক কার্যকারিতা না মানে এবং বিয়ে ভঙ্গের রায় বৃথা ও বাস্তবে অকার্যকর বলে আপন মনে ভাবতে ও প্রচার করতে থাকে, তা হলে সেই ব্যক্তি উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর কি সন্তোষজনক জবাব দেবে তা আমার বুঝে আসেনা। এরূপ ব্যক্তি যদি সেলিম হয় বা দ্বিতীয় স্বামীর পর্যায়ে থাকে, তাহলে সে বিবিধ জটিলতা থেকে মুক্ত কোন্ কর্মপন্থা অবলম্বন করতে সক্ষম হবে, তাও আমার অজানা। আমার মতে, এই সকল জটিলতার চূড়ান্ত সমাধান এবং সকল বিতর্ক অবসানের সর্বশেষ উপায় হলো ইমাম আবু হানিফার মূলনীতি অনুসরণ করা এবং আদালতের রায়কে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ-উভয়ভাবে কার্যকর মেনে নেয়া। এরপর আমরা সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারবো যে রোকেয়ার বৈবাহিক ও দাম্পত্য সম্পর্ক এখন সেলিমের সাথে সর্বোতভাবে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে তার বিয়ে হওয়া সম্পূর্ণ বৈধ। রোকেয়া যদি গুণাহ করে থাকে তবে তার পরিমাণ সে আখেরাতে অবশ্যই ভোগ করবে। ইমাম সাহেবের উক্তির দরুন তার পাপের বা পারলৌকিক শাস্তির কিছুমাত্র লাঘব হওয়া প্রমাণিত হয়না।
ইমাম আবু হানিফার নীতির যে ব্যাখ্যা আমি করেছি, তার আলোকে দেখলে এই নীতি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ও অখণ্ডনীয় বলে মনে হবে। এটি অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ও কল্যাণময় মূলনীতি। শরিয়তের আইন বিধি ও নির্দেশমালার বাস্তব প্রয়োগে যেসব জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, তা বহুলাংশে এর দ্বারা নিরসন করা সম্ভব। তাছাড়া কুরআন ও সুন্নাহর কোনো স্পষ্টোক্তি বা কোনো মূলনীতির সাথে এর কোনো বৈসাদৃশ্য বা বিরোধও নেই। বরঞ্চ হযরত আলীর একটি রায় থেকে এ নীতির পক্ষে অধিকতর সমর্থন পাওয়া যায়। রায়টি নিম্নরূপ :
এক ব্যাক্তি জনৈক মহিলাকে নিজের স্ত্রী দাবি করে আদালতে মামলা দায়ের করলো এবং স্বীয় দাবির সপক্ষে সাক্ষীও পেশ করলো। বিচারক হযরত আলী রা. সাক্ষী সাবুদের উপর নির্ভর করে পুরুষটির পক্ষে রায় দিলেন এবং তার দাবি সঠিক বলে মেনে নিলেন। মহিলাটি বললো : আমি আসলে তো তার স্ত্রী ছিলামনা কিন্তু আপনি যখন রায় দিয়ে দিয়েছেন তখন ঐ পুরুষটির সাথে আমার বিয়েও সম্পন্ন করুন, যাতে আমি তার জন্য বৈধ হয়ে যাই। হযরত আলী রা, বললেন, --------------- অর্থাৎ তোমার বিরুদ্ধে যে দু'ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়েছে, তারাই তো ঐ পুরুষটির সাথে তোমার বিয়ে সম্পন্ন করে দিয়েছে। এখন আর আনুষ্ঠানিক বিয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। এই মামলায় হযরত আলীর রা. কথা ও কাজ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আদালতের রায় জাহের ও বাতেন উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়ে যায়। আর এখান থেকেই ইমাম আবু হানিফার 'জাহেরি' ও বাতেনি কার্যকারিতা'র তাৎপর্যও বুঝা যায়।
মোটকথা, এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইমাম আবু হানিফার ঘোষিত নীতিতে বিরোধ ও বৈপরিত্যের প্রশ্ন তোলার কারণ ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে ইমাম সাহেবের সূক্ষ্মদর্শিতা এবং তাঁর প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতি না দিয়ে পারা যায়না।
বিষয়: বিবিধ
১১৯৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন