সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ৮
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৬ জুন, ২০১৭, ১২:৫০:০১ রাত
পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বি বড় একটা হল রুম, দক্ষিণ পাশে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার দরজা জানালায় পর্দা দিয়ে মহিলাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘরে ও বারান্দায় সারিবদ্ধ ভাবে চেয়ার পাতা রয়েছে। সভার শুরুতেই চেয়ারগুলি ভর্তি হয়ে যায়, শেষের দিকে পিছন দিককার খালি জায়গায় মানুষ আকির্ণ হয়ে উঠে, বাহিরেও লোকেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিতর্ক শুনে। জামাল এসে তার উস্তাদ মুজাহিদ বিল্লাহর কাছাকাছি বসে চারিদিকে দৃষ্টি বুলাল। বিভিন্ন ক্যাটাগরির মানুষে ঘরটা ভর্তি, মাদরাসার ছাত্র, স্কুল কলেজ ভার্সিটির ছাত্র, আলেম, জেনারেল শিক্ষিত, কৃষক- শ্রমিক, কিশোর, যুবক, পৌঢ়, বৃদ্ধ সব কিসিমের মানুষই আছে। সবাই পশ্চিম মুখী তাকিয়ে আছে।
পশ্চিম পাশের দেয়াল সংলগ্ন এক ফুট উঁচু একটা তেপায়া, তার উপর চেয়ার টেবিল। টেবিলের উপর বুখারি, মুসলিম, তিরমিযির মত দেখতে কয়েকটা কিতাব ও একটা কোরান শরীফ রাখা। চেয়ারে একটা লোক বসে আছে, মধ্যমাকৃতি, মধ্য বয়স্ক, মধ্যম চেহারার মানুষ। দাড়ি টুপি পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরনে, একদম সাদামাটা। জামালের বুঝতে বাকী রইল না এই লোকটাই সেই ভন্ড লোকটা যাকে তার অনুসারীরা ইমাম ও উস্তাদজি বলে ডাকে। সেই দেওবন্দিদের গালি গালাজ করে, বিরোধিতা করে। লোকটার প্রতি ঘৃণায় তার শরীর রি রি করে উঠে। ভণ্ডটার মুখে একদলা থুথু দিতে পারলে হয়ত তার মনের খেদ কিছুটা হলেও মিটত।
কোরান সুন্নাহর কাঠগড়ায় ফিরকাবাজিঃ
মুল বার্তাঃ সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত উম্মতের সর্ববাদি সম্মত অভিমত হল উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ফরয এবং বিভক্তি হারাম। অর্থাৎ এটা ইজমায়ে উম্মত, এ বিষয়ে কারো কোন মতভেদ নেই। আর এ ফরযিয়্যাত অন্য যে কোন ফরযিয়্যতের তুলনায় অতিশয় দৃঢ় ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নামায রোযা হজ্ব যাকাত ইত্যাদি না করলে শাস্তির হুমকি এসেছে তবে রাসূল (সাঃ) এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কোন হুমকি আসেনি। কিন্তু সুরা আল-ইমরানের ১০৬ নং আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে ফিরকাবাজদের সাথে রাসূল (সাঃ) এর কোন সম্পর্ক থাকবে না এবং ফিরকাবাজদের জাহান্নামের সংবাদ দেয়া হয়েছে। যারা ফিরকাবাজি করে তারা কাফের, এরা উম্মাহর ইহকাল ও পরকাল নষ্ট করছে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন আলেমগন নবীদের ওয়ারিশ। এর দ্বারা তিনি ইসলাম ও উম্মাহর দায়িত্ব অর্পন করে গেছেন আলেমদের উপর, কোন রাজা বাদশার উপর নয়। কাজেই আলেমদের উপর ফরয ছিল ইসলাম ও উম্মাহর রক্ষনা বেক্ষন করা। কিন্তু তারা এই দায়িত্ব পশ্চাতে নিক্ষেপ করে ফিরকা সৃষ্টি করে, পরস্পর বিদ্বেষ ছড়িয়ে উম্মাহ ধ্বংসের রাজপথ তৈরি করে দিয়েছে। আজ যদি তারা বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকত তাহলে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকত, একটা কেন্দ্র থাকত। আর মুসলিম বিশ্ব একটা কেন্দ্রের অধিনে পরিচালিত হলে পাশ্চাত্যের দাজ্জাল মুসলমানদেরকে বন্য পশুর মত মারতে পারত না, আর মুসলমানরাও কুকুরের মত কামরা কামড়ি করে মরত না, গলা কাটাকাটি করত না। বাস্তবতায় বুঝা যাচ্ছে মুসলিম জাতির ইহকাল ও পরকাল ধ্বংসের মূল কারণ হল ফিরকাবাজি।
আর এই ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল ফিরকাবাজি মিটিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। আর ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না, যতক্ষণ না ফিরকাবাজ আলেমদের ধরে ধরে বিচার করা হয় এবং এদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হয়। কাজেই ইসলাম ও উম্মাহর স্বার্থে, আল্লাহ- রাসুলের মুহব্বতে এ কাজে প্রত্যেক ফেরকার যুব সমাজ ও ছাত্র সমাজকে আগে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রথম আসরঃ
হাসান মুসান্না উঠে দাড়ালেন। মাথা নিচু করে টেবিলের চার পাশে দু’তিনটা চক্কর দিলেন। তারপর হঠাৎ পুর্বমুখি দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘মানুষের প্রত্যেক কাজের পিছনে একটা লক্ষ উদ্দেশ্য থাকে, আমাদের এই মজলিসেরও নিশ্চয়ই লক্ষ্য উদ্দেশ্য আছে। আমাদের উদ্দেশ্য হল মুসলিম উম্মাহ, আলোচ্য বিষয় কুরআন সুন্নাহ। কারণ বর্তমানে উম্মাহর যে লাঞ্চনাদায়ক পতন ঘটেছে ইতিপুর্বে পৃথিবীর অন্য কোন জাতির মধ্যে এমন লাঞ্চনা বঞ্চনা ও গঞ্চনা দেখা যায়নি। কাজেই কোরআন সুন্নাহর আলোকে আমরা আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে এই পতনের কারণ শনাক্ত করব, তা থেকে উত্তরণের উপায় উদ্ভাবন করব এবং সেই মোতাবেক কাজ করব, এটাই আমাদের অঙ্গিকার। ইতিপুর্বে আমাদের আলোচনার নির্যাস এই ছিল যে, উম্মাহর এই দুর্গতির প্রধান কারণ হল ফিরকাবাজি।
কারণ এই অভিশপ্ত ফিরকাবাজির কারণে ইসলাম পন্থীরা একে অন্যেকে সমর্থন করে না, সহযোগিতা করে না, নির্বাচনে ভোট দেয় না বরং বিরুদ্ধাচারন করে। ফলে কোন ইসলামী দলই সরকার গঠন করতে পারে না। অথচ ইসলামী দলগুলি ঐক্যবদ্ধ থাকলে প্রত্যেক দেশে তারাই সরকারে থাকত। আর তখন এমনিতেই খিলাফত বা এ জাতীয় মুসলিম বিশ্বের একটা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। আর একটা কেন্দ্র থাকলে আজ আরাকান, ফিলিস্তিন কাশ্মির জিংজিয়াং ইত্যাদি দেশের মুসলমানরা শিয়াল কুকুরের মত মারা পড়ত না, মুসলিম দেশগুলিতেও তারা নিজেরা নিজেরা কুকুরের মত কামড়াকামড়ি করে মরত না। অমুসলিমরাও তাদের নিয়ে এমন জঘন্য খেলার সুযোগ পেত না। এখন প্রশ্ন হল, এই সর্বনাশা সর্বগ্রাসি ফিরকাবাজি সম্পর্কে কোরআন কি বলে তা আমাদের জানা অত্যাবশ্যক।
আল্লাহ তা’লা বলেন, مَّا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِن شَيْء – আমি কোরানে কোন কিছু বাদ দেইনি। অর্থাৎ কোরআন হল পুর্নাংগ জীবন বিধান, মানব জাতির সংবিধান। কাজেই এ অভিশপ্ত ফিরকাবাজি সম্পর্কে অবশ্যি কোরানে দিক নির্দেশনা পাওয়া যাবে। এখন আমরা কোরআন সুন্নাহ ও বাস্তবতার আলোকে ফিরকাবাজি নিয়ে আলোচনা করব। যে বিধান বেরিয়ে আসবে আমরা তা মেনে নেব এবং সেই মোতাবেক কাজ করব। তারপর তিনি উচ্চস্বরে বললেন ‘এই তো আমাদের অঙ্গিকার, নাকি? সবাই সমস্বরে ‘জী হা’ বলে হাত তুলল। তারপর তিনি বললেন, ‘তবে আমাদের এই মজলিসে বক্তা ও শ্রোতার জন্য কিছু শর্ত আছে। শ্রোতার শর্ত হল--
১। এখানে দেওবন্দ, তাবলীগ, জামাতে ইসলামী, আহলে হাদীস, সালাফী, বেরেলভী, মাজার পন্থী ইত্যাদি প্রত্যেক ফিরকার লোক উপস্থিত আছেন। যারা উপস্থিত আছেন তারা নিজ নিজ ফিরকার প্রতিনিধি বলে গণ্য হবেন। এ মজলিসে কোরআন হাদীসের আলোচনা থেকে যে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে- এখানে উপস্থিত প্রত্যেক ফেরকার প্রতিনিধিরা কোনরূপ জেদ ও গোয়ার্তুমি ব্যতীত তা মেনে নিবেন। আর মেনে নিবেন প্রশ্ন উত্তর ও তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে। সকল সন্দেহ সংশয় অপলোদন করে বাস্তবতার ভিত্তিতে মেনে নিবেন- যাতে পিছনে যারা আছেন তারাও এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়, কোনরূপ বিতর্কের সুযোগ না পায়। যেমন ধরা যাক, কোরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল যে, ফিরকাবাজি কুফুরি, ফিরকাবাজরা কাফের। তখন মজলিসের সবাই তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে সংশয়মুক্ত হওয়ার পর তা মেনে নিবেন এবং তওবা করবেন। এই মেনে নেওয়া ও তওবা প্রত্যেক ফেরকার উনুপস্থিত লোকদের জন্যও প্রযোজ্য হবে। এরপর কোন দল বা ফিরকা সেই সিদ্ধান্ত ও তওবা মেনে নিতে অস্বিকার করলে আমরা সম্মিলিত ভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। এই শর্তে যারা রাজী নয় তারা এই মজলিসে থাকবে না।
২। যারা রাসূল (সাঃ) কে একমাত্র জীবনাদর্শ এবং কোরআন সুন্নাহকে একমাত্র অনুসরনীয় জানেন মানেন তারাই এখানে থাকবেন কিন্তু যারা রাসূল (সাঃ) কে মানেন স্ব স্ব ফিরকার ইমাম ও মুরুব্বির মাধ্যম হয়ে এবং কোরআন সুন্নাহ মানেন মুরুব্বীদের লিখিত কিতাবাদির মাধ্যম হয়ে তারা এখানে থাকবেন না।
৩। আমাদের বর্তমান লক্ষ হল, শীঘ্রই ইসলামী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটা নীতি নির্ধারক উলামা পরিষদ গঠন করা। তারপর রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সমন্বয় সাধন করে একটা সার্বজনীন ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে আগামি নির্বাচনে এদেশে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এই সরকারের কাজ হবে প্রত্যেক মুসলিম দেশে ইসলামী দল সমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে সুপ্রিম পাওয়ার উলামা পরিষদ গঠন করা। এই উলামা পরিষদের প্রত্যক্ষ ভোটে কেন্দ্রিয় খেলাফত/ মুসলিম জাতিসংঘ/ আফ্রেশিয় উইনিয়ন গঠন করা। তুর্কি কামাল ১৯২৪ সালে খেলাফত উৎখাত করেছিল, এখন ২০২৪ সালের মধ্যে কেন্দ্রিয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থাৎ আগামি নির্বাচনে এদেশে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং ২০২৪ এর মধ্যে কেন্দ্রিয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আর এটা বিভিন্ন ইসলামী দল ও ফিরকার মধ্যে ঐক্য ব্যতীত সম্ভব নয়। কাজেই উম্মাহর ঐক্যের পক্ষে কোন ফেরকাবাজ অন্তরায় হলে শরীয়া আদালতেই হউক বা অন্য যে কোন প্রকারেই হউক তাদের ধ্বংস করা হবে। এই কাজে যারা সম্মত নয় তারা এখানে থাকবে না এবং তারা উম্মাহর শত্রু বলে গন্য হবে। কারণ এ ছাড়া মুসলিম জাতীর মুক্তির আর কোন উপায় নেই।
৪। আমাদের এ মজলিস হল প্রশিক্ষন মঞ্চ এবং আত্মসংশোধন কেন্দ্র। ফিরকাবাজি, হিংসা বিদ্বেষ ইত্যাদি কোন কোন ঘাতক ব্যধির ভাইরাস উম্মাহর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, ভেতর থেকে খেয়ে শূন্য করে ফেলেছে, উম্মাহকে এইডস আক্রান্তের ন্যায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, কোরান হাদীসের আলোকে তা অনুসন্ধান করে চিকিৎসা নিতে হবে। অর্থাৎ এখানে আত্মসংশোধন করতে হবে। আবার প্রত্যেক মহৎ কাজের আগে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তারপর তা বাস্তবায়িত করা হয়। আল্লাহর দরবারে আমাদের দাঁড়াতে হবে, তখন তিনি অবশ্যই প্রশ্ন করবেন, কোরানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা স্বত্ত্বেও ফেরকাবাজি করেছিলে কেন, ফিরকার কারনে উম্মাহ ধ্বংস হওয়ার সময় কি পদক্ষেপ নিয়ে ছিলে, ফিরকাবাজদের কি বিচার করেছিলে, ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংসের সময় তোর তৎপরতা কি ছিল? আল্লাহ অবশ্যি প্রত্যেক মুসলিমকে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি করবেন। তখন সেখানে আমরা কি জবাব দিব এই মজলিস হচ্ছে তারই প্রশিক্ষণ কোর্স। কাজেই এ মজলিসের প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিব, কোনরুপ জেদ ও গোয়ার্তুমি করব না। কারণ আল্লাহর দরবারে গোয়ার্তুমি চলবে না।
৫। উম্মাহকে ধ্বংস করার জন্য অনেক দল মত ফেরকা ও সংগঠন আছে কিন্তু ঐক্য করার জন্য কোন সংগঠন নাই। কাজেই আমাদের এই মজলিস হল ঐক্যের মজলিস। এর নাম সম্পর্কে আগে অনেক মতান্তর হয়েছে, তবে আমি এর নামকরন করলাম ইত্তেহাদুল উম্মাহ- উম্মাহর ঐক্যমঞ্চ। সাগর যেমন খাল বিল নদী নালা সবকিছুকেই বুকে টেনে নেয় এই ইত্তেহাদুল উম্মাহও মহাসমুদ্রের মত উম্মাহর প্রত্যেকটা দল ফেরকাকে আপন বুকে টেনে আনবে। যারা আসতে চাইবে না তারা এর উর্মির তরঙ্গাভিঘাতে বিলীন হয়ে যাবে। এটা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। তারপর তিনি চেঁচিয়ে বললেন, উল্লেখিত শর্তে সবাই রাজী তো? সকলে সমস্বরে জী হা বলে হাত তুলল। তারপর তিনি বললেন, এবার বক্তার জন্য শর্ত হল-
১। তিনি স্বফিরকার প্রতি কোনরুপ পক্ষপাতিত্ব না করে কোরআন হাদীসের আলোকে নিরপেক্ষ আলোচনা করবেন। আলোচনার সময় প্রাচীন তাফসীর থেকে উদৃতি দিতে হবে, আধুনিক কালের তাফহিমুল কোরআন, মাআরেফুল কোরআন, বয়ানুল কোরআন, যিলালিল কোরআন ইত্যাদির রেফারেন্স দেয়া যাবে না। কারণ তাফহীমের দলিল দিলে জামাত ছাড়া অন্য কেউ মানবে না, মাআরেফুল কোরানের দলীল দিলে দেওবন্দি ছাড়া অন্যরা মানবে না, বয়ানুল কোরানের উদৃতি দিলে বেরেলভীরা মানবে না। কাজেই বিতর্ক থেকে বাঁচতে আমরা তর্কাতিত প্রাচীন তাফসীরের শরণাপন্ন হব।
২। আলোচনায় কোরআন হাদীস থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে তা প্রতিকুল হলেও বক্তা নিজের ফিরকার জন্য মেনে নিবেন তারপর অন্যদের দাওয়াত দিবেন।
৩। যে কোন ফেরকার অতীত মৃত মুরুব্বিদের সমালোচনা করা যাবে না। আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে বর্তমান জীবিত ফেরকাবাজদের উপর।
৪। কোরআন হাদীসের আলোচনা সাপেক্ষ কোন বিষয়ে বিজ্ঞ আলেম নয় এমন কেউ বক্তৃতায় আগ্রহ প্রকাশ করবেন না। এই গেল শর্তাদি।
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় কোরআন সুন্নাহর কাঠগড়ায় ফিরকাবাজি। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বিজ্ঞ আলেম প্রয়োজন। আর এজন্য আমি মাওঃ মোজাহিদ বিল্লাহকেই উপযুক্ত মনে করি, কারণ সর্বত্র তার ইলম ও প্রজ্ঞার খ্যাতি রয়েছে। সবাই চেঁচিয়ে উঠল ‘জ্বি হা, আমরা তাকেই চাই। ফর্সা লম্বা তাল পাতার সেপাই মাওঃ মুজাহিদ বিল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন, চারদিকে একনজর তাকিয়ে শুরু করলেন ‘নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহিল কারিম, বিসমিল্লাহির রহমানিরাহিম। শ্রদ্ধেয় ইমাম, ফিরকা বা ফিরকাতুন শব্দটি আরবি, এর অর্থ, দল শ্রেণী সম্প্রদায় অংশ ভাগ ডিভিশন ইত্যাদি। কিন্তু ইসলামের পরিভাষায় একই নবীর উম্মত এবং একই গ্রন্থের অনুসারীদের বিভিন্ন দল উপদলকে ফিরকা বলা হয়।
হিজরি প্রথম শতাব্দিতেই ফিরকার জন্ম হয়, মুসলমানরা শিয়া সুন্নি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, এরপর উভয় দল শত শত ফেরকায় বিভক্ত হয়। এখানে আমরা শুধু সুন্নিদের আলোচনা করব। এই সুন্নিদের মাঝে দেওবন্দি, তাবলীগী, বেরেলভী, জামাতী, তরিকতী, মাজার পন্থী, আহলে হাদীস, ওহাবী, তালেবান, ব্রাদার হুড, আইসিস, বোকু হারাম ইত্যাদি শত শত দল উপদল রয়েছে এরা সবাই ফিরকা। ৭৩ ফিরকার হাদীসেও সবাইকে ফিরকা বলা হয়েছে। কাজেই মুসলমানদের যে কোন দল উপদল বলতেই ফিরকা বলে গন্য হবে।
তখন একজন দাঁড়িয়ে বলল, ‘মুসলমানদের প্রত্যেক দল এক আল্লাহ এক নবী এক কোরানের অনুসারী। আবার নামায রোযা হজ্ব যাকাত সবাই একইভাবে আদায় করে। কেউ চার ওয়াক্ত বা সাত ওয়াক্ত নামায পড়ে না, ২৫ টা বা ৩৫ টা রোযা রাখে না। কাজেই তারা ফিরকা হবে কেন? বিশেষত ভারত বর্ষের মুসলমানরা সাধারণত সুন্নি হানাফি। যদিও আমরা ছোটখাট বিষয়ে মতবিরোধ করে নিজ নিজ পসন্দানুযায়ি দেওবন্দি তাবলীগী জামাতী, বেরেলভী, আহলে হাদিস, মাজার পন্থী ইত্যাদি বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়েছি বটে কিন্তু সবাই একক হানাফি মাযহাবের নিয়মানুযায়ি ইবাদাত বন্দেগি করে থাকি। কাজেই আমরা ফিরকা হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
মুজাহিদ বিল্লাহ বললেন, ‘ইসলামের নামে যতটি দল আছে সবাই ফিরকা। এ বিষয়ে আমি কিছু আকলি ও নকলি দলীল দিচ্ছি--
১। অর্থগতভাবে ফিরকা শব্দটি জামাত এর বিপরীত। ফিরকা অর্থ পৃথক থাকা বিচ্ছিন্ন থাকা আর জামাত অর্থ একত্রে থাকা মিলিত থাকা। এখন আমার প্রশ্ন হল, পৃথিবীর মুসলমানরা কি জামাতবদ্ধ আছে নাকি ফিরকাবন্ধি আছে? আরে ঐক্য থাকলে তো খিলাফতই প্রতিষ্ঠিত থাকত, মুসলমানদের এত দুর্গতি হত না।
২। ৭৩ ফিরকার হাদীসে হক পন্থী বাতিল পন্থী নামে কোন বিভাজন করা হয় নাই, সবাইকে ফিরকা বলা হয়েছে। অথচ তাদের একটা দল বেহেস্তে যাবে, অর্থাৎ যারা ঐক্যের পথে থাকবে ও ডাকবে।
৩। বস্তুত মুসলমানদের বিভিন্ন দলকে বাস্তবতার নিরিখে ফেরকা বলা যায় না, সম্প্রদায় বলতে হয়। কারণ একই নবী ও গ্রন্থের অনুসারিরা একই নিয়মে সামাজিক, ধর্মিয় ও বৈবাহিক নিয়ম কানুন, প্রথা, আছার অনুষ্ঠান ইত্যাদি উদযাপন সত্ত্বেও বিভিন্ন দলে বিভক্ত থাকলে তাকে ফিরকা বলা হয়। পক্ষান্তরে বিভিন্ন নবী ও গ্রন্থের অনুসারী এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রথার অনুসারিদেরকে জাতি বা সম্প্রদায় বলা হয়। বাস্তবে দেখা যায় মুসলমানরা এখন আর ফেরকা নেই সম্প্রদায়ে পরিণত হয়ে গেছে। যেমন-
বিবাহঃ ইসলামের বিধান হল, অন্য ধর্মের তাওহীদবাদি যে কারো সাথে মুসলমানের বিয়ে জায়েয। কিন্তু বর্তমান মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ ইহুদি খৃষ্টান ইত্যাদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ জায়েয নেই, কারণ তারা একত্ববাদী নয়, এতে ধর্মীয় মুরুব্বীদের অনুমোদন নেই। তদ্রুপ দেওবন্দি তাবলিগী জামাতী বেরেলভী তরিকতি ইত্যাদি ফিরকার মধ্যে আন্তবিবাহ হয়েছে এমনটা কোথাও দেখা যায় না। এটা স্ব স্ব ফিরকার মুরুব্বীরা জায়েয মনে করেন না। অর্থাৎ আল্লাহ রাসুল যেখানে আহলে কিতাবের সাথে বিয়ে জায়েয করেছেন সেখানে ফেরকাবাজ শয়তানরা আন্তফেরকার বিয়ে হারাম করেছেন। কারণ তারা বিভিন্ন নবীর (মুরুব্বির) উম্মত। কাজেই তারা আলাদা আলাদা সম্প্রদায় হিসাবে প্রমানিত।
আছার অনুষ্ঠানঃ প্রত্যেক ফেরকার ধর্মানুষ্ঠান আলাদা আলাদা। দেওবন্দিদের ধর্মসভা, তাবলিগিদের জোড় বা ইজতেমা, জামাতের সেমিনার টি সি, বেরেলভী ও মাজারপন্থিদের উরশ, কাওয়ালি, গান- বাজনা। আর এসব ধর্মানুষ্ঠানে এক ফেরকার বক্তা বা মুরুব্বিরা অন্য ফেরকার অনুষ্ঠানে গিয়েছে এমন প্রমাণ নেই, কারণ এটা তারা হারাম মনে করেন। যেমন মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ ইত্যাদি সম্প্রদায়গুলি পরস্পরের ধর্মানুষ্ঠানে যাওয়া হারাম মনে করে থাকে, কাজেই এরা পৃথক সম্প্রদায়।
ইবাদাতগাহঃ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ইবাদাত গাহের নাম বিভিন্ন রকম। যেমন মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডা ইত্যাদি, তদ্রুপ মুসলমানদের ইবাদাত গাহ তথা মসজিদগুলিরও বিভিন্ন নাম। যেমন মারকায বা তাবলিগের মসজিদ, আহলে হাদিসের মসজিদ, হানাফি মসজিদ, জামাতের মসজিদ, তরিকতি মসজিদ, শিয়া মসজিদ ইত্যাদি। অর্থাৎ দুনিয়াতে কোথাও মুসলমানের মসজিদ নাই, যা আছে সব সাম্প্রদায়িক মসজিদ। কাজেই এগুলি মসজিদে দেরার।
ইমামঃ ইমামের পিছনে ঠাকুর ভিক্ষু পাদ্রীরা এক্তেদা করে না, আবার ঠাকুর পাদ্রি পোরুহিতের পিছনেও অন্যরা যায় না। তদ্রুপ দেওবন্দি তাবলিগীরা মরে গেলেও বেরেলভী জামাতি ইমামের পিছনে নামায পড়বে না। বেরেলভীরা নামায ছেড়ে দিবে তবুও অন্যদের এক্তেদা করবে না। কাজেই প্রমাণিত হল মুসলমানদের ফিরকাগুলি এখন আর ফিরকা নেই তারা বিভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ে রুপান্তরিত হয়ে গেছে।
ধ্বংসের প্রতিযগিতাঃ হিন্দু বৌদ্ধ ইহুদি খৃষ্টান ইত্যাদি সম্প্রদায় গুলি একে অন্যকে ধ্বংসের প্রতিযোগিতা করে না, পৃথিবীর কোথাও এর প্রমান নেই। কিন্তু মুসলিম ফিরকাগুলি যেমন, দেওবন্দি তাবলিগী জামাতী বেরেলভী তরিকতি সালাফি ইত্যাদি সম্প্রদায়গুলি একে অন্যকে ধ্বংসের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে, সর্ব শক্তি ব্যয় করছে। এমনকি তারা একে অপরকে ধ্বংস করার জন্য বামপন্থী, নাস্তিক- মুরতাদ ও বিধর্মীদের সহযোগিতা নিচ্ছে, বেলতলা থেকে হাইকোর্ট তলা পর্যন্ত দৌড়াচ্ছে। কাজেই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, তারা শুধু ফিরকাই নয় বরং প্রত্যেক ফিরকার মুরুব্বীদের নবীর স্থলাভিষিক্ত করে পৃথক পৃথক সম্প্রদায়ে পরিণত হয়ে গেছে। এরা তো জাহান্নামে গেছেই, সেই সাথে অজ্ঞ- সরল প্রাণ অনুসারিদেরকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংস করছে। কাজেই এদের বিচার আবিস্ব্যম্ভাবি। জানি না এই শয়তানদের ক্ষমা করলে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন কিনা। এখন শ্রদ্ধেয় উস্তাদ, আমার প্রস্তাব হল এই সব ভণ্ড দলগুলিকে আপনি সম্প্রদায় হিসাবে ঘোষণা করুন, অন্তত ফিরকা হিসাবে তো অবশ্যই।
হাসান মুসান্না দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যুক্তি প্রমাণ সহ কারো কিছু বলার আছে? কেউ মাথা তুলল না, সবাই অধোমুখে বসে রইল। কিছুক্ষণ নিরবে কেটে গেল। তারপর ছাত্র লীগের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘উস্তাদজি, কথায় আছে, রোগীর অবস্থা কেমন গো?- খুব ভাল, আগে যাওবা বাইরে হাগত এখন ঘরেই হাগে। এই ফিরকাবাজদের অবস্থাও তাই হয়েছে। মুজাহিদ সাব আগে যাওবা ফিরকা প্রমাণ করেছিলেন কিন্তু এখন সম্প্রদায় প্রমাণ করলেন। আরো আলোচনা হলে একেবারে কাফের মুশরিক বানিয়ে ছাড়বেন। কাজেই আর বিতর্ক না বাড়িয়ে আপনি ফিরকা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিন। উস্তাদজি প্রশ্ন করলেন ‘কারো কিছু বলার নেই, না? তাহলে সবাই মেনে নিলেন যে, ইসলামের নামে প্রতিটি দল উপদল একেকটা ফিরকা, সুতরাং এই প্রস্তাব পাশ হল।
বিষয়: রাজনীতি
১০৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন