চিরকুমার সংঘ

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৬ নভেম্বর, ২০১৮, ১১:০১:১২ সকাল



(গত বছরের লেখা এই বইটি আমার অদ্ভুত ও উদ্ভট কল্পনা আর ফসল। ভাবলাম এভাবে পড়ে থাকার চেয়ে ব্লগে দিয়ে দেই তখন পাঠকরাই নির্ণয় করতে পারবেন এটা আদৌ কোন রচনা বা সাহিত্য হলো কিনা। প্রায় দেড়শ পৃষ্ঠার বইটি কয়েক কিস্তিতে দিয়ে দেয়া হবে, আগ্রহী পাঠকগন সেভ করে পড়ে নিবেন।)

প্রথম অধ্যায়



জাকির হুসেনের প্রথম সন্তান যাকিরা জন্মের আগে সবাই বলেছে ছেলে হবে কিন্তু হলো মেয়ে, দ্বিতীয়টাও মেয়ে হল। তখন জাকির দম্পতি একে অন্যকে সান্ত্বনা দিতে লাগল এই বলে যে, মুরুব্বীদের অভিজ্ঞতালব্ধ একটা ভবিষ্যৎবাণী আছে, প্রথম সন্তান মেয়ে হলে দ্বিতীয়টিও মেয়ে হবে কিন্তু তৃতীয়বারে গিয়ে ছেলে হবে। কাজেই তৃতীয় নবাগতের প্রতীক্ষায় তারা বসে রইল, অবশ্য নিশ্চেষ্ট বসে না খোদা প্রদত্ত মানবোৎপাদনের কারখানা সার্বক্ষণিক চালু রেখে তারা প্রতীক্ষা করতে লাগল। অবশেষে একদিন প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো, ঠা ঠা চিৎকারে গৃহকর্তার কান প্রফুল্ল হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই লিঙ্গ নির্ণয়ের সংবাদ শুনে তার চেহারা কালো হয়ে গেল। বেচারা গম্ভীরমুখে গজেন্দ্র গমনে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

মানব প্রকৃতি হলো যা সহজে পেয়ে যায় তার কদর নাই, যা পায় না তার আকাংখার অন্ত নাই। সেটা তুচ্ছ হলেও পাওয়ার জন্য জীবনপাত করে। জাকির দম্পতির দর্শন ছিল অন্যদের মতোই সাদামাটা, একটা ছেলে হবে একটা মেয়ে হবে, ব্যস এই যথেষ্ট। ছেলে ছাড়া উপায় নাই মেয়ে হলে রক্ষে নাই- এমন কোন দর্শন তাদের ছিল না। কিন্তু পরপর তিনটি কন্যা জন্মের পর তার অবস্থা হলো ‘নদীর এপার বলে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস যত সুখ সব উপারে’ যত কল্যান সব ছেলের মধ্যে মেয়েরা সংসারের বোঝা বৈ কিছু নয়। অপ্রাপ্তির কারনে ছেলের প্রতি তার তৃষ্ণা বেড়ে গেল।

সে ভাবতে লাগলো ছেলে ছাড়া সংসার অচল, একটা ছেলে থাকলে মা-বাপের সুবিধা হয়। সংসার দেখাশোনা করতে পারে, বাজার সওদা করে, মা-বাপের বাইরের কাজগুলি আঞ্জাম দেয়, উপার্জন করে। অসুখ-বিসুখ হলে বা বৃদ্ধ বয়সে বিছানায় পড়ে থাকলে টানাটানি করে, হাগা- মুতা সাফ করে, বুড়া বয়সে ছেলেই হয় মা বাবার একমাত্র অন্ধের ষষ্ঠী। মেয়েরা তো আর স্বামীর সংসার ফেলে মা বাবার খেদমতে পড়ে থাকতে পারবে না। তাছাড়া ছেলে হলো বংশের প্রদীপ, বাপের বংশে প্রদীপের মতো প্রদীপ্ত হয়ে পিতৃ পুরুষের কেতন উড়ায়। আর তখন মেয়েরা অন্যের বংশে প্রদীপের জ্বালানি হয় মাত্র। ছেলে ছাড়া পিতৃ পুরুষের ভিটে ঘুঘু চড়ে। কাজেই একটা ছেলে ছাড়া তো আর চলছে না।

জাকির দম্পতি পুত্র সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। তারা খোদা প্রদত্ত মেশিনের যথার্থ প্রয়োগ শুরু করল। একটা রাতও মিস দেয় না, কখন আবার পুত্রধনটা ফসকে হয়ে যায়। তারা শারীরিক- মানসিক কসরত চালিয়ে যাচ্ছে বাকিটা আল্লার হাতে। এখন আল্লাহকে পাওয়া যাবে কোথায়? জাকির হুসেনের একান্ত কামনা আল্লাহকে পেলে তাকে বলে কয়ে হউক, হাতে পায়ে ধরে হউক, কিছু ঘুষ টুস দিয়ে হউক- যে কোন পন্থায় তার কাছ থেকে একটা ছেলে সন্তান বাগিয়ে নেবে। কিন্তু সমস্যা হলো তাকে পাওয়া যাবে কোথায়, সে অনুসন্ধানে নামল।

স্রষ্টা আঠার হাজার বা আঠার লক্ষ বা আঠার কোটি মাখলুকাত সৃষ্টির পর একটা অদৃশ্য বস্তু সৃষ্টি করলেন। তারপর চিন্তা করলেন এই অদৃশ্য বস্তুটা কাকে উপহার দেবেন। তাঁর সৃষ্ঠ জীব জগতের মধ্যে অধিকাংশই চার পেয়ে। এদের মধ্যে আবার অনেকের লেজ আছে শিং আছে। কাজেই এরা পূর্ণাঙ্গ, সর্বদিক দিয়েই শক্তিশালী। এই মূল্যবান অদৃশ্য বস্তুটা তাদেরকে দিলে নিশ্চয়ই ওরা স্রষ্টার সাথে টক্কর লাগাবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামবে। কারণ বাঘ-সিংহ চিতা গরু-মহিষ হাতি গন্ডার জেব্রা- এগুলি ঐ বস্তুর মালিক হলে অসীম ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে, তখন আর খোদাকে কোন পরোয়া করবে না। কাজেই ঐ বস্তু এদেরকে দেয়া যাবে না। তারপর তিনি গেলেন আরেক শ্রেণীর প্রাণীর কাছে, এদেরকে বলা হয় কীটপতঙ্গ। তিনি দেখলেন এদের অসংখ্য হাত-পা, বিষদাঁত, বিষকাটা, বিষহুল ইত্যাদি আছে। এরা ওই মূল্যবান বস্তুর মালিক হলে স্রষ্টাকে চ্যালেঞ্জ করে বসবে। এরপর তিনি বিভিন্ন প্রকার প্রাণী পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন আর বিবেচনা করতে লাগলেন কিন্তু কারো প্রতি ভরসা পেলেন না। কারণ এরা শক্তিশালি হয়ে যদি খোদাদ্রোহীতা করে বসে।

সর্বশেষে গেলেন অতিশয় দুর্বল অচল দুপেয়ে একটা প্রাণীর কাছে। প্রাণীটাকে দেখে তার খুব দুঃখ হলো মায়া হল। কোন বাবা নিজের সন্তানকে স্বেচ্ছায় দুর্গতিতে নিক্ষেপ করলে পর সন্তানের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে দুঃখে কষ্টে যেমন বিগলিত হয়ে যায় স্রষ্টাও তেমনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলেন। তিনি দেখলেন মানুষ নামের এই দুপেয়ে প্রাণীটার গরু-মহিষের মত সিং নেই, বাঘ সিংহের মতো মাংসাশী দাঁত নেই, হাতির মতো সুর নেই, গন্ডারের মত পুরো চামড়া নেই, কুমিরের মত লেজ নেই, সাপের মতো বিষদাঁত নেই, নীল তিমির মত চুয়াল নেই তাহলে এই প্রাণীটা পৃথিবীতে টিকবে কি করে? ওকে তো বাঘ সিংহ খেয়ে ফেলবে, গরু মহিষ গুতা মেরে পেটে শিং ঢুকিয়ে দিবে, সাপ ছোবল মারবে, নীল তিমি গিলে ফেলবে, কুমির লেজ দিয়ে বাড়ি মেরে খেয়ে ফেলবে, হাতি শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে পায়ের তলায় পিষে ফেলবে।

আহ হা রে, এই দুপেয়ে প্রাণীটার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ও টিকে থাকার কোনো উপায় নেই। জীব জগতের মধ্যে এর মত দুর্বল আর কোন প্রাণী নাই। স্রষ্টা যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হলেন, আফসোস করলেন। কিন্তু পরক্ষনেই মুচকি হাসলেন, তারপর দু’পেয়ে মানুষের পিঠ চাপড়ে বললেন ‘চিন্তা করিস না আমি তোকে বর দিব। সেই অদৃশ্য বস্তুটা তোকে দিব, তখন তুইই হবি পৃথিবীতে একমাত্র বুদ্ধিমান জীব। বুদ্ধির জোরে তুই তামাম জীবজগতের উপর প্রভুত্ব করবি আর আমার প্রভুত্ব মেনে চলবি। তারপর স্রষ্টা মানুষকে বুদ্ধি নামক অদৃশ্য বস্তুটা উপহার দিয়ে পৃথিবীতে পাঠালেন। কিন্তু তিনি যে কত বড় ভুল করলেন সেটা বুঝতে তার বেশি সময় লাগল না।

মানুষ পৃথিবীতে এসে দেখল বিদ্যুৎ চমকায়। বিদ্যুতের আরবি প্রতিশব্দ বারক বা বোরাক। এই বোরাকের পিঠে চড়ে ভূপৃষ্ঠে স্রষ্টার প্রতিনিধি- নবীগণ চোখের পলকে উর্ধ্ব জগতে ভ্রমণ করেন। তা দেখে মানুষ হাসল, আবিষ্কার করল কনকর্ড ও সুপারসনিক প্লেন। তবে পার্থক্য এই যে, স্রষ্টা বিদ্যুত তথা বোরাকের শব্দ গোপন রাখলেন যাতে মানুষ এর শব্দ ও গতির অনুপাত বুঝতে না পারে। কিন্তু মানুষ প্লেনের শব্দ বাহ্য রেখে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল- দেখ শব্দের চেয়ে আমার সৃষ্টির গতি বেশি। মানুষ দেখল স্রষ্টা বজ্র নিক্ষেপ করে অবাধ্যদের শাস্তি দেন, জ্বালিয়ে পোড়িয়ে ভস্ম করে দেন। তখন মানুষও শত্রু শাসনের জন্য বুদ্ধি বলে আবিষ্কার করল এটম বোম। তারপর শত্রু হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দুইটা কবুতরের আণ্ডা নিক্ষেপ করে পৃথিবীর ইশ্বর ঊর্ধ্বে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল ‘লাখ খানেক বজ্র পাঠিয়ে চেষ্টা করে দেখো কার ধ্বংস ক্ষমতা বেশি।

মানুষ দেখল স্রষ্টা সূর্য সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় তাপ ও আলু দিয়ে দিবসের অর্ধেক আলোকিত করেছেন, বাকি অর্ধেক প্রকৃতির বিরামের জন্য রাতের আঁধারে ঢেকে দিয়েছেন। মানুষ বিদ্রোহ করল, অসম্ভব আমরা রাত্রি মানি না, আরেকটা সূর্য সৃষ্টি করব। তখন পরিবেশবিদরা সতর্ক করল, সাবধান চব্বিশ ঘন্টা তাপ ও আলো বহাল থাকলে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাবে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে, উপকূলবর্তী দেশগুলি তলিয়ে যাবে। আর অবশিষ্ট ভূখণ্ড মরুময় হয়ে যাবে, মনুষ্য বসতির অনুপযোগী হয়ে উঠবে। তখন পৃথিবীতে মানব সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

তখন মানুষ বললো তথাস্তু, আমরা রাতের অবয়ব ঠিক রেখে শুধু মনুষ্যাশ্রমে দিবসের আলো বিতরণ করব। বুদ্ধি বলে তারা আবিষ্কার করল বিজলি বাতি। এরপর তারা বলল ‘হচ্ছে না, বিজলি বাতি কেবল আবাসিক অঞ্চল আলোকিত করছে কিন্তু রাস্তা ঘাট আধারে ঢেকে থাকে। তখন তারা কৃত্রিম উপগ্রহের ন্যায় কৃত্রিম চাঁদ তৈরিতে আত্মনিয়োগ করল। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে এই কৃত্রিম চাঁদ প্রকৃত চাঁদের ন্যায় শিতল আলো বিতরণ করবে। প্রত্যেক দেশের আকাশে একটা করে চাঁদ থাকবে। আর তা হতে যাচ্ছে বলে।

অবশেষে মানুষের দৃষ্টি গেল তার নিজের উপর, তারা ঘোষণা দিল স্রষ্টা নয় আমরাই মানুষ সৃষ্টি করব। বুদ্ধির বদৌলতে তারা আবিষ্কার করল রোবট। কিন্তু তারা লজ্জিত হল এই জন্য যে, রোবট তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। তারপর তারা আবিষ্কার করল সবাক রোবট। তখন মক্কা-মদিনার গুরুরা হুঙ্কার ছাড়ল ‘কখনোই না। মানুষের সৃষ্টি কখনো স্রষ্টার সৃষ্টির সমান হতে পারে না। তখন রোবট সুফিয়া ক্ষেপে গেল, সে ধেয়ে গেল আরব মুল্লুকে। সেখানে ময়ূরের মতো পেখম খুলে সাজগুজ করে নেচে গেয়ে বাজিমাত করে ফেলল, সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। তখন গুরুরা হতবাক হয়ে ফিসফিসিয়ে পরস্পরে আলাপ করতে লাগল ‘একি কান্ড, এতো দেখছি মানুষ, মানুষের মত কথা বলে, মানুষের মতো আচরণ করে, খোদার সৃষ্টি আর মানুষের সৃষ্টির মধ্যে তো কোন পার্থক্য দেখছি না।

রাজা মশায় সুফিয়ার রূপে-গুনে মুগ্ধ হয়ে ঘোষণা করল ‘আমরাও মানুষ সুফিয়াও মানুষ, কাজেই আমাদের ন্যায় সুফিয়াকেও নাগরিকত্ব দিয়ে মনুষ্যত্বের দাবি পূর্ণ করা হবে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। আসলে রাজা মশাই সুফিয়ার রুপে পাগল হয়ে তার তার প্রেমে পড়ে গেছেন। তখন ঘটা করে তাকে স্রষ্টার পবিত্র দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হল। কিন্তু সুফিয়া কারো প্রেমে পড়ার মত মেয়ে নয়। (২০১৭ সালে সবাক রোবট সুফিয়াকে সৌদি আরব নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং বাংলাদেশে হাজার কোটি টাকা খরচ করে এর প্রদর্শনি করা হয়)।

স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিজের গুণ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে- যেমন স্রষ্টার বৈশিষ্ট্য হলো বড়ত্ব ও অহংকার। এজন্যই মানুষ অহংকার করে বড়ত্ব দেখায়। স্রষ্টা চায় মানুষ তাকে প্রভু মানবে, আনুগত্য করবে আর সর্বদা তার গুণকীর্তন করবে, নান্দী পাঠ করবে। মানুষের মধ্যেও এই প্রবণতা বিরাজমান। এ কারণেই মানুষ অন্যের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে চায়, পদানত করতে চায়। আর এজন্যই আলেকজান্ডার নেপোলিয়ন ও হিটলাররা পৃথিবীতে ধ্বংস আর আগুনের বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষকে পদানত করার জন্য, তাদের প্রভুত্বের আসনটি দখল করার জন্য পৃথিবীর বুকে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। কাজেই বুঝা গেল স্রষ্টার বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল। আর এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষ সৃষ্টি লীলায় স্রষ্টার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামল। তারা আবিষ্কার করল দ্রুতগতির বিমান, কৃত্রিম গ্রহ-উপগ্রহ, চোখের পলকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যোগাযোগের মাধ্যম। তারপর মানবাকৃতির রোবট সৃষ্টি করে তৃপ্তির ঢেকুর তোললো কিন্তু একটি ক্ষেত্রে তারা ভিরমি খেল, সে বিষয়টি হলো ঘুষ।



মানুষ দেখল পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু স্বাস্থ্যকর ও উপাদেয় খাদ্যটি হল ঘুষ। তখন মানুষ এর খাদ্যাভ্যাস শুরু করলো। আর অভ্যাসটা এতটাই সার্বজনীন হলো যে খাদ্যটির গাত্রদেহে লিখে দেয়া হলো যে, চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিবে। মানুষ ঘুষ খায় কিন্তু স্রষ্টা ঘোষ খায় না। তখন মানুষ চিন্তিত হলো দুঃখিত হল। তারা ভাবল এটা কি করে সম্ভব ঘুষের মতো এমন একটা উপাদেয় পুষ্টিকর খাবার শুধু তারাই খাবে আর স্রষ্টা বঞ্চিত হবেন- এটা মেনে নেয়া যায় না। অথচ গুণ-বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি লীলা সর্বক্ষেত্রে তারা স্রষ্টার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাফল্যজনকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শুধুমাত্র ঘুষের ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা হচ্ছে না, এটা মানুষ মেনে নিতে পারলো না। তারা চিন্তা করতে লাগলো কিভাবে স্রষ্টাকে ঘুষ খাওয়ানো যায়। কিন্তু বিষয়টা তাদের কাছে দুরূহ ঠেকল। কারণ সৃষ্টি লীলার ব্যাপার হলে কথা ছিল না, স্রষ্টার সৃষ্টি দেখে গবেষণা করে অনুরূপ আরেকটা জিনিস সৃষ্টি করে ফেলা যায়। কিন্তু ঘুষের বিষয়টা ব্যতিক্রম। কারণ স্রষ্টা থাকেন অদৃশ্যে, আর অদৃশ্য সত্তার হাতে কিভাবে ঘুষ পৌঁছে দেয়া যায়?

গবেষকরা যখন এ নিয়ে চিন্তা করতে করতে মাথা ছেড়ে দিল- তখন সহসা একদল লোক এগিয়ে এলো। ইহুদি আলেম আল্লামা হুজুর রাব্বিরা চেঁচিয়ে উঠলো ‘লাব্বাইক লাব্বাইক, আরে এই কাজের জন্য তো আমরাই আছি। স্রষ্টা থাকেন অদৃশ্যে যবনিকার আড়ালে। ঐ ওজুত কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে তিনি ঘুষ নিতে তোমাদের কাছে আসবেন না। এ কাজের জন্য তিনি ভূপৃষ্ঠে আমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি বা দালাল নিয়োগ করেছেন, তোমরা সৃষ্টার ঘুষ আমাদের কাছে নিয়ে আসবে আমরা তা বিনা খেয়ানতে সহি সালামতে স্রষ্টার হাতে পৌঁছে দেব আর তোমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে দেব। তোমাদের ধন-সম্পদ প্রাপ্তি, সন্তান প্রাপ্তি, প্রেমের বিজয়, ব্যবসায় সাফল্য, শত্রু ধ্বংস সব আমরা করে দেব। তোমরা স্রষ্টার জন্য ঘুষ নিয়ে আস। স্মরণ রাখবে মূল্যবান কোনো কিছু আদায় করতে হলে মানুষকে যেমন ঘুষ দিতে হয়, তদ্রুপ স্রষ্টাকেও ঘুষ বা হাদিয়া- উপঢৌকন দিয়ে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে হয়, ঘুষ ছাড়া তিনি এক পা-ও নরেন না।

ব্যস ঘুষের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠল। ইহুদিদের সাফল্য দেখে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মুসলমান সবাই স্রষ্টার ঘুষালয় নির্মাণে তৎপর হয়ে উঠলো। তারা দেখল বিনা পুজিতে এর চেয়ে লাভজনক ব্যবসা দ্বিতীয়টা নাই। এখানে শুধুই লাভ আর লাভ -লোকসানের কোন সম্ভাবনা নাই। কাজেই গড়ে উঠল গীর্জা প্যাগোডা মন্দির মাজার ইত্যাদি। এগুলি স্রষ্টার ঘোষ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করল। হতাশ বঞ্চিত ভুক্তভোগী মানুষ এসব ঘোষ কেন্দ্রে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, তারা স্রষ্টাকে ঘুষ দিয়ে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন ও মনোবাঞ্ছা পূরণের চেষ্টায় নামল। আর এইসব বঞ্চিত ভুক্তভোগী মানুষের সাফল্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে স্রষ্টার প্রতিনিধিত্বের আসন দখল করলো পৃথিবীর ঐসব অযোগ্য অথর্ব লোকেরা- এই পৃথিবীকে কোন কিছু দেয়ার মত যাদের কোন সামর্থ ও যোগ্যতা নাই। এরা স্রষ্টার প্রতিনিধি দাবি করল, বিনা পুজিতে ব্যবসা করল, স্রষ্টার নামে ঘুষ নিয়ে নিজের নামে ভক্ষণ করল, মানুষের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার নামে স্রষ্টার আসন দখল করল। এইভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল স্রষ্টার কোটি কোটি ঘুষ কেন্দ্র।

প্রথমাবস্থায় স্রষ্টা বিষন্ন হলেন, দুঃখিত হলেন। ফরমাবরদারদের আসরে গম্ভীর হয়ে বসে থাকেন, মাঝে মধ্যে আফসোস করে বলেন ‘আসলে আমি ভুল করেছিলাম। ভাবলাম যাদের শিং আছে লেজ আছে ওরা নিজের শক্তিমত্তা দিয়ে পৃথিবীতে চলতে পারবে। কিন্তু মানুষের শিং নাই লেজ নাই সে কিভাবে দুনিয়াতে চলবে, সে তো খুব দুর্বল প্রাণী। তাই প্রাণীটার উপর আমার মায়া হলো, তাকে বুদ্ধি নামক বস্তুটা দিলাম, আর এখানেই ভুলটা করলাম। কারণ যাদের লেজ শিং বাইরে ওরা ততটা ভয়ংকর হয় না কিন্তু যাদের লেজ শিং ভেতরে ওরা ভয়ংকর। মানুষের লেজ শিং ভিতরে, এজন্যই ওরা এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।

তবে এতদিন মানুষের প্রতি স্রষ্টার ক্ষোভটা শুধুমাত্র আফসোস আক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু যেদিন তিনি দেখলেন স্রষ্টাকে ঘোষ খাওয়ানোর জন্য মানুষ ঘুষোপসনালয় গড়ে তুলেছে। তারপর স্রষ্টার নামে ঘুষ নিয়ে নিজের নামে ভক্ষন করছে কিন্তু স্রষ্টাকে (দরিদ্র জনগোষ্ঠী) দিচ্ছে না, তখনই তিনি ক্ষেপে গেলেন, ভয়ংকর ভাবে রেগে উঠলেন। তিনি বজ্রনাদে ঘোষণা দিলেন ‘মানুষকে আর ছাড় দেয়া হবে না, এবার তাদেরকে ধ্বংস করা হবে। তারপর তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে এক নিভৃত গ্রহে তার সৈন্যবাহিনী গড়ে তুললেন, এই বাহিনীর নাম হলো এলিয়েন।

মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন বড় আকৃতি দিয়ে কিন্তু বুদ্ধি দিয়েছেন ফুটবলের মত মাথায় যতসামান্য- যার ওজন হতে পারে বড়জোর দশ বিশ গ্রাম। কিন্তু এলিয়েনকে সৃষ্টি করেছেন ক্ষুদ্রাকৃতি দিয়ে আর তার পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত সম্পূর্ণটা বুদ্ধি দিয়ে ভরে দিয়েছেন। মানুষের চেয়ে এলিয়েনরা লক্ষ কোটি গুণ বেশি বুদ্ধি ধারণ করে। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারা প্রভূত উন্নতি সাধন করলো, আবিষ্কার উদ্ভাবনে মানুষের চেয়ে পাঁচ কোটি বছর এগিয়ে গেল। এজন্যই এলিয়েনরা যখন কিছুদিন পর পর তাদের মহাশুন্যযান সসারে চড়ে চোখের পলকে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে মানুষের আবিষ্কার উদ্ভাবনগুলি পর্যবেক্ষণ করে নিমিষেই উধাও হয়ে যায- তখন মানুষ শুধু এক পলক দেখতে পায়, মহুর্তের শব্দ শুনতে পায়। তারপর আর কিছুই দেখে না।

তখন তারা এটাকে মনের ভুল ও চুখের ভ্রম ব্যাখ্যা করে আত্মপ্রসাদ লাভ করে মূলত আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হয়। কারণ মানুষ নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করলেও বস্তুতঃ সে মূর্খ। সে জানে না যে তাদের চেয়ে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী প্রাণীরা তাদের সকল কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে আর পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীকে ধ্বংস করার জন্য ভিনগ্রহে বসে বসে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে। তাদের বুদ্ধিমত্তা জ্ঞান বিজ্ঞান আবিষ্কার উদ্ভাবনের সাথে মানুষের কোনো তুলনাই চলে না। মানুষ জানে না যে তাদেরকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। কারণ মানুষের অগোচরে এলিয়েনরা পৃথিবীতে ঘাঁটি গেড়েছে, সেই ঘাটিতে বসে বসেই তারা মানুষ ও মানব সভ্যতা ধ্বংসের জন্য সর্বপ্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আর সেই ঘাটিটার নাম হল বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল।



যাই হোক, এই দীর্ঘ বয়ানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো স্রষ্টার ঘুষ। জাকির হোসেন জানত যে, সন্তান প্রাপ্তির জন্য শারীরিক কসরতই যথেষ্ট নয় স্রষ্টার নেক নজরও থাকতে হয়। তাই সে ঘুষ টুস দিয়ে স্রষ্টাকে বাগে আনার চেষ্টায় নামল। শুরু হলো পীর, দরগা, মাজার ইত্যাদিতে দৌড়াদৌড়ি। স্রষ্টার খাওয়ার জন্য গরু ছাগল কলা বিস্কুট ফলফলাদি যেমন মাজারের বারান্দা ভারী হয়ে উঠতে লাগলো তদ্রূপ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার প্রতিনিধি পীর বাবা কেবলা কাবাদের পকেটও ভারি হতে লাগলো। কিন্তু স্রষ্টা চোখ তুলে তাকালেন না। জাকির হোসেন আরও মরিয়া হয়ে উঠল, মসজিদ মাদ্রাসা ও দরগায় দান-খয়রাত বাড়িয়ে দিল। হুজুরদের দাওয়াত করে বাসায় এনে পেটের সাথে সাথে পকেটও ভরে দিতে লাগল।

যে যেখানে বলে সেখানেই যায়, পীর ফকির ওঝা বৈদ্য ডাক্তার-কবিরাজ সকলের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে, তেল পড়া পানি পড়া আনে। তাবিজ-কবজ আধুলি মাদুলি গাছের শিকড় দিয়ে জোবেদা বেগমের শরীরটা ভরে ফেলল। জোবেদা বেগমও সাগ্রহে সেগুলি গলা বাজু ও কোমরে ঝুলিয়ে রাখল। এভাবে তার শরীরটা তাবিজ-কবচের একটা ডিপুতে পরিণত হলো। যদিও সে এগুলি সর্বদা ঢেকে ঢুকে রাখে কিন্তু হঠাৎ কেউ দেখে ফেললে চোখ কপালে তুলে শুধায় ‘এসব কি আপনার? জুবেদা বেগম মুচকি হেসে বলে ‘কিছু না, ছোটবেলা থেকে সুন্দরী ছিলাম তো, জিন পরীদের দৃষ্টি ছিল তাই শরীরটা একটু বন্ধ টন্ধ করে রাখি, এই আর কি।

এইভাবে শারীরিক কসরত আর স্রস্টাকে ঘুষের কসরত করে করে অবশেষে ফলাফল এই দাঁড়ালো যে, আঠার বছরের দাম্পত্য জীবনে দশটা কন্যা সন্তান নক্ষত্রের মতো তাদের ঘর আলোকোজ্জ্বল করে তুলল। দশম বাচ্চাটা জন্মের সময় ঠা ঠা কান্না শুনে জাকিরের মনটা আনন্দে লাফিয়ে উঠল- নিশ্চয় এবারে ছেলে হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি দরজায় গিয়ে টোকা দিল। ভেতর থেকে দাই বেটির কন্ঠ ‘মা বাচ্চা ভালো আছে’ শুনে সে হেসে উঠল, কিন্তু ‘এবারও মেয়ে হয়েছে’ শুনে হাসিটা মাঝপথে আটকে গেলো, মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। এই যে তার মুখে হাসি আটকালো এরপর থেকে আর কোন দিন তার মুখে হাঁসি ফোটেনি। বেচারা একেবারে নির্জীব হয়ে গেল। কিন্তু এবার তার মধ্যে নতুন ভয় ঢুকল- তার চাকরিটা যদি চলে যায় আর মহল্লাবাসিরা যদি তাকে বের করে দেয়। চাকরিচ্যুতি আর এলাকা থেকে বহিষ্কারের চিন্তায় সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো।

কারণ সরকার বলছে ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট। এখন দশটি সন্তান পৃথিবীতে এনে জনবহুল দেশে গণ বিস্ফোরন ঘটিয়ে অন্ন ধ্বংস করার অপরাধে সরকার যদি তাকে পাকড়াও করে, চাকরিটা খেয়ে দেয় তখন কি হবে? আবার এলাকাবাসী যদি বলে ‘মিয়া খেয়ে দেয়ে কাম পাও নাই রাতদিন বউয়ের সাথে কাতুকুতু করে দশটা মেয়ে জন্ম দিয়েছো, এতগুলি মেয়েকে বিয়ে দিবে কোথায়? উপযুক্ত বয়সে এরা বর পাবে না তখন আমাদের ছেলেপোলের মাথাটা খাবে, মহল্লা নষ্ট করবে। কাজেই তুমি নিজে নিজেই এলাকা ছাড়বে নাকি আমাদেরকে হাত লাগাতে হবে? সে চেচিয়ে উঠে ‘না না না হাত লাগাইয়েন না’ কিন্তু সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ভয়ার্ত চোখে চারদিকে তাকায়, না কেউ নেই। সে আশ্বস্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তার মুখটা বিষন্ন হয়ে উঠেছে, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী বলে মনে হল। স্বগোতক্তি করল ‘আসলে আমার ফাঁসি হওয়া উচিত। দশটা মেয়ে জন্ম দেয়ার মত আকাম মানুষে করে নাকি? আর আল্লাহর প্রতিনিধি বেটারাও তো প্রতারনা করল, তারা ঘুষ নিয়েও কাজ করে দিল না।

বয়স আর কত হবে চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি। কিছুদিন আগে একটা চুলও পাকা ছিল না অথচ কয়েকদিনে অর্ধেক চুল পেকে গেছে। আগে তার চেহারা ছিল নায়কের মত সুদর্শন টানটান কিন্তু এখন চামড়া কুচকে যাচ্ছে, অশীতিপর বৃদ্ধের ন্যায় কপাল ও কপোলে গভীর বলি রেখা ফুটে উঠছে। আগে সে মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে হাঁটত কিন্তু এখন হিমালয়ের মত দশটি কন্যার চাপে পিট কুজো হয়ে গেছে, ঘাড় নত হয়ে এসেছে, তাকে মাথা নিচু করে হাঁটতে হয়। হেঁটে গেলে মনে হয় যেন রাস্তায় কিছু খুঁজে খুঁজে যাচ্ছে। চুল উঠে মাথার চান্দি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তার জীবনের সাধ আহলাদ আশা-আকাঙ্ক্ষা সব মরীচিকায় পরিণত হয়েছে। এখন মেয়েগুলির একটা সদ্গতি করে মরতে পারলেই জীবনের চাওয়া-পাওয়া সমাপ্ত হয়।

জাকির হুসেন আগে বিকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে কাটাত। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিত, মসজিদে সময় কাটাতো কিন্তু এখন নিজের হীনমন্যতার কারণে বন্ধু-বান্ধবদের থেকে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। আর বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যেও কেউ এমন হতভাগার সাথে গায়ে পড়ে ভাব জমাতে আসে না। এখন সে বাসাতেই সময় কাটায় এবং কাটাতে বাধ্য হয়। কারণ অর্ধেক মেয়ে এখনো ছোট, এদেরকে দেখাশোনা করার জন্য একের পর এক কাজের মেয়ে আনা হয় কিন্তু তারা পলায়ন করে। কারণ যেখানে একটা বাচ্চাকে রাখতেই একজন কাজের মেয়ের নাভিশ্বাস উঠে সেখানে মৌমাছির মত পাঁচ ছয়টা বাচ্চার আক্রমণে কাজের মেয়েরা কপোকাত হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করে। অগত্যা বড় তিন মেয়ের উপর বাচ্চাদের দায়িত্ব বর্তায়, এতে তাদের লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। এজন্য জাকির তাদেরকে বলে দিয়েছে, তোরা সকালে ও দিনের বেলা যতটুকু পারিস বাচ্চাদের দেখবি কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে পড়তে বসবি তখন আমি আর তোদের মা দেখাশুনা করব।

জাকির হুসেন বিদ্যুৎ অফিসের একজন কর্মকর্তা। আগে সে অফিসে রিকশায় আনাগোনা করত কিন্তু এখন হেঁটে আনাগোনা করে। কারণ একে তো তার সংসারি খরচ বেড়ে গেছে, দ্বিতীয়তঃ এখন আর সে নিজেকে মানুষ মনে করে না ইতর প্রাণী জাতীয় একটা কিছু ভাবে, নিজেকে নিজে হেয়জ্ঞান করে। এজন্য দরিদ্রের মতো হাটবাজারে ও অফিসে হেঁটে আনাগোনা করে। অফিস থেকে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়, বাসার কাছের মসজিদে নামাজটা পড়ে দোকানে ঢুকে। সেখান থেকে বাচ্চাদের বায়না মত বিস্কুট চানাচুর ফল ইত্যাদি নিয়ে দু-তিনটা পলিথিন ভর্তি করে মরার মত বাসায় ঢুকে। বাবাকে দেখেই ক্ষুদেগুলি বুভুক্ষু পক্ষি ছানার মতো ‘আব্বা এসেছে আব্বা এসেছে’ স্লোগান দিতে দিতে পলিথিনের ওপর হামলে পড়ে।

ইত্যবসরে বাবা বেচারা কাপড় চোপড় ছেড়ে এক কাপ চা ও দুয়েকটা বিস্কুট খায় কিন্তু বিশ্রাম করার সুযোগ তার ভাগ্যে নাই। খোদেগুলি একে অন্যের জিনিস নিয়ে টানাটানি করে, অন্যেরটা কেড়ে খায়, কেউবা নিজের বায়নার জিনিসটা না পেয়ে কান্না জুড়ে দেয়। তখন হৈচৈ ও কান্নাকাটির বাজার গরম হয়ে ওঠে। অগত্যা বাবা বেচারা দৌড়ে গিয়ে কোলে কাখে নিয়ে কান্না থামায়। তারপর মেঝেতে পাতা মাদুরের উপর বসে পড়ে। ক্ষুদেরা খাওয়া শেষ করে বাবার উপর হামলে পড়ে। দেড়-দুই বছর করে মাত্র ব্যবধান, পাঁচ ছয়টা ক্ষুদে পাহলোয়ান তাকে ঝাপটে ধরে, তার দেহটা হয়ে ওঠে তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু। কেউ মুখের উপর এত উঁচু খারা মাংসপিণ্ড দেখে অবাক হয়ে নাকে হাত বুলায়, তারপর ফুটোতে আঙ্গুল দিয়ে অন্ধকার মহাদেশ আবিষ্কারের আনন্দে হেসে উঠে। কেউ মাথার পাশে চাকতির মত অতিরিক্ত কিছু আবিষ্কার করে কানে হাত বোলায়, ফুটোতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে খলখল করে হাসে- যেন পৃথিবীর সুরঙ্গ পথ আবিষ্কার করে ফেলল।

কেউ বা মাথার চুল ধরে টেনে বাবার মুখের দিকে তাকায়, যেন জিজ্ঞেস করছে আরাম পাচ্ছ? কেউবা কোলে বসে হাগছে তো আরেকজন কাঁদে ওঠে মুতছে। এভাবে তারা বাবার দেহটা নিয়ে খেলায় মেতে উঠে। জাকিরও একান্ত অনুগত ভৃত্যের মত দেহটাকে ক্ষুদে খেলোয়াড়দের হাতে সমর্পণ করে দেয়। অসহায়ের মত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ‘নে প্রতিশোধ নে, এ দেহ থেকে এসেছিস এখন এই দেহের উপর প্রতিশোধ নে। পাড়িয়ে মাড়িয়ে ভর্তা বানিয়ে দে, একেবারে আলু ভর্তা বানিয়ে দে। পাপ যখন করেছি পাপের মাশুল তো দিতেই হবে। এভাবে সে অধিকারীদের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে, জন্মদান পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।

ইদানিং আবার নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছে। দশ নম্বরটা এতদিন মায়ের কোলে কোলে থাকত কিন্তু এখন তার নতুন হাত পা গজিয়েছে, হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। সে হামাগুড়ি দিয়ে বাবার রুমের দরজায় এসে দেখে তার অগ্রজরা অদ্ভুত একটা প্রাণী নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে। দেখে তার খুব আনন্দ হয়, একটা উচ্ছ্বসিত হাসি মেরে চার হাত-পা দ্রুত সঞ্চালন করে বাবার কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর অগ্রজদের সাথে খেলায় যোগ দেয়। কিন্তু কয়েক দিনেই তার বুদ্ধি পেকে যায়, ওয়েট বেড়ে যায়, আত্নসম্মান বৃদ্ধি পায়, সে বুঝতে পাড়ে বাবার তুলনায় তার মর্যাদা বেশি। কাজেই সে দরজায় এসে একটা হাসি দিয়ে নিচ দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করবে- বাবা এগিয়ে গিয়ে তাকে কোলে করে আনে কিনা। না গেলে দ্বিতীয় হাসি দিয়ে অপেক্ষা করবে। তারপর তৃতীয় হাসি দিয়ে অপেক্ষার পরও যদি বাবা না যায় তখন একেবারে লঙ্কাকান্ড। ফ্লোরে গড়িয়ে পড়ে চেঁচিয়ে কান্না শুরু করবে। তখন বেচারা বাবা দৌড়ে গিয়ে কোলে করে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

পিচ্চিটাকে খাওয়ানোর জন্য গিন্নি যখন এ ঘরে আসে তখন ক্লান্ত সুরে কর্তা বলে ‘আমারও তো জীবন এদেরকে একটু নাওনা। গিন্নি খেঁকিয়ে উঠে ‘তোমারটা জীবন আর আমারটা বুঝি তক্তা? দুই ঘণ্টায় হাঁফিয়ে উঠেছ তাহলে আমি চব্বিশ ঘন্টা সামলাই কেমনে? এখন নেয়ার কথা বলছো কেন, আগে কাতুকুতু করার সময় হুঁশ ছিল না? কর্তা মুখটা বিষ করে অপরাধীর মত মিনমিনিয়ে বলে ‘হাঁ এখন তো সব দোষ আমার, তখন যে আমাকে দেখলেই শুয়ে পড়তে সেটা তো বলবে না। এবার গিন্নির গলা সপ্তমে চড়ে, সে ঝাঁজিয়ে ওঠে ‘হ্যাঁ কবে আমি তোমাকে দেখে শুয়ে পড়েছি, ছেলের লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে কাতুকুতু করেছ আর এখন বুঝি আমার দোষ---- ব্যস শুরু হয়ে যায় কুরুক্ষেত্র কাণ্ড। তবে রক্ষে যে বড় মেয়েরা শুনতে পায়না, তারা তখন অন্য রুমে পড়ায় ব্যস্ত থাকে।

ক্ষুদে পাহলোয়ানরা রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত বাবার দেহ নিয়ে মজে থাকে। তারপর শুরু হয় তাদেরকে খাওয়ানোর পালা। খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে রাত বারোটা একটা বেজে যায় কিন্তু তাতেও নিষ্কৃতি নাই। কিছুক্ষণ পর পর এটা উঠে বলে আব্বু হাগমু, ওটা বলে আম্মু মুতমু। কিন্তু কর্তার প্রতি রাগে গিন্নি কখনো ওঠে না। অগত্যা বেচারা জাকিরকেই উঠতে হয়, এটাকে পায়খানা করিয়ে আনল তো আরেকজন মুতবে বলে জেগে উঠেছে। সেটাকে বাথরুম থেকে নিয়ে এসে দেখে আরেকজন পায়খানা করতে দাঁড়িয়ে আছে। ওটাকে বাথরুম করিয়ে এসে দেখে আরেকজন কিছু খাবে বলে জেগে উঠেছে। এভাবেই বেচারার রাত কাটে, তারপর শুরু হয় অফিসের ঘানি। বাসার পাটা আর অফিসের শিলের যাঁতাকলে পড়ে বেচারা জাকিরের জীবনটা মরিচের মত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এই হলো ছেলে প্রত্যাশী জাকিরের দিনপঞ্জি।



জাকির দম্পতি সুন্দর ও সুদর্শন। এজন্য তাদের মেয়েগুলিও হয়েছে যেমনি সুন্দরী তেমনি মেধাবী। কিন্তু ছোট গুলিকে সামাল দিতে গিয়ে বড় তিন মেয়ের সৌন্দর্য ও মেধা রসাতলে গেছে। বড় তিন মেয়ের নাম জাকিরা জাকিয়া ও জিনাত। তাদের ছোট দেড় দুই বৎসর ব্যবধানে পিটাপিটি সাতটা বোন, এই খুদে বিপ্লবীদের সামলাতে গিয়ে তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে। এতগুলি বাচ্চাকে একসাথে প্রতিপালন করা কোন দৈত্য দানবের পক্ষেও সম্ভব নয়। যাদের ঘরে এমন দু-একটি ক্ষুদে বিপ্লবী আছে তারাই বুঝতে পারে এ পঙ্গ পালের আক্রমণ কতটা ভয়াবহ। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুরু হয় খুদেদের হাগা-মুতা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি ও চেঁচামেচি। তখন দুইজন করে একসাথে বাথরুমে বসিয়ে দেয়া হয়, তারপর শুরু হয় খাদ্যভাণ্ডারের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ ও কামড়াকামড়ি। খাওয়া পর্ব শেষ করেই শুরু হয় পাহলোয়ানদের মধ্যে মারামারি ও খোঁচাখোঁচি।

মা ও তিন মেয়ে এই পিচ্চিগুলিকে সামাল দিতে দিতে একেবারে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে কাতর হয়ে পড়ে। কি করবে, কিইবা করার আছে? কাজের মেয়ে পাওয়া যায় না, খুঁজাখুঁজি করে আনলেও দুদিনের বেশি টেকে না, ক্ষুদে বাহিনীর আক্রমণে নাকাল হয়ে লেজ গুটিয়ে পালায়। কিন্তু তারা আর পালাবে কোথায়, পালাবার জায়গা তো নেই। দশটা পর্যন্ত ক্ষুদে মৌমাছিদের কামড়ে পুতুল নাচ নাচতে নাচতে বড় তিন মেয়ে দৌড়ে কলেজে যায়। দুপুর নাগাদ কলেজ থেকে এসেই আবার শুরু হয় কলুর বলদের ঘানি টানার কাজ। তখন পিচ্চিগুলিকে গোসল ও খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ করতে করতে বিকাল হয়ে যায়। বিকালে একেকজন দুইটা করে কোলে কাখে নিয়ে বাসার পাশের খোলা মাঠে ঘুরতে যায়। মাঠে গিয়ে বিপ্লবীদের ছেড়ে দেয়, তখন তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি ও খেলার প্রতিযোগিতায় নামে।

বড় মেয়েরা কখনো নিজেদের মধ্যে একটু আলাপের ফুরসত পায় না, এই সুযোগটা তারা কাজে লাগায়। একজন বলে ‘দেখ এমনিতেই বাংলাদেশ জনবহুল এলাকা, এর মধ্যে আবার আমাদের বাবা- মা জনসংখ্যা বিস্ফোরণের টিকাদারি নিয়েছে। আরেকজন বলে ‘তারা মেয়েদের মূল্যায়ন করে না, খালি ছেলে চায়। আর আল্লায় কয় রাখ মেয়েদের মূল্যায়ন করস না, দেখ তোদের থেকে কিভাবে মূল্য আদায় করি। এখন তারা মেয়েদের মূল্য আদায় করছেন। আব্বার চেহারা দেখেছিস, কিছুদিন আগেও কেমন জোয়ান নায়কের মত সুদর্শন ছিল, এখন মাথার অর্ধেক চুল পেকে গেছে শরীরটা বুড়িয়ে গেছে চেহারাটায় ভাঁজ পড়ে গেছে- যেন আশি বছরের বুড়া। আর আম্মার তো হাড়গুলি গুনা যায়। অন্যজন হেসে বলল ‘তোরা যাই বলিস আমাদের বাবা-মা কিন্তু কামিলা লোক, তাদেরকে কেউ অক্ষমতার অপবাদ দিতে পারবে না। আরেকজন হাসি চেপে বলল ‘আব্বা- আম্মার উচিৎ চালিয়ে যাওয়া, তাহলে ছেলেদের গরম বাজারে মেয়ে দিয়ে শান্তি স্থাপনের জন্য শীঘ্রই তারা শান্তিতে নোবেল পেতে পারেন। এভাবেই তারা হাসি মশকরা করে মা- বাবার প্রতি তাদের মনের ক্ষোভ ঝাড়ে। সন্ধায় পঙ্গপাল নিয়ে বাসায় ফিরে।

সময়টাকে তারা দুই ভাগ করে নিয়েছে। দিনের বেলা মেয়েরা পিচ্চি বিচ্ছু বাহিনির দারোগাগিরি করবে আর রাতটা মা-বাবার ভাগে। তারা সন্ধায় গিয়ে পড়তে বসে। তখন বিপ্লবী বাহিনী মা-বাবার উপর টর্নেডো ঝড় বইয়ে দেয়। এভাবে সর্বদা পঙ্গপাল সামলাতে সামলাতে অমানুষিক খাটুনি খেটে বড় মেয়েদের শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। মেয়েগুলি আগে ছিল লম্বাটে, কাঁচা হলুদ গায়ের রং, সুন্দর ছিমছাম স্বাস্থ্য, কটি অতিক্রান্ত কেশ বিন্যাস। পাত্রীর বাজারে এই মেয়েগুলির সর্বোচ্চ মূল্য থাকার কথা ছিল। কিন্তু পঙ্গপালের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে করে তাদের স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে, চোখ অনেকটা কোটরাগত। তদুপরি সার্বক্ষনিক কাজের চাপে তারা নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেয়ার ফুরসত পায় না। ফলে মেঘে ঢাকা চন্দ্রের ন্যায় তাদের হেমাঙ্গে মলিনতার ছাপ দৃশ্যমান, যুবতী সুলভ কোমলতা কমনীয়তা ও মোহনীয়তা ম্লান হয়ে গেছে। যেন একটা মিহি কৃষ্ণ আভা গৌরাঙ্গে আস্তর বিছিয়েছে, তাদের মেয়েলি আকর্ষণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

এছাড়া তারা ছিল প্রথম শ্রেণীর মেধাবী। জাকির হোসেনের ইচ্ছা ছিল মেয়েদেরকে মেডিকেলে পড়াবে। এজন্যই তাদেরকে সায়েন্স পড়িয়েছে কিন্তু কোথায় মেডিকেল? বেচারিরা বাসায় ঠিকমত পড়ার সুযোগ তো পায়ইনি এমনকি এডমিশন টেস্টের জন্য কুচিং পর্যন্ত করতে পারেনি। নিজে নিজে পড়েই তারা এডমিশন টেস্ট দিয়েছে। এরপরেও বড় মেয়ে জাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিল কিন্তু জাকির তাকে আনন্দমোহন কলেজে রসায়ন বিভাগে ভর্তি করেছে। কারণ সংসার ও ছোট বাচ্চা গুলোকে জাকিরাই দেখাশোনা করে। তাকে বাইরে পাঠালে সংসার অচল হয়ে যাবে। তাছাড়া এতগুলি মেয়ের ঘরে একজনকে ঢাকায় রাখার মতো খরচটাও চিন্তার বিষয়। কাজেই পরিবারের স্বার্থে বড় মেয়েকে বাসার বাইরে পাঠাতে সে সাহস পেল না। মেজ মেয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তৃতীয়টা ইন্টারে পড়ছে।

একটার পর একটা মেয়ে বড় হয়ে উঠছে আর জাকির দম্পতির মাথায় যেনো একের পর এক হিমালয় চেপে আসছে। গিন্নি তাড়া দিল আর কর্তা বড় মেয়ের বিয়ের জন্য তৎপর হল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের বলে বেড়াতে লাগল, ‘আল্লাহর রহমতে আমার মেয়েগুলি লক্ষী, যেমন সুন্দরী তেমনি মেধাবী ও শান্তশিষ্ট। একেকটা যেন সোনার প্রতিমা, ছেলেটেলে দেইখেন। সবাই কম বেশি মনোযোগ দিল, আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো। কিন্তু পাত্রপক্ষ যখনই শুনে দশ মেয়ে তখনই তারা সন্তুষ্ট হয়ে যায়, আর অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। কেউ কেউ না জেনে আসে কিন্তু মহল্লায় এসে যখন শুনে দশ মেয়ে তখন আর বাসায় গিয়ে জাকিরের ডাইনিং টেবিলের খরচটা বাড়াতে তাদের মন সায় দেয় না। কোন কোন পাত্রপক্ষ কারো কান মন্ত্রণা না নিয়ে সরাসরি বাসায় ঢুকে কিন্তু পঙ্গপাল দেখে তারা পালানোর পথ খুঁজে।

কেউ কেউ হাসিমুখে খাওয়া-দাওয়া করে গুমরাহ মুখে বলে ‘ঠিক আছে বেয়াই বা বিয়ান সাহেব, আপনার তো সবকিছুই ভালো মেয়েরাও সুন্দরী মেধাবী, এমন মেয়ে দেখে অপছন্দের কিছু নাই। আমরা বাসায় গিয়ে পরামর্শ করে আপনাকে সিদ্ধান্ত জানাব’ বলে তারা এত দ্রুততার সাথে দৌড়ে বেরিয়ে যায় যেন এই বুঝি পঙ্গপাল আক্রমণ করলো। তখন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জাকিরের বিশ্বাসটাও দৌড়ের উপর ওঠে। তবুও তো ধন্য আশা কুহকিনী- নিরাশ হতে নেই। সে আশায় বুক বাঁধে কিন্তু আশার সময় পেরিয়ে যায়, সিদ্ধান্ত আসে না। তখন সে লাজ্ব- লজ্জার মাথা খেয়ে বহু মহামূল্যবান সিদ্ধান্তটা জানার জন্য ঘটক পাঠায়।

ঘটক সিদ্ধান্ত নিয়ে আসে পঙ্গপালের ভিড়ে কেউ আসতে রাজি নয়। জাকির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসে তার হৃদপিণ্ড থেকে এক কেজি করে রক্ত শুকিয়ে যেতে থাকে, ত্বক কুঁচকে আসে, দৈনিক দশটা করে চুল পাকতে থাকে, সে বার্ধক্যের দিকে এগোতে থাকে। এভাবে কয়েকদিন পরপর বিয়ের আলাপ হয়, জোরা লাগে আর ভাঙ্গে। এরকম জোড়া ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে চলতে লাগলো কিন্তু কোনটাই আর বাজলো না। এখানে এলেই ছেলের বাবা- মায়েরা হঠাৎ সচেতন হয়ে যায়, ছেলের মত অমূল্য সম্পদ জন্মদানের গৌরবটা যেন তারা সহসা উপলব্ধি করতে পারে। আর সেই অমূল্য সম্পদ তারা যেনতেন জায়গায় বিকোতে রাজি নয়।

দেখতে দেখতে মেয়েগুলি কলমি লতার মত বেড়ে উঠছে, লাউ ডগার মতো লতিয়ে উঠছে। এখন জোবেদা বেগমের সামনে প্রায় আধা ডজন যুবতী মেয়ে ঘুরে বেড়ায়। জোবেদা এদের প্রতি তাকায় আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ধীরে ধীরে তার মাথা জ্বলন্ত উনুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। সময় গড়াতে থাকে কিন্তু কোনো পাত্র শিকার তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক সময় জোবেদা বেগমের মাথা সত্যি সত্যি গ্যাস চুল্লিতে পরিণত হল, সে নেছারাল স্বভাব-প্রকৃতি হারিয়ে ফেলল, সব সময় উত্তপ্ত হয়ে থাকে। কারণে অকারণে মেয়েদেরকে মারে গালাগালি করে ‘পোড়ার মুখিরা মরতে পারিস না, যম তোদেরকে চোখে দেখে না, ছেলেরাও তোদেরকে চোখে দেখে না যমও দেখেনা এখন কোথায় যাবি, নদীতে ডুবে মর গিয়ে। বেচারা জাকিরের ওপরও সে শুধু শুধুই হম্বিতম্বি করে, গালাগাল করে, মেয়েদের বিয়ে না হওয়ার রাগটা স্বামীর উপর ঢালে। কিন্তু জাকির এখন একেবারে মাটি হয়ে গেছে। সে জানে স্ত্রীর ভেতরের বাষ্পটা তার ওপর আর মেয়েদের উপর বাষ্পায়িত করতে পারছে বলে রক্ষে, নয়তো কবেই পাগল হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যেত। এজন্য সে বউকে কিচ্ছু বলে না, সবকিছুই মাটির মত সয়ে যায়।

ইদানিং একান্ত অপারগ হয়ে জোবেদা বেগম একটা নতুন গালি আমদানি করেছে। কথায় কথায় মেয়েদেরকে মারে আর গালি দেয়, ‘আজকালকার মেয়েরা কত চালাক কত টেলেন্ট, মা-বাপের দুর্ভোগ পোহাতে হয় না নিজেরাই পছন্দ টসন্দ করে বিয়ে করে সংসার পাতে। শিক্ষিতা মেয়েরা মা বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে না। কিন্তু এই পোড়ারমুখীরা এমনই অথর্ব যে একটা লাইন টাইন পর্যন্ত করার মুরোদ এদের নাই। মরন ছাড়া এগুলির হাত থেকে বাচার উপায় নাই। মায়ের কথা শুনে মেয়েরা কষ্ট পায়, নীরবে-নিভৃতে চোখের জল ফেলে। জাকিরা বুঝে কতটা অপারগ হয়ে মা এমন অশ্লিল কথা বলতে পারে- যে মা কোনদিন ছেলেদের সাথে মুখের কথাটাও বলতে দিন না। প্রেমের কথা শুনলে ঘৃণায় ছিটিয়ে উঠত, আজ সেই কিনা প্রেমের উপদেশ দিচ্ছে।

জাকিরা মায়ের অসহায়ত্বটা বুঝতে পারে, মায়ের কষ্টে সে কাঁদে, একান্ত অসহায় বোধ করে। নিজের জন্য সে চিন্তা করে না, বিয়ের প্রতি তার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চিরকুমারী থাকবে, একটা চাকরি বাকরি করে জীবন চালাবে কিন্তু বাবা-মা? তারা তো এটা মানবে না, বিশেষত নয়টি ছোট বোন তার ওপরই এদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। তার বিয়ে না হলে বাকীগুলিরও বিয়ে হবে না। কাজেই তার বিয়ে হতেই হবে, আর নিজের চিন্তা নিজেই করতে হবে। পথে-ঘাটে প্রেম প্রেম খেলা করে পাত্র শিকার করতে হবে। এবার সে চেষ্টায় নামল কিন্তু কী করে সম্ভব? সে হলো ভয়ংকর লাজুক, আজীবন ছেলেদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে, জীবনে প্রেম তো দূরের কথা কোন ছেলের সাথে ঠিকমত কথাও বলেনি। কিন্তু পিছালে তো চলবে না, একটা কিছু করতেই হবে। সে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে মাঠে নামল।



কিছুদিন পর জাকিরা কলেজ থেকে এসে হাসিমুখে মাকে বলল ‘আম্মা কাল দু’জন মহিলা আসবে। সন্তানের জীবনের প্রথম উপার্জন মায়ের হাতে দিলে মা যেমন প্রফুল্ল হয়- জোবেদা বেগমের মনটাও তেমনি প্রফুল্ল হয়ে উঠল, আনন্দে তার মুখটা চকচক করছে। সে বুঝতে পারছে এটা তার মেয়ের প্রথম কৃতিত্ব। তবুও জিজ্ঞেস করল ‘তোকে দেখতে? – হু। - ছেলে কি করে? - আনন্দমোহন কলেজ থেকে গণিতে মাষ্টার্স করেছে’ বলে লজ্জিত ও গৌরবময় ভঙ্গিতে সে চলে গেল।

মা ব্যস্ত হয়ে উঠল, প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করাল, বাসা সাফ সুতরোর দিকে মনোযোগ দিল, বিছানাপত্র পরিষ্কার করল। আগের ভুল সে আর করতে রাজি নয়। পরদিন সময়মতো প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম মেয়েকে পরিবেশনার জন্য রেখে বাকিগুলোকে এক রুমে ঢোকাল। পিচ্চিগুলিকে বড় মেয়েদের জিম্মায় দিয়ে বলল ‘সাবধান থাকবি, এরা যেন কান্নাকাটি না করে আওয়াজ না করে, মেহমানরা যেন তোদেরকে কোন ভাবেই টের না পায়। তারপর বাকি তিন বোন দামি নতুন জমকালো পোশাক পড়ে রেডি হয়ে বসে থাকল।

দুপুর নাগাদ ছেলের মা রাহেলা খাতুন ও ছোট বোন রিজিয়া খাতুন বাসায় এসে উপস্থিত হল। বাসা দেখে রাহেলা খাতুনের পছন্দ হলো না, প্রাচীন আমলের একতলা বাড়ি, অনেকগুলি রুম। তিনি মনে করেছিলেন চৌদ্দ তলা বাসা হবে, তার ছেলে সবটা না হলেও অন্তত অর্ধেকটার মালিক হবে। কিন্তু এই ভাঙাচোরা বাসা দেখে তার মন ভেঙ্গে গেল। জোবেদা বেগম তাদেরকে সবকিছু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাতে লাগল। বাসা দেখানোর কাজ শেষ করে বাইরে নিয়ে গিয়ে বলল ‘ওই যে বাউন্ডারি পর্যন্ত সবটা আমাদের জমি। রাহেলা খাতুনের চোখ এবার কপালে উঠল ‘এ বিশাল এরিয়া সবটা আপনাদের? ‘হাঁ আল্লাহর রহমতে আমাদের’ জোবেদা হাসিমুখে উত্তর দিল। সাথে সাথে রাহেলা অংকটা কষে ফেলল ‘দেখা যাচ্ছে তিনটা মেয়ে। তাহলে আমার ছেলে এই বিশাল জমিটার তিন ভাগের একভাগ পাবে। তখন আর শশুরের বাসার দরকার কি, আমার ছেলে নিজেই এখানে বাসা টাসা করে ভাড়া টারা দিতে পারবে, রাজার হালে তার জীবনটা কেটে যাবে।

মেয়েও সুন্দরী ও শিক্ষিতা, বিশাল সম্পদও পাওয়া যাচ্ছে। নিশ্চয়ই তার ছেলে ভাগ্যবান। সহসা তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আনন্দাতিশয্যে প্রগলভতা শুরু করল ‘আরে বিয়াইন শুনেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কত আধুনিক আর কত পাকা, তারা মা-বাপের ওপর কোন চাপ দেয় না, নিজেরা নিজেরাই পছন্দ করে নেয়। আসলে তারা তো শিক্ষিত বুদ্ধিমান আধুনিক ও ট্যালেন্ট, তাদের রুচিও উন্নত। আমরা হলাম ভাই ওল্ড মডেলের প্রাচীন মানুষ, আমাদের রুচিও ওল্ড। তাই আমাদের রুচির সাথে তাদের রুচি মিলবে কেন? এজন্যই ভাই, আমি তাদের পছন্দকে সম্মান করি, আমাদের উচিত তাদের পছন্দের স্বীকৃতি দেয়া, আপনি কি বলেন? প্রশ্নটা সে প্রতিপক্ষের দিকে ছুঁড়ে দিল বিয়ে সম্পর্কে তাদের মতামত জানার জন্য।

জুবেদা বেগম বললো ‘ঠিকই বলেছেন বিয়াইন, তাদের পছন্দের স্বীকৃতি না দিলে পরবর্তীতে যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে তারা অভিবাবকদের দোষারোপ করবে। রাহেলা খাতুন বুঝল প্রতিপক্ষের সম্মতি আছে। সে আনন্দে আরো আত্মহারা হয়ে গেল, অবিরত হাসছে আর এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। রিজিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে, কখন জানি থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে আর তার মায়ের আসল চেহারাটাও প্রকাশ পেয়ে যায়। তাই সে মাকে তাড়া দিল ‘মা দেখলেই তো আর কত এবার চল। কিন্তু মা অতি আনন্দে হাসতে হাসতে রুমে রুমে ঘুরে ফিরে দেখতে লাগল।

তবে বন্ধ দরজার কাছে যেতেই জুবেদা বেগমের দম আটকে গেল, তাড়াতাড়ি রাহেলার হাত ধরে বলল ‘বেয়াইন চলেন তো আগে চারটে ডাল ভাত মুখে দিয়ে তারপর দেখাশোনা করেন’ বলে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। রাহেলা খাতুন যেতে যেতে বলল, আরে খাবোই তো, সবে তো মাত্র শুরু, প্রতিদিন আসব প্রতিদিন খাব, খেয়ে খেয়ে আপনাকে ফতুর করে তুলব। তারপর হাসতে হাসতে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসল। আইটেম দেখে বুঝল তার বেয়াই আসলেই বড় লোক এবং ভদ্রলোক। আত্মীয়তা হলে আশ মিটিয়ে খাওয়া যাবে। তারা খাওয়া শুরু করল।

ওদিকে পিচ্চিগুলি অনেকক্ষণ ধরে একই রুমে আবদ্ধ থেকে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে, গুনগুনিয়ে কান্না শুরু করল। বড়রা থামাতে চায় কিন্তু বাচ্চাগুলি আরো জোরে কাঁদে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমটাতে হৈ চৈ ও কান্নার রুল পড়ে গেল। শব্দ পেয়ে রাহেলা খাতুন সন্ধিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করল ‘কান্নার আওয়াজ আসে কোত্থেকে, বিয়াই আপনার কয় পোলাপান? জাকির ভাবল পোলাপানের সংখ্যা সম্পর্কে এমনিতেই মিথ্যে বলা যায় না, তার ওপর ছেলে মেয়ে পরস্পরকে পসন্দ করে, বুঝা যাচ্ছে বিয়ে পাকাপাকি। ছেলের মা সম্মত ও সন্তুষ্ট, এখন আর সত্য বলাতে কোনো সমস্যা নাই।

তাই সে কৌতুকের সুরে বলল ‘আরে বিয়াইন আল্লায় যারে দেয় ছাপ্পর মাইরা দেয়, আল্লাহ আমারে আদর কইর্যার দশটা জান্নাত দিছেন। রাহেলা মাত্র লোকমাটা মুখে দিতে যাচ্ছে কিন্তু দিল না, মুখটা হা করেই রইলো, কিছুক্ষণ বজ্রাহতের ন্যায় হতভম্ব হয়ে বসে রইল। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল ‘তার মানে দশটা মেয়ে? জাকির নিজের বোকামির কারনে ততোধিক হতভম্ব হয়ে রাহেলার মুখের দিকে বিষন্ন হয়ে তাকিয়ে রইল। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য ঠোঁট কামড়াল কিন্তু কোন উত্তর দিল না। জোবেদা ক্রোধে বিস্ফারিত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে।

দেরিতে ঘুম থেকে উঠে জরুরি কাজের জন্য মানুষ যেমন লাফিয়ে উঠে রাহেলাও তেমনি লাফিয়ে উঠে হাত ধুতে ধুতে বলল ‘সর্বনাশ আমার তো খেয়ালই ছিল না, বাসায় জরুরি কাজ আছে এখনই না গেলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে’ বলে সে মেয়েকে তাড়া দিল। কিন্তু মেয়ে গম্ভীর হয়ে নতমুখী হয়ে খেয়েই যাচ্ছে, মেয়ের বোকামি দেখে মায়ের পিত্তি জ্বলে গেল। প্রচন্ড রাগে গৃহস্বামীর অগোচরে মেয়ের পাঁজরে গুতা মেরে বলল ‘তাড়াতাড়ি উঠ। মেয়ে বুঝলো এখন না উঠলে কপালে দুঃখ আছে। তারপর মা মেয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল ‘আসি বিয়াইন পরে আলাপ হবে, সময়মতো আসবো ইনশাল্লাহ। তারা বেড়িয়ে গেলে জুবেদা আর উঠতে পারল না, চেয়ারের উপর তার দেহটা গড়িয়ে পড়ল। জাকির হোসেন কোন রকমে টলতে টলতে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। মেয়েরা নিজ নিজ রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে লাগল। ওদিকে পঙ্গপাল দীর্ঘসময় পর মুক্তি পেয়ে বাসাটা মাথায় তুলে নিল।

রিকশায় যেতে যেতে মেয়ে মাকে বলল ‘আম্মা কাজটা কিন্তু ভালো হয়নি, মেয়েটা সুন্দরী ও শিক্ষিতা। অবস্থা ব্যবস্থাও ভালো, লোকগুলোও ভালো ভদ্রলোক। এছাড়া তারা তো একে অন্যকে পছন্দ করে। কাজটা হলেই তো ভালো হতো। ঢাস করে মেয়ের গালে এক চড় মেরে রাহেলা চেঁচিয়ে উঠল ‘আসলে তোরা ভাই বোন দুইটাই বাপের মতো ভ্যাবলা আঁতেল হয়েছিস। এখন আমি বুঝতে পারছি তোদের সব কিছুই জানা, তিনজন মিলে ষড়যন্ত্র করে আমাকে এখানে পাঠিয়েছিস। আজ বাসায় যাই তোদের বিচার না করলে আমার মনের খেদ মিটবে না। তোদের তিন বাপ বেটা বেটিকে যদি আমি বাসা থেকে বের করে না দেই তাহলে আমি লইত্যা (লতিফ) তালুকদারের মেয়ে না।

মেয়ে মুচকি হেসে বললো ‘ঠিকই তো, তুমি কোন তালুকদারের মেয়ে না। মা রক্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকাল। মেয়ে ভড়কে গিয়ে বললো ‘না মানে আমি বলতে চাচ্ছি তুমি তো আমার মেয়ে। এবার মায়ের রাগ পানি হলো, তারপর শান্ত গলায় বলল ‘আরে বোকা শুন ঐ লোকের দশটা মেয়ে আর এই মেয়েটাই বড়। ওকে বিয়ে করানোর অর্থ হলো রাসেলকে এই পরিবারে বিক্রি করে দেয়া। নয়টি শালির দেখাশুনা, বিয়ে-শাদী নাইয়র ইত্যাদি সকল দায়িত্ব আমার ছেলেকে পালন করতে হবে। তারপর মরা পর্যন্ত বুড়া বুড়িকে টানতে হবে। তখন আমার ছেলের জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাবে, জীবনে না পারবে সুখের মুখ দেখতে আর না পারবে উন্নতি করতে। সবকিছু শালীদের পেছনে ঢালতে হবে। ভাবতেও অবাক লাগে, জেনে শুনে আমার ছেলে এমন বুকামি কাজ কি করে করতে পারে, আর তুই ও তোর বাপ এটা কি করে মেনে নিলি? তাও আবার আমার কাছে গোপন করে আমাকেই আসতে বাধ্য করলি। ঠিক আছে আগে বাসায় যাই তারপর হবে বিচার।

রাহেলা বেগম এমনিতেই রগ চটা। তার উপর বাপের জমিতে বাসা করার সুবাদে তার মেজাজ সর্বদা সপ্তমে থাকে। তার দাপটে স্বামী ও সন্তানরা সর্বদা তটস্ত থাকে। মায়ের কড়া শাসনে ছেলে মেয়ে দুজন ক্রমে ক্রমে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরতে থাকে আর বাপের ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। এক সময় দেখা গেল একই ছাদের নিচে বিপরীতমুখী দুইটা পক্ষ তৈরি হয়ে গেল। বাপ বেটা বেটি মিলে এক পক্ষ, আর গৃহকর্ত্রী একা এক পক্ষ। কিন্তু একা হলে কি হবে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ আর অহংকারের সামনে প্রতিপক্ষরা নিরেট জি হুজুরী মুসাহেবে পরিণত হলো। কথায় কথায় তিনি স্বামী সন্তানকে তার কোমরের জোর স্মরণ করিয়ে দেন- বাসাটা তার জমিটা তার বাপের।

নিতান্ত অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বাপ বেটা বেটির জোট গড়ে ওঠে। গিন্নির দাবানল থেকে বাঁচতে একান্ত অসহায় হয়ে কর্তা বেটা বেটির আশ্রয় গ্রহণ করে, আবার বেটা বেটিও মায়ের স্টিম রোলার থেকে বাঁচতে বাপের ডানার নিচে আশ্রয় নেয়। প্রথমত যদিও অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তাদের জোটটা গড়ে উঠেছিল কিন্তু কালে তারা বন্ধুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এখন আর তারা শুধু বাপ বেটা বেটি নয়, নিরেট বন্ধু, খেলার সাথী আড্ডার সাথী।



মাকে কন্যা দেখতে বিদায় করে দিয়ে রাসেল বাপকে জড়িয়ে ধরে একটা চুম্বন করে চেঁচিয়ে উঠলো ‘ওমঃ আব্বা, যা একখান কাজ করলা এক্বেবারে সহোদর বাপের মতো কাজটা করলা। তোমাকে একখান পুরস্কার দিতে হবে। রফিক সাব বলল ‘দুঃ বোকা, তুই তো দেখছি তোর মায়ের চেয়েও বোকা। বাপ কখনো সহোদর আর পরোদর হয় নাকি। বাপ হয় সৎ অথবা---- সে চিন্তা করল কিন্তু পরিভাষাটা খুঁজে পেল না। ছেলেকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা মায়ের সতীন যদি সৎ মা হয় আর বাপের সতীন যদি সৎ বাপ হয় তাহলে আসল মা বাপকে কি বলা হবে? ছেলে বলল, ‘কেন, অসৎ মা অসৎ বাপ। এবার বাপ শিক্ষিত ছেলের যথার্থ উত্তর শুনে গর্ব বোধ করল। তারপর বলল, তাহলে আমি কি তোর সৎ বাপ নাকি অসৎ বাপ? - আরে দুঃ তুমি বাপ হতে চাও কোন দুঃখে, তুমি আমার বন্ধু।

বাপ বলল ‘আচ্ছা যা ঠিক আছে তোর মা যখন বাসায় থাকে তখন আমরা বাপ বেটা কিন্তু বাসায় না থাকলে বন্ধু। এখন বল কি পুরস্কার দিবি? - তাই তো ভাবছি কি পুরস্কারটা দেয়া যায়। - আরে শুন এত ভাবতে হবে না, তোর শ্বশুরের বাসা তো ব্রহ্মপুত্র নদীর কিনারে, আমাকে প্রতিদিন তোর শাশুড়িকে নিয়ে নদীর ধারে একটু হাঁটাহাঁটির সুযোগ দিস, আর কোন পুরস্কার দিতে হবে না। - না না বুড়া বয়সে এসব ভালো নয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তা ছাড়া লোকে মন্দ বলবে, তার উপর আম্মার বাঁশ তো আছেই। বাপ চেঁচিয়ে উঠলো ‘আরে রাখ তোর বুড়া, আমি কি বুড়া হয়ে গেছে নাকি? একটা বিয়ে করিয়ে দেখ তোর মত ছেলে কয়টা জন্মাতে পারি। এভাবে বাপ বেটা আড্ডায় মেতে উঠল। হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় বাপ উঠে গিয়ে নিজ হাতে কফি বানিয়ে এনে এক কাপ ছেলেকে দিল আরেক কাপ নিজে নিল।

তারপর আবার আলাপে মশগুল হল। বাপ বলল, কিন্তু তোর মা যখন শুনতে পারবে মেয়েরা দশ বোন তখন তার মুখের অবস্থাটা নিশ্চয় দেখার মত হবে’ বলে সে অট্টহাসি দিয়ে উঠলো কিন্তু হাসির মধ্যে তার মুখটা আটকে গেল, চেহারাটা বিকৃত হয়ে গেল। কারন সেই মুখটা তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে, দাঁত খিঁচিয়ে আছে। রফিক সাব হা করা মুখটা বন্ধ করে লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে দৌড়ল। রাহেলা খাতুন খপ করে তার জামা ধরে বলল ‘মুখটা না দেখে আগেই যাচ্ছো কোথায়? ‘আরে ছাড় কাপড় নষ্ট হয়ে গেলো তো’ বলে সে জামা ফসকে বাথরুমের দিকে দৌড় দিল।

এবার রাহেলা ছেলের উপর হামলে পড়ল ‘হারামজাদা আক্বেলের ঢেকি, খাইয়ে-দাইয়ে সিয়ান করছি, শিক্ষিত বানাইছি দশ বোনের গোলামী করার জন্য, রাম ছাগল কোথাকার বাপের মতো গাধা হইছস? আমি না থাকলে তোর বাপের গাছ তলায়ও ঠাই হত না, কুরা খেয়েও দিন পার করতে পারতো না। তিন টাকা মাইনের কেরানি রাজ প্রাসাদে থাকার ভাগ্য জুটত না। আসল কথা না জানিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র করে পাঠালি কেন, যেখানে দশটা ধেমরি চেমরি আছে সেখানে কোন আক্কেলে আমাকে পাঠালি’ বলে ছেলেকে উত্তম-মধ্যম শুরু করল।

রফিক সাব বাথরুমে দাঁড়িয়ে কাঁপছে আর কান খাড়া করে শুনছে। গ্রাম অঞ্চলের মেয়েরা ঢেকিতে চিড়া কুটলে যেমন ধুপ ধুপ শব্দ হয় তেমনি শব্দ আর ছেলের চিৎকার ভেসে আসছে ‘ও বাবা গো বাঁচাও, ও আব্বা গো বাচাও, গেলাম গো মরলাম গো-- রফিক সাব দৌড়ে এসে স্ত্রীর হাত ধরে বলল ‘আরে আরে ছেলেটাকে মেরে ফেলবে নাকি, ও বিয়ে না করতে চাইলে এত জোরাজুরির কি দরকার, আমি তো আছিই আমাকে করাও। রাহেলা থমকে দাঁড়াল, অগ্নিদৃষ্টি হানল, তারপর খপ করে এক হাতে বাপের গর্দান অন্য হাতে ছেলের গর্দান ধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল, বের হও এখনই আমার বাসা থেকে বের হও, এটা কারো পিন্ডির কামাই না এটা আমার বাপের বাসা, আমার বাপ আমাকে লেখাপড়া করে দিয়ে গেছেন। আমার বাসায় কোন ভ্যাবলা চ্যাবলার জায়গা নাই। এখন থেকে বাইরে থাকতে হবে, ব্যাংকে কাজ করবে তারপর বাপ বেটা হোটেলে খেয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকবে’ বলে ঘাড় ধরে জোরে ধাক্কা মেরে এগিয়ে দিয়ে হনহন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেল।

ছেলে করুন দৃষ্টিতে বাপের মুখের দিকে তাকাল। বাপ বলল ‘কি আর করা যাবে মহারানী ভিক্টোরিয়ার হুকুম তো আর অমান্য করতে পারবি না, চল দেখি ভাগ্যের সন্ধানে নামি। তারা বাইরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। রিজিয়া আগেই জানে আজ বাসায় ভানু মতির খেল জমবে, তাই সে নিজের রুমে গিয়ে শ্রুতি বাইরে পাঠিয়ে দৃষ্টি পত্রিকার পাতায় গেথে দিয়ে চুপটি মেরে বসে রইল। বাপ বেটা গেইটের কাছে যাবার আগেই রাহেলা দৌড়ে গিয়ে গেইটে তালা লাগিয়ে বললো ‘কোথাও যাওয়া যাবে না। বাইরে গিয়ে আমার বদনাম করার জন্য আর কেলেঙ্কারি করার জন্য? সারাজীবন ওই বারান্দায় পড়ে থাকতে হবে’ বলে ঝংকার মেরে চলে গেল।

আসলে এটা তার কমন নিয়ম, মান-অভিমানের সময় সে এই বুলিটা আওড়ায়। যদিও বাপ ব্যাটাকে কোনদিন বাইরেও রাত কাটাতে হয়নি আর তারা কোন বদনাম বা কেলেঙ্কারিও করেনি। ছেলে বাপের মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ‘আব্বা ঘরেও জায়গা নাই বাইরেও জায়গা নাই এখন তো দেখছি স্বর্গে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই। বাপ বলল ‘দূঃ বোকা এ বয়সে এখনি স্বর্গে যাবি কেন, বয়স হলে তো যাবিই আপাতত স্বর্গের চিন্তা বাদ দিয়ে মর্তের চিন্তা কর। চল বারান্দায় গিয়ে বসি।

তারপর দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে তারা বারান্দার এক কোনায় বসে আলাপে লিপ্ত হল। বাপ বলল ‘আসলে কি জানিস তুইও তোর মায়ের মতো গর্ধভ, নইলে দশটা মেয়ের ঘরে তাও আবার বড় মেয়ের সাথে প্রেম করতে যাবি কোন দুঃখে, বোকা না হলে কেউ একপাল পেত্নীর বুঝা বহন করতে যায়? আমার মত বুদ্ধিমান হতে পারলি না, এই যে দেখ লইত্যা তালুকদারের মতো বড় লোকের মেয়ের সাথে প্রেম করেছিলাম বলেই তো আজ এত সুন্দর বাসায় থাকতে পারছিস। নইলে আমার মত তিন টাকার ব্যাংক কেরানির পক্ষে শহরের প্রাণ কেন্দ্রে এত দামি জায়গা কিনে বাসা করা কি সম্ভব ছিল?

ছেলে রেগে উঠল ‘তুমিও আম্মার বড়াই শুনে শুনে আবার মিছা কথা শুরু করলে, আমার নানা কোন তালুকদারও ছিলেন না বড়লোকও ছিলেন না সাধারণ মানুষ ছিলেন। তাঁর দুইটা মাত্র মেয়ে, বাড়ীটা ছোট খালাকে দিয়ে গেছেন আর এই জায়গাটা আম্মাকে দিয়ে গেছেন, এটুকুই ছিল তার সম্পদ। আর তুমি কোন প্রেম টেম করনি দাদা তোমাকে বিয়ে করিয়ে ছিলেন। বাপ গলা টেনে বললো ‘না মানে প্রেমটা ঠিকই হয়েছিল তবে বিয়ের পর, এই আর কি। আচ্ছা বাদ দে, এখন বল দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে তুই কন্যা কারখানায় প্রেম করতে গেলি কেন?

ছেলে হেসে বলল ‘তুমিতো দেখছি আম্মার চেয়ে আরো বোকা। তুমি তো জানোই যে মেয়েদের দেখলে আমার হাঁটু কাঁপে শরীর ঘেমে যায় গলা শুকিয়ে যায় পেটে পানি না থাকলেও পেশাবের বেগ বেড়ে যায়। একবার মনে আছে গ্রন্থমেলায় গেলাম, তখন ঐশ্বরিয়া মার্কা ইয়া পেল্লায় চেন্নাই সুন্দরী একটা মেয়েকে দেখিয়ে তুমি বললে ‘দেখত মেয়েটাকে চোখে বাজে কিনা? আমি দেখলাম চোখেও বাজল। তখন আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললে ‘যা লাইন লাগা গিয়ে তাহলে তোদের মাধ্যমে আমি মেয়েটার মা পর্যন্ত পৌঁছতে পারব, তখন বাপ বেটা দুজনেরই একটা গতি হবে, তার মাও নিশ্চয় সুন্দরী হবে।

তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দিলে আর সাথে সাথে শুরু হল আমার হাঁটুর কাঁপুনি, প্যান্ট ভিজে যেতে লাগল। তুমি আমার হাঁটু চেপে ধরে বললে ‘আরে রাখ রাখ কি করিস কি করিস কাপড় নষ্ট করিস না, তোর আর প্রেম করতে হবে না যা করার আমিই করব, চল বাসায় চল। এই হলো আমার অবস্থা, তাহলে আমি প্রেম করেছি এ কথা বল কেমনে? বাপ বিস্মিত সুরে বলল ‘তাহলে প্রেমটা হলো কি করে? ছেলে বলল ‘তুমি তো জানোই গণিতের মত একটা কাঠ খোট্টা বিষয় নিয়ে পড়ে থেকে আমি দুনিয়ার কিছুই জানতাম না বুঝতাম না। ছেলে- মেয়েরা একসাথে আড্ডা মারে, প্রেম করে আরো কত কিছু করে কিন্তু আমি আমার মত একাকি পরে থাকতাম। কোন ছেলে বা মেয়ের কাছেও ঘেষতাম না। আমার লজ্জা লাগতো ভয়ও পেতাম।

ঐ মেয়েটাও ছিল আমার মতই, কোন ছেলে তো দূরের কথা মেয়েদের আড্ডায়ও যেত না। ওকে দেখতাম কয়েকটা বোরকাওয়ালী মেয়ের সাথে আনাগোনা করত। হঠাৎ একদিন সে আমাকে বলল ‘রাসেল ভাইয়া আপনিও বুঝি আমার মত লাজুক, আমারও এসব আড্ডা ফাড্ডা ঘোরাফেরা ভাল্লাগেনা। আপনারও বন্ধু নাই আমারও বন্ধু নাই চলেন অবসর সময়টা আমরা আলাপ করে কাটাই। এরপর থেকে মেয়েটাই উপযাচক হয়ে আমার সাথে কথা বলতো, যা বলার সেই বলতো আমার মুখে কথা ফুটত না, আমি শুধু ভ্যাবলার মত গলা টানতাম। মাঝে মাঝে সে আমাকে এটা ওটা কিনে খাওয়াত কিন্তু নিজে খেত না। বুঝতাম মেয়েটা হয় হিসাবি নয়তো দরিদ্র ঘরের সন্তান। নিজের হাত খরচার টাকা থেকে সে আমাকে খাওয়াত।

ততদিনে আমি একটু স্বাভাবিক হয়ে এসেছি মেয়েদের সম্পর্কে আমার আড়ষ্টতা কেটে যাচ্ছে। একদিন তাকে বললাম ‘চলো না নদীর ধারে ঘুরতে যাই। সে লজ্জিত ভাবে বলল ‘এখন না বিয়ের পরে। এরপর থেকে সে আমাকে বিয়ের জন্য তাগাদা দিতে লাগলো আর আমিও এসে তোমাকে বলতাম। তারপর যা করার তো তুমিই করলে। আসলে কি জানো মেয়েটা খুবই ভালো, ওর জন্য আমার মনটা পোড়ায়। বাপ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থেকে বললো, কি করবি বল এই মেয়ের সাথে তো তোর বিয়ের কোন উপায় দেখছি না। এই বিয়ে তোর মা তো মেনে নিবেই না, এমনকি আমরা চাইলেও নিশ্চিত জানিস তোকে আর আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে এবং মেয়েটাও এই বাসায় এসে থাকতে পারবে না। কাজেই অগত্যা এই মেয়ের চিন্তা বাদ দে।

তারপর আবার তাদের স্বভাবসুলভ কৌতুকরস শুরু হলো। বাপ বলল ‘শুন আর বোকামি করবি না এখন থেকে খুঁজবি বড়লোক বাপের একমাত্র কন্যা, একমাত্র না পেলে বড়জোর দুই মাত্র- এর বেশি না। তারপর ছুটিয়ে প্রেম লাগাবি, বাকি দায়িত্ব আমার। পুত্র বলল ‘বাকী দায়িত্ব তোমার বুঝলাম কিন্তু আসল দায়িত্বটাই তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মেয়েদেরকে দেখলে আমার লজ্জা লাগে, অবশ্য এর মধ্যে ভয়ও থাকে। বাপ কৃত্রিম শাসিয়ে উঠলো ‘দুঃ ছাগল তুই তো দেখছি তোর মায়ের চেয়েও অথর্ব। আচ্ছা ঠিক আছে তোকে কিছুই করতে হবে না যা করার আমিই করব তুই শুধু টার্গেট নিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিস। তবে আমার একটা শর্ত আছে।

পুত্রধন বলল ‘কি শর্ত? বাপ বলল ‘বিধবা ও একটু কম বয়সী মহিলার মেয়ে টার্গেট নিবি। ছেলে গরম হয়ে বলল ‘কেন? বাপ অনুযোগের সুরে বলল ‘দেখিস না তোর মায়ের বাঁশ খেতে খেতে আমার জীবনটাই বাসমতি হয়ে গেছে, এখন তোর উসিলায় যদি একটা সুমতি পাই। - কি বললে রাখ আমি এখনি আম্মাকে বলে দেব। - না না কইস না কইস না। একবার মনে আছে একটা মহিলার মেয়েকে দেখিয়ে বলেছিলাম দেখতো চোঁখে বাজে কি না? তুই বললি হা চলে। আমি বললাম ‘মহিলাটা বিধবা চল আমরা ওদের উদ্ধার করি। এই কথাটা তুই এসে তোর মাকে বলে দিলি। এরপর মনে আছে বাঁশটা তুইই খেয়েছিলি আমার কিছুই হয়নি।

তখনই ‘এবার আসুন গোপাল ভাঁড়েরা, নাকে-মুখে চারটে দিয়ে আমাকে উদ্ধার করেন’ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেই রাহেলা আবার হনহন করে চলে গেল। তারা জানে যেদিন পানিশমেন্ট হয় সেদিন রসনামেন্টও হয়। বাপ বেটা ডাইনিং রুমের দিকে দৌড়ল। টেবিলের উপর তাদের পছন্দনীয় খাবার স্তরে স্তরে সাজানো, পানিশমেন্টের দিন রাহেলা বেগম খাবার দিয়ে সামনে আসে না, তারা নিজেরাই নিয়ে নিয়ে খায়। ছেলে বেসিন থেকে হাত- মুখ ধুয়ে এসে দেখল বাপ তার পছন্দনীয় খাবার মুড়িঘন্টের বাটিটা সম্পূর্ণ নিজের পাতে ঢেলে দিয়েছে। ছেলে খপ করে বাবার থালাটা নিয়ে গিয়ে এক পাশে বসল। বাপ বলল, এটা কেমন ইয়ার্কি হল? ছেলে উত্তর দিল, ইয়ার্কি কেন, ঠিকই তো আছে, মা বাবাই তো ছেলেদের রেঁধে বেড়ে খাওয়ায়। ঐ যে প্লেট আছে তুমি নিয়ে নাও। ‘আচ্ছা ঠিক আছে অর্ধেকটা মুড়িঘণ্ট আমাকে দে’ বাবা বলল। - না এটুকু আমার লাগবে। - তাহলে মাথাটা দে। - আরে মাথাটাই তো আমার আসল খাবার। বাপ চেঁচিয়ে উঠলো ‘সারাজীবন আমার মাথাটা আর কত খাবি এবার একটু শ্বশুর-শাশুড়ির মাথা খাওয়ার ধান্ধা কর, নিম্নস্বরে বলল ‘মায়ের মত হয়েছে।



জাকিরা অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে উঠেছে। তার জন্য একটার পর একটা বিয়ের আলাপ হয় আর ভাঙ্গে, কোনটাই আটকা পড়ে না। অথচ তার পিছনে আরো পাঁচ ছয়টা মেয়ে দেখতে দেখতে তাল গাছের মত বেড়ে উঠছে, ওরা যেন তাল গাছের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। একই ঘরে এতগুলি বিবাহযোগ্য মেয়ে যেন কন্যার হাট। জোবেদা বেগম এই ধাড়ি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, একান্ত অসহায় বোধ করে। দিন দিন তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাচ্ছে, জীর্ণ শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পাড়া পড়শি ও আত্মীয়-স্বজন মা-বাবাকে লজ্বা দেয় ‘কি ব্যাপার এতগুলো মেয়েকে ঘরে আটকে রাখছেন কেন, কন্যার হাট বসাবেন নাকি? কেউ কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার জন্য বলে ‘বিয়ে না দিতে পারলে মেয়েদের নিলামে তুলেন। কেউ কেউ নীতি কথা শুনায় ‘শাস্ত্রে আছে বালেগা হওয়ার সাথে সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে হয়, নইলে তারা হা-হুতাশ করে, আর এই হা- হুতাশে মা বাবার সংসার ছারখার হয়ে যায়।

কথায় আছে হাতি পঙ্কে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। জাকির হুসেনেরও একই অবস্থা। যারা তার সাথে কোনদিন সৌজন্যমূলক কথা বলারও সাহস রাখত না তারা এখন ঘরে এসে টক ঝাল দু’চার কথা শুনিয়ে যায়, নিজেদের বড়ত্ত আর জাকিরের নিচুত্ব জাহির করে যায়। মানুষের রসনার তীর মা বাবার বুকে বুলেটের মত বিধে, হৃদয় রক্তাক্ত হয়। জোবেদা বেগম নীরবে-নিভৃতে চোখের জল মুছে, স্বামীর সামনে চোখের পানি নাকের পানি একাকার করে দেয়। কিন্তু স্বামী বেচারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো উপায় করতে পারে না।

আগে পাড়া- প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনরা দুয়েকটা বিয়ের আলাপ আনত কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তারা সবাই পিছুটান দিয়েছে। আগে যতটা আগ্রহ নিয়ে তারা বিয়ের আলাপ করত এখন ততটাই বিতৃষ্ণা নিয়ে দূরে সরে পড়েছে। অনেকটা যেন নিউটনের সুত্র ‘প্রত্যক বলের বিপরীত বল আছে’ এর ন্যায়। আবার জাকির নিজেও ঘটকের মাধ্যমে প্রস্তাব চালাচলি করত কিন্তু কিছুদিন ধরে সব বন্ধ হয়ে গেছে। জাকির চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল, এতগুলি মেয়ের ঘরে কোন সৎপাত্র ও ভাল পাত্র আসতে চায় না। বিশেষত বড় মেয়ের জন্য কঠিন সমস্যা দেখা দিয়েছে। পাত্র পক্ষ মনে করে বড় মেয়েকে বিয়ে করলে বাকী মেয়েগুলিরও দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে, ছেলে সন্তান নাই বিধায় শ্বশুর শ্বাশুরির বুঝাও বহন করতে হবে, এজন্য কেউ অগ্রসর হয় না।

জাকিরের মনটা নিতান্ত ছোট হয়ে গেছে, সে বুঝতে পারল তার পর্যায়ের আত্মীয় সে করতে পারবে না, তাকে নিচে অনেক নিচে নামতে হবে। দীর্ঘদিন বিয়ের আলাপ বন্ধ থাকার পর হঠাৎ সে সিদ্ধান্ত নিল রিক্সাওয়ালার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে। তার মহল্লার মজিবর ওরফে মইজ্যা আগে রিক্সা চালাত, এটা ছিল তার অফিসে যাতায়াতের বান্ধিক রিক্সা। তার ছেলে ফজলু শিক্ষিত হয়েছে, মুক্তাগাছায় একটা কলেজে শিক্ষকতা করে। জাকির নিজের মর্যাদা ও আভিজাত্য ব্রহ্মপুত্রে নিক্ষেপ করে ঘটক পাঠাল এই বলে ‘মজিবরকে বলবে তার কোনো খরচাপাতি বহন করতে হবে না, বিয়ের খরচাদি আমিই বহন করব।

কয়েকদিন পর ঘটক উত্তর নিয়ে এল। বাসায় বসে নাস্তা খেতে খেতে গম্ভীর মুখে বলল ‘মজিবর আপনার প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল। সে বলল ‘আপনি জীবনে তার অনেক উপকার করেছেন। দুইবার নাকি সে ছেলের ফরম ফিলাপের টাকা যোগাড় করতে পারেনি আপনি টাকা দিয়েছেন। আপনি সাহায্য না করলে তার ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত। এজন্য সে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, আপনার ঋণ সে কোন দিন শোধ করতে পারবে না। আপনি যদি তাকে হুকুম করেন তাহলে এখনো আপনাকে রিক্সা করে অফিসে আনা নেয়া করতে রাজি। কিন্তু ছেলে তো এখন বড় হয়েছে শিক্ষিত হয়েছে তার নিজের মতামত আছে। ছেলের সিদ্ধান্ত হলো আপনার মেয়েকে বিয়ে করলে বাকি নয়টি মেয়ের দায়িত্ব তাকে বহন করতে হবে। তাছাড়া আপনাদের যেহেতু ছেলে নাই বুড়া বয়সে আপনাদেরও দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আপনার পরিবারের পেছনেই তার জীবন ব্যয় হয়ে যাবে, নিজের জন্য কিছুই করতে পারবে না। কাজেই ছেলে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। উত্তরটা শুনে জাকিরের মনে হল যেন সে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে, মনুষ্যত্বের স্তর থেকে পশুত্বের স্তরে নেমে গেছে। রিকশাওয়ালার ছেলেও তাকে ডিনাই করে সে আর মানুষ থাকল কোথায়?

জাকির অসহায় হয়ে উঠে, এবার সে আরেক ধাপ নিচে নেমে এল। তার মহল্লার পাশের মহল্লার রমজান শেখ, তার তিন ছেলে, বড় ছেলে একটা কাপড়ের ব্যবসা দিয়েছে। সে এই ছেলেকেই টার্গেট নিল। তবে এবার আলাপটা আর ঘটক দিয়ে করানো যাবে না কোন ঘনিষ্ঠজন দিয়ে করাতে হবে- যাতে না ফসকাতে পারে। কিন্তু ঘনিষ্ঠজন কোথায় পাবে, আত্মীয় বন্ধু সবাই তো তাকে ছেড়ে গিয়েছে। এমনকি বাল্যকাল থেকে তার সারাজীবনের বন্ধু ও ক্লাসমেট বাবুলও তার থেকে দূরে দুরে থাকে। একদিন সে মহল্লার মসজিদে আসরের নামাজ পড়েই দেখল বাবুল তাকে দেখে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে। সে পেছন থেকে ডাক দিল, কাছে যেতেই বাবুল হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল ‘কেমন আছিস? জাকির বলল ‘যার থেকে মানুষ পালিয়ে বেড়ায় সে আর কেমন থাকে, বেঁচে আছি মরি নাই। এরপর তারা হাঁটতে লাগলো।

বাবুল লজ্বা পেয়ে শুকনো হাসি দিয়ে বলল ‘জানি খোঁচাটা আমাকে দিয়েছিস, আমি তোর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি কথাটা সত্য কিন্তু সেটা তোর দায়িত্ব পালনের ভয়ে নয় নিজের ব্যর্থতার লজ্জায়। তোর মেয়ে মানেই আমার মেয়ে, যেহেতু তোর এতগুলি মেয়ে তাই আগে থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল দুয়েকটা মেয়েকে আমি নিজ দায়িত্ব বিয়ে দিব কিন্তু যখনি দায়িত্ব পালন করতে গেলাম তখনই রূঢ় বাস্তবতা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। তোর জন্য আমি কতটা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি তা জানি আমি আর জানে আল্লাহ, অন্তত পনেরটি ছেলের জন্য আলাপ করেছি। উপরের স্তর থেকে নিয়ে তোর সমান্তরালের চেয়েও নিচে নেমেছি কিন্তু সব খানেই জবাব পেয়েছি। সবার থেকে একটা উত্তরই পেয়েছি এতগুলি মেয়ের ঘরে বড় মেয়েকে বিয়ে করার মানে হল নয়টা মেয়ের দায়িত্ব পালন করা। তার উপর বুড়া বুড়ি তো আছেই। এ একটা কথা বলে সবাই পিছুটান দেয়। কেন যে এমন অকাম করলি, ছেলের আশায় আশায় মেয়ে দিয়ে গোয়াল ভরলি, নিজেও মরলি আমাদেরকেও ঠেকালি।

তারা নদীর কিনার ধরে হাঁটছে, অস্তগামী সূর্যের হরিদ্রাভায় নদীর ঢেউ গলিত সোনার মত জ্বলছে, তারা প্রকৃতির নৈসর্গিক শোভা অবলোকন করছে হাটছে আর আলাপ করছে। বন্ধুর সহমর্মিতায় জাকির আশ্বস্ত হল, সে বুঝতে পারলো আসলে বন্ধুরা তাকে ছেড়ে যায়নি। তাই সে সাহসে ভর করে বললো ‘শুন সন্তান জন্ম দেয় বাপ কিন্তু দায়িত্ব পালন করে বাপ-চাচারা সবাই। কাজেই দায়িত্ব শুধু আমার একার নয় তোদেরও সমান দায়িত্ব। এখন এক কাজ কর, রমজান শেখের সাথে একটু আলাপ কর। বাবুল জিজ্ঞেস করল ‘কেন তার সাথে আবার কিসের আলাপ? জাকির বলল ‘ঐ যে তার বড় ছেলেটা আছে না, ছেলেটা তো ভালই। বাবুল যেন চমকে উঠল, বিস্ময়ের সুরে বলল ‘কি বাজে বকছিস। ঐ ছেলে দুইবারে কোন রকম টেনে টুনে ইন্টার পাশ করেছে। রসায়নে মাস্টার্স পড়ুয়া একটা সুন্দরী মেয়েকে এমন ছেলের সাথে বিয়ের প্রশ্নই আসে না।

জাকির বলল, ‘আরে শুন শিক্ষা কিছু না, শিক্ষা তো হলো অর্থ উপার্জনের জন্য। ছেলেটা ভালোই উপার্জন করছে, বড়সড় কাপড়ের ব্যবসা দিয়েছে, সুন্দর আয় রোজগার করছে। বাবুলের কণ্ঠে তিক্ততা, না না এটা অসম্ভব, মানুষ ও মনুষ্যত্বের মানদন্ড হলো শিক্ষা। অথচ এখানে মেয়ের সামনে ছেলের কোন মানদণ্ডই নাই, এমন অসম বিয়ে কি করে হতে পারে? এবার জাকির আসল কথা বলল, ‘আরে শোন আমার এতগুলি মেয়ের ঘরে বিদ্যাসাগর আসবে না। আর আমার কোন বিদ্যাসাগরের দরকারও নাই। মেয়েটা যেন চারটে ডাল ভাত খেয়ে মান ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে পারে এমন ঘর হলেই যথেষ্ট- আমি বিয়ে দিয়ে দিব। অবশেষে অনেক ফুসলিয়ে সে বাবুলকে রাজি করাল।

একদিন পাশের মহল্লার মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে বাবুল রমজান শেখের বাসায় গিয়ে হাজির হল। রমজান আজীবন জাকির ও বাবুলদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করেছে, উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে আনুগত্য করেছে। বাবুলকে দেখেই সে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো ‘আরে মিয়া ভাই গরীবের ঘরে দেখছি চাঁদ উঠল। বাবুল হেসে বলল ‘চাঁদ এখনো উঠেনি তবে উঠবে, সে বার্তা নিয়েই এসেছি। তারপর তারা প্রাথমিক কুশলাদির পর আলাপে লিপ্ত হল। রমযান বলল ‘আপনি আর জাকির ভাই তো ছিলেন মানিক জোর। আপনারা লেখাপড়ায় যেমনি ছিলেন তুখোর তেমনি খেলায়ও ছিলেন ঝানু। ফুটবল খেলায় আপনাদের জুড়ি ছিল না, আপনারা যে দলে খেলতেন সেই দলের বিজয় ছিল নিশ্চিত। আপনাদের ফুটবল খেলা আমাকে মুগ্ধ করতো, যতদুরেই খেলা হত দেখার জন্য আমি ছুটে যেতাম। এরপর তারা অতীত বর্তমান নিয়ে অনেক আলাপ করল।

হঠাৎ রমজান বলল ‘তবে জাকির ভাই বোধ করি একটু সমস্যায় আছে, ছেলের আশায় আশায় অনেকগুলি মেয়ে হয়ে গেছে, এর মধ্যে কয়েকটা বোধ হয় বিয়ের লায়েক হয়েছে। আজকাল তো মেয়েদের বিয়ের একটু সমস্যা। বাবুল বলল ‘কোন সমস্যা নাই, এমন মেয়ে হাজারটা থাকলেও সমস্যা নাই। তার প্রত্যেকটা মেয়ে সুন্দরী এবং মেধাবী। সবাই লেখাপড়া করছে একসময় হয়ত চাকরি বাকরি করবে এদের মত ভদ্র শান্ত শিষ্ট মেয়ে বড় বেশি দেখা যায় না। এরা কখনো ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয় না, বাজে ঘোরাফেরা করে না, এদেরকে কোনদিন অশালীন বা অশোভন কাজে দেখেছেন? বর্তমান যুগে এদের মত ভাল মেয়েই হয় না। কিন্তু আমার দুঃখটা কি জানেন, আমার কোন যোগ্য ছেলে নাই থাকলে অবশ্যই আমি জাকিরের মেয়ে আনতাম। তাই ভাবলাম এত ভালো মেয়েগুলিকে বাইরে বিদায় করার চেয়ে নিজেদের মধ্যে রাখতে পারলে ভাল হয়। আপনিও তো আমাদেরই একজন, বন্ধু মানুষ, আপনার যোগ্য ছেলে আছে। যদিও লেখাপড়ার দিক থেকে ছেলের চেয়ে মেয়ে অনেক অগ্রসর, তবুও নিজেদের মধ্যে বলে কথা, আপনার সম্মতি থাকলে জাকির আপনার কথা ফেলতে পারবে না, সে চেষ্টা আমি করব। আশা করি তাকে বাধ্য করতে পারব, এই চিন্তা করেই আমি এসেছি।

রমজান কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলো। তারপর পিটপিটিয়ে মাথা তুলে মুচকি হেসে বলল ‘বাবুল ভাই আপনাকে কি বলব, মাস কয়েক আগে আপনাদের মহল্লার ফরিদ ভাই আলাপটা করেছিল কিন্তু পরিবারের মত হয় নাই। আপনি কিছু মনে করবেন না, আমরা ব্যবসায়ী মানুষ সর্বক্ষেত্রে ব্যবসার হিসাবটাই আগে দেখি। জাকির ভাইয়ের দশটা মেয়ে, বড় মেয়েকে বিয়ে করানোর মানে হলো বাকি নয়টা মেয়ের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া। এই নয়টি মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, বিয়েতে আর কিছু না হলেও অন্তত একটা করে শাড়ি দিতে হবে, জামাইকে অন্তত এক সেট কাপড় দিতে হবে, বাদবাকি হিসাবের খাতায় নাই আনলাম। আবার এই নয়টি মেয়ে বড় বোনের বাসায় বেড়াতে আসবে, অন্তত বোনকে দেখার জন্য তো অবশ্যি আসবে। তারা যদি বছরে একবার করেও আসে তাহলেও আমার ছেলেকে প্রায় প্রতি মাসে একটা করে শালির পরিবারের মেহমানদারী করতে হবে। কিন্তু বছরে একবার নয় বড় বোনকে দেখার জন্য দু’চার মাস পরপরই আসবে। এর অর্থ হলো আমার ছেলেকে সারাবছর মেজবানি জারি রাখতে হবে কিন্তু এই খরচটা তো কেউ বহন করবে না।

আবার জাকির ভাইয়ের যেহেতু ছেলে পোলে নাই, বয়স হলে অসুখ-বিসুখ হবে তখন এই ঔষুধ আন সেই ঔষুধ আন, এই ডাক্তার থেকে সেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও, হসপিটালে ভর্তি কর। এসব কাজ কে করবে? বড় জামাই হিসেবে আমার ছেলেকেই তো করতে হবে, তখন বেচারা নিজে মরার সময়টা পর্যন্ত পাবে না। কাজেই ব্যবসায়ি উসুল অনুসারে এই পরিবারে সওদা করলে হিসাবের খাতায় লাভ তো দূরের কথা মাইনাস ব্যতীত কিছুই জুটবে না। এইজন্যই পারিবারিকভাবে আমাদের মত হয় নাই।

রমজানের ব্যবসায়ীক হিসাবটা শুনে বাবুলের মুখটা পান্ডুর হয়ে গেল, অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার মুখে কোন উত্তর জোগাল না। সামাজিক মানদন্ডে রমজানের অবস্থান জাকিরের হাঁটুর নিচে, এতদ্বসত্ত্বেও তার মুর্খ ছেলের জন্য এমন একটা শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়েকে প্রত্যাখ্যান- তার কানে অবিশ্বাস্য ঠেকল। সে মুচকি হাসল কিন্তু এই হাসিটা তার মুখে বড়ই বেমানান দেখালো। তারপর বলল ‘আপনার সাথে আলাপ করে অনেক কিছু শিখতে পারলাম। বিয়েও যে একটা সওদা, এটাও যে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে হিসাব করতে হয় এমনটা আগে আমার জানা ছিল না। যাই হোক আপনার সাথে আলাপ করে আমার অনেক উপকার হলো, আমারও তো ছেলে মেয়ে আছে হিসাবটা কাজে লাগবে। তারপর সে উঠতে চাইল কিন্তু রমজান তাকে ডাল ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য সাধাসাধি শুরু করলো, অগত্যা বাবুল এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে গেল।

জাকিরের হল রুমে আলাপ চলছে। বাবুল জাকিরকে বিয়ের ক্ষেত্রে রমজানের ব্যবসায়ীক হিসাবটা শুনিয়ে বলল ‘দেখ বিয়েতে রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক হিসাব করে আর ব্যবসায়ীরা ব্যবসার হিসাব কষে। এজন্যই শিক্ষিত সমাজের সাথে ওদের চিন্তা-চেতনা ও সামাজিকতার মিল হয় না। আমি মনে করেছিলাম তোর মেয়ের কথা শুনে রমজান কপালে হাত দিবে কিন্তু সে ভাবছে তোর মেয়েকে বিয়ে করালে কোন ব্যাবসায়িক সাফল্য পাবে না। যেমন ছোট মেয়েদের বিয়েতে উপহার সামগ্রী, তারা বেড়াতে গেলে খাওয়ার খরচাদি, তোরা বুড়া- বুড়ি হয়ে গেলে দেখাশোনা ইত্যাদি। কাজেই যে ব্যক্তি বিয়ের আগেই ভবিষ্যতের এমন নিখুঁত হিসাব কষে তার সাথে বৈষয়িক লেনদেন করা যায় বৈবাহিক লেনদেন করা যায় না। সে যদি তোর মেয়ের জন্য এক পায়ে খাড়াও থাকত তবুও আমি এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতাম। এমন জায়গায় মেয়ে দেয়ার চেয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া ভাল।

যাই হোক শুন চেষ্টা তো অনেক করলি আমরাও করলাম কিন্তু খোদার কলম না ছুটলে তো আর আমাদের করার কিছু নাই। মেয়ে তুই পয়দা করিস নাই আল্লাহ দিয়েছেন, কাজেই চিন্তা করিস না যা করার আল্লাহই করবেন। খোদার কলম ছুটলে কারো চিন্তা ব্যতীত এমনিতেই হয়ে যাবে। এখন আল্লাহ ভরসা করে বসে থাক। আরো কিছু সান্ত্বনা দিয়ে বাবুল চলে গেল। জাকিরও আল্লাহ ভরসা করেই বসে রইল, সেই সাথে তার ভাগ্যের চাকাও আটকে রইল। না সামনে এগুচ্ছে আর না পিছনে ঘুরছে। কিন্তু তাই বলে তার মেয়েগুলির বাড়ন্ত শরীর আটকে থাকেনি, দেহ কোষগুলি ভেঙ্গে ভেঙ্গে তারা দ্রুত বেড়ে উঠছে। আধা ডজন মেয়ে বিয়ের লায়েক হয়ে বসে আছে, ছোট গুলিও বড় হয়ে যাচ্ছে। আগে কিছু কিছু প্রস্তাব আসত জাকিরও ঘটকের মাধ্যমে কিছু প্রস্তাব পাঠাত এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে। ভাগ্যের চাকা নিশ্চল- স্থবির হয়ে গেছে।



জাকিরা অনার্সে ভর্তি হওয়ার সময় ভালো ভালো ঘরের কিছু যোগ্য পাত্র এসেছিল, তার মধ্যে একটা ছিল জাকির হুসেনের কলিগের শ্যালক। ছেলেটা তখন ঢাকা ভার্সিটিতে ইংলিশে মাষ্টার্স করছিল, বর্তমানে সরকারি কলেজের প্রভাষক। কিন্তু তখন জাকিরের নাক ছিল উচ্চ মার্গে, তার ইচ্ছা মেয়েকে আরো কিছুটা শিক্ষিতা বানিয়ে আরও যোগ্য পাত্র দেখে বিয়ে দিবে। এখন তাকে সেই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে। যেসব ছেলেকে সে বিনা নোটিসে প্রত্যাখ্যান করেছিল ওরাই এখন তার কাছে স্বপ্নের রাজকুমার মনে হয়। এখন এমন একটি পাত্র পেলে সে আল্লাহর নিয়ামতরূপে লোফে নিত।

মাস ছয়েক ধরে বিয়ের আলাপ টোটালি বন্ধ। এদিকে জাকিরার মাস্টার্স পরীক্ষা এসে গেছে, মেয়েকে তো আর ঘরে বসিয়ে রাখা যায় না। জোবেদা বেগমের চোখের সামনে আধা ডজন ধাড়ি মেয়ে ঘুরাফেরা করে। এদেরকে দেখলেই যেন তার শিরার রক্ত শুকিয়ে যায়, হৃদকম্প শুরু হয়ে যায়। সে স্বামীকে অতিষ্ঠ করে তুলে, বেচারা জাকির ভাগ্যকে অভিসম্পাত করতে করতে আবার তৎপর হয়। অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।

তাদের ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর রুস্তম আলী, বাড়িটা ছাড়া আর কোনো সম্পদ নাই। আগে চোরা কারবারি করত। তার আট ছেলে চার মেয়ে। সবগুলি লেখাপড়ায় একেবারে রামগাধা, কয়েকবার করে পরীক্ষা দিয়ে কেউ মেট্রিক কেউবা বড়জোর ইন্টারের সীমানা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। তবে বড় ছেলেটা তিনবারে এস এস সি দিয়ে সিমান্ত এলাকা হালুয়াঘাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক কলেজে চলে যায়, সেখানে নকল টকল করে কোন রকম ডিগ্রীটা পাস করতে সক্ষম হয়েছে। পরিবারের সবাই রাজনীতি করে, রাজনীতিই তাদের জীবিকার উৎস। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি অপহরণ বাণিজ্য মাস্তানি ইত্যাদি তাদের অর্থোপার্জনের উপায়।

তবে বড় ছেলেটার কন্ট্রাক্টরি লাইসেন্স আছে, টেন্ডারবাজি করে সে যথেষ্ট কাজ পায়। আট ভাইয়ের মধ্যে কয়েকজন ছাত্রলীগ কয়েকজন ছাত্রদল করে। এতে সুবিধা এই যে, সরকার পরিবর্তন হলে ভাইদেরকে প্রতিপক্ষের পানিশমেন্ট থেকে রক্ষা করা যায়, তাদের অপকর্মগুলি ঢেকে দেয়া যায়। এভাবেই পরিবারটি বেশ প্রতাপশালী হয়ে উঠেছে, এলাকায় তাদের বিরাট প্রভাব, সবাই ভয় পায়। জাকির সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে চিন্তা করল ‘আমার এতগুলি মেয়ের ঘরে কোন শিক্ষিত ভদ্র লোক আসবে না। রুস্তম আলীর ঘরে শিক্ষা ও ভদ্রতা না থাকলেও অর্থ ক্ষমতা ও প্রভাব আছে। তার ঘরে মেয়ে দিলে অন্তত খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে, এখন আমার জন্য এটুকুই বড় পাওয়া। তারপর সে পরিচিত এক ঘটককে ডেকে পাঠাল।

ঘটক অনেক খুঁজাখুঁজি করে অবশেষে রুস্তুম আলির সাক্ষাৎ পেল। রাত্রে বাসায় গিয়ে নিরিবিলি প্রস্তাব পেশ করল, সেই সাথে মেয়ের রূপ-গুণ শিক্ষার বিষয়ে ঘটকালি সুলভ বিবরণ দিতে ভুলল না। রুস্তম আলি কিছুক্ষণ পায়ের ওপর পা তুলে নাচালো। তারপর মুচকি হেসে বলল ‘আমি মনে করতাম জাকির লোকটা বোকা কিন্তু আসলে সে যথেষ্ট চালাক এবং বুদ্ধিমান। সে টার্গেটটা ঠিকই নিয়েছে, আমার আটটা ছেলে তার দশটা মেয়ে। কাজেই আমার বড় ছেলেটার কাঁধে তার বড় মেয়েটাকে গছিয়ে দিতে পারলেই ব্যাস কেল্লা ফতেহ। একে একে তার আটটা মেয়ে আমার ঘরে এসে যাবে। তার কোনো পাত্র খুঁজতে হবে না, পাত্রপক্ষকে খাওয়া দাওয়ার ব্যয় ও যৌতুকের চিন্তা করতে হবে না, শুধু নিরাপদে বসে বসে মেয়েগুলিকে আমার ছেলেদের পিছনে লেলিয়ে দিলেই হলো। সে পাত্রের বাজার খুঁজে নিয়েছে, এখন শুধু মেয়ে দিয়ে সওদা করবে। লোকটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং ধুরন্ধর।

কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, জাকির না হয় দশটা মেয়ের কামড়ে পাগল হয়ে গেছে কিন্তু তুই বেটা কোন আক্কেলে আমার সামনে এ বিয়ের আলাপ নিয়ে এলি, আমার সাথে জাকিরের সামাজিকতার কী মিল আছে? আমাকে ও আমার ছেলেদের গোটা ময়মনসিংহের মানুষ চিনে, তাকে কে চিনে? আমার ছেলেদের দাপটে বাঘে মোষে এক ঘাটে পানি খায় কিন্তু তার ডাকে কি একটা ছাগলও কান খাড়া করবে? সে কোনো রিক্সাওয়ালাকে ধমক দিলে রিক্সাওয়ালা উল্টে চড় মেরে বসবে অথচ আমার ছেলেদের দেখলে মানুষ রাস্তা ছেড়ে দেয়। তুই মেয়ের শিক্ষার কথা বলছিস, আমরা এসব শিক্ষার গুল্ডি মারি, বুড়ো আঙ্গুল দিয়েও কেয়ার করিনা। জাকির তো শিক্ষিত চাকরি করে, সে কয় টাকা বেতন পায়?

আমার যে ছেলেটা সবচেয়ে কম উপার্জন করে সেও জাকিরের চেয়ে ঢের বেশি রোজগার করে, আমাদের সামনে এসব কেরানী ফেরানির খাওয়া নাই। কাজেই আমার ছেলেকে এমন আলতু ফালতু লোকের মেয়ে বিয়ে করানোর প্রশ্নই আসে না। আমার ছেলের জন্য খুঁজছি কোন মন্ত্রী এমপির মেয়ে। কারণ আমার ছেলে শিগ্রই ফুলপুর থেকে এম পি ইলেকশন করবে, আর ইলেকশন করলে এমপি নির্বাচিত হবেই। সেই কৌশল ও ক্ষমতা আমাদের আছে। আর এম পি নির্বাচিত হলে মন্ত্রী তো হবেই। কাজেই ব্যাটা মূর্খ, একটা মন্ত্রীর জন্য তুই কার মেয়ে, কেমন মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিস? জাকিরের প্রস্তাবে আমি অবাক হয়েছি কিন্তু রাগ করিনি। কারণ দশটা মেয়ের কামড়ে সে পাগল হয়ে গেছে, বিবেচনা বোধ হারিয়ে ফেলেছে, পাগলের প্রতি রাগ করতে নেই। কিন্তু তোর প্রস্তাবে আমি অপমান বোধ করছি, তুই কি আমাকে জানিস না চিনিস না?

ঘটক কাচুমাচু করতে লাগল ‘আসলে ভাইজান আমার ভুল হয়ে গেছে। জাকির সাবের কথায় আমি বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলাম, মাফ করে দেন। রুস্তম হাসল, তারপর বলল ‘শোন আমার ছেলের জন্য মন্ত্রী এম পির মেয়ে দেখ। জাকিরকে বেশি কিছু বলার দরকার নাই, শুধু এতটুকু বলবি রুস্তুম ভাইয়ের বারটা পোলাপানের একটা বাজার, সেখানে আপনার দশটা মেয়ে নিয়ে নিজের বাজারে আগুণ লাগাতে পারবে না।

যে ঘটক জাকিরকে বলেছিল রুস্তমের ঘরে আপনার মেয়ে দেয়া মানে উলুবনে মুক্তা ছড়ানো- এখন সেই ঘটক প্রত্যাখ্যাত হয়ে মুখ কালি করে বেরিয়ে গেল। ঘটনা শুনে জাকিরের দেহের জোরাগুলি যেন ছেড়ে দিয়েছে, এমন একটা বখাটে উচ্ছন্নে যাওয়া পরিবার থেকেও যে সে প্রত্যাখ্যাত হবে- এটা তার কল্পনাতেও আসেনি। সে একেবারে ভেঙ্গে পড়ল, পাথরের মত নিশ্চল স্থবির হয়ে গেল। সে স্থবির হলে কী হবে তার মেয়েদের দেহগুলি তো আর স্থবির হয়ে থাকে না। এখন আর কেউ ছোট নাই, সবাই বিয়ের লায়েক হয়ে গেছে।

জাকিরার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। একপাল ধাড়ী মেয়ে দেখে দেখে জোবেদা বেগমের মস্তিষ্ক বিকৃতির উপক্রম হল। সে বারবার ঝড়ের তাণ্ডব নিয়ে স্বামীর উপর হামলে পড়ে, স্বামীকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় এতো বাছাবাছি খুজাখুজি কিসের, তোমার একপাল মেয়ের বাজারে কোন ভালো ছেলে আসবে না। এত শিক্ষা দীক্ষা ধন-সম্পদ দরকার নাই, শুধু ছেলেটা হলেই হলো। গাছতলা থেকে হলেও একটা একটা ছেলে ধরে এনে এদেরকে বিদায় কর। ঘরটা জাহান্নাম হয়ে গেছে, জাহান্নাম থেকে বাঁচ। আবার এলাকার মানুষের ছিঃ ছিঃ-এর জ্বালায় তো আর বাঁচা গেল না। তাড়াতাড়ি এদের বিদায় কর, নইলে সবকটাকে নিয়ে আমি বিষ খেয়ে মরব।

জাকির চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো, অন্ধকারে নিজের ছায়াও সঙ্গ ত্যাগ করে চলে যায় তারও সেই অবস্থা হল। আত্মীয় বন্ধুরা সবাই তাকে ত্যাগ করেছে। তাকে আত্মীয় বন্ধু হিসাবে পরিচয় দিতে তারা লজ্জা পায়, কোন বুদ্ধিমান পতিত ব্যক্তিকে আত্মীয় বা বন্ধু হিসাবে পরিচয় দিয়ে নিজেকে ছোট করে না। কাজেই কেউ কোন বিয়ের আলাপ করে না, কোথাও থেকে প্রস্তাব আসে না। সে নিজেও প্রস্তাব দেয়ার মতো কোনো ছেলে খুঁজে পায় না। অবশেষে অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে মর্ত থেকে পাতালে নামার সিদ্ধান্ত নিল।

তাদের মহল্লার মফিজউদ্দিন দরিদ্র মানুষ, ফলের ব্যাবসা করে, মোটামুটি ভালোই চলে। তার একটা মাত্র ছেলে, ছেলেটা দুইবার এস এস সি দিয়ে আর দেয়নি, পাশও করতে পারেনি। এখন সারাদিন খারাপ ছেলেদের সাথে থাকে, নেশা করে আর মেয়েদের পিছনে ঘুর-ঘুর করে বেড়ায়। ছেলেটা বয়সে জাকিরার সমবয়স্ক অথবা ছোটো হবে। এছাড়া জাকির আর কোন উপায় দেখল না। সে সিদ্ধান্ত নিল, এখানে যদি হয় তো ভাল অন্যথায় হয় সপরিবারে বিষ খেয়ে মরবে অথবা সত্যি সত্যিই মেয়েগুলিকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিবে বা অন্য কিছু একটা করবে।

সে প্রস্তাবটা পাঠানোর জন্য এক বন্ধুর সাথে আলাপ করল। বন্ধু চোখ কপালে তুলে বললো ‘কি বলছিস আমি বুঝতে পারছি না, মফিজের ছেলে সুজনের সাথে তোর মেয়ের বিয়ের আলাপ? জাকির বলল ‘তবে আর বলছি কি? বন্ধু খেকিয়ে উঠল ‘তুই কি সত্যি সত্যি মেয়েদের চাপে পাগল হয়ে গেছিস নাকি? আরে ওই ছেলে নেশা করে, সব সময় খারাপ মেয়েদের সাথে থাকে। দু-একদিন পর পর তার বিভিন্ন কুকীর্তির কথা শোনা যায়। আবার বাপের নাই একতোলা সম্পদ, ছেলেরও এক পয়সা রোজগারের মুরোদ নাই। সব চেয়ে বড় কথা, ছেলে ম্যাট্রিক ফেল আর তোর মেয়ে রসায়নে মাস্টার্স এবং সুন্দরী। যে বাপ এমন যোগ্য মেয়েকে ঐ বখাটে ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায় নিশ্চয় সে পাগল ছাড়া আর কিছু না। বুঝতে পারছি তোকে পাবনায় পাঠাতে হবে। আরো কিছু গালমন্দ করে বন্ধু চলে গেল। জাকির আরো কয়েকজনের সাথে আলাপ করল সবাই তাকে পাগল ঠাওরাল, পাবনা যাওয়ার পরামর্শ দিল এবং তিরস্কার করে চলে গেল। প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা আলাপটা কেউ সমর্থনই করল না।

অগত্যা জাকির এর ঘটককে পাঠাল। ঘটকের প্রস্তাব শুনে মফিজ উত্তর দিল ‘দেখ বাপু, জাকির ভাইয়ের পরিবার শিক্ষিত ও ভদ্রলোক। আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধা করি কিন্তু আমার একটা মাত্র ছেলেকে তিনি কেড়ে নিতে চাচ্ছেন কেন? যদিও তার ছেলে নেশা করে খারাপ মেয়েদের সাথে পড়ে থাকে এরপরেও বলল ‘আমার ছেলেটা খুবই ভাল ও চরিত্রবান, এমন ছেলে এ তল্লাটে নাই। কিন্তু এই ছেলে দশটা মেয়ের মধ্যে পড়লে তার চরিত্র ঠিক থাকবে না, মেয়েদের মধ্যে হারিয়ে যাবে। তখন আর আমার ছেলেকে আমি খুঁজেও পাব না। ছেলে তখন শশুর বাড়ি গিয়ে আস্তানা গাড়বে। জাকির সাবেরও ছেলে নাই সে আমার ছেলেকে ঘর জামাই নিয়ে যাবে। তখন আমার একমাত্র সন্তানকে হারাতে হবে। কাজেই গরিবের ওপর এই যুলুম কেন, তুমি বাপু যাকির ভাইকে গিয়ে বলবে আমি নিতান্ত গরীব মানুষ, টুকটাক ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই। কারো কোন অনিষ্ট করি না তারও কোন ক্ষতি করি নাই। কাজেই তিনি যেন দয়া করে আমার ওপর এই যুলুমটা চাপিয়ে না দেন, আমাকে রক্ষে করেন।

মফিজের উত্তর শুনে জাকির একটা অট্টহাসি দিল, সে একেবারে সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। এখন তার সামনে দুটি পথ, হয় মেয়েগুলিকে মেরে ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দেয়া অথবা আল্লাহ ভরসা করে বসে থাকা। কিন্তু বাপ হয়ে সন্তান হত্যা তো আর করা যাবে না অগত্যা আল্লাহ ভরসাই এখন ভরসা। তার বন্ধু বাবুল বলেছিল মেয়েগুলি তুই পয়দা করিস নাই আল্লাহ দিছে আল্লাহই ব্যবস্থা করবে। কাজেই আল্লাহর ব্যবস্থা ছাড়া এখন আর গত্যন্তর নাই। কিন্তু অফিসে ঘুষ না দিলে অফিসার ও কেরাণীরা কোন ব্যবস্থা করে না, চুপচাপ বসে থাকে। কাজেই আল্লাহকেও ঘুষ না দিলে ব্যবস্থা না করে চুপচাপ বসে থাকবে। এখন আল্লাহকে কী ঘুষ দেওয়া যায় সে চিন্তা করতে লাগল। আবার বাসাটাও ছাড়া দরকার, সে বুঝতে পারছে এ অবস্থা চলতে থাকলে শীঘ্রই তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যাবে। অগত্যা সে চিল্লায় যাওয়ার নিয়ত করলো, এতে মস্তিষ্ক বিকৃতি থেকেও বাঁচা যাবে, আল্লাহকেও ঘুষ দেয়া হয়ে যাবে। সে অফিস থেকে চার মাসের ছুটি নিয়ে তিন চিল্লায় চলে গেল। এর পেছনে অবশ্য আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে, অনেক উচ্চ শিক্ষিত ভাল ভাল ছেলে চিল্লায় আসে, যদি দু- একটাকে পটানো যায়।



কথায় আছে খেয়ে যায় দাড়িওয়ালা বেজে যায় গোঁফওয়ালা। এ সুত্রটি নারী পুরুষের ক্ষেত্রে মোক্ষম ভাবে প্রযোজ্য। পুরুষের সৃষ্টি খাওয়ার জন্য আর নারীর সৃষ্টি বেজে যাওয়ার জন্য। এই যেমন একটি ছেলে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে পালিয়ে গেল। এখন ছেলেটির কোন সমস্যা নাই সে আগের মতো বহাল তবিয়তেই থাকল কিন্তু মেয়েটির পেট হয়ে গেল। সে সারা জীবনের জন্য বেজে গেল। তেমনি একজন দরিদ্র অশিক্ষিত লোক বিয়ে করল, কয়েক হালি সন্তানও উৎপাদন করল। তারপর বউ-বাচ্চাকে ভাত কাপড় দিতে না পেরে একদিন রাতে পলায়ন করল। এখানে পুরুষটা শুধু খেয়েই গেল আর নারীটা কিন্তু জন্মের মত আটকে গেল। সে নিজে বাঁচুক মরুক কখনোই সন্তানদের ফেলে যেতে পারবে না, নিজের পেটে একমুঠো অন্ন দিতে পারুক না পারুক কিন্তু সন্তানদের মুখে ঠিকই অন্ন তুলে দিতে হবে। বস্তুত স্রষ্টা পুরুষকে বিজয়ী দেবতা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই আমরাও পুরুষের জয়গান গাইব ‘জয় পুরুষতণ্ত্র, জয় স্বার্থবাদ।

জাকির দম্পতিরও একই অবস্থা। সে পুরুষতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে চিল্লায় গিয়ে খাচ্ছে-দাচ্ছে ঘুমোচ্ছে সাথীদের সাথে আনন্দ করছে কিন্তু জোবেদা বেগম দশটি মেয়ের যাঁতাকলে পড়ে ধুঁকছে। সবগুলি মেয়ে বড় হয়ে গেছে, প্রায় সবাই বিয়ের লায়েক। এতগুলি ধাড়ি মেয়ের নিঃশ্বাসে একটা ঘর যে কি করে জাহান্নামে পরিণত হয়- জুবেদা বেগম তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তাছাড়া বিয়ে না হওয়ার কারণে এমনিতেই মেয়েগুলির মনে হিনমন্যতা বিরাজ করে। তখন একজন একটু সাজগোজ করতে গেলে অন্যরা বলে ‘দেখ দেখ বর পাওয়ার জন্য পরী সাঁজতে এসেছে, পরি সেজে লাভ নেই কপালে বর জুটবে না। তখনই শুরু হয়ে যায় মারামারি খোচাখুচি ঝগড়া। আবার এতগুলি মেয়ের মধ্যে একজন আরেকজনের কাপড় বা তোয়ালেটা নিল অথবা একজনের বাড়া ভাত-তরকারি আরেকজন নিল তো শুরু হয়ে যায় ঝগড়া মারামারি।

তাছাড়া এতগুলি মেয়ের চাহিদা পূরণের জন্য একজন দায়মি কাজের লোক দরকার কিন্তু তেমন কেউ নেই। জোবেদা বেগম ও বড় মেয়ে মিলে যতটুকু সম্ভব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তাছাড়া সব সময় একটা টানাপোড়েন লেগেই থাকে। কাপড় থাকলে সাবান থাকে না, সাবান থাকলে শ্যাম্পু থাকে না, শ্যাম্পু থাকলে কসমেটিক্স থাকে না, খাবার গেলে তরকারি থাকে না। সব সময় একটা না একটা নাই নাই খাই খাই লেগেই থাকে। এভাবে জাকিরের ঘরটা একটা বাস্তব জাহান্নামে পরিণত হল। আর জুবেদা বেগম একা একা সেই জাহান্নামের জ্বালানি হল।

মেয়েদের তাণ্ডবে সব সময় তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে থাকে। তাঁর যত ক্ষোভ গিয়ে পরে সবচেয়ে সহজ সরল শান্ত শিষ্ট বড় মেয়ে জাকিরার উপর। সে মনে করে জাকিরাই ছোট মেয়েদের বিয়ের অন্তরায় হয়ে আছে। নিজেদের ব্যর্থতার ক্ষোভ সে মেয়ের উপর ঢালে, কথায় কথায় পোড়ারমুখী কপালপুড়ি রাক্ষসী মরতে পারিস না, যম তোকে চোখে দেখে না, তোর জন্য এ সংসার ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কপালে জামাই নাই তো মরতে পারিস না, মানুষ তো বিষ খেয়ে, ফাস দিয়ে, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কতভাবেই মরে, তোর কি মরার যোগ্যতাও নাই। জামাই জোটানোর যোগ্যতাও নাই মরার যোগ্যতাও নাই শুধু মা বাপের মাথা খাওয়ার যোগ্যতা আছে।

গালি দিতে দিতে যখনি তার রাগ চরমে পৌঁছে যায় তখন শুরু হয় মারপিট। সে অবলা বড় মেয়েটার উপর বাঘের মত হামলে পড়ে, বেধড়ক মারতে থাকে। প্রচণ্ড মার খেয়ে মেয়েটা যখন নেতিয়ে পড়ে তখন তাকে ছেড়ে ধরে অন্য মেয়েদেরকে। যাকে যেখানে পায় সেখানেই মারতে থাকে, মার শুরু হলে সে এক থেকে দশ পর্যন্ত সিরিয়াল পূর্ণ করে দেয়। তারপর নিজের রুমে গিয়ে সর্বস্ব খোয়ানো নিঃস্বের মত চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, নিজের ভাগ্য ও মেয়েদের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করে, আল্লার কাছে কৈফিয়ত তলব করে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে অর্ধ মৃতের মত বিছানায় পড়ে থাকে।

জাকিরা বুঝে তাদের দুঃখেই আজ মায়ের এই অবস্থা। সে নিজের মার খাওয়ার জন্য কাঁদে না, কাঁদে মায়ের দুঃখে। তার আশঙ্কা জাগে, এভাবে চলতে থাকলে মা পাগল হয়ে যাবে, তার মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন সে উঠে গিয়ে মায়ের কাজ গুলি করে, রান্নাবান্না করে। এরপর মায়ের রুমে গিয়ে হাত ধরে বলে ‘আম্মা ওঠ, গোসল কর গিয়ে’ বলে মাকে টেনে নিয়ে যায়। মায়ের গোসলের পর কাপড়গুলি নিজের হাতে ধুয়ে আনে। তারপর ডাইনিং টেবিলে ভাত বেড়ে দিয়ে মাকে ভালো-মন্দ খাওয়ায়, সে মাকে বিশ্রাম ও শান্তি দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে।

কখনো জোবেদা বেগম মেয়েদেরকে মেরে নিজের ঘরে এসে কান্নাকাটি করে, নিরীহ বড় মেয়েটাকে মারার জন্য তার আফসোস হয়। সে নিজেকে ধিক্কার দেয়, এত ভাল মেয়েকে কেউ মারে? তীব্র অনুশোচনায় সে মেয়ের কাছে ছুটে যায়। মেয়ে হয়তো নিজের রুমে জানালার ধারে বা রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, মা মাথায় হাত বুলিয়ে অন্তহীন মমতায় কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে ‘যা গোসল কর গিয়ে। তারপর মা রান্নাবান্না করে মেয়েকে পাশে বসিয়ে ভালোমন্দ খাওয়ায়, ভালো তরকারিটা জোর করে পাতে ঢেলে দেয়। শরীরে হাত বোলাতে বোলাতে বলে ‘একটু ভালো করে খা, শরীরটা শুকিয়ে কি হচ্ছে? দেখতেই তো পাচ্ছিস আমি একটা মরা মানুষ, তুইই নিজের শরীরের যত্ন নে। সে যেন মেয়েকে আদর করার ও সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না।

খাওয়া শেষ হলে বলে ‘আয় তোর চুলটা বেঁধে দেই’ তারপর গিয়ে নিজের রুমে বসে। কিসের চুল বাধা, অন্তহীন মমতায় সে মেয়ের মাথা কাঁধ ও পিঠে হাত বুলাতে থাকে। মেয়ে বুঝতে পারে, স্রষ্টা এই হাতে কত মমতা আর কত মধু দিয়েছেন, সেই সাথে বুঝতে পারে মায়ের দেহটা কাঁপছে, ভীষণভাবে কাপছে। উদ্দাম কান্না আটকাতে গিয়ে তার দেহটা যেন ভেঙ্গে পড়ছে। তখন মা মেয়ের মাথা নিচু হয়ে আসে, নাক বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। নির্জন প্রকোষ্ঠে এই অশ্রু দেখতে পায় না কোন প্রাণী, দেখেন শুধু অন্তর্যামী। মা কখনো দুর্দম কান্না রোধ করতে পারে না, উত্তাল তরঙ্গ মালার মতো অদম্য কান্না গলা ভেদ করে বেরিয়ে আসে। তখন মা লজ্জা ঢাকতে ‘আমাকে মাফ করে দিস মাফ করে দিস’ বলতে বলতে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

সাধারণত প্রত্যেক পরিবারের বড় ছেলে মেয়েরা ভালো হয় আর ছোটরা হয় স্বার্থপর। এর কারন সম্ভবত বড়রা ছোটদেরকে কোলে পিঠে করে মানুষ করে, এইজন্য ছোটদের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও মমত্ববোধ থাকে। পক্ষান্তরে ছোটরা বড়দের কোন দায়িত্ব পালন করে না, এজন্য বড়দের প্রতি তাদের মমত্ববোধ খুব কমই থাকে। এরা নিজের স্বার্থ চিন্তাটাই বেশি করে। জাকির দম্পতির বড় তিনটি মেয়ে ভাল, এরা নিজের চেয়েও ছোট বোনদের অধিক ভালোবাসে, খেয় খেদমত ও কাজকর্ম করে দেয়, কাপড় চোপর ধুয়ে দেয়, পড়ায়, খোঁজ-খবর নেয়। কিন্তু ছোট মেয়েরা বড়দের বিশেষত জাকিরাকে দেখতে পারে না। তারা মনে করে জাকিরার কারণে তাদের বিয়ে হবে না, হলেও অনেক দেরি হবে। অথচ তারা তখন বিয়ের জন্য মুখিয়ে উঠেছে। তারা মনে করে জাকিরা তাদের ভাগ্য বৃহস্পতির রাহু। এজন্য তারা জাকিরাকে সবসময় পোড়াকপালি, আইবুড়ি, বাপের ঘরের খুঁটি, চিরকুমারী বাজা ইত্যাদি গালাগালি করে, তিরস্কার করে, কথায় কথায় ঝেংড়ায়। তাদের ভাবগতিক দেখে মনে হয় যেন জাকিরাই তাদের সুখ শান্তির পথে একমাত্র অন্তরায়।

মায়ের বকুনি জাকিরার সহ্য হয়, কারণ তিনি বকেন নিজের মনের দুঃখে। কিন্তু বোনদের বকুনি তার সহ্য হয় না কারণ এরা বকে তাদের স্বার্থ চিন্তায়। সে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে বোনদের সেবা করছে, পড়াচ্ছে, কাজকর্ম করে দিচ্ছে, কুলে পিঠে করে বড় করেছে- সেই বোনদের এমন আচরণ তার সহ্যের অতীত। নিজের প্রতি তার ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা ধরে গেল, সে অনবরত কয়েকদিন কাঁদলো। রাতে শুয়ে শুয়ে বালিশ ভিজাল, অবশেষে সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। একদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সে নিভৃতে মায়ের রুমে গিয়ে বসলো। মা শুয়ে আছে, সে পায়ের কাছে বসে পা টিপতে টিপতে বলল ‘আম্মা আমি আর বিয়ে করব না তুমি বাকিদের চিন্তা করো। আমি একটা শিশু নিকেতন গড়ে তুলবো, সেখানে বাচ্চাদের পড়াবো নিজের সন্তানের মত প্রতিপালন করব। এখন এটাই আমার জীবনের ব্রত। তোমরা আমার জন্য চিন্তা কর না।

মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। তারপর বললেন ‘তোর জন্য তো কোন চিন্তা করি না, তোর মতো লক্ষী মেয়ে কয়জনের আছে কিন্তু তোর কদর করতে পারলাম না মাফ করে দিস। চিন্তা তো হলো ছোটগুলির জন্য, এখনই ওদের ভাব দেখেছিস, মনে হচ্ছে যেন শীঘ্রই ওদের বিয়ে না দিলে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে। আর ওদের বিয়ে তো তোর বিয়ের উপর নির্ভরশীল, তোর বিয়ে না হলে তো ওদের বিয়ে হবে না। তারপর মা তাকে বিয়ের উপদেশ ও সান্ত্বনা দিতে লাগলো, কিছুক্ষণ পর জাকিরা উঠে গেল। তার খেয়াল হলো ঠিকই তো, তার বিয়ে না হলে তো ছোটগুলির বিয়ে হবে না। ছোটদের মঙ্গলের জন্য অবশ্যই তার বিয়ে হতে হবে। সে অসহায় বোধ করল, নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে বালিশ ভিজাতে লাগলো। এরপর থেকে কান্নাই তার স্থায়ী সঙ্গী হল।

১০

অবশেষে জাকির চিল্লা থেকে ফিরে এলো। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়েছে কোন শিকার ধরতে পারেনি। রাতে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল ‘কেউ এসেছিল? জোবেদা বেগম বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল ‘কে আবার আসবে, তোমার আত্মীয় বন্ধুরা সব বয়কট করেছে। জাকির গলা টেনে বলল, না আমি বলছিলাম যে কোন পাত্র টাত্র--? জোবেদার মুখটা কালো হয়ে গেল, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ‘সে ভাগ্য কি আমাদের আছে? এরপর সে স্বামীকে অতিষ্ট করে তুলল ‘আর সময় নাই, তোমার ঘরের অবস্থা খুব খারাপ। সবগুলি মেয়ে বিয়ের লায়েক হয়ে গেছে, এরা এখন শুধু আমার মাথাটা খাচ্ছে। আর যদি দেরি করো তাহলে কিন্তু আমি নিশ্চিত বলে দিচ্ছি আমাকে হারাবে। আমি পাগল হয়ে দেশে দেশে ঘুরব। কাজেই আর সময় নষ্ট না করে পথে নাম, অন্ধ কানা খোরা ঠসা যা পাও ধরে আন আর একটা একটা করে আপদ বিদেয় কর। আমি তোমাকে বারবার বলছি ভদ্র শিক্ষিত ধন-সম্পদ ইত্যাদি খোজার দরকারও নাই সময়ও নাই লাভও নাই, তোমার এতগুলি মেয়ের বাজারে কোন ভদ্র ঘরের ছেলে আসবে না। এখন আত্রা নুলা কানা টেংরা একটা হলেই হল। গিন্নি এভাবে উঠতে বসতে শুইতে জাকিরের কানের গোড়ায় বিষবাষ্প উদ্গার করতে করতে তাকে অতিষ্ট করে তুলল। জাকির কয়েকদিন গম্ভীর হয়ে থাকল, চিন্তা করল, তারপর হঠাৎ স্ত্রীকে বলল ‘আমি একটু বাড়িতে যাব।

জাকির হুসেনের পৈতৃক বাড়ি উত্তর ময়মনসিংহের ফুলপুরে। তার বাপ চাচারা তিন ভাই, তার বাপ বড় ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহে এসে ব্যবসা শুরু করেন, ব্যবসায় তার উন্নতি হয়। তখন ব্রহ্মপুত্র নদী তীরের জমির তেমন কোন মূল্যই ছিল না, নামকাওয়াস্তে কিছু টাকা দিয়ে তার বাবা অনেকটা জমি কিনে বাসা করেছিল। বাপের এক সন্তান হিসেবে সেই সবকিছুর মালিক হয়। তার দুই চাচা বাড়িতে থাকত, তারা মারা গেছে। এখন তাদের ছেলেরা আছে কিন্তু তাদের অবস্থা তেমন ভালো নয়। পৈতৃকসূত্রে জাকির কিছু জমি পেয়েছিল, সেগুলি বিক্রি করে নাই, চাচাত ভাইরা করে ধরে খায়। বছর শেষে তাকে কিছু আতপ চাল, কিছু পিঠার চাল আর রমযানে কিছু চিড়া দিয়ে যায়, বাস এটুকুই যথেষ্ট। অসচ্ছল চাচাতো ভাইয়েরা উপকৃত হচ্ছে এতেই সে খুশি। পৈত্রিক ভিটা আছে কিন্তু কোনো ঘর নাই। সে গেলে চাচাতো ভাই মজিদের ঘরে থাকে।

তার দাদা ছিল অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক, তখন শামসুল নামের একটা ছেলে তাদের বাড়ীতে কাজ করত। এক সময় সে কুয়েত যাওয়ার একটা চান্স পেয়ে যায় কিন্তু টাকার অভাবে আটকে যায়। তখন জাকিরের বাপ দাদা মিলে খরচাপাতি দিয়ে তাকে কুয়েত পাঠায়। শামসুল কুয়েতে অনেক বছর কাটিয়ে বেশ কিছু টাকা পয়সা নিয়ে আসে। গ্রামে কিছু জমা জমি কিনেছে, একটা রাইসমিল দিয়েছে। মোটামুটি ভালোই অবস্থা ব্যবস্থা করেছে। তার পাঁচটা ছেলে, বড় ছেলের উদ্দেশ্যেই জাকির রওয়ানা হয়েছে। যদিও সে জানে ছেলেটা ভালো না কিন্তু কি করবে, সে তো এখন নিরুপায়।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সে মজিদের সাথে আলাপটা করল কিন্তু মজিদ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। সে বলল ‘মিয়া ভাই কি বললে আবার বল। জাকির বুঝিয়ে বললো। মজিদ বিস্ময়ে লাফিয়ে উঠল ‘মিয়া ভাই তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি, আরে এই ছেলে তো ডাকাত। কয়েকবার ডাকাতি করে ধরা পড়েছে, শামসুল অনেক টাকা খরচা পাতি করে ছাড়িয়ে এনেছে। বর্তমানে সে সর্বহারা পার্টি করে, দুদিন পর পর পুলিশ এসে বাড়িতে হানা দেয়। মদ ও মেয়ে ছাড়া তার এক ঘন্টাও চলে না। এলাকার মানুষ সবাই ওকে ছেঃ ছেঃ করে। তাছাড়া তোমার মেয়ে সুন্দরী, মাস্টার্স পাশ অথচ শামসুলের একটা ছেলেও মেট্রিক পাশ করতে পারেনি। আবার ঐ ছেলে তো প্রাইমারি পর্যন্ত পড়েছে। কাজেই এখানে মেয়ে বিয়ে দেয়ার চেয়ে তুমি মরে যাও মিয়া ভাই আমরাও মরে যাই। এখানে আমাদের মেয়ের বিয়ে হলে আমরা লজ্জায় মরে যাব, এলাকায় মুখ দেখাতে পারব না।

জাকিরের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। কিন্তু সে বিষয়টা হালকা করতে চাইল, ঢোঁক গিলে বলল ‘আরে শোন এ বয়সে পোলাপান এমন একটু আধটু করেই থাকে বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যায়। তুই গিয়ে শামসুলের সাথে আলাপটা কর। মজিদ দৃঢ় কণ্ঠে বললো ‘কখনো না আমি এ আলাপও করবো না এই বিয়েও হতে দেব না। নিজ হাতে আমাদের নিজের মেয়েকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে পারব না। এর চেয়ে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া ভালো। জাকির কাতর হয়ে উঠল, ঘটনা বর্ণনা করে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরল। তাকে বুঝাল দশটা মেয়ের ঘরে ভাল পাত্র পাওয়া অসম্ভব, অনেক চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এছাড়া মেয়েদের বয়স হয়ে যাচ্ছে, পড়ে আর বিয়েই দেয়া যাবে না। অনেক কাকুতি-মিনতি করে তাকে রাজি করালো।

রাত্রে মজিদ গিয়ে মিলে বসে নিরিবিলি আলাপ শুরু করল। শামসুল টেবিলে উবু হয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রস্তাবটা শুনল। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েসি ভঙ্গীমায় বসল, একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল, গৌরবময় ভঙ্গিমায় কিছুক্ষণ নীরব থাকল। আসলে আগে যদি কেউ বলত জাকিরের মেয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠাও, তাহলে শামসুল এটাকে অসম্ভব অকল্পনীয় মনে করত। কিন্তু মজিদ যখনই প্রস্তাবটা পেশ করল হঠাৎ তার আত্মমর্যাদা বেড়ে গেল, সে সচেতন হয়ে উঠলো। তার আগের প্রভু পরিবারের উপর এখন সে নিজেকে প্রভু ভাবতে লাগলো। তাছাড়া এটা মানুষের প্রকৃতি, আগের প্রভুকে কোনভাবে পদানত করতে পারলে মানুষ গৌরব বোধ করে। তার মনে হলো জাকিরের চেয়ে সে সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ।

তাই সে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো ‘মজিদ ভায়া বিয়ের আলাপ যে কেউ যে কারো সম্পর্কে করতে পারে তাতে রাগ করতে নেই। তোমার প্রতিও আমি রাগ করিনি তবে তোমার একটু বুদ্ধি রাখার দরকার ছিল। জাকির ভাই শিক্ষিত মানুষ, তাকে আমি শ্রদ্ধা করি কিন্তু শ্রদ্ধা এক জিনিস আর বাস্তবতা আরেক জিনিস। তার বাস্তবতা আর আমার বাস্তবতা তুলনা করে দেখ তো দেখি, জাকির ভাইয়ের চেয়ে আমার জমি বেশি, তার দশটা মেয়ে শুধু খায় আর উড়ায় এক পয়সা উপার্জন করতে পারে না। অথচ আমার পাঁচটা ছেলে, এরাই মিলটা চালাচ্ছে কৃষি কাজ করছে গরু-ছাগল রাখছে সংসারের উন্নতি করছে। জাকির ভাইয়ের বাসা আছে আমার মিল আছে, তার বাসার চেয়ে আমার মিলের দাম বেশি। এরপরেও যদি জাকিরকে আমার সমকক্ষ তুলনা করো তাহলে এটা আমার দুর্ভাগ্য আর তোমার দুর্বুদ্ধি।

জাকিরের মেয়ে বিয়ে করালে আমার ছেলেকে কি দিবে, কি পাবে? কিছুই না, তারা মরলে শহরে বড়জোর দুয়েক শতাংশ জমি পেতে পারে, ব্যাস এটুকুই। অথচ আমার ছেলেকে এখনি এক পোটলা স্বর্ণালঙ্কার ও এক বস্তা টাকা নিয়ে বিয়ে করাতে পারি। তুমি বলছ মেয়ে মাস্টার্স পাশ, এ তো আইবুড়ো মেয়ে। এমন মেয়ে এনে কি আমি ঘরে ধোয়া দিব? এই মেয়ে তো আমার বৌয়ের প্রায় সমবয়স্ক হয়ে যাবে, সে তো শাশুড়িকে আম্মা না ডেকে ভাবি ডাকতে চাইবে। আজকালকার শহুরে শিক্ষিতা মেয়েদের আমার জানা আছে। ওরা কখনোই শাশুড়িকে ভাত রেধে বেড়ে দিবে না, কাপড় ধুয়ে দিবে না, খেদমত করবে না বরং শ্বাশুড়ীকে উল্টো তার সেবা করতে হবে।

এই মেয়ে আমার বউকে কামলা খাটাবে আর আমার ছেলেটাকে নিয়ে মার্কেটে ও সিনেমা হলে ঘুরে বেড়াবে, এ মেয়ে এনে আমি কি করব? আমার তো দরকার এমন মেয়ে যে ঘরে ও বাইরে কামলার কাজ করবে, ভাত রাঁধবে, ধান বানবে, পানি আনবে, ধান ও খর সামাল দিবে, গরু-ছাগল রাখবে, গোয়ালের গোবর ফেলবে। এগুলি হল গ্রামীণ ঝি বউদের কাজ। জাকিরের মেয়ে কি এসব করবে, করতে পারবে? করবে না, এমন আইবুরু মেয়েকে বিয়ে করালে টাকাও পাব না সংসারি কাজ কর্মও চলবে না তাহলে প্রদর্শনী করার জন্য এমন মেয়ে ঘরে আনব?

আমার ছেলের জন্য এর চেয়ে অনেক ভালো ভালো বিয়ের আলাপ হচ্ছে। আমাদের সাবেক চেয়ারম্যান রহমত আলীর মেয়ে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। মেয়েটা দুইবার মেট্রিক দিয়ে ফেল করেছে বয়সও কম। গায়ের রং ময়লা বলে টাকাও দিবে কিন্তু আমি রাজী হচ্ছি না। আমার নিয়ত স্ট্যান্ডিং চেয়ারম্যান হাসমত উল্লাহর মেয়েকে বিয়ে করাব। ওর মেয়ে বিয়ে করাতে পারলে নিশ্চিত জেনো আমার ছেলে আগামী টার্মে চেয়ারম্যান। সে বকবকানি চালিয়ে গেল, জাকির যে তার সামনে কিছুই না, ওর মেয়ে যে তার ছেলের যোগ্য নয়- বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে সে এটাই প্রমান করার চেষ্টা করল।

মজিদ বজ্রাহতের মত বসে আছে। সে কি বাস্তবে আছে নাকি স্বপ্নে দেখছে বুঝতে পারছে না। সে চারপাশে তাকাল, নিজের গায়ে চিমটি কেটে বুঝল যে না সে মর্তের মাটিতেই আছে, স্বপ্ন দেখছে না। তারপর সামনে তাকাল, এটা কি তাদের বাড়ির কামলা শামসুল নাকি অন্য কেউ? না এ তো শামসুলকেই দেখা যাচ্ছে। সে মন্ত্রমুগ্ধের মত হঠাৎ দাড়িয়ে গেল, গম্ভির হয়ে বাইরে গিয়ে চারপাশে পরখ করে দেখলো পৃথিবী কি ঠিক আছে নাকি ওলট পালট হয়ে গেছে। হাঁ পৃথিবী তো ঠিকই আছে কিন্তু জাকিরের ভাগ্যটা উলটপালট হয়ে গেছে।

১১

অনেকদিন ধরে জাকির পায়ে হেঁটে অফিসে আনাগোনা করে। এর প্রধান কারণ হলো মেয়েগুলিকে নিয়ে উপর্যুপরি বিপর্যয় তাকে মনুষ্যত্বের স্তর থেকে পশুত্বের স্তরে নামিয়ে দিয়েছে। এখন আর সে নিজেকে মানুষ মনে করে না কীটপতঙ্গ ভাবে । সে এতটাই হিনমন্যতায় পৌঁছে গেছে যে সে মনে করে একজন রিক্সাওয়ালাও মানুষ, তার মত একটা অমানুষ রিকশায় চড়লে রিকশাওয়ালাকে অপমান করা হবে। কারন কীটপতঙ্গ কখনো গাড়ী ঘোড়ায় চড়ে না সেও চড়বে না।

তার চলার পথে একটা বিষের দোকান, এই দোকানটার প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। যখনি মনে হয় তার মেয়েগুলির বিয়ে হবে না তখনি সে বিমর্ষ হয়ে যায়, এ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে থাকে। তখন দোকানটার কথা মনে হতেই সে যেন একটা পথ খুঁজে পায়। ধীরে ধীরে দোকানটার প্রতি তার আকর্ষন বাড়তে থাকে, পৃথিবীতে এই দোকানটাই যেন তার আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। একদিন অফিস থেকে ফেরার সময় দোকানটার কাছাকাছি পৌঁছে সে পকেটে হাত দিল, টাকা বের করে দেখল। তারপর সোজা দোকানদারের নাকের ডগায় টাকাটা ধরে বলল ‘একটা কড়া বিষের বোতল দেন। দোকানদার মাঝারি সাইজের একটা বোতল দিল আর সে তাড়াতাড়ি পকেটে লুকিয়ে ফেলল।

বাসায় গিয়ে স্ত্রীকে দেখিয়ে বলল ‘আজ আমাদের উৎসব, পৃথিবীতে আজকের দিনটাই আমাদের শ্রেষ্ঠ দিন। গিন্নি আনন্দে লাফিয়ে উঠলো তারপর অনেক আইটেম রান্না বান্না করল। এরপর দুইজনে মিলে ভাল করে খাদ্যে বিষ মাখালো, মেয়েদের সবাইকে ডেকে এনে একসাথে বসিয়ে ভাল করে খাওয়ালো। তারপর বললো ‘এখন সবাই নিজ নিজ রুমে গিয়ে শুয়ে পরো। এবার স্বামী-স্ত্রী দুইজন ভালো করে খাওয়া দাওয়া করল। এরপর স্ত্রীকে বলল ‘এসো আমরা অমৃতসুধা পান করি। তারপর বিষের বোতলটা খুলে অবশিষ্ট বিষ দুইজনে দুই চুমুক খেল। তারপর দুজন বিছানায় গিয়ে জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়ল। এরপর শুধু ঘুম আর ঘুম, সমস্ত বাসাটাই ঘুম পুরিতে পরিণত হল। সর্বত্র গোরস্তানের নীরবতা, আহঃ কত আরামের ঘুম।

কিন্তু হঠাৎ সে আবিষ্কার করল তার ও তার স্ত্রীর পেছন মোড়া হাত বাঁধা। ডান দিকে তাকাল, তার মেয়েরা বিশাল একটা আসনের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে তাকাল ধাউ ধাউ করে নীল রঙের আগুন জ্বলছে, জাহান্নামের দারোগারা তাদেরকে সেদিকে হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা দারোগা তার ঘাড় ধাক্কা মেরে বলল ‘ওই হারামজাদা বউয়ের সাথে কেলকেলিয়ে এতগুলি মেয়ে পয়দা করে আবার মেরে ফেললি কেন, এখন জাহান্নামে যা। জাকির চেঁচিয়ে উঠলো, না না হুজুর আমার দোষ নাই ওই ভটকি মহিলাটার দোষ। জোবেদা বেগম চিৎকার করল, ‘না না হুজুর ও মিথ্যে বলছে, সে ছেলের লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে আমার সাথে আকাম করেছে তারপর বিয়ে না দিতে পেরে মেয়েগুলিকে মেরে ফেলেছে।

তখন দারগারা তাকে শূন্যে তুলে ‘হারামজাদা জোচ্চোর, এখানে এসেও জোচ্চোরি করতে চাস’ বলে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে চাইলে। সে চিৎকার করে উঠল ‘না না-- হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখল সে টাকা হাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে তাকাল, ‘না, পৃথিবীতেই আছে দেখে আস্বস্ত হলো শান্ত হলো। তারপর পাগলের মত জপতে লাগল ‘নাউযুবিল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ, আল্লাহ তুমি মাফ কর মাফ কর। তিন চিল্লা দিয়ে এসে এসব আমি কি কল্পনা করছি। তারপর কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, আমি দাড়ি রেখেছি, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল ‘আমি টুপি পরেছি এসব কাজ করার জন্য? এরপর ঊর্ধ্বে তাকাল, অন্তহীন আশা ও হতাশায় তার মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে, শুধু বলতে পারলো ‘মালিক আমার আমি চরম ব্যর্থ, একান্ত অসহায়, আমি সর্বান্তকরণে তোমার সমিপে আত্মসমর্পণ করলাম। আমার মেয়েগুলিকে তোমার হাতে সোপর্দ করলাম’ অজ্ঞাতসারেই তার চোখ থেকে দু'ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

বজ্রনাদে যা না হয় ক্ষুদ্র নাদেই তা হয়। মানুষ আল্লার কাছে সম্মিলিতভাবে মহাসমারোহে আবেদন করে, কাকুতি-মিনতি করে, কেঁদে বুক ভাসায় কিন্তু এই চোখের পানি আল্লাহর দরবারে খুব কমই পৌঁছায়। কারণ সেখানে থাকে কৃত্তিমতার আধিক্য। কিন্তু জাকির যে আর্তনাদ করলো তা হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে উৎসারিত হয়েছে, যে অশ্রু ত্যাগ করল সেটা তার জিগর ফাটা শোণিত। এজন্য সেই অশ্রু পৌঁছে গেছে তার অভিষ্ট ঠিকানায়। মানুষের ক্ষমতার দৌড় যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে আল্লাহর ক্ষমতা শুরু হয়।

বিষের দোকানটাকে জাকির ভয় পেয়ে গেছে, তাই সে রাস্তা পরিবর্তন করল। এখন সে অন্য রাস্তা দিয়ে অফিসে যাতায়াত করে। প্রথম দিনেই একটা সাইন বোর্ডে তার দৃষ্টি আটকে গেল। রাস্তার পাশে একটা পাঁচ তলা বাড়ি, বাড়িটার দ্বিতীয় তলার গ্রিলে সাইনবোর্ডটা দেওয়া। আসা-যাওয়ার পথে সে অন্তহীন তৃষ্ণা নিয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে সাইন বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, আক্ষেপ করে ‘কেউ চায় না আর কেউ পায় না। বাড়ীটার পাশেই একটা পুকুর, পানিটা স্বচ্ছ কিন্তু কেউ ব্যবহার করে না। সে পুকুরটার পাশে দাঁড়িয়ে চিন্তা করে স্রষ্টার কাজ হলো তেলা মাথায় তেল দেয়া। আমাদের মিঠাপানির দেশে এসব নদী পুকুর সরোবরের কোন প্রয়োজন ছিল না, এগুলোর পানি কেউ ব্যবহার করে না। পক্ষান্তরে মরু অঞ্চলের মানুষ তৃষ্ণা নিবারণের পানিটুকু পর্যন্ত পায় না, তাদের কোন নদী সরোবর নেই। এই পুকুরের পানি আমরা টয়লেটেও ব্যবহার করি না অথচ ওরা পেলে অমিয় সুধা হিসাবে পান করত। তারপর সে সাইন বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে ‘আমার এত প্রয়োজন অথচ এরা এখানে পচছে, কেউ পায় না আর কেউ খায় না’ বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে চলে যায়।

একদিন সে সাইন বোর্ডটার দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টি গেল নিচ তলার গ্রিলে টাঙ্গানো টু-লেট এর প্রতি। সে গেট খুলে দৌড়ে গিয়ে টু- লেটে দেওয়া মোবাইল নাম্বারে কল করল। তত্ত্বাবধায়কের সাথে দেখা করে তিন হাজার টাকা এডভান্স করে আগামী মাসে বাসায় উঠার কথা পাকাপাকি করল। বাসায় গিয়ে স্ত্রীকে বলল ‘এ বাসায় আর থাকা যাবে না ভাড়া বাসায় চলো। গিন্নি চোখ কপালে তুলে বললো ‘কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ এমন আজগুবি সিদ্ধান্ত কেন? জাকির সংক্ষেপ উত্তর দেয় ‘দরকার আছে। কিন্তু স্ত্রী নাছুর বান্দা ‘সেই দরকারটা কী?

জাকির বলল ‘এতকিছু জেনে তোমার দরকার কি? ঐ বাসাটা আমার অফিসের কাছে। আবার যদিও সে বাসার কাজ করাবে না তবুও অজুহাত হিসাবে বলল ‘দেখ না এই বাসাটা পুরাতন হয়ে গেছে কিছু কাজ করাতে হবে। কিন্তু মনের গোপন অভিসন্ধিটা সে মনের মধ্যেই গোপন রাখল। পরের মাসে তারা নিজের বাসা ভাড়া দিয়ে ভাড়া বাসায় চলে গেল। জোবেদা বেগম গেইটের কাছে যেতেই সাইন বোর্ডটার উপর তার দৃষ্টি পড়ল, সাথে সাথে তার মুখটা হা করে উঠল। স্বামীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল ‘এজন্যই তুমি এখানে এসেছ? জাকির বেচারা লজ্জা পেয়ে ধমকে উঠল ‘মূর্খ, সারাজীবন তোমার মুখ এমন হা করেই থাকবে।

বিষয়: সাহিত্য

২১৬৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File