সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ৭

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৫ জুন, ২০১৭, ১২:১৭:১৩ রাত

দুই বছর কেটে গেছে। কৃষি ও ইমামতি থেকে অনেক টাকা আয় হয়েছে, জমি কিনা বাদে তার হাতে প্রায় আড়াই লাখ টাকা জমা হয়েছে। পরিবারটি এখন সুখি, তাদের মুখে বিজয়ির হাসি, সহসা ঘনিয়ে আসা ভাগ্যাকাশের কাল মেঘ কেটে যাচ্ছে, তাদের লেখা পড়াও ঠিকমত চলছে।

মাওঃ জালালুদ্দিন দম্পতি ছিলেন সুন্দর ও সুদর্শন, তাদের ছেলে মেয়েরাও তেমনি হয়েছে।জামালের ছোট বোন যয়নব সুন্দরী ও সর্বগুনে গুনান্বিতা একটি মেয়ে। বিভিন্ন জায়গা থেকে তার বিয়ের আলাপ আসছে। পশ্চিম পাড়ার দবির খা একটা সম্বন্ধ এনেছে, ছেলে কামিল পাশ, একটা স্কুলের মৌলভি শিক্ষক। বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে তিন চার মাইল উত্তরে। জামাল খোজ খবর নেয়া শুরু করল। একদিন সে মায়ের সামনে বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, ‘আম্মা দেখছেন দবির খার সাহস কত বড়, যয়নবের জন্য একটা মুশরিক ঘর এনেছে। আরে ঐ ছেলের পরিবার হল শৈল্যা কান্দি পীরের মুরিদ। তারা মিলাদ ক্বিয়াম করে। আর হুজুররা বলেছে যারা মিলাদ ক্বিয়াম করে তারা মুশরিক। একবার ময়মনসিংহ বড় বাজারে সিলেটের বিখ্যাত মুফাসসির হুজুর ওয়াজ করতে এসেছিলেন। উনার কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে ‘যারা মিলাদ পরে তারা বেদাতি, যারা ক্বিয়াম করে তারা মুশরিক, কারণ তারা মনে করে রাসূল (সাঃ) স্ব শরীরে এসে তাদের সামনে হাযির হয়েছেন। এটা শিরক, এজন্যই যারা ক্বিয়াম করে ওরা মুশরিক।

তারপর সে বলল, ‘দবির খার সাহস দেখে আমি অবাক হই, ওকে সাইজ করব। এরপর দবির খাকে ডেকে এনে বলল, ‘আপনার সাহস তো কম নয়, একটা মুশরিক ছেলের জন্য আমার বোনের প্রস্তাব এনেছেন। মনে রাখবেন, একটা মুশরিকের সাথে বিয়ে দেয়ার চেয়ে আমার বোনকে কেটে টুকরা টুকরো করে ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দিব। যান এমন ভুল আর কোন দিন করবেন না। আরো কিছু ধাতানি দিয়ে তাকে বিদায় করল। দবির খা মনে করল শৈল্যাকান্দিরা বুঝি সত্যি সত্যি মুশরিক। তাই সে কিছু না বলে মুখ কাচু মাচু করে মাথা নিচু করে চলে গেল।

যয়নবের এক উস্তাদ কিছুদিন ধরে বলতেছে তাদের বাড়িতে আসবে, কিন্তু এবার সত্যি সত্যি তারিখ দিল আগামি শুক্রবার আসবে। বোনের উস্তাদের জন্য জামাল পুকুর থেকে মাছ তুলল, গরু খাসি মুরগি সব রকম আইটেম জোগাড় করল। হুজুর জুমার পর খাওয়া দাওয়া করে বললেন, ‘জামাল তোমার আম্মাকে বল দরজার আড়ালে দাঁড়াতে, তুমিও থাক আমি একটা আলাপ করব। এবার তার আগমনের হেতু বুঝা গেল। তিনি বললেন ‘আমার স্ত্রীর খালাত ভাই, বাড়ি ফুলপুর। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সকলের বড়। ছেলে ভাল আলেম একটা মাদরাসায় শিক্ষকতা করে। বিরাট অবস্থা, অনেক জমাজমি, বিলে ফিসারি আছে। বাজারে বড় একটা কাপড়ের দোকান আছে, ছেলের মা বাবা দুজনেই হজ্ব করে এসেছে। তারা ভাল মেয়ে চাচ্ছে, আর আমি যয়নবের চেয়ে ভাল মেয়ে কোথাও পাইনি। কাজেই আপনাদের যদি সম্মতি থাকে তাহলে গিয়ে ছেলে দেখে আসুন। আরো কিছুক্ষণ আলাপের পর জামাল বলল ‘আমরা আগামি শুক্রবারে যাব।

পরের শুক্রবারে জামাল তাদের পাশের ঘরের সম্পর্কিত এক দাদা ও খালাত ভাই আরমানকে নিয়ে ছেলে দেখতে গেল। সব কিছু দেখে শুনে তো সে খুশিতে আত্মহারা। কিন্তু তার আশংখা জাগল ছেলেরা বড় লোক আর তারা গরীব। গরিব দেখে যদি বিয়ে না করায়। তবে তার ভরসা হল, তার বোন সুন্দরী দেখে পসন্দ করতে হবে। সে দোয়া করতে থাকে ‘আল্লাহ ইয়াতিমের উপর দয়া কর। এখানে আমার বোনের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করে ফেল। ছেলে পক্ষকে পরের শুক্রবারের দাওয়াত দিয়ে তারা চলে এল। শুক্রবারে ছেলে ও ছেলের বাবা মেয়ে দেখতে এল। চা নাস্তা খেয়ে তারা মেয়ে দেখতে গেল। কিছুক্ষণ পর ছেলের বাবা বেরিয়ে এল কিন্তু ছেলে তো ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছে বের হয় না, পীড়িতির আলাপ জুড়েছে। পাশের ঘরের দাদা গিয়ে চুটকি কাটল, কি নাতি আমার নাতনিকে ছেড়ে বুঝি বাইরে যেতে মন চায় না।

তারপর খাওয়া দাওয়া করে সবাই আলাপে বসল। ছেলের বাবা বলল, ‘মেয়ে আমাদের পসন্দ হয়েছে আল্লাহর কলম থাকলে এ বিয়ে হবে। এখন আপনারা বলেন কি কি অলংকারাদি দিবেন। ছেলে বিরক্ত কণ্ঠে বলল ‘এ তুমি কেমন কথা বলছ, তুমি জান না এটা একটা শহীদ পরিবার, ওরা সবাই ইয়াতিম। ওদের উপর বোঝা চাপাচ্ছ কেন? তোমার পুত্র বধুকে নিজে কিছু দিতে পারলে দিবে, না পারলে নাই। ইয়াতিমদের উপর বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না। বাবা লজ্বিত হল এবং ছেলের প্রতি রুষ্টও হল। বিয়ে তো এটা করাবেনই কিন্তু তিনি চাইছিলেন চাপ দিয়ে দুয়েকটা অলংকার আদায় করে নিতে কিন্তু ছেলে তো তাকে অপমান করল।

অগত্যা তিনি মুখ রক্ষার জন্য বললেন, ‘উহ হো আমার তো মনেই ছিল না যে, ওরা ইয়াতিম। আচ্ছা ঠিক আছে তারা যা পারে দিবে আমরা যা পারি দিব। কারো উপর কোন বাধ্য বাধকতা নাই। জামাল বলল, ‘না, আমি গলার হারটা দিব। আরমান তাকে বাচানোর জন্য খেকিয়ে উঠল, ‘এই তুই হার দিবি কেমনে, এত টাকা পাবি কোথায়? জামাল শান্ত গলায় বলল, ‘আমার জীবনের লক্ষ একটাই, আমাদের যে বাবা নাই তা যেন আমার বোনেরা টের না পায়। আমার রক্ত বিক্রি করে হলেও বোনদের মুখে আমি হাসি ফুটিয়ে রাখব। কারো সামনে তাদেরকে ছোট হতে বা লজ্বিত হতে দিব না। চিন্তা করো না, আমি একেবারে নিঃস্ব নই। শুনে সবাই খুশি হল।

বিয়ের তারিখ সম্পর্কে ছেলের বাবা বলল, আগামী মাসে একটা ডেইট নির্ধারন করেন। কিন্তু মেয়ে দেখে তো ছেলের মাথা ঘুরিয়ে গেছে। সে বলল, ‘আগামী মাসে আমার ঝামেলা আছে, সামনের শুক্রবারে তারিখ দাও। সবাই মাথা নিচু করে মুখ টিপে হাসল। অগত্যা পরের শুক্রবারেই তারিখ নির্ধারিত হল। বিদায় বেলায় ছেলে দাদাকে চুপিসারে বলল ‘আপনার নাতনির সাথে একটু সাক্ষাত করে যাই। কিন্তু একটু সাক্ষাতের কথা বলে এই যে রুমে ঢুকল তার তো বের হবার খবর নাই। অবশেষে দাদা গিয়ে খোঁচা দিল, ‘আরে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, তোমার বাবা রাগারাগি করছেন, বের হও’ বলে হাত ধরে টেনে বের করল আর কানে কানে বলল, ‘কী ব্যাপার, আমার নাতনি বুঝি আত্মভোলা করে দিল। সে শুধু মাথা নিচু করে হাসল।

জামাল ব্যস্ত হয়ে উঠল। একটা গরু ও দুইটা খাসী কিনল। অনেক গুলি মুরগির অর্ডার দিল। কাপড় চোপড় ও অন্যান্য কিনা কাটায় সে মহা ব্যস্ত। ইমাম সাব সব সময় মোবাইলে তাদের খোজ খবর নিতেন। এখান থেকে যাওয়ার পর তিন মাস তার খুব কষ্টে কেটেছে। তারপর হঠাৎ আল্লাহ এই মুহসিনের উপর ইহসান করেছেন। গফরগাঁও টাউনে একটা ভাল মসজিদে তার ইমামতি হয়ে গেল, মসজিদের সাথে রাজকিয় কোয়ার্টার। তিনি স্বপরিবারে থাকেন, রাজার হালে দিন কাটাচ্ছেন। আসলে যে অন্যের জন্য নিজেকে উজার করে আল্লাহই তার জিম্মাদার। জামাল তার মসজিদে গিয়ে স্বপরিবারে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে এল। অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদেরও দাওয়াত করল। ইমাম সাব মেয়ের জন্য অনেক দামী একটা শাড়ি, ছেলের জন্য একটা দামী ঘড়ি ও কাপড় চোপড়সহ অনেক উপহার সামগ্রি নিয়ে স্বপরিবারে বেড়াতে এলেন। বিয়ের দিন পাত্র পক্ষের কাণ্ড দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। আট ভরি স্বর্নালংকার সহ অনেক উপহার সামগ্রি নিয়ে তারা এল। ধুম ধামের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া হল। পাত্রপক্ষ, পাত্রিপক্ষ ও গ্রামবাসী সবাই খুশি। ইয়াতিম পরিবারের উপর আল্লাহ রহম করলেন। জামালের হাতের সম্বল যা ছিল বিয়ে উপলক্ষে প্রায় সবটা খরচ হয়ে গেছে।

তিন বছর কেটে গেল। এবারও সব মিলিয়ে দুই আড়াই লাখ টাকা জমা হল। তার আর কোন ঋণ নাই, সব বন্ধকী জমি ছাড়িয়ে নিয়েছে। এখন তার পরিবার সুখি সমৃদ্ধশালী পরিবার। বড় মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে সকলের আদরে সোহাগে রাণীর হালে আছে। ছোট মেয়ে ফাতেমা ভাল করে লেখা পড়া করছে। মা চুরি করে অন্যের কাপড় সেলাই করে বলে জামাল রাগারাগি করে মেশিনটা গ্রামের এক দরিদ্র মহিলাকে দিয়ে দিয়েছে। মাকে পুর্ণ অবসর দিয়েছে। তার পরিবার এখন আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্ত সুখি পরিবার।

চতুর্থ বছর চলছে। জামাল নিজের লেখা পড়ায় আরো মনোযোগি হল। এবার সে মিশকাত জামাতে পড়ে, আগামিতে দাওরা পড়বে। এখন আর সে ক্লাস কামাই দেয় না, প্রতিদিন ঠিকমত মাদরাসায় যায়। কিছুদিন ধরে সে হাসান মুসান্না নামে একটা লোকের নাম শুনছে, লোকটা নাকি বিশ্বভণ্ড। সে ময়মনসিংহে আসন গেড়ে বসে উল্টা পাল্টা কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। জামাল তার ময়ূরপঙ্খি সাইকেলটায় চড়ে মাদরাসায় পৌঁছল কিন্তু অবাক হল, ক্লাসে কোন ছাত্র নাই, সবাই মুহতামিমের কামরার সামনে ভিড় জমিয়েছে। সে গিয়ে ভিড় ঠেলে জানালা দিয়ে উকি দিল, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ক্লাসমেট ফরিদ আত্তার চোখ বড় বড় করে মুহতামিমকে বলছে, ‘হা আমি হাসান মুসান্নার অনুসারী। এটা যদি আপনাদের ভাল না লাগে তাহলে ঠিক আছে ভাল কথা, আমাকে রাখবেন না আর আমিও থাকব না। কিন্তু আমার গায়ে যদি হাত তুলেন তাহলে আপনাদের অবশ্যি অবগতি থাকার কথা যে, হাসান মুসান্নার অনুসারীরা মাদ্রাসাটা গুড়িয়ে দিবে।

মুহতামিমের ললাটের বলিরেখা আরো গাঢ় হয়ে উঠল। তিনি কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ‘যা বেরু, এক্ষুণি বের হ আমার মাদরাসা থেকে, তোর মত ছাত্র আমার দরকার নেই। ছেলেটা দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কিন্তু জামাল দৌড়ে এসে তার জামার কলার চেপে ধরে চেচিয়ে উঠল, ‘হারামজাদা কাফির, বড় হুজুর ছেড়ে দিলেও আমরা তোকে ছাড়ব না। তুই একটা কাফেরের অনুসারী, তোরা আমাদের মুরুব্বিদেরকে কাফির বলিস, আজ এই ঔদ্ধত্বের জবাব পাবি’ বলে সে ঘুষি দেয়ার জন্য মুষ্টি উত্তোলন করল। ফরিদ তার হাতটা ধরে ফেলে চিৎকার করল ‘তুই তো বড় কাফির। তোর অসহায় অবস্থায় আমি তোকে টাকা পয়সা দিয়ে, কিতাবাদি দিয়ে সাহায্য করেছি। নিজের ভাত তোকে খাইয়েছি, এখন এর প্রতিদান দিচ্ছিস’ বলে সে জামালকে একটা ঘুষি মারল। জামালও একটা ঘুষি মেরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হা তুই আমার জন্য অনেক কিছু করেছিস কিন্তু তাই বলে তোরা আমাদের মুরুব্বিদের কাফের বলবি আর আমরা তোকে ছেড়ে দিব? আজ তোর এই গাদ্দারির বিচার হবে’ বলে দু’জনে দস্তাদস্তি শুরু হয়ে গেল।

একজন শিক্ষক দৌড়ে এসে তাদেরকে ছাড়িয়ে ধমক দিলেন, ‘এই ছাড়, এর বিচার করে লাভ নেই, বিচার করতে হবে ঐ ভণ্ডটার। সে যুব সমাজের মাথা বিগড়ে দিচ্ছে। ছাত্ররাও চেচিয়ে উঠল, হা আমরা হাসান মুসান্নার বিচার চাই, সে আমাদের ছাত্র ভাইদের গুমরাহ করে দিচ্ছে। তারপর ছাত্ররা বকোয়াজ করতে করতে মাদরাসার এক প্রান্তে চলে গেল। সেখানে জামাল ছোট্ট একটা বক্তৃতা করল। তারপরই মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারা ‘হাসান মুসান্নার ফাসি চাই ফাসি চাই বিচার চাই, হাসান মুসান্না কাফের ইত্যাদি শ্লোগান দিতে দিতে মাদরাসা ছেড়ে রোডের দিকে যেতে লাগল। মুহতামিম দৌড়িয়ে দুজন শিক্ষক পাঠালেন তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য। শিক্ষকরা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে ছাত্রদের ফিরিয়ে আনল। মুহতামিম তাদের সামনে নরম গরম বক্তব্য দিয়ে বললেন, ‘তোরা এখানে মিছিল করে কি করবি, মিছিল তো হতে হবে ময়মনসিংহে। কিন্তু ওরা তো তেমন নড়াচড়া করছে না। আমি আগামী সপ্তাহে যাব, সেখানকার মাদরাসাগুলির সাথে যোগাযোগ করে এর একটা বিহিত করেই ছাড়ব ইংশাআল্লাহ। এখন তোরা ক্লাসে যা। ছাত্ররা অগত্যা বিষের ঢোক গিলে ক্লাসে গেল।

মাওঃ জালালুদ্দিনের মৃত্যুর চতুর্থ বছর চলে গেল। এবার সর্ব সাকুল্যে জামালের হাতে চার লাখ টাকা জমা হল। মা পরামর্শ দিলেন এত টাকা ঘরে রাখা যাবে না। একটা একাউন্ট খুলে ব্যাংকে জমা রাখ, সুদের টাকাটা গরিব মিসকিনকে দিয়ে দিলেই চলবে। এদিকে মিশকাত পরীক্ষার পর জামাল ভাবছে দাওরাটা সে কোন ভাল মাদরাসায় গিয়ে পড়বে কিন্তু চিন্তার বিষয় হল কোন মাদরাসায় যাবে। সে শুনেছে ময়মনসিংহের বড় মাদরাসায় একজন নতুন শিক্ষক এসেছেন তাকে বাহরুল উলুম (বিদ্যাসাগর) বলা হয়। তিনি নাকি হাদীস তাফসির ইত্যাদি পড়ানোর সময় বাস্তবতার উদাহরণ দিয়ে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে সমন্বয় করে দেন। তিনি সর্ব শাস্ত্রে সব জান্তা। এতে ছাত্ররা ধর্মীয় জ্ঞানের সাথে সাথে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞানার্জন করতে পারে। সেই সাথে গ্লোবালাইজেশনের বাস্তব পরিস্থিতি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। তাছাড়া এই শিক্ষক একবার তাদের মাদরাসার বাৎসরিক সভায় ওয়াজ করেছিলেন। তিনি কোরান হাদীস ও আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতার সাথে সমন্বয় করে এমন অভুতপুর্ব বক্তব্য দিয়েছিলেন যে, জামাল তন্ময় হয়ে শুনেছিল। মনে হচ্ছিল যেন তিনি কোরানকে পৃথিবীতে বাস্তব রুপায়ন করছেন। তার মনটা আনন্দে নেচে উঠে ‘হা হা এমন একজন শিক্ষকই তো চাই, আমাকে এই মাদ্রাসাতেই ভর্তি হতে হবে।

রমযানে সে একটা ফ্রিজ কিনে এনে মাকে বলল ‘আম্মা আমি দাওরাটা ময়মনসিংহে দিব, প্রতি বৃহস্পতিবার এসে সংসারের কাজকর্ম গুছিয়ে যাব আর তোমার এক সপ্তাহের বাজার সওদা করে দিয়ে যাব। তুমি ফ্রিজে রেখে রেখে খাবে। সপ্তাহের মাঝে তেমন কাজ নেই শুধু মাছের খাদ্য দেয়া। বোরকা পড়ে গিয়ে তুমি নিজেই খাদ্য দিতে পারবে। আর না পারলেও সমস্যা নাই, রফিককে বললে সেই দিয়ে দিবে- পাশের ঘরের এক ছেলের কথা বলল। মাঝে মধ্যে কোন দরকার দেখা দিলে আমাকে কল করলেও আমি চলে আসব বা কোন কামলা নিয়েও করিয়ে নিতে পারবে। রমযানের পর সে গিয়ে মাদরাসায় ভর্তি হল, বেডিং পত্র নিয়ে মাদরাসায় উঠল। কারণ দাওরায় সারাদিনসহ রাত বারটা পর্যন্ত ক্লাস হয়।

মাওঃ মুজাহিদ বিল্লাহ সাতাশ বছরের এক অবিবাহিত যুবক। দুই বছর আগে দাওরা দিয়ে সরাসরি তিনি এই মাদরাসার মুহাদ্দিস হয়ে এসেছেন। ফর্সা লম্বা একটা তাল পাতার সেপাই। দেহে মাংসের দুর্ভিক্ষ, দেখে মনে হয় চামড়ায় আচ্ছাদিত একটা কংকাল দেহ। থুতনিতে কয়েকটা দাড়ি ঝুলছে, মাথাটা ছোট। আর এ জন্যই সবাই অবাক হয় এই ভেবে যে, এই ছোট্ট মেমোরিতে দুনিয়ার সকল লাইব্রেরী তিনি কিভাবে আটিয়ে রেখেছেন। এই ক্ষীণকায় ব্যক্তিটাই বৃহত্তর ময়মনসিংহের অপ্রতিদ্ধন্ধি আলেম এবং সারা বাংলাদেশে দু’চার জনের একজন। প্রথম দিনেই জামালের পরিচয় পেয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়েছেন এবং আশার বানী শুনিয়ে বলেছেন, তুমি শহীদ সন্তান, তোমার মর্যাদা আমাদের সকলের উর্ধ্বে। এখন থেকে তুমি আমার সাথে থাকবে, বোর্ডিংয়ের দুবেলা খাবার তাও আবার শুধু ডাল, এসব খেয়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে। আমার লজিং আছে তিন বেলা ভাল মন্দ খেতে পারবে। থাক আমার সাথে, আমি তোমাকে পৃথিবীর উপযোগি করে গড়ে তুলব।

জামাল যেন আকাশের চাঁদ হাতের মুঠোয় পেল, সে খুশিতে আত্মহারা। সে তার স্বপ্নের উস্তাদের সাথে খাওয়া দাওয়া করে, খেদমত করে, তন্ময় হয়ে তার তাকরির শুনে, সে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করল। কিন্তু শীঘ্রই তার সৌভাগ্যে ফাটল দেখা দিল। সে অবাক হয়, বিস্ময়াবিভুত হয়, এটা কিভাবে সম্ভব যে মুজাহিদ বিল্লাহর মত একজন অপ্রতিদ্ধন্ধি আলেম হাসান মুসান্নার মত একটা ভণ্ডের শিষ্য। পৃথিবীর প্রতি তার স্বাভাবিক বোধ বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। শহীদ সন্তান হিসাবে সে শীঘ্রই সকল ছাত্রের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠে। কয়েক দিনেই সে বুঝতে পারে এ মাদরাসার সকল ছাত্র ঐ ভণ্ডটার শিষ্য। ছাত্ররা প্রকাশ্যে হাসান মুসান্নার আলোচনা করে, প্রশংসা করে, সর্বত্র তার জয়জয়কার। প্রতি শুক্রবার রাতে তার মজলিস বসে, ছাত্ররা জামালকে সেখানে যাওয়ার দাওয়াত দেয়, তারা সবাই সেখানে যায়।

মুহতামিম কিছু বলে না বা বলতে পারে না দু’টি কারণে। প্রথমত তিনি নাকি ঐ ভণ্ডের বাবার ছাত্র, এ জন্য উস্তাদের ছেলেকে সমিহ করে চলেন। আবার মুজাহিদ বিল্লাহকে কিছু বলতে পারেন না, কারণ তাহলে তিনি চলে যাবেন আর তার সাথে ছাত্ররাও চলে যাবে। তখন মাদরাসাটাই ভেঙ্গে যাবে। আর ছাত্রদের কিছু বললে মুজাহিদ সাব প্রতিবাদি হবে তখন মুহতামিমকেই মাদরাসা ছাড়তে হবে। এ জন্য সবাই এক চেটিয়া হাসান মুসান্নার অনুসারী। কিন্তু কিছু কিছু শিক্ষক তার বিরোধি তবে তারা অক্ষম কোণঠাসা। তাদের কার্যক্রম হল শুধু ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের তিরস্কার করেন আর হাসান মুসান্নাকে গালাগালি করেন। তখন উস্তাদ হিসাবে ছাত্ররা প্রতিবাদ না করে শুধু মাথা নিছু করে মিটিমিটি হাসে।

জামাল লেখা পড়া করবে কি, তার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এটা কি করে সম্ভব, যে ব্যক্তি আমাদের মুরুব্বিদের কাফের বলে, গালিগালাজ করে এরা সবাই কিনা তারই শিষ্য। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে ‘এখানে আসলাম আলেম হওয়ার জন্য কিন্তু দেখা যাচ্ছে কাফের হয়ে এখান থেকে যেতে হবে। না না, এখানে থাকা ঠিক হবে না। সে সিদ্ধান্ত নেয় আর কিছুদিন দেখে এখান থেকে অন্য মাদরাসায় চলে যাবে। তার প্রিয় উস্তাদ স্বপ্নের উস্তাদ মুজাহিদ বিল্লাহর প্রতি তার শ্রদ্ধা ঘৃনায় রুপান্তরিত হয়ে গেল। সে আর উস্তাদের সাথে খায় না, কাছে যায় না, খেদমত করে না দূরে সরে পড়ল।

গোরস্থান মাদরাসার বহিস্কৃত ছাত্র তার প্রাচিন বন্ধু ফরিদ আত্তার এ মাদ্রাসাতেই ভর্তি হয়েছে, তার ক্লাসমেট। দুজনে চোখাচুখি হয় কিন্তু আজ পর্যন্ত কথা হয়নি। একদিন বিকালে উভয়েই মুখোমুখি হয়ে গেল, তখন ফরিদ গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি জানি তুই হাসান মুসান্নাকে ঘৃনা করিস, কাউকে না জেনে ঘৃনা করা বা শত্রুতা পোষণ করা শরীয়তের নিষেধ। আল্লাহ তা’লা বলেছেন--

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ﴿الحجرات: ١٢﴾

হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা পাপ। (৪৯: ১২) কাজেই তুই একবার তার মজলিসে যা, তারপর নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবি ঘৃনা করবি নাকি শ্রদ্ধা করবি’ বলে সে হনহন করে চলে গেল, আর কোন কথা বলল না।

বৃহস্পতিবারে জামাল বাড়িতে গিয়ে সাংসারিক কাজে ঝাপিয়ে পড়ল। শুক্রবার জুমার পর আবার মাঠে গিয়ে কাজে লাগল কিন্তু মন বসাতে পারল না। বারবার শুধু ফরিদ আত্তারের কথাটা মনে হচ্ছে, তারও কৌতূহল মাথা চারা দিয়ে উঠেছে, লোকটা দেখতে কেমন, সে কি বলে কেন বলে। বড় বড় আলেমদের কাফের বলার সাহস সে কোথায় পেল, সে কত বড় বিদ্যান যে মুজাহিদ বিল্লাহর মত বাহরুল উলুমকে সে বস করে নিয়েছে। জামাল অস্থির হয়ে উঠে, সময় যাচ্ছে আর অস্থিরতা বাড়ছে, বিকালে তার শরীরে যেন কাঁপন ধরে গেল, আর টিকতে পারল না। সে বাড়িতে গিয়ে চারটে খেয়ে মাকে সালাম দিয়ে রওয়ানা হল। রওয়ানা হল সে ঐ ব্যক্তির উদ্দেশ্যে- তার দৃষ্টিতে যে ব্যক্তিটা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট, সবচেয়ে ঘৃনিত একটা ইতর বৈ আর কিছু নয়।

বিষয়: রাজনীতি

৮৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File