দুটি গল্প (মাহমুদুল হাসান)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১১:৫৯:০৯ সকাল
চলো যাই অভিসারে
ঘুম থেকে উঠে বাথরুম করে এসে নাস্তার টেবিলে বসলাম। মা নাস্তা দিয়ে একটা খাতা নিয়ে এসে বললেন ‘শাহীন এসেছিল, এই খাতাটা দিয়ে বলে গেল তোকে এটা পড়ে শেষ করতে। দুই ঘন্টা পর সে এসে তোকে নিয়ে কি জানি এক জরুরী কাজে যাবে। মা খাতাটা টেবিলের একপাশে রেখে চলে গেলেন। শাহিন আমার বন্ধু সাংবাদিক। আমি হাসান, লেখাপড়া শেষ করে ফাইলপত্র নিয়ে অফিসে অফিসে ধর্না দেই কিন্তু কোন ধর্নাই আমাকে ধন্য করে না, চাকরি নামক সোনার হরিণটার পেছনে শুধু দৌড়াচ্ছি কিন্তু নাগাল পাচ্ছি না। তাই বলে বেকার বসে নেই, গল্প উপন্যাস লিখি। একটা সাহিত্য পত্রিকায় মাঝে- মধ্যে ছাপা হয়, এর মধ্যে দুটো উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে। এজন্যই আমি লেখার উপাদান খুঁজে বেড়াই। শাহীনও এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করে, কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সে একটা স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়ে বলে 'নে একটা গল্প উপন্যাস লিখে ফেল। তাই আমার মনে হল সে হয়তো লেখার কোন উপাদান দিয়ে গেছে। আর এমন উপাদানের জন্য আমি সর্বদা মুখিয়ে থাকি। তাই তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করে খাতাটা নিয়ে আমার রুমে চলে গেলাম। আয়েশী ভঙ্গিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে খাতাটা উল্টাতে লাগলাম। একটা বসুন্ধরা খাতা, প্রায় সম্পূর্ণটাই লেখা। গোটা গোটা মেয়েলি হাতের লেখা, সুন্দর হস্তাক্ষর। আমি পড়তে শুরু করলাম---
আমার নাম ফেরদৌস আরা, তবে সবাই ফেরদৌসী বলেই ডাকে। আমাদের বাড়িটা ফকির বাড়ি নামে পরিচিত, ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবার হিসেবে এলাকার সবাই আমাদের মান্যগন্য করে। আমার বাবা হাইস্কুলের ইংলিশ টিচার। বিয়ের আগে তিনি নাটক ফাটক করতেন, ধর্ম-কর্মের বড় একটা ধার ধারতেন না। কিন্তু আমার মা হলেন পীর বংশের মেয়ে, মায়ের দাদা নাকি অনেক বড় পীর ছিলেন, দেশ-বিদেশে তার নাম ডাক ছিল। কাজেই বিয়ের পর মায়ের গুতায় বাবা গান বাজনা ছাড়তে বাধ্য হলেন, নিয়মিত মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়েন, মাঝে মধ্যে তাবলীগে যান।
মায়ের তাকিদে আমরাও নিয়মিত নামাজ পড়ি কুরআন তেলাওয়াত করি। আমার বোনেরা স্কুল জীবন থেকেই বোরকা পরত। আমি যখন ক্লাস এইটে উঠলাম তখন আমার দেহের পরিবর্তন বুকের পরিবর্তন আমার চোখে ধরা পড়ার আগেই মায়ের চোখে পড়ল। তিনি আমাকে বোরকা কিনে দিলেন। তখন থেকেই আমি নিয়মিত পর্দা করি। কলেজে ওঠার পর পর্দা আরো বেড়ে গেল। কাল বোরকায় সারা শরীর আচ্ছাদিত করার পর নেকাবে মুখ ঢাকি, চোখ দুটি চশমায় ঢেকে আনাগোনা করি। বাড়ি থেকে কলেজ তিন মাইল দূরে, আমার নিরাপদ আনাগোনার জন্য আব্বা একজন দরিদ্র লোককে একটা রিক্সা কিনে দিয়ে বললেন ‘আমার মেয়েকে কলেজে আনা-নেয়া করবে বাকি সময় তুমি ভাড়া মারবে, কিন্তু আমাকে কোন ভাড়া দিতে হবেনা। আমি নিরাপদে রিকশায় যাতায়াত করি।
ইতিমধ্যে কলেজে আমার বেশ কয়েকজন বান্ধবী জুটে গেল। তারা সবাই ইংলিশ স্যারের কাছে ইংরেজি প্রাইভেট পড়ে, আমিও পড়া শুরু করলাম। আমি ছাড়া তাদের সবারই মোবাইল আছে, কেউ না আসলে খোঁজখবর নেয়। স্যার না থাকলে কখন আসবেন কখন পড়াবেন জেনে নেয়। তাছাড়া তারা ফেসবুক চালায়, ভিডিও কল করে, নেটে পত্রিকা দেখে, গুরুত্বপূর্ণ বই ডাউনলোড করে। এভাবে সব দিক দিয়েই তারা উপকৃত হয়। আমার মোবাইল নাই দেখে বান্ধবীরা তিরস্কার করে ‘কিরে তুই কি ফকিন্নি নাকি, একটা মোবাইল কিনতে পারিস না? আধুনিক যুগের সকল সুযোগ সুবিধার ভান্ডার হলো মোবাইল, মোবাইল না থাকলে প্রাচীন আমলের সেই প্রস্তর যুগে পরে থাকতে হয়। এ যন্ত্র ছাড়া আধুনিক জীবনের কল্পনাও করা যায় না।
আমিও বুঝতে পারলাম, মোবাইল ছাড়া আলোর জগতে প্রবেশ করা যায় না, প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারেই পড়ে থাকতে হয়। কাজেই আমি একটা মোবাইল কিনার সিদ্ধান্ত নিলাম। মাকে বললাম ‘আমাকে একটা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল কিনে দাও। মা চোখ কপালে তুললেন ‘মেয়েদের আবার মোবাইল কেন, তুই মোবাইল দিয়ে কি করবি? বললাম 'বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। তাছাড়া মোবাইলে প্রয়োজনীয় বই সাজেশনস পত্রিকা ইত্যাদি অনেক দরকারি জিনিস পাওয়া যায়। মা ঝনঝনিয়ে উঠলেন ‘কোন দরকারি জিনিসের দরকার নাই, কারো সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে আমার মোবাইলে কথা বলবি, ব্যাস। বিয়ের আগে মেয়েদের হাতে মোবাইল দিতে নেই। তিনি কাঠ না করে বসলেন।
অগত্যা আব্বাকে গিয়ে বললাম, অনেক অনুনয় বিনয় করে তাকে রাজি করালাম। আব্বা গলা টেনে মাকে বললেন ‘মেয়েটা কান্নাকাটি করছে দেই একটা মোবাইল কিনে। মা বাজের মত হামলে পড়লেন 'কিসের মোবাইল, মেয়েকে কালই বিয়ে দাও তারপর একটা না দশটা কিনে দাও আমি কিছুই বলবো না। এই মোবাইলের কারণে কত মেয়ের জীবন নষ্ট হচ্ছে তার হিসেব রাখো? ওর হাতে মোবাইল দেখলে আমি ভেঙ্গে ফেলবো। আম্মার ধাতানি খেয়ে আব্বা কাচুমাচু করে বললেন ‘বাদ দে মা, তোর দরকার পড়লে আমার বা তোর মায়ের মোবাইল দিয়ে কাজ চালিয়ে যা।
আমার মনটা ভেঙ্গে গেল তবু হাল ছাড়লাম না। আম্মার মোবাইল দিয়ে বড় ভাইয়াকে কল করলাম। সে বলল ‘দুঃ পাগলী তুই মোবাইল দিয়ে কি করবি মেয়েদের হাতে মোবাইল না থাকাই ভাল। তুই জানিস না এই মোবাইল কত মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে ইত্যাদি উপদেশ দিয়ে সে রেখে দিল। আমার ভীষন রাগ হল, মোবাইল হলো একটা ব্যবহারিক যন্ত্র এটা আবার জীবন নষ্ট করে কেমনে? আমার বুঝতে বাকী রইল না ওদের আদর শুধু মুখে মুখে, মোবাইল কিনতে টাকা খরচ হবে বলে নষ্ট হওয়ার জুজুর ভয় দেখাচ্ছে। অথচ কলেজ জীবন থেকেই ভাইয়াদের হাতে মোবাইল আর আমি মেয়ে বলে একটা মোবাইলেরও যোগ্য না। মেয়ে বলে নীতি বাক্য ও ধর্মের দোহাই দিয়ে দাবিয়ে রাখে। আসলে মা বাবা ভাই কেহই মেয়েদেরকে মানুষ হিসাবে গণ্য করে না, কোন অধিকার দিতে চায়না। আমার ভীষণ কান্না পেল, দুই দিন পর্যন্ত কাঁদলাম। বুঝতে পারলাম আমার প্রতি তাদের আদর-যত্ন শুধুই ভনিতা- লোক দেখানো।
কিন্তু একটা মোবাইলের জন্য আমার মনটা খুব ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। অন্যরা মোবাইল নিয়ে কত আনন্দ ফূর্তি করে অথচ আমি শিক্ষিত ও ধনী ঘরের মেয়ে হয়েও এসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। অবশেষে ছোট ভাইয়্যার কাছে কল করে অনেক কান্নাকাটি করলাম। প্রথমটায় সেও না করল কিন্তু সে হলো সাদাসিধা সরল মনের মানুষ, আমার কান্নাকাটি শুনে রাজি হয়ে গেল। পনের দিন পর সে ভার্সিটি থেকে বাড়ি এল আর আমার হাতে একটা নতুন চকচকে এন্ড্রয়েড নামের বিষের কৌটা তুলে দিল। মায়ের ভয়ে সাথে সাথে আমি মোবাইলটা লুকিয়ে রাখলাম। আম্মা তো বাড়ি মাথায় তুলে নিলেন ‘এত মোবাইল দেয়ার শখ থাকলে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তারপর দেয়া হোক। আব্বা ও ছোট ভাইয়্যা মাকে বুঝালো ‘মেয়েটা একটু আবদার করেছে থাক না, প্রাইভেট পড়তে যায় বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করতে হয় এই তো। এর জন্য এত শাসনের কি দরকার ইত্যাদি বলে তারা আম্মাকে শান্ত করল।
আম্মার সামনে আমি মোবাইল ব্যবহার করি না। আড়ালে-আবডালে একটু-আধটু চালাই, শুধু বান্ধবী ও ভাইয়াদের সাথে মাঝে মধ্যে কল করি। একদিন আমরা বান্ধবীরা মিলে প্রাইভেটে যাচ্ছি কিন্তু তন্বী নাই। তার নম্বর আমার কাছে নাই, স্বপ্নাকে কল করতে বললাম। সে উল্টে বললো তার মোবাইলে টাকা নাই। আমি তার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে কল করলাম। ওপাশ থেকে 'হ্যালো' একটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম 'তন্বী কোথায়, আজ প্রাইভেটে আসবে না? কন্ঠটা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল 'ও বাসায় নেই, আপনি কে বলছেন? আমি ফেরদৌসী তন্নীর বান্ধবী' বলে কল কেটে দিলাম। কারণ এর আগে কোন ছেলের সাথে আমি মোবাইলে কথা বলিনি।
স্যারের বাসায় গিয়ে দেখি তন্বী বসে আছে, ঘটনা শুনে সে হাসতে হাসতে কুটিকুটি। কারণ সে বলল ‘তারা শুধু দুই বোন কোন ভাই নেই। নম্বর চেক করে দেখলাম ভুলটা আমারই হয়েছে। পরদিন হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল, রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলাম ‘হ্যালো কে? ওপাশ থেকে ভেসে এলো ‘আমি তন্নীর ভাই’ সেই সাথে মৃদু হাসির শব্দ। আমি ধমক দিলাম ‘আপনি তো গতকাল মিথ্যে বলেছেন, তন্নীর কোন ভাই নেই আপনি কে? কন্ঠটা বলল ‘আমি ইমন, ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র। সাথে সাথে আমি কল কেটে দিলাম। কারণ আমাদের পরিবারের একটা ধর্মীয় ইমেজ আছে। আমিও খুব লাজুক এবং পর্দানশীন, কোন ছেলের সাথে কথা বলি না। সুন্দরী দেখে অনেক ছেলে আমার পিছনে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু আমি কাউকে পাত্তা দেই না। তাছাড়া ছেলেদের ব্যাপারে আম্মা সব সময় আমাকে সতর্ক করে।
কিন্তু শীঘ্রই বুঝলাম ইমন নামের ছেলেটা আমার পিছু নিয়েছে, বিভিন্ন মেসেজ পাঠায়। তবে বিশেষ দূষণীয় কিছু নয়, কবিতার লাইন বা গানের কলি। মাঝে- মধ্যে কল দেয় কিন্তু আমি রিসিভ করি না। একদিন লাগাতার চার-পাঁচটা কল দেয়ার পর রিসিভ করলাম। ওপার থেকে মধুর কন্ঠ ভেসে এলো ‘একটু পরিচয় হলে কি সংবিধান লংঘন হবে নাকি, কল ধরেন না কেন? বললাম ‘পরিচয়ের দরকার কি? সে বলল ‘আপনি কোন তন্নীর কথা বলেছিলেন, আমার খালাতো বোনের নামও তন্বী। তারপর সে আমার পরিচয় জানতে চায়, মোলায়েম ও আকর্ষণীয় সুরে কথা বলে। আমার পরিচয় নিয়ে নিজের পরিচয় দিল- নাম ইমন আহসান ফারাবি, ঢাকা ভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স করছে, বাপ সচিবালয়ে চাকরি করে, ঢাকার উত্তরায় বাসা। আমি বললাম ‘আমার ভাইও ঢাকা ভার্সিটির ফার্মাসি অনুষদে পড়ে। সে ভাইয়্যার পরিচয় নিল।
ছেলেদের সাথে কথা বলতে আমার ঘৃণা লাগে অবজ্ঞা জাগে। কিন্তু ইমনের ব্যাপারটা অন্যরকম ঠেকল। শত হলেও ঢাকা ভার্সিটিতে ইংলিশের ছাত্র, উত্তরায় বাসা, বাপ বড় চাকুরে। এমন কাউকে আর যাই হোক অন্তত অবজ্ঞা করা যায় না। তাছাড়া তার মধুর কন্ঠ স্মিত হাসি আমার কানে রিনিঝিনি সংগীতের ঝংকার তুলে। আমি কেমন একটা নিষিদ্ধ আকর্ষণ অনুভব করতে থাকি। ইমন মেসেজ পাঠায়, মাঝে- মধ্যে কল করে। আমি কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে অবিমৃষ্যের ন্যায় তার কলে সারা দেই না দিয়ে থাকতে পারি না।
আমি তখন ষোড়শী- ষোল বছর অতিক্রম করেছি। আমার হেমাঙ্গে শ্রাবণের ভরা নদীর মত উদ্দাম যৌবনের বান ডেকেছে। তন্বী লতিকায় পূর্ণেন্দু কৌমোদির ন্যায় যৌবন প্রভা প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। হৃদয় বাতায়নে বাসন্তী মলয় প্রবাহে কামনার ফুটন্ত মুকুলগুলি গোলাপের ন্যায় প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। সৃষ্টির তামাম সৌন্দর্য নিয়ে বুকের উরোজ যুগল ক্রমে ক্রমে প্রস্ফুটিত হয়ে লাল পদ্মের মত বিকশিত হচ্ছে। আমার গণ্ড ঠোঁট বাহু কটি প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ লোল কামনায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। নিজের শরীরের প্রতি তাকিয়ে আমি এক উন্মাদ মাদকতায় হারিয়ে যাই, মন উচাটন হয়ে ওঠে। অনুক্ষণ আমার তনু মনে দুর্দম ভাঙ্গা-গড়া চলতে থাকে। মা-বোনদের নীতিবাক্য ‘ছেলেরা ভালো নয় তাদের থেকে দূরে থাকতে হয়’ এই আপ্তবাক্য আমার হৃদয়ের ঝড় কোন সুদূরে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এখন ছেলে- সান্নিধ্য আমার কাঙ্খিত হয়ে ওঠে, পুরুষ কণ্ঠ আমার কর্ণকুহরে সংগীতের ঝড় তুলে, হৃদয় বীণার তারগুলি বাজতে থাকে। আমি আমূল বদলে যাই।
ইমনের সাথে আমার নিয়মিত কথাবার্তা হয়। একদিন সে কল না করলে আমার মন উসখুস করে। ইতিমধ্যে মোবাইল সম্পর্কে আমি যথেষ্ট অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সকল অসামাজিক বিষয় আমার করায়ত্ত হয়ে গেছে। আমার বান্ধবীদের মধ্যে অনেকেই বহু আগে থেকেই মোবাইল চালায়, ঝানু প্লেয়ার। তাদের কাছ থেকে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার ভাইবার ইমো ভিডিও কল নেটে বিভিন্ন জিনিস চার্জ করা ইত্যাদি শিখে নেই। তাদের কয়েকজনের প্রেম আছে, প্রেমিককে কিভাবে মেসেজ দিতে হয় কিভাবে কল করতে হয় ইত্যাদি কলাকৌশলও তারা আমাকে শিখায়। খুব শীঘ্রই এসব বিষয়ে আমি পি এইচ ডি ধারী হয়ে যাই।
এখন বাড়িতে আমি আর বাবা মা ছাড়া কেউ থাকে না। আমি আলাদা রুমে থাকি, এই একাকীত্ব রাত্রিযাপন আমাকে সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। অশরীরী ইমনকে আমি বিছানায় সঙ্গী হিসাবে পেয়ে যাই। আগেই তাকে বলে রেখেছিলাম আমি মিস কল না দিলে কল করবে না তাহলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিদিন রাত দশটার পরে মা বাবা শুয়ে পড়ে। তখন আমি মিস কল দেই, সাথে সাথে ইমন কল ব্যাক করে। তারপর শুরু হয় আমাদের প্রণয় অভিসার, ঘন্টার পর ঘন্টা ফিসফিসিয়ে আলাপ চলে। আমরা স্বপ্নের জাল বুনি- ইমন বলে লেখাপড়া শেষ করে আমাকে নিয়ে বিদেশ চলে যাবে, চাকরি বাকরি নিয়ে বিদেশেই সেটেল হবে।
আমি প্রতিবাদ করি ‘না না, বাবা মা ভাই বোন ছেড়ে আমি বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকতে পারব না। তারচেয়ে দেশেই তুমি ভালো একটা সরকারি চাকরি করবে। ইমন জিজ্ঞেস করে 'দেশে থাকলে কি আমার মা বাবার সাথে থাকবে নাকি আলাদা বাসায় থাকবে? আমি বলি 'তুমি চাকরি করে নিজের উপার্জনে বাসা করবে। আমরা নিজের বাসায় থাকব, পৈতৃক সম্পত্তির উপর নির্ভরতা অক্ষমতার লক্ষণ। ইমন সায় দেয়- হাঁ সে নতুন বউ নিয়ে আলাদা বাসায় থাকবে, জীবনটা উপভোগ করবে। পরিবারের সাথে থাকলে এই সুযোগ পাওয়া যায় না। সে বলে তার দুইটা বাচ্চা হলেই যথেষ্ট। আমি বাধা দেই 'না না আমরা পাঁচ ভাই-বোন, আমার অন্তত তিন চারটা বাচ্চা দরকার। এভাবে আমরা স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে কখন ভোর হয়ে যায় টেরও পাই না, সকালে ঘুমাই।
অনেক সময় ইমন পাগলামি করে, রাতে ভিডিও কল করে আমাকে আদর করে চুমু দেয় মধুর সুরে কথা বলে। তার জাদুময় বচনে আমি আত্মহারা হয়ে যাই। তাছাড়া তার জমকালো পোশাক, নায়কের মত ক্যাপ ও কালো চশমায় ঠিক নায়কের মতোই দেখা যায়। সে আবদার করে, আমি ইচ্ছা সত্ত্বেও মানা করি। সে অনুনয় করতেই থাকে আমার মধ্যেও উন্মাদনা এসে যায়, তাকেও উন্মাদ করার মাদকতায় পেয়ে বসে। তখন টেবিলের উপর বইয়ে ঢেস দিয়ে মোবাইলটা রাখি, তারপর বুকের ওড়না সরিয়ে বুকটা টান টান করে ভিডিও কলের সামনে দাঁড়াই। সে বলে ‘ওহ হচ্ছে না, কাপড়টা আরেকটু সরাও। আমি গায়ের জামা খুলে ফেলি, ঘুরে ফিরে বুক পিঠ বাহু আগা পাচা দেখাই। দেহের প্রতিটা ভাঁজ ও খাঁজ মোবাইলের সামনে মেলে ধরি। মনে মনে হাসি ‘শালা তুমি আমাকে যেমন পাগল করেছো আমিও তোমাকে উন্মাদ বানিয়ে ছাড়বো। আমার গায়ের রং কাঁচা হলুদের মত, বুঝতে পারি আমার মন মহাজন বেসামাল হয়ে ওঠেছে, মোবাইলে তার গরম নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।
দু-এক দিন পরপরই ইমন এমন পাগলামি করে আমিও সুযোগ কাজে লাগাই। আমার উর্বর দেহের প্রতিটা গলি-ঘুপচি তার চোখের সামনে দৃশ্যমান করে একেবারে পাবনার রোগি বানিয়ে ছাড়ি। ক্ষতি তো নাই, সে তো আর আমার দেহ পাচ্ছে না শুধু ছায়াটা চাটবে। বিনিময়ে শুনতে পাই শুধু হা হুতাশ আর গরম নিঃশ্বাস। এভাবে আমার অশরীরী অভিসার চলতে থাকে।
আমি গ্রামীণ ধর্মীয় পরিবারের মেয়ে। আগে ছিলাম গোবেচারা টাইপের অবলা বালিকা। কিন্তু এখন আমি স্মার্ট ও ট্যালেন্ট। আমার প্রেম আমাকে অন্য মেয়েদের চাইতে আধুনিক ও চতুর বানিয়ে তুলেছে। প্রেম আমার অহংকার আমার গর্ব আমার আশীর্বাদ, ইমন আমার নয়নের তারা জীবনের নিধি। গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়, শির উন্নত ও উদ্ধত হয়ে ওঠে। গ্রামে ও কলেজে আমার আশপাশের মেয়েদেরকে দেখলে করুনা হয়, অবজ্ঞা জাগে। মনে হয় এরা জীবনের স্বাদ কিছুই পাইনি, জীবনের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি জীবনের লক্ষ্য বুঝতে পারেনি। প্রেমহীন জীবন মূল্যহীন ব্যর্থ। এদের জীবনের কানাকড়িও মূল্য নেই, এরা শুধু বিয়ে নামের গতানুগতিক প্রকৃতির বলি। নিজেকে আমার ধন্য মনে হয়। আমার প্রেম আমার গর্ব আর ইমন হলো সেই গর্বের ধন। আমার ভালোবাসা আমাকে অস্থির ও চঞ্চল করে তুলে, লেখাপড়ার খবর নাই রাত দিন শুধু একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে থাকি।
আমি ছিলাম বোনদের চেয়েও সুন্দরী, এলাকায় আমার সমপর্যায়ের সুন্দরী কেউ ছিল না। ইয়ারসেন্স পরীক্ষার পর থেকেই পাত্রপক্ষ পতঙ্গের ন্যায় আমার রূপের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু বিয়ের আলাপ শুনলে আমার শরীরে যেন কাঁটা ফুটে। এর মধ্যে মা আবার নতুন উপদ্রব শুরু করেছে, ফিসফিসিয়ে আব্বার সাথে আলাপ করে। মাঝে- মধ্যে আমি শুনতে পাই মা বাবাকে বুঝায় 'তোমার এই মেয়ে বড় দুইটার মত নয়, এর হাবভাব ভালো ঠেকছে না। কি যেন এক ধান্দার উপর থাকে, শরীরটাও বাড়ন্ত। আমার ভয় হয় কখন জানি কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে। তাই বলছি ইন্টার পাশের দরকার নাই বিয়ে দিয়ে দাও, বিয়ের পর জামাই চাইলে পড়াবে না চাইলে বাদ। আমার কথা শুনো, ওকে বিয়ে দিয়ে আমাকে উদ্ধার কর আমি সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকি।
এই মহিলাটার ভরং দেখে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। বেশ কিছুদিন ধরে সে আমাকে সন্দেহ করে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। দিন দিন যেন আমি তার শত্রু হয়ে যাচ্ছি। অথচ আমার বাবা ও ভাইয়েরা কত ভাল, তারা এখনও আমাকে সেই ছোট্ট খুকিটি মনে করে। বাচ্চাদের মত বাজার থেকে এটা ওটা কিনে এনে খাওয়ায়। আমার ভাইয়েরা ভার্সিটি থেকে আসার সময় জামা-কাপড়, ব্যাগ বোরকা চশমা ঘড়ি কসমেটিক্স- একটা না একটা কিছু নিয়েই আসে, কখনো খালি হাতে আসে না। আমার বোনেরাও ঈদের সময় আমাকে জামা কাপড় উপহার দেয়। বাবা ও ভাইয়্যারা আমাকে না বলে আমার পরামর্শ ছাড়া কোন কাজ করে না। কেউ আমাকে সন্দেহ করে না, অবজ্ঞার চোখে দেখে না কিন্তু এই মহিলাটাই যত গোল বাধাচ্ছে। আম্মার তাকিদে আব্বাকেও দেখলাম নড়েচড়ে বসল। সম্ভবত আমার পরিবর্তনটা আব্বার চোখেও ধরা পড়েছে। আগে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসলে ‘ইন্টার পাসের আগে আমার মেয়েকে বিয়ে দিব না’ বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। কিন্তু এখন দেখি কেউ আসলে যত্ন-আত্তি করে, আলাপ-সালাপ করে।
হঠাৎ একদিন তিনজন লোক এসে উপস্থিত- মা মেয়ে ও ছেলে। আমি কিছুই জানি না অথচ তারা আমাকে দেখতে এসেছে। ছেলেটা স্মার্ট সুদর্শন, সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার। তারা আমাকে দেখে খুশিতে আত্মহারা, পাত্রী তাদের খুব পছন্দ। মহিলাটা তো আম্মার সাথে গায়ে পড়ে আলাপ জমিয়ে বসেছে। আবার মেয়েটা আমার রুমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ‘ভাবী ভাবী’ বলে একেবারে অস্থির করে তুলল আর আহলাদী আলাপ শুরু করল। আমি অবজ্ঞায় হাসি। আমার হাসি দেখে সে মনে করেছে তার ভাইকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। সে আরো আহলাদী হয়ে ভাইয়ের গুনকীর্তন শুরু করল, সেই সাথে বিয়ের পর আমার কাছে তার কি কি আবদার সেগুলির ফিরিস্তি পেশ করতে লাগল। বাচাল মেয়েটার বকবকানি শুনে আমি শুধু হাসি কিছু বলি না।
বিদায় বেলায় মহিলা ইনিয়ে বিনিয়ে বলল ‘বেয়াই শুভ কাজ ত্বরীতে, ভালো কাজে দেরি করতে নেই, আগামী মাসের দশ তারিখ বিয়ে। অর্থাৎ পচিশ দিন পর। আবারো আমি হাসলাম। কারণ যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া- পড়শির ঘুম নাই। এই মূর্খ মহিলা জানে না, যে হৃদয় সিংহাসনে ইমনকে বসিয়েছি সেখানে অন্য কারো জায়গা নাই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাদের সামনে যাবো না, তখন ইমনকে কল করলাম। সে বলল 'যাও সামনে না গেলে তো সমস্যা হবে, পরের চিন্তা পরে। আমিও ভাবলাম না গেলে মা বাবা আমাকে সন্দেহ করবে, সামনে গেলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাবে না। আপাতত যাই পরে চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
রাত দশটার পর যে শাড়ি অলংকার পড়ে মেহমানদের সামনে গিয়েছিলাম সেগুলি আবার পরে ইমনকে মিস কল দিলাম। সাথে সাথে সে ভিডিও কল করল। আমি নববধূর সাজে নিজেকে মেলে ধরলাম। সে বিস্ময়ে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন আমার রূপের সুধা আকন্ঠ পান করছে। সে সম্মোহিতের মতো দেখছে তো দেখছেই, চোখের পলক পর্যন্ত ফেলছে না। আমি ধমক দিলাম ‘এভাবে তাকিয়ে থাকবে নাকি একটা কিছু করবে? আগামী পচিশ তারিখ বিয়ে। এবার সে সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল ‘কি করা যায় তুমিই বল। বললাম 'আমার বলার কি আছে, তুমি যা বলবে তাই।
এরপর সে আমাকে পরখ করতে লাগল 'তোমার ইচ্ছা কি, তুমি কি রাজি আছো--- তোমার সম্মতি থাকলে--- ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্ন করে সে আমার অভিপ্রায় জেনে নিল। সম্মতি বুঝতে পেরে সরাসরি প্রস্তাব করল 'তাহলে তো আর দেরি করার দরকার নাই প্রস্তুত হও আমি গিয়ে তোমাকে ঢাকায় নিয়ে আসব। বললাম ‘ঢাকায় গিয়ে কোথায় থাকব, বিয়ে কোথায় হবে? সে বলল ‘আমি মা ও বোনের সাথে আলাপ করেছি, তারা রাজি কিন্তু তারা আব্বাকে এখনো সম্মত করাতে পারছে না। তবে আমি জানি তোমার মতো ডানা কাটা পরী দেখলে আব্বা পাগল হয়ে আমাদের বিয়ে দিবেন। এখন বল আমি কবে আসবো?
বললাম ‘আমার তৈরি হতে দুয়েকদিন সময় লাগবে, প্রস্তুতি শেষ হলে তোমাকে জানাব। তারপর সে আবার পাগলামি শুরু করল। আমিও কাপড় খুলে খুলে তার সামনে আমার দেহটাকে উন্মুক্ত করে দিলাম। সে বারবার বলতে থাকে ‘এদিকে ওদিকে’ আর আমিও ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখাই। সবশেষে নববধূর সাজে তুলা কতগুলি সেলফি পাঠিয়ে নিষ্কৃতি পেলাম। আনন্দে আমার মনটা ভরে উঠেছে। আমার সাধনার ধন আমার ইমনের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি। শীঘ্রই বড়লোকের বউ, বড় লোকের পুত্রবধূ হতে যাচ্ছি। আমার চোখ দুটি স্বপ্নময় হয়ে ওঠে।
তিন দিন পর আমার প্রস্তুতি শেষ হল। আব্বার ড্রয়ার থেকে চল্লিশ হাজার টাকা আর আম্মার গহনাগুলি চুরি করতে সক্ষম হয়েছি। আরো কিছু প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে প্রস্তুতি সম্পন্ন করলাম। রাতে নিজের ঘরে পায়চারি করছি, আমার শরীর কাঁপছে ভীষণ ভয় লাগছে। কারণ আমি কোথায় যাচ্ছি কার কাছে যাচ্ছি, কোন অজানা সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছি? যাকে কোনদিন চাক্ষুষ দেখিনি তার কি বিশ্বাস আছে? তাছাড়া সে যা বলেছে সে সব সত্যি কি মিথ্যা তাই বা কে জানে। এক অজানা আশঙ্কায় আমার হাত পা কাপছে, দর দর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তখন ইমন ভিডিও কল দিল, আমাকে দেখেই বলল 'কি ব্যাপার তুমি কাঁদছো নাকি? আমি গম্ভীর হয়ে সরাসরি বললাম 'আচ্ছা তোমাকে আমি চিনি না কোনদিন দেখি নাই তুমি যা বলছ তা সত্য না মিথ্যা তাও জানি না। তুমি আদৌ ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র কিনা, উত্তরায় আদৌ তোমাদের বাসা আছে কিনা- এসবের কি নিশ্চয়তা আছে?
ইমন তার চিরায়ত মুলায়েম কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো ‘ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছ তুমি। আমাকে কি তুমি এতটাই নীচ মনে কর? আমার প্রতি তোমার এটুকু আস্থা না থাকলে আমরা একসাথে জীবন কাটাব কেমনে, আমাকে কি তোমার মিথ্যাবাদী মনে হয়? এরপর সে বিভিন্ন প্রমাণ দিতে লাগল, ঢাকা ভার্সিটির ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন শিক্ষকের নাম বলল, তার কয়েকজন ক্লাসমেটের নাম বলল, তাদের সাততলা বাসাটা উত্তরার কোন জায়গায় তার একটা মৌখিক নকশা পেশ করে বলল 'শোনো এসব বিষয়ে কেউ মিথ্যা বলে না। সে দিব্বি কাটলো ও বিভিন্ন ওয়াদা প্রতিশ্রুতি দিল। তারপর বলল ‘এরপরেও তোমার সন্দেহ হলে তুমি আরো যাচাই করে দেখতে পার।
আমি আজীবনের সহজ-সরল মেয়ে, কোন ঘোর প্যাচ বুঝি না। তার কিরা কসম, মধুর ব্যবহার ও জাদুময় কথায় মোমের মতো গলে গেলাম। সন্দেহজনক কথাবার্তার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করে বললাম ‘আসলে মা-বাপ ভাই-বোন সব কিছু ছেড়ে যাচ্ছি তো, এ জন্যই মনটা খারাপ তুমি কিছু মনে করো না। সে বলল ‘বুঝতে পারছি, আমি মাইন্ড করিনি। তারপর সে আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল- আমার জন্য সে জীবন উৎসর্গ করবে, আমার সুখের জন্য কি কি করবে ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি শোনাতে লাগল। এমনিতেই আমার মন খারাপ তার উপর বকবকানি শুনে আমার মাথা ধরে গেল। বললাম ‘আজ আর বেশি কথার দরকার নাই ঘুমাও। কাল দশটা থেকে এগারটার মধ্যে আমার কলেজের দক্ষিণ পাশের যে চৌরাস্তাটা আছে সেখানে থাকবে। তারপর জায়গাটার পরিচয় দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু ঘুম আসে না, শুধু এপাশ ওপাশ করি। এক অজানা আতঙ্কে আমার বুকটা দুরু দুরু কাপে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বুকে ঝাপ দিতে যাচ্ছি আল্লাহই জানে ভাগ্যে কি আছে। একবার ভাবি যাব একবার ভাবি যাব না। এভাবে দুটানায় ছটফট করতে করতে রাত পোহালো, এক ফোটা ঘুম হলো না, সকালেও ঘুম হলো না। আব্বা আজ সকাল সকাল বেরিয়ে গেছেন। কারণ তিনি টাউনে যাবেন, আমার বিয়ের কার্ড, গহনাগাটি, কাপড়-চোপড় ইত্যাদির অর্ডার দিবেন। আমি খাওয়া দাওয়া করে সুযোগের অপেক্ষায় বসে রইলাম। কলেজে যাওয়ার জন্য বাইরে রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে। যখনই দেখলাম আম্মা উচ্ছিস্ট বাসন মাজতে কল পাড়ে গেছে তখনই ভ্যানিটি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রিকশায় উঠে একটানে কলেজের পাশের চৌরাস্তায় গেলাম। নেমেই দেখি আমার স্বপ্নের রাজকুমার দাঁড়িয়ে আছে। সেই জমকালো পোশাক, নায়কের মত কালো চশমা মাথায় ইংলিশ ক্যাপ। এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরলাম। আগেই সে সিএনজি প্রস্তুত রেখেছিল। একটানে গেলাম জেলা সদরে, সেখানে ঢাকার বাসে চড়ে শুরু হল আমার নিরুদ্দেশ যাত্রা। যে বাবা-মা ভাই-বোন আজীবন আমায় মাথায় রাখেনি উকুনে খাবে বলে, মাটিতে রাখেনি পিপড়ায় খাবে বলে, রেখেছে বুকের উপর। সেই বুকে লাথি মেরে অপরিচিত এক পুরুষের হাত ধরে চললাম। একবার পিছন ফিরে তাকালাম না, তাদের মান-সম্মান ও জীবন-মৃত্যুর কথা চিন্তা করলাম না। অপরিচিত এক পুরুষকে তাদের উপর প্রাধান্য দিলাম। কাজেই আমার মত মেয়েদের ভাগ্যে নির্মম পরিণতি হওয়াই উচিত।
বাসায় পৌছে আমি প্রথম ধাক্কা খেলাম। বাসা না বলে এটাকে পুরো বাড়ি বলাই ভাল। বহু আগেই পলেস্তারা উঠে ইট ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ধাক্কা খেলাম আমার প্রেমিকের চেহারা দেখে। ক্যাপ খুলতেই দেখা গেল চান্দিতে চুল নাই, টাক মাথার কারণে বয়স আন্দাজ করা গেল না। গগলস খোলার পর দেখলাম চোখ দুটি গর্তে পড়ে আছে, দেখে মনে হয় আগুনে পোড়ার মত জ্বালাময়, এমন উদ্ভূত চোখ আমি জীবনে দেখিনি। বুঝতে পারলাম ভিডিও কল করার সময় তার কেপ-চশমা পরে থাকার কারন। গায়ের রং কিছুটা ফর্সা হলেও শ্রমিকদের মতো রোদে পুরা মলিন। আমি হতোদ্যম হয়ে কি বলব দিশা না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘নিজের বাসায় না গিয়ে এখানে আসলে কেন? সে বলল ‘বাসায় একটু সমস্যা, আমার মা বোন এখনো আব্বাকে রাজি করাতে পারেনি। শীঘ্রই তাকে রাজি করিয়ে তোমাকে নিয়ে বাসায় চলে যাব।
বললাম ‘এখন থাকব কোথায়, বিয়ে ছাড়া তো একসাথে থাকা যাবে না। সে একটা মন ভুলানো হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল, চুম্বন করে বলল 'আরে বিয়ে তো হবেই। তারপর জোর করেই আমাকে নিয়ে রাত্রি যাপন করলো। অজানা আশঙ্কায় আমি ভেঙ্গে পড়লাম, কি করব কর্তব্য স্তির করতে পারছি না। সকালে সে বলল ‘বাইরে বেরিও না। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে’ বলে বাইরে চলে গেল। সন্ধ্যার পর একটা মাদ্রাসা ছাত্র আর দুইজন লোক নিয়ে হাজির হল। লোক দুইটা সম্ভবত কোনো মিল কারখানার শ্রমিক। আমাকে বলল ‘আব্বাকে রাজি করিয়ে শীঘ্রই বাসায় চলে যাব, সেখানে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ধুমধাম করে কাবিনসহ আমাদের বিয়ে হবে। এখন আপাতত মৌখিকভাবে বিয়েটা পড়িয়ে রাখি। বিয়ে হয়ে গেল। শুরু হলো আমার হতাশা আর অনিশ্চিত সংসার যাত্রা।
শীঘ্রই বুঝতে পারলাম ইমন ভার্সিটি ছাত্র তো দূরের কথা সাধারণ শিক্ষিতও নয়। কারণ সে সাধারণভাবে কথা বললেই একদম গেঁয়ো ভাষা ব্যবহার করে। আমি সাধারন কথ্য ভাষায় ব্যবহৃত দু-একটা ইংরেজি শব্দ বললে সে অর্থ বুঝে না, ধরা পড়ার ভয়ে চকিত হয়ে সরে যায়। তাছাড়া শিক্ষিত বা ভার্সিটি ছাত্র হওয়ার মত শারিরিক মানসিক ব্যবহারিক নূন্যতম নিদর্শন তার মধ্যে নেই। কারণ ছাত্রদের শরীর থাকে কোমল লাবণ্যময় কিন্তু তার চেহারা যেমন রুক্ষ তেমনি শরীরও ক্ষেত কামলাদের মতো রোদে পুরা মলিন। হাত-পা কাঠ কয়লার মত ফাটা ফাটা, হাতের তালু আঙ্গুলের গিরা শক্ত কর পড়া। দেখেই বুঝা যায় গার্মেন্টস সোয়েটার বা এ জাতীয় কোন ফ্যাক্টরীর শ্রমিক। আমি ভেঙ্গে পরলাম।
সে সকালে যায় একদম সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে, তখন তাকে কর্মক্লান্ত দেখায়। আমি জিজ্ঞেস করি সারাদিন কোথায় থাকো? সে বলে ‘কেন ভার্সিটিতে। - ভার্সিটি যাও তোমাকে তো পড়তে দেখি না, তোমার বই-পুস্তকও তো দেখি না। - আরে বই-পুস্তক বাসায়, কদিন পর বাসায় গিয়েই পড়তে বসব। - তোমাদের বাসাটা কোথায় আমাকে একটু দেখাও না। - রাখো আর কয়েকটা দিন সবুর কর। মা ও বোনের চাপে আব্বা দুর্বল হয়ে এসেছে শীঘ্রই বাসায় চলে যাব।- আমিও তোমার সাথে ভার্সিটি যাব, ঘুরেফিরে দেখব। - আরে রাখো বাসায় গেলেতো গাড়ি নিয়ে শুধু ভার্সিটি কেন সারা শহর সারা দেশ ঘুড়ে বেড়াবে। আমি তার হাত ধরে বলি 'তোমার হাতের তালু এমন কেন? সে চমকে উঠে কিন্তু এই ধুরন্ধর পলকে নিজেকে সামলে নিয়ে মধুমাখা হাসি দিয়ে বলে ‘আর বলো না আমি ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম করি, ভারোত্তোলন ও অন্যান্য কসরত করতে গিয়ে এ অবস্থা হয়েছে। তাছাড়া বাসে হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আনাগুনা করি তো, এজন্য কর পড়ে গেছে।
তারপর সে আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর সোহাগ করে, স্মিত হাস্যে মধুময় বচনে কথা বলে। যুক্তি প্রমাণ দিয়ে তার বড়ত্ব জাহির করে, ভবিষ্যতের বড় বড় স্বপ্ন দেখায়। আসলে আমি অতিশয় সরল মেয়ে, তার ছলা কলা ও জাদুময় কথায় আমার আস্থা ফিরে আসে। তাকে বিশ্বাস করি তার বুকে নিজেকে সমর্পণ করি। কিন্তু যখনই সে বাইরে চলে যায় আর আমি একা চিন্তা করার সুযোগ পাই তখনি বাস্তবতা আমার সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। আমি হতাশ হই, ভয় পাই- কি আছে আমার ভাগ্যে, এখন আমি কী করতে পারি? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিছানায় পড়ে থাকি।
দুই সপ্তাহ কেটে গেছে, কেউ দেখে ফেলার ভয়ে বাইরে বের হই না। কিন্তু একাকী আবদ্ধ ঘরে দুশ্চিন্তা ও হতাশায় আমার পাগল হবার অবস্থা। একদিন বিকালে দরজা খুলে ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আসার সময় টঙ্গীর সাইনবোর্ড দেখে এসেছিলাম, এ জায়গাটা সম্ভবত টঙ্গি বা এর আশপাশ কোন এলাকা হবে। বাড়িটা বিচ্ছিন্ন, আমার পাশের ঘরে লোক আছে। একটু দূরে দুইটা যুবতী মেয়ে ও একজন বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, দেখেই বুঝা যায় গার্মেন্টস কর্মি। তারা আমাকে দেখেই 'আরে ইমরানের বউ এত সুন্দর' বলে এগিয়ে আসল। মহিলাটা আমার নাম ধাম ও পরিচয় জানতে চাইল। কিন্তু পরিচয় জেনে তার চোখ কপালে উঠল, বিস্ময়ের সুরে বলল ‘তোমার মা-বাবা কি অন্ধ নাকি, এমন ধনী শিক্ষিত পরিবারের সুন্দরী মেয়েকে আবার এমন লোকের সাথে বিয়ে দেয় কেমনে?
আমি গর্ব সহকারে ইমনের পরিচয় দিলাম। আমার কথা শুনে মেয়ে দু’জন হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ল। একজন তার আসল পরিচয় তুলে ধরলো ‘ওর নাম ইমরান, বাড়ি জামালপুরের ঝগড়ার চর। আমাদের বাড়িও একই গ্রামে, ওর বাপ দর্জির কাজ করে। সে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় আছে বাড়িতে তার বউ আছে একটা ছেলে আছে--- এ পর্যন্ত শুনেই আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল চোখে অন্ধকার নেমে এলো, পৃথিবীটা যেন লাটিমের মত ঘুরছে। আমি টলতে টলতে কোন রকমে ঘরে গিয়ে ধপাস করে বিছানায় পড়লাম। বুক ফেটে গলা ছিড়ে কান্না আসছে, মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে লাগলাম। অনুশোচনার দহন আর তীব্র মানসিক চাপে আমার জ্বর উঠে গেল। এভাবেই শুয়ে থাকলাম, রাতে কিছুই খাওয়া হলো না।
পরদিন কৌশল করে বললাম ‘এই অবস্থায় থাকলে আমি মরে যাব। আমাদের বাড়িতে চল, আমাদের অনেকেই চাকরি বাকরি করে তাদেরকে বলে কয়ে তোমার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে। অথবা আব্বাকে বলে তোমাকে কোন ব্যবসা জুড়িয়ে দেয়া যাবে। সে চাতুর্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বলল ‘আরে এতো ব্যস্ত হলে চলবে, এই তো কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা বাসায় চলে যাব। আমি কান্নাকাটি করি না খেয়ে থাকি কিন্তু আমার কথা সে গায়েই মাখে না।
আমার মরণ যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, সর্বদা বাড়ির কথা মনে পড়ে। খাওয়া নাই ঘুম নাই কেমন পাগলিনি হয়ে উঠেছি। সব সময় বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে থাকি, স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাচ্ছে। জীবন মৃত্যুর পাল্লা সমান হয়ে উঠেছে, জীবনের চেয়ে মৃত্যুর দুয়ার নিকটবর্তী মনে হচ্ছে। সব সময় বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে তাকাদা দেই কিন্তু সে তার অভিনয় চালিয়েই যায় ‘এই তো শীঘ্রই বাসায় চলে যাবো।
একদিন বললাম ‘তোমার যে কেমন বাসা আছে তা আমার জানা হয়ে গেছে। আর তুমি যে কোন ভার্সিটির ছাত্র তাও জানা হয়ে গেছে। সহসা তার চেহারা পাল্টে গেল, মুখটা বিকৃত হয়ে কালো হয়ে গেল। এত দ্রুত মানুষের চেহারার রং পাল্টাতে আমি দেখিনি। কিন্তু এই ধুরন্ধর মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে রুক্ষ স্বরে বলল ‘সব জেনে ফেলেছো? - হাঁ তোমার বউ আছে বাচ্চা আছে সবকিছু।- তাহলে এখন কি করবে?- বাড়িতে চলে যাব। - চলে যাবে কেন, আমি তোমার স্বামী আমার সাথেই থাকতে হবে। - না আর এক মুহূর্তও আমি এখানে থাকবো না। - আমি তোমাকে যেতে দিবো না, তুমি আমার বিবাহিত বউ। - আমাকে আজই নিয়ে যেতে হবে নইলে আমি চিৎকার করব, আশপাশের সবাইকে জানিয়ে দিব। - তাতে কোন লাভ হবে না। - তাহলে আমি পালিয়ে যাব।
সে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল 'ঠিক আছে আমাকে দুই দিন সময় দাও একটু প্রস্তুতি নিই। নতুন শ্বশুর বাড়ি যাব খালি হাতে তো আর যাওয়া যাবে না। পরের দুই দিন সে সকালে বেরিয়ে গেল অনেক রাতে বাসায় ফিরল। তৃতীয় দিন বললো চল ‘তোমাকে বাপের বাড়ি রেখে আসি। সে সিএনজি নিল, ঘন্টা দুয়েক পর আমাকে নিয়ে একটা জলাময় এলাকায় আসল। এখানে অনেকটা দূরে দূরে বিচ্ছিন্ন বাড়িঘর। একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল ‘এটা আমার খালার বাড়ি, তুমি এখানে বস আমি বিমানবন্দর গিয়ে ট্রেনের টিকিট নিয়ে আসি। মহিলাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, বুড়ি অথচ জর্জেটের নকশি শাড়ি পড়ে বসে আছে। বিশাল ভুড়ি রুক্ষ চেহারা মুখভর্তি পান চিবাচ্ছে।
মহিলাও আমাকে দেখে কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল, ইমরানকে বলল ‘তোমার বউ যে এত সুন্দরী তা তো ভাবিনি। তারপর সে আমার পরিচয় নিল। বুঝা গেল মহিলা আমাকে দেখে খুব খুশী, যত্ন-আত্তি করতে লাগল। ইমরান বলল ‘খালা শুধু আলাপ করবেন নাকি ওকে একটু বিশ্রাম করতে দেবেন, লম্বা জার্নি। ‘হা হা ঠিকই তো' বলে মহিলা আমাকে পাশের একটা রুমে নিয়ে গেল। আমার ব্যাগ মহিলার রুমেই পড়ে রইল, আমি শুয়ে বসে সময় কাটাতে লাগলাম।
এমরান দুপুরে গেছে এখন বিকাল গড়িয়ে যাচ্ছে আসছে না দেখে আমি মহিলাকে জিজ্ঞেস করার জন্য ঘর থেকে বের হলাম। আমাকে দেখে কয়েকটা যুবতী মেয়ে মিটিমিটি হাসছে আর ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। অজানা আতঙ্কে আমার গা ছমছম করে উঠল, পরিবেশটা কেমন অস্বাভাবিক ভীতিকর। তখনই মহিলা বেরিয়ে এসে ধমকে উঠল ‘তুমি বাইরে কেন ঘরে যাও। আমি ইমরানের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বলল ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। আশংকায় আমার হাত পা কাপছে, সন্ধ্যা মিলিয়ে রাত্রি নেমেছে আমি ছটফট করছি।
হঠাৎ মধ্যবয়স্ক দৈত্যাকৃতির একজন লোক জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখল। তারপর মহিলার ঘরে চলে গেল। আমার নাকের ডগায় দম এসে গেছে। পরক্ষণেই মহিলা লোকটাকে নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে বলল ‘শোনো মেয়ে তোমাকে আমি দুই লাখ টাকা দিয়ে কিনে রেখেছি। এখন খদ্দের মাতিয়ে আমার টাকা সুদে আসলে উসুল কর। শুনেই আমি ‘ওয়াল্লা গো’ চিৎকার দিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিলাম। মহিলাটা আমার চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বিছানায় ফেলল। তারপর লোকটাকে ইঙ্গিত দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেল। আমি লাফিয়ে উঠে লোকটার পায়ে পরে জবাই করা মুরগির মত ধাপড়াতে লাগলাম ‘আপনি আমার ধর্মের বাপ, আমাকে বাঁচান আমাকে আমার মা বাপের কাছে যেতে দেন। আমার বুক ফাটা আর্তনাদ লোকটার কানে ঢুকল না।
সে আমাকে জড়িয়ে ধরে স্পর্ষকাতর জায়গায় হাত চালাতে লাগল। আমি তার হাত কামড়ে দিলাম। লোকটা আর্তনাদ করে ‘কবিতা কবিতা’ বলে মহিলাকে ডাকল। সে এসে আমাকে কিল ঘুষি মারল, আমিও তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দৌড় দিতে চাইলাম। লোকটা আমাকে খপ করে ধরে ফেলল। তারপর দু’জনে বেদম মারতে লাগল- চড় ঘুষি লাথি মারতে মারতে আধমরা করে বিছানায় ফেলে মহিলা চলে গেল। আমি মা বাবা ও ভাইদের ডেকে ডেকে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। ততক্ষনে লোকটা পাশে শুয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। এরপর রাতভর চলল আমার অর্ধমৃত দুর্বল কচি দেহটার উপর পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট, নির্মম ও বর্বর নির্যাতন।
মহিলাটার নাম কবিতা, সারা জীবন বেশ্যাবৃত্তি করে শেষ বয়সে নির্জন প্রান্তরে এই বাড়িটা ভাড়া নিয়ে মিনি পতিতালয় খুলে বসেছে। আর এই লোকটা ব্যবসায়ী, এখানে নতুন মাল এলে সে দশ হাজার টাকায় প্রথম রাত্রি যাপন করে। কিন্তু আমার রূপ দেখে এক রাতের জন্য সে কবিতাকে বিশ হাজার টাকা দিয়েছে। পরদিন সকালে আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না, ঝড় কবলিত সুপারি গাছের মতো নেতিয়ে পড়লাম। এর মধ্যে আরও খদ্দের এলো আমি বাধা দিলাম, তারা আমাকে মেরে আধমরা করলো তারপর চলল পাশবিক নির্যাতন। এরপর একের পর এক খদ্দের আসতে থাকে, আমি প্রতিরোধ করি আর মার খেয়ে বিছানায় পড়ি, তারপর ধর্ষিতা হই। এভাবে নরকের কীটেরা আমার দেহটাকে কুরে কুরে ছিন্নভিন্ন করে খেতে লাগল।
খদ্দেরদের মধ্যে আমার রূপ যৌবনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে, তারা হুমরি খেয়ে পড়ল। আমাকে দিয়ে সর্দারনী আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই আমার কদর বেড়ে গেল, দুইটা পুরান পতিতা আমার জন্য নিয়োগ দিল। আমি খেতে না চাইলে তারা বুঝিয়ে শুনিয়ে বা জোর করে মেরে ধরে খাওয়ায়, সব সময় রাজকন্যার মত সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। বড় বড় বিত্তবান ধনী খদ্দেররা আসতে থাকে, আমাকে দেখলেই যেন তাদের আজন্মের ক্ষুধা বেড়ে যায়, অক্টোপাসের মত ঝাপটে ধরে। আমার কচি দেহটা দলে মলে পিষে ভর্তা বানিয়ে চলে যায়। নারী দেহ যে পুরুষের খাদ্য, চরম ও পরম লোভনীয় খাদ্য- এটা আমার পূর্বে জানা ছিল না।
ততদিনে আমার প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙ্গে গেছে, মার খেতে খেতে একসময় হাল ছেড়ে দিলাম, নিজেকে পরিস্থিতির হাতে সমর্পণ করলাম। আমার খ্যাতি শুনে খাদ্য লোভি নরকের কীটেরা বিরতিহীন আসতে থাকে, বন্য কুকুরের মত আমার দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করে রক্তমাংসের স্বাদ আস্বাদন করতে থাকে। আমি নিরেট একটা যৌন মেশিনে পরিণত হলাম।
পালানোর অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন সুযোগ নাই। দুইজন পতিতা সারাক্ষণ আমার সাথে ছায়ার মত লেগে থাকে, কবিতা চোখে চোখে রাখে। আমার রুমটা দু’তলায়। অবসর সময়টা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। অদূরেই একটা নদী, চৈত্রের খরায় জল শুকিয়ে ক্ষীন একটা ধারা বইছে আর চরের বালুকারাশি রোদে পোড়ে অঙ্গার হচ্ছে। অথচ বর্ষায় তার দুকূল ছাপিয়ে যৌবনের ধারা ছোটে। আমি শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি- এই নদীটার সাথে আমার জীবনের কত মিল। একদিন আমি সুখ ও হাসি আনন্দের জোয়ারে ভাসতাম অথচ আজ আমার জীবন প্রবাহ ঐ নদীটার মতই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। মা-বাবা-ভাই-বোন আমাকে অন্ধের মত ভালবাসত। ছোটবেলায় আমাকে কোলে নেয়ার জন্য ভাই-বোনদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। বড় হয়ে ভাইদের সাথে একই স্কুলে পড়তাম, তারা আমার বইয়ের বোঝা বহন করত, সব সময় এটা ওটা কিনে খাওয়াত। একসময় বড় ভাই ঢাকা ভার্সিটি আর ছোট ভাই রাজশাহী ভার্সিটি ভর্তি হলো। তারা বাড়িতে আসলে আমার জন্য কাপড় চোপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসতো। বাবা-মা-ভাই-বোন কোন কাজ করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করত, আমাকে না জানিয়ে কেউ কোন কাজ করত না। আমি ছিলাম পরিবারের মধ্যমনি।
বোনেরা আমাকে ছাড়া থাকতে পারত না, জোর করে তাদের শশুর বাড়ি নিয়ে যেত। বড় বোনের জামাই সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক আর ছোট বোনের জামাই কলেজ শিক্ষক। আমি ছিলাম তাদের চেয়েও সুন্দরী ও দীর্ঘাঙ্গি, পরিবারের আশা ছিল আমাকে আরো বড় চাকরিজীবী দেখে বিয়ে দিবে। হায় কপাল, যেখানে আমার রাজরানী থাকার কথা ছিল সেখানে নিজের দুর্মতির কারণে আজ আমি বেশ্যা, বারবনিতা- শত পুরুষের ভোগের সামগ্রী। মা বাবা ভাই বোনের আদরের দুলালীর আজ এ কেমন পরিণতি। ওহ খোদা আমার মরন কতদূর।
এই নরকপুরীতে আমার তিন মাস কেটে গেছে। উপর্যপুরি দৈহিক পীড়ন, কলুষিত জীবন আর মানসিক চাপে আমার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। চোখ কোটরাগত, চর্মাচ্ছাদিত হাড়ের খাচায় কোনরকম ধোক ধোকে প্রাণটা টিকে আছে। আয়নায় নিজের চেহারা নিজেই চিনতে পারি না। আগের রূপ যৌবন আর কিছুই নাই। নরকের কীটেরা এতদিন খুবলে খুবলে আমার দেহটা খেয়েছে কিন্তু এখন আর এই কঙ্কাল দেহের রসাস্বাদনের জন্য কেউ আসে না, আগের টানে দুয়েকজন আসলেও চেহারা দেখে নাক সিঁটকে চলে যায়। এই দেহ এখন উচ্ছিষ্ট পরিত্যক্ত, কারো কাছে এখন আর আমার কোন কদর নাই। কবিতা এখন আমার খোঁজ খবর নেয় না, কেউ পাহারাও দেয় না। একবার ভাবি পালিয়ে যাব, পরক্ষনেই মনে হয় কোথায় যাব, বাড়ীতে? নাঃ আমি চাইনা আমার পরিবারে আমার অভিশপ্ত জীবনের কালো ছায়া পড়ুক। তার চেয়ে এখানেই থাকি, আমার জীবন প্রদীপের সলতে তো প্রায় শুকিয়ে এসেছে।
পঙ্কিল জীবনের গ্লানি হতাশা ও নৈরাশ্যের বুঝা আর বইতে পারি না। মানসিক বিকার দেখা দিয়েছে। নাওয়া-খাওয়া নাই ঘুম নাই সব সময় বিছানায় পড়ে থাকি, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে থাকি- এই তো বড় ভাইয়া একটা জামার সেট নিয়ে এলো, ছোট ভাই একটা ব্যাগ নিয়ে এসে বলল ‘দেখ পছন্দ হয়েছে? বাবা এক গ্লাস পানির জন্য ডাকলো, মা খাওয়ার জন্য ডাকছে--- এভাবে সব সময় মা বাবা ভাই বোনদের ডাক আমার কানে বাজে। ঘোরের মধ্যে আমি মা বাবার সাথে বায়না ধরি, ভাই বোনদের সাথে খুনসুটি করি আড়ি ধরি, এভাবেই আমার রাত দিন কাটে। যখন হুশ পাই তখন সমগ্র জগতটাই যেন একটা প্রশ্ন হয়ে আমার সামনে দেখা দেয়- যেসব মেয়েরা মা বাবা ভাই বোনের স্বর্গীয় ক্রোড় ছেড়ে পরপুরুষের হাত ধরে বেরিয়ে গিয়ে তাদের মুখে চুনকালি দেয়- সে সব মেয়েদের ভাগ্যে কি এর চেয়ে উত্তম পরিণতি হতে পারে, না কি হওয়া উচিত?
খাতাটা এ পর্যন্তই লেখা ছিল। ঘটনাটা পড়ে আমি বিমর্ষ হয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। পরক্ষণেই সম্বিত ফিরে পেয়ে উঠে বসলাম ‘নাঃ, মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। নিশ্চয়ই সে অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সুস্থ হলে তার মা বাপের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু তারা তো জানতে চাইবে তাদের মেয়ে এতদিন কোথায় ছিল, তখন কি বলব? তখন বলতে হবে এক লম্পটের হাত থেকে উদ্ধারের পর মেয়েটি আমার মায়ের কাছে ছিল বা হাসপাতালে ছিল বা একটা কিছু বানিয়ে বলতে হবে, বেশ্যালয়ের কথা কখনো বলা যাবে না। তাহলে আশা করা যায় সেই ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বা অন্য কোন ভাল পাত্রের সাথে ওর বিয়ে হবে, মেয়েটা আবার সুখের ঠিকানা খুঁজে পাবে। আনন্দে আমার মনটা নেচে উঠলো, কারন পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় মানব সেবা আর কিছু নাই।
তাড়াতাড়ি মেয়েটার কাছে পৌঁছানোর জন্য শাহিনকে কল দিলাম কিন্তু সে কল কেটে দিল। বুঝলাম কাছাকাছি এসে গেছে, পাঁচ মিনিট পর সে এসে হাজির হলো। আমি ব্যাগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘মেয়েটা এখন কোথায়? সে বলল ‘নদীর চরে। - মানে? - মানে হলো গতরাতে মেয়েটা মারা গেছে, লাশ নদীর চরে ফেলে দেয়া হয়েছে। ‘মারা গেছে’ আমার অন্তরাত্মা তোলপাড় করে একটা বিষাক্ত আর্তরব মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, কান্নার একটা প্রমত্ত ঢেউ এসে গলায় আটকে রইল। সীমাহীন কষ্টে আমি নাড়াচাড়া করতে পারলাম না, বজ্রাহতের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। শাহিন তাড়া দিল ‘চল তাড়াতাড়ি চল, মেয়েটার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি কিছু না বলে সম্মোহিতের মত তার পিছু পিছু চললাম।
অদৃশ্য বন্ধন
জরিনা গার্মেন্টস থেকে বেরিয়ে ড্রেনের পাশে বসে বমি করতে লাগল, তার শরীরটা ভীষণ ভাবে কাঁপছে। মেয়ে সখিনা উবু হয়ে তার কাঁধে ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর মায়ের শরীর শান্ত হলে সখিনা রিকশায় করে তাকে নিয়ে বাসায় ফিরল। তারা থাকে উত্তরার একটা বস্তিতে। বাসায় পৌঁছে জরিনার আবার দাস্ত- বমি শুরু হল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ল। হাত পা ছড়িয়ে দিয়েছে, শরীর অবশ হয়ে গেছে। আসলে গ্রামের মুক্ত পরিবেশের মুক্ত হওয়া ছেড়ে ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে এসে অনেকেই টিকতে পারে না। তার উপর বস্তির নোংরা পরিবেশে রোগ বালাই লেগেই থাকে। জরিনা দীর্ঘদিন ধরে জন্ডিসে ভোগছে। কিন্তু এখন জ্যৈষ্ঠের গরমে গ্যাস চেম্বারের মত উত্তপ্ত গার্মেন্টসে পাতিলের ভাতের মত সেদ্ধ হয়ে যায়। ফলে দাস্ত- বমিসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
সখিনা মাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ শুরু করল। কারণ তার মা কথা বলছে না, ঘাড় ছেড়ে দিয়েছে। কান্নাকাটি শুনে আশপাশ ঘরের মহিলারা ছুটে এসেছে। সবাই বলাবলি করছে 'তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে নইলে টিকানো যাবে না। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল কে নিয়ে যাবে? জরিনার পাশের রুমে থাকে তিনজন মেয়েলোক, তারপরের রুমে থাকে রতন ও তার মা। রতনের মা ছেলেকে বলল ‘যা, তোর চাচীকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যা। জরিনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সখিনা সার্বক্ষণিক মায়ের কাছে থাকে, রতনের মা তাদের জন্য ভাত তরকারি রান্না করে দেয় আর রতন হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। সে গার্মেন্টসের সময়টুকু বাদে বাকি সময় রুগির পাশে থাকে। এক সপ্তাহ পর জরিনা বাসায় ফিরল।
রতন খুব কর্মঠ ছেলে। সে সময়টাকে দুই ভাগ করে নিয়েছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত গার্মেন্টস করে তারপর গভীর রাত পর্যন্ত ফুটপাতে বসে টুকটাক ব্যবসা করে। কখনো পাইকারি দামে তরিতরকারি কিনে ফুটপাতে বসে বিক্রি করে। কখনো ফুল বেছে, শীতকালে নিলামে কাপড় কিনে বিক্রি করে। এভাবে যখন যা সুবিধা পায় তাই করে। এতে তার যথেষ্ট আয় হয়। তার মা-ও বসে নেই, সেলাই কাজ করে। প্রথম তারা যখন ঢাকায় আসল তখন তার মাও গার্মেন্টসে কাজ করতে চাইল কিন্তু এটা রতনের আত্মসম্মানে বাধল। সে বলল ‘আমার মত জোয়ান ছেলে থাকতে তুমি গার্মেন্টসে কাজ করবে কেন? তুমি বাসায় থাক প্রয়োজনে আমি বাড়তি উপার্জন করব। এরপর থেকেই সে রাতে ব্যবসার কাজে নামে।
এভাবে কিছুদিন চলার পর মা ছেলেকে বলল ‘হাত গুটিয়ে বসে থাকতে আমার আর ভাল্লাগে না। আমাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দে টুকটাক কাজ করলে আমার সময়টাও কাটবে কিছু আয়ও হবে। রতন ভাবলো প্রস্তাবটা মন্দ না, সে একটা মেশিন কিনে দিল। আগে থেকেই রতনের মা সেলাই কাজ জানে, সে মহল্লার মেয়েদের কাপড় চোপড় সেলান শুরু করলো। এতে তাদের যথেষ্ট উপার্জন হয়, অর্ধেক টাকা সংসারে ব্যয় করে বাকি অর্ধেক ব্যাঙ্কে জমা করে।
রতন তরিতরকারির ব্যবসা করছে। প্রতিদিন রাতে সে একটা পলিথিনে করে কিছু তরকারি নিয়ে সখিনাদের ঘরে যায়, বসে বসে টেলিভিশন দেখে ও গল্পগুজব করে। সখিনার মা তরকারির দাম দিতে চায় কিন্তু রতন বলে ‘চাচী এগুলো আমার কিনা না লাভের তরকারি, দাম দিবেন কেন? জরিনা খুশি হয়, মাঝে মধ্যে তাকে যত্ন-আত্তি করে খাওয়ায়। সে রতনের উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারে। ছেলেটা টিভি দেখার ভান করে সখিনার সাথে কথাবার্তা বলে, তার দিকে তাকিয়ে থাকে অনর্গল হাসে। কিন্তু সখিনা ঘরে না থাকলে বসে না। জরিনা মনে মনে খুশি হয়, ছেলেটা কর্মঠ, এর সাথে সখিনার বিয়ে হলে ভাগ্যই বলতে হবে।
সে মেয়েকে উস্কাতে থাকে এই বলে যে ‘ছেলেটা কর্মঠ, স্বভাব চরিত্রও ভাল। আজকালকার ছেলেদের কত বাজে নেশা থাকে, মদ গাঁজা খায় বাজে আড্ডা দেয় মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়ায়। অথচ রতনটার এসব কোন নেশা নাই। সারাদিন গার্মেন্টসে কাজ করে আবার অর্ধেক রাত পর্যন্ত ব্যবসাও করে অথচ মাকে কাজ করতে দেয় না। এতো ভালো ছেলে আজকাল পাওয়া যায় না।
অসুখের পর থেকে জরিনা আর গার্মেন্টসে যায় না। তাই মেয়েকে বলল ‘তুই রতনের সাথে গার্মেন্টসে যাওয়া-আসা করবি। রতনকেও বলে দিলো ‘বাবা তুমি ওকে সাথে করে নিয়ে যাবে- নিয়ে আসবে। দেখো না ওই হারামজাদা আলালটা বেশ কিছুদিন ধরে বিরক্ত করছে। আলাল একই বস্তির ছেলে, সে দীর্ঘদিন ধরে সখিনার পিছু লেগে আছে। সখিনাও তাকে মনে মনে কিছুটা গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু মায়ের সাথে আনাগুনা করার দরুন এতদিন আলাল সখিনার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি।
সখিনা সুন্দরী খাটো মোটাসোটা, সতের বছরের যৌবন তার দেহে বানের পানির মতো থৈ থৈ করছে। তনু দেহে দারিদ্রতার কালিমা ভেদ করে যৌবনের দীপ্তি চকচক করছে। সখিনা রতনের সাথে আনাগোনা করে। বাজার সওদা কাপড়-চোপড় ইত্যাদি কোন কিছু কিনতে হলেও জরিনা তাকে রতনের সাথে পাঠায়। এই সুযোগে রতনও তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চায়, হোটেলে নিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ায়, কসমেটিকস কাপড়-চোপড় ফল-ফলাদি ইত্যাদি কিনে দেয়। সিনেমা দেখাতে চায়, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু সখিনা যায় না। মাঝে মধ্যে হাত ধরে কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু লজ্জায় বলতে পারে না। কারণ রতন খুব লাজুক।
এসব সখিনার ভাল লাগে না, অস্বস্তি লাগে। কারণ ভালোবাসা জিনিসটা মন থেকে উৎসারিত হতে হয়। রতনকে সে আগে থেকে রতন ভাই বলে ডাকত। বড় ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ন্যায় রতনকে দেখলেও তার সেই শ্রদ্ধা জাগ্রত হয় কিন্তু মন থেকে ভালোবাসার কোনো আলোক শিখা উৎসারিত হয় না। সে মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী চেষ্টা করে তাকে ভালবাসতে কিন্তু বুঝতে পারে বারবার সেই ভালোবাসা শ্রদ্ধায় রূপান্তরিত হয়ে যায়, তাকে জীবন সাথী হিসেবে কল্পনা করতে পারে না। বরং আলালের দিকে তার মন কম্পাসের কাটার মত ঝুঁকে আছে। সে চায় রতনকে এড়িয়ে আলালের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে কিন্তু মায়ের জন্য পারে না।
সখিনা রতনের সাথে আনাগুনা করে এটা আলাল সহ্য করতে পারে না। সে সখিনাকে কাছে টানতে চায় কিন্তু রতনের জন্য পারে না। একদিন গার্মেন্টস ছুটি হলে রতন সখিনাকে খুঁজতে লাগল। এক কর্মী বলল ‘সে আলালের সাথে চলে গেছে। রতন দ্রুত হেঁটে গিয়ে তাদেরকে ধরে ফেলল। কাছে গিয়ে বলল 'সখিনা তোমার মা আলালের সাথে চলতে নিষেধ করেছে আমার সাথে এস। আলাল চোখ পাকিয়ে বলল 'ও কার সাথে চলবে সেটা তার ইচ্ছা তুই বাধা দেওয়ার কে? 'ওর মা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে ওকে সাথে করে আনা নেওয়ার' বলে রতন সখিনার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আলাল গর্জে উঠল ‘ওর হাত ছাড়। তখনই কথায় কথায় দুজনের মধ্যে মারামারি লেগে গেল। সখিনা কিল ঘুষির মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’জনকে ছাড়িয়ে বলল ‘তোমরা আমাকে নিয়ে এমন করলে কিন্তু আমি মাকে ও বসকে বলে দিব’ বলে সে রতনের সাথেই বাসায় ফিরল।
ইতিমধ্যে বস্তিতে রাষ্ট্র হয়ে গেল সখিনার জন্য আলাল ও রতন মারামারি করেছে। বিষয়টা বস্তির মুখরোচক আলোচনায় পরিণত হল। পাশের ঘরের জোবেদা এসে জরিনাকে বলল ‘তোমার মেয়েকে নিয়ে দুই ছেলে কামড়া-কামড়ি শুরু করেছে, কোন দিন জানি কি হয়ে যায় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও। জরিনা বলল 'আলালটা একটা দুশ্চরিত্র খারাপ ছেলে, সে ইয়াবার ব্যবসা করে। ওর কাছে মেয়ে বিয়ে দিব নাকি? জোবেদা বলল ‘ওর কাছে দিবে কেন রতনের কাছে দিয়ে দাও। কাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবটা শুনে যদিও জরিনার মনটা হেসে উঠলো কিন্তু মুখটা গম্ভীর করে বলল ‘রতনের মা প্রস্তাব পাঠালে চিন্তা করে দেখতে পারি।
জোবেদা গিয়ে রতনের মায়ের কাছে আলাপটা পেশ করল। রতনের মায়ের রাতের ঘুম হারাম হলো। দীর্ঘদিন থেকে সে স্বপ্ন দেখছে মাতুল সূত্রে প্রাপ্ত জায়গাটুকুতে একটা বাড়ি করবে। ছেলেকে গেরস্ত ঘরের শিক্ষিতা মেয়ে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে সে বাড়িতে থাকবে আর ছেলে বাইরে চাকরি বাকরি করবে। একদিন তার নাতি নাতনী হবে, তাদের নিয়ে হেসে খেলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে। তার দীর্ঘ পোড় খাওয়া বৈধব্য জীবনের কষ্ট লাঘব করে নিবে। ছেলেকে গার্মেন্টসের মেয়ে বিয়ে করানো সে কল্পনাও করতে পারে না। বাড়িতে থাকবে বলে মা ছেলে পরিশ্রম করে ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছে। এতদিন সে মনে করেছে সাহায্যের জন্যই ছেলে জরিনার ঘরে আনাগুনা করে। জরিনাকে এখানে দেখার কেউ নাই বলে সেও সুযোগ দিয়েছে।
কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে মানব সেবা করতে গিয়ে তার ছেলেই হেবা হয়ে যাচ্ছে। সে সারা রাত ছটফট করে কাটাল। পরদিন জোবেদাকে বলল ‘আমি মরে গেলেও গার্মেন্টসের মেয়ে বিয়ে করাবো না। আমার ছেলেকে গেরস্থ ঘরের লেখাপড়া জানা পর্দানশীন মেয়ে বিয়ে করাব। ব্যাংকে আমার বাড়ি করার মতো টাকা জমা হয়ে গেছে কিছুদিনের মধ্যেই দেশে ফিরে যাব। আবার ছেলেকে বলল ‘তাড়াতাড়ি অন্য কোথাও বাসা দেখ, আমি এ বস্তিতে আর থাকব না। রতন বলল ‘এত সস্তায় অন্য কোথাও বাসা পাওয়া যাবে না। এক হাজার টাকায় ঢাকা শহরে ঘর তো দূরের কথা কবুতরের খুপড়িও পাওয়া যায় না। মা বলল ‘টাকা যাই লাগুক অন্য জায়গায় বাসা দেখ। ‘বেশি টাকা ভাড়া দিয়ে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়’ বলে ছেলে মায়ের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
মা প্রতিদিন তাকিদ দেয় আর ছেলে অসম্মতি জানায়। অগত্যা মা ছেলেকে সখিনার সংস্রব থেকে সরাতে চায় কিন্তু পারে না। সুযোগ পেলেই সে জরিনার ঘরে গিয়ে বসে থাকে, সখিনার সাথে আনাগোনা করে গল্পগুজব করে। একদিন মা ছেলেকে বলল ‘চল দেশে যাই গা, ব্যাংকে যে টাকা জমছে তা দিয়া আমাগো বাড়ি ঘর অয়া যাইব। ঘরদোর করে তোকে বিয়ে করামু। ছেলে কাজ ছেড়ে যেতে অস্বীকার করল। অবশেষে মা আসল কথাটা পারল 'যত টালবাহানাই করস আমি বাইচ্চা থাকতে তুই গার্মেন্টসের মেয়ে বিয়া করতে পারবি না। আমি তোকে গেরস্থ ঘরের ভালো মেয়ে বিয়ে করাব।
মা ছেলের টানাপোড়েন চলতে থাকে। অবশেষে ছেলেও একদিন মাকে শেষ কথা জানিয়ে দিল ‘বিয়ে করতে হলে আমি সুখিনাকেই করব নইলে জীবনে আর বিয়ে করব না। মা কান্নাকাটি শুরু করল, রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হলো। শুরু হলো মান-অভিমান। কিন্তু সন্তানের সাথে মা বাবারা পারে না, অগত্যা মাকেই ছেলের সামনে আত্মসমর্পণ করতে হল। তারপর জোবেদাকে দিয়ে সে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। জরিনা এতদিন রতনের মায়ের ভাবগতিক দেখে আশঙ্কায় ছিল কিন্তু এখন সে নিজেই প্রস্তাব পাঠিয়েছে দেখে খুশিতে আটখানা হয়ে গেল।
জরিনার স্বামী রুগী, দুই বাচ্ছা নিয়ে বাড়িতে থাকে। স্বামীর সাথে সে রতনের কথা আগেই আলাপ করেছে। এখন মোবাইলে খুশির সংবাদটা জানিয়ে বিস্তারিত পরামর্শ করল। পরদিন পাশের ঘরের জুবেদাকে ডেকে এনে বলল 'সখিনার বাপ আগামী শুক্রবারে আইব, দেখে শুনে পয়- পছন্দ অইলে কাবিন কইর্যা রাখব, তারপর সুযোগ মত আমাগো বাড়িতে গিয়ে বিয়া পড়ায়া মেয়ে উঠিয়ে দেয়া অইব। কারণ বাড়িতে বিয়া না অইলে বদনাম অয়, গায়ের লোকেরা বলাবলি করে লাইন কইর্যা বিয়া অইছে।
রতন প্রয়োজনীয় কাপড়- চোপড় ও বাজার সওদার দিকে মনোযোগ দিল। নব বধুর জন্য কাপড়-চোপড় ও প্রসাধন সামগ্রী কিনল। হবু শ্বশুরকে খাওয়া-দাওয়া করানোর জন্য সওদা পাতি করল। শুক্রবার সন্ধ্যার পর উভয় ঘর খুব ব্যস্ত হয়ে উঠল। জরিনা রান্না-বান্নায় ব্যস্ত, তার ঘরে হবু বর, তার মা, জুবেদা ও অন্যান্য দুয়েকজন মেহমান আসবে। বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হবে, খাওয়া-দাওয়া হবে, সে মাংস পোলাও রান্না করছে। তার স্বামীও খুব খুশি, বিনা যৌতুকে ভাল একটা ছেলে পাওয়া গেল। তার মুখটা খুশিতে চকচক করছে। সে মনের আনন্দে খাটের উপর বসে বসে টিভি দেখছে। ওদিকে সখিনা বারান্দায় গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে। কারণ রতনকে সে বড় ভাই মানতে পারে শ্রদ্ধা করতে পারে কিন্তু স্বামী হিসেবে কল্পনা করতে গেলেই তার ঘৃণা লাগে, অস্বস্তি আসে। রতন ভালো ছেলে, তবুও কেন তার এমন হয় সে জানে না। মায়ের কাছে বলতে চায় কিন্তু সাহস পায় না।
রতন ও তার মা নতুন জামা-কাপড় পড়ে ভাল সাজগোজ করল। তারপর সখিনার জন্য আনা শাড়ি ব্লাউজ প্রসাধন সামগ্রী ও কিছু মিষ্টি নিয়ে মা ছেলে ও জুবেদা- এই তিন জন জরিনার ঘরে হাজির হল। তারা সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকল। সখিনার বাপ সালামের উত্তর দিয়ে মেহমানের সম্মানে সোজা হয়ে বসল। রতনের মা তার দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে রইল। তারপর টলতে টলতে গড়িয়ে পড়ল কিন্তু পেছন থেকে ছেলে তাকে জড়িয়ে ধরল। সখিনার বাপ ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে মূর্তির মত নিশ্চল বসে আছে। রতন তার মাকে ঘরে নিয়ে মাথায় পানি ঢালছে। কেউ বুঝতে পারল না কি হল কেন হল।
২
উত্তর ময়মনসিংহ থেকে একটা কাফেলা রওয়ানা হয়েছে। নারী-পুরুষ-শিশু সব মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশজন সদস্য। তারা ময়মনসিংহে এসে চট্টগ্রাম গামী ট্রেনে চড়ে বসল। ক্ষুধা, নিরন্তর ক্ষুধার আগুন নেভাতে তারা জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে পাড়ি জমাচ্ছে।
উত্তর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ইন্ডিয়া সীমান্তে কোদালিয়া বাঁধ, এই বাঁধের কারণে উজানের লোকেরা পানিতে ভাসে কিন্তু ভাটির বিশাল অঞ্চল বন্যা থেকে রক্ষা পায়। এ জন্য এ বাঁধ উভয় পক্ষের কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়, নিত্যদিন লাশ পড়ে। উজানের লোকেরা চায় বাঁধটা ভেঙ্গে দিতে আর ভাটির লোকেরা বাঁধের উপর বাড়ি ঘর নির্মাণ করে পালাক্রমে পাহারা দেয়। ১৯৮৪ সালের আশ্বিন মাস, কোন এক সুযোগে উজানের লোকেরা বাঁধটি ভেঙ্গে দেয় আর সাথে সাথে শুরু হয় প্রাকৃতিক শক্তির ভয়াবহ ধ্বংসলীলা। কয়েক ফুট স্ফিত পানির তোরে মানুষ ও গবাদি পশুর লাশ ভেসে আসতে থাকে এবং প্রথম ধাক্কাতেই সেই অঞ্চলের পোলগুলো ভেঙ্গে ফেলে। সমগ্র উত্তর ময়মনসিংহ পানিতে ভাসতে থাকে। এই বাঁধ আর নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।
এরপর থেকে পুরা বর্ষায় বন্যা লেগেই থাকে। কৃষক পরিবারগুলি একদম লাস্ট সিজন- আশ্বিন কার্তিক মাসে ধান রোপন করে কিছু আমন পায়, এ দিয়ে কোনরকমে তারা অস্তিত্বের সংগ্রাম চালিয়ে যায়। কিন্তু যেসব ভূমিহীন শ্রমিক কৃষকের ক্ষেত খামারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত- কর্মশূন্য হয়ে তারা মানবেতর জীবন যাপন করে। জীব জন্তুর মত ঘাস-পাতা কচুর ডাটা সেদ্ধ করে খেয়ে চর্মাচ্ছাদিত হাড়ের খাঁচায় কোন রকম ধুকধুকে প্রাণটা ধরে রেখেছে। তদুপরি মরার উপর খরার ঘা- এর মত ১৯৮৮ সালের বন্যা মরন আঘাত হানে। আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত লাগাতার বন্যার কারণে কোথাও একগাছি ধান রইল না, সাহারার মতো মাঠের পর মাঠ ধুধু করে, ফসলের চিহ্নমাত্র নাই। উত্তর ময়মনসিংহে শুরু হয় ভাঙ্গন। কর্মের জন্য মানুষ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেটের দিকে হুমড়ি খেয়ে পরে।
এমনি আকালের সময় কিছু ভূমিহীন শ্রমিক পরিবার দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য চাকমার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। স্থানীয় ভাষায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে চাকমা বলা হয়। সেখানে সরকার বাঙ্গালীদের পুনর্বাসন করছে- জমি দিচ্ছে বাড়িঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে, থাকা-খাওয়া ও ঔষধপত্র সবকিছু ফ্রী দিচ্ছে। যদিও সেখানে শান্তিবাহিনীর গুম-খুন ও ভয়ানক সব রোগ পীড়ার কথা শোনা যায় তবুও দুবেলা-দুমুঠো খেতে তো পাওয়া যাবে। দেশে থেকে পেটের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরার চেয়ে সেখানে গিয়ে পেটটা ঠাণ্ডা রেখে প্রকৃতির আগুন সহ্য করা যাবে। এভাবে পেটের দায়ে দশটি পরিবারের প্রায় পঞ্চাশজন সদস্য দেশত্যাগ করছে।
জবর আলীর বাইশ তেইশ বছরের ছেলে আতর আলী উগ্র স্বভাবের, অভাবের তাড়নায় তার কিছুটা চুরির অভ্যাস গড়ে উঠেছে। একবার মাস্টার বাড়ির একটা খাসি চুরি করে বিক্রি করে দেয়, মোড়ল বাড়ির পুকুর থেকে মাছ চুরি করে বিক্রি করেছে। তাছাড়া বিভিন্ন বাড়ি থেকে কাঁঠাল লিচু নারিকেল ইত্যাদি যখন যা পায় চুরি করে বিক্রি করা তার অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়। ধরা পড়লে জবর আলী গিয়ে চোরাই মালটা ফেরত দিয়ে হাতে পায়ে ধরে মুক্তি পায়। এছাড়া তার অনেক মেয়ে কেলেঙ্কারিও আছে। গ্রামবাসীরা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জবর আলীকে পরামর্শ দিলো ‘তোমার বড় ছেলে তো চাকমা যাচ্ছে ওদের সাথে আতর আলিকেও পাঠিয়ে দাও। অগত্যা জবর আলী তাদের সাথে ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়ে আপদ বিদায় করল।
কাফেলা চট্টগ্রাম নেমে রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিল। অভিবাসন প্রত্যাশী বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখানে একত্রিত হয়। এখানে তাদের সংখ্যা গণনা করা হয়, জমি ও রেশন বরাদ্দ দেওয়া হয়, তারপর পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এখানে কোন রেশন দেয়া হয় না, কেউ হাতের সম্বল খরচ করে খায় কেউ আশপাশ এলাকা বা চট্টগ্রাম টাউনে গিয়ে কাজ কাম করে চলে। আতর আলী মিশুক, চাপাবাজ ও কর্তৃত্বপরায়ণ, সে প্রত্যেকের কাছে যায় আড্ডা দেয় গল্পগুজব করে। খুব সহজেই সে ক্যাম্পের সকলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলল। এর মধ্যে নরসিংদীর একটা মেয়ের প্রতি তার চোখ পড়ে। শ্যামলা রঙের স্বাস্থ্যবান মেয়েটি তাকে পাগল করে তোলে। সে মেয়েটির পরিবারের সাথে খুব ভাব জমিয়ে বসে।
একমাস পর তাদের যাওয়ার অর্ডার হল। কিন্তু এর মধ্যে শুরু হলো দালালের দৌরাত্ম্য, তারা দাবি করল এক হাজার করে টাকা দিলে সমতল ভালো ফসলি জমি পাইয়ে দিবে, না দিলে পাহাড় জঙ্গল ও নালাপূর্ণ জমি নিতে হবে, কোন ফসল হবে না। কেউ টাকা দিল কেউ দিল না, এ নিয়ে ক্যাম্পে তোলপাড় শুরু হল। ঝগড়ার একপর্যায়ে আতর আলী ক্ষিপ্ত হয়ে এক দালালের মাথায় চেয়ার দিয়ে আঘাত করে বসল, ক্যাম্পের সকলের মধ্যস্থতায় বিষয়টা মিমাংশা হল। এই ঘটনার পর থেকে আতর আলী কাফেলার নেতা হয়ে গেল।
এরপর তাদেরকে পরপর দুটি ক্যাম্পে নেওয়া হল। নাম রেজিস্ট্রি করে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র দেয়া হল। কিন্তু দ্বিতীয় ক্যাম্পের পর আর গাড়ি চলবে না পায়ে হেঁটে যেতে হবে। শুরু হয় চরম ভোগান্তি, গাড়ি চলাচলের মত রাস্তা তো নেই-ই এমনকি পায়ে হাঁটার রাস্তাও নাই। কখনও খাড়া পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠতে হয়, পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মনে হয় যেন আকাশে উঠল। তারপর শুরু হয় উতরাই, খুব সতর্ক পদক্ষেপে নামতে হয়। একটু অসাবধান হলেই পা ফসকে গড়াতে গড়াতে গভীর খাদে গিয়ে পড়তে হবে আর সাথে সাথে জীবনলীলাও সাঙ্গ হবে। পাহাড় পেরিয়ে কোথাও সামান্য গিরিপথ, কোথাও নালা। গভীর নালা গুলিতে বড় বড় গাছ ফেলে সেতু বানানো হয়েছে। কিন্তু অগভীর নালাগুলি হাঁটু বা উরু সমান পানি ভেঙ্গে পায়ে হেঁটে পার হতে হয়। এসব নালার পানি বরফের মতো ঠান্ডা কিন্তু ডালিমের রসের মত স্বচ্ছ।
নালা বা উপত্যকা পেরিয়ে আবার পাহাড়, দুর্গম অরণ্য। এসব ভয়াল জঙ্গলের কোথাও কোথাও পায়ে চলার মত পথ পাওয়া যায় আর কোথাও কোনো পদচিহ্ন নাই। তখন ঝোপ-ঝাড় ভেঙ্গে ঠেলে পথ করে নিতে হয়। এসব পাহাড় জঙ্গল এতটাই দুর্গম আর বৃক্ষলতা পূর্ণ যে এগুলির অধিকাংশ স্থানে কোন কালেও মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি। আবার এসব জঙ্গলের বিশাল বিশাল গাছ আকাশ ছেয়ে আছে আর নিচে লতাগুল্ম আচ্ছাদিত হয়ে আছে। ফলে সৃষ্টির সূচনা থেকে এই মাটিতে সূর্যের আলো পড়তে পারেনি। তার উপর পাহাড়ি সাপ বিচ্ছু ও হিংস্র প্রাণীর ভয় তো আছেই।
লাগাতার তিনদিন পায়ে হেঁটে দুর্গম ও দুর্ভেদ্য আমাজনের জঙ্গল পাড়ি দিয়ে অবশেষে কাফেলা সর্বশেষ ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু তখন নারী-শিশুরা আধমরা হয়ে গেছে, আর্মিরা তাদের সেবা শশ্রুষা শুরু করল। যথোপযুক্ত খাবার ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিল, কয়েকদিনেই তারা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল।
এরপর শুরু হলো জমি বরাদ্দের কাজ। তাদেরকে কয়েকটা জায়গা দেখানো হল কিন্তু অসমতল পাহাড় ও নালাপূর্ণ বলে তারা সেগুলি প্রত্যাখ্যান করল। অবশেষে ঘুরে ফিরে ক্যাম্প থেকে পাঁচ মাইল দূরে ঝিনুকছরি নামে একটা জায়গা তারা পছন্দ করল। সেখানে প্রত্যেক পরিবারকে পাঁচ কর করে জমি দেওয়া হল। এখন প্রত্যেকের জমির মাথায় একই সরলরেখায় বাড়ি নির্মাণ করতে হবে, একই সরলরেখায় হলেও বাড়িগুলি হবে কিছুটা অন্তর অন্তর, বস্তির মতো লাগোয়া নয়। শুরু হলো বাড়ি ঘর নির্মাণের কাজ। তারা সকালে যায় সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসে। জঙ্গলে বাঁশ-কাঠের অভাব নাই, আর্মিদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় তারা এক মাসের মধ্যে বাড়ি ঘর নির্মাণ কাজ শেষ করল। তারপর সবাই নিজ নিজ বাড়িতে আশ্রয় নিল। তাদের থাকা খাওয়ার চিন্তা ঘুচল। সরকার মাস মাস রেশন দিচ্ছে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র দিচ্ছে কৃষি বীজ ও সরঞ্জামাদি দিচ্ছে কিন্তু এর পরেও তারা সুখী হতে পারল না।
মুক্ত সমতলভূমির বাসিন্দাদের সামনে এই ভয়াল জঙ্গল মৃত্যুর করাল রূপ নিয়ে হাজির হল। কালাজ্বর ও জঙ্গলের বৈরী আবহাওয়া তাদের জন্য প্রতিকূল হয়ে উঠল। বদ্ধ বাতাস, রৌদ্রতপ্তহীন ভূমি, বরফের মতো নালার পানি- একটার পর একটা রোগ পীড়া ডেকে আনতে লাগল। তার মধ্যে ভয়ংকর হল কালাজ্বর। শরীরে প্রচন্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, গা আগুনের মত গরম হয়ে যায়, চোখ চুল্লির মত লাল হয়ে যায়। সরকার এই কালাজ্বরের পর্যাপ্ত ঔষধ সরবরাহ করে, ঔষধ খেয়ে ভাল হল কিন্তু পরদিন আবার সেই জ্বর। এভাবে পালাক্রমে জ্বর চলতেই থাকে আর মানুষ মরতে থাকে।
তার উপর আছে বন্য প্রাণীর উপদ্রব। রাত হলেই বন্য শুকুর কুকুর শেয়াল বাঘডাসা ইত্যাদি খাদ্যের খুঁজে ঘরের পিছনে গুদগুদ করে ঘুরে বেড়ায়। বাইরে কোন কিছু থাকলে তছনছ করে দেয়। গভীর রাতে কিছুক্ষণ পর পর চিতা ও ভল্লুকের রক্ত হিম করা ডাক শোনা যায়, আর সাপের ভয় তো নিত্যসঙ্গী। এজন্য শত প্রয়োজন থাকলেও রাতে কেউ ঘরের বাইরে বের হয় না। তাছাড়া জংলি টিকটিকি গাছের পাতার আড়ালে বসে মানুষের দিকে তাকিয়ে জিব্বা নাড়াতে থাকে আর লাল হতে থাকে। বাঙালিরা মনে করে এভাবে এরা মানুষের শরীরের রক্ত চুষে নেয়, আর এভাবে রক্ত চুষে নিলে কিছুদিন পর মানুষটা মারা যায়। এই সকল বিভীষিকার ঊর্ধ্বে আসল বিভীষিকা হল শান্তি বাহিনীর আতংক।
এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে কিছু লোক পরিবারের দুয়েকজন সদস্য হারিয়ে সাধের চাকমা ছেড়ে আবার দেশে ফিরে যায়। আতর আলীর ভাই তিন বাচ্চাসহ চাকমা এসেছিল কিন্তু আসার পর থেকে জ্বরে ভুগতে ভুগতে তিন মাস পর তার ভাই ও একটা ভাতিজা মারা যায়। আতর আলী ঘটনা জানিয়ে বাপকে চিঠি লিখল। কয়েকদিন পর তার বাপ এসে হাজির হলো বটে কিন্তু বৃদ্ধ বেচারা বিছানায় পড়ে গেল। দীর্ঘ পথ হেঁটে পা দুটি ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। আবার আসার সাথে সাথে কালা জ্বর দেখা দিয়েছে। জবর আলী তাড়া দিল ‘তাড়াতাড়ি রেডি হ কাল সকালেই রওনা হতে হবে, এখানে থাকলে তোদের আগে আমিই মরে যাব। এখানে এভাবে পড়ে থাকার চেয়ে দেশে গিয়ে না খেয়ে মর, সেও ভালো। আতর আলী বলল ‘তুমি ওদেরকে নিয়ে চলে যাও, এখানে আমার কিছু টাকা পাওনা আছে। টাকা গুলো উঠিয়ে আমি সময় মতো চলে আসব। দু’দিন পর জবর আলী ছেলের পরিবার নিয়ে বিদায় হল।
আতর আলী যে কারো সাথে মিশতে পারে, তার মধুময় কথা ও জাদুময় ব্যবহারে যে কাউকে বশ করতে পারে। সে আর্মিদের সাথে খাতির জমিয়ে রেশন ক্যাম্পের কয়াল হয়েছে অর্থাৎ রেশনের মাল সে মাপ ঝোপ করে দেয়। আবার পাহাড়ি চাকমাদের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। চাকমাদের সাথে বসে বসে মদ খায় মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে। দুজন চাকমার সাথে গোপনে চোরাকারবারীতে যুক্ত হয়েছে। এতে তার যথেষ্ট আয় হচ্ছে। তাছাড়া বলা যায় সেই বাঙ্গালীদের নেতা, প্রত্যেকের বাড়িতে যায় খোঁজ-খবর নেয় আলাপ-সালাপ করে।
আগে থেকেই সে নরসিংদীর মেয়েটির পিছনে লেগে আছে। মেয়েটার নাম আসমা, বাপের নাম কিসমত আলী। মেয়েটির উর্বশী শরীর তার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। একদিন প্রতিবেশী এক বৃদ্ধ কিসমত আলীর কাছে প্রস্তাব নিয়ে এল 'আতর আলী আসমাকে বিয়ে করতে চায়। কিসমত আলী খুশি হল- ছেলেটা কর্মঠ, যথেষ্ট পয়সা পাতি উপার্জন করছে। তাছাড়া সে সকলের প্রিয়পাত্র, একদিন ছেলেটা এই অঞ্চলের নেতা হবে। এর সাথে বিয়ে হলে আসমার ভাগ্যই বলতে হবে। বাঙ্গালীদের নিয়ে ধুমধাম করে কিসমত আলী মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল। আতর আলীর আচার-ব্যবহার যতটা ভদ্র তার চরিত্র ততটাই বিষাক্ত। অধিকাংশ সময় সে চাকমাদের সাথে আড্ডা দিয়ে কাটায়, মদ খায়।
এভাবে এক চাকমা মেয়ের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিষয়টা বাঙ্গালীদের জন্য মুখরোচক আলোচনায় পরিণত হল বটে কিন্তু পাহাড়িদের জন্য আত্মসম্মানের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল। পাহাড়িরা তাকে বুঝাল হুমকি ধমকি দিল কিন্তু আতর আলী এসব গায়ে মাখে না। তার কাজ সে চালিয়ে যেতে থাকে। আসমা এসব শুনে স্বামীকে ফিরানোর চেষ্টা করে, হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে কিন্তু আতর আলী স্ত্রীর কথা শোনার মতো লোক নয়। আসমা বেশি প্যানপ্যান করলে তাকে মারধর করে। এক দিন কয়েক পাহাড়ি মিলে আতর আলীকে রাম ধোলাই দিল, এতে তার জেদ আরো বেড়ে গেল। সে মেয়েটাকে নিয়ে প্রকাশ্যে কেলেঙ্কারি করতে লাগল। অবশেষে বিষয়টা শান্তিবাহিনীর কানে গেল, আতর আলীর নাম শান্তিবাহিনীর কালো তালিকায় উঠে গেল। সবাই কানাঘুষা করতে লাগল আতর আলীর দিন শেষ। শান্তিবাহিনী যেখানে সাধারণ বাঙালিদের ধরে নিয়ে গুম করে ফেলে সেখানে আতর আলীর যে কি অবস্থা হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানে।
বিয়ের আট মাস পর হঠাৎ একদিন আতর আলী উধাও, স্ত্রী বা অন্য কাউকে কিছু বলে যায়নি। আসমা তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। সে ভাবল শান্তি বাহিনীর ভয়ে তার স্বামী আত্মগোপন করেছে কিছুদিন পর আবার ফিরে আসবে। তার বাপ বলল ‘জামাই তার সব পাওনা উঠিয়ে নিয়ে গেছে কিন্তু ঋণ শোধ করে যায়নি। আসমা স্বামীর অপেক্ষায় বসে থাকে কিন্তু আতর আলীর কোন পাত্তা নাই। সময় মত আসমার একটি পুত্র সন্তান হল, নাম রাখা হল রতন আলী। সন্তান কোলে নিয়ে স্বামীর পথের পানে তাকিয়ে আসমার প্রতীক্ষার প্রহর কাটে। দেখতে দেখতে দুটি বছর কেটে গেল কিন্তু আতর আলীর সন্ধান নাই।
৩
আসমারা দুই ভাই দুই বোন, বড় বোন আগেই মারা গেছে। পরিবারের বাকি সবাই চাকমা এসেছে। কিন্তু এখানে আসার ছয় মাসের মধ্যে ভয়াল কালা জ্বরে তার মা ও এক ভাই মারা যায়। এরপরেও তাদের পরিবার সুখেই চলছিল। মাস মাস সরকার ঔষধপত্র দেয় চাষাবাদের সরঞ্জাম বীজ ইত্যাদি দেয়। তার বাপ ও ভাই চাষবাসের কাজ শুরু করেছে। এছাড়াও তারা জঙ্গল থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে এলাকার বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করে। এতে তাদের অতিরিক্ত আয় হয়। বাপ- ভাই উপার্জন করে আসমা রান্নাবান্না করে। স্বামী না থাকলেও তার দিনগুলি সুখেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এই হতভাগিনীর কপালে সুখ বেশি সময় সইল না।
একদিন তার বাপ ভাই লোকালয় ছাড়িয়ে বাইরের একটা জঙ্গলে লাকড়ি সংগ্রহ করতে গেল। দিক সীমানাহীন এই জঙ্গলে বা এর আশপাশে কোন মনুষ্য বসতি নাই। তারা জঙ্গলের পাশ দিয়ে লাকড়ি কুড়াতে লাগল। হঠাৎ আবিষ্কার করল একটা পায়ে চলা পথ দুর্গম অরণ্যের ভিতরে চলে গেছে। কৌতূহলবশত তারা সেই পথ ধরে হাটতে লাগল। অনেক দূর যাওয়ার পর তাদের কানে মানুষের কন্ঠ বাজল। তারা গাছের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে সতর্কভাবে অগ্রসর হল। কাছাকাছি গিয়ে হতবাক হয়ে দেখল ফুটবল খেলার মাঠের মতো বিশাল এক মাঠ। এখানে কয়েকশো চাকমা যুবক অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ করছে, কিছু মেয়েও আছে। কিসমত আলী বুঝতে পারল এখানে শান্তিবাহিনীর ট্রেনিং হয়। নিরাপত্তার জন্য তারা এই গহীন অরণ্যের মাঝখানে জঙ্গল কেটে সমতল করে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বানিয়েছে। মাঠের উত্তর পাশে একটা ঘর, সম্ভবত অস্ত্র-গুদাম। তারা বাপ বেটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দম বন্ধ করে এই দৃশ্য দেখতে লাগল।
সহসা কিসমত আলী পিঠে তীক্ষ্ণ একটা খোঁচা অনুভব করে পিছন ফিরে তাকাল আর সাথে সাথে তার চেহারায় মৃত্যু আতঙ্ক ফুটে উঠল, কলিজা রক্ত শূন্য হয়ে গেল। দুইটা চাকমা বাপ-বেটার পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে মিটিমিটি হাসছে আর সামনের দিকে ইঙ্গিত করে অস্ত্র দিয়ে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শান্তিবাহিনীর এই গুপ্ত ঘাঁটির চারপাশে সব সময় পাহারা থাকে, এই পাহারাদাররাই তাদেরকে ধরে নিয়ে গেল।
সন্ধ্যার পর থেকে আসমা অস্থির হয়ে উঠেছে। একবার ঘরে যায় একবার রাস্তার মুখে গিয়ে দাঁড়ায় কিন্তু তার বাপ ভাইয়ের কোন হদিস নাই। রাত যতই বাড়তে থাকে তার অস্থিরতাও বাড়তে থাকে। সে চিন্তা করে রাস্তাঘাটে একাকী কোন বাঙালি দেখলে শান্তি বাহিনী ধরে নিয়ে যায় তারপর পাহাড়ে বা নালায় তাদের লাশ পড়ে থাকে। এখন তার বাপ ভাইকেও যদি ধরে নিয়ে যায়? সে আর ভাবতে পারে না, কাঁদতে কাঁদতে তাদের প্রতিবেশী রুস্তম আলীর বাড়িতে গিয়ে উঠল। রুস্তম আলী সম্পর্কে তার চাচা, নরসিংদী থেকে একসাথে ছেড়ে এসেছে। রুস্তম আলীর বুঝতে বাকি রইল না যা হবার হয়ে গেছে। তবুও আসমাকে সান্তনা দিয়ে বলল ‘কাঁদিস না মা তোর বাপ হয়তো লাকড়ি বেচতে গিয়ে ফ্যাক্টরিতে দেরি করছে, শীঘ্রই চলে আসবে চিন্তা করিস না। বউকে গোপনে বলল ‘এত রাতেও যখন ফিরল না তাহলে মনে হয় সর্বনাশ হয়ে গেছে। তুমি যাও মেয়েটা একা বাড়িতে থাকতে পারবে না।
রাত যত গভীর হয় আসমার সন্দেহ তত ঘনীভূত হয়। মধ্যরাতে সে বিলাপ শুরু করল, মাটিতে গড়াগড়ি যায় মাথার চুল ছিঁড়ে নাকে মুখে বুকে করাঘাত করে আর আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করে। মায়ের কান্নায় বাচ্চাটাও কান্না শুরু করেছে। রুস্তমের বউ মা ও ছেলেকে সামলাতে সামলাতেই রাত পোহালো।
সকালে জানা গেল বস্তি থেকে দূরে একটা নালার পাশে কিসমত আলী ও তার ছেলের লাশ পড়ে আছে। আসমার রক্তাশ্রু ঝরে পড়ল, স্বামীহারা মেয়েটির শেষ সম্বলটুকু কালবৈশাখী উড়িয়ে নিয়ে গেল। রুস্তম আলী অসহায় মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। তারপর আসমার মামাকে চিঠি লিখল। ত্রিভুবনে এক মামা ছাড়া তার আর কেউ নাই, মামার নাম শহর আলী। কয়েকদিন পর মামা এসে ভাগ্নিকে নিয়ে গেল এবং নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিল। আসমা শীঘ্রই বুঝতে পারলো সে মামার বুকে আশ্রয় পেয়েছে বটে কিন্তু মামীর সংসারে আশ্রয় পাওয়াটা কঠিন। মামি তাকে উটকো ঝামেলা মনে করল। অগত্যা সে মামীর মনোতুস্টির জন্য কাজ কামে মনোযোগ দিল।
শহর আলী মধ্যম মানের কৃষক, তার সংসারে অনেক কাজকর্ম। আসমা একাই সব সামাল দেয়, ধান মাড়াই-ঝাড়াই, ঘর সামলানো, ধান ভানা, গরু-ছাগল রাখা, রান্নাবান্না বাসন-কোসন মাজা, এক কথায় সব কাজ তাকে একাই করতে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কাজ শুরু হয় রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তার নিষ্কৃতি মিলে। মামি যখন দেখল মোটা মাইনে দিয়েও এমন একটা কাজের লোক পাওয়া যাবে না- ঘরে বাইরে সব কাজ আসমা একাই সামাল দিচ্ছে তখন সে সন্তুষ্ট হল। আসমাও নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে মামার সংসারে নিজেকে উৎসর্গ করল।
এদিকে শহর আলীর বয়স হয়েছে, বিভিন্ন রোগ শোক দেখা দিয়েছে। একদিন সে আসমাকে ডেকে বলল ‘মা রে আমি কখন মরে টরে যাই ঠিক নাই। তোর মায়ের ওয়ারিশ দেয়া হয়নি, সে সামান্য কিছু জমি পাবে। পশ্চিমের ভিটায় দশ শতাংশ জমি আছে, ওটা আমি তোকে দিয়ে গেলাম ছেলেটাকে নিয়ে সেখানে বাড়িঘর করে থাকতে পারবি। এর কিছুদিন পর শহর আলী মারা গেল।
আসমা বুঝল মামির টানাটানির সংসারে আর থাকা সম্ভব নয়। সে থাকল মামার বাড়িতে কিন্তু রান্নাবান্না আলাদা করে নিল। পাশের মোড়ল বাড়িতে কাজ কাম করে ও হাঁস-মুরগি রেখে তার ভালোই চলে যায়। এখন তার একমাত্র চিন্তা হলো ছেলেটাকে নিয়ে। ছেলের বাপ নাই ধন- সম্পদ নাই ভবিষ্যতে সে কি করে চলবে- এটাই তার চিন্তা। ছেলে হাইস্কুলে পড়ে, সে সিদ্ধান্ত নিল যত কষ্টই হোক ছেলেকে লেখাপড়া করাবে যাতে ভবিষ্যতে একটা চাকরি বাকরি করে চলতে পারে। কিন্তু অভিভাবকহীন ছেলে-পোলে খুব কমই মানুষ হয়। ছেলে মায়ের দুঃখ বুঝলো না, সে স্কুলে যাওয়ার নাম করে বের হয় কিন্তু সারা দিন বন্ধুদের সাথে খেলায় মেতে থাকে। রাতদিন দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়, বখাটে ছেলেদের সঙ্গ পেয়ে নিজেও বখে যায়।
তাছাড়া অর্থাভাবে সে প্রাইভেট পড়তে পারে না, অংক ইংরেজিতে খুবই দুর্বল। ফলে এস এস সি টেস্টে কয়েক সাবজেক্টে ফেল করল। কর্তৃপক্ষ তাকে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিল না, আর এখানেই তার লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটল। আসমা নিজেও এখন আর তেমন কাজ কর্ম করতে পারে না। অগত্যা সে ছেলেকে কাজে লাগাল, অন্যের বাড়িতে কাজ কাম করে ছেলেও ভালই উপার্জন করে। মাঝে মাঝে কাজ করতে সে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলে যায়। একবার সে মাকে বললো ‘চল গার্মেন্টসে চলে যাই। আসমা ভাবল প্রস্তাবটা মন্দ না। গার্মেন্টস করে কিছু টাকা জমিয়ে যদি বাড়িটা করা যায়। তারপর ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে সে বাড়িতে থাকবে আর ছেলে বাইরে কাজ কর্ম করবে। নিজের বাড়িতে থাকা তার বহুদিনের স্বপ্ন। কাজেই সে ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেল।
আতর আলী পার্বত্য এলাকায় চোরাই কারবার করে বেশ কিছু টাকা নিয়ে দেশে এসেছিল। এ টাকায় সে ধান-পাটের কারবার শুরু করল। ব্যবসায় তার উন্নতি হল, বাড়িতে টিনের ঘর করল। এলাকায় জানে আতর আলী এখনো বিয়ে করেনি। কাজেই সে নির্বিঘ্নে জরিনা নামের একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে সুখের সংসার পেতে বসল। এক সময় ধান-পাটের ব্যবসায় মার খেয়ে কৃষি কাজে নামল। বর্গা চাষ করে সংসার চালায়। ইতিমধ্যে তার তিনটি সন্তান হয়ে গেছে, দুটি মেয়ে একটি ছেলে। সংসার বড় হয়ে গেছে বিধায় বর্গা চাষে আর চলে না। তাছাড়া কৃষিতে বিভিন্ন বান দুর্যোগ চলছে। একবার বন্যায় সব ফসল খেয়ে গেল। এতে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেল। পাওনাদারদের তাকাদায় অসহায় হয়ে সে বউ-বাচ্চা নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাল।
কিন্তু সে হল রোগী, কোমরের হাড় ক্ষয়ে গেছে কোন কাজকর্ম করতে পারে না। আবার ঢাকায় বসে বসে খাওয়াও সম্ভব নয়। অগত্যা সে স্ত্রী আর বড় মেয়ে সখিনাকে গার্মেন্টসে রেখে ছোট দুই বাচ্চাকে নিয়ে বাড়িতে চলে গেল। বাড়িতে সে গরু ছাগল পালে, সামান্য কিছু জমি বর্গা করে। বাচ্চা দুইটাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। স্ত্রী-কন্যার উপার্জনে তার সংসার মোটামুটি ভালোই চলছে।
আসমা তার ছেলেকে নিয়ে উত্তরার একটা বস্তিতে খুব সস্তায় এক রুম ভাড়া নিয়ে থাকে। পাশের রুমে থাকে তিনজন মহিলা। একজনের নাম জুবেদা, তাদের পাশের রুমটা খালি। একদিন জুবেদা বলল ‘আপা আমার সাথে গার্মেন্টসে কাজ করে একজন মহিলা কম দামের বাসা খুজছে। আসমা জিজ্ঞেস করল ‘ওদের সাথে কোন ছেলে মানুষ আছে? আজকালকার ছেলেগুলো কিন্তু খুব ত্যাদর। জুবেদা বলল ‘না তারা শুধু মা মেয়ে থাকবে। আসমা বলল ‘তাহলে তো ভালই হয় নিয়ে আস। কয়েকদিন পর জরিনা ও সখিনা এসে খালি রুমে উঠল। কেউ জানল না আসমা ও জরিনা দুই সতীন। এজন্যই দীর্ঘ পচিশ বছর পর আসমা তার হারানো স্বামীকে জরিনার ঘরে দেখতে পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়।
বিষয়: সাহিত্য
১৮০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন