সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ২৪
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৫ জুলাই, ২০১৭, ০১:০৫:০৯ দুপুর
বাংলাদেশ প্রসঙ্গঃ
সম্ভবত বাংলাদেশে যে পরিমাণ চেতনার বানিজ্য হয় পৃথিবীর অন্য কোন দেশে চেতনা নিয়ে এতটা বানিজ্য হয় না। এ চেতনা বানিজ্যের মুল উৎস হলো ইংরেজ শাসন। কারণ ইংরেজরা তোলাদন্ড হাতে নিয়ে এসে যখন দেখল, এদেশে হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ তো আছেই সেই সাথে মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যেও কোন ঐক্য নেই। একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, রাজ্য আক্রমণ করে, তারা নিজ নিজ স্বার্থে পরস্পর হানাহানি করে বহুধা বিভক্ত হয়ে আছে। ইংরেজ তুলাদন্ড ফেলে রাজদন্ড হাতে নেয়ার প্রয়াসি হয়ে উঠল। আর এ ক্ষেত্রে তারা divide and rule নীতি প্রয়োগ করল। অর্থাৎ তাদের মূলনীতি ছিল, ভাই ভাই সে লড়াও, ঘর ঘর সে, পরুসি পরুসি সে, গাঁও গাঁও সে, মহল্লা মহল্লা সে, রাজা রাজা সে, অওর হিন্দু মুসলমান সে লড়াও। আর এভাবে বিভক্ত করে, দুর্বল করে ভারত শাসন কর। অন্যথায় গুটি কয়েক ইংরেজ ভারত বর্ষ জয় করে শাসন করা সম্ভব ছিল না।
তারপর ইংরেজরা চলে যাবার পর উত্তরাধিকার হিসাবে আমরা ইংরেজের এ নীতিটি গ্রহণ করি। আমরা খন্ড খন্ড হয়ে একেক দল একেকটা চেতনার বানিজ্য শুরু করে দিয়েছি। যেমন এক দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরি করছে। কথা সত্য মতলব খারাপ। সত্য এজন্য যে, কেউ পরাধিনতা বা অন্যের গোলামি মেনে নেয় না বিধায় নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে প্রাকৃতিকভাবেই মানুষ সচেতন থাকে এবং থাকতে হয়। এটা দেশ প্রেম এবং মহৎ মানবীয় গুন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের লোটতরাজ, শাসন শোষণ থেকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক সাম্য ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে এদেশে শোষণ বঞ্চনাহীন একটি আদর্শ সমাজ গড়ার লক্ষে।
অথচ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি অতীত হয়ে গেলেও সে লক্ষ্য তো অর্জিত হয়ই নি বরং ঐসব চেতনার বেনিয়ারা দেশের সম্পদ লোটপাট করে বিদেশে পাচার করছে, সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে, খুন খারাবিতে দেশকে শ্মশানে পরিণত করছে। দেশ বারংবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হচ্ছে। অথচ সাধারন মানুষ প্রান্তিকে চলে যাচ্ছে। কাজেই বুঝা যাচ্ছে এই চেতনার পেছনে আসল চেতনা হচ্ছে অন্তহীন লোটপাট আর লালসার অনন্ত সরোবরে লকলকিয়ে উঠা বাসুকির অযুত কোটি রসনার রসদের যোগান মূল উদ্দেশ্য। আর এটাই চেতনাবাজদের মতলব।
আরেক দল জাতীয়তাবাদী চেতনার ফেরি করছে। এখানেও কথা সত্য মতলব খারাপ। আর তা দু’টি কারণে, প্রথমতঃ ইসলাম সাধারণতঃ রাষ্ট্র, ভাষা, আঞ্চলিকতা ও গোত্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি দেয় না। ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে . مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ - তোমরা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের ধর্মে কায়েম থাক। তিনিই তোমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন)। অর্থাৎ ইসলামই মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। কাজেই সকল মুসলমান ভাই ভাই, এক জাতি, এক গোত্র, সকল মুসলিম দেশ এক দেশ। ইসলামী জাতীয়তাবাদের সুবিধা এই যে, ধনি দেশ গুলির সম্পদে দরিদ্র দেশগুলির অধিকার স্বীকৃত, দরিদ্র জন গোস্টি যে কোন দেশে ভিসা ও বর্ডারবিহীন ভাবে সে দেশের বিধিমালা অনুযায়ী চাকরি-নকরি, ব্যবসা-বানিজ্যি ইত্যাদি সুবিধা প্রাপ্ত হবে, যে কোন দেশে বসবাস করতে পারবে। কাজেই ধনী দরিদ্রের বৈষম্য নিরসন এবং অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম জাতিয়তাবাদের কোন বিকল্প নেই।
সুতরাং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যদি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জন্ম না দিয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদের জন্ম দিতেন এবং সার্কের ন্যায় মুসলিম জাতিসংঘ বা আফ্রেশিয় ইউনিয়ন বা কেন্দ্রীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতেন বা চেষ্টা করতেন তাহলে তিনি শুধু বাঙালি জাতিই নয় বরং সমগ্র মুসলিম জাতির ত্রানকর্তার বরমাল্যটি অর্জন করতে পারতেন। কারণ মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কোন কেন্দ্রীয় সংস্থা থাকলে আজ মধ্যপ্রাচ্যসহ ফিলিস্তিন, আরাকান, কাশ্মির, জিংজিয়াং ইত্যাদি স্থানে মুসলমানদের মানব বিপর্যয়ের সম্মুখিন হতে হত না এবং মুসলিম দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যও থাকতো না।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কুফল এই হলো যে, আজ মধ্যপ্রাচ্যের স্বজাতি মুসলিম ভাইয়েরা আমাদেরকে মিসকিন বাঙালি বলে ডাকে, আমরা তাদের ফুটপরমাশ খাটি। অথচ তাদের প্রত্যেকটা পেট্টো ডলারে তাদের নিজেদের যতটুকু অধিকার রয়েছে ইসলাম আমাদের জন্যও ঠিক ততটুকু অধিকারই সাব্যস্ত করেছে। আবার মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলি আমাদেরকে শ্রমিক জাতি, দাস জাতি হিসাবে গন্য করে। আর এসবই মুসলিম জাতীয়তাবাদের খেলাপ।
দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যদি আমাদেরকে ধনে-জনে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, যশ-খ্যাতি, ক্ষমতা ও নেতৃত্বে বিশ্ব সভার আসরে পৌঁছে দিতে পারত, যেমন হিটলারের জাতীয়তাবাদী চেতনা জার্মানদের বিশ্ব জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল, কামাল আতাতুর্কের জাতীয়তাবাদ তুর্কিদের জন্য অন্তত কিছুটা হলেও সুফল বয়ে এনেছিল- তাহলেই আমরা এ জাতীয়তাবাদকে আশির্বাদ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারতাম। কিন্তু এ জাতীয়তাবাদীরা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে জাতির ললাটে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুর্নীতি গ্রস্থের কলঙ্ক তিলক এঁটে দিয়েছে। মিসকিন জাতি, শ্রমিক জাতি, দাস জাতি ইত্যাদি কলঙ্কময় অবিধাগুলি জাতির ভাগ্যলিপিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই প্রমাণিত হল, এসব জাতীয়তাবাদ কায়েমী স্বার্থবাদীদের বেলুনিয় স্লোগান মাত্র, জাতীর কল্যাণ সেখানে কিছুই নাই। বস্তুত মুসলিম জাতীয়তাবাদের শ্লোগান ব্যতীত এ জাতির মুক্তির দ্বিতীয় কোন সুরঙ্গ নেই।
ইসলাম পন্থীদের চেতনা বানিজ্যঃ
এবার মূল আলোচনায় ফিরে আসি। আমাদের কথা ছিল বাংলাদেশী আলেমদের কর্মকান্ডের পর্যালোচনা। বাস্তবতায় দেখা যায়, আলেমগণ উপরুক্ত চেতনাগুলির ভুল ত্রুটি শুধরে দেয়া তো দুরের কথা বরং তারাই চেতনা বানিজ্যে চ্যাম্পিয়ন। তারা ইসলামকে পুঁজি বা মূলধন হিসাবে গ্রহণ করে বিভিন্ন চেতনা বিকিয়ে যাচ্ছে। যেমন আমাদের একদল দেওবন্দী চেতনার বানিজ্য করছি, কেউ মওদুদিবাদী চেতনা, কেউ ইলিয়াছি চেতনা, কেউ রেজাখানি, কেউ কাদরিয়্যা-চিশতিয়্যা চেতনা, কেউ তাহরিরী, কেউ তাওহিদী, কেউ সালাফি ইত্যাদি ইসলামের নামে শত শত চেতনার বানিজ্য করে দু’পয়সা কামিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে বেশ তো ভালই দিনাতিপাত করছি।
আর এমনিভাবে প্রতিটি মুসলিম নামধারী ফিরকা ইসলামকে মূলধন বানিয়ে বানিজ্য করছে মাত্র, ইসলামের জন্য কিছুই করছে না। অবশ্যই এখন প্রতিটি ফিরকা আপত্তি তুলবে এবং দাবী করবে যে, আমরা যা কিছু করছি সব ইসলামের জন্য করছি। ভ্রান্ত, তাদের এ দাবী সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কারণ আল্লাহ্ এক, রাসূল সাঃ এক, কোরআন এক, কাজেই মুসলিম জাতিও এক থাকবে। তাছাড়া কোরআন একতা বা ঐক্যকে বাধ্যতামূলক ফরযে আইন করেছে, ভাঙ্গন হারাম করেছে। সবকিছু একক থাকা সত্ত্বেও যারা একাধিক হয়েছে- উম্মাহর মধ্যে ভাঙ্গন বিভক্তির সৃষ্টি করেছে, এরা উম্মাহর জারজ। এরা আল্লাহ্ ও রাসূলের সাথে গাদ্দারি করছে, কোরআন সুন্নাহকে পিঠের পিছনে নিক্ষেপ করে, উম্মাহকে শতধা বিভক্ত করে কাফের মুশরিকদের দিয়ে স্বজাতিকে ধ্বংস করাচ্ছে।
এরা যদি ইসলামী চেতনা তথা মুসলিম ভ্রাতৃত্বে চেতনাশীল থাকত, ইসলামের বিধান মেনে চলত, ঐক্যবদ্ধ থাকত এবং জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা করত তাহলে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারত। কিন্তু তারা যেহেতু ইসলামী চেতনা পোষন করে না বরং স্ব স্ব ফেরকার চেতনা ফেরি করে বেড়ায় বিধায় এরা উম্মাহর অভিশাপ। এখন দেওবন্দী, জামাতী, তরিকতী, তাবলিগী, সালাফী ইত্যাদি ফিরকার কাছে আমাদের দাবী, কোরআন হাদীসের ভিত্তিতে যদি আমি মিথ্যা বলে থাকি তাহলে গালাগালির জন্য আমাকে বিচারের মুখোমুখি কর, আর যদি সত্য বলে থাকি তাহলে আল্লাহ্র ওয়াস্তে, আল্লাহ্র দোহাই ইসলামের দাবী পূরণ কর, ঐক্যবদ্ধ হও, খিলাফত প্রতিষ্ঠা কর, পতনন্মোখ জাতিকে রক্ষা কর, জাতির ইহকাল পরকাল সঙ্কটমুক্ত কর। সর্বোপরি নিজেদেরকে পরকালে দরবারে ইলাহিতে জবাবদিহির কঠোরতা থেকে শঙ্খামুক্ত কর। আল্লাহুম্মা আমিন।
আলেম সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ
এতো গেল চেতনার বেসাতী সংক্রান্ত আলোচনা। এক্ষণে আমরা আলোচনা করব আলেম সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে। আলেম সমাজের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে- ইসলাম বা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আর খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য যে চিরন্তন সংগ্রাম তাকেই জিহাদ বলে। উল্লেখ্য যে, কারো গর্দান মেরে কালেমা পড়ানোর নাম জিহাদ নয় বরং জিহাদের মূল বার্তা হচ্ছে, সমাজের শোষণ বঞ্চনা উৎখাত করে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যায়-অবিচার-যুলুম-নির্যাতন নির্মূল করে ইনসাফ ও ন্যায় ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এজন্যই আল্লাহ তা’লা বলেন, আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই কাফের, তারাই জালেম, তারাই ফাসেক ৷
এটাকে আমরে বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকারও বলা হ্য়। যেমন রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন - «من رأى منكم منكرا فليغره بيده فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان» وَفِي رِوَايَةٍ: "وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الإيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ" ‘‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন অসৎকাজ (হতে) দেখবে, সে যেন তাকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করে। তবে যদি সে ঐরূপ করতে অক্ষম হয়, তাহলে কথা দ্বারা যেন তাকে প্রতিহত করে, যদি এরপরও করতে অক্ষম হয়, তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করে। আর সেটা হবে সবচাইতে দুর্বল ঈমান। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এর বাইরে বিন্দুমাত্র ঈমান নাই)।
এখন পর্যালোচনার বিষয় হলো, আলেমগণ এ দায়িত্ব কতটুকু পালন করছেন। আমরা জানি এ দায়িত্ব পালনের লক্ষে রায় বেরেলির সিংহ সৈয়দ আহমদ বেরেলভি আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিছু পাঠান গাদ্দারের কারণে বালা কোটের ময়দানে সে আন্দোলনের সমাধি রচিত হয়। তারপর ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের ব্যর্থতার পর মুসলমানদের উপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। তখন আলেম সমাজ ইংরেজের সাথে সন্মুখ সমরের আর কোন সম্ভাবনা না দেখে রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ সবকিছু ছেড়ে ছোড়ে মসজিদ মাদরাসা ও খানকায় ঢুকে পড়লেন। সেই যে তারা ঢুকলেন অদ্যাবধি আর কখনো বের হলেন না।
পক্ষান্তরে ব্যর্থ সিপাহি বিপ্লবের পর মুসলমানদের একটা অংশ জাতীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগিতার লক্ষে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির আসায় ইংরেজ বৈরিনীতি পরিহার করে হিন্দুদের ন্যায় তোষণ ও সহযোগিতার নীতি অবলম্বন করল। তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করল, ইংরেজের মন জয় করল, চাকরি- নকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করল। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ইংরেজ চলে যাবার পর সঙ্গত কারণেই এ আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে আসে। কারণ তারা আধুনিক শিক্ষায় রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞ ছিল।
পক্ষান্তরে আলেম সমাজ তখন দেওবন্দ ভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা ও অন্যান্য খিদমত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং মসজিদ মাদরাসা ও খানকার চার দেয়ালের মধ্যে নিজেদের বন্দী করে ফেলেছিলেন। ফলে যা হবার তাই হলো। খৃষ্টীয় পোরুহিতদের কুকর্ম আর ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সমগ্র ইউরোপ যেমন বস্তুবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ গ্রহণ করেছিল, একইভাবে আলেমদের পশ্চাতমুখিতা এবং নিস্পৃহতার কারণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতি হয়ে উঠেছিল বস্তুবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ নাস্তিক্যতাবাদ এবং সর্বগ্রাসি পুঁজিবাদ। বিষয়টি পর্যালোচনার দাবী রাখে।
মুসলিম নেতৃবৃন্দ কংগ্রেস বা হিন্দুদের থেকে যখন ঐক্য সমতা ও ইনসাফের কোন সম্ভাবনাই দেখলেন না তখন শেরে বাংলার লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবী জোরালো হল। তখন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ আলেম সমাজকে বুঝালেন,পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে তা হবে ইসলামের ল্যাবরেটরি- গবেষণাগার। এ প্রতিশ্রুতি পেয়ে আলেম সমাজ সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয়। এখন প্রশ্ন হল নবসৃষ্ট পাকিস্তানের নেতৃত্বে কে থাকবে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতি বা সংবিধান কি হবে ?
এখানে, ঠিক এখানেই কথাটা। কারণ তখন পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আলেম সমাজ তাদের মসজিদ-মাদরাসা-খানকা ছেড়ে এগিয়ে আসেন নি। ফলে ইসলামের সূচনা কাল থেকে যে সাধারণ রেওয়াজ চলে আসছিল, মুসলিম রাষ্ট্রগুলি আলেমদের নেতৃত্বে কর্তৃত্বে পরিচালিত হওয়া- তার ছন্দ পতন ঘটল। ইংরেজ আমলের ন্যায় আলেমগণ রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে গেলেন। আর নেতৃত্বের আসন কখনো ফাঁকা থাকে না। সেখানে মানুষ না বসলে শয়তান আসন গ্রহণ করে। সুতরাং আবিশ্যম্ভাবি পরিণতি হলো পাশ্চাত্য ধারার বস্তুবাদি সেক্যুলারিস্টদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে গেল। আর তারা তো ইসলাম বুঝেই না- প্রতিষ্ঠা তো সুদূর পরাহত। কাজেই জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে গালাগালি করা- যে তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করে মুসলিম জাতির সাথে গাদ্দারি করেছে এটা ঠিক নয়। এর জন্য দায়ী আলেম সমাজ, তারা এর দায় কোন ভাবেই এড়াতে পারবেন না।
আবার ইসলামের যে চির সুন্দর অর্থব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা (বিস্তারিত খিলাফত ইশতেহার) আলেমগণ তা জনগণের সামনে তোলে ধরতে পারেন নি এবং সেগুলো প্রয়োগের কোনরূপ চেষ্টা তদবীরও করেন নি। ফলে পাকিস্তান একটি ধর্মহীন পুঁজিবাদী শোষণের রাষ্ট্রে পরিণত হল। এ সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তান পুর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করল। ফলে পাক বাংলা ভারতের প্রায় অর্ধ কোটি মানুষের রক্তপাত ঘটিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হল। কাজেই আলেম সমাজ এ পাপের দায় এড়াতে পারবেন না। কারণ শরীয়া আইন চালু থাকলে শোষণ যুলুম নির্যাতন চলতে পারত না। আবার উভয় পাকিস্তানের আলেমগণ পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ যুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে, জিহাদের হুমকি দিলে তার অবসান হত, পাকিস্তান ভাঙ্গত না, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনপাত ঘটত না। কাজেই এর দায় আলেমদের।
পাকিস্থান জন্মের পর ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আলেমগণ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে তো আসেনইনি, তদুপরি মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন ফিরকা বিভক্তি সৃষ্টি করে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছেন। বিষয়টা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ইংরেজ আমলের আগে উপমহাদেশে কোন ফিরকা ছিল না, সকলের একটাই পরিচয় ছিল সুন্নী হানাফি মুসলমান। কিন্তু বৃটিশ রাজত্বে বিভিন্ন প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে দেওবন্দী, তাবলীগী, জামাতে ইসলামী, বেরেলভী ইত্যাদি দলের সৃষ্টি হল। যেমন, দেওবন্দীরা ইসলামী শিক্ষার খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছে, তাবলিগীরা অশিক্ষিত ও আধুনিক শিক্ষিত জনগোষ্টির দোরগোড়ায় ইসলামের দাওয়াত ও শিক্ষা পৌঁছে দিচ্ছে, জামাতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে যাচ্ছে, বেরেলভীরাও মাযার ভিত্তিক কিছুটা হলেও ইসলামের খেদমত করে যাচ্ছে। এ প্রত্যেকটা দলই ইসলামের একেকটা অংশে মহৎ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা হল তারা একে অন্যের খিদমতের স্বীকৃতি তো দিচ্ছেই না বরং পরস্পরের প্রতি এতটাই বিষ উদগিরণ করছে, এতটাই শত্রুতা পোষণ করছে যতটা কাফের মুশরিকদের সাথেও করে না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তারা বিধর্মীদের সাহায্য গ্রহণ করে। ফলে পাক-বাংলায় বাহ্যত মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ মনে হলেও আসলে তারা সংখ্যা লঘিষ্ঠ। ফলে তারা নিজেরা নিজেরা কামড়া কামড়ি করে যেমন মরছে, তদ্রুপ বিধর্মীদের হাতেও বন্য প্রাণীর মত মারা পড়ছে। হায়, এই দুঃখ রাখার স্থান কোথায়? অথচ তাদের বুঝা উচিত ছিল, বিভিন্ন শাখায় খিদমতদাতা এসব দল এক্ত্র হলেই পূর্নাংগ ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে যেত।
কাজেই এই ফিরকাগুলি ঐক্যবদ্ধ হওয়া ব্যতীত ইসলাম প্রতিষ্ঠা, খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম জাতির উত্থানের আশা করা মরীচিকায় পানি প্রাপ্তির আশার নামান্তর। আর এ বিষয়টি যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, ছাত্র সংগঠন- ছাত্র শিবির, ছাত্র সেনা, ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদিরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে তত তাড়াতাড়ি তাদের নিজেদের, ইসলামের ও উম্মাহর জন্য মঙ্গল বয়ে আসবে। আল্লাহ সবাইকে সঠিক সমঝ দান করুন।
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশঃ
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফের একবার ইসলাম প্রতিষ্ঠার সুযোগ এল। কারণ তখন কমিউনিষ্টরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তারক্তি শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু আলেম সমাজের বিরুদ্ধাচরণের কারণে তারা ব্যর্থ হয়েছে এবং বর্তমানে নাসিয়াম- মানসিয়্যার অবস্থায় পৌঁছে গেছে। অথচ সমাজতন্ত্রের জন্ম ইসলাম থেকে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার একটা অংশ সমাজতন্ত্র যা লেলিনের স্বিকৃতি এবং ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব থেকেই বুঝা যায়। (খেলাফত ইশতিহারে বিস্তারিত আসছে) কাজেই তখন কমিউনিষ্টদের সাথে মিলে তাদেরকে ইসলামাইজেশন করে খুব সহজেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু আলেম সমাজ তা করেন নি।
আবার বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির দুটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র। এ দু’টি মূলনীতির কারণে আলেম সমাজ বঙ্গবন্ধুকে গালাগালি করে, রাগ করে অভিমান করে একেবারে মসজিদের মেহরাবে ঢুকে লম্বা ঘুম দিলেন। তা না করে তারা যদি বিষয়টা ইসলামের সাথে বাজিয়ে দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন এগুলি ইসলামেরই মূলবার্তা। যেমন পুর্বে আলোচনা হয়েছে এবং কোরানের অসংখ্য আয়াত দ্বারা প্রমানিত পৃথিবীতে আল্লাহ্র দ্বীন একটাই যা নূহ (আঃ) এর মাধ্যমে শুরু হয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। পরবর্তিতে পৃথিবীবাসী একক দ্বীনের অনুসারী না হয়ে বিভিন্ন নবীর অনুসরনে বিভিন্ন সম্প্রদায় হয়ে গেছে। যেমন নূহের অনুসারী হিন্দুরা, মুসার অনুসারী ইহুদীরা, ইসার অনুসারী খৃষ্টানরা ইত্যাদি। সুতরাং দ্বীন যেহেতু একটাই কাজেই ধর্ম তো নিরপেক্ষই আছে, মানে একক দ্বীন একক ইসলাম। কাজেই ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রমাণ হল। আর সমাজতন্ত্র ইসলাম থেকেই জন্ম নিয়েছে। এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত আলোচনা আসছে। কাজেই আলেমরা একটু উদারনীতি অবলম্বন করলেই বঙ্গুবন্ধুর সাথে আপোস করতে পারতেন কিন্তু তারা তা করেননি।
তারপর প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে আলেমদের চেষ্টা তদবির ব্যতীতই অর্ধেক ইসলাম তো প্রতিষ্ঠা হয়েই গিয়েছিল। সংবিধানে আল্লাহ্র উপর আস্থা, বিসমিল্লাহ সংযোজন, রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম ইত্যাদি হয়েছিল। বাকী ছিল শুধু ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। তখন আলেমরা জনগণের সামনে ও সরকারের সামনে এগুলির সুফল বর্ণনা করে কিছুটা চেষ্টা করলেই খুব সহজে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু তারা সেই চেষ্টা করেন নি। ফলে সদ্য স্বাধীন একটা দেশ লোটেরা হায়েনাদের লোটপাটের মগরাজ্যে পরিণত হল এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের চারনভূমি হয়ে উঠল। কাজেই এ পাপের দায় আলেম সমাজ কোন ভাবেই এড়াতে পারেন না।
অনেক রক্ত ঝরিয়ে, খড় কুটো পুড়িয়ে অবশেষে ১৯৯১ সালে এল চির প্রতিক্ষিত অনেক সাধের সংসদীয় গণতন্ত্র। আর পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের মুল বার্তাটাই হচ্ছে, ধর্ম-কর্মের দরকার নাই, ভোগ-বিলাস, সুখ সম্ভোগে ষোল কলায় জীবনটা উপভোগ করাই মানব জন্মের চরম ও পরম লক্ষ। জন্ম একটাই জীবন একটাই, কাজেই ভোগের দরিয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দাও। আর ভোগের জন্য অর্থের প্রয়োজন। কাজেই ধর্মের নীতিকথা বাদ দিয়ে বৈধ অবৈধ যে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জন কর, জীবন উপভোগ কর। পাশ্চাত্যের এ ভোগবাদি দর্শনে আজ পৃথিবী বিষিয়ে উঠেছে। এক শতাংশ মানুষ নিরানব্বই শতাংশের রক্ত চোষে নিচ্ছে। একই ধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশের লোটেরারা দুই দলে যোগ দিয়ে পালাক্রমে শাসনে শোষণে দুর্নীতিতে দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছে। এদেশ এখন বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং আমরা মিসকিন, দাস ও শ্রমিক জাতি হিসেবে বিশ্বময় পরিচিত। কাজেই এসবের দায় আলেম সমাজ কোন ভাবেই এড়াতে পারবেন না।
বিশেষত ১৯৯১ থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে, জনগণকে সার্বভৌমত্বের মালিক বানানোর বুলি আউড়িয়ে যেসব মানবতাহীন কর্মকান্ড ঘটানো হচ্ছে-এসবের দায় কে বহন করবে ? যেমন-
১। অন্তহীন লোটপাটঃ লোটেরা দুর্বৃত্তের দল দুই দলে বিভক্ত হয়ে দেশের সম্পদ লোটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে, দরিদ্র দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। অথচ দেশের মানুষ মধ্যযুগে আফ্রিকার গোলামদের ন্যায় দাস হিসাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে, থাইল্যান্ডে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মায়ানমারের জঙ্গলে তাদের গন কবর পাওয়া যাচ্ছে, সমুদ্রে সলীল সমাধি হচ্ছে। গালফ অঞ্চলের মরু সাহারায় ক্ষুধা পিপাসায় বেওয়ারিশ কুকুরের মত মারা পড়ছে, বিভিন্ন সমুদ্রের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন জুটাতে এদেশের নারীরা পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশী বিদেশী বিভিন্ন পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। নরকের কিটদের খাদ্য হচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালায় ৬/৭ বছরের শিশু ইট পাথর ভেঙ্গে পেটের অন্ন যোগাচ্ছে। বৃদ্ধ অসহায় নারী, পুরুষ, শিশু ডাস্টবিনে কুকুরের সাথে কাড়াকাড়ি করে বর্জ্য খেয়ে উদরপূর্তি করছে। অথচ দেশের সম্পদ বাইরে পাচার না করলে, সম্পদের সুষম বন্টন হলে, অন্তত যাকাতের সুষম বন্টন হলেও এ পরিস্থিতির উদ্ভব হত না।
অথচ আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ) প্রদত্ত জিহাদ এবং আমরে বিল মারুফের দায়িত্ব হিসাবে আলেম সমাজের কর্তব্য হচ্ছে যেখানেই শোষণ, অন্যায়, অবিচার, জুলুম পাওয়া যাবে সেখানেই প্রতিবাদ করবে। কাজেই আলেম সমাজের উচিত ছিল সম্মিলিতভাবে রাজপথে দাড়িয়ে হুঙ্কার দেয়া, সকল মুস্তাদআফ রাষ্ট্রের পোষ্য। আর জনগণকে শোষণ করে অবৈধ সম্পদ উপার্জন হারাম। কাজেই লোটেরাদের সকল সম্পদ ফিরিয়ে এনে ইসলামী বিধান মতে মুস্তাদআফ (বয়োবৃদ্ধ, ইয়াতিম, বিধবা, প্রতিবন্ধি) গোস্টিকে সরকারি ভাতায় প্রতিপালন করতে হবে। আর সক্ষমদের দেশে বিদেশে সরকারিভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করব। এখন আপনাদের কাছে প্রশ্ন হলো, এ দায়িত্ব আলেম সমাজের উপর ফরয (কেফায়া) ছিল কিনা ? তারা এ দায়িত্ব পালন করছেন কিনা ? না করলে তজ্জন্য আল্লাহ্র দরবারে জবাবদিহি করতে হবে কিনা ? কোরআন সুন্নাহর বিধান মতে সকলেই উত্তর দিন। সবাই চেঁচাল, না না তারা কোন দায়িত্বই পালন করছে না।
রাজনীতির নামে মানুষ হত্যাঃ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে, রাজা ও সৈন্য মরেছে কিন্তু সাধারণ জনগণের কেউ ক্ষতি করেনি। কিন্তু আমরা এমন এক হতভাগ্য জাতি যে, আমাদের প্রিয় দুই দলের যে দল মসনদে থাকে তারা বিরোধীদলকে শায়েস্তা করার নামে দেশের নাগরিকদের পথে-ঘাটে, মাঠে-প্রান্তরে ক্রস ফায়ারে, গুলি করে হত্যা করে। আর জেল যুলুম নির্যাতনের তো কোন সীমা পরিসীমাই নাই। পক্ষান্তরে যারা বিরোধি দলে থাকে তারা রাজপথে বাস, ট্রাক, ট্রেনে, ক্ষুদ্র যানবাহনে মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারে । তাছাড়া সরকারকে জব্দ করতে তারা জনগণের জান-মাল, গাড়ি-ঘোড়া, ধন-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, গাছ-গাছালি, বাড়ি-ঘর সবকিছুই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভাংগচুর করে ধ্বংস করে দেয়, প্রলয়কান্ড ঘটায়। নিজেদের ক্ষমতার লড়াইয়ে সাধারন জনগণকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, তাদের ও রাষ্ট্রের সম্পদ এভাবে ধ্বংস করার নযির সম্ভবতঃ পৃথিবীর ইতিহাসে নাই, এমনকি বর্তমানের গণতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক কোন দেশেও এমন নযির নেই (যুদ্ধাবস্থা ব্যতীত)।
অথচ দেশে অসংখ্য ইসলামী দল আছে, আলেম আছে কিন্তু কেউ এ বীভৎস হত্যাকান্ড সম্পর্কে টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারন করেনি। বস্তুত আলেম সমাজের উচিত ছিল প্রতিটা রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক হত্যাকান্ডের কিসাস অথবা দিয়ত (ক্ষতিপুরন) দাবী করা, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দাবী করা। জনগণকে সাথে নিয়ে এসব হত্যাকান্ড, ধ্বংসলীলা, ক্ষতি ও যুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, যুদ্ধ ঘোষণা করা। তদুপরি পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের ধ্বংসকারীতা এবং ইসলামের কল্যাণময়তা জনগণের সামনে তুলে ধরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো। কিন্তু তারা কিছুই করেন নি বিধায় আলেম সমাজ কোনভাবেই এসবের দায় এড়াতে পারবেন না।
দেশের সম্পদ ধ্বংসঃ ১৯৯১ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে- যারাই বিরোধি দলে থাকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠে। মানুষ তো হত্যা করেই সেই সাথে দেশের সম্পদ, জনগণের সম্পদ ভেঙ্গে ছোড়ে, আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। প্রতিদিনের হরতালে ব্যবসায় সেক্টরে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, আবার শত কোটি টাকার সম্পদ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, ভেঙ্গে ছোড়ে ধ্বংস করা হয়। এভাবে মাসের পর মাস যখন হরতাল অবরোধ চলতে থাকে- তখন দেশের কি পরিমান ক্ষতি হয়? অথচ এই ক্ষতিটা না হলে এ সম্পদ দিয়েই দেশের মুস্তাদআফ শ্রেণীকে ভাতা দেয়া যেত, প্রতিপালন করা যেত, দেশ অনেক এগিয়ে যেত। কাজেই তখন আলেম সমাজের উচিত ছিল, জনগণকে সাথে নিয়ে না’রা বুলুন্দ করা “বন্ধ কর এসব দাজ্জালি কর্মকান্ড, সাধারন জনগণের জান মালের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। দেশ ধ্বংস না করে উন্নয়ন কর, ইসলামী বিধানানুসারে মুস্তাদআফ শ্রেণীকে প্রতিপালন কর। অন্যথায় আমাদের অনুকুলে ক্ষমতা হস্তান্তর কর। আমরা ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করব”। কিন্তু কোন আলেম বা ইসলামী দল কিছুই বলে না বিধায় ঐসব পাপের দায় তারা এড়াতে পারবেন না।
ছাত্র রাজনীতিঃ বিষাক্ত ছাত্র রাজনীতি দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছে। যারা ভবিষ্যতে জ্ঞান বিজ্ঞান, শিক্ষা, সভ্যতা ও উন্নয়নে দেশের নেতৃত্ব দেবে, রাষ্ট্র পরিচালনা করবে-তাদেরকে ক্ষমতালিপ্সু লোটেরারা নিজেদের ক্ষমতার সিড়ি হিসাবে ব্যবহার করছে। ফলে এসব কোমলমতি ছাত্ররা বই খাতা কলম ফেলে অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। সহোদর ভাইয়ের মত নিজেদের ক্লাসমেট, রুমমেট ভাইকে অবলীলায় হত্যা করছে। যে দেশের দরিদ্র জনগোস্টির ট্যাক্সের টাকায় তারা প্রতিপালিত হচ্ছে, শিক্ষা পাচ্ছে তাদের বুলেট বোমায় হত্যা করছে, আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, জনগণের ধন সম্পদ, ব্যবসা বাণিজ্য, বাড়ি-ঘর সব কিছু ভেঙ্গে ছোড়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যে ছাত্র সমাজ দেশের নির্মাতা হওয়ার কথা তারাই দেশ ধ্বংস করছে। সর্বোপরি দলীয় লেবেল এঁটে এসব ছাত্ররা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাগিবাজি, ডাকাতি, মাস্তানি, খুনখারাবিসহ হেন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করছে না।
এভাবে অভিশপ্ত ছাত্র রাজনীতি দেশ ও জাতি ধ্বংসের রাজপথ তৈরি করছে, জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছে। অথচ আলেম সমাজের উচিত ছিল, যে লোটেরারা জাতির আগামী কান্ডারি ছাত্র সমাজকে ব্যবহার করছে- তাদের বিরুদ্ধে হুসিয়ারি উচ্চারণ করা “নিজেদের সন্তানদের জঠরিয় নিরাপত্তায় দেশে বিদেশে উচ্চ শিক্ষিত বানাচ্ছ আর এ দেশের দরিদ্র কৃষকের সন্তানদের তোমাদের হীন স্বার্থে ঢেলা হিসাবে ব্যবহার করছ, দেশের ও তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়ার কারণে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। প্রত্যেকটা হত্যা ও ক্ষতির জন্য কিসাস বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।” তাহলে এ অভিশপ্ত ছাত্র রাজনীতি এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু আলেমগণ সেই দায়িত্ব পালন করেন নি বিধায় এর দায় তারা এড়াতে পারবেন না।
নারী সমস্যাঃ আজ পাশ্চাত্য নেংটা সভ্যতার কুপ্রভাবে, সহশিক্ষা ও সহকর্মের কুপরিনতিতে নারী সমাজ অস্তিত্ব সংকটের মোকাবেলা করছে। এখন পথে ঘাটে মাঠে প্রান্তরে বিদ্যালয়ে কর্মালয়ে নারী ভয়ঙ্কর হিংস্রতার শিকার হচ্ছে। ইভটিজিং ধর্ষণ ও বহুমুখী অত্যাচারে নারী আজ নীলকণ্ঠ। তার নিজ দেহ নিজের কাছেই বোঝা ও অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে। তারা আপন আলয়েও নিরাপদ না। এক্ষেত্রে আলেম সমাজের উচিত ছিল প্রতিবাদ করা এবং ঘোষণা দেয়া, নিরাপত্তার স্বার্থে নারীর শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র আলাদা কর, শালিন পোশাক ও পর্দা বাধ্যতামূলক কর। যারা ইসলামী এ আইনের প্রতিবাদ করবে বা মানতে অস্বীকার করবে- কোন নারী নির্যাতিতা হলে, ধর্ষিতা হলে- তাদেরকে এর জবাবদিহি করতে হবে, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাহলে এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হত।
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়তনঃ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠন বিভিন্ন নামে তৃনমুল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসব দলিয় নেতা কর্মীরা যখন বিরোধি দলে থাকে তখন তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ খুন, দেশ ও জনগণের সম্পদ ধ্বংসসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যা করে না। আবার তারা নিজেরাও খুন, গুম, ক্রস ফায়ার, জেল যুলুম ও ধন সম্পদের ক্ষয় ক্ষতির শিকার হয়। তারপর যখন ক্ষমতায় যায় তখন সুদে আসলে চক্রবৃদ্ধিহারে সেই সব ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। তখন তারা দেশটাকে বিস্তির্ণ শিকার ক্ষেত্র মনে করে, দেশ হয়ে উঠে তাদের কাছে মগের মুল্লুক। তৃনমুলের একজন কর্মী সমর্থক পর্যন্ত লোটপাটে মেতে উঠে। তারা বিভিন্ন উপায়ে জনগণের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে, সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখল করে। ইসলামী কোন দল বা কোন আলেম কখনো সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখল করে না, অবৈধ উপার্জন করে না।
দলীয় ছত্র ছায়ায় নেতা কর্মীরা এসব অপকর্ম করে বেড়ায় অথচ তাদের জন্য সাত খুন মাফ। তাদের কোন বিচার নাই। এছাড়া সর্বক্ষেত্রে নোংরা দলীয়করণ দেশটাকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এভাবে দেশের জনগণ ত্রিমুখি শোষণ নির্যাতনের যাতাকলে পিস্ট হচ্ছে। অর্থাৎ দলীয় নেতা-কর্মীরা শোষণ করে, পুলিশ প্রশাসন শোষণ করে, তা ছাড়া সরকারি বিভিন্ন ট্যাক্স খাজনা, খারাজ ইত্যাদি তো আছেই। এই ভাবে পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতন্ত্র দেশ জাতি ধ্বংস করে দিচ্ছে- অথচ আলেম সমাজ নীরব। পশ্চিমা তন্ত্র মন্ত্রে যখন মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, মুক্তির জন্য ত্রাহি ত্রাহি করছে- তখন আলেম সমাজ চির সুন্দর ইনসাফপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে বলছে না, ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে না। সকল ইসলামী দল মিলে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণ করছে না বিধায় এসবের দায় তারা কোন ভাবেই এড়াতে পারবেন না। তজ্জন্য আল্লাহ্র দরবারে জবাবদেহি করতে হবে।
তাছাড়া বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব পশ্চিমা দাজ্জালতন্ত্রের খপ্পরে পরে আগ্নেয়গিরির মত জ্বলছে-তা নিরসনে আলেম সমাজ সম্মিলিত কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। এখন প্রশ্ন হল, যে সব বিষয় বর্ণিত হল এবং অন্যান্য আরো যেসব অন্যায় রয়েছে- সেসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা আলেমদের উপর কর্তব্য ছিল কিনা? জিহাদ এবং আমরে বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকারের আওতায় আলেমগণ সে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা?না করলে আল্লাহ্ ও জনগণের কাছে জবাবদিহিতার দায়ে তারা দায়ী বা আবদ্ধ কিনা ? জবাব দিন। সকলেই বলল, আলেমরা ইসলামের কোন দায়িত্বই পালন করছে না, তারা বরং ইসলাম ধ্বংসের কাজ করে যাচ্ছে। কাজেই তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
ফতোয়াবাজিঃ
বস্তুত আলেমগণ তাদের উপর ফরয দায়িত্ব পালন করেন নি বরং তাদের উপর যা হারাম ছিল সেই হারাম কাজের দায়িত্ব তারা সুচারুরূপে পালন করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। আর তা হলো দু’টি বিষয় ফিরকাবাজি ও ফতোয়া বাজি। ফিরকাবাজি হারাম জেনেও আলেমগণ উম্মাহকে হাজার হাজার ফিরকায় বিভক্ত করে ফেলেছেন। উল্লেখ্য যে অশিক্ষিত লোকেরা কখনো ফিরকার জন্ম দিতে পারে না, এসবের জন্মদাতা আলেমগণ। এ সম্পর্কে পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বিধায় এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। এক্ষণে আমরা ফতোয়াবাজি সম্পর্কে আলোচনা করব।
কোন আলেমের ফতোয়া তৈরী করার আধিকার নাই। ফতোয়া তো দিয়েছেন আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ)। আর এসব ফতোয়া হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ এ দুটি আধিকার সংক্রান্ত। এখন আলেম সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে এসব ফতোয়া ইফরাত তাফরীত ব্যতীত মানুষের কাছে পৌছে দেয়া। আল্লাহ্র হক হচ্ছে তাকে একক স্রষ্টা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া, কোন কিছু শরীক না করা এবং মুহাম্মদ (সাঃ) কে আল্লাহ্র সর্ব শেষ রাসূল হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া। এই ফতোয়া হিন্দু বৌদ্ধ ইহুদী খৃষ্টান ইত্যাদি প্রত্যেক জাতীর ধর্ম গ্রন্থে আছে। অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মদ (সঃ)-এর গুনাবলি সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে। আলেম সমাজের উচিত ছিল এসব বর্ণনা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে অমুসলিমদের হাতে হাতে পৌছে দেয়া এবং মসজিদ মাদরাসা ওয়াজ মাহফিল সর্ব ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোচনা করা। কিন্তু আলেমরা এ ফতোয়ার দায়িত্ব মোটেও পালন করছেন না, কিঞ্চিত পরিমানে ইসলামপন্থি আধুনিক শিক্ষিতরা এ দায়িত্ব পালন করছেন। যেমন শায়খ আহমদ দীদাত, যাকির নায়েক প্রমুখগণ।
আবার হক্বুল ইবাদ সংক্রান্ত ফতোয়া হচ্ছে সকল জনগণ রাষ্ট্রের পোষ্য। সরকার সক্ষমদের কর্মসংস্থান করে দিবে আর অক্ষমদের ভাতা দিয়ে প্রতিপালন করবে। কেউ দুর্নীতি করবে না, অবৈধ সম্পদ উপার্জন করবে না, করলে তা ফিরিয়ে এনে জনগণের মাঝে বণ্টন করতে হবে। হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে দিয়ত-ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নিরাপওার স্বার্থে নারীর শিক্ষা ও কর্ম ক্ষেত্র আলাদা করতে হবে। ইয়াতিম বিধবা বয়োবৃদ্ধ প্রতিবন্ধিরা রাষ্ট্রের পোষ। এছাড়া ছাত্র রাজনীতি, দলীয়করন, দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ইত্যাদি সকল আপরাধ নির্মূল করে অর্থনৈতিক সাম্য ও ইনসাফ ভিত্তিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলি হচ্ছে ইসলামের ফতোয়া। কিন্তু আলেম সমাজ কোথাও কখনো এসব ফতোয়ার দায়িত্ব পালন করেন না বরং উল্টো বিষাক্ত ও বিভ্রান্ত দু’টি বিষয়ে ফতোয়াবাজি করে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর নাকের ডগায় দম নিয়ে এসেছেন ।
তারা তালাক ও নাস্তিক মুরতাদ সংক্রান্ত ফতোয়াবাজী করাকেই একমাত্র ইসলামী দায়িত্ব বলে ঠাউরে নিয়েছেন। ফলে তালাক সংক্রান্ত ফতোয়াবাজীর গণ্ডগোলে ১৯৯৬ টার্মের আওয়ামী সরকারের আমলে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়, বহু লোক আহত হয়। হাইকোর্ট ফতোয়া নিষিদ্ধ করে। তখন এ নিয়ে বিশাল দাঙ্গা হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়েছিল। আবার আলেমদের অপকর্ম এবং তালেবান, আলকায়েদা, আইসিস ইত্যাদিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে ইসলাম ভীষণভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। তার উপর পশ্চিমাদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অমুসলিমরা তো বটেই এমনকি মুসলিম পরিবারের সন্তানরা ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলছে, বিধর্মিদের সাথে সুর মিলাচ্ছে। আর আলেম সমাজ এসব ষড়যন্ত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলা না করে বরং ঘৃতাহুতি দিচ্ছে।
যেমন তসলীমা যখন বলল, মেয়েরা ছেলেদের ধর্ষণ করে পাছায় লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দিবে। তখন আলেমদের উচিত ছিল, রাজপথে দাঙ্গা হাঙ্গামা না করে তসলিমাকে জিজ্ঞেস করা-কীরে তসলীমা তুই এমন কুকথা বললি কেন ? তখন সে বলত “আমি দেখলাম একটি ছেলে একটি মেয়েকে (বেশ্যা) ভোগ করে টাকা না দিয়ে পাছায় লাথি মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে তখন আমিও রাগে ঐ কথা বলেছি”। তখন আলেমদের উচিত ছিল ‘রাখ এর বিহিত করতেছি’ বলে রাজ পথে দাড়িয়ে সিংহগর্জনে না’রা বুলুন্দ করা, রাষ্ট্র যন্ত্রের কর্তারা শুনো, তোমরা দেশের সম্পদ লোটপাট করে দেশে বিদেশে মোঘল হেরেম নির্মাণ করছ, আর দেশের মেয়েরা এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন জুটাতে পানির দরে হাটে বাজারে নিজের ইজ্বত ফেরি করছে। এক্ষণে এই মহুর্তে ইসলামী বিধান অনুসারে সকল ছিন্নমুল নারীর পুর্নবাসন কর, ভাতা প্রদান কর। অন্যথায় আমরা জেহাদের ডাক দেব, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দাড় করে দেব আগুনের প্রাচীর।
এমনি ভাবে প্রত্যেকটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কোরানের মানবিক বিধান প্রতিষ্ঠার দাবী তুললে তসলীমাসহ অন্যান্যরা বুঝত যে, সত্যিই ইসলাম একটা ইনসাফপুর্ন মানব কল্যাণকর ন্যায়সঙ্গত ধর্ম। আর তখন মুরতাদদের দাওয়াত দিলে, “এখন তোমারা তওবা কর”। তখন ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ ছেড়ে অবশ্যই তারা তওবা করত। কিন্তু প্রকৃত দায়িত্ব পালন না করে আলেমগণ রাসূলের উম্মতকে তার ঘর (ইসলাম) থেকে বের করে দিলেন।
আবার লতীফ সিদ্দিকী জামাত, তাবলীগ, হজ্ব ও রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে কুমন্তব্য করার কারণে আলেমরা তাকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছে। অথচ আলেমদের অপকর্ম তথা ইসলাম বিকৃতির কারণেই এ ব্যক্তিটি এমন মন্তবা করেছে। কারণ পূর্বে আলোচনা গত হয়েছে যে, ইসলাম বিকৃত করেই প্রত্যেকটি ফিরকার জন্ম হয়েছে। কাজেই জামাত ও তাবলীগ দু’টি ফিরকা। তদুপরি জামাত ইসলামের নামে ছেলেদের টেনে নিয়ে অন্যদের দ্বারা হত্যা করাচ্ছে এবং নিজেরাও হত্যার শিকার হচ্ছে অন্যদেরও হত্যা করছে। আর আলেমগণ যদি তাবলীগকে কোরানের সাথে বাজিয়ে দেখেন, তাহলে নিশ্চত বুঝতে পারবেন তারা ইসলামের গণ্ডির মধ্যেই নেই, খারেজীদের ন্যায় ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে। কারণ তারা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জিহাদ সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে ও অস্বীকার করে চলেছে।
আবার হজ্বের মূল উদ্দেশ্য হলো সারা বিশ্বের মুসলমান সম্মিলিতভাবে লাব্বাইকা বলে আল্লাহ্র ঘরে, আল্লাহ্র সামনে হাজীরা দিবে এবং পরস্পরের দুঃখ কষ্ট ও সমস্যাগুলি শুনবে, জানবে, বুঝবে ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করবে। তখন মুসলিম বিশ্বের প্রধান নেতা/মহাসচিব/ খলীফার সামনে মজলুম মুসলমানরা নিজ নিজ অভিযোগ পেশ করবে। যেমন জামাত হেফাজত আওয়ামী লীগের অভিযোগ করবে, ফিলিস্তিন আরাকান কাশ্মীর ইত্যাদি মজলুম মুসলমানরা তাদের অভিযোগ পেশ করবে আর খলীফা সেসব প্রতিকারের ব্যবস্থা করবেন। যেমন রাসূল (সঃ) জীবিত থাকলে যা করতেন- খলীফারও তাই কর্তব্য অর্থাৎ মুসলিম বিশ্বের সকল সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু হজ্বকে বিকৃত করে আমরা একটা প্রমোদ ভ্রমনে রুপান্তরিত করেছি। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে খলীফা নাই বিধায় এ দায়িত্ব সৌদি বাদশা বা মক্বা- মদিনার ঈমামদের উপর বর্তায়।
আবার রাসূল (সঃ) মুস্তাদআফ গোষ্ঠীর যে অধিকার দিয়ে গেছেন, যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে আমরা শুধু অপকর্ম করছি। যেমন জামাত নিজেদের ও অন্যদের হত্যা করছে। তাবলীগ ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার খবর নাই, শুধু পুটলা পাটলি নিয়ে মসজিদে মসজিদে ঘুরছে আর বসে বসে খাচ্ছে। আর দেওবন্দিরা ভিক্ষা করছে, সদকা লিল্লাহ ফেতরা খেয়ে জীবন ধারণ করছে। এই সব দেখে লতীফের মত ব্যাক্তিরা ভাবছে এটাই বুঝি রাসূল (সঃ) এর ধর্ম। আর এ জন্যই এসব নির্বোধরা রাসূল (সাঃ) ও ইসলাম সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার সাহস দেখাচ্ছে। অথচ তাদের উচিত ছিল মুসলমান হিসাবে প্রকৃত ইসলামকে জানা ও মানা।
যাই হউক বুঝা যাচ্ছে, আলেমদের অপকর্মের কারনে, ইসলাম বিকৃতির কারণে আজ ইসলামের সন্তানরা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, ইসলামের শক্র হয়ে যাচ্ছে। আলেমরা এসব ধর্মদ্রোহীদের দাওয়াত না দিয়ে ইসলামের কথা না বুঝিয়ে ফতোয়া বাজীতে লিপ্ত হলেন। তাদেরকে নাস্তিক মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে রাজপথ অগ্নিবৎ উত্তপ্ত করে তুললেন। ফলে তসলীমাকে নির্বাসনে পাঠানো হল, লতীফকে জেলে ঢুকানো হল, ব্লগারদের কাউকে হত্যা করা হল, কেউ দেশ ত্যাগ করল। এভাবে পশ্চিমের দাজ্জাল মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার ন্যায় মালালাসহ এসব ধর্মদ্রোহিদের হাতে পেয়ে ইসলামের সন্তানকে ইসলাম ধ্বংসের আড়কাঠি হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে গেল। আর এ সুযোগ করে দিলেন আলেমরা। কারণ ইসলামী বিধান মতে কোন মুরতাদকে পর পর তিনবার ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে, ইসলামের সৌন্দর্য গুলি উওমরুপে বুঝাতে হবে। এর পড়েও ফিরে না আসলে তার বিচার কার্যকর করা হবে।
অথচ এসব লোকেরা তিনবার নয় একবার বুঝালেই ইসলামে ফিরে আসত। কারণ এরা তো ইসলাম পন্থিদের অপকর্ম দেখে এটাকেই ইসলাম মনে করে ধর্মদ্রোহী হয়ে গেছে কিন্তু অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করেনি। আর আত্নার খোরাকদাতা ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম নাই । কাজেই এদের সামনে প্রকৃত ইসলাম তুলে ধরলে অবশ্যই তারা ফিরে আসত। আবার যেখানে ইসলাম নাই সেখানে স্বৈরাচারিতা ও অরাজকতার শস্যক্ষেত্র হয়। যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে মুরতাদের ব্যাপারে ইসলামী বিধান কার্যকর থাকত তাহলে তো এসব মুরতাদরা বন্দী হবার পর ইসলামের দাওয়াত পেত, সংশোধনের সুযোগ পেত। অথবা বর্তমান অবস্থায়ও যদি তসলীমা ও লতিফরা আলেমদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিত এ মর্মে যে, ইসলামী বিধান মতে আমাদের বিচার হউক, তিনবার দাওয়াত দেয়া হউক। তাহলে তারা অন্তত কৃত্তিম তওবা করে হলেও বাচার সুযোগ পেত।
কাজেই বুঝা যাচ্ছে আলেমগণ প্রকৃত দায়িত্ব পালন না করে তাদেরকে ইসলাম ও দেশ থেকে বের করে দিয়ে ইসলামের শত্রুদের হাতে কুঠার তুলে দিচ্ছে। আর এভাবে তারা নিজেরাই আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ) এর ক্রোধের পাত্র হলেন। কারণ ইরশাদ হচ্ছে--
- لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ أَلَّا يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ- তারা বিশ্বাস করে না বলে আপনি হয়তো মর্মব্যথায় আত্নঘাতী হবেন। (২৬: ৩) (فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلَىٰ آثَارِهِمْ إِن لَّمْ يُؤْمِنُوا بِهَٰذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا যদি তারা এই বিষয়বস্তুর (কোরআন) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে তাদের পশ্চাতে সম্ভবতঃ আপনি পরিতাপ করতে করতে নিজের প্রাণ নিপাত করবেন। (১৮: ৬)
অত্র আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, কাফেররা ইসলাম না মানার কারণে রাসূল (সঃ) শোকে, দুঃখে অনুশোচনায় মরনাপন্ন অবস্থায় পৌঁছে গেচেন। সে ক্ষেত্রে ভুল ক্রটির কারণে কোন মুসলমানকে না বুঝিয়ে, সংশোধনের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি ধর্ম ও রাষ্ট্র থেকে বের করে দেয়া রাসূল (সাঃ) এর বিরুদ্ধাচরনের নামান্তর। ধর্মদ্রোহিদের রাসূল (সাঃ) এর নির্দশ মোতাবেক তিনবার দাওয়াত না দিয়ে রাসূলের (সাঃ) হুকুম অমান্য করে তার উম্মতকে তারই ঘর (ইসলাম) থেকে বের করে দেয়া অবশ্যই রাসূলের (সাঃ) ক্রোধের উদ্রেক করবে। এ জন্যই রাসূল (সাঃ) বলেছেন, -- منهم خرجت الفتنة،و إليهم تعود- অর্থাৎ আলেমদের সৃষ্ট ফেতনার পরিণতি তাদের দিকেই ফিরে আসবে।
এখন বাস্তবতায় দেখা যায়, আলেমরা যাদেরকে নাস্তিক- মুরতাদ বলে গালাগালি করে তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে হেফাজত ও জামাতের আলেমদেরকে পথে ঘাঁটে মাঠে প্রান্তরে আদালতে নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জঙ্গী, সন্ত্রাসী বলে সমাজ ও রাষ্ট্রে কোণঠাসা করে রাখছে। বিশ্বময় তাদেরকে জঙ্গি-সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। এভাবেই আলেমদের সৃষ্ট ফেতনার পরিণতি তাদের দিকেই ফিরে এসেছে, সত্য কিনা সবাই জবাব দিন? সকলেই সমস্বরে চিৎকার করল, হাঁ হাঁ সত্য, আলেমদের অপকর্মের পরিনতি এখন তারাই ভোগ করছে।
ইতিহাসের শিক্ষা/ পুনরাবৃত্তিঃ
ইতিহাসের বড় শিক্ষা হল ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। যদি করত, তাহলে পৃথিবীতে প্রথম খুনের পর দ্বিতীয় খুন হত না, প্রথম যুদ্ধের পর দ্বিতীয় যুদ্ধ হত না। তদ্রুপ আলেমদের ফিরকাবাজি ও এখতেলাফের কারণে অতীতে মুসলিম জাতির যে সর্বনাশ হয়েছে- তা থেকে শিক্ষা নিলে মুসলমানদের পরবর্তী বিপর্যয় হত না, বর্তমানে এ ধ্বংস গহ্বরে পতিত হতে হত না। এখানে আমরা বাগদাদের উদাহারণ টেনে আনছি। কারণ ফিরকাবাজির কারণে বাগদাদে আটবার দাঙ্গা হয়েছিল, তবে অষ্টমবারের পর আর কোন দাঙ্গা হয়নি। কারণ তখন আর দাঙ্গা করার মত সেখানে কেউ জীবিত ছিল না। যেমন-
প্রথম ঘটনাঃ প্রথম ঘটনা ঘটে হিজরী ৩১৭ সালে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত, মাকামে মাহমুদ শব্দের অর্থ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে ঝগড়ার সূত্রপাত হয়। শেষ পর্যন্ত এই ঝগড়া ব্যাপক আকার ধারণ করে। মারামারি কাটাকাটি করে হাজার হাজার লোক মারা যায়। ঐতিহাসিক আবুল ফিদা লিখেছেন, এই সংঘর্ষে কয়েক হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল, তাদের মধ্যে আলিম ও বিদ্বান লোকের সংখ্যা অনেক ছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাঃ-হিজরি ৩২৩ সাল, তখন খলীফা ছিলেন রাজী বিল্লাল। বাগদাদের বড় মসজিদে বিসমিল্লাহ পড়া নিয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। একদল ঘোষণা দিল যারা নামাজে উচ্চস্বরে বিসমিল্লাহ পড়বে না, তাদের কেউ ইমাম হতে পারবে না। অন্য দল ঘোষণা দিল যারা বিসমিল্লাহ নিম্নস্বরে পড়বে না তারাও ইমামতি করতে পারবে না। আলেমরাও স্ব স্ব ফতোয়ার উপর অটল থাকল। ফলে ভয়ানক দাঙ্গার সৃষ্টি হল, মসজিদ রক্তাক্ত হয়ে গেল। খলীফা ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। দাঙ্গার সংবাদ শুনে তিনি ফরমান জারি করলেন, নামাজে সবাইকে উচ্চস্বরে বিসমিল্লাহ পাঠ করতে হবে, যারা আদেশ অমান্য করবে তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে এবং তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু নিম্ন স্বর ওয়ালারা খলীফার আদেশ মেনে নিতে পারল না। বিবাদ অব্যাহত থাকল। ঐতিহাসিক আবুল ফিদা বলেন, দীর্ঘ সাত বছর পর্যন্ত এ ঝগড়া স্থায়ী হয়। অবশেষে খলীফা রাগান্বিত হয়ে তাদেরকে ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। ফলে তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হল এবং অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা করা হল।
তৃতীয় ঘটনাঃ বাগদাদের তৃতীয় ঘটনা ঘটে ৩৯৮ হিজরীতে। শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে শরীয়তের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতভেদ হতে থাকে। শেষে শিয়ারা সুন্নীদেরকে আর সুন্নীরা শিয়াদেরকে কাফির বলে ফতোয়া জারি করতে লাগলো। অবশেষে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলো। ঐতিহাসিক যুহরী বলেন, এই সংঘর্ষে বিপুল সংখ্যক মুসলমান প্রাণ হারিয়েছিল।
চতুর্থ ঘটনাঃ বাগদাদের চতুর্থ ঘটনা ঘটে ৪৪৮ হিজরীতে। এই ঘটনার জন্য সুবিখ্যাত আলিম ইমাম কুশায়রীকে দায়ী করা চলে। তিনি একজন আশায়েরা মতবাদের লোক ছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনু খাল্লিকান বলেছেন, ইমাম কুশায়রী বাগদাদে এসে আকিদা সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে হাম্বলী মাযহাবের লোকদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ শুরু করে দিলেন। পরে এই ঝগড়া দাঙ্গায় রূপ নিলো। এই দাঙ্গায় কয়েক হাজার মুসলমান প্রাণ হারিয়েছিল।
পঞ্চম ঘটনাঃ বাগদাদের পঞ্চম ঘটনা ঘটে ৪৮৩ হিজরীতে। এ ঝগড়া বাধে শিয়া আর সুন্নী মুসলমানদের মধ্যে। শিয়ারা সুন্নীদেরকে আর সুন্নীরা শিয়াদেরকে কাফির, ফাসিক, মুনাফিক ও বিভ্রান্ত বলে গালিগালাজ করতে থাকে। এর ফলে উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই বেধে যায়। হয় মরবো- না হয় মারবো, এই পণ করে দু’দলই সমর ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক যুহরী বলেছেন, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষে বহু সংখ্যক মুসলমান মারা পড়ে। শাসন কর্তৃপক্ষ বহু চেষ্টা করেও অবস্থা আয়ত্বে আনতে পারেননি।
ষষ্ঠ ঘটনাঃ বাগদাদের ষষ্ঠ ঘটনা ঘটে ৫৮২ হিজরীতে। মহররমের সময় তাজিয়া নিয়ে মাতম করতে করতে শিয়ারা জোরে জোরে হজরত আবু বকর, হজরত উমর ও হজরত উসমানের মত জবরদস্ত সাহাবায়ে কেরামকে গালাগালি দিতে থাকে। সুন্নী মুসলমানরা এই বেয়াদবি সহ্য করতে না পেরে শিয়াদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ বেধে যায়। ঐতিহাসিক ইয়াফেযী বলেছেন, এই ভয়াবহ যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মুসলমানের প্রাণহানি ঘটে।
সপ্তম ঘটনাঃ বাগদাদের সপ্তম ঘটনা ঘটে ৫৮৭ হিজরীতে। আকিদা সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে দু’মাযহাবের মুসলমানদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতে থাকে। পরে ইহা দাঙ্গায় রূপ নেয়। ঐতিহাসিক ইয়াফেযী বলেন, এ যুদ্ধে মুসলমানদের জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল।
অষ্টম ঘটনাঃ ১২০০ শতাব্দির ঘটনা। বর্তমান উজবেকিস্তানের শাসক খাওয়ারেজম শাহ ছিলেন আলাভী সমর্থক। তিনি বাগদাদের খলীফার নামে খুৎবা দিতেন না। এমনকি বাগদাদ আক্রমণ করে খলীফাকে উৎখাত করার সংকল্প করে ছিলেন। ফলে খলীফা এক লোকের মাথা মুন্ডিয়ে তৎকালীন লিপি শিল্প অনুযায়ী তার মাথায় সুচ দিয়ে লিখলেন-“আপনি খাওয়ারেজম আক্রমণ করুন, আমাদের সমর্থন ও নেক দোয়া আপনার সাথে থাকবে”। তারপর লোকটিকে তাতারি সম্রাট চেঙ্গিস খানের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হল। চেঙ্গিস খান তার মাথা মুন্ডিয়ে বার্তাটি পাঠ করে মুসলিম বিশ্ব আক্রমণের সাহস অর্জন করল। কারণ সে বহু দিন ধরে মুসলিম বিশ্বে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে লালায়িত ছিল। কিন্তু বাগদাদের খেলাফতকে যমদূতের মত ভয় করত। সে জানত কোন মুসলিম দেশে হাত দিলে খলীফা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। আর তখন পৃথিবী থেকে চেঙ্গিস খান ও মঙ্গোলিয়ার অস্তিত্ব মুছে যাবে। কাজেই খলীফার বার্তা পেয়ে সে এটাকে সূর্য দেবতার আশির্বাদ হিসাবে গ্রহণ করল।
পক্ষান্তরে খাওয়ারেজম শাহ্র হটকারিতা, নির্বুদ্ধিতা আর কাপুরুষতার কারণে যুদ্ধ বেধে গেল। মুসলিম বিশ্বের উপর নেমে এল রোজ কিয়ামতের বিভীষিকা। চেঙ্গিস খান মধ্য এশিয়াকে শ্বশানে পরিণত করল। তারা যুদ্ধের চিরাচরিত কোন নিয়ম মেনে চলত না। প্রত্যেক যুদ্ধ জয়ের পর তাতারিরা নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সকল নাগরিকের মুন্ডু কেটে এনে মিনার নির্মাণ করত। সবচেয়ে বড় মিনারের জন্য চেঙ্গিস খান সবচেয়ে বড় পুরুস্কার বরাদ্দ দিত। গর্ভবতী নারীদের পেট ফেড়ে শিশু বের করে হত্যা করা হত। সাধারণ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারত। গোবির এ নর পিশাচের ধ্বংসলীলা এতটাই বীভৎস ছিল যে, ব্যাবিলন, নিনোয়া, পম্পিয়ায় প্রকৃতির ধ্বংসলীলাও এর সামনে ম্লান হয়ে যায়।
মুসলিম বিশ্ব যখন হিংস্র হায়েনাদের শিকারে পরিণত হয়েছে- তখন বাগদাদের খলীফা মসনদে বসে গোঁফের নীচে মিটিমিটি হাসে এবং মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ্ পাঠ করে। তারপর মদ আর নর্তকির আসর গরম করে তুলে। আর উলামায়ে দ্বীন- যাদের উপর রাসূল (সাঃ) ইসলাম ও উম্মাহ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তারা বাগদাদের মোড়ে মোড়ে বিতর্কানুষ্ঠান করত। শরয়ী মাসলা-মাসায়েল নিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলত। পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করে দাঙ্গা বাধিয়ে রাখত। এমনকি মহিলার দুধ বাজারে বিক্রি করা, স্ত্রীর দুধ খেয়ে ফেলা ইত্যাদি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ের বিতর্ক সৃষ্টি করে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, ফ্যাসাদ বাধিয়ে রাখত। কিন্তু চেঙ্গিস খান মুসলিম বিশ্বের উপর যে প্রলয় ঘটাচ্ছে সেদিকে তারা ফিরেও তাকাত না। তখন আলেমরা যদি খলীফাকে বাধ্য করত তাতারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার জন্য তাহলে পৃথিবীর কোন সিংহের গুহা অথবা মুশিকের গর্ত গুটি কতেক নর পিশাচের গর্দান রক্ষা করতে পারত না। অথবা আলেমরা নিজেরাই জিহাদ ঘোষণা করলে, আর সম্মিলিত মুসলিম শক্তি মঙ্গোলিয়ার দিকে ধাওয়া করলে পৃথিবীতে তাতারী নামের কোন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকত না। কিন্তু বাগদাদের আলেমরা কর্তব্য কাজ না করে নিজেদের মধ্যে ফিরকাবাজি ও দলাদলি সৃষ্টি করে জাতি ধ্বংসের ফাঁদ তৈরিতে মশগুল থাকল।
মাত্র ত্রিশ বছরের ব্যবধান। ১২৫২ সাল, বাগদাদের খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহ, তার উজিরে আ’জম ইবনুল আলকেমি শিয়া। আবার খোরাসানের শাসক চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খানের প্রধান উপদেষ্টা নাসির উদ্দিন তুসি ইসমাইলি শিয়াদের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর তখন ফেরকাবাজির ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে শত্রুতা এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যে, তারা শত্রুর সাহায্যে একে অন্যকে ধ্বংসের তৎপরতায় লিপ্ত থাকত। শিয়া ইবনুল আলকেমি সুন্নী খেলাফত ধ্বংসের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। সে খলীফাকে বুঝাল, দশ লক্ষ সৈন্য পোষার মত বেকার খরচের কোন প্রয়োজন নেই। সেনা বাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হল।
আভ্যন্তরিন কাজ শেষ করে সে নাসিরুদ্দিন তুসির মাধ্যমে হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণের দাওয়াত দিল। স্বজাতি ধ্বংসের এই দুই কালপ্রিট ইবনুল আলকেমি ও তুসি উভয়েই বড় মাপের আলেম ছিলেন। তখনো বাগদাদের চকে চকে ফিরকাবাজ আলেমদের আসর বসত। কথিত আছে এক আসরে তখন মিসওয়াক নিয়ে বিতর্ক চলছিল। বিতর্কে সাব্যস্ত হলো মিসওয়াক আগে ডান পাশ থেকে শুরু করতে হবে। তারপর দাঁতের উপড়ের পাটিতে নাকি নিচের পাটিতে লাগাতে হবে – তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হল কিন্তু সিদ্ধান্ত হলো না। কারণ মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে, হালাকু খান বাগদাদ পৌঁছে গেছে।
বাগদাদ পরিণত হল পুরা কাহিনীতে। চল্লিশ লক্ষ মানুষের গোরস্থানে পরিণত হলো প্রাচি-প্রাতিচী সভ্যতার প্রসূতি বাগদাদ। যে খলীফা ও আমীর উমরারা মুসলিম বিশ্বকে তাতারী দানবদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নতর্কি আর মদের আসরে মগ্ন ছিল, খেলাফতের আসন দখল করে খোদার দ্বীনকে নিয়ে তামাসা করেছিল হালাকু খান তাদেরকে সহজভাবে হত্যা করলেন না। পাগলা হাতির পায়ের তলায়, ঘোড়ার পায়ে পিষে, বস্তায় পেছিয়ে শ্বাস রুদ্ধ করে, পিটিয়ে, কুপিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হয়। তাদের সুন্দরী স্ত্রী-কন্যাদের দাসীবাঁদী হিসাবে রেখে বাকিদের হত্যা করা হয়। আর যে উলামায়ে দ্বীন ইসলামকে যশ খ্যাতি আর অর্থোপার্জনের অবলম্বন বানিয়েছিল, খোদার দ্বীনকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছিল, নিজেদের মধ্যে ফেরকা বিভক্তি করে সার্বক্ষনিক দাঙ্গায় ইন্ধন যুগিয়েছিল, তাতারীরা তাদের সামনে তাদের স্ত্রী-কন্যাকে ধর্ষণ করল, হত্যা করল, সুন্দরীদের বেছে নিয়ে দাসি-বাদী বানাল। আর আলেমদের ধরে ধরে কেটে টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ফেলে রাখল বা দজলার পানিতে ভাসিয়ে দিল। তারা স্থলজ ও জলজ প্রাণীর খাদ্য হল। যারা তাতারী তুফান ডেকে আনল আর যাদের জন্য ডেকে আনল তাদের কেউ রেহাই পেল না।
নগরি ধ্বংস করার পর হালাকু খান যখন জানল মাটির নীচে গুপ্ত কক্ষে এখনো কিছু লোক আত্মগোপন করে আছে তখন সে দজলার বাঁধ ভেঙ্গে দিতে হুকুম দিল, তাদেরও সলীল সমাধি হল। তাতারীরা তিলোত্তমা বাগদাদ এমন ভাবে ধ্বংস করল যে, রোজে পয়দায়েশ থেকে নিয়ে নক্ষত্রমণ্ডল পৃথিবীর বুকে এমন বীভৎস ধ্বংসলীলা আর কখনো দেখেনি। এ হল এক ভাগ্যাহত জাতির ইতিহাস। যে জাতির পথ প্রদর্শক মুরুব্বিরা বহিঃশত্রুর মোকাবেলার চেয়ে নিজেদের মধ্যে ফিরকা-বিভক্তি সৃষ্টি করে পরস্পরকে ধ্বংসের তৎপরতায় লিপ্ত ছিল- এ পরিণতি ছিল তাদের কৃতকর্মের ফল। কিন্তু বাগদাদের বাসিন্দারা যদি ঐসব ফিরকাবাজ, ফিতনাবাজ, দাঙ্গাবাজ আলেমদের থেকে সচেতন থাকত, তাদেরকে ফিরকা বাজি থেকে বিরত রাখত বা তাদের শাস্তি দিত বা হত্যা করত তাহলে অবশ্যি তারা আল্লাহ্র গযব থেকে বেঁচে যেতে পারত। কিন্তু এ ধ্বংসলীলা ছিল তাদের ভাগ্যলিপির শামিল।
বাগদাদের লাইব্রেরীতে সাত শত বছরের মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং পৃথিবীর সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংগ্রহশালা ছিল। এতবড় লাইব্রেরী পৃথিবীতে পূর্বে কখনো ছিল না, আর ভবিষ্যতে হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। হালাকু খান সে লাইব্রেরী দজলায় ডুবিয়ে দিল। তখন বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান বুক চাপড়াতে চাপড়াতে মাতম করতে লাগল ‘হায় হায়, মুসলিম জাতির কি সর্বনাশই না হল, যে অমুল্য সম্পদ আজ দজলার স্রোতে ভেসে গেল মুসলমানরা আর কোন দিন এ সম্পদ ফিরে পাবে না। বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান মাতম করতে করতে সেখানেই মারা গেল। বস্তুতঃ বাগদাদ ধ্বংসের চেয়ে লাইব্রেরী ধ্বংস মুসলিম জাতির জন্য যে অভিশাপ বয়ে আনল আজো মুসলমানদের পক্ষে সে অভিশাপ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি, আর হবে কিনা সন্দেহ। কারণ শুধু বাগদাদের লাইব্রেরীটা থাকলেও জ্ঞান-বিজ্ঞানে চিরস্থায়ীভাবে মুসলিম নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকত, ইউরোপ কখনো মাথা তুলে দাড়াতে পারত না। কিন্তু এ লাঞ্চনা হচ্ছে এক অপরনামদর্শি জাতির ললাট লিখন।
পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ ও গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু দু’টি গণহত্যার সামনে অন্যগুলি নিষ্প্রভ ও নাস্তি প্রমাণিত হয়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে নেবুচাদ নেজার (আরবি বুখতে নসর) কর্তৃক তৎকালীন ইহুদী রাষ্ট্র জেরুজালেম ও যিহুদা ধ্বংস সাধন। সম্রাট রাজ্য দু’টি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে সকল নাগরিক হত্যা করেন। বন্দি কিছু লোককে গোলাম হিসাবে ব্যাবিলনে নিয়ে আসেন- যাদের থেকে পরবর্তী ইহুদী বংশ ধারা রক্ষা পায়।
এ সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে -- فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ أُولَاهُمَا بَعَثْنَا عَلَيْكُمْ عِبَادًا لَّنَا أُولِي بَأْسٍ شَدِيدٍ فَجَاسُوا خِلَالَ الدِّيَارِ ۚ وَكَانَ وَعْدًا مَّفْعُولًا [١٧:٥] -- অতঃপর যখন প্রতিশ্রুত সেই প্রথম সময়টি এল, তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলাম আমার কঠোর যোদ্ধা (নেবুচাদ নেজার) বান্দাদেরকে। অতঃপর তারা প্রতিটি জনপদের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। এ ওয়াদা পূর্ণ হওয়ারই ছিল ।
বাইবেল ওল্ড টেস্টামেন্ট, রাজাবলির ২য় খণ্ডে বলা হয়েছে,
17 Therefore he brought upon them the king of the Chaldees, who slew their young men with the sword in the house of their sanctuary, and had no compassion upon young man or maiden, old man, or him that stooped for age: he gave them all into his hand.
1 18. And all the vessels of the house of God, great and small, and the treasures of the house of the Lord, and the treasures of the king, and of his princes; all these he brought to Babylon.
2 19. And they burnt the house of God, and brake down the wall of Jerusalem, and burnt all the palaces thereof with fire, and destroyed all the goodly vessels thereof.
20.And them that had escaped from the sword carried he away to Babylon; where they were servants to him and his sons until the reign of the kingdom of Persia:
3
4 21. to fulfil the word of the Lord by the mouth of Jeremiah, until the land had enjoyed her sabbaths: for as long as she lay desolate she kept sabbath, to fulfil threescore and ten years.
5 ১৭। ঈশ্বর তখন বাবিলরাজকে দিয়ে যিহুদা ও জেরুজালেম আক্রমণ করালেন। বাবিলরাজ এসে সমস্ত তরুনদের এমনকি মন্দিরে উপাসনারত লোকদেরও হত্যা করলেন। নিষ্ঠুরভাবে, কোনো দয়ামায়া না দেখিয়ে তিনি স্ত্রী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, সুস্থ-অসুস্থ, যিহুদা ও জেরুজালেমের সমস্ত ব্যক্তিকে নির্বিচারে হত্যা করলেন। প্রভুই তাকে যিহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের শাস্তি দেবার অধিকার দিয়েছিলেন।
6 ১৮। নেবুচাদ নেজার প্রভুর মন্দির থেকে যাবতিয় জিনিসপত্র বাবিলে নিয়ে গেলেন। রাজকর্মচারীদের মূল্যবান জিনিসপত্র তিনি নিয়ে যান।
7 ১৯। তিনি ও তার সেনাবাহিনী মিলে জেরুজালেমের প্রাকার গুঁড়িয়ে দিয়ে মন্দির, রাজপ্রাসাদ ও রাজকর্মচারীদের বাড়ি-ঘরদোর সবকিছু পুড়িয়ে দিলেন।
8 ২০। যে সমস্ত ব্যক্তিরা বেঁচে ছিল নেবুচাদ নেজার তাদের সবাইকে ক্রীতদাস হিসেবে বাবিলে নিয়ে গিয়েছিলেন। পারস্যরাজ বাবিল অধিকার করা পর্যন্ত এই সমস্ত ব্যক্তিরা বাবিলেই ছিল।
9 ২১। এইভাবে প্রভু নবী যিরমিয়র মুখ দিয়ে ইসরাইলের লোকেদের উদ্দেশ্যে যা যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সে সবই মিলে গেল। প্রভু যিরমিয়র মারফত ভবিষ্যদ্বাণী করেন, বিশ্রামদিনে বিশ্রাম না নিয়ে লোকেরা যে পাপাচার করেছে তা শোধন করতে এই ভূখণ্ড এভাবে পতিত থাকবে। এইভাবে দেশটি ৭০ বছর ধরে বিশ্রাম পেয়েছিল।
প্রফেট জিরমিয়ার গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে,
(7)The lion is come up from his thicket, and the destroyer of the Gentiles is on his way; he is gone forth from his place to make thy land desolate; and thy cities shall be laid waste, without an inhabitant
(8)For this gird you with sackcloth, lament and howl: for the fierce anger of the Lord is not turned back from us
(9)And it shall come to pass at that day, saith the Lord, that the heart of the king shall perish, and the heart of the princes; and the priests shall be astonished, and the prophets shall wonder
(The Book of the Prophet Jeremiah)
দ্বিতীয় ধ্বংসলীলা হচ্ছে- হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদের ধ্বংস এবং চল্লিশ লক্ষ মানুষের গণহত্যা। তদুপরি এসব মানুষের পচা গলার দুর্গন্ধ এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে সুদূর সিরিয়া পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল। এখন প্রশ্ন হল, এ দুটি ধ্বংসলীলার কারণ কি ? কোরআনই এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে-
ثُمَّ أَنتُمْ هَٰؤُلَاءِ تَقْتُلُونَ أَنفُسَكُمْ وَتُخْرِجُونَ فَرِيقًا مِّنكُم مِّن دِيَارِهِمْ تَظَاهَرُونَ عَلَيْهِم بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَإِن يَأْتُوكُمْ أُسَارَىٰ تُفَادُوهُمْ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيْكُمْ إِخْرَاجُهُمْ ۚ أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ ۚ فَمَا جَزَاءُ مَن يَفْعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰ أَشَدِّ الْعَذَابِ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ [٢:٨٥]
অতঃপর তোমরাই পরস্পর খুনাখুনি করছ এবং তোমাদেরই একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিস্কার করছ। তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও অন্যায়ের মাধ্যমে আক্রমণ করছ। আর যদি তারাই কারও বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে বিনিময় নিয়ে তাদের মুক্ত করছ। অথচ তাদের বহিস্কার করাও তোমাদের জন্য অবৈধ। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দূগর্তি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ্ তা’লা ইহুদীদেরকে নির্দেশ দিয়ে ছিলেন সর্বদা মিলে মিশে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকতে। কিন্তু তারা আল্লাহ্র আদেশ অমান্য করে, জেরুজালেম ও যিহুদা নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। আর এ দু’টি রাষ্ট্র সর্বদাই যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মারামারিতে লিপ্ত থাকত, ঠিক যেমন বাংলাদেশ ও পাকিস্থান। তখন আল্লাহ্ ক্রুধান্বিত হয়ে নেবুচাদ নেযারকে দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। তেমনি ইন্ডিয়াও হয়ত একদিন বাংলাদেশ ও পাকিস্থান ধ্বংস করে দিবে যদি এতদাঞ্চলের মুসলমানরা সতর্ক না হয়, ঐক্যবদ্ধ না হয়।
বাগদাদ ধ্বংসের কারণঃ পূর্বে আলোচনা হয়েছে আল্লাহ্ তা’লা অসংখ্য আয়াতে মুসলিম জাতির ঐক্য ফরয করেছেন এবং বিভক্তি হারাম করেছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মুসলমানরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ফিরকাবাজির সৃষ্টি করে মারামারি কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়। যেমন উল্লেখিত ঘটনায় মাকামে মাহমুদের অর্থ, কেউ এ শব্দের অর্থ না জানলে গুনাহ হবে না, কেউ নামাযে বিসমিল্লাহ না পড়লেও নামায হয়ে যাবে। আরো অন্যান্য তুচ্ছ বিষয়ের উপর যখন দাঙ্গা, হাঙ্গামা ও গণহত্যা সংগঠিত হল তখন আল্লাহ্ তা’লা ক্রুদ্ধ হলেন এবং দাঙ্গা হাঙ্গামার পরেও যখন তারা সংশোধন হল না তখন হালাকু খানকে দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ধ্বংসলীলার দায় কার উপর বর্তাবে? উত্তর একটাই আলেম সমাজের উপর বর্তাবে। কারণ আলেমরা যদি বাগদাদের মোড়ে মোড়ে বিতর্কানুষ্ঠান না করত, ফেরকাবাজি করে দাঙ্গা হাঙ্গামার সৃষ্টি না করত তাহলে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হত না। তদুপরি সম্মিলিত আলেম সমাজ যদি তাতারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করত তাহলে পৃথিবীর বুক থেকে তাতারীরা নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কাজেই এ ধ্বংসলীলার দায় আলেমদের। আবার প্রসাশন বা সাধারণ জনগণ যদি দাঙ্গা সৃষ্টিকারী ফেরকাবাজ আলেমদের বিচার করত, শাস্তি দিত বা হত্যা করে ফেলত-তবুও তারা আল্লাহ্র গযব-তাতারী ধ্বংসলীলা থেকে বেঁচে যেতে পারত।
ইতিহাসের শিক্ষাঃ চিন্তার বিষয়, কথিত আছে যে, সম্রাট নেবুচাদ নেযার যখন জেরুজালেম ধ্বংস করার জন্য নগরিতে উপনিত হয় তখনো ইহুদি আলেমরা শরীয়তের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় এবং মর্যাদায় কে বড়, দাউদ (আঃ) নাকি সুলায়মান (আঃ)- এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত ছিল। ঠিক একইভাবে হালাকু খান বাগদাদ ধ্বংসের সময় শিয়া- সুন্নী আলেমরা বিতর্কে লিপ্ত ছিল- খিলাফতের প্রথম হকদার কে, আবূ বকর (রাঃ) নাকি আলী (রাঃ)। আবার সুন্নী আলেমরা অতীব নগন্য ও জঘন্য বিষয়, স্ত্রী লোকের দুধ পাত্রে করে বাজারে বিক্রি করা, স্ত্রীর দুধ খেয়ে ফেলা, স্বামীর কোন কথায় কয় তালাক পতিত হয়, এসব বিষয়ের তর্ক করে দলাদলি সৃষ্টি করে দাঙ্গা বাধিয়ে রাখত।
একইভাবে সমস্ত মুসলিম বিশ্বের কথা না বলে শুধু স্বদেশের কথা বলি। এখানের মুসলমানরা বিভিন্ন বিদাত ও মতবাদ সৃষ্টি করে হেফাজত, জামাত, তরিকত, আওয়ামী লীগ ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। তারপর আওয়ামী লীগ তরিকতি সুন্নী ইত্যাদিদের সমর্থনে বঙ্গসাগরের উপকুলে এই ব-দ্বিপের জন্মাবধি যা ঘটেনি, শাপলা চত্বরে ঘটাল স্বজাতি ভাইদের উপর ইতিহাসের সেই নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ। তেমনি হেফাযত, তাবলীগ ও তরিকতিদের মৌন সমর্থনে জামাতকে আদালত থেকে নিয়ে পথে ঘাটে মাঠে প্রান্তরে নির্বিচারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। অথচ ইসলাম পন্থীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে তারাই সরকারে থাকত, তখন এসব হত্যা ও জেল- যুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হত না।
কাজেই বন্ধু, আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর চাই। পৃথিবীতে আল্লাহ তা’লা ধর্ম পাঠিয়েছেন কি ঐক্যবদ্ধ থেকে মানবতাকে রক্ষা করার জন্য নাকি কামড়া কামড়ি করে মরার জন্য? ইহুদী ধর্ম থেকে নিয়ে ইসলাম পর্যন্ত প্রত্যেক ধর্মের আলেমরা কেন একই নিয়মে, একই কায়দায় ফিরকা বিভক্তি সৃষ্টি করে আল্লাহ রাসূলের সাথে গাদ্দারি করে, স্ব-ধর্ম ধ্বংস করে, অনুসারীদের সাথে নিকৃষ্টতম প্রতারণা করে? ফিরকাবাজি করে আলেমরা ইসলাম ধ্বংস করছে নাকি রক্ষা করছে? কোরআন কি ফিরকা বাজির জন্য নাযিল হয়েছিল? ইসলামে ফিরকাবাজির সুযোগ আছে কি না? না থাকলে তাদের বিচার হওয়া উচিত কি না? বিচার না করলে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন কি না? ফিরকাবাজির অবসান ঘটিয়ে ঐক্য ব্যতীত ইসলাম ও উম্মাহর মুক্তির দ্বিতীয় কোন উপায় আছে কি না?
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে! (নজরুল)
যাই হউক, এখন আমার প্রশ্ন হল- ইসলাম ও উম্মাহর মুক্তির লক্ষে আমরা সকলেই ঐক্যের শপৎ নিব কিনা, ঐক্যের স্বার্থে ফিরকাবাজদের ধ্বংস করব কিনা, না করলে ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংসের দায়ে আল্লাহ্র আদালতে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে কিনা? সকলেই উত্তর দিন। সবাই চেঁচিয়ে উঠল, হাঁ হাঁ আমরা ঐক্যের শপৎ নিব এবং ফিরকাবাজদের ধ্বংস করব। তারপর হাসান মুসান্না সকলকে তওবা ও শপৎ বাক্য পাঠ করালেন।
দৃষ্টি আকর্ষনঃ
কোথাও আগুন লাগলে কেউ বসে থাকে না, সবাই নেভানোর জন্য আপ্রান চেষ্টা করে। কিন্তু হায় মুসলিম জাতি, আজ জ্বলছে, জ্বলছে মুসলিম দুনিয়া । অথচ সেই আগুনে সবাই ঘৃতাহুতি দিচ্ছে কিন্তু নেভানোর জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না। মুসলিম বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই যেখানে মুসলিম গণহত্যা চলছে না, কোথাও কাফেররা মারছে কোথাও নিজেরা নিজেরা কামড়া কামড়ি করে মরছে। আর সন্ত্রাসবাদ তো ইসলামকে কফিনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
আরব মুলুকের গাদ্দার রাজারা ইসরাইলের দাসত্ব করছে আর কাতার ইরান ইরাক সিরিয়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলি ধ্বংসের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে মুসলমান মুসলামানকে ধ্বংস করছে আর ভারতের ডুগডুগি বাজাচ্ছে। কাজেই ভাইটি/বোনটি আমার, ইসলামের এই দুর্দিনে আপনি যদি নিস্ক্রিয় বসে থাকেন, তাহলে কি আপনি মুসলমান হিসাবে গণ্য হবেন, বিবেকের আদালতে ও আল্লাহ্র আদালতে কি জবাব দিবেন? একটু এগিয়ে আসুন, আপনার সমর্থন এ জাতির মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে।
এটা সর্ব স্বিকৃত যে ঐক্য ব্যতীত এ জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। আর ঐক্যটা খুবই সহজ কঠিন কোন বিষয় নয়। কারণ কোরান হাদীস ঐক্য ফরয ও বিভক্তি হারাম করেছে। আর কোন সংস্থা সংগঠন ব্যতীত একা এ কাজ করা সম্ভব নয়। কাজেই এগিয়ে আসুন। আমরা সামনে কিছু কাজ করতে চাই। যেমন- ১। ঐক্যের জন্য ইসলামী দলগুলোকে চিঠি দেয়া ও একত্রে বসানো। ২। কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসাগুলিতে যোগাযোগ করে বা চিঠি/হ্যান্ডবিল দিয়ে তাদেরকে সচেতন করা ও জনগনকে সচেতন করা। ৩। ফিরকাবাজীর বিরুদ্ধে হাই কোর্টে রীট করা ও সংবাদ সম্মেলন করা, বিচার না হলেও অন্তত ব্যাপক গনসচেতনা সৃষ্টি হবে। ৪। ইসলামী দলগুলোকে লাভ দেখানো যে ঐক্য হলে দেশে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। আর নিম্নোল্লেখিত শর্তে রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্য হবে। (সাম্ভাব্য প্রস্তাব)।
১। মুসলিম জাতীয় অধিকারঃ জাতির বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষে মুসলিম জাতিসংঘ/আফ্রেশিয় ইউনিয়ন/ খিলাফত বা এ জাতীয় কোন সংস্থা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। এ সংস্থা হবে যুক্তরাষ্ট্রীয়-ফেডারেল সরকারের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন। মুসলিম দেশগুলি এর অধিনে প্রদেশের ন্যায় গণ্য হবে। এ সংস্থার কাজ হবে ত্রিব্ব, মানে তিন ব, মানে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও বিশ্ব নেতৃত্বে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা। ইউরোপিয় ইউনিয়নের ন্যায় সকল দেশে একই শিক্ষা, আইন, ভিসাহীন উন্মুক্ত কর্মক্ষেত্র প্রবর্তিত হবে ইত্যাদি।
২। নাগরিক অধিকারঃ রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সরকারের পোষ্য। কাজেই সক্ষমদের দেশে অথবা বিদেশে সরকারি খরচে কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। অক্ষম-প্রলেতারিয়েত-মুস্তাদআফদের সরকারি ভাতায় প্রতিপালন করতে হবে। মুস্তাদআফ হল ইয়াতিম, বিধবা, বয়োবৃদ্ধ, সকল প্রকার প্রতিবন্ধি ও হিজড়া। সর্বোপরি সকল ছিন্নমূলের পুনর্বাসন করতে হবে।
৩। বিচারঃ ইংরেজ প্রবর্তিত গাজাখুরি বিচার ব্যবস্থা বাতিল করে ইসলামী দিয়ত বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
৪। চিকিৎসাঃ প্রত্যেক উপজেলায় নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক পৃথক মানসম্পন্ন আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। প্রত্যেক ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। প্রত্যেক হাসপাতালে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য আলাদা বিভাগ থাকতে হবে।
৫। নারী অধিকারঃ নারীর শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র আলাদা করতে হবে, তবে পঞ্চাশোর্ধ নারী পুরুষ ইন্টারসেঞ্জ হতে পারবে। বৃদ্ধা ও ১৬ বছরের কম বয়স্কা দরিদ্র মেয়েদের ভাতা দিতে হবে। ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিচার ও ক্ষতিপূরণ উভয়টির বিধান রাখতে হবে।
৬। কৃষক শ্রমিক অধিকারঃ কৃষি খাতে সম্পূর্ণ জ্বালানি ফ্রী করে দিতে হবে। শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য তত্বের যৌক্তিক সমাধান করতে হবে।
৭। শিক্ষাঃ আফগান থেকে আরাকান পর্যন্ত সকল মাদরাসায় আরবী মাধ্যমে জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখা পাঠ্যভুক্ত করতে হবে।
৮। ইসলামী দলগুলির জন্য ১৫০ আসন ছেড়ে দিতে হবে।
সুতরাং যেসব দল এসব শর্তে রাজি থাকবে তাদের সাথে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য হবে। আর এটা নিশ্চিত যে, কোন সংগঠন ব্যতীত একাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়, কাজেই ব্লগার ভাই বোনরা এগিয়ে আসুন। কারো পক্ষে সম্ভব হলে একটা অনলাইন নিউজ চালু করুন। অন্তত একটা ব্লগ খোলে ঐক্য প্রত্যাশিদের লেখার সুযোগ করে দিন। লক্ষ লক্ষ যুবক ঐক্য কামনা করে তাদের নাম রেজিস্ট্রেশন করুন। ঐক্য সম্পর্কে ব্যাপক লেখালেখি করুন, অন্তত আমার লেখাগুলি সর্বত্র ছড়িয়ে দিন।
আপাতত যারা ঐক্য প্রত্যাশি তারা আমার নামটা প্রিয়তে রাখুন। তাহলে পরামর্শের মাধ্যমে আমরাই একটা সংগঠন গড়ে তুলতে পারব। এভাবে আমরা হতে পারব অভিশপ্ত উম্মাহর তিমির মরুপথে আলোর মিনার। লক্ষ করুন, শাহবাগিরা মানুষ মারার জন্য ঐক্য হয়েছিল, আমরা কি ইসলাম উম্মাহ ও মানবতা রক্ষার জন্য ঐক্য হতে পারি না। আল্লাহ্র ওয়াস্তে সবাই এগিয়ে আসুন।
বিষয়: রাজনীতি
১৫২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন