সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- 29- 30
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৩:১২:৪৮ দুপুর
চতুর্থ অধ্যায়
১
জামালের হৃদয় পটে ফিরকাবাজির যে জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল, বিতর্কানুষ্ঠানে কোরান হাদীস ও যুক্তির মুহুর্মুহু হাতুড়ি পেটায় তা অপসৃত হয়ে তার মনে সত্যের আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এরপর থেকে তার হৃদয়ে যেন নিরন্তর দুটি কাটা ফুটতে লাগল। একটি হল শিবির করার কারণে খালাত ভাইয়ের জানাযা না পড়া, অন্যটি হল আহলে হাদিসের পাঁচটি পরিবারকে রিক্ত ও সর্বস্বান্ত করে দেশ থেকে বিতারিত করা। ফিরকাবাজির পরিণতি যে কত বিষময় তা সে হারে হারে টের পেতে লাগল। সে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকে আর চিন্তা করতে থাকে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত কি। অনেক চিন্তা ভাবনার পর সিদ্ধান্ত নিল হাসান মুসান্নার কাছে যাবে, তার কাছে পরামর্শ চাইবে। এখন তার দৃষ্টিতে হাসান মুসান্নাই একমাত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ, তার মুর্শীদ, ইসলাম ও উম্মাহর ভাবী ত্রানকর্তা।
একদিন জহুরের নামায পড়ে সে মুসান্নার কাছে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টি বুলাল, কম ভাড়ার নিম্ন মানের একটা রুমে তিনি থাকেন। লোনা ধরা দেয়ালের কোথাও কোথাও প্লাস্টার উঠে গেছে। ফুটপাতের কিনা কম মূল্যের চৌকি, কোন তোষক নাই একটা কাথা বিছানো, পাশের দেয়ালে কম দামের একটা মশারি গুটিয়ে রাখা, সামনে ফুটপাতের একটা টেবিল, তার উপর কয়েকটা বই, একটা গ্লাস ও একটা জগ। ঘরের এক পাশে টানানো রশিতে একটা লুঙ্গি, দুইটা জামা ও একটা গেঞ্জি ঝুলছে। ব্যস ঘরের মালামাল এ পর্যন্তই, খাওয়া- দাওয়া করেন পাশের এক মেসে। তিনি চৌকিতে শুয়ে আছেন, চোখের সামনে দুহাতে একটা বই ধরে পড়ছেন। এজন্য তাকে দেখতে পাননি।
জামাল আপন মনে হাসল, কত মুর্খ নাদান কত ভোগ বিলাস ও জৌলুসপূর্ণ জীবন যাপন করছে অথচ একজন অবিসংবাদিত শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত ব্যক্তির এই হল জীবন চিত্র। আর ইনিই যথা শীঘ্র মুসলিম বিশ্বের কায়া পাল্টে দিতে যাচ্ছেন। হাঁ একমাত্র ইনিই পারবেন, কারণ তিনি যথার্থই উমর বিন আব্দুল আযিয। সে সালাম দিয়ে বলল, উস্তাদজি আসতে পারি? তিনি ‘আস’ বলে উঠে বসলেন। ঘরে বসার মত কোন চেয়ার বা তেপায়া নাই। চৌকির কোণার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন ‘বস, তুমি কে? জামাল বলল ‘আমি মোজাহিদ সাবের ছাত্র। আমার বাবা মাওঃ জালালুদ্দিন শাপলা চত্বরে শহীদ হয়েছেন, আমি তার একমাত্র ছেলে। শহীদ সন্তান শুনে তিনি স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কেন এসেছ, আমি কি তোমার কোন কাজে আসতে পারি?
জামাল শ্রদ্ধায় গদগদ করে বলে উঠল ‘উস্তাদজি, আমি দুটি বিষয় নিয়ে খুব মনোকষ্টে আছি। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শের জন্য এসেছি। তারপর সে ঘটনা দুটি বর্ণনা করল। তিনি মাথা নিচু করে বসে আছেন, ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় তার মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। জামাল ভয় পেতে লাগল, গালিই দেয় নাকি মারেই, কে জানে। সহসা তিনি গর্জে উঠলেন, ‘ফিরকাবাজি ফিরকাবাজি, ফিরকাবাজি, এই ফিরকাবাজির কারণেই তোমার বাবাকে জীবন দিতে হল। আর এ বিষে তুমিও আক্রান্ত হলে। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি কি তোমার বাবার নামে কোরান শরীফ পড়? –জ্বী। - দৈনিক কতটুকু? – এক পারা। - তুমি কি হাফেয ? – জ্বী। - তাহলে এক পারা কেন, আরো বেশি পড়বে। আনাগুনা ও শুয়ে বসে থাকার সময়টাতে মুখস্ত পড়বে সমস্যা তো নাই। আর এখন থেকে তোমার বাবার সাথে খালাত ভাইয়েরও নিয়ত করবে। অর্থাৎ দুজনের নামেই তেলাওয়াত করে তাদের নামে বখশে দিবে। এটাই হল খালাত ভাইয়ের জানাযা না পড়ার পাপের কাফফারা।
আর যাদেরকে তুমি দেশ থেকে উচ্ছেদ করেছিলে তারা ধন সম্পদ ও শারীরিক- মানসিকভাবে যে ক্ষতির শিকার হয়েছে তা তুমি পোষিয়ে দিতে পারবে না। কাজেই তাদের সাথে যোগাযোগ রাখ, সম্পর্ক রাখ, তাদের হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাও। কিন্তু যে মেয়েটির বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিলে তার কি বিয়ে হয়েছে? - তা আমি জানি না। - ঠিক আছে খোজ নাও। যদি না হয় তাহলে মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা কর। তাছাড়া তোমারও তো বিয়ের বয়স হয়েছে, যদি তারা তোমার কাছে দিতে সম্মত থাকে তাহলে নিজে গ্রহন কর। জামাল লজ্বায় মাথা নিচু করল। তিনি আরো কিছু উপদেশ দিয়ে তাকে বিদায় দিলেন।
মুক্তাগাছা থেকে জামালপুরে ছেড়ে আসা আহলে হাদীসের পাঁচটি পরিবারের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তারা সর্বস্ব হারিয়ে যৎকিঞ্চিত টাকা নিয়ে এসেছিল- তা দিয়ে কোন রকম বাস্তু- ভিটা কিনে বাড়ি করতে সক্ষম হয়েছিল। ফসলি জমি কিনা বা ব্যবসা করার মত অর্থ কড়ি তাদের হাতে ছিল না। অগত্যা জীবন ধারনের জন্য তাদের কেউ কেউ মনিষ খাটে, কেউ নিম্ন মানের ব্যবসা করে, কেউ অন্যের জমি বর্গা চষে, কেউ দোকানে বা হোটেলে কাজ করে। ফেরকাবাজির যাতাকলে পড়ে এভাবেই চলছে তাদের মানবেতর জীবন। অথচ আগে তারা সবাই ছিল স্বচ্ছল কৃষক। কেউ কেউ ছিল ভাল মানের ব্যবসায়ি।
ছমির মণ্ডল যে টাকা নিয়ে এসেছিল তা দিয়ে এক খণ্ড জমি কিনে কোন রকম দুইটা ঘর উঠাতে সক্ষম হল। থাকার জন্য এক ছালা একটা টিনের ঘর ও একটি রান্না ঘর। যে বেচারা আগে ছিল মধ্যবিত্ত কৃষক, প্রচুর জমিজমা ছিল, কয়েকশ মণ ধান উৎপাদন করত, এখন সে লাজ লজ্বার মাথা খেয়ে শাক সবজির ব্যবসা করে কলুর বলদের মত সংসারের ঘানি টেনে চলেছে। তার ঘরের সামনের ফাকা জায়গায় ও বাড়িতে শাক সবজি আবাদ করে, আবার এলাকা থেকে কিনে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে। তার দুই ছেলে দুই মেয়ে ও তারা দু’জন, এই ছয়জন মানুষের সংসারের বোঝা বহন করতে গিয়ে তার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে। মেয়েরা বড় ছেলেরা ছোট। কাজেই তারা বাবাকে সাহায্য করতে পারে না। তার গিন্নি বাড়িতে হাঁস মুর্গী পালে, অন্যের গরু ছাগল ভাগে নিয়েছে, কিছু জমি বর্গা করে। এভাবে অতীব কষ্টে তার সংসার চলে কিন্তু এতেও তার দুঃখ নাই।
তার আসল দুঃখটা হল জমীলার আজো বিয়ে হয়নি। মুক্তাগাছায় বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনাটা সরিষাবাড়িতে প্রচার হয়েছে যে, জমিলার আগে বিয়ে হয়েছিল স্বামী তালাক দিয়ে দিয়েছে। এখন তালাক প্রাপ্তা মেয়ের জন্য সাধারণত কোন ঘর আসে না। সুন্দরী মেয়ে দেখে দুয়েকটা ঘর যাওবা আসে বউ মারা গেছে, এক দুই হালি সন্তান আছে- এ জাতীয় বর। ছমির মণ্ডলের মেয়ে দুটিই যথেষ্ট সুন্দরি। জমিলার লেখাপড়া বন্ধ কিন্তু নাবিলা সরিষাবাড়ি কলেজে পড়ে। তার জন্য অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। চাকরিজীবি ব্যবসায়ী ইত্যাদি ভাল ভাল ঘর আসে। কিন্তু বাবা মা তো আর বড় মেয়ে ঘরে রেখে ছোট মেয়ে বিয়ে দিতে পারেন না। তাই সে নির্লজ্জ বেহায়ার মত নাবিলার জন্য আসা পাত্রপক্ষকে বলে ‘নাবিলার চেয়ে আমার জমিলা অনেক ভাল, অনেক সুন্দরী, লক্ষি মেয়ে, তাকে নেন।
পাত্র পক্ষ বলে, সে তো তালাক প্রাপ্তা। তখন ছমির মণ্ডল কাঁদে, তাদের হাতে ধরে কাকুতি মিনতি করে, ‘আপনারা বিশ্বাস করেন, আমার মেয়ের বিয়ে হয়নি শুধু কথা বার্তা পাকা হয়েছিল। তখনই গ্রামের মসজিদের ইমাম আমরা আহলে হাদীস বলে বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়। বিশ্বাস না হলে আপনারা মুক্তাগাছা গিয়ে যাচাই করে আসুন। কিন্তু এক কন্যা দায় গ্রস্থ বাবা যতই আর্তনাদ করে তার হাহাকার শুধু ইথারে বাজে পাত্র পক্ষের হৃদয়ে বাজে না। ছমিরের কান্না ও কাকুতি মিনতি দেখে তাদের অবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়, সন্দেহ প্রবন হয়ে উঠে, ভাবে মেয়েটার হয়ত আরো সমস্যা আছে। তখন পাত্র পক্ষের কেউ বলে ‘এই বুড়ি মেয়ে বিয়ে করাব নাকি। কেউ বলে ‘আমরা এতই পানিতে পড়েছি যে, একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়ে বিয়ে করাতে হবে। এভাবে তারা ক্রোধ ঝেড়ে চলে যায়। জমিলার বিয়ে হয় না, জমিলার কারণে ছোট বোনের বিয়ে আটকে আছে। আর দু’বোনের বিয়ের কারণে বাবা মায়ের ঘুম আটকে আছে, রাতে তাদের চোখের পাতায় কাটা ফুটে। এই হতভাগ্য দম্পতি ভাবে মেয়ে দুটির বিয়ে দিতে পারলে তারা ভিক্ষে করে খেলেও নিজেদেরকে সুখি ভাবতে পারবে।
ছমির মণ্ডল বাড়ির আঙ্গিনায় ডাটা করল্লা ও অন্যান্য কিছু তরকারী করেছে। সেখান থেকে কিছু তরকারী তুলে নিয়ে আসল, আর কিছু গ্রাম থেকে কিনে নিয়ে এসেছে। সেগুলি নিয়ে উঠানে বসে আঁটি বেঁধে বাজারে নেয়ার জন্য তৈরি করছে। ডাটার আটি বাঁধতে বাঁধতে সে কলার পাতরা নির্মিত দেউরির ফাক দিয়ে দেখল একজন হুজুর টাইপের লোক তার বাড়ির দিকে আসছে। লোকটা এসে বাইরের উঠানে দাঁড়াল। দেখেই তার শরীরটা কাটা দিয়ে উঠল, ধমনিতে রক্ত সঞ্চালন তীব্র হয়ে উঠল, মাথায় রক্ত উঠে গেল। নিজের অজান্তেই তার হাত চলে গেল পাশে পড়ে থাকা দায়ের হাতলে। উল্কার বেগে ছুটে গিয়ে লোকটাকে কুপিয়ে কুপিয়ে চাক চাক করে ফেলল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, শরীরটা কাঁপছে। দায়ের হাতল ধরে মাথা নিচু করে উবু হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল, নিজেকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে। কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এল।
চরম শত্রুও বাড়িতে এলে নিরাপত্তা দিতে হয়। কাজেই সে রাগ নিয়ন্ত্রণ করল। হাতলটা ছেড়ে উঠে গজেন্দ্র গমনে লোকটার কাছে গেল। জামাল সালাম দিয়ে বলল, চাচা কেমন আছেন? মণ্ডল কোন উত্তর না দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, আবার কোন সর্বনাশ করতে এসেছ? জামাল মুচকি হেসে বলল, আপনাকে একটা কিসসা শুনাতে এসেছি। মণ্ডলের মাথায় আবার রক্ত উঠে গেল। তাদেরকে পথের ভিখারী বানিয়ে, এত বড় সর্বনাশ করেও যে এভাবে ইয়ার্কি মারে তাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। একবার ভাবল, বাড়ির অন্যদের ডেকে নিয়ে এসে ওকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলবে। কিন্তু সে ধৈর্য্য ধারন করে বলল, বল কি বলতে চাও। জামাল বলল, দাঁড়িয়ে কিসসা বলা যায়, একটু বসতেও দিবেন না?
মণ্ডল বাড়ির ভিতরে চলে গেল। দুইটি তেপায়া নিয়ে এসে চালা ঘরের সামনের বারান্দায় গিয়ে বসল। তবে সে ঘৃণা ও অবজ্ঞায় কিছুটা তফাতে বসল। জামাল শুরু করল ‘প্রাচীন আরবের ঘটনা। হারেছ নামক এক যুবক বিখ্যাত প্রতাপশালী কুব্বাদ বিন কুবাইসের বাড়িতে আশ্রয় নিল। আশ্রয় দাতা তার থাকা খাওয়া ও আরাম আয়েশের উত্তম ব্যবস্থা করল। হারেছ লক্ষ করল, তার মুনিব প্রতিদিন ভোরে বেড়িয়ে যায় আর গভীর রাতে বাড়ি ফিরে। সে ভাবে, নিশ্চয়ই তার মুনিবের কঠিন ও জটিল কোন কাজ আছে, এত দয়ালু মুহসিন আশ্রয়দাতা এমন কষ্ট করতেছে, তার কাজে সে সাহায্য করবে। একদিন রাতে সে গিয়ে আশ্রয়দাতাকে এ ভ্রমণের কারণ জিজ্ঞেস করে প্রতিশ্রুতি দিল ‘আমি আপনার কাজে সাহায্য করব’। তখন কুব্বাদ বললেন, তাইফা গোত্রের এক লোক হুবলের মেলায় আমার বাবাকে হত্যা করেছিল, আমি প্রতিদিন ঐ ব্যক্তির খোঁজে বের হই, তাকে হত্যা করে আমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে।
হারেছ কিছুক্ষণ পাথরের মত জড়বৎ দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর আস্তে আস্তে গিয়ে মুনিবের সামনে মস্তক অবনত করে বলল, আমিই তাইফা গোত্রের সেই মুজরিম, আপনি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিন। কুব্বাদের শরীরটা কেঁপে উঠল, সহসা তার হাত তরবারির বাটে চলে গেল, তার ভিতরের সিংহটা হুঙ্কার ছাড়ল, শরীর ঘামছে। কিন্তু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে হারেছের দিকে পশ্চাৎফিরে দাঁড়িয়ে বলল, কাল সূর্যোদয়ের আগেই তুমি এত দুরত্বে যাবে যেন কোন ভাবেই আমি তোমাকে খোঁজে না পাই। অন্যথায় আশ্রিত হত্যার গুনায় আমি গুনাহগার হয়ে যাব। শেষ রাত্রে মুনিবের গোলাম হারেছকে ডেকে তোলে বাইরে নিয়ে গেল, সাজোয়া ঘোড়া দেখিয়ে বলল, আপনি এই মুলুক ছেড়ে অন্য কোন মুলুকে চলে যান, যাতে আমার মুনিব কোন দিন আপনাকে খোঁজে না পায়। এক থলে আশরফি (স্বর্ণমুদ্রা) হাতে দিয়ে বলল, আমার মুনিব এগুলি আপনাকে দিয়েছেন, এতে আপনার বাকি জীবন আরাম আয়েশে চলার ব্যবস্থা আছে।
তারপর জামাল হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। মণ্ডলের সামনে গিয়ে রুকু দেয়ার মত উবু হয়ে চেঁচিয়ে উঠল ‘চাচা আমি আপনাদের সর্বনাশ করেছি, আপনাদের সম্পদ ধ্বংস করেছি, দেশ থেকে বিতারিত করেছি, আপনার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছি, এত সব ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দেয়া তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই মুজরিম আপনার সামনে দাঁড়িয়ে, এই আপনার সুযোগ, এই সুযোগ কাজে লাগান। সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, ‘যে ধর্মের নামে আপনাদের এত বড় সর্বনাশ করলাম, সেই ধর্মের দর্পনেই দেখতে পেলাম আমার পরকাল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন হয় আপনারা আমাকে হত্যা করুন অথবা গোলাম বানিয়ে বিক্রি করুন বা কামলা খাটিয়ে আপনাদের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিন। তার কান্নার বেগ বেড়ে গেল, চিৎকার করে কাঁদতে লাগল ‘একটা কিছু করুন, আমাকে বাচান, পরকালের হিসাব থেকে আর জাহান্নামের আগুন থেকে আমাকে রক্ষা করুন। কষ্ট ও অনুশোচনার আতিশয্যে সে আর কথা বলতে পারল না, শুধু গোঙাতে লাগল।
মণ্ডল ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, এমনটা সে কল্পনা করেনি, সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জামালকে জড়িয়ে ধরে সেও কেঁদে উঠল ‘শান্ত হও বাবা, শান্ত হও। যা হবার হয়ে গেছে, তা নিয়ে এখন আর অনুশোচনা করে লাভ কি। এসব আমাদের ভাগ্যলিপি, তুমি আমি খণ্ডাব কেমনে। জামাল নিজেকে ছাড়িয়ে ঝংকার দিয়ে উঠল ‘ভাগ্যলিপি, কিসের ভাগ্যলিপি? ফেরকাবাজ আলেম নামের কিছু শয়তান আমাদেরকে বিভক্ত করে পরস্পরের শত্রু বানিয়ে একেকটা সম্প্রদায়ে পরিণত করেছে। তারপর বলছে কামড়াও, কুকুরের মত কামড়া কামড়ি করে মর। ইহকালে ধ্বংস হও পরকালে জাহান্নামে যাও। অথচ আল্লাহ রাসূল (সাঃ) এর হুকুম হচ্ছে বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে ভূপৃষ্ঠে খোদার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ফেরকাবাজরা খোদার নির্দেশ পিছনে নিক্ষেপ করে মুসলমানকে মুসলমানের শত্রু বানিয়েছে, কুকুর বানিয়েছে। আর আমরাও এই সব শয়তানদের উম্মত হয়ে গেছি। কোরান হাদীস কি বলছে সে দিকে না তাকিয়ে এই শয়তানদের হুকুম তামিল করছি।
যে মুসলমান পরস্পরের সহযোগি হওয়া ফরয, আমরা তা না করে একে অন্যকে ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি। কাজেই আপনি ভাগ্যকে দোষ দেন কেন, ঐ ফিরকাবাজদের আর নিজেদেরকে দোষ দিচ্ছেন না কেন? ওরাই আমাদেরকে এভাবে তৈরি করেছে যেন আমরা একে অন্যকে ধ্বংস করি আর কুকুরের মত কামড়া কামড়ি করে মরি। আর এই সুযোগে কাফেররা আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে। চাচা খোদার কসম করে বলছি, আপনি আমি ঐ মুজরিমদের বিচার করতে পারি আর না পারি কিন্তু জানবেন ওদের বিচার আসন্ন। আপনি কান পেতে শুনুন, ঐ নব যুগের পদধ্বনি শুনা যায়। এসে গেছে, এসে গেছে যুগের নকীব, পতিত উম্মাহর ত্রানকর্তা। সে ঘুমন্ত জাতিকে খোচা মেরে মেরে জাগ্রত করছে, শীঘ্রই শুনতে পাবেন তার হুঙ্কার। তখন আর এসব ফিরকাবাজ মুজরিমরা কোন সিংহের গুহায় বা মুসিকের গর্তে আত্মগোপন করেও শেষ রক্ষা করতে পারবে না। আপনি কি চিনেন সেই নাজাত দাতাকে, তার নাম হাসান মুসান্না।
জামাল উচ্ছসিত ও উত্তেজিত ভাবে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে এমনভাবে কথা বলছে যেন নাটকে পাঠ করছে। মহিলারা দরজা জানালার ফাক গলে এসব দেখছে। মণ্ডল হতভম্ব হয়ে জামালের বক্তব্য শুনছে, সে বিস্ময়াবিভুত, মনে হচ্ছে যেন জীবনে এই প্রথম নতুন কিছু শুনছে। সে বলল, হাসান মুসান্না নামটা আমি অনেকবার শুনেছি। প্রতি শুক্রবার নাকি সে কিসের অনুষ্ঠান করে। এখানকার অনেক শিক্ষিত লোক তার মজলিসে যায়। জামাল বলল, এতদিন শুনেছেন কিন্তু এবার দেখার সময় হয়েছে, খুব শীঘ্রই দেখতে পাবেন। যাই হউক চাচাজান আমি যে জন্য এসেছি’ বলে সে একটু দম নিল, মাথা নিচু করল, লজ্বায় লাল হয়ে উঠল, তার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে এল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, জামিলার কি বিয়ে হয়েছে? মণ্ডল বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘না, মুক্তাগাছায় পুলিশ ছেলেটার সাথে বিয়ে ভাঙ্গার ঘটনাটা এখানে প্রচার হয়েছে যে, জমিলা তালাক প্রাপ্তা। এখন এই মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। ছোট মেয়েটার জন্য ভাল ভাল ঘর আসছে কিন্তু ওর জন্য বিয়ে দিতে পারছি না। কি যে ছিল কপালে, বলে সে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
জামাল অন্য দিকে ফিরল, লজ্বায় তার কণ্ঠ বুজে এল। মিনমিনিয়ে বলল, ‘চাচাজান, আমি হাসান মুসান্নার শিষ্য। তার সাথে পরামর্শ করেছি, তার নির্দেশ মতই এসেছি এবং সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি। চাচাজান আমার জন্ম কর্ম আপনাদের হাতে, আপনাদের সামনেই বড় হয়েছি, আমার ও আমার পরিবারের সব কিছুই আপনার জানা। কাজেই যদি ... যদি...... যদি জমিলার জন্য আমাকে একান্ত অযোগ্য মনে না করেন তাহলে..... লজ্বায় কথা শেষ করতে পারল না। মণ্ডল কিছুক্ষণ বিদ্যুৎ পিষ্টের ন্যায় নিশ্চল বসে থাকল। তার মনে হল যেন কেউ তার মাথার উপর থেকে হিমালয়টা ধাক্বা দিয়ে সরিয়ে দিল। জামাল দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সহসা সে জামালের কাছে গিয়ে কাঁধে ধরে কেঁদে ফেলল, তুমি আমাকে মুক্তি দিবে বাবা, আল্লাহ বুঝি তোমাকে আমার মুক্তিদাতা করে পাঠালেন।
জামাল বলল, মুক্তি কি বলছেন, আমি অন্যায় করেছি, ওর বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছি এখন প্রায়শ্চিত্ত তো আমাকেই করতে হবে। মণ্ডল সহসা জামালের কাঁধ ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ নিরব থাকল। তারপর তেপায়ায় বসে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, জামাল তুমি হাসান মুসান্নার শিষ্য, তার কথায় তোমার মধ্যে অনুশোচনা এসেছে। আমাদের ক্ষতি করার জন্য তোমার মনে অপরাধ বোধ জেগে উঠেছে। এটাই তোমার তওবা হয়ে গেছে, আল্লাহ তোমাকে মাফ করবেন। তোমাকে নতুন করে আর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না। আমার মেয়ের কপালে যা আছে তাই হবে, তোমার ত্যাগ স্বিকার করার দরকার নাই। আমি তোমার কাছে বিয়ে দিব না। জামাল এই প্রথম হবু শশুরের দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘চাচাজান, আসলে কথাটা আমি ঠিক ভাবে বলতে পারিনি। আসল কথাটা হল শুধু প্রায়শ্চিত্তের জন্য নয়, ওকে আমি আগে থেকেই পসন্দ করি। আপনি তো জানেনই সে মুক্তাগাছা কলেজে আর আমি মাদরাসায় পড়তাম, দুজন একই রাস্তায় যেতাম। একবার ভেবেছিলাম বিয়ের প্রস্তাব দিব। কিন্তু তখন আমার পারিবারিক অবস্থা বিয়ে করার মত ছিল না, আর আপনিও হয়ত দিতেন না। কাজেই ধরে নিন আগের প্রস্তাবটাই এখন দিচ্ছি।
জমিলা জানালার ফাক দিয়ে এতক্ষণ সব দেখছে আর শুনছে। তার মাথা ঘুরাচ্ছে, আস্তে আস্তে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ থেকে টপ টপ করে অশ্রুর ফোটা বালিশে গড়িয়ে পড়ছে। মণ্ডল চেঁচিয়ে উঠল ‘আল হামদুলিল্লাহ, আল্লাহ্র শুকর, তিনিই মানুষকে বিপদে ফেলেন তিনিই উদ্দার করেন। জানের দুষমন কখনো হয় জানের বন্ধু, আজ তুমি হলে আমার মুক্তিদাতা’ বলতে বলতে সে বার বার উপরে তাকিয়ে মনে মনে আল হামদুলিল্লাহ পড়তে লাগল। তারপর বলল, জামাল তুমি তোমার মাকে নিয়ে একদিন আস। উনিও তো অনেক দিন ধরে ওকে দেখেননি। আর তোমার যেহেতু অভিভাবক নাই উনিই বিয়ের কথাটা পাকা করে যাবেন। জামাল বলল, জ্বি হাঁ, আম্মাকে নিয়ে খুব শীঘ্রই আসব, তিনিই আলাপ সমাধা করবেন। তবে আমাদের কাজটা হতে একটু দেরি হবে, আমার কনিষ্ঠ বোনটা এখনো বিয়ের বাকী। অবশ্য বেশ কয়েকটা ভাল ভাল ঘর আসছে, আশা করি খুব শীঘ্রই বিয়ে হয়ে যাবে। আর আমি এখন ময়মনসিংহের বড় মাদরাসায় পড়ি, আমার পরিক্ষার এখনো কয়েক মাস বাকি। পরিক্ষার পর একটা কর্ম জুটিয়ে তারপর বিয়ের কাজটা শেষ করা আমার ইচ্ছা।
মণ্ডল বলল, তা হউক দেরি হউক কোন সমস্যা নাই কিন্তু তোমার মাকে একবার নিয়ে আস। আমার ইচ্ছা, তোমাদের ব্যাপারটা নিশ্চিত করে আমি ছোট মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করব। মনে মনে বলল, তাহলে আমি একটু ঘুমুতে পারব, তারপর আমি যদি ভিক্ষে করেও খাই তবুও আমি মহাখুশি। এখন বুঝবে না, সন্তান হলে তারপর বুঝবে। জামাল বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আম্মাকে নিয়ে শীঘ্রই আসব, এখন তাহলে উঠি। মণ্ডল বলল, ‘না না এত দূর থেকে এসেছ চারটা না খেয়ে যাবে কেমনে। জামাল বলল, সর্বনাশ আমি সরাসরি মাদরাসা থেকে এসেছি, আম্মা জানে না। আরো দেরি করলে তিনি দুশ্চিন্তায় কান্নাকাটি শুরু করে দিবেন’ বলে সে সালাম দিয়ে হাটা শুরু করল।
এবার কর্ত্রি গলা বাড়িয়ে বলল, আপনি ছেলেটাকে না খাইয়ে ছাড়লেন কেন, ওকে ডাকেন, আমি তাড়াতাড়ি চারটে রেধে ফেলি। মণ্ডল ডাকল ‘জামাল, না খেয়ে গেলে তোমার চাচি রাগ করবেন। সে কিছুটা দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘আজ না, আম্মাকে নিয়ে এসে খাওয়া দাওয়া করব ইংশাল্লাহ। তারপর হনহন করে হাটা শুরু করল।
জমিলা বিছানা ছেড়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। তার দুটি মৃগাক্ষি এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেই মানুষটার দিকে যে তার দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত। কিন্তু কলেজের রাস্তায় হঠাৎ যেন সে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, শত্রু কেন, আমরা কি মিত্র হতে পারি না? জমিলা চমকে উঠে, স্মৃতির মুকুরে দেখতে পায় সে কলেজে যাচ্ছে, আর একটা সুন্দর সুদর্শন বলিষ্ঠ গড়নের ছেলে শরীর হেলে দুলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, যেন সে হাওয়াই জাহাজে উড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে চুপটি করে এসে ঠিক তার পেছনে হঠাৎ বেল বাজাত, তখন জমিলা চমকে উঠত আর সে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে যেত। কে এই দুষ্ট ছেলে, তার কি, সে কি তার সারা জীবনের দুষ্টুমীর সাথী হতে যাচ্ছে? জামিলার ভিতরে ক্রমে ক্রমে জমে উঠা দুঃখ ব্যথা হতাশা সব কিছু ঝেটিয়ে বের করে নিয়ে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে যায়। সে আকাশের দিকে তাকায়, এত আলো কোত্থেকে এল। তার আকাশ তো ছিল শ্রাবণের মেঘে ঢাকা আমাবস্যার নিকষ কালো আধারাবগুন্টিত কিন্তু সহসা সেখানে সুর্যোদয় হল কোত্থেকে। দিগন্ত বালে অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত সে তার জীবনের সুর্যটার প্রতি এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। নিজের অজান্তেই তার পদ্মলোচন থেকে অশ্রুর ফোটা ঝড়তে থাকে। এ অশ্রু বেদনার নয় আনন্দের, এ অশ্রু হারানোর নয় প্রাপ্তির।
২
ইসলামী ফিরকাগুলির মধ্যে ঐক্য স্থাপন, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমন্বয় ও খিলাফত প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কয়েকটা অধিবেশনে লাগাতর আলোচনা চলল। অবশেষে মাওঃ মোজাহিদ প্রশ্ন উত্থাপন করল, আমরা খিলাফত কার্যক্রম ও ঐক্য প্রক্রিয়া কিভাবে শুরু করব? এ বিষয়ের উপর দীর্ঘ আলোচনা হল। সবশেষে হাসান মুসান্না বললেন ‘আমরা যদি প্রথমেই ইসলামী দল ও ফিরকাগুলিকে ঐক্যের দাওয়াত দেই তাহলে তারা আসবে না। এর প্রমাণ হল, পূর্বে এমন অনেক ঐক্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। কারণ কোন ফেরকাই ইসলাম ও খিলাফতের প্রতিনিধিত্ব করে না, তারা স্ব স্ব ফিরকার প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন কওমিপন্থীরা দেওবন্দবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, জামাতিরা মওদূদীবাদ, তাবলীগীরা ইলিয়াসবাদ, বেরেলভীরা রেজভীবাদ,সালাফিরা ওয়াহাবীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, কেউই ইসলাম বা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। যদি চাইত তাহলে কারো প্রচেষ্টা ব্যতিত তারা নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করত।
একথা সর্ব স্বীকৃত যে, সকল ফিরকা ঐক্য হয়ে গেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। কারণ সমগ্র মুসলিম জনগন কোন না কোন ফেরকার সাথে জড়িত। কাজেই সকল ফেরকার ঐক্য মানে সমগ্র উম্মাহর ঐক্য, আর সমগ্র উম্মহর ঐক্য মানে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়া, আর খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে উম্মাহর ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সাফল্য নিশ্চিত হওয়া এবং বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অভিষিক্ত হওয়া। এজন্যই বলা হয়, ইসলামপন্থীদের শিকড় মাটির গভিরে আর তার কাণ্ড আরসে আজীম পর্যন্ত বিস্তৃত। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলগুলির কোন শিকড় নাই, এরা ভাসমান শেউলার ন্যায়। যেমন আমাদের আওয়ামী লীগ ও বি এন পি পালাক্রমে ক্ষমতায় যায়। আসলে তারা ফিরকাবাজীর সুযোগে রাজনীতি করে। যেমন, হেফাজত ও জামাতের ভোটে বি এন পি ক্ষমতায় যায়। আর বেরেলভী, তরিকতি ও আংশিক তাবলীগের ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়। এখন এই ইসলামী দলগুলি যদি বলে আমরা আর কাউকে ভোট দিব না, এবার নিজেরাই সরকার গঠন করব। তাহলে চোখের পলকে তাদের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, কেউ তাদেরকে রুখতে পারবে না। কারণ দেশের সকল জনগন এসব ফেরকার সাথে জড়িত।
কাজেই আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হল এই ফেরকাগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে সমগ্র উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু এসব ফেরকার মুরুব্বিরা অতীতে প্রমাণ করেছেন যে, তারা ইসলাম ও খিলাফত ত্যাগ করতে রাজী, যেমন বর্তমানে ত্যাগ করে আছেন, এমনকি তারা মরতে রাজি কিন্তু ঐক্য হতে রাজী নয়, যেমন জামাত হেফাজত মরেছে কিন্তু ঐক্য হয়নি। কাজেই মুরুব্বীদের দিক থেকে আমরা নিরাশ। কিন্তু যুব সমাজ ও ছাত্র সমাজের কাছে আমরা সম্পূর্ণ আশাবাদী। ইসলামের মূল বার্তাটা তাদের কর্ণকুহরে ঢুকাতে পারলে তাদের বক্ষে সাত সাগরের বান ডাকবে। কাজেই এখন আমাদের কর্তব্য হল যুব সমাজ ও ছাত্র সমাজকে খিলাফত প্রতিষ্ঠার লাভগুলি বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদেরকে সচেতন করা ও জাগ্রত করা। আর যখন তারা জেগে উঠবে তখন ফিরকাবাজ মুরুব্বিরা পালানোর পথ খোঁজে পাবে না।
আর তাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আমরা নবীদের সুন্নত অনুসরণ করব। যেমন হযরত ঈসা (আঃ) ইসলাম প্রচারের জন্য বার জন এপোস্টল বা হাওয়ারীকে দিকে দিকে প্রেরণ করেছিলেন। রাসূল (সাঃ) পরপর তিন বছর আকাবায় বয়াত গ্রহণ করেন এবং এর নকীবদের মদীনায় প্রেরণ করেন ইসলাম প্রচারের জন্য। কাজেই আমরাও এ সুন্নত অনুসরণ করব। দ্বিতীয় বয়াতে আকাবার নকীব ছিলেন বারজন, ঈসা (আঃ) এর হাওয়ারী ছিলেন বারজন। কাজেই আমাদেরও নকীব হবে বার জন। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরে ঘোরে খিলাফতের কল্যাণকর বিষয়গুলি তুলে ধরবে ও ইসলামী দলগুলিকে ঐক্যের দাওয়াত দিবে- এই হল আমার প্রস্তাব। এখন সবাই এর উপর বিতর্ক করুন।
শুরু হল বিতর্ক, অবশেষে সকলের কণ্ঠভোটে এ প্রস্তাবই পাশ হল। তারপর মুসান্না বললেন, আমরা যে প্রতিনিধি দল পাঠাব তাদের তো কিছু পাথেয় লাগবে। কাজেই প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ি তাদের রাহা খরচের জন্য কিছু কিছু জমা দিন। এই টাকা উঠানোর জন্য আমি প্রফেসর হাকিম, ডাঃ আসাদুজ্জামান ও আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্র রফিক- এই তিন জনের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে দিলাম। এদের কাছে আপনারা টাকা জমা দিন। দুই সপ্তাহ পর্যন্ত টাকা উঠানো হল, আট লক্ষ টাকা জমা পড়েছে। মোজাহিদ ও জামাল প্রতিনিধি দলের সাথে যাওয়ার জন্য জেদ ধরল। মুসান্না জামালকে ধমক দিয়ে বললেন ‘লেখা পড়া নষ্ট করে দ্বীনের অন্য কোন কাজের অনুমতি নাই। মোজাহিদকে বললেন, তুমি চলে গেলে আমাদের অধিবেশন কে চালাবে।
তারপর তিনি ভাল বাগ্মী ও কর্মঠ দেখে ছয়জন আলেম ও ছয়জন আধুনিক শিক্ষিত লোক নির্বাচন করলেন। একজন আলেম ও একজন জেনারেল শিক্ষিতের সমন্বয়ে দুজন করে ছয়টি দল গঠন করলেন। তারপর সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুর- এ ছয়টি বিভাগের কোন শহরে কোন দল যাবে তা নির্ধারন করে দিয়ে বললেন, ঢাকায় পরবর্তিতে আমি ও মোজাহিদ একটা দল নিয়ে যাব। বিদায়ের দিন তাদেরকে বললেন ‘তোমরা আগে বিভাগিয় শহরে যাবে। সেখানে তোমাদের কার্যক্রম শেষ করে একটার পর একটা জেলায় গিয়ে কাজ করবে। তোমাদের প্রধান কাজ হবে মাদরাসা ও কলেজগুলিতে। জহুরের সময় মাদরাসায় গিয়ে উপস্থিত হবে। কারণ এ সময় সকল ছাত্র মসজিদে থাকে। আর কলেজগুলিতে ক্লাস শেষ হওয়ার পর সকল ছাত্রকে ডেকে নিয়ে একটা রুমে বসিয়ে বক্তৃতা করবে।
তোমাদের কমন বক্তব্য হবে, মুসলিম জাতীর বর্তমান বিপর্যয় তুলে ধরা এবং দাজ্জালের ষড়যন্ত্র উন্মোচন করা। দাজ্জাল কিভাবে মুসলিম দুনিয়াকে বিভক্ত করে, পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে মুসলিম জাহানকে কারবালায় পরিণত করেছে, কিভাবে মুসলমানদের সম্পদ লোটে নিয়ে নিজেরা বিশ্ব মোড়ল সেজেছে আর আমাদেরকে দাস জাতিতে পরিণত করছে। অথচ আমরাই পৃথিবীর মুল সম্পদ ও মুল ভূখণ্ডের মালিক। দাজ্জাল কিভাবে ফিলিস্তিন, কাশ্মির, জিংজিয়াং ও আরাকানের মুসলমানদের যোপকাস্টে বলি দিচ্ছে। বিশেষত আরাকানের আলোচনা করবে। আমাদের নাকের ডগায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মানবেতিহাসের যে বর্বরতম নির্যাতন হচ্ছে, সেখানে যে মানবতার চিতা জ্বলছে, ন্যাড়া ভিক্ষুরা সেখানে যে সভ্যতার কবর রচনা করে চলেছে এ বিষয়টা তাদের সামনে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরবে।
তখন তারা যদি মানুষ হয় আর মুসলমান হয় তাহলে তাদের বিবেকে ঝড় উঠবে। তারপর তাদেরকে বুঝাবে, এসব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল খিলাফত বা মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা। আর খিলাফতের ডাক নিয়েই আমরা তোমাদের কাছে এসেছি। তোমরা আমাদের ভোট দিবে আর আমরা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে তোমাদেরকে দাজ্জালের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিব, ইংশাল্লাহ। তখন তোমরা ধন সম্পদ ও ঐশ্বর্য্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হবে, বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে তোমাদের অভিষেক হবে। বক্তৃতার পর তারা সম্মতি জানালে তাদের কাছ থেকে ঐক্য ও ভোটের শপথ নিবে। কিন্তু শুধু এটুকুতেই কাজ হবে না। কারণ যারা দুনিয়াদার মানুষ তারা পারলৌকিক স্বার্থের দিকে ফিরেও তাকায় না, তারা শুধু জাগতিক স্বার্থের হিসাব কষে। আর যারা ধার্মিক মানুষ তারাও ইহলৌকিক স্বার্থকে পারলৌকিক স্বার্থের উপর প্রাধান্য দেয়।
এজন্যই কোরানে বলা হয়েছে, মানুষকে প্রজ্ঞা ও উত্তম বচনে দাওয়াত দিবে। এ কারণেই রাসূল (সাঃ) কাফের মোনাফিকদের সাথে মুওয়াল্লেফাতে কুলুব করতেন, অর্থাৎ তাদেরকে বেশি বেশি ধন সম্পদ দিয়ে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতেন। কাজেই তোমাদের কাজ হবে প্রত্যেক শ্রেণীর সামনে খিলাফত প্রতিষ্ঠার সুফলগুলি তুলে ধরা। যেমন খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে মুস্তাদআফ শ্রেণী রাষ্ট্রীয় ভাতা পাবে, শ্রমিক শ্রেণীর উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বের মীমাংসা করা হবে, তারা উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবে। কৃষক শ্রেণী ভর্তুকি পাবে এবং কৃষি পন্যের উপযুক্ত মূল্য পাবে। কওমি ও আলিয়া শিক্ষা ব্যবস্থা একিভুত করে আরব দেশগুলির সিলেবাস পাঠ্যভুক্ত করা হবে, তখন তারা সমগ্র বিশ্বেই চাকরি সুবিধা পাবে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বুঝাবে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে, তখন তারা বাণিজ্যে ও বিজ্ঞানে বিশ্ব নেতৃত্ব অর্জন করবে। বিচার বিভাগে সর্বত্র দিয়ত বা ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। তখন নিহত ব্যক্তির পরিবার, ধর্ষিতা নারী ও ক্ষতিগ্রস্থরা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাবে, বেঁচে থাকার অবলম্বন পাবে। এভাবে খেলাফতের কল্যাণময়তা তাদের সামনে তুলে ধরবে, তাতে জনগণ আকৃষ্ট হবে।
তারপর তিনি প্রতিনিধি দলকে বললেন, ঈসা (আঃ) তার বারজন হাওয়ারিকে দাওয়াতি কাজে পাঠানোর সময় বলেছিলেন, ‘†Zvgv‡`i †Kvgi-euvawb‡Z †Zvgiv †mvbv, iƒcv wKsev Zvgvi cqmvI wb‡qv bv| 10 c‡_i Rb¨ †Kvb iKg _wj, `yÕUv †KvZ©v, RyZv ev jvwVI wb‡qv bv, KviY †h KvR K‡i †m LvIqv-civ cvevi †hvM¨| 11Ò†Zvgiv †h †Kvb kn‡i ev Mªv‡g hv‡e †mLv‡b GKRb Dchy³ †jvK Lyu‡R wb‡qv Ges Ab¨ †Kv_vI P‡j bv hvIqv ch©ন্ত Zvi evox‡Z †_‡Kv| 12 †mB evoxi wfZ‡i XzKevi mgq Zv‡`i mvjvg Rvbv‡qv| 13 hw` †mB evox Dchy³ nq Z‡e †Zvgv‡`i kvন্তি †mB evoxi Dc‡i †b‡g AvmyK| wKন্তু hw` †mB evox Dchy³ bv nq Z‡e †Zvgv‡`i kvwন্তি †Zvgv‡`i Kv‡QB wd‡i AvmyK| 14 hw` †KD †Zvgv‡`i MªnY bv K‡i ev †Zvgv‡`i K_v bv †kv‡b Z‡e †mB evox ev Mªvg †_‡K P‡j hvevi mg‡q †Zvgv‡`i cv‡qi ayjv †S‡o †d‡jv| 15 Avwg †Zvgv‡`i mwZ¨ ejwQ, †ivR nvk‡i †mB Mªv‡gi †P‡q eis mv`yg I গgyiv (লুতের জনপদ) kn‡ii Ae¯’v A‡bKLvwb mn¨ Kievi gZ n‡e| (মথি- ১০)
কিন্তু ইসলামের বিধান হচ্ছে যেমন আল্লাহ তা’লা বলেন, যখন তোমরা দ্বীনের কাজে বের হবে তখন রিক্ত হস্তে বের হয়ো না, পাথেয় নিয়ে বের হবে। অবশ্য সর্বোত্তম পাথেয় হল তাকওয়া। কাজেই পার্থিব পাথেয় হিসাবে আমি তোমাদের মাথা পিছু দশ হাজার করে দিলাম। কিন্তু তোমাদের আসল পাথেয় হল তাকওয়া। তোমরা আল্লাহ্র কাজে বের হচ্ছ, ভূপৃষ্ঠে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব এবং সমগ্র মানব জাতীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে যাচ্ছ। কাজেই তোমাদের প্রধান পাথেয় হল তাকওয়া। তোমরা সারাদিন কাজ করবে আর রাতে নামায পড়ে আল্লাহ্র দরবারে কান্নাকাটি করবে- তিনি যেন আমাদেরকে দাজ্জালের ফেতনা থেকে মুক্তি দেন, ইসলাম ও উম্মাহর বিজয় দান করেন, সমগ্র উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার তাওফিক দান করেন।
তোমরা দরিদ্রের মত জীবন যাপন করবে। থাকার জন্য কোন মাদরাসা বা কলেজ হোস্টেলে গিয়ে সুপারকে বলবে তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। পারত পক্ষে গেস্ট হাউজে থাকবে না। খাওয়ার ব্যাপারে কেউ আগ্রহ দেখালে তার আতিথ্য গ্রহণ করবে। অন্যথায় কারো উপরে বুঝা না হয়ে হোটেলে স্বল্প মূল্যে কিনে খাবে। মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে, অপচয় করবে না। আপাতত একেক দল বিশ হাজার করে নিয়ে যাও। পরে আরো লাগলে কল করো, পাঠিয়ে দেয়া হবে। আরো কিছু উপদেশ দিয়ে তিনি তাদেরকে বিদায় করে দিলেন। দুইজন করে একেক দল একেক বিভাগিয় শহরের দিকে রওয়ানা হল।
তারপর তিনি অর্থ কমিটিকে ডেকে নিয়ে বসলেন। আরো দুইজন বাড়িয়ে প্রফেসর হাকিমের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে বললেন, ‘আপনারা যুগপৎ অর্থ কমিটি ও বিচার কমিটি। আপনাদের কাজ হল, অনুসন্ধান করবেন খাস জমি বা সরকারি পতিত জমি কোথায় আছে। তারপর রেল ষ্টেশন ও অন্যান্য জায়গায় যেসব ছিন্নমূল, ভাসমান মানুষ, পথকলি ও পতিতা আছে তাদেরকে খোঁজে বের করবেন এবং ঐসব পতিত জমিতে এসব সর্বহারাদের ঘর করে দিবেন। আর তাদের চলার জন্য বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার মধ্যে কোন ব্যবসা ধরিয়ে দিবেন। এভাবে তাদের থাকা ও খাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করবেন।
আপনাদের দ্বিতীয় কাজ হল, বিচার ব্যবস্থায় হাত দেয়া। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দরিদ্র পরিবারের কেউ নিহত হল তখন তার পরিবারটি পথে বসে। তাছাড়া মামলার খরচ চালাতে গিয়ে ভিটে বাড়িসহ বিক্রি করে দেয় কিন্তু বিচার পায় না। আবার কোন মেয়ে ধর্ষিতা হলে তার পরিবারটি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সবাই তাদেরকে ঘৃণা করে। মেয়েটি তখন তার পরিবারে একটা মুর্তিমান অভিশাপ হয়ে বিরাজ করে। তাছাড়া মেয়েটির চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে তার পরিবার আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হয় কিন্তু ধর্ষক বহাল তবিয়তেই থাকে। কাজেই আপনারা ঘাতক ও ধর্ষক পরিবারে গিয়ে বলবেন, তোমাদের শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। আর মৃত্যুদণ্ডের বিকল্প হিসাবে ইসলাম দিয়তের বিধান দিয়েছে, তা হল একশত উট বা তার সমমূল্য । কাজেই তোমরা যদি বাচতে চাও তাহলে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে একশত উটের মূল্য দাও।
কিন্তু এতটা যদি দিতে সক্ষম না হয় তাহলে মুজরিমের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দিয়ে দিতে হবে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে। তবে তা কোনভাবেই বিশ- ত্রিশ লাখের কম হলে চলবে না। এ অবস্থায় নিহতের পরিবারটা বেঁচে থাকার অবলম্বন পাবে আর ধর্ষিতা মেয়েদেরকেও টাকার লোভে কেউ বিয়ে করতে রাজি হবে। আর যদি কোন মুজরিম এ ফয়সালা মেনে নিতে অস্বিকার করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে অর্থ ও জনবল দিয়ে সাহায্য করতে হবে- যাতে সে ন্যায় বিচার পায়।
মনে রাখবেন ইসলাম হল হক্বুল্লাহ ও হক্বুল ইবাদ- এ দুটি বিষয়ের সমষ্টি। কিন্তু বর্তমান আলেম সমাজ ও ফিরকাগুলি ইসলামের একটা ডানা ভেঙ্গে আরেকটা ডানা মাথায় নিয়ে আছে। অর্থাৎ তারা শুধু হক্বুল্লাহ নিয়ে আছে কিন্তু হক্বুল ইবাদ সম্পর্কে কিছুই বলে না। যেমন, দেওবন্দি, তাবলীগী, বেরেলভী, আহলে হাদীস, তরিকতি, পীর ও মাযারপন্থি ইত্যাদিদের সকল কার্যক্রম শুধু হক্বুল্লাহর মধ্যে আবর্তিত। বস্তুত এরা হক্বুল ইবাদ সম্পর্কে জানেও না। আর এজন্যই ধর্মীয় বিষয়ে এদের সাথে জনগণের সম্পর্ক থাকলেও রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ভোটের ক্ষেত্রে কোন সম্পর্ক নেই। যেমন কিছু কিছু ইসলামী দল সারা দেশে নির্বাচনি প্রার্থি দেয়। তারপর দেখা যায় এরা নিজের স্ত্রীর ভোটটা পর্যন্ত পায় না, তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। এর কারণ হল, এরা জনগণের সুখ দুঃখের সময় পাশে থাকে না, শুধু নির্বাচনের সময় বসন্তের কোকিল হিসাবে আগমন করে। আর তখন জনগণও তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়। এরা হল নিছক ধর্ম ব্যবসায়ী।
যাই হউক, আমরা তো ধর্ম ব্যবসায় নামি নাই, ইসলাম ও মানবধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি। কাজেই ইসলামের ইনসাফপূর্ণ অর্থ ও বিচার ব্যবস্থাগুলি সমাজে প্রয়োগ করুন। জনগণ যখন এগুলির স্বাদ পেয়ে যাবে তখন আপনার আমার প্রচেষ্টা ব্যতীত তারাই স্ব প্রনোদিত হয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবে। আর এসব কার্যক্রমের জন্য আপনাদের যথেষ্ট অর্থ প্রয়োজন।আপাতত সাত লক্ষ টাকা আপনাদেরকে কেশ দেয়া হল। তারপর ক্রমান্বয়ে বিত্তবানদের থেকে উঠিয়ে আপনাদের চাহিদা পূরণ করা হবে। আপনারা কাজ শুরু করে দিন। এরপর অর্থ কমিটি তাদের কাজ শুরু করল।
ওদিকে বিভিন্ন এলাকায় প্রেরিত প্রতিনিধিরা ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে। ফলে হাসান মুসান্নার সাথে সাক্ষাতের জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে অসংখ্য প্রতিনিধি দল আসতে লাগল, আর তিনিও তাদের সামনে খিলাফতের গুরুত্ব ও উপকারীতা তুলে ধরে ঐক্য ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য বাইয়াত গ্রহণ শুরু করলেন। তারপর তাদেরকে খিলাফত ইশতিহারের কিছু বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার প্রসারের তাকীদ দিয়ে বিদায় জানাতে লাগলেন। এভাবে তাদের কার্যক্রম ব্যাপক প্রসারতা লাভ করতে থাকে। প্রতি শুক্রবারের আসর ঠিক মতই চলছে।
একদিন হাসান মুসান্না মোজাহিদকে বললেন, আমাদের কার্যপরিধি তো বেড়ে যাচ্ছে, চল এই সুযোগে ঢাকায় কিছু কাজ করে আসি। এখনি না গেলে পরে আর সময় পাওয়া যাবে না। তারপর তিনি মোজাহিদসহ বার জনের একটি দল নিয়ে ঢাকায় গেলেন। এক ভক্তের বাসায় তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হল। তারা তিনজন তিনজন করে চার দলে ভাগ হয়ে ঢাকার বিভিন্ন মাদরাসা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ গুলিতে যাতায়াত শুরু করল। তারা ছাত্রদের সামনে বর্তমান মুসলমানদের দুরাবস্থা তুলে ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করে যে, খিলাফত প্রতিষ্ঠা ব্যতীত এ থেকে মুক্তির উপায় নাই। আর খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সকলের সমর্থন প্রয়োজন। তারপর তারা ছাত্রদের থেকে সমর্থন ও সহযোগিতার শপৎ গ্রহণ করে।
তাদের কার্যক্রম সবর্ত্র প্রচারিত হতে থাকে, পত্র পত্রিকায় নিউজ আসতে থাকে, মুসান্না নিজেও খিলাফতের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখে পত্রিকায় পাঠাতে লাগল। টিভি চ্যানেল গুলোতে সংবাদ আসে, টক শোতে আলোচনা চলতে থাকে। এ অবস্থা দেখে দুটি শ্রেণী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। প্রথম শ্রেণীটি হল বিভিন্ন ফেরকার নেতৃত্বদান কারী আলেম। হাসান মুসান্নার প্রতিনিধিরা যেসব আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল তারা নীরব থাকল কিন্তু যাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি তারা রেগে গেল। কারণ একে তো তাদের কাছে কেউ যায়নি, তাদের আনুগত্য করেনি বা তেল মারেনি। দ্বিতীয়ত এসব ফিরকাবাজ আলেমরা ধর্মীয় নেতৃত্ব একমাত্র তাদের জন্মগত অধিকার মনে করে। সেখানে হাসান মুসান্নার আন্দোলনকে তারা নিজেদের নেতৃত্বের জন্য হুমকি মনে করল বিধায় মনে মনে ফুসতে লাগল। কিন্তু তাদের তো পত্র পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল ছিল না যে তার বিরুদ্ধে বক্তব্য বিবৃতি দিবে। অগত্যা তারা মসজিদ মাদরাসায় বিষোদগার করতে লাগল। আর একটা কিছু করার জন্য মনে মনে সুযোগ খুজতে লাগল।
দ্বিতীয় শ্রেণীটি হল রাজনৈতিক দল। তারা এই ভেবে প্রমাদ গুনল যে, হাসান মুসান্না যে নাগরিক অধিকারের ঘোষণা দিয়েছে এবং খিলাফত ইশতিহার নামে যে ইশতিহার প্রচার করছে- নির্বাচন হলে নিশ্চিত সে সরকার গঠন করবে, আর তখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি মাঠে মারা যাবে। কাজেই তারা পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল গুলিতে তারস্বরে চিৎকার শুরু করল, টকশো গুলোতে তার বিরুদ্ধে বিষ উগলে দিল। এ অবস্থা দেখে তিনি প্রতিনিধি দলের সাথে পরামর্শ সভায় বসে বললেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমঝোতা করে তাদেরকে পথে আনার এটাই মোক্ষম সময়। অন্যরা বলল, কখনো না, আমরা কারো সাথে সমঝোতা করব না, নিজেরাই সরকার গঠন করব।
তিনি তিক্ত কণ্ঠে বললেন, তোমরা আসলেই মুর্খ। আমাদের উদ্দেশ্য তো রাজা বাদশাহ হওয়া নয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা, ইসলাম ও উম্মাহর মুক্তি নিশ্চিত করা। আর তা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমঝোতা করতে হবে এবং তা দুটি কারণে। প্রথম কারণ মুজিব জিয়া আমাদের। তারা দেশের জন্য জাতীর জন্য নিজেদের শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত দিয়ে গেছেন। তাদের দল মানে আমাদের দল। এদেশের মুসলমানরাই আওয়ামী লীগ ও বি এন পি প্রতিষ্ঠা করেছে, ভোট দিয়েছে, সরকারে নিয়েছে। কাজেই আমাদের দল আমরাই পরিচালনা করব, নতুন কোন দল গঠন করব না। তাদেরকে শুধু পথে আসতে বাধ্য করব।
দ্বিতীয় কারণ, আমাদের উদ্দেশ্য হল সারা পৃথিবীতে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আমরা যদি একা মাঠে নামি তাহলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে। তখন আমরা সরকার গঠন করলেও দেশ চালাতে পারব না, আর খিলাফত প্রতিষ্ঠা তো হয়ে উঠবে সুদুর পরাহত। কাজেই তাদের সাথে সমঝোতা ছাড়া উপায় নাই। আমরা নেতৃত্বের পরিবর্তন চাই না শুধু আইন পরিবর্তন চাই। তোমরা তাদের সাথে আমার বসার ব্যবস্থা কর। সভায় এ প্রস্তাব গৃহিত হল।
প্রথমে আওয়ামী লীগের সাথে বৈঠক হল। তাদের বাঘা বাঘা নেতারা উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করে সর্বশেষে বললেন, ‘আপনারা করেন ধর্মীয় রাজনীতি আর আমরা করি সেক্যুলার রাজনীতি। আমাদের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির তিনটি হল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ। আমরা এগুলি বাদ দিতে পারব না। কাজেই আপনাদের সাথে সমঝোতা কেমনে হবে? হাসান মুসান্না বললেন, এগুলি তো বাদ দেয়ার দরকার নাই। কারণ এগুলি তো ইসলামেরই মুল বার্তা। যেমন -
গনতন্ত্রঃ একথা সর্ব স্বীকৃত যে, আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে পৃথিবীর কোথাও জনমতের কোন মূল্যায়ন ছিল না, সর্বত্র রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল, দুনিয়াবাসি তখন গণতন্ত্র কাকে বলে জানতই না। সেই সময় রাসূল (সাঃ) সর্ব প্রথম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ওফাতের সময় তিনি নিজে খলীফা নির্বাচন না করে জনমতের উপর ছেড়ে গিয়েছেন। তারপর আনসার ও মুহাজিরদের প্রত্যক্ষ ভোটে তথা বাইয়্যাতের মাধ্যমে আবু বকর (রাঃ) খলীফা নির্বাচিত হন। কাজেই এ কথা কারো অস্বিকার করার জো নাই যে, পৃথিবীর সর্ব প্রথম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ (সাঃ)। আর সেই গণতন্ত্রেরই আধুনিক সংস্করণ হল বর্তমান গণতন্ত্র।
সমাজতন্ত্রঃ আপনারা তো সমাজতন্ত্র দূরের কথা কোন তন্ত্রই করেন না, শুধু পেটতন্ত্র আর লোটপাটতন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। ইসলামের তিনটি অর্থ ব্যবস্থা। তৃতীয় স্তরটিই হল সমাজতন্ত্র। কার্লমার্ক্স ইসলামী অর্থতন্ত্র থেকেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। তবে মার্ক্সের সমাজতন্ত্রের চেয়ে ইসলামী সমাজতন্ত্র হাজার গুনে শ্রেষ্ঠ।
ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদঃ ধর্মের জন্ম ধর্ম গ্রন্থ থেকে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা ধর্মের ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। আর প্রত্যেক ধর্ম গ্রন্থের মুল বার্তা হচ্ছে, স্রস্টা একজন এবং সর্বশেষ ধর্মাবতার মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে সেসব গ্রন্থে ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে। যেমন বাইবেলের প্যারাক্লিট, বেদ পুরানের কল্কি নরাশংস, ত্রিপিটকের মৈত্রেয় বুদ্ধ ইত্যাদি দ্বারা মুহাম্মদ (সাঃ) কে বুঝানো হয়েছে। কাজেই প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থগুলি দ্বারা প্রমাণিত হল যে, আদি অন্ত ধর্ম একটাই, আর তা হল ইসলাম এবং অন্তিম ধর্মাবতার হলেন মুহাম্মদ (সাঃ)। সুতরাং ধর্ম যেহেতু একটাই বিধায় এর নিরপেক্ষতা প্রমাণিত হল, অর্থাৎ একক ধর্ম ইসলাম। কাজেই আপনাদের ঐ চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার দরকার নাই, শুধু ইসলামের পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিলেই হল। আমরা খিলাফত ইশতেহার ঘোষণা করেছি, সেখানে যে নাগরিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে আপনারা যদি সেগুলি বাস্তবায়নের অঙ্গিকার করেন তাহলে আপনাদের সাথে সমঝোতা হবে। অন্যথায় আপনাদের সাথে আমরাও থাকব না জনগণও থাকবে না। তারা এই শর্তে রাজী হয়ে বিদায় নিল।
বি এন পির প্রতিনিধি দল আসল, তাদের সাথে শুধু একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক হল, সেটি জাতীয়তা বাদ। তারা বলল, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। তখন হাসান মুসান্না বললেন, ইসলাম সাধারণত রাষ্ট্র, ভাষা, আঞ্চলিকতা ও গোত্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি দেয় না। যেমন কোরানে বলা হয়েছে, ‘এটা হল তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের মিল্লাত (জাতি), তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলমান’। অর্থাৎ ইসলামই মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। কাজেই সকল মুসলমান ভাই ভাই, এক জাতি, এক গোত্র, সকল মুসলিম দেশ এক দেশ। ইসলামী জাতীয়তাবাদের সুবিধা এই যে, ধনি দেশ গুলির সম্পদে দরিদ্র দেশগুলির অধিকার স্বীকৃত হবে, দরিদ্র জনগোস্টি যে কোন দেশে ভিসা ও বর্ডারবিহীন ভাবে সে দেশের বিধিমালা অনুযায়ী চাকরি-নকরি, ব্যবসা-বানিজ্যি ইত্যাদি সুবিধা প্রাপ্ত হবে, যে কোন দেশে বসবাস করতে পারবে। কাজেই ধনী দরিদ্র বৈষম্য দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম জাতিয়তাবাদের কোন বিকল্প নেই।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কুফল হলো এই যে, আজ মধ্যপ্রাচ্যের স্বজাতি মুসলিম ভাইয়েরা আমাদেরকে মিসকিন বাঙালি বলে ডাকে, আমরা তাদের ফুটপরমাশ খাটি। অথচ তাদের প্রত্যেকটা পেট্টো ডলারে তাদের নিজেদের যতটুকু অধিকার রয়েছে ইসলাম আমাদের জন্যও ঠিক ততটুকু অধিকারই সাব্যস্ত করেছে। আবার মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলি আমাদেরকে শ্রমিক জাতি, দাস জাতি হিসাবে গন্য করে। আর এসবই মুসলিম জাতীয়তাবাদের খেলাপ।
দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যদি আমাদেরকে ধনে-জনে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, যশ-খ্যাতি, ক্ষমতা ও নেতৃত্বে বিশ্ব সভার আসরে পৌঁছে দিতে পারত, যেমন হিটলারের জাতীয়তাবাদী চেতনা জার্মানদের বিশ্ব জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল। কামাল আতাতুর্কের জাতীয়তাবাদ তুর্কিদের জন্য অন্তত কিছুটা হলেও সস্থি বয়ে এনেছিল- তাহলেই আমরা এ জাতীয়তাবাদকে আশির্বাদ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারতাম। কিন্তু এ জাতীয়তাবাদীরা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে জাতির ললাটে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্তের কলঙ্ক তিলক এঁটে দিল। মিসকিন জাতি, শ্রমিক জাতি, দাস জাতি ইত্যাদি কলঙ্কময় অবিধাগুলি জাতির ভাগ্যলিপিতে পরিণত হল। কাজেই প্রমাণিত হল, এসব জাতীয়তাবাদ কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থসিদ্ধির স্লোগান মাত্র, জাতীর কল্যাণ সেখানে কিছুই নাই। সুতরাং মুসলিম জাতীয়তাবাদের শ্লোগান ব্যতীত এ জাতির মুক্তির দ্বিতীয় কোন উপায় নাই।
তাছাড়া ইসলামিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমগ্র উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করে মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা খুবই সহজ। তখন মুসলমানদের এ জাতীয় কোন কেন্দ্র বা সংস্থা থাকলে মধ্যপ্রাচ্যসহ ফিলিস্তিন, আরাকান, কাশ্মির, জিংজিয়াং ইত্যাদি স্থানে মুসলমানদের মানব বিপর্যয়ের সম্মুখিন হতে হবে না এবং মুসলিম দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যও থাকবে না। আলোচনান্তে তারা এ প্রস্তাবে সম্মত হল এবং খিলাফত ইশতিহার বাস্তবায়নের শর্তে রাজী হয়ে খুশি মনে বিদায় নিল।
সর্বশেষে আসল কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি দল। হাসান মুসান্না তাদেরকে বললেন ‘আচ্ছা যারা নিজের বাপকে বাপ না ডেকে অন্যকে বাপ ডাকে তাদেরকে আমরা কি বলি? তারা উত্তর দিল, জারজ। তিনি বললেন ‘আপনারা হলেন উম্মাহর জারজ। কারণ সমাজতন্ত্রের জন্ম দিয়েছেন রাসূল (সাঃ) আর কার্লমার্ক্স সেখান থেকে চুরি করেছে। এর প্রমাণ হল, লেলিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তার পরিষদবর্গসহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটেনের কূটকৌশল ও মিসরের আলেমদের কুপমুন্ডুকতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। কাজেই আপনারা যেহেতু মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মত হয়ে মার্ক্সিয় আদর্শ গ্রহণ করেছেন এজন্য আপনারা উম্মাহর জারজ। এরপর তিনি ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, শ্রেণী সংগ্রামের ডাক দিয়ে, রক্তপাত ঘটিয়ে সম্মানিকে লাঞ্চিত করে আর নীচাসয়কে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করে মার্ক্সিয় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা কি হাজার গুনে শ্রেষ্ঠ ও যুক্তিযুক্ত নয়? বিশ্লেষণ শুনে তারা খুবই প্রীত হল এবং ইত্তেহাদুল উম্মাহর সাথে ঐক্যের ঘোষণা দিয়ে হৃষ্টচিত্তে বিদায় হল।
এরপর মুসান্না প্রত্যেক দল থেকে তিনজন প্রতিনিধি আহ্বান করে বৈঠক ডাকলেন। সেখানে বিভিন্ন বিষয় আলোচনার পর তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনটি শর্তের ভিত্তিতে আপনাদের সাথে আমাদের সমঝোতা হবে নচেৎ হবে না। ১) যেসব ছোট দল আওয়ামী লীগ ও বি এন পি থেকে বেড়িয়ে নতুন দল গঠন করেছে তাদেরকে স্ব স্ব দলে ফিরিয়ে নিতে হবে। তারপর সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ঐক্যমত্যের সরকার গঠন করতে হবে। প্রয়োজনে প্রত্যেক দল থেকে তিনজন প্রতিনিধি বৈঠক করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যের পথ বের করে আনতে হবে। ২) আমরা খেলাফত ইশতেহারে যা ঘোষণা করেছি সেগুলি বাস্তবায়ন করতে হবে, সকল নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বোপরি মুসলিম উম্মাহর মুক্তির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় খিলাফত বা মুসলিম জাতিসংঘ বা আফ্রেশিয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৩) ইসলামী দলগুলির জন্য ১৫০ আসন ছেড়ে দিতে হবে। এই আসনগুলি আমরা জামাত হেফাজত তরিকত ও অন্যন্য ইসলামী দলগুলির মধ্যে ভাগ করে দিব। তারা নৌকা বা ধানের শিষ নিয়েই নির্বাচন করবে তাতে কোন সমস্যা নাই। তবে কোন মনোনিত ব্যক্তি যদি নির্বাচন না করে বা তাকে বুঝিয়ে অন্য কেউ প্রার্থি হয় তাহলে আমাদের আপত্তি থাকবে না।
ব্যস এই হল আমাদের শর্ত। কোন দল এই শর্তে রাজি না থাকলে আমরা তাদের সাথে থাকব না, আর আমরা না থাকার অর্থ হল জনগণ থাকবে না। কারণ আমরা যে খিলাফত ইশতিহার দিয়েছি- তাতে সর্বস্তরের জনগণ আমাদের একচেটিয়া সমর্থক। তখন সকল দল এসব শর্তে রাজী হল। তারপর হাসান মুসান্না রাজনৈতিক ভাবে বিজয়ের সফলতা নিয়ে ময়মনসিংহে ফিরে গেল কিন্তু ফিরকাবাজ আলেমদের একটা অংশ তার বিরুদ্ধে ভুজঙ্গের মত ফুসতে লাগল।
বিষয়: রাজনীতি
১২৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন