হাসান ফেরদৌসি - ১২

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৮ অক্টোবর, ২০১৭, ০৬:৪৩:৩৯ সন্ধ্যা

১৮

এশার পর বড় হুজুর উপস্থিত হলেন। আর বাড়ির লোকের মধ্যে ফেরদৌসির সম্পর্কিত দুই চাচা ও দুই চাচাত ভাই আসল। পুরুষ সংখ্যা মোট পাঁচজন। আর অন্দর মহলে আছে আট দশজন মেয়ে লোক। এই হল বিয়ে অনুষ্ঠানের মেহমানবৃন্দ। তারা কাজি সাবের অপেক্ষায় বসে বসে আলাপে মত্ত হল। আর আলাপের বিষয় বস্তু হল, মাষ্টার হাসানকে পুত্র বানিয়ে নিয়েছিলেন, নিজের সম্পদের ওয়ারিশ দেয়া ও মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার অসিয়্যত করে গেছেন। কিন্তু মেয়েরা ও মেয়ের জামাইরা বাধ সেধেছে তারা অন্যত্র বিয়ে দিবে, ইত্যাদি আলাপে অনেক সময় গড়িয়ে গেল, কাজি সাব এখনো আসেনি। মা ভেতর থেকে তাকীদ দিয়ে পাঠিয়েছেন বিয়ে পড়ানোর জন্য। বড় হুজুর বিয়ের খুৎবা পাঠ করে দুই চাচাকে পাঠালেন পাত্রির ইযিন আনার জন্য। চাচারা গিয়ে কনের পাটির সামনে বসল, কনে লাল শাড়ি পড়ে লম্বা ঘোমটা টেনে বসে আছে, মেয়েরা মণ্ডলাকারে তার পাশে বসে আছে। এক চাচা প্রস্তাব করল, মহরে ফাতেমির বিনিময়ে হাসান বিন উসমানের সাথে তোমার নিকাহর প্রস্তাব করা হল, কবুল বল। ফেরদৌসি ঘোমটার আড়ালে মাথা নিচু করে বসে আছে, তার আত্মা ধুক পুক করছে, শরীরটা কাঁপছে। সুখানুভুতির নিঃসীম সিন্ধুতে সে অবগাহন করছে, আজ এক্ষণে তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, তার জীবনের এক মাত্র সাধ বাস্তবায়িত হচ্ছে। জীবনে কোন দিন এতটা আনন্দানুভুতি সে উপলব্ধি করেনি। তার নাকের গোড়া বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝড়ছে। আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতায় সে উচ্চারন করল ‘আল-হামদুলিল্লাহ। এতে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার হয়ে গেল। আল্লাহর প্রতি শুকরিয়াও আদায় হল আবার প্রস্তাব কারীরা কনের সম্মতি পেয়ে মজলিসের দিকে রওয়ানা হল।

ততক্ষণে হাসান বসে বসে মন মুকুরে স্ত্রীর চাঁদ মুখ খানা দেখছে, স্ত্রী সন্তান সংসার নিয়ে কল্পনা করছে, স্বপ্নের জাল বুনছে। প্রস্তাব কারীরা এসে সালাম দিয়ে বলল, মেয়ে ইযিন দিয়েছে। তখন বড় হুজুর হাসানের সামনে বসে প্রস্তাব করল ‘উবায়দুল্লাহ মাষ্টারের মেয়ে আতিয়া ফেরদৌসিকে আপনার সাথে নিকাহের--- কথা শেষ হল না, ঠিক তখনি ‘এসব কি হচ্ছে’ একটা কর্কশ কণ্ঠ রুমের মধ্যে গুঞ্জরিত হয়ে উঠল। হাসান সামনে তাকাল, পটেটো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সে চিৎকার করল, আপনারা কি বিয়ে পরাচ্ছেন নাকি, কার অনুমতিতে বিয়ে দিচ্ছেন, আপনাদেরকে পুলিশে দেয়া হবে। বড় হুজুর বললেন, ফেরদৌসির মা আমাদেরকে ডেকে এনেছেন। পটেটো খেকিয়ে উঠল, আরে ঐ মহিলা তো একটা আস্ত পাগল, পাগল না হলে কেউ নিজের মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পাত্র বাদ দিয়ে এমন একটা রাস্তার ছেলের সাথে বিয়ে দেয়। আপনাদের কি বিবেচনা নাই, এত ভাল মেয়েকে একটা ফকিরের সাথে বিয়ে পড়াতে চাইছেন কোন আক্কেলে। এক্ষুনি চলে যান নইলে সমস্যা হবে।

এক চাচা বলল, কিন্তু ছেলে মেয়ে তো একে অন্যকে পসন্দ করে। পটেটো ঝংকার দিয়ে উঠল, বাড়ির কামলাকে কোন মেয়ে পসন্দ করতে পারে না, যদি করে তাহলে বুঝতে হবে সে পাগল, তার ইচ্ছা মাফিক কোন কাজ হবে না, আমরা তার অভিভাবক, আমরা যা সিদ্ধান্ত নিব তাই হবে, এখন আপনারা যান। হৈ চৈ শুনে মা ও ফেরদৌসি দৌড়ে এল। মা বললেন, তুমি এসব কি করছ, আমি তাদেরকে ডেকে এনেছি তুমি অপমান করছ কেন। আমার মেয়ে আমি বিয়ে দিব তুমি বাঁধা দেয়ার কে? পটেটো হল অভদ্র এবং হিংস্র প্রকৃতির লোক। তার ভাইয়ের কাছে বিয়ে না দেয়ার কারণে আগে থেকেই সে প্রতিশোধ পরায়ণ। ক্রোধে শাশুড়ির দিকে এগিয়ে গেল, আপনি যান এখান থেকে, ঘরে গিয়ে বসে থাকেন। আপনি তো একটা আস্ত পাগল’ বলে শাশুড়ির হাত ধরে ধাক্বা মারল। তিনি উল্টে পড়ে গেলেন। ফেরদৌসি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তারপর সে অভ্যাগতদের প্রতি তাকিয়ে বলল, এখন আপনারা কি করবেন, বিয়ে পড়ান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পাত্র বাদ দিয়ে একটা ফকিরের সাথে বিয়ে পড়ান। তারপর ভাই বোন যারা উপস্থিত নাই তাদের সকলের কাছে জবাবদিহি করবেন, না পারলে জেলে ঢুকবেন। মেহমানরা মাথা নিচু করে নীরব থাকল। তারপর সে সারমেয়র মত ঘেউ ঘেউ করে উঠল, এখনো বসে আছেন কেন, যান আপনারা। মেহমানরা অপমানিত হয়ে বিদায় নিল।

ঘটনা হল পটেটো শহরে হাসানকে দেখেই মাজেদার বাসায় দৌড়ে গিয়ে বলল, হাসানের সাথে কাপড় চোপড় ও অন্যান্য সওদা পাতির ব্যাগ দেখা গেছে। তখনি তাদের মনে বিয়ের সন্দেহ জেগে উঠল। মাজেদা বলল, কি সর্বনাশ, নিশ্চয়ই আম্মা গোপনে ওদের বিয়ে দিচ্ছেন। তখন অন্যান্য মেয়ে ও জামাইদের ডেকে এনে জরুরী পরামর্শ সভায় বসল। সভায় সিদ্ধান্ত হল, পটেটো তখনি শ্বশুর বাড়ি রওয়ানা হবে, গিয়ে বিয়ে অনুষ্ঠান দেখলে তা ভেঙ্গে দিবে। আর যে কোন অবস্থায়, যে ভাবেই হউক হাসানকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে। কারণ সে থাকলে অন্যত্র বিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না। সেই মোতাবেক পটেটো গিয়ে হাজির হল। সে আর এক মিনিট পড়ে আসলে বা অনুষ্ঠানের শুরুতে আলাপে সময় নষ্ট না করে বিয়ে পড়িয়ে দিলে এ সমস্যার উদ্ভব হত না। এটাই হল সময়ের মূল্য। কখনো কখনো এক মিনিটের মূল্য জীবনের মূল্যের চেয়েও ভারী হয়ে যায়।

পটেটোর চোখ চিতার চোখের মত জ্বলছে। সে অগ্নি দৃষ্টিতে হাসানের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আজ তোকে শুধু মুতাব না হাগাবও। তুই আমাকে বিয়ের পাটিতে মুতাইছিলে না, আজ সেই ফলটা পাবি। এখন খাট থেকে নেমে সোজা বের হয়ে যা, খড়ের কুত্তা খড়ে যা, যেখান থেকে এসেছিলি সেখানে চলে যা। হাসান মাথা নিচু করে বসে আছে, তার চোখ থেকে অশ্রু ঝড়ছে। সে কোন কথা বলল না কিন্তু ক্ষোভে দুঃখে বেলুনের মত ফুলতে লাগল। পটেটো চেঁচাল, ঐ হারামজাদা কথা কানে ঢুকছে না, এক্ষুনি বেড়িয়ে যা। - কেন বাড়িটা কি আপনার নাকি? – আমার না তো কি তোর বাপের। ফকিন্নির বাচ্চা বড় লোক বিয়ে করতে চাস, আজ তোর বিয়ের সাধ মিটাব। - আমি ফকির হতে পারি কিন্তু ফকিন্নির বাচ্চা নয়, এটা সবাই জানে, আপনি হলেন প্রকৃত ফকিন্নির বাচ্চা। আপনার মা অন্যের বাড়িতে বাড়া বানত, আপনার ভাইয়েরা এখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে খায়।

সত্য কথায় আতে ঘা লাগল, হাসান যেন তার কলিজায় হাত মেরেছে। সে মাটিতে আর হাসান খাটে বসা। তার চোখ দুটি জ্বলে উঠেছে ‘হারামজাদা তোর এত বড় সাহস, মুখে মুখে কথা কস, বিয়ের দিনের ঘটনা মনে নাই’ বলে পা তুলে হাসানের গায়ে লাথি মারল। সেও সাথে সাথে পটেটোর বুকে ঘুষি মারল। ঘুষির চোটে টাল খেতে খেতে সে কিছুটা পিছনে গিয়ে স্থির হল, তার মাথায় আগুন ধরে গেছে। বাঘের মত লাফিয়ে উঠে হাসানের উপর হামলে পড়ল, সমানে কিল ঘুষি মারতে লাগল। পটেটো জানে না যে সে ঘুমন্ত সিংহের পাছায় আঙ্গুল দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে। হাসান ‘কুত্তির বাচ্চা’ বলে হুঙ্কার ছেড়ে পটেটোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হয়ে গেল তার স্বভাব জাত কারাতে কুংফু। তার হাত পা চক্রাকারে ঘুরতে লাগল আর ঢুস ঢাস করে হাতুড়ি পিটার মত পটেটোর নাকে মুখে মাথায় বুকে পিঠে আঘাত হানতে লাগল। হাসান সম্পর্কে পুর্বে পটেটোর এমনটা জানা ছিল না। সে মনে করেছিল এটুকু ছোকরা, কয়েকটা লাথি মেরে বিদায় করে দিবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এতো মানুষ নয় আফ্রিকান সিংহ।

শিলা বৃষ্টির মত কিল ঘুষি লাথি তার দেহটাকে একেবারে পেঁজা তুলার মত ধুনা ধুনা বানিয়ে দিচ্ছে। সে প্রাণপন চেষ্টা করছে হাসানের আঘাত প্রতিরোধ করে প্রত্যাঘাত করতে কিন্তু কোথায়, পাথুরে বৃষ্টির মুখে নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছে না। পটেটো মারের চোটে কুকরে গিয়ে কখনো ঢাস করে টিনের বেড়ায় পড়ছে, লাথি খেয়ে উঠছে। আবার পড়ছে উঠছে, একেবারে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। মা হাসানকে ফিরানোর জন্য আসতে চাইছে কিন্তু ফেরদৌসি তাকে ঝাপটে ধরে রাখছে আর আনন্দে নাচছে। পটেটো উপায়ান্তর না দেখে বাইরের দরজা দিয়ে দৌড় দিতে চাইল। কিন্তু লাথি খেয়ে উঠানে মুখ থুবড়ে পড়ল। হাসান লাফ মেরে নেমে ফুটবলের মত লাথাতে লাগল, মারের চোটে ততক্ষণে পটেটোর মাংসল শরীরটা কুকুর কুণ্ডলীর মত কুকরে গিয়ে ফুটবল হয়ে গেছে। হাসান আরামসে তাকে ফুটবলের মত লাথিয়ে যাচ্ছে আর সে কাঠের টুকরার মত গড়াচ্ছে।

হাক ডাক শুনে মহিউদ্দি রাস্তা থেকে দৌড়ে এসে অবস্থা দেখে ভাবল, এখন দু’জনে হাসানকে ঘায়েল করতে পারবে। সে লাফ দিয়ে তাকে পেছন থেকে জাবরে ধরে চিৎকার করল, দুলাভাই উঠেন। কিন্তু ততক্ষণে দুইটা ব্জ্রমুষ্টি তার চাপায় পড়ল, তার মনে হল চাপার দাঁতগুলি ভেঙ্গে গেছে, কানপট্টি ফেটে গেছে, মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে এল। সে ‘ও বাবা গো’ চিৎকার করে দৌড়ে পালিয়ে গেল। হাসান দস্তুরমত ফুটবল লাথিয়ে যাচ্ছে। ততক্ষনে মা ফেরদৌসির বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে হাসানের পিঠে থাপড়াতে লাগল আর বকতে লাগল, ‘থাম থাম, হায়রে কি সর্বনাশ করছিস থাম। ফেরদৌসি দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁত বিজলাচ্ছে, মাথা ঝাকাচ্ছে আর বাম হাতের তালুতে ডান হাত মেরে মেরে চেচাচ্ছে, দে দে আরো জোরে দে, ফুটবল খেল’ বলছে আর আনন্দে নাচছে। মহিউদ্দি মার খেয়ে দৌড়ে গিয়ে কয়েক জন বন্ধু ডেকে এনে দড়ি সংগ্রহ করে বলল, আজই সুযোগ, যা করার আজই করতে হবে। যে কোন কৌশলে ওকে বেঁধে ফেলবি, নচেৎ এই সিংহটাকে আটকানো যাবে না।

মা যখন দেখলেন হাসান থামছে না তখন সামনের দিকে গিয়ে তাকে আটকাতে চাইলেন। শাশুড়িকে দেখেই পটেটো তার পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘আম্মা আম্মা আমাকে বাচান, ও আমাকে মেরে ফেলবে। মা সামনে থেকে দু’হাতে হাসানকে জড়িয়ে ধরলেন, সে থামল। মা চিৎকার করলেন, জানোয়ার, আমি দুধ কলা খাইয়ে সাপ পুষেছি, ভাল ভাল খাইয়ে হাতি বানিয়েছি। তোর এত বড় সাহস তুই আমার মেয়ের জামাইকে মারিস, আদব কায়দা শিখিস নাই’ হাসানের দু’গালে দুইহাতে চড়াতে লাগলেন আর বকতে লাগলেন। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ফেরদৌসির চিৎকার ‘হাসান সরে যা’ সে চকিতে পেছন ফিরে তাকিয়ে লাফ দিল। ফলে বাড়িটা মাথায় না লেগে হাঁটুতে লাগল, হাটুর বাটি নড়ে গেছে। সে আর্তনাদ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। মহিউদ্দি আবার বাড়ি দেয়ার জন্য বাঁশ উত্তোলন করল কিন্তু মা খপ করে তা ধরে ফেললেন। মহিউদ্দি চিৎকার করল, তোরা দাঁড়িয়ে কি দেখছিস তাড়াতাড়ি ওকে বেঁধে ফেল। আহত সিংহের উপর এক পাল শৃগাল হামলে পড়ল আর ত্রস্ত হাত চালিয়ে দড়ি পেছিয়ে বেঁধে ফেলল।

হাসান হাটুর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ফেরদৌসি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করতে লাগল, ‘ওকে বেধো না, ও তো তোমাদের কোন অন্যায় করেনি’ সে চিৎকার করে কাঁদছে আর বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে। এতক্ষণে পটেটো কিছুটা প্রকৃতিস্ত হয়েছে, তার শরীর ক্লান্ত, মাথা ঘুরছে। নাক মুখ মাথা থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে, জামা লাল হয়ে গেছে। সে হাসানের কাছে এসে ‘আজ তোকে উচিত শাস্তি দিব’ বলে দুইটা লাথি মারল। সাথে সাথে ফেরদৌসি পায়ের জুতা দিয়ে কয়েকটা বাড়ি মেরে চেঁচাল, ‘বাহাদুর ওকে মারছিস কেন, এত বাহাদুর হলে ওর বাধন ছেড়ে দে তারপর দেখ, এতক্ষণ তো বাহাদুরি দেখাই গেছিল। তারপর মায়ের দিকে তাকাল, ‘তোমার কারণেই এ অবস্থা হয়েছে, তুমি না থামালে ওকে বাঁধতে পারত না, সারা বাড়ির মানুষ এলেও ওর কাছে ঘেষতে পারত না। সে মাকে বকছে, কাঁদছে আর হাসানের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু অন্যরা বাঁধা দিচ্ছে।

মহিউদ্দি বিস্ফারিত চোখে ফেরদৌসির দিকে তাকিয়ে আছে। বিয়ের লাল শাড়ি পরনে, স্বর্ণালংকার গায়ে জড়ানো, মুক্ত কবরির বিশাল কেশদাম পৃষ্ঠোপরি ছড়িয়ে আছে, পৃষ্ঠ ও স্কন্ধ ঢেকে আছে। তার মধ্যে রক্তিমাভ মুখখানা পূর্ণিমা শশির মত চমকাচ্ছে যেন কৃষ্ণ সরোবরে লালপদ্ম। ক্রন্দনরত মলিন মুখখানি তার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। দেহ লতায় শ্রাবণের যমুনার মত উদ্দাম যৌবন ঢেউ খেলছে, বানের পানির মত রুপ যৌবন থৈ থৈ করছে, বর্ষায় পত্রাচ্ছাদিত ঝোপ ঝাড়ের ন্যায় দলমল করছে। মহিউদ্দি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সে ফুলকিত, শিহরিত রোমাঞ্চিত। সেই সাথে তার ভিতরের সিংহটা হুঙ্কার ছাড়ল, ফেরদৌসি আমার শধুই আমার। ওর জন্য আমি পৃথিবীতে প্রলয় ঘটাতে পারি, একশটা খুন করতে পারি। ও শুধুই আমার, হয় ওকে পাব, নচেৎ নিজের জীবন বিলিয়ে দিব। সে উপায় চিন্তা করতে লাগল।

পটেটোর মন চাচ্ছে হাসানকে মনের মত পিটাতে কিন্তু শাশুড়ি ও ফেরদৌসির জন্য কাছে ঘেষতে পারছে না। আবার এখন তাকে কি করবে বুঝতে পারছে না। সাহায্য করার জন্য সে মহিউদ্দির প্রতি কৃতজ্ঞ, অগত্যা তাকে বলল ‘মহিউদ্দি চল ওকে পিটিয়ে গ্রাম ছাড়া করে দিয়ে আসি। মহিউদ্দি বলল, দুলাভাই আপনি আসলেই একটা মুর্খ, ওকে তাড়িয়ে দিলেই বাঁচতে পারবেন নাকি, সে কখনোই ফেরদৌসিকে অন্যত্র বিয়ে দিতে দিবে না। - তাহলে উপায়? - উপায় হল ওকে পুলিশে দিব। - কেমনে, কি অপরাধে?- অপরাধ পড়ে চিন্তা করে বের করব, এই যেমন ধরেন আমাদের বাড়ির মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল বা তার অলংকার চুরি করেছিল বা অন্য কিছু একটা পরামর্শ করে বের করব। মহিউদ্দির এক সাঙ্গ বলল, কিন্তু এতে তো কেউ সাক্ষি দিবে না, ফেরদৌসি ও তার মা-ই উল্টা সাক্ষি দিবে। মহিউদ্দি বলল, তুই আরেকটা বোকা, আমরা কি বাড়িতে পুলিশ ডেকে আনব নাকি? থানায় নিয়ে গিয়ে আমরা কয়েক জন সাক্ষ্য দিয়ে আসব।

পটেটো লাফিয়ে উঠল, ঠিক ঠিক এটাই সঠিক বুদ্ধি। কিন্তু এখন তো যাওয়া যাবে না, রিকশা পাওয়া যাবে না, ঘাটে নৌকা পাওয়া যাবে না, তাহলে রাখব কোথায়? মহিউদ্দি বলল, ঘরে বেঁধে রাখব, সকালে নিয়ে যাব। ততক্ষণে বাড়ির অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে, সবাই জানে মহিউদ্দি ও তার দল উচ্ছনে যাওয়া বখাটের দল। তার কোন অভিবাবক নাই, বাপ ও বড় ভাই মারা গেছে, কাজেই এখন সে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী- যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায়, কারো কথা মানে না। এদের অনিষ্টের কারণে সবাই ভয় পায়, কেউ কিছু বললে পরে অনিষ্ঠ করে। তাই অনেকেই সুপারিশ করার সাহস পেল না। কেউ কেউ ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করতে লাগল। মা কাঁদছে আর অনুনয় করছে, কিন্তু তারা কারো কথা শুনছে না। ফেরদৌসি বিলাপ করে কাঁদছে আর বাধন খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু তাকে আটকে রাখা হচ্ছে। দড়ি দিয়ে হাসানের বুক থেকে পা পর্যন্ত সম্পূর্ণটা পেছিয়ে বাঁধা। মহিউদ্দি ধমকিয়ে বাড়ির সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে বলল, ওকে ধরে ঘরে নিয়ে চল। তখন কয়েকটা কুকুর হাসানকে চ্যাং দোলা করে ঘরে নিয়ে গেল। কিন্তু হাসানের রুমে বেঁধে রাখার মত কোন সুবিধা জনক জায়গা পেল না। পাশের রুমে নিয়ে গেল, সেখানে পশ্চিমের বেড়ার সাথে সুবিধা জনক একটা সিমেন্টের খাম আছে। তারা আরো দড়ি এনে খামের সাথে পেছিয়ে পেছিয়ে বাধল।

ফেরদৌসি আকুল হয়ে কাঁদছে আর তাদের হাতে পায়ে ধরছে হাসানকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু তারা কথা তো শুনছেই না বরং আরো সম্ভ্রমহানি করছে। এতক্ষণ বাইরে ময়দানে ছিল বলে কেউ তার গায়ে হাত দেয়নি। কিন্তু ঘরে নিরিবিলি পেয়ে ‘এই তুই যা’ বলে হাত ধরে টানে, গায়ে হাত দেয়, স্পর্শকাতর জায়গায় হাত মারে। সুন্দরি যুবতীর অঙ্গ স্পর্শে তারা ফুলক অনুভব করে। সে দুঃখে অপমানে মাটিতে পড়ে কাঁদে। মা কখনো জামাইকে কখনো অন্যদের অনুনয় করে কাঁদে। তখন জামাই বা অন্যরা তাকে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে বলে, আপনি চুপ করে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকেন, এসব ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না। ফেরদৌসি একবার রাগে দুঃখে দৌড়ে এসে হাসানের বাধ খুলতে লাগল, মহিউদ্দি গিয়ে তার গায়ে হাত মেরে বলল, এই তুই যা। দুঃখে অপমানে লজ্বায় ঘৃনায় সে ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর মায়ের রুমে দৌড়ে গিয়ে মাটিতে গড়াতে লাগল আর চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, অসহায় পরিবারটির সাহায্যে কেউ এগিয়ে এল না। মা আবার এলেন কিন্তু তখন তারা পথে পাহারা বসিয়েছে, এ রুমে আগমন একদম বন্ধ করে দিল। এরপর সবাই মিলে আলাপে মশগুল হল।

পরদিন সকালে হাসানকে নিয়ে থানায় যাবে, কে কে যাবে, কিভাবে সাক্ষ্য দিবে, তার বিরুদ্ধে কি কি অভিসংশন দায়ের করা হবে ইত্যাদি নিয়ে আলাপ হল। তারপর আলাপ উঠল, হাসান কত খারাপ, তার নাম গোত্রের পরিচয় নাই রাস্তার ভিখারি অথচ ফেরদৌসির মত কুলিন সুন্দরি মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। এবার জন্মের মত বিয়ের সাধ মিটবে, জেলে বসে বসে ফেরদৌসির নাম জপ করতে করতে মৃত্যুর মুখ দেখতে হবে’ ইত্যাদি আলাপ করতে করতে মধ্য রাত পার হয়ে গেল। পটেটো হাই তুলতে তুলতে বলল, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে আমি শুতে গেলাম’ বলে সে হাসানের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। অন্যরাও বলল ‘এখানে এত লোক তো থাকার দরকার নাই, আমরা ঘুমুতে গেলাম। থাকল শুধু মহিউদ্দি ও তার চামচা শাহিন। তারা দু’জন বিছানায় শুয়ে আলাপ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

বিষয়: সাহিত্য

৯৩৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384241
১৯ অক্টোবর ২০১৭ সকাল ০৫:৩৮
টাংসু ফকীর লিখেছেন : ধন্যবাদ জনাব৤ আমি খুব পছন্দ করি হাসান ফেরদৌসি৤

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File