হাকীম ইবন হাযাম রা:
লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:২৪:২০ রাত
নাম হাকীম, ডাক নাম আবু খালিদ। পিতা হাযাম ইবনে খুওয়াইলিদ, মাতা যয়নাব মতান্তরে সাফিয়্যা। হাকীম নিজেই বলছেন: আমি ‘আমুল ফীল’ (হস্তী বৎসর) অর্থাত আবরাহার কাবা আক্রমণের তের বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করি। ওয়াকিদী বলেন: হাকীমের জন্ম রাসূলুল্লাহর সা: জন্মের পাঁচ বছর পূর্বে। তার পিতা হাযাম ফিজার যুদ্ধে মারা যায়। তিনি নিজেও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুবাইর ইবন বাকার বলেন: হাকীম কাবার অভ্যন্তরে জন্ম গ্রহণ করেন। (আল ইসাবা-১/৩৪৯)।
ইতিহাস বলছে, তিনি আরবের একমাত্র সন্তান যে কাবার অভ্যন্তরে ভূমিষ্ট হয়েছে। তার মা কয়েকজন বান্ধবী সহ কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। সেদিন কোন এক বিশেষ উপলক্ষ্যে কাবার দরযা খোলা ছিল। সে সময় তার মা ছিলেন গর্ভবতী। আল্লাহর ইচ্ছায় সেখানে তার প্রসব বেদনা ওঠে, তিনি বের হওয়ার সময় পেলেন না। একটি চামড়া বিছিয়ে দেওয়া হলো। তিনি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। তার নাম রাখা হয় হাকীম ইবন হাযাম। উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ তার ফুফু।
হাকীম মক্কার এক সম্পদশালী অভিজাত পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন অতিশয় ভদ্র ও বুদ্ধিমান। কুরাইশরা তাকে নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়। জাহিলী যুগে আরবে যারা মক্কায় আগত হাজীদের দেখাশুনা করতো, আহার করাতো, তাদের বলা হতো ‘মুতয়িম’ অর্থাত যে আহার করায়- হাকীমও ছিলেন মক্কার এক অন্যতম ‘মুতয়িম’। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৬৪-৬৫)।
জাহিলী যুগে যারা আল্লাহর ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কায় এসে দূর্দশায় পড়তো তিনি নিজের অর্থ দিয়ে তাদের সাহায্য করতেন। নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে ছিলেন রাসুলুল্লাহ সা: অন্তরঙ্গ বন্ধু। বয়সে রাসুলুল্লাহর সা: বড় হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহকে ভালোবাসতেন, তার সাহচর্যকে মূল্যবান মনে করতেন। অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহও তাকে ভালোবাসতেন এবং তাকে সঙ্গ দিতেন।
অত:পর হযরত খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদের সাথে রাসুলুল্লাহর সা: বিয়ে এবং রাসুলুল্লাহর সা: সাথে হাকীমের আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে তাদের পুরাতন সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। তবে খুব বিস্ময়ের ব্যাপার যে, দুজনের মধ্যে এত গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মক্কা বিজয়ের পূর্ব দিন পর্যন্ত তিনি রাসুলুল্লাহর সা: ওপর ঈমান আনেননি। তিনি যখন ঈমান আনেন তখন রাসূলুল্লাহ সা: এর নবুওয়াতের বিশটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।
আল্লাহ তাআলা হাকীমকে যে জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও রাসুলুল্লাহর সা: আত্মীয়তা দান করেন তাতে এটাই সঙ্গত ছিল যে, তিনিই সর্ব প্রথম তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ঈমান আনবেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তা হয়নি। এ ব্যাপারে আমরা যেমন বিস্মিত হই, তেমনি নিজেও নিজের আচরণে বিস্মিত হয়েছেন। ইসলাম গ্রহণেরপর আমরণ তিনি তার বিগত জীবনের কার্যকলাপের জন অনুশোচনায় দগ্ধিভূত হয়েছেন। ইসলাম গ্রহণের পর তার পুত্র একদিন তাকে দেখলেন, তিনি বসে বসে কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করলেন:
আব্বা, কাঁদছেন কেন?
বেটা আমার কান্নার কারণ অনেকগুলি।
প্রথমত আমি বিলম্বে ইসলাম গ্রহণ করেছি। ফলে বহু বড় বড় নেক কাজ থেকে পিছিয়ে পড়েছি। এখন যদি সমগ্র পৃথিবীর সমপরিমাণ স্বর্ণও আমি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করি তবুও আমি তার সমকক্ষতা অর্জন করতে পারবো না।
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ আমাকে বদর ও উহুদে প্রাণে বাঁচান। তখন আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, আমি আর কক্ষনও রাসুলুল্লাহর সা: বিরুদ্ধে কুরাইশদের সাহায্য করব না এবং মক্কা থেকেও আর বের হব না। কিন্তু তার পরই আবার কুরাইশদের সাহায্য করার দু:সাহস দেখিয়েছি।
তৃতীয়ত: যখনই আমি ইসলাম গ্রহণের কথা ভেবেছি তখনই বয়স্ক সম্মানিত কুরাইশ নেতাদের প্রতি লক্ষ্য করেছি। তারা তাদের জাহিলী আচার আচরণ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে। আমিও তাদের অনুসরণ করেছি। আফসুস! আমি যদি তাদের অনুসরণ না করতাম! বাপ দাদা ও নেতৃবৃন্দের অনুসরণই আমাকে ধ্বংস করেছে। বেটা, এখন আমি কেন কাঁদবো না?
হাকীমের এত বিলম্বে ইসলাম গ্রহণে যেমন আমরা এবং তিনি নিজেও বিস্মিত হয়েছেন, তেমনি খোদ রাসুলুল্লাহও সা: কম বিস্মিত হনি। তার মত অন্যান্য বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা দ্রুত ইসলামে শামিল হোক রাসূল সা: এটাই কামনা করতেন।
মক্কা বিজয়ের পূর্বরাত্রি রাসূল সা: সাহাবীদের বললেন, মক্কার চার ব্যক্তির মুশরিক থাকা আমি পছন্দ করিনি। তারা ইসলাম গ্রহণ করুক এটাই আমি কামনা করেছি।
প্রশ্ন করা হলো, তারা কে কে? বললেন, আত্তাব ইবন উসাইদ, জুবাইর ইবন মুতয়িম, হাকীম ইবন হাযাম ও সুহাইল ইবন আমর॥ আল্লাহর অনুগ্রহে তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ সা: যখন তার সংগী সাথী সহ মক্কার শিয়াবে আবী তালীবে অবরুদ্ধ তখন মুশরিক বা পৌত্তলিক থাকা সত্ত্বেও হাকীম তার ফুফু খাদীজাকে গোপনে খাদ্য সামগ্রী পাঠাতেন। একদিন গম নিয়ে যেতে নরাধম আবু জাহলের নজরে পড়ে যান। আবু জাহল বাধা দেয়। আবুল বাখতারী ইবন হিশাম কাছেই ছিল। সে এগিয়ে এসে আবু জাহলকে বলে: সে তার ফুফুর জন্য সামান্য কিছু খাদ্য পাঠাচ্ছে। তুমি তাতে বাধা দিচ্ছ? শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বেশ মারপিট হয়। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩৫৩-৩৫৪)।
কুরাইশদের প্রতিরোধ সত্ত্বেও যখন মক্কার ভেতরে ও বাইরে রাসূলের সা: সাহায্যকারীর সংখ্যা বেড়ে গেল তখন কুরাইশরা বেশি বিচলিত হয়ে পড়লো। তারা রাসুলুল্লাহর সা: ব্যাপারে একটি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মক্কার ‘দারুন নাদওয়া’ গৃহে সমবেত হলো। এ বৈঠকে অন্যান্য কুরাইশ নেতৃবন্দের সাথে হাকীমও উপস্থিত ছিলেন। একজন নাজদী বৃদ্ধের বেশে ইবলিসও এ বৈঠকে উপস্থিত ছিল। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৮০-৮১)।
কুরাইশরা বদরে অবতরণের পর তাদের কিছু লোক রাসুলুল্লাহর সা: কূপ থেকে পানি পান করার জন্য এগিয়ে এলো। তাদের মধ্যে হাকীমও ছিলেন। রাসূল সা: তাদের পানি পানে বাধা দিতে নিষেধ করলেন। যারা সেই পানি পান করেছে, একমাত্র হাকীম ছাড়া তাদের সকলে বদরে নিহত হয়েছিল। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/ ৬২২)।
কুরাইশরা বদরে শিবির স্থাপনের পর উমাইর ইবন ওয়াহাবকে পাঠালো মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা নিরূপণের জন্য। উমাইর মুসলিম শিবিরের আশেপাশে ঘুরে এসে বললেন: তারা তিনশো বা তার কিছু কম বা বেশি হতে পারে। উমাইর কুরাইশদের যুদ্ধে অবতীর্ণ না হওয়ার জন্য মত প্রকাশ করেন। তার কথা শুনে হাকীম ইবন হাযাম জনতার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উতবা ইবন রাবীয়ার কাছে এসে বললেন: আবুল ওয়ালীদ! তুমি কুরাইশদের নেতা ও সরদার। তুমি কুরাইশদের মান্যগণ্য ব্যক্তি। চিরদিন তাদের মধ্যে তোমার সুকীর্তি স্মরণ করা হোক তা কি তুমি চাও না? উতবা বললো: হাকীম, এ কথা কেন? হাকীম বললেন: তুমি লোকদের মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। উতবা হাকীমকে আবু জাহলের নিকট পাঠায়। হাকীম বলেন, আমি আবু জাহলের কাছে গিয়ে দেখলাম সে তার ঢালে তেল লাগাচ্ছে। আমি বললাম: আবুল হাকাম! আমাকে উতবা তোমার নিকট এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছে। আবু জাহল বললো: আল্লাহর কসম! সে মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের দেখে কাপুরুষ হয়ে গেছে।
মুহাম্মাদ ও আমাদের মধ্যে আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরবো না। আর উতবা তো এমন কথা বলবেই। তার ছেলে তো রয়েছে তাদের সাথে। এ জন্য সে তোমাদের ভয় দিচ্ছে। এভাবে হাকীম ও উতবা সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য যে চেষ্ঠা করেছিলেন, আবু জাহলের গোয়ার্তুমীতে তা ভন্ডুল হয়ে যায়। আল্লাহর ইচ্ছায় বদরের প্রথম শিকার আবু জাহল। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬২২-২৪)।
বদরের পরাজয় সম্পর্কে হাকীম পরবর্তীকালে বর্ণনা করেছেন: আমরা একটি শব্দ শুনতে পেলাম, যেন আকাশ থেকে মাটিতে এসে পড়লো। শব্দটি ছিল একটি থালার ওপর পাথর পড়ার মত। রাসুলুল্লাহ সা: সেই পাথরটি নিক্ষেপ করেছিলেন। আমরা পরাজিত হয়েছিলাম। (হায়াতুস সাহাবা-৩/৫৫০)।
মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ সা: ‘মাররাজ জাহরান’ পৌঁছে শিবির স্থাপন করেছেন। কুরাইশদের পক্ষ থেকে গোপনে খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আবু সুফাইয়ান ইবন হারব, হাকীম ইবন হাযাম ও বুদাইল ইবন ওয়ারকা মক্কা থেকে বের হন। মক্কার অদূরে ‘আরাক’ নামক স্থানে পৌঁছে তারা উট, ঘোড়া ও মানুষের শোরগোল শুনতে পান। তারা আরও এগিয়ে রাতের অন্ধকারে এক সময় মুসলিম এলাকায় ঢুকে পড়েন। মুসলিম প্রহরীরা তাদের ধরে ফেলে। আবু সুফইয়ানের ঘাড়ে উমার রা: কয়েকটি ঘুষি বসিয়ে দেন। আবু সুফইয়ান ভয়ে চেঁচিয়ে আব্বাসের সাহায্য কামনা করেন। আব্বাস ছুটে এসে তাঁকে উমারের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এদিকে হাকীম ও বুদাইলকে বন্দী করে রাসুলুল্লাহর সা: নিকট উপস্থিত করা হলে তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু সুফইয়ানও ইসলাম গ্রহণ করেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৬৩, ১৭০-৭২, সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪০০)।
মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ সা: বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করছেন। তিনি হাকীম ইবন হাযামকে সম্মান প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন। তিনি এক ঘোষণা দানের নির্দেশ দেন:
১. আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তার কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দাহ ও রাসূল- যারা এ সাক্ষ্য দিবে তারা নিরাপদ।
২. যে ব্যক্তি অস্ত্র ফেলে কাবার চত্বরে বসে পড়বে সে নিরাপদ।
৩. যারা নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে তারা নিরাপদ।
৪. যে আবু সুফইয়ানের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে সে নিরাপদ।
৫. যে হাকীম ইবন হাযামের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে সেও নিরাপদ।
হাকীম ইবন হাযামের বাড়ীটি ছিল মক্কার নিম্ন ভূমিতে এবং আবু সুফইয়ানের বাড়ীটি উচ্চ ভূমিতে।
হাকীম ইবন হাযাম অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন যে, ইসলাম পূর্ব জীবনে ইসলাম ও রাসূলের সা: শত্রুতায় যে ভূমিকা ও যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন ঠিক তেমন ভূমিকা ও সেই পরিমাণ অর্থ তিনি ইসলামী জীবনে পালন ও ব্যয় করবেন।
মক্কার ‘দারুন নদওয়া’ ছিল একটি বাড়ী। কুরাইশরা সেখানে সমবেত হয়ে পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। কুরাইশ বংশের উর্ধ্বতন পুরুষ কুসাঈ এ বাড়ীটি নির্মাণ করে। হাত বদল হয়ে ইসলাম পূর্ব যুগে হাকীম বাড়ীটির মালিক হন। ইসলাম গ্রহণের পর মুআবিয়ার খিলাফতকালে তিনি বাড়ীটি এক লাখ দিরহামে বিক্রি করেন। মুআবিয়া তাকে তিরস্কার করে বলেন: তুমি বাপ দাদার মর্যাদা ও কৌলিন্য বিক্রি করে দিলে? হাকীম বললেন: এক তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি ছাড়া সব সম্মান, সব কৌলিন্য বিলীন হয়ে গেছে। জাহিলী যুগে একপাত্র মদের বিনিময়ে বাড়ীটি আমি কিনেছিলাম। আর আজ এক লাখ দিরহামে বিক্রি করলাম। তোমাকে আরও জানাচ্ছি, এ অর্থের সবই আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় হবে। সুতরাং ক্ষতিটি কোথায়? (সীরাতু ইবন হিশাম-১/১২৫)
ইসলাম গ্রহণের পর হাকীম ইবন হাযাম একবার হজ্জ আদায় করলেন। মূল্যবান কাপড়ে সজ্জিত উত্তম জাতের একশো উট তার আগে আগে হাকিয়ে নিয়ে গেলেন। সবগুলিই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কুরবানী করলেন।
আর একবার তিনি হজ্জ করলেন। যখন তিনি আরাফাতে অবস্থান করছেন তখন তার সাথে একশো দাস। প্রত্যেকের কন্ঠে একটি করে রূপোর প্লেট ঝুলছে, আর তাতে লেখা আছে: হাকীম ইবন হাযামের পক্ষ থেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মুক্তিপ্রাপ্ত দাস। তাদের সকলকে তিনি মুক্তি দেন। অন্য একটি হজ্জে তিনি এক হাজার ছাগল বকরী সংগে নিয়ে যান। সবগুলি মিনায় কুরবানী করেন এবং সেই গোশত দিয়ে মুসলমান গরীব মিসকীনদের আহার করান।
হুনাইন যুদ্ধের পর হাকীম ইবন হাযাম রাসুল সা: এর নিকট গণীমতের সম্পদ থেকে চাইলেন। রাসূল সা: তাকে কিছু দান করলেন। তিনি আবার চাইলেন। রাসূল সা: তাকে আবারও দান করলেন। এভাবে সেদিন তিনি একাই একশো উট লাভ করলেন। তখন তিনি নওমুসলিম। (সীরাতু ইবন হিশাম-২৪৯৩)।
অত:পর রাসূল সা: তাকে লক্ষ্য করে বলেন:
‘ওহে হাকীম, এই সম্পদ অতি মিষ্টি ও অতি প্রিয়। যে ব্যক্তি আত্মতৃপ্তির সাথে গ্রহণ করে তাতে বরকত দেওয়া হয়। আর যে তা লোভাতুর অবস্থায় গ্রহণ করে তাতে বরকত দেওয়া হয়না। সে ঐ ব্যক্তির মত যে আহার করে; কিন্তু পরিতৃপ্ত হয় না। আর উপরের হাতটি নীচের হাত অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর। অর্থাত দাতা হাতটি গ্রহীতা হাত অপেক্ষা উত্তম।’
রাসুলুল্লাহ সা: মুখে এ বাণী শুনে হাকীম বললেন: ইয়া রাসুলাল্লাহ সা:, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন সেই সত্তার নামে শপথ, আজকের পর জীবনে আর কোন দিন কারও কাছে কিছুই চাইব না। কারও কাছ থেকে কিছুই গ্রহণ করবো না।’ হাকীম তার শপথ যথাযথভাবে পালন করেন।
হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে ‘বাইতুল মাল’ থেকে হাকীমের ভাতা গ্রহণের জন্য খলীফা তাকে একাধিকবার আহবান জানান। হাকীম বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেন। হযরত উমার রা: খলীফা হলেন। তিনিও বার বার হাকীমকে আহবান জানাতে লাগলেন তার অংশ গ্রহণের জন্য। শেষ পর্যন্ত হযরত উমার রা: জনগণকে সাক্ষী রেখে বললেন: ওহে মুসলিম জনমন্ডলী! তোমরা শুনে রাখ, আমি হাকীমকে তার অংশ গ্রহণের আহবান জানিয়েছি, আর সে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। এভাবে হাকীম আমরণ আর কারও কাছে হাত পেতে আর কিছুই গ্রহণ করেননি। উমার রা: প্রায়ই বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমাকে স্বাক্ষী রেখে বলছি, আমি হাকীমকে তার অংশ গ্রহণের জন্য ডেকেছি, কিন্তু সে প্রত্যাখ্যান করেছে। (হায়াতুস সাহাবা-২/২৫০-৫১)।
একবার হাকীম ইবন হাযাম মুশরিক অর্থাত পৌত্তলিক অবস্থায় ইয়ামনে যান। সেখান থেকে ইয়ামনের ‘যু-ইয়াযন’ রাজার একটি চাদর খরীদ করে মদীনায় গিয়ে রাসুলুল্লাহকে সা: কে উপহার দেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সা: তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমি মুশরিকের কোন হাদিয়া গ্রহণ করিনে।’ হাকীম চাদরটি বিক্রি করলে রাসূল সা: তা ক্রয় করেন এবং গায়ে দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন। হাকীম বলেন, এই পোশাকে এত সুন্দর আর কাউকে আমি আর কক্ষনও দেখিনি। রাসুলুল্লাহকে সা: যেন পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্রের মত দেখাচ্ছিল। অচেতনভাবে তখন আমার মুখ থেকে রাসূলুল্লাহর সা: প্রশংসায় একটি কবিতা বেরিয়ে আসে। (হায়াতুস সাহাবা-২/২৪৩-৪৪)।
একবার রাসূলুল্লাহ সা: কুরবানীর ছাগল ক্রয়ের জন্য একটি দীনার দিয়ে হাকীমকে বাজারে পাঠালেন। তিনি বাজারে এক দীনারে একটি ছাগল ক্রয় করে আবার তা দুই দীনারে বিক্রি করেন। অত:পর এক দীনার দিয়ে একটি ছাগল ক্রয় করে অন্য দীনারটি সহ রাসুলুল্লাহর সা: নিকট হাজির হলেন। রাসুল সা: তার রিযিকের বরকতের জন্য দুআ করলেন এবং লাভের দীনারটি সাদকা করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। (হায়াতুস সাহাবা-৩/৩৪৫)
হযরত হাকীমের মৃত্যুসন সম্পর্কে মতভেদ আছে। ইমাম বুখারী তার ‘তারিখে’ উল্লেখ করেছেন, তিনি হিজরী ৬০ (ষাট) সনে একশো বিশ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। তবে উরওয়ার মতে তিনি খলীফা হযরত মুআবিয়ার রা: খিলাফতের দশম বছরে মৃত্যুবরণ করেন।
নাওফিল ইবন হারেস রা:
নাম নাওফিল, কুনিয়াত বা ডাক নাম আবু হারেস। পিতা হারেস ইবন আবদিল মুত্তালিব, মাতা গাযিয়্যা। কুরাইশ বংশের হাশেমী শাখার সন্তান। রাসূলুল্লাহর সা: চাচাতো ভাই।
রাসুলুল্লাহ সা: দাওয়াতী কাজ শুরু করতেই নিকটতম আত্মীয়রাও তার শত্রু হয়ে যায় এবং বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগে যায়। তবে নাওফিলের অন্তরে সব সময় ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান ছিল। এ কারণে পৌত্তলিক থাকা অবস্থায়ও তিনি রাসুল সা: এর বিরোধিতা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি। মক্কার মুশরিকদের চাপে বাধ্য হয়ে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বদরে যান। কিন্তু তখন তার মুখে এই পংক্তিটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল:
‘আহমাদের সাথে যুদ্ধ করা আমার জন্য হারাম, আহমাদকে আমি আমার নিকট আত্মীয় মনে করি।’
বদরে মক্কার পৌত্তলিক বাহিনীর পরাজয় হলে অন্যদের সাথে তিনিও বন্দী হন। এই বন্দী অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেন। যখন রাসুল সা: তাকে বললেন: নাওফিল, ফিদিয়া বা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হয়ে যাও। নাওফিল বললেন: মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ আমার নেই। নাওফিল বলে উঠলেন: আল্লাহর কসম, এক আল্লাহ ছাড়া জিদ্দার তীরগুলির কথা আর কেউ জানেনা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল। জিদ্দায় তার এক হাজার তীর ছিল। অবশ্য অন্য একটি মতে তিনি খন্দক যুদ্ধের বছর ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদীনায় চলে যান। (টীকা: সীরাতু ইবন হিশাম ২/৩. আল ইসাবা-৩/৫৭৭)।
নাওফিল ছিলেন একজন ভাল কবি। ইসলাম গ্রহণের স্বীয় অনভূতি অনেক কবিতায় প্রকাশ করেছেন। তার কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপ:
‘দূরে যাও, দূরে যাও, আমি আর তোমাদের নই।
কুরাইশ নেতাদের দ্বীনের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
আমি সাক্ষ্য দিয়েছি, মুহাম্মাদ নিশ্চয়ই নবী।
তিনি তার প্রভুর কাছ থেকে হিদায়াত ও দিব্যজ্ঞান নিয়ে এসেছেন।
তিনি আল্লাহর রাসূল- তাকওয়ার দিকে আহবান জানান,
আল্লাহর রাসূল কোন কবি নন।
এই বিশ্বাস নিয়ে আমি বেঁচে থাকবো।
কবরেও আমি এই বিশ্বাসের ওপর শুয়ে থাকবো।
আবার কিয়ামতের দিন এই বিশ্বাস নিয়ে ওঠবো।’
খন্দক অথবা মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে হযরত আব্বাসের সা: সাথে আবার তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আবওয়া পৌঁছে রাবীয়া ইবন হারেস ইবন আবদিল মুত্তালিব আবার মক্কায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। নাওফিল তাকে বলেন: যে স্থানের মানুষ আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে, যেখানের অধিবাসীরা তাকে অস্বীকার করে- সেই পৌত্তলিক ভূমিতে তুমি কোথায় ফিরে যাবে? এখন আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সম্মান দান করেছেন, তার সঙ্গী সাথীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তুমি আমাদের সাথেই চলো। অত:পর কাফিলাটি হিজরাত করে মদীনায় পৌঁছে।
ইসলাম গ্রহণের পূর্ব থেকেই নাওফিল ও আব্বাসের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। এ কারণে রাসূল সা: তাদের দুজনের মধ্যে দ্বীনী ভাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেনএবং দুজনের বসবাসের জন্য দুটি বাড়ীও বরাদ্দ করেন। বাড়ী দুটির একটি ছিল মসজিদে নববী সংলগ্ন ‘রাহবাতুল কাদা’ নামক স্থানে এবং অন্যটি ছিল বাজারে-‘সানিয়্যাতুল বিদা’র রাস্তায়।
মদীনায় আসার পর সর্ব প্রথম মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন। তায়েফ ও হুনাইনসহ বিভিন্ন অভিযানে যোগ দিয়ে বিশেষ যোগ্যতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বিশেষত: হুনাইনে তিনি চরম সাহসিকতা দেখান। মুসলিম বাহিনী যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয় তখনও তিনি শত্রুর মুকাবিলায় পাহাড়ের মত অটল থাকেন। এই যুদ্ধে তিনি মুসলিম বাহিনীকে প্রভূত সাহায্য করেন। যাত্রার প্রাক্কালে তিন হাজার নিযা তিনি রাসুল সা: এর হাতে তুলে দেন। রাসুল সা: মন্তব্য করেন: আমি যেন দেখছি, তোমার তীরগুলি মুশরিকদের পিঠসমূহ বিদ্ধ করছে। (টীকা: সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩)।
হযরত নাওফিল রা: হিজরী ১৫ সনে মদীনায় ইনতিকাল করেন এবং খলীফা হযরত উমার তার জানাযার নামাযের ইমামতি করেন। মদীনার ‘বাকী’ গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।
হযরত রাসুলে কারীম সা: সব সময় নাওফিলের খোজ খবর নিতেন, মদীনার এক মহিলার সাথে রাসূল সা: তার বিয়ে দেন। তখন তার ঘরে কোন খাবার নেই। রাসূল সা: স্বীয় বর্মটি আবু রাফে ও আবু আইউবের হাতে দিয়ে এক ইয়াহুদীর নিকট পাঠান। তারা বর্মটি সেই ইয়াহুদির নিকট বন্দক রেখে বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ত্রিশ সা’ যব খরীদ করে রাসুল সা: এর নিকট নিয়ে আসেন। তিনি তা নাওফিলকে দান করেন।
বিষয়: বিবিধ
১৩০২ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন