সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ৫-৬
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৪ জুন, ২০১৭, ১২:০৯:৫০ রাত
জামাল মসজিদ মক্তবের দায়িত্বটা ঠিকমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে সেই সাথে ভাবছে কয়েকটা টিউশনি হলে ভাল হত। কিন্তু গ্রামের টিউশনিতে টাকা কম, শহরের টিউশনিতে টাকা বেশি। মুক্তাগাছা টাউন তাদের বাড়ি থেকে দেড় দুই মাইল দূরে। সে পরিচিত কয়েক জনকে বলে কয়ে সেখানে কয়েকটা টিউশনি জোগার করে নিল। এদিকে বর্গাদারদের কাছ থেকে জমি ছাড়িয়ে নিজেই আবাদ শুরু করেছে। লিজে দেয়া পুকুরের মাছও বিক্রি হয়ে গেছে, তিন লক্ষ টাকা খরচ করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা বিক্রি হয়েছে। আড়াই লাখ টাকা লাভ। লাভ দেখে জামালের আত্মা ধুক পুক করে, তাদের পুকুর থেকে অন্যরা এত টাকা লাভ করে নিয়ে যাচ্ছে অথচ তারা টাকার অভাবে মরছে। লীজ ওয়ালা পিড়াপিড়ি করল কিন্তু সে বলে দিল, আর লীজে দিবে না নিজেই ফিসারি করবে। সমস্যা হল ফিসারি করতে গেলে লাখ তিনেক টাকা দরকার, এত টাকা সে পাবে কোথায়। মহা চিন্তায় পড়ে গেল, একবার ভাবল, ঋণ করবে কিন্তু ফল হবে না। কারণ তখন লাভের টাকা পাওনাদার নিয়ে নিবে। আরেক বার ভাবল জমি বন্ধক দিবে, তাও সাহস পেল না। কারণ এমনিতেই অর্ধেক জমি বন্ধক পড়ে আছে।
অনেক শলা পরামর্শের পর অবশেষে মা বললেন ‘চল তোর বড় খালার বাড়িতে যাই, আশা করি আল্লাহয় একটা ব্যবস্থা করবেন। সে মাকে নিয়ে মাইল তিনেক পশ্চিমে খালার বাড়ি গিয়ে খালাকে বুঝাল, ‘আমরা এখন অসহায় আমাদের বেচে থাকার জন্য একটা অবলম্বন করে দেন। বড় খালাত ভাই আরমানকে বুঝাল, ‘ফিসারি ব্যবসায় সমান সমান লাভ, লাখ তিনেক টাকা খরচ করলে আড়াই তিন লাখ লাভ হবে, তোমাকে লাভের অর্ধেক বা তিন ভাগের দুই ভাগ দিয়ে দেব। খালাত ভাইয়ের হাতে নগদ কোন টাকা ছিল না কিন্তু সে ভাবল ইয়াতিম পরিবারটির দেখা শুনা করা তার জন্য ফরয, তার উপর তারা সাহায্যের আবেদন করেছে- এ অবস্থায় তাদেরকে খালি হাতে ফিরানো তার কাছে অসম্ভব ঠেকল। তাছাড়া ওরা তো মাগনা টাকা চাচ্ছে না, লভ্যাংশ দিবে। কাজেই নিজের ক্ষতি করে হলেও সে টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
অগত্যা জামালকে বলল, ‘দেখ আমার হাতে নগদ কোন টাকা পয়সা নেই, কিছু ছিল বিভিন্ন ব্যবসায় লাগিয়ে দিয়েছি। এখন তোদের ভালোর জন্য আমার ক্ষতি করে হলেও টাকা দিব। ব্যবসার টাকা তুলে, গরু ছাগল বিক্রি করে তোকে সর্বোচ্চ লাখ দুয়েক টাকা দিতে পারব এর বেশি পারব না, বাকিটা তুই ম্যানেজ করে নিস। জামাল আল হামদুলিল্লাহ বলে আনন্দ চিত্তে মাকে নিয়ে বিদায় হল।
শুরু হয় জীবন যুদ্ধ, বেচে থাকার সংগ্রাম, টিকে থাকার লড়াই। সে সকাল নয়টা পর্যন্ত মক্তবে থাকে, তারপর বাড়িতে এসে চারটে খেয়েই মাঠে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, বীজ তলা ঠিক করা, খেতের আল ঠিক করা, জমি চাষ দেয়া, ফিসারিতে খাদ্য দেয়া, মাছের রোগ পীড়া হল কিনা পর্যবেক্ষন করা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকে। সে আধা বেলায় চার পাঁচটা কামলার সমপরিমাণ কাজ করে। নিজে করা যায় এমন কোন কাজ কামলা দিয়ে করায় না। ধানের চারা নিজে তুলে দেয় কামলারা রোপণ করে, তাতে অর্ধেক মুজুরি বেচে যায়। সে কঠোর পরিশ্রম করে আর আত্নবিশ্বাসী হয়ে উঠে। এ বয়সটায় মানব সন্তান দানব হয়ে উঠে, সে দানবের মত কাজ করে। কঠিন যে কোন কাজ সে পানির মত ফিনিস করে দেয়। এভাবে একটানা আসর পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে।
আসরের নামায পড়ে সে পায়ে হেটে মুক্তাগাছা টাউনে চলে যায়। সেখানে পাঁচ ছয়টা টিউশনি করে, কোরান শরীফ শিক্ষা দেয় এবং প্রাইমারি ছাত্রদের অংক ইংরেজি পড়ায়। মাগরিব ও এশা মুয়াজ্জিন পড়ায়, ইয়াতিম পরিবারের সহযোগিতা হিসাবে মুসুল্লিরা এটা ছাড় দিয়েছে। তারপর রাত এগারটা থেকে বারটার মধ্যে বাড়িতে আসে। তারপর চারটে খেয়ে ঘন্টা দুয়েক পড়ার পর ঘুমিয়ে পড়ে। সে মাদরাসায় বলে কয়ে তার ও বোনদের জন্য কিতাব তুলে নিয়ে এসে বোনদের বলে দিয়েছে, ‘লেখা পড়া বন্ধ করা যাবে না, বাড়িতে বসে বসে পড়, যেগুলি না পারবি আমাকে জিজ্ঞেস করবি। সে নিজেও রাত্রে ঘণ্টা দুয়েক পড়ে, আটকে গেলে গোরস্থান মাদ্রাসার হুজুরের কাছ থেকে জেনে আসে। এভাবেই চলতে থাকে সংসার সমরাঙ্গনে এক তরুন বালকের নিরন্তর সংগ্রাম, সুস্থির নিঃশ্বাস ফেলার মত তার এক মুহুর্তও সময় নাই।
ওদিকে তার বিধবা মাও বসে নেই, বাড়ির পাশের এক দর্জিকে ধরে পুরাতন একটা সেলাই মেশিন বাকিতে নিয়ে এসেছে। কাজ করে করে কিস্তিতে টাকা দিবে। গায়ের মহিলাদের কাপড় বানানো শুরু করেছে, দুই মেয়ে তাকে সাহায্য করে। জামাল রাগ দেখায়, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের এখন ভাল উপার্জন হচ্ছে, গিরস্তি ও ফিসারিও করছি, তাহলে তোমাকে এমন নিচু পর্যায়ের পরিশ্রমের কাজ করতে হবে কেন? কিন্তু মা তার কথার পাত্তা দেন না, নিজের বালক সন্তানের উপর নির্ভরশীল না থেকে ইয়াতিম সন্তানদের জন্য নিজেও কিছু করতে চান।
মাস তিনেকের মধ্যে জামালের হাতে বেশ কিছু টাকা জমা হয়ে গেল। এবার বুঝি তার স্বপ্ন পূরণ করার সময় এল। ছোট বেলা থেকে সে দেখেছে তাদের গায়ের কয়েকজন ধনি লোক চায়না ফনিক্স সাইকেল চালাত, রাস্তা ঘাটেও দেখেছে, কত সুন্দর চকচকে ঝকঝকে সাইকেল। এমন একটা সাইকেল চালানো তার সারা জীবনের সখ। ছোট বেলায় ভাবত বড় হয়ে কিনবে, বড় হয়ে বাবাকে কয়েক বার বলেছে কিন্তু কিনে দেয়নি। এখন তো আর কোন বাধা নাই, তার হাতে টাকা আছে। তাছাড়া একটা সাইকেল তার খুব দরকারও বটে। টিউশনি করার জন্য দুই মাইল পথ পায়ে হেঁটে আনাগুনা করতে হয়, আরো কত দরকার। কাজেই এবার সে সাইকেল কিনবেই। সে উচ্ছসিত হয়ে উঠে, তার মন আনন্দে আত্নহারা।
একদিন তার পরিচিত অভিজ্ঞ একজনকে নিয়ে ময়মনসিংহ গেল। মার্কেটে গিয়ে যাচাই বাচাই করে একটা নতুন সাইকেল বাধাল। তারপর সাইকেলে চড়ে বাড়িতে ফিরল। তার মনে হল যেন সে সাইকেলে চড়ে আসেনি প্লেনে চড়ে এসেছে, মাটি দিয়ে আসেনি আকাশ পথে এসেছে। নিজের উপার্জনের পয়সায় জীবনের প্রথম সাধ পূরণ করল, গর্বে তার বুকটা ভরে উঠেছে। বাড়িতে গিয়েই সে ন্যাকড়া দিয়ে সাইকেল মুছে তেল দিতে লাগল। তার মা ও বোনেরা এত সুন্দর সাইকেল দেখে বিজয়ের হাসি হাসল। তারা বুঝতে পারল, তাদের ভাগ্যাকাশে ঘনিয়ে আসা অমানিশার কাল আধার কেটে যাচ্ছে।
জামাল মক্তব ছুটি দিয়ে মসজিদ বন্ধ করে সবে মাত্র বারান্দায় আসল, অমনি মোবাইল বেজে উঠল এবং অপর প্রান্ত থেকে মাত্র কয়েকটা কথা বলল। তার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল। তার দেহের জোড়াগুলি যেন ছেড়ে দিয়েছে, সে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল আর বিলাপ করতে লাগল, ‘ভাইয়্যা ভাইয়্যা, আরিফ ভাইয়্যা, তোমার কী হল কেন এমন হল। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে মাকে জানানোর জন্য বাড়িতে দৌড়াল। বাড়িতে গিয়েই চৌকিতে গড়িয়ে পড়ে চিৎকার শুরু করল, ‘আম্মা আম্মা গো আরীফ ভাইয়্যা আর নাই। সে মারা গেছে, যহুরের পর জানাযা হবে। মা ও ছেলে মেয়েরা কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে জানাযা ধরার জন্য রওয়ানা হল। আরীফ হল জামালপুরের তিন খালাত ভাইয়ের সর্ব কনিষ্ঠ ভাই। সে জামালের সমবয়সী এবং বন্ধু ছিল।
তারা বাড়িতে পৌছে পুলিশ দেখে অবাক হয়ে গেল। মরা বাড়িতে আবার পুলিশ কেন? তারপর ভিতর বাড়িতে গিয়ে দেখল লাশ খাটিয়ায়, তখনো গোসল দেয়া হয়নি, আগের কাপড় চোপড় পড়া। রক্তে কাপড় ভিজে আছে, জামাটা সম্পুর্ন লাল হয়ে গেছে। জামাল তার মুখের দিকে তাকাল, নুরানি চেহারার মুখটা কেমন নির্জীব নিথর, থুতনিতে কয়েকটা দাড়ি। মুখটা যেন ঘৃনা আর উপহাসে থমথম করছে, ঠোঁটটা ঈষৎ ফাক হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন, এ অসময়ে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় দেয়ার জন্য সে সমগ্র পৃথিবীকে অভিশম্পাত করছে। জামাল আস্তে আস্তে তার প্রিয় ভাই ও বন্ধুর শিয়রের কাছে গিয়ে বসল, মাথায় হাত বুলাল। তারপর হাঁটুতে মাথা গুজে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল। এক সময় ক্রোধ ও ঘৃনায় সে উঠে দাঁড়াল, যারা এ নিস্পাপ বালকটিকে বাচতে দিল না তাদের উপর প্রতিশোধ নিবে। সে বড় ভাই আরমানের খোঁজে তার ঘরে গেল।
ঘর ভর্তি মানুষ, আরমান তাদেরকে ভাইয়ের মৃত্যু কাহিনী শুনাচ্ছে, ‘আরীফ ঢাকা কলেজে পড়ত, সেখানে একটা মেচে থাকত, সে খুব মেধাবি ছাত্র ছিল। কলেজে পড়ত আর টিউশনি করে অনেক টাকা উপার্জন করত। নিজের খরচ চালিয়ে বাকি টাকা বাড়িতে পাঠাত। সে শিবির করত। পরশু রাতে তাকে ধরে নিয়ে যায় আর আমরা কিছু শুনার আগেই গতরাতে তাকে ক্রস ফায়ারে দেয়া হয়’ (ঘটনাটা সত্য) এটুকু বলেই সে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে বিলাপ শুরু করল, ‘আমার ভাই, আমার পরিবারের সম্পদ, এর মত ভাল ছেলে এ এলাকায় নাই। সে কষ্ট করে অনেকগুলি টিউশনি করে বাড়িতে টাকা পাঠাত তার টাকায় আমাদের সংসার চলত। সে ছিল অন্য রকম মেধাবি তার আশা ছিল ডাক্তার হবে। আমাদের সব শেষ হয়ে গেল। সকল আশা ভরসা ধ্বংস হয়ে গেল, আমাদের পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেল। সে বিলাপ করতে করতে বিছানায় কাতরাতে লাগল আর অন্যরা শান্তনা দিতে লাগল।
জামাল চমকে উঠল, সে গম্ভীর হয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাড়ির বাইরে গিয়ে একটা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে সে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল, ‘ভাইয়্যা, আমার আরিফ ভাইয়্যা শেষ মেষ তুমি কাফের হয়ে মরলে। সারা জীবন ভাল থেকে অবশেষে কেন তুমি শিবির করতে গেলে, তুমি কি জান না শিবির করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়, আর মুসলমান থাকে না। তোমার তো পরকাল নষ্ট হয়ে গেল, হায় এই দুঃখ আমি কোথায় রাখব। সে তার প্রিয় ভাই ও বন্ধুর এভাবে গুমরাহ হয়ে মৃত্যুবরণ করার দুঃখে গাছ তলায় বসে বসে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ জানাযার কথা মনে হল, এখন জানাযার কি হবে, কোন কাফেরের জানাযা পড়া তো জায়েয নেই। সে বিমর্ষ হয়ে ভাবতে লাগল, শিবির করলে কি আসলেই মানুষ কাফের হয়ে যায়, তাদের জানাযা পড়া যাবে না? সে নিজে জানে না জামাত শিবিররা কি মুসলমান নাকি কাফের। তবে হুজুরদের কথায় বুঝা যায় ওরা আর মুসলমান থাকে না, কাফের বা এ জাতীয় একটা কিছু হয়ে যায়।
সে তার হুজুরদের কথা স্বরণ করতে লাগল, কওমী মাদরাসার সবাই বলে জামাত শিবিরের আকিদায় সমস্যা আছে, আর আকিদা গত সমস্যা থাকলে তো মানুষ আর মুসলমান থাকে না, কাফের মুনাফিক জাতীয় একটা কিছু হয়ে যায়। আবার মওদুদিকে সবাই মিস্টার মওদুদি বলে ডাকে। তার স্বরণ হল, একবার তার বাবার মাদরাসার বড় হুজুর ছাত্রদের ট্রাংক খুলে চেক করলেন। অধিকাংশ ছাত্রের ট্রাংকে শেক্সপিয়র, টলস্টয়, গোর্কি, রবিন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম ইত্যাদি লেখকদের উপন্যাস পাওয়া গেল। বইগুলি ফিরিয়ে দিয়ে তিনি ছাত্রদের ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই শয়তানের বাচ্চারা আজে বাজে বই না পড়ে ইসলামি বই পড়তে পারিস না কিন্তু দুইটি ছাত্রকে ধরে দপ্তরে নিয়ে এলেন। একজনের ট্রাংকে রগরগে যৌনতা সম্পর্কে লিখা কলিকাতার বই ‘নাভির নিচে কস্তুরি’ পাওয়া গেল। বড় হুজুর তাকে কয়েকটা বাড়ি দিয়ে বললেন, ‘এই শয়তান কানে ধরে তওবা কর এমন অশ্লিল বই আর কোনদিন পড়বি না। তারপর তাকে ছেড়ে দিলেন আর বইটা পুড়িয়ে দিলেন।
অন্য ছেলেটার ট্রাংকে পাওয়া গিয়েছিল মওদুদির তাফহিমুল কোরান- এর একটা খণ্ড। এজন্য তিনি ছেলেটাকে প্রচণ্ড মাইর দিলেন, আহ কী ভয়ঙ্কর মার, মারের চোটে ছেলেটা বড় হুজুরের পা ধরে ধাপাধাপি করছিল আর চিৎকার করে কাঁদছিল। তারপর নাম কেটে সাথে সাথে মাদরাসা থেকে বের করে দিলেন, এক মুহুর্তও আর মাদরাসায় থাকতে দেয়া হয়নি। তার এখনো মনে আছে ছেলেটা পুটলা পাটলি মাথায় নিয়ে কিভাবে অপমানিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাদরাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কাজেই মওদুদির বই পড়া, শিবির করা যদি কুফুরি না হত তাহলে বড় হুজুর এত কঠোরতা করতেন না। বিশেষত তাফহীম হল একটা কোরান বা কোরানের তাফসীর। জামাল চমকে উঠে, ‘না না, ওরা মুসলমান না। আর একটা অমুসলিমের জানাযা পড়া কখনোই জায়েয হবে না- যত আপনজনই হউক না কেন। সে ছিটিয়ে উঠে মায়ের কাছে গেল। তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, ‘আম্মা চল যাই গা, আরিফ ভাই শিবির করত, আর শিবিরের জানাযা পড়া যায়েয নাই। মা চোখ কপালে তুললেন। তারপর ছেলেকে ধমক দিলেন আর বুঝালেন।
জামাল লজ্বিত হয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে ভাবতে লাগল চলে যাবে কিনা। কিন্তু জানাযা না পড়ে গেলে অন্যরা তো গালাগালি করবেই সেই সাথে আরমান ভাই রাগ করবে। আর রাগে যদি সে ফিসারির জন্য প্রদত্ত টাকা ফেরত নিয়ে আসে তাহলে তো না খেয়ে মরতে হবে। অগত্যা সে থাকার সিদ্ধান্ত নিল তবে জানাযা পড়বে না, শুধু হিলাবাযি করবে। ফাদে পড়লে হিলা করা জায়েয আছে। জহুরের পর জানাযা দাঁড়াল, আরমান সামনে গেল। জামাল লোক নিন্দার ভয়ে দাঁড়াল বটে তবে নিয়্যত করল না। শুধু নাভীর নিচে হাত দু’টি পেতে রাখল। কারো তলপেটে ব্যাথা উঠলে যেভাবে হাত চেপে রাখে সেও সেভাবে ধরে রাখল।
জানাযার পর সে দাফন করতে গেল না, একটা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে এস্তেগফার করতে লাগল। তারপর মাকে নিয়ে রওয়ানা হল। এই অনিচ্ছাকৃত পাপের জন্য তার মুখ পাংশু বর্ণ হয়ে গেল। পুরা রাস্তাটা সে এস্তেগফার ও তওবা পড়তে পড়তে গেল। কাফেরের জানাযা পড়ার জন্য পাপের অনুভূতি তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। রাতে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে হাত উঠিয়েই সে চোখের পানি ছেড়ে দিল, ‘মা’বুদ তুমি তো জান দায়ে আটকা পড়ে একটা কাফেরের জানাযা পড়তে আমি বাধ্য হয়েছি। এই অনিচ্ছাকৃত পাপের কারণে তুমি আমাকে শাস্তি দিও না, মাফ করে দাও। সে জারজার হয়ে কাঁদতে লাগল আর তওবা এস্তেগফার পড়তে লাগল। এইভাবে আলেম নামের ফিরকাবাজ শয়তানরা ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংস করার জন্য যে বিভক্তির বিষ ছড়িয়েছে, এই অবুঝ অজ্ঞান বালকটি সেই বিষে আক্রান্ত হয়ে গেল।
৬
বছর ঘোরে এল। জামাল ফিসারীর মাছ বিক্রি করল। দুই লক্ষ টাকা লাভ হয়েছে। লভ্যাংশের এক লক্ষ টাকা খালাত ভাই আরমানকে দিল কিন্তু সে পঁচিশ হাজার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা তুই রেখে দে। ফিসারিতে তো বিরাট লাভ, তোর কি আবার টাকা লাগবে নাকি আমি নিজেই গিয়ে ফিসারি দিব। জামাল বলল, ‘না ভাইজান, আমার ধান বিক্রি, ফিসারি, ইমামতি ও টিউশনির টাকা মিলিয়ে দুই লক্ষ টাকার মত নগদ কেশ আছে, আমার আর টাকা লাগবে না। আরমান বলল, ‘ফিসারি সাবধানে করবি, মাছে মরক ধরলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে। তোদের সংসারটা এখন উঠতি সংসার, একবার মার খেলে আর সোজা হতে পারবি না। আরো কিছু উপদেশ দিয়ে সে হাসি মুখে বিদায় নিল।
জামালের পরিবারে এখন খুশীর বন্যা, ধ্বংসোন্মুখ পরিবারটা পর্যাপ্ত টাকার মুখ দেখছে। সে অর্ধেক টাকা দিয়ে বন্ধকি জমি ছাড়াল আর বাকি অর্ধেক টাকা ফিসারির জন্য রাখল। একদিন রাতে খেতে বসে মা বললেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের তো এখন কিছু টাকা হয়েছে, আল্লাহ আমাদের সুদিন ফিরিয়ে দিয়েছেন। কাজেই তোদের লেখা পড়াটা আবার শুরু কর। জামাল আত্নতৃপ্তির হাসি দিয়ে বলল, আপনি এতদিনে বলতেছেন, আমি তো কবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি রোযার পর আমরা সবাই ভর্তি হয়ে যাব। সে এবার দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে কৃষি ও ফিসারিতে মনোযোগ দিল। রমযানের পর মেয়ে দুটিকে মহিলা মাদরাসায় ভর্তি করে দিয়ে আসল। আর সে নিজে মুক্তাগাছা টাউনের গোরস্থান মাদরাসায় ভর্তি হল, তবে ভর্তির সময় সে বড় হুজুরকে বলেছে ‘সাংসারিক ঝামেলার কারনে আমি ঠিকমত ক্লাস করতে পারব না, মাঝে মধ্যে গায়ের হাজির থাকতে হবে। হুজুর বলেছেন ‘একজন শহীদের সন্তান হিসাবে তোমার জন্য আমরা সর্বোচ্চ ছাড় দিব। তুমি ভাল ছাত্র, সংসার ও লেখা পড়া দুটোই তুমি চালিয়ে যেতে পারবে। আমরা চাই তুমি তোমার বাবার চেয়েও বড় আলেম হবে।
জামালের এখন ভাল আর্থিক সামর্থ হয়েছে। তাই পড়ার স্বার্থে সে রাতের টিউশনিগুলি ছেড়ে দিল। এবার সে মায়ের পিছু নিল, অন্যের কাপড় সেলানোর মত নিচু কাজ করতে দিবে না। সে ধমক দিল ‘নিজের কাপড় ছাড়া অন্যের কাপড় সেলাই করলে কিন্তু আমি মেশিন বিক্রি করে দিব। মা মুখে বললেন আচ্ছা কিন্তু ছেলের আড়ালে আবডালে কিছু কাজ করতে লাগলেন। কারণ মেয়েদের জন্য বাবার স্থলে তিনি আছেন, এখন তিনিই তাদের বাবা মা। কাজেই তাদের জন্য তিনি একটা কিছু করতে চান, অতিরিক্ত খরচের জন্য তাদের হাতে দু’টি পয়সা তুলে দিতে চান। যদিও ছেলে তার বোনদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে। এমনকি বাহির থেকে আসলে সে খালি হাতে আসে না। বোনদের জন্য বিস্কুট চানাচুর আচার ইত্যাদি একটা কিছু নিয়ে আসে। আর মেয়েদের কাপড় চোপড় ও কসমেটিক্সের তো কোন অভাবই নাই। তবুও মা হিসাবে নিজের মনের শান্তনার জন্য তিনি মেয়েদের জন্য কিছুটা উপার্জন করতে চান। জামালের সংসার ভালই চলছে কিন্তু এলাকায় দেখা দিল সমস্যা।
তাদের দক্ষিণ পাড়ায় আগে দুইটা আহলে হাদীস পরিবার ছিল। কিন্তু ইদানিং খুলনা থেকে আহলে হাদীসের এক আলেম এসে সেখানে ঘরোয়া সভা করে। এতে আরো কয়েকটা পরিবার আহলে হাদীস হয়ে গেছে। তাতে সমস্যা ছিল না, কিন্তু সমস্যাটা দেখা দিল এই জায়গায় যে, তারা বলে বেড়াচ্ছে, হানাফিরা বেহেশতে গেলে কুত্তাও বেহেশতে যাবে। হানাফী ফিকাহ পড়ার চেয়ে লেংটা ছবি দেখা ভাল। হানাফীরা সহিহ হাদীসের উপর আমল করে না, মাযহাব অর্থ টয়লেট’ এলাকায় ইত্যাদি বিদ্বেষমূলক কথা ছড়াচ্ছে। জামাল প্রতি জুমায় বিনয়ের সাথে নরম ভাষায় তাদেরকে বুঝাতে থাকে, বিদ্বেষ না ছড়ানোর জন্য অনুরোধ করতে থাকে। কিন্তু আহলে হাদীসের লোকেরা অপপ্রচার চালিয়েই গেল।
এক জুমায় সে মসজিদে হুংকার ছাড়ল, ‘যারা ইমাম মানে না তাদের ইমাম শয়তান, যারা মাযহাব মানে না শয়তানি পথ তাদের মাযহাব। তারপর সে জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুরু করল। মুসুল্লিরা উত্তেজিত হয়ে উঠল। আহলে হাদীসের লোকেরা অবস্থা বেগতিক দেখে ফসকে ফসকে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠল। বুঝা যাচ্ছিল যে, তখন তারা থাকলে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটে যেত, মসজিদের ভিতরেই কয়েকটা লাশ পড়ে যেত। নামাযের পর সবাই দরবারে বসল, অনেক আলোচনার পর ঘোষণা দেয়া হল, আহলে হাদীসের পাঁচটি পরিবারকে সমাজ থেকে খারিজ করা হল, তাদের এক ঘরে করা হল। এই পাঁচটি পরিবারের উপর ধীরে ধীরে অত্যাচারের খড়গ নেমে আসতে থাকে।
এলাকার লোকেরা তাদের সাথে কথা বলে না, লেনদেন করে না, বেচাকিনা করে না। তাদেরকে দেখলেই হাসি মশকরা করে, ‘কাফের যাচ্ছে কাফের যাচ্ছে বলে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। তাদের পিছনে বাচ্চাদের লেলিয়ে দেয় যেভাবে পাগলের পিছনে লেলিয়ে দেয়া হয়। এতে এলাকার দুষ্ট লোকেরা সুযোগ পেয়ে যায়। তারা পরিবারগুলিতে আতরা পাতরা চুরি করতে থাকে। চোরেরা যখন দেখল এলাকার লোকেরা কিছু বলে না বরং আরো উৎসাহ দেয় তখন তারা আরো সাহস পেয়ে গেল। এখন তারা ফল ফসল, হাস মুরগি, কাপড় চোপড় গরু ছাগল ইত্যাদি বড় বড় জিনিস চুরি করা শুরু করল। ওদিকে জামাল প্রতি শুক্রবারে অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে আহলে হাদীসের বিরুদ্ধে ওয়াজ করে যাচ্ছে, ‘আহলে হাদীসরা কাফের। কারণ আমাদের ইমামগণ প্রত্যেকটা ইবাদতের পদ্ধতি কোরান হাদীসের দলীল দ্বারা প্রমাণ করেছেন কিন্তু আহলে হাদীসরা এসব দলীল মানে না। এর অর্থ হল তারা কোরান হাদীস মানে না। এজন্যই এরা কাফের।
আবার এরা মাযহাব ও ইমাম মানে না, নিজেদের খেয়াল খুশি মত ইবাদাত করে অর্থাৎ তারা শয়তানের মাযহাব মানে, শয়তান তাদের ইমাম। এদের ইবাদাত হয় না। কাজেই এরা কাফের। এই কাফেরদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেন না, লেনদেন করবেন না, কথা বলবেন না, এক গ্লাস পানি পর্যন্ত দিবেন না। এদেরকে বয়কট করুন। যে পর্যন্ত না তারা হানাফি মাযহাবে ফিরে আসে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখুন। ওরা গুমরাহ হয়ে গেছে, জাহান্নামের দিকে দৌড়াচ্ছে, ওদেরকে বাচানো আমাদের সকলের উপর ফরয। কেউ তাদের সাথে সম্পর্ক রাখলে আমরা তাকেও এক ঘরে করব, কঠিন শাস্তি দিব। আর সবাই সাবধান থাকবেন, নতুন করে কাউকে যেন গুমরাহ না বানাতে পারে।
জামাল এখনো ছেলে মানুষ, তার লেখা পড়া শেষ হয়নি। সে জানে না, আহলে আদীস, জামাত শিবির, সালাফি, বেরেলভী ইত্যাদি অন্যান্য ফিরকাগুলি কি আসলেই কাফের নাকি অন্য কিছু। তবে তার হুজুরদের কথা বার্তা শুনে এবং নিজের অনুমানে বুঝে যে, ওরা সম্ভবত কাফেরই হবে। তার হুজুরদের কথা বার্তায় সে যতটুকু বুঝতে পেরেছে তাতে সে অনুমান করে নেয় একমাত্র দেওবন্দিরা ছাড়া অন্যান্য ফিরকাগুলি কাফের মুশরিক মোনাফিক ও ফাসেক ফুজ্জার জাতীয় একটা কিছু। এ জন্যই ঐ পাঁচটি পরিবারের জন্য দুঃখে তার বুকটা ফেটে যায়, ‘আহ হা রে, এই লোকগুলি হানাফি থেকে আহলে হাদীস হয়ে গেল, হেদায়েত থেকে গুমরাহ হয়ে গেল। মুসলিম থেকে কাফের হয়ে গেল, জান্নাতি থেকে জাহান্নামী হয়ে গেল। মনের দুঃখে সে বিমর্ষ হয়ে থাকে। সে ভাবে এ লোকগুলিকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাচানো ফরয, ফরযে আইন হয়ে গেছে। এখন তার উপর দ্বীনের একটাই কর্তব্য- এ লোকগুলিকে হানাফি মাযহাবে ফিরিয়ে আনা। সে সর্ব শক্তি নিয়োগ করল। মহল্লার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে বুঝাতে লাগল, আহলে হাদীসকে বয়কট করে, শাস্তি দিয়ে, অত্যাচার করে হলেও হানাফি মাযহাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে মহল্লা বাসীকেও এ পাপের শাস্তি ভোগ করতে হবে, আল্লাহ গজব নাযিল করবেন। এভাবে সে মজলুম পাঁচটি পরিবারের উপর সবাইকে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগল।
পক্ষান্তরে তখন সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ তুলে দেয়া হচ্ছে, সমকামিরা স্বীকৃতি চাচ্ছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ের সমান অংশ নির্ধারন করে কোরান বিরোধি আইন পাশ হচ্ছে, ইসলাম পন্থিদের ধ্বংস করা হচ্ছে, সর্বত্র সেক্যুলার মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে, নারী পুরুষের অবাধ যৌনতার সনদ দেয়া হচ্ছে, আরো অসংখ্য ধর্ম, সমাজ ও মানবতা বিধ্বংসী আইন পাস হচ্ছে কিন্তু জামাল সেদিকে ফিরে তাকানোর অন্তত টু শব্দটি পর্যন্ত করার প্রয়োজন বোধ করে না। কারণ তার হুজুররা এ বিষয়ে কেউ কিছু বলে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যা খুশি তা হউক এতে তাদের মাথা ব্যথার কিছু নেই। তাদের একমাত্র মাথা ব্যথা অন্যান্য ফিরকাগুলিকে কাফের মুশরিক প্রমাণ করা এবং ধ্বংস করা। কাজেই রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কিছু বলতে হবে এমন শিক্ষা সে তার উস্তাদদের থেকে পায়নি। তার লক্ষ শুধু অন্যান্য ফিরকাগুলি, এ জন্যই সে আহলে হাদীসের পেছনে কোমর বেধে লাগল। এভাবেই এক অবুঝ বালক ফের একবার ফেরকাবাজির বিষে আক্রান্ত হয়ে গেল।
সকালে জামাল তার পংখিরাজ সাইকেলটায় চড়ে হেলে দুলে হাওয়া খেতে খেতে মাদরাসায় চলল। রাস্তায় গায়ের কয়েকজন লোক তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে পেছনে দেখাল ‘কয়েকটা লোক আসছে। এরা ছমির মণ্ডলের মেয়ের বিয়ে ঠিক করে আসছে। ঐ যে ছেলেটা দেখা যায় এটাই জামাই। পুলিশে চাকরি করে। লোকগুলি কাছে আসতেই তারা ঘিরে ধরল, আপনারা কোত্থেকে এসেছেন, ওরা তো সবাই কাদিয়ানি হয়ে গেছে। আমরা ওদেরকে এক ঘরে করেছি, আমাদের জমি দিয়ে ওদের আনাগুনা করতে দেইনা। এ বাড়িতে বিয়ে করালে এরোপ্লেন দিয়ে আনাগুনা করতে হবে। আমাদের জমির উপর দিয়ে আশা যাওয়া করতে পারবেন না। আপনারা বাইরের মানুষ কাজেই আপনাদের সাথে দুর্ব্যবহারও করা যায় না, বেশি কিছু বলাও যায় না। শুধু এতটুকু বলি গোটা এলাকার বিরুদ্ধে গিয়ে এ বাড়িতে বিয়ে করাবেন কেমনে।
জামাল শুধু বলল, ‘ওরা তো কাফের। একটা কাফের পরিবারের মেয়ে বিয়ে করানো কি আপনাদের উচিত হবে, নাকি জায়েয হবে? এটুকু বলেই সে চলে গেল। গ্রামবাসীরা আরো কিছুক্ষণ বিষোদগার করার পর ছেলের বাবা গর্জে উঠল, ‘এই চল দুনিয়াতে কি মেয়ের আকাল দেখা দিয়েছে যে, একটা কাদিয়ানি পরিবারে ছেলে বিয়ে করাতে হবে। আমার চাকরিজীবী ছেলের জন্য মেয়ের অভাব নাই’ বলে ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে হন হন করে চলে গেল। বিয়েটা ভেঙ্গে গেল।
মেয়েটা মুক্তাগাছা কলেজে পড়ে, নাম কুলসুম। আগে থেকে তার প্রতি জামালের লোভ ছিল। প্রতিদিন সকালে তারা উভয়েই মাদরাসা ও কলেজে যায়, রাস্তায় প্রতিদিন সাক্ষাত হয়। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরি ছিল। তার কুসুম কমল মুখ খানি জামালকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। ছোট বেলা থেকেই মেয়েটাকে তার ভাল লাগে। তার হৃদয়ে কুলসুমের প্রেম রস সিঞ্চিত হয়ে যায়। সে ভাবে কী করা যায়, বিয়ের প্রস্তাব দিবে কি না কিন্তু পরক্ষনেই চমকে উঠে। এখনো তার লেখা পড়া শেষ হয়নি, আবার ছোট দু’টি বোনের বিয়ে দিয়ে তারপর নিজের চিন্তা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা একটা কাফের পরিবারে বিয়ে করলে তো মহল্লা বাসীরা তাকে জুতা পেটা করে দেশ ছাড়া করবে। তার মন ধ্বসে যায়। অগত্যা মনের আশাটা নিজের বুকের মধ্যেই দাফন করে দিল।
লা মাযহাবি পাঁচটি পরিবারের উপর নেমে আসে অত্যাচারের কৃপান। খোদার সুবিস্তৃত যমিন তাদের জন্য সংকুচিত হয়ে গেল, তাদের পায়ের তলায় মাটি নাই। প্রথমে তারা গ্রামবাসীদের বৈরিতার মুখো মুখি হল। তারপর চুরি ও বিভিন্ন পয়মালের মুখোমুখি হল। তারপর আশংখা করল কখন জানি মহল্লা বাসীরা সবাই মিলে আক্রমণ করে তাদেরকে হত্যা করে বা বাড়ি-ঘর শুদ্ধু তাদেরকে আগুনে পোড়িয়ে মারে। এতকিছু সত্ত্বেও তারা কখনো নিরাশ হয়নি, কিন্তু এবার প্রমাদ গুনল। কুলসুমের বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে, এ এলাকায় থেকে মেয়েদের বিয়ে তো দেয়া যাবেই না, এমনকি তাদের ইজ্জত রক্ষা করাও কঠিন। কারণ মেয়েরা স্কুল কলেজে বা বাইরে গেলেই পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা ঘিরে ধরে, কাপড় ও উড়না ধরে টানাটানি করে, কু প্রস্তাব দেয়, অশ্লিল কথাবার্তা বলে, সময় ও সুযোগ মত সাক্ষাত করবে বলে হুমকি দেয়। কখন জানি কোন মেয়েকে বাজের মত ছো মেরে নিয়ে যায় এ আশংখায় মানুষগুলি দিশেহারা হয়ে গেল।
অগত্যা তারা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে আবদার করল ‘আমরা চরম আশংখা ও উৎকণ্ঠায় আছি। আমাদের মেয়েদের ইজ্জত হুমকির মুখে। কাজেই এ অবস্থায় থাকা আমাদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না, আমরা মাতৃভুমি ছেড়ে চলে যাব। জামালপুরের সরিষা বাড়ি এলাকায় অনেক আহলে হাদীস আছে, আমরা সেখানে আমাদের ভাইদের কাছে চলে যাব। আপনি ন্যায্য মূল্যে আমাদের ধন সম্পদ ও জমি বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করে দিন। তাদের জন্য চেয়ারম্যানের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। তিনি গ্রাম বাসীদের নিয়ে মূল্য নির্ধারন করতে বসলেন। প্রত্যেক জিনিস বাজার মূল্যের এক চতুর্থাংশ মূল্য নির্ধারন করা হল। কিন্তু গ্রামের ক্রেতারা তাও দিল না, সামথিং কিছু দিয়ে লোটের মালের মত সব কিছু জোর পুর্বক নিয়ে গেল। জমি বাড়ির ক্ষেত্রেও তাই হল, নির্ধারিত মূল্য না দিয়ে সামান্য কিছু দিয়ে জোর করে জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়ে নিল। জামালের ক্ষেতের সাথে এক লা মাযহাবির পঞ্চাশ শতাংশ জমি ছিল। সুযোগ পেয়ে সে উপযুক্ত সময়ের আগেই মাছ বিক্রি করে স্বল্প মূল্যে ক্ষেতটা কিনে নিল।
স্বাধীনতার সময় হিন্দু পরিবার গুলিকে যেমন লোটপাটের লক্ষ বানানো হয়েছিল একই ভাবে পাঁচটি পরিবারের উপর চলল পাশবিক তাণ্ডব। ঐ পাঁচটি পরিবার ছিল স্বচ্ছল কৃষক, কারো কারো ভাল মানের ব্যবসাও ছিল। কিন্তু এইভাবে ফিরকাবাজির যাতাকলে পড়ে এ ভাগ্যাহত মানুষগুলি সর্বস্ব হারিয়ে রিক্ত- নিঃস্ব হয়ে প্রিয় মাতৃভুমি ত্যাগ করে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে পশ্চিম দিকে হিজরত করল। কাঁদল আকাশ, কাঁদল প্রকৃতি, কাঁদল না শুধু পাষাণ মানুষের মন, এই হল ফিরকাবাজির পরিনতি। ফিরকাবাজ আলেমরা ইসলামের মুখোশ পরে, ইসলামের খিদমতের নামে ইসলাম উম্মাহ ও মানবতার জন্য বস্তুত এ খেদমতটাই দিয়ে যাচ্ছে। ওদের ক্যাকটাস কাটায় আজ ইসলাম ও উম্মাহ নীলকণ্ঠ।
বিষয়: রাজনীতি
৮৭৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন