চিরকুমার সংঘ - ২
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৭ নভেম্বর, ২০১৮, ১০:১০:২১ রাত
দ্বিতীয় অধ্যায়
১
চিরকুমার সংঘের মুখপত্র ষান্মাসিক পত্রিকা ‘চিরকুমার বার্তা’ বছরে দুইবার বের হয়। দুই বাংলাতেই এর লেখক ও পাঠক রয়েছে বিধায় পত্রিকাটি উভয় বাংলায় সমান জনপ্রিয়। আবার ব্যতিক্রম ধর্মী ও রসালো এ পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যাও দুই বাংলার মধ্যে শীর্ষে। সত্তাগত ভাবে ছেলে ও মেয়েরা একে অন্যকে প্রতিপক্ষ মনে করে, একে অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারলে আনন্দ উপভোগ করে। এই পত্রিকাটি যেহেতু মেয়েদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বিধায় অবিবাহিত ছেলেরা পত্রিকাটি পড়ে আনন্দ পায় এবং মেয়েদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার কৌশল শিখে নেয়। আবার পত্রিকাটিতে পুরুষের উপর নারীর দাদীগিরি করার রসালো বিবরণ থাকে, তাই নারীরা এটি কিনে পুরুষের নাকের ডগায় রশি লাগিয়ে ছাগলের মত পেছন পেছন ঘুরানোর কৌশলটা শিখে নেয়।
তেমনি স্বামী-স্ত্রী দম্পতিরা পত্রিকাটা কিনে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে। কারণ গিন্নী কখনও স্বামীর উপর হাত ঘোরালে সে চেঁচিয়ে ওঠে ‘দেখলে দেখলে চিরকুমাররা তো ঠিকই বলে, তোমরা স্বামী বেচারাদেরকে মানসিক টর্চার করে করে ভেড়া বানিয়ে রাখো, হায় কেন যে ওদের সদস্য হলাম না। আবার স্বামী কোন হম্বিতম্বি করলে গিন্নিরা বলে ‘দেখলে তো চিরকুমাররা বলে বেড়ায় আমরা নাকি স্বামীদেরকে গোলাম বানিয়ে রাখি। কিন্তু তোমরা যে আমাদের সাথে দাসী-বাঁদির মতো ব্যবহার করো সেটা কেউ বলে না, আসলে পুরুষ জাতটাই স্বার্থবাদী।
নারী-পুরুষের সম্পর্কটাই হল রসাল, আর পত্রিকাটির উপজীব্য হলো এই রস। এ জন্য সাধারণ মানুষ পত্রিকাটা পড়ে রসবোধ করে। এভাবে পত্রিকাটি দুই বাংলায় প্রায় এককোটি কপি বিক্রি হয় এবং মোটা অংকের অর্থ আয় হয়। এই অর্থ দিয়ে চিরকুমার সংঘের যাবতিয় খরচ বেয়ার করা হয়। প্রতিদিন রাতে চিরকুমার অফিসে চাইনিজ বিরিয়ানি, অন্তত ছোলা মুড়ি খাওয়ার উৎসব হয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও আনন্দ স্ফুর্তি তো আছেই। এই খাওয়া ও আনন্দে ভাগ বসানোর জন্য শহরের অবিবাহিত যুবক তরুণের দল সংঘের সদস্য হয়েছে, অপরিচিত বিবাহিতরা সরাসরি সদস্য হয়ে যায়। কিন্তু পরিচিতরা এসে গলা টেনে বলে ‘বিয়ে করে ভুল করেছি এখন কি সদস্য হওয়া যায় না? আমাদেরকে এই শর্তে একটা সান্স দেওয়া হোক যে আমরা আর বিয়ে করব না। অবশ্য এই লোকগুলির আগমনটা হয় খাওয়ার সময় কিন্তু কাজের বেলায় অদৃশ্য।
এবারও পত্রিকা প্রকাশের সময় আসন্ন, অফিসে কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে গেছে। পত্রিকায় বাংলাদেশী লেখকদের দুই ভাগ আর কলকাতার লেখকদের এক ভাগ লেখা প্রকাশ করা হয়। কারণ তাদের লেখা প্রকাশ না করলে সেখানকার পাঠক ধরা যায় না। প্রচুর লেখা জমা পড়েছে। রসিক লেখকরা সবাই লেখা পাঠায়, আবার বিখ্যাত লেখকদের প্রচুর সম্মানী দিয়েও লেখা আনা হয়। সঙ্গত কারণেই পত্রিকাটিতে দেশ-বিদেশের বড় বড় লেখক বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদদের লেখা স্থান পায়। এসব লেখা যাচাই-বাছাই করার জন্য উচ্চশিক্ষিত চিরকুমারদের একটা কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। পচিশ সদস্যের এই কমিটি যাচাই-বাছাই করে নির্বাচিত লেখাগুলির পান্ডুলিপি সভাপতির টেবিলে নিয়ে জমা করে। তারপর সভাপতি চূড়ান্ত বাছাই করে লেখা বিন্যাস করেন।
সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এবং উপদেষ্টা সিরাজ হায়দার বয়স্ক এবং অসুস্থ মানুষ। তিনি সমিতিতে আসেন না, সভাপতিকেই সব দায়িত্ব পালন করতে হয়। সভাপতির নাম হুমায়ূন আহমেদ, ঢাবি থেকে সদ্য রসায়নশাস্ত্রে মাস্টার্স করা যুবক মানুষ। তার টেবিলের উপর পান্ডুলিপির স্তুপ পড়ে আছে, সে লেখাগুলি চূড়ান্ত বাচাই করে বিন্যাস করল। এই বিন্যাসের প্রথমে আসে সম্পাদকীয়, আর সম্পাদকীয় লেখার দায়িত্ব তার। তারপর প্রথম অধ্যায়ে চিঠিপত্র ও বাস্তব অভিজ্ঞতা। এ অধ্যায়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা চিঠি-প্ত্র পাঠায়। মেয়েদের যেসব লেখার বিবরণ থাকে এমন যে, তারা এক সাথে কয়েক হালি ছেলের সাথে প্রেম করে, একে অন্যের আড়ালে ডেটিং করে বেড়ায়, হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে, প্রেমিকদের পকেট খসিয়ে নিজের খরচ চালায় এবং বাড়িতেও টাকা পাঠায়। আবার ছেলেদের যেসব চিঠিতে লেখা থাকে- প্রেমিকারা তাদেরকে ফতুর করে তাদেরই সামনে অন্য প্রেমিকের হাত ধরে ঘোরাফেরা করে, অন্যের সাথে বিয়ের দাওয়াত দেয়- তাদের চিঠি এ অধ্যায়ে নির্বাচিত হয়।
দ্বিতীয় অধ্যায় হল নারী মহল। যেসব নারী স্বামীকে দৈনিক তিনবার ঝাঁটা পেটা করে, রাতে বারান্দায় ফেলে রাখে, নাকে দড়ি দিয়ে গরু ছাগলের মতো পেছন পেছন ঘোড়ায়- তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলি এ অধ্যায়ে স্থান পায়। আবার যেসব পুরুষ স্ত্রীকে রান্না করে খাওয়ায়, কাপড় ধুয়ে দেয়, পা টিপে দেয়, কথায় কথায় স্ত্রীর চড় থাপ্পর খায় তাদের লেখাও এই অধ্যায় নির্বাচিত হয়। তৃতীয় অধ্যায়ে বড় বড় লেখকদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গবেষণাগুলি ছাপানো হয়। এ বছরের নির্বাচিত প্রবন্ধ হলো বিখ্যাত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা খাতুনের ‘কাঁঠালের কোষ’। তিনি ছেলেদেরকে কাঁঠালের কোষ এবং মেয়েদের খাদ্য বলে প্রমাণ করেছেন। তারপর উপদেশ দিয়েছেন মেয়েরা যেন ছেলেদেরকে কাঁঠালের কোষের মত চিপে রসটা খেয়ে চিবড়াটা ভাগারে ছুড়ে মারে, ছেলেদেরকে ধরে ধরে বেডরুমে নিয়ে ধর্ষণ করে পাছায় লাথি মেরে বাসা থেকে বের করে দেয়। তারপর রসিয়ে রসিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন- তিনি কীভাবে কবি-সাহিত্যিকদের ও খেলারামদের খেলে খেলে ফোকলা করে বাদামের খোসার মত ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর নামের এক চাঁদাবাজকে চুষে চুষে একেবারে চুপসে যাওয়া বেলুন বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। ইত্যাদি উদাহারন টেনে তিনি মেয়েদেরকে উপদেশ দিয়েছেন তারাও যেনো এভাবে ছেলেদেরকে ভোগ করে ডাস্টবিনে ছুড়ে মারে।
দ্বিতীয় নির্বাচিত প্রবন্ধটি হল বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আসাদের দ্বিতীয় লিঙ্গ। তিনি বিভিন্ন মনীষী ও গবেষকদের উদ্ধৃতি নকল করে প্রমাণ করেন যে, ছেলেরা হলো প্রথম লিঙ্গ আর মেয়েরা দ্বিতীয় লিঙ্গ। তারপর তিনি উপদেশ দিয়ে বলেন, ছেলেরা যেন কখনো দ্বিতীয় লিঙ্গের কাছে না যায়- তাহলে তারা বীর্য হারিয়ে ক্লীব হয়ে যাবে। কারন বিয়ের আগে পুরুষ থাকে ষাঁড় কিন্তু বিয়ের পর বলদ হয়ে যায়। তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন- না বুঝে হঠাৎ বিয়ে করার পর বুঝতে পারলেন ধিরে ধিরে তিনি বলদ হয়ে যাচ্ছেন, কিছুদিন পর দেখলেন ক্লীব হয়ে গেছেন। তাই তিনি সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন দেশের উন্নয়ন করতে চাইলে ছেলেদের বীর্য ক্ষয় রোধ করতে হবে। তারা যেন দ্বিতীয় লিঙ্গের কাছে না ঘেষতে পারে সেজন্য আইন পাশ করতে হবে। এ অধ্যায়ে পুরুষ বিদ্বেষী নারীবাদী লেখা আর নারী বিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক প্রবন্ধগুলি স্থান পায়। তারপর বিগত চিরকুমার সম্মেলনের বিভিন্ন চিত্র ও বিশিষ্টজনদের বাণী স্থান পায়। সর্বশেষে চিরকুমার সংঘের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য, সদস্য হওয়ার নিয়মাবলী ও সদস্য পদের নমুনা কুপন যুক্ত করা হয়। সর্বশেষে চিরকুমার থাকার উপকারিতা, কল্যাণময়তা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়।
পঁচিশজন সদস্য রাত দিন কঠিন পরিশ্রম করে লেখা যাচাই-বাছাই ও বিন্যাসের কাজ শেষ করে ছাপাখানায় পাঠিয়ে দিল। তারপর শুরু হল সম্মেলনের তোরজোড়। কারণ সমিতির নিয়ম হল চাঁদা তুলে পত্রিকা ছাপানোর খরচ ও সম্মেলনের খরচ বেয়ার করা হয়। আবার পত্রিকা ছাপিয়েই তা মুক্ত বাজারে ছাড়া হয় না, চিরকুমার সংঘের মহাসম্মেলন করে বিশিষ্টজনদের দিয়ে পত্রিকার মোড়ক উন্মোচন করা হয়, তারপর বাজারে ছাড়া হয়। এর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য হলো পত্রিকার কাটতি। সম্মেলনে প্রায় অর্ধলক্ষ কফি বিক্রি হয়ে যায়। সমিতির বিশাল ব্যয়ভার এ পত্রিকার আয় থেকেই সংকুলান করা হয়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল প্রচার প্রসার, দেশের টিভি চ্যানেলগুলি সম্মেলনের লাইভ শো দেখায়, পত্রিকাগুলি হেড নিউজ করে। এতে দেশ-বিদেশে সমিতির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাপক আলোচনা হয়। এভাবে সমিতির পক্ষ থেকে ব্যাপক যুব সমাজের কাছে চিরকুমারত্বের দাওয়াত পৌঁছে যায়। এ জন্যই সম্মেলনের মাধ্যমে তারা এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের কৌশল অবলম্বন করে।
এবার শুরু হলো দাওয়াতি কার্যক্রম। ময়মনসিংহের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রতিস্টান প্রধান, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, মন্ত্রী- এমপি ও সাধারণ মানুষকে দাওয়াত দেয়া হয়। তাছাড়া দেশের প্রথম শ্রেণীর শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিক গবেষক লেখক বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সেলিব্রেটি ইত্যাদিরকেও দাওয়াত দেয়া হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও সংক্ষিপ্ত চিঠি লেখা হলো ‘জনাব আপনার/ আপনাদের সদয় অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আগামী আটাশে ডিসেম্বর সার্কিট হাউজ ময়দানে চিরকুমার সংঘের মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাতে আপনার/ আপনাদের সবান্ধব উপস্থিতি একান্ত কাম্য। বিশেষ দ্রষ্টব্য মহিলাদের আগমন বা উপস্থিতি নিষিদ্ধ। অনুরোধক্রমে- সভাপতি, হুমায়ুন আহমেদ।
এই চিঠি ছাপিয়ে খামে ভরে বিতরণ শুরু হলো। চিরকুমার অফিসে দৈনিক কয়েক শত সদস্যের আগমন ঘটে। তাদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে দেয়া হলো, একেক মহল্লা দুই তিন জনের দায়িত্বে দিয়ে তাদের হাতে চিঠি ও সমিতির রশিদ বই দেয়া হলো। তারা বিশিষ্টজনদের চিঠি পৌঁছে দিবে আর বিভিন্ন উৎস থেকে চাঁদা উঠাবে। শুরু হলো চিঠি চালাচালি ও চাঁদা সংগ্রহের কাজ।
ময়মনসিংহের ডিসির কাছে স্বয়ং উপদেষ্টা সিরাজ হায়দার চিঠি নিয়ে গেলেন। তাকে দেখেই ডি সি দাঁড়িয়ে উঠল, হ্যান্ডশেক করে সসম্মানে বসাল। প্রবীণ রাজনীতিক হিসাবে ডি সি উপদেষ্টাকে স্যার বলে সম্বোধন করে। সৌজন্য আলাপ শেষে ডি সি গলা টেনে বললো ‘দেখুন স্যার আমরা তো প্রশাসনের লোক, আমাদের সরকারি বাধা-নিষেধ আছে, অনেক কিছুই আমাদেরকে এড়িয়ে চলতে হয়। এরপরেও চেষ্টা করব, যদি না আসতে পারি তাহলে জানবেন সরকারি বাঁধা পড়েছে। আসলে কিসের সরকারি বাধা, সে তো সরকারক থোড়াই কেয়ার করে। আসল সরকার হলো তার গিন্নি। কারণ ঐ মহিলা ঢাকা আলিয়ার সাবেক অধ্যক্ষের মেয়ে, কট্টর ধার্মিক কঠোর পর্দানশীন। ডি সি কোন ব্যতিক্রম করলেই তাকে বাঁশ দেয়। কাজেই গিন্নি যদি শুনতে পারে ডি সি চিরকুমার সম্মেলনে গেছে, তাহলে ঝড়-বাদলের রাত হোক বা মাঘ মাষের কনকনে শীত হোক অর্ধেক রাত পর্যন্ত বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, সেই সাথে বোনাস হিসাবে বাংলাদেশের সস্তা বাঁশ তো আছেই। কাজেই গিন্নীর বাঁশ খাওয়ার অজুহাতটা সে অবলিলায় সরকারের কাঁধে চাপিয়ে দিল। কারণ সরকার তো আর এটা তদন্ত করতে আসছে না।
২
গোটা ময়মনসিংহ শহরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। গৃহিনীর রান্নাঘর থেকে নিয়ে শিক্ষালয় ধর্মালয় ব্যবসালয় ও চা স্টল পর্যন্ত সর্বত্র একই আলোচনা- চিরকুমার সম্মেলন। অবিবাহিত কিশোর যুবকেরা দল বেঁধে ঘুরে আর প্রত্যেক পাড়া মহাল্লা দোকানপাট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সম্মেলনের দাওয়াত দেয় চাঁদা তুলে। তাদের সাথে বিবাহিত যুবক প্রৌঢ় বৃদ্ধরাও যোগ দিয়েছে। সর্বস্তরের পুরুষ আনন্দের জোয়ারে ভাসছে কিন্তু সর্বস্তরের নারী রাগে ফুসছে। তাদের এই আদর্শের দ্বন্দ্ব ডাইনিং টেবিল থেকে বিছানা পর্যন্ত গড়ায়।
যেমন অনেক গৃহকর্তাই সম্মেলনের জন্য চাঁদা উঠিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে অর্ধেক রাতে বাসায় ফিরে। তখন গিন্নি ডাইনিং টেবিলের সামনে বসে ঘুমের ঘোরে মাথাটা বর্শির সিপের মত উঠানামা করতে থাকে। কর্তার সাড়া পেয়ে লাফিয়ে উঠে বাজখাঁই গলায় বলে ‘এতক্ষন কোথায় ছিলে, ঐ শয়তান সংঘের শয়তানগুলির চামচামি করে এসেছ? ওদের সাথে এত পিরিতি তাহলে বাসায় আসছ কেন, ওদের সাথে চিরকুমার হয়ে থাক গিয়ে। কর্তা সারাজীবন গিন্নির অগ্নি দৃষ্টির সামনে বিড়ালের মত মিউ মিউ করলেও এবার চিরকুমারদের সাথে থেকে তার সাহস বেড়ে যায়। সাহসে ভর করে বলে ‘তাই থাকতে হবে, চিরকুমার না থেকে যে ভুলটা করেছি এখন সেই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে। চিরকুমার থাকলে এভাবে নিত নিত তোমার বাঁশ খেতে হতো না।
গিন্নি এবার আরো ঝাঁজিয়ে ওঠে ‘কী দুনিয়ার সব বাঁশ যাচ্ছে আমার আর এখন উল্টো শোনাচ্ছ আমার বাশ খাও। শুনি তুমি করটা কি, সংসারের এতসব ঝক্কি-ঝামেলা কে পোহায়? এই এক পাল মানুষের রান্নাবাড়া, কাপড় চোপড় ধোয়া, বিছানাপাতি ঘরদোর সাফ সুতরো রাখা, ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা-নেয়া করা- এসব কে করে শুনি, তুমি কোন কাজটা কর? তারপর সে আসল খুঁটির জোরটা প্রকাশ করে ‘আমার বাবার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা এনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বড়লোক হয়েছ, এখন হোন্ডায় চড়ে রাতদিন হাওয়া খেয়ে বেড়াও আর ওই শয়তান সংঘের দালালি কর। ঠিক আছে ওই শয়তানদের সাথে চিরকুমার হয়েই থাকো গিয়ে আমার আর দরকার নাই’ বলে রাগে হনহন করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। কর্তা ভাবে চিরকুমারদের মতো এবার সেও নিজের ওয়েট বাড়াবে, গিন্নিকে তেল মেরে আর নিজেকে ছোট করবে না।
সামনে বাচ্চাদের রুম, সে ভিতরে ঢুকে সন্তানদের প্রতি তাকিয়ে বাৎসল্যে তার মনটা আপ্লুত হয়ে আসে। সহসা বুঝতে পারে স্ত্রী না থাকলে তো এই সোনা মুখগুলি সে দেখতে পেত না। তখন স্ত্রীর মর্যাদা বুঝতে পারে। স্বরন হয় বেচারী সংসারের জন্য খাটতে খাটতে নিজের জীবনটা উজাড় করে দিচ্ছে। তখন স্ত্রীর প্রতি তার হৃদয়ে ভালোবাসার বান ডাকে। আস্তে আস্তে বেডরুমে যায় ‘আচ্ছা তোমার হাঁটুর ব্যথাটা এখন কেমন’ বলে স্ত্রীর পা টিপা শুরু করে। কোমরের ব্যাথাটা কি কমেছে’ বলে কোমর টিপে দেয়। গিন্নি মহাশয় বালিশে মুখ গুঁজে হাসতে থাকে। তারপর স্বামি যখন সীমালংঘন করে আরও কিছু টিপাটিপি শুরু করে তখনই সে লাফিয়ে উঠে বলে ‘হইছে হইছে এত সোহাগ লাগবে না, সারারাত না খেয়ে থাকবে নাকি চলো’ বলে দুজন গিয়ে খাবার টেবিলে বসে।
শীঘ্রই তাদের কলহাস্যে ঘরটা মুখর হয়ে ওঠে। কর্তা হাসতে হাসতে বলে ‘আরে তুমিও তো দেখছি একটা হাঁদারাম। আমি কি ওদের পছন্দ করি নাকি একটু আনন্দ করার জন্য আর বিরিয়ানী খাওয়ার জন্য যাই। আর তুমি কি মনে করো ওরা চিরকুমার থাকবে নাকি, পঙ্গপালের মতো যখন মেয়েরা আক্রমণ শুরু করবে তখন দেখতে পাবে ওরা কিভাবে আত্মসমর্পণ করে। আর আক্রমণ না হলেও ওদের বয়েসটা যখন আর একটু বাত্তি হয়ে যাবে তখন দেখবে ঠিক বধু দেবীর পদমুলে নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দিচ্ছে। গিন্নি মুচকি হেসে বলে ‘ঠিক আছে চালিয়ে যাও সমস্যা নাই কিন্তু রাত আটটার মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে। এভাবে চিরকুমার সংঘের ওসিলায় সর্বত্র নারী-পুরুষের মধ্যে শ্রেণী সংগ্রামের বাজার গরম হয়ে ওঠে।
দুর্বল চিত্তের মানুষ দ্বিমুখী হয় আর দ্বিমুখী হয়ে তারা উভয় পক্ষ থেকে ফায়দা লুটে নেয়। তেমনি যারা স্ত্রৈন প্রকৃতির ও দুর্বল চিত্তের পুরুষ তারা চিরকুমারদের সাথে সম্মেলনের কাজকর্ম করে বিরিয়ানি খেয়ে এমনকি পান বিড়ি সিগারেটের পয়সাটা আদায় করে মেয়েদের বদনাম করতে করতে বাসায় আসে। তারপর স্ত্রীকে বলে ‘আরে শুন দুনিয়ার যত অপদার্থ অকর্মা আছে- যারা বিয়ে পায়না কেউ ওদের কাছে বিয়ে দেয় না, দিলেও এরা রোজগার করে খাওয়াতে পারবে না- সেই কাপুরুষগুলি এসে চিরকুমার সংঘে ভিড় করেছে। পত্রিকা বেঁচে বেশ কিছু টাকা পায় তা দিয়ে আনন্দ স্ফুর্তি করে, জীবনের ব্যর্থতা ভুলে থাকার চেষ্টা করে। এভাবে তারা চিরকুমারদের বদনাম করে। আর বদনাম শুনে গিন্নীদের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তারাও উৎসাহ পেয়ে চিরকুমারদের একেবারে নপুংসক বানিয়ে ছাড়ে আর স্বামীর প্রতি আদর-সোহাগ বাড়িয়ে দেয়, খাওয়ার প্রতি যত্নবান হয়ে ওঠে।
কিন্তু শামসুল হক খুব কঠোর প্রকৃতির লোক তার স্ত্রীও কঠোর। সে চিরকুমার সম্মেলনের জন্য পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে এসে বাসায় বলল ‘আজ কাজের মতো একটা কাজ করে এলাম। গিন্নি জিজ্ঞেস করল ‘কি এত সুন্দর কাজটা করলে? শামসুল হক বলল ‘চিরকুমারদের পঞ্চাশ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে এলাম। গিন্নি খেকিয়ে উঠল, কী আমি একটা কিছুর কথা বললে তোমার টাকা থাকে না আর এখন ঐ ভবঘুরে বাউন্ডুলেদের সমিতিতে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে দিলে? ঠিক আছে আমাকে এক্ষন দুই লাখ টাকা দাও, এখন দিতে হবে আমি সেই হিরার হারটা কিনব। শামসুল হক ধমকে উঠে ‘কেন আমি দিব কেন, নিজে কামাই করে খরচ কর গিয়ে, পরে পরে আর কত চলবে? আমার সারা জীবনের উপার্জন তোমার পিছনে ঢেলেছি আর নয়। আজ যদি চিরকুমার থাকতাম তাহলে আমার কোটি কোটি টাকা থাকতো, তুমি আছ শুধু আমার টাকা ভাঙ্গার তালে। আমার চিরকুমার থাকাই ভালো ছিলো।
গিন্নি বলে ‘তোমার টাকা ভাঙ্গব না তো কোন নাগরের টাকা ভাঙ্গব। টাকার প্রতি এত দরদ তাহলে আমাকে এনেছিলে কেন? কর্তা বলে ‘আমি কাউকে আনি নাই। এবার গিন্নি সত্যি সত্যিই রেগে গেল, কি তুমি আন নাই তো আমি পায়ে হেঁটে এসে পরেছিলাম নাকি? মনে নাই আমার পেছন পেছন ঘুর ঘুর করে বেড়াতে আর আমার দাদাকে গিয়ে বলতে ‘বিয়ে না দিলে আত্মহত্যা করবে। এখন ঐ শয়তান সঙ্গের আস্কারা পেয়ে মাথায় উঠে গেছ। ঠিক আছে থাক তুমি তোমার টাকা নিয়ে চিরকুমার হয়ে, এই আমি বাপের বাড়ি চললাম’ বলে সত্যি সত্যিই বেরিয়ে যেতে লাগল। এবার শামসুল হকের হুশ হল। সে দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে বলল ‘এই গাধা তোর মা ঝগড়া করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ছেলে কিশোর বয়সী, চিরকুমারদের সাথে তাঁরও ওঠাবসা। রুম থেকে বেরিয়ে সে মায়ের আঁচল ধরে টেনে টুনে নিয়ে আসল।
রিয়াজ উদ্দিনও কড়া লোক কিন্তু তার বউ একেবারে মাটির মানুষ। সে চিরকুমারদের বিরিয়ানি খেয়ে বাসায় এসে বলল ‘আসলে কি যান মেয়েরা হলো ভূত, এরা বিয়ের পর ভুতের মত স্বামীর ঘাড়ে চড়ে বসে বসে খায় আর ঠ্যাং নাচায়। কোন কাম কাজ করে না, এক পয়সা উপার্জন করে না শুধু খরচ করে। এরা হলো পুরুষদের বুঝা, জাতির বুঝা। তার গিন্নি বিপরীতমুখী তাকিয়ে একটু হাসলো তারপর মুখটা গম্ভীর করে বললো ‘ঠিকই বলেছো, আসলে আমরা তোমাদের বুঝা, স্ত্রীদের জন্য তোমাদের কত কষ্ট করতে হয়, অর্থ খরচ করতে হয় আমাকে মাফ করে দিও আর বুঝা হয়ে থাকতে চাই না’ বলে রুমে গিয়ে বোরকা পরতে লাগল। রিয়াজের দম বন্ধ হবার উপক্রম, সে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘কি কর? স্ত্রী বলল ‘চলে যাব, তোমার অনেক টাকা-পয়সা খরচ করেছি আমাকে মাফ করে দিও। রিয়াজ পাগলের মত স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে ‘তুমি এসব কি বলছ, আমার এত এত ধন সম্পদ বাসা বাড়ি এসব কার জন্য, তুমি ছাড়া এসবের কি মূল্য আছে আমার জীবনের কি মূল্য আছে? গিন্নী স্বামীর বুকে মাথা রেখে মিটিমিটি হাসে। এভাবে চিরকুমার সমিতির বদৌলতে ঘরে ঘরে নারী- পুরুষের সংঘাত উস্কে উঠে।
৩
অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অবশেষে নির্ধারিত দিনে সার্কিট হাউজ ময়দানে মহাসম্মেলন শুরু হল। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও বিশাল মাঠ উপছে পড়ছে, সর্বত্র লোকে লোকারণ্য, যেন এক জনসমুদ্র। ময়মনসিংহের সকল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলের ছাত্ররা এসেছে, সর্বশ্রেণীর তরুণ-যুবকরা এসেছে। তবে তাদের অধিকাংশই এসেছে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য, চিরকুমার সংঘের সমর্থক বা সহকর্মি হয়ে খুব কম লোকই আসে। প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরাও আসে, অবশ্য তারা আসে নিজের মধ্যে জোয়ানি ফিরিয়ে আনতে। কারণ চিরকুমারদের বক্তব্য শুনলে তাদের ঠাণ্ডা রক্ত গরম হয়ে ওঠে, নিজেকে জোয়ান জোয়ান মনে হয়, প্রেম প্রেম খেলার একটা ভাব জেগে ওঠে। বিশাল মাঠ ভর্তি হয়ে রাস্তাঘাটে মানুষ গিজগিজ করছে, স্থান না পেয়ে অনেকেই গাছে উঠে বা অন্যের বাড়ির ছাদে উঠে সম্মেলন দেখছে।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মহিলা সাংবাদিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও নেতৃরাও এসেছে। সম্মেলনের আশপাশ এলাকার বাসাগুলিতে তারা এসে আশ্রয় নেয়। তখন সেসব বাসার গিন্নিরা পুরুষদের বাসা থেকে বের করে দিয়ে আগত মহিলাদের সাদরে গ্রহণ করে, খাওয়া দাওয়া করায় ও নির্বিঘ্নে বক্তব্য শোনার ব্যবস্থা করে দেয়। চিরকুমারদের লেজে আগুন ধরানোর জন্য তারা সাংবাদিক ও সমাজকর্মী মহিলাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। তখন এই মহিলারা সম্মেলনের বক্তব্য শুনে, তারপর মোক্ষম মোক্ষম পয়েন্টগুলি ধরে চিরকুমারদের উপর হামলে পড়ে। এরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ঝড় তুলে। চিরকুমারদের অ্যারেস্ট করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানায়, চিরকুমার অফিস ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য জনগনকে আহ্বান জানায়।
মাঠের উত্তর পাশে দক্ষিণমুখী করে বিশাল প্যান্ডেল নির্মাণ করা হয়েছে, তিন সারি করে চেয়ার বসানো হয়েছে। ভি আই পি অতিথিরা সামনের সারিতে বসবে, বিশেষ অথিতিরা দ্বিতীয় সারিতে আর সাধারণ মেহমানরা তৃতীয় সারিতে বসবে। এরপরেও স্থান সংকুলান হয়না, তখন মঞ্চের দুই পাশে চেয়ার দিয়ে সাধারন অথিতিদের আসন দেওয়া হয়। তিন অধিবেশনে সভার কার্যক্রম চলে। প্রথম অধিবেশন সকাল দশটায় শুরু হয়ে জহুর পর্যন্ত। যহুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দ্বিতীয় অধিবেশন, তারপর রাত্রে চলে সংগীতানুষ্ঠান।
প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছে। এই অধিবেশনের সভাপতি হিসাবে উপস্থিত আছেন আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ আর দোয়া অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য এসেছেন ময়মনসিংহের বড় হুজুর। এছাড়া বক্তব্য ও মূল্যবান বাণী দেয়ার জন্য বিশিষ্টজনরা উপস্থিত হয়েছেন। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হল। তেলাওয়াতের পর সম্মেলনের সভাপতি ডঃ মনিরুজ্জামান এবং বড় হুজুর দু’জন মিলে ‘চিরকুমার বার্তা’ এর মোড়ক উন্মোচন করলেন, সাথে সাথে সমগ্র মাঠে হাততালি ও স্লোগান উঠল। এরপরই পত্রিকা বিক্রির ধুম পড়ে গেল। ময়দানের চারপাশে দশটি স্টল করা হয়েছে, ক্রেতারা এসব স্টলে লাইন দিয়ে পত্রিকা কেনা শুরু করলো।
তারপর সভাপতি ডঃ মনিরুজ্জামান বক্তব্য নিয়ে এলেন। তার সভাপতি হওয়ার যোগ্যতা হল- এ পর্যন্ত তিনি মাত্র দু'টি বিয়ে করতে সক্ষম হয়েছেন। তার প্রথম স্ত্রী ম্যাজিস্ট্রেট দুইটা বাচ্চা আছে। কিন্তু হঠাৎ তার এক যুবক বন্ধু মারা যায় আর বন্ধুর যুবতী সুন্দরী বিধবা স্ত্রী দেখে তার মাথা ঘুরিয়ে যায়। তখন তিনি প্রচার করতে লাগলেন, অল্প বয়সে মহিলাটা বিধবা হয়ে গেছে মাত্র একটা বাচ্চা, এভাবে তো তার জীবন চলবে না। বন্ধুর স্ত্রী হিসাবে নিশ্চয়ই আমার একটা কর্তব্য আছে। কিছুদিন পর তিনি সেই কর্তব্য পালন করলেন- বিয়ে করে ফেললেন। তখন তার প্রথম স্ত্রী দুই বাচ্চা নিয়ে আলাদা বাসায় চলে গেলেন।
তিনি বক্তব্য শুরু করলেন, বিসমিল্লাহ বলে আল্লাহর প্রশংসার সাথে সাথে চিরকুমারদের উচ্চসিত প্রশংসা করলেন। কারন তাদের প্রশংসা না করলে পকেটে কিছু পড়বে না। কাজেই তিনি প্রাণ খুলে প্রশংসা করে বললেন ‘চিরকুমাররা হলো জাতির সম্পদ দেশের সম্পদ। কারন এমনিতেই বাংলাদেশ জনবহুল দেশ, এখানে শনৈঃ শনৈঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু আমাদের সোনার ছেলেরা নিজেকে কষ্ট দিয়ে কঠোর সাধনা করে চূড়ান্ত আত্মসংযম করে অবিবাহিত থেকে দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরন রোধ করছে। এভাবে তারা দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে বিধায় তারা প্রশংসার দাবিদার।
আবার তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে, তারা ইচ্ছা করলেই চাকরি করতে পারে কিন্তু এখানেও তারা আত্মত্যাগ করছে। ফলে কোটি কোটি বেকারের দেশে তাদের চাকরিগুলি অন্যরা পাচ্ছে, এতে বেকার সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হচ্ছে। এভাবে তারা আত্মত্যাগের মাধ্যমে দরিদ্র দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করছে, বেকার সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান করছে। কাজেই সরকারের কাছে আমাদের দাবী চিরকুমার সংঘকে স্বীকৃতি দেয়া হোক, জাতীয় সংগঠন হিসাবে ঘোষনা দেওয়া হোক। তদুপরি সরকারিভাবে এই সংগঠনের প্রচার প্রসারের ব্যবস্থা করা হোক। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ ও বেকার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দেশের তরুণ ও যুবসমাজকে এই সমিতির সদস্য হওয়া বাধ্যতামুলক করা হোক। সর্বোপরি সর্বস্তরের জনগণের উচিত সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে এমন একটি অভূতপূর্ব কল্যাণকর সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তরুন ও যুবসমাজের উচিত এই সংগঠনের সদস্য হয়ে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করা।
তারপর তিনি শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে দু’হাত উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ‘আপনারা কি বলেন সবাই সহযোগিতা করবেন তো? ধুন্ধুমারের মধ্যে হরেক রকম আওয়াজ শোনা গেল। কিছু শোনা গেল সহযোগিতা করব, কিছু শোনা গেল বাঁশ দিব মুলা দিব কলা দিব ইত্যাদি। সভাপতি একটু দম নিলেন, হাসিমুখে সামনে তাকিয়ে দেখলেন তার কলেজের অনেক ছাত্র দেখা যাচ্ছে। প্রায় তার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে এলো ‘এই তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন, হারামজাদাগুলিকে বাঁশ দে, কুলাঙ্গার গুলাইনের কাম নাই কাজ নাই বড়লোক বাবার হোটেলে বসে বসে খায় আর আকাম করে। হালার পুতেরা বিয়ে করবে না চাকরি করবে না শুধু বসে বসে খাবে, জনগণের অন্ন ধ্বংস করবে। এরা দেশের শত্রু, জাতির বুঝা, পরিবারের অভিশাপ। পেটা শুয়ারগুলিকে, বাঁশ মার, বাঁশ মেরে মেরে রাস্তার ধারে খাড়া করে পুঁতে রাখ। চিরকুমার থাকার সাধ মিটিয়ে দে।
কিন্তু না, কিছু না বলে তিনি পকেটে হাত দিলেন। কারণ কিছু বললে খালি পকেটে ফিরে যেতে হবে। তারপর তিনি চিরকুমার সংঘের প্রশংসা করলেন, সকলের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে তাদের সাফল্য কামনা করলেন। সর্বশেষে দুই প্রকারের আশীর্বাদ করলেন, উচ্চ স্বরে বললেন ‘আল্লাহ তুমি এই সংঘকে কবুল কর, মনে মনে বললেন ধ্বংস করো। সবাই চিরকুমার সংঘের সহযোগিতা করুন, মনে মনে বললেন বাঁশ দেউন। জয় চিরকুমার সংঘ, মনে মনে বললেন গোল্লায় যাক চিরকুমার সংঘ’ বলে তিনি বক্তব্য শেষ করলেন।
তারপর সমিতির সভাপতির কানে কানে ‘আমার একটু জরুরী কাজ আছে, আমি আসি’ বলে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। সভাপতি নিচে গিয়ে একটা পেট মোটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললো ‘এটা রাখেন স্যার। প্রিন্সিপালের মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠলো, তিনি হাত বাড়িয়ে নির্মিলিত চোখে বললেন ‘এসবের কি দরকার ছিল? হুমায়ুন বললো ‘নেন স্যার আমরা তো আপনার ছাত্রের মতোই। কিন্তু মনে মনে বলল ‘হালার পুত কেন যে এসেছ তা তো আমরা জানিই। তোমরা যে আমাদের কত বড় খয়ের খা তাও জানি, সুযোগ পেলেই আমাদেরকে বাশ দিবে। কাজেই টাকা দিয়ে তোমাদেরকে যদ্দুর ব্যবহার করা যায়। টাকার জন্য এসেছ এখন টাকা নিয়ে বিদেয় হও। ওদিকে অধ্যক্ষ সাহেব খামটা নিয়েই কেউ দেখে ফেলে কিনা তাড়াতাড়ি প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু পরিমাণটা জানার জন্য তার মন উসখুস করছে। তিনি আর ধৈর্যধারণ করতে পারলেন না, মানুষের সামনেই খামের মুখটা খোলে ভিতরে আঙ্গুল চালিয়ে গুনলেন, দশটা নোট। গতবছর দিয়েছিল আটটা। তিনি আনন্দে হেসে উঠলেন, ‘কোন হালা আধা ঘণ্টা ব্যয় করে দশ হাজার কামাতে পারে?
৪
প্রিন্সিপাল চলে গেলে বড় হুজুর এসে সভাপতির আসনে বসলেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে একের পর এক আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্য চলতে লাগলো। সবাই চিরকুমার থাকার মাহাত্ম্য ও উপকারিতা বয়ান করল ‘চিরকুমাররা জাতির সূর্য সন্তান, আকাশের মুক্ত বিহঙ্গ। এরা নিজেদের পায়ে নারীর বেড়ি পড়ে না, এরা স্বাধীন ঘুঘু। এভাবে তারা চিরকুমারদের প্রশংসা করে তাদের প্রতি সরকার ও জনগণের সাহায্য সহানুভূতির দাবি জানাল। চিরকুমারদের জয়জয়কার করে স্লোগান দিল, শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ-পাতাল মুখরিত হয়ে ওঠল। তবে স্লোগানের মধ্যে গড়বড় শোনা যায়। কারণ এখানে অধিকাংশ পোলাপান এসেছে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য চিরকুমারদের সমর্থক হিসেবে নয়। বিশাল মাঠে অতি অল্পসংখ্যকই আছে তাদের সমর্থক।
কাজেই কোন বক্তা যখন শ্লোগান তুলে চিরকুমার সংঘ--- তখন সমর্থক শ্রেণী বলে জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। কিন্তু বাকিদের কেউ বলে গোল্লায় যাক কেউ বলে চুলোয় যাক কেউ হলে জাহান্নামে যাক কেউ হলে রসাতলে যাক। আবার বক্তা যখন বলে চিরকুমার সমিতি--- তখন নগণ্য সংখ্যক সমর্থকরা বলে চিরজীবি হোক কিন্তু দুষ্টু পোলাপানের দল বলে ধ্বংস হোক। তারপর বক্তা যখন হাত উঠিয়ে সকলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেয়ার জন্য বলে- তরুণ-যুবকরা সবাই এই সমিতির সদস্য হবে কিনা? তখন নগণ্যরা বলে সদস্য হব কিন্তু অধিকাংশরা বলে বাঁশ দিবো মুলা দিব চুলা দিব ইত্যাদি। এসব স্লোগান বক্তা ও চিরকুমারদের কানেও যায় কিন্তু তারা বিরক্ত হয়না বরং উপভোগ করে। এভাবে প্রথম অধিবেশনের কাজ শেষের দিকে চলে এল।
জহুরের আজানের সময় হয়ে গেছে এখন দোয়া হবে। বড় হুজুর অনেক চিন্তা ভাবনার পর তার বক্তব্য ঠিক করলেন। কারণ উল্টাপাল্টা কিছু বললে যদি আবার হাদিয়াটা ফসকে যায়। তার পরিচয় হলো এ পর্যন্ত তিনি মাত্র তিনটা বিয়ে বাগাতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একে একে দুইটা বিয়ে করেন কিন্তু তিন ঘরের তিনহালি পোলাপানের কামড়ে পয়সা উপার্জনের ধান্দায় তিনি সর্বদা নাচের উপর থাকেন, চতুর্থ বিয়ের কথা ভুলেই গেছেন। তিনি হামদ-নাতের পর বক্তব্য শুরু করলেন ‘আসলে আমরা বেহেস্তে ছিলাম কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় মা হাওয়া একটা অকাম করলেন, ফলে আমরা বেহেশ্ত থেকে এই পাপ-পঙ্কিলময় পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হলাম। মা হাওয়া ঐ অপকর্মটা না করলে আজও আমরা বেহেস্তে থাকতাম।
এজন্যই ইহুদি- খৃষ্ট ধর্মমতে মেয়েরা হলো শয়তানের বাহন অথবা সরাসরি শয়তান। আর আমাদের উচিত এই শয়তানদের থেকে লক্ষ যোজন দূরে অবস্থান করা। যদিও তিনি কোন রাতেই এজাতীয় শয়তানের উষ্ণ পরশ ব্যতিত শয়ন করেন না। তিনি বলেন ‘আর এই কাজটি করতেছে চিরকুমার সদস্যরা। কাজেই এরা হলো প্রকৃত মানুষ খাটি মানুষ, জাতির সূর্যসন্তান, এরা আল্লাহর পুরস্কারের হকদার। আসলে নারী পুরুষের যে কাজটা তা হলো যিনা। বিয়ের আগে হোক বা পরে হোক কাজ তো আসলে একটাই, কাজেই এটা যিনা বলে গণ্য হওয়া উচিত। আর যিনা থেকে চিরকুমাররা দূরে থাকছে, তারা কোনদিন বিয়েও করবে না যিনাও করবে না। কাজেই এরা হলো প্রকৃত নিষ্কলুষ মানুষ, মহাপবিত্র, ফেরেশতাতুল্য নিষ্পাপ মা’সুম। আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে জান্নাত দান করবেন। আসলে জাহান্নামেও--- মুখ ফসকে কথাটা বলেই সাথে সাথে মুখটা বন্ধ করে দিলেন। কারণ তিনি বলতে চাইছিলেন ‘আসলে জাহান্নামেও এদের জায়গা হবেনা’। কিন্তু এটা বললে আর কপালে হাদিয়া জুটবে না।
তারপর তিনি বললেন ‘নারীরা হলো শয়তানের রশি, শয়তান এই রশি পুরুষের গলায় লাগিয়ে টেনে নিয়ে বেড়ায়, বিভিন্ন পাপ কাজ করায়। যারা বিয়ে করেছে তারাই শয়তানের রশি গলায় পড়েছে। তারপর শয়তান এদেরকে দিয়ে ঘুষ, সুদ চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি আত্মসাৎ কালবাজারি, জবরদখল ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত করায়। বিয়ে না করলে মানুষ এসব অপকর্ম করত না। কারণ একার জন্য কেউ বিত্ত-বৈভবের চিন্তা করে না। কাজেই প্রমানিত হল নারীরা শয়তানের রশি। (যদিও তিনি তিনটা রশি গলায় পড়েছেন)। তারপর বললেন ‘চিরকুমাররা এই গোলামির রশি থেকে মুক্ত, তারা বিয়েও করবে না শয়তানের রশি গলায়ও পড়বে না দাসত্বও করবে না। কাজেই এরাই হলো প্রকৃত মানুষ, আল্লাহর খাঁটি বান্দা রাসূলের আদর্শ উম্মত। এদের জন্যই রয়েছে ইহকালের শান্তি আর পরকালের সাফল্য। আল্লাহ তাদেরকে মহাপুরস্কার দেবেন। এখন যুবসমাজের প্রতি আমার আহ্বান তোমরা এই সমিতির সদস্য হও চিরকুমারব্রত গ্রহণ কর, মনে মনে বললেন তারপর গোল্লায় যাও।
এরপর তিনি দোয়ার জন্য হাত উঠালেন এবং দুইভাবে দোয়া করলেন। মুখে বললেন ‘হে আল্লাহ চিরকুমার সমিতিকে কবুল ও মঞ্জুর কর, মনে মনে বললেন ধ্বংস কর। সকল যুবসমাজকে সমিতির সদস্য হবার তাওফিক দাও, মনে মনে বললেন চিরকুমারদের বাঁশ দেওয়ার শক্তি দাও। এই সমিতিকে দির্ঘায়ু দান কর, মনে মনে বললেন বিলুপ্ত কর। এভাবে দেয়া পর্ব শেষ করে তিনি মঞ্চ থেকে নেমে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। কারণ কেউ তার পেছনে পেছনে আসছে না। তিনি আশঙ্কাবোধ করতে লাগলেন তাহলে কি টাকা দিবে না, শুধু শুধুই এই মিথ্যে অভিনয় করা হলো? অনুশোচনায় হুজুরের শরীর ঘেমে উঠল, তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন। আসলে সভাপতি হুমায়ুন তখন মাইকে কথা বলছে। সে ঘোষণা দিল ‘সুধীমন্ডলী জোহরের আযানের সময় হয়ে গেছে এখন নামাজের জন্য এক ঘণ্টা বিরতি। আমাদের সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন সমাপ্ত হলো। দুইটা থেকে আবার দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হবে।
তারপর সে দৌড়ে নেমে গিয়ে হুজুরের দিকে একটা পেট মোটা খাম বাড়িয়ে দিল, তা দেখে তিনি একটা মনমাতানো হাসি উপহার দিলেন। কারন তিনি সরকারি চাকরি করেন না যে টাকা নিতে লজ্জা পাবেন, তার কাজই হল অন্যদের থেকে টাকা নেওয়া। কাজেই খপ করে খামটা নিয়েই মুসাফাহা করে বিদায় নিলেন। যেতে যেতে মানুষের সামনেই খামটা ছিড়ে টাকা বের করে গুনলেন। খাদেম পিছু পিছু যাচ্ছে, সে জিজ্ঞেস করল ‘হুজুর কত দিছে? তিনি উত্তর দিলেন ‘আট হাজার, গতবছর ছয় হাজার দিছিল, এবার দুই হাজার বেশি দিছে। শুনে খাদেমও খুশি হুজুরও খুশি। কারণ হুজুর মাদ্রাসা পরিয়ে পান দুই হাজার, মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি করে পান মাত্র তিন হাজার। এমন কঠিন দায়িত্ব পালন করে পান মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। অথচ এখানে অল্প কিছুক্ষণে পেলেন আট হাজার, এজন্যই তিনি এত খুশি।
সম্মেলন ভঙ্গ হলে ছেলেরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, খাওয়া-দাওয়াও আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠল। ওদিকে দশটি বুকস্টলে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়, তারা লাইন দিয়ে নতুন পত্রিকার সাথে সাথে পুরাতন পত্রিকাও কিনতে লাগল।
৫
দুপুর দুইটায় দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো, এই অধিবেশনে কোন আমন্ত্রিত অতিথি বা মুরুব্বি নাই। এটা শুধু যুবক তরুণদের আসর, এখানে চিরকুমাররাই মূল আলোচক। সমিতির সভাপতি হুমায়ূন আহমেদ সম্মেলনের সভাপতির আসন গ্রহণ করল। সে স্বাগত বক্তব্যে বলল ‘প্রিয় যুবক তরুণ ভাইয়েরা। আমরা জানি মেয়েরা হলো ফুল আর ফুল ফুটে নিজের স্বার্থে অন্যকে আকৃষ্ট করার জন্য। কারন সে তো অনাদরে-অবহেলায় ঝরে পড়ে মানুষের পদতলে পিষ্ট হত, তার জন্ম ব্যর্থ হত, লোকচক্ষুর অন্তরালে ঝরে গিয়ে পচে গলে মাটির সাথে মিশে যেত। এজন্যই সে মোহনীয় রূপ ধারণ করে গন্ধ ছড়িয়ে মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করে। তারপর অনুরাগির নাকে মুখে চোখে মমতার পরশ পায়, গলায় বা মাথায় ঠাঁই পায়।
মেয়েদেরও একই অবস্থা। তারা কলি থেকে কিশলয় পর্যন্ত ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়ে সুগন্ধি ছড়ায় পুরুষের হৃদয় আকৃষ্ট করার জন্য। তবে পার্থক্য এই যে, ফুল মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করে অনাদরে ঝরে পড়া থেকে সাদরে গৃহীত হওয়ার জন্য। কিন্তু মেয়েরা ছেলেদের আকৃষ্ট করে ভক্ষণ বা খাদ্য বানানোর জন্য। যেমন আফ্রিকার জঙ্গলে সূর্যমুখীর মতো দেখতে পতঙ্গভুক একপ্রকার ফুল আছে। এই ফুলগুলি লজ্জাবতী গাছের মত সাধারনত চুপসে থাকে। কিন্তু অন্ধকার রাতে এগুলি প্রস্ফুটিত হয়ে সূর্যমুখীর মত মেলে ওঠে, এগুলির পরাগরেণু থেকে আলোক বিচ্ছুরিত হয়। অন্ধকার রাতে আলোক শিখা দেখে বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ এসে জমা হয়। যখনি সূর্যমুখীর মুখটা কীটপতঙ্গে ভরে ওঠে তখনই আবার চুপসে যায়, পতঙ্গগুলি চলে যায় তার পেটের মধ্যে, পরমুহূর্তে হজম হয়ে যায়, তাদের একটা ডানাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
অনুরূপভাবে মেয়েরা হলো নরপতঙ্গভুক ফুল। মেয়েরা জানে যে তারা দুর্বল, বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর ঝঞ্জাবর্তের সাথে পাঞ্জা লড়ে তারা টিকে থাকতে পারবে না। এজন্যই তারা ময়ূরের মতো পেখম মেলে শিখাবৎ প্রদীপ্ত হয়ে নর পতঙ্গ শিকারে নামে। তখন কূপমন্ডুক ছেলেরা মেয়েদের রূপের আগুনে ঐ পতঙ্গের ন্যায় আত্মাহুতি দেয়। তারপর মূর্খ পুরুষগুলিকে বিয়ে নামের লাগাম পরিয়ে গাধা ও ঘোড়া বানিয়ে তাদের পিঠে চড়ে মেয়েরা নির্বিঘ্নে পৃথীবীর মাঠ ঘাট দাবড়ে বেড়ায়, সারা জীবনের জন্য ভারবাহী গাধা বানিয়ে নেয়। কাজেই যুবক ও তরুন ভাইয়েরা মেয়েদের বিয়ে নামক মরণ ফাঁদ থেকে সাবধান। এজাতীয় আরো কিছু উদাহারন দিয়ে মেয়েদেরকে পুরুষখেকু রাক্ষসি প্রমান করে সভাপতি তার বক্তব্য শেষ করল।
তারপর সমিতির সেক্রেটারি জাফর ইকবাল বক্তব্য নিয়ে এল। প্রথমে স্লোগান দিয়ে সে বক্তব্য শুরু করল ‘জয় স্বার্থবাদ, জয় নারীবাদ। মেয়েরা এই পৃথিবীর একমাত্র স্বার্থবাদী গোষ্ঠী, তারা স্বার্থ ছাড়া কোন কাজ করে না, পুরুষের সাথে তাদের সম্পর্কটা শুধু স্বার্থের। আমি এর বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি, তবে উদাহরণটা বাইরে থেকে দিলে হয়ত তেমন বিশ্বাসযোগ্য হবে না বিধায় একেবারে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে, আমার মা বাবার উদাহরণ দিচ্ছি। আগে আমরা গ্রামে থাকতাম, একান্ত দরিদ্র ছিলাম আমার বাবা টুকটাক ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। পরিবারে সব সময় নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা বিরাজ করত, অনেক সময় ভাল মন্দ খাবার জুটত না, শাকপাতাই ছিল আমাদের কমন খাদ্য।
ছোটবেলা থেকেই আমি লক্ষ্য করেছি পরিবারে যখন ভালো কোন ব্যঞ্জন যেমন মাছ গোশত ডিম ইত্যাদি রান্না হত তখন আমার মা সবাইকে এক চামচ করে দিতেন এমনকি বাবাকেও এক চামচের বেশি দিতেন না। বাদবাকি তরকারিটা লুকিয়ে রেখে অন্য সময় শুধু আমাকে দিতেন আর বাকিদের খাওয়াতেন শাক পাতা দিয়ে। অবশ্য আমার মা কখনো ভালো তরকারি পাতে নিতেন না বরং তার অংশটা আমার বরাদ্দে দিয়ে দিতেন। সারাজীবন দেখেছি শাক পাতাই ছিল তাঁর আদর্শ খাবার। আমি আর আমার বাবা একসাথে বসে খেতাম। অধিকাংশ সময় দেখা যেত আমি খাচ্ছি মাছ গোশত আর বাবার পাতে হয়তো আলু ভর্তা বা কচুর শাক বা সামান্য ডাল। অনেক সময় তিনি খেতে পারতেন না। বোঝা যেত যেন তার মন আমার তরকারি থেকে সামান্য একটু ভাগ পেতে চাচ্ছে। সামান্য একটু তরকারি দিলে যেন তিনি অমৃতের মতো গোগ্রাসে খাবার শেষ করতে পারেন। কিন্তু আমার মা দিতেন না।
একদিন রাতে বাপ বেটা একসাথে খেতে বসেছি। বাবার পাতে পচা-বাসি সামান্য একটু ডাল, গন্ধে তিনি খেতে পারছেন না আর আমি মাংস দিয়ে লালা ঝড়িয়ে ঝড়িয়ে খাচ্ছি। তিনি আমার পাতের দিকে কিছুক্ষণ পিটপিটিয়ে তাকিয়ে থেকে অবশেষে সীমালঙ্ঘন করলেন। মায়ের দিকে ফিরে একটা মোসাহেবি হাসি দিয়ে গলা টেনে বললেন ‘একটু গোশত--- মা ধমকে উঠলেন ‘তোমাকে দিলে ছেলেটা আরেকবার খাবে কি’ বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। পাপানুভুতিতে মানুষ লজ্জিত হয় জানি কিন্তু বেচারা বাবাকে এমনতরো লজ্জিত হতে আমি আর কোনদিন দেখেনি। দুর্লঙ্ঘনীয় অপরাধের দায়ে তার মুখটা কালো হয়ে গেল। এক চিমটি লবণ নিয়ে কোনোরকম কয়েক লোকমা খেয়ে দ্রুত পলায়ন করে লজ্বা থেকে বাঁচলেন। এরপর থেকে বাবা আর কোনদিন আমার পাতের দিকে ফিরে তাকানোর মত দুঃসাহস দেখায়নি। আর আমার মা শাঁকপাতা খেতে খেতে তার অবস্থা এমন হলো যেমন কুকুরের পেটে ঘি ভাত সয় না, তদ্রুপ মায়ের পেটেও মাছ-মাংস সইতো না এগুলি শুধু আমার পেটে সইত।
যাই হোক আমাদের বক্তা অনেক, চিরকুমারদের অনেকেই বক্তব্য দেবেন। কাজেই আমি আর সময় নষ্ট না করে আরেকটা উদাহারন দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। ব্যবসা করে একসময় আমার বাবা অনেক উন্নতি করলেন ময়মনসিংহ শহরে জায়গা জমি কিনে বাসাবাড়ি করে এখানে চলে আসলাম। একবার পরিবারস্থ সকলেই মওসুমী জ্বরে আক্রান্ত হলাম। আমি, আমার দুই বোন ও বাবা প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হলাম শুধু মা সুস্থ থাকলেন। আমি লক্ষ্য করলাম মা সবসময় আমার বিছানার ধারে বসে থাকেন, শুধু ঔষধ খাওয়ানোর প্রয়োজন হলে বাবার রুমে ও মেয়েদের রুমে যেতেন। অন্যথায় রাত দিন আমার পাশে বসে সেবা-শুশ্রূষা করেন, মাথায় পানি দেন, জলপট্টি দেন, জোর করে এটা-ওটা খাওয়ান। নিজের রুমে পর্যন্ত যান না, রাতে আমার পাশে একটু আধটু কাত হয়ে শুয়ে সামান্য ঘুমিয়ে নেন।
একদিন আমার বাবা কাঁপতে কাঁপতে এসে আমার পাশে বসে কপালে হাত বুলিয়ে বললেন ‘বাজান এখন কেমন লাগছে? আমি কোন উত্তর দিলাম না। মা ধমকে উঠলেন ‘নিজে মরতেছ আবার এখানে এসেছো কোন উমেদারি করতে? বাবা শুকনো হাসির ভঙ্গিমা ফুটিয়ে বললেন ‘ছেলেটাকে না দেখে যে থাকতে পারছি না। মা আবার ধমক দিলেন ‘হয়েছে হয়েছে এখন নিজের রুমে যাও, অসুখ বাড়লে আমি আর টানাটানি করতে পারবোনা। বাবা বেচারা সম্ভবত এসেছিলেন আমার পাশে কিছু সময় কাটাবেন বলে কিন্তু ধমক খেয়ে বিরক্ত মুখে তিনি উঠতে চাইলেন আর সাথে সাথে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। মা দৌড়ে এসে টেনে তুলে কয়েকটা ঝাড়ি দিলেন ‘নিজে মরার ফুরসত পায় না আবার ছেলেকে দেখতে এসেছে, এখন যদি জ্বর বাড়ে তাহলে আমি আর ফিরেও তাকাবো না টেনে নিয়ে ওই বারান্দায় ফেলে রাখব। এখন ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাক। তারপর আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বাবা কাঁপতে কাঁপতে একাকী গেলেন আর মা এসে আমার মাথা টিপা শুরু করলেন কিন্তু বাবার কোন সাহায্য করলেন না। জয় স্বার্থবাদ।
দুটি উদাহরণ দিলাম, তা থেকে প্রমাণিত হলো যে মেয়েরা স্বার্থপর। তারা শুধুমাত্র সন্তান বিশেষত ছেলে সন্তান প্রাপ্তির জন্য পুরুষের শরণাপন্ন হয়। যখনি সন্তান হয়ে যায় তখন সন্তানই হয় তার যথা সর্বস্ব আর ওই পুরুষটা হয়ে যায় শুধুমাত্র কলুর বলদ। যেমন আমার মা নিশ্চয়ই আগে আমার বাবাকে ভালোবাসতেন, ভালো-মন্দ খাওয়াতেন, সেবা যত্ন করতেন। কিন্তু আমার জন্মের পর তার সকল ভালোবাসা সেবা-যত্ন আদর আহ্লাদ আমার বরাদ্দে নির্দিস্ট হয়ে গেল আর আমার বাবা হয়ে গেলেন শুধু কলুর বলদ বা উপার্জনের মেশিন। কাজেই প্রমাণিত হলো মেয়েরা স্বার্থপর, আর স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই তারা পুরুষের শরণাপন্ন হয়।
তারপর স্বার্থটা হাসিল হয়ে গেলে পুরুষটা হয়ে যায় কলুর বলদ আর তার স্বার্থের ধন সন্তানটা হয়ে যায় তার সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। কাজেই আমরা যদি তাদেরকে সেই স্বার্থটা না দেই তাহলে তারা দূর থেকে আমাদেরকে কামনা করবে, ভালবাসবে, শ্রদ্ধা করবে কখনো হালের বলদ বা কলুর বলদ বানাতে পারবে না। কিন্তু স্বার্থটা দিয়ে দিলেন তো মরলেন আর আপনার কোন দাম থাকবে না। কাজেই এখন আমরা যুবক তরুণরা শপৎ করব এই মর্মে যে, মেয়েরা কাদিলে কোকালেও আমরা কখনো তাদেরকে স্বার্থের পুঁজি শুক্রাণুটা দিব না। আমাদের পিয়ারে তসলিমা আপা শ্লোগান তুলেছেন, জরায়ু আমার সিদ্ধান্ত আমার। কাজেই আমাদেরও শ্লোগান হল- শুক্রাণু আমার সিদ্ধান্ত আমার। এখন সবাই হাত তুলে শপৎ করুন। যুবকরা হাত উঠাল কিন্তু মুখে বলল ‘যার যা প্রাপ্য তা পাবে তোমরা শুধু কচু খাবে।
তারপর সে বক্তব্য শেষ করে চলে যেতে উদ্যত হতেই সভাপতি ডেকে নিয়ে কানে কানে বলল ‘এটা কেমন বক্তব্য হল, এতে তো মেয়েদের নিন্দাবাদের চেয়ে জিন্দাবাদই বেশি হয়ে গেল, এটা তো তাদের পক্ষে চলে গেল। জাফর কিছুটা রাগত স্বরে বলল ‘সত্য কথা কার পক্ষে গেল আর কার বিপক্ষে গেল পরোয়া করি না’ বলে চলে গেল।
৬
তারপর বক্তব্য নিয়ে এল চিরকুমার সদস্য এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র রাইসুল ইসলাম ওরফে ঠ্যাঙ্গারু। কারণ সে হলো তালপাতার সেপাই, রোগা পটকা হ্রস্ব দেহ দীর্ঘ পা। হাঁটার সময় মনে হয় শুধু দুইটা ঠ্যাং হেটে যাচ্ছে। আবার সে অনেকটা ক্যাঙ্গারুর মত লাফিয়ে লাফিয়ে হাটে, এজন্য রসিক বন্ধুরা ঠ্যাং আর ক্যাঙ্গারুর সন্ধি করে তার নাম দিয়েছে ঠ্যাঙ্গারু। সে বক্তব্য শুরু করল ‘বন্ধুগণ পুরুষরা হলো মেয়েদের দেহরক্ষী এবং গোলাম। যেমন ধরেন আমরা ছেলেরা যেখানে খুশি সেখানে পড়ে থাকতে পারি ঘুমাতে পারি। এই ধরেন আমরা রাতে এই মাঠে শুয়ে থাকতে পারি। আপনারা চলে গেলে আমি একা এখানে ঘুমাতে পারি, এমনকি আমাজনের জঙ্গলে, আফ্রিকার সাহারায়, হিমালয়ের চূড়ায়, বঙ্গোপসাগরের তলায়, ব্রহ্মপুত্রের ডগায়, গাছতলা আমতলা জামতলা যেখানে খুশি রাত কাটাতে পারি, কোন সমস্যা নাই।
কিন্তু মেয়েরা তা পারে না। রাজা সলোমনের এই পুত্রিদের জন্য রংমহল না হলেও অন্তত একটা নিরাপদ কুটির চাই, দুগ্ধফেননিভ নরম তুলতুলে বিচানা চাই, নইলে শাহজাদিদের গুলবদনে কাঁটা ফুটে, ময়ূরাক্ষীতে ঘুম নামে না। তাদের চাই নিরাপদ ও আরামদায়ক আশ্রম। কিন্তু ঐ নিষ্কর্মাদের তো কোন কিছু করার মুরোদ নাই, নিজের ব্যবস্থাপনা করার সামর্থ্য নাই তাই তারা পুরুষ শিকারে নামে। এরা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে আর ময়ূরের মতো পেখম মেলতে থাকে, প্রজাপতির ন্যায় ডানা মেলে চন্দ্রকলার মতো জ্যোতি ছড়াতে থাকে। সেই জ্যোতিতে ছেলেদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, পতঙ্গের মতো আত্মাহুতি দেয়। তখন তারা দেনমোহর বা কাবিননামার ফাঁদে ফেলে ছেলেদেরকে একেবারে দেহরক্ষি ও গোলামে পরিণত করে। ব্যস এরপর আপনার নিজের নিরাপত্তা থাকুক বা না থাকুক কিন্তু স্ত্রীর নিরাপত্তা বিধান করতে আপনি বাধ্য, আপনার মাথা গুজার ঠাই থাকুক বা না থাকুক কিন্তু স্ত্রীর জন্য নিরাপদ কুটির আর আরামদায়ক বিছানার ব্যবস্থা করতে আপনি বাধ্য।
এরপর সন্তানাদি হয়ে গেলে আপনি জন্মের মতো গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে গেলেন, মৃত্যু ছাড়া এ থেকে মুক্তির আর কোন উপায় নাই। আপনার নিজের খাওয়া-পরা আরাম-আয়েশ গোল্লায় যাক কিন্তু স্ত্রী-সন্তানের খাওয়া পরা আরাম-আয়েশ ও নিরাপত্তার জন্য আপনাকে উদয়াস্ত কলুর বলদের মত খেটে মরতেই হবে, কোন নিষ্কৃতি নাই। আমি এর একটা উদাহরণ দিচ্ছি, তবে বিশ্বাসের গ্যারান্টি হিসাবে উদাহরণটা আমার নিজের পরিবার থেকেই দিচ্ছি। আমার বাড়ি গ্রামে, বাবা মধ্যবিত্ত একজন কৃষক। কিন্তু আমার বড় বোন অতুল সুন্দরী ও মেধাবী হওয়ার সুবাদে ডাক্তার ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। আমি গ্রামের স্কুল থেকে এস এস সি-তে ভাল রেজাল্ট করলাম। তখন সবাই বলল শহরে গিয়ে ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে মেডিকেলে চান্স নেয়ার চেষ্টা করতে। কিন্তু মা-বাবা মাথা ঘোরাতে লাগলো, এত খরচ তারা বহন করতে পারবেন না।
এ দুঃসময়ে আমার বোন এসে আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। আমার বাবা দরিদ্র হলে কি হবে তার আত্মসম্মানবোধ প্রবল। কয়েকদিন পর বাবা চাল ডাল তরিতরকারি নিয়ে বোনের বাসায় হাজির হলেন। কিছু টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন ‘জামাইয়েরটা খেতে নেই দিতে হয়। আমি মাস মাস রইসুলের থাকা-খাওয়ার খরচ দিয়ে যাব। আমার বোন কিছু বলল না, বাবা একদিন থেকে চলে গেলেন। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে কি পরামর্শ করল কে জানে। একদিন দুলাভাই আমাকে ডেকে বলল ‘তোমার বোন তোমাদের বাড়ীতে বেড়াতে যাবে দিয়ে আস গিয়ে। আমি তাকে পৌঁছে দিয়ে চলে আসলাম।
আমার বোন টানা পনের দিন থাকার পর দুলাভাই তাকে আনতে গেল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সে একটা হিসাবের খাতা নিয়ে বাবার সামনে বসে বললো ‘আব্বাজান আপনার মেয়ে আর আমার দুই বাচ্চা পনেরদিন ধরে এখানে আছে, তাদের খাওয়া খরচের হিসাবটা দেন। অবশ্য শহরের চেয়ে গ্রামে তো খরচ একটু কম হওয়ার কথা। এখন কি তাদের প্রতিবেলার খাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা হিসাব করবেন নাকি পনেরদিনের হিসাব মোটের উপর ধরে দেবেন?
তখন বাবা বেচারা কিছুক্ষণ হা করে জামাইয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে রইলো। তারপর আমার বোনকে ডেকে বলল ‘আচ্ছা রইসুলের খরচ বাবদ তোকে যে দেড় হাজার টাকা দিছিলাম সেই টাকাটা ফেরত দে তাড়াতাড়ি দে, আমি বেশি ভদ্দরলোকি করে ফেলেছিলাম। আমার বোন শুধু হাসল, দুলাভাই আর একটা কথাও না বলে খাতাটা নিয়ে চলে গেল। ঘটনাটা শুনে আমি বুঝলাম এটা আমার বোনের ইঞ্জিনিয়ারিং। তখন আমার খুব আফসোস হল, কারণ বিয়ের পর আমার বোনের লেখাপড়াটা বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ লেখাপড়াটা চালু থাকলে সে ভালো সাংসারিক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতো।
শ্যালক হল পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় আত্মীয়। এজন্যই কথায় বলে মাছের মধ্যে মাছ হলো রুই আর আত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয় হলো শ্যালক। একটা উদাহরণ থেকে শালার পদমর্যাদা সম্পর্কে আন্দাজ নিতে পারবেন। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় আমাদের উপরের ক্লাশে পড়তো হেড স্যারের শ্যালক রফিক ও তার ছেলে রাজু। রাজু ক্লাসে সবচাইতে পড়া বেশি পারত কিন্তু বছর শেষে দেখা যেত এক রুল হতো রফিকের। একদিন রফিক তার ভাগ্নেকে জিজ্ঞেস করলো ‘আচ্ছা তুই সবসময় পড়া বেশী পারিস কিন্তু তোর রুল এক হয়না কেন? রাজু উত্তর দিল ‘আমি যদি আমার বাবার ছেলে না হয়ে শালা হতাম তাহলে এক রুলটা আমার জন্যই রিজার্ভ থাকত।
যাই হোক এই শ্যালকের পদমর্যাদা নিয়ে দুলাভাইয়ের সংসারে আমার অবস্থান। এখানে তার ভাই-বোন বা অন্য যে কোন আত্নিয়ের চেয়ে আমার গুরুত্ব বেশি। তদুপরি বোন ও ভাগ্নে-ভাগ্নিরা তো আমাকে ছাড়া চোখেই দেখে না। কারন বাচ্চারা মায়ের পরেই মামাকে আপন মনে করে, মনের কথা বলে। দুলাভাইয়ের কাছে আমার ভাগ্নে ভাগ্নিদের আবদার উপেক্ষা হতে পারে কিন্তু আমার আবদার কখনো উপেক্ষা হয় না। আমার প্রয়োজনগুলি সে চাহিবামাত্র পূরণ করে দেয় আর আমিও দুহাতে লোটে নেই। কারণ এই শালা সরকারি ডিউটি ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট রুগি দেখে, গরিবের পেটে লাথি মেরে কসাইয়ের মত টাকা খসিয়ে নেয়। কাজেই ভাবলাম আমিও গরিব তাই এই কসাইয়ের কাছ থেকে টাকা খসিয়ে নিয়ে দরিদ্রের অধিকার কিছুটা হলেও উসুল করে নেই। বলাই বাহুল্য দুলা ভাইয়ের সংসারে আমার এই প্রভুত্বের ভিত্তি হল স্ত্রীর ভাই হওয়া, দুলা ভাই নামের গাধাগুলি স্ত্রীর সাথে সাথে শ্যালকদেরও দাস হয়ে যায়।
যাই হোক আসল কথায় আসি। আমি দেখেছি দুলাভাই নামের এই গাধাটা রাতদিন পরিশ্রম করে মানুষের পকেট কেটে পয়সা উপার্জন করছে আর দিন শেষে এসে আমার বোনের কাছে জমা দিচ্ছে- যেন একটা গোলাম সারাদিন উপার্জন করে মনিবের কাছে জমা দিল। এই টাকা ও সংসার- সন্তানের উপর তার আর কোন অধিকার নাই সব অধিকার আমার বোনের। আমার বোন দেদারসে টাকা উড়াচ্ছে, মাসে মাসে শাড়ি গহনা কিনছে, পোলাপানের পোশাক পাল্টাচ্ছে, সংসারী খরচাপাতি করছে, সেই সর্বেসর্বা তাকে কেউ কিছু বলার নেই। কিন্তু দুলাভাই তার কোন আবদার রক্ষা না করলে বা উল্টাপাল্টা করলে তাকে ধমক খেতে হয়, শুধু ধমকই নয় আরো কিছু হয়।
যেমন আমি আমার রুম থেকে প্রায় প্রায়ই শুনতাম দুয়েক রাত পরপর কে যেন নানি নানি বলে মৃদু সুরে ডাকে। আমি গায়ে মাখতাম না কিন্তু এক রাতে বহুক্ষণ ধরে ডাক শোনার পর আমার কৌতুহল হল, জানালা সামান্য ফাঁক করে উকি দিলাম। তখন আমার বোনের রানীর মত অসীম ক্ষমতা দেখে হাসিতে পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। কারন দুলাভাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নানী নানী বলে ডাকছে। পাশেই বারান্দায় একটা ভাঙা খাট ফেলে রাখা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আমার বোন দরজা ফাঁক করে সরোষে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো ‘নানি কেন আজ দাদি আপা বুবু সই সখি কোন কিছু ডেকেও লাভ হবেনা। দুই দিন ধরে হীরার আংটিটা আনার কথা বলছি কিন্তু মনে থাকে না। আজ বারান্দায় পড়ে থাকলে কাল খুব সুন্দর মনে থাকবে’ বলে একটা চাদর ও বালিশ ভাঙ্গা খাটটার উপর ছুড়ে মারল আর ধরাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আহ হা রে, বেচারা দুলাভাইকে দেখলাম কাচুমাচু করে ভাঙ্গা খাটের ওপর কুকুর কুন্ডুলি মেরে শুয়ে পড়ল। এরপর থেকে দু’চার দিন পরপর শুনতাম নানি বা দাদী ডাক, আর দেখতাম কর্তা মশাইয়ের ঠাই হয়েছে বারান্দার ভাঙা খাটে। আমি ভাবতাম এই যে বেচারা রাতদিন গাধার পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করছে, এতে তার লাভ কি? সবই তো ভোগ করছে আমার বোন ও তার সন্তানরা। সে তো শুধু কলুর বলদের মত খেটেই যাচ্ছে কিন্তু সে পাচ্ছেটা কি? হা পাচ্ছে কলুর বলদ যেমন দিন শেষে এক খাঁচা ঘাস পায় তেমনি পুরুষ নামের বলদগুলিও সারাদিন খেটে খুটে এসে এক প্লেট ভাত পায়। বিলাস নয় শরীর ঢাকার মতো কাপড় পায়।
যেমন আমার বোন কয়েকদিন পরপর মার্কেটে যায়, নিজের জন্য পছন্দসই শাড়ি কিনে, বাচ্চাদের পোশাক কিনে তারপর চক্ষুলজ্জার খাতিরে সাথে আমি গেলে আমাকে আর দুলাভাই গেলে তাকে এক আধটা কিছু কিনে দেয়। কিন্তু আমাদেরকে দেওয়াটা যে তার একান্ত অপচয় হলো এবং স্বল্পমূল্যে কিনার দলিলটা সে পেশ করে এভাবে যে, পুরুষ মানুষের তো আর এত সাজগোজের দরকার নাই, তোমাদের একটা শার্ট একটা প্যান্ট হলেই যথেষ্ট। একথা বলে সে বুঝাতে চায় বিলাস ও বিনোদন শুধু মেয়েদের জন্য, এখানে পুরুষের কোন অধিকার থাকতে নেই। পুরুষের দায়িত্ব হলো শুধু মেয়েদের বিলাসিতার রসদ আঞ্জাম দেওয়া।
এই ধরেন কয়দিন আগে যে ঈদ গেল, ঈদ মার্কেট করার জন্য আমরা সবাই গেলাম। প্রথমে আমার বোন নিজের জন্য একটা মহামূল্য বহুমূল্য শাড়ি কিনল, তারপর বাচ্চাদের জন্য বিদেশী সেট কিনল, তারপর উভয়পক্ষের শ্বশুর-শাশুড়ি অর্থাৎ আমার বাবা-মা ও দুলাভাইয়ের বাবা মার জন্যে কাপড়-চোপড় কিনল। এরপর আমাকে একসেট প্যান্ট শার্ট কিনে দিল। বিদায়ের সময় অসম্মতির দৃষ্টিতে দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল ‘তুমি কিছু কিনবে? দুলাভাই গোলামের মত একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল ‘না না আমার লাগবে না চলো। বোন আমতা আমতা করে বলল ‘সবাই কিনল--- আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে একটা গেন্জী কিনে দিচ্ছি’ বলে একটা রঙ্গিন গেঞ্জি কিনে দিল। আসলে সকলের জন্য কিনা হয়েছে এখন দুলাভাইয়ের জন্য না কিনলে বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখা যায় বলেই আমার বোন তার উপর এত বড় অনুগ্রহটা করল।
বেচারা দুলাভাই বধু রত্নের হাতের একখানা গেঞ্জি পেয়ে একেবারে খুশিতে আটখানা। সে বাসায় গিয়ে কাপড়-চোপড় খুলে গেঞ্জিটা পড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ঘুরেফিরে নিজের আগা পাছা মাথা ভাল করে দেখলো। তারপর আমার বোনের সামনে এসে অকৃত্রিম একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল ‘গেঞ্জিটা আমাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে তাই না’ বলে হাসতে লাগলো। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কারণ এই হাসিটা আমি কোথায় যেন দেখেছি। হঠাৎ মনে পড়লো হা হা শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি বইতে দেখেছি। এটাকেই বলে খাঁটি আদি আসল খানদানি ক্রীতদাসের হাসি। আর তখনই সৃষ্টিগতভাবে নারীর ক্রীতদাস পুরুষ জাতটার ওপর আমার মায়া হলো। তারপর এই সমিতির সদস্য হলাম আর লিখা শুরু করলাম আমার জীবনের প্রথম উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি। লেখা প্রায় শেষের দিকে শীঘ্রই চিরকুমার সংঘ থেকে বইটি প্রকাশিত হবে, সবাইকে পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
যাই হোক আমার বক্তব্য শেষ পর্যায়ে, এখন আমাদের শপথ গ্রহণের পালা। আমরা বুঝতে পারলাম মেয়েরা তাদের দেহের নিরাপত্তা, থাকার নিরাপত্তা, আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য পেখম মেলে বিয়ে নামক প্রহসনের মাধ্যমে আমাদেরকে দেহরক্ষী ও ক্রীতদাসে পরিণত করে। কাজেই এখন আমরা শপৎ করব- কেউ মেয়েদের ছলনায় ভুলব না, বিয়ে নামক পাতা ফাঁদে পা দিব না। সবাই শ্লোগান দিন চিরকুমার সংঘ-- শ্রোতাদের কেউ বলল জিন্দাবাদ কেউ বলল মুর্দাবাদ। বক্তা বলল ‘মেয়েদের ছলনা থেকে-- কেউ বলল দূরে যাও কেউ বলল কাছে যাও। এরপর সে বক্তব্য শেষ করে ভয়ার্ত চোখে শ্রোতাদের দিকে তাকালো। কারন তার আশঙ্কা জাগল কেউ যদি গুমর ফাঁস করে দেয়। না কেউ কিছু বলেনি, সে হাসি মুখে বিদায় নিল। কারণ তার মা-বাবা দু'জনই সরকারি কলেজের অধ্যাপক, সে আজীবন মা-বাবার সাথেই আছে। তার কোনো বড় বোন নেই, ছোট একটা বোন আছে প্রাইমারীতে পড়ে।
৭
এরপর বক্তব্য নিয়ে এল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহির রেজা ওরফে টাকু। কারণ পঁচিশের আগেই তার মাথার সম্মুখ ভাগের চুল উঠে গিয়ে টাকু হয়ে গেছে। সে বক্তব্য দিতে অভ্যস্ত নয়, মাইকের সামনে দাঁড়িয়েই ভয়ে কাঁপতে লাগলো, দুই হাটু পরস্পর বাড়ি খাচ্ছে। কিন্তু বক্তব্য শুরু করে বলল ‘ভাইয়েরা আমার, আমি কী বক্তব্য দিব দেখেন আমার শরীর কিভাবে কাপছে, কেন কাঁপছে জানেন? রাগে, মেয়েদের প্রতি রাগে। ওদের কথা মনে হলেই রাগে এভাবে আমার শরীর কাঁপতে থাকে। কারণ মেয়েরা আমাদেরকে গোলাম মনে করে- এ কথাটা মনে হতেই আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। প্রচন্ড রাগ উঠে যায় আর শরীর কাঁপতে থাকে। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে না পেরে কাঁদতে থাকি, স্রষ্টার দরবারে ফরিয়াদ জানাই ‘হে আল্লাহ এটা তোমার কেমন তামাশা? আমাদেরকে মেয়েদের গোলাম বানিয়ে সৃষ্টি করলে, আমরা শুধু তাদেরকে কামাই রোজগার করে খাওয়াবো, নিরাপত্তা দিব, দায়িত্ব বহন করব অথচ তারা আমাদের কোনো দায়িত্বই বহন করবে না, এক পয়সা উপার্জন করবে না। এটা কি সমঅধিকার হল, ইনসাফ হল? ওদের গোলামী করার জন্যই কি তুমি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছ?
তখন স্রষ্টা দুঃখিত হয়ে বলেন ‘কান্দিস না ভুল যা হবার তো হয়েই গেছে এখন আর কেদে লাভ কী? তোরা বরং এক কাজ কর, একটা সমিতি টমিতি গঠন করে ঘোষণা মেরে দে যে, তোরা বিয়ে করবি না। তখন ওই ইভের বংশধর অকর্মাগুলি সাইজ হয়ে যাবে। এরপরই আমরা এই চিরকুমার সংঘ প্রতিষ্ঠা করলাম। উদ্দেশ্য মেয়েদের গোলামী থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া, পুরুষ প্রজাতিকে নিষ্কৃতি দেওয়া। কারন একটা মেয়ে জন্মের সাথে সাথেই জেনে যায় তার সকল দায়িত্ব বহন করার জন্য তার আগেই তার ক্রিতদাসটা পৃথিবীতে এসে বসে আছে। তখন সে ওই ক্রীতদাসটার উপযোগী করে নিজেকে গড়তে থাকে। কোন মেয়ের এমন উদ্দেশ্য থাকে না যে, সে স্বনির্ভর হবে গাড়ী বাড়ী নারী করবে, সহায়-সম্পদ করবে, দেশ জাতির উন্নতি করবে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করবে। কেউ কোন মেয়ের এমন উদ্দেশ্যের কথা শুনেছেন? শ্রোতারা সবাই সমস্বরে না বলল। বক্তা বলল, ‘হাঁ মেয়েদের এমন উদ্দেশ্য থাকে না, তাদের শিক্ষাদীক্ষা রূপচর্চা শরীরগঠন ইত্যাদির পেছনে লক্ষ্য একটাই, ভালো মানের একটা গোলাম জুটানো।
আবার মেয়েদের মা-বাবারা দেখুন কত স্বার্থপর। তারা জানে যে মেয়েরা আপদ, এই আপদ তারা নিজেদের ঘরে রাখবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্যের ঘাড়ে ছাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে আর কথায় কথায় বলে ‘মেয়েরা হলো পরের ঘরের মানুষ, যত তাড়াতাড়ি অন্যের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া যায় ততই মঙ্গল। এজন্যই মেয়েটা একটু বড় হতে না হতেই তারা মেয়ের গোলাম ওরফে জামাই খুঁজতে থাকে।
কিন্তু স্রষ্টা একটা চালাকি করেছেন, মানুষের অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি কষ্টসাধ্য ও দুষ্প্রাপ্য করে দিয়েছেন। একইভাবে কন্যা রত্নের জন্য একান্ত প্রয়োজন জামাই নামক গোলামটাকে স্রষ্টা অনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। অবশ্য তিনি ইচ্ছা করলে নির্দিষ্ট করে দিতে পারতেন অমুক মেয়ের জন্য অমুক ছেলে, তমুক মেয়ের জন্য তমুক ছেলে। কিন্তু তা না করে মেয়ের বাবা মাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ জন্যই মেয়ে একটু বড় হলেই মা-বাবা মাঠে নেমে গেলামটাকে খুঁজতে থাকে। মেয়ের বয়স যদি বিশ অতিক্রান্ত হয়ে যায় তখন তাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকে যে ভাবেই হোক একটা গোলাম ধরে এনে তাকে বাবা আব্বা ডেকে, মুরগের আগা মাথা খাইয়ে, টাকা-পয়সা দিয়ে তেল মবিল মেরে আপদটাকে জামাই নামের গোলামের গলায় ঝুলিয়ে দেয়।
ব্যস এরপর মা-বাবার আনন্দ আর ধরে না, তারা প্রাণখুলে হাসে, আড্ডা দেয় নাক ডেকে ঘুমায়। এখন তারা মহাখুশি ও মহাসুখী, তাদের আর কোন দুঃখ নাই, কারণ আপদ বিদেয় করে দিয়েছে। এদিকে গোলামটার অবস্থা হলো আগে তার থাকা-খাওয়া ভূত ভবিষ্যতের জন্য কোন চিন্তা ছিল না, হোটেলে খেয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকলেই চলত। কিন্তু এখন তার মহারানীর জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী কুড়ে ঘর থেকে নিয়ে মুঘল হেরেম, হর্ম্য প্রাসাদ বা রংমহল তৈরি করতে হবে। বড়লোক হলে দাসী বাদী, সোনার পালঙ্ক, দুগ্ধফেননিভ ফরাস ও আপাদমস্তক মণিমাণিক্য হীরা-জহরত আর প্রবাল দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে হবে। মহারানী রাত দিন সোনার পালঙ্কে শুয়ে থাকবেন দাসী বাদিদের খেদমত নিবেন আর গোলামটা মহারানীর ভোগ-বিলাসের রসদ জোগানোর জন্য যোগ্যতানুযায়ী খেত খামারে, রিকশা ঠেলাগাড়ি নিয়ে, অফিস-আদালত মিল-কারখানা ইন্ডাস্ট্রিতে উদয়াস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে থাকবে।
তারপর যখন মহারানীর কয়েকটা সন্তানাদি হয়ে যায় তখন তো আর কথাই নাই। মহারানী তখন সুপ্রিম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান। তিনি তখন বাচ্চাদের সাথে আড্ডা দেন, গল্প-গুজব করেন, নদীর ধারে পার্কে সিনেমা হলে আত্মীয়ের বাসায় কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে ঢু মারেন আর রাত নামলেই ইন্ডিয়ান সিরিয়াল নিয়ে মেতে উঠেন। এক কথায় তিনি তখন সর্বেসর্বা।
পক্ষান্তরে ঐ গোলামটার অবস্থা হলো এখন সে একেবারে ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে গেছে। স্ত্রী-সন্তানের বিলাস ব্যাসনের রসদ জোগানোর জন্য সে চব্বিশ ঘন্টা চরকার মত চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সুদ ঘুষ কালবাজারি চুরি ডাকাতি চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি প্রতারণা চোরাচালানি ইত্যাদি হেন অপকর্ম নেই যা সে করে না। এভাবে সে স্ত্রী সন্তানের জন্য নিজের ইহকাল ও পরকাল নষ্ট করে। এই ক্রীতদাসেরা বৈধ অবৈধ পন্থায় বিশাল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে কিন্তু পরিণতিতে সে পায় চুলাটা। সন্তান ও সম্পদ এসবের মালিক কিন্তু স্ত্রী। স্বামী নামের গোলামটার কপালে জুটে শুধু ইহকালে দুবেলা দুমুঠো ভাত আর পরকালে জাহান্নাম। এই হলো বিয়ের উত্তর পরিণতি, স্বামি নামের ক্রীতদাসদের প্রাপ্তি। তখন সভার এক পার্শ্ব থেকে মুরুব্বি গোছের একজন শ্রোতা ভদ্রলোক চিৎকার করলো ‘এই মুর্খের বাচ্চা মূর্খ স্ত্রী সন্তান ও সংসারের মালিক স্বামী, এজন্যই স্বামীরা এত কষ্ট করে।
টাকু বক্তা হাসলো, শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে বললো ‘আসলে আমি জানি এই চাচার একখান বিয়ের লায়েক মেয়ে আছে, এজন্যই তিনি রেগে গেছেন। কিন্তু শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না, কাশ দিয়ে পাদ ঢাকা যায় না তদ্রুপ রাগ দিয়ে সত্য ঢাকা যায় না। চাচাকে বলছি স্ত্রী সন্তান সংসার আপনার কিনা তা বুঝে নেন। আমি জানি আপনার তিনটা ছেলে আছে। আপনি এখনই বাসায় গিয়ে সকলের সামনে ঘোষনা দিবেন- গাঙ্গিনা পাড়ের দোকানটা বা সাংকি পাড়ার জায়গাটা বিক্রি করে দেবেন, তারপর বেচতে পারবেন? পারবেন না, আপনার স্ত্রী সন্তান বেচতে দেবে না। কাজেই বুঝা গেল সম্পদের মালিক আপনি নয়, আপনার স্ত্রী সন্তান আসল মালিক।
এবার আসুন সন্তান কার, আপনার নাকি আপনার স্ত্রীর? এটাতো মীমাংসিত বিষয়, কারন ইসলাম সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে সন্তান আপনার নয় আপনার স্ত্রীর। যেমন আল্লাহ তার পরেই মায়ের স্থান দিয়েছেন কিন্তু বাবাকে নয়। আমাদের রাসূল (সাঃ) বলেছেন ‘মায়ের অধিকার তিনগুণ বাপের একগুন। যেমন আপনাকে বাঘে আক্রমণ করলো আর আপনার স্ত্রীকে শৃগালে ধরল। বাঁচানোর জন্য উভয়েই সন্তানকে ডাকতে লাগলেন। তখন আপনার ছেলে তিনবার যাবে আপনার স্ত্রীর কাছে চতুর্থবারে আপনার কাছে আসবে আর ততক্ষনে আপনি বাঘের পেটে চলে গেছেন। কাজেই আল্লাহ প্রদত্ত পুরুষের অধিকারটা দেখলে হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরে যায়, এই অধিকার দেয়ার চেয়ে না দেওয়াই ভালো ছিল। কাজেই বুঝা গেল সন্তান মায়ের।
এবার আসুন আপনার স্ত্রীর উপর কার অধিকার বেশি আপনার নাকি আপনার সন্তানের? বিষয়টা পরীক্ষা করার জন্য আপনি এখনই বাসায় চলে যান, গিয়েই আপনার ছেলেদের সামনে চাচিকে কিছুক্ষণ গালাগালি করে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করবেন, তারপর? তারপর যদি আপনার ছেলেরা ঠেঙ্গিয়ে আপনার হাত পা ভেঙ্গে বাসা থেকে বের করে না দেয় তাহলে আমি যে কোনো বাজি ধরতে রাজি আছি। আপনি যান, এখন যান চাচিকে পিটিয়ে যদি আস্ত হাত পা নিয়ে ফিরে আসতে পারেন তাহলে আমি এই যে দাঁড়ালাম, সবাইকে সাক্ষী রাখলাম। এখানে দাঁড়িয়ে দশটা বিয়ে করব, আমার বাবাকেও ডেকে এনে চৌদ্দটা বিয়ে করাবো।
বেচারা ভদ্রলোক মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো আর শ্রোতারা ঠিক ঠিক বলে চিৎকার করতে লাগলো আর বেদম হাসতে লাগল। বক্তা হেসে বলল ‘উপস্থিত চাচার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে ত্রি-রত্ন তথা স্ত্রী সন্তান ও সম্পদের মালিক স্বামী নয় স্ত্রী। স্বামী হল শুধুই কলুর বলদ বা ক্রীতদাস। ইহকালে তার ভাগ্যে জুটে চোলা আর পরকালে কাজ ভালো করলে মুক্তি অন্যথায় ইহকাল-পরকাল দুটাই গেল। এই হলো বিয়ের মাধ্যমে মেয়েদের গোলামীর খাতায় নাম লেখানোর পরিণতি।
সুতরাং আমরা যদি মেয়েদেরকে বিয়ে না করি তাহলে কারো কলুর বলদ আর হালের বলদ হতে হবে না, অন্তত আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তিটা তো আমাদের থাকবে। এজন্যই আমি যুবক ও তরুণ ভাইদের আহবান করছি আপনারা মেয়েদের ছলনা থেকে দূরে থাকুন। এ আহবানের মাধ্যমে আমার বক্তব্য শেষ করছি’ বলে সে চলে গেল।
৮
এরপর বক্তব্য নিয়ে এলো কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নজরুল ইসলাম উরফে নায়িকা। কারণ সে অত্যন্ত সুন্দর ও সুদর্শন, স্বভাব-প্রকৃতিও অনেকটা মেয়েদের মত নরম কোমল, কণ্ঠ মিনমিনে, চাল চলন মেয়েলি- এজন্যই সহপাঠীরা তাকে নায়িকা বলে ডাকে।
সে বলল ‘আমার আলোচ্য বিষয় দুটি- নারীবিদ্বেষ ও সমঅধিকার। সবাই বলে আমরা চিরকুমাররা নাকি নারীবিদ্বেষী মেয়েদের শত্রু। আসলে আমরাই হলাম মেয়েদের প্রকৃত বন্ধু কিন্তু নারীরাই হলো প্রকৃত নারীবিদ্বেষী। বউ শাশুড়ী ননদী সতীন ইত্যাদির উদাহরণ নাইবা দিলাম, সবচেয়ে মজবুত সম্পর্ক ঝি জননীর উদাহরণ দেই। প্রত্যেক মা তার ছেলেকে যতোটুকু ভালোবাসেন মেয়েকে ততটুকুই অবহেলা করেন। প্রত্যেক বস্তুর ভালোটা ছেলের জন্য বরাদ্দ দিয়ে তলানীটা মেয়েকে দেন ততটুকু যতটুকুতে বেচারি জীবন ধারণ করতে পারে, বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু বাবারা ব্যতিক্রম, তারা ছেলের চেয়ে মেয়েকে অধিক ভালোবাসে। কাজেই মেয়েদেরকে বলব, আপনারাই আপনাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ, আমরা আপনাদের শত্রু নই। প্রত্যেকটা ঘরে একজন নারী শ্বাশুরী ননদি জা সতিন কর্তৃক যতটা নির্যাতিত হয় পুরুষ দ্বারা তার শতাংশের এক ভাগও হয় না। কাজেই আমাদেরকে দোষারোপ না করে নিজেদেরকে করুন।
সমঅধিকার। মেয়েরা আমাদের কাছে সমঅধিকার চায় আর আমরাও তাদেরকে সমানাধিকার দিতে চাই। কিন্তু আমার প্রশ্নটা হলো এই অধিকারটা কি শুধু শিক্ষা, চাকরি ও গদি দখলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নাকি সকল ক্ষেত্রে? যদি সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয় তাহলে এটা কোন ধরনের সমঅধিকার? আর যদি সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় তাহলে আমাদের মতো মেয়েদেরকেও মাঠে- ময়দানে হাল চষতে হবে, রিকশা ঠেলাগাড়ি টানতে হবে, জলে স্থলে মাঠে ঘাটে সর্বক্ষেত্রে ছেলেরা যা যা করে মেয়েদেরকেও তাই তাই করতে হবে। কিন্তু যদি বলা হয় সৃষ্টি বৈচিত্র্যের কারণে মেয়েরা এসবের উপযোগী নয় বিধায় মেনে নিলাম। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে তো ছেলে মেয়ে উভয়েরই সমান চাহিদা, এমনকি নিরাপত্তাহীনতার কারণে মেয়েদের প্রয়োজনটা একটু বেশি। কাজেই এখানে তো সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা থাকা দরকার, অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের দায়িত্ব একা স্বামীর উপর না থেকে উভয়ের উপর সমান দায়িত্ব বিধিবদ্ধ থাকা দরকার। গারো চাকমা ও বার্মার মগদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা চালু আছে, ছেলেরা রান্নাবান্না করে আর মেয়েরা উপার্জন করে খাওয়ায়।
আমাদের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম করা হোক, তাহলে আমরা একটা কেন দশটা বিয়ে করতে পিছপা হব না। মেয়েরা উপার্জন করবে আর আমরা ঘরে বসে রান্নাবান্না করব, বাচ্চার হাগা মুতা সাফ করব আর সারাদিন ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখব। উল্টাপাল্টা হলে বউ যদি দুয়েকটা লাথি গুতা মারেও তাহলেও সমস্যা নাই। কারন রবীন্দ্রনাথ উপদেশ দিয়ে গেছেন পেটে খেলে পিঠে সয়। পেটটা ভরে খাইয়ে পিটটা ভরে কিলালেও সমস্যা নাই। আমরা তখন পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খাব আর তারা কষ্ট করে উপার্জন করবে বিধায় একটু-আধটু গঞ্জনা সইতে আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না।
কিন্তু তারা যদি সম্পূর্ণ সাংসারিক দায়িত্ব না নেয় তাহলে সমঅধিকারের ভিত্তিতে অর্ধেক দায়িত্ব গ্রহণ করুক, মেয়েরা এক বছর সংসার চালাবে আমরা একবছর চালাবো। অথবা প্রত্যেকেই সংসারের অর্ধেক খরচ বহন করবে, মেয়েরা যদি এই শর্তে রাজি থাকে তাহলে আমরাও বিয়ে করতে রাজি আছি। সর্বশেষ সরকারের কাছে ও সর্বস্তরের জনগণের কাছে আমাদের আবেদন- প্রকৃত সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন, নারী-পুরুষের সমান দায়িত্ব বন্টন করুন। তাহলে আমরাও চিরকুমার থাকবো না মেয়েরাও রক্ষা পাবে। সর্বস্তরে এই আহ্বান জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করলাম।
এরপর বক্তব্য নিয়ে এলো ময়মনসিংহের বড় মসজিদ মাদ্রাসার দাওরা ক্লাশের ছাত্র মুফতি ফয়জুল্লাহ। সে হামদ ও নাতের পর বক্তব্য শুরু করল ‘শ্রদ্ধেয় সুধীমন্ডলী, আমার পুর্বে যেসব চিরকুমার ভাইয়েরা বক্তব্য দিয়ে গেছেন তারা এককভাবে মেয়েদেরকে দোষারোপ করে গেছেন, এটা ঠিক না এটা অন্যায়। আমি একজন আলেম হিসেবে এটা মেনে নিতে পারি না। কারণ আগে নিজের দোষ দেখতে হবে তারপর অন্যের দোষ শুধরে দিতে হবে। যেমন যীশু খৃষ্ট ইহুদিদেরকে তিরস্কার করে বলেছিলেন ‘ভণ্ডের দল অন্যের চোখে কোটা দেখলে তোমরা হাউমাউ করে ওঠ অথচ নিজের চোখে যে গাছের গোড়া পরে রয়েছে সেটা চোখে দেখ না। আবার রাসুল (সা আমাদেরকে নিজের দোষ দেখতে বলেছেন। কাজেই আমরা ছেলেরা আগে নিজেদের দোষ দেখব তারপর মেয়েদের দোষ ধরিয়ে দিব।
আসলে মেয়েরা আমাদেরকে গোলাম বানায় না বরং আমরাই গোলামি মনোবৃত্তি নিয়ে বেড়ে উঠি, তারপর পরিণত বয়সে গোলাম হয়ে যাই। যেমন একটা ছেলে জন্মের পর মা বাবা স্কুলে পাঠায়, ধমকিয়ে শাসিয়ে ঠাসিয়ে লেখাপড়া করায়। কিন্তু প্রাইমারি অতিক্রম করার পর আর ছেলেটিকে শাসন করতে হয় না। তখন তার মধ্যে চেতনা আসে যে তাকে আজীবন একটি নারীর দাসত্ব করতে হবে। তখন থেকেই সে স্বপ্ন দেখে কল্পনা করে- সে লেখাপড়া করে অনেক বড় শিক্ষিত হবে, বড় মাপের চাকরি করবে, প্রচুর অর্থ উপার্জন করবে, বিশ্ব সুন্দরী দেখে একটা খান্দানি পরিবারে বিয়ে করবে। বউটাকে আপাদ-মস্তক হিরা চুনি পান্নায় মুড়িয়ে হর্ম্য প্রাসাদে নিয়ে তুলবে, সোনার পালঙ্কে শুইয়ে রাখবে, তার খেদমতের জন্য দাসি বাদি নিয়োগ করবে, বিনোদনের জন্য বহুমূল্য রঙ্গিন টিভি কিনে দেবে। তখন মহারানি দাসী বাদী পরিবেষ্টিত হয়ে সোনার পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে ভারতীয় সিরিয়াল দেখবে। তারপর সে দুনিয়া উলট পালট করে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে এসে মহারানীর পাশে শয়ণ করবে। এই যে মহারানীর পাশে একটু শয়নের প্রাণান্তকর অভিলাষ, এর জন্যই এত আয়োজন।
তারপর বাচ্চা-কাচ্চা হবে। তাদেরকে ব্যয়বহুল ভালো ভালো স্কুলে ভর্তি করতে হবে, তখন লক্ষ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হবে। এই টাকা উপার্জনের জন্য সে পৃথিবীর মাটি ওলট-পালট করবে, রাতকে দিন দিনকে রাত করবে, বৈধ- অবৈধ সব একাকার করে দিবে। অষ্টপ্রহর বর্তুলাকার ঘোরতে থাকবে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সম্পদ উপার্জন করবে, কিন্তু কার জন্য নিজের জন্য? না নিজের জন্য নয়, সে তো কাজের চাপে দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ারও ফুরসত পায় না। সবই করবে ঐ মহারানি ও তার সন্তানদের জন্য। এই হলো বাল্যকাল থেকে প্রত্যেকটা ছেলের আশা-আকাঙক্ষা ও কল্পনা।
কেন বাপু, এত যে সংগ্রাম, এই যে জীবনপাত এই যে যুদ্ধ এতকিছু কেন, কার জন্য? কোন মেয়ে কি বাল্যকালে এসে তোমার কানে কানে বলে গিয়েছিল ‘এই যে গোলাম সারাজীবন আমার ও আমার সন্তানদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা বিনোদনের দায়িত্ব তোমাকে বহন করতে হবে, গোলামী করতে হবে। কাজেই এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ কর। সে চেঁচাল, সবাই উত্তর দিন কোন মেয়ে কোন ছেলের কানে কানে এমন কথা বলে যায়? শ্রোতারা সমস্বরে বলল ‘না না বলে না। বক্তা বলল ‘যদিও মানুষ গোলামী থেকে বেঁচে থাকতে চায় কিন্তু প্রমাণিত হলো যে একমাত্র ছেলে নামক মূর্খ অপরিণামদর্শী প্রজাতিটাই গোলামির মানসিকতা নিয়ে জন্মায়। সারাজীবন সে একজন নারীর গোলামী করার আশা করে কল্পনা করে আকাংখা করে কামনা করে। তারপর বিয়ের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করে। এই গোলামীতে সে আত্মতৃপ্তি লাভ করে, গৌরব বোধ করে, যত বেশি পূর্ণাঙ্গভাবে গোলামী করতে পারে ততবেশি নিজেকে সার্থক ও সফল পুরুষ ভাবতে থাকে। কাজেই মেয়েদের দোষ দিয়ে লাভ নেই প্রকৃত দোষী হল ছেলেরা।
এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, চিন্তা-চেতনায় নারী বিরুধি অবস্থান নিতে হবে। আল্লাহ পাক বলেছেন ‘আমি সেই জাতির অবস্থা পরিবর্তন করি না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। কাজেই আমাদের গোলামী ভাগ্যের পরিবর্তন আমাদেরকেই করতে হবে। আল্লাহ মাটিতে নেমে এসে মেয়েদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করবেন না। কাজেই আমাদের শপৎ করতে হবে- আমরা কোনদিন বিয়ে করবো না কোন মেয়ের গোলামি করবো না। আর যেহেতু আমরা বিয়ে করবো না বিধায় শিক্ষা দীক্ষা চাকরি নকরি ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কিছুই করবো না। কারণ এসব করলে আমাদের উন্নতি হবে, তা দেখে ছেলেদের উপর মেয়েদের শ্যান দৃষ্টি পড়বে। তখন মেয়েরা ও মেয়ের বাবারা ছেলেদের পিছনে লাইন দিবে। ফলে তাদের পদস্খলন ঘটবে আর বিয়ে নামক গোলামীতে আবদ্ধ হয়ে যাবে।
পুর্বে যা গেছে তো গেছেই, প্রাচিনকাল থেকে নিয়ে বর্তমান পর্যন্ত পুরুষরা সতর্ক ছিল না। এজন্য তারা চাকরি নকরি ব্যবসা-বাণিজ্য ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে, উন্নতি করেছে আর বিয়ে করে বৌয়ের গোলামী করতে করতে তাদেরকে কবরে যেতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে যাতে সামনের প্রজন্মগুলি আর নষ্ট না হতে পারে। কাজেই আমাদের চিরকুমার সংঘের পক্ষ থেকে আমরা প্রস্তাব পাশ করছি- কোন ছেলে প্রাইমারির বেশি লেখাপড়া করতে পারবে না। একান্ত কেউ বিদ্যা বুদ্ধি ও জ্ঞান-গরিমা হাসিল করতে চাইলে সর্বোচ্চ এস এস সি- এর বেশি লেখাপড়া করা দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কোন কিছু করা যাবে না, শুধু পেট চালানোর জন্য দৈনিক এক আধ ঘণ্টা কাজ করা যাবে, এর বেশি নয়।
সবসময় বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরতে হবে, খেলাধুলা ও তাসের আড্ডায় মেতে থাকতে হবে। কখনোই কোনো ভালো কাজ করা যাবে না। নেশা করা ইসলাম হারাম করেছে বিধায় নেশা করা যাবে না ঠিকই কিন্তু মেয়েদেরকে দেখানোর জন্য দৈ মাঠা মদের বোতলে ভরে জনসমক্ষে পান করতে হবে আর মাতালের মত ঢুলু ঢুলু অভিনয় করতে হবে। তাহলে মেয়ে ও মেয়ের বাবারা বিয়ের ফাঁদে আটকাতে চাইবে না। তারপর সে হাত উঠিয়ে চেঁচাল, যুবক ভাইয়েরা আমাদের এই প্রস্তাবে সবাই রাজি তো? তখন সভাই হাত উঠাল কিন্তু কেউ বলল ‘কচু আছি, কেউ বলল ‘কলা আছি, কেউ বলল রাজী তবে আমার বিয়ের পর ইত্যাদি বিভিন্ন মন্তব্য চলতে লাগলো।
বক্তা বলল ‘তাবলীগের মুরুব্বিরা সব সময় উপদেশ দেন জানার মধ্যে কামিয়াবি নাই মানার মধ্যে কামিয়াবি। যেমন আবু জেহেল জানত রাসুল (সাঃ) নবী কিন্তু সে মানে নাই বিধায় কামিয়াব হতে পারেনি। কাজেই আমরা এতক্ষণ চিরকুমার ভাইদের যে মূল্যবান ওয়াজ নসীহত শোনলাম এগুলি যদি না মানি তাহলে আমাদের কোন কামিয়াবী আসবে না। আর কামিয়াবির জন্য নিজে চেষ্টা করতে হবে ও আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে হবে। এখন মোনাজাত হবে সবাই হাত উঠান।
বক্তা দোয়া শুরু করল ‘হে আল্লাহ আমরা হলাম তোমার সৃষ্ট জীবের মধ্যে সবচেয়ে মজলুম। তুমি তো মজলুমের দোয়া সবার আগে কবুল কর, কাজেই আমাদের দোয়া কবুল করো। আমরা নিজেই নিজের না, নারীর দাস। ওরা আমাদেরকে দাস বানিয়ে রাখে, ওদের অত্যাচারে এখন আমরা অতিষ্ঠ। এভাবে অত্যাচার চলতে থাকলে আমরাও একদিন ডাইনোসরের মত ভুপৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাব, তখন তোমার দাসত্ব করার কেউ থাকবে না। কাজে কাজেই মালিক ওগো তুমি আমাদের বাচাও, মেয়েদের হাত থেকে বাঁচাও। তোমার সাহায্য ছাড়া ওদের ভয়ংকর ফেৎনা থেকে আমাদের বাঁচার কোন উপায় নাই।
মালিক ওগো, তুমি মেয়েদের করালগ্রাস থেকে পুরুষদেরকে দূরে রাখ, ছেলেরা যেন কখনো মেয়েদের বিয়ে না করে বা করার সুযোগ না পায়। মনে মনে বলল ‘তবে দাউরা পাশের পরই তুমি আমার বিয়ের ফায়সালাটা করে দিও, দেখো না স্বপ্নদোষ হতে হতে সব উজাড় হয়ে যাচ্ছে, শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছে। ওদিকে ইমামের মুসল্লিদের খবর হলো যুবকরা প্রত্যেকে যার যার পছন্দনিয় মেয়েকে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কাকুতি মিনতি করতে লাগল। এভাবেই তাদের দোয়া শেষ হল।
৯
দোয়ার পর আরো কয়েকজন বক্তব্য দিল। তারপর দ্বিতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণার জন্য সভাপতি উঠে বলল ‘যুবক ও তরুণ ভাইয়েরা, আমরা এতক্ষণ বিজ্ঞ অভিজ্ঞ চিরকুমারদের বক্তব্য শুনলাম, অনেক মূল্যবান ওয়াজ নসীহত শুনলাম। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, শত শুনলেও কোন ফায়দা হবে না যদি না তা কার্যে পরিণত করি। হাদীসে এসেছে ‘তোমরা খারাপ কথা এক কানে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দেবে কিন্তু ভাল কথা কান দিয়ে ঢুকিয়ে হৃদয়ে স্থান দেবে, সে অনুযায়ী আমল করবে। কাজেই মহামান্য বক্তাগণ মেয়েদের সম্পর্কে যেসব ভয়ঙ্কর তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেছেন সেগুলি স্মরণ রাখতে হবে। এসবের উপর আমল করতে হবে, মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে হবে। চিরকুমার সংঘের সদস্য হতে হবে, মেয়েদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।
কারন ওরা জন্মগতভাবেই আমাদেরকে গোলাম মনে করে। বিয়ের মাধ্যমে তারা সেই গোলামটার মালিক হয় আর তার স্থাবর- অস্থাবর সবকিছু দখল করে নেয়। এরপরই শুরু হয় স্বামী নামক গোলামদের উপর ভয়ানক নিপীড়ন। বস্তুত বিয়ের আগে নারী অবলা আর পুরুষ বীর কিন্তু বিয়ের পর গনেশ উল্টে যায়। স্ত্রী সর্বময় কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, পুরুষের উপর শারীরিক ও মানসিক টর্চার শুরু করে। স্ত্রীর অত্যাচারে বাংলার প্রতিটা ঘরে ঘরে কত পুরুষের রক্তাশ্রু ঝরে পড়ছে, ঘরের কোনায় বাথরুমে গাছতলায় রাতের আধারে কত পুরুষ নীরবে নিভৃতে কেঁদে মরছে। এই অশ্রু যদি মাটি শোষণ করে না নিত তাহলে দেশ অশ্রুর বন্যায় তলিয়ে যেত। বস্তুত বিয়ের আগে মেয়েরা কিছুটা ইভটিজিংয়ের শিকার হয় কিন্তু বিয়ের পর তারা এর প্রতিশোধ নেয়, রাক্ষসী হয়ে ওঠে। কাজেই এখনই যদি পুরুষ সমাজকে নারীর কবল থেকে রক্ষা করা না যায় তাহলে শীঘ্রই এরা ডাইনোসরের মত ভূপৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সুতরাং মেয়েদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, অন্তত আমাদের অধিকারটুকু টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। তবে একটি বিষয় আমরা পরিষ্কার করতে চাই- অনেকেই মনে করে আমাদের যুদ্ধটা নারী জাতির বিরুদ্ধে। আসলে তা নয়, বিবাহিত নারীদের ব্যাপারে আমাদের কোন ওজর আপত্তি নাই। মা চাচি খালা দাদি-নানি হিসাবে আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধা করি পেন্নাম করি। কিন্তু আমাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ হলো ঐ সব অবিবাহিত ধাড়ি মেয়েগুলির বিরুদ্ধে যারা ময়ূরের মত পেখম মেলে প্রজাপতির ডানা মেলে ষাঁড়ের মত মাঠে-ময়দানে ঘুরে বেড়ায় আর শিকার খুঁজে। আমাদেরকে ধরে ধরে গোলাম বানাতে চায়, একমাত্র ওদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন।
আর এ লক্ষেই আমরা সমিতি গঠন করেছি। কারন এরা মায়াবি, অলৌকিক শক্তির অধিকারী, সম্মোহনী ক্ষমতার মালিক। এদের সম্মোহন ক্ষমতা এত তীব্র যে এরা যদি কারো প্রতি কটাক্ষে তাকায় বা চোখ টিপ মারে তাহলে সাথে সাথে লোকটা মারা যায়। তারপর রুপের আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। এভাবে সৃষ্টির আদি থেকে এরা পুরুষ জাতটাকে শিকার করে আসছে। কাজেই কারো একার পক্ষে এদের করাল দৃষ্টিবান ও ধনুর্বাণ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এজন্যই আমরা গঠন করেছি চিরকুমার সংঘ। সর্বস্তরের যুবক তরুণরা আমাদের সমিতিতে আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে মেয়েদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করব। হাতে হাত রেখে শপৎ করব, বিয়ে নামক প্রহসনের মাধ্যমে আমরা নিজেরাও ওদের গোলাম হব না আর কোন পুরুষকে গোলাম বানাতেও দেব না' এটাই আমাদের সমিতির অঙ্গিকার।
তবে অতীব দুঃখের সাথে বলছি চিরকুমার সমিতির উপর অনেক হুমকি-ধমকি আসছে। অনেক স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, রাজনৈতিক নেত্রী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারের মহিলারা আমাদেরকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছে আমাদেরকে নাকি পেদিয়ে পেদিয়ে বৃন্দাবন পাঠাবে, কেউ বলে গঙ্গাস্নানে পাঠাবে, কেউ বলে হজ্বে পাঠাবে, কেউ বলে আফ্রিকা পাঠাবে, কেউ বলে পটল তোলা পাঠাবে। যার যেভাবে মন চায় হুমকি দেয় গালি দেয়। এখন বুঝলেন তো ওরা কত স্বার্থপর? আমরা বিয়ে করবো না কেন গোলাম হব না কেন এ জন্য তারা আমাদের উপর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। আসলে নারী জাতটাই সন্ত্রাসী। ওরা হল মাদার অব টেরর।
কিন্তু এইসব মহিলাদেরকে আমরা দৃঢ় কণ্ঠে বলতে চাই কোন লাভ হবে না, আপনাদের হুমকিতে আমরা লেজ গুটিয়ে পালাব না। আমরা হলাম পুরুষ, সিংহের জাত। আমাদের হুঙ্কারে ভু-কম্পনের সৃষ্টি হয়, আমাদের চিৎকারে প্রতিপক্ষ কলিজা ফেটে মারা যায়। কাজেই আমাদেরকে রক্তচক্ষু দেখাবেন না আমরা কাউকে ভয় পাই না। আমরা আলেকজান্ডার নেপলিয়ন হিটলার-এর বংশধর। আমরা কোন বাধাঁ মানি না, পৃথিবীর এমন কোন অসাধ্য নাই যা আমরা সাধন করিনি।
আমরা চাঁদে মঙ্গলে উড়ে যাচ্ছি, মহাকাশে প্রমোদ ভবন নির্মাণ করছি, এই মহাবিশ্বকে হাতের মুঠোয় পোরে নিয়েছি। কিন্তু একটা ক্ষেত্রে এসে আমরা বারবার পরাজিত হচ্ছি। সৃষ্টির আদি থেকে পুরুষ স্বর্গ- মর্ত্য- পাতাল জয় করে এসে নারীর সামনে মাথা নুইয়ে দিয়েছে, পরাজয় বরণ করেছে। বড় বড় মহাবীররা এ একটি জায়গায় এসে আত্মসমর্পণ করে বসে। কিন্তু এখন সে যুগ হয়েছে বাসি, এটা বিজ্ঞানের যুগ স্বাধীনতার যুগ। আমরা প্রমান করব যে, আমরা নারীর দাস নই। আমরা স্বাধীন আমরা বীর, চির বিজয়ি। বল বীর চির উন্নত মম শির।
এখন আমি চিরকুমার সংঘের সভাপতি হিসাবে অবিবাহিত মেয়েদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলাম। এটা আমাদের ধর্মযুদ্ধ, আমাদের মান ইজ্জত ও স্বাধীনতার যুদ্ধ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম পুরুষ স্বাধীনতার সংগ্রাম। কাজেই সর্বস্তরের তরুণ যুবকদেরকে চিরকুমার সমিতির সদস্য হয়ে এ যুদ্ধে আত্মাহুতি দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এখানেই আমাদের দ্বিতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি হলো। সন্ধার পর শুরু হবে সংগীতানুষ্ঠান, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গায়িকা ফাটাওয়ালীর একক সংগীত সন্ধ্যা। এরপর সভা ভঙ্গ হয়ে গেল।
কিন্তু মুরুব্বী, অভিভাবক ও বিয়েযোগ্য মেয়ের বাপেরা একেকজন একেক মন্তব্য করতে করতে সভাস্থল ত্যাগ করতে লাগল। কেউ বলল ‘হালার পুতেরা বড় লায় পেয়ে গেছে এদেরকে পিটিয়ে শহর ছাড়া করা দরকার। কেউ বলল ‘শুধু এদেরকে না এদের মা-বাবাকেও দেশ ছাড়া করতে হবে। জাকির হোসেন এক কোনায় দাঁড়িয়েছিল, সে নাক সিঁটকে বললো ‘হালার পুত, তোর জেহাদ তোর বাপের পাছা দিয়া দিমু, তারপর বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল।
সন্ধ্যার পর শুরু হলো ফাটাওয়ালির একক সংগীতানুষ্ঠান ‘ফাইট্যা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়, বন্ধু যখন বউ লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া হাইট্যা যায়, বুকটা ফাইট্যা যায়। বাংলাদেশের ফুটপাতে ফেরারি এক গায়িকা এই গানটা গেয়ে রাতারাতি বিশ্বখ্যাতি পেয়ে যায়। কিন্তু ময়মনসিংহের মানুষ হল বিটলে, নিয়মমাফিক শিল্পী নয় বলে তারা ঐ গায়িকাকে নাম ধরে না ডেকে ঐ গানের সাথে সংশ্লিষ্ট করে ফাটাওয়ালি নামকরণ করেছে। সে মঞ্চে উঠেই গানে টান দিয়ে খ্যামটা নাচ শুরু করলো। শ্রোতারাও তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে উদ্দাম নৃত্য শুরু করল। টানা আড়াই ঘণ্টা দর্শক-শ্রোতা মাতিয়ে রাখার পর গায়িকা তার দলকে ফিসফিসিয়ে বলল ‘তোমরা বাদ্যযন্ত্রসহ সবাই গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বসে থাকবে, আমি আসার সাথে সাথে গাড়ি ছেড়ে দেবে।
তারপর সে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলল ‘সারাজীবন ময়মনসিংহের কথা শুনেছি কিন্তু এখানে এসে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। আপনাদের চিরকুমার সমিতিটা খুবই ভালো, ওরা আমাকে অগ্রিম টাকা দিয়ে দিয়েছে। এখানে আসার পর যথেষ্ট আদর-আপ্যায়ন করেছে, ভালো-মন্দ খাইয়েছে, একটা বিদেশী পানিও দিয়েছিল কিন্তু আমি ওটা ফেরৎ দিয়েছি। কারণ আমি আবার বিদেশি মাল খাই না দেশিটা পছন্দ করি। যাই হউক, তারা এত টাকা খরচ করে আমাকে এনেছে আপনাদের বিনোদনের জন্য আর চিরকুমার সমিতির পাবলিসিটির জন্য। কাজেই আমি আহ্বান জানাচ্ছি ‘আপনারা সবাই চিরকুমার সমিতির সদস্য হোন। তারপর সমিতির গাধাগুলিকে বাশ মেরে মেরে গারদে অথবা জাহান্নামের চৌরাস্তায় পাঠান, নইলে ময়মনসিংহের কলঙ্ক গুছবে না’ বলে সে চোখের পলকে গিয়ে গাড়িতে বসল এবং গাড়ি ছেড়ে দিল। সাথে সাথে ঠিক ঠিক বলে শ্রোতারা হইচই করতে করতে চলে গেল।
চিরকুমাররা হতবাক হয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গায়িকা পলায়ন করেছে, নইলে ঘাড় ধরে টাকাগুলি ফেরত নিয়ে নিত আর বাঁশ দিত। তারা বিস্ময় প্রকাশ করল ‘ফাটাওয়ালি এটা কেমন কাজ করলো, ওকে আনলাম আমাদের এডভাইজের জন্য কিন্তু সে তো আমাদের সমিতিকে ফাটিয়ে দিয়ে গেল। ওর পেছনে এতগুলো টাকা জলাঞ্জলি দেয়া হলো কেন? সভাপতি গম্ভীর গলায় বলল ‘আগেই তো বলেছিলাম সংগীত টংগীতের দরকার নাই, আনলেও পুরুষ শিল্পী আন কিন্তু আমার কথা শুনলে না। এখন বুঝলে তো কেন নারী শিল্পীর কথা নিষেধ করেছিলাম? নারীরা সবাই এক কিন্তু পুরুষরা এক হতে পারল না। বেঙ কখনো এক পাল্লায় উঠে না, এজন্যই এদের গোলামী করতে হয়।
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছরও সমিতির পত্রিকা চিরকুমার বার্তা- এর কাটতির বাজার গরম হয়ে উঠেছে, ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ কপি বিক্রি হয়ে গেছে। এতে প্রচুর অর্থ সমাগম হচ্ছে, প্রতিদিন সমিতির বিশাল হল রুমে সদস্যদের আসর বসে। তাদের আনন্দ স্ফুর্তির জন্য সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, খাওয়া-দাওয়া হয়। পত্রিকা বিক্রির টাকা থেকেই এসব খরচ বেয়ার করা হয়। খাওয়া ও স্ফূর্তির গন্ধ পেয়ে শহরের যুবক তরুণের দল হুমড়ি খেয়ে পড়ে, কেউ সমিতির সদস্য হয় কেউ শুধু আনন্দ-স্ফূর্তি করে চলে যায়। প্রতিদিন এই বিশাল সভ্যদের হাতে এক প্যাকেট করে বিরিয়ানি তুলে দেয়া হয়, সাথে সাথে চা-নাস্তা বিস্কুট ইত্যাদি তো আছেই। সমিতির এই বিশাল বিরানি অর্ডার সাপ্লাই দিতে দিতে ময়মনসিংহের হোটেল মালিকরা হাঁফিয়ে উঠেছে। তারা মুখে আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয় আর মনে মনে বলে- এভাবে কিছুদিন ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারলে বিল গেটসকে টক্কর দিতে আমাদের খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।
১০
কিন্তু চিরকুমার সমিতির এই চওড়া ভাগ্যটা বেশি দীর্ঘ হতে পারল না। কারন মহিলা সাংবাদিক সমাজকর্মী মানবাধিকারকর্মী ও নেত্রীরা দেশে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল। তারা ব্লগ-ফেসবুকসহ ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় চিরকুমারদের বিরুদ্ধে ঝড় বইয়ে দিল। সরকার ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানাল- সমিতি বন্ধ করে এর দুষ্ট সদস্যদের আটক করা হউক। তারা বিভিন্ন দলিল প্রমাণ দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করল যে, চিরকুমার সংঘ হল শয়তানদের সংগঠন, সমাজের কিছু বখে যাওয়া উচ্ছন্নে যাওয়া নিষ্কর্মা অপদার্থ ও নষ্ট ছেলেদের সংগঠন। এরা হল সমাজের সবচাইতে ক্ষতিকারক পোলাপান, এরা দেশ ও জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত। সময় থাকতে এদেরকে নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, দেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। মেয়েরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনে নামবে, তখন সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়বে। দেশ অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কাজেই বেড়ার আগুন চালে ওঠার আগেই নেভানোর ব্যবস্থা করা হোক। সমিতির পাণ্ডাদের ধরে ধরে রিমান্ডে নেয়া হোক। তারপর ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য তাদেরকে ফাঁসি অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হোক।
কিন্তু বিষয়টা সরকারি বা বিরোধী দল কেউই গায়ে মাখলো না, তারা শুধু কাদা ছোড়াছুড়ি করল। সরকারি দল বলল ‘এটা বিরোধী দলের কান্ড। তারা নারী-পুরুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে চাচ্ছে। কিন্তু তাদের আশা পূরণ হবে না, আমরা বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করে দেব। আবার বিরোধী দল বললো ‘সরকার নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়, সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দিয়ে দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। তারপর বহির্বিশ্বে দেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে চিরস্থায়ী ক্ষমতা দখল করতে চায়। কিন্তু আমরা সেই সুযোগ দিব না, তাদের কোমরে গামছা লাগিয়ে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাব। এভাবে উভয় দল প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা দিল বটে কিন্তু সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কেউ টু শব্দটা পর্যন্ত উচ্চারণ করলো না। নারী সংগঠনের নেত্রী ও চিন্তাবিদরা যখন দেখল সরকারি দল ও বিরোধীদল শুধু কাদা ছোড়াছুড়ি করছে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কেউ এগিয়ে আসছে না- তখন তারা নিজেরাই একটা কিছু করার প্রয়োজন বোধ করল।
দেশের মহিলা সংগঠনগুলি একত্রিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা বেগম রোকেয়া শাকের হুসেনকে সভাপতি ও ময়মনসিংহের মহিলা এম পি মমতাজ মহলকে সেক্রেটারি করে নতুন সংগঠন করল। সেই সংগঠনের নাম দিল ঝাড়ু সংঘ, লেগু ঝাড়ু। কারণ তারা ঝাড়ু মেরে ছেলেদের আনুগত্যে আনবে ও চিরকুমার সমিতি বিলুপ্ত করবে। এই সমিতির পক্ষ থেকে ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজ ময়দানে কাউন্টার সভা আহবান করা হলো। নির্ধারিত দিনে ডঃ বেগম রোকেয়া শাকির হোসেনের সভাপতিত্বে সভার কার্যক্রম শুরু হলো। তিনি একজন বয়স্ক মুরুব্বী মহিলা। নারী শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ, ভদ্র, সুধিজন ও মাদার অব উইম্যান রাইটস হিসেবে সর্বত্র পরিচিত ও সমাদৃত।
উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন ‘আসলে মানুষ ধর্মকর্ম ছেড়ে দিয়েছে, ধর্মগ্রন্থ বর্জন করেছে। এজন্য আজ সমাজে অশান্তি দেখা দিয়েছে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে, পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাচ্ছে। একে অন্যের প্রতি আস্থা ও দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলছে। নারী-পুরুষ একে অন্যের দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা করছে, নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করছে। মানুষ আজ পশুর মত হিংস্র হয়ে উঠেছে, এ জন্যই সমাজে এত অশান্তি, এত বিশৃঙ্খলা। কিন্তু মানুষ যদি ধর্মকর্ম পালন করত, ধর্মগ্রন্থ অনুসরণ করতো তাহলে মানব সভ্যতা এতটা হুমকির সম্মুখীন হতো না। এই যেমন আমি প্রতিদিন ফজর পড়েই কোরান শরিফ নিয়ে বসি, নয়টা পর্যন্ত বসে বসে তিলাওয়াত করি। প্রত্যেকটা আয়াত গভীরভাবে চিন্তা করি, সৃষ্টি রহস্য ও নারী পুরুষের দায়িত্ব নিয়ে গবেষণা করি।
মানুষ যদি কোরান হাদিস পাঠ করত তাহলে বুঝতে পারত যে, আল্লাহ তা’লা নারী-পুরুষ প্রত্যেককেই নির্ধারিত দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর সেই দায়িত্বটা হলো নারী প্রভুত্ব করবে আর পুরুষ দাসত্ব করবে। উভয় প্রজাতি সৃষ্টির সময়ই এই দায়িত্বটার অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা সকল রুহ সৃষ্টি করে আলমে আরওয়াহ তথা রূহের জগতে একত্রিত করে প্রশ্ন করলেন ‘আলাসতু বিরাব্বিকুম- আমি কি তোমাদের রব নই? তখন রুহেরা সবাই সমস্বরে উত্তর দিল ‘বালা- হা, আপনিই আমাদের প্রভূ। এরপর আলমে আরওয়াহের সেই ভান্ডার থেকে আল্লাহপাক একটা একটা করে রুহকে নারী বা পুরুষ করে পৃথিবীতে পাঠাতে লাগলেন।
তবে রুহ কিন্তু নহে নারী নহে নর সে হলো ক্লীব। নর- নারী হয় দেহ রুহ নয়। পরকালে দেহ থাকবে না বিচার হবে শুধু আত্মার। এর প্রমাণ হলো আল্লামা হুজুররা বলে থাকেন জাহান্নামের আগুন আত্মা দগ্ধ করবে, শরীর নয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে পরকালে দেহ থাকবে না শুধু আত্না থাকবে। এজন্যই কেয়ামতের ময়দানে মানুষ পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান স্বামী, আত্মীয়-স্বজন কাউকেই চিনবে না। কারণ রুহ তো ক্লীব, তার তো কোনো আত্মীয় হয় না, আত্মীয় হয় দেহের।
তবে বাংলা শব্দ ভান্ডারের আত্মীয় শব্দটা একটা ভুল শব্দ। আমি এর বিশ্লেষণ করছি। আত্মীয় শব্দের অর্থ হল আত্মার সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ, অথচ আত্মার সাথে কেউ সম্পর্কিত নয় বরং সম্পর্কটা হয় দেহের সাথে। যেমন বাবা মা সন্তান জন্ম দিল, তারা কিন্তু একটা দেহ থেকে আরেকটা দেহ জন্ম দিল আত্না থেকে আত্না নয়। আবার স্বামী ও স্ত্রীর সর্ম্পক আত্মার নয় শরীরের, তেমনি শ্বশুর-শাশুড়ি, খালা-খালু, মামা-মামি, শালা-শালী, ফুফা ফুফু ও চাচা চাচি ইত্যাদি সম্পর্কগুলি শরীরের সাথে, আত্মার সাথে নয়। এজন্যই আপনজনদের আত্মীয় বলা ভুল বরং বলতে হবে দৈহিকজন, শারীরিকজন, স্বজন ইত্যাদি। এই যেমন ধরেন আপনি সন্তান জন্ম দিলেন মানে রক্তমাংসের একটা শরীর জন্ম দিলেন, আত্মা আপনি জন্ম দিতে পারেন না, আত্নার জন্মদাতা একমাত্র আল্লাহ। কাজেই আত্মার আত্মীয় একমাত্র আল্লাহ। এজন্যই আল্লাহকে বলা হয় পরমাত্মা বা পরমাত্মীয়। এই পরমাত্না রুহের জগত থেকে একটা একটা করে রুহ পৃথিবীতে পাঠান, তবে পাঠানোর আগে তাকে জিজ্ঞেস করেন ‘তুমি কি গোলামী করতে রাজি আছ?
তখন চালাক ও বুদ্ধিমান আত্মাগুলি বলে ‘না আমি কারো দাসত্ব করতে পারব না। তখন সেই আত্মাগুলিকে নারী দেহ করে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। কারণ নারীরা কারো দাসত্ব করবে না, তারা প্রভুত্ব করবে। পক্ষান্তরে বোকা নির্বোধ ও অপরিণামদর্শী আত্মাগুলি গোলামি কাকে বলে জানে না বুঝে না। তাই তারা ছাগলের মত দাঁত বের করে হাসে আর বলে ‘হা হা আমরা গোলামি করব। তারা মনে করে গোলামি বুঝি খুব একটা আরামদায়ক মজাদার ও মূল্যবান জিনিস। তখন পরমাত্না এই হাবাগুবা ভ্যাবলা ছাগল পাগল আত্মাগুলোকে পুরুষদেহ করে পাঠায়।
তখন স্রষ্টা মনে মনে হাসেন আর বলেন ‘যাও পৃথিবীতে গিয়ে ঝি- জায়া- জননী- এ তিন প্রকার প্রাণীর দাসত্ব করবে, বিনা পারিশ্রমিকে শুধু পেট খোরাকির বিনিময়ে। তাদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা বিনোদন ইত্যাদি মৌলিক দায়িত্ব তোমার উপর ফরয করা গেল, আমৃত্যু এই দায়িত্ব পালন করবে। কাজেই বুঝা গেল পুরুষ জন্মের সময়ই পরমাত্মার সাথে অঙ্গীকার করে এসেছে যে, সে মৃত্যু পর্যন্ত মা- স্ত্রী-কন্যার দাসত্ব করবে। এখন পৃথিবীতে এসে সেই দায়িত্ব অস্বীকার করলে তো চলবে না। আল্লাহ এই দাসত্ব পুরুষের ভাগ্যলিপির শামিল করে দিয়েছেন, ফরয করেছেন। এখন সেই ফরয অস্বীকার করলে তো ওদেরকে কাফের হয়ে মরতে হবে। তখন আল্লাহ ওদেরকে পেদিয়ে পেদিয়ে জাহান্নাম পাঠাবেন।
কিন্তু কেউ জাহান্নামে যাক এটা আমার ভাল লাগে না। এজন্য আমি মেয়েদেরকে বলি তোমরা একটু ছাড় দাও একটু দয়া কর, ছেলেদের প্রতি একটু মানবিকতা প্রদর্শন কর। দেখনা বেচারাদের কি দুর্গতি, তারা তোমাদের জীবিকার জন্য সেই ভোরে চারটে পান্তা খেয়ে মাঠে গিয়ে দুপুর পর্যন্ত হাল চাষ করে, তারপর বাড়িতে এসে সংসারের কাজকর্ম করে, তারপর তোমাদের খাওয়া পরার জন্য সন্ধ্যায় দৌড়ে বাজারে যায়। কেউবা সারাদিন রিকশা-ভ্যান ঠেলাগাড়ি টানে, কেউবা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অফিস-আদালত মিল কারখানায় কাজ করে, কেউবা আপনজন ও স্বদেশ ত্যগ করে মেয়েদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিদেশ গিয়ে ফরেনারদের গোলামী করে। এভাবে পুরুষরা মেয়েদের গোলামী করার জন্য উদয়াস্ত খেটে মরে।
কাজেই মেয়েদের প্রতি আমার উপদেশ হল- তোমরা ছেলেদেরকে একেবারে ভৃত্যের মত না খাটিয়ে অন্তত তোমাদের নিজেদের জীবন ও সংসারের কিছুটা দায়িত্ব বহন কর, কিছুটা আয় রোজগার কর। ছেলেরা খাটতে খাটতে ওদের টেম্পারেচার সবসময় হাইভোল্টেজে অবস্থান করে। তাই ওরা কিছু করলে বা পাগলামী করলে তোমরা রাগ না করে মাফ করে দাও। ওরা তো গোলাম- দুর্বল, কাজেই দুর্বলের প্রতি কঠোরতা না করে মাফ করে দেওয়া ভালো। মেয়েদের বুঝতে হবে যে, স্বাধীনতার জন্য কারা আন্দোলন করে? যাদের স্বাধীনতা নাই তারাই স্বাধীন হতে চায়, সংগ্রাম করে, নিজেদের রক্ত মাংস বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে।
এই পরাধীনতার দুঃখটা আমরা বুঝি। কারণ একদিন আমরাও পরাধীন ছিলাম। তখন আমার দাদা মাস্টারদা সূর্যসেন, আমার ভাই মৌলভী নেসার আলী তিতুমির, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মজনু শাহ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছেন। ফকির বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ ইত্যাদি কত বিদ্রোহ-বিগ্রহ হয়েছে। তারা নিজেদের রক্ত মাংস বাতাসে উড়িয়েছে স্বাধীনতার জন্য। কাজেই পরাধিন মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেতে অনেক কিছুই করে। ছেলেরা সৃষ্টির আদি থেকে পরাধীন। তারা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত নারীর দাসত্ব করে যাচ্ছে। এখন এ থেকে মুক্তির জন্য তারা বিদ্রোহ করেছে, চিরকুমার সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছে। কাজেই তাদের বিদ্রোহটা যুক্তিসঙ্গত।
এখন মেয়েদের কাজ হলো রাগারাগি না করে তাদেরকে মাফ করে দিয়ে নতুন ভাবে দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে নেয়া, অর্থাৎ বিয়ের মাধ্যমে তাদেরকে দাসত্বের চাকরিটা ফিরিয়ে দেয়া। আরে ওরা তো অবুঝ দাসত্ব করতে করতে নাভিশ্বাস উঠেছে, এজন্য অপরিণামদর্শীর মত বিদ্রোহটা করে ফেলেছে। এখন তোমরা ওদেরকে মাফ করে দাও। শক্তিমানরাই দুর্বলদের মাফ করে, কি বল মেয়েরা? তখন মেয়েরা চেঁচিয়ে উঠলো ‘কক্ষনো না কক্ষনো না। ভার্সিটি পড়ুয়া একটা ধাড়ী মেয়ে দাঁড়িয়ে চিত্কার করলো ‘ম্যাডাম আপনি কিন্তু ছেলেদের পক্ষে ওকালতি করছেন।
সভাপতি লজ্জিত হয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল ‘আরে না কী যে বলো, আমি ঐ গোলামদের পক্ষে ওকালতি করতে যাব কোন দুঃখে। তবে আমি হলাম মুরুব্বি মানুষ, আমাকে তো উভয় পক্ষের চিন্তা করতে হয়। এমনিতেই মানুষ আমাকে দোষ দেয় আমি নাকি শিক্ষার নামে মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে টেনে এনেছি, বেপর্দা করে দিয়েছি। কাজেই আমাকে উভয় কুল রক্ষা করে চলতে হয়। এজন্যই আমি তোমাদের মধ্যে মীমাংসার চেষ্টা করছি। রাগারাগি করে তো কারো লাভ হবে না উভয়পক্ষের ক্ষতি হবে। কাজেই মেয়েদেরকে বলছি তোমরা ক্ষমাশীল হও, ক্ষমা মহত্তের লক্ষন আল্লার গুন।
আর ছেলেদেরকে বলব দেখ বাপুরা, তোমরা হলে গোলাম জাতি। তোমরা আল্লাহর দরবারে দাসত্বের অঙ্গীকার করে ক্রীতদাস হিসাবে জন্ম নিয়েছ। এই ভূপৃষ্টে তোমাদের একটাই দায়িত্ব- নারীর দাসত্ব করা, ঝি জায়া ও জননীর সেবা করা। এ থেকে তোমাদের মুক্তির কোন উপায় নেই। তবে আমরা মেয়েরা তোমাদের দূরাবস্তা দেখে দয়াপরবশ হয়ে তোমাদের অনেকটা দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। তোমাদেরকে পুরাপুরি স্বাধীনতা না দিতে পারলেও অন্তত কিছুটা স্বাধীনতা দেয়ার জন্য গঠন করেছি নারী স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সমিতি ও সংগঠন। মুর্খরা মনে করে এটা বুঝি নারীদের জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন। আসলে তা নয়, এটা হল মধ্যপদলোপী কর্মধারয়, এর ব্যাসবাক্য হলো নারী থেকে স্বাধীনতা। অর্থাৎ পুরুষরা যখন কোন ভাবেই নারী থেকে স্বাধীনতা পাচ্ছে না তখন আমরা নারীরা দয়াপরবশ হয়ে তাদেরকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা না দিয়ে কিছুটা মুক্তির ব্যবস্থা করেছি। যেমন ভারতবাসীরা বহু আন্দোলন করেও ব্যর্থ হওয়ার পর ইংরেজরা স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা দিয়ে চলে গিয়েছিল, তদ্রুপ আমরাও পুরুষকে কাজের দায়িত্ব ও সংসারী ব্যয়ভার থেকে অনেকটা মুক্তি দিয়েছি।
এখন আমরা অফিস-আদালত, মিল-কারখানা, শিক্ষালয়সহ পথে ঘাটে মাঠে প্রান্তরে জলে-স্থলে, অন্তরীক্ষে- সর্বত্র বিশাল কর্মযজ্ঞের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছি। এতে পুরুষের কাজের বুঝা অর্ধেক কমে এসেছে। আবার তাদের সংসারের ব্যয়ভার ও দায়িত্ব অর্ধেক আমরা বহন করছি। কাজেই আমি ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলব- তোমরা এটুকু প্রাপ্তিতেই সন্তুষ্ট থাক। বেশি খাইতে চাইলে আম-ছালা দুটোই হারাবে, তখন আর পৃথিবী নামের এই গ্রহে তোমাদের ঠাই হবে না। কারণ এই গ্রহ নারীর, এই গ্রহ ঝি জায়া ও জননীর। কাজেই এখানে থাকতে হলে নারীর দাসত্ব করেই থাকতে হবে। আল্লাহ তোমাদের শুভবুদ্ধি দান করুন, আমিন। আমার উদ্বোধনী বক্তব্য শেষ করার আগে পরবর্তী বক্তাদের উদ্দেশ্যে কয়েকটা কথা বলব।
আপনারা মেয়েদেরকে উস্কে না দিয়ে, ছেলেদেরকে বাঁশ দেয়ার চেষ্টা না করে তাদের অসহায়ত্বটা বুঝার চেষ্টা করুন, তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন। চিরকুমাররা তো হলো জন্মগতভাবেই চিরদাস কাজেই মরার উপর খরার ঘা না মেরে উভয়পক্ষকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করে সমঝোতার চেষ্টা করুন, বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর ব্যবস্থা করুন। আশা করি আল্লাহ আমাদের মাধ্যমে মীমাংসার পথ খুলে দিবেন- এই আশাবাদ ব্যক্ত করে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে এখানেই আমার বক্তব্য শেষ করলাম, আসসালামু আলাইকুম।
১১
এরপর বক্তব্য নিয়ে এল মানবাধিকার কর্মী শাবানা আজমি। তিনি বললেন ‘পৃথিবীতে মানুষ যা কিছু করে স্বজাতি বা পরবর্তী প্রজন্মের সুখ-শান্তির জন্য করে। যেমন রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্য, আরব সাম্রাজ্য, ইংরেজ সাম্রাজ্য যারা প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা নিজের জন্য করেনি বরং স্বজাতি ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য করেছিল। কারণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে তাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। আর যুদ্ধ ময়দানে গিয়ে তারা জানত না যে তারা মারা যাবে নাকি ফিরে আসবে। এরপরেও যুদ্ধ করেছিল স্বজাতির জন্য। যেমন ইংরেজরা ভারতবর্ষে যুদ্ধ করেছে, অনেকেই মৃত্যু বরন করেছে তারপর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। আর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর এ দেশের সম্পদ লুটপাট করে নিজেদের দেশে নিয়ে গেছে। সেই সম্পদ দিয়ে আজ পর্যন্ত তারা পৃথিবীর দাদাগিরি করছে, তাদের পরবর্তী বংশধররা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে কালাতিপাত করছে আর আমরা গিয়ে তাদের গোলামী করছি। কাজেই বুঝা গেল, মানুষ যা কিছু করে স্বজাতি বা পরবর্তী বংশধরদের জন্য করে।
ঠিক একইভাবে একজন মাও ছেলে সন্তান জন্মায় তারই স্বজাতি পরবর্তি আরেকটা মেয়ের সুখের জন্য। কারণ একজন মা যখন তার ছেলেকে জন্ম দেয় তখন সে জানে না যে, সে বেঁচে থাকবে নাকি মরে যাবে। এতে বুঝা যায় মা ছেলেকে জন্ম দেয় নিজের জন্য নয় অন্যের জন্য। এখন প্রশ্ন হলো সেই অন্যটা কে? একজন মা বাচামারা তোয়াক্কা না করে এই আশায় ছেলে জন্ম দেয় যে, তার ছেলেটা বড় হবে একদিন একটা মেয়েকে বিয়ে করবে, তাঁর দাসত্ব করবে সন্তানাদি হলে তাদের দায়িত্ব বহন করবে। এভাবে একজন মা ছেলে সন্তান জন্ম দিয়ে তার স্বজাতি আরেকটা মেয়ের দাস তৈরি করে দিয়ে যায়। কোন মা এই উদ্দেশ্যে ছেলে জন্মায় না যে, তার ছেলে মা-বাপ, ভাই-বোনের সেবা করে জীবন কাটাবে বরং তার উদ্দেশ্য থাকে তার ছেলে স্ত্রী-কন্যার সেবা করবে আর সে বেঁচে থাকলে তারও সেবা করবে। অর্থাৎ ছেলে জন্ম দেয়ার উদ্দেশ্যই হলো ঝি জায়া জননীর খাদেম জন্ম দেয়া। আল্লাহও এই উদ্দেশ্যেই ছেলেদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
এখন ছেলেরা যদি এ দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করে তাহলে তাদেরকে ছেটে ফেলতে হবে। যেমন কাটা ঝোপঝাড় জঙ্গল ইত্যাদি বাড়তে বাড়তে রাস্তার উপর এসে গেলে সেগুলি ছেঁটে ফেলতে হয়, চুল লম্বা হয়ে গেলে কেটে ফেলতে হয়, সন্ত্রাস বেড়ে গেলে ক্রসফায়ারের নামে ছেঁটে ফেলা হয়। তদ্রুপ ছেলেরাও বেড়ে গেলে তাদেরকে ছেঁটে ফেলতে হবে। এখানে চিরকুমার সংঘ-এর ছেলেরা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে, সরকারের কাছে আমাদের জোর আবেদন এদেরকে ফাঁসি বা ক্রসফায়ারের মাধ্যমে ছেটে ফেলা হোক। আরো কিছু নরম গরম কথা বলে সে বক্তব্য শেষ করল।
তারপর বক্তব্য নিয়ে এলেন প্রীতিলতা সেনগুপ্ত। তিনি বললেন ‘পুরুষ জীবনের তিনটা স্তর- বাল্য যৌবন ও বার্ধক্য। এই তিনটা স্তর তিন প্রকার নারীর জীবনের বিনিময়ে গঠিত হয়। যেমন একজন মা ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর প্রলয় থেকে বাঁচাতে তার সন্তানকে দশ মাস দশ দিন জঠরে পোরে রাখে, তারপর আজরাইলের সাথে পাঞ্জা লড়ে পৃথিবীতে আনে, তারপর নিজের কলজেটা একটু একটু করে চুষিয়ে চোষিয়ে খাইয়ে পৃথিবীর পথে হাঁটতে শিখায়। তারপর নেংটা পশু বাচ্চাটাকে কাপড়-চোপড় পরিয়ে মানুষ বানায়, লেখাপড়া শিখিয়ে পৃথিবীর উপযোগী যোদ্ধা বানায়, খাইয়ে-দাইয়ে আরামে বিলাসে বড় করে তুলে। যখন সে পূর্ণাঙ্গ হয়ে যায় তখন বিয়ে করিয়ে আরেকটা মেয়ের হাতে নিজের দায়িত্বটা সমর্পণ করে দেয়।
তারপর স্ত্রী বন মানবটাকে চুল দাড়ি গোফ কেটে ছেঁটে সভ্য মানব বানায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রান্না বান্না করে সুখাদ্য খাওয়ায়, কাপড় চোপড় ধুয়ে পোশাক-পরিচ্ছদ বিছানাপত্র সুন্দর পরিপাটি করে রাখে, নিজেকে ফুয়েলের মত পোড়িয়ে তাকে সভ্য সমাজে বুক ফুলিয়ে চলার মতো সকল রসদ যোগান দেয়। এরপর তার মরুময় জীবনকে শস্য শ্যামল করতে ঘরে আসে তার কন্যা। এই কন্যা নামের কোকিলটার কলকাকলিতে তার উশর মরুময় জীবন মরুদ্যানে রূপান্তরিত হয়। এভাবে তিন প্রকারের নারি পুরুষ জীবনের তিনটি স্তরকে জীবন রস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, সবুজ শ্যামল করে তোলে।
কিন্তু পুরুষ জাতটা বড়ই অকৃতজ্ঞ। এরা এতটাই পাষাণ এতই জঘন্য যে, সে তার ত্রাণকর্ত্রী নারীর সেবা করবে না আনুগত্য করবে না দাসত্ব করবে না। কাজেই ছেলেদের প্রতি আমার প্রশ্ন, তোমাদের জীবনের এই তিনটি স্তরে তিন প্রকার নারী- ঝি জায়া ও জননীর আশ্রয় ছাড়া আর কি কোন আশ্রয় আছে, বেঁচে থাকার অবলম্বন আছে? এরা ছাড়া কোথায় তোমাদের আশ্রয়, কে তোমাদের রক্ষা করবে শান্তি দেবে বাঁচিয়ে রাখবে? এছাড়া যদি তোমাদের কোন আশ্রয় থাকে তাহলে চলে যাও সেখানে, এই পৃথিবীতে তোমাদের থাকার দরকারও নাই অধিকারও নাই। কারণ এই পৃথিবী নারীর, নারী আছে বলেই সূর্যোদয় হয় চাঁদ উঠে, ফুল ফোটে অলি গায়। কুকিল ডাকে জোয়ার ভাটা হয় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা হয়। নারী না থাকলে পৃথিবী মরুভূমি হয়ে যাবে, মানব জন্ম রহিত হয়ে যাবে। তখন ভূপৃষ্ঠ থেকে মানুষ ও মানব সভ্যতা জিন জাতির ন্যায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
কাজেই ছেলেদের প্রতি আমার আহ্বান- হয় তোমরা পথে আস বিয়ে করে মেয়েদের সেবা কর। অন্যথায় এ গৃহ ছেড়ে চলে যাও অন্য কোন নরকে। স্বরন রাখবে, এই পৃথিবী ফ্রম দ্য উইমেন ফর দ্য উইম্যান বাই দ্য উইম্যান। জয় নারী, জয় হিন্দ বন্দে মাতরম। মেয়েরা সবাই শ্লোগান তুল ‘জরায়ু আমার সিদ্ধান্ত আমার’ বলে সে বক্তব্য শেষ করল।
এরপর বক্তব্য নিয়ে এলেন সংস্কৃতিকর্মী রত্না ওরফে শাবানা। তিনি বুক ফুলিয়ে বললেন ‘বোনেরা আমার নিশ্চয়ই আপনারা ঐ শয়তানি সংঘের মুখপত্র ‘চিরকুমার বার্তা’ এর মনোগ্রামে একটা লেখা দেখেছেন- শুক্রাণু আমার সিদ্ধান্ত আমার। ঐ হালার পুতেরা কত বড় মূর্খ দেখেন, ওরা জানেই না যে শুক্রাণুর প্রকৃত মালিকানা কার? আর জানবে কি করে ওরা তো মূর্খ অকাঠ মূর্খ। ওরা যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের কিছুই জানে না তদ্রুপ সৃষ্টিতত্ত্বের ত- টা পর্যন্ত জানে না। কারণ ওরা তো কোনদিন কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক ইত্যাদি পাঠ করে না। যদি পাঠ করত তাহলে অবশ্যই জানতে পারত যে স্রষ্টা আদম ইভকে সৃষ্টি করে ঘোষণা দিলেন যে ‘এবার আমি পৃথিবী আবাদ করব।
তখন ফেরেশতারা তাদের দলনেতা জিব্রাইলকে প্রশ্ন করল ‘আচ্ছা আমাদের প্রভু এই মাত্র দুইটা প্রাণী দিয়ে বিশাল পৃথীবি ক্যামনে আবাদ করবেন? উত্তরে জিব্রাইল বললেন ‘তিনি একটা পিচ্ছিল পদার্থের মধ্যে শুক্রাণু নামক কীট সৃষ্টি করে পুরুষকে দিয়ে বলবেন ‘এই পদার্থ আমি তোমার মধ্যে গচ্ছিত রাখলাম বটে কিন্তু স্মরণ রাখবে এর প্রকৃত মালিকানা নারীর, সে চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকবে। তারপর নারী যখন চাইবে তখনই পুরুষ ইনজেকশনের ন্যায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই শুক্রাণু নারীর জঠরস্তিত জরায়ুতে স্থাপন করবে। তখন এই শুক্রাণু নারীর পেটের মধ্যে ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ মানব আকৃতি ধারণ করবে। নিদৃষ্ট সময়- দশ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর উহা পৃথিবীতে নেমে আসবে। তারপর ধীরে ধীরে বড় হয়ে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হবে। এভাবে স্রষ্টা নারীর পেটে মানব উৎপাদন করে পৃথিবী আবাদ করব।
একথা শুনে স্বর্গীয় দূতেরা কাঠ ফাটা হাসি শুরু করলো। হাসতে হাসতে কেউ মূর্ছা গেল, কেউ দম আটকে মরার উপক্রম হলো, কেউ হাসতে হাসতে কাশতে কাশতে গলা দিয়ে রক্ত এল, স্বর্গে উদ্দাম হাসি ও কাশির রুল পড়ে গেল। জিব্রাইল ধ্মকে উঠলেন ‘মুর্খের দল এভাবে দাঁত কেলিয়ে হাসছিস কেন? ধমক খেয়ে স্বর্গীয় দূতেরা হাসি থামিয়ে বললো ‘নারীর পেটে মানুষ ধরবে, এক মানুষের পেটে আরেক মানুষ থাকবে এমন গাঁজাখুরি গপ্প আমরা জীবনেও শুনি নাই, আর এমন অদ্ভুত কাণ্ড হতে কোথাও দেখি নাই’ বলে তারা আবার বেদম হাসিতে ফেটে পড়ল। তখন জিব্রাইল রেগে গিয়ে হুংকার ছাড়লেন ‘গর্ধবের দল চুপ রাও, সময় হলেই দেখতে পারবে। তারপর পৃথিবীতে এসে যখন নারীরা পেটে বাচ্চা ধারণ শুরু করল তা দেখে স্বর্গীয় দূতেরা এই যে মাথা নত করল আজ পর্যন্ত কোনদিন নেতার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায়নি।
যাই হোক, সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনার পেছনে আমার মূল উদ্দেশ্য হলো শুক্রাণুর প্রকৃত মালিকানা কার পুরুষের নাকি নারীর- তা প্রমান করা। সৃষ্টির সময়ই স্রষ্টা এর ফয়সালা করে দিয়েছেন। এরপরেও জিনিসটা যেহেতু তার ভেতরে গচ্ছিত বিধায় যদি ধরেও নেয়া যায় এর মালিকানা ছেলেদের- তখন প্রশ্ন জাগে এই পদার্থ দিয়ে ওরা কি করবে? চিনি লেবু দিয়ে গ্লাসে গুলে শরবত খাবে, নাকি তেলের মতো মাথায় মালিশ করবে, নাকি স্নু পাউডারের মতো মুখে মাখবে, নাকি মলমের মত কোমর পেট পিঠের ব্যথায় মালিশ করবে? না এসব কোনো কাজে আসবে না। আর যেহেতু কাজে আসবে না বিধায় এর মালিকানাও তার নয় এর প্রকৃত মালিক হলো মেয়েরা। কাজেই স্রষ্টার বিধান অনুযায়ী চাহিবামাত্র উহার প্রাপককে দিতে বাধ্য থাকিবে। সুতরাং মেয়েরা মানে স্ত্রী পথে-ঘাটে-মাঠে প্রান্তরে বনে-বাদাড়ে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নিরিক্ষে- যেখানেই তাদের প্রাপ্য চাইবে ছেলেরা সেখানে তা দিতে বাধ্য থাকিবে। এর ব্যতিক্রম হলে স্রষ্টার বিধান লংঘন করা হলো, স্ত্রীর অধিকার বঞ্চনার দায়ে মানবাধিকারও লঙ্ঘিত হল। কাজেই এটা ইহলোকে- পরলোকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।
যেমন ধরেন আমি এমাজ উদ্দিনের কাছে এক থলে আশরফি জমা রেখে বললাম সাবিনা জেসমিন চাহিবামাত্র তাকে এটা দিয়ে দেবেন। তারপর সাবিনা চাইলেও যদি না দেয় তাহলে কি এমাজ উদ্দিন দণ্ডনীয় অপরাধ করলেন না, সাজার যোগ্য হলেন না? ঠিক একইভাবে ছেলেদের মধ্যে স্রষ্টা কর্তৃক গচ্ছিত মেয়েদের আমানত চাহিবা মাত্র না দিলে বা দিতে অস্বিকার করলে অপরাধ বলে গণ্য হবে- আর এ অপরাধটাই করছে চিরকুমার সংঘের ছেলেরা। এজন্য আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই, শয়তান সংঘের পাণ্ডাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হোক। আর মেয়েদের সমস্যা হলো ওরা ভদ্র ও ধৈর্যশীল। মুরুব্বীরা তাদেরকে উপদেশ দেয় ধৈর্যে মেওয়া ফলে। কিন্তু আমি উপদেশ দেই বেশি ধৈর্য ধরলে মেওয়া পচে যায়। মেয়েদের অতি ধৈর্য আর অতি ভদ্রতার কারণে মেওয়া পচে গেছে, ছেলেরা আস্কারা পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছে। এখন মুগুর মেরে ওদেরকে মাথা থেকে নামাতে হবে।
আমাদের পথিকৃত বেগম রোকেয়া বলে গেছেন, সকল আত্নার জন্ম একসাথে। এজন্য কেউ ছোট বড় নাই সবাই সমান। পার্থিব জন্মে স্ত্রীর চেয়ে স্বামীর বয়স বেশি হলেও উভয়ের আত্নিক বয়স সমান। আর একারণেই কেয়ামতের ময়দানে সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী হবে, কেউ কাউকে মানতে হবে না। কাজেই আমি মনে করি দুনিয়াতেও এত মানামানির দরকার নাই, ছেলেরা অন্যায় করলে বয়সে বড় হলেও মেয়েরা তাদেরকে ধরে ধরে মুগুর মারবে।
আমরা শ্লোগান দেই জরায়ু আমার সিদ্ধান্ত আমার। এখন ওই মূর্খরা আমাদের অনুসরণে একটা শ্লোগান আবিষ্কার করে ফেলেছে- শুক্রাণু আমার সিদ্ধান্ত আমার। এই মুর্খরা আজো এটাই জানেনা যে জরায়ু নারীর পেটে থাকে, এটা কখনো ছেলেদের পেটে গিয়ে আশ্রয় নেয় না। কাজেই এর মালিকানা সম্পুর্ন নারীর। এজন্য নারী কখন কার শুক্রাণু জরায়ুতে গ্রহণ করবে না করবে সেটা তার এখতিয়ার। কিন্তু ছেলেদের এই এখতিয়ার নাই, কারণ শুক্রাণু কখনো ছেলেদের পেটে যায় না, ছেলেদের কোন কাজে আসে না বিধায় এর মালিকানাও নারীর সিদ্ধান্তও নারীর। এখন ছেলেরা যদি এই সিদ্ধান্ত মানতে না চায় তাহলে মুগুর মেরে মেয়েরা তাদের অধিকার আদায় করে নিবে। ‘জয় নারীতন্ত্র জয় নারীবাদ’ বলে সে বক্তব্য শেষ করল।
১২
এরপর বক্তব্য নিয়ে এলেন বিশিষ্ট নারীবাদী লেখিকা ও রাজনীতিবিদ হিলারি থেচার। তিনি বললেন ‘মেয়েরা হলো সৌন্দর্য ও শান্তির প্রতীক। পক্ষান্তরে ছেলেরা হল কুৎসিত ও বিভৎসতার প্রতীক। কারন এদের চেহারা, অবয়ব ও শারীরিক গঠন কুৎসিত, এদের পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত লোম আর মোটা মোটা কালো পশমে ভরপুর। উহঃ গরিলার মত কি বীভৎস, দেখলেই বমি আসে। খোদার সৃষ্ট জীবের মধ্যে পুরুষের মত নোংরা ও কুৎসিত সৃষ্টি দ্বিতীয়টা নাই। এরা কখনই সভ্য মানব নয়, এরা হলো বনমানব। এদের নাকটা ছাড়া পুরো মুখ ভর্তি চুল দাড়ি, বুক পেট পিঠসহ সারাদেহ বনমানবের ঝালরের মত মোটা কাল পশমে ঢাকা। এরা এতই কুৎসিত যে, এদের নাসারন্ধ্র, কানের ছিদ্র ও পাতা পশমে ভর্তি, এমনকি হাত-পায়ের আঙুলেও দেখবেন চুল, কি ভয়ংকর বিশ্রী মোটা ও কালো পশম। আসলে এরা মানুষ নয় এরা হলো বনমানব।
এখন প্রশ্ন হলো মানুষ বানরের বংশধর- এই ধারণাটা এলো কোত্থেকে এবং কেন? এই ধারণার উৎস কি নারীদেহ নাকি পুরুষদেহ? উত্তরটা আমরা জানি। ডারউইন নারী অবয়ব পসন্দ করতেন বিধায় দাড়ি-গোফ কামিয়ে লম্বা চুল রেখে নারীর মতো থাকতেন। কিন্তু প্রকৃতি গবেষণার জন্য তিনি বিগল জাহাজ নিয়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় চলে গেলেন, বছরের পর বছর ধরে গবেষণা কর্ম চালিয়ে গেলেন কিন্তু কিছুই আবিষ্কার করতে পারলেন না। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে চুল দাড়ি গোঁফে তিনি বনমানব হয়ে গেলেন। হঠাৎ একদিন একটা গরিলা দেখে তিনি নিজের সাথে তুলনা করলেন। তারপর ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। কারন তিনি ভাবলেন মানুষ নতুনত্ব চায় নতুনকে বিশ্বাস করে। এতদিনে তো কিছুই আবিষ্কার করতে পারলাম না, কাজেই নতুন একটা থিউরি ঘোষণা দিয়ে দেই। তারপরই তিনি তথ্য দিলেন- বানর থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের উৎপত্তি।
এই থিউরি শুনে মার্ক্স- এঙ্গেলস আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বনমানুষের মত নিজেদের গোঁফ- দাড়ি দেখে ও চেহারার সাথে বানরের মিল দেখে তারাও বলে উঠল ‘ডারউইন তো ঠিকই বলেছে। কিন্তু ফ্রয়েড চেঁচালেন ‘কক্ষনো না, যৌন মিলন ব্যতিত বিবর্তনের মাধ্যমে কোন প্রাণীর উৎপত্তি হয় না। প্রাণী বিবর্তিত হয়ে বড়জোর আকৃতিতে ছোট বড় হতে পারে কিন্তু ভিন্ন প্রাণীতে রূপান্তরিত হতে পারে না। আসলে মানবজাতি জিন ও বানরের শংকর প্রজাতি। এই পৃথিবীর পূর্বতন বাসিন্দা জ্বীন জাতি ছিল ভয়ঙ্কর কামুক। বর্তমান ইউরোপিয়ানদের ন্যায় তারা জীব-জন্তু ও পশু- পাখির সাথেও কুকর্মে লিপ্ত হতো। তবে তারা বানরের সাথে কুকাজটা বেশি বেশি করতো। ফলে এ দুয়ের শংকর হলো মানুষ। কিন্তু যৌন উন্মাদ আখ্যা দিয়ে বিজ্ঞানিরা ফ্রয়েডের এই থিউরি প্রত্যাখ্যান করল। যাই হউক, পুরুষের লোমশ জংলী চেহারা দেখে মানুষকে বানরের বংশধর বলে সনাক্ত করা হয়েছে, আমাদের কারণে নয়। কাজেই ওরা হল জংলি অসভ্য গরিলা বনমানব কিন্তু আমরা হলাম সৌন্দর্যের প্রতীক মা হাওয়ার বংশধর সভ্য মানবী।
কাজেই পুরুষকে মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি দিলে সৌন্দর্য ও মনোহারিত্বের প্রতিমা নারী জাতিকে অপমান করা হয়। আসলে আমরা মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের মর্যাদা বুঝি না। এই দেখেন স্রষ্টা আমাদেরকে কত রুপ গুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কবি সাহিত্যিকরা অষ্টপ্রহর আমাদের সৌন্দর্যের গুণগান গেয়ে নিজেদের ধন্য করে। আমাদের রুপ গুনের বর্ণনা দিয়ে তারা মহাকাব্য রচনা করে, মহাকবি উপাধি পায়। আমাদের সৌন্দর্যকে তারা পূর্ণেন্দু কৌমুদী, কাঁচা হলুদ, কাঁচা সোনা, মধ্যাহ্ন রোশনি, ঊষার স্নিগ্ধ প্রভা, প্রদোষ মিহির, ফুল, রক্ত জবা, গোলাপ, ফুটন্ত পদ্ম, নলিনী, সূর্যমুখী আরো কত কিছুর সাথে তুলনা করে। আমাদের কণ্ঠকে তারা কোকিল কন্ঠ, মধুবর্সি, বংশী, অমৃত ইত্যাদি অভিধায় অভিষিক্ত করে, এতেও যেন তাদের তৃষ্ণা মিটে না। আসলে আমাদের রূপ-সৌন্দর্যের যথার্থ উপমা ও বর্ণনা হয় না। সর্বোপরি আমাদের বুকের সৌন্দর্য সৃষ্টি জগতের তামাম সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেয়।
স্রষ্টা পুরুষকে যেমন কুৎসিত রূপে সৃষ্টি করেছেন তার বিপরীতে আমাদেরকে চরম ও পরম সৌন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এজন্য আমাদেরকে বলা হয় দেবী। আমাদের মুখমন্ডল চাঁদের মতো স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময়, আমাদের মাথার চুল ব্যতীত পায়ের পাতা পর্যন্ত অণুবীক্ষণ অনুসন্ধান চালিয়েও একটা পশম কেউ বের করতে পারবে না। ওদের মতো আমাদের পেটে পিঠে বুকে সারা গায়ে নোংরা কালো পশম নেই। আমাদের রূপ ও সৌন্দর্যে শুধু পুরুষ কেন তামাম সৃষ্টিজগৎ মুগ্ধ, এমনকি ফেরেশতারাও পাগল। রাজা সলোমনের আমলে হারুত ও মারুত নামের দুই ফেরেশতা জোহরা নামে এক মহিলার প্রেমে পড়ে, তাকে পাওয়ার জন্য তার স্বামীকে হত্যা করে। সেই পাপের জন্য স্রষ্টা এখনো একটা কুয়ার মধ্যে তাদেরকে উল্টো পায়ে ঝুলিয়ে শাস্তি দিচ্ছেন।
ছেলেরা আমাদের রুপ দেখে মুগ্ধ হয়ে নিজেদের চেহারা দেখে লজ্জিত হয়। তখন তারা দাড়ি-গোফ কামিয়ে নারী সাজতে চায়। কিন্তু তখন আরও বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাদের কামানো থুতনি ক্ষুরের মত ধারাল হয়ে উঠে, ঘষা লাগলে মনে হয় চামড়া ছিলে যাচ্ছে, রক্ত জমে লাল হয়ে উঠে। কাজেই আমরাই হলাম সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের প্রতীক, আর পুরুষ হল কুচ্ছিতের প্রতীক।
আবার আমরা নারীরা হলাম শান্তির প্রতীক। কারণ আমরা কখনো সন্ত্রাস যুদ্ধ-বিগ্রহ মারামারি খুনাখুনি চুরি-ডাকাতি মাস্তানি চাঁদাবাজি ধর্ষণ প্রতারনা ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড করিনা। পক্ষান্তরে পুরুষরা হল ধ্বংস আর প্রলয়ের প্রতিক। সৃষ্টির সূচনা থেকে পৃথিবী এদের বীভৎসতা দেখে আসছে। বারবার এরা মহাযুদ্ধ বাঁধিয়েছে পৃথিবীতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে আর অবিরত অন্যায় অপকর্ম করতে করতে পৃথিবীটাকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছে। কাজেই বুঝা গেল মেয়েরা শান্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক আর পুরুষ কুৎসিত ও বিভৎসতার প্রতীক। সুতরাং প্রমাণিত হলো মেয়েরাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। আর শ্রেষ্ঠ হয়ে আমরা যে কুৎসিৎ প্রজাতির ছেলেদেরকে দাস হিসাবে গ্রহণ করে পাশে শুয়ার অনুমতি দেই সেটা ওদের চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য। ছেলেরা যত বেশি একথাটা স্মরণ রাখবে তত বেশি তাদের জন্য মঙ্গল হবে’ বলে সে বক্তব্য শেষ করল।
এরপর বক্তব্য নিয়ে এলো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মাননীয় সংসদ সদস্য কবরী উসমান। তিনি ঝংকার মেরে উঠলেন ‘ছেলেদের ঔদ্বত্য সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তাদের ঔদ্বত্য এতটাই বেড়ে গেছে যে আজ তারা প্রকাশ্যে রাজপথে দাঁড়িয়ে ঘোষনা দেয় বিয়ে করবে না, মেয়েদের দাসত্ব করবে না। ছেলেদেরকে জিজ্ঞেস করি দাসত্ব করবে না তো এই পৃথিবীতে তোদের আগমনের উদ্দেশ্যটা কি, দায়িত্বটা কি, কাজটা কি? প্রত্যেক সৃষ্টজীব সৃষ্টির পেছনে একটা লক্ষ্য উদ্দেশ্য আছে। পুরুষ সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো ছেলেটা উপযুক্ত বয়সে একটা বিয়ে করবে, মেয়েটার দাসত্ব করবে। তার আপাদমস্তক সোনা চুন্নি পান্না দিয়ে মুড়িয়ে মহারানী সাজিয়ে সোনার পালঙ্কে নিয়ে শুওয়াবে, দাসি বাঁদি নিয়োগ করে দিবে। তারপর মেয়েটা মহারানীর মত সোনার পালঙ্কে বসে বসে রঙ্গিন টিভিতে শুধু ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখবে বাংলা সিরিয়াল দেখবে না। কারণ এটা নিম্নমানের- যা মহারানীর পক্ষে শোভন নয়।
আর পুরুষদের কাজ হলো উদয়াস্ত ক্ষেতে-খামারে পথে-ঘাটে-মাঠে জলাশয়ে স্থলাশয়ে খাটুনি খেটে ঝি জায়া ও জননির চাহিদার যোগান দিবে। তারপর রাত্রে বাসায় এসে জীবন ধারণের উপযোগী দু'মুঠো অন্ন পাবে আর মহারানীর পাশে শুয়ে ঘুমানোর অনুমতি পাবে। ব্যাস এই যথেষ্ট, এর বেশি পুরুষের অধিকার থাকতে নেই, চাহিদা থাকতে নেই। কিন্তু আজ কালকার ছেলেরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। অবশ্য ওদেরকে দোষ দেয়া যায় না, দোষটা হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী উভয়ই নারী। আমি কতবার তাদেরকে বলেছি- আপনারা থাকতে থাকতে ছেলেদের দাসত্বের দলিলটা পাকাপোক্ত করেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিলুপ্ত করে নারীতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। আপনারা মরে গেলে জয় তারেক এসব করবে না, তারা বরং ছেলেদের পক্ষাবলম্বন করবে।
কিন্তু তারা আমার কথা শুনল না আর শুনবে বলেও মনে হয় না। কাজেই মেয়েদেরকে বলছি আকাশ থেকে ফেরেশতা এসে পাতালের বাসুকি এসে অলিম্পাসের দেবতা এসে তোমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যাবে না। নিজেদের বাহুর জুড়েই নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাজেই ছেলেরা ইভটিজিং করতে এলে, ধর্ষণ করতে এলে বা গোলামি করতে অস্বীকার করলে থাবরিয়ে থাবড়িয়ে শুধু ওদের কানই ঠসা করবে না নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের করে আনবে। তারপর পেদিয়ে পেদিয়ে জেলে পাঠাবে। একা না পারলে দশ জন মিলে করবে। আমাদের এবারের সংগ্রাম ছেলেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম ছেলেদের দাস বানানোর সংগ্রাম- এই আহ্বান জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
এরপর আরও কয়েকজন বক্তব্য দেয়ার পর সম্মেলনের আহ্বায়িকা ময়মনসিংহের মহিলা এম পি সর্বজনাব মমতাজ মহল সমাপনি বক্তব্য শুরু করলেন। তিনি ছেলে ও মেয়েদের স্বভাব প্রকৃতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করলেন, বিভিন্ন উদাহরন দিয়ে প্রমাণ করলেন যে মেয়েরা হলো শান্ত ভদ্র, তারা শান্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক। পক্ষান্তরে ছেলেরা হল উগ্র চন্ডাল, তারা অশান্তি ধ্বংস আগুন ও প্রলয়ের প্রতীক। পৃথিবীর যত অশান্তি সব তারাই সৃষ্টি করে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য শান্তিময় ও আবাদময় করে রাখে একমাত্র মেয়েরা। কাজেই মেয়েরাই হলো পৃথিবীর মূল সম্পদ আসল নাগরিক। কারণ সন্তান লালন পালন, খাওয়া পরা, থাকার ব্যবস্থা ইত্যাদি মানব জীবনের মূল চাবিকাঠিগুলি মেয়েদের হাতে, জীবনের মৌলিক ক্ষেত্রে নারীর সাহায্য ছাড়া পুরুষ চলতে পারবে না। এজন্যই ছেলেদেরকে মেয়েদের দাসত্ব করতে হবে, সকল দায়িত্ব পালন করতে হবে।
কিন্তু তারা যদি এই দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করে তাহলে তাদেরকে বয়কট করতে হবে। কাজেই আমি মেয়েদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি, তোমরা ছেলেদেরকে রান্নাঘরে, খাওয়ার টেবিলে, বিছানায় সর্বত্র বয়কট কর। তাদেরকে ভাতে মার, পানিতে মার, কাপড়ে মার, বিছানায় মার। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নিরিক্ষে সর্বত্র বয়কট কর। ছেলেদের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, নারীর পৃথিবীতে ওদের নিঃশ্বাস হারাম করে তোল। এখানে যারা উপস্থিত আছো তোমরা এই বার্তা প্রত্যেক পরিবারের মেয়েদের কাছে পৌঁছে দেবে। বিশেষত চিরকুমারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসবে- এবারের সংগ্রাম নারী স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম পুরুষদের নাক বিঁধানোর সংগ্রাম। তারপর তিনি ‘ঝাড়ু সংঘের’ আগামি কর্মসুচি দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
(দুই অধ্যায় দেয়া হল আর দুই অধ্যায় বাকী থাকল)
বিষয়: সাহিত্য
২৩৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন