মহাত্না ভ্যালেন্টাইন – মাহমুদুল হাসান
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১১:৪৬:৩০ সকাল
( যদি দিবস হতে হয় তাহলে ভালোবাসা দিবস নয় বরং শহীদ দিবস হওয়া উচিত। কারণ জুলিয়া ও ভ্যালেন্টাইনের সম্পর্কটা ছিল পিতা পুত্রি বা গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক নয়। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে যতদূর জানা সম্ভব হয়েছে তা আমি এই গল্পে সন্নিবেশ করার চেষ্টা করেছি, আশা করি গল্পটি পাঠে পাঠকরা ভ্যালেন্টাইন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণায় পৌঁছতে সক্ষম হবেন)।
রুমু উৎসব। মহামতি রুমুলুস নেকড়ের দুধ পান করে অসীম
শক্তি ও প্রজ্ঞার অধিকারী হয়েছিলেন। এই ক্ষমতা বলে তিনি রোম সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার স্মরণেই এই উৎসব। রুমোর বিশাল
মূর্তির বেদিমূলে কিছু ছাগল ও কুকুর বেঁধে রাখা হয়েছে। বেদির সামনে
হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সর্বাগ্রে শহরের অবিবাহিত যুবকরা
ছাগলের সামান্য চামড়া কোমরে পেঁচিয়ে কোনরকম লজ্জা নিবারণ করে খালি গায়ে
দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের মধ্যমনি হল এক যুবক, কাঁচা হলুদ
গাত্রবর্ণ, ঈগলের ঠোঁটের মত খাঁড়া সুচালো নাক, প্রশান্ত ডাগরাক্ষি দৃঢ়
ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক, চউড়া কাধ, আজানুলম্বিত বাহু, আয়রন পেটা শরীর, সব
মিলিয়ে সুন্দর সুপুরুষ। দেখেই বুঝা যায় পৃথিবীকে কিছু দেয়ার জন্য ও
কর্তৃত্ব করার জন্য যারা জন্মায় এই যুবক তাদের একজন। তার নাম ফিলিপ,
প্রধান সিপাহসালারের পুত্র। সে উপস্থিত যুবকদের নেতা।
সহসা জল্লাদ এসে এক কুপে ছাগল ও কুকুরগুলির গর্দান ফেলে দিতে লাগলো। বলির
কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে যুবকরা হুমরি খেয়ে পড়লো, ছাগল ও কুকুরের রক্ত
গায়ে মেখে চামড়া ছাড়ালো। তারপর কেউ কাঁচা চামড়া কোমরে পেছালো আর কেউ
বদলালো না আগের চামড়া পড়েই থাকল। কিন্তু সবাই চামড়া ফালি ফালি করে
কেটে দড়ির মতো পাকিয়ে চাবুক বানালো। তারপর শুরু হলো শোভাযাত্রা।
এই মিছিলের সামনে আছে বাহারি সাজে সজ্জিত নর্তকীর দল। তারা বাদ্যের তালে
তালে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে এগিয়ে যাচ্ছে। এদের পিছনে অর্ধ-উলঙ্গ
কুমার যুবকরা চামড়ার চাবুক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর নারী পুরুষ
যাকে সামনে পাচ্ছে বাড়ি মারছে। তাদের পিছনে হলো রোমান সাম্রাজ্যের উপর
তলা থেকে নিচ তলা পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষ। সুসভ্য রোমকরা জমকালো পোশাক
পরে মহান রুমুলুসের সম্মানে এই উৎসবে যোগ দিয়েছে। মিছিলের মধ্যে কিছুটা
অন্তর অন্তর নর্তকী ও ব্যান্ড পার্টি, তারা রুমুর নামে আকাশ মাটি
কাঁপিয়ে জয়ধ্বনী করতে করতে নেচে গেয়ে এগিয়ে চলেছে।
এই শোভাযাত্রার উপলক্ষ হলো কুমার যুবকরা। কারন রুমানদের বিশ্বাস- রুমুর
বেদিমূলে উৎসর্গিত ছাগল- কুকুরের রক্ত ও চামড়া পবিত্রতার প্রতীক। এই
রক্ত গায়ে মেখে ও চামড়ার চাবুক ধারণ করে যুবকরা পবিত্র হয়ে উঠেছে।
কাজেই তারা পবিত্র চাবুক দিয়ে বাড়ি দিলে বিবাহিতা মহিলাদের মনোবাঞ্ছা
পূর্ণ হবে। তারা উত্তমরূপে গর্ভধারণ করতে পারবে, সুসন্তান জন্ম দিতে
পারবে এবং বন্ধাদেরও বাচ্চা হবে। এজন্যই রুমু উৎসবের সময় মহিলারা
ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এসে দাড়ায় আর যুবকরা তাদেরকে চর্ম চাবুক দিয়ে
পিটিয়ে পিটিয়ে অগ্রসর হয়। এতে মহিলারা রক্তাক্ত হয়, গর্ভধারণের
উপযোগী হয়। এজন্যই চর্মচাবুক খাওয়া মহিলাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। আর
এখানেই এ উৎসবের সার্থকতা।
শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে, মহিলারা রাস্তার দু'পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর
যুবকরা মনের আনন্দে পিটিয়ে পিটিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। শুধু মহিলাই নয় সামনে
পুরুষ পেলেও তারা চাবুক চালায়, এতে পুরুষরাও নিজেকে ধন্য মনে করে। কারণ
পবিত্র চাবুকের বাড়ি খেলে দেহ মন পবিত্র হয়। শোভাযাত্রাটি নগরীর বিশাল
বিশাল সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার রুমোর মন্দিরের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো।
সেখানে ভুড়িভোজ, মদপান ও নারী পুরুষের সম্মিলিত নাচ গান শুরু হলো। এই
অনুষ্ঠান মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে, পরদিন হবে জুনু উৎসব।
রোমকদের বিশ্বাস ফেব্রুয়ারি হলো পাখিদের মিলন ঋতু। বছরের দ্বিতীয় মাসের
প্রথম সপ্তাহে পাখিরা সাথী খুঁজে বের করে, দ্বিতীয় সপ্তাহে বিয়ে করে,
তারপর চৌদ্দ তারিখে ডিম পাড়তে বসে। পাখিদের অনুসরণে সুসভ্য রোমকরা এ
দিনটিকে সাথী নির্বাচনের দিন হিসেবে ধার্য করে। কিন্তু দেব দেবীর
আশীর্বাদ ছাড়া তো শুধু নিজের ইচ্ছায় প্রেম- বিয়ে সার্থক হবে না। কাজেই
তারা গ্রীকদের অনুসরণ করল। গ্রিক সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের উপর রোমান সভ্যতা
গড়ে উঠেছে। কাজেই গ্রিকদের প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির ন্যায় রোমানরাও
প্রেম বিয়ের জন্য কোন দেবীর প্রয়োজন অনুভব করল। তারা জুনুকে প্রেম ও
বিয়ের দেবী হিসেবে মনোনীত করল। ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারা জুনু দেবীর সামনে
‘র্যা ফেল ড্র’ এর মাধ্যমে সঙ্গিনী নির্বাচনের পদ্ধতি চালু করল। এদিন
কুমারী যুবতীদেরকে লটারির মাধ্যমে যুবকদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়।
উৎসব উপলক্ষে এদিন সরকারি ছুটি থাকে, এ উৎসবকে লুপারকেলিয়া বলা হয়।
নগরীর একপ্রান্তে জুনু দেবীর মন্দির, সামনে বিশাল চত্ত্বর। সকাল থেকেই
যুবক-যুবতীরা রঙ বেরঙের জমকালো পোশাক পরে দলে দলে চত্বরে এসে জমা হচ্ছে।
চত্বরের দুই পাশে আসন পাতা, নিয়মানুসারে ছেলেরা ডান পাশে ও মেয়েরা বাম
পাশে অবস্থান গ্রহণ করল। শুরু হলো উৎসবের প্রথম পর্ব। মন্দিরের সামনে
বিশাল মঞ্চ করে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বসেছে। অবিবাহিত
মেয়েরা মঞ্চে যায় কর্তৃপক্ষ তাদের নামাঙ্কিত করে একটা করে কার্ড দেয়।
মেয়েরা নিজ নিজ নামাঙ্কিত কার্ড বিশেষ পদ্ধতিতে ভাঁজ করে- যাতে নামটা
দেখা না যায়। তারপর সামনে রাখা কাঁচের বড় একটা ঝারে নিয়ে ফেলে রাখে।
এভাবে নাম নিবন্ধনের কাজ শেষ হলে শুরু হয় লটারি। ছেলেরা একজন একজন করে
এসে ঝাড় থেকে একটা কার্ড তুলে কর্তৃপক্ষের সামনে টেবিলে রাখে। সঞ্চালক
কার্ডটা খুলে প্রার্থী যুবককে জানায় ‘তোমার ভাগ্যে অমুক মেয়ে। তারপর
পিয়ন কার্ডটা নিয়ে মেয়েদের মঞ্চের সামনে গিয়ে নির্ধারিত মেয়েকে ডেকে
এনে ছেলেটার হাতে তুলে দেয়। এখন তাদের কাজ হলো একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে
ঠোঁট চুম্বন। এই চুম্বনে যে যত বেশি সময় নিতে পারবে তাদের প্রেম তত
সার্থক বলে গণ্য হবে। কাজেই যুগলরা পাঁচ মিনিট থেকে আধা ঘন্টা পর্যন্ত এক
চুম্বনে কাটিয়ে দেয়।
এভাবে লটারি চলতে লাগলো। একসময় সিপাহসালার পুত্র ফিলিপের পালা এলো, সে
উঠে দাঁড়ালো। মেয়ে মঞ্চ থেকে একটা অপরূপ সুন্দরী যুবতী দাড়িয়ে হাত
নাড়ল, সে রাজপরিবারের মেয়ে। দীর্ঘ দিন ধরে তাদের মন দেয়া নেয়া চলছে
কিন্তু লটারিতে নাম আসছে না বলে বিয়ে হচ্ছে না। ফিলিপ সেদিকে তাকিয়ে
মুচকি হাসল কিন্তু পরক্ষণেই তার মুখটা কালো হয়ে গেল। কারণ লটারিতে যদি
আন্দ্রিয়ানোর নাম না আসে? গত দুই বছর মিস হয়েছে এবারও মিস হলে কি উপায়
হবে- সে আর চিন্তা করতে পারল না, বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে, হাত-পা
কাঁপছে। সে সোজা গিয়ে জুনুর মূর্তির পাদমূলে মস্তক স্থাপন করে প্রার্থনা
করল। তারপর কাঁচের ঝাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো। সে পাগলের মত জুনুর নাম জপ
করতে করতে ঝাড়ের মধ্যে হাত ঢুকালো কিন্তু খালি হাত ফিরিয়ে আনল। আবার
হাত দিল কিন্তু সাহস পাচ্ছে না, কাগজের উপর হাত বুলিয়ে ঘুরিয়ে আনলো।
কর্তৃপক্ষ তারা দিল এবার সে মরিয়া হয়ে ‘মাদার জুনু দয়া করো’ বলতে বলতে
হাত মারলো, কাগজগুলি উলটপালট করে একটা কার্ড চিমটি দিয়ে তুলে নিয়ে
কর্তৃপক্ষের সামনে রাখলো।
ফিলিপ আন্দ্রিয়ানোর প্রেমের কথা সবাই জানে। কার্ডটা খুলেই সঞ্চালক
চেঁচিয়ে উঠল ‘আন্দ্রিয়ানো। ফিলিপ দুই হাত ঊর্ধ্বে ছোড়ে মেরে ‘জয় মাতা
জুনু’ চিৎকার করতে করতে মেয়ে মঞ্চের দিকে দৌড়ল। আন্দ্রিয়ানো ফিলিপের
অবস্থা দেখে নিজেও লাফিয়ে উঠল, এক দৌড়ে গিয়ে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।
তারপর একে অন্যের ঠোঁট কামড়ে ধরলো, এক চুম্বনে কাটিয়ে দিল বিশ মিনিট।
ফিলিপ বলল, জুনুর অসীম দয়া। আন্দ্রো বলল ‘হা আমি প্রতিদিন তার মন্দিরে
অর্ঘ্য দিব।
এভাবে লটারির কাজ শেষ হলো, অবিবাহিত যুবক যুবতীরা সবাই যুগলবন্দী হয়ে
গেছে। এবার শুরু হবে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব। চত্বরের এক পাশে নৃত্য
মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, গায়ক ও বাদক দল মঞ্চের পাশে অবস্থান নিয়েছে। এখন
একেক যুগল আসবে আর নাচবে, সেই সাথে চলবে গান ও বাদ্য বাজনা। তবে এখানে
শুধু সম্ভ্রান্ত জুটিরাই নাচবে, সাধারণ পরিবারের যুবক-যুবতীদের নাচার
সুযোগ নাই তারা উন্মুক্ত নাচে অংশ নিতে পারবে। প্রথমেই রাজপরিবার থেকে
পরপর তিন যুগল এসে নাচল, তারপর আসলো ফিলিপ আন্দ্রিয়ানো জুটি। শুরু হলো
উদ্দাম নৃত্য, সেই সাথে কান ঝাঁ ঝাঁ করা গান ও বাদ্য বাজনা।
ফিলিপ জুটি প্রথমে কয়েক প্রকার দেশীয় নাচ দেখালো, তারপর বিদেশি নাচ, সব
শেষে শুরু করল চক্র নাচ। হঠাৎ ফিলিপ আন্দ্রোর সরু কোমরে হাত বাজিয়ে
শূন্যে তুলে ফেললো, আর আন্দ্রো তার কাঁধে হাত রাখল। এরপর সে আন্দ্রোকে
নিজের চারপাশে শূন্যে ঘোরাতে ঘোরাতে নিজে মঞ্চের চারপাশে ঘুরতে লাগল।
ঘুরছে, ঘুরছে, ফিলিপ মঞ্চের চারধারে ঘুরছে আর আন্দ্রোকে চরকার মত
ঘোরাচ্ছে, ঘূর্ণনের চোটে আন্দ্রোর হালকা-পাতলা কচি দেহটা ধনুকের মত বেঁকে
গেছে। দর্শকদের উল্লাস ধ্বনি উঠল আর তারাও ক্লান্ত হয়ে মঞ্চ ত্যাগ করল।
এরপর আরো কয়েক জুটি নাচানাচির পর শুরু হলো উন্মুক্ত নাচ।
তারপর শুরু হলো উৎসবের তৃতীয় পর্ব। এ পর্বে আছে খাওয়া-দাওয়া, মদপান,
নাচানাচি ও খেলাধুলা। মধ্যরাত পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান চলবে, এই হল
লুপারকালিয়া উৎসব। এই উৎসবের মাধ্যমে রোমান যুবতীদেরকে যুবকদের মধ্যে
বন্টন করা হয়, পরের বছর তারা প্রেম করবে লিভ টুগেদার করবে যদি পরস্পরকে
পছন্দ হয় তাহলে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হবে। আর যদি পছন্দ না হয় তাহলে পরের
বছর আবার লটারি দাও, না হলে আবার লটারিতে যেতে হবে। এভাবে সঙ্গী পছন্দ না
হওয়া পর্যন্ত হিন্দুদের মোক্ষ লাভের উদ্দেশ্যে পুনর্জন্মের ন্যায় একের পর
এক লটারিতে অংশগ্রহণ করতে হয়। কিন্তু লটারি ছাড়া নিজের পছন্দমত
ইচ্ছামাফিক কেউ বিয়ে করতে পারবে না। কারণ এ বিয়েতে দেবী জুনুর আশীর্বাদ
থাকবে না বিধায় এমন বিয়ের অনুমোদন নাই। এটাই সুসভ্য রোমানদের নিয়ম।
২৬৯ সাল, রুম শাসন করছে পৃথিবীর সবচেয়ে দাম্ভিক স্বেচ্ছাচারী স্বৈরাচারী
যুদ্ধবাজ দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। পৃথিবীটাকে সে বিস্তীর্ণ শিকার ক্ষেত্র মনে
করে, মানুষের প্রভুত্বের আসনটি তার জন্মগত অধিকার মনে করে। গ্রিক
আলেকজান্ডারকে মানুষ চির বিজেতা দিগ্বিজয়ী বীর হিসেবে গণ্য করে- এটা সে
সহ্য করতে পারে না। তার অভিপ্সা হলো মানুষ একমাত্র তাকেই শ্রেষ্ঠ বিজেতা
গণ্য করবে পূজা করবে। কাজেই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষকে পদানত করার জন্য সে
বিভিন্ন দিকে অভিযান প্রেরণ করল, পূর্ব পশ্চিম ও উত্তর সীমান্তে যুদ্ধের
ফ্রন্ট খুলে দিল। দেশের যুবকদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দিয়ে রণাঙ্গনে পাঠায়,
এভাবে সে যুদ্ধের আগুন প্রজ্জ্বলিত করল।
সেনা ব্যারাকে দীর্ঘদিন ধরে প্রশিক্ষণ চলছে। নতুন যুবকদের প্রশিক্ষণ
দিয়ে বিশাল এক ফৌজ গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের মধ্যে যোগ্যদেরকে কমান্ডার ও
সেনাপতি হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। এখন সম্রাট আনুষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে
ব্যাজ পরাবেন, তারপর তারা রণাঙ্গনে চলে যাবে। এদিকে গোলামদের নেতা
নির্বাচনের সময়ও উপস্থিত। কাজেই রুমের বিখ্যাত কলোসিয়ামে অনুষ্ঠানের
ব্যবস্থা করা হলো। নির্ধারিত দিনে কলোসিয়াম লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল,
গ্যালারির পঞ্চাশ হাজার আসন পুর্ন হয়ে উঠেছে। সম্রাটের আসন গ্রহণের
মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। সাধারণ সৈনিকদের কুচকাওয়াজের পর তাদের
বিদায় দেয়া হলো। এরপর সম্রাট নিজ হাতে কমান্ডার ও সেনাপতিদের ব্যাজ
পরিয়ে বিদায় দিলেন। তারপর শুরু হলো গোলামদের প্রতিযোগিতা, পৃথিবীর
সর্বকালের সবচেয়ে নিষ্ঠুর খেলা।
রোমকরা যুদ্ধবন্দীদের গোলাম হিসেবে ব্যবহার করতো। এসব গোলামদের কোন
মানবিক অধিকার ছিল না। রাতে এদেরকে গরু ছাগলের খোয়ারের মতো অন্ধকার
স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে গাদাগাদি করে রাখা হতো, সকালে শুকরের পালের মতো
তাড়িয়ে মাঠে নিয়ে সারাদিন কাজ করাত, রাতে আবার হাকিয়ে এনে খোঁয়াড়ে
তুলত। তাদেরকে ততটুকু খাদ্য দেওয়া হত যতোটুকুতে বেচারাদের হাড়ের খাচায়
প্রাণটা টিকে থাকতে পারে। তথাকথিত সুসভ্য রোমকরা এই গোলামদেরকে নিয়ে
ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠতো। তাদেরকে ক্ষুধার্ত সিংহ ও শিকারি কুকুরের
খাচায় ঢুকিয়ে দেওয়া হতো, বুভুক্ষু প্রাণীগুলি যখন তাদের দেহটা
ছিন্নভিন্ন করে ভক্ষন করত তখন তারা অট্টহাসিতে ফেটে পরত, খাঁচার চারপাশে
ঘোরে ঘোরে হাততালি দিয়ে নাচত। রোমানদের পৈশাচিকতার আরেক দৃষ্টান্ত হল
গোলামদের নেতা নির্বাচন পদ্ধতি। তারা শক্ত-সামর্থ্য কয়েকজন গোলামকে বেছে
নিয়ে প্রত্যেকের হাতে তলোয়ার দিয়ে একে অন্যকে হত্যার নির্দেশ দিত
কিন্তু আত্মরক্ষার্থে কোন ঢাল দিত না। তারপর গোলামরা একে অন্যকে মারতে
মারতে সর্বশেষ বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিকে তারা বীর হিসেবে ঘোষণা দিয়ে
পুরস্কার দিত এবং গোলামদের নেতা হিসেবে নির্বাচন করতো। কেউই খেলায় অংশ
নিতে অস্বীকার করলে তাকে সিংহের খাচায় নিক্ষেপ করা হতো।
খেলা শুরু হয়েছে। আগেই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দশজন গোলাম নির্বাচন করা
হয়েছে। তন্মধ্যে দুজনকে রেঞ্জে পাঠানো হল কিছুক্ষন তলোয়ার চালিয়ে একজন
নিহত হলো, তার লাশ সরিয়ে নেওয়া হলো। আসলো তৃতীয়জন, তার হাতে দ্বিতীয়
জন নিহত হলো। আসলো চতুর্থজন, সেও নিহত হলো। এবার এলো পঞ্চম গোলাম, তার
একটু পরিচয় অবশ্যক। সে আরব-বংশোদ্ভূত এক সর্দারের পুত্র, পারস্য বাহিনীর
একটা অংশের সেনাপতি ছিল। কিছুদিন পূর্বে বন্দি হয়ে আসে। চওড়া কাধ,
বলিষ্ঠ বাহু, পেটানো শরীর, সুন্দর সুঠাম শক্তিমান নওজোয়ান, নাম হাইসাম।
তার বীরত্বের খ্যাতি আছে, সবাই ভয় পায়। সে কোর্টে আসতেই প্রতিপক্ষ
কেঁপে উঠলো, ভয় ও আশংকায় আক্রমণ করে বসলো। হাইসাম আক্রমণ প্রতিহত করে
পাল্টা আক্রমণ করল পরক্ষণেই বিকট চিৎকার করে প্রতিপক্ষের দেহটা মাটিতে
গড়িয়ে পড়লো। লাশ সরিয়ে নেয়ার পর ষষ্ঠ প্রতিযোগী এল আর কিছুক্ষণের
মধ্যে তার দেহের রক্ত মাটি চুষে নিল। এল সপ্তম প্রতিযোগি, কিছুক্ষণ
টুকাটুকি করে তার শরীরের কয়েক জায়গায় কেটে গেল। হাইসাম চূড়ান্ত
আঘাতের জন্য তলোয়ার উত্তোলন করতেই সে দেবতার নাম নিয়ে মারলো ভুদৌড়।
খেলার পরিচালক সিপাহসালার পুত্র ফিলিপ, সে অষ্টম প্রতিযোগীকে ডাকলো। সাথে
সাথে সম্রাটের কাছে তার ডাক পড়লো সেখানে তার বাবাও বসে আছে। সম্রাট তাকে
দেখেই ধমকে উঠলেন ‘গোলামদের খেলার নিয়ম জানো না, কেউ রেঞ্জ থেকে জীবন
নিয়ে পালাবে না, এক প্রতিযোগী নিহত না হওয়া পর্যন্ত অন্য প্রতিযোগী
আসবে না। ফিলিপ মনে করেছিল রোমকরা যেমন ক্লান্ত বা জখম হয়ে গেলে
প্রতিযোগিতা ছেড়ে চলে যায় তদ্রুপ গোলামটাকেও মুক্তি দিয়ে দিবে কিন্তু
নিষ্ঠুর সম্রাটের জন্য তা আর সম্ভব হলো না। সে হুকুম দিল আর কয়েকজন
সৈন্য গোলামটাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে আসলো, হাইসাম তাকে বধ করল। কিন্তু
এবার সে প্রমাদ গুনল, কারন সামনের প্রতিযোগিরা ভয়ংকর, তার সমান অথবা তার
চেয়েও শক্তিশালী। এখন হয় কৌশলে টিকে থাকতে হবে অথবা জীবন দিতে হবে।
অষ্টম প্রতিযোগীর সাথে আধাঘন্টা জীবনপণ যুদ্ধের পর হাইসাম তাকে হত্যা করল
কিন্তু ততক্ষণে তার শরীর ফালা ফালা হয়ে গেছে, শরীর বেয়ে রক্ত মাটিতে
গড়িয়ে পড়ছে।
এবার আসলো নবম প্রতিযোগী, সেও কিছুক্ষণ টুকাটুকির পর নিহত হলো। সর্বশেষ
আসলো দশম প্রতিযোগী, সে সাইবেরিয়ান যুদ্ধা, যেমনি শক্তিশালী তেমনি
কুশলী। ক্লান্ত ও আহত হাইসাম বুঝল এবার কৌশল ছাড়া বাঁচতে পারবে না।
প্রতিপক্ষ সিংহ বিক্রমে আক্রমণ করল, হাইসাম শুধু প্রতিহত করে যাচ্ছে আর
সুযোগ বুঝে পোঁচ মারছে। এভাবে সে প্রতিপক্ষকে কাটতে লাগল আর নিজেও
ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো। অনেকক্ষণ পর সে প্রতিপক্ষকে পরপর দুইটা আঘাত
হানলো- একটা তলোয়ারে আরেকটা হাতে, হাতটা কেটে পড়ে গেল আর সাথে সাথে বুকে
তলোয়ার বসিয়ে দিল। প্রতিপক্ষ ঢলে পড়ল কিন্তু নিজেও ক্লান্ত হয়ে
মাটিতে বসে পড়ল। এভাবে নয় জনকে হত্যা করে হাইসাম বিজয়ী হলো। এই হলো
সুসভ্য জাতির গোলামদের নিয়ে খেলা ও নেতা নির্বাচন পদ্ধতি। ফিলিপ
হাইসামকে বিজয়ী ঘোষণা করল আর সম্রাট তাকে বিজয়ীর পুরুস্কার দিয়ে
গোলামদের সেনাপতি নিয়োগ করল। তারপর সবাই তাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠলো,
মদের ভাণ্ড উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। পরদিন এসব বাহিনীকে বিভিন্ন ফ্রন্টে
পাঠিয়ে দেয়া হলো।
২
উত্তর সীমান্তের কাটোয়া প্রান্তরে তুমুল যুদ্ধ চলছে। সহসা রোমক বাহিনীর
প্রচন্ড আক্রমণে প্রতিপক্ষ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল, কয়েক হাজার আহত-নিহত
সৈন্য ময়দানে ফেলে তারা পলায়ন করল, কিছু বন্দি হল। রোমান সৈন্যরা
নিজেদের আহত জওয়ানদের ঘোড়ার গাড়িতে তুলে দ্রুত চিকিৎসা ক্যাম্পে নিয়ে
গেল, সেখানে শত শত চিকিৎসক ও সেবিকারা কাজ করছে। আহতদের সরিয়ে নেয়ার পর
নিহতদের দাফনের ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু প্রতিপক্ষের হতভাগ্য সৈন্যরা
কারো সাহায্য পেল না। বিশাল রণক্ষেত্রে তাদের লাশগুলি বিক্ষিপ্ত হয়ে
পড়ে আছে, অনেকে আহত হয়ে মরণ যন্ত্রণায় গোঙ্গাচ্ছে কাতরাচ্ছে। এই
দুর্ভাগাদের চিকিৎসা দেওয়ার কেউ নেই। তখনই একজন মধ্যবয়সী চিকিৎসক
ত্রানকর্তার মত এগিয়ে এলেন। তার বারজন অনুসারীকে দ্রুত কাজে লাগালেন।
তিনি প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করছেন আর বাকিরা ব্যান্ডেজ ও ঔষধ খাওয়ানোর
কাজ করছে। তারা দ্রুত কাজ করছে, দেখতে দেখতে কয়েকশ আহতের চিকিৎসা হয়ে
গেল।
কিন্তু বিধিবাম। হঠাৎ কয়েকজন রুমান সৈন্য এসে বলল ‘ভ্যালেন্টাইন সেনাপতি
আপনাকে ডাকছেন দলবল নিয়ে চলুন। মহান ভ্যালেন্টাইনের মুখটা কালো হয়ে গেল
কিন্তু না গিয়ে উপায় নাই। সেনাপতি তাদেরকে দেখেই গর্জে উঠলেন ‘আপনি
রুমের বাসিন্দা হয়ে নিজের সৈন্যদের চিকিৎসা না করে শত্রুসৈন্যের চিকিৎসা
করছেন কোন সাহসে, আগেও আপনি এমন রাষ্ট্রদ্রোহি কাজ করেছেন। ভ্যালেন্টাইন
শান্ত স্বরে বললেন ‘আমি তো আমাদের সৈন্যদের চিকিৎসার জন্যই এসেছি কিন্তু
দেখলাম শত শত চিকিৎসক আছেন, আহতরা সবাই চিকিৎসা পাচ্ছে এখানে আর আমার
প্রয়োজন নাই। তখন ময়দানের দিকে আর্তনাদ শুনে সে দিকে এগিয়ে গেলাম,
তাদেরকে দেখে আমার মায়া হলো। আমি চিকিৎসক, মানবতার সেবাই আমার ধর্ম---
‘চুপ কর অবিশ্বাসী কাফের’ গর্জে উঠলো সেনাপতি ‘তোমার আবার ধর্ম আছে নাকি?
তুমি স্বধর্ম ত্যাগ করে রুমের খোদা জুপিটারকে অস্বীকার করে খ্রিস্টধর্ম
প্রচার করে বেড়াচ্ছ। তুমি ভাল চিকিৎসক বলে কয়েকজন অমাত্যের দয়ায় এখনো
বেঁচে আছ নইলে কবেই সম্রাট তোমার গর্দান উড়িয়ে দিতেন। যে চিকিৎসার
বদৌলতে রুমের মাটিতে এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছ সেই চিকিৎসা দিচ্ছ শত্রু
সৈন্যকে। তোমার দেহের উপর এখনো যে গর্দানটা আস্ত আছে সেটা তোমার জন্য
জুপিটারের আশীর্বাদ। যাও নিজের সৈন্যদের চিকিৎসা করোগে, এরপর আর কোনদিন
শত্রু সৈন্যের চিকিৎসা করলে গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হবে। মহান
ভ্যালেন্টাইন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ খ্রিস্টধর্ম প্রচারের
কারনে এমনিতেই তিনি রাজশক্তির বিরাগভাজন হয়ে আছেন এখন আবার শত্রুসৈন্যের
চিকিৎসা দিয়ে অন্যায় করেছেন। তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেলেন এবং রুম
সৈন্যদের চিকিৎসায় মনোযোগ দিলেন।
ভ্যালেন্টাইন হলেন অত্যন্ত দয়ালু, হৃদয় বান ও অমায়িক মানুষ, পরম যত্ন
ও ভালোবাসা দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করেন। কোন প্রকার লাভ লোভ ও প্রত্যাশা
ব্যতীত তিনি চিকিৎসা সেবা দেন, তার চিকিৎসায় সুস্থ হয়নি এমন দৃষ্টান্ত
খুব কম। এজন্য দেশ-বিদেশে তার সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি
বিভিন্ন ভেষজ সামগ্রী নিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসেন। একজন একজন করে রোগী আসে
আর ঔষধ নিয়ে যায়। কিন্তু গাছ গাছড়ায় তৈরি একটা ঔষধ কেউ নিতে চায় না,
কারণ এই ওষুধটা ভয়ানক তেতো, গলাধঃকরণ করা যায় না। অথচ এই ঔষধটাই হল
সবচেয়ে উপকারী, অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির মহৌষধ। অনেক চিন্তা ভাবনার পর
তিনি সহকারীদের বললেন ‘তোমরা ওয়াইন, দুধ ও মধু মিশ্রিত করে ঔষধটা
প্রস্তুত কর। এভাবে তৈরীর পর দেখা গেল ঔষধটা সুমিষ্ট হয়েছে।
ভ্যালেন্টাইনের আশ্রমে বারজন করে অনুসারী থাকে। ঈসা (আঃ) এর ন্যায় তিনিও
বারজন করে শিষ্য গ্রহণ করেন- এর কম বেশি নয়। তাদেরকে দিনের বেলা চিকিৎসা
পদ্ধতি শিক্ষা দেন ঔষধ তৈরির ফর্মুলা শিক্ষা দেন আর রাতের বেলা
খ্রিস্টধর্ম শিক্ষা দেন। এভাবে তিন মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে চিকিৎসা
ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দেন। আবার
বারজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো হয়, এভাবে চক্রাকারে চলতে থাকে। শিষ্যরা
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে আর চিকিৎসার আড়ালে খ্রিস্টধর্ম
প্রচারের কাজ চালিয়ে যায়।
রোমানরা ছিল পৌত্তলিক প্যাগান ধর্মের অনুসারী। তারা অসংখ্য দেব দেবীর
পূজা করত তন্মধ্যে প্রধান দেবতার নাম জুপিটার। রুমে অন্য কোন ধর্ম প্রচার
বা গ্রহন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। তবে ইহুদীরা তাদের সাথে আঁতাত করে
স্বধর্ম পালন করত আর মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করত। অভিশপ্ত
ইহুদীরা ঈসা (আঃ) এর ন্যায় নবদিক্ষিত মুসলমানদেরকেও রুমকদের হাতে ধরিয়ে
দিত। তখন তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে শুলে চড়িয়ে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা
হত। বস্তুত ঈসা (আঃ) এর পর থেকে সম্রাট কনস্টানটাইন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
পর্যন্ত তিন শত বছর ছিল মুসলমানদের জন্য চরম সংকট কাল। (কোরআনের ভাষায়
আদম থেকে মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত সব ধর্ম ইসলাম, অর্থাৎ ইসলামের
ক্রমোন্নতি ধাপ। কাজেই প্রত্যেক নবীর উম্মত মুসলমান)।
এসময় ইহুদিদের প্ররোচনায় রুমান শাসকরা তাদের উপর চালায় পৃথিবীর
নজিরবিহীন নির্যাতন। কুরআনে এমন অনেক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন
আসহাবে কাহাফ নামে একদল মুসলমান শাসকদের ভয়ে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন,
আসহাবে উখদুদ নামক একদল মুসলমানকে কুয়ায় আগুন প্রজ্জ্বলিত করে সেখানে
পুড়িয়ে মারা হয়। এজন্যই তখন ইসলাম প্রচারকগন অত্যন্ত গোপনে দাওয়াত ও
তাবলীগের কাজ করতেন। সঙ্গত কারণেই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন চিকিৎসার আড়ালে
ধর্ম প্রচারের কাজ করেন। প্রতি রবিবার তার আশ্রম থেকে তিন মাইল দূরে
পার্বত্য অঞ্চলের এক নিভৃত গুহায় মজলিস হয়, সেখানে নতুনদের ইসলামে
দীক্ষিত করা হয় এবং ইঞ্জিলের (বাইবেল) শিক্ষা দেওয়া হয়।
রবিবার বিকেলে এক শিষ্য কানে কানে বলল ‘ফাদার আজ আঠারজন বাপ্তিস্ম নিতে
আসছে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তিনজন শিষ্যকে ডেকে বললেন ‘তোমরা আশ্রম পাহারা
দিবে, কেউ আমাকে খুজতে এলে বলবে চিকিৎসার জন্য বাইরে গেছে। এটা মিথ্যা
বলা হবে না কারণ আমি আধ্যাত্মিক চিকিৎসা দিতে যাচ্ছি। তারপর বাকি
শিষ্যদের নিয়ে রওয়ানা হলেন। লোকালয় পেরিয়ে গহীন অরণ্য, কোন মনুষ্য
বসতি নাই রাস্তাঘাট নাই শুধু দু’পায়ে চলার মতো সংকীর্ণ পথ আছে। তারপর
মাইল খানেক পাথুরে ন্যাড়া পাহাড় পেরিয়ে সেই গুহা। গুহা সংরক্ষণ,
নওমুসলিমদের দেখবাল এবং প্যাগানদের উপর দৃষ্টি রাখার জন্য গুহার অদূরেই
লুসিয়াস নামক একজন মুসলমান রাখাল তার পরিবার ও মেষপাল নিয়ে থাকে।
ভ্যালেন্টাইন শিষ্যদের নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পেছনে দৃষ্টি রেখে
দুর্গম পথ পেরিয়ে রাতে গুহায় পৌঁছলেন। নতুন বাপ্তিস্ম গ্রহণের জন্য
আঠারজন লোক রাখালের বাড়িতে এসে অপেক্ষা করছে। তিনি তাদেরকে নিয়ে এক
মাইল দূরে নদীতে গিয়ে বাপ্তিস্ম দিলেন। তারপর তাদেরকে নিয়ে গুহায় ফিরে
এলেন।
গুহায় নতুন পুরাতন মিলিয়ে প্রায় ষাটজন লোক। একজন বলল ‘ফাদার রাতের
অন্ধকারে এই দুর্গম এলাকায় যাতায়াত করা আমাদের জন্য খুব কষ্টকর। তার
চেয়ে একটা গীর্জা তৈরি করে আমাদের শিক্ষা দীক্ষার ব্যবস্থা করেন। ফাদার
বললেন ‘একান্ত বোকার মত কথাটা বললে, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না আমাদের উপহার
কি বিভীষিকা বয়ে যাচ্ছে? নির্বিচারে আমাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে আগুনে
পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। এখন গির্জা নির্মাণের অর্থ হল নিজের খুরে নিজের কবর
খনন করা। ধৈর্য ধরো, একদিন পৃথিবীর কোনায় কোনায় গির্জা নির্মিত হবে
ইনশাআল্লাহ। তারপর তিনি নতুনদের উদ্দেশ্যে ওয়াজ নসিহত শুরু করলেন।
তিনি বললেন ‘রোমানদের শত শত দেবদেবী। কাঠ মাটি পাথর দিয়ে মানুষের হাতে
নির্মিত মূর্তি মানুষের কি কল্যাণ করতে পারে? বস্তুত দেব- দেবী বলতে কিছু
নেই, এসব শয়তানের কারসাজি। এ মহাবিশ্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ, তিনি
সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তিনিই মানব জীবনের কল্যাণ-অকল্যাণ ও জীবন-মৃত্যুর
মালিক। কাজেই আমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের জন্য আল্লাহর দাসত্ব
করতে হবে, যারা তাঁর দাসত্ব করবে না তাদেরকে তিনি শয়তানের সাথে
জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। যুগে যুগে মানুষ আল্লাহকে ভুলে গিয়ে দেবদেবীর
পূজা করেছে, তখন তাদের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ নবী রাসুল পাঠিয়েছেন কিতাব
পাঠিয়েছেন। তিনি আদম থেকে নিয়ে ইব্রাহিম, ইয়াকুব, ইউসুফ, মুসা (আঃ) সহ
অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরন করেছেন। সর্বশেষ ঈসা (আঃ) কে পাঠিয়েছেন ইঞ্জিল
শরীফ দিয়ে। এখন আমরা যদি তাকে অনুসরণ করি আর ইঞ্জিলের শিক্ষা মেনে চলি
তাহলে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবো আর পরকালে পাবো অসীম
নিয়ামত, সেই সাথে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করব।
তবে শুধু নিজে বাঁচলে চলবে না সমগ্র মানবজাতিকে মূর্তিপূজা ও শয়তানের
দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনতে হবে। ঈসা বলেছেন
তোমরা আমার বার্তা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দাও। কাজেই আমরা যারা উপস্থিত আছি সবাই
ইসলামের দাওয়াত দিব। প্রথমে নিজের পরিবার, তারপর নিকটাত্মীয় ও
বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত দিতে হবে। তবে সাবধান বিশ্বস্ত লোক ছাড়া
দাওয়াত দিলে নিজের জীবন বিপন্ন হবে। কারণ ইহুদী গুপ্তচররা সবসময় আমাদের
পিছনে লেগে আছে। আসলে প্যাগানদের চেয়ে ইহুদীরা আমাদের বড় শত্রু। এভাবে
আরো কিছু উপদেশ দিয়ে তিনি ইঞ্জিল (বাইবেল) থেকে পাঠ শুরু করলেন।
রাখাল লুসিয়াস মজলিস চলাকালীন বাইরে বসে পাহারা দেয়। হঠাৎ সে দৌড়ে এসে
বললো ‘সাবধান ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সাথে সাথে সবাই তরবারী-
খঞ্জর খুলে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফাদার ধমকে উঠলেন ‘ওদের সাথে আমরা পারবো না,
আমি যাচ্ছি বিপদ বুঝলে তোমরা পালিয়ে যেও। তবে দলবদ্ধ হয়ে যাবে না
বিচ্ছিন্নভাবে একা একা যাবে, কেউ ধরা পড়লে অন্য সাথির নাম বলবে না’ বলে
তিনি মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু শিষ্যরা তাকে
একা যেতে দিল না। তিনি বুঝালেন ‘আল্লাহ আছেন আমার কিছুই হবে না। কিন্তু
তোমরা ধরা পড়লে রুম ইসলাম ও মুসলিম শূন্য হয়ে যাবে। তারপর তিনি
লুসিয়াসকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
রাজ পরিবার ও প্রশাসনের অনেকে ফাদার ভ্যালেনটাইনের কাছে চিকিৎসা
নিয়েছেন। সুযোগ বুঝে তাদের অনেকের কাছে তিনি ইসলামের দাওয়াত পেশ
করেছেন। কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করেছেন আর কেউ গ্রহণ করেননি তবে অনুরক্ত।
কেন্দ্রীয় জেলের দারোগা ইউক্লিস ও তার সহকারী ম্যাথিউস ইসলাম গ্রহণ
করেছেন। সতর্কতার জন্য তারা আসতে পারেননি তবে একজন মুসলিম গোলামকে দিয়ে
দুঃসংবাদটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। একটু পর ফাদার গোলামকে নিয়ে গুহায়
ঢুকলেন, মশাল জালানো হলো। তারপর গোলাম বলতে শুরু করল ‘আমাকে ইউক্লিস
পাঠিয়েছেন। ধোপা পল্লীর প্রায় ত্রিশজন মুসলমান ধরা পড়েছেন, ওই মহল্লার
এক ইহুদী ধরিয়ে দিয়েছে। কে তাদেরকে দীক্ষা দিয়েছে আর কে কে মুসলমান
হয়েছে- এসব তথ্য জানার জন্য কয়েদিদেরকে অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে
কিন্তু তারা মুখ খুলছেন না। সংবাদটা শুনে সবাই হায় হায় করে উঠলো, চাপা
কান্না শুরু হলো। ফাদার তাদের মুক্তির জন্য সবাইকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে
প্রার্থনা করে সভা সমাপ্ত ঘোষণা করলেন। সবাই ভীত- সন্ত্রস্ত হয়ে বিদায়
নিল। ফাদার গোলামকে বললেন ‘ইউক্লিসকে বলবে যেভাবেই হোক সে যেন এই
লোকগুলির মুক্তির ব্যবস্থা করে।
ফাদার ভ্যালেন্টাইন নিজ ঘরের বারান্দায় বসে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন।
হঠাৎ রোমান সৈন্যের দুইটা ঘোড়ার গাড়ি এসে আঙ্গিনায় দাঁড়ালো। শিষ্যদের
মুখে মৃত্যু আতঙ্ক ফুটে উঠল, তাদের বুঝতে বাকি রইল না ধৃত মুসলমানরা
ফাদারের নাম বলে দিয়েছে। তারা ভ্যালেনটাইনের চারপাশে ব্যূহ রচনা করে
দাঁড়ালো। ফাদার বুঝলেন ‘এই আহম্মকগুলি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। জীবন গেলে
তার যাবে কিন্তু শিষ্যদের কোন ক্ষতি তিনি সহ্য করতে পারেন না। তিনি
লাফিয়ে উঠে তাদেরকে ধমক দিয়ে বললেন ‘তোমরা কাজে যাও এখানকার ব্যাপার
আমি দেখছি’ বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। একজন অফিসার এসে করমর্দন করে
বলল ‘প্রধান সিপাহসালারের পুত্র ফিলিপ পশ্চিম রণাঙ্গনে মারাত্মক আহত
হয়েছেন তার চিকিৎসার জন্য তিনি আপনাকে নিতে পাঠিয়েছেন। ফাদারের মুখ
থেকে মৃত্যুর কালো ছায়া সরে গেল, শিষ্যদের মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি
ঔষধ পত্র গুছিয়ে প্রধান শিষ্যকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন।
ফিলিপ বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে, সমস্ত শরীর অস্ত্রের ঘায়ে ক্ষত বিক্ষত,
ঘাড়ের ভিতরে তীরের ফলা ঢুকে রয়েছে। অন্য চিকিৎসকরা তা বের করার জন্য
মাংস ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে কিন্তু বের করতে পারেনি। অবস্থা দেখে
ভ্যালেন্টাইন মাথা ছেড়ে দিলেন। সিপাহসালার বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ‘আমার
ছেলে এমনিতেই বীর কিন্তু বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে এই অবস্থা হয়েছে।
রণাঙ্গন থেকে আসার পর সম্রাটের ভাতিজি আন্দ্রিয়ানোর সাথে বিয়ের কথা
পাকাপাকি ছিল কিন্তু সে তো লাশ হয়ে ফিরল। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলেন ‘আমার
ছেলের কি কোন আশা আছে? ভ্যালেন্টাইন বললেন ‘নিরাশ হবেন না দোয়া করুন,
আমি শেষ চেষ্টা করব। সারারাত জেগে তিনি চিকিৎসা দিতে লাগলেন, অস্ত্রোপচার
ব্যতীত তীরের ফলা বের করে আনলেন। পরদিন ফিলিপ চোখ খুলল, ক্ষীণ কন্ঠে কথা
বলতে শুরু করল। ফাদার সেখানেই থেকে চিকিৎসা চালিয়ে গেলেন।
একদিন রাতে নিরিবিলি সময়ে তিনি বললেন ‘ফিলিপ তোমাকে একটা চিন্তার খোরাক
দিতে চাই। আমাদের সুখ দুঃখের মালিক কি ওই কাঁচের ঝাড়ে সুরক্ষিত জুপিটারের
মূর্তি নাকি অদৃশ্য জগতের কোন সত্ত্বা? এই মূর্তির কাছে প্রার্থনা করলে
সে কি তোমাকে সুস্থ করতে পারবে? ফিলিপ মৃদু হেসে বলল ‘আমি বুঝতে পারছি
আপনি কিসের দাওয়াত দিচ্ছেন। ফাদারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তিনি বললেন
‘আমি বিশ্বাস করে শুধু তোমার চিন্তার জন্য কথাটা বললাম। ফিলিপ বলল
‘চিন্তা করবেন না আমার উপকারীর ক্ষতি হতে পারে এমন কোন কথা আমার মুখ থেকে
বের হবে না।
ফিলিপকে দেখার ভান করে জেলখানার দারোগা ইউক্লিস ও ম্যাথিউস এসে ফাদারের
সাথে সাক্ষাৎ করে, ফিসফিসিয়ে আলাপ করে। ফাদার ত্রিশজন ধৃত মুসলমানকে
বাঁচানোর জন্য তাদেরকে অনুরোধ করেন তারাও একটা কিছু করবে বলে ওয়াদা করে।
পাঁচ দিন পর ফিলিপ উঠে দাঁড়ালো সিপাহসালার আনন্দে আত্মহারা হয়ে
ভ্যালেন্টাইনকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন ‘তুমি আমার ভাই আমার বন্ধু,
তুমি যা চাইবে আমি তাই দিব তুমি আমার একমাত্র সন্তানের জীবন বাঁচিয়েছ।
ফাদার চিন্তা করলেন তিনি তার ঈমান চাইবেন অর্থাৎ ইসলামের দাওয়াত দিবেন।
কিন্তু এখনই সময় হয়নি ভেবে বললেন ‘আমি কিছুই চাই না শুধু আপনার
আশীর্বাদ চাই। সিপাহসালার অনেক পীড়াপিড়ির পরও যখন ভ্যালেন্টাইন কিছুই
চাইলেন না অগত্যা তিনি কিছু হীরা-জহরত মণিমাণিক্য উপহার দিয়ে বিদায়
করলেন। ফাদার সেগুলি দরিদ্র মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন।
ইউক্লিস ও ম্যাথিউস পরামর্শ করে তাদের অনুগত পাহারাদারদেরকে রাতে
জেলখানার পাহারায় নিযুক্ত করল আর প্যাগান সৈন্যদের কাউকে ছুটি দিল কাউকে
মদের আড্ডায় বসিয়ে দিল। তারপর মুসলিম কয়েদিদেরকে সৈনিকের পোশাক পরিয়ে
বলল ‘যাও বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, পাহারাদাররা জিজ্ঞেস করলে বলবে
মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা অভিযানে যাচ্ছি। তারা গাড়িতে চড়ে বেরিয়ে
যাওয়ার সময় মহল পাহারাদার ও ফটকের পাহারাদাররা প্রশ্ন করল আর তারা ভুল
করে বসলো। বলল ‘ইউক্লিস ও ম্যাথিউসের নির্দেশে খ্রিস্টানদের ধরতে যাচ্ছি।
এই মুর্খরা তাদের নাম উচ্চারণ করলো। পরদিনই বিষয়টা ধরা পড়ল, ইউক্লিস ও
ম্যাথিউস বন্দি হলো। সম্রাট ক্রোধে ফেটে পরলো, দুটি অপরাধে তারা অভিশংসিত
হল- খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ ও কয়েদিদের পালিয়ে যাওয়ার পথ করে দেয়া। সম্রাট
অত্যন্ত নিষ্ঠুর রায় ঘোষণা করলেন, ইউক্লিস ও ম্যাথিউসকে আগুনে পুড়িয়ে
মারা হলো। এরপরই মুসলমানদের উপর নেমে এলো রোজ কিয়ামতের বিভীষিকা। দলে
দলে মুসলমান ধরে এনে নির্মম নির্যাতন শুরু হল, কাউকে প্যাগান ধর্মে
ফিরিয়ে নেওয়া হলো। বাকিদের কাউকে শুলে ছড়িয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাযজ্ঞ
চলতে লাগল। এ সময় তদন্তে ভ্যালেন্টাইনের নাম বেরিয়ে আসলো।
ক্লডিয়াস সিংহাসনে বসে আছেন, রাজদরবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, অমাত্যরা গরম
গরম বক্তৃতা দিচ্ছে। কেউ বলছে ভ্যালেন্টাইন যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের
সৈন্যদের চিকিৎসা না দিয়ে শত্রুদের চিকিৎসা করে, কেউ বলছে ভ্যালেন্টাইন
খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে প্যাগান ধর্মকে অবমাননা করেছে, জুপিটারের প্রতি
কুফরী করেছে। কেউ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে ভ্যালেন্টাইনকে এভাবে ছেড়ে
রাখলে সে সমগ্র রুমকে ইসলামে দীক্ষিত করবে, প্যাগান ধর্ম বিলুপ্ত করে
দিবে। এভাবে ভ্যালেনটাইনের বিরুদ্ধে অভিশংসন চলতে লাগল। বদমেজাজী
ক্লডিয়াস ক্রোধে চিৎকার করল ‘ভ্যালেন্টাইনকে এক্ষুনি ধরে এনে গর্দান
উড়িয়ে দেওয়া হোক। তখন সিপাহসালার দাঁড়িয়ে মস্তক অবনত করে অভিবাদন
করে বললেন ‘জাহাঁপনা ভ্যালেন্টাইন একজন ভাল চিকিৎসক তার ব্যাপারে
তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত না নিয়ে রাতে উজিরে আজমের সাথে পরামর্শ করে
সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত হবে বলে আমার মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী
দরবারে উপস্থিত নাই, এজন্যই তিনি কৌশল অবলম্বন করলেন। সম্রাট এ প্রস্তাবে
রাজি হলেন।
রাতে সিপাহসালার প্রধানমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে যা বুঝানো দরকার বুঝালেন।
তারপর দুজন গিয়ে সম্রাটের খাসকামরায় উপস্থিত হলেন। সিপাহসালার বললেন
‘জাহাপনা ভ্যালেনটাইনের মত একজন চিকিৎসক গোটা রুমে খুঁজে পাওয়া যাবে না
তার মৃত্যু মানে সমগ্র রুমের ক্ষতি, তাই আমার মনে হয় মৃত্যুদণ্ড না
দিয়ে অন্য কোন দণ্ড দেয়া ভালো হবে। সম্রাট গর্জে উঠলেন ‘তোমার ছেলেকে
সে বাঁচিয়েছে বলে তুমি তাকে বাঁচাতে চাচ্ছ, না? সিপাহসালার ভড়কে গেলেন
কিন্তু উজিরে আজম বললেন ‘জাহাঁপনা ভ্যালেন্টাইন তার ছেলেকে বাঁচিয়েছে
যতটা সত্য তার চেয়েও বড় সত্য সে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক, তাকে হারানো মানে
আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়া। আপনি আমি বা আমাদের যে কেউ অসুস্থ হতে পারি
আহত হতে পারি তখন কিন্তু আমরা ভ্যালেন্টাইনের মতো চিকিৎসক পাবো না।
তাছাড়া তাকে হত্যা করলে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। কাজেই আমার প্রস্তাব হলো
তাকে হত্যা না করে প্যাগান ধর্মে ফিরিয়ে আনা হোক।
সম্রাট কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন ‘ঠিক আছে। তখনই শাহি কাতেবকে ডেকে এনে
তিনটা শর্ত দিয়ে চিঠি লিখালেন। শর্ত গুলি হল- ১। ভ্যালেন্টাইন রুমের
শত্রুপক্ষ কারো চিকিৎসা করতে পারবে না, ২। ইসলাম প্রচার করতে পারবে না,
৩। তাকে খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করে প্যাগান ধর্মে ফিরে আসতে হবে। তারপর
চিঠিটা সিলমোহর করে উজিরে আজমের হাতে দেয়া হলো। উজির সিপাহসালারকে বললেন
‘আপনি এই চিঠি নিয়ে কালই ভ্যালেনটাইনের কাছে যাবেন।
পরদিন সিপাহসালার গিয়ে ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে নিরিবিলি বসে চিঠিটা দিলেন।
তারপর বললেন ‘আমি জানি প্রথম দুটি শর্ত মানা আপনার পক্ষে সম্ভব কিন্তু
তৃতীয়টি সমস্যা। তবে আমাকে কথা দেন দ্বিতীয় শর্তটি মানবেন অর্থাৎ
খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার করবেন না তাহলে আমি গিয়ে সম্রাটকে বলবো আপনি সব
শর্ত মেনে নিয়েছেন। ভ্যালেন্টাইন মাথা নীচু করে আছেন কিছু বলছেন না।
নিরাশ হয়ে সিপাহসালার বললেন ‘ঠিক আছে আমাকে এতটুকু বলুন যে প্রকাশ্যে
ধর্ম প্রচার করবেন না। গোপনে করবেন যাতে আপনার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ না
থাকে, বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব। এবার ভ্যালেন্টাইন হাসিমুখে বললেন
‘হাঁ এটুকু কথা দিতে পারি। সিপাহসালার সন্তুষ্ট হয়ে বিদায় নিলেন।
৩
পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনাপতিরা যুদ্ধ বিরতি দিয়ে ডেরায় অবস্থান করছে।
তারা সম্রাটকে লিখে পাঠালো ‘যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মত প্রয়োজনীয় সৈন্য
আমাদের ছাউনিতে নেই। কারণ বিবাহিতরা স্ত্রী সন্তানের সাথে সাক্ষাতের
উদ্দেশ্যে ছুটি নিয়ে যায় কিন্তু আর ফিরে আসে না। অবিবাহিত কিছু সৈন্য
আছে কিন্তু এত অল্প জোয়ান নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। শীঘ্রই
সৈন্য না পাঠালে আমাদের ফিরে আসতে হবে। সম্রাট উল্টো দুত পাঠালেন ‘তোমরা
যুদ্ধ চালিয়ে যাও আমি সৈন্য সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছি। তারপর তিনি রাজ্যময়
ফরমান জারি করলেন ‘বিবাহিত-অবিবাহিত সর্বস্তরের যুবকদের বাধ্যতামূলক
সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু দেখা গেল বিবাহিতদের কেউ আসলো না
শুধু অবিবাহিত কিছু যুবক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করলো। আর অবিবাহিতরাও আসলো
বিয়ে করার উদ্দেশ্যেই। কারণ তখন ছিল যুদ্ধের যুগ বীরের যুগ- যারা
সেনাবাহিনীতে যোগ দিত এবং যুদ্ধে যেত তারা সমাজে এলিট শ্রেণী বলে সমাদৃত
হত এবং এলিট শ্রেণীতে বিয়ে করার যোগ্য বিবেচিত হতো। সমাজ তাদেরকে
সম্মানের চোখে দেখত আর মেয়েরাও তাদেরকে স্বামীত্বে বরণ করার জন্য
লালায়িত থাকত। পক্ষান্তরে যারা যুদ্ধে যেত না তারা ভীতু কাপুরুষ বলে গণ্য
হতো। সমাজ তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখত, মেয়েরাও তাদেরকে স্বামী হিসাবে বরণ
করতে চাইত না। কাজেই বাধ্য হয়ে যুবকদেরকে যুদ্ধে যেতে হত। এজন্যই তারা
রাজ ফরমানে সারা দিল।
কিন্তু বিবাহিতরা স্ত্রী সন্তানের মায়া কাটাতে পারল না। কারন যুদ্ধবাজ
সম্রাটের বিরতিহীন যুদ্ধে অসংখ্য সৈন্য মারা যাচ্ছে তাদের স্ত্রীরা বিধবা
হচ্ছে সন্তানরা ইয়াতিম হচ্ছে, এই যুদ্ধকে তারা অন্যায় যুদ্ধ মনে করে।
এজন্যই তারা সম্রাটের ডাকে সাড়া দেয়নি। সম্রাট চিন্তা করলেন বিয়ে করা
সন্তান উৎপাদন করা রুমান যুবকদের জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। তাদের
আসল কর্তব্য হলো বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রোম সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে
অমরত্ব দান করা আর বহির্দেশ জয় করে সাম্রাজ্যের গৌরব বৃদ্ধি করা। তা
করতে হলে যুবকদের সৈনিক হতে হবে আর সৈনিক হওয়ার জন্য বিয়ে বন্ধ করতে
হবে। কারণ নারী হলো পৃথিবীর সকল অনর্থের মূল, পুরুষের পায়ের বেড়ি। এদের
জন্যই পুরুষরা মহৎ কাজের উদ্দেশ্যেও বাড়ি ছেড়ে বের হতে চায় না। সম্রাট
অনেক চেষ্টা করেও যখন আশানুরূপ সৈন্য সংগ্রহ করতে পারলেন না তখন তিনি
চিন্তা ভাবনা করে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন। হঠাৎ একদিন ফরমান জারি করলেন
‘কোন যুবক বিয়ে করতে পারবে না, রুমে বিয়ে নিষিদ্ধ হল। রুমবাসিরা এই
অদ্ভুত ফরমান শুনে অবাক হয়ে গেল, যুবকরা ক্ষেপে গেল। কিন্তু কেউ
প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার সাহস পেল না।
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ফরমান শুনে বললেন ‘বিয়ে হলো আল্লাহর বিধান প্রকৃতির
নিয়ম। বিয়ে না করলে নর-নারী অবৈধ প্রণয় করবে জারজ সন্তান জন্ম দিবে।
এদের নির্দিষ্ট পিতা থাকবে না, জীব জন্তুর মত অনাদরে অবহেলায় মানুষ হবে,
বড় হয়ে অসামাজিক কাজ করবে, পৃথিবীকে বিষিয়ে তুলবে। বিয়ে না হলে নারীদের
জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে, তাদের নিরাপদ আশ্রয় থাকবে না, অবৈধ সন্তান
জন্ম দিলে কোন পুরুষ সেই সন্তানের দায়িত্ব বহন করবে না তখন নারীরা কঠিন
বিপদের মুখে পড়বে। আবার সন্তান না থাকলে বৃদ্ধ বয়সে দেখাশোনার কেউ
থাকবে না, তখন নর হোক নারী হোক ইতর প্রাণীর মতো রোগে শোকে ধোকে ধোকে মরতে
হবে। কাজেই বিয়ে ছাড়া গত্যন্তর নাই। বিয়ের মাধ্যমে পৃথিবী বাসযোগ্য
থাকবে স্রষ্টার সৃষ্টি ধারা অব্যাহত থাকবে। আমি তো পুরোহিত- ধর্মযাজক,
বিয়ে করা আমাদের জন্য হারাম। যদি জায়েজ থাকতো তাহলে সর্বাগ্রে আমিই
বিয়ে করে দেখাতাম। (কোন কোন গবেষক মনে করেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের
বিরোধিতায় সেন্ট মারিয়াসকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু এই তথ্য সঠিক নয়,
কারণ খ্রিস্টান পোরুহিতদের জন্য বিয়ে করা হারাম। কাজেই যিনি ধর্মের জন্য
জীবন দিয়েছেন তিনি ধর্মবিরোধী কাজ করবেন- এটা যুক্তিসঙ্গত নয়)
এভাবে তিনি অনুসারীদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে
লাগলেন। তখন মুসলিম যুবক যুবতীরা তার কাছে আসতে লাগলো আর তিনি গোপনে
বিয়ে দিতে লাগলেন। তাদের দেখাদেখি প্যাগান যুবক-যুবতীরাও আসতে লাগল,
ফাদার তাদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে বিয়ে দেন। কিন্তু যারা প্যাগান
ধর্ম ত্যাগ করতে চাইল না তাদেরকে তাদের ধর্ম মতেই বিয়ে দেন। এভাবে তিনি
পূর্ণোদ্যমে কাজীর কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। দিনের বেলা চিকিৎসকের আসনে
আর রাতে বসেন কাজীর আসনে। নিজের ডেরায় অন্ধকার কুঠুরিতে একটা মোমবাতি
জ্বালিয়ে বর-কনেকে বিয়ের মন্ত্র পাঠ করান। এভাবেই তিনি উপাধি পেলেন
ফ্রেন্ড অব লাভারস- ভালবাসার বন্ধু।
একদিন ফিলিপ এসে বলল ‘ফাদার আমার চিকিৎসার সময় আপনি একটা গোপন দাওয়াত
দিয়েছিলেন, এখন সেই দাওয়াত কবুল করতে এসেছি। ফাদার হেসে বললেন ‘তুমি
একা কেন তোমার প্রেমিকা কোথায়? ফিলিপ চলে গেল, পরদিন আন্দ্রিয়ানোকে
নিয়ে হাজির হলো। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিতে হয় পানিতে দাঁড়িয়ে, এটাকে
বাপ্তিস্ম বলে। ভ্যালেন্টাইন তাদেরকে নিয়ে নদীতে গেলেন, বাপ্তিস্ম দিলেন
তারপর রাতে তাদের বিয়ে পড়ালেন। এভাবেই ভ্যালেন্টাইন তার গোপন মিশন
চালিয়ে যেতে লাগলেন কিন্তু বিষয়টা গোপন রইল না, ক্লডিয়াসের কানে পৌঁছল।
তিনি ক্রোধোন্মত্ত হয়ে ভ্যালেন্টাইনকে বন্দি করার নির্দেশ দিলেন। আবার
মুসলমানদের উপর বিপর্যয় নেমে এলো।
ইউক্লিসকে হত্যার পর জেলখানার দারোগা হয়েছে অস্ট্রেরিয়াস। তিনি
কৌতূহলবশত জেলখানায় ভ্যালেনটাইনের কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ান,
কথাবার্তা হয়। ভ্যালেনটাইনের সদালাপ, চমৎকার ব্যক্তিত্ব, মধুর ব্যবহার ও
গভীর পান্ডিত্বে তিনি মুগ্ধ হন। সুযোগ পেলেই তার সাথে বিভিন্ন বিষয়
নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় মেতে ওঠেন। এই সুযোগে ফাদারও তার দাওয়াতী
কার্যক্রম শুরু করলেন। বাস্তব যুক্তি দিয়ে দেব দেবীর অসারতা আর আল্লাহর
অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। ধিরে ধিরে দারোগার হৃদয়ের আধার কেটে গিয়ে
সত্যের আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কিন্তু সম্রাটের ভয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করার
সাহস পেলেন না, তবে মানসিকভাবে তৈরি হয়ে থাকলেন।
একদিন তিনি ভ্যালেন্টাইনকে বললেন ‘জুলিয়া নামে আমার একটা জন্মান্ধ মেয়ে
আছে। আপনি যদি তাকে একটু পড়াতেন তাহলে তার উপকার হত আপনারও সময়টা কাটত।
ভ্যালেন্টাইন আগ্রহের সাথে সম্মতি দিলেন। তিনি জুলিয়াকে মেয়ের মত স্নেহ
করেন, পাটিগণিত ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়ে পাঠদান করেন। ধিরে ধিরে
ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। প্রৌঢ় ভ্যালেন্টাইন আর বালিকা
জুলিয়ার মধ্যে পিতা-পুত্রির ন্যায় গুরু-শিষ্যের ন্যায় বন্ধুত্ব গড়ে
উঠল। বাড়িতে জুলিয়ার ভালো লাগে না ছুটে আসে ভ্যালেন্টাইনের কক্ষে, দুজনে
বসে বসে গল্প গুজব করে। ভ্যালেন্টাইন তাকে শিক্ষা দেন, অন্ধ জুলিয়ার
সামনে পৃথিবীর সৌন্দর্য আর প্রকৃতির বর্ণনা ফুটিয়ে তুলে বলেন ‘এসবের
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। তারপর মুর্তির অক্ষমতা আর আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নিয়ে
আলোচনা করেন।
জুলিয়ার মন আয়নার মত পরিস্কার হয়ে ওঠে, সে হৃদয় মুকুরে গুরুর বর্নিত
বর্নিল পৃথিবীটা দেখতে পায়। একদিন সে গুরুকে ডাকল ‘ফাদার। গুরু সারা
দিলেন ‘বল বৎস। শিষ্য বলল ‘ফাদার আমরা যদি মূর্তি পূজা ছেড়ে আল্লাহর
পূজা করি তাহলে কি তিনি আমাদের প্রার্থনা শুনবেন? - অবশ্যই শুনবেন। -
ফাদার আমি কি চাই জানেন, আপনার মুখ থেকে পৃথিবীর যেসব সৌন্দর্যের বর্ণনা
শুনেছি আমি সেসব স্বচক্ষে দেখতে চাই। আল্লাহ কি আমার আশা পূরণ করবেন?
একটা অবুঝ বালিকার প্রাণের আকুতি দেখে ভ্যালেন্টাইন কেঁদে ফেললেন। তিনি
আল্লাহর দরবারে হাত উঠালেন, গুরু শিষ্য দুজন প্রাণ ভরে কাঁদলো। এরপর থেকে
জুলিয়া রাতদিন দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কাঁদতে
লাগলো আর ভ্যালেন্টাইনও প্রার্থনার সাথে সাথে জেলে বসেই চিকিৎসা শুরু
করলেন। অলৌকিক ভাবে কয়েকদিন পর জুলিয়ার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো। তারপর সে
গুরুর হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করল।
মহাত্না ভ্যালেন্টাইন ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, রুমের জনগণ
তাকে খুব ভালোবাসতো। বিশেষত যেসব যুবক-যুবতীর তিনি বিয়ে দিয়েছিলেন তারা
তাকে দেখতে জেলখানায় আসে, বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দেয় শান্তনা দেয়।
জেলখানায় ভ্যালেন্টাইনের কক্ষটি ছিল রাস্তার পাশে, সে দিকে একটা জানালা
খোলা থাকত। নবদম্পতিরা এসে জালনা দিয়ে ফুল ফল ও উপহারসামগ্রী নিক্ষেপ
করে আর বলে ‘ফাদার আমাদের শুভেচ্ছা গ্রহন করুন, আপনার প্রতি আমাদের
ভালোবাসা। এভাবে সবাই তাকে শ্রদ্ধা জানায়, সহমর্মিতা প্রকাশ করে।
ভ্যালেন্টাইনের বিচার ইস্যুতে রাজদরবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অমাত্যরা
দাবি করছে ভ্যালেন্টাইন একজন উদ্ধত প্রকৃতির লোক, সে একের পরে এক রুমের
স্বার্থবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে। সে আমাদের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ
করেছে, রুমের যুবকদেরকে বিভ্রান্ত করে গুমরা করছে। সর্বশেষ সম্রাটের
হুকুম অমান্য করে যুবকদের বিয়ে দিচ্ছে। তার অপরাধ একটা নয় একাধিক,
কাজেই তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। প্রধান উজিরসহ যারা ভ্যালেনটাইনের
চিকিৎসা নিয়েছেন এমন কয়েকজন দাবি করলেন ভ্যালেন্টাইন একজন ভাল চিকিৎসক
তাকে হত্যা না করে আমাদের ধর্মে ফিরিয়ে আনা হোক। সম্রাট চেঁচিয়ে উঠলেন
‘এ সুযোগ তাকে আগেও দেওয়া হয়েছে কিন্তু সে সুযোগ গ্রহণ করেনি।
সিপাহসালার বললেন ‘জাঁহাপনা আমাদেরকে শেষ চেষ্টা করার অনুমতি দিন। সম্রাট
অনুমতি দিলেন। প্রধানমন্ত্রী সিপাহসালার ও আরো কয়েকজন মিলে রাতে গিয়ে
ভ্যালেনটাইনের সামনে এই প্রস্তাব পেশ করল।
ভ্যালেন্টাইন হেসে বললেন ‘আমি রুমের সন্তান, আমি রুমের কল্যান চাই সম্রাট
ও আপনাদের সকলের কল্যাণ চাই। আপনারা মূর্তি পূজা ত্যাগ করে কল্যাণের পথে
আসুন। নইলে জনসাধারণের পাপের বোঝা সম্রাট ও আপনাদেরকেই বহন করতে হবে। আর
সেই পাপের আগুনে রুম জ্বলে পোড়ে খাক হয়ে যাবে। তারপর তিনি মূর্তির অসারতা
ও আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করলেন। আগন্তুকরা প্রথমটায় ক্ষুব্ধ
হলেও শীঘ্রই সত্য উপলদ্ধি করতে পারলেন। সেনাপতি ও উজিরে আজম অনুভব করলেন
আর কিছুক্ষণ থাকলে ভ্যালেন্টাইন প্যাগান হবে দূরের কথা তারাই মুসলিম হয়ে
যাবে। উজিরে আজম ধমকে উঠলেন ‘বকোয়াজ বন্ধ করে আমাদের প্রস্তাবে রাজি আছ
কিনা তাই বল। - আমি আলোর জগৎ ছেড়ে অন্ধকারে যেতে পারবো না।- তাহলে আমরা
গিয়ে সম্রাটকে কি বলবো? - বলবেন তিনি যেন মূর্তিপূজা ত্যাগ করে ইসলামে
দীক্ষা গ্রহণ করেন। এর মধ্যেই তার নিজের ও রুমের কল্যাণ নিহিত। তারা চলে
গেল।
এই সংবাদ শুনে সম্রাট বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন। সাথে সাথে পত্র লিখিয়ে
জেল দারোগার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অস্ট্রেরিয়াস চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে
ভ্যালেন্টাইনকে চিঠি দেখালেন ‘কাল ভোরেই জনসমক্ষে ভ্যালেন্টাইনের
শিরোচ্ছেদ করা হোক। পরদিন সকালে ভ্যালেন্টাইন অস্ট্রেরিয়াসের হাতে একটা
পত্র দিলেন। তারপর তাকে বধ্যভূমিতে নেওয়া হলো এবং রোম নগরীর
ফ্লালিসিনিয়ান গেটের বাইরে শিরশ্ছেদ করা হলো। এভাবেই ১৪/২/২৭০ সালে একজন
মহান ব্যক্তিকে শহীদ করে দেয়া হলো। যুগে যুগে স্বৈরাচারী শাসকদের হাতে
এভাবেই মহান ব্যক্তিরা নির্যাতিত হয়েছেন। অস্ট্রেরিয়াস ভ্যালেন্টাইনের
পত্রটা নিয়ে তার মেয়েকে দিল। জুলিয়া পত্র খুলল তাতে লেখা ‘ফ্রম ইউর
ভ্যালেন্টাইন’ চিঠিতে সে বসন্তের হলুদ ফুলের রং দেখতে পেল। এক নজর দেখেই
জুলিয়া মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়ে বেহুশ হয়ে গেল। এরপর থেকে গুরুর কবর
পাশেই তার অধিকাংশ সময় কাটে।
একজন মহান চিকিৎসক ও মহান ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডে রুমবাসিরা দুঃখিত হল
আফসোস করল। কিন্তু নওমুসলিমদের রক্তাশ্রু ঝরে পড়ল, তারা মাতম করল, তাদের
মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। রাজপ্রাসাদে ও নগরে যেসব গোপন নওমুসলিম ছিল
তারা আত্মগোপনে চলে গেল। কেউ কেউ পাহাড়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিল,
নেতৃস্থানীয়রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলমানদের সংগঠিত করতে লাগলো।
পাহাড়ের নিভৃত গুহায় পরামর্শ সভা চলতে লাগলো, তারা নতুন উদ্যোমে ইসলাম
প্রচারে আত্মনিয়োগ করলো। ভ্যালেন্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধায় জনগণ ব্যাপকহারে
ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো।
হঠাৎ একদিন সিপাহসালারের পুত্র ফিলিপ উধাও হয়ে গেল, বহুদিন পর্যন্ত তার
কোনো পাত্তা নেই। সহসা একদিন গভীর রাতে নগরীর এক প্রান্তে দ্রুত ধাবমান
অশ্বখুরধ্বনি শোনা গেল, সেই সাথে ঘুমন্ত রুমবাসীরা শুনতে পেলো ফিলিপের
কণ্ঠস্বর ‘রুমের বাসিন্দারা শোনো, অত্যাচারী রক্তপিপাসু ক্লডিয়াসকে হত্যা
কর, মহামতি ভ্যালেন্টাইন হত্যার বিচার কর, কাল্পনিক দেব- দেবী পরিত্যাগ
করে একেশ্বরে আত্মসমর্পন করো। অন্যথায় রুমের পাপের আগুনে রুম জ্বলে পোড়ে
ছাই হয়ে যাবে’। এভাবে চিৎকার করতে করতে সে নগরীর এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে
অন্য প্রান্ত দিয়ে চোখের পলকে বেরিয়ে যায়। কিছুদিন পরপর নগরীর বিভিন্ন
প্রান্তে তার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। আবার নগরবাসীরা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে
নগরীর বিভিন্ন প্রাচীরে দেওয়াল লিখন দেখতে পায় ‘ক্লডিয়াসকে হত্যা করে
ভ্যালেন্টাইন হত্যার প্রতিশোধ নাও, দেব দেবী পরিত্যাগ কর ইত্যাদি।
ক্লডিয়াস ক্রোধান্ধ হয়ে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে দেয়। দলে দলে
নওমুসলিমদের ধরে ধরে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। তখন ক্লডিয়াসের
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, বিয়ে নিষিদ্ধ ও বিভিন্ন অজুহাতে ফিলিপ তার বাবা,
প্রধান উজির ও অন্যান্য এলিটদের সম্রাটের বিরুদ্ধে সংঘটিত করে জনগনকে
খেপিয়ে তুলতে লাগল। শুরু হয় বিপ্লব বিদ্রোহ, সেই আন্দোলনের জোয়ারে
ক্লডিয়াসের তখত তাউস ভেসে গেল। নতুন সম্রাটের অভিষেক হলো, কিন্তু নতুন
ধর্মের অগ্রযাত্রা দেখে নতুন সম্রাটও প্রমাদ গুনল। নতুন উদ্যমে
মুসলমানদের উপর নেমে এল নির্যাতনের স্টিমরোলার। কিন্তু এ নির্যাতন বনের
আগুনে বাতাসের ঝাপটার কাজে দিল। মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো।
কারন ততদিনে তাদের সামনে মুর্তির অসারতা ও ইসলামের সত্যতা প্রকট হয়ে
উঠেছে। শাসকরা যখন দেখল প্যাগান ধর্ম হুমকির সম্মুখীন তখন তারা উন্মত্ত
হয়ে উঠলো। সন্দেহ হলেই যে কাউকে ধরে এনে হত্যা করতে লাগল, ইহুদিদের
প্ররোচনায় তারা মুসলমানদের উপর গনহত্যা চালিয়ে গেল। মুর্তি পূজারী
শাসক- পোরুহিত আর মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।
মহাত্না ভ্যালেন্টাইনের শাহাদাতের পর রুমে যে আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল
মাত্র ত্রিশ বছর পর সম্রাট কনস্টানটাইনের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে সে আগুন
নির্বাপিত হয়। সম্রাট ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে প্যাগান ধর্ম
নিষিদ্ধ করেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এশিয়া ও ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের
ব্যাপক প্রসার ঘটতে লাগলো। দেখতে দেখতে বিশাল রোম সাম্রাজ্য ইসলাম গ্রহণ
করে মুসলিম সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়ে গেল আর প্যাগান ধর্ম চিরতরে
বিলুপ্ত হয়ে গেল।
তারপর শহীদ স্বরনে ৩৫০ সালে ভ্যালেন্টাইনের কবরের উপর প্রক্সিদেস নামক
গির্জাটি নির্মাণ করা হয়- যা এখনো আছে। ততদিনে রুমে ইসলামের শিকড়
দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে, পোপের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৪৯৬ সালে
পোপ জেলাসিয়াস দেখলেন রুমবাসীরা তখনো ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে জুনু উৎসব হিসাবে
পালন করে। লটারির মাধ্যমে যুবতীদেরকে যুবকদের মধ্যে বন্টন করা হয়- যা
অত্যন্ত অশ্লীল অমানবিক ও ধর্মবিরোধী কাজ। তিনি এই ঘৃণ্য কুসংস্কার বন্ধ
করার পদক্ষেপ নিলেন। শহীদ ভ্যালেন্টাইনের স্মৃতিকে অমর করার লক্ষ্যে ১৪ই
ফেব্রুয়ারিকে জুনু উৎসবের পরিবর্তে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসেবে ঘোষণা
করেন। এই দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ধর্ম ও মানবতার প্রতি ভ্যালেন্টাইনের
ভালোবাসা, প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা নয়।
কিন্তু পশ্চিমারা সবকিছুকেই ভোগের উপকরণ হিসাবে দেখে। তারা ভ্যালেন্টাইন
ও জুলিয়ার মধ্যে কাল্পনিক প্রেমের রং ছড়িয়ে দিবসটিকে ভালোবাসা দিবস
নাম দিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার উৎসবে পরিণত করে। ক্রমান্বয়ে এর মধ্যে
অশ্লীলতা ঢুকতে থাকে, গির্জায় মদপান জনসমক্ষে যুবক যুবতীদের অশ্লীলতা
ইত্যাদি অপকর্ম চলতে থাকে। একটি ধর্মীয় উৎসব অশ্লীল উৎসবে রূপান্তরিত
হতে যাচ্ছে দেখে প্রথমে ফ্রান্স এটিকে নিষিদ্ধ করে, ইংল্যান্ডের
পিউরিটানরাও নিষিদ্ধ করে। ক্রমান্বয়ে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি,
জার্মানি ইত্যাদি দেশেও নিষিদ্ধ করা হয়।
তারপর ১৬৬০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস আবার এটিকে ভালবাসা
দিবস হিসাবে চালু করে। তখন সর্বপ্রথম ইস্টার সানডে নামক একটি কার্ড
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘হোয়াট ইলস ভ্যালেন্টাইন’ নামে সর্ব প্রথম
বাণিজ্যিকভাবে কার্ড নির্মাণ করে বাজারে ছাড়ে এবং প্রথম বছরেই পাঁচ
হাজার কার্ড বিক্রি হয়ে যায়। তারপরই স্বার্থান্বেষী বেনিয়ারা এটাকে
অর্থোপার্জনের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করে। তার উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও
সস্তা জনপ্রিয়তা প্রত্যাশী মিডিয়ার অপপ্রচারে দিবসটি ভালোবাসা দিবস
হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। এভাবেই মহামতি ভ্যালেন্টাইনের শাহাদাত দিবস
হিসাবে ঘোষিত একটি ধর্মীয় উৎসবকে প্রেমিক প্রেমিকার অশ্লীল উৎসবে পরিণত
করা হয়। সমাপ্ত
বিষয়: বিবিধ
৯১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন