হাসান ফেরদৌসি - ১০

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৬ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:২৭:১৮ দুপুর

১৬

পরীক্ষার পর পরিক্ষার্থিরা বিভিন্ন জায়গায় বেড়ায়, ক্লান্তি কাটায়, আনন্দ স্ফুর্তি করে। ফেরদৌসি ও বেড়ানোর জন্য গো ধরল। তার ইচ্ছা অনেক দিন ধরে নানু বাড়ি যায় না, মামাত বোনদের জন্য তার পরান পোড়ছে, সেখানেই বেড়াবে। তাদের সাথে খেলাধুলা করবে, বাগান বাড়ি বেড়াবে, নৌকায় চড়ে নদীতে ঘুরবে, আনন্দ করবে, কয়েকদিন পর চলে আসবে। সে হাসানকে ফুসলায়, চল আমরা দু’জন যাই। তুই গেলে আমজাদ ভাইয়্যারা খুব খুশি হবে, তোকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠবে, অনেক মজা হবে। তারপর কয়েক দিন থেকে আমরা চলে আসব। হাসান যেতে চায় কিন্তু বাধ সাধেন মা। তার কথা হল, তিনি কয়েক বছর ধরে বাপের বাড়ি যান না, এ সুযোগে মাকে দেখে আসবেন। অবশেষে মায়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হল। পাশের ঘরে চাল ডাল দিয়ে বললেন ‘তোর চাচির ঘরে খাওয়া ধাওয়া করিস, আমি সপ্তাহ খানেক থেকে ওকে নিয়ে চলে আসব। তারপর তার যক্ষের ধন হাঁস মুরগি গুলি ঠিক মত খোঁয়াড়ে তোলার তাকীদ দিয়ে দুপুরে তারা বের হল। হাসান বাজার পর্যন্ত গিয়ে তাদেরকে রিকশায় তুলে দিয়ে আসল।

আজ আটটি বছর ধরে হাসান ফেরদৌসি ছায়ার মত একে অন্যের সাথে লেগে আছে, কখনো বিচ্ছিন্ন হয়নি। সেই শৈশব থেকে দুজন এক সাথে থেকেছে, খেয়েছে, হেসেছে, খেলেছে, নেচেছে, খোঁচাখোঁচি করেছে, মারামারি করেছে। যখন একটু বড় হল তখন তারা নিজের অজান্তে প্রাকৃতিক নিয়মেই একে অন্যের প্রতি হৃদয়ের গভীর টান অনুভব করল। তারপর যখন পিতামাতার মুখে তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত শুনতে পেল তখন আর তারা পৃথক স্বত্তা থাকল না, দুটি আত্মা একাত্মা হয়ে গেল, দুটি স্বপ্ন এক হয়ে গেল, দু’টি আশা আকাঙ্ক্ষা এক হয়ে গেল, একে অন্যের মধ্যে হারিয়ে গেল। তখন থেকে তারা পরস্পরকে না দেখে থাকতে পারে না, পরস্পরের কথা না শুনলে ভাল লাগে না, একে অন্যকে নিয়ে স্বপ্ন না দেখলে চোখের পাতায় ঘুম নামে না। ফেরদৌসি নেই, বিশাল বড় ঘরটা খা খা করছে, সব কিছুই শূন্য ও উজার মনে হয়। হাসান বিষণ্ণ হয়ে ঘরময় ঘোরে, একাকি কিছুই ভাল লাগে না। ফেরদৌসির অপ্সরীসম তন্বি দেহটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে, ফেরদৌসির কল হাস্যের লহরি কানে বাজে, ফেরদৌসির মান অভিমান তার হৃদয়ে বাজে। যেদিকে তাকায় শুধু ফেরদৌসি, ডানে বামে উপরে নীচে, দিবসের আলোয় নক্ষত্রের দীপালিতে শুধু ফেরদৌসি আর ফেরদৌসি। তার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই ফেরদৌসি। একাকি বিষময় ঠেকে, সে তার প্রিয়ের পথ পানে তাকিয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে থাকে।

পঞ্চম দিন দুপুরে খাওয়ার সময় চাচী বললেন, ইঞ্জিনিয়ারের বড় ছেলে এসেছিল ফেরদৌসি ও তার মাকে নিয়ে যেতে, তাদের কোন মেয়ের নাকি বিয়ে। তারা নানা বাড়ি গেছে শুনে সেখানেই চলে গেছে, ওখান থেকে নিয়ে যাবে। হাসান ভাবল, ভালই হয়েছে, বিয়েতে গেলে তো ফিরে আসতে আরো কয়েক দিন লাগবে, সে প্রমাদ গুনল। আসলে বিয়েতে শুধু ফেরদৌসির মা গিয়েছে সে যায়নি। তখন সে মামাত বোনদের সাথে খেলায় মত্ত, সারাদিন বাগান বাড়িতে খেলাধুলা করে, নদীতে নৌকা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মা একাই বিয়েতে গেল, আবার কন্যার সাথে তাকে জামাই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল, কন্যা সম্পর্কে তার নাতনি। ফলে তাদের আসতে দেরি হচ্ছিল। এদিকে হাসানের আর তর সইছে না, তার নাভিশ্বাস উঠেছে। দশ দিন চলে গেল, দুপুরে সে খাওয়া দাওয়ার পর বিষণ্ণ হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে, আজ দিনটা দেখবে, যদি না আসে তাহলে কাল সে নিজেই গিয়ে নিয়ে আসবে।

হঠাৎ দরজায় ভুতের মত কাল মুর্তি, ঘরে ঢুকেই নেকাবটা খুলে হাসানের দিকে কটাক্ষে তাকিয়ে রইল, চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। হাসান ‘আরে তুই এসে গেছিস, আম্মা কোথায়, নাকি একাকি এলি’ বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ফেরদৌসি ফুফিয়ে কেঁদে উঠে ‘পাষাণ, এতদিন গেলি না কেন’ বলে হাত পা নাচিয়ে ঝংকার মেরে পাশের রুমে চলে গেল। বোরকা খোলে বিছানায় পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। হাসান ব্যাভাচেকা খেয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত তার পিছু পিছু গেল। ফেরদৌসি বিছানায় উপোর হয়ে পড়ে কাঁদছে। সে বিছানায় উঠে প্রেয়সীর চওড়া পিঠে বুক ঠেকিয়ে অন্তহীন মমতায় জড়িয়ে ধরল, তারপর থুতনি ধরে মুখটা নিজের দিকে টেনে এনে গোলাপ গণ্ডে চুম্বন করে বলল, ‘কি হয়েছে, কাঁদছিস কেন? ফেরদৌসি উঠে বসে অভিমানের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝংকার দিল ‘কাদব না, তোর কি, তুই তো ছেলে মানুষ, আর ছেলেরা হয় পাষাণ। এতটা দিন আবার না দেখে থাকে কেমনে’ বলে সে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে হাসানের বুকে মাথা রাখল ‘আমি তোকে ছাড়া বাচব না, আমার বুকটা পোড়ে গেছে’ বলতে বলতে হাসানকে জড়িয়ে ধরে অভিযোগ করতে লাগল, ‘আম্মা বিয়েতে চলে গেল। এরপর থেকে আমি রাস্তার পানে তাকিয়ে আছি কিন্তু তার (হাসানের) কোন পাত্তা নাই। আমি কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছি। তারা মনে করেছে আমি বাড়ির জন্য কাঁদছি। অবশেষে মামা এসে এগিয়ে দিয়ে গেল।

আবার সে হাসানের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল, ‘আমার কি হয়েছে জানি না, আমি তোকে না দেখে থাকতে পারি না, প্রথম কয়েক দিন মামাত বোনদের সাথে ঘোরাফিরা করে ভালই কাটল। তারপর শুধু তোর কথা মনে পড়ে, একেক বার মনে হয়েছে যেন আমার কলজেটা পোড়ে যাচ্ছে, ভিতরটা ফাকা হয়ে যাচ্ছে। আমি মরে যাব, আমি আসলেই তোকে ছাড়া মরে যাব, একদিনও বাচতে পারব না’ বলতে বলতে সে অঝোরে কাঁদতে লাগল। আসলে দীর্ঘ পৌনে এক যুগে এ দুটি যুবক যুবতি একে অন্যের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে, তারা এখন আর পৃথক সত্তা নয় একক সত্তা। কয়েক দিনের বিচ্ছেদে তারা একে অন্যের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে, অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে যে তারা পরস্পরকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে না- যেভাবে মাছ পানি বিহীন বাঁচতে পারে না। হাসানও তার হবু বধূর মাথা ও মুখে হাত বুলাচ্ছে, আদর করছে আর শান্তনা দিচ্ছে, ‘আরে আমি তো আম্মার অপেক্ষায় আছি, নচেৎ কবেই গিয়ে নিয়ে আসতাম। অনেকক্ষণ আদরে আহলাদে ফেরদৌসির বিষাদ কালিমাচ্ছাদিত মুখখানি পুর্নেন্দুর মত দীপ্তিমান হয়ে উঠল।

এরপর সে প্রিয়জনের আলিঙ্গনোষ্ণ হয়ে প্রগলভতা শুরু করল, মামাত বোনদের সাথে কোথায় কোথায় ঘোরেছে- সেসব বিবরন দিল। তারপর মামাত ভাইদের আলাপ শুরু করল ‘আমজাদ ভাই রাগে ফায়ার, এতদিন হয়ে গেল তুই যাসনি কেন। সুযোগের অভাবে সে আসতে পারছে না। সুযোগ পেলেই এসে তোকে নিয়ে যাবে, আর এতদিন না যাওয়ার কারণে তোকে নাকি কান ধরে মাফ চাইতে হবে। বড় খবর হল গত দুই বছর হাডু ডু খেলা হয়নি। প্রতিপক্ষরা তোকে ভয় পেয়ে গেছে। তারা জানে যে খেলা হলেই আমজাদ তোকে নিয়ে যাবে, আর তোর যাওয়া মানে তাদের হার নিশ্চিত। তোর সাথে খেলবে এমন কোন প্লেয়ার নাই, এজন্য সেই ইউনিয়নের লোকেরা পিছিয়ে গেছে। তবে আমজাদ ভাই নাকি চেষ্টা করছে, ওরা যদি রাজি হয় তাহলে তোকে নিয়ে যাবে।

সে প্রিয়তমের সান্নিধ্যে হাসছে, চাদের মত হাসছে, যে হাসিতে মুক্তা ঝড়ে। হাসান শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে আর তার ভিতরটা তোলপাড় করে যাচ্ছে। বাকি দিন কাটল ফেরদৌসির উচ্ছসিত আবেগ আর কলহাস্যে। বিচ্ছেদের পর হাসানকে পেয়ে তার ভিতরটা আলোড়িত হয়ে উঠেছে, সেই আলোর বিচ্ছুরন সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। তন্বি দেহে নব যৌবন আষাঢ়ে যমুনার মত ঢেউ খেলছে।

সন্ধ্যায় ফেরদৌসি যতক্ষণ রান্না করল হাসান ততক্ষণ তার পাশে বসে রইল। চুলোর আগুন যখন বেড়ে যায় তখন তার প্রতিবিম্বে ফেরদৌসির লাল গণ্ড আরো লোহিত বর্ন ধারন করে, আগুন যখন কমে যায় তখন মলিন দেখায়। হাসান বসে বসে প্রিয়ার মুখের এই বিচিত্র রুপ দেখে, তার চোখ দুটি অনন্ত পিয়াসি হয়ে উঠে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তারা নিজ নিজ রুমে গিয়ে শয়ন করল। হাসান অভ্যাসমত হারিকেনটা ড্রিম করে রাখল। কিছুক্ষণ পর হারিকেনের আলো বেড়ে গেল। হাসান তাকিয়ে দেখল বগলে বালিশ চেপে ফেরদৌসি দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর সুরে বলল, আমি একা থাকতে পারব না, আমার ভয় করে। হাসান বলল, ভয় কিসের আমি তো আছিই। এরপর আর কেউ কথা বলল না, কিছুক্ষণ নীরব কেটে গেল। হঠাৎ ফেরদৌসি হারিকেনটা ড্রিম করে ‘আমি এখানেই থাকব, একা আমার ভয় করে’ বলে হাসানের পাশে শুয়ে পড়ল।

একি হল, এটা কি করে সম্ভব। খালী ঘর, আশপাশে কেউ নেই, বিপজ্জনক বয়সের দুটি যুবক যুবতি একই বিছানায়- শীঘ্রই যাদের বিয়ে হবে। হাসান চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আর ফেরদৌসি তার দিকে ফিরে কাত হয়ে শুয়েছে। কেউ কারো সাথে কথা বলে না, নীরব নিস্পন্ধ, পিন পতন নীরবতা। শুধু নিশ্বাসের শব্দ শুনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ফেরদৌসির হাতটা উঠে গেল হাসানের বুকের উপর। হাসান নীরব শুয়ে আছে, নড়াচড়া করছে না। আরো কিছুক্ষণ পর হাতটা চলে গেল হাসানের মাথায়। অসীম মমতায় মাথায় হাত বুলাচ্ছে, চুলের ফাকে ফাকে আঙ্গুল চালাচ্ছে। এটা একটা অবস্থা, যে অবস্থায় কোন ফেরেস্তা, অলী আওলিয়া, গওস কুতুব বা যত বড় দরবেশই হউক না কেন, ঠিক থাকে না, থাকতে পারে না, থাকা সম্ভব নয়। অপ্সরী সুন্দরি ষোড়শী, ভরা নদীর মত ভরভর যৌবন। কাঞ্চন দেহ লতায় যৌবন ভার কচু পাতায় শিশির বিন্দুর ন্যায় টলমল করছে, মৃদু মলয় স্পন্দনে ঝড়ে পড়বে। পক্ষান্তরে একুশ বছরের টগবগে যুবক, পাগলাটে বয়স, উদ্দাম যৌবন। অথচ দু’জনার মধ্যে কোন অন্তরায় নেই।

হাসান শুয়ে আছে, কিন্তু তার ভিতরের সিংহটা আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠল। ফোলে ফেপে উঠছে, রোষে উঠছে, শিকার ধরার জন্য ওঁত পেতেছে, শরীর মোচড়াচ্ছে, বুকের ভিতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে, দম আটকে আসছে, নিশ্বাস গভির হচ্ছে, শরীরটা ধনুকের মত বেকে যাচ্ছে, এবার সিংহ ঝাপ দিবে। কিন্তু না ‘এটা পাপ এটা অন্যায়, এটা সীমালঙ্ঘন, এটা খোদার অবাধ্যতা, এটা খেয়ানত, কেউ নিজের জিনিস নিজে খেয়ানত করে না, অপবিত্র করে না- তাহলে আমি কেন করব। দুদিন পর আমাদের বিয়ে হবে, তবে কেন দুদিনের জন্য আমার পাত্র, আমার ভবিষ্যৎ বংশধরের পাত্র কলুষিত করব, যা আমার তা আমি অপবিত্র করতে পারি না, দু’দিনের জন্য পাপ অর্জন করতে পারি না’ সে চিন্তা করতে করতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ সে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে হারিকেনের আলো বাড়াল। চার চোখের মিলন হল কিন্তু লজ্বায় উভয়েই দৃষ্টি অবনত করল। হাসান দেখল, মদনাসক্ত ফেরদৌসির চোখ ঢুলুঢুলু করছে, মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে, থমথম করছে। লজ্বায় গালে রক্ত জমা হয়ে গেছে, রক্ত জবার মত লাল হয়ে উঠেছে। কারণ তারা একে অন্যের কাছে যা যাচ্ছে তা অতিশয় লজ্বার, অতিশয় গোপন। নতুন বয়স নতুন যৌবন, আর এ সময় পরস্পরের কাছে প্রথম যাচিত বিষয়টা হয়ে উঠে সীমাহীন লজ্বার। আর এ জন্যই তারা একে অপরের প্রতি তাকাতে পারছে না।

হাসান নীরব হয়ে চেয়ারে বসে আছে আর ফেরদৌসি শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর সে বলল, দু’জন এক সাথে থাকা যাবে না, তুই তোর রুমে যা’ তার কণ্ঠ কাঁপছে। ফেরদৌসি কথা বলল না। সে বারবার বলার পর উত্তর দিল, আমি একা থাকতে পারব না, আমার ভয় করে। হাসান ধমক দিল, আম্মার রুমে থাকতে ভয় করলে পাশের রুমে যা, এখানে কাছাকাছি থাকলে ভয় করবে না।কিন্তু ফেরদৌসির কোন সাড়া নেই, সে চরম অভিমানী হয়ে শুয়ে আছে। আরেক বার হাসান দাঁড়িয়ে বলল ‘ঠিক আছে, তুইই এখানে থাক আমি পাশের রুমে যাচ্ছি। তখন সে উঠে বালিশটা নিয়ে হাসানের প্রতি কটাক্ষে দৃষ্টিপাত করে চলে গেল। সেই দৃষ্টিতে ঘৃণা ও অবজ্ঞা ঝড়ে পড়ছে।

ফেরদৌসি হাসানকে ছাড়া এক মুহুর্ত থাকে না। অথচ পরদিন সকাল থেকে তার কাছে একবারও আসেনি। হয়ত লজ্বায় অথবা হাসানের কাপুরুষ সুলভ আচরণের কারণে। সকালে হাসান খেতে গেল, তখন সে ভাত বেড়ে দিয়ে চুলার ধারে বসে অন্য দিকে ফিরে রইল। কারো মুখে কোন কথা নেই। কিছুক্ষণ পর সে ওড়নায় ঘোমটা টেনে বলল, ‘আমাদের বিয়ে কবে’ তার কণ্ঠে তিক্ততা ও রুক্ষতা। হাসান বলল, তার আমি কি জানি, আম্মাই বলতে পারবে। সে ভেংচি কাটল, আম্মাই বলবে, আম্মাকে না জানালে সে কি ঘোড়ার ডিমটা বলবে। এ তারিখে আম্মা আসলে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয় যেন বলে দিলাম’ বলে সে উঠে হনহন করে চলে গেল।

দু’টি যুবক যুবতি কঠিন চাপে আছে। কি যেন একটা চরম ও পরম লোভনীয় কিন্তু আত্মহত্যার ন্যায় সর্বনাশা কাজে তারা হাত দিতে চায়, তবে ভয় পায় এক পা এগোয় তো দুই পা পিছায়। তাদের পরম আরাধ্য বিষয়টা নাগালের সীমানায়, মুঠির মধ্যে- যা চাইলেই পাওয়া যায় কিন্তু এটা অসামাজিক, এটা অন্যায়, এটা পাপ। তারা দুটানায় দুদোল্যমান। আর এই চাপেই তারা হয়ে গেছে নির্বাক, নিস্পন্দ, স্থবির। একে অন্যের সাথে কথা বলে না, বিষণ্ণ ও গম্ভীর হয়ে আছে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর হাসান তার রুমে গিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর ফেরদৌসি গেল, গম্ভীর মুখে মুচকি হাসল। কিন্তু এই হাসিটা বৃষ্টির সময় সূর্য কিরনের ন্যায় বেমানান। তারপর বলল, আজ তোকে একটা সারপ্রাইজ দিব। - কি সারপ্রাইজ? - দেখলেই বুঝবি। তবে আমি না ডাকলে আসবি না’ বলে সে চলে গেল। আর হাসান সারপ্রাইজ দেখার আশায় বসে রইল।

ফেরদৌসি ভাইয়্যা ডাকটা বর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, এখন শুধু হাসান ডাকে। তবে এখন সমস্যা হল তুই ডাকটা, এটা হঠাৎ বদলানো সম্ভব নয়। কারণ একে তো হঠাৎ তুমি বলতে জিহ্বা ঘুরবে না, দ্বিতীয়ত বিয়ের আগেই তুমি বললে অন্যেরা হাসাহাসি করবে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিয়ের পর হাসান যদি তাকে তুই তুখারি করে তবে সেও তুই ডাকবে। আর যদি তুমি ডাকে তবে সেও তুমি ডাকবে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর পাশের রুমে আওয়াজ হল ‘হাসান’। সে উঠে গেল আর সাথে সাথে তার চোখ যেন ধাধিয়ে গেল। সে হতবিহ্বল হয়ে অপলক নেত্রে হবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। সে বিয়ের শাড়ি পড়েছে, মায়ের গহনাগুলি গায়ে জড়িয়েছে, মেকাপ লিপস্টিক ইত্যাদি দিয়ে নববধূ সেজে দাঁড়িয়ে আছে। হাসানের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। নব যৌবনা মধুকরি, তন্বি লতিকায় উদ্দাম যৌবনের ঢেউ খেলছে, ভরা নদীর মত রুপ তরঙ্গ ফুলে ফেপে উঠছে, বানের পানির মত যৌবন জ্বালা উপছে পড়ছে। এ পুর্নেন্দু কৌমুদী নয় এ মধ্যাহ্ন দিবাকর রশ্মি। প্রদোষ মিহির প্রভার ন্যায় গোলাপি আভা ছড়াচ্ছে, নরপতঙ্গ দহনেচ্ছু শিখাবৎ জ্বলছে। মোহ, রুপের মোহ। যাদু, রুপের যাদু। সুধা, রুপের সুধা। রুপ আর সুধা, কে বড়? রুপ আর সুধা, পার্থক্য কত? হাসানের মাথা ঘুরিয়ে যায়, যেতে হয়, যেতে বাধ্য, পুরুষ মাত্রেই মাথা ঘুরায়।

সে বিদ্যুৎ পিষ্টের ন্যায় তাকিয়ে আছে। ফেরদৌসি বসে তাকে সেলাম করল, আস্তে আস্তে উঠে হবু স্বামীর বুক ঘেঁষে দাঁড়াল। হাসান বাহ্যিক অনুভুতি হারাল। সে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে গোলাপ রাঙ্গা কপোল দেশে ওষ্ঠাধর চেপে ধরল। প্রবল বাত্যা- মলয় পীড়নে বৃক্ষ পত্রের ন্যায় তার ঠোঁট দুটি স্ত্রী অঙ্গে সঞ্চালিত হতে থাকল। উভয়ের বাহ্যিক অনুভূতি উধাও হল, নিয়ন্ত্রন হারিয়ে তারা পৌঁছে গেছে সুখানিভুতির কুহেলিকাচ্ছন্ন মখমল মোলায়েম কোন ভুবনে। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বিছানার পাশে এসে বসল, উভয়ের বাহু বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠল। নিঃশ্বাস গরম হচ্ছে, স্নায়ু ঢিলা হয়ে আসছে, চারটি অধরোষ্ট একাকার হয়ে গেছে।

তারা জড়াজড়ি করে নিজেদের অজান্তেই বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। আর সাথে সাথে বাইরে দক্ষিন দরজায় টোকা পড়ল। দ্বিতীয় টোকার সাথে ‘এই হাসান দরজা খোল’ আওয়াজ এল। হাসান লাফিয়ে উঠে ফিসফিসিয়ে আর্তনাদ করল ‘সর্বনাশ আম্মা এসে গেছে’ বলে উত্তর মুখি দৌড় দিল। একটু গিয়ে আবার ফিরে এসে ফেরদৌসিকে হাত ধরে টেনে নিয়ে সর্ব উত্তরে মায়ের রুমে গিয়ে বলল, ‘এখন বুঝবি মজা, তাড়াতাড়ি এগুলি খোলে তারপর গিয়ে দরজা খোল। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি সে বাইরে। দরজা খোলতে দেরির কারণ জিজ্ঞেস করলে বলবি ঘুমিয়ে পরেছিলাম’ বলে হাসান উত্তর দিকে দৌড়াল। রান্না ঘরের পিছনে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটা রাস্তা আছে, সেই রাস্তা হয়ে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে চলে গেল।

ঘটনা হল, ফেরদৌসির মা কন্যার সাথে ফিরে এসে এক নাতিকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেলেন এই উদ্দেশ্যে যে, ফেরদৌসিকে নিয়ে বাড়িতে আসবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে যখন শুনলেন, সে এসে গেছে তখনি তার মাথা ঘুরিয়ে গেল। বিবাহেচ্ছু দুটি যুবক যুবতি খালী বাড়িতে খালী ঘরে থাকলে না জানি কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে - এই আশংখায় তিনি উর্ধ্বশ্বাসে বাড়িতে ছুটে এলেন। ঘরে ঢুকেই তিনি মেয়েকে প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, দুই রাত কোথায় আছিলি? ফেরদৌসি বলল, আমি আমার রুমে ভাইয়্যা তার রুমে ছিল। মা খেকিয়ে উঠলেন, কেন, তুই তোর চাচীর সাথে থাকতে পারলি না, আমি নাই তুই খালী ঘরে থাকলি কেন? আমাকে ছাড়া একা আসলি কেন, দুই দিন অপেক্ষা করতে পারলি না কেন’ ইত্যাদি বলে বকতে লাগলেন। তারপর আরো কিছু প্রশ্ন করে তার সন্দেহ প্রবল হয়ে উঠল। তিনি দুঃখে কষ্টে একেবারে পাথর হয়ে গেলেন। বিয়েতে যাওয়ার জন্য নিজেকে তিরস্কার করতে লাগলেন আর ফেরদৌসিকে যাচ্ছে তাই গালিগালাজ করতে লাগলেন।

হাসান বাইরে ঘোরাফিরা করে ঘণ্টা খানেক পর এসে দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল, ফেরদৌসি দরজা খোল। মা দরজা খোললে সে হন্তদন্ত হয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মা কখন এলেন, এই রাতে কিভাবে এলেন’ যেন একজন সাধু শন্ত- কিছুই জানে না, কিছুই বুঝে না। মা সালামের উত্তর না দিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি নাই তুই ফেরদৌসিকে ঘরে রাখলি কেন, তোর চাচীর সাথে রাখতে পারলি না? সে বলল, সে তার রুমে আমি আমার রুমে সমস্যা কি। তিনি বললেন, সমস্যা কি জানস না, খোঁচাখোঁচি ছাড়া তো তোদের পেটের ভাত হজম হয় না। কিছুক্ষণ তিরস্কার করে তিনি চলে গেলেন আর হাসানও হাফ ছেড়ে বাঁচল। পরদিন থেকে তিনি আরো কঠোর হয়ে উঠলেন, এখন তাদেরকে চোখে চোখে রাখেন। দিনের বেলায়ও দু’জনকে নিভৃতে এক্ত্র হতে দেন না। কারণ শিয়ালের মুখে মুরগি দিয়ে, বাঘের মুখে ছাগল দিয়েও তিনি বিশ্বাস রাখতে পারেন কিন্তু কোন যুবক যুবতিকে বিশ্বাস করতে রাজি না।

বিষয়: সাহিত্য

১০১৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384214
১৬ অক্টোবর ২০১৭ দুপুর ০২:২২
দিল মোহাম্মদ মামুন লিখেছেন : এত্ত বিশাল! দুই পর্বে পোস্ট করলে পড়তে সুবিদা হতো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File