অঙ্কুশ (মাহমুদুল হাসান)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১০ এপ্রিল, ২০১৯, ১০:০৬:৫৪ রাত
মাঘ মাস, কুজ্ঝটিকায় চরাচর আচ্ছন্ন। দুপুর পর্যন্ত কুয়াশাবগুন্ঠিত মিহির দৃষ্টিগোচর হয় না, বিকেলে হলদে পিণ্ড থেকে কিছুটা হরিদ্রাভা ছড়ায়। হালকা শৈত্যপ্রবাহ চলছে । আমি আর ঈশান রুমের দুই পাশে নিজ নিজ খাটে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি। ভোর ছয়টার দিকে ঈশান পারভেজের মোবাইল বেজে উঠল। সে কয়েকটা কথা বলেই লাফিয়ে উঠল, তাড়াতাড়ি গায়ে শীত বস্ত্র জড়াতে জড়াতে বলল ‘জিসান যাবে? ফুলপুরের দারোগা কল করেছে বালিয়া ইউনিয়নে নাকি একটা খুন হয়েছে। আমি লেপের নিচ থেকে মাথা বের করে ‘এই কুয়াশায় বাইরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়’ বলে আবার লেপ মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলাম।
একটা রুম ভাড়া নিয়ে দু’পাশে দুইটা খাট ফেলে আমরা দুই বন্ধু থাকি। সকালে হোটেলে নাস্তা খাই, দুপুরে ও রাত্রে কাজের মহিলা এসে রান্না করে দিয়ে যায়। এই হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে আমি আর উঠলাম না, কাজের বুয়া এসে রান্নাবান্না শেষ করে আমাকে ডেকে তুলল। শীতের দিনে আমার মতো কোড়ে মানুষের গোসলটা একটু কমই হয়। তাই হাত মুখ ধুয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসলাম। বুয়াকে বললাম ‘খালা দু’জনের রান্না করলেন কেন, জানেন না গোয়েন্দাগিরি করতে গেলে তার আর হুশ থাকে না। বুয়া বলল ‘সে নাই আমি তো জানি না, রাতে আসবে তো? বললাম ‘তা আসবে। বুয়া চলে গেল।
কিছু কিছু মানুষ ব্যতিক্রমী প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। বস্তু নীচয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, রহস্য উন্মোচন, বিষয়ের গভির পর্যন্ত অনুসন্ধান- এসব যদি প্রতিভা হয় তাহলে ঈশান পারভেজ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। মদ গাঁজা আফিমের নেশার মত রহস্য উদঘাটন তার নেশা। প্রাকৃতিক রহস্য অপরাধ রহস্য উভয় দিকেই তার ঝোঁক। কিন্তু অপরাধ রহস্য পেলে সে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। পানিতে এক মাইল দূরে মানব রক্তের ঘ্রাণ পেলে জোঁক যেভাবে ছুটে আসে- ঈশানও অপরাধের গন্ধ পেলে সেভাবেই ছুটে যায়। স্কুল জীবন থেকেই সে অনেক রহস্য উন্মোচন করে সুনাম কুড়িয়েছে। তবে বছর দুই আগে একটা ফাঁসির খুনিকে বাঁচিয়ে সে একেবারে হৈচৈ ফেলে দেয়, রাতারাতি হিরো বনে যায়। এ ঘটনায় সর্বত্র তার সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পত্রিকায় নাম আসে। এরপর থেকে প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ তাকে সমীহ করে চলে। কোথাও কোন অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ তাকে ডাকে। বিনিময়ে ঈশানের পকেটটা ভারী হয় কিন্তু তার কর্মফলের কৃতিত্বটা তারা নিয়ে যায়।
তার আসতে রাত হবে জানি কিন্তু এই হার ফাটানো শীতে এত দেরি করবে ভাবিনি। রাত বারোটায় দরজায় টোকা পড়ল। ঘরে ঢুকেই সরাসরি রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে হাত পা গরম করতে লাগলো। মানুষের মুখ হল মনের আয়না, দীর্ঘ সান্নিধ্যের কারণে বন্ধুটির নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা হয়ে গেছে। সে যদি সাধারন হাসি খুশি থাকে তাহলে বুঝতে হবে ঘটনাও সাধারণ, কোনো রহস্য নাই। আর যদি দুই একটা সূত্র পেয়ে যায় কিন্তু সন্ধান না পায়- তাহলে সে কিছুটা গম্ভীর হয়ে আমার সাথে সূত্রগুলির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মূল ঘটনা পর্যন্ত পৌঁছাতে চেস্টা করে। কিন্তু যদি রহস্যের সন্ধান পেয়ে যায় তাহলে সে একেবারে পাথর হয়ে যায়, গুরু গম্ভীর হয়ে থাকবে রহস্য উম্মোচন না করা পর্যন্ত একটা কথাও বলবে না। এ সময় যত শত চেষ্টা করলেও তার মুখ থেকে কোন কথা টেনে বের করা যাবে না।
তার মুখ দেখেই বুঝলাম ঘটনা কোন জটিল নয়। কাজেই আমার কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না সে নিজেই বলবে। আমি কৌতুহলী দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। সে মুচকি হেসে বলল ‘কি ব্যাপার ভায়া কিছু জানতে চাইছ, কিন্তু ঘটনা কোন জটিল নয়। গোড়া থেকেই বলি আমি কাশেম দারোগাকে সাথে নিয়ে অকুস্থলে গিয়ে দেখলাম মানুষের ভিড়, দারোগাকে বললাম লোকগুলি হঠিয়ে দিন। সে লাঠি দিয়ে হম্বিতম্বি করে মানুষ তাড়িয়ে দিল। লাশটা চিৎ হয়ে পড়েছিল বাজার থেকে আধা কিমিঃ দূরে রাস্তার পাশে। আমি লাশের দিকে তাকালাম, ভড়কে যাওয়ার মত অবস্থা। চোখ দু’টা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, মুখটা হা করে আছে, আতঙ্কের একটা বিভীষিকা যেন চেহারায় জ্বলজ্বল করছে। লোকটার বয়স পঞ্চাশের প্লাস মাইনাস হবে। মুখে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি, চেহারায় যেন একটা শয়তানি ও অপরাধীর অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে। আমার অতীত অভিজ্ঞতা যদি ভুল না হয় তাহলে বলব লোকটা মৃত্যুর সময় বিস্ময় ও আতঙ্কের চরমে পৌঁছে গিয়েছিল।
জিজ্ঞেস করলাম ‘কি দেখে তুমি এই অনুমান করলে? ঈশান বলল ‘আগেই তোমাকে বলেছি লোকটার মুখ বিকট হা করে ছিলো। এর কারণ হতে পারে ঘাতক এমন কেউ ছিলো যাকে দেখে সে চরমভাবে অবাক হয়ে গিয়েছিল, পরক্ষণে ভয়ানক আতঙ্কে তার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। যাই হোক পর্যবেক্ষণের জন্য লাশের পাশে বসলাম। তেলচিটে পড়া শার্ট আর লুঙ্গি পরনে, গায়ের চাদরটা পাকানো অবস্থায় রাস্তার পাশে পড়ে আছে। বুঝা যায় মরার আগে সে ঘাতককে অথবা ঘাতক তাকে চাদর পেছিয়ে ধরতে চেয়েছিল। বুকের উপর আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের লাভার ন্যায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। বুকের রক্ত বেয়ে রাস্তার নিচ পর্যন্ত চলে গেছে, পুটিনের মত রক্ত জমাট বেঁধে গেছে।
যখম দেখার জন্য বুকের দুইটা বোতাম খুলে শার্টটা দু’পাশে সরালাম। শার্টের উপর লেগে থাকা জমাট রক্তটা সরে যাওয়াতে জখমটা স্পষ্ট দেখা গেল। আঘাতটা কিসের বুঝতে পারলাম না। কারণ ছুরির আঘাত হলে চামড়াটা লম্বালম্বি কাটা থাকবে। অথবা দা কুড়াল কাস্তে ইত্যাদি সাধারন গৃহস্থালি অস্ত্রের আঘাত হলেও উপর-নিচ লম্বা কাটা থাকবে, গোলাকৃতি হবে না। কিন্তু এই জখমটা ছিল আধুলির মত গোল। প্রথমটায় ভাবলাম গুলির জখম কিন্তু উল্টিয়ে দেখলাম পিঠের দিকে কোন চিহ্ন নেই। অথচ গুলি ঢুকার জায়গায় আধুলির মত গর্ত হয় কিন্তু বেরোনোর জায়গায় বড় গর্ত করে বেরিয়ে যায়। কাজেই বুঝা গেল এটা দা ছুরি বা গুলির আঘাত নয়, চুখা গোলাকার কোন অস্ত্রের আঘাত হতে পারে। কিন্তু অস্ত্রটা কি তা বুঝতে পারলাম না।
তবে ঘাতক অতিশয় আক্রোশে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বাম বুকে ঠিক কলিজার উপর গভীর পর্যন্ত অস্ত্রটা বসিয়ে দিয়েছে। আর সাথে সাথে লোকটা মারা যায়। লাশের মধ্যে পর্যবেক্ষণের আর কিছু ছিল না। কোন তথ্য পাওয়ার আশায় আশপাশে অনুসন্ধান শুরু করলাম। লাশের পাশের ক্ষেতটা একটা জালাপাঠ বা বীজতলা। আশপাশের বাকি সব ক্ষেতে বোরো ধান রোপণ করা হয়েছে। অনেক অনুসন্ধান করেও আর কোন আলামত পেলাম না। অনুসন্ধান পর্ব শেষ হলে দারগা লাশটাকে চাটাই দিয়ে পেছিয়ে মর্গে পাঠিয়ে দিল।
এরপর আমরা চলে গেলাম নিহত ব্যক্তির বাড়িতে। তার স্ত্রী, পাড়া-প্রতিবেশী ও বাজারের কিছু লোকের জবানবন্দিতে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসলো। বস্তুত লোকটা ছিল ইতর প্রকৃতির, নারী কেলেংকারীসহ তার অনেক কেলেঙ্কারি রয়েছে। প্রতিবেশী জয়নালের স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল। এ নিয়ে জয়নাল স্ত্রীকে অনেক মারপিট করে, সতর্ক করে অবশেষে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু চারটা পোলাপানের কামড়ে সে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এরপরেও যখন পরকীয়া থামলো না তখন গ্রামে কয়েকবার দেন-দরবার হল, ওই নিহত ব্যক্তিকে কান ধরে উঠবস করানো হল। এত কিছুর পরেও তাদের অবৈধ প্রণয় চলতে থাকে।
নিরুপায় হয়ে জয়নাল তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েকবার নাকি আক্রমণও করেছে কিন্তু অন্যরা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ হয় যে খুনটা জয়নালই করেছে। সেই ভিত্তিতে দারোগা সাক্ষীদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে জয়নালকে ধরার জন্য তৎপর হয়ে উঠল। আমি বললাম ‘তাহলে তো মামলা ডিসমিস, তোমার আর খাওয়া নাই। ঈশান কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে চিন্তা করল। তারপর বললো ‘হা তবে খুনটা কি অস্ত্র দিয়ে করল তা আমার জানা দরকার। তাছাড়া একজন লোক আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে একটা ঘটনা বলল, তা যদি সত্যি হয় তাহলে জয়নাল খুনটা করেনি। অগত্যা আমাকে আবার যেতেই হবে।
পরদিন কাক ডাকা ভোরে সে রওনা হয়ে গেল, আমি লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকলাম। সে বাসায় ফিরল রাত এগারটার দিকে, মুখটা গম্ভীর থমথমে। বুঝলাম এবার বাপু রহস্য পাকে হাবুডুবু খাচ্ছে। অভ্যেস মত গ্যাসের চুলায় ঠান্ডায় আরষ্ট হাত দুটি ছড়িয়ে দিয়ে বলল ‘জিসান কেসটা যেমন সরল মনে হয়েছিল আসলে তা নয়, বিষয়টা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ঘটনা হল ঢাকার একজন শিল্পপতি কয়েকশ একর জমি লিজে নিয়ে একটা ফিশারি করেছে। জায়গাটা জয়নালের বাড়ি থেকে তিন মাইল উত্তরে আর খুনটা হয়েছে তার বাড়ি থেকে এক মাইল দক্ষিণে অর্থাৎ দুই জায়গার ব্যবধান চার মাইল। জয়নালের কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ মিলে ওই পিশারির পাহারাদারকে ম্যানেজ করে মাছ চুরি করে বিক্রি করে , পাহারাদারকেও ভাগ দেয়।
ঘটনার দিন রাতে তারা মাছ চুরি করে ফুলপুরের আড়তে নিয়ে বিক্রি করেছে। এই আড়ত বসে রাতে। কারন রাতেই মাছ ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। পিশারি থেকে আড়তের দূরত্ব পাঁচ মাইল। জয়নাল খুনের মামলায় ফেঁসে যাচ্ছে দেখে তার সঙ্গী চুরেরা আমাকে একটা নিরিবিলি গাছ তলায় নিয়ে গেল। তারপর সবাই আমার হাত ধরে বলল, যদি তাদের নাম প্রকাশ না করার ওয়াদা করি তাহলে তারা আমাকে গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য দিবে। তবে প্রয়োজনে জয়নালের নাম প্রকাশ করতে বাধা নাই। তথ্য পাওয়ার আশায় আমি ওয়াদা করলাম। তখন তারা এ ঘটনা বলল। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর মুখের অভিব্যক্তি দেখে অবিশ্বাস করার উপায় ছিল না।
যাই হোক সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য স্থানীয় একজন হন্ডা ওয়ালাকে ভাড়ায় নিয়ে ফিসারিতে গেলাম। ম্যানেজার ও শ্রমিকরা পিশারির এক পাশে মাঝারি একটা পুকুর দেখিয়ে বলল ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা রাতের দিকে এই পুকুরের অন্তত বিশ মণ মাছ চুরি হয়ে গেছে। তারপর ছুটলাম ফুলপুর চুরেরা যে আড়তের কথা বলেছিল সেখানে গেলাম। মালিক বলল ‘হা বৃহস্পতিবার রাত এগারটার দিকে সাত আটজন লোক মাছ নিয়ে এসেছিল। তারপর খাতা বের করে বলল ‘তিন হাজার টাকা দরে সাড়ে বাইশ মন তেলাপিয়া মাছ বিক্রি করেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘আচ্ছা তাদের মধ্যে কাউকে চিনেন কিনা? মালিক বলল ‘না চিনি না, কত লোক মাছ বেচতে আসে কয়জনকে চিনে রাখা যায়। জিজ্ঞেস করলাম ‘তখন সময় কত ছিল? মালিক বলল ‘রাত এগারটার মত হবে। তারপর তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়লাম। চিন্তা করে দেখলাম হিসাব ঠিক আছে, রাত সাতটা আটটার দিকে মাছ ধরে ঠেলাগাড়িতে করে পাঁচ-ছয় মাইল দূরত্বে পৌঁছতে এগারটা বাজতে পারে।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তারা আড়তে মাছ বিক্রি করেছে রাত এগারটায় আর খুনটাও হয়েছে ঠিক এগারটায়। অকুস্থল থেকে আড়তের দূরত্ব ছয় সাত মাইল। এখানেই সমস্যা, একই ব্যক্তি একই সময়ে ছয় সাত মাইল দূরত্বে থেকে খুনটা করলো কিভাবে? আবার এমনও তো হতে পারে জয়নালের দুষ্কর্মের সাথীরা তাকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে, চুরিটা হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেখানে জয়নাল ছিল না, বিষয়টা প্যাঁচ লেগে গেল। আরো অনুসন্ধানের জন্য এলাকায় চলে গেলাম। গ্রামে ও বাজারে কিছু অনুসন্ধানের পর যা জানতে পারলাম তাতে আমার ভিড়মি খাবার উপক্রম হলো। ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়া শুরু করেছে।
নিহত লোকটা পেশায় ছিল একজন কয়াল। কয়াল অর্থ বুঝ? এটি একটি আরবি শব্দ, কায়ল অর্থ মাপা বা পরিমাপ করা, আর পরিমাপকারীকে গ্রাম্য ভাষায় কয়াল বলা হয়। ফুলপুর এলাকাটায় প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়। প্রত্যেক বাজারে ধানের বড় বড় আড়ত আছে। নিহত ব্যাক্তি আগে আবুল কালাম নামে একজন সাবেক চেয়ারম্যানের কয়াল ছিল। সে ধান ময়ালে ঘুরে ঘুরে ধান কিনত আর পরিচিত লোক পেলেই তার ধান নিয়ে আড়তে ঢেলে দিত। ধান আধামন হলে মালিককে বলত ‘ত্রিশ সেরের দাম দেন, ত্রিশ সের হলে বলতো ‘এক মনের দাম দেন। তারপর আড়ালে গিয়ে ধান ওয়ালার কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে তার হাতেও কয়েক টাকা ধরিয়ে দিত। এরপর অন্যদের কাছ থেকে মাপে বেশি নিয়ে কমতি ধানের পরিমাণ পূর্ণ করত।
এছাড়া মালিকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে গ্রামে ও বিভিন্ন বাজারে ধান কিনত সেখানেও টাকা মারত। আবার মালিকের কাছ থেকে বেতন বাবদ অনেক টাকা অগ্রিম নিয়ে যায়, এ টাকা আর ফেরত দেয়নি। একবার ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা চুরি করে ধরাও খায়। এসব ফেরেববাজীর কারণে মালিক তাকে তাড়িয়ে দেয়। সে গিয়ে খালেক নামের আরেক আড়তদারের কাজে যোগ দেয়। তখন থেকেই সে আগের মালিকের ক্ষতি করতে থাকে। এই লোকটা ছিল কর্মঠ, যে কারো সাথে আলাপ করে সে বশে আনতে পারত। আগের মালিক যে সব মিলে ধান দিত সেগুলিকে পটিয়ে সে নতুন মালিকের আড়ত থেকে ধান দেয়া শুরু করল। সে সাবেক মালিকের পাওনা টাকা তো দিলই না বরং বিভিন্ন ভাবে ক্ষতি করতে লাগলো।
আবুল কালাম ছিল সাবেক চেয়ারম্যান এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তি। সে ঐ ব্যাক্তিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। অবশেষে তার নতুন কর্মচারী জালালকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়। উড়ো সংবাদ শোনা যায় পঞ্চাশ হাজার টাকা নাকি চুক্তিও হয়। কাজেই বাজারের মানুষের সন্দেহ খুনটা জালালই করেছে। কারণ রাত এগারোটায় জালাল ও নিহত ব্যাক্তি একসাথে চা স্টল থেকে বের হওয়ার সময় অন্তত পচিশজন মানুষ তাদেরকে দেখেছে। রাস্তায়ও কয়েকজন দেখেছে তারা দুজন আলাপ করতে করতে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। তারপর জালাল বাড়িতে গেল কিন্তু ঐ ব্যাক্তি লাশ হয়ে রাস্তার ধারে পড়ে রইল। আমি জালালের খুঁজে তার বাড়িতে গেলাম কিন্তু পেলাম না। এখন কি বুঝলে?
আমি মাথা চুলকে বললাম ‘সন্দেহটা তো জালালের উপরই জমাট হচ্ছে কিন্তু জয়নালও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যায়নি। সে আনমনা হয়ে বলল ‘ঠিকই বলেছ জয়নাল মাছ বেচতে গিয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আচ্ছা যাক আশা করি কাল একটা সলুক পাব।
পরদিন এসে কিছুক্ষণ বিষণ্ন হয়ে থাকল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল ‘জয়নাল তার এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট হয়ে গেছে কিন্তু আমার মনে হয় খুনটা সে করেনি। জিজ্ঞেস করলাম ‘তোমার এমন মনে হওয়ার কারণ কি? সে বলল ‘কারণটা হলো জালাল বাড়িতে নাই সে কোথায় গেছে বাড়ির লোকেরা বলতে পারে না। গেলাম তার মালিক আবুল কালামের কাছেআমার পরিচয় পেয়ে বেচারা যেন চমকে উঠল। জালালের কথা জিজ্ঞেস করতে বলল ‘তার মেয়ে জামাই নারায়ণগঞ্জে কাজ করে, সেখানে কিছু টাকা আনতে গেছে, কবে আসবে বলতে পারে না। খুন সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা জিজ্ঞেস করতেই বেচারা ব্যস্ত হয়ে ‘আপনি পড়ে আসেন আমার জরুরী এক জায়গায় যেতে হবে’ বলে দ্রুত চলে গেল। এ আচরনে বুঝা যায় কালামের কারসাজীতে জালালই খুনটা করেছে, তোমার কি মনেহয়? বললাম ‘আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।
পরদিন সে রাতে এসে হাসিমুখে আমার হাতে একটা অস্ত্র দিয়ে বলল ‘বলতো এটা কি? আমি হাতে নিয়ে দেখলাম কাঠের হাতল ওয়ালা একটা লোহার দন্ড, হাতলের নিচ থেকে লোহাটা দুই ভাগ হয়ে গেছে। গোলাকার সুজা দণ্ডটা ক্রমশ সরু হয়ে মাথাটা চুখা হয়ে আছে অপর অংশটা কাস্তের মতো বাঁকা। দেখেই বুঝলাম এটা মাহুতের অস্ত্র অঙ্কুশ, এটা দিয়ে হাতি নিয়ন্ত্রণ করে। অবাধ্যতা করলে লোহার দন্ডটা আমুল হাতির মাথায় বিদ্ধ করে শাস্তি দেয়। জিজ্ঞেস করলাম ‘এই অস্ত্র তুমি কোথায় পেলে? সে বলল, ‘লাশ যেখানে পরেছিল তার পাশের ক্ষেতটা বীজতলা, সেখানেই এটা পড়েছিল। আজ কামলারা চারা উঠানোর সময় এটা পায়। আমি তোমাকে বলেছিলাম না- দা ছুরি কুড়াল বা বুলেটের আঘাতে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়নি, হয়েছে গোলাকার কোন অস্ত্রের আঘাতে, এই হল সেই অস্ত্র। আঘাত করে নিরাপত্তার স্বার্থে ঘাতক এটা বীজতলায় নিক্ষেপ করে চলে যায়। অস্ত্রটা রক্তমাখা ছিল কামলারা না বুঝে ধুয়ে ফেলেছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরীক্ষা করার আর কোন সুযোগ নাই।
সুরতহাল রিপোর্টও হাতে এসেছে। সেখানেও বলা হয়েছে রড জাতীয় কোন লৌহদন্ডের আঘাতে কলিজা এপোরওপোর হয়ে গেছে। এছাড়া শরীরে আর কোনো আঘাতের চিহ্ন নাই। আমি বললাম ‘কিন্তু এই অস্ত্র আসল কোত্থেকে, সার্কাসের হাতি ছাড়া আমাদের এলাকায় হাতি দেখা যায় না। খুনি জয়নাল বা জালাল যেই হোক এই অস্ত্র পেল কোথায়? ঈষান বলল ‘এটাই তো চিন্তার বিষয়। আচ্ছা দেখা যাক কাল থেকে নতুন ভাবে অনুসন্ধান চালাতে হবে। পরদিন থেকে সে ভোরে বেরিয়ে যায় রাতে ফিরে আসে কিন্তু একটা কথাও বলে না, সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না।
কয়েকদিন পর হঠাৎ বলল ‘জিসান পার্বত্য চট্টগ্রাম যেতে হবে আগ্রহ থাকলে যেতে পার। আমি অবাক হয়ে গেলাম ‘হঠাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন কী উদ্দেশ্যে, এই কেস নাকি অন্যকিছু? সে উত্তর দিল না। বুঝলাম এ সময় তার মুখ থেকে কথা বের হবে না। কিন্তু রহস্য জানার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে উঠেছি, আবেগে উত্তেজিত হয়ে উঠেছি। পরদিন পুটলাপাটলি গুছিয়ে নাইট কোচে ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছে একটা হোটেলে উঠলাম। পরদিন সকালে সে স্থানীয় আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক পর ফিরে এসে বলল ‘জিসান চলো আরো অনেক দূর যেতে হবে। আমি বললাম ‘পার্বত্য অঞ্চল মোটেও নিরাপদ নয়, পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত তার উপর পাহাড়ের বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তো আছেই। শহরের এ নিরাপদ আশ্রয়ে ছেড়ে গিয়ে আমি বাপু বেঘুরে মরতে পারবো না। সে বলল ‘আমাদের কাজই যদি না হয় তাহলে এখানে এসে বসে থেকে লাভ কি? বললাম ‘কর্মস্থলটা কত দূর, এখান থেকেই কি কার্যক্রম চালানো যায় না? সে বলল ‘না জায়গাটা অনেক দূর, গভীর পার্বত্য এলাকার গভীরে। সমস্যা নাই সেখানে আর্মি ক্যাম্প ও নিরাপদ হোটেল আছে। বুঝলাম আর তর্ক করে লাভ নেই, আমি যাই বা না যাই সে তার গন্তব্যে পৌঁছবেই। কাজেই আর বিতর্ক না বাড়িয়ে খাওয়া দাওয়ার পর রওনা হলাম।
বাসে কয়েক ঘন্টা যাওয়ার পর একটা বাজারে পৌঁছলাম। এরপর আর কোন পাকা রাস্তা নাই পাহাড়ে চলাচলের একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে দুজন চেপে বসলাম। গাড়ি মন্তর গতিতে এগিয়ে চলল। পাহাড়ি পথ অসমতল, এবরো থেবরো উঁচু নিচু রাস্তা। পাহাড় কেটে নদী ভরাট করে মাঝে মধ্যে নদীতে কাঠের সেতু দিয়ে রাস্তাটা করা হয়েছে। গাড়ি কখনও পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যায় আবার ঝমঝম করে সমতলে নেমে আসে। মনে হয় আমরা যেন আকাশ আর মাটিতে উঠানামা করছি। একটা পাহাড় পেরোতেই সমতল, তারপর নালা। নালাগুলিতে বাঁশ কাঠ দিয়ে সেতু নির্মান করা হয়েছে। চারিদিকে দুর্গম অরন্য, ঝোপঝাড়, বাঁশঝাড়, আকাশ ছাওয়া বিশাল বিশাল গাছ ইত্যাদি।
সৃষ্টির কোন কালে এসব গাছগাছালির জন্ম হয়েছে কে জানে। হয়তো হাজার হাজার বছর কেটে গেছে এসব দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে কোন জনবসতি গড়ে ওঠেনি। একসময় হয়ত মগ বর্গীরা ডাকাতির সুবিধার্থে পার্বত্য অঞ্চলের কোন কোনায় আশ্রয় গ্রহণ করে। তারপর তাদের বংশধররা ধীরে ধীরে এ বিশাল অরণ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। মাইলের পর মাইল পাহাড় জঙ্গল আর নদীনালা। এগুলিতে জংলি মোরগ, শেয়াল, গিরগিটি ভালুক ইত্যাদির বাস, কোন জনবসতি নাই। সূর্য একটু হেলে গেলেই গাছগাছালির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায় আর দেখা যায় না।
আমার ভয় হতে লাগল এসব জঙ্গলে চিতা ভালুক ইত্যাদি হিংস্র প্রাণী ওৎ পেতে থাকে। বিচ্ছিন্ন কাউকে পেলেই আক্রমণ করে বসে। তবে এই জংলি হিংস্র প্রাণীর চেয়েও ভয়ঙ্কর হিংস্র হল পাহাড়ের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেকড়েগুলি। হিংস্র প্রাণীর মুখে পড়লেও জান বাঁচানোর আশা থাকে কিন্তু এদের মুখে পড়লে আর রক্ষা নাই। বিশেষত এরা যদি আমাদেরকে সেনাবাহিনীর লোক বা সাংবাদিক সন্দেহ করে বসে, ব্যাস তাহলেই খালাস পার্বত্য সমাধি বরণ করতে হবে।
একটা পাহাড়ের উপরে উঠে গাড়ি থেমে গেল আর রাস্তা নাই। আমরা ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। সামনে পায়ে চলা সরু পথ, এখন দু'পায়ের উপর ভরসা। আমরা দ্রুতলয়ে হাঁটতে লাগলাম, সন্ধার আগেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে। সরু পথ ধরে কখনো অতিকষ্টে পাহাড়ের উপরে উঠতে হয় তারপর সমতল বা নালা। অবশ্য প্রত্যেক নালায় পারাপারের জন্য গাছ ফেলে রাখা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে অন্য সব কিছুর অভাব থাকতে পারে কিন্তু গাছের অভাব নাই। একসময় কিছুটা সমতল এলাকায় বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন বাড়িঘর দেখা গেল। সমতল খেতগুলিতে মগদের বিখ্যাত জুম ফসল দেখতে পেলাম। মগরা ক্ষেতে কাজ করছে। মগ মেয়েরা বাচ্চা পিঠে নিয়ে কাজ করছে, কেউ লাকড়ির বুঝা নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে, কেউ নালা থেকে কলসি কাখে পানি নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু বাঙ্গালীও দেখা গেল। এই বসতিগুলিতে আর্মি ক্যাম্প আছে।
উঁচু-নিচু বন্ধুর পথে চলতে চলতে আমরা একেবারে বিকল হয়ে গেছি। অবশেষে সন্ধ্যায় একটা পার্বত্য বাজারে পৌঁছলাম। আমি আধমরা হয়ে গেছি কিন্তু ঈশান কর্মঠ ও কষ্টসহিষ্ণু। বিশেষত গোয়েন্দাগিরির কাজে যত কস্টই হোক সে ক্লান্ত হয় না। আমি গিয়ে একটা খোলা চা স্টলে বসে চা অর্ডার দিলাম। ইশান লোকজনের কাছে বিভিন্ন তথ্য নিতে লাগলো ‘এটা লাউয়্যাছড়ি কিনা, আর্মি ক্যাম্প কোথায়, হোটেল কোথায় ইত্যাদি।
তারপর বাজারের এক পাশে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে উঠলাম। ঈশান ক্যাম্প কমান্ডারের কাছে চেয়ারম্যান ও ফুলপুর থানার ওসি কর্তৃক প্রদত্ত পরিচয় পত্র তুলে দিয়ে বলল ‘আমরা একটা কেসের তদন্ত কাজে এসেছি আপনার সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হবে না। কমান্ডার আশ্বাস দিলেন। তারপর ক্যাম্পের কাছেই অতিথিদের একটা ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল, খাওয়ার ব্যবস্থাও তারাই করবে। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পা ফুলে গেছে। এছাড়া বাঙালিরা এখানে আসলেই কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়। এজন্য আমাদেরকে প্রয়োজনীয় ঔষধ দেওয়া হলো একটা বড়ি উপস্থিত খাইয়ে দিল। ব্যাস কিছুক্ষনের মধ্যেই পা ফোলা, মাথাধরা ও ক্লান্তি কেটে গেল। রাতে খাওয়ার পর ঈশান গিয়ে কমান্ডারের সাথে তার কেস নিয়ে আলাপ করল এবং বিভিন্ন তথ্য জেনে নিল। তারপর সারারাত বেঘোরে ঘুম।
লাক্কাছরি, আর্মি ক্যাম্প থেকে আট মাইল দূরের একটা এলাকা। পরদিন সকালে সে বলল ‘জিসান আগেই এই দুর্গম এলাকায় তোমার যাওয়ার দরকার নাই, আগে আমি উদ্দিষ্ট ঠিকানা খুঁজে বের করি তারপর যাবে। আমারও যাবার শখ নাই, গতকালের খাটাখাটুনিতে এমনিতেই অবশ হয়ে আছি। তাই বললাম ‘সাবধানে থেকো শান্তিবাহিনীর চোখে পড়লে কিন্তু একেবারে শান্তির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে। সে মুচকি হেসে পিস্তলটা প্যান্টের পকেটে গুঁজে বিদায় নিল। আমিও এলাকাটা দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। এখানে মোবাইল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, কারণ এ এলাকায় কোন টাওয়ার নাই। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ ঈশানের কোন খবর নাই। আমি পেরেশান হয়ে কমান্ডারকে গিয়ে বললাম। তিনি বললেন ‘এলাকাটা অনেক দুর আর কিছুক্ষণ দেখেন, না আসলে আর্মি পাঠাতে হবে। না কাউকে পাঠাতে হল না, রাত আটটায় সে একেবারে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।
তারপর বলল ‘বাপ্পিসরে এতদূর আমি ভাবতেই পারিনি, তার উপর রাস্তাঘাটের নাম নিশানাও নাই। কোথাও দুপায়ে চলার মত রাস্তা আছে, কোথাও জঙ্গল মাড়িয়ে হাটতে হয়। আবার একটু পরপর নালা, কোনটায় সেতু আছে কোনটায় নাই। তবে ভালই লাগছে, ময়মনসিংহ এলাকার প্রচুর বসতি আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘তোমার কাজের কোনো অগ্রগতি হল? সে রহস্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বলল ‘তেমন না, শুধু একজন মহিলার সাথে আলাপ হল। বললাম ‘ধান বানতে শিবের গীত কেন, গোয়েন্দাগিরির কাজে মহিলার কি দরকার, খুব সুন্দরী বুঝি প্রেম করবে? ‘দেখা যাক’ সে উত্তর দিল। জিজ্ঞেস করলাম ‘আটমাইল দুর আবার দুর্গম পথ তাহলে সেখানে কোথাও থেকে তদন্তকাজ চালালে সুবিধা হতো না? সে বলল ‘না সেখানে থাকার সুবিধা নাই। তারপর সে বাঙালিদের জীবন মান ও পাহাড়ে তাদের জীবন যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগল।
পরদিনও সে একাই গেল। রাত নয়টায় ফিরে এসে বলল ‘জিসান কাল তোমাকে নিয়ে যাবো। নিজের দেশের লোকগুলিকে একটু দেখে আস আর হয়তো সুযোগ পাবে না। পরদিন খুব ভোরেই রওয়ানা হলাম, দুর্গম পথ পেরিয়ে দুপুর নাগাদ গিয়ে লোকালয়ে পৌছলাম। এ এলাকায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও রংপুর এলাকার মানুষ বেশি। ঈশানের সাথে আগে অনেকের পরিচয় হয়েছে। আমাদের পেছনে মানুষের সারি লেগে গেল, দেশের মানুষ পেয়ে তারা যেন মা বাপু খুঁজে পেয়েছে। তারা আনন্দিত উল্লসিত, সবাই নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। দুয়েক বাড়ি যাই, এটা ওটা খেতে দেয়। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়েছে, এলাকার প্রভাবশালী একজন ডিলার আমাদেরকে একরকম জোর করেই তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তার আসল বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর।
খাওয়া দাওয়ার পর একটা ছোট্ট বাড়িতে গিয়ে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলাকে দেখিয়ে ঈশান বলল ‘ওনার কথাই তোমাকে বলছিলাম। উনার জীবন খুব কষ্টেরএকটা ছেলে ছাড়া ত্রিভুবনে তার কেউ নাই। ততক্ষণে মহিলা দুইটা বেতের মোড়া এনে উঠানে দিল, আমি ও ঈশান বসলাম। মহিলা তার দুঃখের ইতিহাস শুরু করল। কিন্তু মানুষ পেছনে গিজগিজ করছে, সবাই নিজ নিজ বাড়িতে নিতে চায়। ঈশান বলল ‘তুমি যাও দেশের মানুষগুলোকে একটু ঘুরে ফিরে দেখে আস আর সুযোগ পাবে না, কারণ এদিকে আর আসা হবে না। আমি তাদের সাথে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে লাগলাম। একটু সুখের আশায় এই লোকগুলি এখানে এসে যে কষ্ট করছে তা দেখে আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। ঘণ্টাখানেক পর ঈশান এসে বলল ‘চল রাত হয়ে গেলে অন্ধকারে পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পরদিন বলল ‘চল আশা করি আজ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব। তিন মাইল দুরের একটা জায়গায় গিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। শত শত হাতি দিয়ে মাহুতরা কাজ করাচ্ছে, বড় বড় গাছের গুড়া হাতিরা পায়ে ঠেলে বা শুর দিয়ে পেঁচিয়ে পাশের নালায় ফেলছে, আর্মিরা তদারকি করছে। ঈশান এক আর্মির সহযোগিতায় রনজু নামের একটা ছেলেকে ডাকিয়ে আনল। তেইশ চব্বিশ বছরের যুবক, প্রশস্ত বক্ষ চওড়া কাঁধ বলিষ্ঠ গড়ন, গায়ের ফর্সা রং রোদে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে, দেখে হাতির মতো শক্তিশালী ও তেজী মনে হয়। আমরা গিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গায় গাছ তলায় বসলাম।
প্রাথমিক পরিচয়ের পর আমার প্রশ্নের জবাবে রঞ্জু বলল ‘এসব পাহাড়-জঙ্গল সরকারিভাবে পরিষ্কার করা হচ্ছে বাঙ্গালীদের পুনর্বাসনের জন্য। জঙ্গলের ঝোপঝাড় কেটে আগুনে পোড়ানো হয়। সাধারন গাছগুলিতে আর্মিরা একটু গর্ত করে বারুদ বা এই জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে দেয় তখন কাঁচা গাছটা সপ্তাহখানেকের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু বড় বড় দামী গাছগুলি কেটে আমরা হাতি দিয়ে টানিয়ে গভীর নালায় নিয়ে ফেলি। নালা দিয়ে ভাসিয়ে নেয়া হয় রোডের কাছে। সেখানে আবার হাতি দিয়ে ট্রাকে তোলা হয়। তারপর এসব কাঠ ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। আমরা এখানে কখনো চুক্তিভিত্তিক কখনো রোজানা কাজ করি।
আরও কিছুক্ষণ সাধারন আলাপের পর ঈশান জিজ্ঞেস করল ‘ময়মনসিংহে কেন গিয়েছিলে? ছেলেটা যেন চমকে উঠল, সামলে নিয়ে শুষ্ক হাসি দিয়ে বলল ‘'না ময়মনসিংহ তো চিনি না, কেন যাব কার সাথে যাবো। ইশান বলল, ‘দেখ ফুলপুরে যে খুনটা হয়েছে আমি সেখান থেকে এসেছি। সব আলামত সংগ্রহ করেই তোমার কাছে এসেছি। ছেলেটা পায়ের নিচে সাপ পড়ার মতো লাফিয়ে উঠল। সহসা যেন চোষ কাগজে তার মুখের সব রক্ত চুষে নেওয়া হয়েছে, মুখটা কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে। সে চিৎকার করল ‘খুন, কিসের খুন, আপনারা কে কোত্থেকে এসেছেন আমাকে কী ব্ল্যাকমেইল করতে এসেছেন’ বলে সে চলে যেতে লাগল।
ইশান তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে অঙ্কুশটা বের করে মাটিতে পুঁতে দিয়ে গর্জন করে উঠল, ‘রঞ্জু এদিকে তাকাও। চলার পথে হঠাৎ বাঘ দেখলেও মানুষ এতটা সন্ত্রস্ত হয় না। তার চোখ দুটি যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, মুখটা হা করে আছে, শরীর কাপছে। ঈশান শান্ত গলায় বলল ‘বুঝতেই পারছ সব আলামত আমার হাতে এসে গেছে, এখন যদি টালবাহানা করো তাহলে আর্মি কাছেই আছে এখনি এরেস্ট হয়ে যাবে। আর যদি আমাকে সবকিছু খুলে বল তাহলে আমি তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব। এখন ভেবে দেখো কোনটা করবে।
রঞ্জু ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বসল, মৃত্যু ভয়াল চোখে অঙ্কুশটার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশান বলল ‘আমাকে ভয়ের কারন নাই, আমি তোমার হৃদয় বিদারক ইতিহাস জানি। সব জেনেই তো তোমার কাছে এসেছি। এখন তুমি যদি সব স্বীকার করে সত্য বল তাহলে তোমাকে বাঁচানোর সবরকম চেষ্টা আমি করব। কিন্তু যদি ছলচাতুরি কর তাহলে এখানেই এরেস্ট হয়ে যাবে। ছেলেটা মাথা নিচু করে বসে আছে, তার নাকের ডগা বেয়ে ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
২
যমুনার বিস্তৃত চরাঞ্চল, মরুভূমির মত দিগন্ত বিস্তৃত বালুকারাশি। রাস্তাঘাটের চিহ্নমাত্র নেই দৃষ্টিসীমা ব্যাপ্ত ধু ধু সিকতাময় প্রান্তর। মাথার উপর সূর্য অগ্নি বর্ষণ করছে, মিহির কিরণ প্রতিবিম্বিত হয়ে মহাসমুদ্রের তরঙ্গমালার মতো মরীচিকা ঢেউ খেলছে। এই বালিয়াড়ি সিন্ধু মারিয়ে একটা কাফেলা চলছে। বারটি পরিবারের নারী পুরুষ শিশু মিলিয়ে পঞ্চাশজন মানুষ। ভাত, শুধু ভাত। এক মুঠো অন্নের জন্য তারা জন্মভুমি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পেটের আগুন নিভাতে তারা প্রকৃতির আগুনকে বরন করে নিয়েছে। মরুচারীদের মত চরাঞ্চলের জীবন বড় দুঃসহ, নিষ্ঠুর ও সংগ্রামী। যমুনার তীরবর্তী এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকে, সাধারণত ধান পাট জাতীয় ফসল হয় না আশা শুধু রবিশস্যের। তবে কোন কোন বছর আশ্বিন মাসে পানি নেমে গেলে আমন রোপন করে কিছু ফসল পাওয়া যায়।
কিন্তু ১৯৮৮ সালের সর্বগ্রাসী করাল বন্যায় সব গ্রাস করে নিয়ে গেছে। চরাঞ্চলের মানুষের এক মুঠো অন্নসংস্থান হবে তো দূরের কথা গরু ছাগলের জন্য একমুঠো তৃণ পর্যন্ত দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। যতদূর চোখ যায় সাহারা মরুভূমি, কোন ফল ফসল নাই ঘাস তৃণলতা নাই, রুক্ষ আর বন্ধা বেলাভূমি। অসহায় মানুষগুলির শেষ সম্বল গরু ছাগল ও ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করে পেটের দায় মিটাতে লাগল। অবশেষে যখন তারা ভূপৃষ্ঠে বেঁচে থাকার মত কোন অবলম্বন পেলো না এবং ভুগর্ভ ব্যতিত আর কোন গত্যন্তর দেখল না তখনই নিরুপায় হয়ে চাকমার উদ্দেশ্যে রওনা হল। স্থানীয়রা পার্বত্য চট্টগ্রামকে চাকমা বলে। সেখানে গেলে সরকার রেশন দিবে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করবে, জায়গা জমি দিয়ে চাস বাসের সুযোগ করে দিবে। তারা দুমুঠো খেয়ে বাচতে পারবে। কিন্তু এখানে পড়ে থাকলে এই ঊষর চরাঞ্চলের বুকে তাদের কঙ্কালগুলি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে থাকবে। কাজেই বেঁচে থাকার আশায় তারা জন্মভূমি ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে।
আমোদ আলীর পরিবারও এই কাফেলার সদস্য, তারা স্বামী স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বাহাদুরাবাদ ঘাটে গিয়ে তারা ট্রেনে চড়ল। তারপর ময়মনসিংহে গিয়ে লোকাল ট্রেনে চড়ে আঠার ঘণ্টাপর চট্টগ্রাম নেমে শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে উঠল। তাদেরকে বলা হলো এখানে বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। স্থান নির্ধারণ করে জমি বরাদ্দ দেয়ার পর তাদেরকে নেয়া হবে। কিন্তু এখানে সরকারি কোন রেশন বা ভাতা দেওয়া হবে না নিজ খরচে থাকতে হবে। আবার শুরু হল অসহায় মানুষগুলির জীবন সংগ্রাম, বসে বসে খাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য তাদের নাই, কোন রকম রাহা খরচটা নিয়ে তারা বেরিয়েছে। তবে সমস্যা নাই চট্টগ্রাম উন্নত এলাকা, কাজ করলে পেটের চিন্তা করতে হয় না। কাজেই তারা কাজে নামল।
মহিলারা আশপাশ এলাকার বাড়িতে গিয়ে ঝিয়ের কাজ করে, পুরুষরা চলে যায় চট্টগ্রাম শহরে। যমুনার চরাঞ্চলের চেয়ে এখানে জীবন যুদ্ধ অনেক সহজ। সেখানে কাজের কোন সুযোগই ছিল না অথচ এখানে চাইলেই কাজ পাওয়া যায় আর কাজ করলে নতুন পয়সার মুখ দেখা যায়। উদ্বাস্তু পরিবারগুলির ভালই চলছে। আমোদ আলী তার দুই ছেলেকে নিয়ে টাউনে চলে যায় সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় ক্যাম্পে ফিরে। তারা খুব খুশি, তিন বাপ বেটা মিলে যথেষ্ট উপার্জন করে, এই সুযোগটা তারা যমুনার তীরে কোন দিন পায়নি। পরিবারের খরচা বাদে তাদের কিছু আয়ও হতে লাগলো। আমোদ আলীর তিন সন্তানের মধ্যে দশ- বার বছরের আসিয়া সর্বকনিষ্ঠ। বাপ-ভাই কামাই করে সে আর তার মা বসে বসে খায়। ভাইরা ছোট বোনকে খুব আদর করে, কোনদিন খালি হাতে আসে না বোনের জন্য লজেন্স চানাচুর বিস্কুট কাপড় কসমেটিক ইত্যাদি নিয়ে আসে, সুখেই তাদের দিন কাটছে।
একমাস পর তাদের যাওয়ার অর্ডার হলো কিন্তু দালাল পিছু নিল। এক হাজার করে টাকা দিলে সমতল ফসলি জমি পাইয়ে দিবে। অগত্যা সবাই দালালকে এক হাজার করে টাকা দিল বটে কিন্তু দালাল কোন কাজ করলো না। এক মাস পর তারা আবার রওয়ানা হল, গাড়িতে চড়ে পরপর দুটি ক্যাম্পে গেল। সেখানে তাদের যাচাই-বাছাই ও সংখ্যা গণনা করা হলো। দ্বিতীয় ক্যাম্পের পর গাড়ি চলাচলের কোন রাস্তা নাই তাদেরকে পায়ে হেঁটে রওনা হতে হল। শুধু পাহাড় আর পাহাড় জঙ্গল আর জঙ্গল। এই হতভাগ্য মানুষগুলি উষর মরুভূমি ছেড়ে পার্বত্য জঙ্গলে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে, সমতলভূমি তাদের ভাগ্যে নাই। দুর্গম গিরি পথ, কোন রাস্তা নাই, দু’পায়ে চলার মত মাঝে মধ্যে মাটির আভাস পাওয়া যায়, বাকি পথ জঙ্গল ভেঙ্গে যেতে হয়। কখনো পাহাড় কখনো সমতল কখন নালা। গভীর নালাগুলিতে পারাপারের জন্য মোটা মোটা গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে তবে অগভীর নালা গুলি পায়ে হেঁটে পার হতে হয়।
এই দুর্গম অরণ্য পথে একটানা হাঁটতে হাঁটতে সকলের পা ফুলে গেছে, নারী ও শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অবশেষে একটানা তিনদিন হাটার পর তারা লাউয়্যাছরি আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হল। জমি বরাদ্দ ও বাড়িঘর না উঠা পর্যন্ত তাদেরকে এখানেই থাকতে হবে। সরকারিভাবে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। কালা জ্বর ও অন্যান্য পার্বত্য রোগের প্রতিষেধক ঔষধ দেওয়া হলো। দুই দিন পর তাদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। দুর্গম পর্বতের সারি আর নালা, ফসল উপযোগী সমতলভূমি নাই বললেই চলে। জমি দেখে তারা বেঁকে বসল, দাবি জানাল এই পাহাড়-পর্বত তারা নিবে না, ফসল উপযোগী সমতলভূমি দিতে হবে নচেৎ থাকবে না চলে যাবে। দালাল তাদের থেকে এক হাজার করে টাকা নিয়েছে সমতলভূমি পাইয়ে দিবে বলে। অগত্যা তাদের দাবি মেনে নেওয়া হলো। আর্মি কমান্ডার বললেন ‘ঠিক আছে তোমাদের পছন্দ মত জায়গা দেয়া হবে।
দুদিন পর তাদেরকে আরেকটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। এই জায়গাটা মোটামুটি পছন্দ হল, ফসলের উপযোগী কিছু সমভূমি আছে। প্রত্যেক পরিবারকে পাঁচ একর করে জমি দেয়া হল, এখন প্রত্যেকের জমির মাথায় বাড়ি করতে হবে। তাতে বাড়িগুলি একটা সরল রেখায় হবে বটে কিন্তু বস্তির মতো লাগোয়া হবে না কিছুটা অন্তর অন্তর হবে। এরপর শুরু হলো বাড়ি ঘর নির্মাণের কাজ। নিজ নিজ ঘর নিজেকেই নির্মাণ করতে হবে, আর্মিরা শুধু সহযোগিতা করবে। ক্যাম্প থেকে আট মাইল দুরে তাদের জমি দেয়া হয়েছে। উদ্বাস্তুরা সকালে কয়েকটা রুটি নিয়ে যায় একটানা কাজ করে রাত্রে ক্যাম্পে পৌঁছে। জঙ্গলে বাঁশ কাঠের অভাব নাই, বাঁশ কাঠ কেটে বাড়ি নির্মাণের সামগ্রী প্রস্তুত করে, আর্মিরা সহযোগিতা করে। নতুন দেশ নতুন উপনিবেশ নতুন উদ্যোগ। এক মাস পরিশ্রম করে তারা ঝকঝকে তকতকে বাড়িঘর নির্মাণ করে ফেলল। তারপর সবাই নিজ নিজ বাড়িতে গিয়ে উঠল।
আছিয়া মাঝে মধ্যে তার বাপ ভাইয়ের সাথে যেত, তাদের কাজে সহযোগিতা করত, দুপুরে খাওয়ার সময় নালা থেকে পানি এনে দিত। এখন নতুন বাড়িতে উঠে সে খুব খুশি। কিন্তু একটি বিষয়ে তার মন খারাপ। তাদের বাড়িটা পড়েছে বস্তির একদম দক্ষিণ প্রান্তে, তাদের দক্ষিণে সব পাহাড়ি চাকমা, কোন বাঙালি বাড়ি নাই। উদ্বাস্তু পরিবারগুলি পুনর্বাসিত হয়ে উৎফুল্ল হল, তারা নতুন বাড়ি ঘর পেয়েছে জমি পেয়েছে মাথাপিছু রেশন পাচ্ছে ঔষধপত্র পাচ্ছে। কাজেই তারা আনন্দচিত্তে নতুন দেশে নতুন জীবন যাত্রা শুরু করল।
কিন্তু শীঘ্রই তাদের হরিষে বিষাদ শুরু হল। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের নতুন আবহাওয়া তাদের গায়ে সইল না। তার উপর ডালিমের রসের মতো দেখতে নালার স্বচ্ছ পানি খেয়ে দেখা দিল জ্বর, স্থানীয় ভাষায় এটাকে বলে কালাজ্বর। এই ভয়ংকর জ্বর কাঁপুনি দিয়ে উঠে সাথে সাথে রোগীকে কাবু করে ফেলে। ভুকম্পের মত শরীর কাঁপতে থাকে, চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠে, শরীর আগুনের মত গরম হয়ে যায়। আর্মিরা দিন-রাত পাহারা দেয় খোঁজখবর নেয়, তদারকি করে, ঔষধ পত্র দেয়। ঔষধ খেলে ভাল হয় কিন্তু কিছু সময় বাদে আবার জ্বর। এভাবে প্রত্যেক ঘরে হাসপাতালের মত দু'একজন সব সময় বিছানায় পড়ে থাকে। কেউ ঔষধ খেলে কিছুটা ভালো হয় আর কারো কারো লাগাতার জ্বর চলতেই থাকে। এই ভয়ঙ্কর জ্বরে বৃদ্ধ ও শিশুসহ বেশ কয়েকজন লোক মারা যায়। উদ্বাস্তু পরিবারগুলি মৃত্যু আতঙ্কে নির্জীব হয়ে পড়ে।
তার উপর আছে বন্য প্রাণীর উপদ্রব। সন্ধ্যার পর বন্যপ্রাণীর ভয়ে বাঙালি পরিবারগুলি বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। তখন ঘরের চারপাশে বন্য শুকর ঘুতঘুত করে ঘুরে বেড়ায়। তারপর রাত যত গভীর হয় চিতার ডাক তত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। চিতা ভল্লুক শুকর ও অন্যান্য বন্য প্রাণী খাদ্যের আশায় বাড়ি ঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে কলজে ফাটানো গর্জন ছাড়ে। বাঙালি পরিবারগুলি কাথার নিচে মাথা গুঁজে দম বন্ধ করে পড়ে থাকে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন বা যে কোন প্রয়োজনেও তারা রাতে বাইরে বের হতে সাহস পায় না। দিনের বেলা দেখা যায় আরেক উপদ্রব, আরশোলার মত দেখতে সবুজ আর লাল বর্ণ টিকটিকি গুলি গাছে থাকে। বাঙালিরা মনে করে এগুলি পাতার আড়ালে লুকিয়ে থেকে মানুষের দিকে তাকিয়ে জিহবা নাড়াতে থাকে আর দূর থেকেই মানুষের রক্ত চুষে নিয়ে লাল হতে থাকে। এভাবে দু-একদিন রক্ত চুষে নিলে মানুষ মারা যায়।
বাঙালি পরিবারগুলি এমন প্রতিকূল পরিবেশে এসে নিরাশ হয়ে যায়, করাল মৃত্যু আতঙ্কে সর্বদা তটস্থ থাকে। পরস্পর আলোচনা করে দেশে ফিরে যাবে কিনা, কিন্তু কোথায় যাবে? সেখানে তাদের বাড়িঘর গুলিও ধসে গেছে। যমুনার বন্ধ্যা বালুচরে কোন ফসল উৎপাদন হয় না। শুষ্ক মৌসুমে দিগন্ত বিস্তৃত ধূ ধূ বালুকাময় প্রান্তর আর বর্ষায় থৈ থৈ পানি- এই হলো চরের জীবনচক্র। কাজ কর্ম করে খাওয়ারও কোন সুযোগ নাই। কিন্তু এখানে তো পেটের চিন্তা করতে হচ্ছে না। সরকার রেশন দিচ্ছে ওষধ দিচ্ছে জমি দিয়েছে ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ কৃষি সরঞ্জামাদি সব দিচ্ছে। তাছাড়া এখানে কাজকর্ম করে চলার মত অনেক সুযোগ আছে। এখানে থাকলে পেটের চিন্তা নাই কিন্তু দেশে গেলে পেটের আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরতে হবে। আর পেটের আগুনে মরার চেয়ে প্রকৃতির আগুনে পুড়ে মরা অনেক সহজ। অগত্যা পরিবারগুলো এক মুঠো ভাতের জন্য এখানেই মাটি কামড়ে পড়ে রইল।
আসিয়া তার বাপের মাথায় পানি দিতে দিতে বলল ‘আব্বা লও দ্যাশে যাই গা, এখানে থাকলে আমরা সবাই মইর্যা যামু। আমোদ আলীর শরীর আগুনের মত গরম, বাঁশ দিয়ে নির্মিত মাচার উপর তারা থাকে। জ্বরের প্রকোপে মাচাসহ শরীর কাঁপছে। সে একটা কুকানি দিয়ে বলল ‘দেশে গিয়ে খাবি কি? আসিয়া আর কোন কথা বলল না, দেশে ভাতের কষ্টের কথা মনে হতেই সে চুপ মেরে গেল। কত কষ্ট করেছে, জীবনে কোনদিন পেট ভরে দু’বেলা খেতে পারেনি। কখনো একটু জাও বা আধখান রুটি বা এক লোকমা ভাত খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। অনেক সময় একটু ভাতের ফ্যান লবণ দিয়ে গিলে সারাদিন থাকতে হয়েছে।
ছোট সময় একবার সারা দিন না খেয়ে কান্নাকাটি শুরু করল, তখন তার বাপ কয়েক বাড়ি ঘুরে এক বাড়ি থেকে ভাত খাইয়ে এনেছিল। সে সব কষ্টের কথা মনে হলে তার গা শিউরে ওঠে। এখানে তো ভালোই আছে, অন্তত ভাতের অভাব নাই। তার দুই ভাই একটা বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে, বাপও কখনো বাঙ্গালীদের কখনো চাকমাদের কাজ করে, এতে ভালোই আয় হয়।
সে হলো বাপ ও ভাইদের চোখের মনি। ভাইয়েরা কখনো খালি হাতে আসে না, খাবার জিনিস বা কাপড় চোপড় একটা না একটা কিছু নিয়ে আসে। এক মাত্র ছোট বোনকে তারা প্রাণাধিক ভালোবাসে। বাপও তাকে এটা ওটা কিনে এনে দেয়, কোন কিছুর দরকার হলে তার মাকে না ডেকে তাকে ডাকে, বাপের কাজ করে দিতে পারলে তারও আনন্দ লাগে। কিন্তু এখানে সমস্যা হল অসুখ-বিসুখ। দুই দিন আগে তার মা ও ভাই জ্বর থেকে উঠল এখন তার বাবা বিছানায় পড়েছে। বিছানা কখনো খালি যায় না, কেউ না কেউ পড়েই থাকে। সুস্থ হয় আবার পড়ে, এটাই এখানকার নিয়ম।
আমোদ আলীর ছেলেরা তিন মাইল দূরের একটা বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সারাদিন কাজ শেষে রাতে বাসায় ফিরে। সবাই আশঙ্কা করে কখন জানি শান্তি বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে যায়। কারন রাতে শান্ত শান্তিবাহিনীর সামনে পড়া মানে বাঘের মুখে পড়া। এভাবে তারা অনেক বাঙালিকে হত্যা করেছে। এই তো কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহের তিনজন লোককে গুম করে ফেলেছে। আসিয়া ভাইদেরকে তাকাদা দেয় ‘বিস্কুট কোম্পানির কাজ ছেড়ে দাও, এখানে স্থানীয়দের কাজ করো, করলেও রাত পর্যন্ত কাজ করার দরকার নাই। কিন্তু আমোদ আলী কিছু বলে না, কারণ ছেলেদের উপার্জনে তার যথেষ্ট আয় উন্নতি হচ্ছে, সুখের মুখ দেখছে। কিন্তু ভাগ্যে এই সুখ বেশি সময় সইল না।
একদিন দুই ভাই বাড়িতে ফেরার সময় রাস্তার পাশে এক চাকমা বাড়িতে মানুষের জটলা দেখতে পেল। তারা বুঝতে পারল এখানে শান্তি বাহিনীর লোক এসেছে। পথে রাতের টহলদার আর্মির সাথে তাদের দেখা হল। দুই ভাইয়ের বড়টা একটু বোকা টাইপের, আর্মি সামনে পেয়েছে একটা কিছু বলতে হয় বিধায় সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলল। আর সাথে সাথে আর্মিরা তাদেরকে সাথে নিয়ে অগ্রসর হল। ছেলেরা যেতে চাইলো না কিন্তু বাড়িটা দেখিয়ে দেয়ার জন্য আর্মিরা জোর করে নিয়ে গেল। শান্তি বাহিনীর একজন মহিলা অস্ত্রসহ ধরা পড়ল। আর এখানেই আমোদ আলীর পরিবারের কপাল পুড়ল।
দুইদিন পর তার দুই ছেলে নিখোঁজ হলো। পরদিন পাহাড়ে কাজ করার সময় আমোদ আলীও নিখোঁজ হলো। পরের দিন তিনজনের লাশ পাওয়া গেল দুই মাইল দূরে একটা জঙ্গলের পাশে নালায়। আমোদ আলীর পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল। আসিয়া ও তার মা অর্ধমৃত হয়ে গেছে, রান্না বান্না নাই খাওয়া-দাওয়া নাই শুধু মাটিতে গড়াগড়ি দেয় আর বিলাপ পারে, বুক চাপড়ায়, মাতম করে, মাথার চুল ছিড়ে। যাকে সামনে পায় আছিয়া তার পায়ে পড়ে চিৎকার করে ‘আমার বাপকে এনে দাও, ভাইয়্যাদের এনে দাও। বাঙালিরা অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়াল।
একটি যুবক ছেলেও পরিবারটির সাহায্যে এগিয়ে আসল। ছেলেটিকে সবাই চিনে। সে রেশন অফিসে কাজ করে, চাল ডাল আটা ইত্যাদি মেপে দেয়। সকলের সাথে তার খাতির, বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বিভিন্ন বস্তি ঘুরে বেড়ায়, বাড়ি বাড়ি যায় গল্পগুজব করে। আর্মিদের সাথেও তার সুসম্পর্ক। সে আশপাশ মহল্লা গুলির সুখে-দুখে পাশে থাকে, কেউ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করে। তার মিশুক স্বভাব ও মধুর ব্যবহারের কারণে সবাই তাকে ভালোবাসে।
ছেলেটি থাকে পেছনের ময়মনসিংহের বস্তিতে। আসিয়াদের বাড়ির পাশ দিয়ে সে রেশন অফিসে যাতায়াত করে। প্রতিদিন যাওয়ার সময় 'চাচি কি করেন' বলে ঘরে ঢুকে আছিয়ার মায়ের সাথে আলাপ সালাপ করে। বাজার সওদা কোন কিছু লাগবে কিনা জেনে যায়। তারপর ফেরার সময় প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে যায়। তাছাড়া রেশনের জন্য আসিয়া বা তার মাকে যেতে হয় না ছেলেটাই চাল ডাল মাথায় করে বাড়িতে দিয়ে যায়। শীঘ্রই বুঝা গেল ছেলেটি আসিয়ার প্রেমে পড়েছে, সময়-অসময়ে বাড়িতে এসে বসে থাকে। বসে বসে আসিয়ার মায়ের সাথে আলাপ করলেও তার দৃষ্টি থাকে মেয়েটার দিকে। আসিয়া তখন পূর্ণ যুবতী, গায়ের রঙ শ্যামলা, দাঁত ভাসা। কন্যা হিসেবে খুব আকর্ষণীয় না হলেও তার ঊর্বশী শরীর ছেলেটির মাথা ঘুরিয়ে দেয়।
একদিন আসিয়ার সম্পর্কিত এক চাচা এসে তার মাকে বলল ‘তোরাব আলী তো আছিয়াকে বিয়ে করতে চায়। আসিয়ার মা খুশি হলো, তাদেরকে দেখার কেউ নাই বিয়েটা হলে ভালোই হবে, ছেলেটাও কর্মঠ। আসিয়া বাপ ভাইয়ের কেনা কাপড়- চোপর ও প্রসাধন সামগ্রি সাজ-গোজ করল কিন্তু তাদের স্বরনে চোখের জলে তার কাজল ও মেকাপ ধুয়ে গেল। বিয়ে হয়ে গেল, তাদের সংসার ভালোই চলতে লাগলো।
ধীরে ধীরে আসিয়া ও তার মা তোরাব আলীর আসল চরিত্র জানতে পারল। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুরে। দেশে থাকতে সে শুধু আকাম কুকামই করেছে। মাঠে কোন মেয়ে গরু ছাগল চড়াতে গেলে সে পাট ক্ষেতের দিকে টেনে নিয়ে যেত, জঙ্গলে লাকড়ি কুড়াতে গেলে জাপটে ধরত। মানুষের এটা ওটা নিয়ে বিক্রি করে দিত। একবার চেয়ারম্যানের পুকুর থেকে রাতে মাছ চুরি করে বিক্রি করে দেয়, টের পেয়ে চেয়ারম্যান তাকে গুলি করে মারতে চেয়েছিল। তার কুকর্মে এলাকাবাসী ও তার মা বাপ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। অবশেষে একটা পথ পাওয়া গেল। সেই এলাকার কিছু ছিন্নমূল চাকমা যাচ্ছে, সেই কাফেলায় তোরাব আলীর বড় বোনের পরিবারও আছে। সুযোগ পেয়ে এলাকাবাসী ও তার মা বাপ তোরাব আলীকে জোর করে সেই কাফেলার সাথে পাঠিয়ে দিল।
কিন্তু এখানে এসে কালাজ্বরে তোরাব আলীর ভগ্নিপতি মারা যায়। তখন তার বাপ মেয়েকে নিতে এসে তোরাব আলিকে বলল- দেশে চল এই মরার দেশে আর থাকার দরকার নাই। তখন তোরাব আলী জমিয়ে বসেছে, স্থানীয় মগদের সাথে বসে বসে গলা পর্যন্ত মদ খায় আর মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে। আর্মি এমনকি শান্তি বাহিনীর কিছু নেতার সাথেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাছাড়া সে চোরাই কারবার করে যথেস্ট উপার্জনও করছে। কাজেই সে বাপকে বলল ‘আমি গেলেও পরে যাব আর কিছুদিন থাকি দেখি কি হয়। অগত্যা তার বাপ মেয়ে ও তিন বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেল।
আসিয়া শীঘ্রই স্বামীর আসল চরিত্র দেখতে পেল। সে গভীর রাত পর্যন্ত মগ পল্লীতে আড্ডা দেয়, গলা পর্যন্ত মদ গিলে বাড়িতে আসে। বউকে মারধর করে শাশুড়ির সাথেও দুর্ব্যবহার করে। বিভিন্ন মগ মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক। এর মধ্যে আবার এক মহিলার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। মহিলার স্বামী তোরাব আলীকে সতর্ক করে কিন্তু সে গায়ে মাখে না। একদিন হাতে নাতে ধরা পড়ে। মগটা দায়ের কোপ বসিয়ে দেয় কিন্তু তোরাব আলী ভাগ্যগুনে বেঁচে যায়, এক দৌড়ে পালায়। এরপরেও সে ক্ষান্ত হয় না। অবশেষে বিষয়টা শান্তি বাহিনীর কানে চলে গেল। তোরাব আলীর নাম শান্তিবাহিনীর কালো তালিকায় উঠে গেল।
একদিন রাতে সে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বাড়িতে এসে বউকে বলল ‘এখানে আর থাকা যাবে না দেশে চলে যাব, প্রস্তুতি নাও খুব ভোরে রওনা হতে হবে। শাশুড়িকে বুঝাল- পরিস্থিতি শান্ত হলে কিছুদিন পরে তাকে নিয়ে যাবে। এখন সাথে নিলে দেরি হয়ে যাবে আর দেরি হলে সে জীবন নিয়ে পালাতে পারবে না। তারপর সারারাত মা মেয়ে কাঁদলো আর তল্পিতল্পা গোছাল। সূর্যোদয়ের আগেই তারা রাওয়ানা হয়ে গেল। আসিয়া তার বাপ ভাইয়ের জমানো টাকাগুলি সাথে নিল। বিদায়ের সময় শ্বাশুড়ি বললো ‘সাবধানে যেও আসিয়ার কিন্তু তিন মাস চলছে।
তোরাব আলীদের সাথে একই এলাকার সিরাজের পরিবার এসেছিল। তবে চাকমা এসে কালা জ্বরে তার বড় ছেলে মারা যায়। তখন সে এই মৃত্যু পুরি ছেড়ে চলে যায় কিন্তু দেশে না গিয়ে চট্টগ্রামে এক বস্তিতে উঠে, কাজকর্ম করে চলে। তোরাব আলী আগে একবার গিয়েছে তার বাসায়। এবারও সে সিরাজের বাসায় গিয়ে উঠল। বউকে বলল ‘দেখ এখানে যদি কাজ-কর্ম পাই তাহলে আর দেশে যাবো না এখানেই থেকে যাব। শাশুড়ির কথা বলল ‘আম্মাকেও এখানে নিয়ে আসব। আসিয়া খুশি হয়ে বলল ‘আমিও বাসাবাড়িতে কাজ করব, দু’জনে মিলে কাজ করলে আমাদের সংসার খুব সুন্দর চলবে। তোরাব আলি স্ত্রীর টাকাগুলি হাতে নিয়ে কাজ খুঁজার নামে দুই দিন ঘোরাফেরা করল। তৃতীয় দিন এসে বলল ‘চল ভালো একটা কাজ পেয়েছি, মালিক মহিলা তার বাসাতেই থাকার ব্যবস্থা।
তারা মহিলার বাড়িতে গেল। ফাঁকা জায়গায় একটা দ্বিতল বাসা, ভিতরের একটা রুমে বিশাল ভুরি কিম্ভুতকিমাকার এক মহিলা খাটের উপর বসে পান চিবুচ্ছে। মহিলা এতটাই মোটা যে গালের মাংস ঝুলে পড়েছে এবং থুতনি বুকে লেগে আছে, মুখে নিষ্ঠুরতার চাপ। স্বাভাবিক সংসারী কোন মহিলা বলে মনে হল না। আসিয়ার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। মহিলা কর্কশ গলায় বলল ‘বউকে পাশের রুমে রেখে কাজে যাও। পাশের রুমে গিয়ে আসিয়া বলল ‘আমি এখানে একা থাকতে পারব না আমার ডর লাগছে। তোরাব আলী হাসি দিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল চুম্বন করল এবং শেষ বারের মত মিলিত হল। তারপর বলল ‘আরে পাগলি ডরের কি আছে আমি একটু পরেই আসতেছি’ বলে স্ত্রীকে শান্তনা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
আসিয়ার অস্বস্তি লাগছে জায়গাটা কেমন যেন অস্বাভাবিক, অন্য সব বাসা বাড়ির মতো নয়। আশপাশে নারী পুরুসের ফিসফিসানি শুনা যায়, এখানে যেন কোনো গুপ্ত রহস্য আছে। আসিয়া ভয়ে বাইরে বের হলো না, শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম যখন ভাঙলো তখন পড়ন্ত বিকেল। এখনো তার স্বামী আসছেনা দেখে অস্থির হয়ে উঠেছে। ভয়ে ভয়ে মালিক মহিলাকে গিয়ে বলল ‘আমার স্বামী কোথায় এখনো আসছে না কেন? মহিলা কুৎসিত একটা হাসি দিয়ে বলল ‘এত ব্যস্ত কেন আসবে আসবে সন্ধ্যার পরেই আসবে। আসিয়া বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখল অন্যান্য রুমে আরো মেয়ে আছে, সবাই যুবতী। দুয়েকটা পুরুষ আনাগুনা করছে। তাকে দেখে মেয়েরা এগিয়ে এলো কিন্তু তাদের কথাবার্তা ও চালচলন অশ্লীল। আসিয়ার আত্নাটা ধক করে উঠল। সে ভয় ও ঘৃনায় তার রুমে গিয়ে বসে রইল।
হা আসলো, সন্ধ্যার পর দানবের মত একটা লোককে সাথে নিয়ে মহিলা আসিয়ার রুমে ঢুকে বিশ্রি একটা হাসি দিয়ে বলল ‘এই যে তোর স্বামী এসেছে, এবার স্বামীকে সন্তুষ্ট কর। আসিয়ার মাথায় যেন বজ্রপাত হল। সে চিৎকার করল ‘আমার স্বামী কোথায়? তারপর ঢুকরে কেঁদে উঠে দরজার দিকে দৌড় দিতে চাইল কিন্তু মহিলা খপ করে তার চুলে ধরে বলল ‘মাগির ভরং দেখ, এত স্বামী স্বামী করছস স্বামি তো তোকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। এক লাখ টাকা দিয়ে কিনেছি এখন খদ্দের মাতিয়ে সুদে-আসলে আমার টাকা উসুল করবি’ বলে চুলে ধরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে বিচানায় ফেলল। করে সে বেরিয়ে গেল।তারপর লোকটাকে ইংগিত
লোকটা এগিয়ে গেল আর সাথে সাথে আসিয়া তার পায়ের উপর হুমরি খেয়ে পরে জবাই করা মুরগির মত ধাপড়াতে লাগল 'আপনি আমার ধর্মের ভাই, আমাকে বাঁচান আমার ইজ্জত বাঁচান আমি তিন মাসের গর্ভবতী। স্বামী আমাকে এখানে ফেলে চলে গেছে’ ইত্যাদি বিলাপ করতে করতে সে লোকটার পায়ের উপর মাথা খুটতে লাগল। লোকটা অবাক হলো, স্বামী তার স্ত্রীকে বিশেষত গর্ভবতী স্ত্রীকে বেশ্যালয়ে বিক্রি করে দিয়েছে- এমনটা সে ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি। মেয়েটার আকুল কান্নায় তার মায়া হলো। এভাবে সর্ব রিক্তের মত কোন মেয়েকে সে কাঁদতে দেখেনি। বেশ্যার সর্দারনিকে শোনানোর জন্য সে ধমক দিল 'ভরং বন্ধ কর মাগী। তারপর বসে আসিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো ‘শান্ত হও শান্ত হও, কথা দিলাম তোমাকে আমি উদ্ধার করব। তারপর পরিচয় জানতে চাইল, আসিয়া তার দুঃখের কাহিনী শোনাল। লোকটা বলল ‘সর্বোচ্চ এক ঘন্টার মধ্যে আমি ফিরে আসব, এই একঘন্টা তুমি নিজেকে রক্ষা করবে। কাউকে আসতে দিবে না দরজা বন্ধ করে বসে থাক’ বলে লোকটা চলে গেল।
সে একজন আর্মি অফিসার। নতুন মাল আসলে সরদারনি তাকে খবর দেয়, তাতে সে মোটা ফী পায়। আধ ঘন্টার মধ্যে অফিসার ফিরে এলো, হুড়মুড় করে বাড়িতে পুলিশ ঢুকে পড়ল। অবস্থা বেগতিক দেখে সরদারনি পালিয়ে গেল। পুলিশ আসিয়াসহ আটটি মেয়েকে উদ্ধার করল। আসিয়াকে অফিসারের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে বাকিদের থানায় নিয়ে গেল। তারপর কাউকে নিজের জিম্মায় কাউকে আত্নীয় স্বজনের জিম্মায় ছেড়ে দিল। অফিসার আছিয়াকে একটা বস্তিতে নিয়ে গিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলাকে বলল ‘মেয়েটা আজ রাতে আপনার সাথে থাকবে। বৃদ্ধার স্বামীকে বলল ‘কাল আপনাকে বান্দরবন যেতে হবে, রেডি হয়ে থাকবেন সকালে আমি আসব।
অফিসার পরদিন সকালে এসে বৃদ্ধকে প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে মেয়েটাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিল। আসিয়া তার পায়ে পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অফিসার তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিল ‘যাও বোন তোমার মায়ের কাছে যাও, আল্লাহ তোমার ভাল করবেন। তারপর হাতে কিছু টাকা দিয়ে আশীর্বাদ করে বিদায় করল। এভাবে একজন চরিত্রহীন আর্মি অফিসারের দয়ায় আসিয়া তার মায়ের বুকে ফিরে এল। ছয় মাস পর তার কোল জুড়ে এলো এক পুত্র সন্তান, তার নাম রাখা হলো রজব আলী, তবে সবাই রঞ্জু বলে ডাকে। এই ছেলেটিই হয়ে উঠল আসিয়ার অন্ধের ষষ্টি, বেছে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
৩
রঞ্জুর চোখ দুটি চিতার চোখের মতো জ্বলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘কিন্তু এসব ঘটনা তুমি জানলে কি করে? সে বলল ‘আমার কিছুটা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মা ও নানিকে জিজ্ঞেস করতাম ‘আমার বাবা কোথায়? তারা বলত ‘মরে গেছে। কিন্তু বস্তির লোকেরা বলত ‘তোমার বাবা তোমার মাকে ফেলে চলে গেছে। ময়মনসিংহ বস্তির অনেকেই দেশে বেড়াতে যেত, আমাকে বলত ‘চল তোমার বাপকে দেখে আসবে’ বলে নিয়ে যেতে চাইতো কিন্তু আমি যেতাম না। তারা গিয়ে বাবার সাথে আমার কথা আলাপ করত। তখন নাকি ঐ লোকটা বলত ‘আমার কোনো ছেলে নাই, ওই মহিলা নষ্টা ওটা অন্য কারো ছেলে। তারা এসে আমার সাথে এসব আলাপ করত, আমি খুব কষ্ট পেতাম। দিন দিন বিষয়টা গা সওয়া হয়ে গেল।
কয়েক মাস আগে আমার নানী মারা যায়। রোগশয্যায় একদিন তিনি মায়ের আড়ালে আমাকে বললেন ‘তোকে একটা গোপন কথা বলব যা আমি আর তোর মা ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ জানে না। তোর বাপ তোর মাকে বেশ্যালয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল, একজন দয়াবান মানুষ তাকে উদ্ধার করে আমার কাছে দিয়ে যায়। তিনি ওই লোকটার নোংরা জীবনের ইতিহাস বর্ণনা করে বললেন ‘যদি পারিস এই কুত্তার বাচ্চার বিচার করিস'। কয়েকদিন পর নানী মারা গেলেন।
তখন থেকে আমি কেমন জানি হয়ে গেলাম। বুকের উপর যেন একটা পাথর চেপে বসেছে, খাওয়া গোসল অনিয়মিত হয়ে পড়ল, চোখের পাতায় ঘুম আসে না। সারাক্ষণ মনে হয় এটা কি করে সম্ভব, একজন লোক তার গর্ভবতী স্ত্রীকে বেশ্যালয়ে কিভাবে বিক্রি করে দিতে পারে। যে মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন কাটিয়েছে, আমাকে অবলম্বন করে বেঁচে আছে- সেই মহীয়সী মায়ের দিকে আমি তাকাতে পারতাম না। মনে হত এই মহিলাটা বেশ্যালয় থেকে ফিরে এসেছে। লক্ষ কোটি বিচ্ছু যেন আমার কলজেটা কামড়ে ছিড়ে ফেলত, বুকটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেত। ক্রোধ ঘৃণা আর জিঘাংসায় আমার শরীরটা বোমার মত ফেটে পড়ত। ভেতরের সিংহটা গর্জে উঠল ‘যে শুয়োরের বাচ্চা নিজের স্ত্রীকে বিক্রি করে দেয় এই পৃথিবীর আলো বাতাসে তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নাই। আমি যদি আমার মায়ের এক ফোটা দুধও পান করে থাকি তাহলে এর শোধ আমি তুলবই।
আমার সার্বক্ষণিক বিষন্ন অবস্থা দেখে মা জিজ্ঞেস করতেন ‘কিরে তোর কি হয়েছে? আমি বলতাম নানীর জন্য মনটা পুরায়। আমার সরল প্রান মা তাই বিশ্বাস করতেন। আমি উপায় খুঁজতে লাগলাম- এর মধ্যে সুযোগ এসে গেল। পশ্চিম মহল্লায় নেত্রকোনা অঞ্চলের লোক আছে, সেখানে আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে সেও আমার সাথে মাহুতের কাজ করে। তাদের বাড়ি ছিল মদনপুর এলাকায়। সেখানে শাহ সুলতান রুমীর মাজারে প্রতিবছর মাঘ মাসে ওরস হয়, বিশাল লোক সমাগম হয়। সেই ওরসে আমার বন্ধু ও এখানকার কিছু কিছু লোক যায়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বন্ধু আমাকে দাওয়াত দিল আর আমি সুযোগটা লুফে নিলাম। তাদের বাড়িতে গিয়ে এলাকাটা ঘুরে ফিরে দেখার নামে আমি ওই লোকটার খুঁজে বেরিয়ে পড়তাম।
যাই হোক আপনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমি কোনরূপ লুকোচুরি না করে আমার ঘটনা বললাম। এক কুৎসিত অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে আমি আল্লাহর দরবারে কোন অপরাধ করিনি। এখন আপনি আপনার ওয়াদা রাখুন। ঈশান বলল ‘তোমাকে ওই এলাকায় তিন দিন দেখা গেছে, কারন কি? রঞ্জু বলল ‘প্রথম দিন লোকটার ঠিকানা খুঁজে বের করেছি। দ্বিতীয় দিন হত্যার কোন সুযোগ পায়নি, তৃতীয় দিন রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে কাজ শেষ করে ফিরেছি। যাই হোক এখন আমার ব্যাপারে আপনার রায় শুনান। ঈশান বলল 'এই হত্যাকাণ্ডের জন্য যদি একজন নিরাপরাধ মানুষ জেলে পঁচে না মরত তাহলে আমি মুখে তালা দিতাম। কিন্তু ওই নিরাপরাধ লোকটাকে বাঁচাতে হবে। তিন দিন আমি কথা বলব না, এই তিন দিনে তুমি নিজেকে যতদূর আড়াল করতে পারো করে নাও। সে ইঙ্গিত দিয়ে বলল ‘বঙ্গোপসাগর তো খোলাই আছে, যাও আরো অনেক দেশ আছে। তারপর সে ‘চলো জিসান' বলে হাঁটা শুরু করল।
আমি বললাম 'তুমি এগুতে থাক আমি আসছি। তারপর ছেলেটাকে বললাম ' দেখ, তোমার প্রতি আমার ও ইশানের পুর্ন সহমর্মিতা আছে। কিন্তু সে আইনের লোক না হলেও আইন নিয়েই তার কাজ কারবার। তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু সুযোগ তোমাকে দিয়েছে, এখন তুমি কি করবে? খুশিতে ছেলেটার মুখ চকচক করছে। সে বলল ‘তিনদিন না একদিনের সুযোগই আমার জন্য যথেষ্ট। আরাকান, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ায় আমার অনেক বন্ধু থাকে। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাদের কারো কাছে চলে যাব। তারপর প্রয়োজন হলে চীন জাপান বা অন্য কোন দেশে চলে যাব। মা ছাড়া তো আমার আর কোন পিছুটান নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘তোমার মায়ের কি হবে? রঞ্জু বলল ‘মায়ের জন্য চিন্তা নাই মাস মাস টাকা পাঠাব। তারপর সময় ও সুযোগ মত আমার কাছে নিয়ে যাব। আমি আশ্বস্ত হয়ে আরো কিছু পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিলাম।
রাত্রে ইশানকে বললাম ‘তোমার মিশন তো শেষ হলো এবার রহস্য উম্মোচন করো। সে হেসে বলল ‘রহস্য কিছুই না, আমার সন্দেহটা জয়নাল ও জালালের ওপর ঘুরপাক খাচ্ছিল। যথার্থ অনুসন্ধানের পর বুঝতে পারলাম আসলে জয়নাল সেইদিন রাতে ফুলপুরে চোরাই মাছ বেচতে গিয়েছিল। বাকি থাকল জালাল, সে জামাইয়ের বাসা থেকে ফিরে এলে তার পিছু নিলাম। কিন্তু তার মুখ দেখেই বুঝা গেল এ লোক অপরাধী নয়। লোকটা জুয়া খেলে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গোপনে মেয়ের কাছ থেকে টাকা আনে। এজন্যই সে বাড়িতে না জানিয়ে গোপনে মেয়ের কাছে টাকা আনতে গিয়েছিল। সন্দেহভাজনদের সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার পর আর কোন সূত্র রইল না। তখনই হঠাৎ অঙ্কুশটি উদ্ধার হল, বুঝতে পারলাম এটাই হত্যার আসল অস্ত্র। কিন্তু সন্দেহ হল এই এলাকায় হাতি নাই মাহুত নাই তাহলে এই অস্ত্র এল কোত্থেকে?
আবার অনুসন্ধান শুরু করলাম। অবশেষে জানতে পারলাম ছাতিয়ানতলা তালুকদার বাড়িতে হাতি আছে। ছুটে গেলাম সেখানে কিন্তু নিরাশ হলাম। কারন তালুকদারের মাহুত অতিশয় বৃদ্ধ, কাউকে খুন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে কিছুক্ষণ জেরা করার পর বুঝতে পারলাম সে তোরাব আলিদের এলাকাতেই কোনদিন যায়নি। তখন অঙ্কুশটা বের করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এটা কোত্থেকে এলো? সে কিছুক্ষণ ভালো করে পরখ করে বলল ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই জাতীয় অঙ্কুশ বানায়, আমাদের অঙ্কুশ অন্যরকম’ বলে তার অঙ্কুশটা বের করে দেখালো, দুইটা দুই রকম।
তখন আমার মাথায় অন্য চিন্তা ঢুকল। আগেই শুনেছিলাম তোরাব আলি একবার চাকমা গিয়েছিল। তারপর খোজাখুজি করে একটা পরিবার বের করলাম- যারা তোরাব আলির পড়ে চাকমা ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিল। এই পরিবারের একজন বৃদ্ধ বলল ‘তোরাব আলী লোক ভাল ছিল না। সে চাকমায় বিয়ে করেছিল। দেশে আসার সময় বউ নিয়ে রওয়ানা হয় কিন্তু রাস্তায় ফেলে চলে আসে। মেয়েটা ফিরে গিয়ে তার মায়ের কাছে আশ্রয় নেয়। কিছুদিন পর তার একটা ছেলে হয়। ব্যস এই তথ্য পাওয়ার পর কেসটা আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। পরবর্তী ঘটনা তো তোমার জানাই। এখন ঘুমাও, খুব ভোরে রওনা হতে হবে। পরদিন সকালে আমরা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
বিষয়: সাহিত্য
১০৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন