সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ১2
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৩ জুলাই, ২০১৭, ১২:০১:৪৬ দুপুর
ইহুদী-খৃষ্টান সম্প্রদায়ের ন্যায় বিভক্তি হারামঃ
(وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ﴿آلعمران: ١٠٥﴾
আর তাদের মতো হয়ো না যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল আর মতভেদ করেছিল তাদের কাছে সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী আসার পরেও। আর এদেরই জন্য আছে কঠোর শাস্তি (৩: ১০৫)
যোগসুত্র ও ব্যাখ্যাঃ- পূর্বের আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা নির্দেশ দিয়েছেন –উম্মাহর মধ্যে একটি দল আমরে বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকার- এর দায়িত্ব পালন করবে, অন্যান্য কাজের সাথে তাদের প্রধান কাজ হবে উম্মাহকে বিভক্তির হাত থেকে বাচিয়ে ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখা। কিন্ত এরপরেও যারা জাতির মধ্যে ইহুদী- খৃষ্টানের ন্যায় ফিরকা বিভক্তির সৃষ্টি করবে তাদের জন্য আল্লাহ্ তা’লা কঠোর হুসিয়ারি প্রদান করেছেন। তিনি বলেন ইহুদী- খৃষ্টানরা কিতাব প্রাপ্ত হওয়ার পরও নিজেদের হিংসা বিদ্বেষের ((بغيا بينهم কারণে বিভক্ত হয়েছিল তদ্রুপ কোরান প্রাপ্তির পরও তোমরা বিভক্ত হলে কঠিন শাস্তির যোগ্য হবে। এখানে- وَأُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ-(তাদেরই জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি) ফিরকাবাজ মুসলমানদেরকে বলা হয়েছে, ইহুদী-খৃষ্টান সম্পর্কে বলা হয়নি।
বিভিন্ন তাফসীরের মতামতঃ এখানে – وَلَا تَكُونُوا - নাহী বা নিষেধাজ্ঞার সীগা (শব্দরূপ) যা দ্বারা হারাম সাব্যস্থ হয়। অর্থ তোমরা ইহুদী খৃষ্টানের ন্যায় বিভিন্ন ফিরকায় বিভক্ত হয়ো না। ইমাম ইবনে কাছির বলেন- يَنْهَى هَذِهِ الْأُمَّةَ أَنْ تَكُونَ كَالْأُمَمِ الْمَاضِيَةِ فِي تَفَرُّقِهِمْ وَاخْتِلَافِهِمْ، وَتَرْكِهِمُ الْأَمْرَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيَ عَنِ الْمُنْكَرِ مَعَ قِيَامِ الْحُجَّةِ عَلَيْهِمْ. – অত্র আয়াতে আল্লাহ তা’লা এ উম্মতকে নিষেধ করেছেন যে, তোমরা অতীতের জাতিগুলির ন্যায় দলীল প্রমাণ থাকা সত্বেও মতভেদ করে বিভক্ত হয়ো না এবং আমরে বিল মা’রুপ ও নেহি আনিল মুনকার পরিত্যাগ করো না। - كَالَّذِينَ- দ্বারা ইহুদী খৃষ্টান উদ্দেশ্য, তবে কেউ কেউ বলেন এর দ্বারা – اهل بدعة- অর্থাৎ যারা ইসলামের মধ্যে নতুন মতবাদ সৃষ্টি করে মুসলিম জামাত থেকে পৃথক হয়ে গেছে তারা উদ্দেশ্য। ইবনে আব্বাস বলেন, অত্র আয়াতে আল্লাহ তা’লা মুমিনদেরকে জামাতবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, এখতেলাফ ও বিভক্তি থেকে নিষেধ করেছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন-দ্বীনের ব্যাপারে ঝগড়া ও বিরোধ করে পুর্ববর্তীরা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বিভক্তি বাদী প্রতিটি ফিরকা সরাসরি অত্র আয়াতের প্রতিপাদ্য এবং তাদেরকে সরাসরি মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দেয়া হয়েছে- وَأُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ - আর এদেরই জন্য আছে কঠোর শাস্তি।
মুসনাদে আহমদে এসেছে, عن أَبِي عَامِرٍ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ لُحَيٍّ قَالَ: حَجَجْنَا مَعَ مُعَاوِيَةَ بْنِ أَبِي سُفْيَانَ، فَلَمَّا قَدِمْنَا مَكَّةَ قَامَ حِينَ صَلَّى [صَلَاةَ] الظُّهْرِ فَقَالَ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: "إنَّ أهْلَ الْكَتَابَيْنِ افْتَرَقُوا فِي دِينِهِمْ عَلَى ثنتيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً، وإنَّ هذِهِ الأمَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً -يَعْنِي الْأَهْوَاءَ-كُلُّهَا فِي النَّار إِلَّا وَاحِدَةٌ، وَهِيَ الْجَمَاعَةُ، وَإِنَّهُ سَيَخْرُجُ فِي أُمَّتِي أَقْوَامٌ تُجَارى بِهِمْ تِلْكَ الأهْواء، كَمَا يَتَجَارى الكَلبُ بصَاحِبِهِ، لَا يَبْقَى مِنْهُ عِرْقٌ وَلا مَفْصِلٌ إِلَّا دَخَلَهُ. واللهِ -يَا مَعْشَر العَربِ-لَئِنْ لَمْ تَقُومُوا بِمَا جَاءَ بِهِ نَبِيُّكُمْ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَغَيْرُكم مِن النَّاسِ أحْرَى أَلَّا يَقُومَ بِهِ". –
অর্থাৎ হযরত মোয়াবিয়া (রাঃ) হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্বায় আগমন করেন। যহুরের নামাজের পর তিনি দাঁড়িয়ে বলেন, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, আহলে কিতাব তাদের ধর্মের ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি করে ৭২ ফিরকায় বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মত ৭৩ ফিরকায় বিভক্ত হবে। অর্থাৎ সবাই প্রবৃত্তির বশীভুত হয়ে পড়বে। তাদের একটি দল ব্যতীত সবাই জাহান্নামী হবে। আর সেই দলটি হল জামাত। (অর্থাৎ যারা নিজেরা ঐক্যের উপর থাকবে এবং অন্যদেরও রাখার চেষ্টা করবে)। আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকও হবে যাদের শিরায় শিরায় কুপ্রবৃত্তি এমনভাবে প্রবেশ করবে যেমন কুকুরে কাটা ব্যক্তির শিরায় শিরায় বিষক্রিয়া পৌছে যায় (ফিরকাবাজ আলেম)। হে আরববাসীগণ, তোমরাই যদি তোমাদের নবীর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত না থাক, তাহলে অন্যরা তো আরো দূরে সরে পড়বে।
ব্যাখ্যাঃ- ফিরকা সংক্রান্ত উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে-
১। ৭৩ ফিরকায় বিভক্তরা প্রবৃত্তির অনুসারী হবে, তাদের শিরায় শিরায় ফিরকাবাজির বিষ ছড়িয়ে পড়বে। এরাই হল ফিরকাবাজ আলেমরা, ফিরকার হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতা তাদের দেহ মনে বিক্রিয়া হয়ে গেছে।
২। আবার একমাত্র নাজাত প্রাপ্ত দল তারাই-যারা আমরে বিল মা’রুপ ও নেহি আনিল মুনকার-এর আওতায় নিজেরা ফিরকা বিভক্তি না করে ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং অন্যদেরও রাখার চেষ্টা কর। কাজেই হাদীসের আলোকে বুঝা যাচ্ছে, মুসলমানদের বিভিন্ন ফিরকা যেমন শিয়া, সুন্নী, বেরেলভী, দেওবন্দী, তাবলীগী, জামাতী, সালাফী ইত্যাদি প্রতিটি ফিরকা নিজেদেরকে নাজি বা নাজাত প্রাপ্ত দল মনে করে আর অন্যদেরকে ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করে- তাদের এ দাবী ভ্রান্ত। হাদীসের মধ্যেই এর জবাব নিহিত আছে।
১। রাসুল (সা) স্পষ্ট বলেছেন- كُلُّهَا فِي النَّار إِلَّا وَاحِدَةٌ، وَهِيَ الْجَمَاعَةُ، - একটি দল ছাড়া সবাই জাহান্নামে যাবে, সেই দলটি হল জামাত বা ঐক্যবদ্ধ দল।
২। অত্র হাদীসে ফিরকাবাজি ও বিভক্তিকে জাহান্নামের কারণ দর্শানো হয়েছে। কাজেই যারা ফিরকাবাজি করবে না বরং ঐক্যের চেষ্টা করবে, বিভক্তিতে বাধা দিবে তারাই মুক্তি প্রাপ্ত দল হিসাবে গণ্য হবে। সুতরাং আমরে বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকার এর আওতায় মুসলমানদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে-উম্মাহকে ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখা, বিভক্তিতে বাধা প্রদান করা, প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
এখন আমার প্রশ্ন হল, আলেমরা কি এ আয়াতের নির্দেশ মানছে, ৭৩ ফিরকার হাদিস মানছে নাকি অমান্য করেছে? সবাই হাত উঠিয়ে সমস্বরে চিৎকার করল, ‘না না মানেনি বরং অবাধ্যতা করেছে। মাও; মোজাহিদ বলল, হা তারা কোরান হাদিসের নির্দেশ উপেক্ষা করে উম্মাহকে শত শত ফিরকায় বিভক্ত করেছে। ইহুদি খৃষ্ট পোরুহিত রাব্বিদের ন্যায় বিভক্ত করে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে। আচ্ছা ফিরকাবাজী সম্পর্কে কোরান হাদিসে যে এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে প্রত্যেক ফেরকার মুরুব্বিরা কি সেগুলি তাদের অনুসারিদেরকে জানাচ্ছে, নাকি গোপন রাখছে? সবাই বলল, ‘না, জানাচ্ছে না গোপন রাখছে, জানালে তো এত সব ফিরকা বিভক্তি থাকত না। মোজাহিদ বলল, কাজেই এখন আমার প্রশ্ন হল পৃথিবীতে আল্লাহ রাসূল (সাঃ) এর সবচেয়ে বড় দুষমন কে, সবচেয়ে বড় গাদ্দার কে, সবচেয়ে বড় দাজাল কে? ইসলাম ও উম্মাহর সবচেয়ে বড় দুষমন কে, ইহুদি খৃস্টান নাকি ফিরকাবাজ আলেমরা? সবাই সমস্বরে চেঁচাল, ফিরকাবাজ আলেমরা।
মোজাহিদ বলল, গাদ্দারির তো একটা সীমা আছে। মানুষ মানুষের সাথে গাদ্দারি করতে পারে, অমুসলিম ও নাস্তিক মুরতাদরা আল্লাহ রাসুলের সাথে গাদ্দারী করতে পারে। কিন্তু আলেম হয়ে, রাসুলের সুন্নাত গায়ে জড়িয়ে, ইসলামের দায়ী সেজে, আল্লাহ রাসুলের প্রতিনিধি দাবী করে তাদের সাথেই চূড়ান্ত গাদ্দারি করছে, মোনাফেকি করছে, ইদুরের ন্যায় ইসলামকে ভিতর থেকে কেটে ধংস করে দিচ্ছে। এরাই হল ঘরের শত্রু বিভীষণ। এদের তো কঠিন বিচার হওয়া দরকার, গীর্জার ইনকুইজিশন কোর্টের ন্যায় আগুনে পোড়িয়ে মারা দরকার। কাজেই শ্রদ্ধেয় ইমাম, আপনি প্রত্যেক ফেরকার মুরুব্বি নামক শয়তানদের আল্লাহ রাসুল ইসলাম ও উম্মাহর দুষমন, গাদ্দার ও দাজ্জাল বলে রায় ঘোষণা করুন এবং তাদের ধংসের আহ্বান জানান। কারণ এদের ধংস ব্যতীত ইসলাম ও উম্মাহর মুক্তি জুটবে না।
হাসান মুসান্না দাঁড়িয়ে বললেন, ‘প্রত্যেক ফেরকার আলেমরা কোরান হাদিসের নির্দেশ অগ্রায্য করে উম্মাহকে বিভক্ত করেছে, আবার ফিরকা সংক্রান্ত নস গুলি গোপনও রাখছে। কাজেই এরাই হল প্রকৃত গাদ্দার ও দাজ্জাল- এ বিষয়ে কারো কোন আপত্তি আছে? কেউ কথা বলল না। তিনি বললেন, তাহলে এই প্রস্তাব পাশ হল এবং ফিরকাবাজদের ধংসের ডাক দেয়া হল। সবাই শপথ নিন, স্ব স্ব ফিরকার মুরুব্বি ধ্বংস করা হবে, পৃথিবীতে বাঘ সিংহ মানব দানব সবই থাকবে কিন্তু ফিরকাবাজ নামের কোন প্রানীর অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ –
أُولَٰئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ ﴿الأعراف: ١٧٩﴾ - এরা হল চতুস্পদ প্রাণীর ন্যায়, বরং এর চেয়েও নিকৃষ্ট, এরাই গাফেল।
বিষয়: রাজনীতি
৬৮৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন