তমদ্দুন মজলিস, একজন গোলাম আজম এবং আমাদের ভাষা আন্দোলন
লিখেছেন লিখেছেন আজাদ আরিফ ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১০:৪৪:৩৫ সকাল
১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের একটি ক্লাশে একজন অধ্যাপক বাঙলায় লেকচার দিচ্ছেন। এমনটি ভাবতে পারছেন? ব্যাপারটি আপনার কাছে এখন যতোটি সহজ মনে হচ্ছে, ব্যাপারটি সেসময় মোটেই সহজ ছিলোনা।তখনকার সময়ে এটি ছিল একরকম দু:সাহসিক কাজ।সেই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছিলেন একজন অধ্যাপক। তার নাম আবুল কাশেম।তিনি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন।
তখন থেকেই আবুল কাশেম স্যার পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা 'বাঙলা' হবার স্বপ্ন দেখেন।
অধ্যাপক সাহেব জানতেন আর বিশ্বাস করতেন এই স্বপ্ন দূর্বার আন্দোলন ছাড়া পূরন হবার নয়।তাই, তখন তিনি বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা, আর পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতিত মুসলিমদের কথা বলার জন্য গড়ে তুলেন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। নাম- পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস'।
এই সংগঠনটিই ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ১৯৪৮ সালে বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যে প্রতিশ্রুতি পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন দিয়েছিলেন,১৯৫২ সালের ২৭ শে জানুয়ারিতে তিনি তা অস্বীকার করে বিশ্বাসঘাতকতা করলে, এর বিরুদ্ধে তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামি লীগ,যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ পূর্ব পাকিস্তানের অনেক সংগঠন দূর্বার আন্দোলনে ফেঁটে পড়ে।এসব আন্দোলনকে শক্ত হাতে পরিচালনা করেছিল আবুল কাশেম স্যারের সেই 'তমদ্দুন মজলিস'।
তাই, ৫২ কে যদি ৭১ এর পিতা বলা হয়, তাহলে 'তমদ্দুন মজলিস' হলো ৫২'র জনক।
তমদ্দুন মজলিস সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় লেখা আছে-
'তমদ্দুন মজলিস'- "১৯৪৭ সালে আবুল কাসেম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের ,(তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তান) একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি তুলে তমদ্দুন মজলিস বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু করে।''
.
ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধকে এখন ফিল্টারিত করে পুরোটাই সেক্যুলারিজেইশান করা হয়েছে।
এখনকার কথিত লেখক -বুদ্ধিজীবীকূল ভাষা আন্দোলনের কথা লিখতে গেলে প্রথমেই সালাম-রফিক-জব্বারদের বুলেটবিদ্ধ হবার কাহিনী দিয়ে শুরু করন।
এতে বাঙালি পাঠকসমাজ সহজেই আবেগপ্রবন হয়ে পড়ে।অথচ, যে সংগঠনটি না হলে ভাষা আন্দোলনই হতোনা, যেটি না হলে হয়তো আজকে উর্দূই হতো আমাদের মাতৃভাষা,সে 'তমদ্দুন মজলিস' এর কথা আমাদের লেখক-বুদ্ধিজীবিগন অত্যন্ত সচেতনভাবে এড়িয়ে যান।
কেন জানেন? কারন, যে সংগঠনটির হাত ধরেই হয়েছিল ভাষা আন্দোলন, সেই সংগঠনটি ছিল একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন।একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠনের হাত ধরে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, মাতৃভাষার দাবি অর্জিত হয়েছে এটি যদি প্রচার পায়, তখন তো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, ৫২'র ভাষা আন্দোলন নিয়ে চেতনার ফেরি করে বেড়ানো বাম আর সেক্যুলারদের তাহলে অবদান কি? তখন তারা কি জবাব দিবেন?এই ভয়ে তারা ভাষা আন্দোলন ইস্যুতে 'তমদ্দুন মজলিস' এর নাম ভয়েও মুখে আনেন না।কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস!! বাঙালি মুসলিম যুবকদের খুব ছোট্ট একটি অংশই এই 'তমদ্দুন মজলিস' সম্পর্কে জানে।অধিকাংশ হয়তো নামও কোনদিন শুনেনি।অথচ, বাঙালির সকল আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্বে ছিল মুসলমানরাই,যাদের ধর্ম ছিল ইসলাম,নবী ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা), আর ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন।কিন্ত তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল আর কৃতিত্বকে ফেরি করে ব্যবসা করছে বাম আর ধর্মনিরপেক্ষরা।
.
ভাষা আন্দোলনের সময় গোলাম আজম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ 'ডাকসু'র জি.এস ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের দাবি সম্বলিত যে ইশতেহার তৈরি করা হয়েছিল, যাতে লেখা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সকল মানুষের দাবি-দাওয়া, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলির সামনে পাঠ করে শোনান অধ্যাপক গোলাম আজম।মাথার উপর সমূহ বিপদের সম্ভাবনা নিয়েও গোলাম আজম সেদিন সেটি পাঠ করেছিলেন।এরজন্য পরে তাকে কারাবরন করতে হয়েছে।ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবার কারনে ১৯৫৫ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজের চাকরি হারান এবং আবার গ্রেফতার হোন।
গোলাম আজমের ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ততা নিয়ে 'তোয়াহা' নামের তৎকালীন একজন ছাত্রনেতা 'ঢাকা ডাইজেষ্ট' পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন- ‘‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলার স্বপক্ষে ইশতেহার বিলি করতে ছাত্ররা চকবাজারে জনতা কর্তৃক ঘেরাও হয়।তখন পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল ছিল। ছাত্ররা উত্তেজিত জনতার সামনে অসহায় অবস্থার সম্মুখীন। এসময় গোলাম আযম সাহস
করে এগিয়ে যান। তিনি চিৎকার করে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন,- 'আরে ভাই, আমরা কি বলতে চাই, তা একবার শুনবেন তো!'
এ বলেই তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কী উপকার হবে তার উপর
ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে উপস্থিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। পরিস্থিতি শান্ত হলো। গোলাম আযম সাহেব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরকেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর জি, এস, ছিলেন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন মেধাবী। স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন অমায়িক এবং ভদ্র। ভালো সার্কেলের ছাত্ররা যেমন পরষ্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে, তেমনি আমরা সহজাতভাবে একত্রিত হয়ে ভাষা আন্দোলনে কাজ করেছি।’’
হ্যাঁ, গোলাম আজম চান নি পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে আমরা ভারতের দাসে পরিণত হই।ভারত দ্বারা তিনপাশ থেকে ঘিরে থাকা এই দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই গোলাম আজম ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন।কিন্ত তিনি তো ভাষা আন্দোলনের একজন ত্যাগি কর্মী।এটি স্বীকার করে নিতে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বাঁধে কেনো?
যে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের (যেটা না হলে আজ বাংলাদেশ হতোনা) বিরোধিতা করেছিল,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল,
বলেছিল- 'চাষার জাতের বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার নেই',
সেই রবীন্দ্রনাথকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডক্টরেট দেওয়া হয়।তার রচিত গানকে জাতীয় সঙ্গীত করা হয়।কেনো?
রবি ঠাকুরের এই বাঙালি বিদ্বেষ কি আমাদের বুদ্ধিজীবিদের একটিবারের জন্যও ভাবায় না?
রবীন্দ্রনাথ তার আজীবন বাঙলা,বাঙালি বিদ্বেষের পরও যদি আজীবন বাঙালির হাতে পূজিত হতে পারে, গোলাম আজম ৭১ এ তার একটি সিদ্ধান্তের কারনে কেন আজীবন ঘৃণিত হবেন? উনি মুসলিম ছিলেন বলে? ইসলামি আন্দোলন করতেন বলে?
বিষয়: রাজনীতি
১৯৭১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তমুদ্দন মজলিশ এবং অধ্যক্ষ আবুল কাশেমই ভাষা আন্দোলন এর জন্মদাতা। আর তথাকথিত বাম রা প্রথমে এর বিপক্ষেই ছিল। কারন সোভিয়েট আদর্শ অনুসারে একটিই রাষ্ট্রভাষা গ্রহনিয় ছিল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন