হাসান- ফেরদৌসি -১

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০২ অক্টোবর, ২০১৭, ০৪:১৯:০৯ বিকাল

(হাসান ফেরদৌসি সিরিজের দ্বিতীয় গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে চরিত্রগুলির নাম পরিচয় হুবহু সত্য কিন্তু আখ্যানটা হুবহু মিথ্যা)



জামালপুর জেলার পশ্চিম মণ্ডলে অনন্তবিস্তার প্রমত্তা যমুনা। নিঃশব্দ বীচিক্ষুদ্ধ আবিলাম্বু দিক সীমানাহিন তটিনী। দিগন্ত রেখা বিস্তৃত আবিলমন্ডল মধ্যে অনন্ত বীচিমালার সহস্র স্থানে নিরন্তর তরঙ্গভঙ্গ চলছে। যত দূর চক্ষু যায়- ততদূর পর্যন্ত তরঙ্গভঙ্গ প্রক্ষিপ্ত বারিরাশি সিকতাময় তটে আঁচড়ে পড়ছে আর ভগ্ন মৃত্তিকা খণ্ড স্বশব্দে পাতিত হয়ে বারিধি বক্ষে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কাননকুন্তলা ধরণীর উপযুক্ত অলকাভরণ। এ সময় বিশাল জলধিপাড়ে দিগন্ত রেখায় দিনমণি অস্ত যাচ্ছে, তার আভায় নদী বক্ষের সুবর্ণ বীচিমালা ফণিনীর ন্যায় সাগর সঙ্গম অভিলাষে নিরন্তর ধেয়ে যাচ্ছে।

বিহঙ্গকুল কিচিরমিচির রবে তট- তটিনী ঝাপটিয়ে যাচ্ছে আপন নীরে, ধীবর খাড়া হাতে জাল কাধে ফিরছে আপন আলয়ে। গোপাল তার গো-পাল নিয়ে বাড়ি ফিরছে, কিষাণিরা হংস-কক্কুট তাড়ীয়ে খোয়াড়ে নিচ্ছে, নির্মল গগন মণ্ডলে খণ্ড খণ্ড শ্বেত নীরদ ভেসে বেড়াচ্ছে। অস্তাচল গামী দিবসপতির হরিদ্রাভায় পৃথিবী নৈসর্গিক রুপে অবগাহন করছে। দূর গ্রামগুলির সবুজ বনানির উপর দিয়ে কামিনীদের প্রদোষ কালিন রন্ধন- ধুম্র কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের অনন্ত নিলিমায় মিশে যাচ্ছে।

যমুনার অদূরেই পুর্বদিকে হাজরাপাড়া বাজার। বাজার পরিপূর্ণ জমে উঠেছে। কেউ সওদাপাতি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। অলস ও কর্মব্যস্ত কেউ কেউ তখনো দ্রুতপায়ে আসছে। বাজারের মুখে রাস্তাগুলি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, রিকশা, ভ্যান, সাইকেল ইত্যাদির ভিড় লেগে আছে। চালকরা বিভিন্ন জায়গার নাম ধরে ডাকছে, যাত্রি তুলছে আর দ্রুত আপ ডাউন করছে। এ সময়টা তাদের উপার্জনের মোক্ষম সময়। বাজার থেকে পুর্বদিক গামী রাস্তার মুখে বছর বার বয়ঃক্রমের একটি বালক দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে শত ছিন্ন একটা জামা, পরনে লূঙ্গির পাড় কয়েক জায়াগায় ছিঁড়া, গিড়া দিয়ে রেখেছে, সম্পূর্ণ লুঙ্গিটা নেটের মত ফুটো ফুটো। পায়ে ফিতা ছিঁড়া স্যান্ডেল তার দিয়ে বাধা। গায়ের রং শ্যাম বর্ণ, বগলের নিচে ছোট্ট একটা পুটলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে কেউ দেখলে ভিক্ষুক ঠাউরাতে ভ্রম করবে না। তার গোলগাল মুখটি ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে লম্বাটে দেখাচ্ছে। ছেলেটা পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে, বাল্যের চাঞ্চল্য ও সজীবতা তার মধ্যে নেই। কালের নিষ্ঠুর পীড়ন তাকে করে দিয়েছে স্থবির, নৈদাঘ চৈতালি শুকনো পাতার ন্যায় জরাগ্রস্ত। এই বিশাল বাস্তু চরাচরে একটি শিশুর যখন কোন আশ্রয় না থাকে, যখন কোন অবুঝ বালক আশ্রয়হীন ভবসিন্ধুতে একাকি ভেলায় ভাসতে থাকে তখনই তার এমন অবস্থা হতে পারে। তার বেদনাবিধুর মুখখানি জানান দিচ্ছে, সে এই পৃথিবীর অবাঞ্চিত।

ছেলেটির সামনে দিয়ে যেসব হাটুরে বেরিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, একটা কিছু বলতে চায় কিন্তু সাহস পায় না। একটু দরিদ্র গোছের, শ্রমিক বা বৃদ্ধ কাউকে দেখলে সে এগিয়ে যায়, মিনমিন করে কিছু একটা বলে কিন্তু অনেকেই তার কথা শুনতেই পায় না, শুনলেও বুঝে না, বুঝলেও ভিখারি বেশে অবাঞ্চিত বালকের দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করে না। সন্ধ্যা মিলিয়ে রাত্রি নেমেছে কিন্তু কোন পথিক তার কথায় কান দেয় না, তার দিকে ফিরেও তাকায় না। রাতের আবলুস কালো অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। ছেলেটা চমকে উঠল, তার উদ্দিষ্ট ঠিকানা খুঁজে না পেলে সে কোথায় যাবে। রাতের অন্ধকারের মধ্যে সে জীবনের অন্ধকার দেখতে পেল। অবশেষে সে মরিয়া হয়ে উঠল। সামনে দিয়ে মধ্য বয়সী একজন লোক যাচ্ছে, সে দৌড়ে গিয়ে লোকটার হাত ধরে কেঁদে উঠল, চাচা উবায়দুল্লাহ মাস্টারের বাড়ি চিনেন? লোকটার মায়া হল, কোন উবায়দুল্লাহ মাস্টার? - ফকির বাড়ির। - তুমি কোত্থেকে এসেছ? – ফুলপুর থেকে। - এসো আমার সাথে, আমি ফকির বাড়ির সামনে দিয়েই যাব। তারপর সে ছেলেটার সাথে আলাপ করতে করতে চলল।

রাস্তাটা পাঁচশ হাত পুর্বে গিয়ে দক্ষিণে মোড় ঘুরল, আধা কিলো যাওয়ার পর আবার পশ্চিমে মোড় ঘোরল। মোড় থেকে রাস্তার উত্তর পাশে বস্তির মত লম্বা আধা কিলো দীর্ঘ বিশাল বাড়ি। অধিকাংশই পাকা ঘর, মাঝে মধ্যে দুয়েকটা টিনের ঘর। ছেলেটা দেখছে আর লোকটার সাথে আলাপ করতে করতে যাচ্ছে। লোকটা বলল, এটাই ফকির বাড়ি। এ এলাকার মধ্যে এ বাড়ির লোকেরাই সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত, অনেকেই চাকরি বাকরি করে। এরাই এলাকার সবচেয়ে ধনী ও সম্ভ্রান্ত। কিছুদুর যাওয়ার পর লোকটা ‘এসো’ বলে রাস্তা থেকে উত্তর পাশের উঠানে নেমে গেল। তারপর উত্তর দক্ষিণা লম্বা একটা টিনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিল ‘মাস্টার ভাই, মাস্টার ভাই বাড়িতে আছেন? ‘কে’ ভিতর থেকে আওয়াজ এল। পরক্ষণেই দক্ষিণ মুখি দরজা খোলে হারিকেন হাতে পঞ্চাশোর্ধ একজন লোক এসে দাঁড়াল। ছেলেটা দেখল, দীর্ঘদেহি, পাকা আমের মত গায়ের রং, অসম্ভব ভুড়ি, কাচাপাকা দাড়ি, গোলগাল চেহারা থেকে যেন জ্যুতি চমকাচ্ছে। মুখটা যেন মায়া মমতা ও বাৎসল্যের আকর। ছেলেটার রুধিরুদ্র মুখ থেকে দুঃখের কালিমা সরে গিয়ে চাঁদের মত চকচক করে উঠল, আনন্দে তার মনটা নেচে উঠল। তার মনে হল যেন এ ব্যক্তিই তার জন্ম জন্মান্তরের আপন জন।

হাটুরে লোকটা বলল, এই ছেলেটা বাজারের মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিল, আমি সাথে করে নিয়ে এলাম। মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন ‘কে ও, বাড়ি কোথায়? - এর নাম হাসান, বাড়ি নাকি ময়মনসিংহের ফুলপুর। - ‘হাসান, ফুলপুর’ তিনি চমকে উঠে দ্বিরুক্তি করলেন, দ্রুত ঘর থেকে নেমে ছেলেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমার বাবার নাম কি? ছেলেটা যুগপৎ আনন্দ ও আশংখায় কাঁপছিল। সে মৃদুস্বরে শুধু বলতে পারল ‘উসমান’। মাস্টার চমকে উঠলেন, আর সাথে সাথে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করলেন, তুমি উসমানের ছেলে? আবেগাতিশয্যে তিনি তাকে খপ করে কোলে নিয়ে ‘এই শুনছ শুনছ’ চিৎকার করতে করতে ঘরের দিকে ছোটলেন। হাটুরে লোকটা অসহায় বালকের সাদর সংস্থান দেখে হাসল, তারপর সালাম দিয়ে বিদায় নিল।

মাস্টার বেজান হয়ে স্ত্রীকে ডাকতে লাগলেন ‘কই গেলা গো, আরে তাড়াতাড়ি আস, দেখ কে এসেছে। হাক ডাক শুনে গৃহকর্ত্রি দৌড়ে এলেন, তার মেয়েরাও এল। ততক্ষণে মাস্টার ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে খাটের কিনারে বসল। গৃহকর্ত্রি জিজ্ঞেস করলেন ‘কে ও? মাস্টার উত্তর দিলেন, আরে হাসান, উসমানের ছেলে। কিন্তু আমার তো পাগল হবার অবস্থা, এতদূর থেকে এইটুকু ছেলে একা আসল কেমনে, তাও আবার রাত্রে। গৃহকর্ত্রি হাসানের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি একা এসেছ? হাসান মাথা ঝাকাল। মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন ‘কেন, তোমার আব্বু কোথায়? - আব্বু নেই। - নেই মানে? ছেলেটা গুমরে কেঁদে উঠল ‘আব্বু মারা গেছে। তারপর ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। মাস্টার ক্ষণকাল নির্বাক নিস্পন্ধ হয়ে বিস্পারিত নেত্রে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। সহসা দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘উসমান, আমার ভাই উসমান নেই, আমার ভাই মারা গেছে। হায় আল্লাহ! তুমি একি করলে, আমি একটু জানতেও পারলাম না’ এভাবে বিলাপ করতে করতে তিনি বিছানায় গড়িয়ে পড়লেন।

বিছানায় গড়াতে লাগলেন আর তীব্র কান্নার গমকে বাস্পরুদ্ধ হয়ে পশুর মত গোঙ্গাতে লাগলেন। আর কিছুক্ষণ পরপর ‘উসমান, আমার ভাই উসমান’ বলে চিৎকার করতে লাগলেন। গৃহকর্ত্রি ও মেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুচছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থায় হাসানের কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। মাস্টার হঠাৎ উঠে বসে ছেলেটাকে প্রচণ্ড জোরে বুকে চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হতভাগা কেন আইলি, কেন আইলি’ বলতে বলতে ছেলেটার পিঠে চড় মারতে লাগলেন আর ‘কেন আইছিলি, এই অভিশপ্ত দুনিয়ায় কেন আইছিলি, এখানে তোর কি কাজ। তিন বছর বয়সে মা হারাইলি, এখন বাপটাকেও হারাইলি, তোর পূর্ব পুরুষরা তোর জন্য পা রাখার মতও একটু ভুমি রেখে যায়নি। তাহলে এখনো বেচে আছিস কেন, এই দুনিয়ার গ্লানি আর বঞ্চনা ভোগ করার জন্য? তোর বাপের সাথে মরলি না কেন কপাল পোড়া, এখনো বেঁচে আছিস কেন? শোকের আতিশয্যে তিনি পাগল হয়ে গেছেন, এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে ছেলেটার পিঠে জোরে জোরে চড় মারছেন আর চিৎকার করছেন ‘কেন মরলি না কপাল পোড়া, কেন মরলি না। ছেলেটাও অন্তহীন দুঃখে চিৎকার করে কাঁদছে। মেয়েরা ও তাদের মাও ততক্ষণে বিলাপ জোরে দিয়েছে। ঘরটিতে মরা বাড়ির মাতম উঠল।

গৃহকর্ত্রি দেখলেন তার স্বামীর হুস নাই, কষ্টাতিশয্যে ছেলেটাকে আঘাত করে যাচ্ছেন। তিনি দৌড়ে গিয়ে স্বামীর হাত ধরে চেচালেন, ‘এই আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন নাকি। ওকে তো মেরে ফেলছেন’ বলে হাসানকে স্বামীর ক্রোড় থেকে টেনে এনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ছেলেটা তখনো চিৎকার করে কাঁদছে। তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ মুছে দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। মাস্টার বিছানায় গড়িয়ে গড়িয়ে বিলাপ করেই চলেছে। গৃহকর্ত্রি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আহ হা রে মুখটা শুকিয়ে কি হয়েছে, সারাদিন বোধ হয় কিছু খাওয়া হয়নি। এসো আগে চারটে খেয়ে নাও’ বলে তিনি হাসানকে জড়িয়ে ধরে রান্না ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। মেয়েরাও কাঁদতে কাঁদতে নিজ নিজ কামরায় চলে গেল। মাস্টার অনেক্ষণ বিলাপ করে ক্লান্ত হয়ে গেল। বিছানায় কিছুক্ষণ মরার মত পড়ে থাকল। তারপর উঠে রান্না ঘরের দিকে রওয়ানা করল। ছেলেটা সারাদিন কিছু খায়নি, ক্ষুধার জ্বালায় চাটাইয়ে বসে গোগ্রাসে খাচ্ছে। অধিক কান্নায় তার চোখ দু’টি ফুলে গেছে, লাল টকটক করছে।

মাস্টার এসে তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলালেন। তারপর ‘উসমান কবে........ কিন্তু কথা শেষ করতে পারলেন না। ছেলেটার বেদনা বিধুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনটা হাহাকার করে উঠল, বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। কান্না লোকানোর জন্য তিনি অন্য দিকে ফিরলেন, ঝামটি মেরে থাকলেন, তার শরীরটা কাঁপছে। তিনি আর টিকতে পারলেন না, দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে আবার বিছানায় পড়ে কাঁদতে লাগলেন। হাসানের নাকের গোঁড়া বেয়ে চোখের নোনাজল পাতে গড়িয়ে পড়ছে। গৃহকর্ত্রিও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ মুচছেন।

রাতে পরিবারস্ত সকলের খাওয়া দাওয়ার পর সবাই এক রুমে বসল। মাস্টার দম্পতি হাসানের দুই পাশে বসে তার মাথায় ও পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আদর করতে লাগল। মেয়েরা হাসানকে জানার কৌতূহল নিয়ে সবাই জড়ো হয়েছে। কেউ চেয়ারে কেউ খাটের উপর বসেছে। ছয় সাত বছরের একটা মেয়ে বাবার গায়ে ঢেশ দিয়ে বসে আছে। মোটা, নাদুস নুদুস, গাতুম গুতুম, দুধে আলতা গায়ের রং- যেন একটা সূবর্ণ পুতুল। কিন্তু তার একটা খুত আছে, নাক বুছা। মেয়েটাকে হাসানের খুব ভাল লাগে, সে আড়চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে। মেয়েটা বাবার বাহু ধরে নাড়িয়ে নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘আব্বু আব্বু ও কে? বাবা বললেন ‘ও তোমার ভাইয়্যা। - সে কি আমাকে আপু ডাকবে? – না তোমাকে ফেরদৌসি ডাকবে, তুমি যে ছোট। ওমা, এই পুচকে মেয়েটা সাপের মত ফুসে উঠল, হুট করে দাঁড়িয়ে হাত পা নাচিয়ে ঝংকার দিয়ে উঠল ‘না, আমাকে আপু ডাকতে হবে, নইলে তাকে আমি ভাইয়্যা ডাকব না। মাস্টার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করে হেসে বললেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে, সে তোমাকে আপু ডাকবে তুমি তাকে ভাইয়্যা ডেকো। এবার পিচ্চিটার গুমরাহ মুখে হাসি ফুটল।

তারপর তিনি হাসানকে আদর করে বললেন ‘পুত্র, তোমার আব্বুর কি হয়েছিল, কিভাবে তিনি মারা গেলেন, আর আমাকেই বা খবর দেয়া হয়নি কেন? হাসান দুঃখ যন্ত্রণায় এমনিতেই অর্ধমৃত ছিল, তার উপর এতগুলি ছেংড়া মেয়ের উপস্থিতি, সে লজ্বায় মিইয়ে গেল। বিধ্বস্ত ও ক্ষীণ কণ্ঠে বলল ‘আব্বুর কোন অসুখ ছিল না। আমাদের টিনের দোতলা ঘরটা তো আপনি দেখেছেন, নদীর ভাঙ্গনে ঘরের অর্ধেক ভিট পর্যন্ত ভেঙ্গে গিয়েছিল। কিছুদিন আগে যে একটা বড় তুফান হইছিল না – সেই তুফানে ঘরটা ভেঙ্গে পড়ে যায়। আমি বাড়িতে থাকতাম না, মাদরাসায় থাকতাম। আব্বু ঘরের মধ্যে ছিল, তার উপর একটা খাম পড়ে চাপা দিয়ে রেখেছিল। লোকেরা এসে তাকে বের করল কিন্তু তিনি দাঁড়াতে পারলেন না। এরপর মাত্র একদিন একরাত্রি ছিলেন। মৃত্যুর আগে মাদরাসার হুজুরকে দিয়ে একটা চিঠি লিখালেন। তারপর আমাদের পাশের বাড়ির ইয়াকুব চাচাকে দিয়ে বললেন, ‘চিঠিসহ আমাকে যেন আপনার কাছে পৌঁছে দেয়। কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেল ইয়াকুব চাচা আসে না, সংসারি কাজ ফেলে এতদূর আসতে সাহস পায় না। কালকে তার বউ বলল ‘আপনার যাওয়ার দরকার নাই, আপনি ফুলপুর গিয়ে ওকে বাসে তুলে দিয়ে আসেন, তারপর সে একাই যেতে পারবে। আজ সকালে ইয়াকুব চাচা এসে আমাকে শেরপুরের বাসে তুলে দিল আর কিছু টাকা দিল। আমি শেরপুর নেমে মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে এ পর্যন্ত আসলাম।

মাস্টার ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ‘চিঠি কোথায়? হাসান পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে দিল। তিনি দ্রুত তা খোলে পড়তে লাগলেন- ‘আস-সালামু আলাইকুম। বড় ভাই উবায়দুল্লাহ, ভাই আমার বন্ধু আমার। বিদায় বন্ধু বিদায়, ইহকালে আর দেখা হবে না। আমার একমাত্র অনাথ সন্তানটাকে আল্লাহ্‌র হাওলায় রেখে গেলাম। এই পৃথিবীতে তার কোন সম্পদ, সম্বল, আশ্রয় ও অবলম্বন বলতে কিছু থাকল না। আমি তাকে তোমার হাতে সমর্পন করলাম, এখন একমাত্র তুমিই তার আশ্রয়। তোমার সন্তানরা যদি এক মুঠো ভাত পায় আমার সন্তানকে আধা মুঠো ভাত দিও। তোমার সন্তানরা যদি জ্ঞানার্জন করে তবে আমার সন্তানকেও জ্ঞানদান করিও। আমার জন্য দোয়া কর, আল্লাহ্‌ যেন আমাকে ক্ষমা করে তার নিয়ামত দান করেন। আল্লাহ তোমার সহায় হউন।

ইতি, তোমার ভাই, তোমার বন্ধু উসমান।

মাস্টার চিঠিটা পড়ে আবার ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলেন। চিঠির উপর তার অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর হাসানকে জড়িয়ে ধরলেন, হঠাৎ উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন, ‘আজ থেকে তুই আমার সন্তান, আমার উত্তরাধিকারী, এরা সব তোর ভাই-বোন। তারপর চোখ মুছে মেয়েদের উদ্দেশ্যে তিনি তার অতীত ইতিহাস বর্ণনা শুরু করলেন। হাসানদের পরিবারের সাথে পূর্বের আত্মীয়তা, সেখানে থাকা, লেখাপড়া করা, স্বাধীনতার সময় হাসানের বাবা কিভাবে তার জীবন বাচিয়েছিলেন, সেইসব ইতিহাস বর্ণনা করলেন। আর বর্ণনা করলেন এই উদ্দেশ্যে যাতে তার ছেলে মেয়েরা হাসানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে, তাকে ভাই হিসাবে মেনে নেয়। তারপর মেয়েরাও হাসানকে বিভিন্ন প্রশ্ন করল, শান্তনা দিল, আদর করল, সবাই খুশি আনন্দিত। হাসানও সকলের আদরে আহলাদে সন্তুষ্ট হল, নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে তার মনটা আনন্দে ভরে উঠল। এভাবে আলাপ করতে করতে রাত বারটা পার হয়ে গেল। তখন গৃহকর্ত্রি মেয়েদেরকে তাড়া দিলেন, এই রাত অনেক হয়েছে, ঘুমুতে যা। মেয়েরা নিজ নিজ কামরায় চলে গেল।

মাস্টার সর্ব দক্ষিণের রুমটি হাসানের জন্য মনে মনে বরাদ্দ দিলেন। কিন্তু প্রথম দিন ছেলেটা একাকি ভয় পেতে পারে বিধায় তিনিও গিয়ে তার সাথে শয়ন করলেন। হাসানের মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ঘুম পারালেন। শীঘ্রই তার ক্লান্ত দু’টি চোখেও ঘুম নামল। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক পর তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি আস্তে আস্তে উঠে হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিয়ে হাসানের মুখের উপর উপোর হয়ে পড়লেন। তিনি তাকিয়ে আছেন, তাকিয়ে আছেন তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব, সবচেয়ে রিক্ত, সবচেয়ে বদবখত এক বালকের মুখের দিকে। টপ টপ করে তার চোখের তপ্ত অশ্রু ছেলেটির মুখের উপর গড়িয়ে পড়ছে। আবার তার অশান্ত বক্ষে কান্নার ঢেউ আঁচড়ে পড়ল। তিনি আস্তে আস্তে উঠে বাইরে চলে গেলেন। একটু শান্ত হয়ে অজু করে এসে তাহাজ্জুদে দাঁড়ালেন।



সকালে হাসান সর্ব দক্ষিণের রুমটিতে বসে আছে। ফেরদৌসি এসে ডাকল ‘ভাইয়্যা ভাত খাবে চলো’ বলে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। কিছুক্ষণ গিয়ে হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে আপুমণি ডাকবে না? হাসান খুশিতে আত্মহারা, কত সুন্দর নাদুস নুদুস ফুটফুটে মেয়ে, তাকে ভাইয়্যা ডাকে। সে উত্তর দিল ‘হাঁ ডাকব। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত রান্না ঘরে পিড়ি বা চাটাই বিছিয়ে খাওয়া দাওয়া করা হয়। রান্না ঘরের মেঝেতে চাটাই বিছানো, তাতে মাস্টার বসে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। সামনে ভাতের ডিশ ও কয়েকটা তরকারীর বাটি, গৃহকর্ত্রি চুলোর ধারে বসে ভাত তরকারী বেড়ে দিচ্ছেন। হাসান গিয়ে মাস্টারের পাশে বসল। ফেরদৌসি বাবার সাথে বসে খায় কিন্তু আজ সে হাসানের পাশে বসে বলল, আমি ভাইয়্যার সাথে বসে খামু।

মা তাদের দুজনকে ভাত বেড়ে দিলেন আর মাস্টার নিজে নিয়েই খেতে লাগল। কয়েক লোকমা খাওয়ার পর হাসানের গলায় ভাত আটকে গেল, গিরা লাগল। সে হাত বাড়িয়ে কর্ত্রিকে বলল ‘গ্লাসটা একটু দেন। তিনি তাড়াতাড়ি গ্লাস এগিয়ে দিলেন। মাস্টার হাসল, তিনি বুঝতে পারলেন ছেলেটা এখনো কাউকে কিছু ডাকছে না, তাকে এখনো শিখানো হয়নি। তিনি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাজান, এই মহিলা কে জানো? ইনিই তোমার মা, তিন বছর বয়সে তোমার মা মারা যাননি, এখানে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন আর এখানেই থাকতেছেন। ইনিই তোমার আসল মা। এখন থেকে তুমি তাকে আম্মা বলে ডাকবে, পারবে না? হাসান লজ্বিতভাবে মাথা নিচু করে ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিল, ‘জ্বি আচ্ছা। গৃহকর্ত্রি মিটিমিটি হাসছেন, তিনি স্বামীর দিকে আঙ্গুল তুলে হাসানকে বললেন, ‘আর উনি কে জানো? উনিই তোমার বাবা। আজ থেকে তুমি তাকে আব্বা ডাকবে, কি বল? হাসান মাথা কাত করে সম্মতি জানাল।

মাস্টার মিটমিট করে হাসতে লাগলেন। তিনিও চান যে ছেলেটা তাকে আব্বা ডাকুক। কারণ বাপ ডাকলে অন্যের সন্তান বলে মনে হবে না, প্রকৃতই নিজের সন্তান বলে আত্মীকরণ করতে পারবেন। তদুপরি ছেলেটার মা বাপ নাই, এখন সে যেন নিজের মা বাপকে ভুলে যায় এবং তার অতীত গ্লানিময় জীবনের ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে এখানেই তার মা বাপ খুঁজে পায়। এই পরিবারকে নিজের পরিবার মনে করে আত্ম প্রশান্তি পায়। এজন্যই তিনি চাচ্ছেন হাসান তাদেরকে আব্বা আম্মা ডেকে তাদের সন্তানদের সাথে একাকার হয়ে থাকুক। কিন্তু হাসানের জন্য একটু সমস্যা হল। সে ছোট বেলা থেকে মা দেখেনি, কাজেই গৃহকর্ত্রিকে আম্মা ডাকতে তার জিবে বাধল না। প্রয়োজনের সময় কাছে না পেলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আম্মা আম্মা ডাকতে লজ্বা পেত না। কিন্তু আব্বা ডাকতে তার জিব আড়ষ্ট হয়ে আসে। কারণ সদ্য প্রয়াত ব্যক্তিকে সে সারা জীবন আব্বা ডেকেছে, এখন নতুন ব্যক্তিকে আব্বা ডাকে লজ্বা বোধ করতে লাগল। কয়েক দিন ইতস্তত করে ডাকতে ডাকতে এক সময় লজ্বা কেটে গেল। তারপর ধুম ধারাক্কা আব্বা আম্মা ডাকা শুরু করল।

গৃহকর্ত্রি হঠাৎ বললেন, ‘ওর কাপড় চোপড় গুলি দেখেছেন? জামাটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে নেটের মত হয়ে গেছে, আর লঙ্গিটা সবটা ছিঁড়া। আপনি স্কুলে যাওয়ার সময় ওকে সাথে নিয়ে গিয়ে কাপড় কিনে দেন। মাস্টার খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে বলল, হ্যাঁ নিয়ে তো যাবই কিন্তু আমি আরেকটা জিনিস ভাবছি ওকে ভর্তি করব কোথায় স্কুলে নাকি মাদরাসায়। গৃহকর্ত্রি বললেন, ওর যেহেতু কিছুই নাই, স্কুলেই ভর্তি করেন যাতে ভবিষ্যতে একটা চাকরি বাকরি করে খেতে পারে। কথাটা মাস্টারের মনে ধাক্কা দিল, তিনি উষ্মা প্রকাশ করলেন ‘কিছু নাই বলছ কেন, সে আমার সন্তান না, আমার ছেলেরা যা পাবে সেও তাই পাবে। এবার গৃহকর্ত্রি উষ্মা প্রকাশ করলেন, ‘আপনারই আর কি চাল চামড়াটা আছে, কয় কাটা জমি পাবে, তা দিয়ে কি ওর জীবন চলে যাবে? এবার মাস্টার লজ্বিত মুখে মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ঠিকই বলেছ কিন্তু কি করা যায়? কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, উসমান ছেলেকে মাদরাসায় দিয়েছিলে, এখন আমি স্কুলে নিয়ে গেলে এটা তার নীতির খেলাফ হবে। কাজেই আপাতত ওকে মাদরাসায় ভর্তি করি। কিছুদিন পর না হয় স্কুলে নিয়ে নিব, আর যদি মেধা ভাল হয় তাহলে দুটাই একসাথে চালাতে পারবে। গৃহকর্ত্রি বললেন ‘প্রস্তাবটা মন্দ না।

খাওয়া দাওয়ার পর কাপড় চোপড় পরে মাস্টার হাসানকে নিয়ে বাজারে রওয়ানা হলেন। সেখানে তার কাপড়ের অর্ডার দিয়ে তিনি স্কুলে চলে যাবেন, বাজারের পাশেই স্কুল। দর্জির দোকানে গিয়ে দুইটা পাঞ্জাবি ও দুইটা পায়জামার অর্ডার দিলেন। তারপর গিয়ে কারুকাজ করা একটা পাঞ্জাবি, দুইটা লুঙ্গি ও গেঞ্জি কিনলেন, নতুন কাপড়গুলি হাসানকে পরিয়ে পুরাতন ছেঁড়া কাপড়গুলি রাস্তার পাশে নিক্ষেপ করলেন। তারপর বললেন ‘বাজান, এখন তুমি বাড়িতে চলে যাও আমি স্কুলে যাই। হাসান সামনে গিয়ে একটা দোকানের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। তার চোখ দু’টি আনন্দে নেচে উঠল, তাকে রাজ পুত্রের মত দেখাচ্ছে। সে আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ির দিকে রওয়ানা হল।

উবায়দুল্লাহ মাস্টার কারমাইকেল কলেজে পড়ার সময় আধ্যাপক গোলাম আজমের হাত ধরে তাবলীগ জামাতে ঢুকেন। তখন থেকে দাড়ি রাখেন আর সব সময় পাঞ্জাবি টুপি পাগড়ি পরিধান করেন এবং তাবলীগের সাথে লেগে থাকেন। পরবর্তিতে সস্ত্রীক হাসানদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখলেন, হাসানের বাবা নিজের জায়গায় মসজিদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তা দেখে তিনিও এসে নিজের জমিতে মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি বিনা বেতনে মসজিদে নামায পড়াতেন, মাঝে মধ্যে ইদ্গাহের ইমামতিও করতেন। তাছাড়া এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তিনি মাদরাসাটাকে তিল তিল করে একটা বৃহৎ মাদরাসায় পরিণত করেন।

পরদিন তিনি হাসানকে সেই মাদরাসায় ভর্তি করে দিলেন। আর মাদরাসাটি ছিল বাড়ি থেকে মাত্র শ খানেক হাত দূরে। হাসান আগে থেকেই মেধাবি ছাত্র। শীঘ্রই সে মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মাস্টার প্রায় প্রতিদিন গিয়ে ছাত্র শিক্ষকের কাছে হাসানের লেখাপড়ার খোজ খবর নেয়। একদিন তিনি হাসতে হাসতে ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে ডাকতে লাগলেন, কই গো, কই গেলা, আরে তাড়াতাড়ি আস শুনে যাও ঘটনা। স্ত্রী এলে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে খাটে বসে হাসতে লাগলেন। স্ত্রী ধমক দিয়ে বললেন, এত হাসির কি হল, শুনি ঘটনাটা। তিনি স্ত্রীর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, আরে হাসব না মানে, শুন আশ্চর্য্য খবর। আরবি ভাষাজ্ঞানের আসল পড়া হল গ্রামার। আরবি কিতাব গুলিতে যের যবর পেশ ইত্যাদি হরকত দেয়া থাকে না, গ্রামার খাটিয়ে খাটিয়ে পড়তে হয়। হরকতে ভুল করলে গ্রামারে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ধরে ফেলে। আমাদের হাসান কত ঝানো পণ্ডিত হয়েছে জানো? কোন শিক্ষক ভুল করলেই সে হুট করে ধরে ফেলে। তার ভয়ে এখন আর কোন শিক্ষক--- হাসির তীব্রতায় তিনি আর কথা বলতে পারলেন না। হাসতে হাসতে যেন ভেঙ্গে পড়ছেন।

তারপর বিছানায় গড়িয়ে গড়িয়ে হাসতে লাগলেন। কর্ত্রি বারবার জিজ্ঞেস করছেন ‘হ্যাঁ কোন শিক্ষক কি হইছে? কর্তা হাসি থামানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। একটু দম নিয়ে বললেন, কোন শিক্ষক আর ক্লাসে যেতে সাহস পায় না’ বলে আবার হাসিতে ফেটে পড়লেন। কর্ত্রিও হাসতে লাগলেন, হাসির হিড়িক পড়ে গেল। এ যেন তাদের কাছে অলৌকিক কোন কিছু পাওয়ার মত সংবাদ। তারা আনন্দে আত্মহারা, নিজের সন্তানের মহা সাফল্যেও তারা কোন দিন এতটা আনন্দিত হয়নি। অনেকক্ষণ হাসাহাসির পর ক্লান্ত হয়ে গেল। তারপর কর্তা উঠে বসে বলল, হাসানের ভয়ে এখন আর কেউ ক্লাসে যেতে সাহস পায় না। আজ তাদের ক্লাসের জন্য অভিজ্ঞ তিনজন শিক্ষক বদল করে দেয়া হয়েছে, বলে তিনি আবার হাসতে লাগলেন। কর্ত্রি বললেন, আল হামদুলিল্লাহ, খোদার রহম, আল্লাহ অবশ্যি ইয়াতিম ছেলেটার উপর দয়া করবেন। কর্তা বললেন, হ্যাঁ তা তো করবেনই কিন্তু আমাদেরও তো কর্তব্য আছে। ওর পড়ার পরিবেশটা ঠিক করে দিতে হবে। কর্ত্রি বললেন, হ্যাঁ ভাল কথা মনে করছেন, আপনি ওর জন্য নতুন চেয়ার টেবিল বুকশেলফ ইত্যাদি বানিয়ে আনুন, পুরাতন চেয়ার টেবিল দেয়ার দরকার নাই। নতুন জিনিস দেখলে তার মনটা ভাল থাকবে। দু’দিনের মধ্যে হাসানের রুমে নতুন খাট, নতুন বিছানা এল। রুমের কোণায় নতুন চেয়ার-টেবিল, বুক শেলফ উঠল, নতুন হারিকেন ও অন্যান্য জিনিস পত্তর আসল। ব্যস তার রুমটা এখন নিরিবিলি স্টাডি করার মত, গবেষণা করার মত ঘর হল।

কিন্তু ফেরদৌসি সমস্যা বাধাল। আগে সে সন্ধার পর বাবার কাছে বা মায়ের কাছে পড়তে বসত। এখন তার বায়না হল হাসান ভাইয়্যার সাথে বসে পড়বে, এবার সে মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। হাসান যদি বলে, আপুমণি পড়। তখন সে কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে পড়বে, তারপর দুষ্টামি শুরু করবে, কলম নিয়ে বই খাতায় আকিবুকি করবে। কিন্তু যদি আপুমণি না বলে ফেরদৌসি বলে বা ধমক দেয় তাহলে আর পড়বে না, বই খাতা ছিঁড়বে কলম দিয়ে গুতাবে। হাসান যখন ঘরে না থাকে তখন সে গিয়ে চেয়ারে বসে। তারপর বই খাতা উলট পালট করে, পাতা ছিঁড়ে, কলম নিয়ে বইয়ে আকাঝুকা করে। কখনো দোয়াত উল্টে বই বা টেবিলের উপর কালি ফেলে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু অন্যায় করার পর আর সেখানে থাকবে না। পরে মা বাবা কিছু বললে কান্না জুড়ে দেয়। আর যদি হাসান বলে, ‘এই কালি ফেললি কেন’? তখন সে মুখটা গম্ভীর করে চোখ রগড়িয়ে বলে, ‘আমি ফেলেছি তুই দেখেছিস? – তুই ছাড়া এখানে আর কেউ আসে না। - আচ্ছা আমি ফেলেছি তুই দেখেছিস? – তুই ছাড়া আর কে করবে? – না, আগে বল তুই দেখেছিস নাকি? হাসান যত কথাই বলুক তার দলীল একটাই, যেহেতু সে দেখে নাই কাজেই সেও কালি ফেলে নাই। কিন্তু যদি ধমক দেয় তাহলে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে মাকে গিয়ে বিচার দিবে, ভাইয়্যা মেরেছে।

ফেরদৌসি ছিল অসম্ভব মোটা। রাগের সময় যদি হাসান তাকে ভটকি বা ভেটকি (মোটা) ডাকল তো সর্বনাশ করল। একেবারে আহত বাঘিনীর মত তার উপর হামলে পড়ে, তারপর চিমটিয়ে খামছিয়ে কামড়িয়ে হাসানকে নাস্তানাবুদ করে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে মায়ের কাছে বিচার দিবে, ভাইয়্যা আমাকে মারছে। মা তখন বুঝায়, তুমি আর ওর কাছে যেয়ো না, ও খুব পচা খালী মারে, তুমি আমার

কাছে পড়বা’ যাতে সে হাসানের পিছু ত্যাগ করে কিন্তু পরদিন আবার গিয়ে ভাইয়্যার টেবিলে উপস্থিত। মা বাবা কেউ আনতে গেলে আসবে না, জোর খাটালে কান্নাকাটি শুরু করে। এভাবেই দু’টি বালক বালিকার মধ্যে জোয়ার ভাটার ন্যায় সম্পর্কের উজান ভাটি চলতে থাকে।

উবায়দুল্লাহ মাস্টারের সর্ব জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ দুই ছেলে, মাঝখানে পিঠাপিঠি আট মেয়ে। তন্মধ্যে তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে, আর বড় ছেলে ঢাকায় এক কলেজে অনার্স পড়ে। বাকিরা সবাই বাড়িতে থাকে। তাছাড়া কামলা, দুই জন লজিং- একজন মসজিদের ইমাম ও অন্যজন মাদারাসার ছাত্র। সব মিলিয়ে বিশাল পোষ্যভারাক্রান্ত এক পরিবার। তার ফসলি জমি খুব বেশি ছিল না, শুধু খোরাক চলত, বেতন দিয়ে সংসারি খরচ চলত। আর এমন ব্যয় বহুল পরিবারে সর্বদা নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা বিরাজ করে। সব সময় ভাল মন্দ খাওয়া সম্ভব ছিল না, তরি তরকারির একটা টানাটানি লেগেই থাকত। অধিক পোষ্য থাকার কারণে মাছ গোশত বা অন্য যে কোন ব্যঞ্জন বেশি করে কাচা সবজি দিয়ে লম্বা ঝুল রাধতে হত, নইলে শেষের দিকে যারা খেত তাদের টান পড়ত।

কিন্তু হাসানের জন্য দেখা দিল সমস্যা, সে লম্বা ঝুল ও তরকারি খেতে পারে না। ছোট বেলা থেকেই তার পসন্দ ছিল মাছ, গোশত, ডিম ইত্যাদির শুকনা ব্যঞ্জন, এ জাতীয় একটু তরকারি হলেই তার খাওয়া হয়ে যায়। আর তাকে সেভাবেই তৈরি করে দেয়া হত। সকাল বেলা সে খেতে বসে লম্বা ঝুল দেখে কয়েক লোকমা খেয়ে উঠে গেল। দুপুরে খেতে বসল আবার সেই অবস্থা, কয়েকটা মাছে প্রচুর চিচিঙ্গা দিয়ে লম্বা ঝুল। হাসান দু’তিন লোকমা খেয়ে হাত ধুতে গেল, অমনি মা চেঁচিয়ে উঠলেন, এই রাখ রাখ হাত ধুবি না। তখন তিনি পাতিল থেকে কয়েকটা মাছ বেছে দিয়ে জোরজার করে আরো কয়েক লোকমা খাওয়ালেন। তারপর বললেন, এভাবে খেলে তো তুই বাঁচবি না, আচ্ছা দেখি রাত থেকে তোর জন্য কষানো তরকারি থেকে একটু করে রেখে দিব নে খন। আর তুই বিকালে খোরাফিরা না করে কিছু মাছ মারতে পারিস না, দুয়েকটা মাছ হলেও তো তোর জন্য আলাদা একটু ভুনা করে দিতে পারি।

রাত্রে নিয়মানুযায়ি এশার পর সে রান্না ঘরে খেতে গেল। তখন দু’তিন জন খেতে বসেছে। মা বললেন, এখন জায়গা নাই পরে আয়। আসলে জায়গায়ও আছে পিড়িও আছে প্লেটও আছে কিন্তু এখন ভাত দিবেন না। হাসান বুঝতে পেরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আসলে মা বললেন, আরে বাওদা (বোকা) ওদের সামনে আসিস কেন, ওদের খাওয়ার আগে অথবা পরে আসবি। না না, আগে আসার দরকার নাই, পরেই আসবি। কেউ দেখে ফেললে আবার তোর সাথে বিদ্বেষ করবে। তারপর তিনি হাসানের পাতে একটু ভুনা মাছ দিয়ে ভাত দিয়ে ঢেকে দিলেন। আর উপরে একটু সাধারণ তরকারী দিয়ে রাখলেন যাতে কেউ দেখলে মনে করে হাসানও তাদের মত সাধারণ তরকারী দিয়ে খাচ্ছে। এভাবে মা প্রতিদিন মাছ গোশত ডিম ভুনা করে বা কশানো তরকারী থেকে একটু ব্যঞ্জন বাটিতে ভরে লুকিয়ে রাখতেন। নিজের স্বামী সন্তান কাউকে দিতেন না। সর্ব শেষে হাসান খেতে আসলে ভাতের নিচে লুকিয়ে আসল তরকারীটা দিতেন আর কমন তরকারিটা পাতের উপর দিয়ে রাখতেন। এ অভ্যাসটা নিয়মে পরিণত হল। আবার হাসানও বসে নেই, সে প্রতিদিন বিকালে জাল বাইর বর্শি ইত্যাদি দিয়ে কিছু কিছু মাছ মারার প্রচেষ্টা চালাতে লাগল।

বিষয়: সাহিত্য

৮৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File