একজন শিক্ষকের কান ধরে উঠবস! রাজনীতির ভেতর পলিটিক্স? না পলিটিক্সের ভেতর রাজনীতি?
লিখেছেন লিখেছেন আজাদ আরিফ ১৮ মে, ২০১৬, ১২:২৪:১৮ রাত
আমাদের রাজনীতিতে বহুল আলোচিত, সমালোচিত একটি নাম- 'নারায়নগঞ্জ'।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারায়নগঞ্জকে বিখ্যাত করে তোলার নেপথ্যে যে পরিবারের ভূমিকা রয়েছে সর্বাগ্রে, তা হোলো- 'ওসমান পরিবার'।
এই ওসমান পরিবারের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তি, সাংসদ সদস্য শামীম ওসমানের মতে, বাঙালির 'বঙ্গভঙ্গ' থেকে শুরু করে প্রাণের 'মুক্তিযুদ্ধ' পর্যন্ত যে দলের নামটিই সবার আগে আসে, সেই 'আওয়ামিলীগের' জন্মই হয় নারায়নগঞ্জে শামীম ওসমানদের পৈত্রিক বাড়িতে।
যদিও এটি একটি বিতর্কিত ইতিহাস।শামীম ওসমানের প্রচার করা এই ইতিহাসকে নাকচ করে ভূয়া বলে দাবি করেন স্বয়ং নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশানের মেয়র, নারায়নগঞ্জের আরেক বলিষ্ঠ আওয়ামীলীগ নেত্রী ' ড. সেলিনা হায়াৎ আইভি'।
শামীম ওসমানের দাবি করা এই ইতিহাস সত্য হোক অথবা মিথ্যা, আওয়ামিলীগের সাথে যে ওসমান পরিবারের একটি 'নাড়ির টান' রয়েছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
এইজন্যেই নারায়নগঞ্জে 'সাত খুন' হত্যাকান্ডে ওসমান পরিবার যখন সমালোচনার তীরে জর্জরিত, তখন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, 'যাহাই হউক, আমরা ওসমান পরিবারের পাশে আছি।'
সমসাময়িক বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'নারায়নগঞ্জ' এবং 'ওসমান পরিবার' সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয় 'ত্বকী হত্যাকান্ড' এবং চাঞ্চল্যকর 'সাতখুন' ঘটনায়।
সেই নারায়নগঞ্জ এবং ওসমান পরিবারকে আবারো জাতির সামনে নিয়ে এসেছে নতুন আরেকটি ঘটনা।
সেটি হোলো,- নারায়নগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ায় নারায়নগঞ্জ ৫ নং আসনের সাংসদ সদস্য, এমপি সেলিম ওসমানের নির্দেশে কানধরে উঠবস করানোর ঘটনা।
'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' এই টার্মটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় রকমের ট্রামকার্ড বলা চলে।
বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ রাজনীতির ব্যাপারে তেমন কনসার্ন না হলেও, ধর্মের ব্যাপারে তারা খুবই কনসার্ন।
বাংলাদেশ যেহেতু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, তাই এদেশের ধার্মিক মুসলমানরা আর যাই হোক, ধর্মকে কটুক্তি, আল্লাহ-রাসূল নিয়ে কটুক্তি এসব সহ্য করতে পারেনা।
দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর 'সহ্য করতে না পারা'র মতো এই সরলতাকে,ধর্মীয় আবেগকে তাই ট্রামকার্ড বানিয়ে একশ্রেণীর রাজনিতীবিদদের নোংরা রাজনীতি করতে প্রায়ই দেখা যায়।
রাজধানীতে 'মিল্কি' হত্যাকান্ডের ঘটনায় খুনী,দলীয় ক্যাডারদের গায়ে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, এবং ব্লগার হত্যার সময় 'আল্লাহু আকবার' শ্লোগান দেওয়া সহ এরকম বিভিন্ন ঘটনাই যার প্রমান।
আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ রাজনীতি নিয়ে ভাবেনা কিংবা ভাবতে চায়না বলেই অপরাধীরা অপরাধ করে তাদের অপরাধ ঢাকতে 'ধর্মীয় অনুভূতির' ধোঁয়া তুলে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলে।
নারায়নগঞ্জে শিক্ষক কমল কান্তি ভক্তের সাথেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে।
যেহেতু শিক্ষক কমল কান্তি ধর্মীয় দিক থেকে একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের, তাই তার বিরুদ্ধ্যে এরকম একটি গুজব ছড়াতে পারলে তা হবে পুরোপুরিই বাজিমাত।
সাধারন মানুষকে তার বিরুদ্ধ্যে এরকম কিছু বলে ফুঁসলিয়ে দেওয়া গেলেই হোলো, বাকি কাজটা তারাই করে নেবে।
আগেই বলেছি,আমাদের সাধারন মধ্যবিত্ত সমাজের রাজনীতি নিয়ে ভাবনা কম, তাই ঘটনার 'বিহাইন্ড দ্য ষ্টেজে' যে রাজনীতি লুকিয়ে আছে তা
তারা ধরতে পারেনা।
এই ঘটনার সূত্রপাত স্কুলের দশম শ্রেণীর একজন ছাত্রকে মারধরের মাধ্যমে।
বলা হোলো - 'প্রধান শিক্ষক কমল কান্তি ধর্মীয় বিদ্বেষ বশঃত রিফাত নামের ছেলেটিকে মারধর করেছেন।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটার নেপথ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছিলো, নাকি ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্য ছিলো সেই ব্যাপারে সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়, যখন আমরা জানতে পারি, শিক্ষক কমল কান্তিকে বিশেষ বৈঠক আছে বলে শুক্রবারে স্কুলে তলব করা হয়।
বৈঠকের কথা শুনে কমল কান্তি স্কুলে প্রবেশ করলে সাথে সাথে স্কুলের গেইটে তালা লাগিয়ে, মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে স্থানীয় পাবলিক জড়ো করা হয়।এরপর উনাকে মারধর এবং কানে ধরে উঠবস করানো হয়।
ঘটনার বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে আমরা বলে রাখি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়েই একজন শিক্ষককে মারধর এবং কানে ধরে উঠবস করানো কখনোই কাম্য নয়।
একজন শিক্ষক হচ্ছেন জাতি গড়ার কারিগর।এরকম মহান পেশার দায়িত্ব পালনকারী একজনের বিরুদ্ধ্যে শোনা অভিযোগেই তার বিরুদ্ধ্যে এতটা কঠোর অবস্থান অন্যায় তো বটেই, রীতিমত লজ্জাজনক।
যদি ধরে নিই যে, কমল কান্তি সত্যিই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন,
তাহলে তো দেশে আইন-আদালত আছে।আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করেই এরকম হার্ড লাইনে এসে একজন শিক্ষককে এই ধাচের অপমান করাটা পুরো জাতির জন্যই অপমানজনক।
যদি দেশের আইন-আদালত এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হতো, তাহলে এ ব্যাপারে কি করা যেতো, তা সময়ই বলে দিতো।কিন্তু ঠুনকো এবং শুধু শোনা অভিযোগেই একজন শিক্ষককে এরকম মারধর এবং কানধরে উঠবস করিয়ে হয়রানি করানোটা প্রমান করে দেয়, মন-মানসিকতায় আমরা ঠিক কতোটা নীচ আর অসভ্য।
ঘটনার পেছনের ঘটনা আমাদের চোখে সবসময় আড়ালে রয়ে যায়।
শিক্ষক কমল কান্তির বিরুদ্ধ্যে এই প্রপাগান্ডা কোন ধর্মীয় বিদ্বেষ বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য নয়,
এটা পুরোপুরিই ব্যক্তিগত। আরেকটু ভিন্নভাবে বললে বলা যায়,- এর পেছনে রয়েছে একটি চক্রান্ত।আর এই চক্রান্তকে ডিফেন্ড করা হচ্ছে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' বলে।
আমরা শিক্ষক কমল কান্তির মুখ থেকেই জানতে পারি, নারায়নগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উনি স্কুলটার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আছেন।তিনি নিজ হাতেই স্কুলটাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন।
কয়েকমাস আগে তিনি নিজ উদ্যোগেই স্কুলে একটি 'ম্যানেজিং কমিটি' গঠন করেন।
কিন্তু নিজের গড়া এই ম্যানেজিং কমিটিই তাঁর জন্য সাপে বর হয়।
খোদ সেই ম্যানেজিং কমিটি থেকেই তাঁকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার গুঞ্জন উঠে।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামের বোন পারভীন আক্তারকে প্রধান শিক্ষক করার দাবি তুলে কয়েকজন।
খোদ কমিটির তিনজন সদস্য কমল কান্তির বিরুদ্ধ্যে ষড়যন্ত্রে উঠেপড়ে লাগে।
কমল কান্তি খুবই পরিশ্রমী এবং ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক।তাঁকে তাঁর জায়গা থেকে সরাতে হলে চাই এমন সেন্সেটিভ ইস্যু, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাই সহজেই লুপে নিবে।
করাও হোলো তাই। তাঁকে এমন মারপ্যাঁচে ফেলানো হয়েছে, মধ্যবিত্ত বাঙালি তা না গিলে যাবে কই?
যারা এই ব্যাপারে আমার সাথে অদ্যাবধি একমত হতে পারছেন না, তাদের জ্ঞাতার্থে একটি সংবাদ- এই ঘটনার জের ধরে পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের প্রধান শিক্ষক কমল কান্তি ভক্তকে 'সাময়িক' বরখাস্ত করা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদে বসানো হয়েছে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামের বোন পারভীন আক্তারকে।
বুঝতে পারছেন ঘটনা? কমল কান্তিকে আপাতত 'সাময়িক' সময়ের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে।
আর, বাঙালির 'সাময়িক' সময়ের ডিউরেশান যে ঠিক কতো মিলি সেকেন্ড, তা আমার দেশ,দিগন্ত টিভি আর ইসলামিক টিভি সাময়িক বন্ধের ঘটনা থেকেই আঁচ করার চেষ্টা করুন।
শিক্ষক অপদস্থ হওয়ার ঘটনা এটাই বাংলাদেশে প্রথম নয়।মোষ্ট প্রবাবলি, শেষও না।
স্যার কমল কান্তির প্রতি যথাযোগ্য সম্মান রেখেই এদেশের সুশীল আর তাদের লেজুড়বৃত্তি করা মিডিয়ার কাছে প্রশ্ন- যখন এদেশের শিক্ষকদের আন্দোলনে পেপার স্প্রে মারা হয়,মরিচের গুড়োর পানি মারা হয় তাদের চোখে-মুখে,
যখন বুয়েটের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম স্যারকে লীগের ক্যাডারেরা সবার সামনে অপদস্থ করে, তখন আপনাদের বিবেক নাড়া দেয়না?
কমল কান্তিকে কানে ধরে উঠবস করালে যদি পরোক্ষভাবে পুরো বাংলাদেশই কানে ধরে উঠবস করে,
অন্যদের বেলায় কেনো তা হবেনা? কেন শিক্ষকদের দিকে পেপার স্প্রে ছুঁড়ে মারলে তা পুরো জাতির দিকেই ছুঁড়ে মারা হয়না?
কেন বুয়েটের জাহাঙ্গীর আলম স্যারেরা অপমানিত হলে পুরো বাংলাদেশ অপমানিত হবেনা?
সত্য প্রচারের ইজারা নিয়ে বসে থাকা এবং ন্যায়-নীতির শ্লোগান কপচানো এসব মেইনষ্ট্রিম মিডিয়া এবং আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ যখন জাহাঙ্গীর আলমদের সাথে হওয়া অপরাধগুলোতে অপরাধীদের মাথার উপর শেলটার দিয়ে তাদেরকে বারবার বাঁচিয়ে নেয়,তখন সেসব অপরাধীরা বেপরোয়া হতে হতে শেষমেশ কমল কান্তিদের ঘাঁড় মটকায়।
ঠিক ওই মিথ্যেবাদী রাখাল এবং বাঘের গল্পের মতোই।
বাঘ বাঘ বলে ছেলেটা সারাদিন চিল্লাতো আর সবাইকে বোকা বানিয়ে অপদস্থ করতো।কিন্তু যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ চলে এলো এবং রাখালের ঘাড় মটকালো, তখন আর কারো কিছুই করার থাকলো না।
স্যার কমল কান্তির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় যে ব্যাপারটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক বলে মনে হয়েছে, তা হোলো এম.পি সেলিম ওসমানের ভূমিকা এবং বক্তব্য।
আওয়ামিলীগ যে বরাবরই 'ধার্মিক' এবং একই সাথে 'সেক্যুলার' একটি দল, তার আরো একবার প্রমাণ পেলাম।
কমল কান্তিকে কানে ধরে উঠবস করিয়েছিলো নারায়নগঞ্জের ৫ আসনের এম.পি, সাংসদ সদস্য সেলিম ওসমান।
তাঁকে যখন এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হোলো, তিনি বললেন,- 'তাঁকে (স্যার কমল কান্তিকে) জনরোষ এবং প্রাণে বাঁচাতে কানে ধরে উঠবস করিয়েছি।'
এরকম একটি কথা বলে উনি একই সঙ্গে দুইটি পক্ষকেই তুষ্ট করেছেন।
প্রথমত, হিন্দু এবং বাম ঘরানার লোকেরা ভাবছে, আহা! সত্যিই তো! এম.পি সাহেব না থাকলে হয়তো মৌলবাদি মুসলমানেরা কমল কান্তি ভক্তের গলা কেটে নিয়ে উল্লাস মিছিল করতো।তারচেয়ে কানধরে উঠবস করিয়ে তিনি উনাকে হয়তো এ যাত্রায় প্রাণেই বাঁচিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, তাৎক্ষণিকভাবে কমল কান্তিকে কানে ধরে উঠবস করিয়ে তিনি জনসম্মুখে প্রমাণ করতে চাইলেন,- 'তুমি বাপু যেই হও, ধর্ম নিয়া কটু কথা বললে কিন্তু ছাড় নাই,হুম।'
অথচ, আমাদের কে বোঝাবে যে, এই আওয়ামিলীগের খেয়ে-পরে বাঁচা লতিফ সিদ্দীকিরা হজ্ব নিয়ে কটুক্তি করে, আবদুল গাফফার চৌধুরিরা সাহাবি হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কে শয়তানের বাপ বলে,
ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক আজানকে 'শব্দদূষণ' বললেও, সেলিম ওসমান গংদের ধর্মীয় অনুভূতিতে তখন আঘাত লাগেনা।
এই রাজনীতি যতদিন না বাঙালি বুঝবে, ততদিন বিপদ কাটবেনা।
তাই, 'তাকে (কমল কান্তিকে) জনরোষের কবল থেকে বাঁচাতে জনসম্মুখে কান ধরে উঠবস করিয়েছি'- এরকম বক্তব্য শোনার পর গুরু সেলিম ওসমানের কাছে আমার খুব করে জানতে ইচ্ছে করে, 'স্যার, রাজনীতির ভেতর পলিটক্স ঢুকাইলেন, নাকি পলিটক্সের ভেতর রাজনীতি?'
বিষয়: রাজনীতি
১৪২৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন