হাসান ফেরদৌসি - ১৫

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২২ অক্টোবর, ২০১৭, ০৮:০৭:৪৯ সকাল

২১

ফেরদৌসিদের বাড়ির সোজা সোজি আধা কিমি উত্তরে বাজার। বাজারের মধ্য বরাবর জেলা বোর্ডের রাস্তাটা পুর্বে ময়মনসিংহের দিকে আর পশ্চিমে যমুনায় গিয়ে মিশেছে। বাজারের পাঁচশ হাত পুর্ব ও পশ্চিমে গিয়ে বড় রাস্তা থেকে ছোট ছোট দুইটা রাস্তা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে, এই চতুর্থভুজ ক্ষেত্রটা বিশাল মাঠ। মাঠের মাঝখানে পৌঁছে হাসান পুর্ব দিকে মোড় নিল। ফেরদৌসি পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরে বলল, কোথায় যাস? - রাস্তায় উঠি গিয়ে। - আরে বোকা আমাদেরকে না পেয়ে ওরা এখনি খুঁজতে বের হবে। তারা জানে তোদের বাড়ি পুর্ব দিকে, ওদিকে গেলেই ধরা খেতে হবে। - তাহলে কোন দিকে যাব?- পশ্চিম দিকে চল, ওদিকে কেউ খুঁজতে যাবে না। এবার তারা পশ্চিম দিকে দৌড়াতে লাগল। কখনো ক্ষেতের আল দিয়ে, কখনো ধান ক্ষেত বরাবর কাদা ভেঙ্গে দৌড়াচ্ছে। অবশেষে গিয়ে বড় রাস্তায় উঠল। রাস্তায় উঠেই পশ্চিম মুখি দৌড় শুরু করল। মাটির রাস্তা, এখানে সেখানে ভাঙ্গা, খানাখন্দ, গর্ত। ফেরদৌসি বারবার পড়ে যাচ্ছে আর হাসান টেনে তুলছে, সে উঠছে আর দৌড়ছে। এমনিতেই এ পথে লোক চলাচল কম, আবার রাস্তা খারাপ বলে রিকশা চলাচল করে না, মানুষ পায়ে হেঁটেই আনাগুনা করে। হাসান দৌড়ছে আর রিকশা পাওয়ার আশা করছে কিন্তু পেল না।

ফেরদৌসি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, এখন সে দৌড়বে দূরের কথা হাঁটতেই পারছে না। তখন তারা বাজার থেকে অনেকটা পশ্চিমে চলে গেছে। ফেরদৌসির অবস্থা দেখে হাসান বলল, এক কাজ করি, তুই এখানে অপেক্ষা কর আমি বাজারে গিয়ে একটা রিকশা নিয়ে আসি। সে অবজ্ঞার সুরে বলল, ‘তুই আসলেই আহাম্মক, এখন বাজারে গেলে লোকেরা তোকে দেখবে, তারপর যারা আমাদের খোঁজে আসবে তাদেরকে বলবে ওরা পশ্চিম দিকে গেছে, এটা হবে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়া। এভাবেই চল আস্তে আস্তে যেতে থাকি। তারপর তারা কখনো হেটে কখনো দৌড়ে যেতে লাগল। হাসান হল লৌহ পাজরার যুবক- সে ভীতও নয় পরিশ্রান্তও নয়, স্বাভাবিকভাবেই দৌড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফেরদৌসি মেয়ে মানুষ, পালানোর ভয়ে সে ভীতা, এমনিতেই তার শরীর কাঁপছে। তার উপর পরিশ্রমে অভ্যস্ত নয়, কিছুক্ষণ দৌড়ে এসে সে একেবারে বিকল হয়ে গেছে।

অবশেষে ফেরদৌসি পেটে হাত দিয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়ল ‘আমি আর পারছি না রে, আমার পেট ব্যথা করছে’ বলে কেঁদে ফেলল। হাসান বুঝল, দৌড়ে অভ্যস্ত নয় বলেই পেট ব্যথা করছে। তখন দুজন পাশাপাশি বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করল। তারপর হাসান বলল, তুই আমার কাঁধে ভর দিয়ে চল। সে হাসানের কাঁধে হাত রাখল আর হাসান তার কোমর পেছিয়ে ধরে হাঁটতে লাগল। রাত্রি বেলা গ্রামের রাস্তায় মানুষ কম, দুয়েকজন সামনে পড়লে ফেরদৌসি হাসানকে ছেড়ে ওড়নায় ঘোমটা টেনে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে থাকে, মানুষ না থাকলে কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটে। তাদের ধরা পড়ার ভয় নাই, কারণ অনুসন্ধানকারীরা পুর্ব দিকে যাবে, পশ্চিম মুখি কখনোই আসবে না। কাজেই তারা গজেন্দ্র গমনে যেতে লাগল।

মাজেদা নূরানি ও অন্যান্য বোনেরা খেতে বসে ফেরদৌসিকে পানি আনার জন্য পাঠিয়েছিল। অনেকক্ষণ হয়ে গেল সে আসছে না দেখে তারা ডাকতে লাগল কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নাই। বোনেরা বকতে লাগল, পানি আনতে গিয়ে এটা মরল নাকি? নূরানি ইয়ার্কি করল, আবার হাসানের সাথে পালিয়ে গেল না তো? মাজেদা চমকে উঠল আর সাথে সাথে দৌড় দিল- কলপাড়ে দেখল নাই, বাথরুমে দেখল নাই, রান্না ঘরে নাই, চাচীর ঘরে নাই। তখন মাজেদা চিৎকার করল, এই কে কোথায় আছ তাড়াতাড়ি আস, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তার চিৎকার শুনে বোনেরা ও জামাইরা দৌড়ে এল, আশপাশের বাড়ির লোকজন এল। মাজেদা মরিয়া হয়ে চেঁচাল, ফেরদৌসি নাই, নিশ্চয়ই হাসানের সাথে পালিয়েছে, তাড়াতাড়ি যাও ওদেরকে ধরে আন। পটেটো শুনেই মহিউদ্দির খোঁজে দৌড়ল। মাজেদা আশপাশ বাড়িতে গিয়ে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমাদের বংশের মান ইজ্জত আর থাকল না, হাসান ফেরদৌসিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি সবাই যাও, ওদেরকে ধরে আন, ফকির বাড়ির মান সম্মান রক্ষা কর। তখন সবাই বাইরে বেরিয়ে এল।

রাত্রি বেলা মহিউদ্দি তার গ্যাংদের নিয়ে দোকানের পিছনে তাসের আড্ডায় মেতে উঠে। পটেটো গিয়ে ঘটনা বলতেই সে লাফিয়ে উঠল। তারপর সিংহের মত গর্জে উঠল, ‘পালাতে পারবে না, কোথাও পালাতে পারবে না, পৃথিবীর কোন সিংহের গুহা অথবা মুশিকের গর্তে আত্মগোপন করেও বাঁচতে পারবে না, কবরে ঢুকলেও ওদেরকে টেনে বের করে আনব। এই সবাই চল, হুন্ডা ওয়ালারা হুন্ডা নিয়ে যাও, সাইকেল ওয়ালারা সাইকেল নিয়ে বের হও। তোমরা ময়মনসিংহ, শেরপুর ও ফুলপুরের রাস্তায় রাস্তায় খুজবে। তারপর তারা ডাক মেরে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে পড়ল। মহিউদ্দি ও পটেটো তদারকিতে লিপ্ত থাকল। বিশাল বাড়িতে প্রায় ত্রিশটা মোটর সাইকেল আছে। প্রত্যেক মোটর সাইকেলে দুইজন এবং সাইকেলে একজন করে পাঠানো হল। জামাইদের মধ্যে পটেটো ও ইঞ্জিনিয়ারের বাইক আছে, পটেটোর সাথে এক জামাই গেল। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার দাম্ভিক লোক সে এসব কাজে নাই, তার বাইক নিয়ে অন্য দুই জামাই গেল। সর্বশেষে মহিউদ্দি দুই বডিগার্ড নিয়ে নিজের বাইকে চড়ে ছুটল। সবাই পুর্বমুখি ধাবিত হয়েছে, দুয়েক জন উত্তর দক্ষিণে গেল কিন্তু পশ্চিম মুখি যমুনার দিকে কেউ যায়নি। মহিউদ্দি আর পটেটো বিভিন্ন রোডে এলোপাতারি ঘোরতে থাকে আর লোকজন পেলেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনারা কি দুইটা যুবক যুবতি দেখেছেন?

হাজারিপাড়া বাজার থেকে যমুনা প্রায় চার মাইল। উর্ধ্বশ্বাসে প্রায় অর্ধেক রাস্তা আসার পর হাসান বলল, ‘এটা আমরা কেমন পাগলামি করছি, কোন আশ্রয় নাই পরিচয় নাই জানা শুনা নাই- তাহলে আমরা যমুনার দিকে যাচ্ছি কি মরার জন্য। ফেরদৌসি বলল, ‘না গিয়ে উপায় কি, অন্য দিকে যাওয়া মানে ওদের হাতে ধরে পড়া। আর মহিউদ্দি ও পটেটোর মত কুকুরের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে যমুনায় গিয়ে মরাও ভাল। কারণ মহিউদ্দি গ্যাংদের নিয়ে দল পাকিয়েছে সে যেভাবেই হউক আমাকে বিয়ে করবে, তোর সাথে তো নয়ই অন্য কোথাও বিয়ে হতে দিবে না। আবার তোর সাথে বিয়ে বাতিল করার জন্যই পটেটো ভার্সিটির শিক্ষক ধরে এনেছে। কাজেই এদের হাতে ধরা পড়া মানে তোকে হারানো। আর তোকে হারালে আমি বাঁচব না, আমাকে মরতেই হবে। আর মরতেই যদি হয় তাহলে তোর হাত ধরে তোর বুকে মাথা রেখেই মরব, তা যমুনাতেই হউক আর যেখানেই হউক। হাসান আবেগাপ্লুত হয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল, পাগলের মত চুমুতে লাগল, তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ে স্ত্রীর গালের উপর।

আশ্বিন মাস, শুক্লা চতুর্দশির চাঁদ, নির্মল আকাশের স্নিগ্ধ কৌমুদী প্রভায় প্রকৃতি যেন হেসে উঠেছে। এমন মাধবি রাতে যুগল যুবক যুবতি প্রশান্ত চিত্তে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে হেঁটে যাচ্ছে। ফেরদৌসি হাসানের কাঁধে হাত রেখে নিজের ভার ছেড়ে দিয়ে মরার মত হাঁটছে। শুধু দেহের ভারই নয় জীবনের ভারও তার উপর ছেড়ে দিয়েছে, এতে সে চরম সুখি, পরম খুশি ও আত্মতৃপ্ত। এই গভীর রাতে অপরিচিত রাস্তায় কোথায় যাচ্ছে, কোন নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে, কোন বিপদ সংকুল পরিনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, জঙ্গলে যাচ্ছে নাকি সিংহের গুহায় যাচ্ছে, নাকি অথৈ জলে ভাসতে যাচ্ছে- সে জানে না, জানতে চায় না, জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। কারণ তার জীবনে যা চাওয়া পাওয়ার, যা একমাত্র ধন সাত রাজার ধন, তা সে পেয়ে গেছে। হাসান- তার জীবনের জীবন, চোখের আলো, তার স্বামী হাসান সাথে আছে, তার কাঁধে ভর করে যাচ্ছে। এটাই তার বড় পাওয়া, সে খুশি মহাখুশি। কাজেই তারা কি মৃত্যুপুরীতে যাচ্ছে নাকি জঙ্গলে যাচ্ছে- তা জানার দরকার নাই।

ফেরদৌসি খুব কাহিল হয়ে পড়েছে, সে আর হাঁটতে পারছে না। হাসানের কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে, ধরা পড়ার ভয় নাই বিধায় তারা ধীরে সুস্থে আগ্রসর হচ্ছে। ক্ষুধায় তারা দুর্বল হয়ে গেছে। প্রায় মধ্যরাত, ফেরদৌসি অক্ষমতা প্রকাশ করল, আমি আর যেতে পারব না রে, চল কোন গাছ তলায় গিয়ে একটু ঘুমাই, আমার শরীর আর চলছে না। হাসান মহা চিন্তায় পড়ল। এমন সুন্দরি যুবতি বউ নিয়ে কোন গাছ তলায় রাত কাটানো বা কারো বাড়িতে আশ্রয় নেয়া নিরাপদ নয়, যে কোন বিপদ ঘটতে পারে। দুর্ঘটনার ভয় তো আছেই, তদুপরি পালিয়ে আসার বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে শীঘ্রই ধরা পড়ার সম্ভাবনা। কাজেই সে গাছ তলায় বা কোন বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার সাহস পেল না। ফেরদৌসিকে বলল, আমার কাঁধে ভর দিয়ে আর কিছুক্ষণ চল, দেখি সামনে কি ব্যবস্থা করা যায়।

মধ্য রাত পার হয়ে গেছে। কোথাও কোন জনমানবের চিহ্ন নেই, মানুষের রা নেই। আছে শুধু ঝিল্লি রব আর সারমেয়ের ডাক। মাঝে মধ্যে দুয়েকটা বুভুক্ষু নিশাচর ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাসান আশ্রয়ের আশায় নিরাশ হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ সামনে রাস্তার ধারে একটা আলোক শিখা দেখা গেল। সে এগিয়ে গিয়ে দেখল এটা একটা দোকান, তার ধরে প্রাণ ফিরে এল। রাতে এখনো তাদের কিছু খাওয়া হয়নি, ক্ষুধায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। ফেরদৌসিকে কাছাকাছি একটা গাছ তলায় দাড় করিয়ে সে দোকানে গেল। কেক পাউরুটি কলা বিস্কুট ইত্যাদি কিনল, তার পকেটে যথেষ্ট টাকা আছে। তারপর গাছ তলায় এসে দু’জনে ক্ষুধার তাড়নায় গোগ্রাসে কিছুক্ষণ ভক্ষন করল। একটু শান্ত হয়ে লক্ষ্য করল দোকানের পিছনেই বিশাল মাঠ, এর তিন ধারে লম্বা লম্বা ঘর। সে গিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল ‘এটা কি? দোকানদার বলল, এটা হাইস্কুল। তারপর সে ফেরদৌসিকে নিয়ে গিয়ে বলল, আজ রাত আমরা স্কুলেই থাকব। দু’জন গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখল, টিউবওয়েল আছে, পশ্চিম পাশের ঘরের বারান্দা পাকা, তারা সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল। ফেরদৌসির ওড়না দিয়ে একটু জায়গা ঝেড়ে মোছে পরিষ্কার করল। তারপর একটা পাকা পিলারের সাথে তারা ঢেস দিয়ে বসল। কিন্তু সাথে সাথে মশার ঝাক হামলে পড়ল। হাসান লাফিয়ে উঠে বলল, তুই বস আমি দোকান থেকে কয়েল নিয়ে আসি।

শুক্লা চতুর্দশির চাঁদ, তার সোনালি আভায় পৃথিবী প্লাবিত হচ্ছে। দূর গ্রামগুলির বন বনানি অপরুপ শোভায় মুর্ত হয়ে উঠেছে। ফেরদৌসি পুর্ব দিকে তাকাল, তার আত্মাটা ধক করে উঠল। কয়েক গ্রাম পরেই তাদের বাড়ি, স্মৃতির মুকুরে ভেসে উঠল তার বাড়ি, তার স্কুল। স্কুলের ফিল্ড, ক্লাস রুম, ক্লাসমেট ও বান্ধবিদের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল বাড়ির কথা, চাচাত বোন ও সখিদের কথা। ভাই বোন ও মায়ের মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। সে কি তাদের থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে, তার প্রিয় জন্মভূমি, বাড়ি, স্কুল, আপনজন বান্ধবি ইত্যাদি থেকে কি ইহজন্মের তরে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে, আর কি ভাই বোন ও মায়ের মুখ দেখতে পারবে না? সে কি জন্মের মত হারিয়ে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে কোন নিরুদ্দেশ ঠিকানায়? সে ফোলে ফোলে কাঁদতে লাগল।

ততক্ষণে হাসান এসে চারটা কয়েল চারদিকে জ্বালিয়ে দিল, ব্যস মশা উধাও, এবার তারা শান্তিতে বসল। ফেরদৌসি হাসানের গায়ে ঢেস দিয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হাসানের খুব মায়া হল, গভীর মমতায় তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। মাথা মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, আমার জন্য তোকে কত কষ্ট করতে হচ্ছে। ফেরদৌসি নির্মল হাঁসি দিয়ে বলল, তোর জন্য আমি আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারি, এটা কোন কষ্ট হল। তোকে না পেলে অবশ্যি আমাকে আত্মহত্যা করতে হত। আর আত্মহত্যার মোকাবেলায় এটুকু কষ্টই না। হাসান আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে আদর করল। তারপর বলল, আচ্ছা আমরা যে পরিকল্পনা ছাড়া এদিকে ছুটে এলাম, এখানে কোথায় যাব কি করব, এটা কি বোকামি হল না? ফেরদৌসি বলল ‘এটাই ঠিক হয়েছে, কারণ পুর্ব দিকে গেলে এতক্ষনে ধরা পড়ে যেতাম। এদিকে এসেছি বলেই এখনো নিরাপদ আছি। এখন আমরা অন্য কোথাও যাব না, নিরাপত্তার খাতিরে সোজা পশ্চিমে গিয়ে যমুনা পার হয়ে তারপর অন্য চিন্তা ভাবনা।

হাসান বলল, আসলে তো আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে হয়ত সামান্য বাকী আছে, এখন চিন্তার বিষয় হল বিয়ের বাকী কাজটা সমাধা করা কিন্তু কোথায় করব, তারপর আশ্রয়ই বা কোথায় নিব? ফেরদৌসি বলল, চল আমরা ঢাকায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমি কেজি স্কুলে পড়াব, প্রাইভেট পড়াব বা অন্য একটা কিছু করে সংসার চালাব আর তুই লেখাপড়া করবি। তুই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলে অনেক বড় হবি, শীঘ্রই একটা চাকরি জুটাতে পারবি, তারপর তো আমাদের সুখের সীমাই থাকবে না। হাসান সহসা অট্টহাসি দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, আরে বোকা, তুই কি আমাকে এতই নিঃস্ব মনে করিস যে তোকে রোজগার করতে হবে? এখনো আমার অনেক কিছু আছে। পুর্ব থেকেই লোকেরা আমাদের জমিতে বাড়ি ঘর করে থাকত, আমাদের জমি আবাদ করে সংসার চালাত। গরীব মানুষ বলে আব্বা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন কিন্তু এসব জমি তো আমার। তাছাড়া বাড়ির পিছনে আমাদের অনেক জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল, আমি দেখে এসেছিলাম কিছু কিছু চর জাগছে, এখন তো সম্ভবত সম্পূর্ণ জমিই চর জেগে উঠেছে। আমি গিয়ে ঐসব জমি দখল করব, আর সব জমি দখলে নিলে তোদের জমির চেয়েও কয়েকগুন বেশি হবে।

আবার আমাদের ঘরটা ছিল বৃটিশ আমলের মূল্যবান টিনের। এই টিন এত শক্ত যে, হাতুড়ি পিটিয়েও ঢেউ সোজা করা যায় না। এর সব কাঠ ছিল গজারি। এই টিন দিয়ে বিশাল বড় একটা বাড়ি নির্মান করা যাবে। আমি গিয়ে এই সব টিন ও কাঠ ফিরিয়ে এনে সুন্দর একটা বাড়ি বানিয়ে আমার সুন্দরি বউকে রাখব আর আমি লেখাপড়া করব। ময়মনসিংহের কোন কলেজে ভর্তি হব। আমার এখনো যে জমি আছে তা বর্গা দিয়েও স্বচ্ছন্দে আমাদের সংসার চলে যাবে। তাছাড়া শুনেছি আমার এক খালা আছে, কোন মামা নাই, খালা নাকি খুব বড় লোক, ময়মনসিংহে বাসা। তার কাছে চলে গেলেও আমাদের কোন সমস্যা থাকবে না। আসলে আব্বা আমাকে তোদের বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন তোর আব্বা আম্মার খাতিরে। তিনি জানতেন যে তারা আমাকে সন্তানের মত লালন পালন করবেন, আর তারাও তাই করেছেন। নচেৎ আমার আশ্রয়ের জন্য আরো জায়গা ছিল। যাই হউক, চল কাল যমুনা পার হয়ে অন্য কোন পথ ধরে আমার এলাকায় চলে যাই। তারপর বাড়িতেই থাকি বা খালার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেই সেই চিন্তা পরে।

যমুনা পার হওয়ার কথা শুনে ফেরদৌসির হঠাৎ স্বরন হল আর সে সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠল ‘আরে আমরা কি বোকা, ফাও এত চিন্তা করছি কেন, যমুনার ওপারে জুয়েল মামার কাছে গেলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। হাসান আনন্দাতিশয্যে হাততালি দিয়ে উঠল। তারপর বলল, হায় আল্লাহ এই সোজা কথাটা এতক্ষণ আমাদের স্বরণ হল না কেন। তোর মনে আছে জুয়েল মামা আমাকে কত আদর করত, এখন দেখলে মাথায় তুলে নিবে। এটাই সিদ্ধান্ত, আমরা জুয়েল মামার কাছে যাব, তারপর যা করার সেই করবে। ফেরদৌসি এতক্ষণ হাসানের বুকে মাথা রেখে আলাপ করছিল, এখন আবেগে সোজা হয়ে বসে বলল, আমরা গিয়েই জুয়েল মামাকে বলব, আগে আমাদের বিয়ে পড়ান। তারপর বলব, এখন আমাদেরকে নিয়ে বাড়িতে রেখে আসেন। আবার আমরা আম্মার কাছে চলে আসব, নাকি বলিস? হাসান একটু চিন্তা করে বলল, হা তাই তো করা দরকার, আম্মা একা মানুষ, অসুস্থ মানুষ, আমাদেরকে ছাড়া তো চলতে পারবে না। যাই হউক পরের চিন্তা পরে, তোদের বাড়িতে থাকব নাকি আমার বাড়িতে থাকব এটা জুয়েল মামার উপর নির্ভরশীল। এখন ঘুমা, রাত অনেক হয়েছে।

তারপর সে পিলারে ঢেস দিয়ে পা লম্বা করে দিল, উরুর উপর ফেরদৌসির মাথা দিয়ে শুওয়াল, ওড়নায় শরীর ঢেকে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, এখন ঘুমা। হাসানের কোলে শুয়ে আনন্দে ফেরদৌসির মনটা ভরে গেছে, তার চোখ দুটি স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। সে ভাবছে, কেমন হবে তাদের সংসার। বিয়ের পর আবার তারা মায়ের কাছে ফিরে আসবে, হাসান মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবে, অনেক বড় শিক্ষিত হবে, বড় চাকরি করবে, শহরে বাসা করবে, সুন্দর ছিমছাম একটা বাসা- যেখানে ফুল বাগান থাকবে, সে ঘুরাফিরা করবে, কিন্তু তার পিছনে কয়েকটা কিচির মিচির কলরব করে তাকে বিরক্ত করবে, সে তাদেরকে জানে কিন্তু চিনে না, কারণ তারা যে এখনো পৃথিবীতে আসেনি, তাদের চাঁদ মুখগুলি এখনো তার দেখা হয়নি। তখন সে ধমক দিয়ে বলবে, ‘আমাকে ত্যক্ত করছিস কেন বাপের কাছে যা’ কিন্তু ওরা যাবে না। তখন সে গিয়ে বলবে, এই যে তোমার পোলাপান তুমি রাখ আমি এত জ্বালাতন সইতে পারব না’। তখনি দু’জনের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যাবে।

ফেরদৌসি ফিক করে হেসে উঠে বলল, আচ্ছা বিয়ে হলে কি আমরা এখনকার মত ঝগড়া করব না? হাসান একটু চিন্তা করে বলল, ‘না, জামাই বউয়ের মধ্যে ঝগড়া ভাল নয়। ফেরদৌসি আহলাদি কণ্ঠে বলল, ‘না ঝগড়া করতে হবে, তোর সাথে ঝগড়া না করলে আমার ভাল্লাগেনা। - কি নিয়ে ঝগড়া করবি? - এই মনে কর আমি বাজার সওদা বা কসমেটিক্সের কথা বললাম, তুই আনলি না তখন আমি ঝগড়া করব। আবার আমি ঠিকমত রান্নাবান্না করলাম না বা কাপড় ধোয়ে দিলাম না। তখন তুই রেগে গিয়ে ‘মাগী এখনো কাজটা হয়নি কেন’ বলে মারবি। সে মুখ ফসকে কথাটা বলেই আবার সংশোধন করল ‘না না, এসব ছোট লোকি ভাষা ব্যবহার করতে পারবি না, আচ্ছা তুই কি আমাকে মারবি? হাসান একটু চিন্তা করে বলল, ‘হ জামাইরা দেখি বউকে মারেই। - না না মারতে পারবি না। তুই মারলে আমিও মারব। - দুঃ বোকা, বউয়েরা কখনো জামাইকে মারে নাকি? তাছাড়া তুই মারলে তো বদনাম হবে, লোকেরা তোকে ডাকবে ডাইনি আর আমাকে ডাকবে মাইগ্যা। তারপর দু’জনে তর্ক বিতর্ক করে অবশেষে সিদ্ধান্ত হল, হাসান প্রকাশ্যে মারতে পারবে তবে জোরে নয় হালকা। আর ফেরদৌসি গোপনে মারবে যাতে কেউ না দেখে, বদনাম না হয়।

এরপর সে আবার প্রশ্ন করল ‘আচ্ছা বিয়ের পরেও কি আমরা তুই তুই করে ডাকব? হাসান ধমক দিল ‘কি আজাইর‍্যা প্যাচাল শুরু করেছিস, রাত তো পোহাল বলে, ঘুমাবি কখন’ বলে সে ফ্লোরে শুয়ে পড়ল এবং বাহু বিছিয়ে দিল। ফেরদৌসি বাহুতে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল এবং শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে তারা দোকান থেকে আরো কিছু খাদ্যদ্রব্য কিনে এনে খাওয়া দাওয়া করল। টিউবওয়েল চেপে পানি পান করল। তারপর হাসান গিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, চাচা যমুনা এখান থেকে কতদূর? দোকানদার বলল, এই তো মাইল দেড়েক হবে। - এ পথে পারাপারের কোন ব্যবস্থা আছে? - এ রাস্তায় তো মানুষ খুব বেশি একটা চলাচল করে না। তাই পারাপারেরও ভাল ব্যবস্থা নেই। দুয়েকটা নৌকা নদী পাড় করে তবে সকাল দশটার আগে পাওয়া যাবে না। তারপর তারা রওয়ানা করল।

ফেরদৌসি ওড়না দিয়ে শরীর পেছিয়ে ভাল করে ঘোমটা দিয়ে হাঁটতে লাগল। এখন তারা নির্দিষ্ট গন্তব্যে হাঁটছে- জুয়েল মামার কাছে যাবে। কাজেই তাদের আর কোন ভয় নাই আশংখা নাই। আবার পশ্চিম দিকে কেউ তাদের খুঁজতেও আসবে না, আসলে এতক্ষনে এসে যেত। কাজেই তারা চিন্তা মুক্ত ও আসংখা মুক্ত হয়ে গজেন্দ্র গমনে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের ভবিষ্যৎ সংসার নিয়ে স্বপ্নের আলাপ করছে আর চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে একটা সুখের নীড়।

মহিউদ্দিন এ ঘটনাকে তার ভাগ্যের বৃহস্পতি হিসাবে গণ্য করল। এ ঘটনা না ঘটলে হয়ত ফেরদৌসিকে বিয়ে করা তার জন্য কঠিন হত কিন্তু এখন বিষয়টা সহজ হয়ে গেল। যেখান থেকে হউক, যেভাবেই হউক তাকে ধরে এনে সোজা বিয়ে পড়াবে, অন্য কারো সাথে বিয়ের প্রশ্নই উঠে না, এটাই তার সিদ্ধান্ত। সে সারা রাত ঘুমায়নি, মোটর সাইকেলে পুর্বমুখি সকল রাস্তায় টহল দিয়েছে। শেষ রাত্রে এসে বাজারের মুখে চৌরাস্তার ঘটিতে বসল- যারা ফিরে আসবে এ রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। তার সাথে আছে দুই বডি গার্ড শাহিন ও হুমায়ুন। অনুসন্ধানকারীরা ব্যর্থ হয়ে হুন্ডা নিয়ে একেক রাস্তা ধরে ফেরত আসছে আর সে তাদেরকে অন্য রাস্তায় আবার পাঠিয়ে দিচ্ছে। এভাবে সকাল পর্যন্ত বিশ ত্রিশটা মোটর সাইকেল আব- ডাউন করল, তন্নতন্ন করে খুজল কিন্তু হাসান ফেরদৌসির কোন পাত্তা পাওয়া গেল না। পটেটো সাড়া রাত কঠোর পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে গেল, সকালে মহিউদ্দির কাছে বসে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে বলল, এত পরিশ্রম করে কোন লাভ হয়নি, ওদেরকে তো পাওয়া গেল না। অবশেষে মহিউদ্দি বলল, আচ্ছা আমরা তো পশ্চিম দিক ছাড়া বাকী সকল দিক খুঁজলাম কিন্তু পণ্ডশ্রম হল। এখন পশ্চিম দিকটা না দেখলে আমার মনে তৃপ্তি আসবে না। শাহিন তুই আমার হুন্ডাটা নিয়ে যা, একদম যমুনার পাড় পর্যন্ত দেখে আসবি। শাহিন রওয়ানা হয়ে গেল।

মাদারগঞ্জ স্কুলের পাশে দোকানের সামনে একটা হোন্ডা এসে থামল। আরোহী দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল ‘চাচা, পিছন থেকে শুনে এলাম এদিকে নাকি দুইটা যুবক যুবতি এসেছে, আপনি কি তাদেরকে দেখেছেন? দোকানদার বলল, ‘হা রাত্রে তো তারা আমার দোকান থেকেই কলা কেক ইত্যাদি কিনে খাওয়া দাওয়া করল। তারপর সম্ভবত আশপাশেই কোথাও ছিল, সকালে আবার খাওয়া দাওয়া করে চলে গেছে। - তারা কিছু বলেছিল? - হা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যমুনা কতদুর, আর পারাপারের ব্যবস্থা আছে কিনা। - কতক্ষণ হল তারা গেছে? – ঘণ্টা দেড়েক হবে। তারপর শাহিন হাওয়ার বেগে হুন্ডা ছাড়ল। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে, শিকার তার হাতের মুঠোয়। এ সুযোগে সে মহিউদ্দির কাছ থেকে মোটা পুরুস্কার বাগিয়ে নিতে পারবে।

সামনে ভয়াল জঙ্গল, এর মাঝ বরাবর রাস্তাটা গেছে। জঙ্গলের শেষ প্রান্তে পৌঁছেই সে কঠিন ব্রেক কষে সাথে সাথে স্টার্ট বন্ধ করে দিল- যাতে শব্দ শুনা না যায়। চোখের পলকে সরে গিয়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। নির্মিশেস দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে, অদুরেই হাসান ফেরদৌসি হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে তারা খুব মৌজে আছে, হাসতে হাসতে একে অন্যের উপর ভেঙ্গে পড়ছে। শাহিনের ঠোঁটের কোণায় বক্র হাঁসি ফুটে উঠল। সে দ্রুত মোটর সাইকেলটা সামনে ঠেলে নিয়ে আড়ালে গিয়ে স্টার্ট করল, তারপর উল্কার বেগে ছুটল।

বিষয়: সাহিত্য

১৩৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File