তনু হত্যাকান্ড, নেপথ্যে কি সেনাবাহিনী? কিছু সংশয় এবং প্রশ্নঃ

লিখেছেন লিখেছেন আজাদ আরিফ ২৫ মার্চ, ২০১৬, ০৮:৪৪:৪৪ রাত

অনেকের মতো প্রথমে আমারও ধারনা হয়েছিলো তনুকে ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ডের সাথে সেনাবাহিনীই জড়িত।

এইরকম ধারনা জন্মাবার পেছনে কয়েকটি কারন অবশ্য আছে।

১) তনুর লাশ যেখানে পাওয়া গিয়েছিলো, এলাকাটি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পভুক্ত।এরকম একটি 'নিশ্চিদ্র' এবং 'মোষ্ট সিকিউরড' এলাকায় সাধারন জনগনের অবাধ যাতায়াতের কথা না।সেখানে বাইরের কেউ প্রবেশ করতে চাইলে, তাকে যথাযথ কারন, নাম,ঠিকানা,পেশা এবং পরিচিত কোন আর্মি অফিসারের বরাত দিয়েই প্রবেশ করতে হবে।সেখানে যখন এরকম একটি ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলো, সন্দেহের তীর সেনাবাহিনীর দিকে যাওয়াই স্বাভাবিক।

২) তনুর ভাই তার খালাতো বোনের বরাত দিয়ে বলেছে, 'কোন এক আর্মি অফিসার তনুকে বিরক্ত করতো।'

এখান থেকে কিছুটা সন্দেহ আসছে যে, এই ঘটনার পেছনে সেই সেনা কর্মকর্তা জড়িত নয় তো?

৩) তনুর হত্যাকান্ডটি ঘটেছে সেনানিবাসস্থ এলাকায়।কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় সেনাবাহিনীর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।তাদের নীরবতা তাহলে কি প্রমান করে?

৪) তনুকে ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ড নিয়ে দেশের মেইনষ্ট্রিম প্রিন্ট মিডিয়া নীরব কেন? তারা কাদের অপরাধ ঢাকতে চায়?

উপরোক্ত সন্দেহগুলো থেকে এই ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ডটি নিয়ে সেনাবাহিনীর দিকে আঙুল উঠা স্বাভাবিক।

তবে,সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করার আগে আমি মনে করি আমাদের আরেকটু ভাবার যথেষ্ট দরকার আছে।

দরকার আছে, কারন-

১) দেশের অন্যান্য সেনানিবাস আর কুমিল্লা সেনানিবাসের মধ্যে একটি বেসিক পার্থক্য আছে।

পার্থক্যটি হোলো, - দেশের অন্যান্য সেনানিবাসগুলোতে প্রাইভেসি যতোটা জোরালো, কুমিল্লা সেনানিবাসে তারচেয়ে কিছুটা দূর্বল। কারন, এটির ভৌগলিক অবস্থানের কারনেই এটা সম্ভব না।কুমিল্লা সেনানিবাসের গা ঘেঁষেই অনেক পাবলিক স্থাপনা, দোকান-পাট, বাজার ইত্যাদি রয়েছে।

এমনকি, কুমিল্লা সেনানিবাসের বুক ছিড়েই চলে গেছে 'ঢাকা-চিটাগং' এবং 'সিলেট-চিটাগং' মহাসড়ক।

স্বাভাবিক কারনেই, দেশের অন্যান্য সেনানিবাসের চেয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে সাধারন জনগনের অবাধ যাতায়াত কিছুটা নয়, বরং অন্যগুলোর তুলনায় অনেক পরিমানেই বেশি।

এখন, যে সেনানিবাসে এরকম সাধারন জনগনের অবাধ যাতায়াতের বাঁধাদানে কিছুটা শীথিলতা অবলম্বন করা হয়, সেখানে একটি ধর্ষণ এবং হত্যার দায় আমরা একচেটিয়াভাবে সেনাবাহিনীর উপর চাপিয়ে দিতে পারিনা।

২) তনুর খালাতো বোন বলেছে, এক সেনা কর্মকর্তা তনুকে বিরক্ত করতো।

তনুর খালাতো বোনের এরকম জবানবন্দি কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়।

কারন, তনুর বাবা নিজেও সেনানিবাসের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি।তারা থাকেও সেনানিবাসের মধ্যে একটি টিন-শেড ঘরে।এমতাবস্থায়, কোন সেনা কর্মকর্তা যদি কখনো তনুকে বিরক্ত করতো,তাহলে ব্যাপারটি তনু নিশ্চয় কোন না কোন সময় তার বাবাকে জানাতো।আর তার বাবাও নিশ্চয় ওই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করতো এবং এর রেকর্ডও থাকতো।কিন্তু এসবের কিছুই জানা যাচ্ছেনা। তাই, এই সময়ে বসে তার খালাতো বোন কি বলছে, তা কোনমতেই কাউকে দোষী বলার জন্য যথেষ্ট নয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তার বাবা হয়তো চাকরি যাবার ভয়ে ওই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নালিশ করার সাহস পায়নি।

তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত কোন চাকরিজীবীর (সে যে শ্রেণীরই হোক না কেন) চাকরি কোন সাধারন সেনা কর্মকর্তার মর্জি,ইচ্ছা,ভালো লাগা মন্দ লাগার উপর মোটেই নির্ভর করেনা। আর এই ব্যাপারটি তনুর বয়স্ক,অভিজ্ঞ পিতারও জানার কথা।

৩) তনুর ধর্ষণ এবং তদপরবর্তী ঘটনা নিয়ে এখনো কেনো সেনাবাহিনী নিশ্চুপ, সে ব্যাপারে অনেকেই সন্দেহ করছে।

যারা এই সন্দেহ করছে তারা হয়তো জানেনা যে, সামাজিক/গন যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আমাদের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি অন্যদের তুলনায় অনেক কম।

তারা এরকম কোন ঘটনার পর অফিসিয়াল বিবৃতি, শোক/দুঃখ প্রকাশ এসব করেনা।

আর, ঘটনা তদন্তের দায়ভার পুলিশ কাঁধে নিয়েছে।এমতাবস্থায় প্রমান ছাড়া আমরা কাউকেই গড়পড়তা হারে দোষী বলে চালিয়ে দিতে পারিনা।

যারা বলছে, 'সন্দেহের তীর যেহেতু তাদের দিকে',

আরে ভাঈ, সন্দেহের তীর তাদের দিকে এটি আমি আর আপনি ভাবছি।আমাদের ভাবনা কি ১০০ ভাগ সত্য? আর, আমরা যে সেনাবাহিনীর দিকে আঙুল তুলছি তা হয়তো তারা জানেও না।জানবেও না যতক্ষন পর্যন্ত মূলধারার মিডিয়া ঘটনাটা তাদের কাছে ওইভাবে না পৌঁছাবে।

এখন মিডিয়া তো আপনার বা আমার মতো আবেগপ্রবণ হয়ে সেনাবাহিনীকে দোষী বলে দিতে পারেনা। এরজন্য যথেষ্ট প্রমান চাই।

এবার একটু অন্যভাবে ভাবা যাকঃ

আচ্ছা, যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নিই যে, এই ঘটনায় সেনাবাহিনী জড়িত,

তাহলে, আপনি কি মনে করেন এরকম কিছু করার পর সেনাবাহিনী তনুর লাশটিকে এরকম ওপেন প্লেসে ফেলে রেখে যাবে?

এইটুকু কমনসেন্স কি সেনাবাহিনীর মতো এরকম উচ্চপদের সৈনিকদের নেই?

তনুর লাশ যে স্থানে পাওয়া যায়, তার একটু দূরেই তার কিছু ছেঁড়া চুল পাওয়া গেছে।

এখান থেকে বোঝা যায় যে, তাকে খুব নির্যাতন করেই ধর্ষণ করা হয়েছে।

এমতাবস্থায়, সেনাবাহিনীর মতো এরকম চৌকস সেনারা কি কোনভাবেই কোন এভিডেন্স আশ-পাশে রেখে যাবে? এত কাঁচা কাজ তারা করবে?

আচ্ছা, এখানে একটি 'পলিটিক্যাল গেইম' চলছে না তো?

দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভোল্ট থেকে টাকা লোপাটের ঘটনায় সরকার এমনিতেই বেকায়দায়।

গভর্নর বরখাস্ত হয়েছেন। সরকার বেশকিছু ইস্যু সামনে এনে এই ব্যাংক লোপাটের ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে।এরমধ্যে, বাংলাদেশে জিকা ভাইরাস সনাক্ত ইস্যু, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর রায়, কয়েকটি কলেজে হিজাব নিষিদ্ধ ইস্যু অন্যতম।

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের দুই বোলার তাসকিন আহমেদ এবং আরাফাত সানীকে ICC কর্তৃক হঠাৎ ব্যান ইস্যুও এর মধ্যে ধরা যায়।

কিন্তু কোন ইস্যুই ব্যাংক ডাকাতির ইস্যুটাকে ধামাচাপা দিতে পারেনি।তাই সরকারের দরকার ছিল এমন কোন রগরগা ইস্যু, যা সহজেই ব্যাংক ডাকাতির ইস্যু থেকে জনগনের চোখ সরিয়ে আনতে পারবে।

তাহলে কি তনুকে রাজনৈতিকভাবে বলি হতে হোলো? ভাবুন।

আরেকভাবেও ঘটনাটির একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়ঃ

কয়েকদিন আগে একটি গুঞ্জন উঠলো যে,

'দেশের সেনানিবাসগুলোকে সরকারি আইনের আওতায় আনার প্রস্তাব উঠেছে মন্ত্রীসভায়।'

এটি হোলো আমাদের সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি দলীয়করন করার পাঁয়তারা।

সেনানিবাসগুলোকে যদি সরকার তাদের আওতায় নিয়ে পরিচালনা করতে পারে, তাহলে কি ঘটবে ভাবতে পারছেন?

কিন্তু এই ব্যাপারে অন্য তিন বাহিনীর মতামত ভিন্ন ভিন্ন বলে ব্যাপারটি আপাতত ধামাচাপায় পড়ে গেছে।

এমতাবস্থায় সরকার যেকোন মূল্যে সেনাবাহিনীর ভিতর এরকম একটি ঘটনা ঘটিয়ে কি বোঝাতে চাইলো- 'সেনাবাহিনীর মধ্যে নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি হয়েছে।নিজেদের সুরক্ষা এবং রিজার্ভড এলাকায় জনগনের সুরক্ষার ব্যাপারেও তারা উদাসীন।তাই এই মুহূর্তে সেনানিবাসগুলো সরকারি আইনের আওতায় আনাটা জরুরি।'

সরকার কি সেনাবাহিনী কে তাদের কব্জায় নিয়ে নিতে এই গেইম খেলছে না?

আরেকটি ব্যাপার, এই ঘটনা আমাদের মেইনষ্ট্রিম প্রিন্ট মিডিয়া চেপে যাচ্ছে।

তারা কি আসলেই চেপে যাচ্ছে না তাদের চেপে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে, যাতে করে সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারন নাগরিকের এই সন্দেহ সংশয় চরমে উঠে ক্ষোভ এবং একটি অঘটন ঘটানো যায়, এজন্যে?

আমরা আরো খেয়াল করেছি, শাহবাগ এই ইস্যুতে আন্দোলনে নেমেছে।বিগত কয়েকটি বছরে শাহবাগ এবং এর হর্তা-কর্তাদের চিনতে আমাদের কি আর কিছু বাকি আছে?

আমরা তো জানি তারা কার ইশারায় চলে। নির্দিষ্ট মহলের ইশারা না পেলে যে তাদের চেতনা বিস্ফোরিত হয়না, এটা তো সর্বজনবিদিত।

তা নাহলে, এর আগের এরকম অনেক ইস্যুতে তারা আন্দোলনে এলোনা কেনো?

বিশ্বজিত ইস্যু, পুলিশ কর্তৃক সাধারন জনগনকে ভোগান্তির ইস্যু, পুলিশ কর্তৃক চা দোকানিকে পুঁড়িয়ে মারার ইস্যু, মন্ত্রী কর্তৃক মদ খেয়ে শিশুর পায়ে গুলি করা, ছাত্রলীগ-যুবলীগ দ্বারা হিন্দু গর্ভবতী মহিলার পেটে লাথি দিয়ে পেটের সন্তান খুন,ব্যাংক লোপাট, সুন্দরবন ইস্যু সহ অনেক

ইস্যুতে তারা টুঁ শব্দও করেনি।

এমনকি, শাহবাগি মহিলা কর্মী কৃষ্ণকলির বাসায় ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে কাজের মেয়ের ক্ষত-বিক্ষত লাশ।পুলিশ বলছে মেয়েটিকে ধর্ষন করে খুন করা হয়েছে।কিন্তু এটা নিয়ে শাহবাগিদের কোন সাড়াশব্দ নেই। কিছু বুঝছেন?

যেখানেই দেখবেন শাহবাগিরা কোন ইস্যু নিয়ে লাফাচ্ছে, তখনই বুঝে নিবেন- সামথিং হ্যাজ।

পরিশেষে তনু হত্যার সঠিক তদন্ত চাই।আসল অপরাধীদের কঠোরতম বিচার চাই।তনু যদি রাজনৈতিকভাবে বলির পাঁঠা হয়ে থাকে, এমন কুৎসিত রাজনীতির বিরুদ্ধে সকলের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান চাই।

বিষয়: রাজনীতি

১৭৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File