হাসান ফেরদৌসি - ৪
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৬ অক্টোবর, ২০১৭, ০৫:০৮:২১ বিকাল
৭
মাঘ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ। এ সময় বিশাল ফকির বাড়ির জোয়ান বুড়া পোলা সবাই বারোয়ারি আনন্দে মেতে উঠে। শুধু গৃহকর্ত্রিরা ভিত সন্ত্রস্তভাবে সতর্কতার সাথে নিজেদের খোয়াড় আগলে রাখে। হাসান এশার নামায পড়ে মসজিদ থেকে আসছে, পথে তার বন্ধু একটা ছেলে কানে কানে বলল, বলত কালকে কী? হাসান ঠোঁট উল্টে বলল, আমি কি জানি। ছেলেটা বলল, কাল পিকনিক। ‘ইয়াহ হো’ চিৎকার করে সে দুহাত উর্ধ্বে ছুড়ে লাফিয়ে উঠল। অনেক মজা হবে, প্রতি বছরের ন্যায় সে ফেরদৌসিকে নিয়ে অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সাথে উদ্দাম আনন্দে মেতে উঠবে। হঠাৎ তার খোঁয়াড়ের কথা মনে হল, অমনি গমগিন হয়ে বাড়িতে ছুটল। গিয়ে মাকে বলল, আম্মা কাল কিন্তু পিকনিক। মা চমকে উঠে মাথায় হাত দিলেন, সর্বনাশ এখন উপায়। হাসান কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘উপায় তো একটা বের করতেই হবে, আচ্ছা মুরগি গুলি রান্না ঘরে খাচার নিচে আটকে রেখে ঘর তালা মেরে রাখলে কেমন হয়? মা বললেন, হ্যাঁ চল তাই করি। হাসান গোয়াল থেকে গরুর খড়ের বড় বড় দুটি খাঁচা এনে রান্না ঘরে রাখল। রাত্রি বেলা মুরগির গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ধরে নিলে কোন আওয়াজ করে না বরং অতি আরামে গলা দিয়ে একটা কর কর শব্দ বের হয়। সেই কৌশলে মা খোয়াড় থেকে একটা একটা করে মুরগি ধরে দেন আর তার মেয়েরা নিয়ে খাচার নিচে রাখে। তারপর রান্না ঘরে তালা দিয়ে রাখল।
প্রতি বছর গ্যাং পার্টি শীতের শেষে পিকনিকের আয়োজন করে। গ্যাং পার্টি হল ফকির বাড়ির যুবক তরুণের দল। বড় বাড়ি আর খান্দানি বংশের ছেলেরা লেখা পড়ায় খুব কমই মনোযোগি হয়, তারা সারাদিন দল বেঁধে ঘুরে, আনন্দ স্ফুর্তিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকে। সারাদিন হা ডু ডু, দারিয়া বান্দা, ফুটবল ইত্যাদি খেলায় মেতে থাকে, রাত নামলে গিয়ে বসে তাসের আড্ডায়। এতে অভিভাবকরা কয়েক দিন ভাত বন্ধ রাখলেও সমস্যা নাই। বিশাল বড় বাড়ির অনেক রান্না ঘর, কোন একটাতে ঢুকলেই আর পেটের চিন্তা থাকে না। এভাবে সমবয়সী যুবকদের নিয়ে একটা দল গড়ে উঠে। পুর্ব থেকেই চলে আসা নিয়মানুযায়ী ফকির বাড়ির প্রত্যেক প্রজন্ম একটা করে দল গড়ে তোলে আর এদের একজন করে লিডার থাকে। বর্তমান দলের লিডার হল আলবার্ট, মহামান্য আলবার্ট।
গোপালভোগ আমের মত ঠসঠসে গায়ের রং দেখে আপনি বিভ্রান্ত হবেন যে লোকটা কি মিসরি নাকি, ললাট ও কাঁধ অবধি যুলফি দেখে আপনি চমকে উঠবেন, আরে নায়ক রাজ রাজ্জাক এখানে কেন। আবার বলিষ্ঠ গড়ন, চওড়া কাঁধ ও বুকের পাটাতন দেখে যে কেউ ক্লে মুহাম্মদ আলি বলে ভুল না করলেও অন্তত তার মায়ের পেটের ভাই বলতে কসুর করবে না। আর তার কণ্ঠ হল, শ্মশান ভুতের গলার ন্যায় ভরাট। সে যখন ক্রোধে কথা বলে, ভ্রম জাগে মেঘ গর্জন হচ্ছে কিনা। এই আলবার্ট হল ইয়াং দলের নায়ক।এই নেতৃত্ব ইলেকটেড বা সিলেকটেড নয়, তার প্রতিভাই তাকে নেতৃত্বের আসনে অভিষিক্ত করেছে। এই দলটিকে সবাই গ্যাং পার্টি বলে, তারা নিজেদের কোন নামকরণ করেনি এলাকাবাসীই তাদেরকে এ উপাধি দিয়েছে। কারণ তারা হল হরফন্ন মোল্লা বা সর্ব কাজের কাজি। তাদের প্রধান কাজ হল, অভাবি, দুঃখি ও বিপন্ন মানুষের সেবাদান।
যেমন কোন দরিদ্রের ঘরে ভাত না থাকলে গ্যাং পার্টীর কোন সদস্য তাকে নিয়ে গিয়ে কোন স্বচ্ছল কৃষককে বলবে ‘ওকে দশ কেজি চাল দিয়ে দেন। কোন দরিদ্র বিধবা থাকলে কয়েক জন সামর্থবানকে দায়িত্ব দেয়া হবে তারা বিধবাকে মাসে পাঁচ কেজি চাল ও দুই শত করে টাকা দিবে। কেউ অ্যাকসিডেন্ট করলে বা অসুস্থ হলে বা মহামারি দেখা দিলে- ব্যস অন্য কারো যাওয়ার দরকার নাই, ডাক্তার ডাকা, হাসপাতালে নেয়া, ঔষধ আনা সব কিছুই গ্যাংয়ের সাঙ্গরা করবে। বন্যা বা অন্য কোন বিপদাপদ দেখা দিলে সবাই চাচা আপনা জান বাছা কিন্তু গ্যাংয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোজ নিচ্ছে, ভাসমান মানুষকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে, তাদের গরু বাছুর ধন সম্পদ রক্ষনা বেক্ষন করছে। বিত্তশালীদের চাদা ধরে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছে। এক কথায় এলাকায় কোন বিপদ আসলে গ্যাং পার্টির ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালায়। সবকিছুই তারা দক্ষতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করে।
এলাকায় কোন দুঃখি দরিদ্র মানুষ নাই, সবাই প্রয়োজন মাফিক ভাতা পায়। এতদাঞ্চলের ধনী কৃষক, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের মাসিক চাদা ধরা আছে, সবাই নিয়মিত তা পরিশোধ করতে বাধ্য কারণ তারা জানে এ টাকায় অক্ষম অসহায়দের ভাতা দেয়া হয়, গ্যাংয়ের কেউ খরচ করে না, করলেও বড় জোর দুয়েকটা স্মক কিনে ধোঁয়া উড়ায়, এর বেশি নয়। এজন্যই তারা সতঃস্ফুর্তভাবে চাদা দিয়ে দেয়। কিন্তু কেউ দিতে অস্বিকার করলে তার শনির দশা। রাস্তা ঘাটে কোথাও পালের গোদা আলবার্টের সাথে দেখা হলে সে উল্টামুখি হয়ে দাঁড়াবে বা বসবে, তারপর কি মিয়া টাকাটা তো পেলাম না, এলাকায় থাকবেন অথচ এলাকার গরীব দুঃখীদের দিকে ফিরে তাকাবেন না, এ তল্লাটে এ নিয়ম নেই, যেখানে আছে সেখানে চলে যান’। মনে হবে যেন কোন মানুষ কথা বলছে না, কোয়ার মধ্যে কোন দানব কণ্ঠ ঝাড়ছে, আর তা কোয়ার প্রাচিরের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে গিয়ে উর্ধ্ব লোকে প্রতিধ্বনি তুলছে অথবা মেঘ গর্জন করছে। তখন লোকটা যদি বোকের পাটাদারি হয় তাহলে শুধু ঘামবে, অন্য কিছু করবে না। আর যদি কিছুটা ভিতু প্রকৃতির হয় তাহলে তার দেহের নিম্নাংশের কাপড় ভিজে দুর্গন্ধ পানি পা বেয়ে রাস্তায় গড়িয়ে যাবে।
আরো সোনায় সোহাগা হয় যদি সেখানে গ্যাং দলের কেউ থাকে। তারা এসে লোকটার চার পাশে ঘুরবে, যেন চিড়িয়াখানায় নবাগত কোন অদ্ভুত এলিয়েন দেখছে। কেউ হয়তো পেটে গুতা মেরে বলবে ‘আরে বাপরে সরকারি মাল গুদাম। কেউ পেটের পাশে মেদ ধরে ঝাকি দিয়ে বলবে ‘তেল তো ভালই জমেছে। তা মিয়া সব তেল আপনার গায়ে তাহলে আতেলরা তেল পাবে কোথায়? এভাবেই চাদা অস্বীকারকারী বেচারারা মরার আগেই অপমানে মরে যায়। এজন্য চাঁদা আদায়ে কেউ গড়িমসি করে না। আর এই ছাঁদার টাকার এক পয়সাও গ্যাংরা আত্মসাৎ তো করেই না বরং তাদের হাত থেকে যায়। যেমন দেখা গেল, ছাঁদার টাকা বণ্টনের পরেও কোন বিধবা বা দরিদ্রের ঘরে ভাত নাই, বা বন্যা দুর্গতদের অন্ন সংস্থান নাই। তখন গ্যাংয়েরা গিয়ে মায়ের হাড়ির চালগুলি অগোচরে নিয়ে আসে। তারপর যখন খেতে যায় তখন মা ঝাড়ু নিয়ে তার পিঠটা ভাল করে পালিশ দেয়, এরপর কথার মালা উপহার দেয় ‘হারামজাদা অকর্মা, এক পয়সা কামাইয়ের মুরোদ নাই, কাজকর্ম লেখা পড়ার খবর নাই, সারাদিন পাড়াশুদ্ধু টেউ টেউ করে ঘুরস, এখন ঘরশুদ্ধু মানুষকে উপোস রেখে ভাত খেতে এসেছিস, আজ তোকে জনমের ভাত খাওয়াচ্ছি’ বলে দম দমাদম পিঠের উপর পড়তে থাকে। তখন বাইরের গ্যাং মায়ের সামনে ইঁদুর হয়ে পিঠ বাচাতে দৌড়ে পালায়। কোন সমস্যা নাই, এত বড় বাড়িতে রান্না ঘরের অভাব নাই, দয়া করে কোন একটাতে ঢুকলেই হল। আর ঢুকলে ভাতের পাতিলের কি খবর হবে তা জানা না থাকলেও তরকারীর পাতিল সংখ্যায় যত বেশিই হউক আর পরিমানে যত ভর্তিই থাকুক- সেগুলো যে তলানিতে গিয়ে ঠেকবে এতে কারো সন্দেহ করা অন্যায় হবে, এমনকি গ্যাংয়ের প্রতি অবিচার করা হবে।
গ্যাং পার্টীর দ্বিতীয় কাজ হল, এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ঝগড়া ফাসাদ মিমাংসা করা। সারা দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিয়ন্ত্রণ করলেও এ এলাকায় সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব নাই। হাজরাপাড়া ও আশপাশ এলাকার সরকার হল গ্যাং পার্টি, তারা সরকারের মধ্যে সরকার। এখানে সরকারের কোন আইন চলে না, এখানকার আইন দাতা হল গ্যাং পার্টি। ঝগড়া ফাসাদ মারামারি, জমির বিরোধ বউ তালাক ইত্যাদি সব কিছুর বিচার ফয়সালার দায়িত্ব গ্যাং পার্টির হাতে। সঙ্গত কারণেই এ অঞ্চলে সাধারণত মামলা মোকাদ্দমা হয় না। কদাচ কোন মামলা হলে আর দারোগা পুলিশ এলে গ্রামবাসী ও গ্যাং পার্টি এসে বলে, স্যার এতদূর থেকে শুধু শুধু কষ্ট করে কেন এলেন, আমাদের গ্রামের এসব বিষয় আমরাই মিমাংসা করব, চলে যান। তখন হয়ত দারোগা উষ্ণ গলায় বলে ‘আরে সরেন মিয়া, রাস্তা ছারেন আসামী ধরব। তখন গ্যাংরা গোল হয়ে চেপে আসে, তাদের ভাষা ও ভাব গতিক দেখে দারোগা মশাইয়ের বক্ষ পাটাতন যতই দৈর্ঘিক হউক না কেন, তার পশ্চাদ পায়ুর দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। তখন তার অবস্থা হয় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।
তারপর গ্যাংরা ছোটে যায় বাদী বিবাদীর কাছে। তাদের প্রথম লক্ষ্য থাকে বাদী বিবাদীর বিবাহ যোগ্য ছেলে মেয়ে আছে কিনা, যদি থাকে আর কিছুটা সামঞ্জস্য থাকে তাহলে ব্যস বিয়ে উৎসব। তাদের থেকে চাল ডাল গরু ছাগল আদায় করে বিত্তবানদের থেকে কিছু চাঁদা নিয়ে বিশাল বউ ভাত উৎসব। সেই অনুষ্ঠানে বাদী বিবাদী দাঁড়িয়ে একে অন্যকে বলতে হবে ‘বিয়াই আমরা ভুল করেছিলাম এমন কাজ আর করব না। ব্যস দুই শত্রুকে গ্যাং পার্টি চিরতরে বিয়াই বন্ধনে আবদ্ধ করে দিল। তেমনি ভাবে কোন ছেলে যদি এসে বিচার দেয় ‘অমুক আমাকে মেরেছে। ব্যস গ্যাংরা দুই ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীকে এনে হাজির করবে। তখন দলনেতা আলবার্ট উঠে বাদী বিবাদী উভয়ের গালে দুইটা থাপ্পড় মেরে বলবে ‘এই হারামজাদারা ঝগড়া করিস কেন, বন্ধু হয়ে থাকতে ভুতে কিলায়?
তারপর একে অন্যের হাত ধরে বলতে হবে, বন্ধু আজ থেকে আমরা দোস্ত, আর ঝগড়া করব না। এরপর দু’জনকে দুইটা লজেন্স দেয়া হবে, একে অন্যের মুখে তুলে দিয়ে বলতে হবে দূস্ত খাও। এরপর নির্ধারিত দিনে নির্ধারিত স্থানে পাঁচশ পাঁচশ করে টাকা নিয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে উভয়কে ছেড়ে দেয়া হবে। তখন তারা মা বাবাকে বলে কয়ে হউক বা বাবার পকেট কেটে হউক বা মায়ের ডিম মুরগি চুরি করে হউক টাকা সংগ্রহ করতেই হবে, নইলে যে উপায় নাই গ্যাংরা দেশছাড়া করবে। তারপর টাকা নিয়ে নির্দেশিত স্থানে গিয়ে উপস্থিত হবে। সেখানে নাচানাচি হবে, আনন্দ স্ফুর্তি হবে, সেই টাকা দিয়ে মিষ্টি এনে সবাই খাবে। আর তাদের দুস্তিত্ব পাকাপাকি করা হবে, একে অন্যের মুখে মিষ্টি দিয়ে বলবে দোস্ত খাও। এভাবে গ্যাংরা দুই শত্রুকে দুস্তি বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়।
কোন মেয়ে এসে বিচার দিল ‘আলবার্ট ভাইয়্যা অমুক ছেলে আমাকে জ্বালাতন করে। ব্যস দুই ঘণ্টার মধ্যে সেই ছেলেকে উপস্থিত করা হবে। তখন নেতা তাকে বলবে ‘চেপ ফালা, এখন এই চেপের (থু থু) উপর দিয়ে নাক খত দে। তারপর মেয়েটির পা ধরে বলতে হবে ‘তুমি আমার মা তুমি আমার বোন, আর কোন দিন এমন করব না, যদি করি তাহলে সারা দুনিয়ার মানুষের গু খাই। ব্যস মেয়েটি ইভটিজারের জন্য মা বোন হয়ে গেল। এই হল গ্যাং পার্টীর কাজ। তারা কোন অন্যায় করেও না সহ্যও করে না, সর্বত্র ন্যায় বিচার করে। আর সবাই তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য। গ্যাংদের উপর হাত ঘোরাবে এমন বাপের পোলা ঐ তল্লাটে নাই। এভাবেই তারা সেই এলাকায় সরকার উৎখাত করে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। অবশ্য গ্যাং পার্টি আরেকটা দায়িত্ব পালন করে। কারো গাছের আম কাঁঠাল পাকল কিনা, ডাব হৃষ্টপুষ্ট হল কিনা, নারিকেল ঝুনা হল কিনা, কলা পাকল কিনা এসব খবর পক্ষীকুল জানার আগে গ্যাংরাই হালাল করে নেয়।
বাঘা ছিল আগের প্রজন্মের গ্যাং লিডার। সে শুধু নামেই নয় কামেও বাঘ ছিল। গোস্টির এক মেয়ের সাথে তার প্রেম ছিল। ফেরদৌসি আলবার্ট ও ললিতাদের সম্পর্কে বাঘা লাগে দাদা আর ঐ মহিলা ফুফু। যে কারণেই হউক বাঘার কাছে ঐ মহিলাকে বিয়ে দেয়নি। ফলে বাঘা থাকল চিরকুমার আর ঐ মহিলাটা পাগল হয়ে গেল। সে বাড়ি শুদ্ধু দৌড়াদৌড়ি করে, হাততালি দেয় আর মধুবালার গান গায়, মেরা তন দুলে, মেরা মন ভোলে...। নেতায় নেতায় মিল থাকে, তাছাড়া আলবার্ট হল বাঘার শিষ্য। সে নাতিকে খোচা দিয়ে বলে কিরে শালা, তোর মত নায়ক মার্কা চেহারা থাকলে এ বয়সেও আমার পিছনে মেয়েরা লাইন দিত, আর তুই আজ পর্যন্ত একটা মেয়েকেও পটাতে পারলি না। তুই শালা গ্যাং লিডার হওয়ার যোগ্য না, পদত্যাগ কর। আলবার্ট বলে, প্রেম করে তোমার পরিনতি দেখ না, আবার আমাকে জড়াতে চাও নাকি? বাঘা বলে, আরে এটাই তো প্রেমের স্বার্থকতা।
আলবার্টের আপন চাচাত বোনের নাম ললিতা। গোলাপের মত গাত্র বর্ণ, প্রকোষ্ঠ মুখাবয়ব গোলগাল, সুচালো বিল্বকুচ, কটি অতিক্রান্ত অলকাবলি তাকে করে তুলেছে মোহনীয়। হ্রষ্য গ্রিবা মেয়েদের জন্য দোষনীয় হলেও এই বৈশিষ্ট তাকে করে তুলেছে অনন্যা। তার কটাক্ষে চাহনি আলবার্টের বক্ষ বিদির্ণ করে দেয়। তাই সে বাঘাকে বলে, ললিতাকে যদি পাই তাহলে আমি প্রেম করতে রাজি আছি। তখন বাঘা ললিতাকে দেখলেই বলে, ‘এই শালি আলবার্টের মত একটা নায়ক থাকতে এখনো ওর গলায় ঝুলে পড়ছিস না কেন? ললিতা ভেংচি কাটে ‘শালা বুইড়্যা, প্রেম করে দুইটা জীবন নষ্ট করছ এখনো তোমার শখ মিটে নাই? বাঘা বলে ‘আমার শখ মিটলে কি হবে আলবার্টের তো শখ মিটে নাই, সে তো তোর জন্য মরতে বসেছে। এভাবে আলবার্ট ও ললিতার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, প্রেম হয়। তারপর বিয়ে হয় কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, গরীবের বন্ধু অসহায়ের সহায় এই মহান নেতা দুইটি সন্তান রেখে অতি অল্প বয়সে মারা যায়। তারপর আলবার্টের ছোট ভাইয়ের সাথে ললিতার বিয়ে হয়।
যাই হউক, আগের কোন গ্যাং পার্টির আমলে পিকনিকের প্রচলন ছিল না কিন্তু বর্তমান গ্যাং লিডার ভাবল, তারা এলাকা শুদ্ধু মানুষের উপকার করে অথচ বাড়ির মানুষের জন্য কিছুই করতে পারে না। তাই কয়েক বছর আগে পিকনিকের প্রস্তাব পাশ হয়। নিয়ম হল চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা তুলে মসলা পাতি ও অন্যান্য খরচ বেয়ার করা হবে কিন্তু চাল ও গোশত মানে মুরগি প্রত্যেক ঘর থেকে তোলা হবে। তারপর দেখা গেল, চাল সবাই দেয় এমনকি এক কেজি চাইলে পাঁচ কেজি দিতে রাজি কিন্তু কোন গিন্নি মুরগি দিবে তো দূরের কথা একটা পাখাও দিতে রাজি নয়। তাই প্রথম বছর সিদ্ধান্ত হল প্রত্যেকের খোয়াড় থেকে মুরগি চুরি করা হবে। ব্যস গ্যাংরা রাত্রে মুরগি চুরি করল। পরের বছরও একই নিয়মে পিকনিক হল। কিন্তু তৃতীয় বছর গোল বাঁধল, যেদিন চাউল তোলা হল সেদিনের রাত থেকেই গিন্নিরা সতর্ক হয়ে গেছে। তারা রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর বিছানায় না গিয়ে একখান লাঠি নিয়ে খোঁয়াড়ের মুখে পিড়িতে বসে বসে সারা রাত খোয়াড় পাহারা দেয়। প্রথম রাতে মুরগি চুরি সম্ভব হল না, দ্বিতীয় রাতেও একই অবস্থা।
তখন বাড়ির ছেলে মেয়েরা গ্যাংদের উপর হামলে পড়ে, এখনো পিকনিক হয় না কেন, এত দেরি কেন? আবার তারা জানে যে মুরগি চুরি না হওয়া পর্যন্ত পিকনিক হবে না। কাজেই তারা হঠাৎ মায়েদের প্রতি খুব যত্নবান হয়ে উঠে, ঘুমানোর উপদেশ দেয়, না ঘুমিয়ে খোঁয়াড় পাহারা দেয়ার জন্য তিরস্কার করে, অসুখ করবে বলে প্রেসক্রিপশন দেয়, বিভিন্ন ভাবে মায়েদের ভুলাতে চায়। মায়েরা হাসে আর মনে মনে বলে, এত সোহাগের উদ্দেশ্যটা তো জানিই, এবার আর কোন সিঁদেল চোর, গরু চোর আর মুরগি চোরের খাওয়া নাই, তারা দস্তুর মত পাহারা দিতেই থাকে। তখন গ্যাংদের মাথায় শাখের করাত, তারা না পারছে মুরগি চুরি করতে আর না পারছে গোশত কিনে আনতে। কারণ এই বিশাল বাড়ির লোকজনকে গোশত কিনে খাওয়ানো সম্ভব না। জমি বেচেও কুল কিনারা পাওয়া যাবে না, তাছাড়া গ্যাংরা হল ছন্নছাড়া, তারা বাবার কাছে টাকা চাইলে ঠেঙ্গিয়ে ঠ্যাং ভেঙ্গে দিবে। এ বছর আর মুরগি চুরি সম্ভব হল না।
ওদিকে বাড়ির ছেলে মেয়েরা তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। অগত্যা গ্যাংরা কিছু টাকা সংগ্রহ করে একটা গরু কিনল বটে তবে শেষ পর্যন্ত গোশত সংকুলান হয়নি। খাওয়ার শেষের দিকে যারা গোশত পায়নি তারা ক্ষেপে গিয়ে গ্যাংদের উপর হামলা করল, পিকনিকের হাণ্ডি পাতিল ভেঙ্গে চুর্ন বিচুর্ন করল, শামিয়ানা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেরে আগুন জ্বালিয়ে দিল, ভীষণ গণ্ডগোল হল, পিকনিক স্পট কুরুক্ষেত্রে পরিণত হল। এতে বাড়ির অন্যান্য পোলাপান ক্ষেপে গিয়ে গ্যাংদের গালি দিতে লাগল তারা যেভাবেই হউক মুরগি চুরি করতে পারল না কেন, আর মায়েদের তিরস্কার করতে লাগল, খোয়ার পাহারা দিল কেন। পরবর্তিতে গ্যাংরা সিদ্ধান্ত নিল, পিকনিকের তারিখ অঘোষিত থাকবে। পৌষ মাসে ছাঁদার টাকা উঠানো হবে, মাঘ মাসের কোন এক রাতে হঠাৎ গ্যাং লিডার আলবার্ট ঘোষণা দিবে আজ রাতে মুরগি সংগ্রহ, পরের দিন চাল কালেকশন। কারণ আগে চাল কালেকশন করলেই গিন্নিরা সতর্ক হয়ে যায়।
ব্যস সেই থেকে রাতে মুরগি চুরি আর সকালে চাল সংগ্রহ করে পিকনিকের প্রচলন হল। যেসব গিন্নিদের খোঁয়াড় খোয়া যায় তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্না ঘরে বা উঠানে বসে গালে হাত দিয়ে রাগিনি তোলে, ‘মুখ পোড়া বানরের দলের চোখে আমার খোঁয়াড়টাই পড়ল, সবগুলি মুরগি নিয়ে গেছে। আমার দুইটা মুরগি ডিম দিতেছে, তিনটা কোঁচে বসাইছি সব নিয়া গেছে। কেউ জিগির তোলে, ‘আমার বিদেশি চারটা মুরগি সব নিয়া গেছে। কেউবা, আমার তিনটা মোরগ পাঁচটা মুরগি ছিল সব নিয়া গেল। কেউবা আমার বোনের দুইটা মুরগি ছিল তাও নিয়া গেছে, কেউবা আমার মা দুইটা মুরগি দিছিলো চোরের দল নিয়া গেছে- ওদের পিকনিকের নিকুচি করি ওদের বউয়েরা কোন দিন মুরগি পালতে পারবে না, কলেরায় যেন সব নিপাত হয়ে যায়। এভাবে তারা বসে বসে গ্যাংদের মুণ্ডুপাত করতে থাকে। যেহেতু পিকনিকের কোন পুর্ব ঘোষণা থাকে না, তাই গিন্নিদের রাগিণীই এর নিদর্শন হিসাবে গন্য হয়। সকালে ছেলে মেয়েরা ঘুম থেকে উঠে মায়ের রাগিনি শুনলেই বার্তা পেয়ে যায় আজ পিকনিক। তখনি তারা লাফিয়ে উঠে ‘পিকনিক হুররে’ আনন্দ ধ্বনি দিতে দিতে দৌড়ে মাঠে যায়।
প্রতি বছর বাড়ির সামনের মাঠে বিশাল শামিয়ানা টানিয়ে পিকনিকের আয়োজন করা হয়। লাউড স্পিকারে গান বাজে, ছেলে মেয়েরা নাচে, গান গায়, খেলা ধুলা করে, স্ফুর্তি করে। পোলাপান দল বেঁধে মাঠে ও বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করে, খেলায় মেতে উঠে। জোয়ানরা বাজার সওদা, ডেকোরেশন ইত্যাদিতে মহাব্যস্ত হয়ে উঠে। মেয়েরা দা নিয়ে গিয়ে কেউ মুরগি কাটে, কেউ বাটনা বাটে, কেউ কোটনা কোটে। বুড়োর দল মাঠে গিয়ে ফাও মাতাব্বরি করে, গ্যাংদের দিক নির্দেশনা দেয়, দুষ্ট পোলাপানদের ধমকায়, বাবুর্চিদের গিয়ে বলে ‘ঝালটা একটু কম দিস, আমি আবার ঝাল খেতে পারি না। কর্তারা ছেলে মেয়েদের বলে ‘এই তোরা কেউ কিছু খাসনে, তাহলে ভাল করে পিকনিক খেতে পারবি না। কোন মেয়ে হয়ত মায়ের মুরগিটা বের করে কেটে বাড়িতে গিয়ে মাকে বলে ‘আম্মা তোমার মুরগিটা কেটে এলাম। মা তখন ভেংচি কাটে, ‘মর গিয়ে পোড়ামুখি, আবার আমাকে শুনাতে এসেছে। পিকনিক খেয়ে বুকে মাটি নে গিয়ে’। তারপর হয়ত মেয়ে হাসতে হাসতে মাঠে চলে যায় আর মা আবার পিকনিকের গোস্টি উদ্ধার করতে বসে।
এদিন মুরগি খোয়ানো গিন্নিরা মুরগির শ্রাদ্ধ পালন করে থাকে। কারণ সবাই পিকনিকে যাবে বলে বাড়িতে রান্না বান্নাও হয় না, খাওয়া দাওয়াও হয় না। নিজের একার জন্য কেউ রান্নাও করে না। মুরগিহারা কোন গিন্নিকে হয়ত ছেলে মেয়েরা টেনে নিয়ে যায়, বা নিজেই চারটে খাওয়ার জন্য যায়। আর তখন তারা পিকনিকারদের উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়। যেমন কোন গ্যাং হয়ত প্লেটে এক মুঠ ভাত নিয়ে আসে, তারপর গোশতের একটা কাটা দিয়ে বলে ‘চাচি বা ভাবী এটা আপনার মুরগির কলিজাটা, খান মজা করে খান। একজন একটু ডাল দিয়ে বলবে ‘এটা আপনার মুরগির ঝুল। কেউ পাতে পানি ঢেলে বলবে, একটু ডাল দিলাম। তখন সবাই বেচারির চারপাশে ঘিরে থাকে। কেউ বলবে চাচি বা ভাবী আপনার মুরগির রানটা আমি খাইছি, আহ কি যে স্বাদ। একেবারে বমি করে দিছিলাম আর কি। এভাবে একেক জন একেক কথা বলে আর হাসির হিড়িক পড়ে যায়। তখন বেচারির একে তো মুরগি হারানোর শোক তার উপর অপমান। ক্ষোভে অপমানে রাগে প্লেট ধাক্কা মেরে উল্টে ফেলে দিয়ে পিকনিকের গোস্টি উদ্ধার করতে করতে বাড়ি চলে যায়। এজন্যই মুরগি হারা কোন গিন্নি ভুলেও পিকনিকের ধারে কাছে আসে না, তারা বরং সারাদিন গালে হাত দিয়ে রান্না ঘরে বসে বসে মুরগির শ্রাদ্ধ পালন করা আর পিকনিকের খেতা পোড়তেই অধিক নিরাপত্তা বোধ করে। কোন কর্তা যদি বলে ‘মুরগির জন্য বাপ ভাই মরার শোক পালন করতেছ নাকি? তাহলে আর রক্ষে নেই, খেকিয়ে উঠবে, এত মুরোদের ব্যাটা, একটা মুরগিতো কিনার মুরোদ পায় না, আমার মা দুইটা মুরগি দিছিল সেগুলো খেয়ে এখন আমার মুণ্ডু খেতে এসেছ ইত্যাদি।
প্রভাত কালে পাশের ঘরের চাচির আহাজারি শুনে হাসানের ঘুম ভাঙ্গল, সে দৌড়ে গিয়ে দেখল চাচি মাথায় হাত মারছে আর বকছে, আমার কী সর্বনাশ করল। আমার মাইজ ঘরে ডাকাতি করল। দুইটা মুরগি ডিম দিতেছে, দুইটা মুরগ- সব নিয়া গেছে, মুখ পোড়া বানরের দল একটাও রেখে যায়নি। এরপর আশপাশ থেকে মহিলাদের গলা শুনা গেল। হাসান মসজিদে গেল, তারপর বাড়িতে এসে ফেরদৌসিকে নিয়ে মহিলাদের তামাশা দেখতে বের হল। মুরগি হারা মহিলারা যে যেমন পারছে গালাগালি করছে। আর ছেলে মেয়েরা আনন্দে নাচানাচি করছে। ইতিমধ্যে মাঠে লাউড স্পিকারে গান বেজে উঠল। তখন সব পোলাপানের দল ‘ইয়াঃ হো হুররে পিকনিক’ ইত্যাদি চিৎকার করতে করতে মাঠের দিকে দৌড়াল। হাসান ফেরদৌসি হাত ধরাধরি করে মাঠে গেল। শুরু হল নাচ, পোলাপানের নাচ। হৈ চৈ করছে আর নাচছে।
আলবার্টের ছোট ভাইদের নাম মহিউদ্দিন, কিন্তু অশৃঙ্খলতা ও ঔদ্ধ্যত্বের কারণে সবাই তাকে নাম বিগড়ে মইখ্যা বলে ডাকে, কেউ দেখতে পারে না। সে হাসানের সমবয়সী। ফেরদৌসি তখন কলমি লতার মত লতিয়ে উঠছে, বুকের উপর সদ্য ওড়নার ঢাকনি পড়েছে। চন্দ্রকলার মত বিকাশমান ফেরদৌসির রুপের প্রতি মইখ্যার লোলুপ দৃষ্টি কিন্তু হাসানের জন্য সে কোন ফুরসত পায় না। অনেকদিন ধরে সে চেষ্টা করছে ফেরদৌসির কাছে ঘেষতে, খাতির জমাতে কিন্তু হাসানের জন্য সম্ভব হচ্ছে না। এখন পিকনিকে সে একটু সুযোগ নিতে চাইল। মানিক জোড় এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তারা নাচছে, মহিউদ্দি বারবার ফেরদৌসিকে ডেকে বলে ‘আয় নাচি। তখন সে ভেংচি কেটে হাসানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। কখনো সে এসে ফেরদৌসির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় আর হাসান তাকে হালকা চড় থাপ্পড় দেয়। কখনো এসে ওড়না ধরে টানতে টানতে বলে ‘আয় না নাচি গিয়ে। সে হাসানকে জড়িয়ে ধরে, শক্ত করে হাত ধরে রাখে। তখন হাসান বিষের ঢোক গিলে তাকে কিল ঘুষি দিতে চায়, সে দৌড়ে চলে যায়। ঘণ্টা খানেক ধরে পোলাপানের নাচানাচি চলছে। এখন ড্যান্স পার্টি আগমনের প্রতিক্ষা। এই ড্যান্স পার্টির দলনেতা হল বকুল মাষ্টার দম্পতি। এই নব দম্পতি প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারি করে, তারা উভয়েই নৃত্য শিল্পী।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের আগমন লক্ষ করা গেল। অন্যান্য বছরের মত এবারও রং ঢং সং ও সাজ গুজের দিক থেকে বাহারি অবস্থা। বকুল মাষ্টার ও তার স্ত্রী রাজা রাণীর পোশাক পড়েছে, মাথায় মুকুট। কেউ সাদা পাউডার মেখে শ্বেতভুত সেজেছে, কেউ কালি মেখে কাল ভুত, কেউ গাছের পাতা গায়ে জড়িয়ে বন মানব, কেউ পাতার মুকুট দিয়ে বন রাজা সেজে এসেছে। বিশাল বড় বাড়িতে অনেক যুবক যুবতি, তাদের মধ্যে যাদের প্রেম ছিল- তারা বর কনে সেজে এসেছে। অন্যান্য যুবক যুবতিরা সাধারণ পোশাক পড়ে এসেছে। তারা কাছে আসতেই হৈ চৈ ও চিৎকার করে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানো হল। তারপর শামিয়ানার নীচ থেকে সকল পোলাপান বের করে দেয়া হল। এখানে থাকবে শুধু ড্যান্স পার্টি আর অন্যরা শামিয়ানার চারপাশে। গান বন্ধ করে একজন সুকণ্ঠি মাইকে সুর তুলল, ‘দুনিয়া কা মজা লে লো, দুনিয়া তোমহারি হ্যায়--- দুনিয়া কো লাথ মার দুনিয়া সেলাম করে, মোর মোর সেলাম করে, গোট গোট সেলাম করে---- সাথে সাথে শুরু হল নৃত্য, উদ্দাম নৃত্য।
গানের তালে তালে চলছে নৃত্য, পোলাপান সব শামিয়ানার চারপাশে নাচছে। কিছুক্ষণ পর স্বকণ্ঠ বন্ধ করে রেকর্ডারে উদ্দাম নাচের গান দেয়া হল। শুরু হয় পাগলা নৃত্য, গানের তালে তালে নৃত্য, উদ্দাম নৃত্য, খেমটা তালে নাচ আর গান। যুবক যুবতির কটির দোলন সঙ্কোচন, বিল্বকুচের স্পন্দন আর নাচের দাপটে আকাশ মাটি কাঁপতে থাকে। এটা কি নারকীয় নৃত্য নাকি পৈশাচিক নৃত্য তা বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবে। উবায়দুল্লাহ মাষ্টার খুবই ধার্মিক। তার বড় মেয়েদের পিকনিকে আসার অনুমতি নাই। শুধু হাসান ফেরদৌসি ও তার ছোট ভাইটা এক পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। এবার একজন একটা পাগলাটে গানে টান দিল, আর সাথে সাথে শুরু হল, খেমটা নাচ, খাম্বা নাচ, বেলে নাচ, দোলক নাচ, জংলি নাচ। নাচের দাপটে মাটি কাঁপতে থাকে। ড্যান্স পার্টি নাচছে শামিয়ানার নিচে আর অন্যরা চারপাশে চক্রাকারে ঘুরছে আর নাচছে। তারা বিশেষ কৌশলে মাটিতে পা মেরে লাফিয়ে উঠছে, তাতে কোমর দুলছে আর দৌড়াচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে থালা বাটি ডিশ, নাচের তালে তালে সেগুলি বাজাচ্ছে আর নাচছে। নাচের ঝংকারে পানি বেরিয়ে আসে, এই শীতের ভোরেও সবাই ঘেমে জবজবা হয়ে গেছে, কাপড় ভিজে গেছে।
ঘণ্টা দেড়েক পড়ে সবাই ক্লান্ত হয়ে গেল, কুজঝটিকার আড়াল থেকে সুর্য উকি দিয়েছে। নাচ বন্ধ হল। এরপর খাঁচা ভর্তি কেক পাউরুটি কলা ইত্যাদি বিতরণ শুরু হল। কারো বাড়িতে যেহেতু রান্না হবে না বিধায় এখানেই নাস্তার ব্যবস্থা। তারপর সবাই রান্না বান্নার আয়োজনে মাতল। যুবতিরা কাটা বাচা করে, যুবকরা ব্যবস্থাপনা করে। উনানে বড় বড় ডেগচী উঠল। পোলাপান সব আবার খেলায় মেতেছে। মানিক জোড় হাত ধরাধরি করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, ছেলে মেয়ে একসাথে খেলছে বিধায় ফেরদৌসি তাতে যোগ দেয়নি। মহিউদ্দি বারবার ফেরদৌসিকে ডাকছে কিন্তু সে যায় না। আরেকবার এসে খেলাচ্ছলে ফেরদৌসির ওড়না টান মেরে খোলে ফেলল। সাথে সাথে হাসান ঠোঁট কামড়ে ধরে কষে একটা চড় মারল, সেও একটা ঘুষি মারল। হাসান রাগে অন্ধ হয়ে গেছে, এলোপাতারি কিল ঘুষি ও লাথি মারতে লাগল। সমবয়সী হলেও মহিউদ্দি দেখতে ছিল হাসানের চেয়েও স্বাস্থ্যবান ও বলিষ্ঠ, সে মনে করেছিল কয়েক ঘুষি দিয়েই তাকে কাবু করে ফেলবে। কিন্তু পাথর বৃষ্টির মত উপর্যোপরি মুষ্টাঘাত খেয়ে বুঝতে পারল প্রতিপক্ষ মানুষ নয় সিংহ। শীঘ্রই মইখ্যা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, গ্যাংরা দৌড়ে এসে হাসানকে থামাল। মহিউদ্দির ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে। আলবার্ট এসে ভাইয়ের অবস্থা দেখে ক্ষুদ্ধ হল কিন্তু সে ছিল ন্যায় বিচারক। ভাইয়ের গালে দুই থাপ্পড় দিয়ে বলল, তুই ওর ওড়না ধরলি কেন। আবার হাসানকে দুই থাপ্পড় দিয়ে বলল, তুই বিচার না দিয়ে নিজে বিচার করলি কেন। এদিন থেকে মইখ্যার জিদ বাড়ল, সে ফেরদৌসিকে নিজের অধিকারের শামিল মনে করতে লাগল। কিন্তু হাসানের জন্য সে ফেরদৌসির কাছে ঘেষতে পারে না, ফলে দিনদিন তার জিদ বাড়তে লাগল। আর এই জিদ শেষ পর্যন্ত মহাবিপত্তি ডেকে আনল।
কয়েকশ মানুষের খাওয়া পর্ব শেষ করতে সন্ধ্যা লেগে যায়, তাই উজান বেলা থেকেই শুরু করতে হয়। বারটায় প্রথম ব্যচ বসল, আর তাতে হাসান ফেরদৌসিও বসে পড়ল। ‘মানিক জোড় গোশত পাবে না, তাদের মুরগি সংগ্রহ হয় নাই’ বলে আলবার্ট মুচকি হেসে অন্যত্র চলে গেল কিন্তু খাওয়ার সময় পাতে গোশতের অভাব ছিল না।
বিষয়: সাহিত্য
৮৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন