হাসান ফেরদৌসি - ১৬
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৫ অক্টোবর, ২০১৭, ০৬:১২:২১ সন্ধ্যা
২২ (শেষ কিস্তি)
‘চাল নাই চুলা নাই একটা ফকির, রাস্তার ছেলে, বাড়ির কামলা ফকির বাড়ির মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে- এটা ফকির বংশের কলঙ্ক। লোকে তোমাদের মুখে থু থু দিবে, তোমরা মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। একটা ছন্নছাড়া রাস্তার ছেলে তোমাদের মেয়েকে নিয়ে গেছে, তোমাদের মান ইজ্জত ধুলিস্মাত করে দিয়েছে আর তোমরা এখনো বসে আছ। যাও তাড়াতাড়ি ওদেরকে ধরে নিয়ে আস’ এভাবে মাজেদা ও নূরানী ফকির বাড়ির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঘোরে ঘোরে উন্মাদনা সৃষ্টি করছে আর সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছে। হাসান ফেরদৌসিকে ধরে আনার জন্য জোয়ান বুড়া পোলা সবাইকে ঘর থেকে টেনে বের করে পাঠাচ্ছে। মহিউদ্দি উরফে মইখ্যা আগেই গ্যাংদের নিয়ে মোটর সাইকেল মহড়া দিয়ে বেরিয়ে গেছে, এখন অবশিষ্টরাও আস্তে আস্তে যাচ্ছে। এটা একটা হুজোগ।
আগে থেকে সবাই জানত হাসান ফেরদৌসি মানিক জোড়, পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ি তাদের বিয়ে হবে, এতে কারো কোন ওযর আপত্তি ছিল না। কিন্তু মহিউদ্দি, পটেটো, মাজেদা ও নূরানী অপপ্রচার করে একটা বিপরিত আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তারা ফকির বাড়িতে এই আত্মশ্লাঘা উসকে দিল যে, বাড়ির কামলা ফকির বাড়ির মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে, তাদের মুখে চুনকালি দিয়েছে। তখন তারা সবাই হুজুগে মাতল। সেখানে তিন শ্রেণীর মানুষ রওয়ানা হল। সব চেয়ে তৎপর শ্রেণীটি হল গ্যাং সদস্য- যারা চাচ্ছিল মহিউদ্দির সাথে ফেরদৌসির বিয়ে হউক। দ্বিতীয় শ্রেণীটি হল যারা চাচ্ছিল হাসান ফেরদৌসির বিয়ে হউক কিন্তু কি ঘটে তা দেখার কৌতূহল নিয়ে তারা গেল। তৃতীয় দলটি ছিল নিরপেক্ষ, তারা শুধু নীরব দর্শক হিসাবে গেল। এভাবেই এলাকার জোয়ান বুড়া পোলা সবাই এগিয়ে গেল।
ফাকা রাস্তা, এ পথে মানুষ খুব একটা আনাগুনা করে না। রাস্তাটা সমতল থেকে অনেক উচু, বন্যার সময় যাতে তলিয়ে না যায় এবং মানুষ এতে আশ্রয় নিতে পারে- এজন্য সড়কটা এত উচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। এটা যমুনায় গিয়ে মিশেছে, আর যমুনার কিনারে রাস্তাটা এমনই উচু যে এর উপরে দাঁড়ালে মনে হয় হিমালয়ের চূড়া, নীচে নদী বক্ষ যেন ঠিকমত গোচরিভুত হয়না। হাসান ফেরদৌসি যমুনার তীরে পৌঁছে গেছে, মাত্র দেড় দুইশ হাত বাকী আছে। ফেরদৌসি হাসানকে বলল, ‘শুন একটা নৌকা রিজার্ভ নিয়ে আমরা একদম জুয়েল মামাদের বাড়ির কাছে চলে যাব, কিন্তু নৌকা না পেলে কি গতি হবে? হাসান বলল, পাওয়া তো যাবেই হয়ত একটু দেরি হতে পারে। - এতক্ষণ আমরা কোথায় থাকব--- ঠিক তখনি কিসের শব্দে ফেরদৌসি পিছন ফিরে তাকাল। আর সাথে সাথে সে হাসানকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠল ‘সর্বনাশ ওরা আমাদের ধরতে এসে গেছে। হাসান পিছন ফিরে দেখল পঁচিশ ত্রিশটা মোটর সাইকেল মেঘ গর্জনের শব্দ তুলে যেন উড়ে আসছে। একেক গাড়িতে দু’তিন জন করে বসা। হাসান বলল ‘এখন উপায়? ফেরদৌসি তার হাত ধরে টেনে রাস্তা থেকে নামতে নামতে কেঁদে উঠে বলল, ‘চল ঐ জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে থাকি। রাস্তার শ’খানেক হাত উত্তরে ছোট একটা জঙ্গল, তারা সেখানে গিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করল।
অনুসন্ধানকারী দল লক্ষ্য করেছে হাসান ফেরদৌসি জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়েছে। তারা দৌড়ে গিয়ে ছোট্ট জঙ্গলটা ঘিরে দাঁড়াল। মহিউদ্দি ও পটেটো ভিতরে ঢুকে খুঁজাখুঁজি শুরু করল। সহসা মহিউদ্দির মুখে বক্র হাঁসি ফুটে উঠল, সে পিছিয়ে গিয়ে সুঠাম স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী তিনজন গ্যাং ডেকে এনে অঙ্গুলি নির্দেশে একটা ঝোপ দেখিয়ে নিরাপদ দুরত্বে সরে গেল। হাসান যখন দেখল মইখ্যা তাদের অবস্থান দেখে ফেলেছে তখনি সে উঠে দাঁড়াল। কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে, সে বুঝতে পারল সম্ভবত আজই তার জীবনের শেষ দিন। সে ফেরদৌসিকে বুকে চেপে ধরল, মুখে ও মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। অনিরুদ্ধ কান্নার ঢেউ আটকাতে গিয়ে তার শরীরটা কাঁপছে, টপটপ করে ফেরদৌসির পিঠে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
হাসানের শক্তি ও বীরত্ব সম্পর্কে গ্যাংদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তারা তিনজন হাসতে হাসতে অবলীলায় এগিয়ে এল। একজন তার ঘাড়ে ঘুষি মেরে বলল, হারামজাদা শুয়োর, মনে করছিস ফকির বাড়ির মেয়ে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বেঁচে যাবি, চল তোকে আজ শূলে চড়াব। দ্বিতীয় জন ‘এর সাহস দেখেছ, এখনো ফেরদৌসিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে’ বলে পেছন থেকে অনবরত ঘুষি মারতে লাগল। তৃতীয় জন ফেরদৌসির হাত ধরে ‘আয় বেশ্যা মাগী, তুই নাগরের সাথে পালিয়ে এসে বংশের মুখে চুনকালি দিয়েছিস, মহিউদ্দির সাথে গাদ্দারি করেছিস, আজই ওর সাথে তোর বিয়ে হবে’ বলে টানতে লাগল। কিন্তু সাথে সাথে তিনজনই ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ল, তারা অনুভব করল যেন তাদের মুখের উপর হাতুড়ির মত কিছু একটা আঘাত করেছে।
হাসান তিনটি মুষ্ঠি মেরে ফেরদৌসির হাত ধরে জঙ্গলের পশ্চিম পার্শ্বে বেরিয়ে এসে চিৎকার করল ‘ফেরদৌসি আমার বিবাহিত স্ত্রী, স্ত্রীকে নিয়ে আমাকে যেতে দাও, অন্যথায় যমুনার তীর ফুরাতের তীরে (কারবালা) পরিণত হবে। ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন যুবক জঙ্গল ঘিরে রেখেছিল। মহিউদ্দি ও পটেটো তাদেরকে ডেকে এনে এক্ত্র করে হুকুম দিল ‘ঐ হারামজাদার হাত পা ভেঙ্গে ফেরদৌসিকে ছিনিয়ে আন। তারা হল এই বাহিনীর সেনাপতি- এমন সেনাপতি যে হুকুম দিয়ে নিজেরা নিরাপদ দুরত্বে সরে গেল। কারণ তারা জানে হাসানের সামনে পড়লে এবার আর জীবন নিয়ে ঘরে ফিরা সম্ভব হবে না। ত্রিশ চল্লিশ জনের দলটা একসাথে হাসানের উপর হামলে পড়ল। এইবার শুরু হল তার প্রকৃত লড়াই, বীরের বীরত্ব প্রকাশের উপযুক্ত মওকা। হাসান চক্রাকারে ঘুরছে, তার হাত পা সমান তালে চলছে, হাতুড়ির মত শত্রুর নাকে মুখে বুকে মাথায় আঘাত হানছে। গ্যাংরা সম্মিলিতভাবে তাকে ঝাপটে ধরছে আর মুহুর্মুহু আঘাতে ছিটকে পড়ছে। তার হাত পা চরকার মত ঘুরছে, রকেটের পাখার মত এত দ্রুত ঘুরছে যে দেখা যায় না- একটা আবছায়া মনে হয়। কয়েকবার সম্মিলিত আক্রমণ করে গ্যাংরা পিছিয়ে গেল।
মহিউদ্দি ও পটেটো তাদেরকে সংগঠিত করে আবার পাঠাল। তারা এসে হাসানের চারপাশে বৃত্তাকারে ব্যুহ রচনা করে দাঁড়াল। হাসান বৃত্তের মধ্যে লাঠিমের মত ঘুরে ঘুরে তাদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে, যেদিকেই যায় ব্যুহ ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। সবাই পিছিয়ে যেতে লাগল। তখন মহিউদ্দিন ও পটেটো পিছন থেকে চিৎকার শুরু করল ‘তোমরা এতগুলি মানুষ এই একটা ছেলের সাথে পার না, তোমাদের তো যমুনায় ডুবে মরা উচিত, যাও সবাই মিলে ওকে ঝাপটে ধরে ফেল’ বলে মহিউদ্দি এগিয়ে এল। তার সাথে দশ পনের জন একসাথে হাসানকে ঝাপটে ধরল। সে শরীরটা মোচড় দিয়ে কয়েকটা ঝাড়া মারল আর গ্যাংরা ছিটকে পড়ল। তারপর সে লাঠিমের মত ঘুরতে লাগল আর শত্রুর নাক মুখ ফাটাতে লাগল। হঠাৎ মহিউদ্দি একেবারে সিংহের মুখে এসে গেল, হাসান এক হাতে তার গর্দান ও অন্য হাতে হাঁটু ধরে মাথার উপর তুলে একটা আছাড় মারল, সে বিকট আর্তনাদ করে উঠল। তারপর তার গোড়ালি ধরে চারপাশে শুন্যে ঘুরাতে লাগল, তার দেহের আঘাতে গ্যাংরা ছিটকে পড়তে লাগল আর মহিউদ্দির নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসল। সহসা হাসান তাকে ছেড়ে দিল আর সে উড়ে গিয়ে দশ পনের হাত দূরে মুখ থুবড়ে পড়ে ক্যাত করে উঠল। সে আধা বেহুশ, পটেটো দৌড়ে এসে তাকে গাছতলার দিকে নিয়ে গেল। তারপর হাসান যেদিকেই যায় গ্যাংরা পালিয়ে যেতে থাকে। মেষের পালে সিংহের আক্রমণের ন্যায় পালাতে থাকে। অবশেষে গ্যাংরাও দৌড়ে গিয়ে গাছতলায় আশ্রয় নিল।
যমুনা থেকে প্রায় আধা কিমি দূরে রাস্তার উপর প্রাচীন একটা বটবৃক্ষ। মাথার উপর সুর্য জ্বলছে, রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য সবাই গাছতলায় আশ্রয় নিয়েছে। ফকির বাড়ির লোকজন এসেছে, আশপাশ গ্রামের লোকেরাও এখানে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। গ্যাংদের অবস্থা দেখে ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য জামাইরা তিরস্কার করতে লাগল ‘এই একটা ছেলের সাথে তোমরা এতগুলি মানুষ পারলে না, পালিয়ে এসেছ। তোমরা পুরুষ নামের কলঙ্ক, যাও বাড়িতে গিয়ে চুড়ি পরে ঘোমটা টেনে বসে থাক গিয়ে। গ্যাংরা বলল, ওতো মানুষ না, আসুরিক শক্তির অধিকারী কোন সিংহ। মহিউদ্দির এত তেজ, দেখেন তার কি অবস্থাটা করেছে’ বলে সবাই হাসতে লাগল। মহিউদ্দি লজ্বা পেয়ে বলল, শুন ওর সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জানি। খালী হাতে ওর সাথে পেরে উঠা সম্ভব না। সবাই লাঠি নিয়ে চল। পটেটো চিৎকার করল, ‘এটা আমাদের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা ছেলের সাথে আমরা এতগুলি মানুষ পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে এখানে মরে যাওয়া ভাল। চল সবাই, আশপাশের বাড়ি থেকে লাঠি সংগ্রহ কর এবং দা কুড়াল এনে জঙ্গল থেকে বাঁশ কেটে আন। তারপর তারা লাঠি সংগ্রহে ব্যস্ত হল।
ময়দান খালী হয়ে গেছে। হেক্টর বধকারী অ্যাকিলিসের ন্যায় হাসান কোমরে হাত দিয়ে বীরদর্পে পলায়নপর গ্যাংদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফেরদৌসি এতক্ষণ কিছুটা দুরত্বে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তার যুদ্ধ দেখছিল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, হাসানের কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ‘দেশে এমন সাহসি শক্তিশালী কে আছে, অথচ কেউ দাম দিল না মূল্যায়ন করল না’ বলে কাঁদতে লাগল। তারপর গভীর মমতায় ওড়না দিয়ে হাসানের ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে দিল। হাসান বলল, চল আমরা যমুনা পার হয়ে জুয়েল মামার কাছে চলে যাব। তারা পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করল। রাস্তার একশ হাত উত্তরে ছোট্ট জঙ্গল, আর জঙ্গল থেকে যমুনার দূরত্ব দুইশ হাত, এই জায়গাটুকু সিকতাময় চাটান। তারা এর মাঝ বরাবর পৌছতেই গ্যাংরা লাঠি হাতে দৌড়ে এসে তাদেরকে ঘিরে দাঁড়াল। মহিউদ্দি জানে শক্তি প্রয়োগ করে বা যুদ্ধ করে হাসানের কাছ থেকে ফেরদৌসিকে নেয়া যাবে না, তার তো কামনা শুধু ফেরদৌসি। তাই সে নিরাপদ দুরত্বে থেকে চিৎকার করল ‘হাসান তোকে আমাদের কোন দরকার নেই। ফেরদৌসিকে দিয়ে তুই যেখানে খুশি চলে যা আমরা বাঁধা দিব না।
হাসান গম্ভীর সুরে বলল, ফেরদৌসি আমার বিবাহিত স্ত্রী, তিন রাত আগে তার মা আমাদের বিয়ে দিয়েছেন। কাজেই জীবন থাকতে আমি তো আর নিজের স্ত্রীকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারি না। তার চেয়েও বড় কথা ফেরদৌসি আমার জীবন, কাজেই আমার দেহে প্রাণ থাকতে আমার জীবন কেড়ে নিতে পারবি না। তবে ফেরদৌসি যদি স্বেচ্ছায় যেতে চায় আমি কোন বাঁধা দিব না’ বলে ফেরদৌসিকে একটু ধাক্বা দিয়ে এগিয়ে দিল। কিন্তু সে ‘না আমি আমার স্বামিকে ছেড়ে কোথাও যাব না, ঐ কুকুরের সাথে যাওয়ার চেয়ে যমুনায় ডুবে মরব’ বলে সে ডুকরে কেঁদে উঠল। মহিউদ্দি চিৎকার করল ‘তাহলে তোরা দুইটাই যমুনার তীরে মর। এই সবাই আক্রমণ কর, ওদেরকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দে। সাথে সাথে গ্যাংরা হুঙ্কার ছেড়ে আক্রমণ করতে ছুটে এল।
শুরু হল দ্বিতীয় স্তরের যুদ্ধ। হাসান ফেরদৌসিকে ধাক্বা মেরে পিছনে সরিয়ে দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। একসাথে ত্রিশ চল্লিশটা লাঠি তার দিকে ধেয়ে আসছে। একটাকে সে টার্গেট নিল, মাথার উপরে ও পার্শ্বে হাত ঠেকিয়ে দুইটা বাড়ি প্রতিহত করে তৃতীয় লাঠিটা ধরেই টান মেরে হাতে নিল, তারপর এলোপাতারি আক্রমণ শুরু করল। গ্রামাঞ্চলে ছেলেদের শুকর পেটানোর মত পিটাতে লাগল, কুত্তা পিটা করতে লাগল। আর কুকুরগুলি তার সামনে থেকে ভেড়ার পালের মত ছিটিয়ে পালাতে লাগল, কেউ মাটিতে পড়ে যায় আর হাসান সাপের মত পিটায়। সে গ্যাংদের তাড়িয়ে ফিরছে, তারা পালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বৃক্ষতলা থেকে তাদেরকে বারবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
মহিউদ্দি সবাইকে ডেকে এক্ত্র করে বলল, এখন তোমরা ওকে চারদিক থেকে ঘিরে একত্রে আক্রমণ করবে। তারপর শাহিনসহ চারজন শক্তিশালী যুবককে ডেকে এনে বলল, ওরা যখন হাসানকে ঘিরে আক্রমণ করবে তখন তোমরা ফেরদৌসিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে। তারপর মোটর সাইকেলে করে একটানে শাহিনদের বাড়িতে চলে যাবে। এতক্ষণ আমি অন্যদের নিয়ে হাসানকে এখানে আটকে রাখব। সুযোগ পেলেই আমিও তোমাদের সাথে এসে মিলিত হব এবং আজই ফেরদৌসির সাথে আমার বিয়ে হবে, ও আমার বউ, একমাত্র আমার বউ। ততক্ষণে হাসানের চারপাশে গ্যাংরা চক্রাকারে দাঁড়িয়ে চেপে আসতে লাগল। সে হাতের লাঠিটা চারপাশে সিলিংফ্যানের মত বা চরকার মত ঘুরাতে ঘুরাতে আগ্রসর হল, বাতাসে শো শো শব্দ উঠল আর কুকুরগুলি লাঠির আঘাতে ছিটকে পড়তে লাগল।
হঠাৎ তার কানে ফেরদৌসির চিৎকার ভেসে এল, সে চকিতে তাকিয়ে দেখল চারটা কুকুর ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হাসান লাঠি ঘুরিয়ে এক পাশের ব্যুহ ভেদ করে চোখের পলকে সেখানে পৌঁছে গেল। কয়েক বাড়ি খেয়েই দুইটা কুকুর পালিয়ে গেল, শাহিন ও আরেকটা কুকুর মাটিতে পরে গেল আর সে সাপের মত পিটাতে লাগল। ফেরদৌসি তার হাত ধরে বলল, আর মারিস না মরে যাবে, মরে গেলে বিপদ হবে। ততক্ষণে পিছন থেকে একদল এসে তাকে আক্রমণ করল। সে পাল্টা আক্রমণ করল আর কুকুরগুলি পালাতে লাগল। সে যেদিকেই যায় কুকুরের পাল পালাতে থাকে। কোন সিংহ যেভাবে ছাগলের পাল তাড়িয়ে ফিরে সেভাবেই সে গ্যাংদের তাড়িয়ে নিচ্ছে আর সিংহের গর্জন তুলছে, ‘শৃগাল শকুনের দল, আমি তো তোদের কোন অন্যায় করিনি। তোদের অধিকারে হাত দেইনি, তবে কেন তোরা আমাদের পিছু নিয়েছিস? আমরা একে অন্যকে ভালবাসি, আমরা বিবাহিত স্বামী স্ত্রী, আমাদের বাঁচতে দে--- তার গর্জনে যমুনার তীর শনৈ শনৈ কাঁপতে থাকে। অন্তত পঞ্চাশজন গ্যাং পালাক্রমে হাসানের মুখোমুখি হচ্ছে আর কুত্তার মত পিটুনি খেয়ে অবস হয়ে ময়দান ত্যাগ করে যাচ্ছে। সবাই আহত হয়ে ধীরে ধীরে গিয়ে বৃক্ষতলে জমা হল।
ততক্ষণে বৃক্ষতলায় কয়েকশ মানুষ জড় হয়ে গেছে। ফকির বাড়ির বৃদ্ধ ও মহিলারাও এসে গেছে, আশপাশ গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সেখানে এসে ভিড় জমিয়েছে। স্থানীয় গ্রামের লোকেরা কৌতূহলী হয়ে ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করছে। তখন ইঞ্জিনিয়ার, পটেটো ও অন্যান্য জামাইরা উত্তর দিচ্ছে ‘এই ছেলেটা মেয়েদের বাড়িতে বছুরে কাজ করত, এই সুবাদে মেয়েটাকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। লোকেরা যখন হাসানের বীরত্ব দেখে হর্ষধ্বনি তুলে তার প্রশংশা করে, তখন তারা বলে, এই ছেলের পূর্ব পুরুষরা ডাকাত ছিল, সে নিজেও নাকি মাঝে মধ্যে ডাকাতি করত, এজন্যই এত সাহসি। পুরুষের মত দুঃসাহসি ও জেদি মাজেদা এবং নূরানীও এসেছে। তারা গ্রামের মহিলাদের বুঝাতে লাগল, এই কামলা ছেলেটা আমাদের বোনকে যাদু করে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। নইলে এমন সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে কি কামলা ছেলের সাথে পালিয়ে আসে?
গ্যাংরা সবাই পালিয়ে আসছে দেখে মাজেদা ও নূরানী এগিয়ে এসে তিরস্কার শুরু করল, ‘ফকির বাড়ির মায়েরা সব ইঁদুর জন্ম দিয়েছে, একটা সিংহের তাড়া খেয়ে সবগুলি শৃগালের মত লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে। আরে শৃগালের দল এমন মাইগ্যা মার্কা মুখ দেখানোর চেয়ে যমুনায় গিয়ে ডুবে মর। একটা ছেলের সামনে থেকে তোরা চল্লিশ পঞ্চাশটা তাগড়া জোয়ান পালিয়ে এসেছিস, দেশে গিয়ে মুখ দেখাবি কেমনে? নূরানী হাতের চুড়ি খুলে বলল ‘নে এই চুড়ি পরে ঘরে গিয়ে বসে থাক, বাইরে তো মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবি না। এভাবে তারা গ্যাংদের শ্লাঘায় খোচা দিতে লাগল। মহিউদ্দি এসে বলল, ‘শুন এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো না, তোমরা এত সাহসি এত বাহাদুরি গপ্প মারতেছ তো দাঁড়িয়ে আছ কেন, যাও ওর সামনে দাঁড়াও গিয়ে। নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গপ্প মারা সহজ কিন্ত বাস্তবতা কঠিন। এটা সবাই জানে তোমরাও জান যে, হাসান সিংহের মত শক্তিশালী, সে প্রকৃত বীর এবং দুঃশাহসী। তাকে এত সহজে ঘায়েল করা চাট্টিখানি কথা নয়।
তারপর সে গ্যাংদের উদ্দেশ্যে বলল, দেখ ভাইয়েরা এখন বিষয়টা আমাদের জীবন মরণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। একটি ছেলের সামনে আমরা এতগুলি মানুষ পালিয়ে গিয়ে মানুষকে মুখ দেখাতে পারব না, এমন লাঞ্চিত জীবনের চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। কাজেই হয় ওকে যমুনার তীরে দাফন করে ফেরদৌসিকে নিয়ে যাব নয়তো আমরাই দাফন হয়ে যাব। এভাবে সে নরম গরম একটা বক্তব্য প্রদান করল। তাতে গ্যাংদের শ্লাঘায় বাঁধল, তারা আরো জেদি হয়ে উঠল। মহিউদ্দিন ও পটেটো আগেই কয়েকজনকে নিয়ে গিয়ে প্রচুর লম্বা লম্বা বাঁশ কেটে এনেছে। তখন পটেটো বলল, আসলে যুদ্ধে কৌশল অবলম্বন করতে হয়, এতক্ষণ আমরা বোকামির কারণে মার খেয়েছি। কিন্তু এখন কৌশলে কাজ করতে হবে। এই যে বাঁশ কেটে এনেছি, প্রত্যেক বাশের মাথা চোখা। দূর থেকে চোখা বাঁশ দিয়ে গুতিয়ে ওর শরীরটা চালনির মত ফুটো করে ফেলতে হবে। কুচ দিয়ে মাছ গেথে ফেলার ন্যায় ওকে বাশের ডগায় গেথে ফেলতে হবে। তারপর তারা সবাই একটা একটা করে লম্বা বাঁশ নিয়ে রওয়ানা হল।
হাসান লাঠি হাতে বিষণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, লাঠির আঘাতে রক্ত জমে শরীরের বিভিন্ন জায়গা কাল হয়ে গেছে। মাথার পিছনে ফেটে গিয়ে রক্ত ঝড়ছে। ফেরদৌসি জারজার হয়ে কাঁদছে, রক্ত মুচছে আর মহিউদ্দি ও পটেটোকে অভিসম্পাত করছে। আর তখনি তারা এসে হাসানকে চক্রাকারে ঘিরে দাঁড়াল। মহিউদ্দিন দূর থেকে চিৎকার করল, ‘হাসান ফেরদৌসিকে দিয়ে তুই চলে যা, তোকে আমাদের কোন দরকার নেই। হাসান ফেরদৌসির মুখের দিকে তাকিয়ে করুন কণ্ঠে বলল, যাবি? সে নিঃস্বের মত কেঁদে উঠল, তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না, মরলে দুজন একসাথেই মরব। তখন হাসান চিৎকার করল, ফেরদৌসি আমার বিবাহিত স্ত্রী। তোমরা ভাল করেই জান তার বাবা এই বিয়ের অসিয়্যত করে গেছেন, তিন রাত আগে তার মা আমাদের বিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আমার স্ত্রীকে নিতে চাইলে আমার রক্তে স্লান করিয়ে আমার লাশের উপর দিয়ে টেনে নিতে হবে। মহিউদ্দি চিৎকার করল, এই সবাই আক্রমণ কর।
শুরু হল যুদ্ধের তৃতীয় স্তর। হাসান ফেরদৌসিকে ধাক্বা দিয়ে বলল, তুই এক পাশে সরে দাঁড়া। তখনি কাপুরুষগুলি নিরাপদ দুরত্বে থেকে বিশ পঁচিশ হাত লম্বা বাঁশ দিয়ে হাসানের গায়ে গুতা মারতে লাগল। অসংখ্য চোখাবাঁশ তার কাপড় ভেদ করে শরীরে গিথে যাচ্ছে আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এই অভিনব কৌশল মোকাবেলা করা তার জন্য কঠিন হয়ে গেল। সে চারপাশে লাঠি ঘুরিয়ে নিজের মুখ ও মাথা নিরাপদ রাখার চেষ্টা করছে। কোন কোন বাশে বাড়ি মেরে সরিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু অসংখ্য বাশের গুতোয় তার শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে, এই কৌশল প্রতিরোধের উপায় সে খুঁজে পেল না। হাসানের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে মহিউদ্দি আস্তে আস্তে ফেরদৌসির কাছে এসে খপ করে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। হঠাৎ তার কানে ফেরদৌসির চিৎকার ভেসে এল, সে এক পলক তাকিয়ে লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে সেদিকে এগিয়ে গেল, মহিউদ্দি এক নজর দেখেই হাত ছেড়ে দৌড়ে পালাল।
তখন হাসান ব্যুহের একপাশে এসে গেছে, শত্রুরা লম্বা বাঁশ তার দিকে সহজে ঘুরাতে পারল না। এই সুযোগে সে আক্রমণ করল। গ্যাংদের শুকরের মত পিটাতে লাগল, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। হাসান ময়দানে ঘোরে ঘোরে মরিয়া হয়ে সর্বশেষ আক্রমণ করল। শত্রুদের কুত্তা পেটা করতে লাগল, শুকরের মত পিটিয়ে পিটিয়ে ময়দান ত্যাগে বাধ্য করল। শত্রুরা সবাই বাঁশ ফেলে নিরাপদ দুরত্বে সরে গেছে। তারা সকলেই আহত, কারো মাথা ফেটে বা নাক ভেঙ্গে বা দাঁত ভেঙ্গে রক্ত ঝড়ছে, কারো হাত ভাঙ্গা, কারো পা ভাঙ্গা, সবাই রক্তাক্ত।
হাসান ময়দানের মাঝখানে দাঁড়াল। ততক্ষণে সিংহের তেজ কমে এসেছে, সাড়া শরীরে রক্ত বেয়ে যাচ্ছে, সে দুর্বল হয়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে ফেরদৌসি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, গ্যাংদের প্রতি তাকিয়ে আর্তনাদ করল, তোমরা কেন তাকে মারতে চাও, কি তার অপরাধ? সে আমার স্বামী, আমার আব্বা এই বিয়ের অসিয়্যত করে গেছেন, তিন রাত আগে মা আমাদের বিয়ে দিয়েছেন। আমরা স্বামী স্ত্রী, আমরা একে অন্যকে ভালবাসি, এটাই কি আমাদের অপরাধ? স্বামী স্ত্রী হওয়া যদি অপরাধ হয় তাহলে দুনিয়ার স্বামী স্ত্রীদের বিচার কর। ভালবাসা যদি অপরাধ হয় তাহলে ইউসুফ জুলেখা, লাইলি মজনু, শিরি ফরহাদের বিচার কর। আর যদি অপরাধ না হয় তাহলে তোমরা মহিউদ্দি, পটেটো, ইঞ্জিনিয়ার ও মাজেদাদের বিচার কর। কারণ তারা স্ত্রীকে স্বামীর বুক থেকে কেড়ে নিতে চায়। অপরাধিদের বিচার কর আমাদেরকে ছেড়ে দাও, আমরা তো তোমাদের কোন অন্যায় করিনি। ওকে বাঁচতে দাও, আমি আমার স্বামীর জীবন ভিক্ষা চাই, ভিক্ষা দে--- সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে দু’হাত প্রসারিত করে আর্তনাদ করে, কপাল চাপড়ায়, মাটিতে হাত মারে আর বিলাপ করে। এক অসহায় বালিকার বিলাপ যমুনার তীরে প্রতিধ্বনি তুলে কিন্তু গ্যাংদের পাষাণ হৃদয়ে কোন ভাবান্তর হয় না।
পটেটো ভাবল হাসান দুর্বল হয়ে গেছে এখন হয়ত ফেরদৌসিকে দিয়ে দিতে পারে, আর কাছে গেলেও হয়ত আক্রমণ করবে না। এই ভরসায় সে আস্তে আস্তে নিকটে গিয়ে বলল, হাসান আমরা তোমার কোন ক্ষতি করতে চাই না, ফেরদৌসিকে দিয়ে তুমি যেখানে খুশি চলে যাও আমাদের কোন আপত্তি নাই। তুমি বীর, তোমার বেঁচে থাকার দরকার আছে’ বলে সে গিয়ে ফেরদৌসির হাত ধরল। সাথে সাথে হাসান ছিটিয়ে উঠে তার বুকের জামায় থাবা মেরে ধরে শুন্যে একপাক ঘুরিয়ে এনে মাটিতে আচাড় মারল। তারপর বুকে পাড়া দিয়ে ধরে হাতের লাঠিটা উত্তোলন করে চিৎকার করল ‘কুত্তার বাচ্চা, কোন অধিকার বলে স্ত্রীকে স্বামীর বুক থেকে কেড়ে নিতে এসেছিস’ বলেই লাঠিটা তার পেটে ঢুকিয়ে একদম মাটীর সাথে গেথে দেয়ার জন্য লাঠি নিম্নগামী করল, আর সাথ সাথে ফেরদৌসি তার হাত ধরে ফেলে আর্তনাদ করে উঠল ‘ওকে মারিস না’ একই সাথে পটেটো তার পায়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘তুমি আমার ধর্মের বাপ, আমাকে মেরো না, তাহলে নূরানী বিধবা হয়ে যাবে। হাসান থামল, একটা লাথি মেরে বলল, ‘যাঃ শৃগাল, নূরানীর জন্য তোর জীবনটা ভিক্ষা দিলাম। পটেটো ধরফর করে উঠে শৃগালের মত গুটিশুটি মেরে এক দৌড়ে গাছতলায় নূরানীর কাছে চলে গেল।
এদিকে মহিউদ্দিন সবাইকে সংগঠিত করছে আর চিৎকার করছে, তোমরা সবাই ওকে ঘিরে ফেল, সে এখন দুর্বল হয়ে গেছে আর বেশিক্ষন টিকবে না। তখন সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল কিন্তু তারা আক্রমণের আগেই হাসান ব্যুহের এক পার্শ্বে সরে গিয়ে সারাসি আক্রমণ করল। সবাই সিংহের তাড়া খেয়ে ছাগলের মত পালাতে লাগল। হাসান শৃগালগুলিকে তাড়িয়ে নিচ্ছে আর চিৎকার করছে, শুয়োরের বাচ্চারা, আমরা তো তোদের কোন অন্যায় করিনি। আমরা তো শুধু নিজেদের অধিকারটুকু ছেয়েছি, আমাদের অধিকার নিয়ে আমাদের মত করে আমাদের বাঁচতে দে। আমাদের যেতে দে, আমরা তোদের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যাব, কোনদিন তোদের সামনে আসব না’ সে হাকিয়ে নিচ্ছে আর চিৎকার করছে। তার চিৎকারে গ্যাংদের হৃদয়ে কাঁপন ধরে যায়।
গাছতলায় কয়েকশ মানুষ দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। তারা রুদ্ধশ্বাসে এই অসম যুদ্ধ দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠছে আর বারবার হর্ষধ্বনি করছে ‘এ বীর, এ আলেকজান্ডার, এমন বীরত্ব আমরা কোথাও দেখিনি। একটি ছেলে চল্লিশ পঞ্চাশটা যুবককে মারতে মারতে নাকের ডগায় দম নিয়ে এসেছে এমন কোথাও শুনিনি। এ আসুরিক শক্তির অধিকারী, এ দেশের সম্পদ জাতির সম্পদ, ওকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। আপনারা এই যুদ্ধ থামান, নইলে আমরা এই ছেলের পক্ষ হয়ে মাঠে নামব- জনগণ ক্ষেপে গেছে। ততক্ষণে ইঞ্জিনিয়ারের অবস্থাও পাল্টে গেছে, সে বিস্ফারিত চোখে হাসানের দিকে তাকিয়ে আছে, সিংহের মত তার আক্রমণ দেখছে আর উত্তেজিত হয়ে উঠছে। সহসা সে চিৎকার করল ‘হাসান প্রকৃতই সিংহ, সে সত্যিকারের বীর। তার পূর্ব পুরুষরা বীর ছিল, যুদ্ধা ছিল। আর পূর্ব পুরুষের রক্তই তাকে অপ্রতিদ্ধন্ধি বীর আর যোদ্ধায় পরিণত করেছে। সে আমাদের দেশের সম্পদ, জাতির সম্পদ। আর এমন একটা সম্পদ আমরা নষ্ট করতে পারি না, আমাদের এই অধিকার নেই, এই সম্পদ রক্ষা করা সকলের কর্তব্য। পটেটো যান, এই যুদ্ধ থামান, হাসান ফেরদৌসিকে নিয়ে আসেন, আমি আজই ওদের বিয়ে দিব। কিন্তু পটেটো স্ত্রীর পায়ের কাছে বসে বসে তখনো কাঁপছে, সে কাপা কণ্ঠে বলল, আমি আর ওখানে যেতে পারব না। ইঞ্জিনিয়ার মুচকি হেসে তৃতীয় জামাইকে বলল, ফজলু আপনি যান, ওদেরকে নিয়ে আসেন, আমি আজই মহাধুমধামে ওদের বিয়ে দিব। ফজলু চিৎকার করল, এই তোমরা মারামারি থামাও। কিন্তু তার কণ্ঠ ধুন্দুমারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। ইঞ্জিনিয়ার ধমক দিল ‘আরে আপনি তো একটা পাগল, এতদূর থেকে শুনতে পাবে নাকি, কাছে যান। সে ধীর পদক্ষেপে কুরুক্ষেত্রের দিকে রওয়ানা হল।
পরামর্শ অনুযায়ি মহিউদ্দিরা চারটা বাশের আংটা বা ফাঁদ বানিয়ে আনল। অর্থাৎ দ্বিভুজ কোণ ডাল কেটে বাশের মাথায় বেঁধে আংটা বানানো হয়েছে। গ্যাংরা রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসে বিক্ষিপ্ত ঘোরাফিরা করছে। মহিউদ্দি সবাইকে ডেকে এক্ত্র করে বলল, এটাই আমাদের শেষ আক্রমণ, সিংহ দুর্বল হয়ে গেছে এবার পড়ে যাবে। তোমরা ওকে বৃত্তাকারে ঘিরে বাঁশ দিয়ে গুতাতে থাকবে, কেউ কেউ মাথায় বাড়ি মারতে থাকবে। তখন শাহিন ও হুমায়ুনরা চারজন ওর পায়ে বাশের আংটা লাগিয়ে টান মেরে মাটিতে ফেলে দিবে। একেক পায়ে দুইটা করে আংটা লাগাবে। আর পরে যাওয়ার সাথে সাথে সবাই তার উপর বাঁশ দিয়ে চেপে ধরবে। সিংহ যেভাবে জালে আটকায় সেভাবে তার উপর বাশের জাল তৈরি করে দিবে। তারপর সবাই বাঁশ পারা দিয়ে বা চেপে ধরবে আর সাথে সাথে কয়েকজন গিয়ে তাকে বেঁধে ফেলবে। এই সিংহকে না বাঁধা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না, সে মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে। এখন যাও ওকে ঘিরে ফেল।
মধ্যাহ্ন সূর্য অগ্নি বর্ষণ করছে। হযরত হুসাইন যেভাবে কারবালা তীরে শত্রু বেষ্টিত হয়েছিলেন হাসানও যমুনার তীরে শত্রু বেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধুকছে। সমস্ত শরীর বাশের গুতায় চালনির মত ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, মাথাটা ঝুকে আছে, শরীর বেয়ে রক্ত গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। সে ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছে, শরীরটা কাঁপছে। ফেরদৌসি তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে, কাঁদছে আর গ্যাংদের অভিশম্পাত করছে ‘কেন তোমরা ওকে মারছ, কি আমাদের অপরাধ, কেন আমাদের এত শাস্তি। ইমাম হুসাইনের ন্যায় আজ কাফেররা নিষ্পাপ হাসানকে মেরে ফেলছে। সহসা সে উর্ধ্বে দু’হাত প্রসারিত করে চিৎকার করল, হে আল্লাহ তুমি কোথায়, তুই কি অন্ধ হয়ে গেছিস, দেখতে পাচ্ছিস না, আজ যমুনার তীর কারবালায় পরিণত হয়ে গেছে। নিরাপরাধের রক্তে যমুনা কলুষিত হয়ে গেছে। কোথায় তোর সাহায্য, কখন তোর সাহায্য। আমার স্বামিকে বাঁচাও, আমার স্বামীর জীবন ভিক্ষা দাও’ সে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। তার কান্নার লহরি যমুনার তীরে তীরে প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পরে উর্ধ্বে ।
তখনি পাপিস্টরা এসে হাসানকে ঘিরে দাঁড়াল, কেউ কেউ বাঁশ দিয়ে গুতাচ্ছে কেউ মাথার উপর দিয়ে বাড়ি মারছে। হাসান ফেরদৌসিকে ধাক্কা মেরে বলল, তুই দূরে গিয়ে দাঁড়া। তারপর সে লাঠি ঘুরিয়ে আঘাত প্রতিহত করতে লাগল। তখনি শাহিনরা হাসানের অগোচরে নীচ দিয়ে বাঁশ ঢুকিয়ে তার একেক পায়ে দুইটা করে আংটা লাগিয়ে হেচকা টানে মাটিতে ফেলে দিল। আর সাথে সাথে শৃগালগুলি হর্ষধ্বনি তুলে সব বাঁশ তার উপর ফেলে চেপে ধরল। সিংহের খাচার ন্যায় তার উপর বাশের জাল তৈরি করে পারা দিয়ে ধরল। চোখের পলকে কয়েকজন এসে তার হাত বেঁধে ফেলল।
এ অবস্থা দেখে ফেরদৌসি চিৎকার করে হাসানের দিকে দৌড়াল। মহিউদ্দির কাছ দিয়ে আসার সময় সে থাবা মেরে তার হাত ধরে চেঁচাল ‘ওদিকে কোথায় যাস মাগী, তোর ভাতার মরে গেছে, এখন আমিই তোর ভাতার’ বলে রাস্তার দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। সড়ক মাত্র কয়েক হাত দূরে। রাস্তার উপর উঠেই ফেরদৌসি ঝাকি মেরে হাত ফসকিয়ে হাসানের দিকে দৌড় দিতে চাইল, মইখ্যা পথ আগলে দাঁড়াল। ফেরদৌসি কেঁদে উঠে চিৎকার করল ‘হারামজাদা আমাকে আমার স্বামীর কাছ যেতে দে। মইখ্যা অট্টহাসি দিয়ে বলল ‘কে তোর স্বামী, ওইটা তো মরে ভুত হয়ে গেছে। এখন আমিই তোর স্বামী, আয় আমার বুকে আয়। তোর রুপের আগুনে আমার শরীর ঝলসে গেছে, কলিজা পোড়ে গেছে, তোর রুপের নেশায় আমি মাতাল। এখন তোর যৌবন সুধা পান করে অন্তরাত্না শান্তি করব। সে ধরতে এগিয়ে যায় আর ফেরদৌসি পিছিয়ে যায়, চিৎকার করে হাসানকে ডাকে। মাত্র দশ হাত পিছনেই বিক্ষুব্ধ যমুনা।
ফজলু রনক্ষেত্রের কাছাকাছি এসে দেখল মহিউদ্দি ফেরদৌসিকে ধরার জন্য যমুনার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সে ফেরদৌসিকে আনার জন্য সেদিকে এগিয়ে গেল। হাসান বাশের জালের নীচে আটকা পরে আছে। হাত বাঁধা অবস্থায় অবচেতন হয়ে পড়ে আছে, আলো আধারির মত তার কানে কি যেন আর্তনাদ বাজছে, কিন্তু অবচেতন রাডারে ধরা পড়ছে না। ফেরদৌসি একদম রাস্তার মাথায় যমুনার কিনারে পৌঁছে গেছে, সুউচ্চ খাড়া কাচার। জীবন নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে সে অসহায় হয়ে চিৎকার করে তার মহাজনকে ডাকল ‘হাসান’। তারপর আর্তনাদ করে উঠল, ‘আমাকে আমার স্বামীর কাছে যেতে দে’। সহসা হাসানের কানে এ আর্তনাদ বেজে উঠল, সে আহত সিংহের মত উছল মেরে বাশের নেট ভেদ করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর পশ্চিম দিকে তাকাল। ভয়ে গ্যাংরা কিছুটা পিছিয়ে গেল।
মহিউদ্দি অট্টহাসি দিয়ে বলল, এখন আর কাউকে ডেকে লাভ নেই ডার্লিং, আমার বুকে এসো। ফেরদৌসি তার দিকে থু থু নিক্ষেপ করে বলল, ‘তুই আমাকে কোনদিন পাবি না নেড়ি কুত্তা, আমার লাশটাও পাবি না। সে ঝংকার মেরে উঠল, পাই না পাই এই যে দেখ, আর কোথায় যাবি’ বলে ধরার জন্য সামনে হাত মারল কিন্তু তার হাত দুটি শুন্যে ঘোরে এল। ফেরদৌসি পিছাতে গিয়ে পড়ে গেছে অথবা যমুনায় ঝাঁপ দিয়েছে। হাসান জানে ফেরদৌসি সাঁতার পারে না। দৃশ্যটা দেখে তার গলায় হেচকির মত একটা শব্দ হল, উর্ধ্বে তাকাল, চিৎকার করল ‘ইয়া আল্লাহ, দুই হাত মোচড় মেরে ফটফট করে মোটা রশি ছিঁড়ে ফেলল, পার্শ্বে পরে থাকা লাঠিটা থাবা মেরে নিয়ে উল্কার বেগে ছুটল। ঘটনার আকস্মিকতায় মইখ্যা স্তব্ধ হয়ে গেছে, সে নির্বাক হয়ে যমুনার দিকে তাকিয়ে আছে। হাসান দৌড়ের বেগের উপর লাঠিটা তার পেটে মেরেই ‘ফেরদৌসি আমার ফেরদৌসি’ চিৎকার করে প্রমত্তা যমুনায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। চোখা লাঠি মহিউদ্দির পেটের ডানপাশে ঢুকে নাড়ি ভুরিসহ বামপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, সাথে সাথে ফেরদৌসিকে বিয়ের সাধ তার ইহজন্মের তরে সাঙ্গ হয়ে গেছে।
হাসান মরিয়া হয়ে সাতরিয়ে ফেরদৌসিকে খুঁজতে লাগল, পর্বতসমান ঢেউয়ের ঘাতে ঘাতে সে ডুবছে আর ভাসছে। তার যখমগুলির মুখে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল, এখন পানির কামড়ে তা সরে গিয়ে অজস্র ধারায় শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে আর যমুনার ঢেউ রক্তিম হয়ে উঠছে। সে হাতরিয়ে তার প্রিয়াকে খুঁজতে লাগল আর ক্রমে ক্রমে দুর্বল হয়ে এল। এভাবেই বিক্ষুব্ধ যমুনার অনন্ত তরঙ্গমালায় দুলতে দুলতে হাসান ফেরদৌসি কোথায় হারিয়ে গেল?
উপসংহার
এই সংবাদ বাড়িতে পৌঁছার সাথে সাথে মা জিগর ফাটা চিৎকার করে যমুনার দিকে দৌড়লেন। মাঠের কোণাকুণি ধান ক্ষেত পেড়িয়ে, কাদা ভেঙ্গে পাগলের মত উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ছে, পড়ছে উঠছে আর দৌড়ছে। ছেলে মেয়েরা থামাতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। অবশেষে তাকে রিকশায় তুলে রওয়ানা হল। যে মা একই বৃন্তের দু’টি কুসুমকলি পরম যতনে তিল তিল করে ফুটিয়ে তুলেছেন কিন্তু গন্ধ ছড়ানোর আগেই ফুটন্ত দুটি গোলাপ ঝড়ে পড়ল। তার মানিক জোড় হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য- এটা সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যমুনার কিনারে পৌঁছেই তিনি ঝাঁপ দিলেন কিন্তু ভাগ্যিস ছেলে মেয়েরা তাকে পেছন টেনে ধরল। তিনি মাটিতে গড়িয়ে পড়লেন, জবাই করা পশুর মত ধাফড়াতে লাগলেন। সর্বস্ব খোয়ানো এক মায়ের আর্তনাদে যমুনার তীর শনৈ শনৈ কাঁপতে থাকে, দুলে উঠে খোদার আসন আরশ কুরসি।
মা সেখান থেকে আর উঠলেন না, ছেলে মেয়েরা টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু তিনি চিৎকার করে কামড়িয়ে খামছিয়ে তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে দিলেন। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে মাতম করতে লাগলেন। অগত্যা তারা সেখানে মায়ের জন্য পলিথিন টানিয়ে একটা ঝুপড়ি বানিয়ে দিল। বিলাপই তার একমাত্র সম্বল হল, নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিলেন, সেলাইন পুশ করে রাখা হল। তিনদিন পর অর্ধমৃত অবস্থায় তাকে রিকশায় তুলে বাড়ি নেয়া হল। এরপর তিনি মাত্র দুই দিন বেঁচেছিলেন।
হাজারি পাড়ার ঘরে ঘরে শোকের মাতম উঠল। ফকির বাড়ির আবাল বৃদ্ধ বনিতা মাটিতে লোটিয়ে পড়ল, কোথায় তাদের মালিক জোড়, কোথায় হারিয়ে গেল মানিক জোড়? যে দুটি নিষ্পাপ বালক বালিকা ছোট থেকে এক সাথে হেসে খেলে বড় হয়েছে, যাদের নিষ্পাপ দুষ্টুমি তাদের হৃদয় আলোড়িত করত, হাসির খোরাক যোগাত, যাদেরকে দেখে সকলের চোখ জোড়াত- তাদের সেই চাঁদ সুরুজ আজ কোথায় হারিয়ে গেল, তাদের মানিকেরা চিরদিনের জন্য কোথায় চলে গেল? তারা কচি দুটি প্রাণের অন্তিম প্রয়াণ সহ্য করতে পারল না, ঘরে ঘরে কারবালার মাতম উঠল।
বিদ্যুৎ ঝলকের মত এ ট্র্যাজিক সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। জামালপুরের ঘরে ঘরে শোকের ছায়া নেমে এল। মানুষ যমুনার তীরে ভিড় করল, নৌকা ষ্টীমার লঞ্চ ইত্যাদি দিয়ে খুঁজাখুঁজি শুরু হল। জেলে নামিয়ে যমুনার মাটি পানি উলট পালট করা হল কিন্তু কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। হাসান ফেরদৌসি বেঁচে নেই- এটা কেউ বিশ্বাস করতে পারল না। তখন তাদের মধ্যে আফওয়াহি ছড়িয়ে পড়ল- ওরা বেঁচে আছে, নিভৃতে কোথাও সংসার পেতে বসেছে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হল, হাসান ফেরদৌসি আর ইহলোকে নেই। তখন তারা মাতম করল, বচনা করল শোকগাথা, এই গাথা লোকগাথায় পরিণত হয়ে স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেল। আশ্বিন কার্তিক দুই মাস গ্রামাঞ্চলে কোন কাজ কর্ম থাকে না, তখন তারা শোক উদযাপন করে। কবিয়ালরা পুতির সুরে আবৃত্তি করে হাসান ফেরদৌসির ট্র্যাজিক প্রণয়োপাখ্যান, গাড়িয়াল ও ধীবররা ভাওইয়্যার সুরে গায়, গ্রামে গ্রামে জারি ও শারি গানের আসর বসে, সে গুলিতে হাসান ফেরদৌসির গাথা মঞ্চস্থ করা হয়। এভাবে তারা দুই মাস শোক উদযাপন করে। দাদা দাদিরা নাতি নাতনীর আসরে শুনায় হাসান ফেরদৌসির অনবদ্য প্রেম কাহিনী ও তাদের ট্র্যাজিক পরিনতির আখ্যান। শিশুরা চোখের জলে বুক ভাসায়।
এখনো পশ্চিম জামালপুরের বাসিন্দারা শোক পালন করে। প্রতি আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশির দিনে তারা তাজিয়া মিছিল বের করে। খড় মাটি দিয়ে তৈরি তিনটি মুর্তি গাড়িতে তুলে, দুলহান দুলহানির সাজে সজ্জিত হাসান ফেরদৌসির দুটি মুর্তি কুরসিতে বসানো হয়, পাশে মইখ্যার মুর্তি। হাসানের হাতে একটা লাঠি মহিউদ্দির পেটে ঢুকানো, তাতে রং মাখিয়ে রক্ত বের হওয়ার নিদর্শন করা হয়। তারপর তারা গাড়ি নিয়ে মিছিল সহকারে যমুনার দিকে যাত্রা করে। হাসানের যুদ্ধের ন্যায় তারা লাঠি দিয়ে নিজেদের গায়ে আঘাত করে, রক্তাক্ত করে আর মাতম করে, হায় হাসান হায় ফেরদৌসি। তারপর যমুনায় গিয়ে মুর্তি বিসর্জন করে আবার ‘হায় হাসান হায় ফেরদৌসি’ বিলাপ করতে করতে ফিরে আসে।
যেসব গ্যাংরা হাসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ছিল তারা মানুষের ক্ষোভের মুখে পতিত হয়। দুঃখ ও অনুশোচনায় তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রামে গিয়ে বিভিন্ন কর্মের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। মাঝে মধ্যে যখনি তারা বাড়িতে আসে তখনি চলে যায় যমুনার তীরে, দুহাত নদীর দিকে বাড়িয়ে চিৎকার করে ‘হাসান ফেরদৌসি, এখন আমাদের কি হবে, আমরা যে ধ্বংস হয়ে গেলাম। আমাদের ক্ষমা কর, তোমরা ক্ষমা না করলে যে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমরা তোমাদের উপর যুলুম করেছিলাম, অন্যায় করেছিলাম। আমাদের মাফ করে দাও--- তারা যমুনার তীরে চিৎকার করে, বিলাপ করে, মাতম করে। অনুশোচনায় মাটিতে গড়াগড়ি যায়, মাথার চুল ছিঁড়ে, বুকে মুখে আঘাত করে আর ক্ষমা চায়, পাপের প্রায়শ্চিত্য করে।
যমুনা পাড়ের জেলে পল্লিগুলিতে কিংবদন্তির মত ছড়িয়ে আছে- প্রতি আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশির রাতে বিয়ের জমকালো পোশাক সজ্জিত যুবক যুবতি নদীর তীরে হাত ধরাধরি করে হেঁটে বেড়ায়, কথা বার্তা বলে হাসাহাসি করে, তাদের কলহাস্যের লহরী যমুনার কুলে কুলে বাজতে থাকে। লাল শাড়ি পরা যুবতি আপাদ মস্তক স্বর্ণালংকার সজ্জিত, যুবক জ্যোতির্ময় হেমাম্বর পোশাক সজ্জিত, উভয়ের দেহ সোনালী আভা ছড়ায়। তাদের মস্তকোপরি কাঞ্চন কিরীট চতুর্দশি কৌমুদীর প্রভায় হরিদ্রাভা বিচ্ছুরিত হয়। কিন্তু সূর্যোদয়ের আগেই তারা আবার নদী গর্ভে অদৃশ্য হয়ে যায়।
হাসান ফেরদৌসি যমুনায় বিলীন হয়ে গেছে কিন্তু বেঁচে আছে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে। তারা আবাল বৃদ্ধ বনিতার প্রাণের নায়ক নায়িকা।
সমাপ্ত
দ্রষ্টব্যঃ একমাস পর শুরু হবে অত্র সিরিজের তৃতীয় গ্রন্থ- উত্তর বাসন্তী’ বা অন্য নামে।
বিষয়: সাহিত্য
১৪৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন