এযুগের ইব্রাহীম আদহাম।
লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৩:২৯:৫৭ দুপুর
এযুগের ইব্রাহিম আদহাম | বাদশাহী ছেড়ে যিনি ঘুরে বেড়ান পৃথিবীর পথে পান্তরে
==========================
কাতারের যুবরাজ হামদ বিন ফাহাদ তাবলীগের পরশে যেভাবে বদলে গেছেন
=========================
ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। হওয়ার কথা ছিল বর্তমান বাদশাহ। কিন্তু না, রাজ সিংহাসনের মোহ থাকে রাজদরবারে আটকাতে পারেনি। রাজ মুকুটের লোভ ছেড়ে খোদার প্রেমে তিনি এখন একজন আপাদমস্তক দা'য়ী ইলাল্লাহ। রাজমহল ছেড়ে তিনি পড়ে থাকেন মার্কাজ মসজিদে। সেখানে নিজের প্রতিষ্টিত হিফজ খানাতেই থাকেন সাধারন তালেবে এলেমদের সাথে। অধিকাংশ সময়ই কাটান দেশ থেকে দেশান্তের তাবলীগী সফরে।আমি কাতারের যুবরাজ শেখ হামদ বিন ফাহাদের কথা বলছি।
আমরা বলখের বাদশাহ, ইব্রাহিম ইবনে আদহাম এর কথা ইতিহাসে পড়েছি। তিনি কি তার চেয়ে কম। আমাদের সৌভাগ্য, আমাদের সময়ে এমন মানুষের দেখা পেয়েছি।
.
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যমতে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী দেশ কাতার। পৃথিবীর সেরা সূখি মানুষদের দেশ। আইএমঅএফ এর তথ্যমতে মাথাপিছু সর্বোচ্চ আয়ের দেশ। প্রাকৃতিক গ্যাস ভান্ডারে কাতারের অবস্থান তৃতীয়। অতি সম্প্রতি ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক হয়ে বিশ্ব দরবারে কাতার সদর্পে ঘোষণা করেছে নিজেদের সমৃদ্ধ অর্থনীতির কথা। ১৯৭২ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সেখানে রাজতান্ত্রিক শাসন চলছে। কাতারের ঐতিহ্য ও শাসনরীতি অনুযায়ী দেশটির ক্রাঊন প্রিন্স বা যুবরাজ পরবর্তী আমির হন। যুবরাজ হন সাধারণত বাদশাহ বা আমিরে বড় ছেলে। সে রীতি অনুযায়ী পরবর্তী খলিফা বা বাদশাহ হওয়ার কথা ছিল শেখ হামাদ বিন ফাহাদ বিন আব্দুল আযীয আল সানির। কিন্তু না! সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভবিষ্যতের বাদশাহ নিজের যুবরাজের পদটি ছেড়ে দেন তার
ছোট ভাই শেখ তামিম বিন ফাহাদ বিন
খলিফা আল সানির জন্য ( বর্তমান বাদশাহ)।
.
তিনি বেছে নেন অন্য এক পদ। রাজ পরিবারের অঢেল বিলাস বৈভব ছেড়ে তিনি দিনহীন সাধারণ মানুষের মতো নেমে পড়েন আলোর পথে,আল্লাহর পথে। জান্নাতের পথেই এখন তার চির বিচরন। ছিলেন কাতার সেনাবাহীনীর জেনারেল। পড়ালেখা করেছেন দাদার ( সাবেক বাদশাহ) ইচ্ছায় আমেরিকা ডিফেন্স ইউনির্ভাসিটিত। সেখানেই পরিচিত হন তাবলীগ জামাতের সাথে। সেনা অফিসার থাকা অবস্থায়ই তাবলিগের সঙ্গে জরিয়ে পড়েন ওতপ্রোতভাবে। একসময় ছেড়ে দেন চাকুরী। শুধু কি তাই।
তাকে প্রস্তাব করা হয় তিনি যেন কমপক্ষে কাতারের ধর্ম মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে দ্বীনের কাজ করেন। তিনি তাও ফিরিয়ে দিলেন বিনয়ের সাথে এই কথা বলে, "যে মন্ত্রী হলে সিকরটি থাকবে। সাধারন মানুষ অহরহ আসতে পারবেনা আমার কাছে। আর আমার কাজইতো সাধারনেন দ্বারে দ্বারে বারে বারে যাওয়া।'
.
রাজকীয় সমস্ত ভোগ-বিলাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন মানুষের দ্বারে দ্বারে ইসলামের আলো পৌঁছে দিতে। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে কাজ করার তাগিদে তিনি
ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ৪মাস লাগিয়েছেন। এর পর পাক ভারত বাংলাদেশের মুরব্বিদের সাহচর্যে আরো কিকিছু সসয় থেকে নিজেকে আমূল বদলে ফেলেন।শুরু করেন দেশ- বিদেশে দ্বীনের দাওয়াতের কাজ। তিনি প্রতিবছর এসেছেন বাংলাদেশে। ঘুরেন গ্রামে গ্রামে। এভাবে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে। থাকেন মাটির বিছানায়। টিনের ছালা কিংবা মাটির দেয়ল ঘেরা অনেক মসজিদে। সাধারন গাম্য টয়লেট ব্যবহার করেন নিসংকোচভাবে। চাপাইনবাবগঞ্জ, ভোলা, টেকনাফ ও ময়মনসিঙ্গহেরর প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে,পথে-ঘাটে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে ঘুরে বেরিয়েছেন নিতান্তই একজন সাধারন সাদা মাটা দা'য়ী হিসাবে। তাবলীগের ঈমানী মেহনত একজন মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে শেখ হামাদ তার উজ্জল দৃষ্টান্ত।
.
রাজকীয় পরিচয়ের বাহিরে তৈরি করেছেন সাধারন নাগরিক পরিচয়ের পাসর্পোট।
তার জামাতের কয়েকজন ছাড়া কেউ জানতো না তার পরিচয়। তিনি ননিজেকে এতোটাই লুকিয়ে রাখেন যে,এমনকি বাংলাদেশস্থ কাতার দূতাবাসও জানতে পারেনি তার বাংলাদেশে অবস্থানের কথা।প্রায় প্রতি বছরই আসেন বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমায়। তার পরিবারের সদস্যরা রাজকীয় প্লেন নিয়ে আসলেও তিনি আসেন সাধারন মানুষের সাথে জামাত বন্দি হয়ে।
.
রাজ-পরিবারের অতীব গুরুত্বপূর্ণ সদস্য
হয়েও তিনি নিজের জন্য তিনি দু'টি
পাসপোর্ট ব্যবহার করেন।একটি রাজকীয়
কোন সফরে যান তখনই শুধু রয়েল
পাসপোর্টি ব্যবহার করেন।অন্যথায় তিনি
সবসময় তিনি সাধারণ কাতারি
পাসপোর্টটি ব্যবহার করেন। ইমিগ্রেশনের
লোকজনও তার এই সাধারণ পাসপোর্টে
তাকে চিনতে পারে না। তার সাধারণ
চলেফেরার সবচেয়ে বড় সুবিধা
হলো,তিনি সবসময় মিডিয়ার একেবারে
অন্তরালে থাকেন।তাই তার বর্তমান বা
দু'এক দশকের কোন ছবি মিডিয়ার কাছে
নেই। তার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত
অঞ্চলে দাওয়াতের কাজে সময় লাগানো
একজন তাবলিগি সাথী নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,কোন মসজিদে যখন যুবরাজ শেখ ফাহাদ যেতেন তখন জামাতের আমির তাকে যদি সমাজের নেতৃস্থানীয় কোনো লোক যেমন,এলাকার চেয়ারম্যান,বড় ব্যাবসায়ী,রাজনৈতিক নেতার কাছে তশকিলে পাঠাতে চাইতো তিনি তাদের
কাছে না গিয়ে এলাকার নিম্নশ্রেণীর
কাছে যেতে পছন্দ করতেন।নেতৃস্থানীয়
ব্যাক্তির বদলে তিনি ছুটে যেতেন
সাধারণ রিক্সাওয়ালা,পান বিক্রেতা,
কৃষক,শ্রমিকদের কাছে। তাদের পাশে
বসে,তাদের হাত ধরে দ্বীনের কথা
শোনানোর জন্য নিয়ে আসতেন মসজিদে।
নিজ হাতে তাদের আপ্যায়ন করাতেন।
এভাবেই তিনি নিজের রাজকীয় অহমকে
মিটিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের
সাধারণ মানুষের আত্মশুদ্ধিরকল্যানে।
.
আরবি, ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ, জার্মানি,উর্দুসহ
কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী এই যুবরাজ রাজ- পরিবারের সদস্য হলেও ব্যক্তিগতজীবনে অত্যন্ত সরল জীবনযাপন করেন। বর্তমানে উপমহাদেশের তাবলিগওয়ালা মানুষজন
অনেকেই তার পরিচয় জেনে যাওয়ায়
তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় লম্বা সফর কমিয়ে
দিয়েছেন।তিনি আফ্রিকা মহাদেশে
কয়েক বছর একাধারে মেহনত করেছেন
নিরলসভাবে।আফ্রিকার প্রায় প্রতিটি দেশে তিনি দাওয়াতে তাবলিগের মিশন নিয়ে ছুটে গেছেন বহুবার।
.
বর্তমানে তিনি আরব,ইউরোপ ও
আমেরিকায় বেশি কাজ করছেন। আরবের
কোন দেশেই তাবলিগজামাত উপমহাদেশের মতো মসজিদকেন্দ্রিক করার অনুমতি নেই। সেখানে কাজ করতে হলে তাবলিগ জামাতের জন্য আলাদা কামরা করে নিতে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র যুবরাজ শেখ ফাহাদের কারণেই আরবের মধ্যে কেবল কাতের সাধারণভাবে মসজিভিত্তিক তাবলিগ করার অনুমতি আছে। কাতারের ধর্মমন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে তাবলিগের উপর খড়্গহস্ত হতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক ছাপে ,কিন্তু শুধু তার কারণে কাতার সরকার তাবলিগবিরোধী কোনো কর্মসূচি
গ্রহণে সাফল্য লাভ করেনি। তার
দাওয়াতের কারণে কাতারের উঁচুস্তরের
অনেক মানুষ তাবলিগ জামাততের সাথে
যুক্ত হয়েছেন।তাদের মধ্যে রাজ
পরিবারের অনেক সদস্য যেমন আছে
তেমনি আছে ধনাঢ্যরা।তার প্রমাণ পাওয়া
যায় এবার ইজতেমা উপলক্ষে কাতার
থেকে আগত মেহমানের বহর দেখে।
.
রাজপরিবার, মন্ত্রীরা সহ তিনটি বিমান রিজার্ভ করে তার তুরাগ তীরের ইজতেমায় এসেছেন।এই তিনটি বিমান ইজতেমার কয়েকদিন বাংলাদেশের বিমানবন্দরেই অবস্থান করে। ইজতেমা শেষ করে তদের নিয়েই তা উড়ে যায় কাতারে।রাজ-পরিবারের মাঝেও তিনি তাবলিগের দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার চাচাতো ভাই শেখ নাসের যুক্ত হয়েছেন তাবলিগের এই নিঃস্বার্থ দাওয়াতি কাজে।কাতারের
সাবেক ধর্মমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহও
বর্তমানে তাবলিগের কাজে নিজের
সর্বস্ব দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছেন। শোনা
যায়, সৌদি বাদশাহ নাকি সন্ত্রাসবাদের
অজুহাত তুলে অনেকবার কাতারের
বাদশাহ হাম্মাদ বিন খলিফাকে তার
দেশে তাবলীগের কার্যক্রম গুটিয়ে
ফেলার জন্য উপদেশ দিয়েছেন।কিন্তু
কাতারের আমির সৌদি বাদশাহকে সাফ
জানিয়ে দিয়েছেন,কোনভাবেই তিনি
তার দেশে তাবলিগের কার্যক্রমে
কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না।কেননা,
তিনি উপলব্ধি করেছেন, পৃথিবীতে
একমাত্র এইন একটি জামাত অনন্য পদ্ধতিতে নিঃস্বার্থভাব মের খেদমত করে
যাচ্ছে।উপরন্ত তিনি সৌদি বাদশাহকে
বলেছেন, সৌদি আরবে তাবলিগের ওপর
যে সমস্ত বিধি-নিষেধ আছে তা তুলে
দিয়ে তাদেরকে বেশি করে কাজ করার
সুযোগ করে দেয়া উচিৎ। প্রসাদ ছেড়ে
আল্লাহর পথে চলে আসা এই যুবরাজ
এভাবেই নিজের জীবনকে ইসলামের
খেদমতে সপে দিয়েছেন।তিনি যেন এ
যুগের ইবরাহীম ইবনে আদাম(রহ)। আমাদের সন্তানদের আমরা হামদ বিন ফাহাদের রাজকীয় জীবন বদলে যাওয়ার গল্পপ শুনাব ইবাহিম আদহামের মত।এই বৎসরও বিশ্ব ইজতেমায় এসেছিলেন এই মহান মানুষটি।
আল্লাহ তার দীর্ঘ হায়াতে তৈয়েবা নসীব করুন।
সৈয়দ আনোয়ার আব্দুল্লাহ
বিষয়: বিবিধ
২৫৮৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন