সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ১৮- ১৯
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৯ জুলাই, ২০১৭, ০১:২৮:৫৭ দুপুর
ফিরকাবাজদেরকে তাওহীদের উপর ঐক্যের নির্দেশ এবং মুরুব্বীদের রব হিসাবে আনুগত্যের নিষেধাজ্ঞা- ১৮
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ ۚ فَإِن تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ [٣:٦٤]
বলুনঃ ‘হে আহলে-কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে আস-যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান-যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না, তাঁর সাথে কোন শরীক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা বানাব না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করে, তাহলে বলে দাও যে, ‘সাক্ষী থাক আমরা তো অনুগত।(৩/ ৬৪)
ঈমাম কুরতুবী বলেন, এখানে তিনটি আলোচনা রয়েছে। (১) قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ - ইবনে যায়েদ, হাসান ও সুদ্দীর মতে এখানে আহলে কিতাব দ্বারা নাজরানের প্রতিনিধি দলকে সম্ভোধন করা হয়েছে। কাতাদা, ইবনে জুরাইজ ও অন্যান্যদের মতে মদীনার ইহুদীদের সম্ভোধন করা হয়েছে। কারণ আনুগত্যের ক্ষেত্রে তারা নিজেদের ধর্মগুরুদের রব হিসাবে গ্রহণ করেছিল। কেউ কেউ বলেন, এখানে ইহুদী, নাসারা সবাই উদ্দেশ্য।
কিন্তু ইমাম তাবারী বলেন فالواجب أن يكون كل كتابيّ معنيًّا به. لأن إفرادَ العبادة لله وحدَه، وإخلاصَ التوحيد له، واجبٌ على كل مأمور منهيٍّ من خلق الله. واسم"أهل الكتاب"، يلزم أهل التوراة وأهل الإنجيل، فكان معلومًا بذلك أنه عني به الفريقان جميعًا
ফতহুল কাদির গ্রন্থকার বলেন, لِأَنَّ هَذِهِ دَعْوَةٌ عَامَّةٌ لَا تَخْتَصُّ بِأُولَئِكَ الَّذِينَ حَاجُّوا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عليه وَسَلَّم. আয়াতের আহ্বান ব্যাপকার্থক বিধায় উহাকে নাজরানের প্রতিনিধিদের সাথে খাস করা যাবে না বরং ব্যাপকার্থেই প্রয়োগ করতে হবে।
ইমাম বগবী বলেন, উক্ত আয়াতের মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) রুম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আর দাওয়াত সংক্রান্ত ঐ বিশাল লম্বা হাদিসটি বুখারী শরীফের ৬নং হাদীস হিসাবে সংকলিত হয়েছে।
تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ – অর্থ, হে আহলে কিতাবের লোকেরা! তোমাদেরকে যে সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত কথার দিকে আহ্বান করা হচ্ছে তাতে সাড়া দাও। আর সেই কথাটি হল আমরা একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত করব, তার সাথে কোন কিছু শরীক করব না। ইমাম তাবারী বলেন . كَلِمَةٍ سَوَاءٍ (সকলের সমান কলেমা) অর্থ কলেমায়ে আদল, আর কলেমায়ে আদল অর্থ আমরা আল্লাহ্র এককত্বে বিশ্বাস করব, একমাত্র তারই ইবাদত করব, তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য থেকে মুক্ত থাকব, তার সাথে কোন কিছু শরীক করব না।
(২) দ্বিতীয় আলোচনা হচ্ছে.. وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ – অর্থ- আমরা কোন জিনিস হালাল ও হারাম করণের ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ্র বিধান ছাড়া অন্য কাউকে অনুসরণ করব না। অর্থাৎ ইহুদী নাসারারা যেমন তাদের ধর্মগুরুদের হালাল ও হারামকৃত বিষয়গুলি মেনে নিয়ে তাদের ধর্মগুরুদের রবের স্থলে অধিষ্ঠিত করেছিল অথচ সেগুলি আল্লাহ্ তা’লা হালাল ও হারাম করেন নি। আমরা তেমন করব না, অর্থাৎ আমাদের আলেমরা আল্লাহ প্রদত্ত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করলে আমরা তা মেনে নিব না।
কিন্ত মুসলমানরা আল্লাহর নির্দেশ মানেনি, আলাহ মুসলিম ঐক্য ফরয করেছেন কিন্তু ফিরকাবাজ আলেমরা তা হারাম করেছে, আবার আল্লাহ বিভক্তি হারাম করেছেন কিন্তু ফিরকাবাজরা তা হালাল করেছে আর মুসলমানরাও ফিরকাবাজদের এ অপকর্ম মেনে নিয়েছে। এ সম্পর্কে (اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ) আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা গত হয়েছে।
ইমাম তাবারীর মতে এর অর্থ হল আল্লাহ্র অবাধ্যতার বিষয়ে কেউ হুকুম করলে আমরা তার আনুগত্য করি না, আল্লাহকে যেভাবে সিজদা করা হয়, সেভাবে আমরা কাউকে (মাযারে) সিজদা করি না। ইবনে জুরাইজ বলেন, আল্লাহ্র অবাধ্যতায় আমরা একে অন্যের আনুগত্য করি না। আর রব হিসাবে গ্রহণ করা অর্থ তাদের উদ্দেশ্যে নামায পড়া নয় বরং ইবাদতের বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতা ও সর্দারদের আনুগত্য করা।
(৩) তৃতীয় আলোচনা হচ্ছে.. فَإِن تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ.ঈমাম তাবারী এর ব্যাখ্যায় বলেন, ইহুদী নাসারারা যদি . كَلِمَةٍ سَوَاءٍ- এর ডাকে সাড়া না দেয়, কুফুরী করে, তাহলে হে মুসলিমরা তোমরা বল, তোমরা তাওহীদ ও একনিস্ট ইবাদত থেকে পলায়ন করলে অথচ তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নাই, তার কোন শরীক নাই। তোমরা সাক্ষ্য থাক যে, আমরা আত্মসমর্পনকারী এবং জিহ্বা ও অন্তরে তার আনুগত্যকারী।
ইমাম কুরতুবী বলেন, যে তাওহীদের দিকে তোমাদেরকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে- তা থেকে যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে সাক্ষ্য থাক যে, আমরা মুসলিম, আত্মসমর্পনকারী। ইসলামের গুণে গুণান্বিত। সেসব বিধানের অনুসারী যেগুলি আল্লাহ্ তা’লা অনুগ্রহ ও নিয়ামত স্বরুপ আমাদেরকে প্রদান করেছেন। আর আমরা কাউকে রব হিসাবে গ্রহণ করি না, যেভাবে তোমরা ঈসা, উযায়র ও ফেরেস্তাদেরকে রব হিসাবে গ্রহণ করেছ। কারণ তারাও আমাদের মতই মানুষ, আমাদের মতই খোদার সৃষ্ট জীব। সর্বোপরি আমরা কোন ধর্মগুরুকে এমন রব হিসাবে গ্রহণ করি না যে আমাদের উপর তা হারাম করবে যা আল্লাহ্ হালাল করেছেন আবার তা হালাহ করবে আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন। আর এরূপ করলে তো আমরাও তোমাদের ( ইহুদী নাসারা) ন্যায় ধর্মগুরুদের রব হিসাবে গ্রহণ করে নিলাম।
বাস্তব প্রয়োগ ও ব্যাখ্যাঃ বর্তমানের আলেম সমাজ এ জাতীয় আয়াতগুলি ইহুদী খৃষ্টানদের সম্পত্তি সাব্যস্ত করে বর্জন করে চলেছেন। অথচ এসব আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা পূর্ববর্তী উম্মতদের দৃষ্টান্ত পেশ করে মুসলমানদের উপদেশ দিচ্ছেন যে, ইহুদী-খৃষ্টানরা যেভাবে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে নিজেদের পোরুহিত ও ধর্ম গুরুদের প্রভু হিসাবে গ্রহণ করে এবং খৃষ্টানরা যিশুকে খোদার ব্যাটা হিসাবে গ্রহণ করে মুশরিক হয়ে গেছে তদ্রুপ মুসলমানরাও যেন ধর্মগুরুদের রব হিসেবে গ্রহণ করে মুশরিকে পরিণত না হয়। আমরা জানি কোরআন সার্বজনিন ও সর্বকালিন। কাজেই এসব আয়াত ইহুদী-খৃষ্টান ও মুশরিকদের শানে নাযিল হলেও সংশ্লিষ্ট অবস্থা মুসলমানদের মধ্যে পাওয়া গেলে তাদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। দেড় হাজার বছর পর মুসলমানরা ইসলামের মধ্যে কতটুকু বিকৃতি ঘটিয়েছে, তারা মুসলমান আছে নাকি ইহুদী খৃস্টানের ন্যায় মুশরিকে পরিণত হয়েছে- বর্তমান প্রেক্ষাপটে উক্ত আয়াতগুলির আলোকে পর্যালোচনা করতে হবে।
পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে, নবী রাসূল ব্যতীত কারো নিঃশর্ত আনুগত্য করা জায়েয নাই। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, মুসলমানদের প্রত্যেকটি ফিরকা স্ব স্ব ফিরকা বা মুরুব্বীদের নিঃশর্ত আনুগত্য করছে, নবী রাসূলের মত অনুসরণ করছে, উক্ত আয়াতের ভাষায় ধর্মগুরুদের প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছে। যেমন, আল্লাহ রাসূল ঐক্য ফরয ও বিভক্তি হারাম করেছেন, কিন্তু প্রত্যেক ফেরকার মুরুব্বীরা ঐক্য হারাম আর বিভক্তি হালাল করেছেন। আর তাদের অনুসারীরাও কোনরুপ বাদ-প্রতিবাদবিহীন তা মেনে নিয়ে অসংখ্য ফিরকায় বিভক্ত হয়ে ইহুদী খৃষ্টানের ন্যায় আয়াতের বাস্তবতা প্রতিপাদন করছে। যেমন -
বেরেলভী ধারাঃ আ’লা হযরত আহমদ রেজা খান (রঃ) কয়েকটি বিতর্কের জন্ম দিয়ে গেছেন।
১) রাসূল (সাঃ) নূরের সৃষ্টি এবং গায়েব জানেন।
২) দেওবন্দীদের কাফের বলে ফতোয়া বাজী করেছেন।
৩) সকল উলামায়ে কেরাম বৃটিশ ভারতকে দারুল কুফর ঘোষণা দেয়ার পর তিনি ভারতকে দারুল আমান ঘোষণা দিয়ে আলেম সমাজের বিরোধিতা করেন এবং ইংরেজ তোষণ নীতি অবলম্বন করেন। অথচ তখন হিন্দু, মুসলিম, শিখ, মারাঠা সবাই ইংরেজ বিরোধি আন্দোলনে লিপ্ত। এভাবে তিনি “করে শত্রুর সাথে গলাগলি ধরে মিত্রের সাথে পাঞ্জা” নীতি গ্রহণ করে নতুন ফিরকার জন্ম দিয়ে মুসলিম জামাত থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার অনুসারীরা গুরুর মতাদর্শ অনুসারে রাসূল (সাঃ) নূরের সৃষ্টি, গায়েব জানেন, দেওবন্দীরা কাফের ইত্যাদি বিতর্কিত বিষয়গুলি প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সর্ব শক্তি নিয়োগ করছে। গুরুর প্রতিটি কথা প্রমাণ ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। কিন্তু গুরুর ভুলগুলি সংশোধন করার, অন্যদের সাথে আপোস করার মত মন মানসিকতা দেখাচ্ছে না, কোরান-হাদীসের নির্দেশ মানছে না। অথচ উক্ত তিনটি বিষয়ের মধ্যে রাসূল (সাঃ) গায়েব জানেন কথাটি শিরকী মতবাদ। কারণ কোরআন হাদীস থেকে কয়েকশ দলীল দেয়া যাবে যে, রাসূল (সাঃ) গায়েব জানতেন না। কাজেই প্রমাণিত হলো যে, বেরেলভীরা আ’লা হজরতের নিঃর্শত আনুগত্য করছে এবং –
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّه- (আল্লাহকে ছেড়ে ধর্মগুরুদের রব হিসাবে গ্রহণ করেছে) এর প্রমাণ রাখছে।
দেওবন্দী ধারাঃ দেওবন্দ মূলত মুসলিম মিল্লাতের প্রাচীন শিক্ষা ও সভ্যতার উত্তর ধারক। এ ধারাটি ১০৫০ সালে উযির নিযামুল মূলক কর্তৃক ইমাম গাযযালির মাধ্যমে প্রণিত এবং বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহিত দরসে নিজামী সিলেবাসের অনুসারী। অথবা ইংরেজ আমলে দিল্লির নিজামুদ্দিন ফিরিঙ্গি মহল্লী কর্তৃক প্রনিত সিলেবাসের অনুসারী। এটা একটি শিক্ষা ও সংস্কার মূলক আন্দোলন, কোন ব্যক্তি কতৃক প্রতিষ্ঠিত ফিরকা বা দল নয়। কাজেই এর প্রতিষ্ঠাতাগণ বা পরবর্তী মুরুব্বীদের দোষ ত্রুটি থাকলে এর দায় সংশ্লিষ্ট মুরুব্বীর, প্রতিষ্ঠানের উপর সে দায় চাপানোর কোনই যৌক্তিকতা নাই। কারণ দেওবন্দ গোটা দুনিয়া, বিশেষত ভারত বর্ষে ইসলামী শিক্ষা সংস্কার, প্রচার-প্রসার, তাবলীগ ইত্যাদির প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান, কাজেই এর মধ্যে ভুল ত্রুটি থাকলে পরবর্তীরা তা সংশোধন করে নিবে এটাই ইসলামের দাবী। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অনুসারীরা দেওবন্দ ও তার মুরুব্বীদের নিঃর্শত আনুগত্য করছে।
যেমন দেওবন্দের সিলেবাসে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের কোন অস্তিত্ব নাই। দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা থেকে বর্তমান পর্যন্ত দেড় শত বছর ধরে এভাবেই চলছে। ফলে এখান থেকে বড় বড় আলেম বের হচ্ছে বটে তবে তারা বিজ্ঞান ও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর এ সুযোগে বস্তুবাদী শিক্ষিতরা রাষ্ট্রক্ষমতায় জেঁকে বসেছে। ফলে এ ভোগবাদী পুঁজিবাদীদের শাসনে-শোষণে সামাজিক বৈষম্য বিকট আকার ধারন করেছে, সর্বত্র হাহাকার ও যুলুম নির্যাতনের জন্য মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। কিন্তু যোগ্য ও সৎ আলেম সমাজ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলে পৃথিবী এতটা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হত না। বিশেষতঃ বাংলাদেশে যেখানে ৭% হিন্দু জনসংখ্যা, সেখানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রনের মূল ঘাটি বিচার, সচিবালয় ও পুলিশ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ে ৭৫% পদ দখল করে আছে। আর তারা ইংরেজ আমলে মুসলমানদের সাথে যে আচরণ করেছে এখন কি অন্যথা আশা করা যায় ? এর প্রমাণ ইসলাম বিরোধি আইন পাশ হচ্ছে। ইসলাম পন্থীদের ধ্বংস করা হচ্ছে, নাস্তিক মুর্তাদদের প্রাধান্য ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ বিশাল দেওবন্দী ধারা চাকরিতে ঢুকলে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হত না। কিন্তু দেওবন্দ অনুসারীরা এ বিষয়ে সতর্ক নয়, পরিবর্তনের কোন চিন্তা চেতনাও তাদের মধ্যে নেই। সেই প্রাচীন মান্দাতার আমলের সিলেবাস নিয়েই তারা পড়ে থাকবে।
(২) দেওবন্দীরা উপমহাদেশে ইসলামের প্রধান ধারক-বাহক। আর বড়দের ভুলও বড় হয়। কাজেই তাদের দুটি বিদাত ইসলাম ধ্বংসের প্রধান কারণ। একটি হচ্ছে বিজ্ঞান থেকে ধর্ম শিক্ষা আলাদা করণ অন্যটি ইসলামকে ভিক্ষা বৃত্তির উপর নির্ভরশীল করে দেয়া। ফলে পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষিতরা রাষ্ট্র ক্ষমতাসহ সকল সুযোগ- সুবিধা ভোগ করছে আর আলেমরা জনপদে জনপদে ঘুরছে আর হাঁকছে, ‘ভিক্ষে দাও পুরবাসী ভিক্ষে দাও, আল্লাহ ও রাসূল না খেয়ে আছেন। এ সম্পর্কে খিলাফত ইশতেহারে বিস্তারিত আলোচনা আসছে। তবে সংক্ষেপে মূল কথাটা বলে দেই-সকল ইসলামী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখা আরবীতে ভাষান্তর করে আফগান থেকে আরাকান পর্যন্ত সকল কওমী ও আলিয়া মাদরাসায় পাঠ্য করে দিতে হবে।
(৩) উপনিবেশিক আমলে দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে প্রণিত উসুলে হাশতেগানা ষষ্ট মূলনীতি আজো অনুসৃত হয়ে আসছে যা নিঃশর্ত আনুগত্যের প্রমাণ। অথচ স্বাধীনতার পর এ উসুল বহাল থাকার কথা নয়, উচিতও নয়।
(৪) দেওবন্দের গর্ভজাত তাবলীগ জামাত ধীরে ধীরে খারেজীদের ন্যায় রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। অথচ দেওবন্দীরা এর লাগাম টেনে ধরছে না, সংস্কার করছে না।
(৫) তাদের সম্পর্কেও অন্যান্য ফিরকা যেমন আহলে হাদীস-সালাফীদের আপত্তি আছে। আরো অন্যান্য বিষয়াবলীর পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, দেওবন্দীরাও আকাবিরে দেওবন্দ ও দেওবন্দী শিক্ষা ব্যবস্থার নিঃশর্ত আনুগত্য করছে। ফলে তারাও একটি বাতিল ফিরকায় পরিণত হয়েছে।
তাবলীগ জামাতঃ বৃটিশ ভারতে মুসলিম জাতি যখন অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি তখন হিন্দুরা ‘ঘর ওয়াফসী’ নাম দিয়ে মুসলমানদেরকে হিন্দু বানানোর আন্দোলন শুরু করল। ওদিকে মিশনারিরা বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলে খৃষ্টান বানানোর জোর প্রচেষ্টা চালালো। হিন্দু ও মিশনারীদের ধমার্ন্তর করণ এবং মুসলিম সমাজে অনুপ্রবিষ্ট শিরক বিদআত ও অশিক্ষা কুশিক্ষা ইত্যাদির মোকাবিলায় মুসলিম জাতিকে রক্ষার উদ্দেশ্যে মাওঃ ইলিয়াস (রঃ) তাবলীগের প্রবর্তণ করেন। আর তদীয় জামাতা শায়খুল হাদীস মাওঃ যাকারিয়া (রঃ)তাবলীগী নেসাব “ফাসায়েলে আমল” প্রণয়ন করেন। তাবলীগের উদ্দেশ্য ছিল অশিক্ষিত প্রান্তিক জনগোষ্টির কাছে ইসলামের দাওয়াত ও শিক্ষা পৌঁছে দেয়া। আর ফাযায়েলে আমল রচনার উদ্দেশ্য ছিল অশিক্ষিত মুসলমানদেরকে ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞানদান করা। আর এ জন্য মাওঃ যাকারিয়া (রঃ) কোরান হাদীস বিভিন্ন কিসসা কাহিনী উপমা ইত্যাদির সমন্বয়ে অতীব সহজ করে গ্রন্থটি রচনা করেন যাতে অশিক্ষিত লোকেরা তা হজম করতে পারে। এ কারণেই তাতে দেখা যায় অনেক জয়ীফ ও মওজু হাদীস রয়েছে। কাউকে আলেম বানানোর জন্য গ্রন্থটি রচিত হয়নি বিধায় নিরেট কোরান হাদীসের ভিত্তিতে গ্রন্থটি রচনা করলে কঠিন হয়ে যেত যা থেকে সাধারণ মুসলমানরা উপকৃত হতে পারত না। মাশাল্লাহ, এখন তাবলীগ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত আলেম দলমত নির্বিশেষে সবাই তাবলীগের দিকে ঝুকছে। কিন্তু সেই সাথে তাবলীগ খারেজীদের ন্যায় একটি বাতিল ফেরকায় পরিণত হয়েছে। কারণ—
১। তাবলীগ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জিহাদ ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র নামায, রোযা ও তাবলীগ সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে এবং এটাকেই পূর্নাঙ্গ ইসলাম মনে করছে। সুরা তওবাসহ জিহাদের আয়াতগুলি সম্পূর্ণ বর্জন করেছে। তদুপরি জিহাদ সংক্রান্ত নসগুলির অপব্যাখ্যা করে তাবলীগের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। ইসলামের একটি খন্ডাংশ অবলম্বন করে মুসলিম জামাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাতিল ফেরকায় পরিনত হয়েছে।
২। ফাযায়েলে আমলকে কোরানের উপর প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। মসজিদে যোগ্য ইমাম থাকা সত্ত্বেও কোরান তা’লীম না করে ফাযায়েলে আমলের তালীম হচ্ছে। এমনও দেখা গেছে, ইমাম সাহেব তা’লীমের জন্য কোরান নিয়ে বসেছেন, কিন্তু তাবলীগীরা অনিহাভরে তার হাত থেকে কোরান টেনে নিয়ে তালীমের জন্য ফাযায়েলে আমল দিয়েছে।
৩। অন্যরা তো বটেই এমনকি দেওবন্দী আলেমগণও তাবলীগের দোষ-ত্রুটিগুলির সমালোচনা করেন। দেওবন্দী ধারার বর্তমান প্রধান মুরুব্বী পাকিস্তানের আল্লামা তকী উসমানী তিরমিযীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ দরসে তিরমিযিতে তাবলীগের সমালোচনা করেছেন। দেওবন্দীদের নিয়ম হলো তারা তাবলীগ ও জামাতে ইসলামী এ উভয় সংগঠনের সমালোচনা করেন বটে কিন্তু তাবলীগের সমর্থন ও সহযোগিতা করেন, কিন্তু জামাতের বিরুদ্ধাচরন করেন। দেওবন্দী অদেওবন্দী সকল আলেম তাবলীগী নেসাবের যয়ীফ, মওজু হাদীস ও কল্প কাহিনীর সমালোচনা করেন কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে এসে এগুলি সংশোধন করেন না।
৪। আর তাবলীগীদের অবস্থা হলো তারা মাওঃ ইলিয়াস (রঃ) ও অন্যান্য মুরুব্বীদের নিঃশর্ত আনুগত্য করে। এর প্রমাণ হলো, তাবলীগী আলেমগণ ভাল করেই জানেন যে, তারা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা তথা খিলাফত, জিহাদ ইত্যাদি বাদ দিয়ে দিয়েছে, তাবলীগী নেসাব যয়ীফ ও মওজু হাদীস এবং কল্প-কাহিনীতে ভরপুর। এসব জানা সত্ত্বেও তারা এগুলো সংশোধন করছেন না, এরূপ কোন চেতনাও দেখা যাচ্ছে না বরং তারা এটাকেই পূর্নাংগ দ্বীন মনে করছে। তারা মাওঃ ইলীয়াস (রঃ) কে রাসূলের মত এবং ফাযায়েলে আমলকে কোরানের মত অনুসরণ করছে। এমনকি মুরুব্বীদেরকে তারা হযরতজী বলে ডাকে অথচ সাহাবায়ে কেরামের সম্মানেও তারা “জী” শব্দ ব্যবহার করে না। তদুপরি মুরুব্বীদের কথা মালাকে “মালফুজাত” নামকরণ করে হাদীসের চেয়েও গুরুত্ব সহকারে পঠিত হয় এবং পকেট বুক আকারে ছাপিয়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে পকেটে রাখা হয়। অথচ রাসূল (সাঃ) এর চল্লিশ হাদিস, পাঞ্জে সুরা ইত্যাদি কখনো তাদের পকেটে স্থান পায় না। হায় সবর্নাশ। এসব কী হচ্ছে? তাবলীগ কোথায় যাচ্ছে? দেওবন্দী আলেমগণ, তাবলীগী মুরুব্বীগণ হুসে আসুন, আল্লাহ্র ওয়াস্তে হুসে আসুন। তাবলীগ ও উহার নেসাবে সংশোধনি এনে উম্মাহকে বাঁচান, নিজেদের পরকাল শঙ্কামুক্ত করুন।কারণ এজন্যই রাসূল (সাঃ) অভিযোগ করবেন, (( وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَٰذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا আর রাসূল (সাঃ) বলছেন -- ''হে আমার প্রভু! নিঃসন্দেহ আমার স্বজাতি এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য বলে ধরে নিয়েছিল।(২৫: ৩০) এসব কিছু মুরুব্বীদের নিঃশর্ত আনুগত্য ও ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রমাণ ( اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ)
বস্তুত অন্যান্য ফিরকার চেয়ে তাবলীগ জামাত ইসলামের জন্য অধিক ক্ষতিকারক হয়ে দাড়িয়েছে। তবে এর দ্রুত বিস্তৃতির কারণ হচ্ছে, তাবলীগীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা তথা খিলাফতের কথা কিছু তো বলেই না বরং তারা রাজনীতি হারাম মনে করে। এজন্যই পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দাজ্জালী সভ্যতার সাথে তাদের কোন সংঘাত নাই। এ সুবাদে মুসলিম অমুসলিম প্রতিটি দেশে তারা রাজনৈতিক আনুকুল্য পাচ্ছে এবং সর্বত্র দাওয়াতী কার্যক্রম চালাতে কোন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেনা-যেখানে ইসলামী দলগুলি প্রতিকুলতার সম্মুখীন হয়। আর সাধারণ মানুষ ধর্ম-কর্ম করার জন্য সংঘাত-সংঘর্ষহীন কোন সংগঠনই পছন্দ করে বিধায় তাবলীগের দিকে ঝুকছে। কাজেই ইসলামের খেদমতগার এই বৃহৎ সংগঠনটির জন্য এখন আবশ্যক হচ্ছে নিজেদের ভুল ত্রুটিগুলি শুধরে নিয়ে মুসলিম জামাতের সাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করা, এটাই ইসলামের মূল বার্তা এবং ফরয কাজ।
ওহাবী মতবাদঃ- মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নজদী (রঃ) (১৭০৩-১৭৯২) শিরক বিদাতের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন যা উম্মাহর কাছে প্রশংসিত হয়। কিন্তু এ বিষয়ে তারা এতটা বাড়াবাড়ি করল যে, শিরক বিদাতের আশংকায় রাসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতি বিজরিত স্থানগুলি ধ্বংস করে দিল। শিরক বিদাতের ব্যাপারে তারা অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করে এবং নিন্মোক্ত ছয়টি বিষয়কে তারা হারাম মনে করে-
১। তাকলিদ বা মাযহাব অনুসরণ।
২। তাসাউফ বা সুফীবাদ বা পীর মুরিদি।
৩। দোয়ার মধ্যে অসিলা মানা।
৪। তাবিজ কবজ ব্যবহার করা।
৫। - تبرك بالمكان অর্থাৎ নবী রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম, বুজোর্গানে দ্বীন ও অলি আউলিয়াদের মাযার বা স্মৃতি বিজরিত স্থান থেকে বরকত লাভ করা। আর এ কারণেই তারা রাসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতি চিহ্নগুলি বিলুপ্ত করে দেয়। এমনকি তারা রাসূল (সাঃ) এর পবিত্র রওজাকে পর্যন্ত অজ্ঞাত স্থানে স্থানান্তরের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
৬। রওজায়ে আতহার জিয়ারতের নিয়তে ভ্রমণ করা। অর্থাৎ শুধু রওজা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করা জায়েয নেই। তবে মসজিদে নববীতে নামাজের নিয়তে ভ্রমণ করে প্রাসঙ্গিক ক্রমে রওজা শরীফের যিয়ারত জায়েয আছে। সম্ভবত এ মতটি ঠিক নয়। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন..من زار قبري وجبت له شفاعتي - অর্থাৎ যে আমার রওজা যিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল)। যাই হউক, শিরক বিদাতের ব্যাপারে ওয়াহাবী-সালাফীরা জিরো টলারেন্স দেখায়। এর কারণ হচ্ছে, ইবনে ওয়াহহাবের সময়কালে আরব জগত শিরক বিদাতের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। এজন্যই তারা এ বিষয়ে কুঠার হস্ত। তবে ওয়াহবীরা বাড়াবাড়ি করলেও সম্ভবত তারা কোরআন হাদীস ভিত্তিক সত্যের খুব কাছাকাছি। الله اعلم
এখানে উল্লেখ্য যে, ওহাবী ও সুফীবাদীদের যাতাকলে পড়ে দেওবন্দীদের মাথায় শাখের করাত। কারণ তারা মাযার সংশ্লিষ্ট শিরক বিদাতের সমালোচনা করে বিধায় সুফীরা তাদেরকে ওহাবী বলে গালি দেয়। আবার উপরুল্লেখিত ছয়টি বিষয় দেওবন্দীরা জায়েয (শর্ত সাপেক্ষে) মনে করে বিধায় ওয়াহাবীরা তাদেরকে বিদাতি বলে গালি দেয়। যাই হউক, সালাফীরা ইবনে ওয়াহহাব ও ইমাম তাইমিয়ার অন্ধ অনুসরণ করে ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে।
জামাতে ইসলামীঃ ইংরেজ আমলে বেরেলভী এবং মাজার পন্থী কিছু লোক মুসলিম জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর বিশাল মুসলিম জন গোস্টি ইসলামের মূল ধারার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। সম্ভবত! এমূল ধারাটির কেন্দ্রবিন্দু ছিল দেওবন্দ। তারপর এ মূল ধারা থেকে দুটি ফিরকা বের হয় তাবলীগ ও জামাতে ইসলামী। তাবলীগ এখনো দেওবন্দের সাথে যুক্ত থাকলেও জামাত ও দেওবন্দ সাংঘষির্ক অবস্থানে চলে যায়। বুনিয়াদি বিষয়ের উপর মতভেদের ভিত্তিতে এসব ফিরকা-বিভক্তির সৃষ্টি হয়নি বরং তুচ্ছাতিতুচ্ছ, অতীব নগন্য বিষয়ে মতভেদের ভিত্তিতে তারা বিভক্ত হয়ে সাংঘষির্ক অবস্থানে চলে যায়। যেমন সাহাবায়ে কেরাম মি’য়ারে হক কিনা, অনুসরণীয় কিনা, ইসলামি ব্যাংকিং ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে মতভেদের অবতারণা করে তারা ফেরকা বাজিতে লিপ্ত হয়। অথচ ফুরুয়ি বিষয়ে মতভেদ জায়েয কিন্তু বিভক্তি হারাম। এভাবে তারা জায়েয কাজের জন্য হারামে লিপ্ত হয়ে গেল।
মাওঃ মওদূদী (রঃ) কে বলা হয় ক্ষুরধার লেখনীর অধিকারী, অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। পাশ্চাত্যের সর্বগ্রাসি বস্তুবাদি শিক্ষা সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক তুফান যখন মুসলিম দুনিয়া গ্রাস করতে উদ্যত তখন তিনি কলমের সাহায্যে সেই তুফান রুখে দেন এবং পৃথিবীর সকল মতবাদের উপর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। গত শতকে যে মানুষটি ইসলামের উপর সব চেয়ে বেশি লেখালেখি করেছেন তিনি হলেন মাওঃ মওদুদী (রঃ)। কাজেই যে বেশি কথা বলবে তার বেশি ভুল হবে, যে বেশি লিখবে তার বেশি ভুল হবে, এটাই বাস্তব কথা, যুক্তির কথা। একজন লেখকের অনেক প্রকারের ভুল হয়। প্রথমে চিন্তগত ভুল, তারপর চিন্তার বিন্যাসে ভুল, তার শব্দ চয়ন ও বাক্য গঠনে ভুল, আরো অনেক প্রকারের ভুল হয়। আর মানুষ তো ভুলের জাতক, প্রথম মানব (আদম) প্রথম ভুল করেছেন, তাই মানুষ ভুল করে, করবে, করতে বাধ্য। ভুল করেন না নবী রাসূলগণ। অনন্তর মাওঃ মওদুদী নবী-রাসূল ছিলেন না, সাধারণ মানুষ হিসাবে তিনি ভুল করেছেন, করতে বাধ্য। যদি কেউ এটা বিশ্বাস না করে এবং তাকে ভুলের উর্ধেব মনে করে তবে তাঁর ঈমান থাকবে না। অথচ বাস্তবতায় মনে হয়, জামাত মাওঃ মওদুদী (রঃ) কে নিঃশর্ত আনুগত্য করে এবং ভুলের উর্ধ্বে মনে করে।
প্রতিষ্ঠাকালিন জামাতে দেওবন্দী ধারার বড় বড় আলেম সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যেমন, আবুল হাসান আলী নদভী (রঃ), মনযুর নোমানী (রঃ), শামছুল হক ফরিদ পুরী (রঃ), আঃ রহীম (রঃ) প্রমুখ আরো অনেক। কিন্তু তারা মওদুদী (র এর ভুল ও দলের আভ্যন্তরীন ত্রুটি বিচ্যুতি দেখে তা সংশোধনের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে দল ছেড়ে চলে এসেছেন। তারপর তাদের অনেকেই মওদুদী (রঃ) এর রচনাবলির ভুল এবং দলের মেনুপেস্টু-এর ভুলগুলি চিহ্নিত করে গ্রহ্ন রচনা করেন এবং জামাতকে সংশোধনের উদ্যোগ নেন। যেমন মনজুর নোমানী (রঃ) লেখলেন, ‘মাওঃ মওদুদী কে সাথ মেরী রেফাক্বত কী সরগুযাস্ত আওর আব মেরা মাওকফ (মাওলানা মওদুদির সাথে আমার সাহচর্যের ইতিবৃত্ত)। ফরীদপুরী (রঃ) লেখলেন “ভুল সংশোধনী” আরো অন্যান্য আলেমগণ অসংখ্য গ্রহ্ন রচনা করেন। কিন্তু জামাত নেতৃবৃন্ধ সে সব প্রত্যাখ্যান করে পালিয়ে বেড়ালেন এবং ভুল আঁকড়ে ধরে থাকলেন।
অনন্তর বাংলাদেশে হাফেজ্জী হুজুর (রঃ), ফরীদ পুরী (রঃ) এবং অন্যান্য প্রধান প্রধান দেওবন্দী আলেমগণ জামাত নেতৃবৃন্দকে বারবার ডেকেছেন, আনুষ্ঠানিক ভাবে বসার দাওয়াত দিয়েছেন, ভুলগুলি সংশোধন করে একসাথে ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামী আন্দোলন করার লক্ষে। কিন্তু জামাত আসেনি, বসার তারিখ দিয়েও বসেনি। এভাবে জামাত কারো কথা না শুনে গোয়ার্তুমি করে একলা চলো নীতি অবলম্বন করল। মুসলিম জামাত থেকে বেরিয়ে গেল। অথচ মওদুদী (রঃ) এমন কখনো বলেননি যে, আমি কোন ভুল করিনি, যা লিখেছি সবই ঠিক, তোমরা শর্তহীনভাবে আমার আনুগত্য করবে।
যাই হউক, এভাবেই উপমহাদেশে মুসলিম উম্মাহর মূল ধারাটি দেওবন্দ, তাবলীগ ও জামাত এ তিনটি বিপরীত মুখি সাংঘর্ষিক ধারায় বিভক্ত হয়ে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করে দিল। এমনকি উম্মাহ ধ্বংসের রাজপথ তৈরী করে দিল। ফলে হিন্দু ও অন্যান্য জাতি শক্তিশালী হয়ে উঠল আর মুসলমানরা পরস্পর ভ্রাতৃঘাতি হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে ক্ষিন থেকে ক্ষিনতর সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে গেল। সুতরাং জাতি ধ্বংস এবং নিজেদেরকে ধ্বংসের দায় প্রথমে বর্তাবে জামাতের উপর তারপর দেওবন্দীদের উপর। কারণ জামাত অন্যদের শুধরে দেয়া নিজেদের ভুলত্রুটি গুলি তো সংশোধন করলোই না বরং নতুন ফেরকা সৃষ্টি করে উম্মত থেকে বেরিয়ে গেল এবং মওদুদী (রঃ) এর নিশর্ত আনুগত্য করল। (اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ) এর প্রমাণ হচ্ছে তারা মওদুদীর (রঃ) ভুলগুলি সংশোধন না করে বরং সেগুলো সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, অন্যদের থেকে গোপন রাখছে। মওদুদী রচনাবলির অন্ধ অনুসরণ করছে অথচ অন্যদের রচনাকে পাত্তাই দিচ্ছে না, তাদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করছে না। ইত্যাদি কারণে প্রধানতঃ জামাত দায়ী, দ্বিতীয়তঃ দায়ী দেওবন্দীগণ।
কারণ জামাত ইসলামের বুনিয়াদি বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেনি, ফরুয়ী বিষয়ে তাদের সাথে দেওবন্দীদের মতান্তর ঘটে। আর ফুরুয়ী বিষয়ে এখতেলাফ জায়েয। এখন এই জায়েয বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আপোস না করে নিজেদেরকে একমাত্র ইসলামের টীকাদার ভেবে কাউকে মুসলিম জামাত থেকে বের করে দেয়া, ফেরকাবাজি করা, দলাদলির সৃষ্টি করা হারাম, সম্পূর্ণ হারাম যা দেওবন্দীরা করেছেন। কাজেই উক্ত হারাম কাজে জামাতী ও দেওবন্দী উভয় শ্রেনী সমান দোষী। এজন্যই এই দুই শ্রেনী আল্লাহ্র গজবের পাত্র হয়েছে। বাস্তবতায় মনে হয় নিম্নোক্ত আয়াতটি তাদের উদ্দেশ্যেই নাযিল হয়েছে। -(وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَاءُوا بِغَضَبٍ مِّنَ اللَّهِ - দারিদ্রতা ও লাঞ্চনা তাদের ভাগ্যলিপির শামিল করে দেয়া হল আর তারা আল্লাহ্র রোষ টেনে আনল (২:৬১) দেওবন্দীদের উপর আল্লাহ দারিদ্রতা ও লাঞ্চনা ভাগ্যলিপির শামিল করে দিয়েছেন। তারা জাতির ভিক্ষুক শ্রেনী এবং প্রত্যেক সরকার তাদেরকে শাপলা চত্বরসহ বিভিন্ন জায়গায় হত্যা করেছে এবং কোণঠাসা করে রাখছে। তদুপরি তাদেরকে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ অপবাদ দিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। আর জামাতে ইসলামী ইহুদীদের ভাগ্যবরণ করেছে। কারণ ইহুদীদের পৃথিবীর সবাই মারত এবং ঘৃণা করত, দলমত নির্বিশেষে জামাতের সাথেও সবাই একই আচরণ করে চলেছে। তারা ইহুদীদের ন্যায় টাকা জামিয়েছে কিন্তু সেই টাকা নেতাদের জীবন বাঁচাতে ঘুষ দিচ্ছে বা দেশে বিদেশে লবিং গ্রুপিং করার মত অবৈধ খাতে ব্যয় করছে, অথচ দারিদ্র বিমোচন ও অন্যান্য বৈধ খাতে ব্যয় করছে না। এসবই আল্লাহ্র ক্রোধের প্রমাণ। অথচ মূল ধারার এ দুটি বৃহৎ ফেরকা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় তাহলে তারা এ দুর্গতি থেকে মুক্তি পাবে এবং উপমহাদেশসহ বিশ্ব নেতৃত্ব তাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আর এ কাজটি করার জন্যই আমরা মাঠে নেমেছি। আল্লাহ ভরসা।
আয়াতের শিক্ষাঃ উম্মাহর মধ্যে তো বটেই এমনকি আহলে কিতাবের একত্ববাদীদের সাথে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে ভূপৃষ্ঠে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর কোরআন হাদীস ডিঙ্গিয়ে কোন মুরুব্বী বা মুরুব্বীর রচনাবলীর অনুসরণ করে ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়া যাবে না। ফিরকা ও মুরুব্বী মাড়িয়ে কোরানের নির্দেশ ঐক্য ফরয ও বিভক্তি হারাম- এর বাস্তবতায় ফিরে আসতে হবে।
আমাদের দাবীঃ- এখন প্রত্যেক ফেরকার কাছে আমাদের প্রশ্ন- কোরআন কেন নাযিল হয়েছিল ? কোরানের অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য নাকি এর উপর এখতেলাফ করে বিভিন্ন ফিরকায় বিভক্ত হয়ে পরস্পর কামড়া কামড়ি করে ধ্বংস হওয়ার জন্য? আবার রাসূল (সাঃ) কোরানের ভিত্তিতে আরবদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন নাকি বিভক্ত করেছিলেন? আবার কোরআন নাযিল কি ভুল হয়েছে? (নাউযুবিল্লাহ) কারণ কোরআন না থাকলে তো এসব ফিরকা বিভক্তি হত না। আবার কোরআন কি কারো বাপ দাদার তালুকদারী যে, যার যেখানে যেভাবে ইচ্ছা খোড়াখুড়ি শুরু করবে ? উত্তর যদি কোনটা হাঁ বাচক না হয়- তাহলে আমাদের এক কথা এক দাবী ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যারা রাসূলকে বাদ দিয়ে মওদুদী, রেজা খান, ইলিয়াস, নানুতবী, হাসান বান্না ইত্যাদি রাসূলের গোলামদের অনুসরণ করছে এরা কুলাঙ্গার, আল্লাহ ও রাসূলের দুশমন, ইসলামের শত্রু, আত্মসম্ভ্রমহীন অমানুষ। অমানুষ এ জন্য যে, সাধারণ মানুষকে সিজদা করা যেমন ঘৃণার কাজ- তদ্রুপ কোরআন সুন্নাহর নির্দেশ বাদ দিয়ে নবী রাসূল নয় এমন মানুষের নিঃশর্ত আনুগত্য করাও ঘৃণার কাজ। তাদের কোন আত্মসম্ভ্রম নাই। এদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’লা বলেন- .
( ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ ﴿محمد: ٢٨﴾ - এইটিই! কেননা আল্লাহ্কে যা অসন্তুষ্ট করে তারা তারই অনুসরণ করে আর তাঁর সন্তষ্টিলাভকে তারা অপছন্দ করে, সেজন্য তিনি তাদের আমলসমূহ ব্যর্থ করে দেন। (৪৭: ২৮)
ক্ষতিগ্রস্থ ও ব্যর্থ কর্মশীলদের বিবরনঃ ১৯
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا [١٨:١٠٣]
বলুনঃ আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত।
الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا [١٨:١٠٤]
তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিবজীবনে ব্যর্থ হয়েছে, অথচ তারা মনে করে যে, তারা উত্তমকর্মই সম্পাদন করেছে। ﴿١٠٤﴾
মুফাসসিরীনে কেরামের মতামতঃ এ আয়াতগুলি পরিত্যক্ত। কারণ বর্তমানের আলেম সমাজ আয়াতগুলিকে ইহুদী, খৃষ্টান ও কাফের মুশরেকদের জন্য প্রযোজ্য ঘোষণা দিয়ে বর্জন করেছেন। অথচ মুফাসসিরীনে কেরামের কেউ এমনটি করেননি, তারা এগুলিকে ব্যাপকার্থে প্রয়োগ করেছেন- নিচের আলোচনাতেই তা বুঝা যাবে।
বস্তুত উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেছেন ইহুদি নাসারা উদ্দেশ্য, কেউ বলেছেন মক্বার কাফেররা, কেউ বলেছেন ইহুদী খৃষ্টান পোরুহিত- রাব্বীরা উদ্দেশ্য, তবে সঠিক কথা হচ্ছে আয়াতগুলি ব্যাপকার্থক বিধায় মুসলিম অমুসলিম সকলের জন্য প্রযোজ্য হবে।
যেমন ঈমাম তাবারী বলেন, والصواب من القول في ذلك عندنا، أن يقال: إن الله عزّ وجلّ عنى بقوله (هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالأخْسَرِينَ أَعْمَالا) كلّ عامل عملا يحسبه فيه مصيبا، وأنه لله بفعله ذلك مطيع مرض، وهو بفعله ذلك لله مسخط، وعن طريق أهل الإيمان به جائر كالرهابنة والشمامسة وأمثالهم من أهل الإجتهاد في ضلالتهم، وهم مع ذلك من فعلهم واجتهادهم بالله كفرة، من أهل أيّ دين كانوا.
অর্থাৎ আমাদের নিকট সঠিক মনে হচ্ছে, অত্র আয়াত দ্বারা আল্লাহ তা’লা উদ্দেশ্য নিয়েছেন এমন প্রত্যেক আমলকারি যে স্বীয় আমলকে সঠিক মনে করে এবং স্বীয় আমল দ্বারা আল্লাহর আনুগত্য কারী এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট কারী মনে করে। অথচ তার সেই কর্ম দ্বারা সে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে। আর ঈমানদাররা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করার পদ্ধতি হচ্ছে, স্বীয় কর্মে সীমালঙ্ঘন করা। যেমন বৈরাগ্যবাদ ও যাজকত্ব গ্রহণ করা এবং মুজতাহিদ কর্তৃক অনুরুপ ভ্রান্ত ইজতিহাদ করা। তারা নিজেদের কর্ম ও ইজতিহাদ দ্বারা আল্লাহর সাথে কুফুরী করে, তা তারা যে কোন ধর্মের অনুসারী হউক না কেন।
ইমাম ইবনে কাছির বলেন, হযরত আলী (রাঃ) প্রভৃতি সাহাবীদের মতে এর দ্বারা খারেজীরা উদ্দেশ্য। ভাবার্থ এই যে, এই আয়াত দ্বারা যেমন ইহুদী ও খৃষ্টানরা উদ্দেশ্য, অনুরূপভাবে খারেজীরাও এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, আয়াতটি ব্যাপকার্থক। যে কেউই আল্লাহ তা’লার ইবাদত ও আনুগত্য ঐ পন্থায় করবে, যে পন্থা আল্লাহ তা’লার নিকট পছন্দনীয় নয়, তারা সবাই এই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। যদিও তারা নিজেদের আমলে খুশী হয় এবং মনে করে নেয় যে, তারা আখেরাতের পাথেয় অনেক কিছু সংগ্রহ করে নিয়েছে এবং তাদের নেক আমল আল্লাহ তা’লার নিকট পছন্দনীয় ও তাদের সৎ আমলের বিনিময় তারা অবশ্যই লাভ করবে। কিন্তু তাদের এই ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। তাদের আমল আল্লাহ তা’লার নিকট গ্রহণীয় নয়, বরং বর্জনিয়। তারা ভুল ধারনাকারী লোক।
এগুলি মক্বায় অবতীর্ণ আয়াত। আর এটা স্পষ্ট যে, মক্বায় নাযিলকৃত আয়াতগুলি দ্বারা যেমন ইহুদী খৃষ্টান সম্ভোদিত নয় তদ্রুপ তখন খারেজীদের অস্তিত্ব ছিল না বিধায় তারাও সম্ভোদিত নয়। কাজেই উক্ত আয়াত দ্বারা ইহুদী, খৃষ্টান, খারেজী ও তাদের মত অন্যান্য যারা আছে সবাই উদ্দেশ্য হবে।
তারপর ইমাম ইবনে কাছির কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করে বলেন, এরা ঐ সব লোক যারা নিজেদের পন্থায় ইবাদত ও আমল তো করে এবং মনেও করে যে, তারা অনেক কিছু পুণ্যময় কাজ করলো এবং সেগুলো আল্লাহ তা’লার নিকট গ্রহণীয় ও পছন্দনীয়। কিন্তু তাদের ঐ আমলগুলো আল্লাহ তা’লার নির্দেশিত পন্থায় ছিল না এবং তাঁর রাসূলের (সাঃ) নির্দেশ মুতাবেকও ছিল না বলে সেগুলো গ্রহণীয় হওয়ার পরিবর্তে বর্জনীয় হয়ে গেলো এবং প্রিয় হওয়ার পরিবর্তে অপ্রিয় ও অপছন্দনীয় হয়ে গেলো। কেননা, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতো।
বাস্তব প্রয়োগঃ- কোরান সার্বজনিন সর্বকালিন। কাজেই উক্ত আয়াত মুসলিম অমুসলিম সকল সম্প্রদায়ের উপর সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। অত্র আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেন যারা মনে করে যে, তারা উত্তম কর্ম সম্পাদন করছে অথচ এ কর্মের কারণেই তারা ক্ষতিগ্রস্থ এবং তাদের সকল কর্ম প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এখন অত্র আয়াত বাস্তবতায় প্রতিস্থাপন করলে আমরা দেখতে পাই, ইসলামের প্রতিটি ফেরকা এ আয়াতের প্রতিপাদ্য হয়েছে। যেমন মিসরের ব্রাদারহুড ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ। শহীদ হাসান বান্না, সায়্যেদ কুতুব থেকে নিয়ে বর্তমান পর্যন্ত হাজার হাজার নেতা কর্মিকে হত্যা করা হয়েছে। জেল, যুলুম, নির্যাতন অর্থনৈতিক ক্ষতির কোন সীমা পরিসীমা নাই। যেমন জয়নব আল গাযালি লিখিত কারাগারে রাতদিন বইটিতে পাশবিক নির্যাতনের কিছুটা চিত্র ফুটে উঠেছে। আবার ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য শতাব্দি ব্যাপি তাদের যে চেষ্টা প্রচেষ্টা, ত্যাগ তিতিক্ষা সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, ক্ষমতায় এসেও তারা টিকে থাকতে পারেনি। অথচ তারা মনে করে সঠিক কর্মপন্থাই তারা অবলম্বন করেছে।
ভারত বর্ষে জামাতে ইসলামির অসংখ্য নেতা কর্মিকে হত্যা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। জান মাল উভয় দিক থেকে তারা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ। পৌনে এক শতাব্দি ব্যাপি ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তাদের চেষ্টা তদবির কুরবানি সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। অথচ তারা মনে করে যে, সঠিক কর্ম প্রচেষ্টাই তারা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার দেওবন্দীরা তো সম্পূর্নই ব্যর্থ, তারা তো দেশের নাগরিক হিসাবেই গন্য নয়। কারণ স্কুলে একটি ছেলে ৮ম/১০ম শ্রেণী পাস করে একটি চাকরি পেতে পারে কিন্তু দেওবন্দী ধারায় সাড়া জীবন লেখা পড়া করেও সরকারি খাতায় সে নিরক্ষর এবং জাতীয় খেদমত তথা চাকরির জন্য অযোগ্য। সংবিধানের সমানাধিকারের অপ্রাপ্তি প্রমাণ করে যে, তারা নাগরিক নয়। আবার যে দলই ক্ষমতায় যায়- সবাই তাদেরকে মারে, হত্যা করে, জঙ্গি মৌলবাদী ইত্যাদি বলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, অন্যান্য জুলুম নির্যাতন তো আছেই। বিশেষত শাপলা চত্বরে তাদের উপর চালানো হয় শতাব্দির ভয়াবহ গণহত্যা। অথচ দেওবন্দীরা মনে করে তারা ইসলামের জন্য নিজেদের জীবন যৌবন উৎসর্গ করে উত্তম কর্ম সম্পাদন করে যাচ্ছে। এভাবে যতগুলি ফিরকা আছে পার্থিব জীবনে তাদের সকল কর্ম- প্রচেষ্টা ব্যর্থ এবং তারা জান ও মালের দিক দিয়ে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ। আবার ফিরকাবাজির কারণে তাদের পরকালও শঙ্খামুক্ত নয়।
একজন দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, এ ব্যর্থতার কারণ কী, তাহলে কী কেউ ইসলামী আন্দোলন করবে না? মোজাহিদ বলল, ‘হ্যাঁ করবে, অবশ্যি করবে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করা ফরয। তবে তা করতে হবে কোরান-সুন্নাহ নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতিতে। আর সে পদ্ধতিটি হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করা। ঐক্যহীনতার কারণেই ইসলাম ও ইসলামী দলগুলি পরম্পরায় মার খেয়ে যাচ্ছে, জান- মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। আর এভাবে তারা মারও খেতে থাকবে ইসলামও প্রতিষ্ঠিত হবে না- যতক্ষন পর্যন্ত না তারা ঐক্যবদ্ধ হয়। যেমন আল্লাহর নির্দেশ,-. أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ. অর্থাৎ বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর)। কাজেই ঐক্য হলে চোখের পলকে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, এ জাতি গোলামীর আসন থেকে প্রভুত্বের আসনে অভিষিক্ত হবে।
আরেকজন দাঁড়িয়ে ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘আপনি জামাত হেফাযত ও ব্রাদারহুডের যেসব ভাইয়েরা ইসলামের জন্য জীবন দিয়েছ- তাদের প্রতি এমন অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে পারেন না, এটা শহীদদের প্রতি অবমাননা। মোজাহিদ সহসা মাথা চেপে ধরে চেয়ারে বসে পড়ল। টুপি খোলে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘একটু পানি খাব। তখন তার প্রিয় ছাত্র জামাল দৌড়ে গেল পানি আনতে। পানি খেয়ে সে উঠে দাঁড়াল, তার চোখ দুটি চিতার চোখের মত জ্বলছে, লাল টকটক করছে। তারপর সে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, আসলে আমি একটু আবেগ তাড়িত মানুষ, আপনার প্রশ্নটা শুনেই হঠাৎ মাথায় রক্ত উঠে গেল। খোদার কসম, আমি যদি আমাদের শহীদ ভাইদের প্রতি অবজ্ঞা করি তাহলে আমি মুসলমান তো দুরের কথা মানুষই থাকলাম না। যাই হউক, আপনি সম্ভবত আমাদের এ মজলিসের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জানেন না, তাহলে শুনুন।
আমি ঢাকায় একটা মাদরাসায় পড়তাম, সেখানে আমার ক্লাসমেট একজন বন্ধু ছিল, সে জীবনে আমার অনেক উপকার করেছে। আমি তাকে আমার ভাইয়ের চেয়ে এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও অধিক ভালবাসতাম। শাপলা চত্বরে দুজন একসাথেই গিয়েছিলাম কিন্তু কার দুর্ভাগ্য জানি না, আমি ফিরে আসলাম সে ফিরে আসল না। এরপর থেকে আমি কিছুটা মেন্টাল হয়ে গেলাম। কি হল, কেন হল, কেন ইসলাম ও ইসলাম পন্থীদের এ পতন, এ থেকে উত্তরনের কী কোন উপায় নেই- সব সময় মাথায় এসব চিন্তা গিজগিজ করত। আমার মনে হল যেন আমি মানসিক ভারসাম্য হারাতে যাচ্ছি।
এক সময় ময়মনসিংহে আসলাম । তখন শুনতে পেলাম নদীর তীরে একটা মসজিদে এক লোক উলটা পালটা কথা বলে। কৌতুহল বশে একদিন গেলাম, দেখলাম এশার পর একজন লোক কথা বলছেন, সামনে পঁচিশ ত্রিশজন বসা। আমিও সকলের পিছনে বসে পড়লাম। এদিন তিনি আলোচনা করছিলেন, ‘ফিরকাবাজির পরিনতি জামাত হেফাযত হত্যাকাণ্ড’। আমার মনে হল সারা জীবন ধরে আমি যা খুঁজছি তা পেয়ে গেছি। আমি এতটাই আবেগ তাড়িত হয়ে উঠলাম যে, বক্তব্য শেষে আমি গিয়ে উস্তাদজির হাত ধরে কেঁদে ফেললাম আর বললাম, আজ থেকে আমি আপনার শিষ্য। এরপর আমি আমার ছাত্র ও অন্যান্য লোকদের জড়ো করা শুরু করলাম। স্থান সংকুলন হয় না, এই ঘর ডাঃ ফখরুজ্জামান সাব অন্যত্র ভাড়া দিবেন। তিনিও উস্তাদজির ভক্ত। আমি অনেক দৌড়াদৌড়ি করে, অনেক বলে কয়ে তাকে বিনা ভাড়ায় রাজি করালাম। তারপর আমরা এই ঘরে আমাদের মজলিস স্থানান্তর করলাম।
আর এই মজলিসের পিছনে সকলের উদ্দেশ্য হছে, মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলাম ও উম্মতের মুক্তির লক্ষে একটা কেন্দ্রিয় খেলাফত বা মুসলিম জাতিসংঘ বা আফ্রেশিয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা। তবে আমার আরেকটা উদ্দেশ্য আছে। তা হলো ইনকুইজিশন কোর্ট বা শরীয়া আদালত গঠন করে জামাত ও হেফাযত নেতৃবৃন্দের বিচার করা। কারণ জামাত ও হেফাযত হত্যাকাণ্ডের জন্য সম্পুর্ণ তারা দায়ি, তাদের ফিরকাবাজির কারনেই ইসলাম ও আমাদের উপর খোদার গজব নেমে এসেছে। সামনে আলোচনা আসছে, শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) এর আগে ভারতবর্ষে কোন ফিরকা ছিল না, সবাই সুন্নি হানাফি মুসলমান ছিল। পরবর্তিতে বেরেলভীরা এ জামাত থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু বৃহত্তর উম্মাহ তখনো দেওবন্দ কেন্দ্রিক ঐক্যবদ্ধ ছিল। এরপর মাওঃ মওদুদি (রঃ) ইসলামের উপর ব্যাপক গবেষণা ও লেখালেখি শুরু করলেন, তিনি ইসলামের সর্বাধুনিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিতে লাগলেন। এতে তার কিছু ভুল হল এবং নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হল।
স্বাধিনতা উত্তর বাংলাদেশের দেওবন্দি মুরুব্বিরা একসাথে ইসলামী আন্দোলন করার আহ্বানে জামাত নেতৃবৃন্দকে শর্ত দিলেন, মাওঃ মওদুদীর ভুলগুলি বাদ দিলে ঐক্য হবে, নচেৎ হবে না। তখন জামাত নেতৃবৃন্দ কেটে পড়ল আর দেওবন্দিরাও সরে গেল। তাদের মধ্যে যোজন যোজন দুরুত্ব তৈরি হয়ে গেল। এখানে উভয় দল সীমালঙ্ঘন করল। কারণ বিতর্কিত বিষয় হল, নবীগনের মাসুমিয়্যাত ও সাহাবায়ে কেরামের সত্যের মাপকাঠি তত্ত্ব। এগুলি শরীয়তের বুনিয়াদি কোন বিষয় নয়, ফুরুয়ি বা শাখাগত বিষয়। কাজেই জামাত এগুলি বাদ দিলে কোন সমস্যা ছিল না, আর দেওবন্দিরা এগুলিসহ ঐক্যবদ্ধ থাকলেও কোন সমস্যা ছিলনা। কিন্তু তারা জায়েয বিষয়ে বিতর্ক করে ফিরকাবাজির মত হারামে লিপ্ত হলেন।
এভাবে ইসলামের মুল ধারাটা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল, মাদরাসা পড়ুয়ারা দেওবন্দি থাকল আর স্কুল কলেজ ভার্সিটি ও আলিয়া পড়ুয়ারা জামাতে যোগ দিল । আর উভয় দলের নেতৃবৃন্দ মানুষ হত্যার দোকান খুলল। কিছুদিন পরপর তারা ডাক মারে, কোথায় গো আমাদের উম্মতেরা, ইসলাম গেলো তাড়াতাড়ি এসো। তখন আমরা সরল মনে তাদের এক্তেদা করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি, আর তাগুত আমাদের রক্তে পিয়াসি মাটির তৃষ্ণা মিটায়। এইভাবে তারা হত্যা করিয়ে ও রক্ত ঝরিয়ে আমাদের রক্ত খেয়ে শান্ত হয়ে যায়। এরপর আর ইসলামের খোজ খবর থাকে না। কাজেই বুঝা যাচ্ছে হেফাজত ও জামাত হচ্ছে মানুষ হত্যার দোকান। অথচ এই বৃহৎ দুটি ফেরকা যদি এক থাকত তাহলে তারাই সরকারে থাকত। তখন আর কোন ইসলাম পন্থির রক্তও ঝরত না আর ইসলামও ঠিক থাকত। সুতরাং প্রমানিত হল, এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য মুল দায়ি এসব ফেরকাবাজ নেতৃবৃন্দ। এজন্যই আমার লক্ষ হচ্ছে ইনকুইজিশন কোর্ট গঠন করে এদের বিচার করা ও শহীদ পরিবার গুলিকে দিয়ত (ক্ষতিপূরণ) আদায় করে দেয়া।
এখন আমার প্রশ্ন হল, ইসলাম তো কারোর একার নয়, হেফাজত জামাত সুন্নী তরিকতী সকলেরই সমান। অথচ তাদের ঐক্যহীনতা, গোঁড়ামি ও কোরানের নির্দেশ বর্জনের ফলে আজ ইসলামের সন্তানরা মার খাচ্ছে আর দাজ্জালের সন্তানরা নেতৃত্ব করছে। আর কোন মুমিনের পক্ষে এ অবস্থা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। কাজেই আমার প্রশ্ন হল, যাদের কারনে ইসলাম ও ইসলামের সন্তানরা মার খাচ্ছে তাদের বিচার প্রয়োজন কিনা- সবাই জবাব দেন। সকলেই সমস্বরে বলল, হাঁ হাঁ প্রয়োজন।
ফেরকা ও মাযহাবি গ্রন্থাবলির ভিত্তিতে সবাই দ্বীনকে বিভক্ত করল আর প্রত্যেকেই স্ব স্ব মতবাদে সন্তুষ্ট।
وَإِنَّ هَٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ [٢٣:٥٢] فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُم بَيْنَهُمْ زُبُرًا ۖ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ [٢٣:٥٣] فَذَرْهُمْ فِي غَمْرَتِهِمْ حَتَّىٰ حِينٍ [٢٣:٥٤]
১। আপনাদের এই উম্মত সব তো একই ধর্মের অনুসারী এবং আমি আপনাদের পালনকর্তা; অতএব আমাকে ভয় করুন। ২। অতঃপর মানুষ তাদের দ্বীনকে কিতাবাদির ভিত্তিতে বহুধা বিভক্ত করে দিয়েছে। প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত হচ্ছে। ৩। অতএব তাদের কিছু কালের জন্যে তাদের অজ্ঞানতায় নিমজ্জিত থাকতে দিন।
মুফাসসিরীনে কেরামের মতামতঃ
ইমাম ইবনে জরির তাবারি বলেন, আল্লাহ তা’লা সকল নবীর উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন একক দ্বীন ও একক মিল্লাতের (জাতি) উপর একত্র থাকতে এবং সকল আসমানি কিতাব মেনে নিতে কিন্তু তারা বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হয়ে গেল। আর প্রত্যেক জাতি নিজেদের কিতাব মেনে নিল কিন্তু অন্য জাতীর কিতাব প্রত্যাখ্যান করল। যেমন ইহুদীরা তওরাতের বিধান মেনে নিল কিন্তু ইঞ্জিল ও কোরান প্রত্যাখ্যান করল। তদ্রুপ নাসারারা ইঞ্জিলের বিধান গ্রহন করল কিন্তু কোরান প্রত্যাখ্যান করল। দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় তিনি মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে বলেন, তারা দ্বীনকে বিভক্ত করল কিতাবাদির ভিত্তিতে- যেগুলি তারা নিজেদের মযহাব প্রতিষ্ঠার জন্য দলীল আদিল্লা হিসাবে লিপিবদ্ধ করেছে। ইবনে যায়েদ বলেন, দ্বীন এবং কিতাবের মধ্যে এখতেলাফের অর্থ এটাই। তারা নিজেদের মতবাদে চমতকৃত হয়। বিশেষত প্রবৃত্তির অনুসারী বেদাতিরা নিজেদের মতবাদে সন্তুষ্ট। এটা গুরুত্বপুর্ণ কথা।
ব্যাখ্যাঃ অত্র ব্যাখ্যায় বুঝা গেল, প্রত্যেক ফেরকা নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রন্থাবলি রচনা করেছে আর এতে তারা সন্তুষ্ট।
ইমাম বগবি বলেন, পুর্ববর্তি উম্মতরা আসমানি কিতাবকে বিভক্ত করল, একে অন্যের কিতাব মেনে নিল না। অথবা নিজেদের কিতাবকেই খণ্ড বিখন্ড করল, কিছু অংশ মানল, কিছু প্রত্যাখ্যান করল আর কিছু তাহরিফ (পরিবর্তন) করল।
ইমাম কুরতুবি উক্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তিনটি ব্যাখ্যা দিয়ে চতুর্থ ব্যাখ্যায় বলেন,
لرَّابِعَةُ- هَذِهِ الْآيَةُ تَنْظُرُ إِلَى قَوْلِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: (أَلَا إِنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ افْتَرَقُوا عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَإِنَّ هَذِهِ الْأُمَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِينَ ثِنْتَانِ وَسَبْعُونَ فِي النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَهِيَ الْجَمَاعَةُ) الْحَدِيثُ. خَرَّجَهُ أَبُو داود، ورواه التِّرْمِذِيُّ وَزَادَ: قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: (مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي) خَرَّجَهُ مِنْ حَدِيثِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو. وَهَذَا يُبَيِّنُ أَنَّ الِافْتِرَاقَ الْمُحَذَّرَ مِنْهُ فِي الْآيَةِ وَالْحَدِيثِ إِنَّمَا هُوَ فِي أُصُولِ الدِّينِ وَقَوَاعِدِهِ،
অর্থাৎ অত্র আয়াত রাসূল (সাঃ) এর সেই বানীর দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করছে- যেখানে তিনি বলেন, সাবধান, তোমাদের পুর্বের আহলে কিতাবরা ধর্মের ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি করে ৭২ ফিরকায় বিভক্ত হয়েছিল। আর এ উম্মত ৭৩ ফিরকায় বিভক্ত হবে। ৭২ ফেরকাই জাহান্নামে যাবে তবে একটি দল জান্নাতে যাবে, তারা হল জামাত বা ঐক্যবদ্ধ দল (আবু দাউদ)। তিরমিযির বর্ণনায় অতিরিক্ত এসেছে قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: (مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي)
অর্থাৎ সাহাবাগন জিজ্ঞেস করলেন, মুক্তি প্রাপ্ত দলটি কারা হে আল্লাহ্র রাসুল? তিনি উত্তর দিলেন, আমি এবং আমার সাহাবিগন যার উপর আছি- যারা এর (ঐক্যের) উপর থাকবে। তারপর ইমাম কুরতুবি বলেন, উক্ত আয়াত ও হাদীসে বিভক্তি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। কারণ ঐক্য হল দ্বীনের মূল এবং ভিত্তি।
বাস্তবতাঃ আয়াতে উল্লেখিত উম্মাতুকুম অর্থ মিল্লাতুকুম বা শরিয়াতুকুম, আর যুবুর অর্থ কিতাবাদি। অর্থাৎ তোমরা একই মিল্লাত ও একই শরীয়াতের অনুসারী। কিন্তু তারা কিতাবাদির ভিত্তিতে নিজেদের দ্বীনকে বিভক্ত করে দিল। মুফাসসিরিনে কেরাম উক্ত আয়াত দ্বারা যেমন পুর্ববর্তি উম্মতদের উদ্দেশ্য নিয়েছেন তদ্রুপ উম্মতে মুহাদ্দাদিকেও উদ্দেশ্য করেছেন। কাজেই বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাই, প্রত্যেক ফেরকা নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রন্থাবলি রচনা করেছে, তারপর ফিরকায় বিভক্ত হয়ে গেছে। যেমন তাবলীগের জন্য ফাযায়েলে আমল প্রণয়ন করা হয়েছে, এখন তারা অন্য কোন বই পুস্তক তো পড়েই না এমনকি কোরান হাদীস ও পড়ে না, কোরান তা’লিম করে না, এর প্রয়োজনও বোধ করে না, তারা মনে করে তাবলীগই একমাত্র ইসলাম। মনে হয় যেন ফাযায়েলে আমলই একমাত্র তাদের কিতাব ও ধর্মগ্রন্থ।
আবার আমাদের দেওবন্দিদের অবস্থা হল, আমরা একটা সিলেবাস প্রণয়ন করেছি আর এটাকেই একমাত্র ইসলাম মনে করছি। যদিও এই সিলেবাস কোরান হাদীস বুঝার জন্য যথেষ্ট উপকারী কিন্তু এই সিলেবাসে বিরাট ত্রুটি আছে। এখানে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান পড়ানো হয় না, ফলে বিজ্ঞান সংক্রান্ত কোরান হাদীসের নস গুলি পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বিষয়টা দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ বিধায় ত্যাগ করলাম, পরে বিস্তারিত আলোচনা হবে। যাই হউক আমাদের দেওবন্দি মুরুব্বিরা বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থাদি রচনা করেন, আমরা দেওবন্দিরা এসব বই পুস্তক পড়ি। এর বাইরে অন্য কোন ফেরকার বই তো পড়িই না এমনকি হারাম মনে করি। যেমন আমাদের কোন ছাত্রের কাছে মাওঃ মওদুদীর তাফহিমুল কোরান পাওয়া গেলে তাকে মাদরাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। কাজেই অন্য কোন ফেরকার বই পড়া আমরা নিজেদের জন্য হারাম করে নিয়েছি।
জামাতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মাওঃ মওদুদির বই দিয়ে সিলেবাস প্রনয়ন করা হয়েছে, এই সিলেবাসে ব্রাদারহুডের হাসান বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব শহিদ ও অন্যান্য কিছু আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদদের গ্রন্থাদি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে। এর বাইরে দেওবন্দি বেরেলভী তাবলীগী ইত্যাদি অন্য কোন ফেরকার বই তারা স্পর্শও করে না।
তদ্রুপ বেরেলভী ধারার কিছু বই পুস্তক আছে, ধর্ম পুস্তক হিসাবে তারা সেগুলিই পাঠ করে। অন্য কোন ফেরকার বই স্পর্শ করলেও নাকি তাদের অজু নষ্ট হয়ে যায়। সুফিবাদি ও মাযার পন্থীরা জালালুদ্দিন রুমি ও ফরীদ আত্তারের মরমিবাদ থেকে সংকলন করে কিছু গ্রন্থাদি রচনা করেছে। এগুলিই তাদের ধর্ম গ্রন্থ। এর বাইরে তারা কোরান হাদীস ও পড়ে না, অন্য কোন ফেরকার গ্রন্থ স্পর্শও করে না। আর আহলে হাদীসরা স্ব মুরুব্বীদের লিখিত কিতাবাদি ছাড়া অন্য কারো কিতাব পড়ে না। বিশেষত দেওবন্দি ও সুফিবাদিদের কিতাব তাদের কাছে কুফুরি কালামের মত ঠেকে। যাই হউক উম্মতে মুহাম্মদির প্রতিটা ফেরকা নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রন্থাবলি রচনা করেছে। আর এসব গ্রন্থই তাদের মুল ধর্মগ্রন্থ, কোরান হাদীস তারা পিছনে নিক্ষেপ করেছে।
এর প্রমাণ হল, কোরান সুন্নাহ ডাকছে ঐক্যের পথে আসো, বিভক্তি করো না কিন্তু তারা স্ব স্ব ফেরকার গ্রন্থাবলির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফেরকাবন্দি হয়ে আছে। কোরান সুন্নাহর আহ্বান বর্জন করেছে। কাজেই বাস্তবতা প্রমান করে যে, কোরান হাদীস তাদের আসল ধর্মগ্রন্থ নয়, আসল ধর্মগ্রন্থ হল ফেরকার গ্রন্থাবলী। কাজেই তাদের মুরুব্বীদের লিখিত স্ব স্ব ফেরকার গ্রন্থাবলী কোরানের ন্যায় যত্ন সহকারে পাঠ করে। আর মুরুব্বীদের কথা গুলি যাচাই বাচাই ব্যতীত নবী রাসূলের কথার মত মেনে চলে, নিঃশর্ত আনুগত্য করে। কিন্তু অন্য কোণ ফেরকার গ্রন্থাবলী তারা স্পর্শও করে না, কিফুরি কালাম মনে করে, এমনকি স্পর্শ করলেও নাকি তাদের গায়ে নাপাকি লেগে যায়। আর প্রতি পক্ষ ফেরকার মুরুব্বীদের তারা আযাযিল, দাজ্জাল ও আবু জেহেল মনে করে এবং ঐরূপ ঘৃনা করে।
বিশেষত আন্তসম্প্রদায় গুলি যেখানে একে অন্যের ধর্ম গ্রন্থ পাঠ করে, যেমন আমরা বেদ পুরান বাইবেল পাঠ করি, তারাও আমাদের কোরান পাঠ করে কিন্তু মুসলিম ফেরকাগুলি একে অন্যের বই পুস্তক পড়ে না। এটা তারা জায়েয মনে করে না। কাজেই প্রমানিত হল উক্ত আয়াতের প্রতিপাদ্য হল মুসলিম ফিরকাগুলি। তারা ছিল একই দ্বীন একই কিতাবের অনুসারী একক উম্মাহ। কিন্তু তারা বিভিন্ন মতবাদ জন্ম দিয়ে বিভিন্ন কিতাবাদি রচনা করে ফিরকা প্রতিষ্ঠিত করে অসংখ্য দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে। কাজেই আল্লাহ তাদেরকে ঢিল দিয়েছেন, পরকালে পাকড়াও করবেন। সবাই জবাব দিন ঠিক বললাম কিনা। সকলে সমস্বরে জবাব দিল, হা হা ঠিক বলেছেন। মোজাহিদ বলল, উস্তাদজি উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হল ফেরকাবাজরা আপনি এ রায় ঘোষণা করুন। হাসান মুসান্না দাঁড়িয়ে সর্বসম্মতিক্রমে রায় ঘোষণা করল।
বিষয়: রাজনীতি
৮৯৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন