জঙ্গীবাদী ও চরমপন্থীদের উদ্দেশ্যে।

লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ২৭ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৫:৫৮:৪৯ সকাল



শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী রহ.]

প্রথমতঃ কোন বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যায় প্রবেশের পূর্বে কিছু বিষয় স্মরণ রাখা যরূরী। জ্ঞানীগণ বলেন, ‘বাতিলের উপর যা প্রতিষ্ঠিত, তা নিজেও বাতিল’। উদাহরণস্বরূপ সালাত যদি অপবিত্র অবস্থায় আদায় করা হয়, তবে তা সালাত হিসাবে গণ্য হয় না। কেননা তা শরী‘আত নির্দেশিত বিধি মোতাবেক পালিত হয়নি। আর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ওযূবিহীন কোন সালাত নেই’। তাই মুসল্লী ওযূবিহীনভাবে যত সালাতই আদায় করুক না কেন, তা বাতিল বলেই গণ্য হবে। কেননা তা বাতিলের উপর প্রতিষ্ঠিত। শরী‘আতে এরূপ উদাহরণ ভুরি ভুরি।

দ্বিতীয়তঃ আমরা সর্বদা বলে আসছি শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা কেবলমাত্র তখনই জায়েয, যখন তার কুফরীর বিষয়টি সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়। সাধারণভাবে কখনোই তা শরী‘আতসম্মত নয়। কেননা বিদ্রোহও শরী‘আতসম্মত উপায়ে হওয়া আবশ্যক। যেমনভাবে সালাত আদায়ের জন্য পবিত্রতা অর্জন করা আবশ্যক। এর প্রমাণে আমরা আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীটি প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করব, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আহযাব ২১)।

তৃতীয়তঃ বর্তমানে মুসলমানরা এমন কিছু শাসকের শাসনাধীনে রয়েছে যাদেরকে ধরে নেওয়া যায় যে তারা মুশরিকদের মত সুস্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত। যদি এটা ধরে নেয়া হয় তবে আমি বলব, আজকের যুগের শাসকদের অধীনে মুসলমানরা যে অবস্থায় জীবন-যাপন করছে, এটা রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের মাক্কী জীবনের ন্যায়। রাসূল (সা.)-কে তার মাক্কী জীবন কাফের-মুশরিকদের ত্বাগূতী শাসনের অধীনেই অতিবাহিত করতে হয়েছিল। যারা রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াতকে এবং কালেমায়ে ত্বাইয়েবার আহবানকে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করত। এমনকি রাসূল (সা.)-এর চাচা আবু তালিবও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার দাওয়াতকে অস্বীকার করে বলেছিলেন, যদি আমার কওম আমার ব্যাপারে কটূক্তি না করত, তাহলে আমি অবশ্যই এ কালেমা উচ্চারণ করে তোমার চক্ষু শীতল করতাম।

তারা ছিল নবী (সা.)-এর দাওয়াতের প্রকাশ্য অস্বীকার কারী। অথচ রাসূল (সা.) তাদের শাসনাধীনেই বসবাস করতেন। তিনি তাদেরকে কোন কথাই বলতেন না কেবল একটি দাওয়াত ছাড়া, তা হ’ল- ‘তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে কারো শরীক করো না’।

অতঃপর তিনি মাদানী জীবনে পদার্পণ করলেন। শারঈ বিধি-বিধান নাযিল হতে লাগল। মুসলমানদের সাথে মুশরিকদের যুদ্ধ শুরু হ’ল। যার ইতিহাস সুবিদিত।

কিন্তু মাক্কী জীবনে কোন বিদ্রোহ ছিল না যেমনটি বর্তমানে অনেক অমুসলিম দেশে মুসলমানরা করছে। এরূপ বিদ্রোহ মূলতঃ রাসূল (সা.)-এর আদর্শ ছিল না। যার অনুসরণের জন্য আমরা নির্দেশিত হয়েছি।

চতুর্থতঃ বর্তমানে আলজেরিয়া সম্পর্কে আমরা যা শুনেছি তাহ’ল সেখানে দু’টি বা তারও বেশী দল রয়েছে, যারা শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। যেমন ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট এবং আমার জানা মতে তাদের মধ্যকার একটি জঙ্গী দল। এই চরমপন্থী অংশটি আসলে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠী। এদের প্রত্যেকেরই শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য নিজস্ব পথ ও পন্থা রয়েছে। এখন শাসককে নিজেদের মত করে কাফের ঘোষণা করে যদি এই দু’টি দলের কোন একটি দল বিজয় লাভ করে এবং ক্ষমতারোহন করে, তখন বাকি দলগুলোর কথা বাদই দিলাম, এ দু’টি দল কি ঐক্যমত পোষণ করতে পারবে? তারা কি সেই ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে পারবে যার জন্য তারা যুদ্ধ করেছিল? মনে হয় না। কারণ অচিরেই তাদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হবে।

যার অতীব দুঃখজনক দৃষ্টান্ত আমরা আফগানিস্তানে দেখেছি। আফগানিস্তানে যেদিন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেদিন সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছিল। সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে শরীক হয়েছিল অনেকগুলি দল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা একে অপরের শক্রতে পরিণত হ’ল। সুতরাং রাসূল (সা.)-এর প্রদর্শিত পথের বিপরীত কাজ করলে তার পরিণতি অবশেষে ধ্বংস ছাড়া কিছুই নয়। মূলতঃ ইসলামী হুকুমত কায়েমে এবং ইসলামের হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পথ হ’ল মানুষকে হক-এর পথে দাওয়াত দেয়া।

পঞ্চমতঃ ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াত প্রদানের পদ্ধতি হ’ল, প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত প্রদান করতে হবে। অতঃপর কিতাব ও সুন্নাতের আলোকে মানুষকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। এই দুই মূলনীতির পরিচয় আমরা দিয়েছি দু’টি শব্দ ‘তাসফিয়াহ’ ও ‘তারবিয়াহ’ নামে। আমরা বলছি না যে, এর মাধ্যমেই সারা বিশ্বের মুসলমান একক উম্মাহ হিসাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে; বরং আমরা বলতে চাই যে যারা প্রকৃতই ইসলামের জন্য কাজ করতে চায় অথবা সে পথের অনুসারী হতে চায়, যে পথে পৃথিবীতে ইসলামী হুকুমত কায়েম করা সম্ভব, তাদেরকে অবশ্যই হুকুম ও পদ্ধতিগতভাবে রাসূল (সা)-কে অনুসরণ করা আবশ্যক।

এদিক থেকেই বলব মিসর ও আলজেরিয়ায় যা হচ্ছে, তা ইসলামের নীতি বিরোধী। কেননা ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে ‘তাসফিয়াহ’ ও ‘তারবিয়াহ’-এর পথ অবলম্বন করতে; অন্য কোন পথ অনুসরণযোগ্য নয়। আমি বলছি না যে এর মাধ্যমেই লক্ষ লক্ষ মুসলমান সরল-স্বচ্ছভাবে ইসলামকে অনুসরণ করা শুরু করবে অথবা ইসলামের সঠিক পথ ও পন্থায় নিজেকে পরিচালিত করবে; বরং আমাদের বক্তব্য হ’ল ইসলামকে প্রকৃতই যারা গুরুত্ব দেয় তারা নিজেদের সংশোধন করুক, অতঃপর তার পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে সংশোধনের উদ্যোগ নিক, অতঃপর ক্রমান্বয়ে অন্যদেরকে। এভাবে সংশোধন ও সংস্কারের ধারা ক্রমান্বয়ে শাসক পর্যন্ত উপনীত হোক। এই শারঈ রীতি ও যৌক্তিক পন্থার অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল মানুষের মধ্যে সংশোধন ও সংস্কার আনা সম্ভব।

ষষ্ঠতঃ এই সকল বিপ্লব, বিদ্রোহ এমনকি আফগানিস্তানের জিহাদ, এসব ঘটনায় আমাদের কোন সমর্থন ছিল না কিংবা এর ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদীও ছিলাম না। কারণ সেখানে পাঁচ বা ততোধিক দল রয়েছে। যেমন বর্তমানে আফগানিস্তানে যিনি ক্ষমতায় আছেন তিনি সুফী মতাবলম্বী বলে সুপরিচিত।

যাইহোক এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হ’ল, মতপার্থক্য যেকোন শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। যেমনভাবে আল্লাহ খুন-খারাবীর পিছনে কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন পারস্পরিক বিভেদ। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’। ‘যারা নিজেদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত’ (রূম ৩১–৩২)। সুতরাং মুসলমানরা যখন নিজেরাই দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাবে, তখন তাদের পক্ষে জয়লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেননা এসকল বিভক্তি ও মতপার্থক্য দুর্বলতার চিহ্ন।

তাই বিজয়ী দলের বৈশিষ্ট্য হ’ল, যারা সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা কামনা করে, তারা আধুনিক যুগের জন্য প্রযোজ্য সেই বক্তব্যটিকে অনুসরণ করবে, যা একজন দাঈ উল্লেখ করেছিলেন, যদিও তাঁর অনুসারীরা তা অনুসরণ করে না। সে বক্তব্যটি হ’ল, ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা কর, তবেই তোমাদের রাষ্ট্রে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করবে’।

কিন্তু বাস্তবতায় আমরা যা দেখছি এসব ইসলামপন্থী সংগঠনের অধিকাংশই এই সংস্কার ও প্রশিক্ষণ নীতিকে সামনে রাখছেন না। এখনও তারা ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট অনৈসলামিক আক্বীদা, ইবাদাত, আখলাকগত ক্রটিগুলো সংস্কারে উদ্যোগী হচ্ছেন না। যারা নিজেদের ক্রটিগুলো সংস্কারেই আন্তরিক নন, সেখানে অন্যদের সংস্কারে কি পদক্ষেপ নিবেন! কোথায় রয়েছে শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এসব সংগঠনের সংস্কার ও সংশোধন নীতি বাস্তবায়ন কর্মসূচি?

সুতরাং আমি বলব, বিস্তারিত আলোচনার পর এটা সুস্পষ্ট যে, যে নীতি উল্লেখ করেছিলাম পূর্বেই অর্থাৎ ‘বাতিলের উপর যা প্রতিষ্ঠিত, তা নিজেও বাতিল’, তারই বাস্তবতা লক্ষ্য করছি আমরা বিভিন্ন দেশে। আমাদের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার যে, আলজেরিয়া, মিসরসহ বিভিন্ন দেশে যা ঘটছে তা পূর্ববর্তী ঘটনা পরম্পরারই ফলশ্রুতি এবং সেইসাথে উদ্দেশ্য ও পদ্ধতিতে শারঈ নীতিমালা লংঘনের দুঃখজনক পরিণাম।

সপ্তমতঃ আমরা জানি ন্যায়বিচারক ও প্রজ্ঞাবান শরী‘আত প্রণেতা যুদ্ধের ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা বেঁধে দিয়েছেন। যেমন প্রথম যুগের মুসলিম যোদ্ধাদেরকে মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়ের পাদ্রী, পুরোহিতদেরকেও আক্রমণ করতে নিষেধ করা হয়েছিল (আহমাদ হা/২৭২৮)। যদিও তারা শিরকে লিপ্ত এবং পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত; তবুও শরী‘আত প্রণেতা মুসলিম যোদ্ধাদেরকে নিষেধ করেছিলেন ইসলামের একটি নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য। তাহ’ল আল্লাহ বলেন, … কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না’। ‘আর মানুষ তাই পায় যা সে চেষ্টা করে’ (নাজম ৫৩/৩৮–৩৯)।

এই আয়াত থেকে আমরা দু’টি ইঙ্গিত পাই। একটি হ’ল কোন নারীকে হত্যা করা যাবে না, কেননা সে যুদ্ধ করে না। অপরটি হ’ল যদি সে পুরুষদের সাথে যুদ্ধে শরীক হয়, তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে। এর ভিত্তিতে এখন যদি প্রশ্ন আসে যে, যারা টাইমবোমা বা গাড়িবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং এই বিস্ফোরণের ফলে এমন কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হয়, যে মূলতঃ শারঈ বিধান মোতাবেক দায়ী নয়; তাহ’লে কিভাবে এই কাজ ইসলামে জায়েয হতে পারে?

আমি তো বলব, এটা কেবল মূল ঘটনার একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তার চেয়ে বেশী ধ্বংসাত্মক ঘটনা ছিল কয়েকবছর পূর্বে সংঘটিত সেই বিদ্রোহ। যেই বিদ্রোহ কেবল খারাপ প্রতিক্রিয়াই বয়ে আনছে ক্রমাগতভাবে। এজন্য আমরা বলি, সকল কাজ তার শেষ পরিণতির উপর নির্ভর করে। আর শেষ পরিণতি কখনই ভাল হয় না যতক্ষণ না তা প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামের উপর। সুতরাং যার ভিত্তিই হ’ল ইসলামবিরোধী, তা অচিরেই অনিষ্টকারিতা আর ধ্বংসের বার্তা বয়ে আনতে বাধ্য’ (সংক্ষেপায়িত)।

বিষয়: বিবিধ

১০৩২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

357850
২৮ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ১২:২৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : এটা অনেকটাই বদ্ধ ও চিন্তার মতামত। বিশেষ করে আলজেরিয়া ও মিসর প্রসঙ্গে যা বলাহয়েছে প্রকৃত অবস্থা তা নয়।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File