কিডনি সুরক্ষায় আমাদের করণীয়?
লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৮:১৮:৪৭ সকাল
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ সভাপতি কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি।
বিগত ২০০৬ সাল হতে প্রতিবছরই মার্চ মাসের ২য় বৃহস্পতিবার 'বিশ্ব কিডনী দিবস' পৃথিবীর সবদেশে পালিত হয়। এই দিবস উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য নীরব ঘাতক কিডনি রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে সারা দুুনিয়ার মানুষকে অবহিত করা এবং কিডনি বিকল প্রতিরোধের জন্য সবাইকে সচেতন করা। বিভিন্ন উপাত্ত থেকে জানা যায় কিডনি রোগের হার দিন দিন মহামারী আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি সময় মত চিকিত্সা না করা হয় তবে কিডনি রোগের শেষ পরিনতি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে স্থায়ী ভাবে কিডনির গঠন ও কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে থাকে। এভাবে পাঁচটি ধাপে কিডনি বিকলের দিকে অগ্রসর হয়। প্রথম চারটি ধাপ পর্যন্ত চিকিত্সার মাধ্যমে নিরাময় অথবা যে গতিতে কিডনি ক্ষয় হচ্ছে তা অনেক কমিয়ে আনা যায়। তবে একবার পাঁচ নম্বর ধাপে চলে গেলে তখন বেঁচে থাকার উপায় হলো ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন, যা এতটাই ব্যয় বহুল যে আমাদের দেশের শতকরা দশ ভাগ লোকেরও সাধ্য নেই এই চিকিত্সা চালিয়ে যাবার। তাই এই ঘাতক ব্যাধি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল কিডনি বিকল
প্রতিরোধ করা।
এবারের বিশ্ব কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো Chronic Kidney disease and ageing অর্থাত্ বয়সের সাথে বাড়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ। আর একটি সত্য এভাবে বলা যায় যে, 'আপনার কিডনির বয়স ঠিক আপনার মত' অর্থাত্ আপনি যখন যৌবনে, আপনার কিডনির ক্ষমতাও যৌবনে, আপনি যখন বয়স্ক আপনার কিডনিও বয়সের ভারে ক্ষয়প্রাপ্ত। গবেষণায় দেখা গেছে ৪০ বছর বয়সে কিডনির রক্ত প্রবাহ ৬০০ সিসি, প্রতি মিনিটে, পক্ষান্তরে ৮০ বছর বয়সে তা কমে দাড়ায় ৩০০ সিসি/মিনিট। ৭০ বছর বয়সে কিডনির ক্ষমতা অর্ধেক হয়ে যায়। বয়সের সাথে বাড়ে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্রস্রাব প্রবাহে বাধা জনিত রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ইত্যাদি। এসব কারণে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের হার বয়স্কদের মাঝে অনেকগুন বেশী। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যাদের বয়স ষাটের বেশী তাদের প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জনের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বিদ্যমান। আর একটি
দুঃসংবাদ হলো যে, যাদের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ আছে তাদের ১ জনের যদি মূত্যু হয় কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে, তার প্রেক্ষিতে ১০ থেকে ৪০ জনের মূত্যু হয় কিডনি রোগের কারণে হার্ট এ্যাটাক, ব্রেইন ষ্ট্রোক অথবা রক্ত নালীর রোগে আক্রান্ত হয়ে। অর্থাত্ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ অন্য রোগের জন্ম দেয়।
দিন যতই যাচ্ছে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর পরিসংখ্যাণ অনুযায়ী এই সংখ্যা ২০৩০ সালে দ্ব্বিগুন এবং ২০৫০ সালে তিন গুন হবে। বাংলাদেশে এই সংখ্যা বাড়বে আরও অনেক বেশীগুনে। বয়সের রোগ বিশেষ করে কিডনি রোগও সেই হারে বাড়বে। এ জন্য সরকারকে এখন থেকে এদের চিকিত্সার মহাপরিকল্পনা প্রনয়ণ করতে হবে। বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা যায় বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটিরও অধিক লোক কোন না কোন কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি ঘন্টায় অকাল মৃত্যুবরণ করছে পাঁচ জন লোক।
যাদের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, নেফ্রাইটিস আছে- তাদের কিডনি রোগের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশে শতকরা ৮০ ভাগ কিডনি এই তিন কারণে নষ্ট হয়ে থাকে। ঘনঘন কিডনিতে ইনফেকশন, পাথরজনিত রোগ, প্রস্রাব প্রবাহে বাধা, বয়স চল্লিশ এর উর্দ্ধে, স্থূলতা, ধূমপান, অতিমাত্রায় এন্টিবায়োটিক ও তীব্রবেদনা-নাশক ওষুধ সেবন, অলস জীবনযাপন এবং রোগের অন্যান্য কারণ। মাত্র দুটি পরীক্ষায় জানা যায় কিডনি রোগ আছে কিনা এবং একটি সহজ সমীকরনে বের করা যায় কিডনি শতভাগে কতভাগ কাজ করছে। একটি হলো প্রস্রাবে এলবুমিন বা মাইক্রোএলবুমিন যায় কিনা এবং অন্যটি রক্তের ক্রিয়েটিনিন। একটু লক্ষ করলেই বুঝা যাবে, একটু সচেতন হলেই এবং একটু কষ্ট করে যদি লাইফ স্টাইল বা জীবনযাত্রার প্রনালী বদলীয়ে স্বাস্থ্যকর উপায়ে চলা যায় তবে কিডনি বিকল হওয়ার এ সকল কারণ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব জীবন নাশা কিডনি বিকল। যদিও কিডনি রোগের হার বয়স্কদের মাঝে বেশী। এরোগের সূত্রপাত কিন্তু হয় যৌবন কালের আগ থেকেই। তাই সুস্থ লাইফ স্টাইল চর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে স্কুলে যাবার বয়স থেকেই। নিম্নে কিডনি ভালো রাখার কতগুলো টিপস দেয়া হলো। এ নিয়মগুলো সবাই মেনে চললে শুধু যে কিডনি বিকল রোধ হবে তা নয়, প্রতিরোধ করা যাবে অন্যান্য সকল ঘাতক ব্যধি।
কিডনি ভাল রাখার উপায় সমূহ
ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত রক্তের শর্করা এবং প্রস্রাবের অ্যালবুমিন পরীক্ষা করা ও রক্তের হিমোগ্লোবিন এ-ওয়ান সি (HbA1c) সাত এর নীচে রাখা।
উচ্চ-রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্র্রণে রাখা (১৩০/৮০ এর নীচে, যাদের প্রস্রাবে অ্যালবুমিন থাকে তাদের ১২০/৭০ এর নীচে) ।
ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্ত চাপে আক্রান্ত রোগীদের কিডনির কার্যকারিতা প্রতি ৬ মাস অন্তর পরীক্ষা করা ।
শিশুদের গলা ব্যথা, জ্বর ও ত্বকে খোশ-পাঁচড়ার দ্রুত সঠিক চিকিত্সা করা উচিত্। কারণ এগুলো থেকে কিডনি প্রদাহ বা নেফ্রাইটিস রোগ দেখা দিতে পারে ।
ডায়রিয়া, বমি ও রক্ত আমাশয় এর কারণে রক্ত, পানি ও লবণ শূন্য হয়ে কিডনি বিকল হতে পারে। তাই দ্রুত খাবার স্যালাইন খেতে হবে। প্রয়োজনে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে।
ধূমপান বর্জন করুন, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন ও নিয়মিত ব্যায়াম করুন ।
চর্বি জাতীয় খাবার ও লবণ কম খাবেন এবং পরিমিত পানি পান করবেন ।
চিকিত্সকের পরামর্শ ব্যতীত এন্টিবায়োটিক ও তীব্র ব্যথার ওষুধ সেবন না করা ।
প্রস্রাবের ঘনঘন ইনফেকশনের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিত্সা নিতে হবে।
সুষম খাবার খাবেন যেখানে অন্যান্য খাবারের সাথে থাকবে প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল ।
আসুন এবারের 'বিশ্ব কিডনি দিবস' থেকে বিষ্ময়কর কার্যক্ষম এই ছোট্ট দুটো কিডনির প্রতি যত্নশীল হই এবং কিডনি ভালো রাখতে উপরের টিপ্স গুলো প্রতিদিন চর্চা করি। সবাই মিলে আওয়াজ তুলি-
"কিডনি রোগ জীবন নাশা, প্রতিরোধই বাঁচার আশা"
বিষয়: বিবিধ
৫৪৯৪ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
০ যে সব পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির কার্যকারিতা সঠিকভাবে বোঝা যায় সেগুলো কি কি ?
ডা. ওয়াহাব : চিকিৎসকগণ বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির রোগ নির্ণয় করেন। রক্তের পরীক্ষা, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, কিডনি স্ক্যান, মূত্র পরীক্ষা, কিডনির বায়োপসি ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির রোগ নির্ণয় করা যায়।
সাপ্তাহিক : কিডনি রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রক্ত এবং মূত্র পরীক্ষার মধ্যে কোনটির গুরুত্ব কতটুকু?
ডা. ওয়াহাব : কিডনি রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রক্ত এবং মূত্র পরীক্ষা করা হয়। দুটোরই গুরুত্ব সমান। কারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির কার্যকারিতা জানা যায় এবং মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে রোগের লক্ষণ নির্ণয় করা যায়। তবে কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। প্রস্রাবের পরীক্ষায় স্বাভাবিক রিপোর্ট আসলেও রক্তের পরীক্ষায় কিডনি রোগের প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে।
সাপ্তাহিক : কিডনি রোগের চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?
ডা. ওয়াহাব : কিডনি রোগ চিকিৎসার প্রধান শর্ত হচ্ছে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে হবে অর্থাৎ রোগীর কিডনিতে কোন ধরনের রোগ হয়েছে। সাধারণত ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা করা হয়। তবে কিডনিতে পাথর কিংবা ক্যান্সার হলে অবশ্যই অপারেশনের প্রয়োজন রয়েছে। তবে কিডনি ফেইলর হলে কিডনি ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন করে কিডনি রোগের চিকিৎসা করা হয়।
সাপ্তাহিক : কিডনি ফেইলর কি?
ডা. ওয়াহাব : কিডনির যে পরিমাণ কাজ করা উচিত সে পরিমাণ কাজ না করাকে বোঝায়। অর্থাৎ কিডনি যখন শতকরা মাত্র ৩০-৪০ ভাগের চেয়ে কম কাজে সক্ষম থাকে তখন কিডনি ফেইলর হয়।
সাপ্তাহিক : ডায়ালাইসিস কি? কিডনি ফেইলর চিকিৎসার গুরুত্ব কতটুকু?
ডা. ওয়াহাব : ডায়ালাইসিস হচ্ছে এক ধরনের জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি মূলত কিডনি রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যখন কিডনি ফেইলরের মাত্রা চরমে অর্থাৎ যখন কিডনি শতকরা ৯৫% এর কম কাজ করে তখন সাধারণত ডায়ালাইসিস করা হয়। কিডনি ফেইলর রোগীর চিকিৎসায় ডায়ালাইসিসের গুরুত্ব অপরিসীম। ডায়ালাইসিস করে এখন রোগী বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে। যখন কেউ কিডনি সংযোজন করতে চান তখনও তাকে প্রথমত ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকতে হয়। তারপর কিডনি দাতা পাওয়া গেলে কিডনি সংযোজন করতে হয়। তাই ডায়ালাইসিস ছাড়া একজন কিডনি রোগীর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
সাপ্তাহিক : ডায়ালাইসিসই কি কিডনি ফেইলরের একমাত্র চিকিৎসা?
ডা. ওয়াহাব : ডায়ালাইসিস কিডনি ফেইলরের একমাত্র চিকিৎসা নয়। প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধ সেবনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। অবস্থা গুরুতর হলে ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজন করা হয়।
সাপ্তাহিক : কিডনি প্রতিস্থাপন কি?
ডা. ওয়াহাব : অপারেশনের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক কিডনি সংযুক্ত করাকে কিডনি প্রতিস্থাপন বলে। তবে কিডনি প্রতিস্থাপনের সময় অবশ্য কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন- একই ব্লাড গ্রুপ হতে হবে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপমুক্ত ব্যক্তির কিডনি সংগ্রহ করতে হবে। কিডনি দানকারী ব্যক্তির এমন কোনো রোগ থাকবে না, যা কিডনির মাধ্যমে কিডনি গ্রহীতার শরীরে ছড়াতে পারে।
সাপ্তাহিক : বাংলাদেশের কোথায় কোথায় কিডনির ডায়ালাইসিস কিংবা কিডনি প্রতিস্থাপনজনিত চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে?
ডা. ওয়াহাব : বাংলাদেশের অনেক স্থানেই ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত কিডনি হাসপাতাল। এ ছাড়াও স্কয়ার, জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, এ্যাপোলো, ইউনাইটেড ও বারডেম হাসপাতালে কিডনির ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন করা হয়।
সাপ্তাহিক : ডায়াবেটিস রোগীদের কিডনির রোগের সম্ভাবনা কতটুকু? এ রোগ প্রতিরোধে ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয় কি?
ডা. ওয়াহাব : ডায়াবেটিস রোগীদের ৫০-৬০ ভাগই রোগী কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডায়ালাইসিস করার প্রয়োজন হয় না। তবে ৩০-৪০ ভাগ রোগীর ডায়ালাইসিস দরকার হয়।
ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে কিডনি রোগের সম্ভাবনা কমে যায়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন