সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ২৬
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৮ জুলাই, ২০১৭, ১০:০৭:৩৭ রাত
জামাতে ইসলামী মতবাদঃ
(এখান থেকে গুরুত্বপুর্ন কিছু বিষয় আলোচনা হবে- যা প্রত্যেক মুসলমানের জানা জরুরী। সবাইকে পড়ার আমন্ত্রন জানাচ্ছি)
জামাতের একজন দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিল, ওস্তাদজি আমি ফুলপুরের একটা আলিয়া মাদরাসার আরবি প্রভাষক এবং জামাতের রুকন। আমি নিরপেক্ষভাবে জামাতের বিতর্কিত বিষয়গুলি তুলে ধরার চেষ্টা করব। জামাতকে জানতে হলে আগে এর প্রতিষ্ঠাতা মাওঃ মওদুদীকে (জন্ম- ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩, মৃত্যু ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯) জানতে হবে। তিনি ছিলেন একজন মুজতাহিদে মুস্তাকেল- স্বাধীন মুজতাহিদ। ভারত বর্ষে দেওবন্দসহ অন্যরা তাকে মিস্টার মওদুদী বলে ব্যঙ্গ করে কিন্তু আরব বিশ্বে তাকে মুজতাহিদ হিসাবে গন্য করা হয় এবং যথার্থ সম্মান করা হয়।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উসুল হল, এ ধারার মুরুব্বিরা যত বক্তব্য বিবৃতি লেখালেখি করেছেন সবাই আসলাফের রীতিনীতি অনুসারে করেছেন। অর্থাৎ তাদের মুখে সর্বদা আসলাফের লাগাম লাগানো ছিল কিন্তু মাওঃ মওদুদী (রঃ) ছিলেন স্বাধীন মুজতাহিদ। তিনি পূর্ববর্তীদের লাগাম খুলে ফেলে ছিলেন। তিনি বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে নিজে নিজে কোরান হাদীসের যে ব্যাখ্যা বুঝেছেন আসলাফের বাধ্যবাধকতা বাদ দিয়ে তাই বলেছেন। ফলে দেখা যায় তার কিছু কিছু ব্যাখ্যা আসলাফের উসুলের খেলাফ হয়ে গেছে, আর এভাবেই বিতর্ক ও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। আবার ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে তার ব্যাখ্যা কল্পনার ফানুস নয়, অতি বাস্তববাদী এবং যুক্তিপূর্ণ। এজন্যই উম্মাহর একটা অংশ তার লেখায় দারুনভাবে প্রভাবিত। আর এভাবেই ফিরকার জন্ম হয়েছে।
আমরা জানি, যুগে যুগে ইসলামের সামনে যে চ্যালেঞ্জ দাড়িয়েছে তখনকার আলেমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়েছেন। যেমন ইবনে ওয়াহাব নজদির সময় আরব জগত শিরক বিদাতের আখড়া ছিল। তখন তিনি শিরক বিদাত বিরোধি ইসলামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আবার বর্তমানে ফিরকাবাজির যাতাকলে পড়ে ইসলাম ও উমাহ ধ্বংস হচ্ছে, এজন্য আমরা ফিরকাবাজির বিরুদ্ধে কোরান সুন্নাহর ব্যাখ্যা দিচ্ছি। ঠিক একই ভাবে মাওঃ মওদুদীর (রঃ) সময় ইসলামের সামনে একমাত্র চ্যালেঞ্জ ছিল রাষ্ট্র ও রাজনীতি। কারণ তখন রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিল ইংরেজের হাতে। আর ইংরেজ প্রবর্তিত বস্তুবাদি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত মুসলমানের সন্তানেরা ভাবতে লাগল ইসলাম আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনীতির জন্য উপযোগি নয়। ইসলামে আইন কানুন বলতে যা আছে সেই প্রাচীন যুগের গোত্র ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার কিছু রীতিনীতি। তাই তারা মার্ক্সবাদ ও সেক্যুলার ধনতান্ত্রিক গনতন্ত্রের দিকে ঝুকতে লাগল। আর তখনই তিনি ইসলামের সর্বাধুনিক ও লেটেস্ট ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুরু করলেন।
তিনি ইসলামকে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক গনতন্ত্রের সাথে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করলেন। পুজিবাদি ধারায় রাষ্ট্র চালনা, ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও অন্যান্য বিতর্কিত বিষয়ের জন্ম দিলেন। আর এখানেই তিনি ভুলটা করলেন। কারণ ইসলামের রয়েছে পুর্নাংগ ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আর একটা পুর্নাংগ ব্যবস্থাকে পশ্চিমা খণ্ডিত ব্যবস্থার সাথে সমন্বয় করতে যাওয়া হাতিকে মুশিকের সাথে সমন্বয় প্রচেষ্টার নামান্তর হল। আর এসব আধুনিক ও লেটেস্ট ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যদিও কিছু কিছু ভুল আছে কিন্তু এগুলি আধুনিক শিক্ষিত ধার্মিক শ্রেণীর কাছে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হল। আবার অন্য কেউ বর্তমানের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপযোগি করে ইসলামকে দাড় করাতে পারল না বিধায় আধুনিক শিক্ষিত ধার্মিক সমাজ মাওঃ মওদুদীর (রঃ) মতবাদকেই রাষ্ট্রনীতির জন্য গ্রহন করল। এভাবেই বিতির্ক হল, ফিরকা হল।
যাই হউক ভারত বর্ষে ইসলামের উপর সবচেয়ে বেশি লেখালেখি করেছেন মাওঃ মওদুদী (রঃ) । তার বেশি লেখালেখির কারণেই হউক বা ইসলামের অত্যাধুনিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কারণেই হউক বা সলফে সালেহিনের লাগাম খুলে ফেলার কারনেই হউক তার কিছু কিছু ভুল আছে। এসব ভুলের মধ্যে কিছু আছে প্রকৃতই ভুল আর কিছু আছে মানুষের স্বভাব প্রকৃতিনির্ভর। যেমন আল্লাহ বলেন-
قُلْ كُلٌّ يَعْمَلُ عَلَىٰ شَاكِلَتِهِ ﴿الإسراء: ٨٤﴾
বলুনঃ প্রত্যেকেই নিজ স্বভাব- প্রকৃতি অনুযায়ী কাজ করে। (১৭: ৮৪)
অর্থাৎ প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বভাব প্রকৃতি ও রুচি পসন্দ অনুসারে আমল করে। কাজেই যারা বিপ্লবি চেতনার, রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়- তারা সেসব ব্যাখ্যাকে সঠিক বলে ধরে নিয়েছে। কিন্তু যারা নিস্পৃহ, তাবলীগের ন্যায় শুধু আমল ইবাদত নিয়ে ব্যস্ত থাকে রাষ্ট্র চিন্তা করে না- তারা এসব ব্যাখ্যাকে ভ্রান্ত বলে ধরে নিয়েছে।
তবে উল্লেখ্য যে, মাওঃ মওদুদী (রঃ) এর কোন কথাই শিরক ও কুফর সীমার মধ্যে নাই, বরং শুধু মাত্র জায়েয সীমার মধ্যে বিতর্ক। এখন আমি সংক্ষেপে সেসব বিতর্কিত বিষয়গুলির আলোচনা করছি। আকিদা সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি। যেমন-
ইসমতে আম্বিয়া বা নবীগনের পবিত্রতাঃ
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মতে নবী রাসূলগণ সকল প্রকার সগীরা ও কবীরা গুনাহ থেকে পবিত্র। কিন্তু মওদুদী (রঃ) নবীগণ সম্পর্কে দুই ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিছু কিছু ব্যাখ্যা বিতর্কের সাথে গ্রহন যোগ্য। যেমন-
মওদূদী (রঃ) এর মতে নবুওয়াত লাভের পূর্বের তো কথাই নেই, নবুওয়াত লাভের পরও নবীদের দ্বারা পাপ সংঘটিত হতে পারে এবং হয়েছেও। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাখ্যা গ্রহন করতে কেউ কেউ দ্বিধাবোধ করে থাকেন, তার একমাত্র কারণ এই যে, নবীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ভুল ভ্রান্তির অভিযোগ তোলা নবীদের নিস্পাপ হওয়া সংকান্ত আকিদার পরিপন্থী বলে মনে হয়। কিন্তু যারা এরুপ মতামত পোষণ করেন তারা সম্ভবত এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করেননি যে, নিস্পাপ হওয়াটা আসলে নবীদের সত্তাগত অপরিহার্য বৈশিষ্ট নয়, বরং আল্লাহ তাদেরকে নবুওয়াত নামক সুমহান পদটির দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করার সুযোগ দানের জন্য একটা হিতকর ব্যবস্থা হিসেবে গুনাহ থেকে রক্ষা করেছেন।নচেৎ আল্লাহ্র এই সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থাটা যদি ক্ষণিকের জন্যও তাদের ব্যক্তিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের যেমন গুনাহ হয়ে থাকে, তেমনি নবীদেরও হতে পারে। এটা একটা বড়ই মজার কথা যে, আল্লাহ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রত্যেক নবী থেকেই কোন না কোন সময় নিজের সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে নিয়ে দুয়েকটা গুনাহ ঘটে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, যাতে মানুষ নবীদেরকে খোদা মনে করে না বসে এবং তারা যে মানুষ, খোদা নন, সেটা বুঝতে পারে।
তিনি অন্যত্র সূরা হুদের ৪৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সব নবী রাসূল সম্পর্কে বলেছেন, ‘বস্তুত নবীগণ মানুষই হয়ে থাকেন এবং কোন মানুষই মুমিনের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাপকাঠিতে সর্বদা অটল থাকতে সক্ষম হতে পারে না। প্রায়শঃই মানবীয় নাজুক মুহূর্তে নবীর ন্যায় শ্রেষ্ঠ মানুষও কিছুক্ষণের জন্য মানবিক দুর্বলতার সামনে পরাভূত হয়ে যান’।
নবীদের দ্বারা পাপ সংঘটিত হয়েছে এ মর্মে তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এখানে আদম (আঃ) এর মধ্য থেকে প্রকাশিত ঐ মানবিক দুর্বলতার হাকীকত বুঝে নিতে হবে- যা আদম (আঃ) এর মধ্যে আত্নবিস্মৃতির জন্ম দিয়েছিল এবং আত্ন-নিয়ন্ত্রণের বাঁধন ঢিলা হওয়া মাত্রই তিনি আনুগত্যের সুউচ্চ মর্যাদা থেকে পাপের অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিলেন।‘
এসব ব্যাখা সম্পর্কে আমি কোন মন্তব্য করব না। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাখ্যা আছে- যেগুলি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের খেলাফ, সেগুলো গ্রহনযোগ্য নয়। যেমন তিনি বলেন-
১। হযরত দাউদ (আঃ) তৎকালীন ইসরাইলি সমাজের প্রথা অনুযায়ি উরিয়া হিত্তিয়ার কাছে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বলেছিলেন। একাজে তার কিছুটা কুপ্রবৃত্তির দখল ছিল।
২। হযরত ইউসুফ (আঃ) অর্থমন্ত্রির পদ দাবি করেননি বরং তিনি ডিইরেক্টরশিপ দাবী করেছিলেন। ৩। আদম (সা ভুল করে আনুগত্যের মহান মর্যাদা থেকে পাপের অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিলেন।
৪। তিনি আরো বলেন, ‘অন্যদের কথা তো ভিন্ন প্রায়শই পয়গাম্বরগণ তাদের কুপ্রবৃত্তির মারাত্মক আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছেন। সুরা নিসার ১৫৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, হযরত ঈসাকে (আঃ) আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে একথা বলা থেকে বিরত থাকা এবং মৃত্যুবরণ করেছেন একথা বলা থেকেও বিরত থাকা। যাই হউক, এসব মতবাদ ভ্রান্ত, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা বিরোধি কিন্তু তাই বলে কুফুরি নয়।
২। সাহাবায়ে কেরাম মি’য়ারে হক বা সত্যের মাফকাঠি কিনাঃ
এটা একটা স্পষ্ট বিদাত। কারণ উম্মাহর মধ্যে এ মতবাদ কখনই ছিল না। মওদুদী (রঃ) নতুন এ মতবাদ সৃষ্টি করে সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন। অথচ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মতে সাহাবাগণ আদিল ও ন্যায়নিষ্ঠ, তাদের সমালোচনা জায়েয নয়। যেমন মুসাযারা গ্রন্থে বলা হয়েছে ‘সকল সাহাবি ন্যায় পরায়ণ মেনে নিয়ে তাদেরকে পবিত্র জ্ঞান করা, তাদের দোষ ত্রুটি বর্ণনা থেকে বিরত থাকা এবং প্রশংসা করা। তারা ঈমানের মাফকাঠি, যেমন আল্লাহ বলেছেন-
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ ۗ [٢:١٣]
আর যখন তাদেরকে বলা হয়, অন্যান্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরাও কি ঈমান আনব বোকাদেরই মত!
لَّقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا [٤٨:١٨]
আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে শপথ করল। আল্লাহ অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন।
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ [٩:١٠٠]
আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনছারদের মাঝে পুরাতন, এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কানন-কুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত প্রস্রবণসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা।
এই সকল আয়াতে সাহাবায়ে কেরামকে বুঝানো হয়েছে। কাজেই বুঝা যাচ্ছে তারা ঈমানের মাপকাটি। সুতরাং সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি কিনা, সমালোচনার যোগ্য কিনা এ বিষয়গুলি অনর্থক বিতর্ক এবং সম্পূর্ণ বিদাত। কারণ কোন কালেই এ জাতীয় মতবাদ ছিল না। কাজেই এসব পরিত্যায্য।
আমিরে মোয়াবিয়া (রাঃ) এর সমালোচনাঃ
সমস্যা দেখা দিয়েছে হযরত আমীর মোয়াবিয়ার ক্ষেত্রে। কারণ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, তিনি চারটি ভুল করেছেন। যেমন বিদায়া নিহায়া গ্রন্থকার হাসান বসরীর উদৃতি নকল করে বলেন, হাসান বসরি চারটি বিষয়কে মুয়াবিয়ার (রাঃ) জন্য আপত্তিকর মনে করতেন। ১। হযরত আলীর বিরুদ্ধে তার লড়াই করা, ২। হাজর ইবন আদীকে হত্যা করা, ৩। যিয়াদ ইবন আবীহকে তার পিতার ঔরসভুক্ত করে নেয়া, ৪। নিজ ছেলে ইয়াজীদের অনুকূলে তার বাইয়াত গ্রহন করা।
এখানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ব্যাখ্যা হল এগুলো ছিল তার ইজতিহাদি ভুল। কিন্তু মওদুদী (রঃ) খেলাফত ও মুলুকিয়্যাত গ্রন্থে বলেছেন, কোন সত্যকে ইজতিহাদি ভুল বলে অপব্যাখ্যা করার দরকার নাই বরং এগুলি ছিল হযরত মোয়াবিয়ার ইচ্ছাকৃত ভুল। ব্যস আর যায় কোথায় বাবা। দেওবন্দ ও জামাতের মধ্যে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড বেধে গেল। অথচ এ গ্রন্থে তিনি নিজ থেকে কোন কথা বলেননি, নির্ভর যোগ্য ইতিহাস গ্রন্থগুলি থেকে উদৃতি দিয়েছেন মাত্র। বস্তুত খিলাফত ও মুলুকিয়্যাত গ্রন্থ নিয়ে বিতর্ক করেই জামাত ও দেওবন্দ বিভক্ত হয়ে ফিরকাবাজিতে লিপ্ত হয়েছে।
কাজেই তৃতীয় পক্ষ থেকে আমাদের প্রার্থনা হল, আল্লাহ উভয় শ্রেণির বিচার করুন। কারণ জামাতীরা দুনিয়া শুদ্ধু ইস্যু না পেয়ে একজন সাহাবির পিছু নিয়ে উম্মাহর মধ্যে ফিরকার সৃষ্টি করল তাদের বিচার হওয়া দরকার আছে। আবার দেওবন্দী আল্লামারা মোয়াবিয়া (রাঃ) এর ভুলগুলিকেও সঠিক সাব্যস্ত করার জন্য ফিরকাবাজিতে লিপ্ত হয়ে গেছে তাদেরও বিচার হওয়া দরকার। অবশ্য খালী চোখেই আমরা দেখতে পাচ্ছি বাড়াবাড়ির কারণে আল্লাহ উভয় দলকে পাকড়াও করে ফেলেছেন, তাদের শাস্তি হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, এ গ্রন্থের মোকাবেলায় পাকিস্থানের মাওঃ তকী উসমানী সাহেব লিখেছেন, ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আমীর মোয়াবিয়া’ এ গ্রন্থের ভুমিকায় তিনি বলেছেন, ইসলাম ও মুসলমানদের এত সমস্যা থাকতে প্রাচীন একটি বিতর্কিত বিষয় সামনে আনা হল কেন? বস্তুত এটাই হল আসল কথা। এ জন্যই আমরা দাবী জানাচ্ছি উভয় গ্রন্থের প্রচার প্রকাশ ও মুদ্রন বন্ধ করা হউক, যেসব কপি বর্তমান আছে সেগুলি জ্বালিয়ে দেয়া হউক। তাহলেই সকল বিতর্কের অবসান হবে, বাঁশও থাকবে না বাঁশরিও বাজবে না।
জামাতের সাথে দেওবন্দ ও অন্যান্য ফিরকার যে বিতর্ক তার প্রধান বিষয় হল এ দু’টি, ইসমাতে আম্বিয়া ও সাহাবায়ে কেরামের মি’য়ারে হক ইস্যু। অন্যান্য বিষয়গুলি হচ্ছে জায়েয বিতর্ক। তবে এক্ষেত্রে অন্যান্য ফিরকাগুলি রাজনৈতিক দলগুলির ন্যায় বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে। যেমন ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা নামে একটা সাত তলা ভবন ধ্বসে পড়ে, এতে দুই হাজার মানুষ মারা যায়। তখন আওয়ামি লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বি এন পি আন্দোলনরত ছিল। কাজেই আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাস্ত্র মন্ত্রী মুর্খের মত মন্তব্য করেছিল, বি এন পির ছেলেরা টানাটানি করে রানা প্লাজা ফেলে দিয়েছে। ঠিক একইভাবে ফেরকাগুলিও একে অন্যের বিরুদ্ধে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে। আর তাদের নিয়ম হল কোন ফেরকার সাথে যখন দুয়েকটা বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়ে যায় তখন জায়েয বিষয় গুলিকেও কাটছাট করে বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং ইসলাম বিরোধি প্রমাণের চেষ্টা করে।
যেমন বেরেলভীরা দেওবন্দীদের দুয়েকটা বক্তব্য কাটছাট করে কাফের প্রমাণের চেষ্টা করেছে। তদ্রুপ দেওবন্দীরাও মাওঃ মওদুদীর কোন কোন বক্তব্য কাটছাট করে বাতিল ও শরীয়ত বিরোধি প্রমাণের চেষ্টা করছে। বস্তুত ইসমতে আম্বিয়া ও সাহাবাগনের মিয়ারে হক এই দু’টি বিষয় ছাড়া অন্য কোন বিষয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মসলকের সাথে সাংঘার্ষিক নয়। মাওঃ মওদুদীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সাধারণত বিপ্লবি চেতনার। কাজেই যারা একটু আধুনিক মনা, রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করে তাদের কাছে এসব ব্যাখ্যা গ্রহনীয়। আর যারা শুধু ইবাদাত বন্দেগিকেই ইসলাম মনে করে, ইসলামী রাষ্ট্র চিন্তা করে না তাদের কাছে এসব ব্যাখ্যা গ্রহন যোগ্য নয়। এ জাতীয় বিতর্কিত কিছু বিষয় তুলে ধরা হল।
১। ইমাম মাহদিঃ
মওদুদী (রঃ) ইমাম মাহদী সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে যেয়ে এক জায়গায় বলেছেন, মুসলমানদের মধ্যে যারা ইমাম মাহদীর আগমনের উপর বিশ্বাস রাখেন তারা যথেষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে অবস্থান করছেন এবং তাদের বিভ্রান্তি- এর প্রতি অবিশ্বাসী নতুন প্রথা প্রবর্তনকারী মুজাদ্দিদের থেকে কোন অংশে কম নয়। তারা মনে করেন, ইমাম মেহেদী পুরাতন যুগের কোনো সুফী ধরনের লোক হবেন। তাসবীহ হাতে নিয়ে অকস্মাৎ কোনো মাদরাসা বা খানকাহ থেকে বের হবেন। বাইরে এসেই ‘আনাল মেহেদী’ আমিই মেহেদী বলে চতুর্দিকে ঘোষণা করে দেবেন। উলামা ও শায়খগণ কিতাব পত্র বগলে দাবিয়ে তার নিকট পৌছে যাবেন এবং লিখিত চিহ্নসমূহের সঙ্গে তার দেহের গঠন প্রকৃতি মিলিয়ে দেখে তাকে চিনে ফেলবেন।
অতপর বাইয়াত শুরু হবে এবং জিহাদের এ’লান করা হবে। সাধনাসিদ্ধ দরবেশ এবং পুরাতন ধরনের গোঁড়া ধর্ম বিশ্বাসীরা তার পতাকাতলে সমবেত হবেন। নেহায়েত শর্ত পূরণ করার জন্য নাম মাত্র তলোয়ার ব্যবহার করা প্রয়োজন হবে, নয়তো আসলে বরকত ও আধ্যাত্মিক শক্তিবলেই সব কাজ সমাধা হয়ে যাবে। দোয়া দুরুদ যিকির তাসবীহর জোরে যুদ্ধ জয় হবে। যে কাফেরের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে সেই তড়পাতে তড়পাতে বেহুশ হয়ে যাবে এবং নিছক বদদোয়ার প্রভাবে ট্যাংক ও জঙ্গি বিমানসমূহ ধ্বংস হয়ে যাবে’। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমার মতে আগমনকারী ব্যক্তি তার নিজের যুগের একজন আধুনিক ধরনের নেতা হবেন।
এ ব্যখ্যা হল অতিবাস্তববাদী ব্যাখ্যা। এখানে মওদুদী (রঃ) যদি ইমাম মাহদিকেই অস্বীকার করতেন যেমন কেউ কেউ করে থাকে তাহলে তাকে ভ্রান্ত বলা যেত। কিন্তু ইমাম মাহদি যেমন সুফি দরবেশ আলেম আল্লামাও হতে পারেন, তেমনি আধুনিক কোন নেতাও হতে পারেন, উভয় সম্ভাবনাই আছে। কাজেই এটা বিতর্কের কোন বিষয়ও নয় আবার বুনিয়াদি কোন ব্যাপারও নয়। সুতরাং এ বিষয়ে বিতর্ক করা মানে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা। তবে তার ব্যাখ্যা অতিবাস্তববাদি, বাস্তববাদী যে কেউ এ ব্যাখ্যা মেনে নিবে।
২। কোরান অর্থসহ সংরক্ষিত কিনাঃ ‘কোরান কি ছাড় বুনিয়াদি ইসতেলাহ’ গ্রন্থে মাওঃ মওদুদী বলেন-
কোরান অবতীর্ণ হওয়ার সময় এ শব্দগুলোর (ইলাহ, রব, দ্বীন ও ইবাদাত) যে মৌল অর্থ প্রচলিত ছিল, পরবর্তী শতকে ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এক একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকতা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্য নির্দিস্ট হয়ে পড়ে। এর এক পৃষ্ঠা পর তিনি লিখেছেন- এটা সত্য যে, কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্যে আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণেই কোরানের তিন চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি শিক্ষা এবং তার সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়।
এখানে কোরানের তিন চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি এবং তার সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়’ এ উক্তির জন্য দেওবন্দীরা তার কঠোর সমালোচনা করেছেন। অথচ এখানে মওদুদী (রঃ) অতীব সত্য কথাটাই বলেছেন। কারণ খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্তির পর থেকেই ইসলামের সত্যিকার স্পিরিট বিলুপ্ত হতে থাকে। এর বাস্তব উদাহরণ হল, আমরা ফিকাহর গ্রন্থাবলিতে ফিরকাবাজির বিধান, ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, খিলাফত ইত্যাদি সংক্রান্ত কোন অধ্যায় পাই না অর্থাৎ ইসলাম থেকে এগুলি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই মাওঃ মওদুদী সহিহ বাত কাহা।
৩। ইবাদাত সংক্রান্ত বিতর্কঃ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি ইবাদাত কিনাঃ
মাওঃ মওদুদী ইবাদাত একটি ট্রেনিং কোর্স শিরোনামে বলেন-
‘বস্তুতঃ ইসলামের নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদাতসমূহ এই উদ্দেশ্যে (জিহাদ ও ইসলামী হুকুমত কায়েম) প্রস্তুতির জন্যই নির্দিস্ট করা হয়েছে। দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্র শক্তি নিজ নিজ সৈন্য বাহিনী, পুলিশ ও সিভিল সার্ভিসের কর্মচারীদেরকে সর্ব প্রথম এক বিশেষ ধরনের ট্রেনিং দিয়ে থাকে। সেই ট্রেনিংয়ে উপযুক্ত প্রমাণিত হলে পরে তাকে নির্দিস্ট কাজে নিযুক্ত করা হয়। ইসলামও তার কর্মচারীদেরকে সর্ব প্রথম এক বিশেষ পদ্ধতির ট্রেনিং দিতে চায়। তারপরই তাদেরকে জিহাদ ও ইসলামী হুকুমত কায়েম কারার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি অন্যত্র বলেন, মূলত মানুষের রোযা, নামায, হজ্জ, যাকাত, যিকির, তাসবীহ হল ঐ বড় ইবাদাতের জন্য প্রস্তুত করার ট্রেনিং কোর্স ।
ব্যাখ্যাঃ এখানে সঠিক কথা হল, ইসলামী প্রত্যেকটা বিষয়ের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক দুইটি শিক্ষা আছে। যেমন নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি মূলত ইবাদাত আর পার্থিব শিক্ষা হল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ট্রেনিং কোর্স। যেমন কলেমার মাধ্যমে ইসলামের দুর্গে প্রবেশ করবে, নামাযের মাধ্যমে আশরাফ আতরাফ সবাই সমান হয়ে একজন ইমাম তথা কেন্দ্রিয় খলিফার অনুসরন করবে, অবাধ্যতা করবে না। তারপর যাকাত ও ইনফাকের মাধ্যমে আর্থিক সমতা আনয়ন করবে। তারপর হজ্বের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম একত্র হয়ে কার কি সমস্যা, ইসলামের প্রচার প্রসার, মানব কল্যাণ ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করবে, সিদ্ধান্ত নিবে, সমাধা করবে ইত্যাদি। কাজেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যারা ফরয মনে করে তাদের কাছে এই ব্যাখ্যা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু যারা তাবলীগের ন্যায় ইসলামকে পুটলা পাটলির মধ্যে ভরে মসজিদের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চায় তাদের কাছে এই ব্যাখ্যা গাত্র দাহের কারণ।
৪। ইসলামি শিয়ার তথা দাড়ি টুপি পাঞ্জাবি ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞাঃ
মাওঃ মওদুদী বলেন- রাসূল (সাঃ) যতোবড় দাড়ি রেখেছেন, ততো লম্বা দাড়ি রাখাই হলো সুন্নাতে রাসূল বা উসওয়ায়ে রাসূল- আপনার এ ধারনার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আপনি রাসূল (সাঃ) এর অভ্যাসকে হুবহু রাসূলের ঐ সুন্নাতের মর্যাদা সম্পন্ন মনে করেছেন যা জারি ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য নবী পাক (সাঃ) এবং অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরাম প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমার মতে কারো দাড়ি ছোট কিংবা বড় হবার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। সেই মূল জিনিস এটা নয় যা মানুষের ঈমান বেশী বা কম হবার প্রমাণবহ। আমার আশংকা হয়, ‘ঈমানের কমতিকে এখনো যেভাবে কোন কোন বাহ্যিক জিনিসের আধিক্য দ্বারা পূর্ণ করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর কিছু লোকও সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে না পড়ে। কোন ব্যক্তির আনুগত্য ও প্রাণান্তকর সংগ্রাম যদি আল্লাহ্র পথে হয় দীর্ঘ তবে তেমন কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না, যদি তার দাড়ি হয় হ্রস্ব। কিন্তু যদি তার আনুগত্য ও প্রাণান্তকর সংগ্রামই হয় হ্রস্ব, তবে দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন যে, দীর্ঘ দাড়ি তার কোন কল্যাণেই আসবে না। বরঞ্চ এটাও অসম্ভব নয় যে, খোদার দরবারে তার বিরুদ্ধে ধোঁকাবাজির মোকাদ্দমা দায়ের হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, শরীয়ত প্রণেতা দাড়ির ব্যাপারে কোন সীমারেখা নির্ধারণ করে দেননি। আলিমগণ যে সীমা নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন, তা একটি গবেষণালব্ধ জিনিস মাত্র’।
তার আরো অন্যান্য বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায়, তিনি দাড়ি টুপি পাঞ্জাবী ইত্যাদি ইসলামী শিয়ারের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন, অবজ্ঞা করেছেন। আর এ জন্যই বাস্তবে দেখা যায় জামাত বিশেষত শিবিরের ছেলেরা দাড়ি টুপি পাঞ্জাবির তো ধার ধারেই না এমনকি দেওবন্দী ও তাবলীগের লোকেরা যেভাবে খুশু খুযুর সাথে নামায আদায় করে শিবিরের ছেলেরা ততটা উচ্চ মার্গে পৌছতে পারে না। এসব হল ইসলামী শিয়ারের প্রতি মাওঃ মওদুদীর উপেক্ষার ফসল। অথচ ইসলামের সুচনা থেকেই এগুলি রাসূল (সাঃ) এর সুন্নত, ইসলামী শিয়ার, ধার্মিক মানুষের প্রতিক হিসাবে গন্য হয়ে আসছে, এটা ইজমায়ে উম্মত। কাজেই সঠিক কথা হল, এটা মওদুদী (রঃ) এর ভুল। একজন ইচ্ছাকৃত ভাবে দাড়ি টুপি পাঞ্জাবি না পড়লে ভিন্ন কথা কিন্তু কোন ভুল একটা ইসলামী দলের মসলক হতে পারে না। বস্তুত ইসলামের বিধান হল দাড়িও রাখতে হবে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও করতে হবে।
৫। তাসাউফ ও পীর মুরিদ সংক্রান্ত আলোচনাঃ
মাঃ মওদূদীর (রঃ) মতে তাসাউফের প্রচলিত পীর-মুরিদী তরীকা অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষয় এবং এ থেকে বেচে থাকা জরুরী। তিনি এ ব্যাপারে মুজাদ্দিদে আলফে সানী ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহঃ)-এর পর্যন্ত সমালোচনা করেছেন। যদিও তিনি মূল তাসাওউফ বা ইহসানকে অস্বীকার করেন না বলে দাবী করেছেন কিন্তু চিরাচরিত ও সর্বজন স্বীকৃত পদ্ধতি, পীর মুরিদীর প্রচলিত তরীকা এবং সর্বজন স্বীকৃত পীর মাশায়েখগণের যেভাবে ঢালাও সমালোচনা করেছেন- তাতে তাসাউফের স্বীকৃত অংশ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। এরুপ স্বীকৃতি বাস্তবে অস্বীকৃতিরই নামান্তর। আর বাস্তবেও মওদূদী (রঃ) এর চিন্তাধারায় বিশ্বাসী জামাত শিবিরের লোকজন তাসাউফের সাথে কোন রুপ সংশ্লিষ্টতা রাখেন না।
মাওঃ মওদুদী তাসাউফ অস্বীকার করেন না বটে তবে প্রচলিত পীর মুরিদি ও তরিকত প্রথা অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং এ থেকে বেচে থাকা জরুরি মনে করেন। কিন্তু দেওবন্দী, মাযার পন্থি ও অন্যান্য তাসাউফ পন্থীরা অত্র আয়াত দ্বারা দলিল পেশ করে থাকে এবং মাওঃ মওদুদীর কঠোর সমালোচনা করে থাকে। যেমন-
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ ۚ
হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুণ যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন। আয়াতে তাযকীয়া অর্থ আত্নশুদ্ধি।
এক্ষেত্রে সঠিক কথা হল, তাযকিয়ায়ে নফস ভাল যদি এর সাথে ই’লায়ে কালিমাতিল্লাহ, জেহাদ ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থাকে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় মাযারগুলি শিরক বিদাতের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। পীরেরা খোদার আসন দখল করে নিজেদের পেট মোটা করছে আর মুরীদদের পকেট কেটে নিজেদের পকেট ভারী করছে। তদুপরি এরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ফরয তো দূরের কথা জায়েযই মনে করে না। কাজেই এ জাতীয় পীর মুরিদি হারাম বিধায় মাওঃ মওদুদী সঠিক কথাই বলেছেন।
৬। কোরান হাদীস ও তাকলীদ বিতর্কঃ
মাওঃ মওদুদী তানকিহাত গ্রন্থে বলেছেন, কোরান হাদীসের শিক্ষাই অগ্রগণ্য হবে, তবে তা তাফসীর ও হাদীসের পুরাতন ভাণ্ডার থেকে নয়। তিনি আরো বলেন, কোরান বুঝার জন্য কোন তাফসীর গ্রন্থের প্রয়োজন নাই একজন উচু স্তরের প্রফেসরই যথেষ্ট। এছাড়া হাদীসের শুদ্ধা শুদ্ধি নির্নয়ের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগনের মতামতের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না বলেও মন্তব্য করেছেন। যাই হউক এসব বক্তব্য আধুনিক চিন্তা চেতনার পরিচায়ক। এগুলি শরীয়তের বুনিয়াদি কোন বিষয় তো নয়ই ফুরুয়ি বিষয়ও নয়। কাজেই এসব নিয়ে বিতর্কের কিছু নাই।
আবার ফিকহ ও তাকলীদ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আমার মতে দ্বীনি ইলমের ক্ষেত্রে বুৎপত্তি রাখেন এমন ব্যক্তির জন্য তাকলীদ নাজায়েয এবং গুনাহ বরং এর চাইতেও সাংঘাতিক। তাছাড়া তিনি মুক্ত মনে কোরান অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রতি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যাই হউক তাকলীদ সম্পর্কে তার বক্তব্য দোষনীয় নয় সালাফী ও অন্যান্য অনেকের বক্তব্য এটাই ।
৭। কোরানের কয়েকটি পারিভাষিক শব্দ নিয়ে বিতর্কঃ
আগে থেকেই মুসলমানের মধ্যে কোরানের চারটি পরিভাষার অর্থ নিম্নরুপ। ১। ইলাহ অর্থ মাবুদ। ২। রব- প্রতিপালক। ৩। দ্বীন- ধর্ম, ৪। ইবাদাত- নামায রোযা হজ্ব যাকাত ইত্যাদি। কিন্তু মাওঃ মওদুদী এগুলোর অর্থ করেছেন, ইলাহ- শাসক। রব- শাসক। দ্বীন- রাষ্ট্র সরকার। ইবাদাত- আইন মান্য করা। এরুপ ব্যাখ্যার তিনটি কারণ-
১। তিনি আসলাফের অনুসারী ছিলেন না, পূর্বর্তীদের লাগাম খুলে ফেলেছিলেন। কাজেই স্বাধীন মুজতাহিদ হিসাবে নিজে যা বুঝেছেন তাই বলেছেন।
২, যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনি ইসলামের সর্বাধুনিক ও বিপ্লবি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
৩। তিনি ইসলামকে অতিমাত্রায় রাজনৈতিকায়ন করেছেন। যেমন দ্বীন অর্থ জীবন ব্যবস্থা, আর জীবন ব্যবস্থা বলতে বুঝায় হকুল্লাহ ও হকুল ইবাদ, তথা ইবাদাত ও হুকুমত এর সমন্বয়। অর্থাৎ ইবাদাত বন্দেগির মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ্র হক্ব আদায় করবে এবং রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে নিখিল মানব জাতীর মধ্যে ইনসাফ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করবে, এটাই দ্বীন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, সাহাবায়ে কেরামের যুগেই খেলাফতকে রাজতন্ত্রে রুপান্তরিত করার পর থেকে ইসলাম হতে হুকুমতের ধারনাটা প্রচ্ছন্ন হতে থাকে আর ইবাদাতের ধারনাটা প্রকট হতে থাকে। এভাবে বর্তমান পর্যন্ত এসে মুসলমানরা ইসলামী হুকুমতের দিকটা বাদ দিয়ে শুধু ইবাদাতকেই দ্বীন হিসাবে ধরে নিয়েছে। যেমন, দেওবন্দিরা তা’লীমকেই একমাত্র দ্বীন ভাবছে, তাবলীগীরা মসজিদে মসজিদে ঘোরাফেরা করাকেই দ্বীন ভাবছে, পীর মাশায়েখরা মাযার খানকাকেই দ্বীন ভাবছে।
আর এ অবস্থায় মাওঃ মওদুদী ইবাদাতকে উপেক্ষা করে হুকুমতকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বীনের ব্যাখ্যা করলেন, অর্থাৎ দু’দল দুই মেরুতে চলে গেল। জামাতিরা দ্বীন অর্থ হুকুমত বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহন করে দক্ষিন মেরুতে চলে গেল। আর দেওবন্দী ও অন্যান্যরা দ্বীন অর্থ ইবাদাত গ্রহন করে উত্তর মেরুতে চলে গেল কিন্তু দ্বীনের অপব্যাখ্যাকারী আখ্যা দিয়ে মাওঃ মওদুদীর উপর হামলে পড়ল। অথচ এখানে উভয় শ্রেণী সীমালঙ্ঘন কারী। কারণ দ্বীন- এর প্রকৃত অর্থ হুকুমত ও ইবাদাত উভয়টাই। এই হল জামাতের সাথে অন্যদের দ্বন্ধের কারণ। তবে কারণ সমূহের মধ্যে ইসমতে আম্বিয়া ও সাহাবাগনের মিয়ারে হক- এ দু’টি বিষয় বিদাত ও সংশোধন যোগ্য। কারণ এ মতবাদ দু’টি পুর্বে কখনো ছিল না এবং আহলে সুন্নাতের খেলাফ। আর বাকিগুলি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিকও নয় বিতর্কিত নয়, তবে ফিরকাবাজীর স্বার্থে এগুলিকে বিতর্কিত করা হয়েছে।
যাই হউক মাওঃ মওদুদী (রঃ) ইসলামকে অতি মাত্রায় রাজনৈতিকায়ন করেছেন, আর ততটাই আমল ইবাদাতের দিকে উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন। ফলে জামাত স্রেফ একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। আর বর্তমানে তো তারা মওদুদীর আদর্শ থেকেও সরে এসে একটা মুনাফিক দলে পরিণত হয়েছে। যেমন গত সময়ে সরকারে আমাদের দুইজন মন্ত্রী ছিলেন। সমাজ কল্যাণ ও শিল্প মন্ত্রনালয় আমাদের অধিনে ছিল। দেশের পতিতালয়গুলি সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অধিন কিন্তু জামাতের মন্ত্রীবর ইসলামী বিধান মতে এ অসহায় পতিতাদের পুনর্বাসন তো দুরের কথা এ সম্পর্কে টু শব্দটা পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। ইসলামী বিধান মতে মুস্তাদয়াফ শ্রেণী রাষ্ট্রের পোস্য। কিন্তু জামাতের মন্ত্রীগণ কখনো বলেননি যে, আয় বহির্ভুত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এবং শিল্পপতিদের থেকে যাকাত উশর খুমুস আদায় করে ছিন্নমুল ও পতিতাদের পুনর্বাসন করা হউক, অক্ষম অসহায়দের ভাতা দেয়া হউক, অর্থনৈতিক ও বৈচারিক সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা হউক ইত্যাদি।
জামাত যদি ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকারের কথা বলত তাহলে তারাই স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকত কিন্তু নেতারা তা বলেননি, শুধু ক্ষমতার জন্য পাশ্চাত্য ধারার রাজনীতি করেছেন, ইসলামের সাথে বেঈমানি করেছেন। আমার সন্দেহ এ জন্যই আল্লাহ জামাতের উপর গযব নাযিল করেছেন। জামাত একটা মুনাফিক দল- এর আরেকটা প্রমাণ হল, তাদের সন্তানরা কেউ জামাত করে না। আমরা জানি একজন বাবা যা উত্তম ও শ্রেষ্ঠ মনে করে নিজের সন্তানের জন্য তাই বরাদ্দ করে। যেমন তাবলীগিরা তাবলীগকেই নাযাতের উসিলা মনে করে বিধায় তাদের ছেলে মেয়েদের তাবলীগ করায়। দেওবন্দীরা মাদরাসা শিক্ষাকেই একমাত্র ইসলাম মনে করে, এজন্য তাদের সন্তানদের সেখানে পড়া বাধ্যতামূলক। কেউ মাদরাসা ত্যাগ করলে তাকে তাজ্য করে দেয়।
যেমন আমার এলাকার এক হুজুরের মেধাবি ছেলে কিছুদিন মাদ্রাসায় পড়ে ভন্ডামি শুরু করল। হুজুরও তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু একদিন শুনলেন ছেলে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে। সাথে সাথে তিনি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করলেন। ছেলে মামা বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিল, বর্তমানে ঢাকা ভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স করছে কিন্তু বাবা তাকে ত্যাজ্য করেই রেখেছেন। আমরা তাকে বুঝাই ‘এত ভাল ছেলে, আপনার মুখ উজ্বল করছে, তাকে ফিরিয়ে আনুন। কিন্তু হুজুরের এক কথা, সে গুমরাহ হয়ে গেছে তার সাথে আপোস করলে আমাকে আল্লাহ্র দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। এখন প্রশ্ন হল, তাদের এত আত্নবিশ্বাস জন্মাল কি করে, কওমী শিক্ষাকেই একমাত্র মুক্তির উপায় মনে করে? এটা হল তাদের নিষ্ঠা, তারা জানে পৃথিবীর কোথায় যদি ইলম ও আমল না থাকে তাহলে তা কওমী মাদরাসায় কিছুটা হলেও আছে, এজন্যই তাদের এত আত্মবিশ্বাস।
পক্ষান্তরে জামাত নেতৃবৃন্দ ব্যতিক্রম। তাদের সন্তানদের মাদরাসায় পড়ায় না জামাতও করায় না। যেমন মাওঃ মওদুদীর কোন ছেলে মাদরাসা শিক্ষিতও নয়, জামাতও করে না। সবাই আধুনিক শিক্ষিত, একজন আমেরিকায় সিনেমার নায়িকা বিয়ে করেছে, অন্যরাও তথৈবচ। অধ্যাপক গোলাম আযম, নিযামি, মোজাহিদ ও অন্যান্য জামাত নেতাদের কোন ছেলে মাদরাসা শিক্ষিতও নাই জামাতও করে না। তারা নিজেদের সন্তানদের জন্য জামাত পসন্দ করে না। কাজেই তাদের কর্মকান্ড এটাই প্রমাণ করে যে, নেতৃবৃন্দ জানেন আসলে জামাত একটা ভ্রান্ত, মুনাফিক ও পুজিবাদি সংগঠন। ইসলামের সাথে এর সম্পর্ক ততটুকুই আছে যতটুকু অন্যান্য রাজনৈতিক দলের থাকে। কাজেই তারা নিজেদের সন্তানদেরকে এমন একটা ভ্রান্ত সংগঠনে জড়িয়ে তাদের জীবন নষ্ট করতে চান না। কিন্তু অন্যের সন্তানদের ‘এসো এসো জামাতে এসো, এখানে বেহেস্তের টিকেট পাওয়া যায়, ডাইরেক্ট বেহেস্তের গ্যারান্টি’ ইত্যাদি চমকপ্রদ কথায় ডেকে নিয়ে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক হত্যা কান্ডের শিকার বানায়। তারপর তাদের লাশ কুকুরের মত মুখ গুজে পড়ে থাকে রাস্তার ধারে।
আবার জামাত জন্ম লগ্ন থেকে পাশ্চাত্য ও আমেরিকাকে তেল মারে, আনুগত্য করে, হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখে। কিন্তু পাশ্চাত্য জামাত ও বাদ্রারহুডকে বার বার জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যা দেয়। অথচ আমরা খালী চোখেই দেখতে পাই, যেমন ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র শিবির ইত্যাদিদের সম্পর্কে যদি প্রশ্ন করা হয় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজী, মাগীবাজী, মারামারি, খোনাখুনি, অবৈধ উপার্জন ও কর্মকান্ড কারা করে? সবাই বলবে, এক নম্বরে ছাত্রলীগ দুই লম্বরে ছাত্রদল কিন্তু শিবির রাজনৈতিক কারণে মারামারি করলেও ঐসব অবৈধ কর্মকান্ড করে না, ছাত্র সমাজের মধ্যে এরাই সবচেয়ে ভাল, খাটি ও ন্যায়পরায়ণ। আবার ব্রাদারহুডকে মারছে সিসি তবুও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে ব্রাদার হুড সন্ত্রাসী আর সিসি শান্তি কামী। এর কারণ কি?
কারণটা এই উপমায় বলে দেয়া হয়েছে। এক কৃষক কারণে অকারণে সব সময় বউকে পেটায়। একদিন বউ বলল, আচ্ছা তুমি বিনা অন্যায়ে আমাকে মার কেন? তখন কৃষক বলল, আরে মাগী এখনো বুঝিস নাই, আসলে আমি তোকে রাখব না। ব্যস, আসল কথাটা হল, পাশ্চাত্য ও আমেরিকা ইসলাম সহ্য করতে পারে না, এজন্যই তারা ইসলামী দল গুলি রাখবে না, ধ্বংস করে দিতে চায়। অথচ জামাত ব্রাদারহুড তাদেরকেই তেল মারে কিন্তু তেলটা যদি আমেরিকাকে না মেরে অন্যান্য ইসলামী দলগুলিকে মারত তাহলে কবেই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। যেমন জামাত যদি বি এন পি ও আওয়ামী লীগকে তেল না মেরে দেওবন্দিদেরকে বলত, আমরা ও আপনারা তো গোড়া থেকেই এক ছিলাম, এখন মাওঃ মওদূদীর কয়েকটা ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে ফিরকা হয়ে গেছি। কাজেই চলুন এ বিতর্কিত বিষয়গুলি বাদ দিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করি। ব্যস, এ দুটি বৃহৎ ফিরকা এক হয়ে গেলে তাদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠান থেকে রুখে দেয়া কারো বাবার সাধ্যি ছিল না। কিন্তু ইসলামের এই আদিষ্ট কাজটা না করে তারা ইসলামের নিষিদ্ধ কাজ- ইসলাম বিরোধিদের তেল মারে। আর এভাবেই তারা ইসলাম ও নিজেদেরকে ধ্বংস করছে।
যাই হউক বাহ্যিক কর্মকান্ডে বুঝা যায় জামাত একটা পুজিবাদি রাজনৈতিক সংগঠন। এখন প্রশ্ন হল, তাহলে মানুষ জামাত করে কেন? এর উত্তর হল শুন্যতা। ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপযোগি অন্য কোন দল বা সংগঠন নাই বিধায় মানুষ অগত্যা জামাত করে। দেওবন্দী সালাফি বা অন্য কোন ফেরকা যদি যুক্তি সঙ্গতভাবে আধুনিক যুগে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ দেখাত, তাহলে মানুষ সে পথই অনুসরন করত। এখন আমরা চরমভাবে আশাবাদি যে, ইত্তেহাদুল উম্মাহর পক্ষ থেকে সঠিক ও সহীহ পন্থায় যুক্তিসঙ্গত ভাবে ইসলাম ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশনা দেয়া হবে, আর আমরা সবাই সম্মিলিত ভাবে তাতে ঝাপিয়ে পড়ব।
যাই হউক, এতক্ষণ আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে জামাতের মধ্যে যেসব ভুল ত্রুটি বুঝতে পেরেছি- সেগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরন দিলাম। আর এই বিবরন তুলে ধরলাম ছাত্র শিবিরের উদ্দেশ্যে, তারা যেন বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আত্নশংসোধন করতে পারে। তজ্জন্য জামাতের কেউ যেন আমাকে ‘র’ মুসাদের চর বলে আখ্যা না দেয়। আবার দেওবন্দী কোন আলেম- আল্লামা যেন জামাতের সমালোচনা দেখে মনের আনন্দে বগল না বাজায়, বরং সবাই সংশোধন হয়ে ঐক্যের পথে ফিরে আসে। বস্তুত আমার উদ্দেশ্য হল মাদরাসা ও আধুনিক শিক্ষা তথা শিবির ও দেওবন্দী নামের বিভক্তি মিটিয়ে ফেলা, ইসলামের এই অফুরন্ত শক্তি দু’টিকে একত্রিত করে ফেলা। তাহলে দাজ্জালের কবল থেকে ইসলাম ও উম্মাহ মুক্তি পাবে এবং আমরা বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে উববিস্ট হতে পারব।
ইত্তেহাদুল উম্মাহর ঘোষণাঃ
জামাতের গঠন তন্ত্রে ছিল, রাসূলে খোদা ছাড়া কাউকে হকের মাপকাঠি বানাবে না, কাউকে সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করবে না, কারো যেহেনি (চিন্তার) গোলামিতে লিপ্ত হবে না। এখানে সঠিক কথা হল, আমির মোয়াবিয়া (রাঃ) এর কিছু কর্ম ব্যতিত বাকি সকল ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের চিন্তার গোলামি করলে কোন সমস্যা নাই বরং ভাল। কিন্তু চরম সমস্যা হবে তাদের পরবর্তি যুগের কোন মানুষের চিন্তার গোলামি করলে। কাজেই এক্ষণে আমাদের দেখতে হবে আমরা কি মাওঃ মওদুদী ও জামাত নেতৃবৃন্দের যেহেনি গোলামি করছি কিনা?
যেমন, ইসমতে আম্বিয়া ও সাহাবাগণের মিয়ারে হক- এ দু’টি মতবাদ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মসলক বিরোধি। আবার এগুলি ইহকাল পরকালের জন্য দরকারি কোন বিষয়ও নয় শুধু উম্মাহর মধ্যে বিভক্তির হাতিয়ার। এছাড়াও অন্যান্য যেসব বিতর্কিত বিষয় আছে সেগুলি যদি আমরা বর্জন করতে পারি তাহলে প্রমাণিত হবে আমরা মওদুদী ও জামাত নেতৃবৃন্দের যেহেনি গোলামি করছি না, অন্যথায় তাদের যেহেনি গোলাম ও উম্মত বলে গণ্য হব। কাজেই আমরা বিতর্কিত বিষয়গুলি বর্জন করে ঐক্যের পথে এগিয়ে যাব। আর দেওবন্দী ও অন্যাদের প্রতি আমাদের আহ্বান, আপনারাও ফুরুয়ি বিষয়গুলি উপেক্ষা করে ঐক্যের পথে আসুন, নিজে বাচুন ইসলাম ও উম্মাহকে বাচান।
এরপরেও ফিরে না আসলে আমরা মাওঃ মওদুদীর এবং দেওবন্দীরা দেওবন্দের যেহেনি গোলাম বলে গণ্য হব। কাজেই ইসলাম ও উম্মাহকে এই গোলামদের বিষ দাঁত থেকে বাচানোর জন্য ওদের মগজ বের করে রুটি বানিয়ে কুত্তা দিয়ে খাওয়ানো হবে, ইংশাল্লাহ। এটাই আমাদের ইত্তিহাদুল উম্মাহর অঙ্গিকার। আস সালামু আলাইকুম’ বলে সে বসে পড়ল। হাসান মুসান্না দাঁড়িয়ে বললেন, অত্যন্ত সুন্দর ও নিরপেক্ষ আলোচনা। আশা করি সবাই নিজেদের ভুল ত্রুটি সংশোধন করে, হিংসা বিদ্বেষ ও গোয়ার্তুমি বর্জন করে ঐক্যের পথে ফিরে আসবে। এবার দেওবন্দিদের থেকে কেউ দাঁড়ান।
দৃষ্টি আকর্ষনঃ
কোথাও আগুন লাগলে কেউ বসে থাকে না, সবাই নেভানোর জন্য আপ্রান চেষ্টা করে। কিন্তু হায় মুসলিম জাতি, আজ জ্বলছে, জ্বলছে মুসলিম দুনিয়া । অথচ সেই আগুনে সবাই ঘৃতাহুতি দিচ্ছে কিন্তু নেভানোর জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না। মুসলিম বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই যেখানে মুসলিম গণহত্যা চলছে না, কোথাও কাফেররা মারছে কোথাও নিজেরা নিজেরা কামড়া কামড়ি করে মরছে। আর সন্ত্রাসবাদ তো ইসলামকে কফিনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
আরব মুলুকের গাদ্দার রাজারা ইসরাইলের দাসত্ব করছে আর কাতার ইরান ইরাক সিরিয়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলি ধ্বংসের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে মুসলমান মুসলামানকে ধ্বংস করছে আর ভারতের ডুগডুগি বাজাচ্ছে। কাজেই ভাইটি/বোনটি আমার, ইসলামের এই দুর্দিনে আপনি যদি নিস্ক্রিয় বসে থাকেন, তাহলে কি আপনি মুসলমান হিসাবে গণ্য হবেন, বিবেকের আদালতে ও আল্লাহ্র আদালতে কি জবাব দিবেন? একটু এগিয়ে আসুন, আপনার সমর্থন এ জাতির মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে।
এটা সর্ব স্বিকৃত যে ঐক্য ব্যতীত এ জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। আর ঐক্যটা খুবই সহজ কঠিন কোন বিষয় নয়। কারণ কোরান হাদীস ঐক্য ফরয ও বিভক্তি হারাম করেছে। আর কোন সংস্থা সংগঠন ব্যতীত একা এ কাজ করা সম্ভব নয়। কাজেই এগিয়ে আসুন। আমরা সামনে কিছু কাজ করতে চাই। যেমন- ১। ঐক্যের জন্য ইসলামী দলগুলোকে চিঠি দেয়া ও একত্রে বসানো। ২। কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসাগুলিতে যোগাযোগ করে বা চিঠি/হ্যান্ডবিল দিয়ে তাদেরকে সচেতন করা ও জনগনকে সচেতন করা। ৩। ফিরকাবাজীর বিরুদ্ধে হাই কোর্টে রীট করা ও সংবাদ সম্মেলন করা, বিচার না হলেও অন্তত ব্যাপক গনসচেতনা সৃষ্টি হবে। ৪। ইসলামী দলগুলোকে লাভ দেখানো যে ঐক্য হলে দেশে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। আর নিম্নোল্লেখিত শর্তে রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্য হবে। (সাম্ভাব্য প্রস্তাব)।
১। মুসলিম জাতীয় অধিকারঃ জাতির বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষে মুসলিম জাতিসংঘ/আফ্রেশিয় ইউনিয়ন/ খিলাফত বা এ জাতীয় কোন সংস্থা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। এ সংস্থা হবে যুক্তরাষ্ট্রীয়-ফেডারেল সরকারের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন। মুসলিম দেশগুলি এর অধিনে প্রদেশের ন্যায় গণ্য হবে। এ সংস্থার কাজ হবে ত্রিব্ব, মানে তিন ব, মানে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও বিশ্ব নেতৃত্বে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা। ইউরোপিয় ইউনিয়নের ন্যায় সকল দেশে একই শিক্ষা, আইন, ভিসাহীন উন্মুক্ত কর্মক্ষেত্র প্রবর্তিত হবে ইত্যাদি।
২। নাগরিক অধিকারঃ রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সরকারের পোষ্য। কাজেই সক্ষমদের দেশে অথবা বিদেশে সরকারি খরচে কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। অক্ষম-প্রলেতারিয়েত-মুস্তাদআফদের সরকারি ভাতায় প্রতিপালন করতে হবে। মুস্তাদআফ হল ইয়াতিম, বিধবা, বয়োবৃদ্ধ, সকল প্রকার প্রতিবন্ধি ও হিজড়া। সর্বোপরি সকল ছিন্নমূলের পুনর্বাসন করতে হবে।
৩। বিচারঃ ইংরেজ প্রবর্তিত গাজাখুরি বিচার ব্যবস্থা বাতিল করে ইসলামী দিয়ত বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
৪। চিকিৎসাঃ প্রত্যেক উপজেলায় নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক পৃথক মানসম্পন্ন আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। প্রত্যেক ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। প্রত্যেক হাসপাতালে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য আলাদা বিভাগ থাকতে হবে।
৫। নারী অধিকারঃ নারীর শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র আলাদা করতে হবে, তবে পঞ্চাশোর্ধ নারী পুরুষ ইন্টারসেঞ্জ হতে পারবে। বৃদ্ধা ও ১৬ বছরের কম বয়স্কা দরিদ্র মেয়েদের ভাতা দিতে হবে। ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিচার ও ক্ষতিপূরণ উভয়টির বিধান রাখতে হবে।
৬। কৃষক শ্রমিক অধিকারঃ কৃষি খাতে সম্পূর্ণ জ্বালানি ফ্রী করে দিতে হবে। শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য তত্বের যৌক্তিক সমাধান করতে হবে।
৭। শিক্ষাঃ আফগান থেকে আরাকান পর্যন্ত সকল মাদরাসায় আরবী মাধ্যমে জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখা পাঠ্যভুক্ত করতে হবে।
৮। ইসলামী দলগুলির জন্য ১৫০ আসন ছেড়ে দিতে হবে।
সুতরাং যেসব দল এসব শর্তে রাজি থাকবে তাদের সাথে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য হবে। আর এটা নিশ্চিত যে, কোন সংগঠন ব্যতীত একাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়, কাজেই ব্লগার ভাই বোনরা এগিয়ে আসুন। কারো পক্ষে সম্ভব হলে একটা অনলাইন নিউজ চালু করুন। অন্তত একটা ব্লগ খোলে ঐক্য প্রত্যাশিদের লেখার সুযোগ করে দিন। লক্ষ লক্ষ যুবক ঐক্য কামনা করে তাদের নাম রেজিস্ট্রেশন করুন। ঐক্য সম্পর্কে ব্যাপক লেখালেখি করুন, অন্তত আমার লেখাগুলি সর্বত্র ছড়িয়ে দিন।
আপাতত যারা ঐক্য প্রত্যাশি তারা আমার নামটা প্রিয়তে রাখুন। তাহলে পরামর্শের মাধ্যমে আমরাই একটা সংগঠন গড়ে তুলতে পারব। এভাবে আমরা হতে পারব অভিশপ্ত উম্মাহর তিমির মরুপথে আলোর মিনার। লক্ষ করুন, শাহবাগিরা মানুষ মারার জন্য ঐক্য হয়েছিল, আমরা কি ইসলাম উম্মাহ ও মানবতা রক্ষার জন্য ঐক্য হতে পারি না। আল্লাহ্র ওয়াস্তে সবাই এগিয়ে আসুন।
বিষয়: রাজনীতি
১৫২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন