সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ৯

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৭ জুন, ২০১৭, ১২:২৫:৪৭ রাত

মাওঃ মোজাহিদ দাঁড়িয়ে আবার শুরু করল ‘এখন আমরা ফিরকা সম্পর্কে কোরআন হাদীসের বিধান শুনব। আমি প্রথমে কোরআন তারপর হাদীস নিয়ে আলোচনা করব। এখন সুরা আল ইমরানের ১০২ থেকে ১১০ পর্যন্ত আয়াতের আলোচনা পেশ করছি। আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেন--

আল্লাহকে ভয়ের প্রধান বিষয়-

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ﴾

হে ঈমানদারগণ ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো৷ মুসলিম থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়। (আল-ইমরান/১০২)

শানে নুযুলঃ তাফসীরে বগবীতে বলা হয়েছে, জাহেলি যুগে আওস ও খাজরায গোত্রদ্বয় একে অন্যের খুনখার শত্রু ছিল। তাদের মধ্যে ১২০ বছর মেয়াদি যুদ্ধ চলছিল। রাসূল (সাঃ) হিজরতের পর তাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু পরবর্তিতে আওস গোত্রের ছালাবা বিন গনম ও খাযরাযের আসআদ বিন যুরারা আত্মম্ভরিতায় লিপ্ত হল। ছালাবা বললেন, আমাদের মধ্যে দুই সাক্ষীর অধিকারী খুযাইমা বিন ছাবিত, ফেরেশতা কর্তৃক গোসল প্রদত্ত হানযালা, আসেম বিন ছাবেত ও সাদ বিন মুয়াজ- যার মৃত্যুতে আল্লাহ্‌র আরশ কেপেছিল এবং বনু কুরায়যা সম্পর্কে যার ফয়সালায় আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন - এমন সব ব্যক্তিত্ব আছেন। তোমাদের মধ্যে এমন মর্যাদাবান কে আছে?

তখন খাযরাজি বললেন, আমাদের মধ্যে চারজন কোরানের বিশিষ্ট বিজ্ঞ ব্যক্তি আছেন, উবাই বিন কা’ব, মুয়াজ বিন জাবাল, যায়দ বিন ছাবেত ও আবু যায়েদ। তাছাড়া আছেন, সা’দ বিন উবাদার মত আনসারদের নেতা ও খতিব। এভাবে কত্থাবার্তার মধ্যে তারা ক্রোধান্বিত হয়ে উঠে, জাহেলি কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে আর গর্ব করতে থাকে। তখন আওস ও খাজরাযের লোকেরা অস্ত্র শাস্ত্র নিয়ে দৌড়ে আসে। তা শুনে রাসূল (সাঃ) সেখানে গিয়ে তাদের শান্ত করেন। আর তখনই এ আয়াত নাযিল হয়।

যোগসুত্রঃ উক্ত আয়াতে আল্লাহ্‌ তা’লা নির্দেশ দিয়েছেন তাকে যথোপযুক্ত ভয় করার। আর আল্লাহকে ভয় করার বিষয়াবলীর মধ্যে প্রধান বিষয় হল উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি ও ফাটল সৃষ্টি না করে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ। এ জন্যই পরের আয়াতে আল্লাহ তা’লা ঐক্যের নির্দেশ এবং বিভক্তি সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছেন। কারণ বিভক্তি ও ফিরকাবাজি ইসলামের যতটুকু ক্ষতি করে অন্য কোন বিষয় ততটা ক্ষতি করতে পারে না। যেমন কোন মুসলমান নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি কোন কিছুই আদায় না করলে তার ব্যক্তিগত ক্ষতি হয় কিন্ত ইসলাম ও উম্মাহর তেমন কোন ক্ষতি হয় না। পক্ষান্তরে উম্মাহর মধ্যে ফিরকা ও বিভক্তি সৃষ্টি হলে তারা পরস্পর মারামারি-হানাহানিতে লিপ্ত হয়, একে অপরকে ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় নামে। ফলে কাফেররা তাদেরকে ধ্বংসের সুযোগ পায়। কোরান ও হাদিসের মূল বার্তা হচ্ছে, সকল কাফের এক সম্প্রদায়, মুসলিম নিধনে একমত। এজন্যই বর্তমানে দেখা যায় মুসলমানরা নিজেরা নিজেরা তো কামড়া কামড়ি করে মরছেই সেই সাথে সকল কাফের শক্তি একাট্টা হয়ে মুসলিম ধ্বংসে তৎপর রয়েছে। বর্তমান বাস্তবতাই সাক্ষ্য দিচ্ছে ফিরকা-বিভক্তি মুসলিম জাতিকে কতটা দুর্বল করে দিয়েছে, আর দুর্বল জাতি আল্লাহ্‌র নির্দেশ-

وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ (বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর) পালন করতে পারে না। অথচ আল্লাহর ইচ্ছা-

بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ ﴿التوبة: ٣٣﴾ هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ– তিনিই সেইজন যিনি তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন পথনির্দেশ ও সত্য-ধর্মের সাথে যেন তিনি উহাকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করতে পারেন, যদিও মুশরিকরা তা চায় না। (৯: ৩৩) এ জন্যই আল্লাহ্‌ তা’লা তাকে ভয়ের বিষয়াবলির মধ্যে বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার বিধানকে অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বাগ্রে উল্লেখ করেছেন।

একজন দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল ‘আল্লাহকে ভয়ের প্রধান বিষয় ঐক্যবদ্ধ থাকা বিভক্ত না হওয়া- এর প্রমাণ কি? মোজাহিদ উত্তর দিল, এর প্রমাণ তো অত্র আয়াতের শানে নুযুলের মধ্যেই আছে। এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে আওস ও খাজরাযের ঝগড়ার কারণে। আল্লাহ তালা বলে দিয়েছেন নিজেদের মধ্যে বিবাদের ক্ষেত্রে আল্লাহকে যথাযথ ভয় কর। পরের আয়াতে বলে দিয়েছেন কোরানকে অবলম্বন করে ঐক্যবদ্ধ থাক বিভক্ত হয়ো না। আবার অত্র আয়াতের শেষে বলেছেন, পুর্নাংগ মুমিন না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না, অর্থাৎ ফিরকাবাজি করে ফিরকাবন্ধি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না। কারণ এটা কুফুরি।

ঐক্য ফরজ বিভক্তি হারাম-

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ﴾

তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করে বিভক্ত হয়ো না ৷ আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো ৷ তোমরা ছিলে পরস্পরের শক্র ৷ তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন৷ ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো৷ তোমরা একটি অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে৷ আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়ে নিয়েছেন।এভাবেই আল্লাহ তাঁর নির্দশনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলেন ৷ হয়তো এই নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা সরল পথ দেখতে পাবে। (আল-ইমরান/১০৩)

ব্যাখ্যাঃ- تمسك শব্দের অর্থ কোন কিছু পাঁচ আঙ্গুলে দৃঢ়ভাবে, শক্ত করে ধারণ করা। কিন্তু اعتصام শব্দের অর্থ উভয় হাতে শক্ত করে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে জাবরে ধরা।

حبل -অর্থ রশি অর্থাৎ কোরান। বাইবেলে কোরানকে কোলা (ফুরকান) ও আগুন (জিহাদ) বলা হয়েছে। কোরানকে রশির সাথে তুলনা করার কারণ হচ্ছে উভয়টাই নিরাপত্তার মাধ্যম। যেমন গরু ছাগলের গলায় যদি রশি থাকে তাহলে সেই প্রাণী অন্যের ক্ষতি ও নিজের ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকে। তখন সে চড়তে চড়তে বা ঘুরতে ঘুরতে অন্যের ফল ফসল পয়মাল করতে পারে না। তেমনি পাহাড়ে জঙ্গলে ঢুকে গিয়ে বাঘ সিংহ ইত্যাদি হিংস্র প্রানীর খাদ্য হওয়া থেকে নিরাপদ থাকে। অনুরূপভাবে কোরআন হচ্ছে আল্লাহ্‌র রশি যার একপ্রান্ত বান্দার গলায় বাধা অন্য প্রান্ত আল্লাহ্‌র হাতে অর্থাৎ বান্দা ও আল্লাহ্‌র মধ্যে সেতু বন্দন বা যোগাযোগের মাধ্যম। যেমন রাসূল (সাঃ) বলেছেন- কোরআন হচ্ছে আকাশ থেকে মাটিতে ঝুলানো আল্লাহর রশি।

جمعيا-অর্থ একত্রে, সম্মিলিতভাবে, ঐক্যবদ্ধভাবে। এ শব্দটি –اعْتَصِمُوا-এর সর্বনামের তাকীদ হয়েছে। - تَفَرَّق- অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, বিভক্ত হওয়া, দলে দলে ভাগ হয়ে যাওয়া।

মুফাসসীরিনে কেরামের মতামতঃ—حبل-অর্থ এমন উপায় উপকরণ যার মাধ্যমে উদ্দেশ্য ও অভীষ্ট লক্ষে পৌছা যায়। কেউ কেউ বলেন এর দ্বারা উদ্দেশ্য জামাত অর্থাৎ মুসলিম ঐক্য। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহর সাথে প্রদেয় অঙ্গিকার। তবে হাবলুন দ্বারা কোরআনই উদ্দেশ্য হবে, কারণ রাসূল (সাঃ) বলেন-

. عن أبي سعيد الخدري قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: كتاب الله، هو حبل الله الممدودُ من السماء إلى الأرض. – অর্থাৎ কোরআন হচ্ছে আকাশ থেকে মাটিতে ঝুলানো আল্লাহর রশি।

وَلَا تَفَرَّقُوا --অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কোনরূপ বিভক্ত না হওয়া এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের ব্যাপারে পরস্পর মিলে মিশে ঐক্যবদ্ধ থাকা। পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাওয়া। বিভক্তি সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) কঠোরভাবে সতর্ক করে গেছেন—

أنس بن مالك قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم:"إنّ بني إسرائيل افترقت على إحدى وسَبعين فرقة، وإن أمتي ستفترق على اثنتين وسبعين فرقة، كلهم في النار إلا واحدة. قال: فقيل: يا رسول الله، وما هذه الواحدة؟ قال: فقبض يَدَه وقال: الجماعة،" – অর্থাৎ রাসূল (সাঃ)ইরশাদ করেন, বনী ইসরাইল ৭১ ফিরকায় বিভক্ত হয়েছে, কিন্তু আমার উম্মত ৭২ ফিরকায় বিভক্ত হবে। তাদের একটি দল ব্যতিত সবাই জাহান্নামি। তখন রাসূল (সাঃ) কে প্রশ্ন করা হল, সেই একটি দল কারা? উত্তরে রাসূল (সাঃ) হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন ‘জামাত তথা ঐক্যবদ্ধ দল। অর্থাৎ যারা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করবে।

বিধানঃ- উক্ত আয়াতের শরয়ী বিধান হচ্ছে ঐক্য ফরজ বিভক্তি হারাম। কারণ উসূলে ফিকহের মূলনীতি হচ্ছে –الامر للوجوب والنهي للحرام-অর্থাৎ কোরআনের আমর বা অনুজ্ঞা দ্বারা ওয়াজিব সাব্যস্থ হয় আর নিষেধাজ্ঞা দ্বারা হারাম সাব্যস্থ হয়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। সুতরাং -َاعْتَصِمُوا- আমর দ্বারা এখানে তিনটি ওয়াজিব সাব্যস্থ হয়েছে।যেমন-

১। আমর বা অনুজ্ঞা হওয়ার কারণে ওয়াজিব

২।– جمعيا(ঐক্যবদ্ধভাবে) দ্বারা তাকীদ হওয়ার কারণে ডবল ওয়াজিব।

৩। পরিস্থিতির কারণে ওয়াজিব। যেমন কোন মুসলিম দেশ আক্রান্ত না হলে মুসলিম অধিকার খর্ব না হলে স্বাভাবিক অবস্থায় জিহাদ ফরজ নয়। কিন্তু আক্রান্ত হলে জিহাদ ফরজ, এমনকি নারী পুরুষ গোলাম সকলের উপরেই ফরজে আইন হয়ে যায়। অর্থাৎ পরিস্থিতি অনুযায়ী বিধান প্রযোজ্য হয়। অনুরূপভাবে মুসলিম ঐক্য যদি কোরআনের বিধান অনুসারে পূর্ব থেকে ফরয নাও থাকত তবুও মুসলিম বিশ্বের বর্তমান বিপর্যস্থ পরিস্থিতিতে ঐক্য ফরজ বলে গন্য হত। কিন্তু -اعتصام- দ্বারা ঐক্য পূর্ব থেকেই ফরজ সাব্যস্থ হয়ে আছে, এখন পরিস্থিতির কারণে আবার ফরজ হল। কাজেই এখন মুসলিম ঐক্য সর্ব দিক থেকে واجب الوجوب- তথা মহা ফরজ হয়ে গেছে। আবার - وَلَا تَفَرَّقُوا-(তোমরা দলে দলে বিভক্ত হয়ো না) এটা নাহি বা নিষেধাজ্ঞার শব্দরুপ। এর দ্বারা বিভক্তিকে হারাম করা হয়েছে। আবার বিভক্তির কারণে মুসলিম জাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিধায় পরিস্থিতির কারণে তা আবার হারাম হল। সুতরাং উক্ত আয়াত তিনদিক থেকে ঐক্য ফরয করেছে এবং দুই দিক থেকে বিভক্তি হারাম করেছে।

ব্যস অত্র আয়াত দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হল যে, উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ফরয বিভক্তি হারাম। আর ইসলামের মূলনীতি হচ্ছে ফরয অস্বিকার কারী কাফের, হারাম অস্বিকার কারী কাফের। যেমন কেউ নামায রোযা হজ্ব যাকাতের কোন একটা অস্বিকার করলে সর্ব সম্মত ভাবে সে কাফের। আবার কোন হারাম অস্বিকার করলে যেমন শুকর মদ যিনা খুন রাহাজানি ইত্যাদি জায়েয মনে করলে সে কাফের বলে গণ্য হবে। আর এ জাতীয় লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে যতক্ষন পর্যন্ত না ফিরে আসে। যেমন হযরত আবু বকর (রাঃ) যাকাত অস্বিকার কারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। আর যদি ফিরে না আসে তাহলে মুরতাদ হিসাবে তাদেরকে হত্যা করতে হবে। এটাই শরীয়তের অকাট্য বিধান।

এখন সকলের কাছে আমার প্রশ হল, উম্মাহর মধ্যে এই যে অসংখ্য ফিরকা তারা কি মুসলমান আছে নাকি কাফের হয়ে গেছে। কারণ তারা অত্র আয়াতের ফরয ও হারাম অস্বিকার করে বিভিন্ন ফিরকায় বিভক্ত হয়ে গেছে। এক কথায় প্রত্যেক ফেরকা এই আয়াত উপেক্ষা করেছে বা বর্জন করেছে। এখন এরা মুসলমান নাকি কাফের বলে গণ্য হবে, এর উত্তর চাই। উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি আর একটা কথাও বলব না, এই যে বসলাম।

কিছুক্ষণ কেটে গেল। কেউ কথা বলছে না দেখে একজন আলেম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কোরানের সব অনুজ্ঞা দ্বারা ফরয সাব্যস্ত হয় না। কোন কোন আদেশ মুস্তাহাব ও মুবাহ বুঝানোর জন্য আসে। যেমন- وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا - যখন তোমরা এহরাম থেকে বের হয়ে আস, তখন শিকার কর। এই فَاصْطَادُو আদেশ দ্বারা ইহরাম ভঙ্গের পর শিকার করা ওয়াজিব বুঝায় না বরং জায়েয বুঝায়। অর্থাৎ ইহরাম অবস্থায় শিকার হারাম ছিল এখন জায়েয হল। তদ্রুপ অত্র আয়াত দ্বারাও উম্মাহর ঐক্য ফরয বুঝায় না বরং মুস্তাহাব বুঝায়। অর্থাৎ ঐক্য থাকলে ভাল না থাকলেও গুনাহ হবে না। উত্তরটা শুনেই মাওঃ মোজাহিদ ছিটিয়ে উঠল, ‘নাউযুবিল্লাহ, আপনি আলেম না যালেম বুঝতে পারছি না। আপনি জেনে বুঝে কোরানের এমন একটা অপব্যাখ্যা কি করে করলেন। আসলে আপনারা ফিরকাবাজি করার জন্য কোরানের অপব্যাখ্যা শুরু করে দিয়েছেন। যাই হউক আমি এর উত্তর দিচ্ছি--

১। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর সর্ববাদি সম্মত অভিমত হল, ঐক্য ফরয ফিরকাবাজি হারাম। এ বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই- এটা ইজমায়ে উম্মাহ। ঐক্য ফরয এ বিষয়ে উম্মাতের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে সবাইকে সচেতন করছেন, ঐক্যের চেষ্টা করছেন। জামাতের অধ্যাপক গোলাম আজম লিখেছেন ‘ইসলামী ঐক্য ইসলামী আন্দোলন’। আমাদের দেওবন্দিদের মধ্যে মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার মাও আব্দুল মালেক সাব লিখেছেন ‘উম্মাহর ঐক্যঃ পথ ও পন্থা। এ দেশের বিখ্যাত হাদীস বিশারদ ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গির এ বিষয়ে অনেক বক্তব্য বিবৃতি দিয়েছেন গ্রন্থ রচনা করেছেন। ডঃ যাকির নায়েক অনেক বক্তব্য দিয়েছেন। এছাড়া আরো অনেকেই এ দিকে ডাকছেন, সবাই ঐক্য ফরয ও বিভক্তিকে হারাম বলে প্রচার করছেন। যদি তাতে কারো এখতেলাফ থাকত তাহলে নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করত, কিন্তু কেউ তা করেনি। বিশেষত আমরা দেওবন্দি ও তাবলীগীরা ডাঃ যাকির নায়েকের ঘোর বিরোধি কিন্তু সে যে ঐক্য ফরয বলে প্রচার করছে এ বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ করছি না। কারণ এখানে দ্বিমত পোষণ করার কোন সুযোগ নাই।

২। হক বা অধিকার দুই প্রকার, হক্বুল্লাহ ও হক্বুল ইবাদ। কোরানের যে সব অনুজ্ঞা এ দুটির কোনটির সাথেই সংশ্লিষ্ট নয় সেটা মুস্তাহাব বলে গণ্য হবে। যেমন, ইহরাম ভঙ্গের পর শিকার করার মধ্যে না আছে আল্লাহ্‌র ইবাদাত আর না আছে মানুষের উপকার, কারো ক্ষুধা থাকলে শিকার করবে না থাকলে করবে না। কাজেই এই অনুজ্ঞাটা মুবাহ বা জায়েয বুঝানোর জন্য। পক্ষান্তরে ই’তিসাম বা ঐক্য- এর সাথে আল্লাহ, বান্দাহ, মুসলিম উম্মাহ এমনকি সমগ্র মানবতার অধিকার সংশ্লিষ্ট। কারণ ঐক্য থাকলে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর খিলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকলে ইসলাম উম্মাহ ও সমগ্র মানবতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কিন্তু বিভক্ত হলে কি পরিনতি তাতো আমরা মুসলিম বিশ্বে স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি। কাজেই উম্মাহর ঐক্য মহা ফরয বলে গণ্য হবে।

৩। আবার আমি যদি বলি রোযা ও হজ্ব ইত্যাদি ফরয নয় শুধু মাত্র মুসলিম ঐক্য ফরয। তাহলে এর কি জবাব দিবেন? কারণ রোযা ও হজ্ব সম্পর্কে অনুজ্ঞা এসেছে কোরানের দুয়েক জায়গায় কিন্তু উম্মাহর ঐক্যের নির্দেশ এসেছে অসংখ্য জায়গায়। আবার নামায রোযা হজ্ব যাকাত আদায় না করলে শাস্তির হুমকি এসেছে কিন্তু রাসূলের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কোণ হুমকি আসেনি। অথচ সুরা আল-ইমরানের ১০৬ নং আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, ফিরকাবাজদের সাথে রাসূল (সাঃ) এর কোন সম্পর্ক বা দায় দায়িত্ব থাকবে না, আল্লাহ তাদের বিচার করবেন। এ আয়াতের আলোচনা সামনে আসছে। কাজেই ঐক্য ফরয বিভক্তি হারাম, এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেনি, করবেও না, করার সুযোগও নেই। যদি কেউ করে তাহলে সে অবশ্যি কাফের বলে গণ্য হবে। যাই হউক, আমি উত্তর চাচ্ছি উম্মাহর ফিরকাগুলি মুসলিম নাকি কাফের?

সবাই গম্ভির হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে, কেউ কোন উত্তর দিচ্ছে না। উস্তাদজি দাঁড়িয়ে বললেন, প্রত্যেক ফেরকা থেকে একজন করে উঠে দাড়ান, প্রশ্নের উত্তর দিন। কিন্তু কেউ দাঁড়াল না, সবাই অধোমুখে বিষণ্ণ হয়ে বসে রইল। কলেজের একজন প্রফেসর দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কী সর্বনাশা কথা, আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এই মোল্লাদেরকে আমরা মনে করতাম আল্লাহ্‌র খাটি বান্দাহ, দ্বীন ইসলামের একমাত্র রক্ষক, তাদেরকে কত শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি এরাই আল্লাহ রাসূল ও ইসলামের প্রধান শত্রু, এরাই ফিরকা বাজি করে সবকিছু ধ্বংস করছে। এদের তো বিচার হওয়া উচিত। মাননীয় ইমাম, আপনি বিনা নোটিশে এদেরকে কাফের ঘোষণা দিয়ে দিন, তারপর সাধারণ মানুষেই এদের ধ্বংস করবে।

হাসান মুসান্না বললেন, আমি নিজের ভাত খেয়ে তাকফিরী ফতোয়াবাজি করতে পারব না। যারা ফিরকাবাজি করছে তাদেরকে কোরআন হাদীসের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে হবে যে তারা কাফের নয়। না পারলে নিজেরাই নিজেদেরকে কাফের বলে স্বীকৃতি দিবে অথবা অস্বিকার করবে যে তারা কোরানের আয়াত মানে না। তিনি আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, প্রত্যেক ফিরকা থেকে একজন করে উঠে দাড়ান। অগত্যা শিবিরের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা কলেজ ভার্সিটিতে পড়ি। আমাদের বন্ধুরা অনেকেই ছাত্র ইউনিয়ন বা অন্য কোন বস্তুবাদী দলে যোগ দিয়েছে কিন্তু আমরা ইসলামকে ভালবাসি, ইসলামী জীবন যাপন করতে চাই। জামাত শিবির ইসলামের কথা বলে, তারা ইক্বামতে দ্বীন করতে চায় বিধায় তাদের ভাল লাগে, এ জন্যই শিবিরে যোগ দিয়েছি। সংগঠনের জন্য কত কষ্ট করেছি, টাকা পয়সা দিয়েছি, সময় ব্যয় করেছি, নিজের জীবন বিপন্ন করে মিটিং মিছিল হরতাল ধর্ম ঘট করেছি। কত যুলুম নির্যাতিন সহ্য করছি। আমাদের কত ভাই শহীদ হয়ে গেছে, কত ভাই বোন জেল হাজতে পড়ে পড়ে পচছে। তারপর ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘এত সব আমরা কেন করেছি কাফের হওয়ার জন্য, এত লাঞ্চনা দুঃখ কষ্ট কী কাফের হওয়ার জন্য। অন্য কোন দল করলে ধন সম্পদ ও নেতৃত্ব সবই পেতাম কিন্তু ইসলামী দল করে বুঝি কাফের হলাম। কেন, কে আমাদেরকে কাফের বানাল, কে আমাদের ফিরকায় পরিনত করল। যারা আমাদের এই সর্বনাশ করল তারা আসল অপরাধি, আসল কাফের। আমরা ওদের বিচার চাই।

কওমি মাদরাসার এক ছাত্র দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা জানি কওমি মাদরাসায় পড়লে কোন চাকরি নকরি পাওয়া যায় না, সবাই ফকির মিসকিন ডাকে, অবজ্ঞা করে । এতদসত্বেও একমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য, দ্বীনের খেদমত করার জন্য, ইলম শিখে নিজে আমল করার জন্য ও অন্যদেরকে জানানোর জন্য মাদরাসায় পড়তে এসেছি। কিন্তু আমাদের এই সহীহ নিয়তের আড়ালে যারা আমাদেরকে ফিরকায় পরিণত করল তারা আমাদের সাথে বেঈমানি করেছে, আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর সাথে গাদ্দারি করেছে। আমরা ছিলাম ওদের অনুসারী অথচ ওরা আমাদেরকে কুফুরির পথে ঠেলে দিয়েছে। কাজেই ওরাই প্রকৃত কাফের, আমরা ওদের বিচার চাই।

তাবলীগের একজন দাঁড়িয়ে বলল, আমরা একমাত্র ইসলাম পাওয়ার জন্য তাবলীগে ঢুকেছি। নিজেদের ঘর সংসার, চাকরি নকরি, ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে, নিজের গাটের পয়সা খরচ করে, বিদেশ বিভুইয়ে মসজিদে মসজিদে দৌড়াদৌড়ি করে, থাকা খাওয়ায় কত কষ্ট করে তাবলীগ করি। এসব ত্যাগ তিতিক্ষা কি কাফের হওয়ার জন্য? যারা আমাদেরকে বিভক্ত করল কাফের বানাল আমরা তাদের বিচার চাই। এভাবে আহলে হাদিস, বেরেলভী, মাজার পন্থী ও অন্যান্য ফেরকার একজন একজন করে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করল এবং তাদেরকে ফিরকায় বিভক্ত করার জন্য মুরুব্বীদের বিচার দাবী করল।

উস্তাদজি বললেন, ‘এতক্ষনে প্রত্যেকের হুঁশ হল যে, ফিরকাবাজিতে লিপ্ত থেকে আমরা ভুলের উপর ছিলাম, কুফুরির উপর ছিলাম। আমাদের ঈমান ও ইসলাম প্রিতির সুযোগ নিয়ে মুরুব্বি নামক ফিরকাবাজ শয়তানরা আমাদেরকে বিভক্ত করেছে। মুসলিম ভাই ভাইয়ের শত্রু বানিয়েছে, নিজেদের মুর্খতা ও জেদের কারণে আমাদেরকে জাহান্নামের পথে ঠেলে দিয়েছে। এই ফিরকাবাজ মুরুব্বীদের আলোচনা সামনে আসছে। এখন আমাদের কর্তব্য হল তওবা করা। আমরা আল্লাহ্‌র দরবারে কায়মনোবাক্যে, অনুতপ্ত হয়ে, নিবিষ্ট চিত্তে তওবা করব যে, ‘হে আল্লাহ আমরা শয়তানের প্ররোচনায় তোমার হুকুম অমান্য করে ফিরকা বাজিতে লিপ্ত হয়ে কুফুরি অবস্থায় চলে গিয়ে ছিলাম। এর শাস্তি আমরা পেয়ে গেছি। আমাদের পাপের কারনে আজ ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত। কাজেই আমরা তওবা করছি আর ফিরকাবাজি করব না, তোমাকে সাক্ষি রেখে আমরা ঐক্যবদ্ধ হলাম, তোমার হুজুরে ফিরে এলাম, তুমি আমাদের তওবা কবুল কর। সবাই তার সাথে সাথে আবৃত্তি করল।

তারপর তিনি বললেন, প্রত্যেক ফেরকার কিছু না কিছু সদস্য এখানে আছেন। কাজেই এই তওবা প্রত্যেক ফেরকার তওবা বলে গণ্য হবে, সবাই ঐক্য মঞ্চে ফিরে আসবে। যারা অসম্মতি জানাবে ওরা শয়তান, ওরা উম্মাহর দুশমন, কাফের। কাজেই সম্মিলিতভাবে ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।

একজন সাধারণ লোক দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, শ্রদ্ধেয় উস্তাদ, আমরা জানি অমুসলিমরা কাফের কিন্তু আমাদের মুসলমানরা নামায রোযা সব কিছু সঠিক আদায়ের পর শুধু ফিরকা বাজির জন্য কাফের হয়ে যাবে-বিষয়টা আমি বুঝলাম না। মাওঃ মোজাহিদ দাঁড়িয়ে উত্তর দিলেন, ‘অমুসলিমরা পুর্নাংগ কাফের, ওরা স্থায়ি জাহান্নামী হবে, কিন্তু ফিরকাবাজরা আংশিক কাফের। অর্থাৎ তারা সকল দিক দিয়ে মুসলমান তবে ঐক্যের ফরযিয়্যত লংঘনের জন্য আংশিক কাফের যেমন নামায রোযা অস্বিকার করলে কাফের হয়ে যায়। এরা শস্তি ভোগ করবে তবে স্থায়ি জাহান্নামী হবে না। দুনিয়াতে এদের বিধান হল, ঐক্যে ফিরে না আশা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। একান্ত না আসলে হত্যা করতে হবে। যেমন হযরত আবু বকর (রাঃ) যাকাত অস্বিকার কারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। যাই হউক আমি সামনের আলোচনায় যাচ্ছি।

বিষয়: রাজনীতি

৯০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File