প্রশ্ন : এক ভদ্রলোক এক উদ্ভট মাসয়ালা বর্ণনা করেছেন, যা স্পষ্টতই ভুল বলে মনে হয়। মাসয়ালাটি হলো, যেসব মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়া শরিয়তে নাজায়েয, তাদের সাথেও যদি উভয় পক্ষে সম্মতিক্রমে যথারীতি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দান ও তা গ্রহণ, সাক্ষ্য ও মোহরানা সহকারে বিয়ে সম্পন্ন হয় তবে এ ধরনের বিয়ে কার্যকর ও সিদ্ধ হবে।
লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ১৪ মার্চ, ২০১৬, ০৮:৫২:৫০ রাত
তবে তা ফাসিদ অর্থাৎ অন্যায়, ত্রুটিপূর্ণ ও বাতিলযোগ্য হবে। তবে সন্তান সন্ততি জারজ হবেনা, ব্যভিচারের দণ্ড কার্যকর হবেনা, তালাক ছাড়া এ ধরনের বিয়ে বাতিল হবেনা এবং অন্য কোনো পুরুষের সাথে ঐ মহিলার বিয়েও হতে পারবেনা। ভদ্রলোককে যখন এই মাসয়ালার সপক্ষে কোনো প্রমাণ আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলো, তখন তিনি বললেন, এটা ফেকাহ শাস্ত্রের একটা সাধারণ মাসয়ালা। হানাফি মাযহাবে এটা স্বীকৃত। যাকে খুশি জিজ্ঞেস করে দেখ। অনুগ্রহপূর্বক জানাবেন, এ মাসয়ালাটি কি সত্যিই এ রকম? যদি তাই হয়ে থাকে তবে এটা কোন্ কিতাবে আছে? যদি ভালো মনে করেন, তবে জবাব তরজমানুল কুরআনে ছেপে দেবেন।
জবাব : আসল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে এ কথা জানিয়ে দেয়া সমীচীন মনে করি যে, কোনো ফেকাহ শাস্ত্রীয় মাসয়ালা যদি সঠিকও হয় এবং কোনো কিতাবে তা লেকাও থাকে, তা বিনা প্রয়োজনে জনসাধারণের মধ্যে এভাবে প্রচার করা দায়িত্ব সচেতন ও সতর্ক লোকদের কাজ নয়, যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও অস্তিরতার সৃষ্টি হয়, তারা গুনাহর কাজে লিপ্ত হওয়ার আস্কারা পায়, কিংবা ফকীহ ও আলেমদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে। অনুরূপভাবে কোনো মাসয়ালার বিস্তারিত বিশ্লেষণ ছাড়াই তার একটা সংক্ষিপ্ত অস্পষ্ট সার কথা সাধারণ মানুষের গোচরে আনাও ঘোরতর অশান্তি ও বিভ্রান্তি উস্কে দিতে পারে। এতে করে কেবল যে একটি বিশেষ মাযহাব ও মতের প্রবক্তাদেরই দুর্নাম রটে তা নয়, বরং সর্বব্যাপী মূর্খতা ও ভ্রষ্টতার এই যুগে সামগ্রিকভাবে ইসলাম ও ইসলামের অনুসারীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় ও মর্যাদা খাটো হয়। আর যারা দু'একটা ফেকাহ শাস্ত্রীয় মাসয়ালা ও দু'একটা হাদিসের অজুহাত দিয়ে ইসলামের গোটা সাহিত্য ভাণ্ডারকে বাতিল করে দেয়ার ধৃষ্টতা দেখায় এবং আমাদের প্রাচীন ইমাম ও আলেমদের সবার বিরুদ্ধে অনাস্থা ও নিন্দা প্রস্তাব পাস করতে চায়, সেই কুচক্রী মহলেরই মনোবল বাড়ে।
এবার মূল মাসয়ালাটির প্রসঙ্গে আসা যাক। নীতিগতভাবে ইমাম ও ফকীহগণ শুধুমাত্র সেই বিয়েকেই বিশুদ্ধ ও বৈধ মনে করেন, যে বিয়ে কোনো শরিয়তসম্মত বাধা ছাড়াই সম্পন্ন হয় এবং যার অপরিহার্য উপাদানসমূহ ও শর্তাবলীর কোনো একটিও অনুপস্থিত থাকেনা। কিন্তু যে বিয়ে সম্পন্ন হতে কোনো শরিয়তসম্মত বাধা থাকে অথবা যার কোনো অপরিহার্য উপাদান অনুপস্থিত থাকে, ফকীহগণ তাকে অশুদ্ধ বিয়ে গণ্য করেন। অবশ্য আধুনিক হানাফি ফকীহগণ আবার অশুদ্ধ বিয়েকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। একটি বাতিল, অপরটি ফাসিদ। নিকাহে বাতিল বিয়ে হলো এমন বিয়ে, যা হওয়া না হওয়া সমান কথা, যা একেবারেই অচল ও অকার্যকর এবং যা সকল ফকীহদের সর্বসম্মত রায়ে স্পষ্টতই বাতিল। যেমন, কোনো হতভাগা যদি মুহররাম তথা নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো মেয়েকে বিয়ে করে, দুই সহোদরা বোনকে একই সময়ে বিয়ে করে, কিংবা জেনেশুনে অন্যের বিবাহিত স্ত্রীকে বা ইদ্দত পালনরত মহিলাকে বিয়ে করে, তাহলে সেই বিয়ে অন্য সকল মাযহাবের ন্যায় হানাফি মাযহাবেও বাতিল ও অচল। এ ধরণের বিয়ে শরিয়তে বিয়ে হিসেবেই স্বীকৃত নয় এবং তাতে অকার্য্যকর ও অবৈধ ঘোষণা করার জন্য তালাক বা বিচ্ছিন্নকরণের অন্য কোনো পদক্ষেপের প্রয়োজন নেই। এ বিয়ে আপনা আপনি কার্যকর হবে এবং এর দ্বারা জন্ম লাভ করা সন্তান জারজ সন্তান হিসেবে গণ্য হবে। হানাফি মাযহাবেও এ ধরণের বিয়ে এবং ব্যভিচারের আদৌ কোনো প্রভেদ নেই।
হানাফি মাযহাবে অশুদ্ধ বিয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীটি হলো ফাসিদ বিয়ে। যে বিয়ে বৈধ না অবৈধ এবং হিসেবে বিয়ে হিসেবে স্বীকৃত ন অস্বীকৃত সে ব্যাপার সংশয় কিংবা মতভেদ রয়েছে, অথবা যাতে বিশুদ্ধতার শর্তবলীর কোনো একটি অনুপস্থিত বা অস্পূর্ণ থাকে এবং এ কারণে শরিয়ত তাকে ভেঙ্গে দেয়া জরুরি বলে মনে করে, সেই বিয়েকে ফাসিদ বিয়ে বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, এক মহিলা ইদ্দত পালন করেছে কিন্তু বর তা জানেনা, অথবা ইদ্দত শেষ হয়ে গেছে এই ভুল ধারণা পোষণ করে এবং বিয়ে সম্পন্ন করে, অথবা দু'জন সাক্ষীর পরিবর্তে একজন সাক্ষী থাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে বিয়ে একেবারে অকার্যকর বা অচল হবেনা। কিন্তু তা তাৎক্ষণিকভাবে ভেঙ্গে দেয়া জরুরি। এ ধরণের বিয়েতে ব্যভিচারের দণ্ড চালু হবেনা এবং এটা ভাঙ্গার জন্য তালাক অথবা স্বামী স্ত্রীর কোনো একজনের পক্ষ থেকে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করা আবশ্যক। দম্পত্তি যদি বিচ্ছিন্ন হতে ইতস্তত করে, তবে কাজীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদ ঘটানোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এ ধরণের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর হানাফিদের মতে ইদ্দত পালন করতে হবে এবং সন্তান হলে তা বৈধ সন্তান বলে গণ্য হবে।
বাতিল বিয়ে ও ফাসিদ বিয়ের মধ্যে হানাফি মাযহাবে স্বীকৃত এই আইনগত পার্থক্য ফেকাহ শাস্ত্রীয় গ্রন্থাবলীতেও লিখিত রয়েছে। রদ্দুল মুখতারের বিয়ে সংক্রান্ত অধ্যায়ে আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী ফাসিদ বিয়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন :
----------------------------------------
"বিয়ের বিশুদ্ধতার শর্তাবলীর কোনো একটি অনুপস্থিত থাকলে সেই বিয়ে ফাসিদ বিয়ে বলে গণ্য হবে, যেমন প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাক্ষী না থাকা কিংবা আদৌ সাক্ষী না থাকা।"
বাতিল বিয়ে সম্টর্কে তিনি বলেন :
"যে বিয়ে হওয়া না হওয়া সমান সেটাই বাতিল বিয়ে। এজন্য নিষিদ্ধ নারী ও পুরুষের বিয়ে দ্বারা সন্তান বৈধ হয়না এবং ইদ্দত পালনের আবশ্যকতা থাকেনা।"
আল্লামা শামী এর পর বলেছেন, জেনেশুনে অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী বা ইদ্দত পালনরতা মহিলাকে বিয়ে করলে তাও নিকাহে বাতিল বলে গণ্য হবে। কেননা তা আদৌ বিয়েই নয় এবং এ ধরণের বিয়ে ও ব্যভিচারে কোনো পার্থক্য নেই। এ ক্ষেত্রে ব্যভিচারের দণ্ডই প্রযোজ্য।
উপরোক্ত বিশদ আলোচনা মনে রেখে উল্লেখিত মাসয়ালার উপর পুনরায় দৃষ্টি বুলালে বুঝা যাবে, হানাফি মাযহাবের ফকীহগণের নামে এ মাসয়ালা বর্ণনা করা ভিত্তিহীন অপবাদ ছাড়া কিছু নয়। জেনেই হোক বা না জেনেই হোক, এটা তাদের উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কেউ যদি হানাফিদের অভিমত প্রচার করতে এতোই আগ্রহী হয়ে থাকেন, তবে তার প্রথমে এ মাসয়ালার পুরো বিবরণ জানা উচিত। অত:পর তাকে এ অভিমত হুবুহু তুলে ধরতে হবে এবং বিয়ের বৈধতা ও অবৈধতার প্রসঙ্গ আলোচনা করার সময় হানাফিগণ বাতিল বিয়ে ও ফাসিদ বিয়ের যে পার্থক্য দেখিয়েছেন, তা পুরোপুরিভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। নচেত অস্পষ্টভাবে একটা কথা বলেই চুপ করে যাওয়া বা উভয় ধরণের বিয়ে মিলিয়ে একাকার করে ফেলার দরুন একজন সাধারণ শ্রোতার মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হবে। সে ভাবলে, ফকীহগণ জায়েয ও নাজায়েযের ভেদাভেদ বিলোপ করে দিয়েছেন। অথচ এ অপবাদ থেকে তারা সম্পূর্ণ মুক্ত। বাতিল ও ফাসিদ বিয়ে দুটোই তাদের কাছে অবৈধ ও অশুদ্ধ বিয়ে। পার্থক্য শুধু এতোটুকু যে, বাতিল বিয়ে ভাঙ্গার জন্য কোনো তালাক বা বিচ্ছেদ ঘটানোর প্রয়োজন নেই এবং এতে ব্যভিচারের দণ্ড অপরিহার্য চালু হবে। কিন্তু ফাসিদ বিয়ের ক্ষেত্রে তালাক বা সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতেই হবে এবং এতে ব্যভিচারের শাস্তি কার্যকর করা হবেনা। তবে অপরাধের ধরণ ও মাত্রা বিবেচনা করে অন্য কোনো লঘু দণ্ড দেয়া যেতে পারে। [তরমজানুল কুরআন, সেপ্টেম্বর ১৯৭৪]
[ ২ ]
জনৈক বিজ্ঞ আইনজীবীর প্রশ্নের উত্তরে বাতিল বিয়ে ও নিকাহে ফাসিদ সংক্রান্ত শরিয়তের বিধান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও নীতিগত আলোচনা ছাপা হয়েছিল। ফেকাহ শাস্ত্রবিদদের একটি গোষ্ঠি বাতিল বিয়ে ও ফাসিদ বিয়ের মধ্যে যে পার্থক্য করে থাকেন, তা কোন্ মূলনীতির ভিত্তিতে করেন, সেটাই উক্ত আইনজীবী জানতে চেয়েছিলেন। তিনি আরো জানতে চেয়েছিলেন। তিনি আরো জানতে চেয়েছিলেন যে, উভয় ধরণের বিয়ের সংজ্ঞা কি এবং কোনটির কি আইনগত ফলাফল দাঁড়ায়। বাস্তব অবস্থা হলো, যেসব ফকীহ্ নিকাহে বাতিল ও নিকাহে ফাসিদের মধ্যে পার্থক্য করে থাকেন, তারা এ দুটো জিনিসের কোনো পূণাঙ্গ সংজ্ঞা দেননি। এ দুটো পরিভাষার প্রয়োগ এবং তাদের বর্ণিত উদাহরণগুলোতেও যথেষ্ট প্রশস্ততা বিদ্যমান। একই ধরনের বিয়েকে কোথাও বাতিল এবং কোথাও ফাসিদ আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমি কুরআন ও সুন্নাহের উক্তি এবং ফকীহদের মতামত ও ইজতিহারকে সামগ্রিভাবে সামনে রেখে নিকাহে বাতিল ও নিকাহে ফাসিদের আইনানুগ সংজ্ঞা আলাদা আলাদাভাবে নির্ণয়ের চেষ্টা করেছি। অত:পর সেই সংজ্ঞার আলোকে বিভিন্ন ধরণের অশুদ্ধ বিয়েকে এ দুই শ্রেণীতে বিন্যাস্ত করার প্রয়াস পেয়েছি। এ আলোচনার উদ্দেশ্য শুধু এই যে, এই মাসয়ালা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তি দূর হোক এবং আলেম সমাজ প্রস্তাবিত এই সংজ্ঞা, তার প্রয়োগ ও বিন্যাস সম্পর্কে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন যে তা কতোখানি শুদ্ধ ও কার্যোপযোগী। এ কথা সবার জানা যে, আলেম সমাজের মতৈক্য অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতেই স্থির করা যেতে পারে, কোন্ মতটি ফতোয়া তথা বাস্তবায়নযোগ্য এবং তাতে কোনো রদবদল সম্ভব কিনা?
নীতিগতভাবে বিয়ের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ফকীহ ও মুজতাহিদগণের মতামতকে এভাবে বর্ণনা করা যায়, যে বিয়ে সম্পন্ন হতে কোনো শরিয়তসম্মত বাধ্য থাকেনা, তাকে তারা বৈধ ও বিশুদ্ধ বিয়ে মনে করেন। আর বিয়ের জন্য নির্ধারিত শর্তাবলী ও মৌলিক উপাদানের কোনো একটি যে বিয়েতে অনুপস্থিত থাকে, তা ফকীহদের দৃষ্টিতে অবৈধ ও অশুদ্ধ হবে। শেষোক্ত এই অশুদ্ধ ও অবৈধ বিয়ে বিভিন্ন রকমের থাকতে পারে। এসব রকমারি বিশুদ্ধ ও অবৈধ বিয়ের বিশদ বিবরণ দিতে গিয়ে ফকীহগণ, বিশেষত হানাফি ফকীহগণ এর বিবিধ প্রকারের উপর 'বাতিল' ও 'ফাসিদ' এই দুটো পৃথক পরিভাষা প্রয়োগ করেছেন। বাতিল ও ফাসিদের এই প্রভেদকে শরিয়তের আলোকে অনাবশ্যক ও ভিত্তিহীন বলা চলেনা। কারণ বেশ কিছু বিয়ে এমনভাবে সংঘটিত হয়ে যেতে পারে যে, তাকে একেবারে নির্ঘাত বাতিল বলা সম্ভবপর হয়না। আবার সর্বোতভাবে বিশুদ্ধ ও ইপ্সিত মানে উত্তীর্ণও বলার উপায় থাকেনা। তারই অগত্যা সেগুলোকে মধ্যবর্তী স্তরে রেখে বাতিলের পরিবর্তে ফাসিদ তথা ত্রুটিপূর্ণ বা অসম্পর্ণই বলতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, বাতিল বিয়ে ও ফাসিদ বিয়ের কোনো পূর্ণাঙ্গ ও সর্বসম্মত সংজ্ঞা হানাফি ফকীহগণের কাছ থেকেও পাওয়া যায়না। তাদের আলোচনা থেকে কেবল এই ধারণা জন্মে যে, বাতিল বিয়ে বলতে তারা সেই বিয়েকে বুঝিয়েছেন, যা হওয়া না হওয়া সমান কথা, যা আদৌ সম্পন্নই হয়না, এক কথায় যা আদৌ বিয়েই নয়। বাতিল বিয়ে এতো স্পষ্টভাবে অশুদ্ধ ও অচল যে তাকে বাতিল বলে ঘোষণা করতে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার কোনো ঘোষণা দেয়া বা বিচ্ছেদ ঘটানোর প্রয়োজন হয়না। আর ফাসিদ বিয়ে হলো, যার বৈধ না অবৈধ শুদ্ধ হয়েছে কি হয়নি, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে, অথবা যার বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলীর কোনো শর্ত অপূর্ণ বা অনুপস্থিত রয়েছে, অথবা যার বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলীর কোনো শর্ত অপূর্ণ বা অনুপস্থিত রয়েছে, ফলে তা একেবারেই অস্তিত্বহীন নয়, কিন্তু শরিয়তের আলোকে তার বিচ্ছেদ ঘটানো ও ভেঙ্গে দেয়া জরুরি। এতোদসত্ত্বেও আলোচনার বিস্তারিত খুঁটিনাটি পড়ে দেখলে মনে হয়, এই মাসয়ালার বিভিন্ন দিক নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, বিভিন্ন ইবাদতের ক্ষেত্রে যেমস ফাসিদ হওয়া ও বাতিল হওয়া একই অর্থ এবং একই ফলাফল বহন করে, তেমনি বিয়ের ক্ষেত্রেও ফাসিদ বা বাতিলে কোনো পার্থক্য নেই। কেউ কেউ মনে করেন, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে যে বিয়েকে অবৈধ মনে করেন তা 'বাতিল বিয়ে।' আর যে বিয়ের অবৈধতা সম্পর্কে মতভেদ পাওয়া যায় তাই 'ফাসিদ বিয়ে।' কিন্তু হানাফি ফকীহগণ মুসলিম উম্মাহর নিকট সর্বোসম্মতভাবে অবৈধ, এমন কিছু বিয়েকেও 'ফাসিদ' আখ্যায়িত করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বিয়েকে নিছক ইজতিহাদ ও কিয়াসের ভিত্তিতে নয় বরং কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট ও অকাট্য উক্তির ভিত্তিতেই সর্বসম্মতভাবে অবৈধ বলে রায় দেয়া হয়েছে।
এই মাসয়ালাটির অধিকতর জটিলতা সৃষ্টির আরো একটা কারণ হলো, ফকীহগণ যদিও সাধারণভাবে বাতিল ও ফাসিদ শব্দ দু'টিকে সুনির্দিষ্ট ও সীমিত আইনগত পরিভাষা হিসেবে একটিকে অপরটির মোকাবেলায় প্রয়োগ করে থাকেন এবং উভয়টির মধ্যে প্রভেধও নির্দেশ করেন, কিন্তু কখনো কখনো তারা এ দু'টিকে ব্যাপক আভিধানিক অর্থেও ব্যবহার করে থাকেন এবং সে ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নির্দেশ করার অভিপ্রায় থাকেনা। বাতিল বিয়ে শব্দটা হাদিসেও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সেখানেও এটি কোনো নির্দিষ্ট পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, যেমনটি পরবর্তীকালে প্রচলিত হয়ে গেছে। এক হাদিসে রসূল সা. বলেন :
-----------------------------------------------
"যে মহিলা তার অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া বিয়ে করবে, তার বিয়ে বাতিল।"
এ হাদিসের মর্ম যদিও অনেকের নিকট এই যে, এ ধরণের বিয়ে সম্পূর্ণ বাতিল এবং না হওয়ারই সমান, কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো, এখানে বাতিল শব্দটি নির্দিষ্ট ফেকাহ শাস্ত্রীয় পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। বরং কুরআন ও সুন্নাহর সামগ্রিক নীতি নির্দেশনার আলোকে রসূল সা.-এর এই উক্তির মর্মার্থ এটাই দাঁড়ায় যে, এ ধরনের বিয়ে অভিভাবকের সম্মতি দান সাপেক্ষে স্থগিত থাকবে। অভিভাবক অসম্মতি জানালে এবং যুক্তিগ্রাহ্য শরিয়তসম্মত আপত্তি উত্থাপন করলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে।
এই মতভেদ ও জটিলতা নিরসনের জন্যে আমাদের সমগ্র বিষয়টা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বাতিল বিয়ে ও ফাসিদ বিয়ের সংজ্ঞা, বিভিন্ন ধরনের বিয়ের উপর তার প্রয়োগ এবং তার আইনগত ফলাফল নিয়ে ফেকাহ শাস্ত্রে যেসব মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে, শুধু সেগুলোর উপর সর্বোতভাবে নির্ভরশীল হয়ে থাকার পরিবর্তে কুরআন ও হাদিসের স্পষোক্তি এবং ফকীহগণের ইজতিহাদপ্রসূত মতামতের আলোকে গোটা মাসয়ালার বিভিন্ন দিক নিয়ে নতুন করে ভেবে চিন্তে একটা মত স্থির করতে হবে।
এই পর্যায়ে সর্বপ্রথম যে প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে, তা হলো বাতিল বিয়ে ও ফাসিদ বিয়ের সংজ্ঞা কি? প্রথমে বিয়ের আলোচনায় আসা যাক।
বাতিল বিয়ের সংজ্ঞা
কুরআন ও হাদিসের বিয়ে সম্পর্কে যেসব নিয়মনীতি বর্ণিত হয়েছে এবং ফেকাহ শাস্ত্রকারগণ এ বিষয়ে যে বিস্তারিত বিধিমালা প্রণয়ন করেছেন, তার উপর সার্বিকভাবে চিন্তা গবেষণা চালানোর পর বাতির বিয়ের যে সংজ্ঞা অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ ও নির্ভুল বলে মনে হয়, তা হলো : "যে বিয়ে কুরআন ও সুন্নাহর অকাট্য উক্তি এবং মুসলিম ফকীহগণের সর্বসম্মত রায়ে অবৈধ, অশুদ্ধ ও নাজায়েয সাব্যস্ত হবে অথবা যে বিয়েতে বর কনে উভয়ের বা কোনো একজনের সম্মতি নেই এবং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব ও সম্মতির আদান প্রদান হয়নি, সেটাই বাতিল বিয়ে।"
বাতিল বিয়ের উদাহরণ
আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ও সম্মতির আদান প্রদান তথা ইজাব ও কবুল সম্পন্ন না হওয়ার ব্যাপারটা উদাহরণ দিয়ে বুঝানোর অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু অবৈধ ও নিষিদ্ধ, হওয়ার বিষয়টি বুঝার সুবিধার্থে কয়েকটি উদাহরণ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। নিম্নে লক্ষ্য করুন :
১. আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খৃষ্টান মহিলা ছাড়া অন্য সকল অমুসলিম ও পৌত্তলিক নারীকে কোনো মুসলিম পুরুষের পক্ষে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। সূরা বাকারার ২২১ নং আয়াত এবং সূরা মায়েদার ৫ নং আয়াত মিলিয়ে পড়লে এ কথাটা স্পষ্টভাবে জানা যায়। আর উল্লেখিত আয়াত দু'টি এবং সূরা মুমতাহিনার ১০ নং আয়াতের আলোকে মুসলিম নারীর বিয়ে সকল অমুসলিম পুরুষের সাথে নিষিদ্ধ চাই সে আহলে হাদিস কিতাব হোক কিংবা মুশরিক হোক। এই উভয় ধরনের বিয়ে বাতিল হবে।
২. পিতার বিবাহিতা বর্তমান কিংবা সাবেক স্ত্রী, মাতা, কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি, ভাগ্নি, দুধ মা, দুধবোন, শ্বাশুড়ি, স্ত্রীর মেয়ে ও পুত্র বধুকে বিয়ে করা এবং দুই সহোদরকে একত্রে বিয়ের বন্ধনে একত্রিত করা নিষিদ্ধ এবং হারাম। সূরা নিসার ২২ ও ২৩ নং আয়াত এ বিষয়ে স্পষোক্তি রয়েছে। তাই এদের কাউকেও বিয়ে করলে সে বিয়েও বাতিল। জন্মসূত্রে, দুধপান সূত্রে এবং একত্র সমাবেশের যে নিষেধাজ্ঞা এখানে উল্লেখ করা হলো, তন্মধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিষিদ্ধ ব্যক্তির ঊর্দ্ধতন ও অধো:স্তন আত্মীয়গণ এবং নিষেধাজ্ঞার কারণগত সাদৃশ্য বহন করে এমন আরো কিছু সংখ্যক আত্মীয়কে বিয়ে করাও হাদিসে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে এবং সে ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব আত্মীয়তা জানা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে বিয়ে করলে সে বিয়ে বাতিল হবে।
৩. দুই সহোদরকে পর্যায়ক্রমে বিয়ে করে একত্রিত কররে দ্বিতীয় বিয়ে বাতিল হবে এবং এক সাথে বিয়ে করলে উভয় বিয়ে বাতিল হবে।
৪. সূরা নিসার ২৪ নং আয়াতের আলোকে অন্য পুরুষের বিবাহিত স্ত্রীকে বিয়ে করা হারাম বিধায় তা বাতিল বিয়ে। তবে কন্যার প্রথম বিয়ের কথা বরের অজানা থাকলে স্বতন্ত্র কথা।
৫. পূর্ববর্তী বিয়ের ইদ্দত পালনরত মেয়েকে বিয়ে করা দ্বিতীয় পুরুষের পক্ষে হারাম এবং সেই বিয়ে বাতিল বিয়ে হবে, যদি ইদ্দতের কথা বরের জানা থাকে। ভিন্ন পুরুষের বিবাহিতা স্ত্রীকে বিয়ে করা যে কারণে নিষিদ্ধ, এই বিয়েও সেই কারণেই নিষিদ্ধ। কেননা ইদ্দত চলাকালে সাবেক বিয়ের প্রভাব অক্ষুন্ন থাকে। প্রবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে ইদ্দতকালে বিয়ের নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করা হয়েছে:
------------------------------------------------------------
"ইদ্দত পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের সংকল্প দৃঢ় করোনা।" (সূরা আল বাকারা, আয়াত নম্বর ২৩৫)
৬. চার স্ত্রী বর্তমান থাকতে পঞ্চম বিয়ে করা কুরআন ও হাদিসের আলোকে নিষিদ্ধ। সূরা নিসার ৩ নং আয়াত থেকে এ নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত। কেননা সেখানে সর্বোচ্চ চারটি বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ঐ আয়াতে চার সংখ্যাটি যে ঐ সংখ্যার সীমাবদ্ধ করা এবং এর চেয়ে বেশি থেকে নিবৃত করার উদ্দেশ্যেই উল্লেখিত হয়েছে এবং এর চেয়ে বেশি সংখ্যক বিয়ে যে রসূল সা. ব্যতিত আর কোনো মুসলমানের জন্য জায়েয নয়, সে ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা বা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সূরা আযহাবের ৫০ নং আয়াতে সাধারণ মুসলমানদের জন্য চারের মধ্যে বিয়েকে সীমিত রাখা বাধ্যতামূলক উল্লেখ করার সাথেই রসূল সা.-কে এই সংখ্যা সীমার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ জাহেরী মাযহাবে চারের বেশি বিয়ে বৈধ বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ এটা ভুল। ইমাম ইবনে হাযম জাহেরী স্বীয় গ্রন্থ আল মুহল্লার বিয়ে সংক্রান্ত অধ্যায়ে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন :
-----------------------------------------------
"চারটির বেশি বিয়ে করা কারো জন্য হালাল নয়।"
হাদিস থেকেও জানা যায়, এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মুসলমানদের মধ্যে যাদের চারজনের বেশি স্ত্রী ছিলো, রসূল সা. তাদের অবশিষ্ট স্ত্রীদেরকে বিয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে:
"গীলান বিন সালমা সাকাফী যখন মুসলমান হন তখন তার দশজন স্ত্রী ছিলো। রসূল সা. তাকে বললেন : এদের মধ্য থেকে চারজন রেখে দাও।"
অপর এক সাহাবি নওফেল বিন মুয়াবিয়ার পাঁচজন স্ত্রী ছিলো। রসূল সা. তাকে আদেশ দিলেন, ওদের একজনকে ছেড়ে দাও।
কেউ কেউ বলেন, শুধুমাত্র চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ আত্মীয়দের সাথে বিয়ে হলে সেই বিয়েই বাতিল। এছাড়া যাদের সাথে বিয়ে চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ নয়। তাদের সাথে অনুষ্ঠিত বিয়ে ফাসিদ হবে। যেমন এক বোনের মৃত্যু অথবা তালাকের ইদ্দত কেটে যাওয়ার পর তার অন্য বোন নিষিদ্ধ থাকেনা। অনুরূপভাবে চার স্ত্রীর মধ্যে একজন মারা গেলে বা তালাক হয়ে গেলে পঞ্চম স্ত্রী বৈধ হয়ে যায়। এরূপ ক্ষেত্রে বিয়ে নিষেধাজ্ঞা অস্থায়ী বিধায় চার স্ত্রী থাকতে কোনো বিয়ে করলে সে বিয়ে বাতির নয়, ফাসিদ। কিন্তু এ যুক্তি তেমন সবল বলে মনে হয়না। আল্লাহ বা রসূলের আরোপিত কোনো নিষাধাজ্ঞা অস্থায়ী হলেও যতোক্ষণ তা বহাল থাকে এবং বৈধতায় রূপান্তরিত না হয়, ততোক্ষণ তার অবৈধতা স্থায়ী অবৈধতার তুলনায় কম কঠোর নয়। তাই স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ মেয়েদের বিয়ে, দুইবোনের বিয়ে, অন্যের বিবাহিতা বা ইদ্দত পালনরতাকে বিয়ে এবং চার স্ত্রী থাকতে পঞ্চম স্ত্রীকে বিয়ে এ সবই একই পর্যায়ে অবৈধ ও অচল বিয়ে হিসেবেই গণ্য হওয়া উচিত। বরের কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বলতে পারেনা যে, আমার চারটি স্ত্রী আগেই ছিলো কিনা এবং এটা আমার পঞ্চম বিয়ে কিনা, তা আমার জানা ছিলনা।
হানাফিসহ অধিকাংশ ফকীহদের মত, অন্যের ইদ্দত পালনরতাকে জেনে শুনে বিয়ে করলে সে বিয়ে বাতিল। বিশিষ্ট হানাফি ফকীহ ইবনে হুমাম ফাতহুল ক্বাদীরে লিখেছেন, এ ধরনের বিয়ে সর্বসম্মতভাবে বাতিল। ইদ্দত যে একটা অস্থায়ী বাধা এবং তা অচিরেই সরে যেতে বাধ্য, তা সুবিদিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইদ্দতের ভেতরে সাবেক স্বামীর তালাক প্রত্যাহার বা পুন:বিবাহের অধিকার থাকেনা এবং সে কারণে স্ত্রী তার বৈবাহিক বন্ধন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও যদি ইদ্দত পালনরতাকে বিয়ে করলে তা বাতিল হয়, তাহলে অন্যের স্ত্রী, দুইবোনের সমাবেশ অথবা জেনে শুনে পঞ্চম স্ত্রীকে বিয়ে করলে তা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে বাতিল না হয়ে কেবল ফাসিদ হবে কেন?
অনেকে এরূপ যুক্তিও দিয়েছেন যে, শরিয়তসম্মত নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যখন বিয়ে সম্পন্ন হয়, তখন কিছুটা বিয়ের সাদৃশ্য Semblance of marriage সৃষ্টি হয়ে যায়। এ জন্য বিয়ে ফাসিদ হবে, বাতিল হবেনা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেউ যদি সজ্ঞানে চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ আত্মীয়দের বিয়ে করে বসে, তাহলে কোনো সুস্থ রুচি ও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ কি এ কথা মেনে নিতে প্রস্তুত হতে পারে যে, এতে বিয়ের সাদৃশ্য রয়েছে এবং বিয়ে হয়ে গেছে বলে ধারণা জন্মে? ব্যাপাটা শুধু যে রুচি ও বিবেকের উপরই নির্ভরশীল তাও নয়। রসূল সা.-এর আমলে এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছে। এক হতভাগ্য নিজের পিতার বিবাহিতা স্ত্রীকে বিয়ে করেছিল। রসূল সা. তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাদিসটি হলো :
"হযরত বারা ইবনে আযেব বলেন যে, চলার পথে আমার মামার সাথে দেখা হলো। তার হাতে ছিলো একটা পতাকা। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন: আমাকে রসূল সা. পাঠিয়েছেন, এক ব্যক্তি তার পিতার মৃত্যু বা তালাক দেয়ার পরে তার স্ত্রীকে বিয়ে করেছে, তাকে হত্যা করতে ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে।"
এ হাদিসে বিয়ে করা শব্দটার উল্লেখ স্পষ্ট। এ থেকে বুঝা যায়, ঐ লোকটা বিয়ে করার একটা ভেল্কী ঠিকই দেখিয়েছিল। বলা যায়, বিয়ের একটা সাদৃশ্য সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রসূল সা. তার ঐ ভেল্কীর তোয়াক্কা না করে তাকে হত্যা ও তার মালক্রোক করার আদেশ দিয়েছিলেন।
ফাসিদ বিয়ের সংজ্ঞা
উপরে বাতিল বিয়ের যে সংজ্ঞা ও উদাহরণ দেয়া হলো, তাতে বাতিল বিয়ে আসলে কি জিনিস, তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপর নিকাহে ফাসিদের সংজ্ঞার প্রশ্ন আসে। নিকাহে ফাসিদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। তবে তার পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা নিম্নরূপ দেয়া যেতে পারে:
"বিয়ের আকদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব শর্ত নির্ধারিত রয়েছে, তার কোনো একটি যে বিয়েতে অসম্পূর্ণ বা অনুপস্থিত থাকবে, অথবা যে বিয়ে নাজায়েয, নিষিদ্ধ বা হারাম হওয়ার কোনো অকাট্য প্রমাণ কুরআন ও হাদিসে পাওয়া যায়না, অথবা যে বিয়ে বৈধ কি অবৈধ বা সচল কি অচল, তা নিয়ে ফকীহ ও মুজতাহিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, অথবা যে বিয়েতে শরিয়তের দৃষ্টিতে এমন কোনো বাধা রয়েছে, যা বিয়েকে বাতিল প্রতিপন্ন করতে সক্ষম, কিন্তু দুইপক্ষের কোনো একপক্ষ সেই বাধা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় এবং তার অজান্তে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়, সেই বিয়ে ফাসিদ বিয়ে।"
ফাসিদ বিয়ের উদাহরণ
ফাসিদ বিয়ের কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে দেয়া গেলো:
১. বিয়ের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন (ইজাব) এবং বর কর্তৃক তা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ (কবুল) সম্পর্কে দু'জন সাবালক মুসলমান পুরুষ অথবা একজন পুরুষ এ দু'জন স্ত্রীর সাক্ষ্য বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য অপরিহার্য। এই সাক্ষ্য না থাকলে কিংবা অসম্পূর্ণ থাকলে তা ফাসিদ বিয়ে বলে গণ্য হবে।
২. যেসব কারণে বিয়ে বাতিল হয় (অর্থাৎ বিয়ে সম্পন্নই হওয়া হয়না তার কোনো একটি কারণ কোনো বিয়েতে কার্যত উপস্থিত থাকলে এবং বর ও কনে বা তাদের কোনো একজনের সেটা অজানা থাকার দরুন সরল বিশ্বাসে বিয়ে করে বসলে, অজ্ঞতা প্রমাণিত হওয়া সাপেক্ষে বিয়ে বাতিল না হয়ে ফাসিদ হবে। যেমন, তারা জানতে পারেনি যে, তারা বিয়ে অবৈধ হওয়ার মতো আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ, কিংবা স্ত্রী ভিন্ন পুরুষের বিবাহিতা অথবা ইদ্দত পালনরতা, সে কথা বর জানতোনা। এমতাবস্থায় যে বিয়ে হবে তা ফাসিদ বিয়ে হবে।)
৩. সাবেক বিয়ে বহাল বা ইদ্দত চালু থাকা সম্পর্কে ফকীহদের মতভেদ থাকলে দ্বিতীয় বিয়ে হয় বৈধ হবে নচেৎ ফাসিদ হবে। তবে বাতিল হবেনা।
৪. চার স্ত্রী বর্তমান থাকতে পঞ্চম স্ত্রী গ্রহণের বেলায় ক্ষেত্র বিশেষে স্ত্রীর অজ্ঞতার ওজর, গ্রহণযোগ্যতা হতে পারে। তদন্তের পর যদি প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী বরের চার স্ত্রী বিদ্যমান থাকার কথা জানতোনা, তাহলে সে ক্ষেত্রে বিয়ে ফাসিদ হবে।
৫. সুন্নি আলেমগণ সুন্নি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অস্থায়ী বা মেয়াদী বিয়ে সম্পাদিত হলে তাকে ফাসিদ বিয়ে বলে গণ্য করেছেন।
আইনগত ফলাফল
নিকাহে বাতিল ও নিকাহে ফাসিদের সংজ্ঞা ও উদাহরণ দেয়ার পর উভয় ধরনের বিয়ের আইনানুগ ফলাফল কি, সেটা সংক্ষেপে বর্ণনা করছি।
এ কথা শুরুতেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নিকাহে বাতিল ও নিকাহে ফাসিদ উভয়ই শরিয়তের দৃষ্টিতে অশুদ্ধ, অবৈধ ও নিন্দিত। এগুলোর তাৎক্ষণিক বিচ্ছেদ ঘটানো ওয়াজিব। তবে উভয়ের আইনগত ফলাফলে কিছু পার্থক্য রয়েছে এবং তা থাকাও স্বাভাবিক। নিকাহে বাতিলের বিলুপ্তি ঘটাতে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হয়না। তা আপনা থেকেই অচল, নিষ্ক্রীয় ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। স্বামী ও স্ত্রীর অবিলম্বে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য। নচেত, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে হস্তক্ষেপ করে বিচ্ছেদ ঘটতে হবে। এ ধরনের বিয়ের পর সহবাস সংঘটিত হলে তাতে ব্যভিচারের নির্ধারিত দণ্ড প্রযোজ্য হবেনা। তবে অন্য কোনো দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড দিতে হবে, যা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এতে কোনো দেনমোহর দিতে হয়না। ইদ্দতও পালন করতে হয়না। কেননা ইদ্দত শুধুমাত্র বৈধ বিয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যদি দম্পতির মিলনযোগ্য নিভৃত সাক্ষাতকারের পর বিচ্ছেদ ঘটে। বাতিল বিয়েতে সহবাস ব্যভিচার ছাড়া কিছু নয়। ব্যভিচারের কোনো ইদ্দত থাকেনা। তবে মহিলাকে জরায়ু নিষ্কাশিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নিকাহে বাতিলে উত্তরাধিকার নেই এবং সন্তানের সাথে পুরুষের পৈতৃক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়না। পৈতৃক বা প্রজন্মগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল ব্যক্তি বিশেষের বীর্য থেকে সন্তানের জন্মলাভ করাই যথেষ্ট নয়। ইসলাম প্রজন্মগত বা পৈতৃক সম্পর্ক স্বীকৃতি লাভ করে কেবলমাত্র বৈধ বিয়ের পরিণতিতে সন্তান জন্ম নিলে। অন্যথায় উপপত্নীর সন্তানদেরকেও বংশধর বলে স্বীকৃতি দেয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়াতো।
এবার নিকাহে ফাসিদের প্রসঙ্গে আসা যাক। এ বিয়ে একেবারে অচল ও অস্তিত্বহীন নয় বটে। তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা ত্রুটিপূর্ণ, অশুদ্ধ এবং বিচ্ছেদযোগ্য। এ ক্ষেত্রেও স্বামী স্ত্রীর উভয়ের কর্তব্য বিয়ের ত্রুটি ও অশুদ্ধতা জানা মাত্রই আলাদা হয়ে যাওয়া এবং বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার ঘোষণা দেয়া। স্বামী স্ত্রীর প্রত্যেকের অধিকার ও কর্তব্য হলো, যখনই জানতে পারবে যে বিয়ে অশুদ্ধ, তখনই বলে দেবে, আমি বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছি অথবা আমার তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, অথবা আমি তোমাকে তালাক দিয়েছি। এই বিচ্ছেদের ঘোষণা একে অপরের সামনেও করতে পারে, আবার অনুপস্থিতিতেও করতে পারে। যে-ই প্রথম ঘোষণা করবে, তাতেই বিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। দম্পত্তি যদি ইতস্তত করে, তাহলে ইসলামি আদালতের কর্তব্য বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়া। নিকাহে ফাসিদে সহবাস নিষিদ্ধ। সহবাস করলে মারাত্মক গুণাহ হবে। তবে নিকাহে ফাসিদে সহবাস বা সহবাসের উপযোগী নিভৃত সাক্ষাতকার না হওয়া পর্যন্ত শরিয়তের দৃষ্টিতে তার কোনো ফলাফল দেখা যায়না। সহবাস বা নিভৃত সাক্ষাতকার সংঘটিত হলে এবং তারপর বিচ্ছেদ ঘটলে তার নিম্নরূপ ফলাফল দেখা দেবে।
১. তালাকের ইদ্দতের ন্যায় ইদ্দত পালন করতে হবে এবং দম্পত্তির কোনো একজন বা আদালত কর্তৃক বিচ্ছেদ ঘোষণার মুহূর্ত থেকেই ইদ্দত শুরু হয়।
২. নির্ধারিত দেনমোহর ও মোহরে মেসেলের মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত কম, তা দিতে হবে।
৩. সন্তানাদি জন্ম নিলে বংশীয় ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে। সন্তান জন্মদাতার বৈধ সন্তান বলে গণ্য হবে এবং তার উত্তরাধিকারী হবে। [তরজমানুল কুরআন)
বিষয়: বিবিধ
১৩২৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন