সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ১৩
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৪ জুলাই, ২০১৭, ১২:৫৩:৪৪ দুপুর
বিভক্তিবাদিরা কাফের (ফিরকাবাজদের মরণ ঘণ্টা)
﴿يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ ۚ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ﴾
﴿وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
(৩/১০৬) যেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে৷ তাদেরকে বলা হবে, ঈমানের নিয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরী নীতি অবলম্বন করলে ? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই নিয়ামত অস্বীকৃতির বিনিময়ে আযাবের স্বাদ গ্রহন করো৷ (৩/১০৭) আর যাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে, তারা আল্লাহর রহমতের আশ্রয় লাভ করবে এবং তারা চিরদিন এই অবস্থায় থাকবে৷)
যোগসুত্র ও ব্যাখ্যাঃ সুরা আল-ইমরানের ১০২ নং আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা তাকে যথোপযুক্ত ভয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। ১০৩ নং আয়াতে ভয়ের প্রধান বিষয় হিসাবে বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ১০৪ নং আয়াতে বিভক্তির সম্ভাবনাকে চূড়ান্তভাবে অপনোদন করার লক্ষে উম্মতের দায়ী অংশের উপর ফরয (কেফায়া) করে দিয়েছেন যে, তারা সৎকাজের আদেশ আর অসৎ কাজে বাধা দিবে-অর্থাৎ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত রাখবে এবং বিভক্তিতে বাধা দিবে। এত কিছুর পরেও যারা বিভক্তি ও ফিরকাবাজিতে লিপ্ত থাকবে তাদেরকে আল্লাহ্ তা’লা ১০৫ নং আয়াতে ইহুদি- খৃস্টানের সাথে তুলনা করে কঠোর শাস্তির সংবাদ দিয়েছেন। এরপরেও যারা ফিরকা বাজি করবে আল্লাহ তা’লা তাদেরকে বক্ষমান ১০৬ নং আয়াতে পরিষ্কার কাফের বলে ঘোষণা দিয়েছেন । কাজেই বুঝা যাচ্ছে উম্মাহর মধ্যে শিয়া, সুন্নীসহ হকপন্থি বা বাতিলপন্থি নিবির্শেষে যতগুলি ফিরকা রয়েছে যেমন বেরেলভী, দেওবন্দী, জামাতী, তাবলীগী, সালাফী, তালেবান, হিজবুত তাওহীদ, হিজবুত তাহরির, বুকো হারাম, আইসিস, ব্রাদার হুড ইত্যাদিরা সবাই কাফের। যেহেতু তারা সবাই ফিরকাবন্ধি। বিশেষতঃ আলেম সমাজ যারা এসব ফিরকার জন্ম দিয়েছে এবং পরস্পর বিদ্বেষ ছড়িয়ে এগুলি জিইয়ে রাখছে, উম্মাহ ধ্বংসের পথ তৈরি করে দিচ্ছে- তারা আলোচ্য আয়াতগুলির ভিত্তিতে কাফের প্রমাণিত হলো। কারণ আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে . أَكَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ. অর্থাৎ ঈমানের পর কুফরি করেছিলে?
একজন দাঁড়িয়ে ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘আপনি মুসলমানদের কাফের বলেন কেমনে, অথচ রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন- لا تكفروا اهل القبلة-অর্থাৎ আহলে কিবলাকে কাফের বলবে না। কাজেই আপনি কাউকে কাফের বলতে পারেন না। মোজাহিদ বলল, আমি তো কাউকে কাফের বলি নাই, আমি কাফের বলার কে, আর বললেও তো কেউ কাফের হয়ে যাবে না। এখানে স্বয়ং আল্লাহই ফিরকাবাজ দের কাফের বলে ঘোষণা দিলেন। এর কারণ হচ্ছে, যারা ঐক্যের ফরযিয়্যত ও বিভক্তির হুরমত অস্বিকার করে ফিরকাবাজীতে লিপ্ত হবে তারা কাফের হয়ে যাবে, যেমন নামায রোযার ফরযিয়্যত অস্বিকার কারী কাফের হয়ে যায়।
২। এছাড়া অত্র হাদিস দ্বারাও বিভক্তিবাদিরা কাফের প্রমানিত-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ: أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: «لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفَّارًا، يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ
ইবনে উমর বলেন, রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন- তোমরা আমার পরে পরস্পরের গর্দান মেরে কুফুরিতে ফিরে যেও না। অর্থাৎ মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া ঝাটি বাদ বিসম্বাদ কুফুরি।
আরেকজন দাঁড়িয়ে বলল, এ আয়াত বা বিধান ইহুদী নাসারার সাথে সম্পৃক্ত মুসলমানের জন্য প্রযোজ্য নয়। মোজাহিদ বলল, ‘এ দাবী সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কারণ আয়াতে স্পষ্টতঃ বলা হয়েছে . أَكَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ. তোমরা কি ঈমান আনার পরে কুফুরি করেছিলে ? অথচ ইহুদী নাসারারা তো ঈমানই আনেনি। তারা তো পূর্বে থেকেই কাফের আবার নতুন করে কাফের হওয়ার কি আছে। কাজেই বুঝা যায় এ কুফুরির বিধান ফিরকাবাজদের জন্য প্রযোজ্য। দ্বিতীয় উত্তর হল, অত্র আয়াতের পূর্বাপর কোথাও আল্লাহ্ তা’লা ইহুদি-নাসারাদের সম্বোধন করে কোন বিধান বা নির্দেশ দেননি, বরং মুসলমানদের সম্বোধন করে বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এখন যারা এ নির্দেশ পালন করবে না –তারা কাফের প্রমাণিত হবে।
আরেকজন প্রশ্ন তুলল, সম্ভবত এ আয়াত শিরক, বিদআত, নিফাক ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বিভক্তি- ফেরকাবাজির জন্য প্রযোজ্য নয় । মোজাহিদ বলল, এ দাবিও ডাহা মিথ্যা। কারণ অত্র আয়াতের পূর্বাপর কোন আয়াতে শিরক, বিদাত, নিফাক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়নি বরং ঐক্য ও বিভক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আয়াত গুলিতে আল্লাহ্ তা’লা ঐক্য ফরয ও বিভক্তি হারাম করেছেন। এখন এ ফরয ও হারাম লঙ্গন করে যারা ফিরকাবাজীতে লিপ্ত হবে তারা অবশ্যি অবশ্যি কাফের বলে গণ্য হবে। তাছাড়া অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরকারকগন ফিরকাবাজদের শনাক্ত করেছেন এবং ৭৩ ফিরকার হাদিস উল্লেখ করেছেন বিধায় বুঝা যায় উক্ত আয়াত ফিরকাবাজদের জন্য প্রযোজ্য।
তবে উল্লেখ্য যে, যারা ফিরকাবাজি জায়েয মনে করে তারা কাফের। কিন্তু যারা ঐক্য ফরয বিভক্তি হারাম জেনেও নমনীয়তা, উদাসীনতা ও সুযোগের অভাবে কোন ফিরকায় লিপ্ত রয়েছে-তারা কবিরা গুনায় লিপ্ত, কাফের নয়। বর্তমান বিশ্বের আলেম সমাজ সম্ভবত এ শ্রেণীভুক্ত। কারণ বিভক্তি হারাম-এটা সবাই স্বীকার করে। সুতরাং সুরা আলে ইমরানের ১০২ থেকে ১০৬ পর্যন্ত আয়াতগুলি দ্বারা ফেরকাবাজরা কাফের প্রমাণিত হল। কাজেই নিজেদের পরকাল রক্ষার্থে এবং উম্মাহকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে ঐক্যের বিকল্প নেই। সুতরাং আমরা ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছি।
তাফসীর কারকদের মতামতঃ- يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ – ইমাম কুরতবি বলেন, চেহারা স্বেতবর্ণ ও কৃষ্ণবর্ণ হওয়া সম্পর্কে তিনটি অভিমত রয়েছে-
১। এটা কিয়ামতের দিন কবর থেকে পুনরুত্থানের সময় ঘটবে। তখন মুমিনদের চেহারা উজ্জ্বল হবে আর কাফেরদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হবে।
২। ইহা আমলনামা হাতে পাওয়ার পর হবে। মুমিন তার আমলনামায় নেক আমল দেখে খুশি হবে, তার চেহারা উজ্জ্বল হবে। পক্ষান্তরে বদকার যখন তার বদ আমল দেখবে তখন তার চেহারা কৃষ্ণরূপ ধারন করবে।
৩। ইহা মিযানের সময় হবে, নেককারদের নেকের পাল্লা ভারি হলে চেহারা উজ্জ্বল হবে আর বদকারদের পাপের পাল্লা ভারি হলে চেহারা কালো হয়ে যাবে। আর তখনই তাদেরকে বলা হবে. وَامْتازُوا الْيَوْمَ أَيُّهَا الْمُجْرِمُونَ" [يس: 59] - অদ্য পৃথক হয়ে যাও হে অপরাধিরা।
কিয়ামত দিবসে কাদের চেহারা কালো হয়ে যাবে, সে সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। যেমন আতা বলেছেন চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হওয়ার দ্বারা বনী নাযির আর বনী কুরায়যা উদ্দেশ্য। উবাই বিন কাব বলেছেন কাফেররা উদ্দেশ্য, কাতাদা বলেছেন মুরতাদরা উদ্দেশ্য, কেউ বলেছেন মুনাফিকরা, ইকরামা বলেছেন কাদরিয়্যা, আবু উমামা বলেছেন হারুরি তথা খারেজিরা উদ্দেশ্য। তবে সঠিক কথা হচ্ছে, এর দ্বারা বিদাত সৃষ্টিকারী, প্রবৃত্তির অনুসারী ফিরকাবাজরা উদ্দেশ্য। যেমন ইবনে আব্বাস বলেন-
يَعْنِي: يَوْمَ الْقِيَامَةِ، حِينَ تَبْيَضُّ وُجُوهُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ، وَتَسْوَدُّ وُجُوهُ أَهْلِ البِدْعَة وَالْفُرْقَةِ، قَالَهُ ابْنُ عَبَّاسٍ،
অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের চেহারা স্বেতবর্ণ হবে আর বিদাতি ও ফিরকাবাজদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হবে।
عَنْ نَافِعٍ عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي قَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى" يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ" قَالَ: (يَعْنِي تَبْيَضُّ وُجُوهُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَتَسْوَدُّ وُجُوهُ أَهْلِ الْبِدْعَةِ –
অর্থাৎ নাফে’ ইবনে উমর থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা) ইরশাদ করেন, অত্র আয়াতের অর্থ হল, আহলে সুন্নাতের চেহারা স্বেতবর্ণ হবে আর বিদাতিদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হবে।
বুখারি শরীফে বর্নিত- وَفِي صَحِيحِ الْبُخَارِيِّ عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: (إِنِّي فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ مَنْ مَرَّ عَلَيَّ شَرِبَ وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُونِي ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ (. قَالَ أَبُو حَازِمٍ : فَسَمِعَنِي النُّعْمَانُ بْنُ أَبِي عَيَّاشٍ فَقَالَ: أَهَكَذَا سَمِعْتَ مِنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ؟ فَقُلْتُ نَعَمْ. فَقَالَ: أَشْهَدُ عَلَى أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ لَسَمِعْتُهُ وَهُوَ يَزِيدُ فِيهَا: (فَأَقُولُ إِنَّهُمْ مِنِّي فَيُقَالُ إِنَّكَ لَا تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ فَأَقُولُ سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِي (. وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّهُ كَانَ يُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَرِدُ عَلَى الْحَوْضِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَهْطٌ مِنْ أَصْحَابِي فَيُجْلَوْنَ عَنِ الْحَوْضِ فَأَقُولُ يَا رَبِّ أَصْحَابِي فَيَقُولُ إِنَّكَ لَا عِلْمَ لَكَ بِمَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ إِنَّهُمُ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ الْقَهْقَرَى (. وَالْأَحَادِيثُ فِي هَذَا الْمَعْنَى كَثِيرَةٌ. فَمَنْ بَدَّلَ أَوْ غَيَّرَ -- অর্থাৎ সাহল ইবন সা’দ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, আমি হাউযের পাড়ে তোমাদের আগে উপস্থিত থাকব। যে সেখানে উপস্থিত হবে, সে সেখান থেকে পান করার সুযোগ পাবে। আর যে কেউ একবার সে হাউয থেকে পান করবে সে কখনই তৃষ্ণার্ত হবে না। অবশ্যই এমন কিছু দল আমার কাছে উপস্থিত হবে যাদেরকে আমি (আমার উম্মত বলে) চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। কিন্তু এর পরই তাদের ও আমার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেওয়া হবে। আবু সাঈদ খুদরীর (রাঃ) বরাতে এসেছে, তখন আমি (রাসুল) বলব, তারা তো আমার উম্মত ! তখন রাসুল (সাঃ) কে বলা হবে, আপনি তো জানেন না আপনার পর এরা কী বিদাত সৃষ্টি করেছে। তখন আমি বলব, দূর হও দূর হও- যারা আমার পর দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন করেছ, বিকৃতি করেছ। আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বরাতে এসেছে, আপনি তো জানেন না আপনার পর তারা কী বিদাতটাই না সৃষ্টি করেছিল, তারা নিজেদের পশ্চাতে ঘুরে গিয়েছিল। এ সম্পর্কিত অনেক হাদীস আছে।
তারপর ইমাম কুরতুবি বলেন-
فَمَنْ بَدَّلَ أَوْ غَيَّرَ أَوِ ابْتَدَعَ فِي دِينِ الله مالا يَرْضَاهُ اللَّهُ وَلَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ فَهُوَ مِنَ الْمَطْرُودِينَ عَنِ الْحَوْضِ الْمُبْتَعِدِينَ مِنْهُ الْمُسَوَّدِي الْوُجُوهِ، وَأَشَدُّهُمْ طَرْدًا وَإِبْعَادًا مَنْ خَالَفَ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَفَارَقَ سَبِيلَهُمْ، كَالْخَوَارِجِ عَلَى اخْتِلَافِ فِرَقِهَا، وَالرَّوَافِضِ عَلَى تَبَايُنِ ضَلَالِهَا، وَالْمُعْتَزِلَةِ عَلَى أَصْنَافِ أَهْوَائِهَا، فَهَؤُلَاءِ كُلُّهُمْ مُبَدِّلُونَ وَمُبْتَدِعُونَ، وَجَمَاعَةُ أَهْلِ الزَّيْغِ وَالْأَهْوَاءِ وَالْبِدَعِ، كُلٌّ يُخَافُ، عَلَيْهِمْ أن يكونوا عنوا بالآية، والحبر كَمَا بَيَّنَّا، وَلَا يُخَلَّدُ فِي النَّارِ إِلَّا كَافِرٌ جَاحِدٌ لَيْسَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةِ خَرْدَلٍ مِنْ إِيمَانٍ.
অর্থাৎ যে বা যারা দ্বীনের মধ্যে এমন পরিবর্তন পরিবর্ধন করবে অথবা বিদাত সৃষ্টি করবে যে বিষয়ে আল্লাহ অনুমতি দেননি তারাই হাউজে কাউসার থেকে বিতারিত হবে, দূরে নিক্ষিপ্ত হবে এবং তাদের চেহারা কালো হয়ে যাবে। যারাই মুসলিম জামাত (ঐক্য) এর খেলাফ করবে এবং তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে তারাই চুড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যাত হবে এবং দূরে নিক্ষিপ্ত হবে। যেমন খারেজিরা পৃথক ফিরকা হয়ে গেছে, রাফেজিরা স্পষ্ট গুমরাহিতে লিপ্ত হয়েছে, মু’তাজিলারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে- কাজেই তারা সবাই দ্বীন পরিবর্তনকারী এবং বিদাত সৃষ্টিকারী। দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক বক্রতা সন্ধানকারী দল, প্রবৃত্তির অনুসারী দল ও বিদাত সৃষ্টিকারীদের উপরই এ আয়াত প্রযোজ্য। তবে এরা স্থায়ি জাহান্নামী হবে না, স্থায়ি জাহান্নামী হবে কাফেরে জাহেদ- যার অন্তরে সরিষা দানা বরাবর ঈমানও নাই।
উল্লেখ্য যে, তাফসীর ও হাদিসেরও ব্যাখ্যা প্রয়োজন বিধায় আমি তাফসীরের ফাকে ফাকে ব্যাখ্যা দিয়ে যাব। এখানে তিনটি ব্যাখ্যেয় বিষয় রয়েছে--
১ম ব্যাখ্যাঃ অত্র আয়াতে বলা হয়েছে যারা ইমানের পর কুফুরি করেছে তাদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হল ঈমানের পর কারা কুফুরি করল, অত্র আয়াতের উদ্দেশ্য কারা, তাদের কেমনে শনাক্ত করা হবে। হা, তাদেরকে মনিষীগণই শনাক্ত করে গেছেন, তাদের মতামত বুঝতে পারলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। যেমন ইবনে আব্বাস বলেছেন وَتَسْوَدُّ وُجُوهُ أَهْلِ البِدْعَة وَالْفُرْقَةِ،- অর্থাৎ বিদাতি ও ফিরকাবাজদের চেহারা কালো হয়ে যাবে। বস্তুত বিদাতি ও ফিরকাবাজ পৃথক পৃথক দল নয়, যারা বিদাতি তারাই ফিরকাবাজ। কারণ প্রত্যেক দল বিভিন্ন বিদাত সৃষ্টি করে বিতর্কের জন্ম দিয়ে পৃথক ফেরকা হয়ে গেছে। সামনে আলোচনা আসছে। কাজেই বুঝা গেল, ইবনে আব্বাসের মতে অত্র আয়াত দ্বারা ফিরকাবাজরা উদ্দেশ্য, পরকালে তাদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যাবে।
খ ) আবার ইমাম কুরতুবি বলেছেন- مَنْ خَالَفَ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَفَارَقَ سَبِيلَهُمْ، - যারাই মুসলিম জামাত (ঐক্য) এর খেলাফ করবে এবং তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে তারাই চুড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যাত হবে এবং দূরে নিক্ষিপ্ত হবে-------- দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক বক্রতা সন্ধানকারী দল, প্রবৃত্তির অনুসারী দল ও বিদাত সৃষ্টিকারীদের উপরই এ আয়াত প্রযোজ্য। অর্থাৎ ফিরকাবাজরা উদ্দেশ্য।
গ ) পুনশ্চ তিনি বলেন - وَلَا يُخَلَّدُ فِي النَّارِ إِلَّا كَافِرٌ جَاحِد- ( তারা স্থায়ী জাহান্নামী হবে না, কাফেরে জাহেদ ব্যাতিত) অত্র ব্যাখ্যায় তিনি কাফেরদের দুই ভাগ করেছেন। একদল হল কাফেরে জাহেদ যারা আল্লাহ রাসূল বিশ্বাস করে না অর্থাৎ অমুসলিম, এরা স্থায়ী জাহান্নামী হবে। আরেকদল কাফের হল আংশিক কাফের এরা স্থায়ী জাহান্নামী হবে না, নির্ধারিত পরিমান শাস্তি ভোগের পর মুক্তি পাবে। ইমাম কুরতুবির মতে এরা হল ফিরকাবাজ শ্রেনি। যেমন আগেকার খারেজী, রাফেজি মুতাযিলা ইত্যাদিরা আর বর্তমানের বেরেলভী, দেওবন্দী, তাবলীগী, জামায়াতে ইসলামী, ব্রাদারহুড, তালেবান, আইসিস, সূফীবাদ, সালাফী ইত্যাদিরা। কাজেই প্রমানিত হল ফিরকাবাজরা কাফের। আর এই কুফুরির কারণ হল কোরাআন হাদীসের বিধান অস্বিকার করা এবং ঐক্যের ফরযিয়্যাত বিভক্তির হুরমত উপেক্ষা করে ফিরকায় বিভক্ত হওয়া।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাঃ ইমাম কুরতুবি আগেকার মানুষ বিধায় অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় পুর্বের ফিরকাকাগুলির উল্লেখ করেছেন কিন্তু তিনি এ যুগের হলে বর্তমানের ফিরকাগুলিই উল্লেখ করতেন। কারণ বাতেল রুপ পরিবর্বতন করে বারবার ফিরে ফিরে আসে। যেমন পুর্বের ফিরকাগুলিই নাম ও চিন্তার ঈষৎ পরিবর্তনসহ আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা যেমন শরিয়তের সুক্ষাতিসুক্ষ বিশ্লেষণ করে এবং সংকির্ণতা ও বাড়াবাড়ি করে বিভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত হয়েছিল বর্তমানেও তাই হয়েছে। আমি উভয় যুগের ফিরকাগুলির মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করছি, কেউ বিরক্ত হবেন না বিতর্ক করবেন না। অনুরোধ রাখছি, নিজেদের দোষ- ত্রুটি গুলি বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে আত্নসংশোধনের চেষ্টা করবেন।
১। আগের খারেজিরা বর্তমানের দেওবন্দি ধারা নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। কারণ খারেজিরা ছিল তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেম, কোরানের শ্রেষ্ঠ সমঝদার, তখন কোরানে তাদের চেয়ে বড় জ্ঞানি আর কেউ ছিল না। এজন্য তাদেরকে কুররা বা কারী বলা হত, মানে শ্রেষ্ঠ কোরান পাঠক। তাছাড়া আমল ইবাদত বন্দেগি সর্বক্ষেত্রে তারাই ছিল তখন শ্রেষ্ঠ। তারা সাড়া রাত জেগে নামাজ পড়ত কোরান তিলাওয়াত করত। ইউনুস ইবনে আবু ইসহাক বর্ননা করেন যে, খারেজী নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে ওহাব রাসিবী এতো অধিক ইবাদত করত যে, তার দেহের সিজদাস্থান গুলির চামড়া শুকিয়ে গিয়েছিল। লোকে তাকে যুল বায়্যিনাত উপাধিতে ভূষিত করে।
এ ছাড়া আমানতদারি দিয়ানতদারির ক্ষেত্রে তারা ছিল তুলনাহীন। একবার এক খারেজী গাছতলায় পড়ে থাকা একটা খেজুর খেয়ে ফেলল, তখন অন্যরা বলল, তুমি মালিকের অনুমতি ছাড়া খেজুরটা খেয়ে ফেললে? তখনি সে গলায় আঙ্গুল দিয়ে তা বমি করে ফেলে দিল। একদা এক খারেজী একটা শুকর মেরে ফেলল, তখন অন্যরা বলল, তুমি যিম্মির ক্ষতি করলে? তখনি সে মালিকের কাছে ক্ষমা চেয়ে আসল। অথচ তারা বিখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাবকে ফিতনার হাদীস শুনানোর (বসা ব্যক্তি দণ্ডায়মান ব্যক্তি থেকে উত্তম----) কারনে জবাই করে হত্যা করে এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা করে পেট ফেরে সন্তান বের করে দেয়।
খারেজীরা ইসলামের প্রতি অতিশয় নিষ্ঠাবান ছিল বিধায় হজরত আলী তাদের প্রতি দুর্বল ছিলেন। আলকামা ইবনে খালিদের বরাতে ইসমাঈল বর্ননা করেন যে, হজরত আলীকে জিজ্ঞেস করা হল ‘খারেজীরা কি মুশরেক? তিনি বললেন, শিরক থেকে বাঁচার জন্যই তো তারা আলাদা হয়েছে। আবার জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে কি তারা মুনাফিক? তিনি উত্তর দিলেন, মুনাফিকরা আল্লাহ্র ইবাদাত খুব কমই করে থাকে। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল, তবে তাদের অবস্থানটা কি? তিনি বললেন, তারা আমাদের ভাই, আমাদের বিরুদ্ধে ওরা বিদ্রোহ করেছে, এজন্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়ছি। এজন্যই হযরত আলী (রাঃ) কখনোই তাদের মারতে চাননি, তিনি প্রানান্তকর চেষ্টা করেছেন তাদেরকে গোড়ামি, বাড়াবাড়ি ও নিষ্ঠুরতা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু তাদের একগুঁয়েমি জেদ ও সংকির্নতার কারনে তা সম্ভব হয়নি।
ঠিক একইভাবে ভারত বর্ষের বৃহত্তর ফেরকা আমরা দেওবন্দিরাও কোরান হাদীসের সর্বাধিক জ্ঞান চর্চা করি। একথা সর্বজন বিদিত, ইলম ও আমল এখনো কিছু থাকলে কওমি মাদ্রাসাতেই আছে, আলিয়া ও স্কুল কলেজে এসবের কিছুই নাই। আবার আমল ইবাদতের ক্ষেত্রেও আমরা অন্য যেকোন ফেরকার চেয়ে অগ্রগণ্য। কওমি মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকরা যাবতীয় আমলসহ নিয়মিত তাহাজ্জুদ গুযার, রমযানের তাহাজ্জুদে কোরান খতম করে। কিন্তু অন্যান্য ফিরকার ক্ষেত্রে এতটা যুহদ ও সংযম অনুপস্তিত।
সুতরাং কওমি মাদরাসার প্রত্যেক আলেম আল্লামা জানেন যে, কোরান হাদীসের অসংখ্য ও অকাট্য দলিল দ্বারা ঐক্য ফরয ও বিভক্তি হারাম করা হয়েছে। কিন্তু তারা অন্যান্য ফিরকার সাথে ছোট খাট বিদাত নিয়ে মতান্তর করে ফিরকায় বিভক্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ জায়েয বিষয়ে বিতর্ক করে হারামে মুবতালা হয়ে গেছে। কাজেই আমরাও খারেজিদের ন্যায় একগুয়েমি জেদ ও সংকির্নতার কারনে অন্যদের সাথে বিভেদ মিটিয়ে ঐক্য হচ্ছি না, কোরান হাদীসের বিধান মানছি না। খারেজীরা যেমন কিছুটা ছাড় দিয়ে হজরত আলীর খেলাফতে যোগ দেয়নি তদ্রুপ আমরাও কিছুটা ছাড় দিয়ে জামাতের সাথে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ দেই না।
ভারত বর্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফেরকা হল জামাতে ইসলামী। আমি আগেই বলেছি আমি আত্মার খোরাক ও আত্ম সংশোধনের জন্য তুলনামুলক আলোচনা করছি, কেউ রাগ করবেন না। পুর্বের মু’তাযিলাদের আধুনিক সংস্করন হল জামাতে ইসলামী। কারণ মু’তাযিলারা ছিল তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, যুক্তিবাদি ও দার্শনিক। ইহুদিদের মধ্যে ফরিশি নামে একটা ফেরকা ছিল, তারা তওরাতের বিধানকে যুক্তির কষ্টি পাথরে যাচাই করে গ্রহণ করত। এই ফরিশিদের ইসলামী সংস্করণ ছিল মু’তাযিলা। তারা কোরান হাদীসের প্রত্যেকটা বিষয় মানতেক ফালসফা ও যুক্তির কষ্টি পাথরে যাচাই করে সিদ্ধান্ত দিত, চুলচেরা বিশ্লেষন করত। এভাবে তারা খালকে কোরান বা কোরান সৃষ্ট-এর মত একটা উদ্ভট মতবাদের জন্ম দেয়। তারা ছিল গ্রিক দর্শনের অন্ধ অনুসারী ও আধুনিকতাবাদি।
তদ্রুপ আমরা জানি জামাতে ইসলামির অধিকাংশই আধুনিক শিক্ষিত ও উচ শিক্ষিত। যুগ জিজ্ঞাসার প্রেক্ষাপটে ইসলামের আধুনিক ভাষ্যকার মাওঃ মওদুদি (রঃ) এর দর্শন থেকে সরে এসে জামাত অত্যাধুনিক হয়ে উঠেছে। তারা ইসলামকে পাশ্চাত্য সভ্যতার চাচে ঢেলে সাজাতে চায়। এমনকি মু’তাযিলারা যেমন বস্তুবাদি গ্রিক দর্শন গ্রহণ করেছিল, তদ্রুপ জামাতও সর্বনাশা পুজিবাদি গণতন্ত্র মেনে নিয়েছে।
আবার বেরেলভী ধারার রাসুলের গায়েব জ্ঞান তত্ত্বটি মু’তাযিলাদের খালকে কোরান দর্শনের সাথে মিল আছে। মু’তাযিলাদের দর্শন ছিল আল্লাহ একক সত্তা তার মধ্যে বহুত্ব নাই, তিনি কাদিম বা অবিনশ্বর। কাজেই আল্লাহ্র সিফাত বা গুনাবলি মানা যাবে না, মানলে সেগুলিকে অবিনশ্বর মেনে নিতে হবে। আর বহু গুনাবলি মেনে নেয়ার অর্থ হল আল্লাহ্র মধ্যে বহুত্ব পাওয়া যাওয়া, কিন্তু এটা সম্ভব নয় বিধায় আল্লাহ সিফাত বা গুনাবলি থেকে পবিত্র। কাজেই তিনি বক্তা (মুতাকাল্লিম) হওয়া থেকেও পবিত্র। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আল্লাহ যদি বক্তা না হন তাহলে তার বক্তব্য সম্বলিত কোরান কি, কোরান কি অবিনশ্বর নয়? এর উত্তরে মু’তাযিলারা বলে, কোরান হল মাখলুক বা আল্লাহ্র সৃষ্ট বস্তু সমুহের মধ্যে একটি, কাজেই অন্যান্য সৃষ্ট বস্তুর মতই কোরান নশ্বর, অবিনশ্বর নয়। এটা হল তাদের একটি ভুবনখ্যাত মতবাদ।
অনন্তর এই খালকে কোরান মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য মু’তাযিলারা পৃথিবীর সকল জল ঘোলা করেছে, চুলচেরা বিশ্লেষণ দিয়েছে যা এতই সুক্ষ্ম যে, সাধারন মানুষের পক্ষে খালকে কোরান দর্শন, কাদিম- হাদেস বা নশ্বর অবিনশ্বর ইত্যাদি বুঝা কখনোই সম্ভব নয়, যেমন আমিই ঠিকমত বুঝি না। এইভাবে তারা শরীয়তের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অতি বিশ্লেষণ করে গুমরাহ হয়ে গেছে। ঠিক একইভাবে বেরেলভী মতবাদ হল, রাসূল (সা) গায়ের জানেন কিন্তু কোরান হাদীসের অসংখ্য নস দ্বারা প্রমানিত যে, রাসূল (সা) গায়ের জানেন না। এরপরেও তারা গায়েব জ্ঞান তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য এমন সুক্ষাতিসুক্ষ বিশ্লেষণ দিল যা সাধারন মানুষের বোধগম্য নয়। কাজেই বেরেলভী দর্শনে রাসূল (সাঃ) এর গায়েব জ্ঞান তত্ত্বটি অতিবিশ্লেষন ও সীমালঙ্ঘনের ক্ষেত্রে মু’তাযিলাদের খালকে কোরান দর্শনের সাথে হুবহু মিলে যায়। আবার দেওবন্দিদেরকে তাদের তাকফীরী মতবাদটি খারেজিদের তাকফিরি মতবাদের সাথে মিলে। খারেজীরা যেমন হজরত আলী, মোয়াবিয়া, উভয় দলের সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যদেরকে কাফের বলত তদ্রুপ বেরেলভীরাও দেওবন্দিদেরকে কারণ ব্যাতিত কাফের বলে বেড়ায়। পুনশ্চ তাদের মাযার দর্শনটি মুরজিয়া দর্শন- ‘ইমানই যথেষ্ট পাপ পুন্যে ক্ষতি নেই’ এর সাথে কিছুটা মিল আছে।
অনন্তর মাযার ও পীর পন্থীদের মধ্যে যারা মাযারে সিজদা করে, পীরের কাছে মনস্কামনা সফলের বিশ্বাস করে এবং বেশরা পীর ফকির বাউল ইত্যাদিরা হল মুরজিয়্যা ফেরকার বর্তমান সংস্করণ। কারণ মুরজিয়্যাদের বিখ্যাত মতবাদ হল-
১। নাজাতের জন্য ইমানই যথেষ্ট। আমল ইবাদতের কোন দরকার নাই, পাপেও কোন ক্ষতি নাই। ২। নারীরা হল বাগানের ফুলের ন্যায়। যে ইচ্ছা সেই ভোগ করতে পারে, বিয়ে শাদির দরকার নাই। ঠিক একইভাবে ভণ্ডরা মনে করে মাযারে আনাগুনা করা বা একজন পীর ধরাই যথেষ্ট, আমল ইবাদতের দরকার নাই, গুনাহ করলেও ক্ষতি নাই। আবার কিছু কিছু মাযার বেশ্যাদের আখড়ায় পরিনত হয়েছে। সেগুলিতে খারাপ মেয়ে লোক ও উঠতি বয়সের ছেলেদের আনাগুনা যথেষ্ট। কাজেই সুন্দর মিল পাওয়া যায়।
আবার বর্তমানের আহলে হাদীস ও সালাফিদের সাথে আগেকার কাদরিয়্যা ফেরকার কিছুটা মিল রয়েছে। কারণ কাদরিয়্যাদের প্রসিদ্ধ দর্শন ছিল-
১। মানুষের সকল কাজের স্রস্টা সে নিজেই, আল্লাহ নয়। এমনকি প্রানি জগতের প্রত্যেকের কাজের স্রস্টা প্রানি নিজে, আল্লাহ নয়। তাতে আল্লাহ্র কোন হাত, ইচ্ছা বা পরিকল্পনাও নাই।
২। কবিরা গুনাহগার মুমিনও নয় কাফেরও নয় বরং দুই অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থান করে।
৩। আলাহ হলেন আদেল ইনসাফগার। কাজেই তিনি গুনাহগারকে মাফ করতে পারবেন না, শাস্তি দিতে বাধ্য, নেককারকে পুরুস্কার দিতে বাধ্য। অন্যথায় তিনি আদেল থাকবেন না।
তদ্রুপ আহলে হাদীস ও সালাফিদের কঠোরতা ও বাড়াবাড়ির কারনে তারা কাদরিয়্যা দর্শনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কারণ তারা দুচোখে পাপ ছাড়া আর কিছুই দেখে না, যেদিকেই তাকায় শুধু দেখে পাপ আর পাপ। এই পাপের ভয়েই জায়েয বিষয়কেও তারা হারাম করে দিয়েছে। যেমন মাযহাব অনুসরণ, হকপন্থি পীর মুরিদী, তাবিজ কবজ, বুজুর্গানে দ্বীনের কবর যিয়ারত হারাম। এমনকি যিয়ারতের নিয়তে রাসূল (সাঃ) এর মাযারের উদ্দেশ্যে ভ্রমন করাও হারাম। অর্থাৎ তারা বলতে চাচ্ছে আল্লাহ আদেল, কাজেই চুন থেকে পান খসলেই শাস্তি দিবেন, মাফ করবেন না। অথচ তারা নিজেরা যে ফিরকাবাজির মত হারামে লিপ্ত রয়েছে, ইসরাইলের বন্ধু মুসলমানদের শত্রু সৌদি রাজ পরিবারের দাসত্ব করছে সেদিকে ফিরেও তাকায় না।
যাই হউক আমি বলতে চাচ্ছি যেসব ব্যধির কারনে পুর্বের ফেরকাগুলি গুমরাহ হয়েছিল অনুসন্ধান করলে সেইসব ব্যধি বর্তমানের একক ফেরকায় পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন ফেরকায় পাওয়া যাবে এবং হুবহু মিলে যাবে। এ জনই আমি বলেছি ইমাম কুরতুবি এ যুগের হলে অত্র আয়াতের প্রতিপাদ্য হিসাবে বর্তমানের ফেরকাগুলির নামোল্লেখ করতেন।
৩য় ব্যাখ্যাঃ রাসূল (সাঃ) এর হাদীস ও প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বুঝা গেল, যারা দ্বীনের মধ্যে বিদাত সৃষ্টি করে জামাত থেকে বের হয়ে গেছে, নতুন দল সৃষ্টি করেছে, ফিরকাবাজি করেছে, উক্ত আয়াত দ্বারা তারাই উদ্দেশ্য। কিয়ামতের দিন তাদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যাবে এবং তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। এখন উম্মাহর অনুসন্ধান করতে হবে, কারা বিদাত সৃষ্টি করে ফিরকার জন্ম দিল। বিদাত শব্দের অর্থ কোন কিছু নতুন সৃষ্টি করা, পরিভাষায় নতুন সৃষ্ট কোন বিষয়কে ইসলামের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া এবং তা সওয়াবের বিষয় মনে করা। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবির (রঃ) আগে ভারত বর্ষে কোন ফিরকার অস্তিত্ব ছিল না, সবাই ছিল সুন্নী হানাফী মুসলমান। ইংরেজ আমলে নতুন নতুন বিদাত জন্ম নেয় আর তা অবলম্বনে বিভিন্ন ফিরকার আবির্ভাব ঘটে।
যেমন বেরেলভীরা দুটি বিদাত সৃষ্টি করল, রাসুল (সা) গায়েব জানেন, তিনি নুরের সৃষ্টি। জামাত দুটি বিদাত জন্ম দিল, নবীগন মা’সুম- নিস্পাপ কিনা, সাহাবায়ে কেরাম মি’ইয়ারে হক বা সত্যের মাপকাটি কিনা। এভাবে তারা শরিয়ত বহির্ভুত বিষয়ের উপর বিতর্কের জন্ম দিয়ে উম্মাহ থেকে বিছিন্ন হয়ে পৃথক ফিরকায় পরিণত হল। একই ভাবে জিহাদের বিকল্প তাবলীগ- এ বিতর্কে তাবলিগীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বিজ্ঞান থেকে ধর্মীয় শিক্ষা আলাদা করে দেওবন্দীরা উম্মাহর শিক্ষা ও চিন্তাধারা বিভক্ত করে দিল। সালাফী ও আহলে হাদীসরা মাযহাব ও তাকলিদ বিতর্কে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ধারায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার বিতর্কে জামাত, ব্রাদার হুড ইত্যাদিরা পৃথক হয়ে গেল। সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠার বিতর্কে তালেবান, আল কায়েদা, আইসিস ইত্যাদিরা উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
আবার মিলাদ, কিয়াম, মাযার যিয়ারত, দুয়াল্লিন-যুয়াল্লিন, রুকু সেজদায় হাত উঠানো না উঠানো, তারাবি আঁট রাকাত নাকি বিশ রাকাত, একই দিনে রোযা ঈদ ইত্যাদি জাতীয় বিদাতের জন্য নতুন নতুন ফিরকার জন্ম হচ্ছে। আরো অসংখ্য বিদাত বা নতুন নতুন মতবাদ সৃষ্টি করে উম্মাহ শত শত ফিরকায় বিভক্ত হয়ে গেছে। আর এসব ফিরকা একে অন্যের সাথে কোনরুপ ভ্রাতৃত্ব বোধ তো দুরের কথা বরং তারা পরস্পরকে এতটাই ঘৃণা করে, একে অন্যকে ধবংসের এতটাই প্রচেষ্টা করে যে, কাফেররাও অন্তত এতটা করে না। ফলে একেকটা ফিরকা আজ পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যালঘুতে পরিনত হয়েছে। বর্তমানে উম্মাহর পরিচয় হচ্ছে,পরস্পর বিদ্বেষী অসংখ্য সংখ্যালঘু জাতি বা ফিরকার একটা সমষ্টি। সঙ্গত কারণেই মুসলিম জাতি বলতে বোঝায় পৃথিবীর দুর্বলতর একটা জাতি। কাজেই বুঝা যাচ্ছে, এই বিদাত ও ফিরকাবাজীই ইসলাম ও মুসলিম জাতি ধ্বংস করছে, এমনকি ইসলাম ও মুসলিম পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। এ জন্যই আল্লাহ তা’লা এ জাতীয় বিদাত ও বিদাত সৃষ্টিকারী ফিরকাবাজদের জন্য ঐ কঠিন শাস্তি নির্ধারন করেছেন। কিয়ামতের দিন তাদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হবে আর তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
অনুসিদ্ধান্তঃ এবার সবাই আমার প্রশ্নের জবাব দিন। উপরোক্ত আলোচনায় ফিরকাবাজরা উক্ত আয়াতের প্রতিপাদ্য কাফের প্রমানিত হল কিনা? সবাই চেঁচাল, হা হয়েছে, ওরা কাফের। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, প্রত্যেক ফিরকার মুরুব্বিরা ফিরকা সংক্রান্ত কোরান হাদিসের এসব কঠোর বিধান স্ব স্ব অনুসারী ও জনগনকে জানায় কিনা? সবাই বলল, না না জানায় না। তাহলে এরা আল্লাহ রাসুলের গাদ্দার প্রমানিত হল। আর এসব গাদ্দারদের বিচার প্রয়োজন কিনা? সবাই বলল, অবশ্যি প্রয়োজন। মোজাহিদ বলল, শ্রদ্ধেয় উস্তাদ আপনি এ প্রস্তাব পাশ করুন। হাসান মুসান্না দাঁড়িয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, এ বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত আছে? সকলে সমস্বরে চেঁচাল, না না দ্বিমত নাই, আপনি রায় ঘোষণা করুন। তিনি বললেন, এ মর্মে প্রস্তাব পাশ হল যে, ফিরকাবাজরা কাফের, গাদ্দার। কাজেই জনগন ও সরকারের উপর এই গাদ্দারদের বিচার ভার ন্যাস্ত হল, ইনকুইজিশন কোর্টে তোলে তাদের বিচার করতে হবে।
মোজাহিদ আবার বলল, দীর্ঘ আলোচনায় প্রমানিত হল যে, উক্ত আয়াত দ্বারা ফিরকাবাজরা মানে আমরা উদ্দেশ্য, যেহেতু আমরা সবাই ফিরকাবন্ধি। কাজেই সবাই আত্মস্বিকৃতি দান করুন যে, আমরা সবাই কাফের। কিন্তু কেউ কথা বলল না, সবাই মাথা নিচু করে বসে থাকল। মোজাহিদ বলল, উস্তাদজি উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমানিত হয়েছে ফিরকাবাজরা কাফের। কাজেই আপনি সবাইকে কাফের হিসাবে রায় ঘোষণা করুন। হাসান মুসান্না হাসলেন। তারপর বললেন, কেউ পাপের আত্মস্বিকৃতি দেয় না, এমনকি আল্লাহ্র দরবারেও দিবে না, তখন তাদের হাত পা নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-
يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿النور: ٢٤﴾ - সেদিন (ক্বিয়ামতে) তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তাদের জিহবা, তাদের হাত ও তাদের পা, যা কিছু তারা করত; (২৪: ২৪)
কাজেই কানা তো মনে মনে জানাই। আমরা জানি যে আমরা কুফুরি অবস্থায় আছি। সুতরাং আমরা এখন ফিরকাবাজি থেকে তওবা করব, ঐক্যের শপথ নিব এবং ফিরকাবাজ আলেমদের হত্যার অঙ্গিকার করব। আর তা পৃথিবির গোশায় গোশায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ফেরকায় যুক্ত সকল মুসলমানের তওবা ও অঙ্গিকার বলে গণ্য হবে। তারপর তিনি আসরের সবাইকে তওবা ও শপথ বাক্য পাঠ করালেন। মজলিসে চাপা কান্নার আওয়াজ উঠল।
বিষয়: রাজনীতি
৭০৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন