চিরকুমার সংঘ- ৪

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৩ নভেম্বর, ২০১৮, ০৫:০৯:২৫ বিকাল

চতুর্থ অধ্যায়



শিকারি বরশিতে টোপ গেথে পানিতে ফেলে রাখে। তখন বোকা মাছেরা গপ করে গিলে ফেলে কিন্তু চতুর মাছগুলি দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে চলে যায়, টোপ গিলে না। আবার কখনো কোন মাছই বরশি খায় না। ঠিক একই অবস্থা হয়েছে জাকির হোসেনের। সে আশায় বুক বেঁধে চিরকুমার সমিতির নিচ তলায় বাসা ভাড়া নিয়েছিল এই লোভে যে, পাত্রকেন্দ্র সমিতির ছেলেরা তার সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়েদের দেখে আকৃষ্ট হবে, অতি সহজেই বিয়ে হয়ে যাবে। কোন রকম একটি মেয়ের বিয়ে হলেই কেল্লাফতেহ। কারণ তখন লাইন ঘাট ক্লেয়ার হয়ে যাবে, সমিতির ছেলেরা একের-পর-এক বিয়ের জন্য লাইন দেবে। এভাবে বিনা চেষ্টায় বিনা ঘটকালিতে তার দশটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। এই কল্পনা বিলাস নিয়ে সে এতদিন ঘুমিয়ে ছিল। ছয় মাস হয়ে গেল এখানে এসেছে কিন্তু কোন মেয়ের বিয়ে তো দূরের কথা একটা ছেলেও আজ পর্যন্ত তার বারান্দা মারায়নি। এমনকি বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে একটা সালাম পর্যন্ত দেয়নি অথচ সে চেষ্টার কোন ত্রুটি করছেনা।

বিকালে সমিতির ছেলেরা অফিসে যায় তখন সে বড় মেয়েদের নিয়ে বারান্দায় বসে চা খায়, পত্রিকা পড়ে গল্পগুজব করে আসল উদ্দেশ্য হলো প্রদর্শনী করা। কিন্তু সমিতির ছেলেরা বারান্দার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বাঁকা দৃষ্টিতে এক নজর দেখেই চলে যায়, টোপ খাওয়ার মত কোন লক্ষণ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। এবার তার ঘুম ভাঙল। এতদিন হয়ে গেল একটা মাছও খেল না তেমন আলামতও দেখা যাচ্ছে না। আবার অন্যত্র বিয়ের কোন আলাপও নাই, সে চোখে অন্ধকার দেখল। জাকির একেবারে ভেঙ্গে পড়লো, তার রাতের ঘুম হারাম হল। তাহলে কি তার মেয়েদের বিয়ে হবে না, এভাবেই একে একে তার দশটি মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে?

মানুষ তাকে ও তার মেয়েদেরকে ঘৃণা করবে, উপহাসের পাত্রে পরিণত করবে, তারা সমাজচ্যুত হয়ে অভিশপ্ত জীবন যাপন করবে? এই মেয়েগুলিকে সে পৃথিবীতে আনল অথচ তাদের মৌলিক চাহিদা নর-নারী জন্মের উদ্দেশ্যেটাই পূরণ করতে পারছে না। সে অভিশপ্ত, মেয়েগুলিকে জন্ম দিয়ে সে মহাপাপ করেছে। আবার সে আত্মহত্যা ব্যতিত দ্বিতীয় কোনো উপায় দেখছে না। অবশেষে একদিন সে শেষ চেষ্টা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিল। তার বাসাটা রোডের পশ্চিম পাশে, বাসার সামনে করিডোর, উত্তর পাশে সমিতির অফিসে যাওয়ার সিঁড়ি, সামনে উঠানের মত একটু ফাঁকা জায়গা। এবার সে সর্বশেষ পদক্ষেপ নিল, একেবারে পালের গোদাটাকে টার্গেট নিয়ে কাজে নামল। আর মনে মনে বলল ‘আল্লাহ তুমি আমাকে বাঁচাও, আমার অনাথ মেয়েগুলিকে দয়া কর।

বিকালে চিরকুমাররা সমিতিতে আসছে, জাকির হোসেন গেইটের পাশের দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। হুমায়ূন আহমেদ যখনি গেইটের কাছাকাছি এলো তখনই সে অগ্রসর হলো আর গেইটের মুখেই দুজন মুখোমুখি হয়ে গেল। হুমায়ুন সালাম দিল, জাকির যদিও তার নাড়ি-নক্ষত্রসহ সবকিছু জানে ও চিনে তবুও জিজ্ঞেস করল ‘তোমাকে তো চিনলাম না বাবা। হুমায়ুন বাপের পরিচয় দিয়ে বলল ‘আমি এই সমিতির সভাপতি। জাকির হোসেন কৃত্রিম হাসি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ‘আরে তুমি আমজাদ ভাইয়ের ছেলে, সে তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আমি আগে ফুটবল খেলতাম তো, সে আমার খুব ভক্ত ছিল। বন্ধুর ছেলে হয়েও তুমি পরিচয় দাও না, এসো এসো’ বলে তার হাত ধরে টেনে একরকম জোর করেই বারান্দায় নিয়ে গেল। আসলে হুমায়ূনের বাবার সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল না, জাস্ট পরিচয় ছিল।

জাকির হোসেন জানে হুমায়ূনের বাবা মারা গেছে, তাই তার মা ও সংসারের খোঁজখবর নেয়া শুরু করল। হুমায়ুনকে আসতে দেখে মেয়েরা আগেই চলে গিয়েছিল। জাকির ডেকে বলল ‘জাকিরা মা আমাদেরকে কফি দিয়ে যা। কিছুক্ষণ পর সে কফি ও বিস্কুট নিয়ে হাজির হলো, জাকির পরিচয় দিয়ে বলল ‘আমার বড় মেয়ে, রসায়নে মাষ্টার্স করেছে। হুমায়ুন বলল, ‘তাই নাকি, আমিও তো রসায়নে মাষ্টার্স দুজনের দেখছি একই সাবজেক্ট। তারপর নিজের ওয়েট বাড়ানোর জন্য জাকিরার দিকে ফিরে বলল, আমি ঢাকা ভাসিটি থেকে আপনি কোত্থেকে? জাকিরা বলল, আনন্দ মোহন থেকে। এরপর দু'জনের মধ্যে আলাপ জমে গেল। জাকির হুসেনের ঠোটের কোনায় একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। সে কফি খাওয়া শেষ করে বলল ‘তোমরা আলাপ কর আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসি।

বাবার উদ্দেশ্য জাকিরার অজানা জানা ছিল না, তাই বাবার সামনে অবগুন্টিত মাথা থেকে ওড়না নামাল, বুকের কাপড় ঢিলেঢালা করে দিল। তারপর ভূবন ভোলানো একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আপনারা তো খুব মজার একটা সমিতি করেছেন। উর্বশী যুবতীর সেই হাঁসি এটমের মতো পুরুষ হৃদয়কে বিধ্বস্ত করে দেয়। অমাবস্যা রজনীতে সহসা বিদ্যুতে ঝলকে পথিকের চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার ন্যায় নারী সম্পর্কে হুমায়ূনের অন্ধ হৃদয় ধাধিয়ে গেল। সে মুচকি হেসে বলল ‘এটা আমি প্রতিষ্ঠা করিনি। এরপর দু'জনের মধ্যে সমিতি ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ জমে উঠল।

ছাব্বিশ বছরের ঊর্বশী যৌবনা যুবতী আর বত্রিশ বছরের টগবগে যুবক। উভয়েই বুভুক্ষু যৌবনের চূড়ান্ত সীমায় অবস্থান করছে, কামনার চরমে পৌঁছে গেছে। শ্রাবনের নদীর মত ভরভর যৌবন, কচু পাতায় শিশির বিন্দুর ন্যায় টলটলায়মান যৌবন বিপদজনক পয়েন্টে অবস্থান করছে। জাকিরা অবিরাম হাসছে আর কথা বলছে। বরফ শুভ্র দন্তের প্রতিটা হাঁসিতে মুঠি মুঠি মুক্তা ঝরে পড়ে। সেই কলহাস্যের লহরি গর্জনশীল মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ মালার মতো হুমায়ুনের বুকের উপর আছড়ে পড়ে, হৃদয় সরোবরে মুহুর্মুহু টর্নেডোর আঘাত হানে। পুর্ন যৌবনা যুবতীর কটাক্ষ- ক্ষেপণাস্ত্র তনুদেহ তোলপাড় করে দিচ্ছে। প্রতিটা লোমকুপের গোড়ায় শিহরণ জাগিয়ে তুলছে, বক্ষ পাঁজরার পাচিল ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। হৃদয় মুকুরে তার চিরকুমারত্ব ও আজন্মের চিন্তার বিন্যাসগুলি কি ভয়ংকর কালবৈশাখী দুমড়ে-মুচড়ে লন্ডভন্ড করে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে কোন সুদূরের দেশে, কোন অজানা রাজ্যে- যেখানে চরম ঘনান্ধকারে চলছে চরম ঘূর্ণাবর্ত আর ভাঙ্গা গড়ার খেলা। হুমায়ুনের বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে, সে কথা বলছে, আড়চোখে মেয়েটাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছে আর ধীরে ধীরে নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠছে। তাদেরকে আলাপের সুযোগ দিয়ে জাকির হোসেন অনেকক্ষণ পর আসলো। আরও কিছুক্ষণ আলাপের পর হুমায়ূন মাতালের মত টলতে টলতে বিদায় নিল।

হুমায়ুন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। বহু বছর ধরে যে পথিক আঁধার পৃথিবীতে হাঁটছে- সহসা বিদ্যুৎ ঝলক যেমন তার চোখ ধাধিয়ে দেয় অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে কিছুই দেখতে পায় না হুমায়ূনের অবস্থাও ঠিক তাই হয়েছে। জাকিরার শিলা শুভ্র দাঁতের মুক্তা ঝড়ানো হাসি আর রুপের ঝলক তার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। এখন আর সে পৃথিবীর কিছুই দেখতে পায় না, সেই হাসি তার চোখে নাচতে থাকে, সেই রূপের আগুনে সে অহর্নিশ দগ্ধ হতে থাকে। তার মনে হয় এই পৃথিবী আর যা কিছু আছে এর বাহ্যে ও উহ্যে সবই মিথ্যা একমাত্র সত্য হলো সেই হাঁসি আর রূপের আগুন। আবার কোন ব্যক্তি সহসা কঠিন আঘাত পেলে বা শরবিদ্ধ হলে যেমন বাহ্যিক অনুভূতি হারিয়ে চোখে শুধু সরষে ফূল দেখতে থাকে হুমায়ূনের অবস্থাও তাই। জাকিরার কটাক্ষে শরবিদ্ধ হয়ে সে শুধু সরষে ফুল দেখতে লাগল। পৃথিবীর রুপ রস গুন সৌন্দর্য সবই তার সামনে ম্লান হয়ে গেল।

তেতুল, তেতুল সমাচার, আল্লামা হুজুরের তেতুল তত্ত্ব। জনৈক আল্লামা হুজুর বলেছিলেন নারীরা হলো তেতুলের মত, তেতুল দেখলে যেভাবে জিবে লালা ঝড়ে নারী দেখলেও পুরুষের হৃদয়ে লালা ঝরে- এই নিয়ে দেশে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত নারী তেতুল হতে যাবে কোন দুঃখে বরং তার চেয়েও ঊর্ধ্বে আরো কিছু। কারণ তেতুল হলো মানব উৎপাদিত বৃক্ষের ফল আর নারী হলো স্রষ্টার উৎপাদিত ঐশ্বরিক তেতুল। স্রষ্টা এই পৃথিবীকে আবাদ করার জন্য নর-নারী সৃষ্টি করলেন। পৃথিবীর মাঠ ঘাট চষে, পাহাড় কেটে সাগর ভরে সমতল করে আবাদ করার জন্য পুরুষকে তেজি সুঠাম ও শক্তিশালী করে তৈরি করলেন। পক্ষান্তরে নারিকে করলেন দুর্বল, তার কাজ শুধু ঘরে বসে থাকবে আর সন্তান উৎপাদন করে পৃথিবী ভরিয়ে তুলবে। তবে এ কাজের জন্য নারীকে পুরুষের বাহুবন্ধনে আসতে হবে, সমকক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে, পুরুষের প্রবল পরাক্রমের সামনে টিকে থাকতে হবে কিন্তু এত শক্তি সামর্থ নারীর নেই। কাজেই নারীকে পুরুষের যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য, পুরুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও আনুগত্য পাবার জন্য স্রষ্টা নারীকে সৃষ্টির অর্ধেক সৌন্দর্য দান করে তাকে করে তুললেন মোহনীয় লোভনীয় কমনীয় স্বর্গিয় তেতুল।

পুনশ্চ ইশক- মুহব্বত, প্রেম-ভালবাসা নামক একটা বায়বীয় পদার্থ সৃষ্টি করে স্রষ্টা তা পুরুষ হৃদয়ে সিঞ্জন করে দিলেন। এখন নারীকে দেখলেই পুরুষ হৃদয়ে সেই ইশকের ঝড় উঠে, তাকে বাহুবন্ধনে পাওয়ার জন্য পুরুষ লালায়িত হয়ে উঠে, সাধনা করে, স্বপ্ন দেখে, প্রাণপণ চেষ্টা করে, চরম প্রচেষ্টা চালায়, নারীর জন্য জীবনপাত করে, মারে মরে, আত্মহত্যা করে, যুদ্ধ করে দেশের পর দেশ উজার করে দেয়, জাতির পর জাতি ধ্বংস করে দেয়, নিজের রক্ত মাংস বাতাসে উড়ায়। নারী এমনই স্বর্গীয় তেতুল যে এক হেলেনের জন্য প্রাচীন ট্রয় (তুরস্ক) নগরী ধ্বংস হয়েছিল, এক ফ্লোরিন্ডার জন্য ফ্রেডারিকের স্পেন সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়েছিল, এক বালিকার জন্য দাহিরের হিন্দু সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়েছিল, এক রানী ক্লিউপেট্রার জন্য এন্টোনিউ জীবন ও সাম্রাজ্য উভয়ই বিসর্জন দিয়েছিল। নারী এমনই তেঁতুল যার স্মৃতিকে অমর করার জন্য পুরুষ নির্মাণ করল তাজমহল, ঝুলন্ত উদ্যান। নারী হলো স্রষ্টার তেতুল- এজন্যই নারীর উপর দৃষ্টিপাত করলে পুরুষ হৃদয়ে ভালোবাসার ঝড় উঠে, টর্নেডো সাইক্লোনের তাণ্ডব শুরু হয়- সেই ঘুর্নাবর্তে পড়ে পৃথিবীর কত রাজা-মহারাজা, অলি- আউলিয়া, পীর গাউস-কুতুব, কত যোদ্ধা, কত বীর পাহলোয়ান হারিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই।



কাজেই স্রষ্টার এই তেঁতুলকে পাওয়ার জন্য যেখানে সবাই আত্মাহুতি দেয় সেখানে হুমায়ুন তো হলো এক পুঁচকে ছোকরা আর নগণ্য বালক মাত্র। সে জীবনের খেই হারিয়ে ফেলল, মাতালের মতো উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়, ব্রহ্মপুত্রের তীরে বা নির্জন বৃক্ষ বাগানে বা শূণ্যমাঠে গিয়ে গৌতম বুদ্ধের মতো কি জানি তপস্যা করে, দুদিন ধরে সমিতির অফিসেও যায় না। কারণ যেখানে বাধা সেখানেই ডিঙ্গানোর প্রবণতা, যেখানে অন্তরায় সেখানেই প্রতিরোধের আকাঙ্কা। কাজেই যেখানে শপৎ সেখানেই ভঙ্গ করার দুরন্ত কামনা- এটাই মানুষের প্রকৃতি ও সৃষ্টিগত স্বভাব। হুমায়ুনের সামনে বিপরিত মুখি দুটি চ্যালেঞ্জ, একদিকে চিরকুমারত্বের শপৎ অন্যদিকে খোদার সৃষ্টি রহস্যের শৃঙ্খল বিপরিত লিঙ্গের সাথে চিরবন্ধনের দুরন্ত দুর্বার আকর্ষণ। লক্ষ-কোটি পাওয়ার ম্যাগনেটিকের মত জাকিরার সুতীব্র আকর্ষণে সে একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তার ভেতরটা ভেঙে চোরে রিশেপ হচ্ছে। কিন্তু চিন্তার জগতে দেখা দিল দ্বন্দ্ব। কারণ সেই সমিতির প্রধান, একমাত্র ভরসা, সিরাজ হায়দার তার ওপরই সব কিছু ছেড়ে দিয়ে ওসিয়ত করে গেছে। এখন তারই পদস্খলন ঘটলে বাকিদের কি হবে, সমিতি কোথায় যাবে?

হুমায়ূনকে বাসায় আনতে পেরে জাকির হোসেন তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল, তার ভরসা নিশ্চয়ই আল্লাহ এ তারিখে একটা গতি করবেন। কিন্তু হুমায়ূন আর আসছে না দেখে আবার তার ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে ঊর্ধ্বে তাকিয়ে করুণ সুরে আর্তনাদ করল, ‘দিয়ে ধন বুঝায় মন কেড়ে নিতে কতক্ষণ’ প্রভু ধনটা দিয়েও কি আবার কেড়ে নিলে? হুমায়ূন তিনদিন ধরে অফিসে আসে না। চতুর্থ দিন সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে রওয়ানা হলো যে, জাকিরার দিকে ফিরেও তাকাবে না, তাদের ঘরেও যাবে না, চোখ বন্ধ করে সোজা সমিতি ঘরে চলে যাবে। যদিও তার মনে ভাঙ্গনের সুরটাই প্রবল হয়ে বাজছে।

মেয়েকে শিকার ধরার সুবিধা দেয়ার জন্য জাকির হোসেন এখন আর বারান্দায় বসে না, মেয়েরা বসে আছে। বারান্দার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হুমায়ুন অনিচ্ছাবশত একবার তাকাল। সাথে সাথে জাকিরা বিদ্যুৎ ঝলকের মত কলজে বিদীর্ণ করা একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল ‘কি ব্যাপার সভাপতি সাহেব, কেমন আছেন? এ হাসিতে তার আত্মরক্ষার অবশিষ্ট প্রাচীরখানি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেল। সেও একটা মোলায়েম হাসি দিয়ে বলল ‘ভাল, আপনারা কেমন আছেন’ বলে থমকে দাঁড়াল। জাকিরা বলল ‘হ্যাঁ ভাল, আসেন আলাপ করি। হুমায়ূন বুঝতে পারলো আসলে তার অবচেতন মন সমিতির উদ্দেশ্যে নয় এ আহ্বানটা শুনার জন্যই এসেছে। সে কৃতজ্ঞ কুকুরের মত লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে গিয়ে চেয়ারে বসলো। তাকে দেখে অন্যান্য মেয়েরা চলে যেতে উদ্যত হতেই জাকিরা বলল, জাকিয়া আমাদেরকে কপি দিয়ে যা। তারপর দুজনের আলাপ শুরু হলো।

জাকিরা শরীরের কাপড় অগোছালো করল, দেহের ভাঁজ ও খাজগুলি স্পষ্ট করল। একটু পরপর শরীর টানা দিয়ে বুকের শৃঙ্ঘমান উরোজ দুটি স্পষ্ট করে তুলল আর তুষারশুভ্র দাঁতে হাসির মুক্তা ঝরাতে লাগলো। হুমায়ুন ক্রমে ক্রমে অসহায় হয়ে উঠল, তার অবশিষ্ট প্রতিরোধ প্রাচীর ভেঙ্গে গেছে। কিছুক্ষণ পারিবারিক আলাপের পর লেখাপড়ার আলাপ উঠল। জাকিরা বলল ‘আমি এডমিশন টেস্টের জন্য কোন কোচিং টোচিং করিনি এরপরেও ঢাকা ভার্সিটিতে সান্স হয়েছিল কিন্তু আব্বা এত দূরে ছাড়তে চাইলো না, অগত্যা আনন্দ মোহনেই ভর্তি হতে হল। আপনি তো শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন, গবেষণামূলক অনেক বিষয় আপনার জানা আছে। কাজেই আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল সম্পর্কে আপনার ধারণা কি, আমার তো মনে হয় এতে ভুল আছে।

হুমায়ন বিস্ময়ের সুরে বলল ‘কেমন ভুল আছে? জাকিরা তার চিন্তা অনুযায়ী পরামানু বিন্যাসের বিশ্লেষণ করল। হুমায়ুন অবাক হয়ে গেলো, কারণ তার বিশ্লেষণ ভুল কি শুদ্ধ সে জানে না কিন্তু সম্ভাবনাময়। এরপর সে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলো আর জাকিরা উত্তর দিতে লাগল। তারা আলোচনার গভীরে পৌঁছে গেল, প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। হুমায়ূন উঠছে না দেখে জাকিরা বলল ‘সন্ধ্যা হয়ে গেল যান আপনার অফিসে যান। তখন অনিচ্ছায় সে উঠল।

পৃথিবীতে শ্রদ্ধা কয়েক প্রকার, লাভ লোভ ভয় ও গুনির শ্রদ্ধা। যেমন শক্তিমানকে মানুষ ভয়ে শ্রদ্ধা করে, বিত্তবানকে কিছু পাওয়ার লোভে শ্রদ্ধা করে, রাজনৈতিক নেতা ও ক্ষমতাবানদের লাভের আশায় শ্রদ্ধা করে কিন্তু একমাত্র খাঁটি শ্রদ্ধা হল জ্ঞানীকে শ্রদ্ধা। এখানে কোন লাভ লোভ ও ভয় নেই, এটাই হলো প্রকৃত শ্রদ্ধা। যেমন আমরা এরিস্টটল ও চক্রেটিসকে ভালবাসি। ঠিক একইভাবে আগে জাকিরার প্রতি হুমায়ূনের ভালোবাসার টান ছিল কিন্তু এখন সেই ভালোবাসা শ্রদ্ধায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আর যে ভালোবাসায় শ্রদ্ধা মিশ্রিত থাকে সেটাই হলো প্রকৃত ভালোবাসা এবং নিখাত প্রেম। কারণ সে ভাবছে- যে মেয়ে স্থানীয় কলেজে লেখাপড়া করে বিজ্ঞানীদের থিউরিতে ভুল ধরতে পারে, ভুল শুদ্ধ যাই হোক নিজেই একটা ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারে সে সাধারণ মেয়ে নয়। এই মেয়ে গবেষণার সুযোগ পেলে অবশ্যি বিজ্ঞানী হয়ে যাবে। জাকিরার প্রতি তার বাঁধভাঙ্গা ভালবাসার বান ডাকল। এরপর থেকে সে প্রতিদিন বিকালে গিয়ে জাকিরার সাথে আড্ডা দেয়, রসায়নশাস্ত্র ও অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে, সন্ধ্যায় সমিতির অফিসে যায়। সে যুগপৎ জাকিরার রুপ গুনে দগ্ধ হতে থাকে আর জ্ঞান-গরিমায় মুগ্ধ হতে থাকে।

কিন্তু তার এই সুখ বেশি সময় টিকলো না। সমিতিতে হৈ চৈ পড়ে গেল, ‘রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যাচ্ছে, ওই ধাড়ি মেয়েটার সাথে সভাপতির কিসের এত পিরিতি, সারা বিকাল তার সাথে আড্ডা দেয়। সবাই কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলো। তারপর যখন ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হলো- তখন তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু জাফর ও হাবিব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে হুমায়ূনকে শাঁসালো এবং শর্ত দিলো ঐ মেয়ের সাথে আর সাক্ষাৎ করতে পারবে না। এরপর থেকে তারা দেহরক্ষীর মতো হুমায়ূনকে সাথে করে নিয়ে আসে আবার সাথে করে নিয়ে যায়। সে বারান্দার সামনে দিয়ে যায়, জাকিরার দিকে তাকায় আর মুচকি হাসে কিন্তু কিছু বলার সুযোগ পায় না। জাকিরাও বুঝতে পারে তার মনমহাজন বন্দী হয়ে গেছে, সে কষ্ট পায় নিরাশ হয়।

কিন্তু গৃহবন্দী করলেও মনতো আর বন্দী করা যায় না। হুমায়ূনের মন ময়ূরী খাচায় থাকে না জাকিরার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। কারণ এই মন এখন আর তার নিজের নাই জাকিরার হয়ে গেছে। সে সাক্ষাতের জন্য অধির হয়ে উঠে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। তারা সাধারণত সমিতিতে আসে বিকাল পাঁচটায় কিন্তু সেদিন তিনটায় এসে উপস্থিত হলো। জাকিরা বারান্দায় নেই তাকে ডেকে বের করে আনল। জাকিরা তাকে দেখে এতটাই আনন্দিত হলো যে সে নিজের অজান্তে একটা উচ্ছ্বসিত হাঁসি দিয়ে উঠল আর এই হাসিটা হুমায়ূন আকণ্ঠ পান করে নিল। সে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হল এবং আত্মসমর্পণ করল।

দুজন পাশাপাশি বসে এতদিন না আসার কারণ জিজ্ঞেস করে জাকিরা তার অভিসন্ধিটা ব্যক্ত করল ‘আমি একটা সমস্যায় পড়েছি, ব্যাংকে একটা চাকরির দরখাস্ত করেছিলাম। আগামী রোববার ঢাকায় ইন্টারভিউ দিতে হবে। এখন যাওয়ার সমস্যা, আমার তো আপন কেউ নাই যাব কাকে নিয়ে, শুক্রবার হলে অবশ্য আব্বাকে নিয়ে যাওয়া যেত। এখন আব্বা আম্মা বলতেছে চাকরির দরকার নাই, আর গেলেও একা যাওয়া যাবে না। হুমায়ুন যেন এমন কোনো সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিল। বিষয়টাকে সে দৈবদান হিসাবে গ্রহণ করল, লাফিয়ে উঠে বলল ‘আরে চিন্তা কি আমি নিয়ে যাব। জাকিরা দেখল খুশিতে তার মুখটা চকচক করছে, সে বুঝতে পারল সভাপতির চিরকুমারত্বে ছিড় ধরেছে। সে এখন তার হয়ে গেছে। তবুও মুখে বলল ‘আপনি আমার জন্য কষ্ট করবেন, না থাক বাদ দিয়ে দেই।

হুমায়ুন নিরাশ গলায় বলল ‘বাদ দিবেন মানে, আমাকে এত পর ভাবেন কেন, আমি কি আপনার এটুকু উপকার করতে পারব না, ঠিক আছে এতই যখন পর ভাবেন তাহলে আর আসব না। জাকিরা জবাবদিহির সুরে বলল ‘না না না পর ভাবলাম কোথায়, আমি শুধু আপনাকে কষ্টটা দিতে চাচ্ছি না। - এটা আমার কষ্ট নয় প্রাপ্তি। এরপর সে স্ত্রীর মত তাকাদা দিয়ে রাজি করিয়ে বলল ‘দশটায় পরীক্ষা শুরু হলে ভোরে রওনা করতে হবে। আপনি রোববার ভোরে চৌরাস্তা মোড়ে আসবেন আমরা বাসে চলে যাব, এনা গাড়িতে গেলে দুই আড়াই ঘণ্টার বেশি লাগবে না।

চৌরাস্তা জাকিরাদের বাসার কাছেই। রবিবার সকালে সে গিয়ে দেখল হুমায়ুন ব্যাগ হাতে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল ‘হোটেল থেকে নাশতা করে নেন। জাকিরা বলল ‘আমি নাস্তা করে এসেছি। হুমায়ূন বললো ‘ঠিক আছে নাস্তা না করলেও সমস্যা নাই, আমি আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছি’ বলে ব্যাগ থেকে নাস্তা ও পানির বোতল বের করে দেখালো। জাকিরা হাসল আর মনে মনে বলল ‘আল্লাহর শোকরিয়া, অবশেষে মনের মত একটা গোলাম পাওয়া গেল।

তারপর তারা গিয়ে বাসে চড়ল। সবাই নিজ নিজ আসনে বসে আছে, নিজের সিট থেকে অন্যদের দেখা যায় না। বাস বাতাসের বেগে চলছে, দুজন পাশাপাশি সিটে বসা। হুমায়ুন কটাক্ষে জাকিরাকে দেখছে আর প্রেম যমুনার বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা তার বুকের পাঁজরা ভেঙ্গে তছনছ করে দিচ্ছে। জাকিরা হেসে বলল ‘মনে হচ্ছে কিছু চুরি করছেন? হুমায়ুন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না, সহসা তার হাতটা ধরে নিয়ে নিজের গালে নাকে মুখে ঘসতে লাগলো আর আবেগ তাড়িত হয়ে উঠল। জাকীরাও আবেগাপ্লুত হয়ে উঠে, সে তো কোনদিন কোন পুরুষের এমন ভালবাসা পাইনি। সারাজীবন শুধু ছেলেদের অবজ্ঞা ও অনিহা দেখে এসেছে। সেও আবেগে প্রিয়জনের কাঁধে মাথা রেখে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলো।

হুমায়ূনের বাঁধ ভাঙ্গল, সে আবেগাতিশয্যে প্রিয়ার মাথাটা বুকে চেপে ধরে গুমড়ে কেদে উঠল ‘কেন আমি নিজেকে এতটা শাস্তি দিলাম, কেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলাম, কেন স্রষ্টার বিধানকে চ্যালেঞ্জ করলাম, কেন এতটা দিন তিল তিল করে নিজেকে পোড়ালাম, কেন স্রষ্টার নেয়ামত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলাম, কেন স্বর্গ সুখ দুপায়ে মারালাম? সে বকবক করছে আর জাকিরার মাথা ও ললাটে পাগলের মত চুমুচ্ছে।

জাকিরাও বসে নেই, জীবনে প্রথমবার সে প্রিয়জনের সোহাগে উন্মাতাল হয়ে উঠেছে। তার কুসুম কোমল আনন প্রিয়ের মুখে বুলাচ্ছে আর অনুযোগ করছে ‘কেন করলে, কেন নিজেকে কষ্ট দিলে, কেন নিজেও বঞ্চিত হলে আর আমাকেও বঞ্চিত করলে? স্রষ্টা আমাকে তোমার জন্য তোমাকে আমার জন্য সৃষ্টি করেছেন, চিরকুমারত্বের জন্য নয়। সে প্রিয়ের কোলে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে ফুফিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। হুমায়ুন অন্তহীন মমতায় প্রিয়ার গণ্ড চুম্বন করে বলল ‘হা কুমারত্ব, এবার অভিশপ্ত কুমারত্বের খেতা পোড়ব।

পরীক্ষার পর হুমায়ূন জাকিরাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাইল। জাকিরা চোখ কপালে তুলে বললো ‘সর্বনাশ আমার আব্বা-আম্মা খুবই ধার্মিক মানুষ, আব্বা তোমাকে চিনে বলে তোমার সাথে আসতে দিয়েছে কিন্তু সন্ধ্যার আগেই বাসায় পৌছার শর্ত দিয়েছে। আর এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না। হুমায়ূন ভালো একটা হোটেলে গিয়ে প্রেমিকাকে ভাল- মন্দ খাওয়ালো তারপর গিয়ে বাসে উঠল। ময়মনসিংহে এসে জাকিরার হাত ধরে তার চন্দ্র মুখের দিকে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ তাঁকিয়ে রইলো। তারপর রাগ নিনাদিত কন্ঠে বলল ‘দু-একদিনের মধ্যে আম্মা তোমাদের বাসায় যাবেন।



হুমায়ুনের মা হামিদা খাতুন ও বড় বোন বিকালে গিয়ে জাকির হোসেনের বাসায় উপস্থিত হলো। গিয়েই জাকিরাকে জড়িয়ে ধরে হামিদা খাতুন কৃতজ্ঞতায় কেঁদে ফেলল ‘তুমি আমার পুত্রবধূ নয় আমার মা, তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ, আমার পরিবারকে বাঁচিয়েছ, আমার ছেলেকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছ, আমরা কোনদিন তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না। তারপর হুমায়ূনের বড় বোন জাকিরার গালে ঠোক্কর মেরে বললো ‘কিরে পেত্নি তুই ঐ বনের চিরিয়াটাকে কি করে পোষ মানালি। আমরা কেউ পারলাম না, আমার মা এত কঠোর তিনিও পারলেন না। তুই কি করে এই অসাধ্য সাধন করলি, আমরা সবাই তোর প্রতি কৃতজ্ঞ। তুই আমাদের পরিবারে বউ হয়ে নয় রানী হয়ে যাবি, আমরা সবাই আজীবন তোর এই ঋণের দায়ে আবদ্ধ থাকলাম। আসলে তারা সবাই ধরে নিয়েছে জাকিরা প্রেম করে হুমায়ূনকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছে, এ জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠেছে।

হালকা নাস্তার পর হামিদা খাতুন বিয়াই বিয়াইনের সাথে আলাপে মশগুল হল আর মেয়েরা মেহমানদের রাতের খাওয়ার আয়োজন করতে লাগল। হামিদা খাতুন জাকির হুসেনকে বলল ‘আপনি ধন্য, আপনার মেয়ে ধন্য। আপনার মেয়ে আমার পরিবারটাকে বাঁচালো, আমার ছেলেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করল। আমার দুইটা মাত্র ছেলে, বড়টা কানাডায় পড়ে থাকে তার মুখটা পর্যন্ত দেখতে পারি না। শেষ বয়সে আশা করেছিলাম ছোট ছেলেটাকে বিয়ে করাবো, নাতি-নাতনি নিয়ে হেসে খেলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। ওমা ওই হারামজাদা কিসের এক কুলাঙ্গার সমিতিতে এসে কুলাঙ্গার সাজল। এই যে বিয়ের চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনভাবেই রাজী করাতে পারলাম না। চাপ দিলে বা মেয়ে দেখলে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, বন্ধূ বান্ধবদের বাসায় গিয়ে পড়ে থাকে।

একবার একটা মেয়ে দেখে আমরা গোপনে সিদ্ধান্ত নিলাম হুমায়ূনকে বেড়ানোর কথা বলে নিয়ে গিয়ে জোরজার করে বিয়ে পড়িয়ে দিব। সবকিছু ঠিকঠাক, মেয়েকে আংটিও পরালাম কিন্তু বিয়ের আগের রাতে সে কেমনে জানি টের পেয়ে গেল। শেষ রাত্রে গোপনে কখন বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেল আমরা টেরও পেলাম না। এরপর এই যে খুজাখুজি করি কিন্তু তার কোন পাত্তা নাই। সময় গড়িয়ে যায়, আমরা কান্নাকাটি শুরু করলাম। অবশেষে আমাদের দূরাবস্তা দেখে জাফর ও হাবিব তার সন্ধানে নামল। ইতিমধ্যে চার মাস চলে গেছে। একদিন জাফর এসে বলল ‘হুমায়ুন ঢাকায় আছে, এক বন্ধুর বাসায় থাকে আর একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। আমরা মোবাইল করি, কাকুতি মিনতি করি কিন্তু সে আসবে না। নিরুপায় হয়ে জাফর আমাদেরকে নিয়ে রওনা হল। রাত্রে বাসায় আসতেই তাকে আটকালাম, হাত ধরে কেঁদে বললাম ‘চল বাসায় চল। সে শর্ত দিলো কোনদিন বিয়ের কথা না বললে আসবে অন্যথায় আসবে না। নিরুপায় হয়ে তার শর্তে রাজি হলাম। এরপর তার বিয়ের জন্য কত সদকা মান্নত করলাম, পীর ফকির ধরলাম, হজ্ব করলাম, কাবার ঘরে কোরআন শরীফ দিলাম, মসজিদ মাদ্রাসায় দান করলাম কিন্তু রাজি করাতে পারলাম না। অবশেষে আপনাদের মেয়ে সেই অসাধ্য সাধন করল।

বিয়াই আপনার মেয়ের এই ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারব না, আমরা তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম। এটা আপনার মেয়ে না সোনার টুকরা, সে আমার পুত্র বধু নয় আমার মা’ বলে তিনি শিশুর মতো ফুফিয়ে কেদে উঠলেন। কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে বললেন ‘ভাই আমরা অকৃতজ্ঞ নই, আল্লার রহমতে গরিবও নয়। আপনার মেয়ে আমার পরিবারের যে উপকার করেছে আমরা কিছুটা হলেও এর প্রতিদান দিতে চাই। বিয়ের জন্য আপনার এক পয়সাও খরচ করতে হবে না। কাপড়-চোপড় গয়না গাটি সব আমরাই দিব, এমনকি আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে মেহমান আপ্যায়নের খরচটাও দিয়ে দিতে চাই। জাকির হোসেন চমকে উঠল ‘না না ছিঃ একি বলছেন, আমাকে এত ছোট করবেন না। হামিদা খাতুন সহাস্যে বললেন ‘ঠিক আছে খাওয়া খরচ ব্যতীত আপনি আর কিছু করবেন না, বাকি সব দায়িত্ব আমাদের ওপর থাকলো। আমার ছেলের বিয়ের বিষয়টাই ছিল বড় কথা, মেয়ে কাল না ধলা দেখার বিষয় ছিল না। কিন্তু এখন আমরা সুন্দরি ও শিক্ষিতা বউ পাচ্ছি, কাজেই দু'হাতে টাকা ঢালতে আমাদের মনে বাধবে না।

মেয়ে জন্ম দেয়ার গ্লানি কেটে গিয়ে জাকির হোসেন এই প্রথমবারের মতো গৌরব অনুভব করল, নিজেকে ধন্য মনে করল। হামিদা খাতুন আনন্দ আতিশয্যে অবিরত হাসছে আর বকবক করে যাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ আলাপ করে সে বলল ‘বিয়াইন আমরা একটু কুলাঙ্গারদের সমিতিটা দেখে আসি’ বলে উঠল। রান্নাঘরের কাছে গিয়ে জাকিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘আম্মা আমার জন্য কি রান্না করছো? ছোটবেলায় পুরান মায়ের রান্না খেয়ে বড় হয়েছি এখন নতুন মায়ের রান্না খাব, রাধ, আজ আমার মায়ের হাতের রান্না না খেয়ে যাচ্ছি না’ বলে তিনি মেয়েকে নিয়ে দোতলায় চলে গেলেন। হামিদা খাতুন স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে অবসরে গেছেন, তার ভদ্রতা কোমলতা কঠোরতা সম্পর্কে সুখ্যাতি ও অখ্যাতি দুইটাই আছে।

সমিতিতে তখন তুলকালাম কান্ড চলছে। জাফর ও হাবিব সদস্যদের তোপের মুখে পড়ল ‘সভাপতি আসে না কেন, জাকির সাবের মেয়ের সাথে তার কি জানি ইয়ে উড়ো কথা শোনা যাচ্ছে। সভাপতি হয়ে সমিতির আইন ভঙ্গ করলে তাকে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। কথাটা হামিদা খাতুনের কানে গেল, তিনি ধেয়ে এলেন ‘এই হারামজাদারা কি শাস্তি, কিসের শাস্তি রে? চিনতে পেরে সবাই মাথা নীচু করলো কিন্তু একটা ছেলে না চিনে বলে ফেলল ‘সমিতির আইন ভঙ্গ করলে অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হবে, তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। তিনি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ‘ওই হারামজাদা বিয়ের জন্য শাস্তি হলে আগে তোদের মা বাবাকে গিয়ে শাস্তি দে, কারণ ওরা বিয়ে করেই তোদের মত কুলাঙ্গার জন্ম দিয়েছে। আসলে তোদের মা-বাপের বিচার হওয়া উচিত। ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠলো ‘মুরুব্বি আপনি কিন্তু আমাদের বাড়িতে এসে অপমান করতেছেন, পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাঁধাতে চাচ্ছেন। আপনি এক্ষণ বেরিয়ে যান’।

এবার মহিলা সত্যি সত্যিই রেগে গেল ‘হারামজাদা আমি বেরিয়ে যাবো নাকি তোদেরকে বের করব দেখ’ বলে তিনি গিয়ে ঢাস ঢাস করে গালে চড় মারতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন ‘হারামজাদা বাদর আমাকে চিনিস না, স্কুলে পড়ানোর সময় তোদের মতো ছেলেকে মারতে মারতে লেংটা করে ফেলতাম। তখন এক ছেলে দাঁড়িয়ে বলল ‘খালাম্মা কাজটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না, ওকে আপনি চিনেন? ও কিন্তু আপনার খবর করে ছাড়বে, একেবারে ঘুম হারাম করে দিবে। এবার তিনি এটাকে ছেড়ে ওটাকে ধরলেন ‘এই কুলাঙ্গার কি খবর করবে, কি খবর করবে? বলে চড় মারতে লাগলেন। ছেলেটা বলল ‘ওর সম্পর্কে আপনি জানেন? সে হলো ভয়ংকর ছিঁচকাঁদুনে। আরেকবার মেরে দেখেন এমন কান্নাকাটি শুরু করবে যে, আপনাকে সারারাত কোলে কাখে নিয়ে কান্না থামাতে হবে, সে আপনার ঘুম হারাম করে দিবে।

তিনি হাসি লুকানোর জন্য বললেন ‘এই হারামজাদা জাফরটা কোথায় রে? এক ছেলে নরম গলায় বলল ‘খালাম্মা ওর নাম হারামজাদা জাফর নয় শুধু জাফর। হামিদা খাতুন বলল ‘হাঁ আগে ছিল কিন্তু এই সমিতিতে আসার পর ওর নাম হয়েছে হারামজাদা জাফর, সে কোথায়? কিন্তু কেউ কথা বললো না। আসলে হুমায়ূনের মাকে দেখেই হাবীব গিয়ে অন্য রুমে আত্মগোপন করেছে আর জাফর সুযোগ না পেয়ে একজনের আড়ালে মাথা গুঁজে বসে আছে। তিনি ছেলেদেরকে ধমকাতে লাগলেন। একজন বলল ‘খালাম্মা আমাদের সমিতিতে এ নামের কোন মানুষ নাই, তবে গাধা টাধা আছে কিনা আমি জানি না।

তিনি ছেলেটাকে দুইটা থাপ্পড় মেরে পায়চারি করে খুঁজতে লাগলেন। উবু হয়ে থাকা একটা ছেলের কাছে গিয়ে পিঠে দুইটা কিল মেরে বললেন ‘এই হারামজাদা উঠ। জাফর লাফিয়ে উঠে আবুলের মত বললো ‘ও খালাম্মা আপনি কখন এলেন? তিনি কান ধরে টেনে ভেংচি কাটলেন ‘কখন এলাম নাঃ? চল আমার সাথে, আমি একা মানুষ, বিয়ের এতসব ঝক্কি-ঝামেলা বাজার সওদা কে করবে, তোকে আর হাবিবকেই তো করতে হবে, হাবিব কোথায়? জাফর বলল ‘সম্ভবত বাথ রুমে আছে। আপনাকে দেখলে নাকি তার বাথরুম লাগে। হামিদা খাতুন বলল ‘এই শয়তানের বাচ্চারা শুন, আগামী শুক্রবারে হুমায়ূনের বিয়ে তোদের দাওয়াত থাকলো সবাই যাবি, কি বলিস যাবি তো?

ছেলেরা বলল ‘জি জি যাব তবে আমরা কোন উপহার দেই না শুধু খাই। তিনি বললেন ‘আচ্ছা ঠিক আছে উপহার লাগবে না। আমি খাতা নিয়ে বসে থাকব তোরা শুধু ‘বিয়ে করবো’ এটুকু লিখে তারপর খেতে পারবি। ছেলেরা ‘জ্বী জ্বি খাওয়ার জন্য আমরা যে কোন ওয়াদা দিতেও পারি ভাঙ্গতেও পারি’ বলে হাঁসতে লাগলো। তিনি জাফরের হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

এক ছেলে বলল ‘মাগো কত ভয়ংকর মহিলা। তিনি পিছন ফিরে বাজখাই গলায় বললেন ‘কোন হারামজাদা এ কথা বললি রে? সবাই মাথা নীচু করলো কিন্তু বুদ্ধিমান একটা ছেলে দাড়িয়ে বলল ‘খালাম্মা ও তো খারাপ কিছু বলেনি, শুধু বলেছে ‘মা খুব ভদ্র মহিলা। তিনি হাসি লুকিয়ে বললেন ‘আচ্ছা যা মাফ করে দিলাম কিন্তু বিয়েতে না গেলে মাপ করব না থাপ্পড় খাবি। এখন তোরা সবাই আমাকে সালাম দে। সবাই সমস্বরে সালাম দিল, তিনি ওয়া আলাইকুম সালাম’ বলে বেরিয়ে গেলেন। কয়েকদিন পর বিয়ে হয়ে গেল।



হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করলেও তারা এইচ এস সি-তে গিয়ে ভর্তি হয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। তারপর ঢাকা ভার্সিটিতে হুমায়ুন রসায়ন বিভাগে ও হাবিব ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়। আর জাফর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন ও ইলেট্রনিক্স বিভাগে ভর্তি হয়। কলেজ জীবন থেকেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, হুমায়ুনই বাকি দুই বন্ধুকে ডেকে এনে সমিতিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রদান করে স্থায়ীভাবে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করে। বন্ধুত্বের সুবাদে তাদের পারিবারিকভাবেও সম্পর্ক গড়ে উঠে। হুমায়ূন ও জাফরের বাসা একই মহল্লায় কিন্তু হাবিবের বাসা কিছুটা দূরে।

বিয়ের কয়েকদিন পর জাফরের মা দৌড়ে এসে হুমায়ুনের মায়ের উপর হামলে পড়ল ‘ও আপা আপা গো আপনি এতো স্বার্থপর। নিজের ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে রানির মত সংসার করছেন কিন্তু আমার কথা একবারও চিন্তা করলেন না। এই যে আমি বসলাম, আমার ছেলেকে যেভাবেই হউক বিয়ে না করিয়ে দিলে আমি এখান থেকে উঠবো না, এখানে পরেই মরবো। জীবনে যদি ছেলের বউ না দেখতে পারি তাহলে এই জীবন আর রেখে লাভ কি’ বলে কাঁদতে লাগলেন। হামিদা খাতুন ধমকে উঠলেন ‘এই ছাগলের মত ভ্যা ভ্যা করে কেঁদো না তো, একদম চুপ। এখন শান্তভাবে বসে চা নাস্তা কর তারপর চলো তোমাকে জায়গা মত নিয়ে যাই। এরপর জাকিরার কাছে গিয়ে বলল ‘তুমি বাসায় কল করে বল একজন মহিলা জাকিয়াকে দেখতে আসছে, একটু পরিপাটি হয়ে থাকে যেন।

তারপর বাসায় গিয়ে জাকিয়াকে দেখিয়ে বললো ‘দেখো তোমার চলবে কিনা, মেয়ে কিন্তু মাষ্টার্সে পড়ছে। জাফরের মা কিছুক্ষণ নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল ‘এমন সুন্দরী মেয়ে যদি আমি ছেলের বউ হিসেবে পাই তাহলে আমি আল্লার ঘর হজ্ব করব। চা নাস্তা পর্ব শেষে হামিদা খাতুন জাকিয়াকে বলল ‘জাফরকে তো চেন, এই মহিলার ছেলে। এখন তার বাসায় যাবো একটু ভাল করে সাজগোজ করে আস। বাসায় পৌঁছে জাফরের মা হামিদা খাতুনকে বললো ‘আপা ছেলে তো মেয়ে দেখলে বা বিয়ের আলাপ শুনলেই পালায়, বাসা ছেড়ে দেয়। এখন মেয়ে দেখাবেন কেমনে? হামিদা বলল ‘এসব তোমার চিন্তা করতে হবে না, তুমি চা করে আন। তারপর জাকিয়াকে বলল ‘হনুমানটা ওই রুমে আছে তুমি গিয়ে আলাপ করে খাতির জমাও, অভিনয় টবিনয় করে যেভাবেই হোক ওর নাক বিধাবার ব্যবস্থা কর।

জাকিয়া কিছুটা মুখরা এবং সাহসী প্রকৃতির মেয়ে। সে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ‘কি কুমার মহাশয় কেমন আছেন’ বলে খাটের পাশে বসা জাফরের কোমরের সাথে কোমর মিশিয়ে বসল। জাফর ছিটিয়ে উঠে সরে যেতে চাইলো কিন্তু সে কাঁধে হাত রেখে চেপে ধরে বলল ‘না যাচ্ছেন কোথায়, আমাকে আপনার নাক বিধানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে’ বলে তার কানে চুমু মারল। জাফর লজ্জায় লাল হয়ে গেল। এরপর বিড়ালের ইঁদুর খেলার ন্যায় সে জাফরের দেহটা নিয়ে যা করল তার বর্ননা সমীচীন হবে না।

হামিদা খাতুন ভাবল বিপদজনক বয়সের দুটি যুবক যুবতীকে এতটা সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না, আবার কোন আকাম করে বসে। তিনি জাকিয়াকে ডেকে বের করে চা নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। জাফরের মা জাকিয়ার আড়ালে কেঁদে উঠে বলল ‘কি হলো কিছুই তো বললেন না, যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা করেন। হামিদা বলল ‘এ নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না তুমি বিয়ের ব্যবস্থা কর’ বলে চলে গেলেন। পরদিন তিনি জাফর ও জাকিয়াকে কল করে ডেকে এনে জাকিয়াকে ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন। তারপর জাকিয়া চা করে এনে দুজন একসাথে বসে চা খেয়ে একসাথে বেড়িয়ে গেল।

এরপর থেকে তারা প্রতিদিন বিকালে বাইরে যায়, নদীর ধারে ও বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফিরা করে, গল্প গুজব করে। এভাবে কয়েকদিন চলার পর হঠাৎ একদিন জাফর এসে বলল ‘খালাম্মা যা করার তাড়াতাড়ি করেন। হামিদা খাতুন বলল ‘আমি কি করবো তোর মাকে বল গিয়ে। জাফর বলল ‘আমি আম্মাকে বলি কি করে আপনি আলাপ করেন’ বলে সে চলে গেল। হামিদা জাফরের মাকে কল করে ঘটনা জানালো। কিছুক্ষণ পর সে কল ব্যাক করে বলল ‘আপা ছেলে তো রাজি না। হামিদা বলল ‘ঠিক আছে আমি আসছি। বাসায় পৌঁছে সে জাফরকে তার মায়ের সামনে ডেকে এনে বললো ‘কিরে তুই নাকি বিয়ে করবি না? ঠিক আছে তোর মন না চাইলে আর জোরাজুরির দরকার কি’ বলে মুখ টিপে হাসল। জাফর কাচুমাচু করে বলল ‘না মানে আম্মা অনেক দিন ধরে কান্নাকাটি করতেছে আপনারাও চাচ্ছেন। তাই আর মুরুব্বিদের মনে কষ্ট দিতে চাই না’ বলে সে চলে গেল। জাফরের মায়ের মুখে হাঁসি ফুটল। কয়েক দিন পর বিয়ে হয়ে গেল।

আহসান হাবীব সমিতির অফিসে বসে আছে, তার ওপর বৃষ্টির মতো সদস্যদের গালাগালি বর্ষিত হচ্ছে। অপরাধ, তার দুই বন্ধু বিয়ে করল কেন, সে আটকালো না কেন, ওদের বিয়েতে তার হাত আছে, সে নিজেও বিয়ে করবে, ওরা সবাই গাদ্দার, সমিতির সাথে গান্ধারী করেছে, ওদের বিচার হওয়া উচিত ইত্যাদি। হাবীব মাথা নিচু করে বসে আছে। সহসা কামাল পাশা চেঁচিয়ে উঠলো ‘ও আর এক মুহূর্ত সমিতিতে থাকতে পারবে না, ওর নাম কেটে বের করে দিব’ বলে ধেয়ে এসে খাতাপত্র বের করে তাদের তিন বন্ধুর নাম কেটে দিল। এরপর বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই হাবিবকে গালি দিতে লাগলো আর ধমকাতে লাগলো। বেচারা একা কোন প্রতিবাদ করতে পারল না, লজ্জিত হয়ে মাথানিচু করে বেরিয়ে গেল।

তারপর পুরাতন কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের তোড়জোড় শুরু হলো। কামাল পাশা সভাপতি হওয়ার জন্য তদবির শুরু করল কিন্তু সমিতির সদস্যরা জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক। তারা কেউ কামাল পাশাকে সমর্থন করলো না। এক সপ্তাহ পর্যন্ত অনেক যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিন জনকে নির্বাচিত করা হল। সভাপতি হল ডাক্তার মির্জা গালিব, সে ময়মনসিংহের বিখ্যাত মির্জা বংশের একমাত্র সন্তান, বিশাল সম্পদের অধিকারী। অত্যন্ত ভদ্র সুদর্শন সুধীজন ও মর্যাদাবান যুবক। তাকে সভাপতি নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য হলো তার সম্পদ। কারণ সিরাজ হায়দারের সম্পদে সমিতি যথেষ্ট ধনী হয়েছে এখন মির্জা গালিব যদি চিরকুমার থাকে তাহলে অবশ্যই তার সম্পদ সমিতিতে এসে যুক্ত হবে। তখন সমিতি নোবেল সংস্থার মত অতুল সম্পদের অধিকারী হবে। আর তখন সমিতি নোবেল প্রাইজের মতো আন্তর্জাতিক মানের কোন কিছুর প্রবর্তন করতে পারবে- এই আশায় সমিতির সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করেছে।

সহ-সভাপতি হল মির্জা গালিবের ক্লাসমেট ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাক্তার হাসান ইমন চৌধুরী, সেও ভদ্র নম্র ও বড়লোক পরিবারের সন্তান। সেক্রেটারী নির্বাচিত হল কৃষি ভার্সিটির ছাত্র মা’রুফ আহমদ। ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব আগের মতো সুভাষ চন্দ্রের উপরই থাকলো। মির্জা গালিব সভাপতি হয়ে কঠোর হস্তে সমিতির সকল নিয়ম শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনল, ব্যয় কমিয়ে আনলো, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করল। তখন সমিতির উত্তরোত্তর উন্নতি হতে লাগলো।

একদিন জাফর হুমায়ুনের বাসায় এসে বলল ‘হাবিব তো আমাদের ওপর খুব ক্ষ্যাপা। আমরা গাদ্দারী করেছি, আমাদের গাদ্দারির জন্য নাকি তাকে অপমান করে সমিতি থেকে বের করে দিয়েছে। এখন সে বলে বেড়াচ্ছে আমাদের গাদ্দারীর প্রতিশোধ নিবে। হুমায়ুন বললো ‘হ্যা ঠিকই তো, আসলে বেচারাকে খুব অপমান করে তাড়িয়েছে আর এর জন্য দায়ী আমরা। কাজেই আমাদের উপর তার প্রতিশোধ নেয়া একান্ত কর্তব্য, আর বন্ধু হিসেবে আমাদেরও উচিত তাকে প্রতিশোধের সুযোগ করে দেয়া। চল, সেই সুযোগটা করে দেই। পরদিন হুমায়ুন মোবাইল করে হাবিবকে তার বাসায় ডেকে আনল। হাবিব এসেই তাকে গালাগালি শুরু করল ‘গাদ্দার বেইমান শপথ ভঙ্গকারি যাচ্ছে তাই গালাগাল করে যাচ্ছে। হামিদা খাতুন বাসায় নেই বিধায় দায়িত্বটা হুমায়ুনেরই পালন করতে হচ্ছে। সে আড়ালে গিয়ে তৃতীয় শালিকা জিনাতকে কল করে বলল ‘একটা শিকার ধরতে হবে একটু সাজগোজ করে আয়। তারপর কিভাবে নাটকের অভিনয় করতে হবে সব বুঝিয়ে দিল।

হাবিব বকাবকি করেই যাচ্ছে। হুমায়ুন চা নিয়ে এসে বলল ‘আচ্ছা আমি গাদ্দারি করেছি আমার বিচার কর ঠিক আছে, কিন্তু তোমার বিচার কে করে? তুমি আমার শালিকে কি করেছ, সে সব সময় শুধু তোমার কথা বলে, প্রশংশা করে যেন তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন মানুষ নাই। হাবিব কেমন যেন বিস্ময়ের দৃষ্টিতে হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে রইল, তার চোখের তারা নাচছে। ইতিমধ্যে জিনাত এসে গেছে। হুমায়ুন বলল ‘জিনাত দেখতো ও আমাদের ওপর এত ক্ষেপে গেল কেন’ বলে সে চলে গেল। জিনাত চায়ের কাপের তলানি থেকে একটু চা হাতের তালুতে নিয়ে হাবিবের চান্দিতে ঘষে দিয়ে বললো ‘কি ব্যপার কুমার সাহেব এত রাগারাগি করছেন কেন, পানি দিয়ে মাথাটা ঠান্ডা করে দেই। হাবিব লাফিয়ে উঠলো ‘আরে আরে আপনি আমার মাথায় চা দিচ্ছেন কেন? জিনাত বলল ‘ব্যস্ত হবেন না, আপনার মাথা ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করছি। এভাবে ইয়ার্কি ফাজলামোর মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে আলাপ শুরু হলো। ইতিমধ্যে যুবতী নারী দেহের সেই মাতাল ঘ্রান তার নাসিকায় ঢুকে গেছে যা পুরুষ মাত্রকেই মাতাল করে তুলে।

পূর্ন বয়স্কা যুবতী, অপরুপ সুন্দরি, শ্রাবণের ভরা নদীর মতো টলমল যৌবন, পুর্নেন্দু কৌমুদীর মত শীতল আভা ছড়াচ্ছে, সৌন্দর্য ও যৌবনের একটা একটা করে কলা পুর্ন করে ষোল কলা পুর্নিমা চাঁদ। হাবিবের মাথা ঘুরিয়ে গেল, তারা আলাপে মশগুল হলো। তারপর দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে উভয়েই নিজ নিজ বাসায় চলে গেল। এরপর থেকে তারা আর হুমায়ূনের বাসায় আসে না, নিজারাই মোবাইল করে বাইরে ঘুরতে যায়। তাদের অভিসার নিয়মিত চলতে লাগলো। একদিন হুমায়ুন জিনাতকে কল করে বলল ‘এই শালি ডুবে ডুবে আর কত পানি খাবি আজ আমার বাসায় এসে ডুবাডুবি কর। তারপর যা করার আমিই করব। জিনাত উদ্দেশ্যটা বুঝল, হাবীবকে কল করে সাথে নিয়ে দুলাভাইয়ের বাসায় এসে একটা নিরিবিলি রুমে ডেটিং শুরু করলো। হুমায়ুন হাবিবের মাকে কল করে বলল ‘খালাম্মা আপনার ছেলেকে বিয়ে করাতে চান? মহিলা কেদে ফেলল। সে বলল ‘ঠিক আছে কাদতে হবে না, আপনি এখনই আমার বাসায় চলে আসেন। তারপর সে জাফরকে ডেকে এনে দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর মহিলা হন্তদন্ত হয়ে এসে হুমায়ূনের হাত ধরে কেঁদে উঠে বলল ‘বাবা আমার ছেলের বিয়ে---

হুমায়ূন ধমক দিল ‘এই হলো আপনাদের দোষ, একটু সুযোগ পেলেই চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেন, চুপ একদম চুপ। চুপচাপ দেখে আসেন আপনার ছেলে কি করে? জাফর বলল ‘কিন্তু কোন কথা বলতে পারবেন না, চুপচাপ দেখে আমাদের কাছে চলে আসবেন, বাকি যা করার আমরা করব। মহিলা দূর থেকেই শুনতে পেল রুমটা ছেলেকন্ঠ ও মেয়ে কন্ঠের কলহাস্যে মুখর। তিনি সোজা গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালেন। হাবিবের হাত জিনাতের কাঁধের উপর। ছেলে মাকে দেখেই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল, জিনাত তার মাকে চিনে না কিন্তু অনুমানে বুঝে নিয়ে সে আরো উৎসাহী হয়ে উঠল। হাবিবের হাত ধরে বলল, আরে হঠাৎ তোমার কি হয়ে গেলো এমন চুপসে গেলে কেন, এখানে আর না চল নদীর পাড়ে চলে যাই। হাবীব ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দিল আর লজ্জায় লাল হয়ে বিড়বিড় করতে লাগল।

আশার আলো দেখতে পেয়ে মায়ের চোখ খুশিতে ঝকমক করে ওঠল। সে দৌড়ে গিয়ে হুমায়ূনের হাত ধরে বলল ‘বাবা এত সুন্দরী মেয়েটা কে? হুমায়ুন বলল ‘আমাদের শ্যালিকা। মহিলা আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল ‘বাবা এখনই পুলিশে খবর দাও। তারা অবাক হয়ে গেল ‘কেন? মহিলা বলল, ‘আরে বাবা ও কত বড় হারামজাদা তোমরা জান না। কত বিয়ের আলাপ করেছি কত কান্নাকাটি করেছি কিন্তু কিছুতেই সে রাজী হয় না, বিয়ের আলাপ শুনলেই পলায়ন করে, বাসা ছেড়ে দেয়। আজ কায়দা মতো পেয়েছি, পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে কাজী ডেকে বিয়ে পড়িয়ে বউ নিয়ে তবেই আমি বাসায় যাব। জাফর বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তবে আমাদের একটা শর্ত আছে, আপনি গিয়ে গুনে গুনে ওর গালে পাঁচটা থাপ্পর দিয়ে বলবেন ‘হারামজাদা আমরা বিয়ে করাতে চাই তুই রাজি হস না আর এখন ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস, তোর কপালে বিয়ে নাই। তবে জোরে জোরে থাপ্পর দিতে হবে। মহিলা বলল ‘সর্বনাশ মারলে তো বিয়েই করতে চাইবে না। জাফর বলল ‘ঠিক আছে আপনার ছেলেকে নিয়ে চলে যান, আমরা বিয়ে দেব না।

মহিলা কাচুমাচু করে বলল, ‘ঠিক আছে বাবা, তোমাদের যে কোন শর্ত মানতে আমি রাজি আছি, তবুও আমার ছেলেটাকে বিয়ে করাও’ বলে তিনি চলে গেলেন। হুমায়ুন বলল ‘ওকে অপমান করার কি দরকার ছিল? জাফর বলল, দরকার আছে আমরা বিয়ে করেছি বলে হারামজাদা আমাদেরকে অনেক গালাগালি করেছে। কাজেই একটু মার না খেলে ওর বিয়েটা দুরুস্ত হবে না। মহিলা দরজায় গিয়ে মুচকি হেসে পেছন ফিরে দেখল, তারপর ঘরে ঢুকে জিনাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল ‘মা আমার মা, তুমি আমার মায়ের উপকার করেছ। আমি আজই তোমাকে বউ করে ঘরে নিব। তারপর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, বাবা আর অমত করিস না, এখনো অমত করলে আমি কিন্তু গাড়ির নিচে ঝাঁপ দিব’ বলে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। গিয়ে বলল ‘তোমাদের শর্ত পালন করেছি, কোথায় পুলিশ কোথায়? হুমায়ুন বলল ‘খালাম্মা এত ব্যস্ত হবেন না, দেখেন না আপনার ছেলের পেছনে আসল ঔষধ লাগিয়েছি, এই মহৌষধে রোগ সারবেই নিশ্চিত থাকেন। আপনি বাসায় যান, বিয়ের আয়োজন করেন গিয়ে। কয়েকদিন পর তাদেরও বিয়ে হয়ে গেল।



মির্জা আলমগীর ময়মনসিংহের বিশিষ্ট ধনীদের একজন, শহরে তার অনেক জায়গা জমি, বহুতল ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সে উত্তরাধিকার সূত্রেই ধনী, তার পূর্বপুরুষরা উত্তর ময়মনসিংহের কোন এলাকার জমিদার ছিল। তার একমাত্র ছেলে মির্জা জাহাঙ্গীরকে বিয়ে করিয়েছিল নেত্রকোনার বিশিষ্ট এক সংসদ সদস্যের সুন্দরী মেয়ে সুলতানা পারভিনকে। বিয়ের পর তার ফুটফুটে একটা ছেলে জন্ম নেয়, ছেলের নাম রাখা হয় মির্জা গালিব। মির্জা জাহাঙ্গীর সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে সে ব্যবসার প্রয়োজনে লন্ডন রওনা হয় কিন্তু পথিমধ্যে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যায়। তখন মির্জা গালিবের বয়স দুই বছর। কিছুদিন পর ছেলের শোকে জাহাঙ্গীরের মাও মারা যায়। সুলতানার বাবা তার সুন্দরী যুবতী মেয়েকে এভাবে বৈধব্যব্রত অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারলেন না, আবার বিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু তাতে শ্বশুর তো দুরের কথা স্বয়ং সুলতানাই রাজি নয়। তার পরিষ্কার কথা- সে ছেলের মুখ দেখে ও স্বামীর স্মৃতি নিয়ে বাকী জীবন স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারবে।

সুলতানার বাবা অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। অবশেষে একদিন তার মা ও বড় বোন বেড়ানোর কথা বলে তাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। সুলতানা গিয়েই বুঝতে পারল তার বিয়ের বন্দোবস্ত চূড়ান্ত, বর সচিব, একটা মেয়ে বাচ্চা রেখে বউ মারা গেছে। সুলতানা পালানোর উপায় খুঁজতে লাগল কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। বিয়ের আগের রাতে বিয়ে বাড়ির ধুন্দুমারের মধ্যে সে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সুন্দরী যুবতী কিন্তু বুদ্ধিমতি মেয়ে একাকী কোন গাড়িতে উঠার সাহস পেল না, বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে যাত্রী ছাউনির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ভোরের অপেক্ষা করতে লাগলো। সকালে একজন মুরুব্বিকে অনুরোধ করল ‘চাচা ময়মনসিংহে যাওয়ার জন্য আমাকে একটা প্রাইভেট কার রিজার্ভ করে দেন। তারপর গাড়ীতে উঠে ড্রাইভারকে বলল ‘খুব দ্রুত আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে।

বাসায় পৌঁছেই সে মির্জার পায়ের উপর হুমরি খেয়ে পড়লো, জবাই করা মুরগির মত ধাফরাতে লাগল আর বুক ফাটা আর্তনাদ শুরু করলো ‘ও আব্বা গো, আমি আমার ছেলে আর আপনাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না, আমি আপনার ছেলের স্মৃতি বুকে নিয়ে আপনার পায়ের উপর পড়ে থেকে মরবো, তবুও আমার ছেলেকে ছেড়ে যেতে পারবো না। মির্জার শিরায় পূর্বপুরুষের রক্ত ঝলসে উঠল। সে হুঙ্কার ছাড়ল, আমি জমিদার জুলফিকারের বংশধর, বাপের কোল থেকে মেয়েকে কেড়ে নিয়ে বিয়ে দিতে চায় ঐ গাদ্দারদের আমি ক্ষমা করব না। কিছুক্ষণ পর বাইরে একাধিক গাড়ির হর্ন শোনা গেল। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েই সুলতানা শশুরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো ‘ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। সুলতানার মা-বাবা ভাই-বোন ও আরো কিছু লোক দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

মির্জা দৌড়ে গিয়ে বন্দুকটা নিয়ে এসে দরজা খুলে একটা ফাকা গুলি ছুড়ল। তারপর হুঙ্কার ছাড়ল, ইংরেজের কলজে কাঁপানো জমিদার মির্জা জুলফিকার আলীর রক্ত আমার শরীরে। আমার মেয়েকে আমার বুক থেকে কেড়ে নেয় এমন শক্তি আজো পৃথিবী পয়দা করতে পারেনি। এ বাসায় সুলতানা নামে আমার পুত্রবধূ থাকত কিন্তু সে মারা গেছে, এখন যে মেয়েটা আছে সে আমার কন্যা। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রতিপক্ষরা চলে গেলো। এরপর থেকে মির্জার ডাকের মধ্যে পরিবর্তন এল, আগে সে ডাকত বৌমা এখন ডাকে আম্মা, আগে ডাকত তুমি এখন ডাকে তুই, অর্থাৎ পুত্রবধূ কন্যায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। যুবক পুত্র হারিয়ে বাপের বেঁচে থাকার অবলম্বন হল পুত্রবধু আর স্বামী হারিয়ে সুলতানার অবলম্বন হল শশুর। আর তাদের উভয়ের অবলম্বন পিচ্চি গালিব, দুই তিন বছরের গালিব।

দুই প্রজন্মের দু’জন মানুষ একটি শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মির্জা স্বপ্ন দেখে তার নাতি অনেক বড় হবে, বংশ রক্ষা করবে, বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে, গালিব তার বংশের একমাত্র প্রদীপ। মা স্বপ্নে দেখে আর ছেলে বড় হবে, মানুষের মত মানুষ হবে, একদিন পরীর মত একটা সুন্দরী বউ ঘরে আনবে। নাতি-নাতনিতে তার সংসার ভরে উঠবে, তখন তাদেরকে নিয়ে হেসে খেলে তার সারা জীবনের দুঃখ কষ্ট উসুল করে নিবে। ছেলেটা বড় হচ্ছে, বাপের মত বলিষ্ঠ গড়ন ও সুদর্শন রূপে বেড়ে উঠছে। ছেলেকে দেখে মায়ের চোখ জুড়িয়ে যায়। তার ছেলে ভদ্র মার্জিত ব্যাক্তিত্বপুর্ন ও পূর্বপুরুষের ন্যায় কর্তৃত্ববান। তাছাড়া সে প্রচন্ড মেধাবী, ইন্টারে সর্বোচ্চ রেজাল্ট করে ময়মনসিংহ মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।

এরপর থেকে সুলতানা ছেলের বিয়ের জন্য শ্বশুরকে তাকাদা দিতে লাগল। শ্বশুর ধমকায় ‘দুঃ বোকা এখনই বিয়ে করালে তোর ছেলের লেখাপড়া গোল্লায় যাবে, ডাক্তারিটা শেষ করুক। কিন্তু মায়ের দুর্ভাগ্য যে ছাত্রাবস্থায়ই গালিব চিরকুমার সমিতিতে নাম লেখায়। ছাত্রত্বের শেষ পর্যায় থেকে তারা অনেক পাত্রি দেখলো কিন্তু গালিব বিয়ে করবে না। এরপর থেকে সুলতানা শ্বশুরের উপর চাপ দিতে থাকে। শ্বশুর পাত্রী দেখে আর নাতির উপর চাপ দেয় কিন্তু ব্যক্তিত্ববান একরোখা নাতীর সাফ জবাব সে বিয়ে করবে না, চিরকুমার থাকবে। বেশি চাপ দিলে বাসা থেকে চলে যায়। আসলে তখন ময়মনসিংহে যুবক ছেলেদের মধ্যে চিরকুমারত্বের একটা বাতিক চলছে, একেক সময় একেকটা বিষয়ের রিউমার উঠে। ময়মনসিংহে তখন কুমারত্বের লু হাওয়া বিরাজমান।

সুলতানা যখন শুনলো তার ছেলে চিরকুমার সমিতির সভাপতি হয়েছে- তখন সে ভেঙ্গে পড়ল। শশুরের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করল ‘আমি কিসের আশায় কেন সারা জীবন এত কষ্ট করলাম। যে ছেলের জন্য আমার এত ত্যাগ তিতিক্ষা সেই ছেলের এই অবস্থা আমি দেখতে পারবো না। আমি পাগল হয়ে দেশে দেশে ঘুরব। অবশেষে মির্জা আলমগীর ঢাকায় এক ইন্ডাস্ট্রিয়ানের মেয়ের সাথে গোপনে বিয়ে ঠিক করলো। তারপর গালিবকে কিছু না জানিয়ে তারা তিনজন রওনা হলো কিন্তু মেয়ের বাড়িতে পৌছেই বিষয়টা বুঝতে পেরে সে পলায়ন করল। এরপর থেকে সে আর বাসায় আসে না, বন্ধু বান্ধবদের বাসায় বা সমিতির অফিসে পড়ে থাকে। মা সকাল-বিকাল ও গভীর রাত পর্যন্ত তার অপেক্ষায় খাবার টেবিলের সামনে বসে থাকে কিন্তু ছেলে আসে না। মির্জা তাকে ধরে আনতে গেলে পালিয়ে যায়। মা ছেলের পথ পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ধোসর হয়ে আসে, তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়।

একদিন সে উন্মত্ত হয়ে পাগলের মত শশুরের উপর হামলে পড়ল ‘আমার ছেলে কোথায়, আমার ছেলেকে এনে দেন। আমি কিসের আশায় বেঁচে আছি, কেন আপনার সংসারে পড়ে আছি, আপনার বিত্ত-বৈভব দেখে? আমার মা বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু শুধু আমার সন্তানের মুখ দেখে আমি সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছি। এখন আমার ছেলে কোথায়, ছেলের বউ কোথায়, সংসার কোথায়, আমার সারা জীবন কষ্টের প্রতিদান কোথায়? আমি যদি সন্তানই না পেলাম, সন্তানের সংসার না দেখলাম, তাহলে আমার বেঁচে থেকে লাভ কি? আমার মরাই ভালো, আমি মরবো সত্যিই বলছি আমি মরবো। এক সপ্তাহের মধ্যে ছেলে আর ছেলের বউ না পেলে আমি আত্মহত্যা করব বলে দিলাম, আমার মরা মুখ দেখবেন’ বলে সে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে গেল।

লৌহমানব মির্জার ললাটে জীবনের প্রথম ভাজ পড়ল। স্ত্রী ও সন্তানের মৃত্যুর পর সে হয়তো বেঁচে থাকত না কিন্তু এই মেয়েটিকে অবলম্বন করে বেঁচে আছে। এই মেয়েটি আন্তরিক সেবা যত্ন করে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে অথচ এ মেয়েটা আজ তার চোখের সামনে ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার নাতি বিয়ে না করলে তার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে, বংশে প্রদীপ জ্বালাবার মত আর কেউ থাকবে না। কিন্তু সে এখন কি করবে, জেদি ও একরোখা নাতি তো কোন কথাই শুনছে না। সেও পুর্ব পুরুষের মতো স্বেচ্ছাচারী হয়েছে। ইস্পাতকঠিন মির্জা জীবনে এই প্রথম ভেঙ্গে পড়ল। সে আস্তে আস্তে পুত্রবধূর ঘরে গিয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল ‘চিন্তা করিস না মা, এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমি তোর ছেলে আর ছেলের বউ তোর পায়ের উপর উপুড় করে ফেলতে না পারি তাহলে আমি জমিদার মির্জা জুলফিকার আলীর বংশধর নয়। তারপর সে উপায় চিন্তা করতে লাগলো।



হুমায়ুন চরপাড়া মোড়ে ফলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ফল কিনছে। হঠাৎ কে যেন লাঠি দিয়ে তার পায়ে বাড়ি মারল। সে প্রচন্ড রাগে হাত বাড়িয়ে পেছন ফিরে গলা টিপে ধরতে গেল আর সাথে সাথে হাত গুটিয়ে ‘আরে দাদু’ বলে জড়িয়ে ধরতে গেল। কিন্তু বৃদ্ধ দুই পা পিছিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ‘আমাকে নির্বংশ করার ব্যবস্থা করে এখন দাদু মারাচ্ছ? হুমায়ুন যেন তার ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টির সামনে পোড়ে যাচ্ছে, সে মাথা নত করে মিনমিনিয়ে বলল ‘আসলে কি জানো দাদু, মানুষ অবলীলায় কিছু কাজ করে ফেলে কিন্তু এর পরিনতি কি হবে ভাবে না, আমাদের কাজটাও এমনই ছিল। মির্জা বলল ‘তুইই তো ওকে তোদের শয়তানী সংঘে ঢুকিয়েছিলি, এখন তোকেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দেখ ঐ হারামজাদার জন্য আমার মেয়েটা মরতে বসেছে।

সুলতানা কাতর স্বরে বলল ‘বাবা আল্লার ওয়াস্তে একটা কিছু কর। হুমায়ুন একটু চিন্তা করে বলল ‘দাদু এত চিন্তা করো না, কাল আমার বাসায় আসো আশা করি একটা পথ হয়ে যাবে। তারপর সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলল ‘খালাম্মা কাল দুপুরে আমার বাসায় গোশত ভাতের দাওয়াত থাকলো আসবেন, আশা করি একটা উপায় হয়ে যাবে। মির্জা ধমকে উঠল ‘আরে গাধা দাওয়াত এভাবে দেয় নাকি? বলতে হয় ডাল ভাতের দাওয়াত। হুমায়ুন বলল ‘না চিরকুমাররা মিথ্যা বলে না, খাওয়াবো গোশত ভাত তাহলে ডালভাত বলতে যাবো কোন দুঃখে? মির্জা অট্টহাসি দিয়ে বিদায় নিল।

রাত্রে হুমায়ূন তার মা, স্ত্রী ও দুই ভাইরা ভাইকে ডেকে নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলো। সবাই জাকির হোসেনের চতুর্থ মেয়ে সুহানার কথা বলল। কিন্তু হুমায়ূন বলল ‘ময়মনসিংহের শ্রেষ্ঠ খান্দান, শ্রেষ্ঠ ধনী মির্জা বংশের একমাত্র পুত্রবধূ হতে হলে রুপ গুন মেধা সর্বদিক থেকে শ্রেষ্ঠ হতে হবে। নইলে পাত্র ও পাত্রের পরিবার গ্রাহ্যই করবে না। আর এমন পাত্রি একমাত্র হানানা, সে সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। অবশেষে অনেক বিতর্কের পর হানানার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হলো। পরদিন হুমায়ুন শাশুড়িকে কল করে বলল ‘হানানাকে সাজিয়ে গুজিয়ে দুপুরে আমার বাসায় নিয়ে আসবেন।

দুপুরে মেহমানরা আসল। মির্জা গিয়ে গেস্ট রুমে বসল আর সুলতানা ভিতরে চলে গেল। সে জাকিরার প্রতি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হামিদা খাতুনকে বললো ‘আপনি তো পুত্রবধূ নিয়ে সুখে সংসার করছেন আর আমি কি যে পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছিলাম, অল্প বয়সে বিধবা হলাম তারপর ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে সব কিছু বিসর্জন দিলাম। কিন্তু এখন সেই ছেলে ঘরছাড়া’ বলে সে গুমড়ে কেদে উঠল, তারপর বারান্দায় গিয়ে কাঁদতে লাগল।

ইতিমধ্যে হানানা ও তার মা এসে গেছে। এমনিতেই রূপ-গুণ সৌন্দর্য স্বাস্থ্য ও উচ্চতায় হানানা এক অপূর্ব মেয়ে। তার ওপর সাজগোজ করে সে হয়ে উঠেছে অপরূপা সুন্দরী, স্বর্গীয় অপ্সরী। সুলতানা বুভুক্ষের মতো কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর জাকিরাকে জিজ্ঞেস করল ‘বৌমা মেয়েটা কে? – ও আমার বোন, পঞ্চম বোন।- বিয়ে হয়েছে? – না, আপনাদের দেখানোর জন্য এনেছি। সহসা শ্রাবণের আকাশের মতো সুলতানার থমথমে মুখটা পূর্ণিমা চাঁদের মত চকমক করে উঠলো।

হুমায়ুন হানানাকে ডেকে এনে বলল ‘দাদুকে সালাম দিয়ে আস। সে গিয়ে বিনম্র সালাম দিল। মির্জা কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে বলল ‘তোমার নাম কি? – হানানা। - কি পড়? - কৃষি ভার্সিটিতে, মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ। আরো কিছু প্রশ্নোত্তরের পর হানানা বিদায় নিল। মির্জা মাথা নিচু করে কি যেন চিন্তা করছে। হুমায়ুন বলল ‘দাদু কেমন দেখলে? মির্জা বলল ‘আরে বাপরে বিদেশি মাল বলে মনে হচ্ছে, জিনিসটা বাগালি কোত্থেকে? – আরে দুঃ, কৃষকের এলাকা এই ময়মনসিংহে তুমি বিদেশি মাল পাবে কোথায়? জানো না এটা আধুনিক যুগ এখন দেশেই বিদেশি মাল উৎপন্ন হয়। - আগে তো জিনিসটার পরিচয় দিবি। - ওঃ সে আমার শ্যালিকা। - তাই নাকি, তাহলে তো তোরটাও খানদানি মাল। - আছে, চলে আর কি। - আচ্ছা আমার জন্য একটা ব্যবস্থা করা যায় না? - আরে দাদু, এজন্যই তো তোমাকে বোকা বলি। আসলে তুমি মির্জা হওয়ার যোগ্য না, আমার মির্জা হওয়া দরকার ছিল। আরে আগে এটাকে নিয়ে গিয়ে তোমার নাতির নাক বিঁধাও, তখন আমার শালিগুলি ওর দখলে চলে যাবে। আর তখন তোমার নাতিকে বললেই তো ল্যাঠা চোকে যায়, আমাকে তেল মারছ কেন। মির্জা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ‘হুম ঠিকই বলেছিস।

খাওয়া-দাওয়ার পর হুমায়ূন সবাইকে ডেকে নিয়ে বসল। বিভিন্ন আলাপের পর বলল ‘দাদু আর খালাম্মা, আমি জানি আপনারা গালিবকে নিয়ে কষ্টে আছেন। সেই কষ্ট লাঘবের জন্য আমি এই পদক্ষেপ নিয়েছি। আপনারা এই শহরের শ্রেষ্ঠ পাঁচজন সুন্দরী মেয়েকে নির্বাচন করলে নিশ্চয়ই হানানা তার মধ্যে একজন হবে। তাছাড়া মেধা ও স্বভাব চরিত্রের দিক থেকে সে অনন্য। আপনাদের পারিবারিক গৌরবের প্রতি বিবেচনা করেই আমি ওকে আপনাদের জন্য নির্বাচন করেছি। এখন মেয়ে যদি আপনাদের পসন্দ হয়ে থাকে তাহলে নিজ দায়িত্বে আপনাদের ছেলের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। আমি ওর দুলাভাই এবং অভিভাবক, আমি ওকে আপনাদের হাতে সমর্পণ করলাম।

সুলতানা উচ্ছ্বসিত আবেগে হানানাকে জড়িয়ে ধরে তার মাকে বলল ‘আজ থেকে ও আপনার মেয়ে নয় আমার মেয়ে। চিন্তা করবেন না, আমি ওর দায়িত্ব নিলাম। মির্জা বলল, ‘হাঁ এই যে তোকে পুত্রবধু দিলাম, এখন থেকে আর আমার সাথে ঘ্যানর ঘ্যানর করবি না। তারপর হানানার মাকে বলল, আসলে সুলতানা সবসময় একা থাকে, তার একজন সঙ্গি প্রয়োজন। বিয়ের আগ পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে ওকে আমার গাড়ি করে নিয়ে আসবে আবার বিকালে আপনার বাসায় পৌঁছে দিবে’ বলে তারা বেরিয়ে পড়ল।

বাসায় পৌঁছে সুলতানা হানানাকে তার জীবনের করুন ইতিহাস শোনালেন, শুনে মেয়েটার মায়া হল। বিকালে মির্জার গাড়িতে তাকে বাসায় পৌঁছে দেয়া হল। এরপর থেকে প্রতিদিন সকালে মির্জার গাড়ি গিয়ে তাকে নিয়ে আসে আবার বিকালে বাসায় পৌঁছে দেয়। কোন দিন হানানা আসতে না চাইলে সুলতানা কল করে বুঝিয়ে বা ধমকিয়ে নিয়ে আসে। এভাবে ধীরে ধীরে তাদের প্রতি হানানার মনেও মায়া জন্মে গেল। সে এসে হবু শ্বাশুরির সাথে গল্প গুজব করে, রান্না বান্না ও অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করে। এভাবেই ধীরে ধীরে সে তাদের মধ্যে একাকার হয়ে যেতে থাকে।

হুমায়ুন জাফর ও হাবিবকে ডেকে এনে বলল ‘হানানা সবচাইতে ভাগ্যবান। সে শীঘ্রই মির্জা বংশের বউ হতে যাচ্ছে কিন্তু বড়টাকে রেখে তো আর ছোটটাকে বিয়ে দেয়া যাবে না, সুহানার কি ব্যবস্থা করা যায়? জাফর বলল ‘আচ্ছা তোমাদের কি মনে আছে সমিতিতে শাফায়েত উল্লাহ নামে একটা ছেলে ছিলো, সে আমাদের খুব ভক্ত ছিল। সবসময় আমাদের সাথে লেগে থাকত। ছেলেটার সাথে আলাপ করে দেখা যেতে পারে। সে আনন্দমোহন কলেজ থেকে অর্থনিতিতে মাস্টার্স করেছে। তার পরিবার অবশ্য দরিদ্র, কিন্তু ছেলেটা যোগ্য।

হাবিব বললো ‘হা সঠিক চয়েস, ছেলেটাও ভদ্র এবং শান্তশিষ্ট। হুমায়ুন বললো ‘ঠিক আছে, জাফর তুমি ওকে ডেকে আনবে, আমার বাসায় বসে আলাপ করবো। দুদিন পর শাফায়েতকে নিয়ে তারা সবাই বসলো। শাফায়েত প্রস্তাব শুনে লাফিয়ে উঠে বলল ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। আমি তো এটাই চাইছিলাম, আসলে আমি আপনাদেরকে ভালোবাসি। আমি চাইছিলাম আপনাদের অনেকগুলি শালিকা থেকে কোন একটাকে বিয়ে করে আপনাদের দলে ভিড়ে যাব। তাছাড়া মেয়েগুলিও সুন্দরী, ওদেরকে দেখলেই আমার মনে কুছকুছ হোতা হ্যাঁয়। সবাই হেসে উঠল। কয়েকদিন পর তাদের বিয়ে হয়ে গেল।

হানানা প্রথম প্রথম আসতে চাইত না কিন্তু প্রৌঢ়া মহিলাটির দুঃখে তার করুনা হয়। সুলতানার সান্তনার জন্য আসতে থাকে কিন্তু তাদের বিত্ত-বৈভব ও প্রতাপ-প্রতিপত্তি দেখে সে আকৃষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া গালিব হল এক নন্দিত পুরুষ, সুদর্শন, দির্ঘাঙ্গি, সুঠামদেহি, উচ্চ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন যুবক ও ডাক্তার। হানানা স্বপ্ন দেখে ছোট্ট একটা নিড়ে দুটি পঙ্খী বাসা বেধেছে, পঙ্খিটা সারাদিন বাইরে ঘুরে ফিরে রাতে পঙ্খিনির কাছে ফিরে আসে। পঙ্খীনিকে ডানায় জড়িয়ে ধরে, চঞ্চু বুলিয়ে গলায় সুরসুরি দেয়, আদর করে। তারপর সারারাত গলাগলি করে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকে। পঙ্খিটার নাম মির্জা গালিব আর পঙ্খিনিটার নাম হানানা, তার চোখ দুটি স্বপ্নময় হয়ে উঠে।

সে অগোচরে গালিবের রুমে আনা-গুনা শুরু করল। তার বিক্ষিপ্ত বইপত্র কাপড়-চোপড় ও বিছানাপত্র গুছিয়ে রাখে, রুমটা সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর পরিপাটি করে তোলে। কোনদিন হয়তো গালিবের সাথে রুমে দেখা হয়ে যায়, তখন গালিব তাকে ধমকায়, অপমান করে ‘এই মেয়ে আমার জিনিসপত্র ছোবে না, আমার ঘরে আসবে না। কিন্তু তাতে হানানা মনঃক্ষুন্ন হয়না। সে প্রিয়জনের মন পাওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে, তার ঘনিষ্ঠ হবার অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকে।

কখনো সুলতানা হানানাকে সাজিয়ে গুজিয়ে গালিবের সামনে নিয়ে এসে বলে ‘এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি সংসার করতে চাই তুই কি বলিস? গালির কোন উত্তর দেয় না, শুধু উষ্মা প্রকাশ করে চলে যায়। মাও নাছোর বান্দা, সে হানানার বিষয়ে ছেলের সাথে আলাপ করে, অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে কিন্তু ছেলের কোন ভাবান্তর হয় না। একদিন মা ছেলেকে চেপে ধরল। ছেলে উত্তর দিল যদি এমন বাড়াবাড়ি করতে থাক তাহলে কিন্তু আমাকে হারাবে। আমি বাসা ছেড়ে চলে যাব। ছেলের কথা শুনে মা সারাদিন কাঁদল, তা দেখে হানানার মায়া হলো। সে গালিবকে জয় করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নামলো। কিন্তু গালিবের একটা সমস্যা, সে কখনো হানানার দিকে ফিরে তাকায় না। বুঝা যায় সে মেয়েটির রূপের আগুন থেকে নিরাপদ থাকতে চাইছে।



হানানা যেমনি সুন্দরী তেমনি মেধাবী বুদ্ধিমতি স্থিতধী ও রাশভারী। সে সাধারণত ভুল করে না কিন্তু সেদিন ভুলটা করে বসলো- যে ভুল তার জন্য শাপে বর হয়ে দেখা দিল। গালিব বাহির থেকে এসে তার রুমে ঢুকেছে, হানানাও ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। দরজায় গিয়ে দেখল গালিব খাটের পাশে বসে পায়ের মোজা খুলছে। সে বেশি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে সীমালঙ্ঘন করল, এগিয়ে গিয়ে পায়ের কাছে বসে মোজা খুলে দেয়ার জন্য পায়ে হাত দিল। আর অমনি গালিব অনিচ্ছাবশত তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েই চেঁচিয়ে উঠলো ‘এই নষ্টা মেয়ে ছেলে, তোকে না নিষেধ করেছি আমার রুমে ঢুকতে। তোর এত বড় সাহস আমার গায়ে হাত বুলাস’ ঝোঁকের বশে বলেই সে অনুশোচনায় চুপসে গেল।

হানানার চোখ থেকে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, সে আস্তে আস্তে উঠে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা অনুশোচনায় অবনত মস্তক গালিবের দিকে সেই ভাবে তাকালো- যেভাবে কোন বিতাড়িত গোলাম তার একমাত্র অবলম্বন মনিবের দিকে তাকায়। তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। সে আশা করেছিল এই কর্মটির জন্য গালিব তাকে জড়িয়ে ধরবে, আদর করবে, মাফ চাইবে, বুকে ঠাই দিবে। কিন্তু গালিব কিছুই করল না। দুঃখে অভিমানে তার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে, তার মনে হল সে অভিশপ্ত ঘৃণিত, নারী জন্মটাই পৃথিবীর অভিশাপ, এরা তামাম সৃষ্টির ঘৃণার পাত্রী। পৃথিবীর সকল লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও বঞ্চনা ভোগ করার জন্য আর পুরুষের সেবা যত্ন ও ভোগের সামগ্রী হওয়ার জন্যই পৃথিবীতে নারীর আগমন।

নিজের ওপর তার ঘৃনা ধরে গেল, জীবন জীবনের উপর বোঝা হয়ে গেল। সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো, অনেক চিন্তা-ভাবনা করল। জীবনে একমাত্র যাকে চেয়েছিলো তাকে তো আর পাওয়া যাবে না কাজেই আর বেঁচে থেকে লাভ কি, সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু এ সিদ্ধান্তটাও স্তির হলো না, কারণ তার ছোট অনেকগুলি বোন, সে আত্মহত্যা করলে তো ওদের বিয়ে হবে না, তাদের পরিবারটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। অগত্যা সে চিরকুমারীত্বের সিদ্ধান্ত নিল। কোন স্কুলে মাস্টারি নিয়ে বাচ্চাদের সাথে তার অভিশপ্ত জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেবে। অনিরুদ্ধ কান্না রোধ করে সে বিলাসবহুল বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল, শেষ দেখা দেখল। তারপর সুলতানার কাছে গিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল।

দুতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পিছন ফিরে তাকাল, যদি তার প্রিয়জন তাকে ডাক দেয় কিন্তু না, শুধু তার রুমের খোলা দরজা দেখা গেল। তার আত্মাটা ছ্যাঁত করে উঠল, ফিরে গিয়ে প্রিয়কে অভিমানের সাথে দুয়েকটি কথা শুনিয়ে আসতে মন চাইলো কিন্তু বিবেক বাধা দিল, সে গুমড়ে কেদে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে নামতে লাগল, তার মনে হলো যেন সে নিজের অধিকার নিজের সাম্রাজ্য ফেলে চলে যাচ্ছে। অজ্ঞাতসারে তার পা উল্টো দিকে ঘুরে গেল। গজেন্দ্র গমনে গিয়ে গালিবের সামনে দাঁড়াল, যেভাবে কোন নির্যাতিত গোলাম কৈফিয়তের চেহারা নিয়ে মালিকের সামনে দাঁড়ায়।

তারপর ধরা গলায় বলল, ‘ডাক্তার সাহেব আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, অনেক বিরক্ত করেছি মাফ করে দিয়েন। আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করতে আসবো না’ বলে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো ‘আসলে কি জানেন ডাক্তার, আমরা মেয়েরা হলাম পৃথিবীর মূর্তিমান অভিশাপ। এই পৃথিবী কোন দিন আমাদেরকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, পুর্বেও না এখনো না, এমন কি প্রানী হিসেবেও স্বীকৃতি দিতে নারাজ। বাইবেলে বলা হয়েছে নারীকে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই দিন সুসভ্য রোমকরা সিদ্ধান্ত দিল নারীর প্রাণ নেই। কারণ তার সৃষ্টি হাড় থেকে, আর হাড় হলো একটা জড় বস্তু। আজ পর্যন্ত তামাম খৃষ্ট ইউরোপ এই মতবাদে বিশ্বাসী। নারীর প্রাণ নেই, এজন্য সেই আদি কাল থেকে ভারতবর্ষে নারীকে স্বামীর সাথে চিতায় যেতে হতো এখনো কোনো কোনো অঞ্চলে এই রেওয়াজ বিদ্যমান। চিনেও নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হতো না। সমগ্র বিশ্বে নারীর অবস্থান একই ছিল।

নারীকে প্রাণী হিসেবে স্বীকৃতি দিত না ঠিকই কিন্তু স্বার্থবাদী পুরুষ নারীকে ভোগ করার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন কলা কৌশল উদ্ভাবন করেছে। সভ্যতার সূচনা লগ্নে নারীকে বাইরে বের হতে দেওয়া হতো না, সূর্যের দৃষ্টিপথে আসার অনুমতি তাদের ছিল না। এসব মেয়েদেরকে বলা হতো অসূর্যস্পর্শা কন্যা, বাইজেনটিয়াম ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সভ্যতায় এসব মেয়েদেরকে এলিট গণ্য করা হতো এবং উচ্চমূল্য হাকা হতো। এদেরকে ঘরে আটকে রেখে ভোগের ষোল কলা পূর্ণ করা হতো। কিন্তু এখন সভ্যতার পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের রুচিবোধ উন্নত হয়েছে। তারা সর্বক্ষেত্রে সর্বময় নারীকে ভোগ করতে চাইল, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নিরিক্ষে সে নারীকে পাশে কামনা করল। এজন্যই নারীকে ঘর থেকে টেনে বের করে পুরুষের বিশাল কর্মযজ্ঞে তার সঙ্গী করে দেয়া হলো, ভোগের জন্য নারীকে সার্বজনীন ও সর্বময় করে তোলা হলো।

ডাক্তার আমরা হলাম এই পৃথিবীর অবাঞ্চিত, কেউ আমাদেরকে চায় না। কোন পিতা- মাতাই আমাদের জন্মের জন্য সাদর অভ্যর্থনা জানায় না। আর এজন্যই প্রাচীন আরবে জন্মদাতা বাবারা আমাদেরকে মারারও প্রয়োজন বোধ করত না, সরাসরি মাটির নিচে জীবন্ত পুঁতে ফেলত। কিন্তু এখন সভ্যতার পরিবর্তন হয়েছে, মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক উন্নতি করেছে। কাজেই জন্মদাতা বাবারা এখন আর আমাদেরকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে চোখ মেলে তাকাবার সুযোগ দেয় না, তার আগেই মাতৃগর্ভে কন্যা ভ্রূণ শনাক্ত করে আমাদেরকে রিটার্ন পাঠিয়ে দেয় সেখানে- যেখান থেকে আমরা আসি। এজন্য মৃত্যুকে সঙ্গী করেই আমাদেরকে পৃথিবীর পথে রওয়ানা হতে হয়।

ডাক্তার, মাতৃগর্ভ থেকে আমরা সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ক্রমে রক্ষা পেয়ে গেলেও আমাদের জন্মের সময় পৃথিবী আমাদের জন্য গোলাপ বকুল আর জুঁই চামেলীর ডালি মেলে ধরে না, আমরা জীবন্ত অভিশাপ হয়ে জন্ম নেই। জন্মের পর আমাদের মুখ দেখে আমাদের পিতা মাতার মুখে হাসি ফোটে না, তাদের মুখ কালো হয়ে যায়। এখানেও আমাদের অনেককে মৃত্যুর শিকার হতে হয়। কিন্তু এখান থেকে বেঁচে গেলে এরপর থেকেই শুরু হয় আমাদের বঞ্চনা। আমরা ভাইয়ের তুলনায় নিম্নতর প্রাণী বলে গণ্য হই, ভাই বয়সে ছোট হলেও আমাদেরকে মারে, হেয়জ্ঞান করে। মা বাবা ছেলেদেরকে বেশি খাওয়ায়, বেশি আদর যত্ন করে, আমাদের ভাগ্যে জুটে শুধু বিড়ালের মত পাতিলের তলানি। এভাবেই আমরা মা-বাবার গৃহে বেড়ে উঠি।

তারপর যখন আমরা শিক্ষা বা অন্য প্রয়োজনে বাইরে যাওয়া শুরু করি তখনই শুরু হয় আমাদের উপর ইভটিজিং ধর্ষণ নির্যাতন। তখন এই পৃথিবী পৃষ্ঠ আমাদের জন্য বিষিয়ে তোলা হয়, জীবন বিষময় করে দেয়া হয়। তখন আমাদের অনেককে জীবন দিতে হয়। এ সময়টাতে পুরুষ আমাদেরকে শুধু ভোগ্য উপকরণ হিসাবে দেখে, তারা আমাদেরকে ফুসলায়, লোভ দেখায়, প্রতারণা করে পদস্খলন ঘটায়। তারপর আমাদের উচ্ছিষ্ট দেহটা কলার খোসার মতো ভাগাড়ে ছুড়ে মারে। এখানে পুরুষ প্রমাণ করে যে, নারীর ইচ্ছা ও ব্যাক্তি স্বাধীনতা নাই, সে শুধু একটা ভোগের সামগ্রি। পুরুষের ভোগ্য পণ্য হওয়াই নারী জন্মের লক্ষ্য। এই যে আপনারা চিরকুমার সমিতি গঠন করেছেন এই সমিতি যদি আমরা মেয়েরা করতাম তাহলে আপনারাই আমাদেরকে বারবনিতা বেশ্যা আখ্যা দিয়ে মাথা কামিয়ে মুখে চুনকালি মেখে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাতেন।

ডাক্তার মেয়েদের ক্ষেত্রে মানবতা মনুষ্যত্ব ন্যায়বিচার ইনসাফ ও ইনসানিয়াত থাকতে নেই, এটা শুধু পুরুষের জন্য বরাদ্দ। আমরা হত্যা ধর্ষণ ইভটিজিং ইত্যাদি থেকে জীবনে বেঁচে গেলে বিয়ের পিড়িতে বসার ভাগ্য হয়। তখন আমরা চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর দুটি হাত ধরে নতুন সংসারে যাই, স্বামীর পায়ের তলায় আশ্রয় নেই। তারপর আমাদের হাতে মেহেদির রং মুছে যাবার আগেই স্বামীর হাতের দশটি আঙ্গুলের ছাপ গলায় ধারণ করে যখন আমাদেরকে চিতায় বা গোরুস্তানে গিয়ে মৃত্তিকা বাসর রচনা করতে হয় তখন কোথায় থাকে মানবতা কোথায় থাকে ইনসাফ? জবাব দিন ডাক্তার জবাব দিন।

আর যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই তাহলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের জীবন বিপন্ন করে স্বামীর সংসারে উন্নতি করি, নিজের অস্তিত্বের সকল শ্রম ও সাধনা ব্যয় করে একটি সুখের স্বর্গ রচনা করি। তারপর স্বামী যখন তিন কথা বলে পাছায় লাথি মেরে বাড়ী থেকে বের করে দেয়, আমাদের শ্রমে গড়া সংসারে আর আমাদের কোন অধিকার থাকে না তখন কোথায় থাকে ইনসানিয়াত কোথায় থাকে ইনসাফ? জবাব দিন ডাক্তার জবাব দিন।

মেয়েরা কত অত্যাচার সহ্য করে স্বামীর ঘর করে। গ্রামাঞ্চলে মুর্খ লোকদের মধ্যে দেখা যায় স্বামী হালের লাঠি দিয়ে, মুগুর দিয়ে পিটিয়ে স্ত্রীর হাত, পা, পাজরের হাড় ভেঙ্গে ফেলে, মাথা ফাটিয়ে দেয়, থাবড়িয়ে থাবড়িয়ে কান ঠসা করে দেয়। বিড়ালের মত ছেঁচা মেরে নাক থেতলে দেয়, গরুর চাড়ির পানিতে মুখ মাথা ঠেসে ধরে, চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে রাস্তায় নিয়ে লাথাতে থাকে আর বলতে থাকে, ‘যা, তোর বাপের বাড়ি যা’। তখন সেই সতী-সাধ্বী-লক্ষীরা স্বামীর দু’টি পা জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে, ‘আমাকে এই দু’টি পায়ের উপর পড়ে থেকে মরতে দাও। আমি তোমার ভাত কাপড় চাই না, আমি বাড়ি থেকে এনে খাব, হাস-মুরগী, গরু-ছাগল রেখে খাব, বাদীর মত তোমার সব কাজ করে দেব তবুও আমাকে তোমার গোয়ালের কোণায় একটু ঠাই দাও, তোমার বারান্দায় একটু আশ্রয় দাও, আমি তোমার পায়ের উপর পরে মরব তবুও তোমাকে ছেড়ে যেতে পারব না’। আবার শিক্ষিত সমাজের মেয়েরাও কত অত্যাচার সহ্য করে। কত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার মেয়েদের উপর স্বামী অত্যাচার করে, সিগারেটে সুখটান মেরে স্ত্রীর শরীরে চেপে ধরে, মদের বোতল মুখে ঠেসে ধরে, গায়ে পিঠে গরম ইস্ত্রি চালিয়ে দেয়, কারেন্টের চ্যাকা দেয়, স্ত্রীর সামনে অন্য মেয়েদের নিয়ে কাতুকুতু করে, তবুও এসব বিদুষী মহীয়সীরা স্বামীর ঘর ছেড়ে যেতে চায় না। এরপরেও তাদেরকে স্বামীর ঘর ছেড়ে যেতে হয়, তবে পায়ে হেঁটে নয় খাটিয়ায় শুয়ে সাদা শাড়ি পরে।

ভাগ্যগুণে স্বামীর ঘরে স্থায়ী হয়ে গেলে আমরা নিজের জীবন বিপন্ন করে আজরাইলের সাথে পাঞ্জা নড়ে সন্তান জন্ম দেই, তারপর নিজের রক্ত কলিজা খাইয়ে সন্তানকে পৃথিবীর পথে হাঁটতে শিখাই, অনেক বড় স্বপ্ন দেখি সন্তান আমার সাম্রাজ্য আমার। কিন্তু সেই সন্তান যখন বড় হয়ে একমুঠো ভাতের জন্য মায়ের চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গোয়ালে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে বা লাথি মারতে মারতে নিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখে তখন কোথায় থাকে খোদা আর কোথায় থাকে পৃথিবীর বিবেক? জবাব দিন ডাক্তার জবাব দিন। এইখানে সভ্যতার ললাটে রাত্রি নামে, এইখানে ইনসাফের বাণী কেঁদে ফিরে নিরবে নিভৃতে, এইখানে মানবতার চিতা জ্বলে, এইখানে মনুষ্যত্বের সমাধি রচিত হয় ডাক্তার।

লজ্জা ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় হানানার দেহটা প্রবল বাত্যা প্রবাহে বৃক্ষ পত্রের ন্যায় কাঁপছে, অক্ষিদ্বয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নারী জন্মের প্রতি আজন্মের পুঞ্জিভুত ক্রোধ ক্ষোভ ও ঘৃণার বিষবাষ্প সে উদগার করে চলছে, ‘ডাক্তার কেন এই অনাচার, কেন এত বৈষম্য? আমরা তো পৃথিবীতে আসার জন্য কারো কাছে আবেদন নিবেদন করি না, কোনো পুরুষই তো আমাদেরকে পৃথিবীতে আনে। আমরা তো কারো কন্যা কারো বোন কারো স্ত্রী কারো মা। আমাদের সাথে যখন পশুত্বের আচরন করা হয় তখন কি ঐ পুরুষরা কষ্ট পায় না, তাদের মনে আঘাত লাগে না?

নজরুল আমাদের সম্পর্কেই তার ‘নারী’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘শুন মর্ত্যের জীব, অন্যকে যত করিবে পীড়ন নিজে হবে তত ক্লীব। কাজেই প্রশ্ন জাগে, আমাদেরকে যখন পীড়ন করা হয় তখন পুরুষরা কতটুকু সুখে থাকে? কারণ আমরা তো পুরুষেরই মা বোন স্ত্রী কন্যা, আমাদেরকে ছাড়া তো কোন পুরুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। কারন আমরাই পুরুষকে পৃথিবীতে আনি, আমরাই তাদের ঘর সংসারের জ্বালানি হয়ে তাদের সুখের স্বর্গ রচনা করে দেই, আমরা কন্যা হয়ে পুরুষের মরুময় জীবনকে মরুদ্যানে রূপান্তরিত করি। কাজেই নারী যদি এতই অবাঞ্চিত হয়, পুরুষের লালসার পাত্রী আর ভোগের উপকরণ হয়, পৃথিবীর জন্য অভিশাপ হয় তাহলে আমার দাবি, কোনো পুরুষ যেন কন্যা সন্তান পৃথিবীতে না আনে, আর যারা আছে তাদেরকেও যেন মেরে ফেলা হয়। তাহলেই বুঝা যাবে পুরুষ আর পুরুষতান্ত্রিক এই পৃথিবীর অস্তিত্ব কোথায় গিয়ে ঠেকে।



এরপর হানানা চোখ মুছলো, বিষন্ন কন্ঠে বলল ‘ডাক্তার মনের দুঃখে অনেক কথা বলে ফেললাম মাপ করবেন। আসলে কি জানেন আমরা মেয়েরা দাসি হয়ে পুরুষের দাসত্ব করার জন্য জন্মাই, তারপর কেউ পায়ে ঠাই দিলে আমরা রানী নইলে বর্জ্য। জন্মের দাবি অনুযায়ী আপনার কাছে এসেছিলাম আপনার পায়ে আশ্রয় নিতে, কিন্তু লাথি খেলাম এজন্য যে আমি নারী। আর লাথি মারাটা আপনার জন্মগত অধিকার, কারণ আপনি পুরুষ। বস্তুত আপনাকে মনে প্রানে হৃদয়ের রাজা হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম কিন্তু সেই ভাগ্য তো হল না। অগত্যা আপনার স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবো, কারণ আমরা বারবণিতা নই যে একজন ছেড়ে অন্যজন ধরব। কাজেই জীবনের সম্বল হিসাবে আপনার পায়ের একটু ধুলো নিয়ে যাই’ বলে সে কেঁদে উঠল। তারপর এগিয়ে গিয়ে সেলাম করার জন্য পায়ের কাছে বসল।

গালিব ততক্ষণে পাথরের মতো জমে গেছে। তার দেহটা রিখটার স্কেলে অষ্টম মাত্রার ভূ-কম্পের মতো থরথর করে কেঁপে উঠল, তারপর কাঁপতে কাঁপতে হানানার দেহের উপর গড়িয়ে পড়ল। এতক্ষণের পুঞ্জীভূত অনুশোচনা ও দহন যন্ত্রনা সহসা বিস্ফোরিত হলো। সে বিকট চিৎকার করে হানানাকে জড়িয়ে ধরল, ‘কেন তুমি এভাবে আমাকে জবাই করলে, কেন চুরির উল্টা পিঠে জবাই করলে। তুমি কি জানো না এভাবে কোন শিক্ষিত বিবেকবান পুরুষকে বললে সে বেঁচে থাকে না, মারা যায় সে মারা যায়, তার আত্নার মৃত্যু ঘটে’ বলতে বলতে সে প্রচন্ড আবেগে হানানাকে বুকে চেপে ধরল যেন আমের আটির মত চিপে ফেলছে। তারপর পাগলের মত চুমুতে লাগলো।

কান্নার আওয়াজ শুনে সুলতানা দৌড়ে এসে দুজনকে জড়িয়ে ধরে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো ‘কি হয়েছে কি হয়েছে? ‘ওকে আমি লাথি মেরেছি মা’ বলে গালিব হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। সুলতানাও কেঁদে উঠল, কেন মারলি, এমন ফেরেশতার মতো মেয়েটাকে কেন অপমান করলি? গালিব মায়ের হাত ধরে বলল ‘মা যা করার তাড়াতাড়ি করো, ওকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি মা অনেক অপমান করেছি তুমি তার পুরস্কার দাও। তোমার তো টাকা পয়সার অভাব নাই, তোমার পুত্রবধুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দাও’ বলে সে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।

মির্জা বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারীর বিয়ে, ময়মনসিংহের সর্বত্র হৈ চৈ পড়ে গেল। মির্জা আলমগীর পুত্রের বিয়ের বহু বছর পর ফের একবার পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য প্রকাশের মওকা পেল। তিনশ গরু ছয়শ খাসি কয়েক হাজার মুরগি দিয়ে তিনি একমাত্র নাতির বিয়ের আয়োজন করলেন। গোটা শহরের মানুষ খাওয়া দাওয়া করলো, গ্রাম থেকে মানুষ খাওয়া উপলক্ষে আগমন করল, কয়েকদিন পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া চলল। বিয়ে উপলক্ষে বিশাল ভবনে রঙ বেরঙ্গের লাইটিং করা হলো। চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা, বহুমূল্য আয়োজন, জমকালো পোশাক-পরিচ্ছদ অভ্যাগতদের অতীত দিনের রাজা বাদশাদের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিল।

সুপরিসর বাসর ঘরে বহুমূল্য ফার্নিচার, বৃত্তাকার পালঙ্কে জরির ফরাস, পালংকের চারধারে সোনার চেইনের ঝালর দেওয়া, তার উপর আপাদমস্তক সোনায় মুড়িয়ে বসে আছে রাজকুমারী। চাকর-চাকরানীরা রাজকুমারকে ঘরে দিয়ে গেল। গালিব সোনার ঝালর সরিয়ে ভিতরে দৃষ্টিপাত করলো, তার মনে হল বিছানার উপর সোনা ও হীরা মুক্তার একটা স্তুপ পড়ে আছে। হানানা পা থেকে মাথা পর্যন্ত অলংকারে মোড়ানো, অলংকারে তার শরীর ঢেকে গেছে কাপড় আচ্ছাদিত হয়ে গেছে।

সে নববধূর কোলের উপর শুয়ে পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ‘আমাকে জড়িয়ে ধরো, একটু আদর কর, সেদিন তোমার বক্তব্যে আমার বুকটা পোড়ে ভস্ম হয়ে গেছে’ বলে সে স্ত্রীর হাতটা নিয়ে বুকে ঘষতে লাগল ‘আসলে কি জানো তোমার তৎপরতায় আমি তোমার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন তোমার থেকে বাঁচার জন্য, নিজের শপৎ ও কুমারত্ব রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তোমার বক্তব্য এটমের মত আমার সকল চিন্তা চেতনা মন-মানসিকতা ছিন্নভিন্ন করে দিল। তুমি যে এত বড় দার্শনিক আগে তা কল্পনাও করতে পারিনি।

আসল ব্যাপারটা হল, পৃথিবীতে যে যত বেশি দুর্বল সে তত বেশি শক্তিশালী। দেখ আগুনের সামনে পানি কিছুই না, অথচ এই পানি আগুণকে অস্তিত্বহীন করে দেয়। আবার পানির আকার আয়তন আছে কিন্তু বাতাসের কিছুই নেই, অথচ এই বাতাস যখন মহাসমুদ্রের বুকে মুহুর্মুহু আঘাত হানে তখন পানির মরণ আর্তনাদ বহু দূর থেকে শুনা যায়। তেমনি একটা শিশু এতই দুর্বল যে, সে নিজের মনের ভাবটা পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারে না কিন্তু যখনই সে ঠা ঠা শব্দে কান্না জুড়ে দেয় তখন মায়ের হৃদপিন্ডে কাঁপন ধরে যায়। তার কান্নার প্রতিটা রেশ মায়ের কলিজায় মুহুর্মুহু হাতুড়ি পেটাতে থাকে। তখন মা যত ব্যস্তই থাকুক পাগলের মত সন্তানের কাছে ছুটে আসে। বস্তুত প্রত্যেক দুর্বলের বীরত্ব প্রকাশের বা অন্যকে ঘায়েল করার একেকটা অস্ত্র আছে। যেমন শিশুর অস্ত্র হলো কান্না, এই অস্ত্র দিয়ে সে যে কাউকে ঘায়েল করে ফেলে।

তদ্রুপ নারীর বীরত্ব প্রকাশের অস্ত্র হলো চোখের জল আর অসহায়ত্বের ভাষা। এই অস্ত্র দিয়ে সে যে কোন শক্তিমান বীর মহাবীরকে ধরাশায়ী করে ফেলে- যা কখনো শক্তি দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। সেদিনের ঐ ঘটনার জন্য যদি তুমি আমাকে গালি দিতে বা হুমকি দিতে তাহলে আমি বশ্যতা তো দূরের কথা তোমার শত্রু হয়ে যেতাম। কিন্তু তুমি যথার্থ অস্রবান নিক্ষেপ করে আমার বুকটা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলে। ফলে আমি তোমার দাস হয়ে গেলাম, এখন নাও তোমার দাসকে বুঝে নাও।

‘ছিঃ কি কয় না কয়’ বলে হানানা দ্রুত স্বামীর মুখ চেপে ধরল। স্বামী বলল ‘কারণটা কি জানো, যে পুরুষ- যার মধ্যে পৌরুষ আছে সে কখনো নারীর অশ্রু ও নারীর অসহায়ত্বের ভাষা সহ্য করতে পারে না। তখন সে ওই নারীর কল্যাণের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখে। কিন্তু যারা কাপুরুষ পশু এরা দুর্বলের ভাষা বুঝে না। তোমার বক্তব্য শোনার পর থেকে আমি একটা শপথ করেছি, ওইসব বার ভাতারি ও তাদের সন্তান- যারা নিরীহ অসহায় মেয়েদের ইভটিজিং করে ধর্ষণ করে নির্যাতন করে ওদের ধ্বংস করবো।

কারণ ওইসব বার ভাতারীরা ভাগারে গিয়ে জরায়ুতে কুত্তার পানি ধারণ করে কুত্তার বাচ্চা জন্মায়, তারপর এই কুকুরছানা গুলিকে শিখায় না যে, চলার পথে যে নারীটি তোমার চোখের সামনে পড়বে সে যদি বয়স্কা হয় তাহলে তোমার মা, যদি যুবতী হয় তাহলে তোমার বোন, যদি শিশু হয় তাহলে তোমার কন্যা। পারিবারিক শিক্ষাহীন সেই বারোভাতারীর সন্তানরা সভ্যতার আঁচল কামড়ে ধরে, মাতৃ জাতিকে রক্তাক্ত করে। কাজেই আমার শপৎ হলো, ওই কুত্তার বাচ্চাদের সাথে সাথে ঐ বারভাতারিদেরও পৃথিবীর নিঃশ্বাস হারাম করে তুলবো- যারা সন্তান জন্ম দিয়ে উপযুক্ত শিক্ষা দেয় না। হানানা স্বামীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল ‘আজ এসব কথা থাক। গালিব মুচকি হেসে স্ত্রীর গুলবদনের দিকে তাকাল, নিশ্বাস গরম হল, তারপর তার গোলাপ রাঙা কপোল দেশে ওষ্ঠাধর চেপে ধরল।



প্রত্যেক বলের একটা বিপরিত বল বা প্রতিক্রিয়া আছে। চিরকুমাররা আগে বিয়ে তো করবেই না এমনকি মেয়েদের প্রতি ফিরেও তাকাতো না। কিন্তু বিয়ের পর আর তাদেরকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, স্ত্রীর আঁচল ছাড়ে না সারাক্ষন বউয়ের কোমরের গোড়ায় বসে থাকে। মির্জা গালিব সেই যে বাসর ঘরে ঢুকেছিল এরপর সে ঘর থেকে খুব কমই বেড়িয়েছে। বুদ্ধিমতী হানানা এ অবস্থা মেনে নিতে পারলো না। সে বলল ‘তুমি ডাক্তার, এভাবে বসে থাকা চলবে না, হয় চাকরি কর নয় মানব সেবা কর। কিন্তু তার কথা স্বামীর কানে ঢুকে না। একদিন সে বলল ‘আমি তো অযোগ্য অথর্ব দেখে বিয়ে করিনি, আমি পরিবারের ভাত খাব না স্বামীর উপার্জন চাই। তবুও স্বামীর ভাবান্তর নেই। তারপর সে বলল ‘ঠিক আছে আমি পরিবারের ভাত খাব না যেদিন স্বামীর উপার্জন পাব সেদিন খাব।

দুপুরে সবাই খেতে বসেছে কিন্তু হানানা খাচ্ছে না। সুলতানা তাকে মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করেছে, তুই বলে সম্বোধন করে। সে বলল, ‘কি ব্যাপার তুই খাচ্ছিস না যে? হানানা বলল ‘আমি খাব না। - কেন? - কেনর উত্তর আমি জানি না, ওকে জিজ্ঞেস করেন। গালিব বলল ‘সে তোমাদের ভাত খাবে না, আমি রোজগার করলে খাবে। বউয়ের বুদ্ধিমত্তা দেখে শাশুড়ির মনটা ভরে গেল। সে মধ্যস্ততায় নামল ‘আচ্ছা ঠিক আছে, চাকরি-বাকরি জুটাতে গেলেও তো সময় লাগবে, ওকে কিছুদিন সময় দে। হানানা বলল ‘কত সময়? শ্বাশুড়ি বললো ‘মাস ছয়েক। বউ বলল ‘এত সময় দেয়া যাবে না তিন মাস সময় দিলাম। এবার গালিব বুঝতে পারল কিছু একটা করা দরকার, আর বসে থাকলে চলছে না কিন্তু খুব একটা গরজ নাই।

মাস তিনেক পর মির্জা পরিবারে আনন্দের বন্যা ছুটে গেলো। শহরের মিষ্টির দোকান গুলি খালি হয়ে মির্জা বাড়িতে আসতে লাগল আর বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাসায় ছড়িয়ে পড়ল। মির্জা বংশের নতুন উত্তরাধিকারী আসছে। শাশুড়ির পা চঞ্চল হয়ে উঠল কিন্তু বৌয়ের পা খাটে উঠল, কারণ তাকে আর মাটিতে নামতে দেয়া হয় না। এবার গালিবের কান খাড়া হলো। সে গুনগুনিয়ে গায় ‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান, জীর্ণ পৃথিবীতে মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের, চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, তারপর আমার রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ, এরপর হব ইতিহাস।

আর তো বসে থাকলে চলছে না, নতুন বংশধরের জন্য একটা কিছু করতে হবে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে সিদ্ধান্ত নিল- মেইন রোডের উপর তাদের একটা সাততলা ভবন আছে, সেখানে প্রাইভেট হাসপাতাল করবে। কিন্তু একা তো সম্ভব নয়, কাকে নিয়ে করা যায়? সহসা মনে পড়ল তার বযম ফ্রেন্ড ছাত্র জীবন থেকে বন্ধু ডাক্তার হাসান ইমনের কথা। সে আনন্দিত হলো, তাকে নিয়ে হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নিল। সে এখনো সমিতির সহ-সভাপতি পদে আছে। হঠাৎ একদিন রাস্তায় অপ্রত্যাশিতভাবে সাক্ষাৎ হয়ে গেল, হাসান ইমন ও মারুফ একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গালিব ভাবল এখানেই আলাপটা উত্থাপন করবে। সে এগিয়ে গিয়ে ইমনের হাত ধরে বলল ‘কিরে কেমন আছিস? ইমন ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে বলল ‘আপনি কে, আপনাকে তো চিনলাম না? মারুফ বলল ‘কোন গান্ধারের সাথে আমাদের কথা নাই’ বলে তারা দুজন হাত ধরাধরি করে চলে গেল।

লজ্জায় গালিব লাল হয়ে উঠলো। সাথে সাথেই হুমায়ূনের বাসায় গিয়ে বলল ‘দেখলে দুলাভাই, আমি বিয়ে করেছি বলে গাদ্দার হয়ে গেছি। সমিতির সহ-সভাপতি আর সেক্রেটারি আমাকে অপমান করল। কিন্তু মির্জা বংশের ছেলেকে অপমান করার পরিণতি ওরা জানে না, আমি ওদেরকে গুলি করে মারব। হুমায়ূন বলল ‘দূর বোকা গুলি করে মারলে তো ওরা মরবে না বরং অমর হয়ে যাবে। কারণ কাউকে মেরে ফেললে শহীদ হয় আর শহীদরা অমর। কাজেই মারার চিন্তা বাদ দিয়ে ওদের নাকে রশি দিয়ে হত্যার চিন্তা কর। গালিব চেঁচিয়ে উঠলো ‘ওহ উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু আমি নাক বিধাব কেমনে সুঁইয়ের মালিক তো তুমি। সে বলল ‘আরে বোকা ওরা এখন তোমারও শালী, কাজেই ফাঁদ পাত। গালিব অট্টহাসি দিয়ে বলল ‘গুড আইডিয়া আমি অভিযানে নামলাম।

তারপর সে হাসান ইমনের মায়ের কাছে চলে গেলো। বাসায় ঢুকতেই তার মা চেচিয়ে উঠল ‘শয়তানের দল আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে নিজেরা তো ঠিকই বিয়ে করে আনন্দ করছ আর বউ নিয়ে ধেই ধেই করে নাচছ। এখন এসেছ আমার পরিবারের করুণ পরিণতি দেখতে’ বলে তিনি কান্না জুড়ে দিলেন। গালিব বলল ‘খালাম্মা থামেন তো, কথায় কথায় এই ছিঁচকাঁদুনে স্বভাবটা ভাল নয়। সত্যি করে বলেন তো, আপনার ছেলেকে কি বিয়ে করাতে চান? ভদ্রমহিলা চোখ কপালে তুলে বললেন ‘এ তুমি কেমন কথা বলছ, বিয়েতে ছেলের মতি হওয়ার জন্য আমি নিয়মিত নফল রোজা রাখছি। তুমি কি আমার সাথে ইয়ার্কি মারতে এসেছ নাকি? গালিব বলল ‘আমি যদি ইমনকে বিয়ে করাতে পারি তাহলে আমাকে কি পুরুস্কার দিবেন? মহিলা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল ‘কি দিব মানে, যা চাইবে তাই দিব। এমনকি যদি এই বাসাটা চাও তাও দিয়ে দিব।

গালিব বলল ‘বাসা দিয়ে দিলে থাকবেন কোথায়? মহিলা বলল ‘ফুটপাতে থাকব, চোখের সামনে নিজের ছেলের জীবন এভাবে নষ্ট হতে দেখার চেয়ে বউ নিয়ে ফুটপাতে গিয়ে পড়ে থাকব সেও ভালো। তখন নিজেকে ধন্য মনে করব। গালিব বলল ‘আচ্ছা বাসার চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে আমাকে বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দেন। আমি আপনার ছেলের বিয়ের দায়িত্ব নিলাম। মহিলা বললো ‘সত্যি বলছ তো? – অবশ্যি। - তাহলে শপৎ কর। গালিব শপথ করল। তারপর তিনি পঞ্চাশ হাজার টাকা এনে তার হাতে দিয়ে বললেন ‘শুধু পঞ্চাশ কেন আমার ছেলেকে বিয়ে করাতে পারলে তোমাকে পাঁচ লক্ষ টাকা দিব। গালিব বলল, ঠিক আছে কথাটা মনে থাকে যেন’ বলে সে মারুফের বাসায় চলে গেল। মারুফের মায়ের কাছ থেকেও একইভাবে পঞ্চাশ হাজার আদায় করল।

তারপর দুই শালিকে ডেকে এনে পরামর্শ সভায় বসে নির্দেশ দিল ‘তোরা নদীর পাড়ে বৃক্ষ বাগানে চলে যাবি। সেখানে আমাদের সমিতির সহ সভাপতি ও সেক্রেটারিকে দেখতে পাবি। তোদের কাজ হল তাদের সাথে ভাব জমিয়ে তুলবি, বসে আড্ডা দিবি, গল্পগুজবও করবি, বাদাম খাবি কিন্তু আসল পরিচয় দেবি না। বাপের নাম আর আমাদের নাম বলবি না। তোদের কাজ তোরা কর বাকি কাজ আমার। তারপর মেয়েরা চলে গেল। প্রতিদিন বিকালে ইমন ও মারুফ মোটরসাইকেল নিয়ে নদীর ধারে ঘুরতে যায়, বৃক্ষ বাগানে বসে আড্ডা দেয়। সন্ধ্যার পর সমিতিতে যায় কিন্তু এখন তাদের আড্ডায় সদস্য সংখ্যা দুইজন বাড়ল, কলেজ পড়ুয়া দুটি ছাত্রী এসে তাদের সাথে যুক্ত হলো। তবে তারা নিজেদের পরিচয় দিল না।

কয়েকদিন পর গালিব থানায় গিয়ে দারোগাকে বিশ হাজার টাকা দিয়ে বলল ‘নদীর ধারে বৃক্ষ বাগানে গিয়ে দেখবেন দুইটা বলদ দুইটা মেয়ে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। নিভৃতে মেয়ে নিয়ে আড্ডা দেয়ার অজুহাতে ওদেরকে ঘন্টাখানেক সময় আটকে রাখবেন। তাদের মা-বাবা গেলে তাদের জিম্মায় ছেড়ে দিবেন। তবে থানায় আনবেন না বা কোনরূপ অপমান করবেন না। কারণ ওরা উচ্চশিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে মেয়ে। দারোগা দুইজন পুলিশ নিয়ে রওনা হলো। তারপর গালিব ইমন ও মারুফের মা বাবাকে ফোন করে বলল ‘নদীর ধারে আপনাদের সুপুত্রদের কীর্তি দেখে আসেন গিয়ে। আবার সমিতির নেতা পর্যায়ের কিছু ছেলেকে কল করে বলল ‘বৃক্ষ বাগানে গিয়ে তোমাদের সহ সভাপতি ও সেক্রেটারির অপকর্ম দেখ গিয়ে। তারপর সে আপন মনে হাসলো ‘শালারা আমাকে অপমান করার মজাটাও বুঝালাম আবার নাকে রশি দেয়ার কাজটাও করে দিলাম। এরপর হুমায়ূনকে কল করে বলল ‘আমার কাজ শেষ এখন তুমি নদীর ধারে গিয়ে ওদেরকে নিয়ে এসে বিয়ের ব্যবস্থা কর।

বৃক্ষ বাগানে দুই জন আসামি মাথা নিচু করে বসে আছে। সমিতির ছেলেরা তাদেরকে গাদ্দার চরিত্রহীন ওয়াদা ভঙ্গকারী ইত্যাদি গালাগালি করতে লাগল। মেয়ে দুইজন অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। অবস্থাটা দেখে আসামি দুই জনের মা-বাবাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তারা গিয়ে দারোগার কানে কানে বলল ‘দারোগা সাব এদেরকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে কাজী ডেকে নিজ হাতে বিয়ে পড়িয়ে দেন, আমরা আপনাকে পঞ্চাশ হাজার করে টাকা দিবো। দারোগা চোখ কপালে তুলে বললো ‘নিজেদের ছেলে সম্পর্কে আপনারা এ কেমন কথা বলছেন। তারা বলল ‘এরা কত বড় শয়তান আপনি জানেন না, এরা চিরকুমার সমিতির নেতা খেতা, বিয়ে করতে চায় না। আপনি বিয়েটা পড়িয়ে দিতে পারলে যা চাইবেন তাই দিব। এবার দারোগা মশায় ছেলে মেয়েদের আসল পরিচয় পেয়ে আনন্দে নেচে উঠল। কারন সে বুঝতে পারল মোটা দাও মারার একটা মোক্ষম সুযোগ। সে থানায় নিয়ে যাবে বলে হুট হাট করতে লাগলো আর অভিভাবকেরাও উস্কানি দিতে লাগল। তখনই হুমায়ন এসে দারোগাকে চলে যেতে বললো কিন্তু দারোগা যাবে না, আসামি নিয়ে যাবে। অভিভাবকরাও একমত। নিরুপায় হয়ে সে গালিবকে কল করল। গালিব এসে দারোগার দূরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাকে আরো বিশ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করল।

তারপর অভিবাবকদের বলল ‘আপনারা কি পাগল হয়েছেন, ওদের বিয়ের দায়িত্ব আমার, চিন্তা করবেন না, যান বিয়ের আয়োজন করেন গিয়ে। কিন্তু খালাম্মা এই কৃতিত্ব আমার, অনেক চেষ্টা করে ওদেরকে ফাঁদে আটকিয়েছি। আমার বাকি টাকার কথা মনে থাকে যেন। মহিলারা বললো ‘বাবা তুমি আগে ব্যবস্থা করো পুরা পাঁচ লাখই দিব। অপরাধী দুইজন পিটপিটিয়ে তাকিয়ে ঘটনাটা বুঝল, মেয়ে দুইটার পরিচয় জেনে তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তবে ইমন কিছুটা অভিমানের সুরে সাথীকে বলল ‘দেখলি, ওই হারামজাদা গালিব আমাদেরকে ফাঁদে ফেলেছে। মারুফ বলল ‘আরে গাধা ফাঁদ বলছিস কেন, ও আমাদেরকে রক্ষা করেছে। ওদের শালি পাওয়া আমাদের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার। তাছাড়া আমরা স্বেচ্ছায় সমিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম না, ও আমাদেরকে চিরকুমারত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা করেছে, ওকে ধন্যবাদ। তারপর মেয়ে দুজনকে নিয়ে হুমায়ুন চলে গেল। কয়েকদিন পর বিয়ে হয়ে গেল।

বিয়ের পর গালিব নতুন দুই ভাইরা ভাইকে সপরিবারে দাওয়াত করল। প্রাইভেট ক্লিনিক করা নিয়ে আলোচনা হলো, ইমন আগ্রহ প্রকাশ করল। মারুফ বলল ‘আমিও তোমাদের সাথে থাকব, আমি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করব। বিদায় বেলায় হানানা দুই মাঐয়ের হাতে পঞ্চাশ হাজার করে টাকা দিয়ে বলল ‘মাঐ খিরাজের টাকাটা ফেরত নিয়ে যান। গালিব হাসি চেপে বলল ‘আমার এত কষ্টের টাকা তুমি ফিরিয়ে দিলে, ঠিক আছে তোমার অলংকার বেছে ওই টাকা আমি আদায় করব। আর খালাম্মারা বিয়ের শর্ত হিসাবে আমাকে তো আপনাদের পাঁচ লাখ করে দেওয়ার কথা, না দিলে কিন্তু আমার শালীদের ফিরিয়ে আনব। মহিলারা বললো ‘ঠিক আছে তোমার ছেলেটা হউক, দিলে তাকেই দিব।



এবার জাকির হোসেনের মাত্র তিন মেয়ে অবশিষ্ট থাকল। বড় মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হওয়ার সুবাদে বাকি মেয়েদের ডিমান্ড বেড়ে গেল। সমিতির ছেলেরাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো ভালো ঘর আসতে লাগলো এবং পীড়াপীড়ি করতে লাগল। তারা যাচাই-বাছাই করে অষ্টম মেয়েকে দিল অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার ছেলের কাছে, নবম মেয়ের জামাই বেসরকারি ভার্সিটির শিক্ষক, দশম জামাই ডাক্তার। এভাবে একে একে জাকির হোসেনের দশটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল কিন্তু সে কিছু বুঝলোও না টেরও পেলো না। শুধু এইটুকু টের পেল যে, কিছুদিন পর পর তাকে কিছু মানুষের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হলো, সেই সাথে তার ঘর থেকে একটা একটা করে মেয়ে উধাও হয়ে গেল।

জাকির হোসেনের সবগুলি মেয়েই শান্ত শিষ্ট, ভদ্র ও লক্ষী। এরা সবাই স্বামীর পরিবারের মধ্যমনি হয়ে কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্টিত হলো। আর এ কর্তৃত্ব তারা নিজেদের গুণেই অর্জন করেছে। কারণ জাকিরের ছেলে শূন্য ঘরে অনেকগুলি মেয়ে থাকার কারণে এই মেয়েগুলো অযত্ন-অবহেলায় মানুষ হয়েছে। একের পর এক মেয়ে হওয়ার কারণে তারা পিতা-মাতার অনীহা লক্ষ্য করেছে। ভাই না থাকার কারণে মেয়েগুলিও একে অন্যকে অবাঞ্চিত ও হীন দৃষ্টিতে দেখেছে। শুধু মেয়ের পরিবার হিসাবে আত্মীয়-স্বজন ও মহল্লাবাসিরাও তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেয়জ্ঞান করেছে। বিয়ের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি পাত্রপক্ষের অবজ্ঞা ও অবহেলায় তাদের সুন্দর মনটা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। নিজেদেরকে ভেবেছে কীটপতঙ্গ বা এর চেয়েও অধম। মানুষের আচরণ তাদেরকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করেছে যে, তারা মানব সমাজের অবাঞ্চিত এবং পৃথিবীর জীবন্ত অভিশাপ। এজন্যই স্বামীর ঘরে আশ্রয় পেয়ে তারা স্বামীর পরিবারের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছে। স্বামীর পদাশ্রয়ী হয়েছে, শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করেছে, সেবা-যত্ন করেছে, ননদ দেবরকে মমতার বাঁধনে জড়িয়েছে। এভাবে তারা নিজেকে উজাড় করে ভুবন জয়ী চরিত্র দিয়ে প্রত্যেকের হৃদয় সাম্রাজের মণিকোঠায় সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা হয়ে উঠেছে স্বামীর পরিবারে শ্রদ্ধার পাত্রী ও কর্তৃত্বের মালিক।

পক্ষান্তরে চিরকুমাররা নিজ নিজ পরিবারে গলার কাঁটা হিসাবে অবস্থান করছিল। তাদেরকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে ব্যর্থ হয়ে তাদের পিতা-মাতা ও ভাই-বোনরা যখন দিশেহারা- তখনই যে কোন অছিলায় তারা বিয়েতে সম্মতি দিয়ে বিয়ে করে বউ ঘরে তুলল। তখন তারা মনে করল এটা বউয়ের কৃতিত্ব, বউ প্রেম করে হোক বা যেভাবেই হোক তাদের ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছে। কাজেই তারা বউকে ত্রাণকর্ত্রী হিসেবে ভাবতে লাগল। বউয়ের করকমলে আত্মসমর্পণ করলো, তার মায়ার আঁচলে বাঁধা পড়ল। সর্বোপরি তারা যখন বুঝল বউ স্বামীর পরিবারকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, নিজেকে উজাড় করে খেদমত করে, শশুর শাশুড়ি ননদ দেবর সবাইকে আপন করে নিয়েছে। তখন তারা অবলীলায় বউকে কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্টিত করল, বউয়ের প্রতি তারা যৎপরোনাস্তি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠলো।

আর এই শ্রদ্ধা সম্প্রসারিত হলো বউয়ের মা-বাবার প্রতি। কাজেই তারা নিজ গরজেই বউয়ের মা বাবার খোঁজ খবর নেয়, ছেলেদেরকে দিয়ে এটা ওটা পাঠায়। ছেলেরা গড়িমসি করলে ধমক দেয় ‘এই তোদের শশুরের ছেলে নাই, বুড়া বয়সে তাদেরকে দেখে কে? তোরা জামাইরা পালাক্রমে একজন করে গিয়ে তাদের বাজার সওদা ও অন্যান্য কাজ করে দিয়ে আসবি। আর তোরা সবাই চাকরিজীবী, তোদের টাকার অভাব নাই। কাজেই তোদের শ্বশুর-শাশুড়ির ঔষধপত্র বাজার খরচ নিজেরা বহন করবি, এখন তোরাই তাদের ছেলে। ব্যাস উল্টা নিয়ম, যেখানে দুনিয়াশুদ্ধ মা-বাবারা অনুবিক্ষন অনুসন্ধান করে ছেলে শশুর বাড়িতে কিছু দিয়ে ফেলছে কিনা, সেখানে মা বাবাই ছেলেকে বাধ্য করছে শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা ও ব্যয়ভার বহন করার জন্য।

আবার চিরকুমাররাও দীর্ঘদিন নারীসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর হঠাৎ স্ত্রী দেহের গন্ধ পেয়ে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। স্ত্রীর আঁচলে বাঁধা পড়ে গেছে। স্ত্রীর বশ্যতা ও আনুগত্যে তারা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা জানে স্ত্রীর মা-বাবাকে দেখাশোনা করলেই বধুরত্ন সন্তুষ্ট হবে। এজন্য তারা শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমতে আত্মনিয়োগ করল। তাছাড়া এরা সবাই শিক্ষিত বিবেকবান, তারা জানে শ্বশুর-শাশুড়ির ছেলে নাই বিধায় তাদের দেখাশোনা করা জামাইদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। কাজেই জামাইরা সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিল- তারা পালাক্রমে প্রতিদিন একজন করে যাবে, শশুর শাশুড়ির বাজার সওদা ও অন্যান্য প্রয়োজনগুলি মিটিয়ে দিয়ে আসবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিদিন একজন করে যায় কিন্তু কেউ খালি হাতে যায় না। মাছ-গোশত তরিতরকারি ফল ফলাদি কাপড়-চোপড় ইত্যাদি প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যায়। দুজন মাত্র মানুষ, এত সব সামগ্রী ব্যবহার করে শেষ করতে পারে না, স্তূপ জমে যায়। তখন অতিরিক্ত জিনিস গরিবদের দিয়ে দেয়।

জাকির জামাইদের ধমক দেয় ‘তোমরা এত অপচয় করো কেন, আমরা মাত্র দুজন মানুষ এত জিনিসপত্র দিয়ে কি করব, আর আমি কি অক্ষম নাকি যে জামাইদেরটা খেতে হবে? তখন জামাইরা হাসে ‘আপনারা অক্ষম নয় কিন্তু শিশু, আমাদের শিশু। দশজন বিত্তবান মানুষের যদি দুটি মাত্র বাচ্চা থাকে তাহলে ওই বাচ্চা দুটি কতটা জৌলুসের সাথে জীবন যাপন করে? মনে রাখবেন আপনারা কিন্তু সেই বাচ্চা, দশজন জামাইয়ের একমাত্র ছেলে মেয়ে। কাজেই আপনারা রাজপুত্র রাজকন্যার মতো জীবন যাপন করবেন। আমাদের কাজ আপনাদের জন্য আনা আর আপনাদের কাজ হলো ভোগ করা। যেটুকু ভোগ করতে পারেন করবেন বাকিটা ফেলে দেবেন অথবা কাউকে দিয়ে দেবেন।

মাঝে মধ্যে জামাইদের মা-বাবারা বিভিন্ন উপহারসামগ্রী নিয়ে বেয়াই বাড়িতে বেড়াতে আসে। তখন জাকির হোসেনকে বলে ‘বেয়াই আসলে আমরা আপনার মেয়ে নেইনি শুধু বিনিময় করেছি, মেয়ে নিয়ে আমাদের ছেলে আপনাকে দিয়ে দিয়েছি। কাজেই মেয়েদের লালন-পালন করতে আপনার যে শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয়েছে এখন তা আমাদের ছেলেদের থেকে উসুল করে নিন। ছেলে আপনার আর আপনার মেয়ে আমাদের। তখন জাকির আনন্দিত হয় আত্নহারা হয়। আবার জাকির হোসেনও মাঝে মধ্যে স্ত্রীকে নিয়ে জামাই বাড়ি বেড়াতে যায়। তখন মেয়ে-জামাই, বিয়াই বিয়াইন ও অন্যদের জন্য কাপড় চোপড় ও উপহার সামগ্রী নিয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর জামাই ও বিয়াই বিয়াইন বলে এসব কার জন্য এনেছেন, আরেকবার থেকে উপহার সামগ্রী নিয়ে এলে বাসায় ঢুকতে পারবেন না, ঢুকলেও সেগুলি রাস্তায় ফেলে দেব।

১০

একদিন জাকির দম্পতি আলাপ করতে করতে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল, হাসছে পড়ছে উঠছে আর হাসছে। তার স্ত্রীও বেদম হাসতে লাগল। জাকির হাসি থামিয়ে বললো ‘কি অদ্ভুত কাণ্ড দেখ, এসেই সালাম দিয়ে কদমবুচি করবে, তারপর মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকবে যেন সদ্য বাজার থেকে কিনে আনা একটা চাকর। তারপর কথায় কথায় ‘জি আব্বা জি আব্বা’ করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। উচ্চশিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত দশটি ছেলের কদমবুসি খাওয়া ও আনুগত্য পাওয়া নিশ্চয় চাট্টিখানি কথা নয়, নিতান্তই ভাগ্যের ব্যাপার। দেখ ছেলে জন্ম দিলাম না, হাগা মুতা সাফ করলাম না, একদিন কোলে নিলাম না, লালন পালন করলাম না, এক পয়সা খরচ করলাম না, একটা লজেন্স বা একটা গেঞ্জি কিনে দিলাম না, একদিন স্কুলে নিয়ে গেলাম না অথচ দেখ কেমন জোয়ান তাগড়া দশটা ছেলের বাপ হয়ে গেলাম’ বলে আবার বেদম হাসতে লাগল ‘ওঃ চমৎকার, জন্ম না দিয়ে বাপ হওয়ার মজাটাই আলাদা।

সে স্ত্রীর দিকে আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে লাগল, ‘আরে শুন, পৃথিবীর সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হল মেয়ে জন্ম দেয়া, আর সবচাইতে লোকসান হলো ছেলে জন্ম দেয়া। কারণ মেয়ে জন্ম দেয়া মানেই বোনাস হিসাবে একটা করে ছেলে পাওয়া। এই ছেলেটার জন্য তোমাকে আলাদা বাড়ি ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে না, খাওয়া দাওয়া ও উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে না, তার বউ বাচ্চা নিয়ে চলার চিন্তা করতে হবে না। জামাই নামের এই ছেলেটা কখনো তোমার অবাধ্যতা করবে না, বেয়াদবি করবে না, জ্বালাতন করবে না, ত্যক্ত বিরক্ত করবে না বরং এসেই তোমাকে সালাম দিয়ে কদমবুচি করবে। তারপর গোলামের মত মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকবে আর কথায় কথায় ‘জি আব্বা জি আম্মা’ করে করে মুখে ফেনা তুলবে।

পক্ষান্তরে ছেলে জন্ম দিলে মানে নিজের খুরে নিজের কবর খনন করলে। এই হারামজাদা গুলাইল ছোট বেলায় ত্যক্ত বিরক্ত যা করার তো করবেই, তারপর পাছার ফুল পড়তে না পড়তেই দেখবে মেয়েদের পিছনে ঘুর-ঘুর শুরু করে দিয়েছে। এরপর মদ-জুয়া ধরবে, ধীরে ধীরে চাঁদাবাজি মাস্তানি সন্ত্রাসী ও মাগীবাজী শুরু করবে, তোমার পারিবারিক মান-মর্যাদা একেবারে ধূলিসাৎ করে দেবে, এমনকি তোমার নামটাও পুলিশের খাতায় উঠিয়ে দিতে পারে। এরপর বিয়ে করিয়ে একটা মেয়ে ঘরে আনলে মানে খাল কেটে কুমির আনলে। এই মেয়ে তোমাকে বাসা ছাড়া করে ছাড়বে। কারণ সে তোমার আনুগত্য ও খেদমত তো দূরের কথা তোমার সাথে বেয়াদবি করবে, শত্রু ভাববে, হিংসা করবে, বোঝা মনে করবে, কথায় কথায় ঝেঙ্গার পাড়বে আর অপমান করবে। তারপর সুযোগ বুঝে একদিন তোমাকে বৃদ্ধাশ্রম নামের খোঁয়াড়ে পাঠিয়ে দিবে। এই হলো ছেলে জন্ম দেয়ার পরিণতি। কাজেই যারা মেয়ে জন্মায় এরাই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান আর যারা ছেলে জন্ম দেয় এদের মত হতভাগা আর কপালপোড়া দুনিয়ায় অন্য কোনো প্রাণী নাই।

দেখতেই তো পাচ্ছ, আমাদের ছেলে উরফে জামাইরা কিভাবে আমাদের খেদমত করে যাচ্ছে। এজন্যই আমার কি মন চায় জান? যারা ছেলে জন্মের কথা শুনে হাসে- ইচ্ছা হয় ওদের মুখে একদলা গোবর ঠেলে দেই। কারণ এই মূর্খরা জানে না যে, ছেলেটা একটু বড় হতেই তার মুখের হাসিটা চিরদিনের মত কান্নায় রুপান্তরিত হয়ে যাবে। আর মেয়ে জন্মের কথা শুনে যাদের চেহারা কালো হয়ে যায়- ইচ্ছা হয় থাপড়িয়ে থাবড়িয়ে সেই মূর্খদের কান ঠসা করে দেই। কারণ সে জানে না যে, তার ঘরে বিশ্বশান্তি ও খোদার আশীর্বাদ এসেছে।

তারপর সে একটু চিন্তা করে হঠাৎ ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। জোবেদা বেগম লাফিয়ে উঠল ‘আরে হঠাৎ আবার কি আবিষ্কার করে ফেললে? জাকির বলল ‘হ্যাঁ আবিষ্কার মহা আবিষ্কার। আমরা একটা সমিতি গঠন করব। যে মুর্খরা মেয়ে জন্ম নিলে মুখ কালো করে গোমরা মুখে বসে থাকে ওদেরকে থাবড়িয়ে কান ঠসা করে দেব। আচ্ছা আমাদের জামাইরা তো চিরকুমার সমিতি গঠন করেছিল কিন্তু তারা না দেশ জাতির কোন কল্যাণ করতে পেরেছিল আর না নিজেদের। কিন্তু আমাদের সমিতি কন্যাশিশু ও নারীর কল্যাণে কাজ করবে। আচ্ছা বলতো সমিতির নামটা কি দেয়া যায়? জোবেদা বেগম বলল ‘তুমিও কি চিরকুমারদের মতো সমিতি করে মানুষের হাসি ঠাট্টার পাত্র হতে চাও নাকি? বাদ দাও ওসব গাজাখুরী গপ্প, জীবনটা উপভোগ কর। এখন আমাদের হাসির সময়, আনন্দের সময়, খাও দাও ফুর্তি করার সময়।

জাকির বললো ‘নাঃ সমিতি আমি করবই, সেই সাথে জীবনটাও উপভোগ করবো। কিন্তু কীভাবে? এই বয়সে এখন কি গিয়ে ফুটবল খেলতে পারব নাকি ধেই ধেই করে নাচতে পারব? তারপর সে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘চলো না গো আমরা আবার আগের ব্যবসাটা শুরু করি। জোবেদা জিজ্ঞেস করল ‘কোন ব্যবসার কথা বলছ? জাকির হেসে বলল ‘আরে মেয়ে উৎপাদনের ব্যবসা, জান না ইহকালে পরকালে মেয়ে উৎপাদনের কত ফজিলত। দশটি মেয়ে জন্ম দিয়ে পরকালে দশটি বেহেস্ত আর ইহকালে দশটি সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে গেলাম। কারন আমার মেয়েরা দশটি পরিবারের রানী, এর অর্থ হল সেগুলি আমার সাম্রাজ্য। কিন্তু কথায় আছে না ‘এই দুনিয়ায় হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি। কাজেই দশটি বেহেস্ত আর দশটি সাম্রাজ্যে আমার মন ভরছে না, আমার আরো চাই।

সুতরাং আরো মেয়ে উৎপাদন করতে হবে, আমাদের তো আর অন্য কোন কাজ নাই, চল এই কাজটা করি। যত বেশি মেয়ে জন্মাব তত বেশি বেহেস্ত আর সাম্রাজ্যের মালিক হব। লোকমুখে শুনি আঠারটা সন্তান জন্ম দিলে নাকি একটা বিশেষ মর্যাদা পাওয়া যায়। জুবেদা বলল ‘মর্যাদা না ছাই, আঠার সন্তানের পর নাকি বিয়ে ভেঙ্গে যায় আবার নতুন করে পড়াতে হয়। জাকির বলল ‘পড়াব তাতে সমস্যা কি, আঠারটা পয়দা করে বিয়ে পড়াব, আবার আঠারটার পর বিয়ে পড়াবো। কোন খরচা পাতি তো আর লাগছে না, বড়জোর হুজুরকে এক পেট খাওয়াতে হবে, এই তো। জুবেদা বলল ‘হ্যাঁ প্রস্তাবটা মন্দ না, মানুষ দিন দিন বুড়া হয় আর তুমি তো জোয়ান হচ্ছ।

জাকির গর্ব সহকারে বলল ‘আরে এটা হল মেয়ে জন্ম দেয়ার সুলক্ষন। আমি যে সুখী এটা তার আলামত। আচ্ছা এখন তো আর ঘরে কেউ নাই, তুমি সেই বিয়ে বেলার মত নববধু সেজে থাকবে, মনে করবে আমাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে। রাতে জোবেদা তার বিয়ের শাড়ি অলংকার নামিয়ে নববধু সেজে জাকিরের সামনে এসে দাঁড়াল। জাকির কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে বলল ‘এই তোমাকে তো কুমারীর মত লাগছে, আবার বিয়ে দেয়া যাবে। জুবেদা ঝংকার মেরে বলল ‘কিন্তু তোমাকে বুড়ার মত লাগছে, যাও বর সেজে এসো। জাকির উঠে গিয়ে বিয়ের পোশাক নামিয়ে পরিধান করল। তারপর দুজন খাটের উপর উঠে বসল। জাকির আফসোস করে বললো ‘আহা খাটটা ও বিছানাটা নতুন হলে আর কিছু ফুল-টুল হলে তো সেই আগের আদি আসল বাসরটাই উদযাপন করা যেত।

১১

জাকির হোসেন মেয়েদের বিয়ের পরই ভাড়া বাসা ত্যাগ করে নিজের বাসায় চলে এসেছে। বাসাটা সে সংস্কার করেছে, অনেকগুলি রুম বৃদ্ধি করে কয়েকটা ফ্যামিলি ভাড়া দিয়েছে। তার যেমন টাকা-পয়সার অভাব নাই তেমনি কোন দুশ্চিন্তাও নাই। এখন সে রাজা বাদশার মতো জীবনযাপন করে। আগে সে মাথানিচু করে ক্বুজো হয়ে হাঁটত কিন্তু এখন সটান সোজা হয়ে মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে হাটে। আবার তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুক্লা সপ্তমির চাঁদের মতো এক ফালি নব যৌবনও দেখা দিয়েছে। তারা নবদম্পতির মত হেসে খেলে নতুন সংসার শুরু করল।

মহল্লার ছেলের বাবারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকে বলে ‘ভাই আপনি খুব ভাগ্যবান মানুষ। কারণ আপনার কোন ছেলে নাই। আপনার ঘর তো মেয়ের ঘর- শান্তির ঘর কিন্তু ছেলের ঘর হল জাহান্নাম। দেখেন আমার ছেলেটা খুব ভাল ছাত্র ছিল কিন্তু নেশা করে লেখাপড়া তো গেলই, এখন জীবনটাই যেতে বসেছে, মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। রমিজের ছেলে ধর্ষণ মামলায় জেলে আছে। করিমের ছেলে চাঁদাবাজি করে জেলে গেছে। অমুকের ছেলে ইভটিজিং করে কলেজ থেকে বহিষ্কার হয়েছে, তমুকের ছেলে মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে আছে এসব নিত্য নৈমিত্তিক খবর। সর্বত্র ছেলের বাবাদের নাভিশ্বাস। কোন বাবার সব ছেলেই নষ্ট, কোন বাবার দুয়েকটা ভালো কিন্তু তাদেরও কমবেশি কেলেঙ্কারি আছে। কোথাও ছেলের বাবারা ভালো নেই।

একদিন সে শুনল মহল্লার বিত্তবান মানুষ কদ্দুস বেপারির কলেজ পড়ুয়া ছেলে রকিব হাইজ্যাকারদের সাথে যোগ দিয়েছে। তারপর টাকা-পয়সার ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করে রকিবকে দলের লোকেরা মেরে ফেলেছে। এই দলে আছে কুদ্দুসের পাশের বাসার মান্নানের ছেলে হান্নান। কদ্দুস পুত্র হত্যার দায়ে হান্নান মান্নান বাপ বেটা উভয়কেই জেলে ঢুকিয়েছে। জাকির এসব শুনে আনন্দ পায় না বটে কিন্তু গর্ব বোধ করে। কারণ সে কোন ছেলের বাবা নয় মেয়ের বাবা।

তার অফিসের সহকর্মীদের মধ্যেও সমস্যা। তার কলিগ কাশেমের ছেলে হাসেম বিরোধী দলীয় নেতা, একদিন হরতালের সময় দোকানপাট ভাঙচুর করে ও গাড়িতে আগুন দেয়। পুলিশ গিয়ে বাসায় হানা দিল, আসামি না পেয়ে বাবা ও বড় ভাইকে ধরে নিয়ে গেল এবং জেলে পাঠাল। অনেক টাকা পয়সা খরচ করে তারা বেরিয়ে আসল বটে কিন্তু তাগড়া জোয়ান কাশেম লোকটা কয়েকদিনে বৃদ্ধ হয়ে গেল। একদিন তারা অফিসে বসে আছে, তখন এক কলিগ বলল, ‘রহস্যটা বুঝলাম না, জাকির ভাইকে আগে দেখতাম বুড়া এখন দেখছি দিন দিন জোয়ান হচ্ছে আর কাশেম ভাইকে কদিন আগেও দেখলাম জোয়ান আর এখন দেখি একেবারে বাহাত্তুরে বুড়া, এর কারণটা কী? কাসেম প্রায় কান্না জড়িত কন্ঠে বলল ‘কারণটা হলো জাকির মেয়ের বাপ আর আমি ছেলের বাপ। তারও যদি আমার মত কয়েকটা ছেলে থাকতো তাহলে মুখে এত সুন্দর হাসি ফুটতো না, ঠনঠনে বুড়া হয়ে যেত। জাকির তৃপ্তির নিঃস্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মেয়ে দিয়ে সম্মানিত করেন আর যাকে ইচ্ছা ছেলে দিয়ে লাঞ্ছিত করেন, সবই উপরওয়ালার ফয়সালা।

জাকির হোসেন ভাবল এভাবে আর বসে থাকা যায় না কন্যা কল্যান জাতীয় একটা কিছু করা দরকার। সে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আলাপ করল, সবাই আগ্রহ প্রকাশ করল। কারণ প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ বয়সে মানুষ সঙ্গী সাথী হারিয়ে ফেলে। তখন আর তাদের সময় কাটতে চায় না। তাই তারা ক্লাব বা সমিতি জাতীয় কোন কিছুর প্রয়োজন বোধ করে- যেখানে চায়ের আড্ডায় গল্পগুজব করে সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। সেই সাথে মানব সেবা তো আছেই। কাজেই জাকিরের বন্ধুরা সবাই চাঁদা দিয়ে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সমিতি গঠন করল। অনেক বিতর্কের পর সমিতির নাম দেয়া হলো ‘কন্যা কল্যাণ সংঘ’। কারণ এই সমিতির কাজ হবে মেয়ে জন্মালে যাদের মুখ কালো হয়ে যায় তাদের মুখে থাবড়ানো। তবে এ কাজ করার জন্য ক্ষমতাবান ও প্রতাপশালী লোকের প্রয়োজন- যার থাবড়ানোর মতো সামাজিক অথরিটি আছে এবং যার থাবড়া খেয়ে কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাবে না। কাজেই সমিতিতে এ ধরনের লোকদের ডেকে এনে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হলো। আর তারাও কর্তৃত্বের সুযোগটা লুফে নিল। তবে জাকির হোসেন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হল।

সমিতি জমজমাট হয়ে উঠলো। প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরা এখানে বিকাল থেকে গভির রাত পর্যন্ত কফি হাউজের আড্ডা জমায়, শেষ বয়সের আনন্দ-ফুর্তি করে, সমিতির কয়েকটা রুম সব সময় লোকে গিজগিজ করে। সেদিন বিকালে জাকির ও তার বন্ধুরা সমিতিতে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তখন মহল্লার এক ব্যক্তি এসে বলল ‘সারোয়ারের তিন মেয়ের পর এখন আরেকটা মেয়ে হয়েছে। দেখে এসেছি সে মুখ কাল করে বসে আছে। আর যায় কোথায় বাবা, মহল্লার নেতাকে নিয়ে কয়েকজন ছুটল। নেতা গিয়েই জিজ্ঞেস করল ‘কিরে সারো কেমন আছিস? সারো বিষন্ন কন্ঠে বলল ‘আর ভালো, যার একটার পর একটা মেয়ে হয় সে আর কত ভালো থাকে, মরি নাই তবে মেয়েদের বুঝায় খুব শীঘ্রই মরতে হবে--- কথা শেষ না হতেই তার মুখে ঢাস ঢাস করে থাবড়া পড়তে লাগল। সারো চিত্কার করলো ‘এসব কি হচ্ছে? কিন্তু আরও কয়েকজন মিলে থাবড়াতে লাগলো। সারো চেঁচালো ‘ভালো হবে না কিন্তু বলে দিলাম। আপনারা আমার বাসায় এসে আমাকে মারছেন কোন সাহসে, কোন অধিকারে, কোন আইনে? কিন্তু ‘আজ তোকে অধিকার শিখাব’ বলে মুরুব্বিরা দস্তুর মতো থাবড়িয়ে যাচ্ছে। চিৎকার শুনে তার মা স্ত্রী ও কন্যারা এসে বিলাপ শুরু করল।

তখন এক মুরুব্বী ধ্মকালো ‘আরে গাধা এখনো বুঝস নাই, থাবড়া পার্টি এসেছে। এবার তার স্মরণ হলো, সে লাফিয়ে উঠে হাত জোড় করে চেঁচাতে লাগলো ‘মাফ করেন মাফ করেন মেয়ে পেয়ে আমি খুশি সুখি। নেতা বলল ‘আমাদের তো অন্যায় করনি, যার অন্যায় করেছ তার কাছে মাফ চাও যাও। বাচ্চা কোলে নিয়ে বাচ্চার মা এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সারো মেয়েকে কোলে নিয়ে চুমু দিয়ে হাসল, আম্মু মাফ কর মাফ কর, তুমি আমার সাত রাজার ধন’ বলে চুমুতে লাগল। নেতা বলল ‘এবার বাচ্চার মায়ের কাছে হাত জোর করে মাফ চা। সে হাত জোড় করে কাচুমাচু করতেই বউ মুচকি হাসি মেরে চলে গেল। সমিতির পক্ষ থেকে মিষ্টি আনানো হলো। সবাই মিষ্টি খাওয়ার পর জাকির হোসেন বলল ‘শুন সারো মেয়ের ঘর জান্নাত ছেলের ঘর জাহান্নাম। মেয়ে হল আল্লার নেয়ামত আর আমানত। কাজেই প্রাণপণ এই আমানত রক্ষা কর, এরপরেও যদি সমস্যা হয় তাহলে আমাদের সমিতি মেয়েদের লেখাপড়া ও বিয়ের দায়িত্ব বহন করবে, আমরা শীঘ্রই সেই প্রকল্প চালু করতেছি। কিন্তু তোমার মত সচ্ছল মানুষের জন্য সমিতির দ্বারস্থ হওয়া উচিত নয়। যাও ছেলে মেয়ে পার্থক্য না করে বাপের দায়িত্ব পালন কর’ বলে তারা চলে গেল।

জাকির পিছনে হাত রেখে বদ্ধ দরজার সামনে বিষন্ন হয়ে পায়চারি করছে। রুমের ভিতর থেকে উহঃ আহঃ - কোকানোর শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ ঠা ঠা শব্দে বাসাটা মুখর হয়ে উঠলো, সাথে সাথে জাকিরের মুখেও হাসি ফুটল। দাই বেটির উচ্চকণ্ঠ ভেসে এলো ‘ছেলে হয়েছে গো ছেলে হয়েছে, কর্তার ভাগ্য খুলেছে’। কিন্তু জাকির নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারল না, সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘কি হয়েছে? দাই বেটি চেঁচাল, ‘ছেলে গো ছেলে। এবার কিন্তু আমাকে দশ হাজার টাকা হাদিয়া দিতে হবে। সে আবার জিজ্ঞাস করল ‘কি হয়েছে? - ছেলে ছেলে। জাকির বিশ্বাস করে না আবার প্রশ্ন করে। দাই বেটি রাগে দরজা সামান্য ফাঁক করে নবজাতকের লিঙ্গ দেখিয়ে বলল ‘এবার বিশ্বাস হয়েছে তো? আমার কিন্তু বড় পুরস্কার চাই। লিঙ্গ নির্ণয় করে জাকিরের মুখটা শ্রাবণের আকাশের মতো কালো হয়ে গেল, সে মাতালের মত টলতে টলতে নিজের রুমে গিয়ে বসল।

সে আবার দিবাস্বপ্ন দেখায় অভ্যস্ত। কল্পনা করতে লাগল- ছেলে বড় হলে কি হবে বা হতে পারে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার ছেলেটা খুব সুন্দর সুদর্শন হয়েছে কিন্তু স্কুল জীবন থেকেই সে মেয়েদের পিছু নিল। কলেজে উঠে নেশা ও ইভটিজিং শুরু করলো। তারপর অনার্সে ভর্তি হয়ে রাজনীতিতে যোগদান করল। এরপর থেকে তার নেশা ধর্ষণ চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক মারামারি সমানতালে চলতে লাগলো। পুলিশ পিছু নিল, মাঝে মাঝে বাসায় এসে ছেলেকে না পেয়ে বাপকে ধরে নিয়ে যাবে বলে হুমকি দিয়ে যায়।

একদিন পুলিশ তাড়া করল। ছেলে দৌড়ে এসে বাসায় ঢুকল কিন্তু পুলিশও পিছু পিছু এসে ছেলেকে ধরে টেনে হেচড়ে নিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু বাপ কিছু না করে বসে আছে দেখে ছেলে চেচিয়ে উঠলো ‘আমার দোষ নাই, বাবা বাবার দোষ--- তখনই পুলিশ বাপকে ধরার জন্য তেড়ে এল। বাপ লাফিয়ে ওঠে ভোঁ দৌড় মারল, কিন্তু হঠাৎ থমকে দাড়িয়ে ভয়াল চোখে চারিদিকে তাকিয়ে লজ্জিত হল ‘ধুত্তোরি আমিও কি পাগল হয়ে গেলাম নাকি, কেউ তো নেই শুধু শুধুই ভয় পেলাম। পরক্ষণেই ছেলের কথা মনে হতেই সে চেচিয়ে উঠল ‘নিশ্চয়ই ঐ হারামজাদা দু’দিন আগে পিছে আমাকে পুলিশে দিবে। এই হালার পুতকে বাচিয়ে রাখা যাবে না, আঁতুড়েই গলা টিপে মেরে ফেলতে হবে। সে দাঁত কিড়মিড় করে জামাটা নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

১২

মাগরিবের নামাজের পর আস্তে আস্তে গিয়ে ইমাম সাবের হুজরায় বসলো। তারপর গলা টেনে বলল ‘আচ্ছা হুজুর মানুষ যেভাবে একে অন্যের সাথে ঠাট্টা মশকরা করে আল্লাহও কি তেমনি মানুষের সাথে ঠাট্টা মশকরা করেন নাকি? হুজুর চেঁচিয়ে উঠলো ‘নাউজুবিল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ তওবা করেন তওবা করেন, এমন কথা বললেন কেন? জাকির উত্তর দিল ‘বললাম কি আর সাধে, আগে একটা ছেলের জন্য আল্লাহকে অনেক হাতে পায়ে ধরেছি, প্রচুর ঘোষ ঠুস দিয়েছি। এমন কোন মাজার খানকা দরবার নাই যেখানে আমি হাদিয়া উপঢৌকন ও টাকা-পয়সা দেইনি। ময়মনসিংহের এমন কোন পীর বুজুর্গ বড় হুজুর নাই- যাদের পেটের সাথে সাথে পকেটটাও ভরিয়ে দেইনি। কিন্তু আল্লাহ কোন দিন চোখ তুলে তাকান নাই। কিন্তু এখন ‘ছেলেদের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র’ দেখে দেখে ওদের প্রতি আমার ঘৃণা ধরে গেছে। বুঝতে পেরেছি মেয়েরাই একমাত্র শান্তির প্রতীক আর ছেলেরা হলো অশান্তির অবতার। এজন্যই দশটা মেয়ে থাকা সত্ত্বেও আরো কয়েকটা মেয়ে উৎপাদনের ধান্দায় ছিলাম কিন্তু হলো একটা ছেলে। কাজেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এটা কি আমার সাথে আল্লাহর ঠাট্টা-মশকরা জাতীয় একটা কিছু হলো না?

ইমাম সাহেব বললেন ‘কেন ছেলে পেয়ে সবাই খুশি হয় আর আপনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন, ছেলেই তো ভাল কামাই রোজগার করে খাওয়াবে। জাকির হোসেন বলল ‘আপনি কোন রাজ্যে বাস করেন, কোথায় দেখলেন ছেলেরা কামাই করে খাওয়ায়। ওরা বরং বাপকে তিলে তিলে নিঃস্ব করে ফকির বানিয়ে ছাড়ে। তাছাড়া এরা পরিবারের মান-সম্মান ধুলিস্মাৎ করে দেয়। সমাজে চেয়ে দেখেন কয়টা ছেলে ভালো আছে, প্রায় সবাই মদ গাঁজা ইয়াবা ইভটিজিং ধর্ষণ চাঁদাবাজি গুন্ডামি মাস্তানি মাগীবাজী ইত্যাদি কোনো-না-কোনো অপকর্মে লিপ্ত আছে। অথচ মেয়েরা দেখেন কত ভালো, এরা কোন অপকর্মে নাই। এই যে আমার দশটা মেয়ে আছে কোনদিন কি শুনেছেন আমার মেয়েরা নেশা করেছে, পুংটিজিং করেছে, চাঁদাবাজি মারামারি গুন্ডামি মাস্তানি করেছে, এমন কখনো শুনেছেন? ইমাম সাব বলল ‘না আপনার মেয়ে সম্পর্কে প্রশংসাই শুনি। শুধু আপনার মেয়ে কেন কোন মেয়ে সম্পর্কেই এমন শোনা যায় না। জাকির বলল ‘এবার বুঝেন, মেয়ে না হয়ে যদি আমার দশটা ছেলে থাকতো তাহলে আর আমার বদনামের অন্ত থাকত না, আপনি এখানে আমাকে বসতে দিতেন না।

আসলে মেয়েরাই হলো শান্তির দূত আর ছেলেরা হল অশান্তির আগুন। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ বিগ্রহ খুন হত্যা অশান্তি অপকর্ম এসবের মূল হলো ছেলেরা, মেয়েরা এসব করে না। পৃথিবীর মহাযুদ্ধগুলি মেয়েরা বাধায়নি পুরুষরা বাধিয়েছে। পৃথিবীতে যদি ছেলে না থাকত শুধু মেয়ে থাকতো তাহলে কোন অশান্তি থাকতো না। এজন্যই আমার মতে পৃথিবী ও মানবতার শান্তির জন্য সকল ছেলেকে মেরে ফেলা উচিত। আমি যদি কোনদিন পৃথিবীর রাজা হই তাহলে ফিরাউনের মত হুকুম দিব- ছেলে শিশু জন্মের সাথে সাথে মেরে ফেলতে হবে আর মেয়েগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারন ছেলেরা হল অশান্তির বীজ। এই যে আমাকে দেখতেছেন, মনে করছেন খুব একটা ভালো মানুষ। কিন্তু কতটুকু ভালো তা টের পেয়েছেন আমার বাবা। ছেলে বেলায় পাড়ায় পাড়ায় মারামারি করতাম, অন্যের ঠ্যাং ভাঙ্গতাম নিজের মাথা ফাটাতাম। স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেলায় মেতে থাকতাম, বাবার পকেট কেটে মেয়েদের পিছনে ঢালতাম। আমার দশটি মেয়ে কেন হয়েছে জানেন, আমি দশটি প্রেম করেছিলাম কিন্তু তাই বলে চরিত্র নষ্ট করিনি। আরো অনেক কথা আছে সব বলা যাবে না।

ইমাম সাব হেসে বললেন ‘আসলে আপনি ঠিকই বলেছেন। এই যে আমাকে দেখে মনে হচ্ছে একটা দরবেশ ঠিক কি না, কিন্তু আমার ইতিহাস জানেন? ছোটবেলায় আমার জন্য কারো গাছে আম জাম কাঁঠাল লিচু কলা নারিকেল ইত্যাদি থাকত না। তাছাড়া আমি মাদ্রাসায় পড়ার সময় লজিং থাকতাম, যে বাড়িতেই লজিং গেছি মেয়ে থাকলেই প্রেম করেছি, অবশ্য অন্য কিছু নয়। এজন্যই তো দেখেন না, নামাজের আগে পড়ে আমি নফল নামাজ পড়ি। কারণ আল্লাহর কাছে ঐ সব গুনাহ থেকে মাফ চাই, তওবা করি আর ভাবি ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হয়ে জন্ম নিতাম তাহলে সবার আগে বেহেস্তে চলে যেতাম। কিন্তু এখনতো গোনাহর কারণে মেয়েদের পড়ে আমাদেরকে জান্নাতে যেতে হবে। বিশেষ করে আমার প্রেমিকারা যদি আল্লাহকে বলে দেয় ‘আল্লাহ ঐ যে দরবেশের মত হুজুরটাকে দেখছ, আসলে কিন্তু সে একটা লুচ্চা, ওর বিচার কর। তাহলে তো আমি শেষ। কাজেই চিন্তা করি যদি ছোটবেলায় মা বাবা গলা টিপে মেরে ফেলত, তাহলে কতই না ভালো হতো। সরাসরি জান্নাতে চলে যেতাম কিন্তু এখনতো পড়েছি ফাটা বাঁশে।

এজন্যই আপনার যুক্তি ঠিক আছে। ছোট বেলায় ছেলেদেরকে মেরে ফেলা উচিত, এতে উভয় পক্ষের মঙ্গল। তখন পৃথিবী সেই ছেলেটার অশান্তির আগুন থেকে বাঁচলো আবার ছেলেটাও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পেল। কাজেই মেরে ফেলাই ভালো। কিন্তু মারবেন কিভাবে এটাতো হত্যা, গুনাহ হবে না? জাকির হোসেন বলল ‘না না আপনি আজও এটাই জানেন না? আমি বঙ্গানুবাদ কোরান পড়ি, কোরআনে দেখেছি শুধু মেয়েদের কথা বলা হয়েছে যে, ‘জীবন্ত প্রোথিত কন্যা শিশুকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাকে কোন অপরাধে হত্যা করা হলো? কিন্তু ছেলেদের ব্যাপারে কোনো কথাই উল্লেখ নাই। কাজেই বুঝা যায়, কন্যা শিশু হত্যা করলে জবাবদিহি করতে হবে কিন্তু ছেলে শিশু হত্যা করলে কোনো জবাবদিহি নাই।

ইমাম সাব কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বললেন ‘আপনি তো দেখছি আমার চেয়েও বড় আলেম, আপনি তো ঠিকই বলেছেন। কোরান হাদিসের কোথাও লেখা নাই যে, ছেলে শিশু হত্যা করলে গুনাহ হবে বা জবাবদিহি করতে হবে, এটা শুধু মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। কাজেই ওদেরকে মেরে ফেলা যায় বটে কিন্তু আপনি এখন কি করতে চান? জাকির বলল, কি করব মেরে ফেলব, আতুরেই আপদ বিদেয় করে দিব। ইমাম সাব বললেন ‘কিন্তু আমার পরামর্শ হলো মারবেন না, এসেছে যখন দুনিয়াটা একটু দেখার সুযোগ দেন। তাছাড়া মারলে হয়তো রাষ্ট্রীয় আইনে আপনার ফাঁসি হয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে মানুষ করার চেষ্টা করুন।

জাকির বলল ‘কীভাবে চেষ্টা করব? ইমাম সাব বললেন ‘এই সহজ জিনিসটা আপনি জানেন না? আমাকে দাওয়াত করবেন, আমি পানি পড়া ও তেল পড়া দিয়ে আসব। তা বাচ্চার শরীরে মালিশ করবেন, দেখবেন আপনার ছেলে পীর-দরবেশ, ওলী আউলিয়া, গওস কুতুব হবে, তখন আপনার মুখ উজ্জ্বল হবে। দাওয়াত করেন, আমাকে খাওয়ানো একদম সোজা, একেবারে ডালভাত। জাকির সোৎসাহে বলল ‘ডাল ভাতের সাথে দুয়েকটা আইটেম থাকলে কি সমস্যা হবে? হুজুর বলল ‘না না সমস্যা হবে কেন, বিভিন্ন আইটেম তো থাকবেই। এই যেমন ধরেন মাংসের মধ্যে গরু খাসি মুরগি- তিনটাই থাকবে এবং কোনটাই এক কেজির কম হলে আমার চলে না। আর মাছের মধ্যে আধা কেজি কৈ ভাজা, আধা কেজি মাগুরের ঝোল, আধা কেজি মলার চরচরি, এক কেজি বাইন। দুগ্ধ দুধির মধ্যে দুই কেজি মিষ্টি, এক কেজি ছানার পায়েস, এক কেজি মাখন---- হুজুর পদের ফিরিস্তি দিয়ে যেতে লাগলেন। জাকির অসহায়ের মতো হুজুরের পেটের দিকে তাকাল, ভুরি দেখে ভড়কে গেল। তারপর ‘ঠিক আছে হুজুর, আমার গিন্নির সাথে আলাপ করে তারিখটা আপনাকে পরে জানাবো’ বলে সালাম দিয়ে উঠে চলে গেল। কিন্তু জাকির বেচারা হুজুরকে এই যে ভয় পেল, সেদিন থেকে সে এ মসজিদ ছেড়ে দিয়ে অন্য মসজিদে চলে গেল। আর কোন দিন হুজুরের সামনে পড়ে না, দূর থেকে দেখলে অন্য রাস্তা ধরে চলে যায়।

জাকির খাটের কিনারে বসে আছে, বাচ্চাটা মেঝেতে পাতা দোলনায় চেচিয়ে কাঁদছে। সে এক নজর তাকিয়ে ‘যাঃ হালার পুত’ বলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর জুবেদা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে জাকিরের উপর হামলে পড়ল ‘তুমি কিসের বাপ কেমন বাপ, ছেলেটা এতক্ষণ ধরে কাঁদছে আর তুমি কাছে থেকেও একটু কোলে নিতে পারলে না। জাকির বিরক্ত গলায় বলল ‘আমি কোন ছেলের বাপ না আমি মেয়ের বাপ। আরে এত আদর করে লালন পালন করে লাভ কি, বড় হয়ে আকাম কুকাম করবে আর তখন পুলিশের ক্রসফায়ারে মরবে। তারচেয়ে এখনি মরে যাওয়া ভালো। কাজেই এত আদর যত্ন না করে এভাবেই ফেলে রাখ, মরলে তো মরলই না মরলেও বড় হয়ে মারামারি করে মরবে। জুবেদা বিরক্ত মুখে খাটের পাশে বসে বাচ্চাকে খাওয়াতে লাগল। জাকির মোসাহেবি ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে স্ত্রীর কাধে মাথা রাখল, তারপর মধু মাখা কন্ঠে বলল ‘চল না গো আমরা আবার শুরু করি, আমার যে আঠারটা মেয়ে দরকার।

জুবেদা খেঁকিয়ে উঠলো ‘জীবনেও আর তোমার মেয়ে হবে না। কারন এখন তুমি শক্তিমান ও বির্যবান হয়ে গেছ। মেয়েগুলিকে বিয়ে দিয়ে তাদের সুখ-শান্তি দেখে এখন তুমি রাজা হয়ে গেছ, নিশ্চিন্তায় বসে বসে খাচ্ছ, দিনদিন জোয়ান হচ্ছ আর শক্তিশালী হচ্ছ। এজন্য তোমার শুক্রানুও শক্তিশালী হয়ে গেছে। আর এই শুক্রাণু আমার ডিম্বাণু গুলিকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে ছেলে হিসাবে জন্ম নিচ্ছে। কাজেই মেয়ের আশা করে লাভ নেই, এখন থেকে তোমার ছেলেই হবে। আগে আমি ছিলাম শক্তিশালী তুমি ছিলে দুর্বল, তখন আমার ডিম্বাণু তোমার শুক্রাণুকে পরাজিত করে বিজয়ী হতো, তারপর মেয়ে হয়ে জন্ম নিত। এখন আমি দুর্বল আর তুমি সবল। কাজেই তোমার শুক্রাণু বিজয়ী হতে থাকবে আর একটার পর একটা ছেলে জন্ম নিতে থাকবে। সুতরাং মেয়ের আশা বাদ দাও।

জাকির ভীষন চিন্তায় পরে গেল, তার মুখটা নৈরাশ্যে কালো হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল ‘আচ্ছা শোনো শক্তিশালী হবার উপাদান হলো ভিটামিন যুক্ত খাবার, যেমন দুধ কলা ডিম মাংস ইত্যাদি। এখন থেকে তুমি এগুলো নিয়মিত খেয়ে শক্তিশালী হয়ে যাবে আর আমি খাব ভিটামিন শুন্য খাবার। যেমন আলু ভর্তা শুটকি ভর্তা বেগুন ইত্যাদি, কারণ বেগুনে কোন গুন নাই, অথবা না খেয়ে থাকব। এরপর থেকে বেছারা জাকির শুক্রাণু দুর্বল করে মেয়ে পাবার আশায় কৃচ্ছ সাধনা শুরু করলো। কোনদিন হয়তো আলু বা শুটকি বা বেগুন ভর্তা দিয়ে দুয়েক লোকমা খায়, আবার কোন দিন না খেয়ে থাকে। আর জোবেদা বেগম দুধ ডিম মাংস ইত্যাদি খেয়ে ডিম্বাণু শক্তিশালী করার সাধনায় নামল।

১৩

কন্যা কল্যাণ সংঘ থাবড়া সমিতি নামে প্রসিদ্ধি লাভ করল। সবাই সমিতিতে বসে আড্ডা দিচ্ছে, গল্পগুজব করছে। তখন একজন বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে কেঁদে ফেললো। তারপর বলল ‘আমরা বুড়াবুড়ি না খেয়ে মরার উপক্রম হয়েছি। আমাদের কোন সম্পদ নাই, ছেলেও নাই একটা মাত্র মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু জামাই আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। আগে আমার বউ টুকটাক কাজ করে সংসার চালাত, এখন সেও শয্যাশায়ী। কাজেই এখন আমাদের না খেয়ে মরা ছাড়া উপায় নাই, আপনারা আমাদের একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেন।

সমিতির সভাপতি জাকির বৃদ্ধ ও তার জামাইয়ের পরিচয় নিল। তারপর সেই মহল্লার প্রধান মুরুব্বীকে সাথে নিয়ে কয়েকজন রওনা হলো। বৃদ্ধকে তারা সবকিছু শিখিয়ে দিল। জামাইকে বাসায় পাওয়া গেল, জাকির বৃদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করলো কিন্তু সে সাহস পায় না। কয়েকবার ইঙ্গিত করলো, সে শুধু কাচুমাচু করে। আরেকবার জোরে ধমক দিল, বৃদ্ধও কিছুটা সাহস পেয়ে এগিয়ে গিয়ে জামাইকে সমানে থাবড়া মারতে লাগলো। জামাই শশুরের চড় খেয়ে চক্রাকারে ঘুরছে আর চেঁচাচ্ছে ‘আব্বা আব্বা একি করছেন, মারছেন কেন, ভালো হবে না কিন্তু’ সে চেঁচিয়েই যাচ্ছে।

একজন বলল ‘মূর্খ তুমি থাবড়া সংঘের আদালতের আসামি। জামাই এতক্ষণে বুঝতে পেরে শশুরের দু'পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। তখন মহল্লার মুরুব্বী বলল ‘এই বেচারার একটা মাত্র মেয়ে তোমার কাছে বিয়ে দিয়েছে, তুমি ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই। এখন তাদের দেখাশোনা করে কে? জামাই বলল ‘আমি কিভাবে তাদেরকে দেখব, আমি মাত্র বিশ হাজার টাকা বেতন পাই। বাড়িতে দরিদ্র মা-বাবা আছে, তাদেরকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে দুইটা বাচ্চার লেখাপড়া বাসা ভাড়া ও সংসার খরচ চলে না। সেখানে আমি শ্বশুর-শাশুড়িকে কি করে দেখব?

জাকির বলল ‘না দেখে তো উপায় নাই। কারণ তারাও তোমার বাবা-মা। মা-বাবা যেমন তোমাকে জন্ম দিয়েছেন, তদ্রুপ শশুর শাশুড়িও তোমার বউকে জন্ম দিয়ে তোমার হাতে তুলে দিয়ে তোমার সংসার জুড়ে দিয়েছেন। বউ ছাড়া তোমার চলবে না, তোমার সন্তানাদি হবে না, বংশ রক্ষা হবে না। তোমার সংসার ও বংশ রক্ষা করার জন্যই শ্বশুর তার মেয়ে প্রতিপালন করে বিনিময় ব্যতিত তোমার হাতে তুলে দিয়েছেন। এতে তার লোকসান ব্যতীত কোন লাভ নেই, সম্পূর্ন লাভ হলো তোমার। কাজেই তুমি এই বেচারার মেয়ে প্রতিপালনের খরচটা দিয়ে দাও অথবা তুমি তাদেরকে লালন-পালনের দায়িত্ব বহন কর। কারণ ধর্মীয় ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পিতা মাতা ও শ্বশুর শ্বাশুরি উভয় শ্রেণী সমান। তাদের দেখাশোনা করা, সেবা করা, ভরণ পোষণ করা ফরয। এখন তুমি কোনটা করবে ভেবে দেখ। জামাই ভয় পেয়ে গেছে, কারণ থাবড়া সংঘের লোকেরাই হল এ শহরের হর্তা কর্তা। তাদের অবাধ্য হওয়া মানে বনে বাস করে সিংহের সাথে যুদ্ধে নামার নামান্তর। কাজেই সে অনুগত দাসের মতো বলল ‘আপনারা যা বলবেন তাই করব।

জাকির বলল ‘সমিতির নিয়ম আনুযায়ী শ্বশুর-শাশুড়িকে তোমার ভাতা দিতে হবে, তোমার মা বাবাকে যেমন মাসে পাঁচ হাজার করে দাও তেমনি তাদেরকেও পাঁচ হাজার করে দিতে হবে। বাকি দশ হাজারে যদি তোমার সংসার না চলে তাহলে রাতদিন পরিশ্রম কর, প্রয়োজনে তোমার বউকেও কাজে লাগাও। তোমরা জোয়ান মানুষ, তোমরা পরিশ্রম কর। কিন্তু পৃথিবীর ওইসব বিদায়ী অতিথি- যারা তোমাদের জন্য সারা জীবন কষ্ট করে তোমাদের সংসার জুড়িয়ে দিয়েছেন- তাদেরকে একটু শান্তিতে মরতে দাও। তাহলে মানুষের শ্রদ্ধা পাবে আর আল্লাহর কাছে পাবে পরম পুরস্কার। আমাদের সমিতির সার্বজনীন ঘোষণা হলো- পিতা-মাতার ন্যায় শ্বশুর-শাশুড়িকেও ভরণপোষণ এবং সেবা যত্ন করতে হবে। যারা এই আইন মানবে না তারা মানুষের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাক অন্য কোন গ্রহে’ বলে তারা চলে গেল।

জাকির খেতে বসেছে, ডাইনিং টেবিল ভর্তি তরকারির বিভিন্ন আইটেম। সে কাজের মহিলাকে ধমক দিল ‘এক বাটি করে মাংস কেন, গামলা ভরে ভরে আন। তারপর আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগল ‘খেতা পোড়ি শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর। জীবনটা পচিয়ে ফেলেছি, না খেয়ে খেয়ে আমার শরীরটাই ভেঙ্গে গেছে। বিজ্ঞান ফেল, মানুষের চেষ্টা-সাধনা সব ব্যর্থ, আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করবেনই, শুধু শুধুই কষ্ট করে লাভ নেই। ছেলে মেয়ের গুষ্টি কিলাই’ বলতে বলতে সে মাছ-মাংস-ডিম গোগ্রাসে খাচ্ছে আর রাগে গরগর করছে। ঘটনা হল, এবারও তার ছেলে হয়েছে এজন্যই সে রেগে গেছে। তার ওপর গত এক বছর না খেয়ে শুক্রাণু দুর্বল করার সাধনা ব্যর্থ হয়েছে দেখে সে আরো ক্ষেপে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা কয়দিন বেঁচে থাকবে শুধু খাবে, এলোপাথাড়ি খাবে, সর্বভুকের মত দুনিয়ার সব কিছু খেয়ে ফেলবে। খাওয়া-দাওয়ার পর কাজের মহিলাকে চড়া কন্ঠে বলল ‘বেশি বেশি রান্না করে রেখ, রাতে হুজুর খেতে আসবে।

দুঃখের সময়ে মানুষ আশ্রয় খুঁজে। তাই মাগরিবের পর জাকির বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে সেই আগের ইমাম সাব হুজুরের কামরায় বসল। তার সকল সাধনা ব্যর্থ হয়ে ছেলে হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করল আর ইমাম সাব সান্ত্বনা দিল। সবশেষে বলল ‘হুজুর আসলে আপনার দাওয়াতের আইটেম তো একটু বেশি, সেগুলি জোগাড় করতে করতে আমার এত দিন চলে গেল। এখন মোটামুটি জোগাড় করেছি, এশার পর চারটে খাবেন। হুজুর হতাশ গলায় বললেন ‘আপনি কি আমার সাথে ইয়ার্কি মারতে এসেছেন নাকি, চারটে খেলে আমার কি হবে? জাকির হোসেন বলল ‘ঠিক আছে চারটে না হলে আটটা খাবেন, তাও না হলে তিন চারে বারোটা খাবেন। চিন্তা করবেন না আপনার পেট ভরিয়ে দিব’ বলে সে সালাম দিয়ে চলে গেল।

এশার পর ইমাম সাব এসেই ডাইনিং টেবিলে চলে গেলেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভালো করে দেখলেন। বিশাল বড় বড় বাটি ও গামলায় মাছ-মাংস-ডিম চিংড়ি কৈ শিং মাগুর ইত্যাদি হরেক রকম খাবার। তিনি আশ্বস্ত হয়ে বললেন ‘হ্যাঁ ঠিক আছে, এবার আমার তেল ও পানি পড়া কাজ করবে। কারণ খাওয়া-দাওয়া কম হলে আবার আমার তদবির কোনো কাজ করে না। খাওয়া পর্ব শেষ করে তিনি তেল ও পানি পড়ে দিয়ে বললেন ‘নিন পানি দিয়ে গোসল করাবেন আর তেল মালিশ করবেন। ব্যস আপনার ছেলেকে লেখাপড়া করাতে হবে না, এমনিতেই পীর-দরবেশ ওলী আওলীয়া হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ, তারপর তিনি চলে গেলেন।

১৪

জাকির হোসেনের সবগুলি জামাই উচ্চশিক্ষিত, চাকরিজীবী ও বিত্তবান। সকলেরই টাউনে বাসা আছে কিন্তু চতুর্থ জামাই শাফায়েত একটু দরিদ্র, শহরে বাসা নাই। সে একটা কলেজে শিক্ষকতা করে, বউ বাচ্চা নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকে। তার আশা শশুরের বাসাটা দখল করবে, কারণ অন্যান্য জামাইদের নিজস্ব বাসা আছে, নিজের বাসা ছেড়ে তাদের কেউ এখানে আসবে না। কাজেই সে শশুরের বাসাটাকে নিজের বাসা বলেই গণ্য করে আসছিল কিন্তু হঠাৎ করে শশুরের ছেলে উৎপাদনের প্রতিযোগিতা দেখে বেচারা নিরাশ হল এবং শ্বশুরের দিকে মনে মনে ক্ষিপ্ত হল।

ভায়রাদের মধ্যে মির্জা গালিবের সাথে তার সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা। তার কাছে গিয়ে বলল ‘দেখলে তো আমাদের শশুর বুড়া বয়সে কেমন আকাম শুরু করেছে। গালিব অট্টহাসি দিয়ে বলল ‘কেন বাসাটা পাবেন না বলে খুব দুঃখ হচ্ছে বুঝি, এত লোভ ভাল নয়। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট, আপনার লোভের কারণে শশুরের ছেলে হচ্ছে। আমার কত বাসা খালি পড়ে আছে বললাম যে কোন একটাতে থাকেন গিয়ে কিন্তু না আমার বাসায় থাকলে আপনার হেম্পার ফুটো হয়ে যায়। আছেন শশুরের বাসার ধান্দায় এখন খেয়ে ওঠেন।

শাফায়েত হেসে বলল ‘এই ভদ্দর লোক আমি কি ভিক্ষুক নাকি যে তোমার বাসায় থাকব। শ্বশুরের বাসায় আমার অধিকার আছে। আচ্ছা বাদ দাও আসল খবরটা বলি- ছেলে হয়েছে কেন এই দুঃখে শ্বশুর মশাই আকিকা করবেন না। তোমার আপা আমাকে পাঠিয়েছে, তোমার সাথে পরামর্শ করে একটা ব্যবস্থা করার জন্য। গালিব বলল ‘আসলে কি জানেন, আমাদের শশুরের মেয়েগুলি সবাই ভাল, সকলের ভালো বিয়ে হয়েছে সুখে শান্তিতে আছে। এজন্যই তিনি মেয়েদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠেছেন। আমাদেরও উচিত তার এই আস্তাটা অটুট রাখা। এই যে আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি, আপনি নিজে গিয়ে খাসি কিনে আত্মীয়-স্বজন দাওয়াত করে আকিকার ব্যবস্থা করেন’ বলে সে এক বান্ডেল টাকা বের করে দিল।

শাফায়েত হাসি মুখে টাকাটা নিয়ে বলল ‘আচ্ছা তা না হয় করলাম কিন্তু ঐ হালার পুতের এই ছেলে উৎপাদনের প্রতিযোগিতাটা বন্ধ করতে হবে’ বলে সে বেরিয়ে গেল। তারপর আড়ালে গিয়ে টাকা গুনে আপন মনে হাসলো। কারণ এখান থেকে সে অর্ধেক টাকা পকেটে তুলতে পারবে। আর গালিবের টাকা খাওয়াটাকে সে নিজের অধিকার মনে করে। কারণ সে দরিদ্র আর গালিব বিত্তবান, তদুপরি হাসপাতাল করে সে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে। এজন্যই সে গালিবের সাথে হটলাইন বজায় রাখে।

আকিকার দিন আত্মীয়স্বজন সবাই আসল। আত্মীয় বলতে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন আর জাকিরের কিছু বন্ধু বান্ধব। মেহমানরা খাবার টেবিলে বসে হাসি ঠাট্টার ঝড় তুলল। একজন বলল ‘আমাদের বেয়াই বুড়া বয়সে এসব কি উৎপাত শুরু করল। আরেক বেয়াই বলল ‘আরে শোনেন তার মুরোদ আছে, সে মুরোদের ব্যাটা। আপনার মুরোদ থাকলে আপনিও দেখান। অন্যজন বলল ‘আসলে সে পরকালে বিশেষ ফ্যাসিলিটি পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের নবীর উম্মত বাড়িয়ে পরকালে কিছু বোনাস পেতে চাচ্ছে। সে খুব ভালো কাজ করছে আপনারা ঠাট্টা মশকরা করছেন কেন? কারণ আমাদের নবী বলেছেন ‘যে মেয়ে লালন পালন করবে সে জান্নাতে যাবে। আরেকজন বলল, কিন্তু সে তো ছেলে উৎপাদন করছে আর ছেলে লালন-পালনের ক্ষেত্রে রাসুল (সাঃ) এই সুযোগের কথা বলেননি। আগেরজন বলল, সে তো মেয়েই জন্মাতে চাচ্ছে কিন্তু আল্লাহ ছেলে দিয়ে দিলে তার কি করার আছে। এক বন্ধু বলল ‘আসলে আমাদের দেশে তো রত্নগর্ভা, আদর্শ বাবা ইত্যাদি বিভিন্ন পুরস্কার দেয়া হয় এখন জাকিরের উদ্দেশ্য হচ্ছে মেয়ের ন্যায় দশটা ছেলে জন্ম দিয়ে আদর্শ পিতার পুরস্কারটা জিতে নেয়া। এক বেয়াই বলল ‘আরে রাখেন আপনার পুরস্কার, জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দায়ে যে কোন সময় সে এরেস্ট হয়ে যেতে পারে। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে জনসংখ্যা কমানোর ব্যাপারে সরকারি নির্দেশ আছে অথচ সে সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এভাবে একেকজন একেক মন্তব্য করছে আর খাবার টেবিলে হাসি ঠাট্টার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

বেচারা জাকির মেহমানদের কাছে আসে, আবার লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে চলে যায় আর মিটিমিটি হাসে। জামাইরাও আড়ালে-আবডালে পরস্পরে ঠাট্টা করে ‘আসলে কি জানো আমাদের শশুর বুড়া হলে কি হবে আমাদের চেয়ে তার তেজ বেশি। তিনি জামাইদের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন কার অশ্ব ক্ষমতা বেশি। কাজেই এখন তো দেখছি শশুরের সামনে আমাদের লজ্জা পাবার জোগাড় হয়েছে। আবার মেয়েরা মাকে তিরস্কার করে ‘তোমরা বুড়া বয়সে এসব কি শুরু করেছ, লজ্জায় আমরা শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাতে পারি না। আমাদের একটা ভাই হয়েছিল সেই তো যথেষ্ট আবার কেন? আরেক মেয়ে বলে ‘শোন আম্মাকে বলে লাভ নেই, আসল দোষ হলো ঐ বুড়াটার। আব্বাকে সাইজ না করলে সে ক্ষান্ত হবে না। মেয়েরা মা ও শাশুড়ির মত মাকে তিরস্কার করতে লাগল। বেচারি জুবেদা নববধূর মত বাচ্চা কোলে নিয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে, লজ্জায় বেচারি মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে।

মেহমানরা বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বুড়া বয়সে আকাম করার দায়ে মেয়েরা মা-বাপের ওপর হামলে পড়ল। দশ মেয়ে একসাথে গালাগালি ও তিরস্কার শুরু করলো, জামাইরাও বিপুল উদ্যমে উৎসাহ দিয়ে যেতে লাগল। বেচারা জাকির লজ্জা পেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো ‘হুঃ হালার পুত ছেলে জন্ম দিয়ে ফাও গালি খাচ্ছি, মেয়ে জন্ম দিয়ে গালি খেলেও মনটা সামাই দেয়া যেত। ওদিকে জুবেদা এক রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইল। শশুর বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেই জামাইরা আরো বেশি হইচই শুরু করল, তাদের একেকজন একেক মন্তব্য করে আর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।

চতুর্থ জামাই সোহানার জামাই বলল ‘এই যে এক একটা শালা দুনিয়াতে আসছে, এরা হলো আমাদের শত্রু। কারণ কয়েকদিন পর বুড়াবুড়ি মারা যাবে তখন ওই শালারা আকাম করবে আর আমাদের ঘাড় মটকে রক্ত খাবে। কাজেই সময় থাকতেই এই শালাদের আগমনের পথ বন্ধ করতে হবে, বুড়াবুড়ির বিছানা পৃথক করতে হবে। তোমরা কিছু না করলেও আমিই ব্যবস্থা করছি। জুবেদা রুদ্ধ দ্বার ঘরে বসে জামাইদের মন্তব্য শুনে লজ্জায় ঘামছে।

কয়েকদিন পর শাফায়েত মির্জা গালিবের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে খাট ও নূতন বিছানাপত্র কিনল। তারপর জাকিরের অনুপস্থিতিতে সেগুলি নিয়ে এসে এক রুমে পেতে দিয়ে শ্বাশুড়িকে বললো ‘আম্মা আপনাদের এখন বয়েস হয়েছে। বুড়া বয়সে বিভিন্ন রোগ পীড়া দেখা দেয়, একসাথে থাকলে একজনের রোগ আরেকজনের মধ্যে ছড়ায়, এজন্য আলাদা থাকতে হয়। তাছাড়া এখন এই বয়সে আব্বাজানের বিশ্রামের প্রয়োজন, আপনি বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে থাকবেন উনার বিশ্রামের ব্যাঘাত হবে। তাই আমরা সবাই পরামর্শ করে এই ব্যবস্থা করেছি। এখন থেকে আপনারা পৃথক বিছানায় থাকবেন, আপনি এই রুমে আর আব্বাজান ঐ রুমে থাকবেন’ বলে সে জিভে কামড় দিয়ে চলে গেল। জুবেদা ঘোমটা টেনে শুধু লজ্জায় লাল হল কিন্তু জামাইকে কিছু বলার সাহস পেলো না।

জাকির রাত্রে বাসায় ফিরে নতুন খাট নতুন বিছানা দেখে চোখ কপালে তুলে স্ত্রীকে ব্যাপার কি জিজ্ঞেস করল। জোবেদা বলল ‘আহম্মক এখনও বুঝ নাই, মেয়েরা ও জামাইরা আর আমাদেরকে এক বিছানায় থেকে আকাম করতে দিবে না, এতে তারা লজ্জাবোধ করে। জাকির ক্ষেপে গেল, ‘কী হালার পুতদের এত বড় সাহস, আমাদের বিছানা পৃথক করতে চায়। আমার বিছানা আমি গরম করব তাতে ওদের এত মাথাব্যথা কেন? আমার মেয়েদেরকে নিয়ে ওরা যখন বিছানা গরম করে তখন তো আমি নাক গলাতে যাই না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমিও ওদের বিছানা পৃথক করে দিব, আমার মেয়েদেরকে নিয়ে আসব। তখন ওদেরকে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পথে বসে কাঁদতে হবে বলে দিলাম। অনেক অপমান সহ্য করেছি আর না, আমার যা ইচ্ছা তাই করব ওরা নাক গলাতে এলে থাপড়িয়ে নাক ভেঙ্গে দেব’ বলে সে রাগে গরগর করতে করতে বিছানাটা ফেলে দিয়ে খাটটা টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে ফেলে রাখল।

তারপর জোবেদাকে বলল ‘তুমি সাজগোজ কর, আমরা আজ বাসর করব’ বলে বেরিয়ে গেল। একটু পর কিছু ফুল ও ঝালর নিয়ে এসে খাটের মশারি স্ট্যান্ডে লাগিয়ে স্ত্রীকে বলল ‘কি ব্যাপার তুমি এখনও বসে আছ যে? জুবেদা খেঁকিয়ে উঠলো ‘যাও তোমার এসব আকামের মধ্যে আমি আর নেই। মেয়ের কথা বলে বলে একটা করে অপকর্ম করছে আর আমি মেয়ে ও জামাইদের সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না, এই লজ্জার চেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরা ভাল। জাকির তোসামুদি করে স্ত্রীর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো ‘যাও না গো তুমি আমার সোনা তুমি আমার রূপা, আমার যে কয়েকটা মেয়ের প্রয়োজন, মেয়ের জন্য আমার মনটা খা খা করছে। মনে আছে আমার মেয়েরা ছোট থাকতে কিভাবে আমাকে আদর করতো আমিও আদর করতাম, এসব মনে হলো আমি আর স্থির থাকতে পারি না। তাছাড়া একটা করে মেয়ে জন্ম দিলেই নগদ একটা করে বেহেশত, সামর্থ্য থাকতে এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করা উচিৎ নয়, ইত্যাদি ফামপট্টি দিয়ে সে স্ত্রীকে রাজি করাল। তারপর দুজনেই বাসর করার জন্য বর কনের পোশাক পরিধান করল। এরপর তারা নব দম্পতির মতো সংসার করতে লাগল।

১৫

জাকির হোসেন রিটায়ার্ড করেছে। কিন্তু রিটায়ার্ড করলে কি হবে সে দিন দিন জোয়ান হয়ে উঠছে। পাকা চুল দাড়িতে কলপ দিয়ে রাখে, যুবকদের মত বুক ফুলিয়ে হাটে। মাথা উঁচু করে থাবড়া সংঘের সভাপতির চেয়ারে বসে থাকে। এখন তার হাতে অফুরন্ত সময়, এ সময়টা সে সমিতির উন্নতি ও প্রচার-প্রসারের কাজে ব্যয় করে। একদিন পাশের মহল্লার এক ব্যক্তি এসে বলল ‘আমার ভাড়াটে শামসুল গরিব মানুষ, ফুটপাতে রেডিমেড কাপড়ের ব্যবসা করে। তার আগের দুইটা মেয়ে আছে এখন সিজারিয়ান করে আরেকটা মেয়ে হয়েছে। সে এখন পর্যন্ত মেয়ের মুখ দেখেনি, তার মা দেখাশোনা করছে। সে ঘোষণা দিয়েছে- এই বউ রাখবে না হাসপাতাল থেকে ছুটি দিলেই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিবে। কাজেই আপনারা এর একটা বিহিত করেন। তখন জাকির ওই মহল্লার প্রধান মুরুব্বিকে কল করে বললো ‘আপনি বাসায় থাকবেন একটা জরুরী কাজে আমরা আসছি।

শামসুল মাকে ধমকাতে লাগলো ‘তুমি যত ওকালতিই কর যে বউ খালি মেয়ে বিয়ায় এমন মাগী আমি রাখবো না, তার ভাইকে খবর দিয়েছে সে আসলে হাসপাতাল থেকেই সোজা বিদায় করে দেব, এই অলক্ষিকে আর বাসায় তুলব না। মা বলল ‘বউয়ের কি দুষ আল্লাহ মেয়ে দিছে সে কি করবে? শামসুল খেঁকিয়ে উঠলো ‘ওর দোষ না তো কি আমার দোষ, বাচ্চা কি আমি পেটে ধরেছি নাকি যে --- কথা শেষ হল না দরজায় ঘা পড়ল। সে জানালায় উঁকি দিয়েই চমকে উঠলো, তারপর ফিসফিসিয়ে বলল ‘সর্বনাশ থাবড়া পার্টি এসে গেছে মা তুমি গিয়ে দরজাটা খুলে দাও।

সমিতির লোকেরা ভিতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। কারণ শামসুল নাচছে, যেই সেই নাচ নয় একেবারে খ্যামটা নাচ। মহল্লার মুরুব্বি বলল, শামসুল তুমি কি আসলেই নাচ্ছ নাকি আমাদেরকে দেখে ভান করছ? শামসুল বলল ‘কি যে কন চাচা, এই যে দেখেন নাচ কত প্রকার ও কি কি। এই যে দেখেন এটা হল ব্রাজিলের খাম্বা নাচ, এইটা হল ঘেটো নাচ, এটা হল গারো নাচ--- মুরুব্বি অট্টহাঁসি দিয়ে বলল ‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে থাম থাম, এবার বল তো বাপু এই নাচের কারণটা কি? শামসুল বলল ‘নাচব না মানে, আল্লাহ আমাকে নিয়ামত দিয়েছেন মেয়ে দিয়েছেন, সেই আনন্দেই তো নাচ্ছি’ বলে আবার নাচতে নাচতে তার মাকে বলল ‘ওমা তাড়াতাড়ি মিষ্টি আন, তাদেরকে মিষ্টিমুখ করাও, এমন খুশির সময় তাদেরকে মিষ্টি না খাইয়ে ছাড়া যাবে না।

মুরুব্বি বলল ‘আচ্ছা থাম আর নাচ দেখাতে হবে না’ বলে তারা বসল। শামসুল আরো কয়েকটা চেয়ার ও পিড়ি এগিয়ে দিল। জাকির বলল ‘আচ্ছা শামসুল মেয়ে হয়েছে বলে তুমি কি আসলেই খুশি নাকি অভিনয় করছ? তখন শামসুলের মুখটা একটু গম্ভীর হল, সে বিষন্ন গলায় বলল ‘আসলে কি জানেন চাচা আমার দুইটা মেয়ে আছে এখন আবার মেয়ে হয়েছে। আমি গরিব মানুষ, এই মেয়েগুলির লালন পালন, লেখাপড়া বিয়ে-শাদীর দায়িত্ব বহন করা আমার পক্ষে একটু কঠিন, এ জন্য কিছুটা চিন্তা করছি। জাকির বলল ‘আচ্ছা এছাড়া তোমার আর কোন দুঃখ নাই, মেয়ে হয়েছে বলে আফসোস নাই? শামসুল বলল ‘না চাচা, আফসোস নাই কারণ সে তো আমারই সন্তান।

‘বাহঃ চমৎকার’ জাকির চেঁচিয়ে উঠলো ‘তোমাকে ধন্যবাদ শামসুল, ছেলে হোক মেয়ে হোক সে তোমারই সন্তান। আর সন্তান তো সন্তানই সে কখনো ছেলে মেয়ে হয় না, এটাই সত্য কথা। শুন শামছুল, মেয়েগুলিকে তুমি শুধু চারটে ভাত খাওয়াবে, তাদের লেখাপড়া ও বিয়ে-শাদীর দায়িত্ব সমিতি মহান করবে। তুমি কালকেই সমিতিতে গিয়ে তোমার মেয়েদের নাম ঠিকানা দিয়ে তাদের লেখাপড়া বাবদ মাসিক ভাতা নিয়ে আসবে’ বলে তারা উঠতে চাইল কিন্তু শামসুল তাদেরকে মিষ্টি না খাইয়ে ছাড়লো না। এভাবে প্রতিদিন বিভিন্ন সমস্যা আসে আর সমিতি গিয়ে ফায়সালা করে দেয়।

একদিন এক ভদ্রলোক তার শাশুড়িকে নিয়ে আসল, মহিলাকে দেখে সম্রান্ত ও ধনী বলে মনে হল। ভদ্রলোক ইতস্তত করে বলতে শুরু করল ‘আমার নাম আসিফ, একটা সরকারি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করি। আমার শ্বশুর মারা গেছেন কয়েক বছর আগে, তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। তার দুই ছেলে এক মেয়ে- মানে আমার ওয়াইফ। ছেলে দুইজন খাদ্য বিভাগে সরকারি চাকরি করে, তারা বাসাতেই থাকে, এই বাসাটা আমার শাশুরীর। মেয়েকে ঠকানোর জন্য আমার সম্বন্ধীরা বাসাটা লিখে নিতে চায় কিন্তু আমার শাশুরি রাজী হয় না। এজন্য ছেলেরা সব সময় বকাবকি করে অত্যাচার করে। আবার তাদের বউয়েরা এই বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে রান্নাবান্নাসহ বাসার যাবতীয় কাজকর্ম করায়, বাচ্চা রাখায় কিন্তু ঠিকমত খেতে পরতে দেয় না। অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তার দেখায় না, ঔষধ পত্তর কিনে দেয় না, কাজের মেয়ের মতো এক রুমে ফেলে রাখে। ছেলে বা ছেলের বউ কেউ উকি দিয়ে পর্যন্ত দেখে না। বেচারিকে অসুস্থ শরীর নিয়েও কাজ কর্ম করতে হয়, একটু উল্টা পাল্টা হলে গালিগালাজ ও জ্বালা যন্ত্রণা তো আছেই।

তার উপর বউদের উস্কানিতে ছেলেরা কয়েকদিন মায়ের গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে। এমনকি মাঝে মধ্যে টেনে হেচড়ে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসে আর বলে ‘এই বাসায় তুই আর থাকতে পারবি না, যেখানে খুশি সেখানে চলে যা। তখন তিনি আমার বাসায় চলে আসেন আর আমি গিয়ে সম্বন্ধিদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে দিয়ে আসি। সর্বশেষ দুই মাস আগে ছেলেরা মায়ের পুটলা পাটলি বাইরে নিক্ষেপ করে মাকে ধাক্বিয়ে বের করে দিয়ে বলল ‘তোর যেখানে খুশি চলে যা, আজ থেকে এই বাসার দরজা তোর জন্য বন্ধ। তারপর তারা সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ করে দিল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে আমার বাসায় এসে উঠলেন। আমি বললাম ‘এখন থেকে আপনি আমার সাথে থাকবেন, সেই থেকে তিনি আমার সাথেই আছেন।

কিন্তু সমস্যা হল আমার মা বাবা ভাই বোন আছে, তারা উনার দিকে বক্র দৃষ্টিতে তাকায়, এতে তিনি অপমান বোধ করেন। বেশ কিছুদিন ধরে বলছেন, তিনি আর জামাইয়ের বাসায় থাকবেন না, ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টস বা বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে খাবেন’ বলে আসিফ একেবারে ডুকরে কেঁদে উঠল। সমিতির লোকেরাও চোখ মুছলো, শাশুড়ি বোরকার নিচে মুখ আড়াল করল। আসিফ শান্ত হয়ে বলল ‘গতরাতে তিনি নাই, অনেক খুঁজাখুঁজি করে রেলস্টেশন থেকে ধরে নিয়ে আসলাম, আর কিছুক্ষণ দেরি হলেই ঢাকায় চলে যেতেন। উনার মেয়ে তিরস্কার করার পর তিনি বললেন ‘তিনি জামাইয়ের পরিবারে বোঝা হয়ে থাকবেন না, নিজেই একটা কিছু করে খাবেন। তখন বাধ্য হয়ে আমি আপনাদের কাছে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখন দেখুন এই অসহায় বৃদ্ধা মহিলার জন্য আপনাদের কিছু করণীয় আছে কিনা? এক সদস্য বলল ‘ভয়ংকর ব্যাপার, খোদার আরশ কেঁপে উঠার মত ঘটনা। জাকিরের অক্ষিদ্বয়ে আগুন ঝড়ছে, সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ‘আমাদের করণীয় কিছু আছে কিনা তা কাল দেখতে পাবেন। আপনারা সবাই আগামীকাল বিকাল চারটায় আপনার শ্বাশুড়ীর বাসায় উপস্থিত থাকবেন, আপনার সম্বন্ধিদেরও বলে দিবেন।

পরদিন বিকালে সেই পাড়ায় হৈ চৈ পড়ে গেল। সমিতির লোকজন, ওসি, স্থানীয় কমিশনার, নেতৃবৃন্দ ও মুরুব্বিসহ অন্তত শ'খানেক লোক এসে উপস্থিত হল। বিচার দেখার জন্য মহল্লাবাসীরা এসে ভিড় করল। সমিতির সিদ্ধান্ত জানিয়ে ওসি ও অন্যান্য মুরব্বীদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। ওসি ছেলে দু’জনকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করল ‘এই বাড়ির মালিক কে? ছেলেরা বলল আমারাই তো। ওসি বলল ‘কাগজপত্র দেখাও। ছেলেরা বলল ‘আসলে বাসাটা আমাদের মায়ের নামে। ওসির মাথায় আগুন ধরে গেল, সে দু’টাকেই গরুর মত পেটাতে লাগলো আর বকতে লাগলো ‘শুয়োরের বাচ্চারা, তোদের আবার মা আছে নাকি, তোরা কুত্তার বাচ্চা। কুত্তার বাচ্চা ছাড়া মাকে কেউ রাস্তায় ফেলে রাখে নাকি, এটা কুত্তার বাচ্চাদের কাজ। মালিককে বাসা থেকে বের করে দিয়ে জবরদখল করেছিস, আজ তোদেরকে মা চিনাব’ বলে বেদম পেটাতে লাগল।

বুড়ি দৌড়ে এসে ওসির পায়ে পড়ল ‘বাবা ওদের কোনো অন্যায় নেই মারছেন কেন? ওসি ধাক্কা দিয়ে বুড়িকে সরিয়ে দিয়ে পেটাতে লাগলো। তখন জাকির এসে তাকে থামাল। ওসি গর্জে উঠল ‘এই শুয়োরের বাচ্চারা দশ মিনিটের মধ্যে বাসা খালি করে দিবি, আমরা মালিককে বাসা বুঝিয়ে দিয়ে যাব। তারপর পুলিশকে হুকুম দিল বাসার মালামাল বের করে দিতে। পুলিশ গিয়ে মহিলা ও বাচ্চাদের বের করে দিয়ে বাসার মালামাল বাইরে নিক্ষেপ করতে লাগলো আর জিনিশপত্র ভাঙতে লাগল।

বুড়ি পাগল হয়ে গেছে, কখনও ওসির হাতে পায়ে ধরে। কখনো জাকিরের, কখনো কমিশনারের বা মুরুব্বীদের হাতে-পায়ে ধরে আর আর্তনাদ করে ‘আপনারা একি করছেন আমার ছেলেদের বের করে দিচ্ছেন কেন। ওদের কোন দোষ নাই আমি মেয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম ইত্যাদি। একেকজনের হাতে পায়ে ধরে আর ধমক খায়। বুড়ির আহাজারিতে জাকির অধৈর্য হয়ে আসিফকে ডেকে এনে ধমক দিল, তোমার শ্বাশুড়ীকে সামলাও। আসিফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিল, সে স্ত্রীকে বলল মাকে নিয়ে পাশের বাসায় চলে যাও। কিন্তু মেয়ে এসে ধরতেই তিনি দুই থাপ্পর মেরে চেঁচিয়ে উঠলেন ‘আমার ছেলেদেরকে বের করে দিচ্ছে আর তোরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিস’ বলে আবার মাতম শুরু করল।

বাসা পরিষ্কার করার কাজ শেষ হলে জাকির মহাল্লাবাসীকে একত্র করে মায়ের মর্যাদা সম্পর্কে ছোট একটা বক্তৃতা দিয়ে বলল, এটা সমিতির বিচার। আমরা বাসা দখলমুক্ত করে মালিককে দিয়ে গেলাম, তিনি একাংশে থাকবেন বাকিটা ভাড়া দিয়ে নিজের খরচ চালাবেন। এরপর কোনো ব্যতিক্রম হলে আমরা আরো কঠোর পদক্ষেপ নিব। তারপর সিদ্ধান্তটা বুড়িকে জানিয়ে আসিফকে দায়িত্ব দিয়ে তারা চলে গেল।

দুই ছেলে বউ বাচ্চা ও পু্টলা পাটলি নিয়ে বাসার সামনে বসে বসে কাঁদছে। বুড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে লক্ষ রাখতে লাগল, যেই দেখল সমিতির লোকেরা চোখের আড়ালে চলে গেছে অমনি সে দৌড়ে গিয়ে এক বউয়ের কূল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে পাগলের মতো চুমুতে লাগলো। তারপর একটা একটা করে নাতি-নাতনিকে জড়িয়ে ধরে আর কাঁদে ‘তোরা বাইরে থাকবি কেন, বাইরে থাকলে আমি থাকবো তোরা ঘরে যা। ছেলেদেরকে ঘরে যাওয়ার জন্য হাত ধরে টানতে লাগলো আর বলতে লাগলো ‘আমার বউ আর নাতিদের কি মান ইজ্জত নাই, ওরা এভাবে বাইরে পড়ে থাকবে নাকি? ওদেরকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে যা।

ছেলেদের মনটা হাহাকার করে উঠলো, তারা স্ত্রীদের অপকর্মের রাগে তাদেরকে কিল ঘুসি লাথি মারতে লাগল। বুড়ি চেঁচিয়ে উঠলো ‘এই আমার বউদের মারছিস কেন, আমি কিন্তু এখনি আবার সমিতিকে খবর দিব। ছেলেরা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘চল মা ঘরে চল। কিন্তু মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ‘নারে, আমি থাকলে তোদের সমস্যা হবে। আমার জন্য চিন্তা করিস না আমি বাইরে একটা কিছু করে চলতে পারব। তোরা যা বউ বাচ্চাদের নিয়ে ঘরে যা। ছেলেরা ডুকরে কেঁদে ওঠে মায়ের পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো ‘ও মা মাগো আর একটা কথাও বলবা না মা, আর একটা কথাও না, এখনি খোদার আরশ ভেঙ্গে পড়বে। তারপর তারা মায়ের পায়ের ওপর জবাই করা মুরগির মত ধাফড়াতে লাগল। মহাল্লাবাসীদের কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না, সবাই তিরস্কার করতে লাগল ‘হায় রে হতভাগ্য সন্তান, আজো মা চিনলি না। তারপর মা ছেলে বউ নাতি-নাতনি সবাই গলাগলি জড়াজড়ি করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে গেল। সেই কান্নায় আসিফ এবং তার স্ত্রীও অংশগ্রহণ করল।

১৬

কন্যা কল্যাণ সংঘ ওরফে থাবড়া সমিতির কর্মকাণ্ড ব্যাপক ও বিস্তৃত করার জন্য সমিতির পক্ষ থেকে সাধারণ সম্মেলন আহবান করা হলো। সম্মেলনে ব্যাপক আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে কয়েকটা প্রস্তাব পাস হল। যেমন-

১। কোন দরিদ্র পিতার একাধিক কন্যা সন্তান থাকলে শিক্ষা ও বিয়ে শাদীর ব্যবস্থা সমিতি করবে। তজ্জন্য সমিতি স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করবে।

২। অনাথ মেয়েদের সমিতির আশ্রমে প্রতিপালন করে তাদের শিক্ষা ও বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। তজ্জন্য বালিকা আশ্রম গড়ে তোলা হবে।

৩। কোন সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতার ব্যয়ভার বহন করতে অস্বিকার করলে তাদেরকে বাধ্য করা হবে। পিতা-মাতার প্রয়োজনীয় মাসিক ভাতা আদায় করে দেয়া হবে। যদি ছেলে না থাকে তাহলে মেয়ের-জামাই সেই দায়িত্ব বহন করবে। কিন্তু ছেলে মেয়ে কিছুই না থাকলে তাদেরকে সমিতির আশ্রমে প্রতিপালন করা হবে। তার জন্য সমিতি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলবে।

৪। দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি সমিতির সালিশ বোর্ড মীমাংসা করবে।

৫। সমিতির কার্যক্রম বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া হবে। প্রত্যেক এলাকার উচ্চপদস্থ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, বিত্তবান, ক্ষমতাবান ও নেতৃপর্যায়ের লোকদেরকে সমিতির সদস্য পদ দিতে হবে যাতে নির্বিঘ্নে সমিতির সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়।

৬। সদস্য ও বিত্তবানদের চাঁদা, সরকারি অনুদান ও দাতাদের অর্থায়নে সমিতির কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। সম্মেলনের পর থেকে জাকির তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে প্রস্তাবিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের কাজ শুরু করল। এই বিশাল সমিতির সভাপতি হয়ে সে বিরাট কর্মযজ্ঞে মেতে উঠলো, সে এখন ব্যস্ত মহাব্যস্ত।

আবার কানাঘুষা শুরু হলো, তবে এবারের আলোচনা অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করলো। কারণ এবার জাকির হোসেনের মেয়েদের মধ্যে সবচাইতে প্রভাবশালী ধনী ও সম্ভ্রান্ত দুই মেয়ে- বড় মেয়ে জাকিরা ও পঞ্চম মেয়ে হানানা গর্ভবতী। আর বাঙালির সংস্কৃতি হলো মেয়ে গর্ভবতী বা প্রসূতি হলে বাপের বাড়িতে অবস্থান করে, মা দেখাশোনা ও খায় খেদমত করে। কিন্তু জুবেদা খায় খেদমত করবে দূরের কথা সে নিজেই গর্ভবতী হয়ে বসে আছে। আবার বাঙালির কুসংস্কার হল একই বাড়িতে একাধিক গর্ভবতী থাকলে পেটের বাচ্চার ক্ষতি হয়। এ আশঙ্কায় মেয়েরা স্বামীর বাড়িতেই অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছে। শাশুড়ির ঘাড়ের উপর বুঝা হয়ে বসে আছে। এতে সবাই মনে মনে জাকির হোসেনের উপর ক্ষিপ্ত।

জামাইদের বাড়িতে এ নিয়ে আলোচনা হয়, সবাই হাসি-ঠাট্টা করে। শশুর হয়তো বলে ‘বৌমা তোমার বাবাকে আরেকটা বিয়ে করাও, সে তো দিনদিন জোয়ান হচ্ছে। তার দশটা মেয়ে হয়েছে এখন দশটা ছেলে না হওয়া পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হবে না। শাশুড়ি বলে ‘ঐ বুড়াটাকে বাসা থেকে বের করে দাও গিয়ে, বুড়াটার লাজ লজ্জা নাই। জামাইরা বউকে বলে ‘যাই বল আমাদের শ্বশুর কিন্তু কাজের লোক, তিনি আমাদের চেয়েও ক্ষমতাবান। মেয়েরা লজ্জায় মিইয়ে যায় কিন্তু কিছু বলতে পারে না। তারা মা-বাপের প্রতি মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়। তারপর বাসায় গিয়ে মা বাপকে ইচ্ছামত গালাগালি করে, অপমান করে। কয়েক দিন এভাবে চলার পর জাকির হোসেন মেয়েদেরকে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। এরপর থেকে সে কোন মেয়ে বা জামাইকে বাসার দিকে হাসতে দেখলেই এত দ্রুততার সাথে বাসা থেকে পলায়ন করে যে, কেউ দেখলে ভাববে চুরি করে বা আকাম করে পালাচ্ছে, যেভাবে কম বয়সী ছেলেরা আকাম করে পালায়।

কিন্তু কথায় বলে খেয়ে যায় দাড়িওয়ালা আটকে যায় গোফওয়ালা। নারীর ক্ষেত্রে এই প্রবাদটা যথার্থভাবে প্রযোজ্য। কারণ পুরুষ মজা মারে আর নারী আটকে যায়। জোবেদা খাতুনেরও একই অবস্থা, জাকির তো পালিয়ে বাঁচল কিন্তু জোবেদা তো আর কোথাও যেতে পারে না। মেয়েরা এসে বাপকে না পেয়ে তার উপর হামলে পড়ে ‘তোমরা এসব কি শুরু করেছ, তোমাদের জন্য আমরা শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাতে পারি না। তোমাদের কি লজ্জা শরম নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। বেচারি জুবেদা মেয়েদের সামনে নববধূর মত লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকে, লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে আর স্বামীর দিকে ক্ষেপতে থাকে। জাকির বাসায় আসতেই তার ওপর বাঘের মত আক্রমণ করে ‘বুইড়্যা লুচ্চা, তোমার জন্য আমি পেট নিয়ে জামাইদের সামনে যেতে পারি না, মেয়েদের মুখ দেখাতে পারি না। আগে ছেলের লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে আকাম বাধিয়েছ এখন আবার মেয়ের জন্য শুরু করেছ। তোমার এসব আকামের বুঝা আমি বহন করব কেন? আমি সংসারের কোনো কাজকর্ম করব না, সব তোমাকে করতে হবে।

এরপর সত্যিই সে শুয়ে বসে থাকে কিছু করে না। বেচারা জাকিরের কপালে বিপদ নেমে এল, স্ত্রীর কাপড় চোপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সংসারের টুকিটাকি কাজকর্ম সব তাকেই করতে হয়। বাচ্চা দুটিও তাকে রাখতে হয়, তাদের হাগা-মুতা, গোসল খাওয়া-দাওয়া সামাল দিতে গিয়ে বেচারার নাভিশ্বাস উঠে, বৃদ্ধ বয়সে শরীরে কুলায় না হাফিয়ে উঠে। তখন সে নিজেকে তিরস্কার করে ‘পাগল মন, আকাম যখন করেছ মাশুল তো তোমাকে দিতেই হবে।

এবারও জাকির হোসেনের ছেলে হলো, সে বুঝতে পারল আগে যেভাবে ছেলের আশায় একের পর এক মেয়ে হয়েছে এবারও মেয়ের আশায় একের পর এক ছেলে হচ্ছে। তিনটা ছেলে হয়ে গেছে আর মেয়ের আশা করা বৃথা। সে নিরাশ হল এবং দুঃখিত হল। কারণ সে জানে ছেলের সংবাদ শুনে এই যে তার মুখ কাল হয়েছে এই কালো মুখেই তাকে কবরে যেতে হবে। কারণ তার ছেলেগুলি বড় হয়ে আকাম কুকাম করে তার মুখ শুধু কালোই করবে কোনদিন উজ্জ্বল করবে না, যেভাবে তার মেয়েরা মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করেছে। বেচারা হতাশায় বাউন্ডুলে হয়ে গেল।

আকিকার দিন জাকিরের মেয়ের বাড়ির লোকজন, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবাই এল। একেকজন তাকে একেক পরামর্শ দিল। একজন বলল, ‘বঙ্গোপসাগরে একটা নতুন দ্বীপ জেগেছে, জাকির সেটা সরকারের কাছ থেকে লিজে নিক, তারপর কয়েকটা বিয়ে করে বউ নিয়ে সেখানে গিয়ে মানব উৎপাদন করে দ্বীপটা ভরিয়ে তুলোক। এভাবে তারা বিভিন্ন পরামর্শ দিতে লাগল আর ডাইনিং টেবিলের ওপর দিয়ে হাসি-তামাশার ঝড় ছুটল। জাকির লজ্জার চরমে উঠে মাঝে মাঝে রেগে যায়, সে বলতে চায় আমি তো আর আপনাদের মত মুরোদহিন না, আমার মুরোদ আছে আমি যত খুশি সন্তান পয়দা করব তাতে আপনাদের এত মাথাব্যথা কেন। কিন্তু মেহমানরা মনক্ষুন্ন হবে ভেবে কিছু বলে না।

খাওয়া দাওয়ার পর অতিথিরা পেটভর্তি মাংস পোলাও আর মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বিদায় হল। মেহমানরা চলে গেলে জামাইরা সবাই এক রুমে গিয়ে পরামর্শ সভায় বসল। পাশের রুম থেকে তাদের অট্টহাসিও দু-একটা কথা জাকিরের কানে এল আর সাথে সাথে সে ভড়কে গেল, তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল জামাইরা তাকে দন্ড দিবে কিন্তু দন্ডটা কি- মৃত্যুদন্ড নাকি যাবজ্জীবন সেটা বুঝতে পারলো না। সে বিষন্ন হয়ে জোবেদাকে গিয়ে বললো ‘মনে হয় মেয়েরা ও জামাইরা আমাকে কোনো দণ্ড দিবে। জুবেদা খেঁকিয়ে উঠল ‘দন্ড মানে কি, তোমাকে নেপোলিয়ানের মতো ওয়াটারলুতে নির্বাসন দেয়া দরকার, নইলে তোমার মেয়ে উৎপাদনের যুদ্ধ থামবে না।

জাকির অসহায় হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ এখন তো সব দোষ আমার। এটাই মেয়েদের দোষ, মেয়েরা হল চরম স্বার্থবাদী। কারণ তারা পুরুষের সাথে সকল কাজে সমান অংশগ্রহণ করে অথচ পরে দোষটা সম্পূর্ণ পুরুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। আকাম কি শুধু আমি একা করেছি তুমি করনি? জোবেদা ঝাঁঝিয়ে উঠল, তুমি প্রতারক, আমাকে মেয়ের আশ্বাস দিয়ে বাধ্য করেছ। বেচারা জাকির স্ত্রীর কাছে প্রশ্রয় না পেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। সে ভাবছে বাসায় থাকলে জামাইরা এসে দন্ড শোনাবে বা অপমান করবে তার চেয়ে বাইরে চলে যাওয়াই ভালো। তারপর সে বেরিয়ে যেতে যেতে চিন্তা করতে লাগল মেয়ে জন্ম দিয়ে অপমান সহ্য করলেও মনকে সান্তনা দেয়া যেত কিন্তু ছেলে জন্ম দেয়াটাই একটা আকাম, তার উপর অপমান- এটা মেনে নেয়া যায় না।

জামাইরা শশুরের দন্ড বিষয়ে একেক জন একেক মন্তব্য করে আর হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ে। মেয়েরাও অন্যরুমে হাসির আসর জমিয়েছে। অবশেষে চতুর্থ জামাই শাফায়েত বলল ‘আরে শুনেন, এই হালার পুতকে বাসা থেকে বের করা ছাড়া কোনভাবেই বিরত রাখতে পারবেন না। আমি গালিবের কথায় একটা খাট কিনে তাদের বিছানা পৃথক করে দিয়েছিলাম, আর এজন্য বেটা আমার উপর এমন ক্ষেপে গেল যে, এরপর থেকে আর আমার সাথে কথাই বলে না, এমনকি সালামের উত্তর পর্যন্ত দেয় না। আমাকে দেখলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। কাজেই এই হালার পুতকে দেশছাড়া না করলে আর চলছে না। আর এর একমাত্র পথ হলো তাবলিগ। কাজেই আমার প্রস্তাব হলো- জীবন চিল্লা না হলেও অন্তত তাকে এক বছরের জন্য দেশের বাইরে চিল্লায় পাঠিয়ে দেয়া হোক। কিছু বিতর্কের পর মেয়ে ও জামাইদের সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব ফাঁস হলো। তারপর জামাইদের মধ্যে মুরুব্বি হুমায়ূনকে দায়িত্ব দেয়া হলো তাদের শশুরকে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে।

শশুরের সফরের যাবতীয় বন্দোবস্ত জামাইরাই করল। বিদায়ের দিন আত্মীয়স্বজন সবাই এলো খাওয়া-দাওয়া হল। জামাইরা শশুরকে বলল ‘আপনি নিশ্চিন্তে যান, সংসারের কোনো চিন্তা করতে হবে না। শাফায়েতকে বাসায় নিয়ে আসব, সেই সবকিছু দেখাশোনা করবে। শশুর বলল ‘ঠিক আছে, এসব বিষয় নিয়ে আমি কোন চিন্তা করি না তোমরা তো আছই যা করার তোমরাই করবে। কিন্তু আমার একটা আবদার, থাবড়া সমিতিটা আমি অনেক সাধনা ও অনেক অর্থ ব্যয় করে প্রতিষ্ঠা করেছি। এটা আমার নিজের প্রতিষ্ঠান, আমার সাধনার ধন। আমি শ্রম দিয়ে তিল তিল করে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। এজন্য সবাই সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করেছে। এখন আমার এই সভাপতির পদটা হুমায়ুনকে দিয়ে গেলাম। হুমায়ুন তুমি সভাপতি হয়ে সমিতির কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাবে, তাহলেই আমি শান্তি পাব।

এরপর জাকির হোসেন একে একে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হল। যেতে যেতে সে ভাবতে লাগলো- আমার জামাইরা বেশি বুঝে, দ্বীনের কাজ করার জন্য আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কেন বাসায় থেকে রাসুলের উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে কি দ্বীনের খেদমত হতো না? আচ্ছা ঠিক আছে, এক বছর পর ফিরে এসে আবার শুরু করব, ইনশাল্লাহ।

১৭

পরদিন শাফায়েত শ্বশুরের বাসায় এসে উঠল। তারপর শাশুড়িকে গিয়ে বলল ‘আম্মা রান্নাবান্না কি একসাথে হবে নাকি আলাদা? জুবেদা বলল ‘একসাথে হবে। জামাই নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বলল ‘তাহলে সংসার খরচ সবটা আমিই বহন করব। শাশুড়ি ধমকে উঠলো ‘তুমি বহন করবে মানে, আমি কি তোমার মেয়ে, নাকি দরিদ্র যে তোমাকে খাওয়াতে হবে? তোমরা ছেলে মেয়ের মত আমার মধ্যে খাবে, তোমাকে এক পয়সাও খরচ করতে হবে না। জামাই আপন মনে হাসলো ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তারপর স্ত্রীকে গিয়ে বললো ‘দেখো কপালের উপর কপাল, ফ্রী বউ পেলাম, এখন ফ্রি বাসা পেলাম, তার উপর খাওয়াটাও ফ্রি পেলাম। এভাবে দুই তিনটা বছর ফ্রি-তে চলতে পারলে নিজেই একখান বাসা করে নিতে পারবো। সোহানা বললো ‘রাখ আমার ভাইগুলি একটু বড় হলে ঠেঙ্গিয়ে তোমার ফ্রি খাওয়াটা ছুটাবে।

শশুরের অভিপ্রায় অনুযায়ী একদিন হুমায়ূন থাবড়া সমিতিতে গিয়ে বলল ‘আমার শশুর তো আমাকে সমিতির সভাপতির পদটা দিয়ে গেছেন। এখন আপনারা যদি মেনে নেন তাহলে আমি সমিতির উন্নয়নের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করব। আপনারা হলেন বুড়া মানুষ ঠিকমত কাজকর্ম করতে পারবেন না। আমি জোয়ান ছেলেদের সদস্য করে তাদের নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আপনারা তো জানেন আগে আমি চিরকুমার সমিতির সভাপতি ছিলাম কাজেই সমিতির উন্নয়ন বিষয়ে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। তার কথা শুনে সাবেক এক বৃদ্ধ সচিব খেঁকিয়ে উঠলো ‘বেয়াদব পোলাপান কয় কি, নাকে চিপি মারলে মায়ের দুধ বেরিয়ে আসবে আর তুমি হবে কি না এই মুরুব্বীদের সভাপতি। তুমিই গাঁজাখোর নাকি তোমার মা বাপ গাঁজাখোর। তার কথা শুনে সব মুরুব্বিরা খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগলো।

জাকিরের বন্ধু বাবুল মিয়া তাকে সস্নেহে পাশে বসিয়ে বলল ‘অনেক চেষ্টা-সাধনা করে তোমার শ্বশুর এই সমিতিটা গঠন করেছেন, আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। এজন্যই আমরা অন্য কাউকে সভাপতি না বানিয়ে তার চেয়ারটা খালি রেখেছি, সে আসলে আবার এই চেয়ারে বসবে। তোমরা তাকে ষড়যন্ত্র করে নির্বাসনে পাঠিয়েছ কিন্তু আমরা তার সম্পর্কে অনেক উচ্চাশা পোষণ করি। কারণ এই মহিমান্বিত পুরুষ দশটা মেয়ে জন্ম দিয়েছেন অথচ মুজিব জিয়া থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কোন বীর বাহাদুর আজ পর্যন্ত দশটা মেয়ে জন্মাতে পারেনি। তারপর এই সিদ্ধ পুরুষ ছেলে উৎপাদন শুরু করেছেন কিন্তু তোমরা ষড়যন্ত্র করে এই আদর্শ মানুষটাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলে। তবে কোনো লাভ হবে না, আশা করি এক বছর পর সে ফিরে এসে আবার সন্তান উৎপাদনের মহাব্রতে হাত দিবে। আর আঠারোটা সন্তান হয়ে গেলেই তার নাম গিনেজ বুকে উঠে যাবে, তখন এটা হবে আমাদের সমিতির জন্য মহাগৌরবের বিষয়। কাজেই বাবা এই সমিতিতে নাক গলাতে এসো না। কারণ মুরুব্বীদের থাবড়া খেয়ে তোমার নাকটা এবড়ো থেবড়ো হয়ে যাবে। এখন যাও মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যাও। তারপর মুরুব্বীরা বিভিন্ন মন্তব্য করতে লাগলো আর বেদম হাসতে লাগল। তখন হুমায়ূনের মন চাইল ঘুসি মেরে এক একজনের নাকসা ফাটিয়ে দিতে কিন্তু মুরুব্বীদের গায়ে তো আর হাত তোলা যায় না। কাজেই সে লজ্জিত ও অপমানিত হয়ে মাথানিচু করে বেরিয়ে গেল।

পরদিন সে ভায়রা ভাইদের বাড়িতে ডেকে এনে ঘটনা জানাল। শুনে এক একজন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে লাগল। গালিব বলল ‘আসলে থাবড়া সমিতি তো মানুষকে থাবড়িয়ে থাবড়িয়ে অভ্যস্থ হয়ে গেছে এখন আপনাকে কি শুধু মুখেই বিদায় করেছে নাকি দুয়েক ঘা লাগিয়েছে’ বলে বেদম হাসিতে ফেটে পড়ল। জাফর মুখে খুঁজতে লাগল থাবড়ার চিহ্ন আছে কিনা। তা দেখে হুমায়ূন রেগে গিয়ে বলল ‘তোমাদেরকে ডেকে এনেছি এই অপমানের প্রতিকার করার জন্য অথচ তোমরা উল্টো আমাকেই অপমান করছ?

গালিব বলল, শুনেন থাবড়া সমিতির ঐ বুড়োদের মধ্যে গিয়ে সুবিধা করতে পারবেন না, আপনাকে মানবে না। তার চেয়ে চলুন চিরকুমার সমিতিটাকে বাছাই। কারণ আমি চলে আসার পর কামাল পাশা তার অনুগত কয়েকটা পাজি পুলাপানের প্রভাব খাটিয়ে জোর করে সভাপতি হয়েছে, তারপর থেকেই সমিতির মরণদশা। তারা কোনো ভালো কাজ তো করেই না বরং সব সময় খাওয়া দাওয়া ও নৃত্য-গীতের আসর জমিয়ে রাখে, কয়েকদিন পরপর ঢাকা থেকে বড় বড় নটি- নর্তকি আনে। সমিতির বিশাল ইনকাম- সিরাজ হায়দারের সম্পদ, তার ওপর পত্রিকা বেচার টাকা সব কামাল পাশা আত্মসাৎ করছে। সে দরিদ্র কৃষকের ছেলে হয়েও শুধু সমিতির টাকা দিয়ে শহরে চারতলা বাসা করে ফেলেছে। হারামজাদা বিয়ে করবে না কিন্তু প্রতিদিন বাসায় একটা করে মেয়ে নিয়ে মৌজ করে, কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে সমিতি থেকে বের করে দেয়।

সুভাষ চন্দ্র এখনো সমিতির ক্যাশিয়ার। সে প্রকৃত চিরকুমার, তার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে এখনও বিয়ে করেনি। সে অনেক কৌশলে পাশার করাল গ্রাস থেকে এখনো সমিতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে। সে না থাকলে পাশা এতদিনে সমিতির সকল সম্পদ হাতিয়ে নিত। সুভাষ মাঝে মধ্যে আমার কাছে আসে, দুঃখ প্রকাশ করে, সমিতিটাকে বাঁচানোর জন্য আমার সাহায্য চায়। কাজেই আমার প্রস্তাব হলো- আমরা আবার ফিরে গিয়ে সমিতিটা দখল করে থাবড়া সমিতির মত কিছু জনকল্যাণমূলক কাজ করি। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব গৃহীত হলো। আহসান হাবীবকে সুভাষ ও অন্যান্য ভাল ছেলেদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হলো।

কয়েক দিন পর হুমায়ূনের বাসায় আবার সবাই পরামর্শ সভায় বসল। সেখানে সুভাষ ও তার অনুগত সমিতির কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ছেলে অংশগ্রহণ করলো। সুভাষ দুঃখ করে বলল ‘হুমায়ূন ভাই ও গালিব ভাই আপনারা ছিলেন সমিতির প্রকৃত সভাপতি। আপনাদের দুজনের মাধ্যমেই সমিতির সুনাম ও আর্থিক উন্নতি হয়েছে কিন্তু আপনারা চলে আসার পর কামাল পাশা সমিতিটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন আমাদের আবেদন হল আপনাদের হাতে গড়া সমিতিটাকে বাঁচান। জাফর বললো ‘কিন্তু আমরা কি করে সাহায্য করবো আমরা তো বিবাহিত। এ নিয়ে কিছুক্ষণ বিতর্কের পর সুভাষ বলল ‘তাতে সমস্যা কি, আপনারা সমিতিটা দখল করে দেন, পদে না গেলেন, বাহির থেকে আমাদেরকে সাহায্য করবেন।

হুমায়ুন বলল ‘তাহলে সমিতি আমরা কিভাবে দখল করব? সুভাষ বলল ‘কামাল পাশার অনুসারী হবে বড়জোর পনের বিশজন। বাকি ছেলেদের সাথে আমি কথা বলে আপনাদের পক্ষে নিয়ে আসব, তখন আমরাই আপনাদেরকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাব। তা দেখে পাশার দল পলায়ন করবে। গালিব বলল ‘ঠিক আছে আমার প্রস্তাব হলো আগামী শুক্রবারে সমিতির পাশের মসজিদে আমরা সবাই জুম্মা পড়ব। সমিতির ছেলেরা যেন সেখানে উপস্থিত হয়ে আমাদেরকে অভ্যর্থনা দিয়ে নিয়ে যায়, তুমি সেই ব্যবস্থা কর। এই প্রস্তাব মেনে সুভাস তার দল নিয়ে বিদায় হলো। তারপর গালিব বললো ‘শুনেন সমিতির সাথে সাথে পদও দখল করতে হবে, তারপর থাবড়া সমিতির সাথে টক্কর দিয়ে জনহিতকর কাজ করতে হবে।

শুক্রবারে তারা নির্দিষ্ট মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করল। কামাল পাশার দশ পনের জনের দলটা ব্যতীত সমিতির সকল ছেলে আসলো, নামাজের পর তারা প্রবীণ নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে ‘হুমায়ূন ভাই গালিব ভাই- জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ, চিরকুমার সমিতি- জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে সমিতিতে গিয়ে উঠল। কামাল পাশার দলের এক ছেলে বলল ‘হুমায়ূন ভাই আমি মরাও খাই জেতাও খাই। ভালো মন্দ দুটাই করি। আপনাদের আগমনের কথা শুনে পাশা কিছু গুন্ডাপান্ডা নিয়ে মারামারি ও গোলাগুলি করে আপনাদের ঠেকাতে চেয়েছিল কিন্তু আমি তাকে বললাম ‘শালা গ্রাম থেকে এসেছ, হুমায়ুন ভাইদের দশটি ভাইরাকে চেন? এই শহরের শ্রেষ্ঠ পরিবারের সন্তান তারা। ওদের সাথে টক্কর দিতে গেলে তোমাদের লাশগুলি ব্রহ্মপুত্রে ভাসবে। আমার কথা শুনে সে ভয় পেয়ে পালিয়েছে, সম্ভবত শহর ছেড়েই চলে গেছে। কাজেই সমিতিটা রাহুমুক্ত করে হস্তগত করুন, তারপর কিছু ভালো কাজ করুন। আগে পাশার সাথে খারাপ কাজ করেছি এখন আপনাদের সাথে ভাল কাজ করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিন।

এক সপ্তাহ পর নতুন কমিটি ঘোষণা করা হলো। হুমায়ুন সভাপতি, জাফর ইকবাল সহ-সভাপতি, ডাক্তার মির্জা গালিব সেক্রেটারি। ক্যাশিয়ার পদে সুভাষ চন্দ্রকেই বহাল রাখা হল। সমিতির সদস্যদের প্রতি নির্দেশ জারি করা হলো- বিয়ে করতে হবে নইলে সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। তারপর সমিতির কার্যক্রম ঘোষণা করা হলো- অনাথ, প্রতিবন্ধি, হতদরিদ্র ও কুৎসিত কদাকার মেয়েদেরকে সমিতির অর্থায়নে বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। কর্মঠ ও যোগ্য নতুন কমিটির নেতৃত্বে সমিতি চাঙ্গা হয়ে উঠলো, সবাই মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করল।

হুমায়ুন সদস্যদের বিয়ের দিকে মনোযোগ দিল। সে স্ত্রীকে ঠাট্টা করে বলল ‘আমার শ্বশুরের একশ মেয়ে থাকলে এখন কাজে দিত। তার কলেজে শিক্ষকতা করে একজন হিন্দু বিধবা মহিলা ছিল, বিয়ের একমাস পর রোড এক্সিডেন্টে স্বামী মারা গেছে। সুভাষ চন্দ্রের সাথে তার বিয়ে দেয়া হলো। আরো বিভিন্ন জায়গায় পাত্রী দেখে সে সমিতির ছেলেদের বিয়ে দিতে লাগল। তারপর সমিতির পক্ষ থেকে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেওয়া দেয়া হলো যে, অনাথ, হতদরিদ্র, কালো ও কুৎসিত মেয়েরা ফটো ও বায়োডাটাসহ দরখাস্ত করলে চিরকুমার সমিতি তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবে। বিজ্ঞাপনের পর থেকে শত শত আবেদন জমা পড়তে লাগল।

১৮

এবার সমিতির সদস্যরা প্রকৃত মানব সেবার সুযোগ পেল। তারা পাত্র অনুসন্ধান শুরু করল, সমিতির খরচে কিছু ঘটক নিয়োগ দিয়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়া হলো। তারপর থেকে পাত্ররা আসতে লাগল আর আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখানোর ব্যবস্থা চলতে লাগলো। প্রতিবন্ধী কালো কুৎসিত মেয়েদের বরকে আত্নকর্ম সংস্থানের জন্য অটোরিক্সা, সিএনজি বা দোকান করার জন্য আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা রাখা হলো। এভাবে প্রথমবার আড়াইশত গণ বিয়ের আয়োজন করা হলো। এরপর দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে এই বিশাল বিয়ে যজ্ঞের কাজ সম্পন্ন হল। সমিতির টাকা, সদস্য ও বিত্তবানদের চাঁদার টাকায় ব্যয় সংকলন করা হলো। গালিব একাই পনের লক্ষ টাকা চাঁদা দিল। এই গণ বিয়ের সংবাদ ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ঝড় তুললো, দেশে ব্যাপক আলোচনা শুরু হল। জনগণ চিরকুমার সমিতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠলো, বিত্তবানরা এগিয়ে এলো, সরকারের সুদৃষ্টি পড়ল সমিতির ওপর। তখন বুদ্ধিমান সভাপতি গণ বিয়ের বিষয়টা চিরকুমার বার্তা পত্রিকায় বিশেষ সংবাদ বুলেটিন করলো। আর পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী ও নেতৃবৃন্দসহ দুইজন মন্ত্রীকে দাওয়াত দেওয়া হলো।

সম্মেলনে সমিতির পক্ষ থেকে লিখিতভাবে এবং সভাপতির ভাষণে সরকারের প্রতি আবেদন জানানো হলো যে, পুলিশ আর্মি বিডিআর আনসার ইত্যাদি বাহিনীতে এবং সরকারি চাকরির বড় বড় খাতগুলিতে প্রতিবছর হাজার হাজার স্বল্প শিক্ষিত ছেলেদের চাকরি হচ্ছে। কিন্তু ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় না, দালাল ও অফিসাররা এ খাত থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আর এতে কিছু সংখ্যক অসৎ মানুষ টাকার কুমির হচ্ছে বটে কিন্তু দেশের বিপন্ন মানুষের কোন কল্যাণ হচ্ছে না। সরকার যদি এই বিশাল খাতের একটা অংশের অথরিটি সমিতির উপর ন্যস্ত করে তাহলে অনাথ প্রতিবন্ধী ও সমাজের অবহেলিত মেয়েগুলির জীবন বেঁচে যায়। কারণ যেসব ছেলে এ জাতীয় মেয়েদেরকে বিয়ে করতে চাইবে সমিতি তাদেরকে সার্টিফিকেট দিবে। আর এই সার্টিফিকেট অনুযায়ী তাদেরকে বিনা ঘুষে ও বিনা বাধায় চাকরি দিতে হবে। এটা সমিতির দাবি, মানবতার দাবি, বিপন্ন ও সমাজ বিচ্যুত মেয়েদের জীবন বাঁচানোর দাবি।

সমিতির এই দাবি সর্বত্র স্বীকৃত হলো। দেশের লেখক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা এ দাবির পক্ষে ব্যাপক আলোচনা ও প্রচারণা চালাতে লাগলো। সর্বস্তরের মানুষ এ দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানালো, রাজনীতিবিদরা এ দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করল, অবশেষ সরকার তা মেনে নিল। সমিতির সদস্যরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সমিতির শাখা ছড়িয়ে দেয়া হলো। তারপর চাকরির বিনিময়ে বিয়ে প্রকল্প চালু করা হলো, উপজেলা পর্যায়ে অনাথ দরিদ্র কালো কুৎসিত ও প্রতিবন্ধী মেয়েদের তালিকা তৈরি করা হলো। তারপর বিয়ের বিনিময়ে চাকরি প্রত্যাশী ছেলেদের আহবান করা হলো। তখন বেকার তরুণ-যুবকরা চাকরি বনাম সোনার হরিণ ধরার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর যেখানেই পুলিশ আর্মি বিডিআর ইত্যাদির মাঠ পরে সেখানেই সমিতির পক্ষ থেকে বিয়ে প্রত্যাশী ছেলেদের তালিকা দেয়া হয়, বিনা ঘুষে ও বিনা তদবিরে তাদের চাকরি হয়ে যায়। এভাবে সারা দেশের অধিকার বঞ্চিত ও অভিশপ্ত মেয়েরা চিরকুমার সমিতির বদৌলতে সুখের সংসার রচনা করতে লাগল।

তখন তাদের চিরবঞ্চিত দুটি হাত উঠে যায় উর্ধ্বে, কৃতজ্ঞতার আশু ঝড়ে পরে, তারা চিরকুমার সমিতির সদস্যদের জন্য প্রার্থনা করে। সমিতি মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ ইত্যাদি সকল ধর্মের মেয়েদের ক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এবার দেশের বুদ্ধিজীবী ও নারী সংগঠনের তৎপরতায় সমিতি আরেকটা প্রকল্প হাতে নিল- উচ্চ শিক্ষিতা মেয়েদের বিয়ে প্রকল্প। উচ্চশিক্ষিতা যেসব মেয়ে কালো কুৎসিত বা দরিদ্র- যাদের বিয়ে হয় না সমিতি তাদের দরখাস্ত আহবান করল। কিন্তু এক্ষেত্রে একটু সমস্যা দেখা দিল। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সুপারিশ খাটে না, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে টিকতে হয়। তাই সমিতি এজাতীয় মেয়েদেরকে যতটুকু সম্ভব সরকারি চাকরিতে ঢোকালো, বাকিদের জন্য বেসরকারি চাকরির ব্যবস্থা করল। সেই সাথে যোগ্যপাত্রদের সরকারি বা বেসরকারি চাকরি দিয়ে ওইসব মেয়েদের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করা হলো।

সমিতির নাম নিয়ে মানুষ হাসাহাসি করে। কারণ নাম চিরকুমার সংঘ অথচ তারা গণ বিয়ের আয়োজন করে। কাজেই বিভিন্ন মহল থেকে সমিতির নাম পরিবর্তনের দাবি আসতে লাগল। তখন সভাপতি হুমায়ূন আহমেদ এ মর্মে একটা বিবৃতি লিখে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিল যে ‘কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলি শুধু নামের বদৌলতে বেঁচে থাকে, নামটা ভেঙ্গে দিলে সেই জিনিসটাই ধ্বংস হয়ে যায়। তেমনি এ সমিতিটাও বেঁচে আছে নামের উপর, নাম পরিবর্তন করলে এর মাহাত্মও ম্লান হয়ে যাবে। কাজেই সমিতির সম্মানিত শুভানুধ্যায়ীদের বলব নাম দিয়ে কাম কি, সমিতির কার্যক্রম ও অবদান দেখুন। শেক্সপিয়র বলেছেন ‘নামের কোন মাহাত্ম্য নাই মাহাত্ম্য হল কর্মের। কাজেই সবাই সহযোগিতা করুন, আমরা কর্মের মাধ্যমে সমিতির গৌরব ফুটিয়ে তুলবো। তাছাড়া এর প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ হায়দার ‘চিরকুমার সমিতি’ বলে নামকরণ করে গেছেন। তিনি বেঁচে নেই, তার অবর্তমানে তারই অর্থ ও শ্রমে গড়া এই মহিমান্বিত সমিতির নাম পরিবর্তন করার অথরিটি আমাদের কারও নেই। দেশের মানুষ সভাপতির এ সিদ্ধান্ত মেনে নিল।

মর্তের বুকে অভিশপ্ত যেসব মেয়ের জন্মটাই ছিলো আজন্ম পাপ- সমিতির কল্যাণে তারা স্বামী সন্তানের মুখ দেখলো, সুখের সংসার রচনা করল। সঙ্গত কারণেই তারা সমিতিকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, সকাল বিকাল সমিতি ও এর সদস্যদের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে, সর্বত্র সমিতির সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। সমিতি হয়ে উঠল বিপন্ন মানবতার আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। সবাই সমিতিকে চাদা দেয়, বিত্তবান ও দাতারা বিশাল এমাউন্টের অর্থ বরাদ্দ দেয়, সেই সাথে সরকারী অনুদান তো আছেই। সমিতির সেক্রেটারি ডাক্তার মির্জা গালিব একাই বছরে ছয় লক্ষ টাকা চাঁদা দেয়। এভাবে সমিতির অর্থ ভাণ্ডারও ফুলে-ফেঁপে উঠতে লাগলো। সারাদেশে সমিতির কার্যক্রম সাফল্য জনকভাবে এগিয়ে চললো।

এবার সমিতি বাইরে শাখা বিস্তার করার সিদ্ধান্ত নিলো। তারা সার্কভুক্ত দেশগুলিতে সমিতির শাখা খুলল। সেসব দেশেও সমিতির কার্যক্রম জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করল। সমিতির অধীনে বিপন্ন মেয়েদের গণহারে বিয়ে হতে লাগলো। বিভিন্ন দেশের মানুষ সমিতির কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হল, আকৃষ্ট হলো, তারা চাঁদা দিয়ে ও সহযোগিতা দিয়ে সমিতিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। সার্কভুক্ত দেশগুলোতে সাফল্যের পর এশিয়ার দেশগুলিতে সমিতির শাখা বিস্তার করা হলো। এশিয়ায় সাফল্যের পর সমগ্র পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলিতে এর শাখা ছড়িয়ে দেয়া হলো। দুনিয়ার মানুষ সমিতির কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হলো। পৃথিবীর বড় বড় লোকেরা সমিতির সদস্য হলো, সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। সারা পৃথিবীতে দুর্দান্ত প্রতাপে সমিতির কার্যক্রম চলতে লাগল। অথচ এর সদর দপ্তর হলো বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের দরিদ্র জনপদ ময়মনসিংহে। জাতিসংঘের মতো এর প্রভাব প্রতিপত্তি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাঙালিরা আনন্দে মেতে উঠল, সারাদেশ খুশির জোয়ারে ভাসছে। কারণ মানব সেবায় অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চিরকুমার সমিতি শান্তিতে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছে।

সমাপ্ত

বিষয়: সাহিত্য

২৯৮৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386184
২৬ নভেম্বর ২০১৮ সকাল ১১:৪২
নিমু মাহবুব লিখেছেন : ব্লগারদের ধৈয্যের কথা চিন্তা করুন।
লেখা সংক্ষেপ করতে সচেষ্ট থাকুন।
Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Rose Rose Rose Rose Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Rose Rose Rose Rose Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Rose Rose Rose Rose Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Rose Rose Rose Rose

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File