তনুর কাছে একটি খোলা চিঠি.....
লিখেছেন লিখেছেন আজাদ আরিফ ২৪ মার্চ, ২০১৬, ০১:১৫:২৬ দুপুর
আসলে আমি সোহাগিকে ভুলতে পারছিনা।
তার সুন্দর, অতিমানবী চেহারার মতো তার নাম দুটিও সুন্দর- 'তনু' আর 'সোহাগি'।
তার 'সোহাগি' নামটি নিশ্চয় তার বাবা রেখেছেন।
মধ্যবিত্ত বাবার উচ্চবিত্ত নাম।
তার নিষ্পাপ চেহারা,মায়া জাগানিয়া চাহনি।
ভরাট দুটি অক্ষিগোলকের মাঝখানে যেন অত্যন্ত সযত্নে দুটি মণি বসানো।
তার চোখের এই মণিদুটির সামনে দাঁড়ালে কারো আর আয়নার দরকার হবেনা।এখানেই যেকেউ দেখে নিতে পারে গোটা বিশ্বলোক।সৃষ্টির এক আদি রহস্যে হারিয়ে যাওয়া যায় এখানেই।
এই নিষ্পাপ অবয়বে কোন ভনিতা নেই।নেই কোন আত্মম্ভরিতা।
মায়া ভরা এই চোখ দুটো দেখলেই প্রেমে পড়ে যাওয়া যায়।
তনুকে আমি চিনতাম না।হয়তো কোনদিন চিনতেও পারতাম না।তাকে চিনেছি সেদিন, যেদিন তার বিধ্বস্ত,নিথর দেহখানা দেখেছি।
কিন্তু তাকে আমি এভাবে চিনতে চাইনি।পৃথিবীর কোন তনুকে আমি এভাবে চিনতে চাইনা।
সাদা গোলাপের মতো দাগহীন এই অবয়বে কেউ এভাবে হামলে পড়তে পারে?
আঁচড়ে দিতে পারে? নাহ! আমি এর বেশি কিছু ভাবতে পারিনা। কতোটা নৃশংস হলে এমন নিষ্কলঙ্ক দেহের উপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়?
'
সোহাগির চোখে-মুখে সোহাগ ছিলো।বাবা-মায়ের সোহাগ, ভাইয়ের সোহাগ,বোনের সোহাগ।সোহাগিদের ছিলোনা কেবল আর্থিক স্বচ্ছলতা।
সোহাগ দিয়ে তো আর পেট চলেনা।তাই সোহাগিকে পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশান করতে হতো।
টিউশান করে সে নিজে চলতো, হয়তো পরিবারকেও কিছু দিতো।কলেজ-ভার্সিটিতে পড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা যেভাবে চলে আর কি।
সেদিন টিউশান করে ফিরতে একটু দেরি হয়।অন্ধকার একটু গাঢ় হয়।চারপাশ একটু নীরব হয়।ঝিঁঝিঁ পোকারা হয়তো সবে ডাকতে শুরু করেছিলো।
কিন্তু সেই অন্ধকার যে তার জন্য কাল হবে, সেই রাত যে তার জন্য কালরাত্রি হবে, এটা কি সোহাগি জানতো?
'
তনু,
তুমি কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাসের ছাত্রী ছিলে।
আমি ইতিহাসের ছাত্র নই, তাই ইতিহাস তেমন জানিনা।
কিন্তু তোমার নিশ্চয় পড়া আছে ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল মার্চ মাসের কথা?
কি কাকতালীয় ব্যাপার দ্যাখো- এখনো মার্চ মাস চলছে।
সেই ভয়াল মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এদেশের লক্ষ তনুর ওপর।
তাদের বিষাক্ত বিষদাঁত কামড় বসিয়েছিলো তোমার মতো হাজারো তনুর গায়ে।তাদের দেহভোগ করে,সতীত্ব হরন করে যাওয়ার সময় বুটের আঘাতে থেঁতলে দিয়েছিলো তাদের চোখ,মুখ,স্তন।
তনু, তুমি ইতিহাস পড়েছো। কিন্তু ভেবেছো কি কখনো তোমার সাথে এই ইতিহাসের পুনঃরাবৃত্তি ঘটবে? ভাবোনি।
আমরাও ভাবিনা। কিন্তু আমরা এমন এক দেশে বাস করি,যেখানে এমন অনেক কিছুই হয় যা আমরা আদতে ভাবতে পারিনা।
ওরা তোমাকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গেছে।
তোমার শরীরের মধ্যে তারা রেখে গেছে বর্বরতার ছাপ।তোমার হাত,মুখ,স্তন থেঁতলে দিয়েছে।
এতটুকুতেই থেমে যায়নি ওরা।ওরা অতো সহজেই ক্ষ্যান্ত হয়নি।
শেষ মূহুর্তে কেটে দিয়ে গেছে তোমার কোকিল কন্ঠী গলাটা, যে গলা দিয়ে তুমি আবৃত্তি করতে 'তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা-
সখিনা বিবির কপাল পুঁড়লো
সিঁথির সিঁধুর মুছে গেলো হরিদাসীর।'
তনু, বোন আমার, শুধু সখিনা বিবির কপাল পুড়ে,হরিদাসীর সিঁথির সিঁধুরই মুছেনি, তোমার সতীত্ব আর প্রাণের বিনিময়েও এখনো এ দেশে স্বাধীনতা আসেনি।স্বাধীনতা থাকলে তুমি কেনো সেনানিবাসের মধ্যে ধর্ষিত হবে,বলো?
ওরা পুরুষ নয়। শিশ্মের নিচে একটি পুরুষদন্ড থাকলেই পুরুষ হয়না।
তবু ওদের আকৃতি পুরুষের মত দেখতে।তাই এই দায়ভার আমি মাথায় নিয়ে, পৃথিবীর সকল পুরুষের পক্ষ থেকে তোমার কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইছি তনু,- 'তুমি আমাদের ক্ষমা করো।'
বিষয়: বিবিধ
১৪০৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মধ্যবিত্ত বাবার উচ্চবিত্ত নাম।পৃথিবীর সকল পুরুষের পক্ষ থেকে তোমার কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইছি তনু-তুমি আমাদের সকলকে ক্ষমা করো। লেখাটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন