গল্প (জীবনের গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৪ নভেম্বর, ২০১৮, ০১:০৯:৫৮ দুপুর
লেখকের কল্পনাশ্রিত ঘটনা যা বাস্তবে ঘটেনি কিন্তু যদি ঘটত তাহলে এমনই ঘটত- এই হল সাহিত্যিকদের মতে গল্পের সংজ্ঞা। কিন্তু আমার মতে গল্প বাস্তবও হতে পারে কল্পনাশ্রিতও হতে পারে। কারণ আমি বাস্তব ও কল্পনাশ্রিত- উভয় প্রকারের গল্প-উপন্যাস লিখছি। অর্থাৎ আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলি কিছুটা কল্পনার বার্নিশ দিয়ে গল্প-উপন্যাসে রূপদান করছি। সেই সাথে শুধু কল্পনাশ্রিত লেখাও আছে। এখন প্রশ্ন হলো প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে কিছু রহস্য কিছু গোপনীয়তা থাকে- যা প্রকাশ করে দিলে তার মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়, সে আর মানুষ থাকে না। হা আসলে আমি মানুষ নয় বড়জোর দুপেয়ে একটা প্রাণী বলা যেতে পারে। কারণ ধৈর্যের একটা সীমা থাকে, আমার বয়স চল্লিশের দশক পেরোতে যাচ্ছে- এ বয়স পর্যন্ত আমার কোন সান্ত্বনা নাই আলো নাই বিজয় নাই আছে শুধু লাঞ্ছনা-বঞ্চনা গ্লানি আর পরাজয়। আজীবন সংগ্রাম করেছি আর ব্যর্থ হয়েছি, বারবার পশুশক্তির কাছে পরাজিত হয়েছি। আর তা এতটাই বেশি যে কোন একক মানব জীবন এতটা গ্লানিময় আর পরাজিত সাধারণত দেখা যায় না। যারা কবর উপন্যাস পড়েছেন তাদের কিছুটা অবগতি হয়েছে।
আসলে আমি জীবনের সবকিছু থেকে হাত ধুয়ে ফেলেছি, হতাশ হয়ে গেছি এখন আর আমার কোন কাজ নাই। তাই গ্রামীণ নিষ্কর্ম মেয়েদের কাথা সিলানোর মত বসে বসে কাঁথা সিলানো মানে লিখা ছাড়া আমার আর কিছু করণীয় নাই। কাজেই এখন আমার লক্ষ হলো আমার আত্বকাহিনি লিখে যাওয়া- এটাই আমার একমাত্র সান্তনা। কারণ মানুষ চায় তার দুঃখগুলি মনের কথাগুলি মানুষ জানুক। রাজা অশোক তার মনের বার্তাগুলি শৈলগাত্রে খোদাই করে গিয়েছিলেন। আমিও চাই আমার আত্মকথা মানব হৃদয়ে খোদাই করে যেতে- যাতে মানুষ চিরপরাজিত এক চিরযোদ্ধার নিঃশব্দ হাহাকার শুনতে পায়। কাজেই আমি আমার জীবনটাকে গল্প-উপন্যাসে রূপান্তর করার চেষ্টা করছি। তবে আমার আত্মজৈবনিক লেখা হতে পারে বড়জোর দশ-বারোটা, বাকি সব লেখা হবে কল্পনাশ্রিত।
গত এক বছর ব্লগ থেকে অনুপস্থিত ছিলাম। কারণ আমার ভাগ্য বড় আজব যাদুকর- কিছুদিন পরপর বিপর্যয় নামে, আর তা সামাল দিতে যথেষ্ট সময় লেগে যায়। আশা করি এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারব, চেষ্টা করব মাসে মাসে একটা করে উপন্যাস নামাতে বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। গল্প-উপন্যাস পাঠকদের দাওয়াত দিচ্ছি, আপনারাও সাহিত্য প্রেমিকদের দাওয়াত দিবেন, মাঝে মধ্যে মন্তব্য করবেন, আমার লেখাগুলির মূল্যায়ন করবেন, ভালো লাগল কি মন্দ লাগল জানাবেন। গল্প শিরোনাম দিয়েছি বিধায় গতবছরের লেখা দুটি ভৌতিক গল্প দিয়ে দিলাম। তবে লেখাগুলি লম্বা হবে, সেভ করে সময় সুযোগমত পড়ে নিবেন। এবার চলুন----
অদৃশ্য প্রতিবেশী
অগ্রহায়ণ মাস, আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। বর্তমানে মেশিনে ধান মাড়াইয়ের কাজ করা হয় কিন্তু এক দশক পূর্ব পর্যন্ত এ কাজটি গরু দিয়ে করা হতো। উঠানে একটা খুঁটি পুঁতে তার সাথে তিন থেকে আট- নয়টা পর্যন্ত গরু জুড়ে দেওয়া হতো। একজন হাতে একটা লাঠি নিয়ে হুটহাট করে গরুগুলিকে খুঁটির চারপাশে বৃত্তাকারে ঘোরাতো আরেকজন ধানের আঁটি ভেঙ্গে ছড়িয়ে দিত। এভাবে গরুর খুরের চাপে খর থেকে ধান আলাদা হয়ে যেত। মাড়াইয়ের কাজ হয়ে গেলে গরুগুলি ছেড়ে দেয়া হতো। তারপর খর ঝেড়ে ঝেড়ে ধান আলাদা করা হতো। জনাব আলী আর আইয়ুব আলী দুই ভাই, বাপ নাই একান্নভুক্ত সংসার। বড় ভাই জনাব আলী বিয়ে করেছে কিন্তু আইয়ুব আলী এখনো বিয়ে করেনি। তারা প্রান্তিক কৃষক, কিছু নিজের জমি আছে আর কিছু অন্যের জমি বর্গা করে সংসার চালায়।
ফজরের আযানের আগেই জনাব আলী তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠল। কারন ধান মাড়াই করে আবার সকালে মাঠে হাল চষতে যেতে হবে। আর ধান মাড়াই করার মতো সাত- আটটি গরু সাধারণত একজন কৃষকের থাকে না। তখন তারা বিনিময় করে কাজ চালায়- অর্থাৎ একজনের গরু আরেকজন এনে মাড়াই করে তারপর অন্য জন তাঁর গরু নেয়। জনাব আলি গরু বিনিময় করে কালার বাপের সাথে। সে ঘুম থেকে উঠেই ছোট ভাইকে ডাকলো ‘আইয়ুব আলী এখনো উঠিস নাই, তাড়াতাড়ি যা কালার বাপের গরুগুলি নিয়ে আয়। মাড়াই করে সকালে আবার হাল নিয়ে যেতে হবে। কালার বাপের বাড়ি আধা কিমিঃ পশ্চিম দিকে। আইয়ুব আলী অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠলো। তার ঘুম পূর্ণ হয়নি, ঘুম ঘুম চোখে টলতে টলতে যেতে লাগলো। তাদের বাড়িটা একটা বস্তি, এর দক্ষিণ থেকে পশ্চিমমুখি বিশাল জঙ্গল। মাঝখানে একটু ফাঁকা মাঠ, আবার উত্তর দিক থেকে আসা আরেকটা ভয়াল জঙ্গল। এই জঙ্গলের দক্ষিণ মাথায় একটা দানবাকৃতির চৈতা গাছ আছে। গ্রামে জনশ্রুতি আছে এখানে একটা কিছু থাকে। এখান থেকে কিছুটা পশ্চিমেই কালার বাপের বাড়ি।
ভোরের সামান্য আলো ফুটেছে বটে কিন্তু তখনো অন্ধকার, এ যেন ভৌতিক আলো আঁধারির মেলা। আইয়ুব আলী বাড়ির পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে ঘুম জড়ানো চোখে মাতালের মত টলতে টলতে হেঁটে যাচ্ছে। জঙ্গলের দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছে চকিতে কিছু একটা দেখতে পেল, জড়তা কাটিয়ে চোখ বিস্ফারিত করে সামনে তাকাল আর সাথে সাথে তার কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে গেল, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল তিব্র আতঙ্কের একটা হিমবাহ। মাথার চুল পর্যন্ত সজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে গেল। তার মাত্র কয়েক হাত সামনে চৈতা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো মিনার, অন্তত একশো হাত উঁচু, মিশমিশে কালো, বিশাল ভুড়ি, গা জুড়ে আঙ্গুলের মত মোটা মোটা লম্বা লম্বা পশম বটগাছের ঝুড়ির মত ঝুলছে, কান দুইটা কোলার ন্যায় হাতির কানের মত নাড়াচ্ছে, মর্মর পাথরের পিলারের মতো সাদা ধবধবে দাঁত ঠোঁটের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আইয়ুব আলী ক্ষণকাল কোন নড়াচড়া করতে পারল না, তার পা দুটি মাটির সাথে সেঁটে গেছে, গলা রুদ্ধ হয়ে গেছে। সহসা ‘ও ভাই ভাইরে আমারে খাইয়া ফালাইছে’ বিকট চিৎকার করে পেছন ফিরে বাড়ির দিকে দৌড় দিল। কিন্তু কিছু দূর গিয়েই একটা আলে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।
‘ডরাইস না আমি আইয়া পরছি’ চিৎকার দিয়ে জনাব আলী বাতাসের বেগে দৌড়ে এল। আয়ুব আলি মুখ থুবরে পড়ে আছে, সে জড়িয়ে ধরে তুললো কিন্তু সাথে সাথে আইয়ুব আলী তাকে এক ঝটকা মেরে ফেলে দিয়ে নাচতে নাচতে চিৎকার শুরু করল ‘এত বড় সাহস, আমার আস্তানায় গিয়ে হানা দেয় আজ ওকে খেয়ে ফেলবো’ বলে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে নাচতে লাগলো। জনাব আলী তাকে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে চায় কিন্তু আইয়ুব আলী তাকে প্রচন্ড শক্তিতে ফেলে দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। ততক্ষণে হট্টগোল শুনে আশপাশের কয়েকজন দৌড়ে এলো, তারপর সকলে মিলে জাপটে ধরে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। বিছানায় শুয়েই সে চেঁচামেচি শুরু করলো ‘আমি ওকে খেয়ে ফেলব, ওর বংশ নির্বংশ করে দেব। সে আমার সাত পুরুষের ভিটায় হানা দিয়েছে, আমার গায়ে পাড়া মেরেছে’ ইত্যাদি বলে বকবক চালিয়ে যেতে লাগল।
ফজরের নামাজের পর ইমাম সাহেব ও মুসল্লিরা আসলো। রোগীর ঘরে তাদের বসার জন্য চেয়ার পিড়ি মোড়া ইত্যাদি দেয়া হল। ইমাম সাহেব একটা চেয়ারে বসে জিনের সাথে জেরা শুরু করল ‘কিরে খবিশ, রোগীকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন, সে তোর কি ক্ষতি করেছে? ইমাম সাহেব জিন-ভূতের তদবির করে না তবু ভয় দেখানোর জন্য বলল ‘এখনই রোগীকে ছেড়ে যা নইলে তোকে আগুনে পুড়িয়ে মারব। কথাটা শুনেই রোগী উঠে বসল, মিটিমিটি হেসে বিছানা থেকে নামল। ইমাম সাব চৌকির পাশে চেয়ারে বসা। তারপর সহসা ইমামের পা ধরে হ্যাচকা টানে উপরে তুলে উল্টে ফেলে দিল, পা উপরে উঠে যাওয়ার কারণে বেচারার লুঙ্গি উল্টে গিয়ে উলঙ্গ হয়ে গেল আর সাথে সাথে রোগী হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। মুসল্লিরা ‘এটা কি করল এটা কি হলো’ বলে হায় হায় করে উঠলো। ইমাম সাব ধড়ফড় করে উঠে কাপড় সামলে নিল, বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। রোগী গর্জাতে লাগলো ‘দেড় টাকার মুন্সি আমাকে ধমকাতে এসেছিস, এক্কেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবো লবণ দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবো। তার বকবক চলতে লাগল। ইমাম সাব জীন ভূতের তদবির করে না বেচারা অসহায় হয়ে বলল ‘এমন খবিশ জিন তো জীবনে দেখিনি, এটা খুব বেয়ারা জিন, এটাকে শায়েস্তা করতে হলে সন্দেশের বাপকে আনতে হবে। তাড়াতাড়ি যান’ বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
সন্দেশের বাপের বাড়ি দেড় কিমিঃ দূরে। এলাকায় একমাত্র তিনিই জিনে ধরা রোগীর চিকিৎসা করেন। একজন সাইকেল নিয়ে রওনা হল এবং দেরি না করে সাইকেলে তুলেই তাকে নিয়ে আসলো। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ মানুষ, নাভি পর্যন্ত সাদা ধবধবে দাড়ি, টুপি পাঞ্জাবি পরা বুজুর্গ ধরনের মানুষ। তিনি এসেই উঠানের এককোনায় ওযু করতে বসলেন- অর্থাৎ ওজু করে রোগী দেখবেন। রুগী একেবারে নীরব তার মুখে টু শব্দটা পর্যন্ত নাই। সে আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে উঁকি দিয়ে ফকিরকে দেখলো- বৃদ্ধ তেপায়ায় কুঁকড়ে বসে অযু করছে। তারপর এক দৌড়ে গিয়ে হাটু সমেত তার কুকড়ানো দেহটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে একটানে মাথার উপর তুলে চিৎকার করে উঠল ‘এখানে আইছস ক্যা, আমাকে কষ্ট দিতে আইছস তার আগেই তোকে’ বলে আছাড় মারতে গেল। রোগী দেখার জন্য গ্রামের অনেক মানুষ এসেছে, তারা চোখের পলকে রোগীকে জাপটে ধরল, টানাহ্যাঁচড়া করে ফকিরকে ছাড়িয়ে নিয়ে তেপায়ায় বসাল। বৃদ্ধ বেছারা থরথর করে কাঁপছে, রোগীকে তার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল।
সন্দেশের বাপ রাগে কাঁপতে কাঁপতে কোনরকম ওজুটা শেষ করল। তারপর পকেট থেকে একটা মাদুলি বের করে গিয়েই রোগির কপালে ঠেসে ধরলো ‘বদ জ্বীন তোর এত বড় সাহস আমার সাথে বেয়াদবি করিস। আজ তোকে পুড়িয়ে মারব। রোগীর কপাল থেকে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে, সে ঘোড়ার মত চেঁচাচ্ছে আর হাত-পা ছুড়ছে। কয়েকজন তাকে ঠেসে ধরে রেখেছে। একসময় রোগী চেঁচিয়ে হুড়োহুড়ি ও হাঙ্গামা করে ক্লান্ত হয়ে বেহুশের মত পরে রইলো। ফকির হাঁফাতে হাঁফাতে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করল। তারপর গিয়ে সওয়াল জওয়াব শুরু করলো ‘আইয়ুব আলীকে ধরছস ক্যা? হ্যায় তোর কি অন্যায় করেছে? রোগী বলল ‘আমি খাদ্যের তালাশে বারাইছিলাম, অনেক পরিশ্রম করে এসে বসে বসে বিশ্রাম করছি তখন সে গিয়ে একেবারে আমার মাথায় পাড়া মারলো। ফকির বলল ‘এটাতো তোর দোষ, তুই লোক চলাচলের রাস্তায় বসলি কেন, সে তো তোকে দেখতে পায়নি এখন ছেড়ে যা। রোগী ঝংকার মেরে উঠল ‘না যাব না, ওটা আমার তিন পুরুষের ভিটা আড়াই হাজার বছর ধরে আমি ওখানে আছি। আর সে কিনা আমার বাড়িতে গিয়ে আমাকে আক্রমন করেছে, আমি ওকে খেয়ে ফেলেছি।
‘খেয়ে ফেলেছিস দেখ কে কাকে খায়’ বলে ফকির চুনের সাথে একটা পদার্থ মিশিয়ে নাকের গোড়ায় ধরল আর অমনি শুরু হলো ঘোড়ার মত চিৎকার ‘যাব যাব আমাকে ছেড়ে দেন’ বলে চেচাতে লাগলো। কিন্তু ফকির তাকে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি দিতে লাগল। অবশেষে রোগীর অবস্থা যখন একেবারেই নাজুক বেহুশ হওয়ার উপক্রম তখন ফকির তাকে ওয়াদা করাল ‘আর কোনদিন আসবে না, যদি আসে তাহলে তাকে আজীবনের জন্য বোতলে আটকে রাখা হবে। রুগী রুপি জিন এ কথার স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তি পেল। ফকির দরজা থেকে লোকজন সরিয়ে দিয়ে জিন যাওয়ার পথ করে দিল। জিন ছেড়ে যাওয়ার সময় রোগী বেহুঁশ হয়ে যায় বা বেহুঁশ থাকে। আইয়ুব আলীর মুখে পানির ঝাপটা দেওয়া হলো, সে পিটপিটিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে উঠে বসলো। চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো ‘কি ব্যাপার এত মানুষ কেন আমার কি হয়েছে? পরক্ষণেই তাঁর স্মৃতি ফিরে এলো। ‘বাপরে কি ভয়ংকর জিনিস’ বলে তার তার শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠলো। এরপর ফকিরের প্রশ্নের জবাবে বলল ‘সে কি দেখেছিল। লোকেরা বললো ‘তারপর কি হল? আইয়ুব আলী বললো ‘জিনিসটা দেখে আমি পিছন ফিরে দৌড় দিলাম এরপর আর কিছুই মনে নাই। হ্যাঁ ভোর থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত ছয় ঘন্টা সময় সম্পর্কে আইয়ুব আলী কিছুই বলতে পারল না। এ সময়টা তার জীবন থেকে উধাও হয়ে গেল, কেন এবং কিভাবে উধাও হল কোথায় গিয়েছিল সে, মেরাজে? বিজ্ঞান এর কি জবাব দিবে?
গ্রামের কৃষিনির্ভর মানুষ যারা তাদের সারা বছর কাজ থাকে না। ধান রোপন ও কাটার সময়টা বাদে বাকি সময় তারা খেলাধুলা ও আনন্দ-ফুর্তি করে কাটায়। বিশেষত আমন রোপনের পর ভাদ্র আশ্বিন কার্তিক এই তিনটা মাস তারা আড্ডা ও খেলাধুলায় মেতে থাকে। জনাব আলী আয়ুব আলি দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই জনাব আলী হলো প্রধান আড্ডাবাজ। কাজ না থাকলে সে সারাদিন ও অর্ধেক রাত পর্যন্ত আড্ডায় মেতে থাকে। দিনে হা-ডু-ডু দাঁড়িয়াবান্ধা, রাতে তাস খেলা বা গল্প গল্পগুজব করে সময় কাটায়। সে এমনই আড্ডা পোকা যে, বিয়ের দিন নতুন বউ বাড়িতে রেখেই সে পাশের হিন্দু বাড়িতে গিয়ে তাসের আড্ডায় বসল। বন্ধুরা বলল ‘আজ ছাড়বো না, বাসরের সাধ মিটিয়ে দিব ,আমাদের সাথে সারারাত খেলতে হবে। গ্রামের অশিক্ষিত গোয়ার মানুষ, স্ত্রীর অধিকার আদায়কে মনে করে স্ত্রৈণতা ও অপমানজনক। সেও বীরত্ব জাহির করল ‘যাব না, আমিও দেখিয়ে দিব।
ব্যস শুরু হল রাত জেগে খেলা। প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাত খেলায় কেটে গেল। নতুন বউ খাওয়ার সময়টুকুতে শুধু বুঝতে পারল ‘এই লোকটা তার স্বামী, এর বাইরে স্বামীর মুখদর্শন তার ভাগ্যে জুটলো না। তিনদিন পর ফিরতি নায়র করানোর জন্য বউয়ের বাপ, বড় ভাই ও ভগ্নিপতি এসে হাজির। তারা সকালে এসে তাড়া দিল বিকালে মেয়ে নিয়ে চলে যাবে। গায়ের মানুষ- এরা সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নায় একসাথে গলাগলি করে চলে। তাদের সম্পর্কটা সহোদর ভাইয়ের চেয়েও গভীর, নখ- গোশতের চেয়েও নিবিড়। এবার তো বন্ধুদের মাথায় কড়াত পড়ল ‘সর্বনাশ, এ অবস্থায় মেয়েটাকে নিয়ে গেলে বাড়িতে তার ভাবি দাদী নানীর সাথে আলাপ করবে স্বামীর সাথে তার দেখা হয়নি। তখন সবাই ভাববে জামাই হয়তো নপুংসক অথবা চরিত্রহীন- বাইরে বাইরে রাত কাটায়। তখন গন্ডগোল হবে এমনকি বিয়েটাও ভেঙ্গে যেতে পারে। তারা জরুরী পরামর্শ সভায় বসে সিদ্ধান্ত স্থির করলো।
দুপুরে খাওয়ার সময় মেহমানদেরকে এক বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল কিন্তু খাওয়া দিল বিলম্ব করে। এখানে কিছুক্ষণ গল্প করে সময় কাটিয়ে আরেক বন্ধুর বাড়ি নিয়ে গেল। সেখানে পিঠা খেতে দেয়া হলো তখন প্রায় বিকেল। মেহমানরা বলল ‘আমাদের যে উঠতে হয়। বন্ধুরা বলল ‘তালই সাব যাবেনই তো, এসেছেন যখন আমাদের এলাকাটা ভালো করে দেখে যান। চলুন বিলটা দেখবেন, প্রচুর মাছ থাকে বিখ্যাত বিল, নিশ্চয়ই নাম শুনেছেন? আপনার জামাই বাড়ির জমি আছে এখানে’ বলে বেচারাদের জোর করে নিয়ে গেল। বিল দেখার পর বলল ‘কাছেই বাজার, চলুন বাজারটা দেখে আসবেন’ বলে জোরজার করে নিয়ে গেল। তখন বিকাল গড়িয়ে গেছে, মেহমানরা যাওয়ার জন্য তাড়া দিল। তারা বলল ‘হা একটু চা খেয়েই চলে যাবেন। ব্যস চা স্টলে গণ্যমান্য কয়েকজন ডেকে এনে আলাপ জুড়িয়ে দেয়া হল। আর এক আলাপেই রাত নয়টা। তারপর মেহমানদের বাড়িতে নিয়ে আসা হল, খাওয়া দাওয়ার পর বলল ‘তালই সাব শুয়ে থাকেন, আল্লায় বাঁচাইলে কাল সকালে রওয়ানা হবেন।
এবার বন্ধুরা জনাব আলীকে বাসর ঘরে পাঠাবে কিন্তু তার কোন পাত্তা নাই। শুরু হলো খোঁজাখুঁজি, একজন সংবাদ দিল সে তাস খেলার ঘরে একাকী বসে আছে। বন্ধুরা দৌড়ে গেল, জনাব আলি বলল ‘কিরে তাস খেলবি না? বন্ধুরা বলল ‘হারামজাদা তাস তোর গোয়া দিয়া দিমু, তাড়াতাড়ি ঘরে যা। কিন্তু সে বলল ‘এ কয়দিন তাস খেলে খুব নেশা ধরে গেছে, আজ না খেললে চলবে না। আসলে সে জেদ ধরেছে, বন্ধুদের কারণে নব বধুর সাথে দেখা করতে পারেনি আর করবেও না। যাওয়ার জন্য বন্ধুরা ধাক্কায়, কিল-ঘুসি মারে কিন্তু এই গোয়ার কোনভাবেই যাবে না। গ্রামে একজন বুড়া মুরুব্বী আছে, ঠিক মত চোখে দেখে না কানে শুনে না লাঠিতে ভর দিয়ে হাটে, সবাই তাকে দাদা ডাকে। বন্ধুরা অপারগ হয়ে বুড়ার কাছে গিয়ে ঘটনা বলল। বুড়া এসে লাঠির কয়েক ঘা দিয়ে বলল ‘হারামজাদা দেশের বদনাম করতে চাস, নিজের মুখে চুনকালি লাগাতে চাস। তাড়াতাড়ি বাসর ঘরে যা। এভাবে বিষয়টা সুরাহা হলো। গ্রামের লোকেরা দরিদ্র, ঠিকমত খেতে পায়না পরতে পায় না কিন্তু এভাবে আনন্দ স্ফুর্তি নিয়ে তারা জীবন কাটায়।
এই আড্ডা বিভিন্ন বাড়ির কাচারি ঘরে হয় বাজারেও হয়। কাইচাপুর বাজার তাদের বাড়ি থেকে এক দেড় কিমিঃ দূরে। জনাব আলী বাজার সওদা করার পর গিয়ে তাসের আড্ডায় বসলো। খেলা খুব জমে উঠেছে, রাত একটায় উঠে দেখল তার প্রতিবেশীরা সবাই চলে গেছে তাকে একা যেতে হবে। কিন্তু সে নির্ভীক মানুষ, চা স্টলের লাকড়ি থেকে একটা লাঠি কুড়িয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করল। অন্ধকার রাত সে আপন মনে হেটে যাচ্ছে। সাহসী ও শক্তিশালী হিসেবে এলাকায় তাদের দুই ভাইয়ের খ্যাতি আছে। গাট্টাগোট্টা স্বাস্থ্যবান, বুকের পাটা দেখলেই তাদের সাহসের আন্দাজ পাওয়া যায়। তবে আইয়ুব আলী বড় ভাইয়ের মতো সাহসী নয়। এই এলাকাটা অধিকাংশ জঙ্গল, ভয়াল ভয়াল জঙ্গল। গ্রামবাসীরা জানে এসব জঙ্গলে অদৃশ্য জগতের প্রাণীরা থাকে। জনাব আলী আপন মনে হাটে, সামনে সরকার বাড়ি। আর সরকার বাড়ির পিছনে একটা ভয়াল জঙ্গল, এই জঙ্গলের পাশ দিয়েই রাস্তা। এখানে একটা জিনিস থাকে সুযোগ পেলেই ক্ষতি করে। এজন্যই রাতে এ রাস্তা দিয়ে কেউ একা আনাগোনা করে না।
নিঝুম রাত, ঝিল্লি রব আর শিয়ালের হুক্কাহুয়া ছাড়া কোনো সাড়াশব্দ নেই। শশীহীন তারার অস্পষ্ট আলোয় সবকিছুই কেমন ভৌতিক মনে হয়। এমন পরিবেশে আলেকজান্ডার- হিটলারদেরও বুক কেঁপে উঠবে। জনাব আলী বেপরোয়াভাবে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু সে হঠাৎ জঙ্গল থেকে কিছুটা দূরে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সে ভীতু নয় কিন্তু শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে, ললাট ঘামছে, চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যা দেখেছে তা সঠিক কিনা বুঝার জন্য কিছুক্ষণ পর চোখ পিটপিট করে আবার তাকাল- এক ভয়ানক আজদাহা জঙ্গলের মাঝে এক পা ও রাস্তায় এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাথা আকাশে। আবলুস কালো শরীরে মোটা মোটা পশম রশির ন্যায় ঝুলছে। এর উচ্চতা কত- একশো, দুইশো, পাঁচশো বা হাজার হাত- জনাব আলী আন্দাজ করতে পারল না। জিনিসটা থেকে পচা লাশের মতো একটা বিকট দুর্গন্ধ আসছে। অন্য কেউ হলে তীব্র আতঙ্কে কলিজা কেটে যেত কিন্তু সে জিনিসটা সরে যাওয়ার জন্য নীচ দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষার প্রহর কাটে কিন্তু কালা পাহাড়টা রাস্তা আগলে দাঁড়িয়েই আছে।
তখন তার উচিত ছিল চিৎকার করা বা কাউকে ডাক দেয়া অন্তত কারো বাড়িতে গিয়ে উঠা। কিন্তু তা না করে সে গ্রামীণ মূর্খ গোঁয়ারের মতো দুঃসাহস দেখাতে গেল, আত্মঘাতী কাজ করে বসলো। সে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, কাছাকাছি পৌঁছে হাতের লাঠিটা জিনিসটার গায়ে নিক্ষেপ করে চোখ বন্ধ করে মরণপণ দৌড় দিল। এক দৌড়ে গিয়ে বাড়িতে উঠলো, তার কিছুই হলো না। বাড়িতে গিয়ে কাউকে কিছু বলল না, খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু রাত থেকেই শুরু হল জ্বর, পরদিন থেকে তার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। খেতে চাইলে যেকোনো জিনিস এমন কি পানির মধ্যেও পচা লাশের গন্ধ পায়, জোরজার করে দু’এক লোকমা খেলেও বমি করে দেয়। খাওয়া একদম বন্ধ হয়ে গেল স্যালাইন পুশ করে রাখা হলো। জ্বর ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল, ডাক্তার-কবিরাজ, পীর-ফকির, উজা-বৈদ্য অনেক আনা হলো কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আর সোজা হয়ে দাঁড়ালো না। অবশেষে তিন মাস ভোগান্তির পর বেচারা জীবনের লেনদেন চুকিয়ে ফেলল। অদৃশ্য শক্তির সাথে দুঃসাহস দেখানোর মাশুল তাকে এভাবেই দিতে হলো।
সংসারের দায়িত্ব চাপলো আইয়ুব আলীর উপর। বড় ভাই মারা গেছে, তার আধা ডজন পোলাপান, নিজে বিয়ে করেছে। একান্নভুক্ত সংসার, কাজেই সব দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হয়। তাদের বাড়ির উত্তর দিকে শালজান বিল, মাছের জন্য এই বিলটা বিখ্যাত। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দুই কিঃমিঃ আয়তনের এই বিলের মধ্যে কোন বাড়িঘর নেই। তবে বিল কেন্দ্রিক চারধারে পল্লী গড়ে উঠেছে। বিলটায় সারা বছর প্রচুর মাছ মারা হয়, বিশেষত পৌষ মাঘে যখন পানি কমে যায় তখন কৃষকরা নিজ নিজ ক্ষেতের চারধারে বিলের কচুরিপানা দিয়ে উঁচু করে আল বেঁধে মাছ মারে। বিলে আইয়ুব আলীদেরও জমি আছে, সেও ক্ষেতের চারধারে আল বেঁধে মাছ মারা শুরু করেছে। মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহ, তখন কুয়াশা ও ঠান্ডা কম। আইয়ুব আলী খাওয়া দাওয়ার পর রাস্তায় বসে কিছুক্ষণ বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিল। তারপর খালুইটা নিয়ে বিলের দিকে রওয়ানা হল। বাঁশের চটা দিয়ে নির্মিত মাছ রাখার পাত্রকে আঞ্চলিক ভাষায় খালুই বলা হয়।
বিলে মাছ ধরার জন্য রাত দিন সব সময় মানুষ থাকে। সে গিয়ে দেখল তার প্রতিবেশী অনেকেই মাছ ধরছে। সে নাম ধরে ডাকলো ‘কিরে আসাম উদ্দিন, কছিম উদ্দিন, সিরাজ, শাহাবুদ্দিন মাছ কেমনরে? সবাই শুধু হু হা করলো কেউ সঠিক উত্তর দিল না। সে বুঝল সবাই মাছের নেশায় পড়েছে, নিশ্চয়ই প্রচুর মাছ মারা পড়ছে। সে তার ক্ষেতের আলে গিয়ে দাঁড়ালো। বিশাল ক্ষেতের চারপাশে কচুরিপানা দিয়ে উঁচু আল বাধা হয়েছে। এই আলের উপর দিয়ে হাঁটলে কচুরিপানা স্প্রিংয়ের মত ঝাম করে, সাবধানে হাঁটতে হয় নইলে কচুরিপানার জাম্পিং নিক্ষেপ করবে ক্ষেতের গলা পানিতে। সে পাঁচটা বাইর পেতেছে, ক্ষেতের চার কোনায় চারটা আর একটা পেতেছে আলের মাঝ বরাবর লম্বা ড্রেন করে তার মাথায়, এতে মাছ বেশি আটকা পড়ে। বাঁশের শলাকা দিয়ে নির্মিত মাছ মারার যন্ত্রকে অঞ্চল ভেদে বাইর মুচনা ইত্যাদি বলা হয়।
আইয়ুব আলী প্রথমেই ড্রেনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখেই তার মাথা ঘুরিয়ে গেল, কৈ, শিং, মাগুর, শোল টাকি ইত্যাদি মাছ ড্রেন উপচে পড়ছে। সে মাছ দেখে বাহ্যিক হুঁশ হারিয়ে ফেলল। গায়ের চাদরটা একপাশে নিক্ষেপ করে লেংটি মেরে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল, দু’হাতে জাবরে মাছ ধরছে আর পাশের খালুইয়ে রাখছে। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সে মাছ ধরে খালুইয়ে রাখছে কিন্তু খালুইয়ে মাছ একটাও নাই।
বিচিত্র পৃথিবী আরো বিচিত্র মানুষ ও প্রকৃতি। জরানি হলো এই বহু বিচিত্রের এক বিচিত্র। এই বিলটার দুটি কিংবদন্তি রয়েছে- জরানি আর মেছোভূত। জরানী হলো ষাটোর্ধ্ব বয়সের মোটাসোটা গাট্টাগোট্টা সাইজের এক বৃদ্ধ, মাথার চুল এমনকি ভুরু পর্যন্ত পেকে সাদা হয়ে গেছে, বুক ভর্তি সাদা ধবধবে দাড়ি, পশুর মতো সারা দেহ শুভ্র পশমে ঢাকা, গরিলার মতো মোটা মোটা হাত পা, পাকা আমের মতো গায়ের রং রোদ-বৃষ্টিতে বিবর্ণ হয়ে গেছে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্সা সারা বছর একটা পশমের গেঞ্জি গায়ে জড়িয়ে থাকে। যে কেউ দেখে বুঝবে লোকটা সামাজিক নয় আরণ্যক। তার বাড়ি বিলের পূর্ব দিকে বড় রাস্তার পূর্বপাশে। তেমন জমিজমা তার নাই সামান্য কিছু আছে আর কয়েকটা পোলাপান আছে, তারাও কিছু রোজগার করে। এ দিয়েই সংসার চলে সে নিজে উপার্জনের কোন ধার ধারে না।
বিলে তার দুই একরের মত জমি আছে, সেখানেই সে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সারা বছর পরে থাকে। তার জমির মাঝখানে মাটি কেটে অনেক উঁচু করে একটা ভিটি বানিয়েছে- যাতে বর্ষায় তলিয়ে না যায়। তাতে তাবুর মতো খরের বিছালী দিয়ে একজন থাকার মত একটা ঘর বানিয়েছে- যাকে আঞ্চলিক ভাষায় ঘলা বলা হয়। বৃষ্টি হলে ভেজা কাকের মত জবুথবু হয়ে বসে থাকে, কাঁথা-বালিশ সব ভিজে যায়। পরদিন রোদে শুকায়, না শুকালে বা টানা বর্ষার দিনে এই ভিজা খাতা বালিশ নিয়েই পড়ে থাকে। অষ্ট প্রহর সে এখানেই থাকে শুধু সকাল সন্ধ্যা খাওয়ার জন্য বাড়িতে যায়। বর্ষায় বিল যখন পানিতে টইটম্বুর হয়ে যায় তখন সে ভেলা নিয়ে তার ঘরে আনাগোনা করে। সে জেলে নয় যে বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে, তবে খাওয়ার জন্য কিছু কিছু মাছ মারে। প্রশ্ন হল, তাহলে সে সার্বক্ষণিক বিলে পড়ে থাকে কেন? এটাই রহস্য এটাই বিচিত্র।
ভর বর্ষায় বিলে কোন জন- প্রাণীর অস্তিত্ব থাকে না। রাত হলে বিলের বুকে নেমে আসে শ্মশানের নীরবতা, তখনো জরানি এই সীমাহীন জলধি বক্ষে কয়েক ফুট দ্বীপে আজরের মতো একাকী জীবন কাটায়। বসে বসে কখনও হুক্কা টানে, কখনো ঘুমায়, কখনো নির্বাক হয়ে বসে থাকে। অন্ধকার রাতে দূর থেকে তার হুক্কার আগুন দেখা যায়। তার সার্বক্ষণিক সাথী হলো তামাক হুক্কা আর আগুনের বেণী। সমাজের কারো সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই, বন্ধুত্ব নাই লেনদেন নাই। তার বন্ধুত্ব এই বিলের নিগূঢ় রহস্য আর অদৃশ্য জগতের জীবেদের সাথে। অনেকেই তাকে বিলের আজর (কেন্দ্রিয় শক্তি, নিয়ন্ত্রক শক্তি বা ভুত) বলে। এ জন্য সবাই তাকে এড়িয়ে চলে।
তবে বিলের মেছো ভূতের সাথে তার গভীর বন্ধুত্ব। দেখা গেল সে ঘুমিয়ে আছে তখন কেউ এসে ডাকলো ‘কিরে ঘুমিয়ে পড়েছিস? একটু তামাক দে তো, খুব নেশা উঠে গেছে। জরানি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে ‘ডিস্টার্ব করিস না তো ঘুমোতে দে। আগন্তুক বলে ‘আরে একটু তামাক দিয়ে পরে ঘুমা। জরানি ধমকাতে থাকে আর আগন্তুক তার ঘলা (ছোট ঘর বা তাবু) ধরে নাড়াতে থাকে, ছাউনির খড় সরিয়ে দেয়। জরানি না উঠা পর্যন্ত খোঁচাখুঁচি চলতেই থাকে। তার ঘরে সব সময় একটা লাঠি থাকে। যখন সে অসহ্য হয়ে লাঠিটা নিয়ে বেরিয়ে এসে ‘হারামজাদা আয়, আজ তোকে জন্মের মত তামাক খাওয়াচ্ছি’ বলে তাড়া দেয় তখনই মেছোভূত দুষ্টু পোলাপানের মতো খিলখিল করে হাসতে হাসতে পালিয়ে যায়। কখনো দেখা গেল কিছু মাছ মেরে সে ঘলার পাশে রেখে এসে শুয়ে আছে। একটু পর শোনা গেল বিড়ালের মত মাছ খাওয়ার শব্দ। তখন সে লাঠি নিয়ে তাড়া দেয় আর খাদক দৌড়ে পালায়।
দেখা গেল সে শুয়ে আছে তখন কেউ বাহির থেকে হাত বাড়িয়ে তার পায়ের আঙ্গুল ধরে টানে আর বলে ‘এই ওঠ মাছ মারতে যাবি না বা অমুক তোকে ডাকছে বা একটু তামাক দে। কখনো তার ঘরে বা শরীরে পানি নিক্ষেপ করে, ঘরের ছাউনি বা কাপড় সরিয়ে ফেলে। কখনো দেখা গেল সে হেঁটে যাচ্ছে তো পেছন থেকে লুঙ্গি তুলে পাছা চেটে দেয় ইত্যাদি যত প্রকারের দুষ্টামি আছে সবই করে তার সাথে। তখন সে লাঠি নিয়ে তাড়া দিলেই মেছো ভূতের দল হাসতে হাসতে পালায়, কখনো নাগালের মধ্যে পেলে কয়েক ঘা লাগিয়েও দেয়। এই তার জীবন, এদেরকে নিয়েই গড়ে উঠেছে তার সংসার- সমাজ। এরাই তার আত্মারজন, আপন চক্র। এ অদৃশ্য জনদের নিয়ে সে সংসার পেতেছে, এদের নিয়েই রাত দিন বিলে পড়ে থাকে। আর এদের মাঝেই তার মৃত্যু হয়। জরানির কোন অসুখ- বিসুখ ছিল না, একদিন সে নিয়ম মাফিক তার ঘলায় শুয়ে ঘুমাল। পরদিন ভোরে দেখা গেল ঘলার সামনে মরে পড়ে আছে, শরীর শক্ত হয়ে গেছে। সে কেন মরল, কিভাবে মরল, কখন মরল, কে মারল কিছুই জানা যায়নি। বিচিত্র জীবনের জন্য তার খ্যাতি ছিল, এজন্য জানাযায় অনেক লোকসমাগম হয়েছিল।
মেছোভূত হল ভূত প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে শান্তশিষ্ট শ্রেণী। এরা মানুষের সাথে দূষ্টামি করে মজা করে কিন্তু কারো ক্ষতি করে না, ঘাড় মটকে দেয় না বা মেরে ফেলে না। এরা মৎস্যভুক, বিলে থেকে মাছ খায় এমনকি লোকেরা মাছ মারলে তারা নীরবে খেয়ে ফেলে।
আইয়ুব আলী টানা তিনঘন্টা মাছ ধরল। ততক্ষণে মাছ কমে এসেছে সে নিজেও ক্লান্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখা গেল মাছ নাই, ড্রেনে মাছের কোন অস্তিত্বই নাই। সে একটা হাঁফ ছেড়ে সোজা হয়ে বসে খালুইটা দেখল। যতক্ষণ সে মাছ ধরেছে ততক্ষণে অন্তত বিশটা খালুই ভরে যাওয়ার কথা কিন্তু তার খালুই শুন্য- একটা মাছও নাই। সে বিস্ময়ে কিছুক্ষণ থ মেরে বসে রইল। তারপর ভাবল তাড়াহুড়ার মধ্যে হয়তো সে আন্দাজে মাছ রেখেছে আর তা খালুইয়ে না ঢুকে পাশ দিয়ে আল বেয়ে চলে গেছে। সে উঠে ঘুরে ঘুরে দেখল কিন্তু আলে মাছের কোন চিহ্ন দেখতে পেল না। অতিশয় মনোকষ্টে বেচারা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তার আশপাশের ক্ষেতগুলিতে অনেকেই মাছ ধরছে। সে তাদের ডাকতে লাগল ‘শুনেছিস আসাম উদ্দিন, কসম উদ্দিন, সিরাজ, আইজল, জয়নাল একেকজনকে ডেকে ডেকে তার ঘটনা জানিয়ে বললো ‘কি ব্যাপার এমন হলো কেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কিন্তু তারা কেউ কোন কথা বলল না শুধু হু হা করে গেল।
শেষ রাত্রি, নিঝুম নিস্তব্ধ বিলের বুকে অস্তগামী চাঁদের হরিদ্রাভা ছড়িয়ে পড়েছে, সর্বত্র মৃত্যুপুরির নীরবতা। কুয়াশাবগুন্ঠিত জলাশয়ে যেন অতিপ্রাকৃত খেলা জমে উঠেছে, এটাই নাকি জিন-ভূতের উপযুক্ত সময়। সহসা তার মনে হলো তাহলে কি এটা মেছো ভূতের কান্ড? অনেক সময় আসলে মাছ থাকে না, মেছোভূত একটা মায়াজাল সৃষ্টি করে খেলা করে। আবার অনেক সময় মাছ থাকে আর ধরা মাছগুলি মেছোভুত খেয়ে ফেলে। হঠাৎ তার শরীরটা প্রচন্ড একটা ঝাঁকুনি মেরে উঠল, ভয়ে গা শিরশির উঠল। ডান পাশে তাকিয়ে দেখল জরানি বসে বসে তামাক খাচ্ছে, কল্কির আগুন দেখা যাচ্ছে। সে মনে মনে একটু সাহস পেল। তার কাছে সান্তনা ও সাহস সঞ্চার করার জন্য সে দিকে এগিয়ে গেল।
কাছাকাছি যেতেই জরানির ওপর তার স্বাভাবিক দৃষ্টি পড়ল, চমকে উঠে চোখ বিস্ফারিত করে তাকাল আর সাথে সাথে তার শরীরটা থরথর কেঁপে উঠল। শিড়দাড়া বেয়ে একটা হিমপ্রবাহ নেমে গেল, সজারুর কাঁটার মত সারা শরীর মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে গেল। হাঁ জরানিই বসে আছে কিন্তু তার মাথার দুই পাশে বিশাল দুইটা সিং বেঁকে মাথার দুই হাত উপরে উঠে গেছে। কুলার মত দুই কান হাতির কানের মত নাড়াচ্ছে, ঠোটের দুই কোনা থেকে সাদা ধবধবে দুইটা দাঁত বেরিয়ে হাতির দাঁতের মত বেঁকে মুখের সামনে অর্ধ চন্দ্রের ন্যায় অর্ধবৃত্ত হয়ে আছে। তার মধ্যে এক হাতে ডাবা (হুক্কা) ধরে সে ভুস ভুস করে ধোঁয়া ছাড়ছে।
আইয়ুব আলীর আগেই পায়খানার বেগ হয়েছিল। দৃশ্যটা দেখেই বেচারা ভ্যাদ ভ্যাদ করে ঠায় পায়খানা করে দিল। পরক্ষণেই সম্বিত পেয়ে বিকট চিৎকার করে পড়িমড়ি দৌড় দিল। তার সামনে অনেকে মাছ ধরছে, সে আত্মরক্ষার্থে দৌড়ে গিয়ে একজনকে জড়িয়ে ধরতে চাইল কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলো কেউ নাই কিছু নাই। আবার দৌড়ে আরেকজনের কাছে গেল কিন্তু কাছে যাওয়ার সাথে সাথে উধাও। আবার দৌড়ল, কচুরিপানার উঁচু আল স্প্রিংয়ের মত ঝাম করে, সে গড়িয়ে পানিতে পড়ে, কোনরকম হাচড়ে পাচড়ে উঠে আবার দৌড়ে, কারো কাছে গিয়ে ধরতে চায় কিন্তু জিনিসটা অদৃশ্য হয়ে যায়। এভাবে সে দৌড়ছে, পড়ছে উঠছে আবার দৌড়ছে, কাউকে ধরতে চাইছে কিন্তু কিছুই পায় না। সে দৌড়ছে আর চিৎকার করছে কিন্তু তার ক্ষীন আওয়াজ কেউ শুনতে পায় না। এভাবে অনেক নাকানি-চুবানি খাওয়ার পর অবশেষে কোনরকমে বিলের উপরের ক্ষেতগুলিতে গিয়ে উঠতে সক্ষম হলো। শুকনায় উঠে সে বেজান দৌড় দিতে চাইল কিন্তু একি? তার সামনে বিশাল শূকরের পাল। সে ডানে বামে যেদিকেই দৌড় দিতে চায় শুকরগুলি এগিয়ে গিয়ে তার পথ আগলে দাঁড়ায়। এভাবে দাড়িয়াবান্ধা খেলার মত অনেকক্ষণ দাপাদাপি করে সে শূকরের পালটা অতিক্রম করতে সক্ষম হলো।
সে প্রাণপণে চিৎকার করছে কিন্তু তীব্র আতঙ্কে তার কন্ঠ বুঝে গিয়ে শুধু একটা ক্ষীন শব্দ বেরুচ্ছে- যা বিশ হাত দূর থেকেও শোনা যায় না। গ্রাম দূরে, জোরে চিৎকার করলেও ঠিক মতো শোনা যায় না। সে মরিয়া হয়ে দৌড়ছে কিন্তু এবার আরেক বিপত্তি সামনে এল। মুরগির পাল, লক্ষ লক্ষ মুরগি। সে এই পালের উপর দিয়েই দৌড় দিল, কয়েক ক্ষেত পরেই গোপাট (ছোট রাস্তা) সে বেজান হয়ে দৌড়তে লাগল। কিন্তু হঠাৎ সামনে এসে গেল বিরাট ঘোড়া ও গাধার পাল, সে ডানে-বাঁয়ে যেদিকেই দৌড় দিতে চায় সেদিকেই ঘোড়ার পাল পথ আটকে দেয়। ততক্ষনে বেচারার প্রাণশক্তি ফুরিয়ে এসেছে, স্নায়ু দুর্বল হয়ে এসেছে, উদ্যম নিঃশেষ হয়ে গেছে। বেচারা টলতে-টলতে এক সময় বেহুঁশ হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
খুব ভোরে মাছ শিকারিরা বিলে যায়, বাইর জাল ইত্যাদি থেকে মাছ তুলে আনে। দেরিতে গেলে চোরেরা মাছ নিয়ে যায়। এমনি কয়েকজন দূর থেকে দেখলো মাটিতে কি একটা পড়ে আছে। ভয়ে ভয়ে তারা কাছে এসে আবিস্কার করল আইয়ুব আলী। তারা কাঁধাকাঁধি করে তাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। বেচারা কঠিন অসুখে পড়ল, জ্বর তো আছেই কিন্তু জটিল সমস্যা হলো পাতলা পায়খানা। যখনই দৃশ্যটা তার মনে হয় তখনই ‘ওরে বাপরে খাইয়া ফালাইছে’ চিৎকার করে জ্ঞান হারায় আর সাথে সাথে পাতলা পায়খানা করতে থাকে। কোন কিছুই খেয়ে পেটে রাখতে পারে না, ঘটনা স্মরণ হলেই চিৎকার করে আর আমাশয় রোগীর মত পাতলা পায়খানা করে বিছানা ভাসিয়ে দেয়, কিছুক্ষণ পরপর কাপড় পালটে দিতে হয়। ডাক্তার কবিরাজ আনা শুরু হলো, চিকিৎসা চলতে লাগলো। অবশেষে ডাক্তার কবিরাজের প্রাণান্তকর চেষ্টায় দেড় মাস ভোগান্তির পর বেচারা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে তার উপর আর কোন জিন ভুতের আক্রমণ হয়নি। ইতিমধ্যে তার ভাইয়ের ছেলেগুলি বড় হয়ে গেছে। তারা অটো রিক্সা, ট্রলি, সিএনজি ইত্যাদির ড্রাইভারি করে যথেষ্ট পয়সা উপার্জন করে। এখন দুই পরিবার পৃথক হয়ে গেছে, তাদের সংসার তার সংসারের চেয়েও সচ্ছল হয়ে গেছে। আইয়ুব আলীরও কয়েকটা পোলাপান হয়ে গেছে। এখন আর সে বর্গা চাষ করে না, নিজের জমিটুকু আবাদ করে আর ধানের ব্যবসা করে। বাজারে বাজারে ধান কিনে আড়তদারদের দেয়। তাদের বাড়ি থেকে দেড় মাইল দূরে বালিয়া বাজার, এ বাজারটাই অত্র ইউনিয়নের বড়বাজার। এখানে অনেকগুলি ধানের আড়ত আছে। আয়ুব আলী বাজারে গিয়ে খুচরা ধান কিনল, তারপর ধান মাপামাপি করে আরতদারকে বুঝিয়ে দিল।
এরপর গিয়ে বসল চা স্টলে। গ্রামীণ মানুষের নিয়মানুযায়ি পুরি সিঙ্গারা চা খেলো আর জমিয়ে আড্ডা দিল। হঠাৎ তার পেট কামড় দিয়ে উঠলো কিন্তু গ্রামের বাজারগুলির জটিল সমস্যা হল এখানে যে, বাজারে বিপুল মানুষের সমাগম ঘটে অথচ কোনো বাজারেই টয়লেট নাই, মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজন মিটানোর সঠিক কোন জায়গা নাই। সরকার ও ইউনিয়ন পরিষদের এ দিকে দৃষ্টি দেয়া একান্ত অপরিহার্য। আয়ুব আলি প্রাকৃতিক কাজ সারতে বেরোলো কিন্তু কোথায় যাবে? বাজার থেকে পূর্ব দিকে দুই ক্ষেত ছাড়িয়ে অর্থাৎ শ'পাঁচেক হাত দূরে একটা বাড়ি, বিরাট বস্তি বাড়ি। এর পেছনে ভয়াবহ জঙ্গল, জঙ্গলের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে আকাশছোঁয়া একটা তেঁতুল গাছ, বহু প্রাচীন গাছ। আশপাশের লোকেরা জানে এই গাছে একটা কিছু থাকে। এ অংশটা বাজারের একদম কাছাকাছি।
মাঘ মাস, কোন কাদা- পানি নাই। আয়ুব আলি সোজা গিয়ে এই গাছটার নিচে লুঙ্গি উঠিয়ে বসে পড়ল। পরক্ষণেই দেখল তার পাশে আকাশ থেকে একটা খাম্বা- পিলার নামল, তারপর আরেকটা- অর্থাৎ জিনিসটা গাছ থেকে দু’পা নামিয়েছে। সাথে সাথে এমন একটা প্রচণ্ড লাথি মারলো যে, বেচারা দশ হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। বিকট চিৎকার দিয়ে সে দৌড় দিল কিন্তু বাজার পর্যন্ত যেতে পারলো না আগেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। চিৎকার শুনে বাজারের লোকেরা দৌড়াদৌড়ি করে গিয়ে ধরাধরি করে আনল। আলোতে এনে দেখে সবাই মাথায় হাত দিল ‘সর্বনাশ পিছনের লুঙ্গি ভিজে গেছে, গুহ্যদ্বার দিয়ে তখনো গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। সবাই বুঝল আর আশা নাই, সময় শেষ। তাড়াতাড়ি রিকশায় করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
বাড়িতে পৌঁছে তার হুঁশ ফিরল। ঘটনা শুনে এলাকাবাসী সবাই এসেছে, আর সবাই বুঝতে পারছে সময় শেষ। আইয়ুব আলী কি ঘটেছে তা বর্ণনা করল। তারপর সকলের কাছে মাফ চেয়ে দাবি-দাওয়া ছাড়াতে লাগল। তার মেয়েগুলির প্রতি লক্ষ্য রাখা ও দেখেশুনে বিয়ে দেয়ার জন্য সবাইকে অসিয়্যত করতে লাগল। ইতোমধ্যে ডাক্তার ও কবিরাজ এসে গেছে, তারা সারা রাত থেকে চিকিৎসা চালিয়ে গেল। একরাত একদিন চলে গেল আইয়ুব আলী মরে নাই, কাজেই আশা করা যায় আর মরবে না। কারণ মরলে এতক্ষণে মরে যেতো। সবাই আশাবাদী হল, ভালো ডাক্তার কবিরাজ এনে সুচিকিৎসার সিদ্ধান্ত হলো কিন্তু টাকা পাবে কোথায়? সে তো গরিব মানুষ, পাঁচটা মেয়ে কোন ছেলে নাই। এই দুঃসময়ে এলাকার এতিম ছেলে হাসান এগিয়ে এলো। হাসানদের পরিবার হলো এই গ্রামে বড় জমিওয়ালা, তার বাপ নাই জমি বর্গা দিয়ে ভাইয়েরা সবাই লেখাপড়া করে। আইয়ুব আলী তাদেরই বর্গাদার।
কাজেই হাসান এগিয়ে আসলো, চিকিৎসার খরচ বহন করল। আর পরিবারের খোরাকের জন্য কয়েক মণ ধান দিল। সুচিকিৎসায় ধীরে ধীরে আয়ুব আলী সুস্থ হয়ে উঠল, দুই সপ্তাহেই উঠে দাঁড়ালো। এই ঘটনাটা ২০০৫ সালের, এরপর থেকে বর্তমান পর্যন্ত আইয়ুব আলী আর জিন-ভূতের মুখোমুখি হয়নি। বর্তমানে তার বয়স ষাটের কাছাকাছি, কাজেই আশা করা যায় এ বুড়ার উপর আর জিন-ভূতের শ্যেন দৃষ্টি পড়বে না।
অগ্নিকন্যা
নিশুতি রাত, নিঝুম প্রকৃতি। জীবজগত নিদ্রাদেবীর কোলে গা ঢেলে দিয়েছে, কোথাও কোন সারা শব্দ নাই। মাঝে মাঝে ঝিল্লিরব আর দু-একটা শিয়ালের হুক্কাহুয়া শোনা যায়। গ্রীষ্মের তাপদাহে প্রকৃতি উত্তপ্ত, মধ্যরাতের ঝিরঝিরে বাতাসের মোলায়েম ছোঁয়ায় মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষিয়মান চন্দ্রকলার শীতল আভায় প্রকৃতিতে আলো-আঁধারির খেলা চলছে, পরিবেশটা কেমন যেন মায়াময় জাদুময় চিত্তাকর্ষক কিন্ত্ত ভীতিকর।
উত্তর ময়মনসিংহের বউলা ইউনিয়নের কাজীবাড়ি, সমগ্র উত্তর অঞ্চল যাদেরকে এক নামে চিনে। পূর্বপুরুষদের গৌরবময় অতীত, বিশাল ভূ-সম্পদ আর উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে থাকার কারণে কাজীবাড়ি জেলার অন্যতম সম্ভ্রান্ত খান্দান হিসাবে খ্যাত। উত্তর দক্ষিনে লম্বালম্বি পূর্বমুখী বিশাল বড় বাড়ি, ভিতর বাড়ির লম্বা উঠোনে মাঝে মাঝে বেড়া দিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির সেপারেশন ও পর্দা রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু বহির বাড়ির একটানা লম্বা উঠোন, এই চওড়া উঠোনের পশ্চিম পাশে সারি সারি থাকার ঘর আর পূর্বপাশে বিক্ষিপ্ত বৈঠক ঘর ও গোয়ালঘর। বৈঠক ঘরে কামলা লজিং বা মেহমান আসলে থাকে। বাড়ির উত্তর মাথায় থাকেন কাজী আবু তাহের, তার ঘরের উত্তর পাশে পুকুর আর পূর্ব পাশে উঠোনের কিনারে বৈঠক ঘর, এর কিছুটা দূরে গোয়াল ঘর। হঠাৎ গোয়াল ঘরে আগুন জ্বলে উঠল, আগুনের লেলিহান শিখা সহস্র জিহ্বা মেলে আকাশের দিকে লকলকিয়ে উঠলো আর তার রক্তিম আভায় বিশাল বাড়ি আলোকিত হয়ে উঠল।
তাহের কাজী শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়েন, এটা তার অভ্যাস। তিনি চোখ মেলে তাকাতেই তীব্র আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে দরজা খুলেই ‘আগুন, আগুন লেগেছে আগুন’ চিৎকার করতে করতে গোয়ালের দিকে দৌড়ে গেলেন। ততক্ষনে অনেকেই জেগে উঠেছে, তারা বিভিন্ন পাত্র নিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গোয়ালের পাশে কলা গাছের বাগান আর একটু দূরেই পুকুর। কেউ বালতি কলসি নিয়ে পুকুর থেকে পানি এনে ছিটিয়ে দিচ্ছে, কেউ কেউ কলাগাছ কেটে আগুনের উপর চাপা দিচ্ছে, চাপে পড়ে আগুন আর বেয়ে যেতে পারছে না। তাহের কাজির চিন্তা হলো গরুগুলি পুড়ে যায় কিনা? তিনি কামলা রমিজকে বললেন ‘গোয়ালে ঢুকে গরু গুলির রশি কেটে দিতে কিন্তু সে গেলো না। আরো কয়েকজনকে বললেন কেউ রাজি হল না। অবশেষে তিনি নিজেই ঢোকার চেষ্টা করলেন কিন্তু অন্যরা তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে তিরস্কার করতে লাগলো ‘পোড়ে মরতে চান না কি, অপেক্ষা করুন আগুন প্রায় নিভে এসেছে।
বিশাল বড় বাড়ি, লোকের অভাব নাই। সকলের প্রচেষ্টায় অল্পক্ষণের মধ্যে আগুন নিভানো সম্ভব হলো। গ্রামের গোয়াল ঘর সাধারনত খরের ছাউনি হয়, এক চালের অর্ধেক পুড়েছে বাকি সব ঠিক আছে, ঘর খাড়া আছে। লোকেরা আগুনের উৎস সম্পর্কে আলোচনা শুরু করল। তবে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না- ঘরের ধোয়া থেকে আগুন লেগেছে। কাজির কামলার নাম রমিজ উদ্দিন, সে বৈঠক ঘরেই ঘুমিয়েছিল। ধোয়া থেকে আগুন লাগা এবং বৈঠক ঘরে থেকেও টের না পাওয়ার কারণে লোকেরা তাকে তিরস্কার করতে লাগলো। রমিজ রাগে গড়গড় করে বলল ‘ধোয়া থেকে আগুন লাগার কোন সম্ভাবনা নাই। তাহের কাজির ছোট্ট নাতনি ঝুমুর আগুন দেখতে এসেছে, কাজী এতক্ষণ নাতনিকে কোলে নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন কোথায় কোথায় কলা গাছ চাপা দিতে হবে আর কোথায় পানি দিতে হবে।
তিনি রমিজকে ছেলের মত দেখেন কখনো গালাগাল করেন না। কিন্তু এখন এগিয়ে এসে ধমক দিলেন ‘তোকে কতদিন বলেছি গোয়ালে সাবধানে ধোঁয়া দিবি, আগুন-টাগুন লাগতে পারে, এখন দেখলি তো কি কাণ্ডটা ঘটল? রমিজ আরো রেগে গেল ‘আসেন, আসেন আমাকে দেখিয়ে যান ধোঁয়া থেকে কেমনে আগুন লাগতে পারে? আমারে দেখান’ বলে সে লাফিয়ে লাফিয়ে গোয়ালে ঢুকলো। মশা তাড়ানোর জন্য গোয়ালের এক পাশে গর্ত করে ঘুটে পচা খড় ইত্যাদি দিয়ে ধোয়া তৈরী করা হয়- এটাকে গ্রামাঞ্চলে ধোয়া দেয়া বলে। তাহের কাজী ও কয়েকজন ঘরে ঢুকে দেখল গর্তের তলায় কয়েকটা ঘুটে জ্বলছে, ধোয়া ছাড়া একটা স্ফুলিঙ্গ পর্যন্ত বের হচ্ছে না, এখান থেকে আগুন লাগার কোনো সম্ভাবনাই নাই।
রমিজ চেঁচিয়ে উঠল ‘দেখান এখান থেকে আগুন লাগতে পারে নাকি? কয়েকজন ঠাট্টা মশকরা শুরু করল ‘এখান থেকে লাগেনি তো আকাশ থেকে আগুন এসেছে, নাকি ভূত-পেত্নী এসে লাগিয়ে গিয়েছে’ ইত্যাদি ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে করতে তারা চলে গেল। কাজি তাহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘আলহামদুলিল্লাহ গরুগুলি যে পুড়ে নাই এটাই খোদার শুকরিয়া, তোকে আরো সাবধান থাকতে হবে’ বলে নাতনিটাকে কোলে নিয়ে চুমুতে চুমুতে ঘরে চলে গেলেন। রমিজ হাসলো, এই হাসি কি উপহাসের নাকি ক্রোধের বোঝা গেল না। কারন তার স্বভাব হল রাগের সময়ও হাসে।
তাহের কাজিরা তিন ভাই, তিনিই সকলের বড় বাড়িতে থাকেন। মেজ ভাই ফুলপুর কলেজের প্রিন্সিপাল, ছোট ভাই গোয়েন্দা বিভাগের বড় কর্মকর্তা। কাজী তাহের ষাটোর্ধ্ব বয়সের ফর্সা লম্বা স্বাস্থ্যবান সুদর্শন মানুষ। হজ্ব করে এসেছেন, বুক জোড়া সাদা দাড়ি, সব সময় টুপি পাঞ্জাবি পড়েন, বুজুর্গ মানুষের মত দেখতে। তিনি গোস্টির বয়োজ্যাস্ট না হলেও বাড়ির সবাই তাকে মানে, তার পরামর্শ ছাড়া কেউ কোন কাজ করে না। এলাকার মধ্যেও তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তি, সবাই মান্য- গন্য করে। লোকেরা তাকে কাজী, বড় কাজী, কর্তা ইত্যাদি সম্ভোধনে ডাকে। তারও তিন ছেলে দুই মেয়ে, দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে সোনালী ব্যাংকে চাকরি করে বাইরে থাকে, মেজো ছেলে ব্যবসা করে বাড়িতে থাকে, ছোট ছেলে লেখাপড়া করে বাইরে থাকে। কাজির চার- পাঁচ বছর বয়সের ছোট্ট নাতনি ঝুমুর আগুনের শিখার মতো সুন্দর, কাজি তাকে অত্যধিক আদর করে, সেও দাদা-দাদীর সাথেই থাকে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তারা শুয়ে পড়ল, ঝুমুর দাদার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। কাজির চৌচালা ঘর টিনের বেড়া, তার ঘরের দক্ষিণ পাশে পরপর দুই ভাইয়ের হাফ বিল্ডিং ঘর। তারা বাইরে চাকরি করে বিধায় ঘর খালি পড়ে আছে- কেউ থাকে না। মধ্যরাতে হঠাৎ একটা ঘরে আগুন জ্বলে উঠল, সারা বাড়ি আলোকিত হয়ে উঠল। ডাকাডাকি করে বিশাল বাড়ির মানুষ সবাই হুমরি খেয়ে পড়লো। কেউ কলাগাছ কেটে কয়েকজনে ধরাধরি করে এনে চালের উপর ফেলল, কেউ কেউ পুকুর থেকে পানি এনে ছিটিয়ে দিতে লাগল। এই বিশাল বাড়িতে লম্বা ঘরের সাড়ি একটার সাথে আরেকটা লাগানো, এই জাতীয় বাড়িতে এক ঘরে আগুন লাগলে অন্যান্য ঘরেও ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাড়ি জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। আগুনের বিস্তৃতি রোধ করার জন্য লোকেরা কাঁথা, চাদর, কাপড়-চোপড়, বস্তা ইত্যাদি পানিতে ভিজিয়ে দু'পাশের চালে ছড়িয়ে দিল- যাতে আগুন পাশের ঘরে অতিক্রম করতে না পারে। অল্পক্ষণেই আগুন নিভিয়ে ফেলা হলো, টিনের চাল বিধায় তেমন ক্ষতি হয়নি। চালের কিছু কাঠ পুড়েছে আর কয়েকটা টিনের অর্ধেক পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। এবার আলোচনার বিষয় হল এই খালি ঘরে আগুন কিভাবে লাগলো? এখানে কেউ থাকে না, নিশ্চয় বাইরে থেকে কেউ লাগিয়েছে।
উত্তর থেকে চতুর্থ ঘরের বাসিন্দা হল কাজির ভাতিজা- অর্থাৎ তার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে নুরুজ্জামানের। সে রমিজের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে, সহসা রুক্ষ স্বরে ডাকল ‘রমিজ এদিকে আয়। আগুন লাগার আগে তুই এখানে কি করছিলি? রমিজ বলতে চাইল কোন বাচ্চা পোলাপানের আওয়াজ শুনে আমি দেখতে এসেছিলাম কিন্তু খালি ঘরে বাচ্চার আওয়াজের অজুহাতটা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই সে বলল ‘গরমের মধ্যে একটু ঘোরাফিরা করছিলাম, কেন আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন নাকি? গত সপ্তাহে গোয়ালে আগুন লাগার জন্য আমাকে দোষ দিয়েছেন, এখন এই ঘরে আগুন লাগার জন্যও আমাকে দোষ দিতে চান নাকি, এটা ফাজলামো পেয়েছেন? বলে সে রাগে গরগর করতে করতে চলে গেল। কাজী নুরুজ্জামান সবাইকে বলল মধ্যরাতে সে পেশাব করার জন্য উঠে দেখে রমিজ প্রিন্সিপালের ঘরের সামনে উকিঝুকি মারছে। তার ঘর ও প্রিন্সিপালের ঘর সংলগ্ন, সে পেশাব করে গিয়ে শুয়ে পড়েছে তখনই আগুনের আলো দেখে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে সবাইকে জড়ো করেছে। খালি ঘর আগুন লাগার সময় সেখানে রমিজ ছাড়া আর কেউ ছিল না। কাজেই আগুনটা সেই লাগিয়েছে।
কথাটা সবাই বিশ্বাস করল এজন্য যে, প্রিন্সিপালের সাথে রমিজের কিছুটা মনোমালিন্য আছে। কারণ বাড়ীতে কাজ করে দেয়ার মত প্রিন্সিপালের কেউ নাই, যখন সে বাড়িতে আসে তখন অগত্যা রমিজকে দিয়েই বিভিন্ন কাজ করাতে হয়। বিষয়টা রমিজ ভালোভাবে নেয় না, সে কাজ করে বটে কিন্তু রাগে গজ গজ করে। এখন সে প্রিন্সিপালের ঘর পুড়িয়ে দিয়ে তার ঝাল মেটাতে চাচ্ছে। কারণ ঘর না থাকলে প্রিন্সিপাল বাড়িতেও আসবে না তাকেও বেগার খাটাতে পারবে না। এই যুক্তিতে সবাই কথাটা বিশ্বাস করল এবং তাহের কাজির সাথে আলাপ করল। কিন্তু রমিজ সম্পর্কে কাজী এটা বিশ্বাস করলেন না।
তাহের কাজির ঘরে তারা বুড়াবুড়ি আর নাতনি ঝুমুর থাকে, উঠানের উত্তর পাশের এক ঘরে তার মেজো ছেলে থাকে। প্রতিদিনের অভ্যাস মত খাওয়া দাওয়ার পর তারা শুয়ে পড়ল, ঝুমুর দাদা-দাদির মাঝখানে শুয়ে দাদার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমায়, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘুমিয়ে পড়ল। মধ্যরাতে কাজির ঘরের চালে আগুন জ্বলে উঠলো, তীব্র আলোকচ্ছটা কাজীর চোখের পাতায় আঘাত হানতেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি চিৎকার করতে করতে দৌড়ে ঘর থেকে বেরোলেন। পরপর আগুন লাগার ভয়ে বাড়ির মানুষ আগের চেয়ে সতর্ক হয়ে থাকে, সবাই আগুন নেভানোর সরঞ্জাম নিয়ে দৌড়ে এলো। পুকুর কাছে, দ্রুত পানি ছিটিয়ে আগুন নিভানো হলো। ঘরের একটা কোণ সামান্য পুড়েছে, দুয়েকটা টিন আর সামান্য কাঠ পুড়েছে, অন্য কোনো ক্ষতি হয়নি। আগুন নেভানোর পর সবাই বিস্ময় প্রকাশ করতে লাগল- এসব কি শুরু হল গোয়ালে বা রান্না ঘরে আগুন লাগলে একটা যুক্তি থাকে যে সেখানে আগুন থাকে কিন্তু ঘরে কোন আগুন থাকে না আবার কারেন্টও নেই যে সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটবে তাও আবার টিনের চাল। এখানে স্বেচ্ছায় কেউ আগুন না ধরালে এমনিতে আগুন লাগার প্রশ্নই উঠতে পারে না, ইত্যাদি আলোচনা চলতে লাগলো।
কাজির মেজো ছেলে রাকিব আগুন নিভিয়ে কাঁদামাখা শরীরে ঘরের ভিতরে ঢুকল, সব ঠিকঠাক আছে দেখে বাইরে এসে রুক্ষ কন্ঠে গর্জে উঠল ‘রমিজ ভাই আগুন লাগার সময় তুমি কোথায় ছিলে? সহসা যেন চুষ কাগজে রমিজের মুখ থেকে সবটুকু রক্ত চুষে নেয়া হলো, তার মুখটা কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে। সে গলা টেনে বলল ‘কেন বৈঠক ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। রাকিব চিৎকার করল ‘মিথ্যে বলো না, তখন আমি সজাগ, জানালা খোলা। আব্বার চিৎকারের সাথে সাথে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, দেখলাম ঘরের যে কোনে আগুন লেগেছে- সেখান থেকে তুমি দৌড়ে বৈঠক ঘরের দিকে যাচ্ছো তোমার হাতে আগুন। রমিজ একাবারে বিমর্ষ হয়ে গেল, তার মুখে যেন কেউ এক পোঁচ কালি মেখে দিল, কণ্ঠনালী উঠানামা করছে কোনো কথা বলতে পারছে না। অবশেষে মিনমিনিয়ে বললো ‘শেষমেষ তুমিও আমাকে এমন কথা বলতে পারলে? আসলে আমি তখন শুয়ে শুয়ে বিড়ি খাচ্ছিলাম, চাচার চিৎকার শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। পরক্ষনেই মনে হলো খালি হাতে এসে তো লাভ নেই আবার দৌড়লাম বৈঠক ঘরে বালতিটা আনতে, তখনও আমার হাতে বিড়ি ছিল’ বলে সে কাজীর দিকে তাকালো। বড় করুন কণ্ঠে বলল ‘চাচা এসব কি হচ্ছে, সবাই আমার উপর দোষ চাপাচ্ছে আপনি কিছু বলবেন না? বলে সে মাথা নিচু করে গজেন্দ্র গমনে বৈঠক ঘরের দিকে চলে গেল।
সবাই কাজী তাহেরকে ঘিরে ধরলো ‘নিশ্চয়ই এ কাজ রমিজের, আকাশ থেকে ফেরেশতা এসে বা কুহ-কাপের জিন পরী এসে এসব করছে না। এ বাড়িরই কেউ না কেউ এই কুকর্ম করছে, আর এই লোকটা রমিজ ছাড়া অন্য কেউ নয়। কারন প্রত্যেকবার আগুনের কাছে তাকে পাওয়া যায়। রাকিব বলল ‘আমি নিজে তার হাতে আগুন দেখেছি, সম্ভবত আগুন লাগিয়ে দৌড়ে বৈঠক ঘরে গিয়েছে আর এখন টালবাহানার আলাপ করছে। অন্যরাও বলতে লাগলো ‘প্রিন্সিপালের ঘরে আগুন লাগার সময় নুরুজ্জামান তাকে দেখেছে, আজ রাকিবও তাকেই দেখেছে। আর কোন সন্দেহ নেই, রমিজই আমাদেরকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করছে, ওর একটা বিহিত করতে হবে। কাজী আর সহ্য করতে পারলো না ‘তোমরা কাকে কি বলছ, তোমরা ভাল করেই জানো যে রমিজ আমার ছেলে, ছোটবেলা থেকে ওকে আমি লালন পালন করেছি, সেই আমার সংসারের কর্তা অথচ তোমরা বলছ সে আমাদেরকে পুড়িয়ে মারতে চাইছে। তোমাদের কথা আমার বিশ্বাস করতে হবে? তার কন্ঠ ধরে এল, ঝুমুর তার কোলেই ছিল, তিনি বাচ্চাকে বুকে চেপে ধরে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে চলে গেলেন।
কাজীবাড়ি বিখ্যাত খানদান, এই বাড়িতে ঘনঘন আগুন লাগার বিষয়টি এলাকায় রাষ্ট্র হয়ে গেল। সেই সাথে প্রচার হলো- কাজি তাহেরের কামলা যাকে তিনি পোষ্যপুত্র মনে করেন সেই রমিজই আগুন লাগায়। কাজী বাড়ির লোকজন রমিজের সাথে কথা বলে না, সন্দেহের চোখে দেখে। এলাকার লোকজন রমিজকে আগুন সম্পর্কে জিগায়, তিরস্কার করে, গালি দেয়। রমিজ বিমর্ষ হয়ে যায়, সে একাকী হয়ে পড়ে, কোণঠাসা হয়ে যায়। একমাত্র কাজি ছাড়া আর কেউ তার সাথে কথা বলে না। কাজি তাকে সান্ত্বনা দেয়, আদর করে কিন্তু কাজির মনও সন্দেহের দোলায় দুলতে থাকে। কারণ সে জানে না রমিজের মা বাপ কে, কোথায় থাকে, বাড়ি কোথায়, আদৌ আছে কি না, সে কি আসলে মানুষ নাকি অন্য কিছু? সে আগুন না লাগালে কি ভাবে লাগবে, কে লাগাবে, কেন লাগাবে, আর প্রতিবার আগুনের কাছেই বা তাকে পাওয়া যায় কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায় না, বেচারা হতবুদ্ধি হয়ে যায়।
ঘন ঘন আগুন লাগার কারণে বাড়ির মানুষ সতর্ক হয়ে উঠেছে। অনেকে স্ত্রীর সাথে পালা করে জেগে থাকে, কেউবা প্রথম রাত্রে ঘুমিয়ে শেষ রাতে সজাগ থেকে নিজ নিজ ঘর পাহারা দেয়। তেমনি একজন হলো কাজী নুরুজ্জামান, তার স্ত্রী প্রথম রাতে আর সে শেষ রাতে জেগে জেগে ঘর পাহারা দেয়। কারণ তার ঘর সংলগ্ন প্রিন্সিপালের ঘরে আগুন লেগেছে, দুই ঘর পড়ে বড় কাজির ঘরেও আগুন লেগেছে। এখন সন্দেহ এবার তার পালা। কাজেই তারা স্বামি- স্ত্রী মিলে ঘর পাহারার ব্যবস্থা করেছে।
গরমের মওসুম, জানালা খোলা। আর জালানার পাশে খাটে শুয়ে কাজী নুরুজ্জামান সজাগ হয়ে কান খাড়া করে রেখেছে। হঠাৎ ছোট্ট একটা শব্দ হলো, সে লাফিয়ে উঠে জালানা দিয়ে বাইরে তাকাল- খর্বাকৃতির একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। ভালো করে দেখার জন্য সে চোখ বিস্ফারিত করল কিন্তু আর কিছুই দেখতে পেল না। পরক্ষনেই আগুনের ছটায় তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সে ‘আগুন আগুন’ চিৎকার করে ঘর থেকে লাফিয়ে বের হল। বাড়ির মানুষ আগুন নিভানোর প্রস্তুতি নিয়েই থাকে, মুহূর্তে সবাই ঝাপিয়ে পড়ল। কিন্তু পুকুর দূরে থাকার কারণে আগুন নিভাতে কিছুটা দেরি হলো এতে অর্ধেক চাল পুড়ে গেছে। তবে রক্ষা যে বাড়ির সব ঘরের চাল টিনের, বেড়া কোনটা টিনের কোনটা দালান। খরের ঘর হলে একদিনের আগুনে গোটা বাড়ি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত।
কালিঝুলি আর কাদা মাটিতে লেপটে নুরুজ্জামানের চেহারা ভুতের রূপ ধারণ করেছে। টর্চ ও হারিকেনের মিটমিটে আলোয় তার বিরাট শরীরটা ভূত-প্রেত বা দানবের মতো দেখাচ্ছে। আগুন নেভানোর সাথে সাথে সে চারপাশে তাকিয়ে ‘রমিজ কোথায় রমিজ কোথায়’ খুঁজতে লাগলো কিন্তু রমিজ নেই। সে মৃদু গর্জন করে একজনের হাত থেকে থাবা মেরে টর্চটা নিয়ে দৌড়ল বৈঠক ঘরে, দরজা সাধারণত খোলাই থাকে। রমিজ ঘুমিয়ে আছে, সে তার হাত ধরে একটানে তুলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল কাজী তাহেরের সামনে। তারপর বলল ‘চাচা তুমি এটা কাকে এনেছো, কোত্থেকে এনেছো, কিভাবে এনেছ? এ তো মানুষ নয়, নির্বাসিত জিন (দুষ্ট জ্বিনদের তাদের দেশ থেকে নির্বাসন দেয়া হয় তখন এরা লোকালয়ে এসে আশ্রয় নেয়)। সে দুই আঙ্গুল চোখের সামনে নিয়ে বলল ‘আমি এই দুটি চোখে দুই ঘরের চিপায় ওকে দেখেছি কিন্তু মুহূর্তেই নাই উধাও হয়ে গেল। পরক্ষনেই ঘরে আগুন, এখনো কি তুমি বলবে ও এসব করছে না? আমি এখানে গুষ্টিসুদ্ধ আগুনে পুড়ে মরতে পারবো না, তোমাকে দুইদিন সময় দিলাম। এর মধ্যে যদি ওর একটা বিহিত না কর তাহলে আমি বউ বাচ্চা নিয়ে টাউনে চলে যাব। এখানে পড়ে থেকে পরিবারসুদ্ধ আগুনে পুড়ে মরতে পারবো না। অতিপ্রাকৃত ঘটনা শুনে সবাই কি কি রব করে উঠলো। নুরুজ্জামান বারবার বলতে লাগলো ‘সে দুই ঘরের চিপায় চাক্ষুষ রমিজকে দেখেছে কিন্তু চোখের পলকে সে উধাও হয়ে গেছে আর সাথে সাথে আগুন লাগল। কাজেই এখন আর কারো কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।
রমিজ বড় কাজির সামনে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখটা কালো হয়ে গেছে। বড় কাজি জিজ্ঞেস করল ‘কিরে রমিজ এতক্ষণ কই আছিলি? সে উত্তর দিল ‘ঘুমাইছিলাম। কাজী বলল ‘আগুন লাগল আর এত হৈহল্লা চিল্লাচিল্লির মধ্যেও তুই ঘুমিয়ে ছিলি, তোর ঘুম ভাঙলো না? রমিজ অপরাধীর মতো বলল ‘আসলে অর্ধেক রাত পর্যন্ত গরমে হাঁসফাঁস করেছি তারপর মরার মত ঘুমাইছি কিছুই টের পাই নাই। সবাই সন্দেহ ও ভয়ের দৃষ্টিতে রমিজের দিকে তাকায়, কানাঘুষা করে নিশ্চয়ই ও মানুষ নয়, জিন-ভূত জাতীয় একটা কিছু। সে কাজী বংশ ধ্বংস করতে এসেছে, এখনি ওর একটা বিহিত না করলে কাজী বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে। তারা বড় কাজির সামনে চেঁচায় ‘চাচা কাজী বংশের উপর ঘোর বিপদে চেপেছে, এখনি একটা কিছু না করলে এই বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। কাজির শরীরটা থরথর করে কেপে উঠে। তিনি বললেন ‘আচ্ছা যাও সবাই ঘুমোতে যাও, রাতে তো আর কিছু করা সম্ভব নয় কাল পরামর্শ করে একটা কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। রমিজ তুইও শুয়ে পড় গিয়ে’ বলে তিনি চলে গেলেন। নাতনি ঝুমুর তার কোলে, সে সব সময় দাদার কোলে কোলেই থাকে।
কাজী ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন, মেয়েটাকে বুকে নিয়ে ঘুম পারালেন কিন্তু তার নিজের ঘুম হলো না। তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন- সত্যিই তো যা ঘটছে সবই অতিপ্রাকৃত। সাধারণত টিনের চালে আগুন ধরালেও ধরে না অথচ এই টিনের চালেই একের পর এক আগুন লেগে যাচ্ছে আর এসব আগুন তো আকাশ থেকে পড়ছে না কেউ না কেউ লাগাচ্ছে বলেই লাগছে। কিন্তু এই কেউটা কে, রমিজ? এ যাবত যত আলামত- নিদর্শন পাওয়া গেছে সব তো তাকেই ইঙ্গিত করছে। কিন্তু সে আগুন লাগাতে যাবে কেন, তাকে ও তার গুষ্টির লোকদের পুড়িয়ে মারতে চায় কেন? কে সে, সে কি মানুষ নাকি অন্য কিছু? কাজির শরীরটা ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো। কারন রমিজ কে, সে চিনে না জানে না। তার যতদূর মনে পড়ে বগুড়া থেকে একজন লোক ফার্নিচারের ব্যবসা করার জন্য বউলা বাজারে আসে, তার ঘর ভাড়া নেয়। লোকটা বগুড়া থেকে ট্রাকে বিভিন্ন ডিজাইনের খাট এনে বিক্রি করত। এত সুন্দর নকশী খাট এতদাঞ্চলে নাই, এখানকার কারিগররা তা বানাতে পারে না। ব্যবসা খুব চললো, এক সময় সে বগুড়া থেকে কারিগর এনে নিজেই খাট ও অন্যান্য ফার্নিচার বানানো শুরু করল। তাদের সাথে এই রমিজকেও সে নিয়ে এসেছিল, তখন সে আট দশ বছরের বালক।
একদিন কাজি গিয়ে দেখল মহাজন ছেলেটাকে একটা রুলার দিয়ে বেদম পিটাচ্ছে। সে দৌড়ে গিয়ে ফিরালো এবং মালিককে ধমক দিল। তখন মহাজন বলল ‘আরে না মেরে কি করবো বলুন, এই ভালো ছেলেটা খারাপ পোলাপানের সঙ্গ পেয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সব সময় খেলায় মেতে থাকে, তাস খেলে, বিড়ি সিগারেট খায়, ঠিকমত কাজকর্ম করে না। তখন কাজী বলল ‘ঠিক আছে আপনার আর নষ্ট ছেলের দরকার নাই ওকে আমি নিয়ে গেলাম, আমার একটা ছেলের দরকার। সেই থেকে আজ বার বছর ধরে রমিজ আছে তার ঘরে, কোনদিন একটু এদিক-সেদিক করেনি। আগে হাল চষা থেকে নিয়ে সংসারের যাবতীয় কাজ সেই করত আর কাজী সংসার চালাত। কিন্তু হজ করে আসার পর থেকে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব তার উপর ছেড়ে দিয়েছে। এখন রমিজই হলো তার সংসারের কর্তা, ধান বিক্রি থেকে নিয়ে সব কিছুই সে নিজ হাতে করে। এখন আর সে নিজে গরুগুলি দেখাশোনা ছাড়া অন্য কোন কাজ করে না, কামলা দিয়ে করায়।
তার হাতে সংসারের যথেষ্ট উন্নতি হচ্ছে, আগের চেয়ে বেশি। সেই দরদাম করে বাজারের জমিটা কিনেছে, মাঠে প্রতি বছর কম বেশী জমি কিনা হচ্ছে। এসব কিছুর দরদাম ও টাকার লেনদেন রমিজই করে, তাকে শুধু হিসাব-কিতাবটা শোনায়। কোনদিন সে একটা পয়সা নড়চড় করে না। তবে তার একটা বদ অভ্যাস আছে, বাজারে গেলে মিষ্টি খায় আর এজন্য দশ- বিশ টাকা গোপন করে, এটা কোন ধর্তব্য বিষয় নয়। ছেলেটার নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা দেখে কাজি তাকে মনে মনে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছেলের বয়স হয়েছে আগামী দুয়েক বছরের মধ্যে তাকে বিয়ে করিয়ে বাজারে একটা ঘর আর কিছু টাকা দিবে- যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য করে চলতে পারে। অথবা চাষাবাদ করে চলার মত কিছু জমি দিবে। কিন্তু এতসব কিভাবে করবে, কার জন্য করবে? সে এসব কি শুরু করেছে? বাড়ির সবাই সন্দেহ করছে- সে নাকি মানুষ নয় জিন। হায় আল্লাহ এসব কি হচ্ছে! কাজির বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়, তার দু'চোখ বেয়ে ফোটা ফোটা অশ্রু বালিশে গড়িয়ে পড়তে থাকে। বাকি রাত আর ঘুম হলো না।
সকালে নামাজ পড়ে তিনি রমিজকে ডেকে নিয়ে বসলেন ‘আচ্ছা রমিজ তুই তো কোনদিন তোর পরিচয় দেসনি, তোর মা বাপ কে, কোথায় থাকে, দেশ কোথায়- কিছুই তো বলিসনি? রমিজ নিরাসক্ত গলায় বলল ‘আমার পরিচয় কি আমি নিজেই জানি না। যতদূর মনে আছে একটা হোটেলে ফুটফরমাশ খাটতাম, সেখান থেকে ফার্নিচার ওয়ালা আমাকে নিয়ে আসে। বাকিটা তো আমার চেয়ে আপনিই ভালো জানেন। কাজি নিরাশ গলায় বলল ‘আচ্ছা ঠিক আছে যা, ওদের কথায় তুই মন খারাপ করিস না। রমিজ চলে গেল। সকালে খাওয়া দাওয়ার পর কাজী নুরুজ্জামান বাড়ির গণ্যমান্য কয়েকজনকে নিয়ে এসে বলল ‘চাচা রমিজকে তাড়িয়ে দাও নইলে এই বাড়ির কেউ নিস্তার পাবে না। কথাটা শুনেই কাজির রাগ উঠে গেলো ‘তোদের কথায় তো আর আমি নিজের ছেলেকে তাড়িয়ে দিতে পারি না। তোরা ওর পেছনে লেগেছিস কেন শুনি, ও তো তোদের কোন ক্ষতি করেনি।
উত্তর শুনে শ্রোতাদের কেউ হাসে কেউ তিরস্কার করে ‘জিন নাকি ছেলে’ বলে সবাই হাসাহাসি করতে লাগল। নুরুজ্জামান বলল ‘ও যেদিন তোমাকে আমাকে বাড়িসুদ্ধ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারবে সেদিন প্রমাণ হবে সে তোমার কেমন ছেলে। বুড়ো বয়সে তোমাকে ভীমরতি ধরেছে, জ্বীন আবার ছেলে হয় নাকি। ওর কি বাপ দাদা জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কোন পরিচয় আছে? কাজী উত্তর দিতে না পেরে বললো ‘ঠিক আছে ও জ্বিন আগে প্রমাণ কর, তারপর ব্যবস্থা করব। তখন কয়েকজন বলল ‘এটাই উত্তম প্রস্তাব, ও জিন কিনা আমরা পরীক্ষা করব, ফকির-কবিরাজ আনবো। তারপর কাকে আনা যায় আলোচনা করতে করতে তারা চলে গেল।
পরদিনই এক ফকির আসলো, তিনি আলেম কোরআনের আয়াত দিয়ে জিন ভূতের তদবীর করেন। তিনি বৈঠক ঘরের চৌকির উপর বসে তিনটা তাবিজ লিখলেন, তারপর মুজরিমকে ডাকলেন। ঘরভর্তি মানুষ, কাজী নুরুজ্জামান রমিজকে ধাক্বিয়ে এগিয়ে দিল। বেচারা ভয়ে ভয়ে হুজুরের সামনে বসল, হুজুর রমিজের দুই মুঠিতে দুইটা তাবিজ ধরিয়ে দিয়ে বুক বরাবর হাত তুলে রাখতে বললেন। তারপর নিজে একটা তাবিজ মুঠিতে নিয়ে রমিজের কপালে একটা টুকা মেরে বললেন ‘ইন্নাহু মিন সোলায়মান ওয়া ইন্নাহু বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, এই কে আছিস কে তুই জিন ভূত পিশাচ পেত্নী শয়তান খবিস যেই হস সারা দে’। কিন্তু সারা দিলো না, রমিজের শরীর কাঁপলো না। হুজুর আবার আয়াত পাঠ করে বললেন ‘নবী সোলায়মানের নামে ডাকছি, জরুরি সাড়া দে। হুজুর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রমিজের দেহের দিকে তাকিয়ে আছেন, কারণ জিন-ভূত থাকলে বা হাজির হলে এতক্ষণে তার শরীরে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যেত। হুজুর বারবার তাবিজটা দিয়ে রমিজের কপালে টুকা দিলেন, আয়াত পাঠ করলেন আর নবী সোলায়মানের দোহাই দিয়ে ডাকলেন কিন্তু কেউ সারা দিল না, কোন আলামত পাওয়া গেল না। এরপর তিনি রমিজের হাত থেকে তাবিজ দুইটা নিয়ে বললেন ‘নাঃ সবকিছুই ঠিক আছে কোন সমস্যা নাই। কথাটা শুনেই তাহের কাজির মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠল। কিন্তু বাড়ির লোকদের চেহারা কালো হয়ে গেল, তারা বলাবলি করতে লাগল ‘হুজুর ধরতে পারেনি, সমস্যা নাই আমরা দৈনিক একজন করে ফকির-কবিরাজ আনব।
পরের দিন এক ফকির আসলো। তিনি এসেই সরিষা তেল পড়লেন, তারপর তার লাঠিতে মাখলেন। বাঁশের এই লাঠিটা বিশেষভাবে তৈরি, কোন গীরা নাই, খুলের ভিতর কোরআনের আয়াত ও বিভিন্ন মন্ত্র ঢোকানো। তারপর বাচ্চাদের ন্যায় পায়ের আঙ্গুল চারপাশে ঘুরিয়ে ছোট্ট একটা বৃত্ত আঁকলেন, তাতে মন্ত্র ফুঁকলেন। তারপর রমিজকে বৃত্তের মধ্যে দাঁড়াতে বললেন। তখন বেলা দশটার কাছাকাছি, পশ্চিম দিকে রমিজের দেহের ছায়া পড়েছে। এবার ফকির লাঠিটা নিয়ে দেহের ছায়ায় আঘাত করতে লাগলো, দু-একটা করে বাড়ি দেয় আর রমিজের মুখের দিকে তাকায়। রুমিজ হতবিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কোন ভাবান্তর নেই। এরপর ফকির মন্ত্র ফুকে জুড়ে জুড়ে আঘাত করতে লাগলো কিন্তু রমিজের ভাবান্তর না দেখে বলল ‘মানুষ না হয়ে অন্য কিছু হলে এতক্ষনে ঘোড়ার মত চেঁচাত আর ওর হাড়গুলি ময়দার মত ছাতু হয়ে যেত। কথাটা শুনে তাহের কাজি প্রসন্ন হল কিন্তু অন্যরা নিরাশ হল।
সে দিন রাত দেড়টার সময় বাড়ির বারতম ঘরে আগুন লাগল। এখন সবাই সচেতন, দৌড়োদৌড়ি করে এসে আগুন নিভিয়ে ফেললো, তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। বাড়ির একজন চিৎকার করলো ‘রমিজ আগুন দিয়েছে, আমি একটু আগেই তাকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছি, তার যাওয়ার পরেই আগুন লেগেছে। রমিজ সেখানেই ছিল, কয়েকজন তাকে ধরে বড় কাজির সামনে নিয়ে গেল। ‘কিরে রমিজ’ বলে তাহের কাজী কৌতূহলের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। রমিজ কাঁপছে, মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কান্না জড়িত কন্ঠে বলল ‘আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ। পেশাবের জন্য উঠলেই আমি বাড়িটা একটা চক্কর দেই এই আশায় যদি কিছু ধরতে পারি। আগুন লাগার আগে আমি এদিক দিয়ে গিয়েছিলাম। কাজি কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বলল ‘শুন রমিজের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না, জিন-ভূত তো রমিজ কেন যে কারো রূপ ধারণ করতে পারে। আসল ঘটনাটা তো ধরতে হবে, তোমরা ভালো শক্তিশালী ফকির-কবিরাজ আন।
পরদিন বিখ্যাত এক ফকির আনা হলো। তিনি দুইটা পরীক্ষা করলেন- বাড়ির সব পুরুষ ডেকে জড়ো করলেন। তারপর প্রত্যেকের চুলের সামনের ঝুটি ধরে মন্ত্র ফুঁকলেন কিন্তু কারো মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। এরপর এক গামলা ময়দার উপর মন্ত্র পড়ে সেই ময়দা দিয়ে একটা বৃত্ত বানালেন আর সবাইকে তাতে ঢুকতে বললেন। প্রথমে রমিজ ঢুকে বেরিয়ে গেল, তারপর একে একে বাড়ির সবাই ঢুকলো বেরিয়ে গেল কিন্তু কারো কিছুই হলো না। কবিরাজ গম্ভীর হয়ে বলল ‘কোন জিন ভূত তো দূরের কথা যার গায়ে সামান্যতম জিনের আছর আছে সে এই বৃত্তে কোনভাবেই ঢুকতে পারবে না, আগুনে পোড়ার মতো চিৎকার শুরু করবে। যাই হোক আপনাদের মধ্যে কোন সমস্যা নাই, আসলে আগুনটা লাগায় পিশাচ জাতীয় জ্বিন। এজন্য আমি ময়দা পড়ে দিয়ে যাচ্ছি এই ময়দা আপনারা রেখার আকারে বাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে দিবেন, তাহলে বাহির থেকে বাড়ির ভিতরে আর কোন পিশাচ শয়তান আসতে পারবে না। কিন্তু বাড়ির ভিতরে যে বা যারা আছে তাকে রোধ করার কোন ব্যবস্থা তিনি করলেন না বা করতে পারলেন না।
বিশাল বাড়ির চারদিকে সাদা মোটা রশির মত আধামন ময়দার রেখা ছড়িয়ে দেয়া হল। কিন্তু ফল হলো উল্টো, অন্য দিন যাও বা শেষ রাতে আগুন লাগতো এদিন মধ্য রাতেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। উত্তর থেকে সারির পঁচিশতম ঘরে আগুন জ্বলছে। সবাই সতর্ক হয়ে থাকে, কোন ডাক চিৎকার শোনা মাত্র বিশাল বাড়ির মানুষ মুহূর্তেই একত্র হয়ে যায়। আগুন নিভানো হলো, অর্ধেক চাল পুড়ে গেছে অন্য কোনো ক্ষতি হয়নি। কাজি তাহের চিৎকার করে বললেন ‘এভাবে আর কতদিন চলবে, কোনদিন জানি সারা বাড়ি পুড়ে সব ছারখার হয়ে যায়। তোমরা রাত জেগে বাড়ি পাহারা দাও আর যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি দেশের বড় বড় ফকির কবিরাজ এনে এর একটা বিহিত কর। সেদিনই বাড়ির মানুষ চার দলে ভাগ করা হলো, প্রত্যেক দল একদিন করে পালাক্রমে বাড়ি পাহারা দিবে। পরদিন থেকে পাহারার কাজ শুরু হল।
কিন্তু এর মধ্যেও আগুন লাগা ক্ষান্ত নাই। দেখা গেল পাহারাদাররা ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় বসে গল্প-গুজব করছে বা তাস খেলছে তখনই কোন ঘরে আগুন লেগে গেছে। অথবা তারা কোন ঘরের বারান্দায় বসে কথা বলছে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। কাজী বাড়ির মানুষ আতঙ্কে পাথরের মত জমে যায় তারা অসহায় হয়ে পড়ে। আগে সপ্তাহ দুয়েক পরপর আগুন লাগতো, তারপরে সপ্তাহে দু’তিনদিন লাগতো কিন্তু এখন প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন ঘরে আগুন লাগে। আর লক্ষ্য করে দেখা গেছে আগুনটা বাড়ির উত্তর দিকের চল্লিশটার মতো ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, এর দক্ষিনে যায় না। এই কাজী বাড়ির পঞ্চম পূর্বপুরুষ ছিলেন কাজী ছানাউল্লাহ মুজাদ্দেদী হুসাইনী, তিনি বড় মাপের পীর ছিলেন। দেশ-বিদেশে তার অসংখ্য মুরিদী ছিল, এমন কি অনেক জ্বিন তার মুরিদ ছিল। দুষ্ট ও অবাধ্য জিনদের তিনি শাস্তি দিতেন, আটকে রাখতেন।
এলাকায় আজও কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে আছে যে, অনেক দুষ্ট জিনকে তিনি বোতলে ভরে পুকুর, খাল-বিল ও নদীতে আটকে রেখেছেন। সানাউল্লাহ পীরের বংশধররা বাড়ির উত্তর অংশে থাকে, এটাই প্রাচীন ভিটা- মূল বাড়ি। বাড়ির উত্তরাংশের চল্লিশটি ঘর তার উত্তর পুরুষদের। আর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই চল্লিশটি ঘরেই আগুন সীমাবদ্ধ থাকছে দক্ষিণ দিকে এগুচ্ছে না। এখানে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত যে আগুনটার লক্ষ শুধু পীরের বংশধরদের উপর সীমাবদ্ধ। বাড়ির দক্ষিণাংশে থাকে পীরের বাকি দুই ভাইয়ের বংশধররা, ধীরে ধীরে লোকজন বেড়েছে আর দক্ষিণ দিকে বাড়িয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে কিন্তু এ দিকে আগুনের রুখ নাই।
ইতিমধ্যে কাজী বাড়িতে আগুনের ঘটনাটা সমগ্র জেলা রটে গেছে, দেশের বড় বড় পীর ফকির কবিরাজ ওঝা- বৈদ্য আনা হচ্ছে কিন্তু কেউ আগুন নেভাতে পারে না। এ আগুনের কথা এলাকায় কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, কাজী বাড়ির লোকেরা তো বড় বড় পীর ফকির আনছেই- এলাকার মানুষও জানাশোনা পীর-ফকির নিয়ে আসছে। এমনকি ঘটনা শুনে কোন কোন পীর ফকির নিজেরাই আসে কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। কাজি বাড়ি বিরাট গুষ্টি, অনেকেই শিক্ষিত চাকরীজীবি তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকে। বাড়ির এমনি দুর্দিনের কথা শুনে তারাও যে যেখানে থাকে সেখানকার বড় বড় পীর ফকির ধরে নিয়ে আসে কিন্তু কোন লাভ হয় না। বউলা ইউনিয়নের পাশে বালিয়া ইউনিয়ন, এখানে ময়মনসিংহের শ্রেষ্ঠ মাদ্রাসাটি অবস্থিত। এ মাদ্রাসায় বেশ বড় বড় কয়েকজন আলেম আছেন তাদের অনেকেই জিন ভুত সংক্রান্ত বিষয়ে তদবির করেন। তাদের মধ্যে মুফতি ওসমান গনি, দৌলত আলী নাজিম সাহেব ও গিয়াস উদ্দিন পীর সাব বিখ্যাত। একদিন তারাও সবাই গেলেন, পানি পড়া দিলেন বাড়ি বন্ধ করার তাবিজ কবজ দিলেন আরও অন্যান্য তদবির যা আছে সাধ্যানুযায়ী ব্যবস্থা দিয়ে সন্ধ্যার পর ফিরলেন। কিন্তু কাজের কাজ এই হলো অন্য দিন যাওবা দেরিতে আগুন লাগত কিন্তু এদিন তারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আগুন লেগে গেল।
কোরবানি ঈদের সময় বাইরের চাকরিজীবীরা সবাই বাড়িতে আসলো, রাতে তারা পরামর্শ সভায় বসল। একেক জন একেক পরামর্শ দিল কিন্তু সব পরামর্শ ইতিমধ্যে পরীক্ষা করা হয়ে গেছে। অবশেষে প্রিন্সিপাল কাজী ওরাসাত হোসেন বললেন ‘বাড়ি তো বন্ধ রয়েছে, অনেক পীর ফকির বাড়ি বন্ধ করে গেছেন। কাজেই কোনো জিন-ভূত সম্ভবত বাহির থেকে বাড়ির ভিতরে আসাটা অসম্ভব। এখন সম্ভাব্য হলো বাড়ির ভিতরের মানুষ, কাজেই আমার প্রস্তাব হলো ভালো একজন পীর ফকির এনে বাড়ির নারী-পুরুষ সবাইকে পরীক্ষা করা হোক। বিশেষ করে বিয়ে করিয়ে যেসব বউ আনা হয়েছে তাদের পরীক্ষা আমি দরকার মনে করি। কারণ এত বড় বাড়ির অসংখ্য বউ, কে কী, কোত্থেকে এসেছে সব আমরা জানি না। সব কিছুই তো করা হলো এখন এ ছাড়া আর কোন পথ আমি দেখছি না। সবাই এই প্রস্তাবে সম্মতি জানালো।
চট্টগ্রাম থেকে একজন জিনের সাধক বড় পীর আনা হলো। তিনি এক সপ্তাহ থেকে বাড়ির সকল নারী পুরুষ পরীক্ষা করলেন বিশেষত বাড়ির নতুন পুরাণ বউদের ভালো করে পরীক্ষা করা হলো, কিছুই পাওয়া গেল না। অবশেষে নিজের পালিত জিন দিয়ে তদবির করলেন কিন্তু কাজ হলো না। তবে এটুকু কাজ হল যে, তার থাকার এক সপ্তাহের মধ্যে কোন আগুন লাগেনি। ব্যর্থ হয়ে তিনিও চলে গেলেন। কাজী বাড়ির মানুষ অজানা আতঙ্কে মুষড়ে উঠল। দৃশ্যমান শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা যায় মারামারি কাটাকাটি ও আপোষরফা করা যায় কিন্তু এই অদৃশ্য শক্তির মোকাবেলা বা আত্মসমর্পণ তারা কি করে করবে? অশরীরী শক্তির আতঙ্কে তারা নির্জীব হয়ে গেল।
নুরুজ্জামান কাজির ঘর সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে রফিক কাজির ঘর। সে একটু দরিদ্র মানুষ, তার ঘরের ছাউনি টিনের কিন্তু বেড়া বাঁশের চাটাই নির্মিত। তার ঘরে আগুন লাগল কিন্তু নেভানো সম্ভব হলো না। কারণ আগুনটা লেগেছে চাটাইয়ের বেড়ায়, লোকজন আসতে আসতে আগুন ঘরময় ছড়িয়ে পরেছে। মানুষ পানি আনা ও কলা গাছ কাটার মধ্যেই সারা ঘর ভস্ম হয়ে গেছে। আসবাবপত্র তেমন বাঁচাতে পারেনি, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বেচারা রফিক তার ভাইয়ের হাফবিল্ডিং খালি ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিল, তার ভাই ঢাকায় চাকরি করে সপরিবারে থাকে। সংলগ্ন ঘর হওয়ার কারণে নুরুজ্জামানের ঘরে আগুন লাগে লাগে অবস্থা। সবাই চেষ্টা করে কোন রকম ঘরটা রক্ষা করলো। আগুন নিভিয়ে এসে নুরুজ্জামান স্ত্রীকে বলল ‘আর এক মুহূর্ত নয়, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পুড়ে মরার জন্য এখানে আর পড়ে থাকবো না। দুই দিনের মধ্যে সব গুছগাছ করো বাসায় চলে যাব। এক বাপের এক ছেলে হিসাবে সে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছে। তার বাবা দারোগা ছিল, একটা ডাকাত দলের ক্রসফায়ারে পড়ে সে মারা যায়। তিনি তাহের কাজির চাচাতো ভাই ছিলেন। নুরুজ্জামান তখন ছোট, তাহের কাজিই তাকে লালনপালন করে এবং সংসার দেখাশোনা করে। সে বাপের উত্তরাধিকারসূত্রে ময়মনসিংহ শহরে দুইটা বাসা, অনেক ফসলি জমি ও বাজারে কয়েকটা দোকানের মালিক হয়েছে। বর্তমানে শহরের একটা বাসা খালি আছে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদিনের মধ্যেই বউ-বাচ্চা নিয়ে খালি বাসায় গিয়ে উঠবে।
পরদিন রাতে নুরুজ্জামানের দল পাহারা দিচ্ছে, সেই এই দলের নেতা। বাপের মতো তারও ডাকাবুকো সাইজের চেহারা, ছয় ফুট লম্বা, পাকা আমের মতো গায়ের রং, চওড়া বক্ষ, বলিষ্ঠ দেহ, গরিলার মতো মোটা মোটা লোমশ হাত পা তার শক্তির প্রমাণ দেয়, গাম্ভীর্যপুর্ন মুখের বলি রেখায় ফুটে উঠে তার তেজ আর সাহসের পরাকাষ্ঠা। কিছু লোক ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে আর কয়েকজন উঠানে বসে তাস খেলছে। নুরুজ্জামান কিছুক্ষণ খেলার পর উঠে দাঁড়ালো, আড়মোড়া দিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে রমিজকে খুজল কিন্তু পেল না, রমিজ এই দলের। সে বৈঠক ঘরে গেল কিন্তু পেল না। নুরুজ্জামানের আত্না ছ্যাঁত করে উঠলো, সন্দেহ মাথা ছাড়া দিয়ে উঠল। সে দ্রুত বেরিয়ে ঘরের সারির সামনে গিয়ে খুঁজতে লাগল, বারান্দার সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিকে যেতে লাগল। উত্তরের মাথার ঘরটা তাহের কাজির, এই ঘর থেকে পঞ্চাশ হাত উত্তরে পুকুর। ঘরের সামনে পৌঁছে সে পুকুরের দিকে কিছু একটা শব্দ শুনতে পেল। সহসা সে সতর্ক হয়ে কান খাড়া করল, ক্ষীন একটা শব্দ ভেসে আসছে, কোন কান্নার আওয়াজ সম্ভবত।
গভির রাত, প্রকৃতি নীরব নিস্তব্ধ। চাঁদ নেই, পরিষ্কার আকাশে তারার আলোয় পৃথিবীতে আলো আঁধারির খেলা চলছে। বহু প্রাচিন পুকুরটির পাড়ে বিভিন্ন জাতের বিশাল বিশাল গাছ ও ছোট ছোট ঝোপঝাড়, পুকুর সংলগ্ন পশ্চিম পাশে বাঁশঝাড়ে ছাওয়া বিশাল জঙ্গল। এমন পরিবেশেই নাকি জ্বীন ভূতেরা ভূপৃষ্ঠে তাদের প্রভুত্ব কায়েম করে। সে ঘরের সামনে দিয়ে পা টিপে টিপে পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো আর যা দেখলো তাতে তার পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রত্যেকটা পশম সজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে গেল, প্রতিটা লোম কূপ থেকে ঝরনার মত ফিনকি দিয়ে ঘাম বেরিয়ে আসলো। এতটা ভয়াবহ আতঙ্কের জিনিস কেউ কোনদিন দেখেনি। তার চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইল, আকাশ পৃথিবী মাটি লাঠিমের মত ঘুরতে লাগলো। সে প্রাণপণে চিৎকার করতে চাইল কিন্তু নিঃসীম আতঙ্কে তার গলা শুকিয়ে গেছে, কণ্ঠে কোন শব্দ বাজলো না, শুধু অস্ফূট একটা আওয়াজ বেরোলো। তাতেই পুকুর জলে একটা আলোড়ন উঠল, সাথে সাথে পুকুরপাড়ের গাছ ও সংলগ্ন জঙ্গলের বাঁশঝাড় তোলপার করে একটা ভয়াবহ তান্ডব ঘটে গেল। পরক্ষণেই একটা বিকট চিৎকার শোনা গেল, তারপর সব শান্ত।
পাহারাদাররা দৌড়ে এলো, টর্চের আলোয় দেখতে পেল পুকুর পাড়ে একটা লোক পড়ে আছে। একজন দৌড়ে এসে মুখের উপর টর্চ মারলো আর সাথে সাথে বিকট চিৎকার করে ভয়ে পিছিয়ে গেল। তারপর একসাথে সবাই এসে টর্চ মারলো, বীভৎস দৃশ্য, চোখ দুইটা ফেটে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, মুখ হা করে আছে। চরম আতঙ্কে দুমড়ে-মুচড়ে চেহারাটা বিকৃত হয়ে গেছে। মুহূর্তেই বাড়ির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল এই ট্রাজিক সংবাদ। নুরুজ্জামানের বউ আর বাচ্চাগুলি লাশের উপর পরে জবাই করা মুরগির মত ধাফরাতে লাগল। তাহের কাজী দৌড়ে এসে নুরুজ্জামানের মাথাটা কূলে নিয়ে বসল, হা করা মুখ ও চোখ হাতের তালু দিয়ে চাপ দিয়ে বন্ধ করে দিল। মাথাটা বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। তার মনে পড়ল দারোগা মারা যাওয়ার সময় নুরুজ্জামান ক্লাস ফাইভে পড়ে, এই ছোট ছেলেটাকে সে সন্তানের মত মানুষ করেছে। তার সংসার, সম্পদ ও লেখাপড়ার কোন ক্ষতি হতে দেয়নি, নিজ হাতে বিয়ে করিয়েছে। সেও তাকে আজীবন বাপের মতো শ্রদ্ধা করেছে, মেনে চলেছে। আজ সেই ছেলে তার চোখের সামনে এভাবে অপঘাতে চলে গেল, কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। তিনি আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন।
কিন্তু শীঘ্রই তার হুশ ফিরল। সে হল বাড়ির কর্তা, অন্যদের তাকেই সামাল দিতে হবে। তিনি ক্ষণকাল স্থির বসে থেকে কয়েকজন মহিলাকে বললেন নুরুজ্জামানের বউ-বাচ্চাকে ঘরে নিয়ে যেতে, কয়েকজনকে পাঠালেন মসজিদ থেকে খাটিয়া এনে লাশ তুলতে। আতঙ্কে প্রতিটা মানুষ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, সারা বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এলো। নুরুজ্জামানের ঘরে বুকফাটা মাতম চলছে, অদৃশ্য আতঙ্কে কাজির ছোট্ট নাতনিটা পর্যন্ত দাদার কোলে উঠে বুকে মুখ গুজে পড়ে আছে। পরদিন দাফন-কাফনের কাজ শেষ করেই দুটি পরিবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। ফুলপুরে তাদের নিজস্ব বাসায় গিয়ে উঠল। নুরুজ্জামানের বড় ছেলেটা ফুলপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। মা ছেলেকে বললেন ‘তিনদিন পর তোর বাপের নামে কুরআনখানি করে আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবো না, সোজা টাউনে চলে যাবো। তোর বাপকে হারিয়েছি এখন তোদের কাউকে হারাতে পারব না, তুই একটা গাড়ি- টারি ঠিক করে রাখিস। তোর বাপ বলেছিল দুইদিন পর চলে যাবে, একদিন চলে গেছে। তারপর ললাটে হাত মেরে বলল ‘হায় কপাল কাল- অভিশাপ আর একটা দিন সময় দিল না’ বলে কপালে হাত মারতে মারতে মহিলা আবার মাতম শুরু করলো।
তিন দিন পর কোরআন খতম করা হলো, কিছু মাদরাসা ছাত্র আর বাড়ির সকল মানুষকে খাওয়ানো হলো। বিকালে একটা পিকআপ এলো, তাতে মালামাল তুলে দিয়ে নুরুজ্জামানের বিধবা স্ত্রী এসে কাজীর কদমবুসি করে বলল ‘চাচা আব্বা আসি দোয়া কইরেন। কাজী গম্ভীর হয়ে ক্ষনকাল বসে রইল। এই মেয়েটাকে সেই ভাতিজার বধু করে এনেছিল আর আজ বৈধব্যের অভিশাপ মাথায় নিয়ে অসহায় হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সে চোখ মুছে বলল ‘যাও মা যাও, বাধা দিব না যে যেভাবে পারো জীবন বাঁচাও।
নুরুজ্জামান মারা যাবার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে, এ পর্যন্ত দুই একবার আগুন লাগলেও অন্য কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। আজ নুরুজ্জামানের দলের পাহারা দেবার পালা। সারা রাত জেগে পাহারা দিতে হয় বিধায় কয়েকজন বাড়িময় ঘুরে পাহারা দেয়, বাকিরা উঠানে বসে তাস লুডু ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটায়। কিছুক্ষণ পর এরা পাহারায় যায় ওরা খেলতে বসে, এভাবে পালাক্রমে পাহারা দিয়ে তারা রাত কাটায়। রমিজ এই দলের সদস্য কিন্তু তাকে সবাই সন্দেহ করে, এড়িয়ে চলে কেউ কথা বলে না। তাকে কেউ খেলায়ও নেয় না একসাথে পাহারাও দেয় না। সে একা একা ঘুরে ঘুরে পাহারা দেয় কখনো অপাংক্তেয় ভাবে বসে বসে খেলা দেখে। এসব অবাঞ্চিত অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেলে সে কাজির কাছে অভিযোগ করে। তখন কাজি তাকে সান্ত্বনা দেয় ‘আরে শুন বিপদে পড়লে মানুষের ঈমান ঠিক থাকে না, ওদের তো এখন জীবনেরই ভরসা নাই। কাজেই মনের দুঃখে সন্দেহের বশে তোর সাথে খারাপ আচরণ করলে বা কিছু বললে তুই কিছু মনে করিস না। আমি তো জানি তুই নিষ্পাপ মাসুম, কাজির কথায় সে সান্তনা পায়।
রমিজ হলো বাইশ- তেইশ বছরের যুবক। দীর্ঘদেহী কাল গাত্রবর্ণ, আয়রন পেটা শরীর, রোদে পোড়া চেহারা, চওড়া কাঁধ আর পেশীবহুল বাহু দেখেই তার শক্তির আন্দাজ পাওয়া যায়। তাছাড়া দুঃসাহসী হিসেবে রমিজের খ্যাতি আছে। রাতের তৃতীয় প্রহর অতীত হয়ে গেছে, ঘুরে ঘুরে পাহারা দিয়ে সে ক্লান্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নির্বাক বসে বসে তাস খেলা দেখল আর একটা বিড়ি খেল। তারপর উঠে পেশাব করার জন্য পুকুর পাড়ের দিকে চলে গেল। গ্রামে নির্ধারিত কোন পেশাব খানা থাকে না, সে সাধারণত পুকুরপাড়ে পেশাব করে। কিন্তু পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই তার কানে একটা ক্ষীন শব্দ বাজলো, সে চকিতে পুকুরের দিকে তাকিয়েই চোখ বিস্ফারিত করল আর সাথে সাথে তার দেহটা থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো। সহসা তার শরীরটা ঘেমে নেয়ে গেল, সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠল, ঘাসের মতো মাথার চুলগুলি দাঁড়িয়ে গেল। সে চোখ কচলে ভাল করে দেখল- ঝুমুর। হা হা ঠিকই দেখছে কোন ভুল নয়- ঝুমুর। কাজির নাতনি ঝুমুর পুকুরের পানির উপর দিয়ে হাঁটছে আর কাদছে। মেয়েটা পুকুরের মাঝখানটায় চক্রাকারে ঘুরছে আর কাঁদছে।
হঠাৎ বিদ্যুতে শক খাওয়ার মত রমিজের দেহ অসাড় হয়ে গেল, দু’পা মাটির সাথে সেঁটে গেছে। চিৎকার করা, ডাক দেয়া বা নড়াচড়া করার মত অনুভূতি তার মধ্যে নেই। সে শুধু সম্মোহিতের মত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। ঝুমুর কাঁদতে কাঁদতে পুকুরের দক্ষিন পারের দিকে এগিয়ে আসছে, হয়তো এখন উঠে আসবে। ঠিক তখনই রমিজের দিকে তার দৃষ্টি গেল আর সাথে সাথে চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরোলো। পরক্ষনেই পুকুরের পানি তোলপাড় করে পাড়ের গাছগাছালি আর জঙ্গলের বাঁশ ঝাড় দুমড়ে-মুচড়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিল। ঠিক তখনি একটা কলজে ফাটা চিৎকার শোনা গেল, সাথে সাথে সব শান্ত নীরব।
পাহারাদাররা এবার আর কেউ একা এলো না, সবাই একসাথে টর্চ মারতে মারতে এগিয়ে এলো। টর্চের আলো পড়তেই সবাই আঁতকে উঠল- ওঃ কী বিভীষিকা, দু’চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, হা করা মুখে কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ জিব্বা বেরিয়ে রয়েছে, ঠোঁটের দু’কোন বেয়ে তাজা রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে, অন্তহীন ভয়ে দুমড়ানো এলুমিনিয়ামের পাত্রের মতো মুখটা বেঁকে মোচড়ে বিকট রূপ ধারণ করেছে। কাজী দৌড়ে এসে রমিজের লাশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো আর সাথে সাথে সংজ্ঞা হারালো। তাকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। একটা করাল আতঙ্ক সমগ্র বাড়িটাকে গ্রাস করে নিল।
সকালে লাশ দাফন কাফন হলো আর দুপুরেই পাঁচটা পরিবার বাড়ি ছেড়ে গেল। তাদের কেউ শহরে নিজের বাসায় কেউ ভাইয়ের বাসায় কেউ আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিবে। এখন জীবন বাঁচানোই তাদের আসল দায়। বাড়ির উত্তরাংশে যারা আছে তারাও মৃত্যুর এই করালগ্রাস থেকে বাঁচার জন্য দু-একদিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। শহরে যাদের বাসা আছে তারা নিজের বাসায় উঠবে, অন্যরা আত্মীয়-স্বজনের বাসা অথবা ভাড়া বাসায় উঠবে, কেউ শ্বশুর বাড়ি আশ্রয় নিবে। কিন্তু যারা দরিদ্র বাসা ভাড়া নেয়ার সামর্থ্য নাই বা কোথাও আশ্রয় নেয়ার সুযোগ নাই তারা এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোন ভিটায় বা ক্ষেতে গিয়ে বাড়ি করবে। আপাতত একটা ছাপড়া তুলে থাকবে তারপর ধীরে ধীরে বাড়িঘর করে স্থায়ী হবে। এই মৃত্যুপুরী ছেড়ে যাওয়ার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠল, তারা প্রস্তুতি শুরু করলো।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বাড়িটাতে নেমে আসে গোরস্থানের নীরবতা, যমপুরীর দুরাগত অশরীরীরা যেন তাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকে কোন অন্ধকার বিবরের দিকে, প্রতিটা মানুষের চেহারায় কুটিল মরণ আতঙ্ক ফুটে উঠে। কারো মুখে কথা নেই, রা নেই ভাষা নেই, সবাই যেন কোন বীভৎস পরিণতির অপেক্ষায় প্রহর গুনে। রাতে খাওয়ার সময় কাজী গিন্নি জিজ্ঞেস করলো ‘সবাই তো বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে আমরা কি করবো? দুঃখ কষ্ট ও তীব্র মানসিক চাপে কাজীর ফর্সা মুখটা বিকৃত হয়ে কালো হয়ে গেছে। রমিজের মৃত্যুতে একদিনে বেচারা আরো বুড়ো হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললে ‘কি করব জানি না, আমি বুড়ো হয়ে গেছি মরলেই কি আর বাঁচলেই কি, বাঁচলেই বা আর কতদিন বাঁচবো। কিন্তু আমার চিন্তা হলো’ বলে তার কোলে বসা ঝুমুরের মুখের দিকে তাকালো আর সাথে সাথে বৃদ্ধ ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো। বললো ‘দেখো ওর মুখটা দেখ কেমন সোনার পুতুলের মত দেখা যাচ্ছে, কেমন মায়াময় ওর চোখ দুটি’ বলে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো ‘ওর কিছু হলে আমাদের বেচে থেকে লাভ কি, বেচে থেকে লাভ কি’ বলতে বলতে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল আর মেয়েটাকে চুমুতে লাগলো। বিষম কান্নার গমকে বৃদ্ধের শরীরটা থরথর করে কাঁপে।
রাতে পাহারার কাজ শুরু হলো কিন্তু মৃত্যু ভয়ে এখন আর কেউ একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে না বা খেলায় মত্ত হয় না, সবাই একসাথে দল বেঁধে বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর দেয়। বাড়ির রক্ত হিম করা দুঃসংবাদ শুনে কাজী তাহেরের কনিষ্ঠ ভাই গোয়েন্দা কর্মকর্তা কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসলেন। এসেই তিনি বড় ভাইয়ের উপর হামলে পড়লেন ‘বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে একটার পর একটা মানুষ মারা পড়ছে আর তুমি এখনো পড়ে আছ কেন, বুড়ো বয়সে জিন-ভূতের হাতে মরার খুব শখ জেগেছে, বাড়ির এত মায়া কেন, জীবন না বাঁচলে বাড়ি দিয়ে কি হবে? আজই বাড়ি ছাড়, হয় মেজ ভাইয়ের বাসায় যাও, না হয় ছেলের বাসায় যাও তাও না গেলে আমার সাথে চলো, তাড়াতাড়ি সব গুছগাছ কর কাল আমার সাথে রওয়ানা হতে হবে’ ইত্যাদি বলে তিনি বড় ভাইকে তিরস্কার করতে লাগলেন। অগত্যা কাজি ও তার গিন্নি পরামর্শ সভায় বসে সিদ্ধান্ত নিল কাল সকালেই তারা ফুলপুরে প্রিন্সিপালের বাসায় চলে যাবে। কারণ তার বাসা কাছে, সেখান থেকে বাড়ি-ঘর ও জমাজমির দেখাশোনা করা সহজ হবে। সিদ্ধান্ত মাফিক তারা প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলো।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা আগেই তার গোয়েন্দাগিরির সকল কলা-কৌশল পরীক্ষা করেছিল কিন্তু কোন ফল পায়নি। এখন রাতে তিনি পাহারাদারদের সাথে যোগ দিলেন আর তাদেরকে বুঝাতে লাগলেন ‘এখানে বাড়ি ঘর সহায়-সম্পদের কোন নিশ্চয়তা নাই কখন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। একটার পর একটা মানুষ মরছে, এখানে জীবনের নিশ্চয়তা নাই কে কোথায় কখন বেঘুরে মরে পড়ে থাকে। কোন কাজকর্ম নাই, সবাই শুধু এক অদৃশ্য আতঙ্কের মোকাবেলায় ভয়ে সিটিয়ে থাকে। এভাবে তো জীবন চলে না, এই ভীতিকর জীবনের চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। নিরাপত্তা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কাজেই আমার পরামর্শ হলো আর কালক্ষেপণ না করে যথাশীঘ্র তোমরা বাড়ি ছেড়ে দাও। এখানে ধুকে ধুকে মরার চেয়ে যে যেখানে পারো গিয়ে আশ্রয় নাও, রাস্তাঘাটে ফুটপাতে গিয়ে পড়ে থাকো সেও ভালো। দেখলে তো দুনিয়ার সব পীর ফকির কবিরাজ ব্যর্থ হলো আর আশা কি? সবাই এক বাক্যে তার কথায় সায় দিল, সিদ্ধান্ত হল দু’দিনের মধ্যে তারা বাড়ি খালি করে দিবে, জিনেরাই থাকুক এ বাড়িতে তারা আর থাকবে না।
সকাল দশটা, তাহের কাজির ঘরের সামনে একটা পিকাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার মেজো ছেলে ও অন্য দু'জন লোক ঘর থেকে মালামাল এনে গাড়িতে তুলছে। হঠাৎ প্রিন্সিপাল কাজী ওরাসাত হোসেন গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন, সাথে কম বয়সী একজন হুজুর মানুষ- বয়স পচিশ ছাব্বিশের বেশি হবে না। প্রিন্সিপাল সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘মিয়া ভাই কি কর? কাজী রুক্ষ কন্ঠে জবাব দিলেন ‘কি করি জানিস না, তোর বাসায় চলে যাচ্ছি। প্রিন্সিপাল হুজুরের দিকে একবার তাকিয়ে বড় ভাইয়ের মুখের পানে চেয়ে একটু কাচুমাচু করল। তারপর হুজুরের হাত ধরে টেনে নিয়ে বারান্দায় ফেলে রাখা একটা বেঞ্চের উপর বসে বললেন ‘মিয়া ভাই উনি তোমার সাথে একটু আলাপ করতে এসেছেন। বড় কাজি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে নিরাসক্ত গলায় বলল ‘কি আলাপ? প্রিন্সিপাল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, ক্ষিন কন্ঠে বললেন ‘উনার নাম আবুল, বালিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। মাদ্রাসার হুজুরদের সাথে আগেও তিনি কয়েকবার এসেছেন। আমাদের বাড়ির ব্যাপারটা নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় চলছে, আজও কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না দেখে উনিও খুব চিন্তিত। কাল রাতে উনি আমার বাসায় গিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেন তাই আপনার সাথে আলাপ করানোর জন্য নিয়ে আসলাম।
কাজী একটু অবজ্ঞার হাসি হাসল ‘হাতি ঘোড়া গেল তল মশা কয় কত জল। সারাদেশের কত মার্কামারা পীর ফকির-কবিরাজ এখান থেকে নাকখত দিয়ে বিদায় নিল আর তুই একটা ছোকরাকে ধরে এনেছিস ব্যবস্থা করতে, তাও আবার ছাত্র। খেয়ে দেয়ে আর কাজ পাস নাই। এসব কিচ্ছু হবে না কিচ্ছু হবে না, কাজী বংশের উপর খোদার গজব পড়েছে এই বংশ নির্মূল হয়ে যাবে, জানি না কার পাপের মাশুল আমাদেরকে দিতে হচ্ছে’ বলে তিনি চোখ মুছলেন। ঝুমুর দাদার কোলে বসে আবুলের দিকে তাকিয়ে কুঁকড়ে গেছে, সে দাদার বুকে মুখ গুঁজে বসে আছে আবুলের দিকে ফিরে তাকায় না। আবুলও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়েটাকে দেখল। বড় কাজি বারবার বলতে লাগলো ‘এখন আর কিছু করে লাভ হবে না বরং ক্ষতিই হবে। সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে দু'দিনেই বাড়ি খালি হয়ে যাবে। অগত্যা আবুল বললো ‘চাচামিঞা এমন তো অনেক দেখা যায় যে দুরারোগ্য রোগী মাদ্রাজ সিঙ্গাপুর ঘুরে এসে বাড়ির পাশের স্থানীয় হোমিও ডাক্তারের দুই ফোটা ঔষধ খেয়ে ভালো হয়ে যায়, বিশ্বাসই সব কিছু করে। আমাকে একটু সুযোগ দেন, এমন দুয়েকটা বিষয় আগে আমি ফয়সালা করেছি। তাই আমি তিনটা দিন সময় চেয়ে নিচ্ছি, যদি কিছু করতে পারি তো ভালো, না পারলে তিনদিন পর চলে যাবেন।
কাজী রাগত স্বরে বলল ‘কিন্তু এই তিন দিনেই তো তিনটা লাশ পড়ে যাবে। আবুল বলল ‘লাশ পড়লে আগে আমারটা পড়তে হবে, এই তিন দিন আমি এখানেই থাকব। তখন গোয়েন্দা কর্মকর্তাসহ আরো কয়েকজন গণ্যমান্য লোক আবুলের সাথে কথা বলা শুরু করল, সে আগে এ জাতীয় ভুত- প্রেতের কোন বিষয় ফয়সালা করেছে কিনা, কোথায় কখন করেছে, ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্ন ও শর্ত দিয়ে দিয়ে বেচারাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। আবুল সব শর্ত মেনে নিল। তখন সবাই বড় কাজীকে বলল ‘মিয়া ভাই সর্বশেষ একটা সুযোগ দেন, আমাদের যদি কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে আমরা এই তিনটা দিন ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখি কী হয়, প্রিন্সিপালও অনুরোধ করলো। অগত্যা বড় কাজি চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে ‘তোদের যা খুশি কর, তবে কোনো লাভ হবে না আমি আগেই বলে রাখলাম’ বলে তিনি ঝুমুরকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। গাড়ির মালামাল আবার ঘরে তোলা হলো। আবুল বৈঠক ঘরে উঠলো, তার সম্বল বলতে শুধু একটা ব্যাগ।
আবুল সারাদিন বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল, ছেলে বুড়ো জোয়ান সকলের সাথে কথা বলল পর্যবেক্ষণ করল। গোধূলি বেলায় গিয়ে বাড়ির চার কোনায় চারটা তাবিজ পুতে এল। মাগরিবের নামাজ পড়েই ঘুমিয়ে পড়ল, মধ্যরাতে উঠে চারটে খাওয়া-দাওয়ার পর পাহারাদার দলের সাথে মিশে গেল। কখনো পাহারাদারদের সাথে কখনো একা একা বাড়িময় ঘুরল। অবশেষে পুকুরপাড়ে এসে স্থির হল, একাকি পুকুর পাড়ে ঘুরতে লাগলো। নিঝুম রাত, পাহারাদারদের ফিসফিসানি ব্যতীত কোন সারা শব্দ নাই, সমগ্র বাড়িতে জেঁকে বসেছে ভৌতিক নীরবতা আর ভয়াল মৃত্যুপুরীর আতঙ্ক। চাঁদহীন আকাশে তারকাদের খেলা আর পৃথিবীতে চলছে আলো-আঁধারির খেলা। কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না, আবছায়া মনে হয়। আর এ আবছায়ার মধ্যে গাছপালা বাড়িঘর সবকিছুই কেমন ভৌতিক রূপ ধারণ করেছে, যেন এক অতিপ্রাকৃত জগৎ। এমনি পরিবেশে আবুল একাকী পুকুর পাড় দিয়ে হাঁটছে, ডর নাই ভয় নাই ঝোপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো হাটে কখনো বসে। সে পুকুরটা পর্যবেক্ষণ করছে। পাহারাদাররা ফিসফিসায় ‘লোকটা কি আসলে মানুষ নাকি অন্য কিছু?
পরদিন সকালে আবুল ঘোষণা দিলো বাড়ির জোয়ান বুড়া পোলা বলতে পুরুষ যা আছে সবাইকে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে। প্রিন্সিপাল গোয়েন্দা অফিসারসহ অন্যান্য মুরুব্বিরা তদারকি করে বাড়ির সবাইকে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে লাগল। সাক্ষাৎ বলতে শুধু বৈঠক ঘরে গিয়ে হুজুরকে একটা সালাম দিবে আর হুজুর হ্যান্ডশেক করবে, ব্যস এইটুকুই। তবে হুজুর খালি হাতে হ্যান্ডশেক করে না, তার তর্জনীতে টেপ লাগানো একটা সুঁই আছে। তিনি সুঁই হাতে মুসাফাহা করেন তবে কেউ বুঝতে পারে না। বিশাল বড় বাড়ি অনেক মানুষ, বিকাল নাগাদ মুসাফাহার কাজ শেষ হলো। গত রাতের মতই এ রাতও কাটলো, তবে আজ আর আবুল পাহারাদারদের সাথে না থেকে সারারাত পুকুরপাড়ে কাটিয়েছে। ভোর থেকেই তাকে বেশ প্রফুল্ল দেখা যাচ্ছে, মনে হয় একটা কিছু আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
সকালে সে প্রিন্সিপাল ও গোয়েন্দা অফিসারকে ডেকে এনে বললো ‘কোন পুরুষকে আর পরীক্ষা করার দরকার নাই, কাজটা মেয়ে লোকের। আজ আমি মেয়েদের পরীক্ষা করব, বাড়ির বুড়ি পোরি ছেড়ি যা আছে সবাইকে দেখতে হবে। প্রথমে আগুনলাগা অংশের চল্লিশটি ঘরের মেয়েদের পরীক্ষা করব, যদি না পাই তখন সারা বাড়ির মেয়েদের পরীক্ষা করতে হবে। তাও না পেলে যারা বাড়ি ছেড়ে বাইরে গেছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কথা মতো খাওয়া-দাওয়ার পর আবুল বাড়ির ভিতর গিয়ে চেয়ার নিয়ে উঠানে বসলো। মুরুব্বীরা তদারকি করে একেকজন করে মহিলা পাঠায় আর আবুল পরীক্ষা করে ছেড়ে দেয়। পরীক্ষা তেমন কিছু না, একটা মন্ত্র পঠিত সুই দিয়ে মহিলার কনিষ্ঠাঙ্গুলির মাথায় খোঁচা মারে, তাতে এক ফোটা রক্ত বের হয় আর রক্তটা দেখেই ছেড়ে দেয়। কারণ জিন জাতির দেহে লাল রক্ত নাই।
দক্ষিণ পাশ থেকে তদন্ত করে করে সব শেষে এসে বসলো তাহের কাজীর উঠানে। তারপর কাজীকে বলল ‘চাচা আপনার ঘরে মেয়ে লোক যারা আছে সবাইকে নিয়ে আসেন। কাজী ঘরে গিয়ে দু’জন মহিলা নিয়ে আসলো। একজনকে দেখে আবুল হাসিমুখে বলল ‘চাচি সারা জীবন তো সংসার করলেন আজ আপনাকেই ভুত প্রমাণ করে ছাড়বো। আসেন কাছে আসেন, সারা জীবন কাঁথা সেলাই করে সুঁইয়ের গুতা তো আর কম খাননি আজ আরেকটা খেয়ে যান’ বলে একটা গুতা মেরে ছেড়ে দিল। অপর মহিলার কনিষ্ঠাঙ্গুলিতেও গুতা মারলো, গল গল করে যুবতী মহিলার তাজা রক্ত বেরিয়ে এলো। মহিলা দু’জন চলে গেল। আবুল বড় কাজির দিকে তাকিয়ে বলল ‘আনেন আর কে আছে? কাজি বলল ‘আমার ঘরে মহিলা দু’জনই, আপনার চাচি আর মেজ ছেলের বউ, আর কেউ নাই। আবুল দৃঢ়তার সাথে বলল ‘আনেন, কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ধরে আনেন। কাজী চোখ কপালে তুলল ‘আমার ঘরের খবর কি আপনি বেশি জানেন নাকি, আমি বলছি নাই আর আপনি বলছেন আছে? আবুল বললো ‘আছে আছে, কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন নিয়ে আসেন।
উঠান ভর্তি মানুষ একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। একজন বলল ‘ঝুমুর নামে একটা বাচ্চা মেয়ে আছে। কাজি হেসে বলল ‘আরে ও তো চার পাঁচ বছরের শিশু। আবুল বলল ‘আণ্ডা বাচ্চা শিশু নবজাতক যাই হউক- মেয়ে লোক বলতে যা আছে সবাইকে আনতে হবে। এই প্রথম কাজি চমকে উঠল, কারণ ঝুমুর এক মুহূর্ত তাকে ছাড়া থাকে না, সব সময় কোলে কোলে থাকে অথচ আজ সকাল থেকেই তাকে দেখছে না। সবাই ঝুমুরকে খুঁজতে লাগলো কিন্তু না ঝুমুর কোথাও নাই। বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত একটা নামহীন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, সহসা যেন তাদের চোখের সামনে রহস্যের পর্দা উন্মোচিত হয়ে উঠলো। সমগ্র বাড়িটাতে একটা হুলস্থুল বেধে গেলো, নারী-পুরুষ সবাই ঝুমুরকে খুঁজতে লাগল। ঘরে বাইরে রান্নাঘরে গোয়াল ঘরে বৈঠক ঘরে সর্বত্র খোঁজা হলো কিন্তু পাওয়া গেল না। বড় কাজী একেবারে নির্বাক নিথর নিস্পন্দ হয়ে গেছে, তার সুন্দর মুখটা তীব্র অনুশোচনা আর বিষাদে কাল হয়ে গেছে। তিনি বারান্দায় একটা চেয়ারে পাষাণ মূর্তির মত নির্বাক হয়ে বসে আছেন।
কয়েকজন এসে বলল ‘ঝুমুর নাই, নিশ্চয় সে পালিয়েছে তাকে ফিরিয়ে আনুন। আবুলের দৃঢ়বদ্ধ ঠোটের উপর অবজ্ঞার হাসি খেলে গেল ‘পালাতে পারবে না, বাড়ি বন্ধ আছে। মানুষ ছাড়া অন্য কিছু বাড়ি থেকে বাইরে যেতে পারবে না আর বাইরে থেকে ভিতরে আসতে পারবে না। ভাল করে খুজোন, সে বাড়িতেই আছে। সমগ্র বাড়িতে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল, বিশাল বাড়ি অসংখ্য লোক সংখ্যা, রহস্য উদ্ধার ও মুক্তির আনন্দে মানুষগুলি যেন পাগলপারা হয়ে উঠেছে। তারা হুমরি খেয়ে পড়লো, সমগ্র বাড়িটাতে তন্নতন্ন করে খুঁজলো, ইঞ্চি ইঞ্চি খুঁজলো, সবাই মিলে বাড়িটাকে যেন চালনি ছাঁকা দিতে শুরু করেছে। ‘নাই নাই’ বলে আবুলের কাছে বারবার খবর আসে আর আবুল হাসে ‘আছে আছে, ভাল করে খুজোন। আসলে বাচ্চাদের কাজ বাচ্চারাই ভালো করতে পারে, বড়রা মোটা মোটা ও ফাঁকা জায়গা গুলিতে খুঁজছে কিন্তু বাচ্চারা যত গলি-ঘুপচি আর অন্ধকার চিপা চাপিতে খুঁজতে লাগলো। বাড়ীর বাচ্চাদের যেন ঈদের উৎসব শুরু হয়েছে, তারা পুলিশি অভিযানের মত চিরুনি তল্লাশি শুরু করেছে। খাটের তলা, ফার্নিচারের তলা, খাঁচার তলা ,আলমারির চিপা, ঘরের কার্নিশ বাক্সের মধ্যে, রান্নাঘরে তাকের চিপা, খড়ির চিপা ইত্যাদিতে তারা চালনি ছাঁকা দিতে লাগল।
তাহের কাজির ঘরের সামনের বারান্দায় এক কোনে হাঁস মুরগির খোয়ার। ছয় সাত বছরের একটা বাচ্চা খোঁয়াড়ে মুখ ঢুকিয়ে আবার বের করে লাফিয়ে উঠে চিৎকার শুরু করল ‘পাইছি পাইছি। সাথে সাথে লোকজন সে দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। দুইজন খোঁয়াড়ে অর্ধেক শরীর ঢুকিয়ে মেয়েটার দু’হাত ধরে টেনে বের করতে চাইল কিন্তু পারল না। কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। সাপের গর্ত থেকে যেভাবে সাপ টেনে বের করা যায় না তদ্রুপ ঝুমুরকেও বের করা সম্ভব হলো না। অগত্যা ঘরের উপরের ছাউনি আর পার্শ্ব ভেঙ্গে খালি করা হল, তারপর পাঁচ ছয় জনে ধরে টেনে হেঁচড়ে আবুলের কাছে নিয়ে গেল। তাহের কাজী চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে আছে। জীবনে সে অনেক বীভৎসতার কথা শুনেছে কিন্তু এমন বীভৎসতা শুধু নবেল নাটকেই পাওয়া যায়, বাস্তবে তার পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে কোনদিন দেখেওনি শুনেওনি। এমনকি পৃথিবীর মানুষও হয়তো এমন ঘটনা শুনেনি, নিশ্চয় একদিন ঝুমুর ইতিহাস হবে।
আবুলের কাছে পৌঁছতেই মেয়েটা বাঁশির মতো তিক্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ‘তুই এখানে এসেছিস কেন, আমি তোর বংশ নির্বংশ করে দিব। তোকে মেরে ফেলবো যা ভাগ’ বলে চিৎকার করতে লাগল। তার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ গাছে গাছে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। মেয়েটা ক্রোধোন্মত্ত চোখে আবুলের দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। আবুল তার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। তারপর লাফিয়ে উঠে মেয়েটার মাথা থেকে হ্যাঁচকা টানে এক গাছি চুল নিয়ে ঝটপট মন্ত্র পড়ল, এরপর ঝুমুরের কনিষ্ঠাঙ্গুলি ধরে চুলটা ভালো করে পেঁচিয়ে গিরা দিয়ে দিলো। বেশ শান্ত, মেয়েটা একেবারে নির্বাক ও শান্ত হয়ে গেল, সহসা তাঁর ক্রোধ উধাও। আবুল তার হাত ধরে টেনে নিয়ে কাজির ঘরের সামনে গিয়ে বলল ‘ঘরে কোন মানুষ থাকলে বের করে দেন। বুড়ি কাজি বেরিয়ে গেল আর আবুল মেয়েটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর দুজনের মধ্যে ফিসফিসিয়ে সওয়াল জওয়াব শুরু হল।
কাজী বাড়ির আগুন রহস্য ধরা পড়েছে- কথাটা বনের আগুনের মতো সারা এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। এমনিতেই ঘটনাটা জেলার প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল, এখন পথে-ঘাটে বাজারে পথিকের কাছে বা একে অন্যের কাছে শুনে মুখে মুখে সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। রহস্য দেখার জন্য মানুষ রিকশা সাইকেল হুন্ডা ভ্যান পায়ে হেঁটে- যে যেভাবে পারল দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো। বিশাল বাড়ির উঠোন লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে, এ যেন টঙ্গীর এজতেমার মাঠ। আসল জিনিসটা দেখার জন্য সবাই উৎসুক হয়ে আছে। বাড়ির মানুষ বড় কাজির ঘরের চারপাশ ঘিরে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম প্রথম তারা ফিসফিসানি ছাড়া কিছুই শুনতে পেল না। সহসা মেয়েটার গর্জন শোনা গেল, বাঁশির মত কন্ঠে সে ঝংকার দিয়ে উঠল ‘কক্ষনো না, আমি সানাউল্লা পীরের বংশ নির্বংশ করে তবেই যাব। এই কাজিদের পঞ্চম পূর্বপুরুষ সানাউল্লাহ পীর আমার মাকে বোতলে বন্দি করে ওই পুকুরের তলায় আটকে রেখেছে। আজ দুইশত বছর ধরে আমার মাকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। এর আগে আমি ওদের অনেক ক্ষতি করেছি, সানাউল্লাহ পীরের দুই নাতিকে হত্যা করেছি। তার বংশের সাতজন নারী আর বারজন পুরুষ হত্যা করেছি, অনেক গবাদিপশু মেরেছি সম্পদের অনেক ক্ষতি করেছি কিন্তু কেউ ধরতে পারেনি। কোন ভাবেই যখন মাকে মুক্ত করতে পারলাম না তখন আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছি সানাউল্লাহ পীরের বংশে কোন প্রাণী বাঁচিয়ে রাখবো না, ওদের ভিটে ঘুঘু চড়াবো, এই বংশ আমি নির্মূল করে দিব, আমাকে ছেড়ে দে।
আবুল বললো ‘তোকে ছাড়ার জন্যই তো আমি এসেছি চলে যা, আর কোনদিন আসবি না। - এই বংশ নির্মূল না করে আমি যাব না, তুই বাঁচতে চাইলে চলে যা। - যাবি তো কিন্তু ফাউ শাস্তি ভোগ করবি। - নিজের মরণ না চাইলে তুই চলে যা, আমাকে বেশি ঘাটালে তোর বংশে বাতি জ্বালাবার কেউ থাকবে না। - তাহলে তুই যাবি না? – না, আমার কাজ শেষ না করে যাব না, আমাকে আমার কাজ করতে দে। যদি বাধ্য করিস পরবর্তীতে এই দেশ আমি উজার করে দেব। - ও আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে তোর যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করছি, তোর নাম কি? – শিনরিন, নাম দিয়ে কাম কি? - কাম কি এখনি বুঝতে পারবি। মুহূর্তকাল নীরব, তারপরই শুরু হল বিকট চিৎকার। বাঁশির মত মিহি সূক্ষ্ম চিৎকারে মানুষের কানে তালা লেগে গেল। এ চিৎকার অন্তত এক মাইল দূর থেকে শোনা গেল। আবুল চেঁচাচ্ছে ‘যাবি যাবি? মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে ভগ্ন গলায় বলল ‘হা যাব যাব, আমার মাকে ছেড়ে দিলে আমি চলে যাব। তারপর কিছুক্ষণ ফিসফিসানির শব্দ শোনা গেল, আর কিছুক্ষণ পর আবুল বেরিয়ে এলো।
কোন কথা বলল না, কারো প্রতি ফিরেও তাকাল না মানুষের ভিড় ঠেলে সোজা বৈঠক ঘরে চলে গেল। ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে লাল কালি দিয়ে একটা কাগজে তিনটা চক আকল, আরবি সংখ্যা ও সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে চকগুলো ভরাট করল। তারপর কাগজটা নিয়ে বেরোলো, ভিড় ঠেলে পুকুরপাড়ের মাঝামাঝি গিয়ে দাঁড়ালো। একটা ইটের টুকরা কুড়িয়ে নিয়ে তার উপর মোড়কের মতো কাগজটা পেছালো, তারপর পুকুরের মধ্য বরাবর নিক্ষেপ করল। মিনিট দুই, কিছুই দেখা গেল না। তারপর পুকুরের ঠিক মাঝখান থেকে ছোট ছোট বুদবুদ উঠতে লাগলো, ফোটাগুলি ক্রমে ক্রমে বড় হতে লাগল। ভাতের পাতিলের মত বলগ উঠতে লাগলো। পুকুরের ঠিক মধ্যিখানে কয়েক হাত বলয়ের মধ্যে ফোয়ারার মত কাদাযুক্ত ঘোলা পানি উথলে উঠতে লাগল- যেন পাতাল থেকে সুরঙ্গপথে পানি ভরকে উঠছে। জল পৃষ্ঠ থেকে পানির ফোয়ারা বলখে অন্তত দুই হাত উপরে উঠে যাচ্ছে। সহসা পুকুরের মাঝখানে একটা আলোড়ন উঠলো, প্রচণ্ড চাপে মাঝখানের পানি সরে গিয়ে জলকম্পের মত পাড়ে আঁচড়ে পড়ল আর পুকুর তলাটা উন্মুক্ত হয়ে মাটি দৃশ্যমান হয়ে গেল। চকিতের জন্য দেখা গেল একটা বড় বোতল বা বৈয়াম প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো আর সাথে সাথে পানি সমতল হয়ে গেল। আর তার উপর দিয়ে জলীয়বাষ্প বা ধোঁয়া উলোর মত কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পশ্চিমের জঙ্গলে মিশে গেল। সাথে সাথে প্রচন্ড প্রভঞ্জন, জঙ্গলের বাঁশ ও গাছগাছালি দুমড়ে মুচড়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে আর সারা বাড়ির গাছগাছালিতে সেই ঝড়ের ঝাপটা লেগে যেন একটা কালবৈশাখীর তাণ্ডব চলতে লাগলো, সেই তাণ্ডবের মধ্য থেকে একটা সূক্ষ্ম হাসির রেখা ভেসে এলো। ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ কমতে লাগলো আর হাসিটা উত্তর দিকে সরতে লাগল, সরতে সরতে একসময় দিগন্তে মিলিয়ে গেল।
পুকুর পাড় এবং উঠোন ভর্তি মানুষ, এতক্ষণ তারা দম বন্ধ করে এই অবিশ্বাস্য এবং অভূতপূর্ব ঘটনা প্রত্যক্ষ করল। তারা আজ স্বচক্ষে যা দেখলো তাতে নিজেদের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কি করে সম্ভব, কুহ- কাপের দেও দানা আর রূপকথার গল্প ছাড়া মানব জনপদে এমন অদ্ভুত ঘটনাও কি ঘটতে পারে? মানুষ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। এলাকার চেয়ারম্যান মেম্বার শিক্ষিত ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা সবাই এসেছে, পুকুরপাড়ে চেয়ারে বসে আছে। তারা এতটাই মোহাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে যে কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, সম্মোহিতের মত হাঁ করে বসে আছে। আবুল কাজ শেষ করে তাদের পাশে গিয়ে বসল। তাহের কাজিও একটা চেয়ারে বসে আছে, ঘটনার আকস্মিকতায় বেচারা পাথরের মত নিষ্প্রাণ হয়ে বসে আছে। কারো সামনে দিনকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে রাত প্রমাণ করলে ওই ব্যক্তির যে অবস্থা হয় কাজিরও একই অবস্থা। সে পৃথিবীর ভালো-মন্দের প্রতি বোধ- বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তার পান্ডুর মুখটা বুকের উপর ঝুলে পড়েছে।
আবুল তার দিকে ফিরে বললো ‘চাচা মিঞা ওই ভয়ংকর জিনিস আপনার ঘরে কোত্থেকে এলো কি করে এলো আমাদের একটু শুনান। কাজি অবসন্ন দেহটা সোজা করে বসলো, গলা খাকারি দিয়ে মিনমিনিয়ে বলা শুরু করল। কিন্তু লোকের কোলাহলের মধ্যে তার কথা শুনা গেল না। ঘটনা জানার জন্য সবাই এদিকে চেপে এসেছে, এই হট্টগোলের মধ্যে কিছু শুনার উপায় নাই। তখন স্থানীয় চেয়ারম্যান উঠে দাঁড়ালো, মানুষকে ধাক্বিয়ে ধাক্বিয়ে পিছনে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল ‘আপনারা ফাকে গিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ান যাতে সবাই শুনতে পায়। লোকেরা পুকুর পাড় থেকে সরে গিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে তাদেরকে ঘিরে দাঁড়ালো। পিছনে অসংখ্য লোক, উঠান প্রায় ভর্তি সবাই হইচই করছে। চেয়ারম্যান উচ্চ স্বরে বলল ‘আপনারা চুপ করে ঘটনা শুনুন, পিছনে যারা শুনতে পাবেন না তারা অন্যদের থেকে শুনে নিবেন। তারপর কাজির দিকে ফিরে বললো ‘চাচা তুমি দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলো, যাতে সবাই শুনতে পায়।
কাজী দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয়ার মতো বলা শুরু করলো ‘আমার ছোট মেয়ে বিয়ে দিয়েছি ত্রিশালের বইলুর ফকির বাড়ি, জামাই হাই স্কুলের মাস্টার। প্রায় বছর দুই আগে কুরবানী ঈদের সময় মেয়ে- জামাইকে দাওয়াত দিতে গেলাম। মেইন রোডে গাড়ি থেকে নামলাম, সেখানে থেকে একটা মাটির রাস্তা সোজা পশ্চিম দিকে চলে গেছে। এই কাঁচা রাস্তা ধরে দেড় কিলোমিটার হাটলে গ্রাম, সেখানেই আমার জামাই বাড়ি। জায়গাটা বিশাল এক মাঠ, আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। এই ফাঁকা জায়গায় কোন রিকশা টিকসা পাওয়া যায় না। আমি মিষ্টি ও অন্যান্য সওদার ব্যাগটা হাতে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম, কারণ মাগরিবের সময় হয়ে গেছে, ইচ্ছা যে জামাই বাড়িতে গিয়ে নামাজটা পড়ব।
মাঠের ঠিক মাঝখানে রাস্তার ধারে প্রাচীন একটা হিজল গাছ এবং ছোট্ট একটা ঝোপঝাড়। সন্ধ্যা মিলিয়ে রাতের আঁধার নেমে এসেছে, চারিদিক কেমন ঘুটঘুট করছে। আমি দ্রুত হাঁটছি, গাছটার শখানেক হাত দূরে থাকতেই দেখলাম একটা বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে আমার দিকে আসছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম নাম কি, বাড়ি কোথায় মা বাপ কোথায়? কিন্তু তিন বছরের বাচ্চা কি বলবে, সে শুধু গাইগুই করে কাদলো কিছুই বলতে পারল না। আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তাড়াতাড়ি মেয়ের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে আলোর মধ্যে তাকে দেখে আমার মনটা কেঁদে উঠলো, চাঁদের মত ফুটফুটে বাচ্চা, চোখ দুটি দেখলে মায়া হয়। বছর তিনেক বয়স, কথা বলতে পারে না। আমি বললাম ‘মানুষ কত নিষ্ঠুর এমন বাচ্চাকে কেউ রাস্তায় ফেলে দেয়, নিশ্চয়ই ভাত বেগরে ফেলে গেছে, এরা কেমন মা বাপ?
আমার মেয়ে বললো ‘অনেক বড় লোকের অবৈধ সন্তান থাকে, এরাও এভাবে রাস্তায় ফেলে যায়। বাচ্চাটাকে দেখে আমার মেয়ে পাগল হলো সে রেখে দিবে, লালন পালন করবে। আমি বললাম ‘তোর এতগুলি বাচ্চাই তো ঠিকমতো সামলাতে পারিস না আবার ওকে পালবি কেমনে? তারচেয়ে বরং আমি নিয়ে যাই, বুড়া বয়সে আমার কাছে কোন নাতি-নাতনি থাকে না, এ মেয়েটাই হবে আমার শেষ বয়সের লাঠি। জামাই বাড়িতে নাই, ময়মনসিংহে তার ভাইয়ের বাসায় গেছে। এদিকে বাড়িতে আমার কাজের ঝামেলা, তাই মেয়ে জামাইকে দাওয়াত দিয়ে পরদিন এই বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে আসলাম। বুড়িও দেখে খুব খুশি হলো তার একটা অবলম্বন হলো। আমার প্রথম সন্তান ছিল মেয়ে, নাম রেখেছিলাম ঝুমুর সে ছোট বেলায় মারা যায়। আমার মরা মেয়ের স্মৃতিটা ফিরিয়ে আনলাম, বাচ্চাটার নাম রাখলাম ঝুমুর। মেয়েটার চেহারাটা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। আমরা বুড়াবুড়ি ওকে পাগলের মতো আদর করতাম, সেও আমাকে ছাড়া থাকতো না, সব সময় কোলে কোলে থাকত। রাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বুকের উপর শুয়ে ঘুমাতো, সবাই ওকে আদর করত। ওঃ কি ভয়ংকর জিনিসই না আমি বুকে জড়িয়ে ধরে দুইটা বছর পার করেছি’ বলে তার শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠলো, বেচারা টাল সামলাতে সামলাতে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল।
সর্বত্র দম বন্ধ করা নীরবতা। একজন মুরুব্বী নীরবতা ভঙ্গ করে আবুলকে বলল ‘আচ্ছা হুজুর আপনি ওই পিচ্চি জিনটাকে আটক না করে ছেড়ে দিলেন কেন? আবুল উত্তর দিলো ‘ভালোর জন্যই ছেড়ে দিয়েছি, ওকে আটকে রাখলে তার বংশধররা এসে আরো বেশি উৎপাত করত। এখন সে তার মাকে নিয়ে চলে গেছে আর বিপদের সম্ভাবনা নাই। প্রিন্সিপাল বলল ‘ওরা যদি আবার ফিরে আসে? আবুল বলল ‘না সেই সুযোগ নাই, ওরাও ফিরে আসবে না আর আসতে চাইলেও পারবে না, সেই ব্যবস্থা আমি দিয়ে যাচ্ছি। তারপর সে বৈঠক ঘরে গিয়ে চারটা তাবিজ লিখে আনল। কাজির হাতে দিয়ে বলল ‘এই তাবিজগুলি মাটির পাত্র বা এমন কোনো পাত্রে ভরবেন যা কোনদিন পচবে না নষ্ট হবে না। তারপর বাড়ির চার কোনে পাঁচ সাত হাত পরিমাণ গভীর গর্ত করে তাবিজগুলি পুতে দিবেন। ইনশাআল্লাহ আপনাদের বাড়ি চির বিপদমুক্ত।
সেই থেকে মুক্তি পেল কাজী বাড়ির মানুষ। যে সমস্যা দেশের বড় বড় পীর ফকির কবিরাজ সমাধা করতে পারল না একজন মাদ্রাসা ছাত্র আবুল তা সমাধা করল। সারা দেশে মানুষের মুখে মুখে তার নাম রটে গেল। আর সেই ঘটনা শাখা-প্রশাখা গজিয়ে মানুষের মধ্যে কিংবদন্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। শিনরিন ওরফে ঝুমুরের নাম হলো অগ্নিকন্যা।
মূল ঘটনাঃ উত্তর ময়মনসিংহের বিখ্যাত এক খান্দানি পরিবারের ঘটনা এটি। গত শতকের আশির দশকের এই ঘটনাটি আজও এলাকায় কিংবদন্তি হয়ে ছড়িয়ে আছে। অদৃশ্য এই আগুনের উৎস ছিল একটি মেয়ে বাচ্চা- যাকে অগ্নিকন্যা নামে ডাকা হয়। দেশের বিখ্যাত সব পীর-ফকির ব্যর্থ হওয়ার পর আবুল নামের একজন মাদ্রাসা ছাত্র বিষয়টা ধরতে পারে। তবে সেখানে খুনোখুনির কোন ঘটনা ঘটেনি।
বিষয়: বিবিধ
১৯২০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন