সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ২৫
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৭ জুলাই, ২০১৭, ০১:০৪:৫৬ দুপুর
বিদাত সৃষ্টির কারণে ফিরকার জন্মঃ
(এখান থেকে গুরুত্বপুর্ন কিছু বিষয় আলোচনা হবে- যা প্রত্যেক মুসলমানের জানা জরুরী। সবাইকে পড়ার আমন্ত্রন জানাচ্ছি)
তারপর মাওঃ মোজাহিদ বলল, এ পর্যন্ত আমরা আলোচনা করলাম যেসব বিষয়ে আলেমরা তাফরিত করেছেন, অর্থাৎ শরীয়তের বিধানের মধ্যে কম করেছেন, উপেক্ষা করেছেন, গোপন করেছেন। এখন আমরা আলোচনা করব ইফরাত সম্পর্কে, অর্থাৎ শরিয়তের মধ্যে আলেমরা যা নতুন সংযোগ করেছেন, বর্ধিত করেছেন, বিদাত সৃষ্টি করেছেন। আর এই বিদাত অবলম্বন করেই ফিরকার জন্ম হয়েছে। আমরা জানি, ইমান ও মুমিনের সংজ্ঞা হল- আমানতু বিল্লাহি ওয়া মালায়িকাতিহি ওয়া কুতুবিহি ওয়া রুসুলিহি...... অর্থাৎ আল্লাহ, ফিরিস্তা, আসমানি কিতাবসমূহ, সকল নবী রাসূল, কিয়ামত দিবস, তাকদিরের ভাল-মন্দ, পুনরুত্থান- এই বিষয়গুলিতে যে বিশ্বাস করবে সেই পাক্বা মুমিন। আর একথা সর্বজন বিদিত ও স্বীকৃত যে, শিয়া সুন্নি নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমান এগুলিতে বিশ্বাস করে, কেউ কোন এখতেলাফ করে না। আবার নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি ফরয এবং সুদ, ঘুষ, যিনা, শুকর, খুন খারাবি ইত্যাদি হারাম- এসব বিষয়েও কেউ কোন মতান্তর করে না অর্থাৎ ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়ে কারো কোন এখতেলাফ নেই। এখন প্রশ্ন হল তাহলে উম্মাহর মধ্যে এতসব ফিরকার জন্ম হল কিভাবে? এর উত্তর হচ্ছে, আল্লাহ তা’লা বলেন, - إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ-
শয়তান তো চায়, তোমাদের পরস্পরের মাঝে শুত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে)।অর্থাৎ শয়তান মানুষের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে চায়। এখন প্রশ্ন হল, এই শয়তান কারা? ইরশাদ হচ্ছে-
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا ﴿الأنعام: ١١٢﴾
এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে শত্রু করেছি মানব ও জিন জাতীর শয়তানদেরকে- তারা কারুকার্যময় কথা দ্বারা একে অপরকে ধোঁকা দেয়। (৬: ১১২)
অর্থাৎ মানুষের মধ্যেও শয়তান আছে। আর এই শয়তান চরিত্রের মানুষেরা শরীয়ত বহির্ভুত বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে বিদাত জন্ম দিয়েছে, ইসলাম বহির্ভুত বিষয়কে ইসলামের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বিদাত জন্ম দিয়েছে। তারপর একেকটা বিদাতের উপর বিতর্ক সৃষ্টি করে তারা বিভিন্ন ফিরকায় বিভক্ত হয়ে গেছে। এই বিদাত সৃষ্টির কারণ হল মেধার যথার্থ প্রয়োগ ক্ষেত্র না পাওয়া। কারণ ইসলামী শিক্ষিতরা কোরান হাদীসে সুপ্ত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কে কোন গবেষণা করে না। হিজরি অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরা বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করত। এজন্যই ইতিহাস, ভুগোল, রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা ইত্যাদি শাস্ত্রের জনক ছিল মুসলমানরা। অষ্টম শতাব্দীর পরে মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর অকর্মন্য মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা। কাজেই তারা বিজ্ঞান চর্চা বাদ দিয়ে শরীয়তের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করে।
বিশেষত ইংরেজ আমলে এ ফিতনা মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে। তখন চুন বিশ্ব ইশ্বর, আগাখানি মতবাদ, খাকসার পাটি, মুনকিরিনে হাদীস, পারভেজি মতবাদ, চকরালভি মতবাদ, মাহদবিয়া মতবাদ, যিকরি মতবাদ ইত্যাদি শত শত বাতিল ফিরকার জন্ম হয়। এসবের অধিকাংশ ফিরকা বিলুপ্ত হয়ে যায় আর কিছু কিছু টিকে যায়। এভাবে মুসলমানরা কোরান হাদীসের বিজ্ঞান চর্চা বাদ দিয়ে শরীয়তের অপব্যাখ্যায় আত্মনিয়োগ করে। এজন্যই বিজ্ঞান সংক্রান্ত কোরান- সুন্নাহর শত শত নস অনুদঘাটিত হয়ে পড়ে আছে, এগুলি যুগ যুগ ধরে মানুষকে বিজ্ঞানের পথে ডাকছে কিন্তু মুসলমানরা এ পথে সাড়া না দিয়ে শরীয়তের অপব্যাখ্যায় আত্মনিয়োগ করল। পক্ষান্তরে মরিস বুকাইলির মত অমুসলিমরা এ ডাকে সাড়া দিয়ে কিছুটা হলেও ইসলামের খিদমত করল আর মুসলমানরা আত্মঘাতি ফিরকাবাজীতে লিপ্ত হয়ে থাকল।
যাই হউক, শরীয়তের খুটিনাটি বিষয়ের অপব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন মতবাদ বা বিদাতের জন্ম দিল। আর এসব বিদাত অবলম্বনেই ফিরকা গুলির জন্ম হয়েছে। এখন আমরা প্রত্যেক ফিরকার আক্বিদা বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা করব, যারা বিদাত সৃষ্টি করেছে এবং সাপের বিষের মত এসব বিদাতি বিষ ছড়িয়ে উম্মাহকে বিভক্ত করে ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংস করছে তাদের বিচার করা হবে। আর উল্লেখ্য যে, এসব ফিরকাবাজদের বিচারের জন্য ইনকুইজিশন কোর্ট বা শরীয়া আদালত গঠন করতে হবে। যেভাবে মধ্য যুগে ইউরোপে গীর্জা শাসনের সময় খৃষ্টান পোরুহিতরা ইনকুইজিশন কোর্ট নামে এক ধরনের আদালত গঠন করেছিল। গির্জার পোরুহিতরা ধর্ম রক্ষার নামে এসব আদালত গঠন করে সাধারণ মানুষের উপর যুলুমের হিমালয় চাপিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু আমরা ইনকুইজিশন কোর্ট বা শরীয়া আদালত গঠন করে প্রকৃত ধর্ম রক্ষা করব। আলেম নামধারি যেসব বিদাতি, ফিরকাবাজ ও ফিতনাবাজ শয়তানরা ইসলাম ধ্বংস করছে এসব আদালতে তাদের বিচার করা হবে। যাই হউক এবার আমি ফিরকা সংক্রান্ত আলোচনা শুরু করছি। মুসলমানদের মধ্যে কতগুলি ফিরকা আছে, পৃথিবীর কোন পরিসংখ্যানবিদ এর সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। এটা সম্ভবও নয়। আবার কোন কোন ফিরকার আক্বিদা বিশ্বাস এত জটিল যে এরা আর ইসলামের গণ্ডির মধ্যেই নেই। কাজেই এসব ফিরকার মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। কাজেই আমরা শুধু ভারত বর্ষের হকপন্থি প্রধান ছয়টি ফিরকা নিয়ে আলোচনা করব। যেমন বেরেলভী, দেওবন্দি, তাবলীগ, জামাতে ইসলামী, আহলে হাদীস ও সৌদি থেকে পার্সেল করা সালাফি মতবাদ।
আমরা জানি শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভির (রঃ) আগে ভারত বর্ষে কোন ফিরকাবাজি ছিল না, সবাই সুন্নি হানাফি মুসলমান ছিল। কিন্তু ইংরেজ আমলে ধুর্ত ইংরেজের প্ররোচনায় বিভিন্ন ফিরকার জন্ম হতে থাকে। এর মধ্যে প্রথম জন্ম নেয় বেরেলভী ধারা। এ ধারায় কিছু লোক বিভক্ত হওয়ার পর বাকী বিশাল মুসলিম জনগোস্টি ঠিক থাকে, সম্ভবত তারা দেওবন্দি বোধ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু এ জামাতটা ভেঙ্গে আবার তাবলীগ ও জামাতে ইসলামী নামে দু’টি ধারার জন্ম হয়। তাবলীগ এখনো দেওবন্দীদের সাথে থাকলেও জামাতে ইসলামী সাংঘর্ষিক অবস্থানে চলে যায়। বেরেলভি ধারার প্রবর্তক আহমদ রেজা খান বেরেলভী (রঃ)--
তখনি হাসান মুসান্না দাঁড়িয়ে বললেন, প্রত্যেক ফেরকা প্রতিপক্ষ ফেরকার প্রতি বিদ্বেষ পরায়ন বিধায় প্রতিপক্ষ ফেরকার আলোচনার অনুমতি নাই। বরং প্রত্যেক ফেরকার একজন করে দাঁড়িয়ে স্ব স্ব ফেরকার দোষ ত্রুটিগুলি আলোচনা করবে, আর তা করবে আল্লাহকে হাজির নাযির রেখে আল্লাহ্র দরবারে জবাবদিহিতার মানসিকতা নিয়ে। কেউ মিথ্যা বললে বাকিরা প্রতিবাদ করবে। জামাতে ইসলামী ও দেওবন্দ সর্বশেষে আলোচনায় আসবে। কারণ ভারত বর্ষের বৃহৎ এ দু’টি ফেরকা হক্বপন্থি, শিক্ষিত, আলেম, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। কাজেই এ দু’টি ফেরকার মধ্যে আমরা প্রথমেই ঐক্যের ডাক দিব। কেউ অন্তরায় হলে তাকে হত্যা করা হবে। কাজেই এদের আলোচনা হবে সর্বশেষে। এখন বেরেলভি ধারা থেকে একজন উঠে দাঁড়ান।
বেরেলভী মতবাদঃ
তখন মাদরাসা পড়ুয়া একটা ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে আলোচনা শুরু করল- শ্রদ্ধেয় ইমাম, আমি ছাত্র সেনার একজন সদস্য। আমাদের বেরেলভী ধারার অনুসারী আছে চট্টগ্রামে, সিলেটে কিছু আছে, দেশের অন্যত্র নাই বললেই চলে। আমরা নিজেদেরকে সুন্নি বলে দাবী করি। আমাদের ইমাম আহমদ রেজা খান বেরেলভী (জন্ম ১৮৫৬, মৃত্যু ১৯২১ সালে) কয়েকটি বিদাত বা নতুন মতবাদ সৃষ্টি করেন। যেমন-
১। ইংরেজ আমলে ইংরেজরা মুসলমানদের উপর অত্যাচারের ষ্টীম রুলার চালিয়েছে। হাজার হাজার আলেমকে হত্যা করেছে, মুসলমানদেরকে চাকরি ব্যবসা বাণিজ্য ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে, ইংরেজ ও হিন্দুর যৌথ শক্তির পীড়নে ভারত বর্ষে মুসলিম জাতি যখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম তখন শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) ভারত বর্ষকে দারুল হরব ঘোষণা করেন কিন্তু আহমদ রেজা খান (রঃ) তখন ভারতকে দারুন আমান ঘোষণা দিয়ে ইংরেজদেরকে আনুকুল্য দিলেন এবং পেলেন। অথচ তখন হিন্দু মুসলমান শিখ সবাই ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে তৎপর। এভাবে তিনি করলেন ‘শত্রুর সাথে গলাগলি ধরে মিত্রের সাথে পাঞ্জা। আমরা বেরেলভী ধারার লোকেরা - أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ - ''দ্বীন কায়েম করো, আর এতে একে-অন্যে বিভক্ত হয়ো না’’ কোরানের এই নির্দেষের উপর আমল করি না, অর্থাৎ রাষ্ট্রিয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করি না। বরং আমরা পাশ্চাত্যের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী, কখনো ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করি না। জামাত ও দেওবন্দীদের যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে চায় আমরা তাদের বিরোধিতা করি। কাজেই এটা আমাদের ভুল নীতি, আর এ নীতি পরিবর্তন করার জন্য আমাদের মুরুব্বিদের আহ্বান জানাচ্ছি।
২। দ্বিতীয় মতবাদ হল দেওবন্দীরা কাফের। বাস্তবে আমরা দেখি দেওবন্দীরা কওমী মাদরাসায় লেখা পড়া করে চাকরি বাকরির কোন ধার ধারে না, ইসলামের জন্য তারা নিজেদের জীবন যৌবন উৎসর্গ করে। কাজেই লোকগুলি কাফের হতে যাবে কোন দুঃখে। দেওবন্দীদের দাবী হল, আহমদ রেজা খান নাকি তাদের মুরুব্বিদের লিখিত কোন কোন কিতাবের উদৃতি কাট ছাট করে এ তাকফিরি ফতোয়া দিচ্ছেন। অবশ্য এ সম্পর্কে আমার কোন অবগতি নাই। কাজেই দেওবন্দী ও আমাদের মুরুব্বিদের প্রতি আহ্বান- আপনারা একত্রে বসে এসব তাকফিরি বিষয়ের মিমাংসা করেন। যারা বসতে চাইবে না তাদের ইনকুইজিশন কোর্টে তুলে বিচার করা হবে। তাকফীরি খেলার সাধ মিটিয়ে দেয়া হবে।
৩। আমরা বলি রাসূল (সাঃ) নুরের সৃষ্টি আর দেওবন্দীরা বলে মাটির সৃষ্টি। এটা একটা বিদাত, কারণ এ জাতীয় মতবাদ রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তি যুগে ছিল না।। কাজেই আমার দাবী হল, হয় উভয় পক্ষ বসে এ বিতর্কের মিমাংসা করুন অথবা ফিরকাবাজির এসব হাতিয়ার ত্যাগ করুন।
৪। আমরা মাযার পন্থি ও সুফিবাদিরা মিলাদ ক্বিয়াম ভাল কাজ, সওয়াবের কাজ মনে করি। আর ক্বিয়াম করাকে ওয়াজিব মনে করি কিন্তু দেওবন্দী, আহলে হাদীস ও সালাফিরা এটাকে শিরক ও হারাম বলে থাকে। আমরা ক্বিয়ামের পক্ষে ইহুদিদের ন্যায় অতি বিশ্লেষণের আশ্রয় নিয়ে থাকি। কাজেই এখানে আমাদের ফেরকার আলেম ও মুরুব্বিদের প্রতি প্রশ্ন-
ক। এটা একটা বিদাত, কারণ হিজরি ষষ্ট শতাব্দি পর্যন্ত মিলাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সর্ব প্রথম মুসেলের বাদশাহ মুযাফফর উদ্দিন কুকরি ৬০৪ হিজরি সালে এর প্রবর্তন করেন। কাজেই একটা বিদাতকে অবলম্বন করে বিতর্কের জন্ম দিয়ে ফিরকাবাজির মত কুফুরিতে লিপ্ত হয়ে নিজেরাও জাহান্নামী হলেন আমাদেরকে জাহান্নামের পথে ঠেলে দিলেন।
খ। মুরুব্বীদের প্রতি প্রশ্ন, শরীয়ত নির্ধারিত বিষয়, যেমন তাহাজ্জুদ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, ইসলাম প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি আমল কি ঠিক মত হয়? প্রতিদিন তাহাজ্জুদ, নফল রোযা ঠিকমত হয়? যদি না হয় তাহলে শরীয়ত বহির্ভুত বিদাত নিয়ে এত মাতামাতি কেন? সারা শরীর উলঙ্গ রেখে মাথায় টুপি দেয়ার এত গরজ কেন? ফিরকাবাজি করে ইসলাম ধ্বংস করার জন্য? কাজেই এসব বিদাত ছড়িয়ে যারা ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংস করছে ইনকুইজিশন কোর্টে তাদের বিচারের দাবী জানাই।
৫। আমাদের ভয়ঙ্কর মতবাদ হল রাসূল (সাঃ) গায়েব জানেন। অথচ কোরান হাদীসের স্পষ্ট দলীল হল রাসূল (সাঃ) গায়েব জানেন না। যেমন-
قُل لَّا أَقُولُ لَكُمْ عِندِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ ۖ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَىٰ إِلَيَّ ۚ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَىٰ وَالْبَصِيرُ ۚ أَفَلَا تَتَفَكَّرُونَ [٦:٥٠]
আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। আমি এমন বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে। আপনি বলে দিনঃ অন্ধ ও চক্ষুমান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা কর না ?
قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ۚ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ [٧:١٨٨]
আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম, ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য।
وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ۚ
তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে, এ গুলো তিনি ব্যতীত কেউ জানে না।
قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ ۚ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ [٢٧:٦٥]
বলুন, আল্লাহ ব্যতীত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে কেউ গায়বের খবর জানে না এবং তারা জানে না যে, তারা কখন পুনরুজ্জীবিত হবে।
عَنِ الرُّبَيِّعِ بِنْتِ مُعَوِّذٍ، قَالَتْ: دَخَلَ عَلَيَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَدَاةَ بُنِيَ عَلَيَّ، فَجَلَسَ عَلَى فِرَاشِي كَمَجْلِسِكَ مِنِّي، وَجُوَيْرِيَاتٌ يَضْرِبْنَ بِالدُّفِّ، يَنْدُبْنَ مَنْ قُتِلَ مِنْ آبَائِهِنَّ يَوْمَ بَدْرٍ، حَتَّى قَالَتْ جَارِيَةٌ: وَفِينَا نَبِيٌّ يَعْلَمُ مَا فِي غَدٍ. فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لاَ تَقُولِي هَكَذَا وَقُولِي مَا كُنْتِ تَقُولِينَ»
অর্থাৎ মুওয়াব্বেয তনয়া রুবাইয়ের বিয়েতে রাসুল (সাঃ) উপস্থিত হলেন, তখন বালিকারা দফ বাজিয়ে গান গাইছিল এবং বদর যুদ্ধে তাদের গোত্রের শহীদদের গুনগান করছিল। এক বালিকা বলল, ‘আমাদের মধ্যে একজন নবী আছেন- যিনি ভবিষ্যৎ জানেন অর্থাৎ গায়েব জানেন। তখন রাসুল (সাঃ) বললেন, একথা (গায়েব জ্ঞান) বলো না, অন্য যা কিছু বলতেছিলে তা বল।
এসব দলীল দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, রাসূল (সাঃ) গায়েব জানেন না। কাজেই ফেরকাবাজ ও ফেতনাবাজ আলেমরা যখন বুঝল কোরান হাদীস দ্বারা রাসূল (সাঃ) এর গায়েব জ্ঞান তত্ত্ব প্রমাণ করা যাবে না তখন তারা মুনাফিকির আশ্রয় নিল। মুতাযিলাদের মত সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ শুরু করল। তারা বলল, ইলমে গায়ব প্রথমত দুই প্রকার যাতি ও আতায়ি। আতায়ি আবার দুই প্রকার মুহিত ও গায়রে মুহিত, মুহিত আবার দুই প্রকার মুহিতে আম ও মুহিতে খাস। এই মুহিতে খাস এর গায়েব জ্ঞান রাসূল (সাঃ) এর আছে। আর এই বিশ্লেষণ এমনই জটিল যে এটা বুঝতে হলে দার্শনিক ও গণিতবিদ হতে হবে, সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের ফেরকাবাজ আলেমরা এমনই ধুর্ত যে, রাসূল (সাঃ) এর গায়েব জ্ঞান তত্ত্ব কোরান হাদীস দ্বারা প্রমাণ করতে না পেরে জটিল ও দুর্বোধ্য বিশ্লেষণের আশ্রয় নিয়ে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করল। অথচ কোরান হাদীসে অসংখ্য নস দ্বারা অতি বিশ্লেষণ, অধিক সওয়াল ও তর্ক- বিতর্ক নিষেধ করা হয়েছে। অতীত জাতি ও ইহুদিরা অধিক প্রশ্ন ও অতিবিশ্লেষণের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই বুঝা যাচ্ছে এই অতি বিশ্লেষণ কারীরা উম্মতের ইহুদি। সুতরাং হয় এরা নিজেদের এসব ভ্রান্ত মতবাদ পরিত্যাগ করবে অথবা ইনকুইজিশন কোর্টে এদের বিচার হবে।
তারপর হাসান মুসান্না দাঁড়িয়ে বললেন, এখন তোমার ফেরকার উদ্দেশ্যে উম্মাহর ঐক্যমঞ্চ তথা আমাদের এই ইত্তেহাদুল উম্মাহর নীতিমালা প্রকাশ কর- যা সকলে মেনে নিবে। ছাত্রটা আবার বলতে লাগল, আল্লাহ তা’লা বলেছেন- ''দ্বীন কায়েম করো, আর এতে একে-অন্যে বিভক্ত হয়ো না’’ অর্থাৎ সকলে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে হবে, কোনরূপ ফিরকাবাজি বা বিভক্ত হওয়া যাবে না। কাজেই আমরা বেরেলভী মতবাদের জন্য এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলাম যে, আমরা সকল বিদাত, অতি বিশ্লেষণ, শরীয়ত বহির্ভুত বিষয় পরিত্যাগ করে লিই’লায়ে কালিমাতুল্লাহ এর জন্য সকলের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব, কোন দলাদলি করব না। আমাদের মতবাদ রাসূল (সাঃ) এর গায়েব জ্ঞান তত্ত্ব, নুরের সৃষ্টি তত্ত্ব, মিলাদ ক্বিয়াম তত্ত্ব ওগুলি বিদাত। কারণ রাসূল (সাঃ) ও খায়রুল কুরুনে এসব মতবাদ ছিল না।
আবার এসব বিষয় ইহকাল ও পরকালের জন্য দরকারি বা কল্যাণকর কোন বিষয় নয়। যেমন বিয়ের সময় পাত্র পাত্রিকে কেউ জিজ্ঞেস করে না যে, আচ্ছা বাবাজি বা মায়াজি বল তো রাসূল কি গায়ব জানেন, তিনি কি নুরের সৃষ্টি, মিলাদ ক্বিয়াম করলে কত মণ সওয়াব পাওয়া যাবে? তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় এডমিশন টেস্টে, বি সি এস পরীক্ষা, চাকরির ইন্টারভিউ বা জীবন জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্য কোন কাজের প্রয়োজনিয় কোন বিষয় নয়। আবার এটা প্রমাণ সিদ্ধ সত্য যে, কবরে মুনকার নাকির এবং কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ্ও এ জাতীয় প্রশ্ন করবেন না।
এখন প্রশ্ন হল, তাহলে এসব বিতর্কিত বিষয়ের জন্ম দেয়া হল কেন? বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে উম্মাহর মধ্যে ফিরকা ও বিভাজন সৃষ্টি করার জন্য এসব বিদাত জন্ম দেয়া হয়েছে, আর এ কাজটি হল শয়তানের। সুতরাং যারা এসব বিদাত জন্ম দিয়ে উম্মাহর মধ্যে ফিরকা বিভাজন সৃষ্টি করেছে তারা শয়তান। আর এসব শয়তানের বিচার করা ওয়াজিব এবং উম্মাহর প্রধান দায়িত্ব। কাজেই বেরেলভী ভাইদের প্রতি আমার আহ্বান- আসুন আমরা বিদাত ও ফেরকাবাজি ত্যাগ করে সকলের সাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করি’। তারপর সে সালাম দিয়ে বসে পড়ল।
আহলে হাদীস বা গাইরে মুকাল্লিদ মতবাদঃ
আহলে হাদীসের একজন দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বক্তব্য শুরু করল ‘আমাদের জন্ম ইংরেজ আমলে। সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর শিষ্য মাওঃ আব্দুল হক বেনারসি প্রথম এ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাকলীদ অস্বীকার করেন এবং আয়িম্মায়ে মুজতাহিদিন- বিশেষত ইমাম আবু হানিফার (রঃ) বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে থাকেন। এসব ফিতনা দেখে সৈয়দ আহমদ তাকে স্বীয় দল থেকে বের করে দেন। আমাদের নাম করনের ইতিহাস হল, আমাদের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব নওয়াব সিদ্দিক হাসান সাবের যুগ পর্যন্ত আমরা নিজেদেরকে মুওয়াহহেদিন ও মুহাম্মদি বলে পরচয় দিতাম। কারণ আমাদের প্রতিপক্ষরা আমাদেরকে ওয়াহাবি বলত। ১৮১৮ সালে সর্ব প্রথম আমরা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে পরিচয় দেয়া শুরু করি। কিন্তু এরপরও আমাদের উপর ওয়াহাবি অপবাদ বন্ধ না হওয়ায় আহলে হাদীস নামটাকে আমরা নিজেদের জন্য রেজিস্ট্রেশন করে নেই। ১৮৮৬ সালে ‘এশাআতিস সুন্নাহ’ পত্রিকার সম্পাদক বিখ্যাত আহলে হাদীস আবু সাইদ মোহাম্মদ লাহোরি ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন করেন যে, ‘দলটি ইংরেজ সরকারের অনুগত ও কল্যাণকামী হিসাবে প্রমাণিত। অথচ তাদেরকে ওয়াহাবি বলে অপবাদ দেয়া হবে এটা সঙ্গত নয়। কাজেই এ দলের লোকজন অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে গভর্নমেন্টের নিকট আবেদন করছে তাদের জন্য ওয়াহাবি শব্দটি বর্জন পুর্বক আহলে হাদীস নামটি বরাদ্দ দেয়া হউক। সরকার এ আবেদন মঞ্জুর করে নেয়।
দেওবন্দী ও অন্যরা বলে থাকে যে, সৈয়দ আহমদ (রঃ) এর বিরোধিতা করে মুসলমানদের মধ্যে ভাঙ্গন ও বিভক্তি সৃষ্টি করে ইংরেজের মন তুষ্টি করাই এ দলটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল। এটা তারা আহলে হাদীসের বিভিন্ন সের পোরস্ত ব্যক্তিদের উদৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টাও করে। যেমন বিখ্যাত আহলে হাদীস জনাব মোবারকের উক্তি ‘জামাতে গুরাবায়ে আহলে হাদীসের বুনিয়াদ রাখা হয়েছিল মুহাদ্দিসিনে কেরামের বিরোধিতার উপর। তদুপরি মোজাহিদ আন্দোলন মানে সৈয়দ আহমদের আন্দোলনের বিরোধিতা করে ইংরেজদের সন্তুষ্ট করাই উদ্দেশ্য ছিল’। যাই হউক এসবের সত্য মিথ্যা আল্লাহই ভাল জানেন। তবে আমাদের ব্যাপারে একটা বাস্তব সত্য হল এই যে, আমরা ইংরেজ সরকারের অনুগত ছিলাম। ঠিক একইভাবে বর্তমানেও আমরা তাগুত সরকারগুলির অনুগত থাকি।অন্যদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করি না বরং হানাফি তথা দেওবন্দিদের বিরুদ্ধে সর্বদা বিষোদ্গার করে থাকি।
আমাদের মসলক হল আমরা তাকলীদ অস্বীকার করি, ইজমা কিয়াস মানি না। আমাদের আক্বিদা বিশ্বাস হল, কোরান হাদীস থেকে সরাসরি আমল করতে হবে। কোন ইমাম বা মাযহাবের অনুসরণ করা যাবে না। আর আমরা যেহেতু কোরান হাদীসের মধ্যে সীমাবদ্ধ বিধায় ইজমা কিয়াস মানি না। ইমামগণ ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে যেসব বিষয় প্রমাণ করেছেন আমরা সেগুলি মানি না। যেমন হযরত উমরের যুগে তারাবীহ বিশ রাকাতের উপর ইজমা আমরা মানি না। সালাফিরাও আমাদের মতই মত পোষণ করে।
পক্ষান্তরে হানাফি দেওবন্দিরা তাকলীদ ওয়াজিব মনে করে। তাদের দাবী সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা কোন আলেমের পক্ষেও সরাসরি কোরান হাদীস থেকে মাসয়ালা উদ্ভাবন করে আমল করা সম্ভব নয় বিধায় ইমাম বা মাযহাব অনুসরণ ব্যতীত গত্যন্তর নাই। আর গত্যন্তর নাই বিধায় মাযহাব মানা ওয়াজিব। কাজেই তাকলীদ ওয়াজিব। কারণ তাকলীদ ছাড়া আমল করতে গেলে সঠিকের চেয়ে ভুলই বেশি হবে। যাই হউক এখানে উভয় শ্রেণী সীমালঙ্ঘন করেছে। কারণ বিজ্ঞ লোকদের অনুসরণ ব্যতীত সকলেই কোরান হাদীস থেকে মাসয়ালা উদ্ভাবন করতে পারবে না। যেমন আমরা ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইবনে হাজম ও ইমাম শাওকানির অনুসরণ করছি অথচ মুখে বলছি তাকলীদ জায়েয নাই। এটা আমাদের মুনাফেকি ও সীমালঙ্ঘন। আবার দেওবন্দি হানাফিরা বলছে তাকলীদ ওয়াজিব। আর তাকলীদ অর্থ হল, কোন ইমাম কোরান হাদীসের ভিত্তিতে কথা বলেছেন ও আমল করেছেন এই আস্থা রেখে কোন দলীল প্রমাণ অন্বেষণ না করে তার আনুগত্য করা অর্থাৎ অন্ধ আনুগত্য। অথচ নবী রাসূল ব্যতীত অন্য কারো নিঃশর্ত আনুগত্য করা হারাম। কাজেই দেওবন্দীরা সীমালঙ্ঘন করেছে, তাকলীদের কথা বলে হারাম কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে।
ইত্তিহাদুল উম্মাহর আহ্বানঃ যাই হউক এই ঐক্য মঞ্চ থেকে আমরা উভয় পক্ষের দিকে আহ্বান করছি, খোদার উপর খোদকারী বন্ধ করুন। আহলে হাদীসের বুঝতে হবে, কোন ব্যক্তি বা মাযহাবের অনুসরণ ব্যতীত সাধারণ মানুষের পক্ষে আমল ইবাদত সম্ভব নয়। আবার দেওবন্দীদেরও বুঝতে হবে যে, তাকলীদ বা নিঃশর্ত আনুগত্যের কথা বলা যাবে না, এটা হারাম। বরং কোন মাযহাব বা ইমামের আনুগত্য করতে হবে এই শর্তে যে, তিনি সাধারণ মানুষ ছিলেন, তার ইজতিহাদ ও দলীলাদিতে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কাজেই যদি ভুল পাওয়া যায় তাহলে সংশোধন করে নিতে হবে। এছাড়া মাযহাব অনুসরণ জায়েয নয়।
বস্তুত আমাদের মুরুব্বীদের কাজ হল, মধ্যপ্রাচ্য থেকে কোটি কোটি টাকা এনে হানাফীদের সালাফী বানাতে ব্যস্ত। অর্থাৎ হানাফীরা যেন কাফের, তাদেরকে মুসলমান বানাতে চাচ্ছে। অথচ বাস্তবতায় আমরা দেখি এদেশে কোন খৃষ্টান ছিল না, অথচ আজ দেশের সীমান্ত অঞ্চল গুলিসহ পাবর্ত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক ধর্মান্তর চলছে। পাবর্ত্য এলাকায় খৃষ্ট রাজ্য স্থাপনের ষড়যন্ত্র চলছে। আপনারা এত পারেন, এত টাকা ঢালতে পারেন-তাহলে ঐসব সমস্যার সমাধান করছেন না কেন ? একটা মুসলিম দেশের মুসলমানসহ অন্যদের খৃষ্টান বানানো হচ্ছে আর আপনারা হানাফীদের পিছু লেগে আছেন- তাদেরকে মুসলমান বানাবেন। ওদিকে মুসলমান খৃষ্টান হয়ে যাচ্ছে সেদিকে আপনাদের কোন দৃষ্টি নেই কেন? ভণ্ডামির একটা সীমা থাকা চাই। বস্তুত মুসলিম জাতির প্রতিটি ফিরকার কাজ হলো নিজেদের মধ্যে খোচাখোচি করে হানাহানির সৃষ্টি করা আর বিধর্মীদের সামনে জী হুযুরী করা। খিলাফত প্রতিষ্ঠা ব্যতিত এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় নেই।
যাই হউক, তাকলীদের মত ফুরুয়ি বিষয় নিয়ে পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ ছড়িয়ে ফিরকা বিভক্তি সৃষ্টি করা হারাম। এরপরেও যারা এসব থেকে বিরত না থাকবে তাদেরকে ইনকুইজিশন কোর্ট পাঠানো হবে’ বলে সে বসে পড়ল।
ওয়াহাবি বা সালাফি মতবাদঃ
একজন সালাফি দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু করলেন ‘আমি আগে হানাফি ছিলাম মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করে সালাফি হয়েছি। বর্তমানে সৌদি মুবাল্লেগ হিসাবে কাজ করছি। এ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহাব নজদি (১৭০৩ – ১৭৯২)। তার সময় কালে আরব জগত শিরক বিদাতের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। কাজেই তিনি শিরক বিদাতের বিরুদ্ধে কঠোরতা অবলম্বন করলেন। এ উদ্যোগ সর্বত্র প্রশংসিত হল এবং দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ল। শায়খ আব্দুহ মিসরি, জামাল উদ্দিন আফগানী, খায়রুদ্দিন তিইনিসি ইত্যাদি মনিষীগণ এ মতবাদে আকৃষ্ট হলেন। বিশেষত এ আন্দোলনের ঢেউ ভারত বর্ষে আছড়ে পড়ে।
সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর জিহাদ, মাওঃ নেছার আলী তিতুমিরের বাশের কেল্লা, হাজি শরীয়তুল্লাহর ফারায়েযি আন্দোলন ছিল ওয়াহাবিজমের ফসল। এরা সবাই সালাফি মতবাদে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। কিন্তু পরবর্তিতে ইবনে ওয়াহাবের অনুসারীরা এমন বাড়াবাড়ি শুরু করল যে, জমহুর উম্মত তা মেনে নিতে পারে নাই। যেমন তারা রাসূল (সঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের মাযার ও স্মৃতিচিহ্নময় স্থানগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দিল, এসব স্থান থেকে বরকত হাসিল করাকে হারাম ঘোষণা করল। চার ইমামের বাইরে ইজতিহাদ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করল। এইসব বাড়াবাড়ি দেখে জমহুর উম্মত ওয়াহাবিদের প্রতি রুষ্ট হল। আর ধুর্ত ইংরেজ সরকার এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাল।
ইংরেজ বিরোধি মুসলমানদের যে কোন আন্দোলনকেই তারা ওয়াহাবী বলে অপপ্রচার করত এবং মুসলমানদের দৃষ্টিতেই হেয় করে তুলত। এভাবেই সালাফিদের প্রতি অন্যান্য মুসলমানদের মনে বিতৃঞ্চার জন্ম নেয়। আমাদের ছয়টি মতবাদ সম্পর্কে অন্যান্য ফিরকা এমনকি জমহুর উম্মাহ মতান্তর করে থাকে। তবে যতই মতান্তর করুক, সালাফিরা অন্য যে কোন ফেরকার চেয়ে নির্ভুল এবং কোরান সুন্নাহর সবচেয়ে নিকটতর, আলেম মাত্রই একথার স্বীকৃতি দিবে, ঠিক কি না? কয়েক জন কওমী মাদরাসার আলেম হাত উঠিয়ে সম্মতি জানাল। যাই হউক ঐ বিতর্কিত ছয়টি বিষয় বুনিয়াদি কোন বিষয় নয় এগুলি হল ফুরুয়ি বা উত্তম অনুত্তমের প্রশ্ন। অথচ সেগুলিকে আমরা হারাম মনে করি-
১। তাকলীদবা মাযহাব অনুসরন ২। তাসাউফ বা পীর- মুরীদি, ৩। দোয়ার মধ্যে উসিলা মানা, ৪। তাবীজ- কবজ প্রসঙ্গ, ৫ তাবাররুক বিল মাকান বা বুযুর্গানে দ্বীন ও অলী-আউলিয়াদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান থেকে বরকত লাভ করা,। ৬। শুধু রওযায়ে আতহার যিয়ারতে উদ্দেশ্যে ভ্রমণ, অর্থাৎ এটা হারাম।
বস্তুত এসব বিষয় জায়েয কিন্তু যখনি এগুলোতে বাড়াবাড়ি করা হয় তখন হারামে পরিণত হয়। যেমন মাযহাবের নামে কারো নিঃশর্ত আনুগত্য করা, পীর মুরিদীর নামে পীরকে খোদার আসনে পৌছে দেয়া, মাযারে মান্নত করা, সেজদা করা, মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার জন্য পীর বাবা বা মাযারে আবেদন করা ইত্যাদি। কাজেই সালাফীদের প্রতি আমার আবেদন জায়েয বিষয়কে হারাম বলা উচিত না, আর সালাফী বিরোধিদের প্রতি আবেদন উল্লেখিত বিষয় গুলিতে যেসব শিরক বিদাত হচ্ছে সেগুলি আপনাদের প্রতিরোধ করতে হবে। নচেৎ এসব পাপের দায়ভার আপনাদের বহন করতে হবে। যাই হউক সকলের প্রতি সর্বশেষ আবেদন, উক্ত বিষয়গুলি হচ্ছে ফুরুয়ি বিষয়, আর ফুরুয়ি বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে ফিরকাবাজির মত কুফুরি কাজে লিপ্ত হয়ে ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংস করা যাবে না। কাজেই সকলকে ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছি’ বলে সে বসে পড়ল।
তাবলীগ মতবাদঃ
একজন আলেম দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিলেন, আমি মারকাজ মসজিদের ইমাম। ছাত্রকাল থেকেই আমি তাবলীগের সাথে জড়িত। মাসে তিনদিন, বছরে এক চিল্লা দিতাম। ফারেগ হওয়ার পর তিন চিল্লা ও সাল লাগিয়েছি। এসব দেখেই আমাকে মারকাজের ইমাম হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে আমি বাইরে থেকে বছরে তিন চিল্লা লাগিয়ে আসি। আমি একজন কট্টর তাবলীগী। জামাত, আহলে হাদীস ও সালাফিরা তাবলীগের সমালোচনা করে বিধায় আমিও ওদের কঠোর সমালোচক। কিন্তু সমস্যা হল দেওবন্দী আলেমরা, তারা তাবলীগকে নাজায়েয বলে না ঠিকই কিন্তু সমালোচনা করে। যেমন পাকিস্তানের আল্লামা তকি উসমানী তিরমিযির শরাহ দরসে তিরমিযিতে সমালোচনা করেছেন। তাদের সমালোচনাতেই হউক বা নিজের গরজেই হউক ধীরে ধীরে আমার মধ্যে এই চিন্তা ঢুকল যে, মাওঃ ইলিয়াস (রঃ) প্রবর্তিত তাবলীগ কি আসলে ইসলাম?
আমরা যে বলি এটাই একমাত্র নবী ওয়ালা কাজ কিন্তু নবীর সাথে তো আমাদের কর্মের কোন মিল নেই। রাসূল (সাঃ), সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তি কোন যুগে এমন দেখা যায়নি যে, তারা জিহাদ, খিলাফত, ইসলামী রাষ্ট্র চিন্তা ইত্যাদি বাদ দিয়ে শুধু পুটলা পাটলি নিয়ে মসজিদে মসজিদে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। আমি চরম সন্দিহান হয়ে গেলাম। তারপর এই মজলিসে আসার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলাম যে, তাবলীগ আর ইসলামে নেই, ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ খারিজ হয়ে গেছে। কিন্তু সাধারণ তাবলীগীদের এ কথা বললে তো তারা আমার মাথা ফাটিয়ে দিবে, এটা দেওবন্দী আলেমদের চিন্তা করতে হবে।
হঠাৎ একজন তাবলীগী দাঁড়িয়ে ঝাঝালো কণ্ঠে বলল, আপনি মারকাযের ইমাম হয়ে তাবলীগের উপর এমন কুফুরি কথা কি করে বলতে পারলেন, আপনার ইমামতি থাকবে না। তিনি বললেন, আমার ইমামতি থাকবে কি না থাকবে সেটা বড় কথা নয়, আসল কথা হল আমরা কোরান হাদীসের উপর আছি কিনা? থাকলে আমার প্রশ্নগুলির উত্তর দিন, আমরা জেহাদ প্রয়োজন বোধ করি না অর্থাৎ সুরা তাওবাসহ কোরানে জেহাদের আয়াতগুলি বাদ দিয়ে দিয়েছি। যাকাত, ইসলামী হুকুমত, ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, খিলাফত, পিতা মাতার খিদমত, মানব সেবা ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক বিধানগুলি আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি। তাহলে আমাদের মধ্যে আছে আর কি ঘোড়ার ডিমটা?
এখন তাবলীগীসহ দেওবন্দী আলেমদের কাছে আমার প্রশ্ন, তাবলীগের মধ্যে এসব বিষয় আছে কি না, যদি থাকে তাহলে পাক্কা মুসলমান। আর যদি না থাকে তাহলে তারা মুসলমান হিসাবে গন্য হবে কিনা? জেদ আর গোয়ার্তুমি না করে কোরান হাদীসের ভিত্তিতে এর জবাব চাই। কারণ এখানে গোয়ার্তুমি চলবে কিন্তু আল্লাহ্র দরবারে গোয়ার্তুমি চলবে না।
অজ্ঞ মুসলমানদেরকে নামায রোযা ইত্যাদি শিখানোর জন্য মুরুব্বিরা ছয় উসুল প্রণয়ন করে তাবলীগের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন মুর্খ তাবলীগীরা ছয় উসুলকেই একমাত্র ইসলাম গণ্য করে ভ্রান্ত ফিরকায় পরিণত হয়ে গেছে। তারা কত দূর গুমরাহ হয়ে গেছে যে, মুরুব্বীদেরকে হযরতজী বলে ডাকে অথচ সাহাবায়ে কেরাম ও আয়িম্বায়ে মুজতাহিদিনের শানেও তারা জী শব্দ উচ্চারন করে না। মুরুব্বীদের কথা মালাকে মালফুজাত নাম দিয়ে পকেট বুকাকারে ছাপিয়ে পকেটে রাখে অথচ পাঞ্জে সুরা ও চল্লিশ হাদীস কখনো তাদের পকেটে শোভা পায় না। তারা ফাযায়েলে আমলের মোকাবেলায় কোরান তালিম পসন্দ করে না।
এখন তাবলীগী ও আলেম সমাজের কাছে প্রশ্ন হল এসব কি ইসলাম? কেন আজো যয়ীফ হাদীস ও কিসসা কাহিনিতে ভরপুর ফাযায়লে আমলকে কোরান ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিকে লিখা হল না? কে দেবে এর উত্তর। তবে আমার কথা হল দেওবন্দের গর্ভজাত তাবলীগকে আলেমরাই নিয়ন্ত্রন করে। কাজেই আলেমগন ঠিক হয়ে গেলে তাবলীগও ঠিক হয়ে যাবে। কাজেই তাবলিগী আলেমদের কাছে আবেদন, তাবলীগকে ঠিক করুন। অন্যথায় মুসলমানদের গুমরাহ করার দায়ে ও ইসলাম ধ্বংস করার দায়ে আপনাদেরকে ইনকুইজিশন কর্টে দাঁড়াতে হবে এবং পরকালে জাহান্নামে যেতে হবে। সবশেষে ইত্তেহাদুল উম্মাহর পক্ষ থেকে তাবলীগকে সংশোধনের দাবী জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি’ বলে তিনি বসে পড়লেন।
বিষয়: রাজনীতি
৯৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন