সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ১৭

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:২১:১৮ দুপুর

ফিরকাবাজরা ধর্মগুরুদের রব হিসাবে গ্রহণ করেছে – ১৭

(اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ ﴿التوبة: ٣١﴾ তারা আল্লাহ্‌কে ছেড়ে দিয়ে তাদের পোরুহিত ও ধর্মগুরুদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে, আর মরিয়ম-পুত্র মসীহ্‌কেও অথচ শুধু এক উপাস্যের উপাসনা করা ছাড়া অন্য নির্দেশ তাদের দেয়া হয়নি। তিনি ছাড়া অন্য উপাস্য নেই। তাঁরই সব মহিমা - তারা যেসব অংশী দাঁড় করায় সে-সব থেকে তিনি মুক্ত? (৯: ৩১)

وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ فَإِن تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ ﴿آل‌عمران: ٦٤﴾ -- আর আমাদের কেউ আল্লাহ্ ছাড়া নিজেদের পরস্পরকে রব হিসাবে গ্রহণ করবো না।’’ কিন্তু তারা যদি ফিরে যায় তবে বলো -- ''সাক্ষী থাকো, আমরা কিন্তু মুসলিম।’’ (৩: ৬৪)

তাফসীর কারকদের মতামতঃ আহবার শব্দটি হিবর এর বহুবচন। হিবর অর্থ মিদাদ বা কালি। এ জন্যই লোকেরা মিদাদু হিবর দ্বারা মিদাদু উলামা অর্থাৎ বিদ্বানের কলমের কালি অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। ইমাম কুরতুবী বলেন, হিবর বা হাবর হল সেই ব্যক্তি যে অলংকার পূর্ণ ও ছন্দবদ্ধ কথা বলে, নিখুত ভাষায় বক্তব্য দেয়। কিন্তু পরিভাষায় ইহুদী আলেমগণকে আহবার বলা হয়। আর রুহবান শব্দটি রাহেব এর বহুবচন, অর্থ যে আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে স্বীয় নিয়ত বিশুদ্ধ করে, ইবাদতে সময় ব্যয় করে এবং উপযুক্ত আমল করে। পরিভাষায় নাসারাদের আলেম ও মুজতাহিদগণকে রাহেব বলা হয়। এখানে ইহুদী নাসারারা তাদের পোরুহিত রাব্বাইদের রব হিসাবে গ্রহণ করার অর্থ এ নয় যে তারা ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে সেজদা করত, উপাসনা করত, রোজা রাখত, পূজা করত বরং এর অর্থ হল আল্লাহ যা হালাল করেছেন পোরুহিতরা তা হারাম করত এবং তারাও তা মেনে নিত। আর আল্লাহ যা হারাম করেছেন ধর্মগুরুরা তা হালাল করত আর অনুসারীরাও তা মেনে নিত। এ সম্পর্কে একাধিক সনদে বর্ণিত হাদীস--

عن عدي بن حاتم قال: أتيت رسولَ الله صلى الله عليه وسلم وفي عُنُقي صليبٌ من ذهب، فقال: يا عديّ، اطرح هذا الوثنَ من عنقك! قال: فطرحته، وانتهيت إليه وهو يقرأ في "سورة براءة"، فقرأ هذه الآية: (اتخذوا أحبارهم ورُهبانهم أربابًا من دون الله) ، قال قلت: يا رسول الله، إنا لسنا نعبدُهم! فقال: أليس يحرِّمون ما أحلَّ الله فتحرِّمونه، ويحلُّون ما حرَّم الله فتحلُّونه؟ قال: قلت: بلى! قال: فتلك عبادتهم!

عن عدي بن حاتم قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقرأ "سورة براءة"، فلما قرأ: (اتخذوا أحبارهم ورهبانهم أربابًا من دون الله) ، قلت: يا رسول الله، إما إنهم لم يكونوا يصلون لهم! قال: صدقت، ولكن كانوا يُحلُّون لهم ما حرَّم الله فيستحلُّونه، ويحرّمون ما أحلّ الله لهم فيحرِّمونه

অর্থাৎ আদী বিন হাতেম (রাঃ) থেকে বণির্ত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূল (সাঃ) এর নিকট আগমন করলাম, তখন আমার গলায় স্বর্ণ নির্মিত একটি ক্রুশ ঝুলানো ছিল। তিনি বললেন, ‘হে আদী তোমার গলা থেকে এ মূর্তি দূরে নিক্ষেপ কর। আমি তা নিক্ষেপ করলাম। আমি পৌঁছার সময় তিনি উক্ত আয়াতটি পাঠ করতেছিলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আমরা তো আমাদের আলেমদের ইবাদত করি না, অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমরা তো তাদের উদ্দ্যেশ্যে নামাজ পড়ি না। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন ‘ঠিকই বলেছ। কিন্তু আল্লাহ যা হালাল করেছেন তারা যখন তা হারাম করে তখন কি তোমরা তা হারাম হিসাবে মেনে নাও না, আবার আল্লাহ যা হারাম করেছেন তারা যখন তা হালাল করে তখন কি তোমরা তা হালাল হিসাবে মেনে নাও না ? তখন আমি বললাম ‘জী হাঁ। রাসূল (সাঃ) বললেন ‘তাদের ইবাদত করার অর্থ এটাই।

عن حذيفة: أنه سئل عن قوله: (اتخذوا أحبارهم ورهبانهم أربابًا من دون الله) ، أكانوا يعبدونهم؟ قال: لا كانوا إذا أحلُّوا لهم شيئًا استحلوه، وإذا حرَّموا عليهم شيئًا حرَّموه.

سأل رجل حذيفة فقال: يا أبا عبد الله، أرأيت قوله: (اتخذوا أحبارهم ورهبانهم أربابًا من دون الله) ، أكانوا يعبدونهم؟ قال: لا كانوا إذا أحلُّوا لهم شيئًا استحلُّوه، وإذا حرَّموا عليهم شيئًا حرَّموه.

عن حذيفة: (اتخذوا أحبارهم ورهبانهم أربابًا من دون الله) ، قال: لم يعبدوهم، ولكنهم أطاعوهم في المعاصي. (1)

অর্থাৎ হযরত হুযায়ফা (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, ইহুদি খৃষ্টানরা কি তাদের আলেমদের ইবাদত করত ? উত্তরে তিনি বললেন, না বরং তাদের আলেমরা যা হারাম করত তারাও তা হারাম হিসাবে মেনে নিত আর যা হালাল করত তারাও হালাল হিসাবে মেনে নিত। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর অবাধ্যতায় তারা আলেমদের আনুগত্য করত।

قال عبد الله بن عباس: لم يأمروهم أن يسجُدوا لهم، ولكن أمروهم بمعصية الله، فأطاعوهم، فسمَّاهم الله بذلك أربابًا.

عن ابن عباس قوله: (اتخذوا أحبارهم ورهبانهم أربابًا من دون الله) ، يقول: زيَّنُوا لهم طاعتهم.

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, তাদের আলেমরা নিজেদেরকে সিজদা করার হুকুম করত না বরং তারা আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ দিত আর অনুসারীরাও তা মেনে নিত এবং আলেমদের আনুগত্যে আত্নপ্রসাদ লাভ করত।

এখানে তাফসীরে ফাতহুল কাদির এর ব্যাখ্যাটি যুগোপযোগি মনে হচ্ছে বিধায় তা হুবহু তুলে ধরা হল। গ্রন্থকার বলেন, উক্ত আয়াতে আল্লাহ্‌র দ্বীনের ক্ষেত্রে তাকলীদ এবং কোরআন ও সুন্নাহর বিধানের উপর সলফে সালেহীনের বক্তব্যকে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে কঠিন হুমকী ও ধমকী এসেছে তাদের জন্য- ِانَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكْرَىٰ لِمَن كَانَ لَهُ قَلْبٌ أَوْ أَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيدٌ ﴿ق: ٣٧﴾ এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্যে, যার অনুধাবন করার মত অন্তর রয়েছে, অথবা নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে। (৫০: ৩৭)

১। নিশ্চয় মাযহাব অনুসারী ব্যক্তি উম্মতের আলেমদের কথায় এক্তেদা করে, তাদের প্রবর্তিত সুন্নাত বা রীতি নীতি পদ্ধতি অনুযায়ী চলে যদিও সেগুলি স্পষ্ট নস, আলাহ প্রদত্ত দলীল প্রমাণ ও কোরআন হাদীস বিরোধি হয়। এটাই হচ্ছে ইহুদী খৃষ্টানের ন্যায় আল্লাহকে বাদ দিয়ে ধর্মগুরুদের রব হিসাবে গ্রহণ করার নমুনা। এটা নিশ্চিত যে, ইহুদী নাসারারা তাদের পোরুহিতদের ইবাদত বন্দেগী করত না বরং তাদের নিঃশর্ত আনুগত্য করত, তারা যা হারাম করত অনুসারীরা তা হারাম হিসাবে মেনে নিত, যা হালাল করত তারাও হালাল হিসাবে মেনে নিত। এটাই তো কথা, এ উম্মতের তাকলীদ কারীদের এ কর্মটি ইহুদী নাসারাদের কর্মের সাথে এর চেয়েও নিকটতর সাদৃশ্য হয়ে গেল- যেমন ডিম ডিমের মত হয়, খেজুর খেজুরের মত, পানি পানির মত। (অর্থাৎ ধর্মগুরুদের নিঃশর্ত আনুগত্যের ক্ষেত্রে ইহুদী নাসারাদের কর্মের সাথে মুসলমানদের কর্ম খাপের খাপ মিলে গেছে।)

২। হায়! হে মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ (সাঃ) এর অনুসারীরা তোমাদের কি হল যে, তোমরা কোরআন ও সুন্নাহকে পার্শ্বে নিক্ষেপ করেছ, আর আনুগত্য করছ এমন লোকদের যারা কোরআন সুন্নাহ মোতাবেক আল্লাহ্‌র ইবাদতের ক্ষেত্রে তোমাদের মতই আদিষ্ট, তাদের আমল সহীহ হওয়ার জন্যও কোরআন সুন্নাহ মোতাবেক হওয়া শর্ত। তোমাদের উলামাদের যেসব রায় ও বক্তব্য সত্যের ভিত্তি নয়, কোরআন সুন্নাহ ও দ্বীনী ব্যাপারে যেগুলি ধর্তব্য নয়- তোমরা সেগুলিই কার্যে পরিণত করছ। অথচ কেউ সেগুলির বিরোধিতা করলে তোমরা উচ্চ কণ্ঠে ডাক চিৎকার ও বাদ বিসম্বাদ শুরু করে দাও। কাজেই তোমরা কোরআন সুন্নাহ বর্জন করেছ এ অবস্থায় যে, তোমরা বধির, অন্তর তালাবদ্ধ, বোধ বুদ্ধি রুগ্ন, আকল বিভ্রান্ত, বন্ধা ধীশক্তি, ব্যাধিগ্রস্থ হৃদয়।

৩। আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে এবং আমাকে পথ প্রদর্শন করুন। তোমরা সেসব কিতাবাদি বর্জন কর যেগুলি তোমাদের মৃত সলফে সালেহীন তথা পূর্ববর্তীরা তোমাদের জন্য লিখে গেছেন। সেসব কিতাব দ্বারা তারা আল্লাহ্‌র কিতাবকে বিকৃত/পরিবর্তন করেছে। অথচ আল্লাহই তোমাদের ও তাদের সৃষ্টি কর্তা, তোমাদের ও তাদের উপাস্য, তোমাদের ও তাদের প্রভু। আর তোমরা যাদেরকে ইমাম বলে ডাক তাদের বর্ণনা বক্তব্য ও প্রবর্তিত পন্থা দ্বারা তোমরা পরিবর্তন করে দিয়েছ তার বর্ণনা যিনি তোমাদের ও তাদের ইমাম, তোমাদের ও তাদের নেতা, তিনি হলেন শ্রেষ্ঠ নেতা মুহাম্মদ (সাঃ)।

৪। হে আল্লাহ্‌ পথ ভ্রষ্টকে হেদায়েত কর, গুমরাহকে পথ দেখাও সুস্পষ্ট পথ। হে আল্লাহ্‌, আমাদের সবাইকে সত্য ও সঠিক পথে পরিচালিত কর, হেদায়েতের রাস্তা উন্মুক্ত কর।

( তাবারী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, ফাতহুল কাদির, বগবী)

আয়াতের বাস্তবতাঃ উক্ত আয়াতের বাস্তবতা হল, আল্লাহ রাসূল ঐক্য ফরয ও বিভক্তি হারাম করেছেন, কিন্তু প্রত্যেক ফেরকার মুরুব্বীরা ঐক্য হারাম আর বিভক্তি হালাল করেছেন। আর আমরাও কোনরুপ বাদ- বিসংবাদহীন তা মেনে নিয়ে হাজার হাজার ফিরকায় বিভক্ত হয়েছি এবং মুরুব্বীদেরকে রব হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছি।

একজন দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করল, ‘এ আপনি কেমন কথা বলছেন, আমরা স্ব স্ব মুরুব্বীদের নিঃশর্ত আনুগত্য করিনা, শুধুমাত্র শরীয়তের ব্যাপারে তাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণটুকু গ্রহণ করেছি। মৌলিকভাবে তো আমরা কোরআন সুন্নাহরই অনুসারী। মাওঃ মোজাহিদ বলল, আপনাদের এ দাবী সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, আর তা প্রমাণ করার জন্য এখন আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে ফিরকাগুলি স্ব স্ব মুরুব্বীদের নিঃশর্ত আনুগত্য করছে কিনা।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, .. ‏تركت فيكم أمرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله وسنة نبيه (রাসূল (সাঃ) বলেন, আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না যতক্ষণ সে দুটি আঁকড়ে ধরে থাকবে, তা হল কোরান ও সুন্নাহ)।অর্থাৎ শুধুমাত্র কোরআন সুন্নাহর অনুসরণ করতে হবে। রাসূল (সাঃ) কখনো কোথাও বলেননি যে, আলেমদের অনুসরণ করতে হবে। আর ..العلماء ورثة انبياء..(আলেমরা নবীদের ওয়ারিশ) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল আলেমরা কোরআন ও সুন্নাহর বার্তা মানব জাতির কাছে পৌঁছে দিবে। এর অর্থ এমন নয় যে, আলেমের অনুসরণ করতে হবে। তারা শুধুমাত্র পিয়নের দায়িত্ব পালন করবেন- কোনরূপ ইফরাত তাফরিত ব্যতিত। অথচ আলেমগণ ইফরাত তাফরিত করেছেন। আর .اولو الامر. (কর্তৃপক্ষ) এর অর্থ, খেলাফত ব্যবস্থার অধিনে প্রসাশনিক কর্তা ব্যক্তিদের নির্দেশ মেনে চলার কথা বলা হয়েছে, এখানে আলেমগণ উদ্দেশ্য নয়। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে আমরা কোরআন সুন্নাহ বাদ দিয়ে স্ব স্ব ফেরকার আলেম ও মুরুব্বীদের অনুসরণ করছি। ফেরকা অধ্যায়ে এ সম্পর্কে আমি আলোচনা করেছি, এখানে সংক্ষেপে কিছু উদাহারন দিচ্ছি-

১। আল্লাহ রাসূল আহলে কিতাবের তাওহীদবাদীদের সাথে মুসলমানের বিয়ে জায়েয করেছেন। কিন্তু উম্মাহর আন্তফিরকাগুলির মধ্যে বিয়ে হয়েছে এমন নজির নাই। যেমন দেওবন্দি জামাতি বেরেলভী ও তাবলীগের পরস্পরের মধ্যে বিয়ে হয় না। এখন কথাটা হল, সাধারন মানুষ তো আর জানে না কোথায় বিয়ে জায়েয আর কোথায় জায়েয নয়, এই বিভাজনটা করে দিয়েছে প্রত্যেক ফেরকার মুরুব্বি নামক আলেমরা। এর প্রমাণ আছে যে, দেওবন্দিরা বলেছে জামাতি ও বেরেলভীদের সাথে বিয়ে জায়েয নাই। বেরেলভীরা বলেছে দেওবন্দি ও জামাতিদের সাথে বিয়ে জায়েয নাই।, তাবলীগীরা বলেছে জামাতীদের সাথে বিয়ে জায়য নাই। প্রত্যেকের দাবী হল প্রতিপক্ষ ফেরকার আক্বিদায় সমস্যা আছে। এখন প্রশ্ন হল, তখন কি অনুসারিরা স্ব স্ব মুরুব্বীদের টুঁটি চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ভণ্ডের দল, আল্লাহ রাসূল আহলে কিতাবের সাথে বিয়ে জায়েয করেছেন আর তোরা মুসলমানের মধ্যে বিয়ে হারাম করার কে? কেউ এমন প্রতিবাদ করেনি বিধায় এটা মুরুব্বীদের রব হিসাবে গ্রহন করার প্রমাণ।

২। প্রত্যেক ফেরকার ধর্মানুষ্ঠান আলাদা আলাদা। একে অন্যের ধর্মানুষ্ঠানে যায় না। অনুসারিরা এর প্রতিবাদ করেনি বিধায় তারা মুরুব্বীদের রব হিসাবে গ্রহণ করেছে।

৩। প্রত্যেক ফেরকার মসজিদের নাম আলাদা আলাদা যেমন মারকাজ মসজিদ, জামাতী মসজিদ, আহলে হাদীস মসজিদ ইত্যাদি। অনুসারিরা এর প্রতিবাদ করেনি।

৪। এক ফেরকার ইমামের পিছনে অন্য ফেরকার লোকেরা নামায পড়ে না। কারণ মুরুব্বীদের নিষেধ আছে। তখন কেউ মুরুব্বি নামক শয়তানের গর্দানে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেনি যে, ইমামতের সকল শর্ত বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাদের পিছনে নামায পড়ব না কেন?

৫। এসবের প্রধান কারণ হল আকাবির সমস্যা। দেওবন্দীরা আকাবিরে দেওবন্দের অনুসরণ করে, তাবলীগীরা আকাবীর বা মুরুব্বীদের অনুসরণ করে, এভাবে প্রত্যেকটি ফেরকা স্ব স্ব ফেরকার আকাবীর বা মুরুব্বীদের শুধু অনুসরণই করে না বরং নিঃশর্ত আনুগত্য করে।

যাই হউক, উপরোক্ত আলোচনায় বুঝা গেল যে, মুসলমানের পরস্পরের মধ্যে বিয়ে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, একে অন্যের মসজিদে ও ইমামের পিছনে নামায পড়া, সকল ফেরকার আলেমদের শ্রদ্ধা করা ইত্যাদি বিষয় জায়েয এবং উত্তম কাজ ছিল। কিন্তু ফিরকাবাজ আলেমরা এই জায়েয বিষয় গুলি হারাম করে দিল আর আমরা অনুসারিরাও বিনা বাক্যব্যয়ে সেগুলি শুধু মেনেই নিলাম না, বরং এই হারাম করন ও বিভাজনের কারনে স্ব স্ব ফেরকার মুরুব্বীদের প্রতি যৎপরনাস্তি কৃতজ্ঞ ও অনুগত হয়ে উঠলাম। কাজেই প্রমানিত হল যে, আমরা প্রত্যেক ফেরকার মুরুব্বীদের রব হিসাবে গ্রহন করেছি।

পুনশ্চ বেরেলভী মুরুব্বিরা যখন বলল, রাসূল (সাঃ) গায়েব জানেন ও নুরের সৃষ্টি, জামাতী মুরুব্বিরা যখন নবীগনের মা’সুমিয়্যাত ও সাহাবাগনের সত্যের মাপকাঠি নিয়ে বিতর্ক তুলল, সালাফি ও দেওবন্দিরা যখন মাযহাব, তাকলীদ ও পীর মুরিদী নিয়ে বিতর্ক তুলল, তখন কি অনুসারিরা স্ব স্ব মুরুব্বীদের টুঁটি চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল যে, বিদাত সৃষ্টি করছেন কেন, উম্মাহর মধ্যে বিভেদ বিভক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছেন কেন, আপনাদের এসব বিদাত ইহকালে- পরকালে কোন কাজে আসবে? তারপর সে প্রশ্ন করল, আপনারা কি এমন জিজ্ঞেস করেছিলেন? কেউ জবাব দিল না, সবাই মাথা নিচু করে বসে রইল। মোজাহিদ বলল, ‘না, কেউ জিজ্ঞেস তো করেইনি বরং মুরুব্বীদের প্রতি আরো কৃতজ্ঞ ও অনুগত হয়েছে। কাজেই প্রমানিত হল সবাই নিজ নিজ মুরুব্বিদের রব হিসাবে গ্রহন করেছে।

এখন আমার প্রশ্ন হল, কিহে বাপু দেওবন্দী, বেরেলভী, জামায়াতী, তাবলীগী, সালাফী, সুফীবাদী, শিয়া, সুন্নী, হিজবূত তাহরীর, হিজবুত তাওহীদ, ব্রাদার হুড ইত্যাদিরা, এবার কি হুস হল ? এখনো যদি না হয় তাহলে হেফাজত ও জামায়াত বনাম আওয়ামী লীগ, ব্রাদার হুড বনাম সিসি, আইসিস বনাম শিয়া, সৌদি জোট বনাম ইরান- কাতার ইত্যাদি নাম ও রূপ ধারণ করে কুকুরের মত কামড়া কামড়ি করে মরতে থাক, দাজ্জালের হাতে বন্য প্রানী ও পশু পাখির মত মরতে থাক। তারপর ? তারপর ইসলাম, উম্মাহ ও নিজেদের ধ্বংসের দায়ে জাহান্নামের আগুনে কতটা ধৈর্য্য ধারণ করতে পার তার প্রশিক্ষণ নিতে থাক। কাজেই নিজেকে যদি মুসলমান দাবী কর-তাহলে ফিরকাবাজীর ধান্দা, মুরুব্বীদের অনুসরণ, তাদের লিখিত কিতাবাদির সিলেবাস ইত্যাদি বর্জন করে সোজা ঐক্যের পথে দৌড়াও, দৌড়াও উল্কার গতিতে। বাচাও নিজেকে, ইহকালের লাঞ্চনা ও পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে। আল্লাহ্‌ সবাইকে সঠিক সমঝ ও তাওফীক দান করুন। আমীন।

অনুসিদ্ধান্তঃ দীর্ঘ আলোচনায় প্রমানিত হল যে, প্রত্যেক ফেরকা স্ব স্ব মুরুব্বীদের রব হিসাবে গ্রহণ করেছে। কাজেই প্রত্যেকেই আত্মস্বিকৃতি প্রদান করুন। কিন্তু কেউ কথা বলল না, সবাই মাথা নিচু করে লজ্বিত মুখে বসে রইল। অবশেষে স্কুল কলেজের কিছু ছাত্র শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করা শুরু করল, ‘তারা বলল, কী সর্বনাশা ব্যপার। রক্ষকই ভক্ষক, এই ফেরকাবাজ আলেমরা যে এত জঘন্য তাতো জানতাম না। উস্তাদজী আপনি রায় ঘোষণা করে দিন। হাসান মুসান্না হাসলেন ‘রায় ঘোষণা করে লাভ নেই। আমি আগেই বলেছি এটা আত্মসংশোধন কেন্দ্র। কাজেই সবাই তওবা করুন আর ফেরকাবাজ ধ্বংসের শপথ গ্রহন করুন।

প্রমাণ আসার পর ফিরকাবাজরা বিভক্ত হয়-

﴿وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِن بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ﴾

প্রথমে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে তো বিভেদ সৃষ্টি হলো তাদের কাছে ( সত্য পথের ) সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে যাওয়ার পর। (বায়্যিনা/ ৪)

ইমাম ইবনে জরির তাবারি বলেন, অত্র আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য আহলে কিতাব তথা ইহুদি নাসারাগন। আল্লাহ তালা ইহুদি নাসারাদের উপর কিতাব নাযিল করে দলিল প্রমাণ পুর্ন করলেন এবং তাদের থেকে আল্লাহ কামনা করলেন যেন, তারা ঐক্যবদ্ধ থেকে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু এ বিষয়ে তারা এখতেলাফ করে অসংখ্য ফিরকায় বিভক্ত হয়ে গেল। যেমন বিভিন্ন সনদে বর্নিত হাদীস - ইহুদীরা ৭১ ফেরকা হয়েছে, নাসারা ৭২ ফেরকা, আমার উম্মত ৭৩ ফেরকা হবে এবং সবাই জাহান্নাবি হবে একটি দল ছাড়া, অর্থাৎ জামাত বদ্ধ দল ছাড়া। কিন্তু ইমাম কুরতুবি বগবি ফতহুল কাদির ও অন্যরা এখানে বায়্যিনা বা প্রমাণ দ্বারা উদ্দেশ্য করেছেন রাসূল (সাঃ) এবং কোরান। পুর্বের কিতাব গুলিতে রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বানী করা হয়েছে এবং রাসুলের প্রতি ঈমান আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাসূল (সাঃ) যখন আসলেন ও কোরান অবতীর্ন হল তখন তারা হিংসা বিদ্বেষের কারনে দূরে সরে গেল, বিভক্ত হল।

বাস্তব প্রয়োগঃ- অত্র আয়াতের ভিত্তিতে একটি সরল প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি কে বড় গাদ্দার, ইহুদি খৃষ্টান নাকি উম্মাহর আলেম সমাজ? বাস্তবতা বলছে আলেম সমাজ। কারন আহলে কিতাবরা রাসুলের প্রতি ঈমান না আনার পিছনে অন্তত কিছুটা হলেও খোড়া যুক্তি কার্যকর ছিল। যেমন-

১। তাদের ধর্ম গ্রন্থ গুলিতে রাসুলের বিবরন অনেকটা রুপকাকৃতিতে ছিল, যেমন মৈত্রেয় বুদ্ধ, কল্কি, নরাশংস, উস্ট্রারোহি, ফারানের ভাববাদি, পারাক্লিট ইত্যাদি।

২) স্বার্থ পুজারি পোরুহিতরা এসব বর্ননার অপব্যাখ্যা করে সাধারণ জনগনকে রাসুলের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াতের পরিবর্তে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল।

৩) ঐসব ধর্ম গ্রন্থ নাযিলের হাজার হাজার বছর পর রাসুলের আগমন ঘটে। এ ছাড়া গোত্র ও জাতিগত হিংসা বিদ্বেষ ও অহংকার ইত্যাদি তো ছিলই।

কাজেই আহলে কিতাবরা রাসুলের প্রতি ঈমান না আনার এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হওয়ার পিছনে ক্ষীণ হলেও একটা যুক্তি আছে। পক্ষান্তরে আলেম সমাজ, গলায় ঝুলিয়ে, পকেটে, পেটে মস্তিস্কে কোরআন নিয়ে চলাফিরা করে। আর এই কোরআনের শত শত আয়াত দ্বারা ঐক্য ফরয করা হয়েছে বিভক্তি হারাম করা হয়েছে। তদুপরি অসংখ্য হাদিসে এ বিষয়ে কঠোর হুমকি এসেছে এমনকি ফিরকাবাজদের হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর ইসলামের বিধান সমুহের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন এবং কঠোর বিধান হচ্ছে উম্মাহর ঐক্য এবং ফিরকাবাজির নিষেধাজ্ঞা। অথচ আলেমরা কোরআন বগলদাবা রেখে আল্লাহ ও রাসূলকে থোরাই কেয়ার করে উম্মাহকে শত শত ফিরকায় বিভক্ত করে ধ্বংস করে দিয়েছে। কাজেই সাধারণ মুসলমানদের আকলে সলিম-সুস্ট বিবেক সিদ্ধান্ত দিবে আল্লাহ ও রাসুলের বড় শত্রু কারা, আহলে কিতাবরা নাকি আলেম সমাজ। যদি আলেম সমাজ হয়,তাহলে দেড়শ কোটি মুসলমানের বিবেকের আদালতে মুকাদ্দমা দায়ের করা হল সেই মুজরিমদের বিচার ফয়সালা করার জন্য।

আমাদের আহবানঃ আলেম সমাজই হচ্ছেন ইসলামের ধারক বাহক। ইসলামের ভাল মন্দ তাদেরকেই বুঝতে হবে। কাজেই সকল আলেম ঐক্যবদ্ধ হয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর ইসলাম বিধ্বংসী সকল অপকর্মের মুলুৎপাটন করতে হবে। অন্যথায় ইসলাম ধ্বংসের সকল দায় মাথায় নিয়ে তাদেরকে আল্লাহর দরবারে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে। আর দেওবন্দী, তাবলীগী, জামাতী, সালাফী, ব্রাদারহুড ইত্যাদি যেসব ফিরকার আমি সমালোচনা করছি বস্তুত ফিরকাবাজি ও অন্যান্য কিছু বিদাত ছাড়া এরাই হচ্ছে ইসলামের মুল ধারা। আর এরাই ইসলামের মুল দায়িত্বশিল বিধায় আমি সমালোচনা করছি। কাজেই প্রথমে এসব ফিরকার আলেমদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারপর বাকীদের ঐক্যের উপর বাধ্য করতে হবে।

যাই হউক, এখন আমার প্রশ্ন হল, বায়্যিনাহ তথা কোরান আমাদের সামনে আছে। এই কোরআনের অসংখ্য আয়াত দ্বারা ঐক্য ফরয ও বিভক্তি হারাম করা হয়েছে। প্রশ্নটা হল, ফিরকাবাজ আলেমরা কি বায়্যিনাহ আসার পর বিভক্ত হয়নি, কোরআনের বিধান প্রত্যখ্যান করেনি? সবাই উত্তর দেন। সকলেই উত্তর দিল , হা হা করেছে, আমরা তাদের বিচার চাই। কাজেই প্রমানিত হল, ফিরকাবাজ আলেমরা আল্লাহ রাসুল ইসলাম ও উম্মাহর প্রধান শত্রু, গাদ্দার ও দাজ্জাল। সুতরাং এখন থেকে আমরা কার অনুসরন করব, স্ব স্ব ফেরকার মুরুব্বীদের নাকি কোরান সুন্নাহর? সবাই সমস্বরে বলল, কোরান সুন্নাহর। মোজাহিদ বলল, শ্রদ্ধেয় ইমাম, এ প্রস্তাব পাশ করুন। হাসান মুসান্না দাঁড়িয়ে বললেন, এ প্রস্তাব পাশ হল, আজ থেকে ফিরকাবাজ আলেমদের অনুসরন হারাম করা হল।

বিষয়: রাজনীতি

৬৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File