দূর্নীতি কে করেছে আর তার দায় কার ঘাড়ে পড়েছে?
লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ১২ মার্চ, ২০১৬, ০৭:৪৭:৫৮ সন্ধ্যা
দূর্নীতির দায় কার? সরকারের না আমলাদের? নাকি জনগণের? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়শই হই নিজে নিজে। আজ একটা প্রমাণাদি হাতে পেলাম যেখান থেকে কিছুটা হলেও পরিষ্কার হওয়া যায় দূর্নীতির দায় আসলে কাদের, কিভাবে দূর্নীতি হয় তৃণমূল থেকে।
ছবিটি ভালো করে দেখুন। প্রথমে দেখুন সবুজ ঘরের নিচে বাদামী রঙ করা ঘরটি। সেখানে স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে ২৮/০৫/১৪ তারিখে পরিশোধিত বিলের পরিমান ৭৫২ টাকা। প্রতিমাসের বিদ্যুৎ বিল এরকমই আসে, অর্থাৎ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যেই। এবার চলে যান সবুজ ঘরের উপরের লাল রঙ করা ঘরটিতে। প্রিভিয়াস ডেইট ০১/০৫/১৪ তারিখে রিডিং ছিলো ৪০৯৫ আর প্রেজেন্ট ডেইট ৩১/০৫/১৪ তারিখে রিডিং ছিলো ৫০৬০, অর্থাৎ ৩১ দিনে ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ ৯৬৫ ইউনিট! বিশ্বাস হয় একটি বাসাবাড়িতে ৯৬৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হতে পারে? যেই বাসার বিদ্যুৎ বিল আসবার কথা ৬০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে সেখানে যদি ৭৬৬৮.৪৫ টাকা আসে তখন নিশ্চয়ই কেউ হাসতে হাসতে বিল পরিশোধ করতে যাবে না।
তো গেলাম বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রে, মনে মনে আগে থেকে প্রস্তুতি ছিলো কি হতে পারে সরকারী অফিসে। তাও আবার বিদ্যুৎ বিলের অভিযোগ জানাতে যাচ্ছি, ভোগান্তি নিশ্চয়ই কোন অংশে কম হবে না এটা মাথায় নিয়েই পৌঁছালাম বিদ্যুৎ অফিসে। ঢুকতেই দেখি চেয়ারে মহারাজ (পিয়ন/দারোয়ান/কামলা টাইপ) গা এলিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছেন চেয়ারে, পা দুটো চেগিয়ে। তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম অভিযোগ কেন্দ্র কোথায়? মহারাজ হাতের ইশারায় কোণার রুম দেখিয়ে বললেন, কিন্তু উনি তো নাই! উনিটা কে সেটা আর জানতে ইচ্ছা হলো না, রুম জানতে পেরেছি তাই মহারাজকে আর বিরক্ত না করেই রুমের দিকে আগালাম। ভালো করেই জানি সরকারী অফিসের আমলা/কামলারা অনেক মূল্যবান, তার চাইতেও মূল্যবান তাদের সময়। মূল্যবান সময়ের জন্যেও মূল্য দিতে হয়, কিন্তু কি করব বলেন, দিনে এনে দিনে খাই লোক, তাই মহারাজদের (আমলা/কামলা) মূল্যবান সময় কিনে নিতে পারি না। যাই হোক, রুমে ঢুকেই দেখি একটা টেবিলের এপারের বেঞ্চিতে ঠ্যাং তুলে আবার আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছেন আরো কিছু রাজপুরুষ আর ওপারে মূল সিটটি একা একা পড়ে রয়েছে আর তার পাশের সিটে একজন বসে চোখ বন্ধ করে মনে মনে কাউকে স্মরণ করছিলেন। ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলাম উনি কই? বেঞ্চিতে বসা মহারাজেরা মনে হয় মনোকষ্ট পেয়েছেন, নেতা গোছের দুইজন বলে উঠলো এতোজন বসে আছি আপনার কারে দরকার?
তখন তাদের দেখালাম বিলের কপিটা আর বললাম এই মাসের বিল এসেছে তাই অভিযোগ জানাতে আসলাম। কপিটা দেখে একজন বললেন দুই তলায় অমুক সাহেবের কাছে যান, আরেকজন বলে উঠলেন, না না দুইতলায় না নিচের ঐপাশের রুমে যান। কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম নিচের ঐরুমের দিকে, আগেই বলেছি দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ আমি, এসব রাজা-মহারাজাদের মূল্যবান সময় কিনে তাদের উপভোগ করার সামর্থ্য নেই। নিচের ঐদিকে রুমে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন তিন তলায় তমুক সাহেবের কাছে যেতে। উঠলাম সিঁড়ি মাড়িয়ে তিন তলায়, সারি সারি টেবিল আর চেয়ার খালি পড়ে আছে। এই খালি চেয়ার-টেবিল দেখে মনে পড়ে গেলো দেশে কতো পাশ দেওয়া ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় একটা চাকরীর জন্য হা পিত্যেশ করছে, খেয়ে না খেয়ে চাকুরী নামক সোনার হরিণটির পিছনে ছুটছে। আর এখানে সারি সারি টেবিল-চেয়ার পড়ে আছে, তমুক সাহেবের টেবিলের সামনে গিয়ে দেখলাম তিনজন মহিলা প্রজা; আমার মতনই আর্জি নিয়ে এসেছেন ২০০ টাকা বাড়তি বিল আসাতে। তাদের অভিযোগ একমাসা তারা বাড়িতেই ছিলেন না, অথচ বিল এসেছে প্রতিমাসে যেরকম আসে সেরকম!!! মনে মনে বললাম ঘরে একটা দোয়া দরূদ পড়ালে জ্বীন, ভূত গুলো চলে যেতো, ফলে বাড়িতে না থাকলে তখন আর কেউই বিদ্যুৎ ব্যবহার করতো না। কিন্তু তমুক সাহেবের কথা হলো সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়াইছে, এখন একটু বেশি বিল আসবেই। ভাবখানা এমন যেন ব্যবহার করলেও আসবে; না করলেও আসবে। উনি আর তাদের কথা না শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার সমস্যা কি? আমি তমুক সাহেবকে দেখালাম আমার সমস্যা কোথায়। উনি বিলের কাগজ হাতে নিয়ে বললেন আজকের রিডিংটা কতো? আমি আশেপাশে খুঁজতে থাকলাম মিটার রিডার কাউকে পাই কিনা দেখার জন্য, না পেয়ে বললাম স্যার জানিনা তো। উনি বললেন আগে আজকের রিডিংটা নিয়ে আসেন এরপর বুঝা যাবে সমস্যা কই! বুঝেনই তো ডিজিটাল যুগের পোলাপাইন তাই বাসাবাড়িতে কল দিয়ে বললাম নিচে নেমে মিটারের রিডিং জানাতে। কিছুটা অবসর পেয়ে ঘাড় ঘুরাতেই দেখি নানা রঙের, বাহারের বোতল সাদা সাদা, স্বচ্ছ্ব, সবুজ কি সোন্দর সেইসকল পেট মোটা গলা চিকন বোতলগুলা। দুই একটা বোতলের তলায় কিছু রঙ্গিন পানি পইড়া থাকতেও দেখি, নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপনে এগুলোকে মদের বোতল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। বোতলের গায়ে লেগে থাকা স্টিকার দেখে জিভে জল চলে আসে, আহহহহ স্কচ!!! কিন্তু হতচ্ছাড়া মোবাইল বেজে উঠলো, তাই আর ঐদিকে না তাকিয়ে তমুক সাহেবের নিকটে গেলাম। আমরা মূর্খ জনগণ, কিভাবে বুঝবো ডিজিটাল মিটারে রিডিং কেমনে নেয়!!! তমুক সাহেবের দিক নির্দেশনা মোতাবেক রিডিং নিলাম মিটারের। ২৬ জুন ২০১৪ তারিখে মিটারের রিডিং হচ্ছে ৫০৩৫.৩৬, তমুক সাহেব সেটা নিজের হাতে লিখলেন বিলের কাগজে। উপরে গোল করে লাল রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে অংশটুকু।
এবার একটু চৌকোনা লাল রঙ করা ঘরটিতে দেখুন প্রেজেন্ট ডেইট ৩১ মে ২০১৪ তে নেয়া রিডিং ছিলো ৫০৬০। দু'টোর ফারাক দেখে মনে মনে আবারো ভাবলাম বাড়িওয়ালাকে জানাতে হবে যাতে বিল্ডিং-এ একটা দোয়া-দরূদ বা মিলাদের ব্যবস্থা করেন, এর ফলে বিল্ডিং এর জ্বিন-ভুতগুলো দূর হবে। এরপর তমুক সাহেব কথা ছাড়াই ৫০% বিল কমিয়ে দিয়ে বিলের পরিমাণ ৩৮০০ টাকা করে দিলেন। রাজা-মহারাজাদের ক্ষমতাই এমন, কলমের খোঁচায় যেকোন কিছু পরিবর্তন করে দিতে পারেন তাহারা নিমিষেই।
নীল রঙের দেয়া ঘরটিতেই কলমের খোঁচায় বিল কমিয়ে দেয়া।
কিন্তু জানেনই তো গরীব প্রজা, দিনে আনি দিনে খাই, তাই ৫০% কমানোটাও পোষাচ্ছে না দেখে মহারাজকে প্রশ্ন করলাম, স্যার ৩১ মে'তে যেই রিডিং নিয়েছে সেইটা তো ২৬ জুনেও এসে হয় নাই তো আমি কেন এই পরিমাণ বিল পরিশোধ করবো? তিনি জানালেন মিটার চেইঞ্জ হইছে ঐটার বিল সহ এড কৈরা দেয়া হইছে, আপনি এখন এইটা নিয়া দুই তলায় অমুক সাহেবের কাছে যান। জানেনই তো গরীব মানুষ দিনে আনি দিনে খাই, তাই ট্যাকা দিয়া কিনতে পারি না রাজা-মহারাজাদের থুক্কু তাদের সময় কিনতে পারি না। তাদের সময় অনেক মূল্যবান, তাই কথা না বাড়িয়ে গেলাম দুই তলায় অমুক সাহেবের কাছে, যাওয়ার সময় আবারো খালি পড়ে থাকা টেবিল-চেয়ারের দিকে তাকালাম। শেষবারের মতন তাকালাম পড়ে থাকা এক গাদা (কম করে হলেও ১৫ টা) নানা কিসিমের বড় বড় বোতলগুলোর দিকে আর ছ্যাবের সাথে একটা ঢোক গিলে নামলাম দুই তলায় অমুক সাহেবের কাছে যাওয়ার জন্য। একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিলো অমুক সাহেবের রুমখানা। ছোট্টরুমে অমুক সাহেব বসে আছেন কোন এক কোম্পানীর বকেয়া বিলের ফাইল নিয়ে। ঐ কোম্পানীর একজন প্রতিনিধিকেও দেখলাম বেশ উৎফুল্ল মেজাজে আছেন কাল্পনিক এক বোতল বডি মাসাজ অয়েল নিয়ে। তাদের দেন-দরবার ততক্ষণে শেষ প্রায়, কি একটা ফাইল আনলেই কাজটা হয়ে যাবে এমন আশ্বাস নিয়ে বিশ্বাসের সাথে ঐ কোম্পানীর লোকটি বের হয়ে পড়েন। এবার আমি তুলে ধরলাম অমুক সাহেবের কাছে আমার আনা আর্জিটুকু। উনি হাতে নিয়ে বললেন তমুক সাহেবের কাছে যেতে, তাকে জানালাম তমুক সাহেবের কাছ থেকে হয়েই এসেছি স্যার। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে ধুপধাপ করে দুটি সিল মেরে উনার মূল্যবান দুটি অটোগ্রাফ দিয়ে বিলের কাগজটি দিয়ে দিলেন। তাকে বললাম স্যার বিলের পরিমাণ অনেক বেশি, এতোটা বিল আসে না। আপনি একটু দেখুন বিগত মাসে বিলের পরিমাণটুকু। তিনি বললেন সেটা তমুক সাহেবকে গিয়ে বলুন, উনি ব্যাপারগুলো দেখেন। মনে মনে বললাম তমুক সাহেবের কাছ থেকে এসেছি কথাটা বোধহয় আপনার কর্ণে পৌঁছায় নি, বড়লোকের কান, রাজা-মহারাজার কান তাতে কি আর ইতর, গরীব, মূর্খদের কথা পৌঁছায়? তাকে আবারো বললাম, স্যার বিল তো আমি মোবাইল ফোনে দেই তো এবার কিভাবে দেবো? উনি বললেন ব্যাংকে গিয়ে দিতে হবে। বিনামূল্যে কিছুটা প্রাপ্তির সুখ নিয়ে বের হয়ে এলাম বিদ্যুৎ অফিস থেকে।
এবার আপনারাই বলুন দূর্নীতির শুরুটা আসলে কে করেছে, সেই দূর্নীতিতে কারা ভাগ বসাতে চেয়েছে আর তার দায় কার ঘাড়ে পড়েছে?
বিষয়: রাজনীতি
১২৪৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
একগুলো সাহেব পার হলেন, আপনার কপাল ভাল কোন বোতলে জন্য ডোনেশন দিতে হয়নি৷ ধন্যবাদ৷
২০০ কোটি টাকা অর্থায়ন করলে ২০ বছর পর দেখা যায় যে সুদ-আসলের বাইরেও তারা আরও ৫০% নিয়ে ফেলেছে ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন