কবর-৮৩ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:৩০:৩৭ সকাল
(শেষ কিস্তি)
যামিনীর তৃতীয় যাম অতীত। সে বাচ্চাটাকে একটা নেইম ফ্লেটের কাছে বসাল, মেয়েটা প্যাক কাদার পুতুলের মত মাটিতে ঢলে পড়ল কিন্তু সেদিকে তার লক্ষ নাই, খেয়াল নাই, চেতনা নাই। তার মনের বিশ্বাস তার মেয়ে কোনদিন মরবে না। তারপর দুই হাত দক্ষিণে গেল, পশ্চিমে ফিরল, বসল, বাম হাত ও হাঁটুতে ভর দিয়ে বাম কাতে শুইল, হাসল। তারপর ডাকল, আব্বা আব্বা, আমি আইছি আব্বা। সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল, ‘এই আকাশের নিচে ভূ-পৃষ্ঠের উপরে সবচেয়ে দুঃখী, সবচেয়ে বঞ্চিত, সবচেয়ে মজলুম আপনার সন্তান আমি আইছি আব্বা, আইছি। না না আমি একা আসিনি বাবা, দেখুন দেখুন কে এসেছে, আপনার রক্তের উত্তর ধারক, আপনার বংশের প্রদীপ, এ বাস্তুলোকে আপনার ও আমার অস্তিত্বের সাক্ষী, আমাদের প্রতিনিধি। একদিন সে বিস্মৃতপুরীর এই দুনিয়ায় আমাদের অস্তিত্বের প্রতিনিধিত্ব করবে। সে আমার সন্তান, আপনার পৌত্রী, তাকে সোহাগ দিন বাবা, তাকে আশির্বাদ করুন, দোয়া করুন।
বাবা, আমার অনেক কষ্ট বাবা, অনেক কষ্ট। সর্বাঙ্গে বিষ, নাগ নাগ জ্বালা। এই পৃথিবী বিষে আমার শরীরটা ভরে দিয়েছে। পৃথিবীর যুদ্ধে আমি রণক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষত বিক্ষত মুমূর্ষু। একজন সৈনিক তো শুধু যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করে কিন্তু বাবা, আমাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে ঘরে-বাইরে, মাঠে-ঘাটে, হাটে-গঞ্জে, শিক্ষালয়ে এবং ধর্মালয়ে। আর আমি সাধারণ সৈনিক ছিলাম না, আমি ছিলাম সেনাপতি। সেনাপতি ছিলাম আমি আপনার পরিবারের এবং ন্যায়, সত্য, ইনসাফ, ধর্ম, শিক্ষা ও মানবতার। এই নীতি আদর্শ নিয়ে পৃথিবীর হিংস্র পশু শক্তির সাথে আমাকে নিরন্তর যুদ্ধ করতে হয়েছে। অনুক্ষণ যুদ্ধে আমি বিকল হয়ে গেছি, আমার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। পৃথিবীকে দেয়ার উপযোগিতা আমার খতম হয়ে গেছে, আমি আর এ পৃথিবীর যোগ্য নয়। এ জন্যই পৃথিবীর সাথে আমার বন্ধন টুটে গেছে। এখন আমাকে অবলম্বন করার, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার মত আর কেউ নেই।
বাবা এই ক্ষিতির বুকে মানুষের তিনটি বন্ধন থাকে। যেমন সাধারণ মানুষের সাথে সাধারণ বন্ধন। এ ক্ষেত্রে মওকা পেলেই আমি সাধারণ মানুষের কল্যাণ করার চেষ্টা করেছি। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বার্থান্বেষি পশু শক্তি মওকা পেলেই আমার অপকার করেছে, অপমানিত করেছে, লাঞ্চিত করেছে। আবার কোন ব্যক্তির প্রধান সম্পর্ক থাকে তার উৎস- তার বাবার পরিবারের সাথে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আজ আমি বলব, বলব সব কথা, আমাকে বলতেই হবে, আর লুকিয়ে রাখার সময় নাই। যে কথায় মহাসমুদ্র পচে যায়, মহাকাশ ভেঙ্গে পড়ে, সকল সত্য ও কৃতজ্ঞতা মাথা ঠুকে মরে। আপনার পর আপনার শিশু সন্তানগুলি ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। আমার কৈশোরের দু’টি বাহু দিয়ে তাদেরকে ঝাপটে ধরে বুকে আগলে রেখেছিলাম, নিজে না খেয়ে না পরে তাদেরকে খাইয়েছি পরিয়েছি, নিজে কষ্ট করেছি, নিজের জীবন বিপন্ন করে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছি, কোন দিন কষ্ট করতে দেইনি, পৃথিবীর বিষাক্ত বাতাস গায়ে লাগতে দিইনি। আমার প্রতিটা রক্ত ও ঘর্ম বিন্দুর বিনিময়ে তাদেরকে শিক্ষা ও সম্পদে মজবুত একটা ভিতের উপর দাড় করাতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আমার প্রদত্ত সেই শক্ত ভিতের উপর নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই তারা আমাকে প্রতিদান দিল এই বলে যে, আমি তাদের জন্য কিছুই করিনি, তাদের পিছনে আমার এক পয়সারও অবদান নেই, তারা আমাকে প্রত্যাখ্যান করল। কিন্তু আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত কথা হল বাবা, আমার জন্মদাত্রী মাও তার ছেলেদের পাল্লায় উঠে তাদের সুরে সুর মিলালেন, আমাকে কষ্ট দিলেন, সৎ মায়ের মত আচরণ করলেন। কাজেই বাবা, জননী যদি সৎ মায়ের মত আচরণ করেন তাহলে সেই সন্তানের বেঁচে থাকার কোন দরকার নেই, কোন অধিকার নেই, তার চলে যাওয়াই ভাল। আমার কৈশোর যৌবনের প্রতিটা অশ্রু বিন্দু, প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস, প্রতিটা আহ এবং প্রতিটা রক্ত ও ঘর্ম বিন্দুর বিনিময়ে যে সংসার আমি গড়ে তুলেছি সেখানে আমার কোন স্বীকৃতি নেই, কৃতজ্ঞতা নেই, অধিকার নেই। এটাই এই নরকপুরীর নিয়ম বাবা, এটাই এখানে প্রথা। সিরাজুদ্দৌলাকে মুহাম্মদ আলী বেগ হত্যা করেছিল- যাকে আলিবর্দি খান রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে প্রাসাদে লালন- পালন করেছিল। কাজেই বাবা, এই নরকপুরীতে আমার আর থাকা চলে না।
আবার কোন ব্যক্তির বেঁচে থাকার অবলম্বন হল তার স্ত্রী, কারণ স্ত্রী হল অর্ধেক দেহ- অর্ধাঙ্গিনি। কিন্তু বাবা, আমার সেই অর্ধেকটা দেহ ছিড়ে ফেড়ে কেটে চলে গেছে, চলে গেছে সে আমাকে ছেড়ে একটা হিন্দুর ঘরে। একজন মানুষ কততম স্তরের বদবখত হলে তার স্ত্রী ধার্মিক পরিবারের মেয়ে হয়েও কোন হিন্দুর ঘরে যেতে লালায়িত হতে পারে। অথচ আমাকে ছেড়ে যাওয়ার মত পার্থিব অপার্থিব কোন অজুহাত ছিল না। কারণ আমি ইউসুফ নবীর মত সুদর্শন না হলেও সক্রেটিসের মত কুৎসিত কদাকার ছিলাম না। আমি সক্রেটিসের মত বিদ্যাসাগর না হলেও আবু জেহেলের মত মূর্খ নাদান ছিলাম না। আমি রাজা সলোমানের মত ধনবান না হলেও বাহলুলের মত কবরস্থানের অধিবাসী ছিলাম না। (আরব্য রুপকথার নায়ক বাহলুল এমনই নিঃস্ব ছিল যে সে গোরস্থানে থাকত) এতদসত্ত্বেও বাবা আমার স্ত্রী আমাকে ও আমার সন্তানকে ফেলে চলে গেছে, সে আমাদেরকে ঘৃণা করে, আর ভালবাসে একজন হিন্দুকে, তাকে ভালবেসে বিয়ে করেছে। সে প্রমাণ করেছে, ধার্মিক পরিবারের একটা হতদরিদ্র অশিক্ষিত মুসলিম মেয়ের জন্য আমি স্বামী হওয়ার যোগ্য নয়, একজন হিন্দু তার যোগ্য। কাজেই বাবা, আমি আর মানুষ থাকলাম কোথায়, আমি কুকুর, আমি পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ। কিন্তু প্রশ্ন হল, আপনি মানুষ হয়ে আমার মত কুকুর কিভাবে জন্মালেন, কেন জন্মালেন? আমি দুপেয়ে হিসাবে জন্ম নিয়ে কেন চার পেয়ে কুকুর হয়ে গেলাম, কারা আমাকে কুকুর বানাল, কে দেবে এর জবাব বাবা, কে দেবে? দুনিয়ার সবচেয়ে বদনসীব সন্তানটি বাবার কবরের মাটিতে মাথা ঠুকতে থাকে আর আর্তনাদ করতে থাকে, ‘বাবা এই হল আমার সাথে পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ আর আমার স্ত্রীর সম্পর্ক, এই হল প্রাপ্তি। সকল সম্পর্ক টুটে গেছে বাবা, সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন একমাত্র আপনি ছাড়া আমার আর কোন বন্ধন নাই, আশ্রয় নাই, ঠাই নাই। আমাকে আপনার সাথেই থাকতে হবে। আমি আর কোথাও যাব না বাবা, আপনার সাথেই থাকব।
এটা বালিয়া মাদরাসার গোরস্থান, মাদরাসার ছাত্র- শিক্ষকগণ এপারের ন্যায় ওপারেও এখানে একসাথে থাকেন। দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যাহত এক সন্তান বাবার কবরের উপর শুয়ে শুয়ে ভাবে, ‘এ পৃথিবীতে বাবা ছাড়া মানব সন্তানের আর কী আছে, কী সম্বল আছে। মা তো নিজের জীবন বিপন্ন করে সন্তান জন্মায়, তারপর বিন্দু বিন্দু করে নিজের রক্ত- কলিজা খাইয়ে খাইয়ে একটু বড় করে। যখন সন্তান হাঁটতে শিখে তখন পিঠ চাপড়ে বলে, অলি ললীরে কাউ বাদুরের ছাও, পাইল্যা লাইল্যা ডাঙ্গর করলাম ফড়িং ধইর্যা খাও---। ব্যস একটু বড় হলেই মা আর খাওয়াবে না, পৃথিবীর মাঠে গিয়ে ফড়িং ধরে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। কিন্তু শিশুটি তো হাঁটতে পারে না, পৃথিবীর পিচ্ছিল ও কন্টকাকীর্ণ পথে তার নড়বড়ে পা কাঁপে, কাত হয়ে পড়ে যায়। দুনিয়ার সকল বৈরি শক্তি এই দুর্বল যোদ্ধাকে ধ্বংস করার জন্য ধেয়ে আসে। আর তখনই একটা দানব এসে শিশুটির পাশে দাঁড়ায়। শিশুটির পা শক্ত করে ধরে ইস্পাতের গাথুনির মত মাটিতে দৃঢ়ভাবে গেথে দেয়। শিশুটি চলার পথের কণ্ঠক কাঁটা, ধুলি বালি, পিচ্ছিল পদার্থ দু’হাতে সরিয়ে ফুল বিছিয়ে দেয়, কুসুমাস্তির্ণ করে দেয়। শিশুটি কোন গর্তে বা খাদে পা দিতে চাইলে পা- টা টেনে নিয়ে সমতলে বসিয়ে দেয়। শিশুটির প্রতি পদক্ষেপে তার পায়ের নিচে নিজের হাত পেতে দেয়, হাত রক্তাক্ত হয়। সে ফড়িং মনে করে বিচ্ছুর লেজে হাত দিতে চাইলে দৈত্যটা সেই হাত টেনে নিয়ে ফুলের উপর বসিয়ে দেয়। কে এই দানব? এই দানবটার নাম বাবা, বাবা, বাবা। আল্লাহ প্রদত্ত মানব সন্তানের জন্য একমাত্র সম্পদ, একমাত্র আশ্রয়।
না না, সে আসলে দৈত্য নয়। সে তো ক্ষীণ দুর্বল শক্তিহীন এক অসহায় মানব, সাধারণ বাতাসের ধাক্কায় সে উল্টে পড়ে যায়। কিন্তু এই শিশুটির স্বার্থ ও রক্ষনা বেক্ষনের ক্ষেত্রে সে দৈত্য। পৃথিবীর প্রতিকুল পরিবেশ, বান-বন্যা, ঝড়-ঝঞ্জা, মানব-দানব ও হিংস্র স্বাপদের আক্রমণ ঐ বাবা নামক দৈত্যটার জন্য শিশুটির কোনই ক্ষতি করতে পারে না। আসুক, ঈশান কোনের কাল বৈশাখী, গর্জনশীল মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা, দিগন্তের অগ্নি ঝড়, দুনীয়ার যত রাক্ষস- খোক্ষস বাঘ সিংহ ধেয়ে আসুক কিন্তু কিছুই করতে পারবে না। বাবা নামক ঐ দৈত্যটাকে ধুলিস্মাতৎ না করা পর্যন্ত শিশুটির কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। এ জন্যই বাবাকে বলা হয় প্রত্যেক শিশুর গৃহপালিত দৈত্য- যে কোন পারিশ্রমিক ও প্রত্যাশা ব্যতীত আলাদীনের দৈত্যের মত শিশুটির সকল ইচ্ছা- আকাঙ্খা পূরণ করে দেয়। তারপর সন্তান যখন বড় হয়ে যায় তখন এই মূর্খরা মনে করে বাবার সাহায্য ছাড়া সে একাই পৃথিবীর মাঠ-ঘাট দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু যখনই সে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোন অপরাধ করে বসে তখনই বুঝা যায় বাবা নামক দৈত্যের পরিচয়। সে ঝড়ের বেগে ধেয়ে এসে সন্তানকে আগলে দাঁড়ায়। তারপর দেখা যায় সন্তান নিরাপদ কুঠরিতে বসে বসে মউজ করছে আর সেই দৈত্যটা মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ধর্ণা দিচ্ছে ও বস্তার বস্তা টাকা ঢালছে। সন্তান যখন বয়স্ক হয়ে যায়, তখন বিছানায় পড়ে থাকা প্যারালাইজডাক্রান্ত বাবা মা যদি শুনতে পায় তার সন্তান বিপদে পড়েছে- তখন তাদের অচল দু’টি হাত উঠে যায় উর্ধ্বে, চোখের কোন বেয়ে অশ্রুর ধারা ছুটে, খোদার আরশ কাঁপিয়ে তোলে।
স্বার্থ হানাহানির এই পৃথিবীতে যেখানে স্বার্থ ব্যতীত কেউ একটা নিঃশ্বাস ফেলে না- সেখানে স্রষ্টা বাৎসল্য নামক একটা বায়বীয় পদার্থের জটাজালে আবদ্ধ করে বাবা মা নামক দু’টি প্রাণীকে একেবারে নিঃশেষ করে দিয়েছেন। সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে মূর্খ বাবা মা নামক দু’টি প্রাণী নিঃস্বার্থ ভাবে প্রত্যাশা ব্যতীত নিজের জীবন, সবটুকু জীবনী শক্তি, প্রতিটা রক্তের ফোটা ও ঘর্ম বিন্দু সন্তানের স্বার্থে বিলিয়ে দিয়ে তিলে তিলে নিজেকে উজার করে দেয়, পলে পলে নিঃশেষ হতে থাকে। তারপর একদিন সর্বশান্ত হয়ে রিক্ত হস্তে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করে। এরা সন্তানের জন্য নিজেকে কষ্ট দেয়, ভুখা থাকে, নাঙ্গা থাকে, নিজের শিক্ষা আদর্শ নৈতিকতা ও ধর্ম জলাঞ্জলি দেয়, এমনকি ইহকাল ও পরকাল নষ্ট করে। একজন রিকশাওয়ালা ক্ষুধার জ্বালা কষ্ট করে কিছু খাওয়ার জন্য হোটেলে ঢোকে। দু’টি ডাল পুরি খেতে তার খুব মন চায় কিন্তু তার বাচ্চাটার কথা স্বরণ হতেই সে এক গ্লাস পানি খেয়ে বেরিয়ে আসে। কারণ সে খেলে চাল ডাল কিনার পর বাচ্চার জন্য কিছু নিতে পারবে না। ক্ষুধার আগুন পেটে জ্বলতে থাকে, ক্ষুধায় পেটে পিঠে লেগে যাওয়া উদর গামছা দিয়ে বেঁধে রাখে, সারাদিন কষ্ট করে। সন্ধ্যায় বাচ্চার পসন্দ জনক জিনিসটা নিয়ে যখন হাতে দেয় তখন তার সন্তানের মুখের হাসিটা তাকে সারাদিনের ক্ষুধা কষ্ট ও গ্লানি ভুলিয়ে দেয়।
একজন অফিসার ক্ষমতার চেয়ারে বসে আছে। তার নীতি আদর্শ খুব দৃঢ়, কোন দিন কোন অন্যায় করেনি কিন্তু এখন বসে বসে ভাবছে ছেলেদের জন্য একটা করে বাসা করা হল, এখন মেয়েটার জন্য একটা বাসা না করলে তো মরেও শান্তি পাবে না। তারপর সে টেবিলের নিচে হাত পাতা শুরু করে, সেই সাথে নিজের শিক্ষা আদর্শ নীতি নৈতিকতা ও ধর্ম জলাঞ্জলি দেয়, ইহকাল নষ্ট করে আর পরকাল ধ্বংস করে। এইভাবে স্রষ্টা বাৎসল্য নামক একটা তরল পদার্থ মানব হৃদয়ে সিঞ্চন করে মানুষকে একেবারে মূর্খ অপরিনামদর্শী একটা প্রাণীতে পরিণত করে দিয়েছেন। কাজেই যেসব সন্তান পিতা মাতার অবাধ্যতা করে, গায়ে হাত তুলে এরা পশু। আর এ জাতীয় পশুর মৃত্যুদণ্ড যৌক্তিক। কারণ এই পৃথিবীতে বাবা নামক বৃক্ষটি ছাড়া আর কোন নিরাপদ আশ্রয় নাই। বিশেষত মেয়েদের জন্য তো বাবার বক্ষ ছাড়া পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন আশ্রয়ই নাই। আরে স্বামী তো হল শুধুই বেনিফেসিয়ারি এক ভয়ঙ্কর স্বার্থবাদির নাম। এরপরেও যেসব মেয়েরা বাবা মায়ের মুখে চুন- কালি দেয়, তাদের সাথে গাদ্দারি করে নাগরের হাত ধরে চলে যায়- তারা মৃত্যুদণ্ডের হকদার। সন্তানের জন্য বাবার বক্ষ এই মহাবিশ্বের চেয়েও আরো অধিক প্রশস্ত। মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে অনেক উন্নতি করেছে, চাঁদে মঙ্গলে উড়ে যাচ্ছে, পৃথিবী ও আকাশের সীমানা অতিক্রম করে যাচ্ছে। তারা চোখের পলকে লক্ষ কোটি আলোক বর্ষ অতিক্রম করে যাছে কিন্তু আজ পর্যন্ত আধা ফুট ব্যাস অতিক্রম করতে পারছে না। সৃষ্টির সূচনা থেকে এমন কোথাও শুনা যায়নি যে, কোন সন্তান বাবা মায়ের আধা ফুট ব্যাসের বক্ষস্তিত বাৎসল্য অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হয়েছে।
কাজেই সন্তানের জন্য এই মর্তের বুকে আল্লাহ্র নিয়ামত বলতে বুঝায় একমাত্র বাবা মা। আর আশ্রয় এবং অবলম্বন বলতে বুঝায় একমাত্র বাবা। যেসব শিশুদের বাবা মারা যায় তারা ভুল করে, বাবার সাথে চলে যায় না। ফলে তাদেরকে পৃথিবীর লাঞ্চনা, মানুষের বঞ্চনা আর ইয়াতিমত্বের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এ জন্যই সে বাবার কবরে দু’মুঠো মাটি দিয়েই কবরে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল কিন্তু শঙ্ক মামারা তো তা হতে দেয়নি। কাজেই বিশটি বছর তাকে সেই ভুলের কাফফারা আদায় করতে হয়েছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে সেই ভুল শুধরে নেয়ার।
হাসান ভাঙ্গা ডান হাত নাড়াতে পারে না, বাম হাতটা বাবার কবরের উপর বুলাতে বুলাতে ডাকল, ‘আব্বা আব্বা গো, আপনি চলে আসার পর এই নরক পুরীতে আমি একটি দিনের জন্যও শান্তি পাইনি, একটিবার স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে পারিনি। বাবা, হাসি কান্নার এই দুনিয়ায় যাদের সুখের পরিমাণ বেশি দুঃখের পরিমাণ কম তাদের জন্ম স্বার্থক। আবার যাদের দুঃখের পরিমাণ বেশি সুখের পরিমাণ কম তাদের জন্ম ব্যর্থ। কিন্তু যাদের সারা জীবন ভর আছে শুধু দুঃখের কালিমা, সুখের আলো নাই তাদের জন্মটা হল কুকুরের জন্ম। বাবা আমি এই পৃথিবীর কুকুর। এখানে আমি দুঃখ ব্যাথা লাঞ্চনা গঞ্চনা ছাড়া কিছুই পাইনি। আব্বা গো, দেখেন আমার ডান পার্শ্বটা অকেজো হয়ে গেছে, হাতটা ভেঙ্গে গেছে, পা ভেঙ্গে গেছে, আমি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেছি। পৃথিবী আমাকে অচল মুদ্রা বলে ঘোষণা দিয়েছে। পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ আর আমাকে চায় না, আমাকে আর কারো প্রয়োজন নাই। কাজেই আপনি ছাড়া আমার আর কোন আশ্রয় নাই, কোন অবলম্বন নাই, বাবা আমি আপনার সাথে থাকব, আপনার বুকে আমাকে ঠাই দেন।
তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বাবার চেহারা, কান্তিময় এক পুরুষ, যুল ওক্বার, জ্যোতির্ময় চেহারা। তার কোলে কাঁধে চড়ছে একটি শিশু, আঙ্গুল ধরে হেঁটে যাচ্ছে। তার অতীতের মধুময় স্মৃতিগুলি চোখের সামনে ভাসতে থাকে। সে বাবার আঙ্গুল ধরে হেঁটে হেঁটে মাঝে মধ্যে বাজারে যেত। সে ছিল মিষ্টি পাগল। তখন বাজারে কোন মিষ্টির দোকান ছিল না। একজন হিন্দু লোক বিকালে মিষ্টি নিয়ে এসে বাইরে বসে বিক্রি করত। তার বাবা গিয়ে দোকানদারকে বলত ‘যা খেতে পারে দেন’ বলে তিনি অন্য কাজে চলে যেতেন। কিছুক্ষণ পর এসে তাকে নিয়ে যেতেন আর ততক্ষণে তার ভর পেট মিষ্টি খাওয়া হয়ে যেত। একবার তার দীর্ঘ একমাস মেয়াদি জ্বর হয়েছিল। তখন তার বাবা মাদরাসা ছুটি নিয়ে সারাক্ষণ তার শিয়রের ধারে বসে থাকত, কাঁদত আর ডাক্তার কবিরাজ আনত।
সময়টা ছিল আমন ধান কাটার সিজন, সবাই কর্মব্যস্ত। তখন তার পায়ে একটা কঞ্চি ঢুকে ভেতরে চলে গেল। সে সময় এসবের ডাক্তার ছিল না কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করানো হত। আর কবিরাজের বাড়ি ছিল দেড় মেইল দূরে, বৃদ্ধ কবিরাজ কারো বাড়ি যেত না রোগীরাই তার বাড়িতে যেত। দুর্গম রাস্তা, রিকশা সাইকেল চলে না, আল বাতর দিয়ে যেতে হয়। তাদের বছুরে কামলাটা চলে গেছে কয়েক মাইল দুরের জমিতে ফসল তোলার জন্য। সবাই কাজের ঝামেলায় ব্যস্ত থাকায় অন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অগত্যা বাবাই তাকে কোলে কাঁধে নিয়ে গেল এবং নিয়ে আসল।
তাদের বছুরে কামলা আইজ্যা মামা বাড়ির অগ্নি কোণে একটা কলা গাছ লাগিয়েছিল। এ গাছটা জীর্ণ শীর্ণ হয়ে ছোট্ট একটা ছড়ি দিয়ে শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তার বুগি থেকে বিস্তৃত ঝারের অন্যান্য কলাগাছগুলি অনেক মোটা ও উঁচু হয়েছিল এবং কোমর সমান উঁচু উঁচু ছড়ি দিত। একদিন তার বাবা ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে হাসছেন, তখন হাসানের মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাসছেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘দেখ, প্রথম গাছটা ছিল ভিত্তি, সে কোন রকম তার বংশ বিস্তার করে ক্ষীণ দুর্বল দেহে চলে গেল। আর তার বংশধররা এখন কেমন হৃষ্ট পুষ্ট ও বলিষ্ঠ হয়ে গড়ে উঠেছে। তেমনি আমিও হলাম আমার পরিবারের ভিত্তি, হয়ত আমি সুযোগ পাব না চলে যাব, তুমি আমার ছেলেদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দীক্ষা দিও। একদিন দেখতে পারবে তারা আমার চেয়ে বলিষ্ঠরুপে গড়ে উঠবে, আমার মুখ উজ্বল করবে, বংশের সুনাম বয়ে আনবে’। তিনি তার বড় ছেলেকে নিয়ে অনেক উচ্চাশা পোষণ করতেন, স্বপ্ন দেখতেন। একদিন হাসান অনেক বড় শিক্ষিত হবে, দেশ জাতি ধর্মের সেবা করবে, মানবতার কল্যাণ করবে, বংশের শ্রী বৃদ্ধি করবে, বাবার নাম করবে, ইহলোকে পরলোকে বাবার মুখ উজ্বল করবে। এ জন্যই তিনি সর্বদা বলে বেড়াতেন, ‘সাধারণত বড় ছেলেরাই মানুষ হয়, বড় হয়, বংশের মান বৃদ্ধি করে’। আসলে বড় ছেলে মেজো ছেলে ছোট ছেলে কথা নয়, যে কোন একজন খ্যাতিমান হয়ে যায়। কিন্তু তার প্রতি যেহেতু ছিল তার বাবার অফুরন্ত আশা ভরসা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা, এজন্যই তিনি বারবার বড় ছেলের আলোচনা করতেন। বস্তুত হুব্বুশ শাইয়্যি আকসারা যিকরাহু- কোন জিনিসের মুহব্বত তার আলোচনা বাড়িয়ে দেয়।
হাসান বাবার কবরে শুয়ে শুয়ে কখনো বাবার স্মৃতি মন্থন করে কখনো মায়ের স্মৃতি স্বরণ করে। মায়ের কথা মনে পড়ল, তার বাবার মৃত্যুর পর সে বাইরে গিয়ে ফিরতে রাত হলে মা বাতি জ্বালিয়ে দেউড়ির পাশে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন। সে রাগ করলে মা মুখে তুলে তুলে খাওয়াতেন। সে অসুস্থ হলে মাও অসুস্থ হয়ে যেতেন। সে ভার্সিটি থেকে বা বাইরে থেকে কিছুদিন পর বাড়িতে ফিরার সময় মা আগেই বলে দিতেন আজ হাসান বাড়িতে আসতেছে, আমার শরীর ভাল লাগছে। এভাবে সে শুয়ে শুয়ে মা বাবার স্মৃতি মন্থন করতে থাকে।
অনেকক্ষণ ধরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এবার শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। আকাশটা যেন একটা নেট, তার উপর দিয়ে সৃষ্টির তামাম জলরাশি গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে আর ঢেলে ঢেলে পৃথিবী পৃষ্ঠে পড়ছে। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে হাসান নিথর হয়ে বাবার কবরে শুয়ে আছে। ধীরে ধীরে তার দেহ সাপের শরীরের মত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। শুরু হল কাশি, প্রচন্ড কাশি, পাগলের মত কাশি, শেষ কাশি, অন্তিম কাশি। মুখ ভরে ভরে রক্ত আসছে, রক্ত বমি হচ্ছে, গ্লাসের গাস, জগের জগ রক্ত আসছে। সে বাম হাতের অঞ্জলিতে রক্ত নিচ্ছে, বাবার কবরের উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে আর হাসছে, ‘আব্বা আব্বা, এই যে আপনার রক্ত, আপনার দেহ থেকে এই রক্ত আমার দেহে এসেছে। এখন আর এই রক্তের আমার প্রয়োজন নাই, কাজেই আপনার জিনিস আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম। পৃথিবীতে থাকলে রক্ত চোষা মাটির জন্য এই রক্ত প্রয়োজন হয় কিন্তু আমি তো আর এখানে থাকছি না। কাজেই আপনার জিনিস আপনাকে দিয়ে দিলাম, আপনার রক্তের ঋন পরিশোধ করলাম। এই দেহটাও আপনার, শীঘ্রই এই দেহটাও ফিরিয়ে দিব বাবা, শীঘ্রই ফিরিয়ে দিব’ বলতে বলতে সে কাশছে, গলগল করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে, বাবার কবরের উপর রক্তের আস্তর পড়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে মিশে সেই রক্ত গোটা গোরস্থানে ছড়িয়ে পড়েছে, লোহিত সাগরে পরিণত হয়ে গেছে। কাশতে কাশতে অবশেষে সে চেতনা হারাল।
বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে, আকাশের কিনারে কিনারে দুয়েকটা নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে মিটমিট করছে। পৃথিবীর মুস্তাকবির- সুবিধাবাদি শ্রেণী এটাকে ব্যাখ্যা করেছে তারকারা হাসে কিন্তু এই মূর্খরা জানে না যে, লোটেরা দানব শ্রেণীর শোষণ শাসন ত্রাসনের এই বিষাক্ত পুরি দেখে তারকারা কখনো হাসে না। বরং নিঃস্ব অসহায় মজলুমের আহ আর্তনাদের কাল ধোঁয়া তারায় লেগে নক্ষত্রপুঞ্জ কাঁপে, চোখ মিটমিট করে কাঁদে, এ কান্নাই বৃষ্টি হয়ে ভূপৃষ্ঠে ঝড়ে পড়ে। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে ভাগ্যাহত যুবকটি পড়ে আছে তার বাবার কবরের উপর, তা দেখে তারকাপুঞ্জ কাঁদে, প্রকৃতি নিথর নির্বাক নিঃস্পন্দ। শোকে রাতের আধার বরফের মত জমাট বেঁধে গেছে। কিছুক্ষণ পর তার চেতনা ফিরল কিন্তু চেতনা বলতে মানবানুভূতির সর্ব নিম্ন চেতনা। অভ্যাস অনুযায়ী সে মেয়েকে কোলে নিতে চাইল। সে উঠতে চাইল, পারল না। হাত বাড়াতে চাইল, পারল না। গড়িয়ে যেতে চাইল- পারল না, তার দেহ অবশ হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল, পৃথিবীর পথে তার যাত্রার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের সাথে তার লেনদেন ও সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।
সে বিষণ্ণ হাসি হাসল, ‘সালাম পৃথিবী সালাম, সালাম পৃথিবীর বাসিন্দারা সালাম। আমায় মাফ কর পৃথিবীর মানুষ, আমায় ক্ষমা কর। তোমাদের সাথে আমার জীবনের লেনদেন সমাপ্ত হল। আমি তো চলে যাচ্ছি, আর কেউ তোমাদের বিরক্ত করতে আসবে না। আমার অতৃপ্ত হৃদয়ের হাহাকার নিয়ে, ব্যর্থ জীবনের গ্লানি নিয়ে, বঞ্চনার কালিমা নিয়ে তোমাদের এই সুখের পুরী থেকে আমি বিদায় নিচ্ছি বন্ধু, আর দেখা হবে না, আর কোন কুকুর তোমাদের দোয়ারে দোয়ারে ঘুরবে না। তোমাদের একটু শান্তনার জন্য আর কেউ তোমাদের দোয়ারে করাঘাত করবে না, একটু সহানুভূতির জন্য আর কেউ তোমাদের মুল্যবান সময় নষ্ট করবে না, একটু মমতার পরশ পেতে আর কেউ তোমাদের বিরক্ত করবে না। সত্য ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলে আর কেউ তোমাদের বিরক্তির উদ্রেক করবে না। বিদায় পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ, বিদায়।
পৃথিবীর বাসিন্দারা, কোন দিন যদি আমাকে তোমাদের স্বরণ হয়, যদি মনে হয় তোমাদের মাঝে একটা অবাঞ্চিত কুকুর থাকত, তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। পৃথিবীর লাঞ্চনা, মানুষের বঞ্চনা আর ব্যর্থ হৃদয়ের গ্লানি নিয়ে সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। তার অতৃপ্ত আত্মার বাসনাগুলি আজো আকাশে বাতাসে হাহাকার করে ফিরছে। তখন যদি তোমাদের দুঃখ হয়, মায়া হয়, অনুশোচনা হয়, প্রায়শ্চিত্য করতে মন চায়, তাহলে আমাকে খুঁজো। আমি থাকব তোমাদের আশপাশেই। ঐ যে রাস্তার পাশে দিগম্বর একটি শিশু হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটি আমি। তার হাতে দু’টি পয়সা তুলে দিও। ঐ যে পর্ণ কুটিরে এক বিধবা ক্ষুধার জ্বালায় সন্তানদের বুকে চেপে ধরে উর্ধ্বে তাকিয়ে মাতম করছে, তার চোখ দিয়ে ঝর্নার ধারা ছুটছে, সেটি আমি। তার মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিও। ঐ যে ডাস্টবিনে বর্জ্য খাচ্ছে আদম সন্তান, সেটি আমি। তার জন্য দু’মুঠো অন্ন সংস্থান করে দিও। ঐ যে ফুটপাতে কুকুরের সাথে গলাগলি করে ঘুমিয়ে আছে যে দু’পেয়ে কুকুর, সেটি আমি। তাকে একটু মাথা গুজার ঠাই করে দিও। ঐ যে বুক ফাটা আর্তনাদ করছে যে মজলুম- সেটি আমি। তার প্রতি ইনসাফ করো, সুবিচার দিও। ঐ যে দুঃখি বঞ্চিত মজলুম মানুষ- তাদের ললাটে তোমার মমতার হাতটি বিলিয়ে দিও। এই অসহায় নিঃস্ব মজলুমদের মাঝে আমি থাকব। তোমাদের পাপানুভূতি জাগ্রত হলে এদের মাঝে এসে প্রায়শ্চিত্য করো। এদের মাঝেই আল্লাহ ঈশ্বর ভগমান বসবাস করেন। স্রষ্টাকে খুঁজতে কখনই মসজিদ মন্দির গীর্জা প্যাগোডায় যেয়ো না, সেখানে স্রষ্টা থাকেন না- থাকে তার গোলামেরা, তারা সেখানে স্রষ্টার সামনে হাজিরা দেয়, স্বীয় দাসত্বের স্বীকৃতি দেয়। স্রষ্টাকে খুঁজো বিপন্ন ও মজলুম মানবতার মাঝে। পৃথিবী বাসির উপর রহম করো, তাহলে আকাশ বাসি তোমাদের উপর রহম করবেন। মৃত্যুর সময় পাপানুভূতি তোমাদের ক্লিষ্ট করবে না, আল্লাহ্র আদালতে দাঁড়াতে হবে না। বিপন্ন মানুষের মাঝে আল্লাহকে খুঁজো যেভাবে আমার বাবা খুঁজতেন।
সহসা তার বাবার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল তার বাবা কিভাবে অভাবি ও দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সেবা করতেন, খাওয়াতেন। বাবার সাথে তার বাল্য স্মৃতিগুলি চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সে হাসল, কারণ এখন সে তার বাবার কাছে যাবে, তার কোলে শুয়ে ঘুমাবে। আর কোন দুঃখ থাকবে না। তার মমতাময়ি মায়ের কথা মনে পড়ল, সে কাঁদল। তিনি সারা জীবন কোন ভাল তরকারি খাননি, বড় ছেলের পাতে ঢেলে দিতেন। নিজের অংশের ভাল তরকারিটা তুলে রাখতেন আরেক বার বড় ছেলের পাতে দিতেন। এই ছেলে ছিল তার একমাত্র সম্বল। এজন্য হাসান বাইরে থাকলে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতেন। ছেলের কোন দুঃখ কষ্ট বা অসুখ বিসুখ হলে ছেলের চেয়ে তিনিই বেশি কাতর হয়ে উঠতেন। মনে পড়ল মা তাকে নিয়ে হজ্ব করতে চেয়েছিলেন। সে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল, ‘মা মাগো, আমি তো চলে যাচ্ছি, এ জনমে আর দেখা হবে না মা, আর মা ডাকার সুযোগ পেলাম না। আপনার এক ফোটা দুধের ঋনও সুধ করতে পারলাম না মা, আপনার এ অভাগা সন্তানকে মাফ করুন মা, মাফ করুন। আপনার উপর আমার কোন দাবী নাই, থাকতে পারে না। আল্লাহ অবশ্যি আপনাকে মাফ করবেন, কারণ আপনি নিষ্পাপ, মাসুম, পুত পবিত্র। দুঃখ করবেন না মা, আপনার হাতের বড় লাঠিটা ভেঙ্গে গেলেও তো আপনার আরো পাঁচটি লাঠি (ছেলে) আছে। তাদের কাঁধে ভর করে চলতে পারবেন, আপনার কষ্ট হবে না। আপনাকে নিয়ে হজ্ব করার ভাগ্য তো আমার হল না, আপনার অন্য ছেলেদেরকে নিয়ে গিয়ে হজ্বটা করে আসবেন। সর্বশেষ মিনতি, আপনার দুধের জাতককে মাফ করবেন। কারণ আপনার ইচ্ছার উপর তার পরকাল নির্ভরশীল। অনেক কষ্ট নিয়ে বিদায় নিচ্ছি মা, এ বুকটায় অনেক ব্যথা, অনেক যন্ত্রনা, অনেক গ্লানি। সবচেয়ে বড় কষ্ট একটাই, বিদায় বেলায় আপনার মুখটা একটু দেখতে পারছি না মা, আমার পোড়া কপালটায় আপনার হাতে একটু আদরের পরশ পেলাম না মা, মাগো আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমি আর সইতে পারছি না মা। আমার মত বদনসিব সন্তান যেন পৃথিবীর কোন মা না জন্মায়- যার মৃত্যুর সময়ও আপনজনের একটু সোহাগ পাওয়ার ভাগ্য জোটে না। দুঃখ করবেন না মা, জানি, ‘কাঁদবেন না, দুঃখ করবেন না’ এসব কথা আপনাকে বলে লাভ নেই, কারণ আপনার কাজ আপনি করবেন। কিন্তু আসল কথাটা হল আপনাকে বেশি সময় দুঃখ করতে হবে না, খুব শীঘ্রই আপনিও আমাদের সাথে এসে মিলিত হবেন, আমি গিয়ে আপনার অপেক্ষায় বসে থাকব। তখন আমরা সবাই একসাথে থাকব। এ জন্মে বিদায় মা, বিদায়।
তার ভাইদের কথা স্বরণ হল, নিজের জীবন উজার করে যাদেরকে সে সন্তান বাৎসল্যে লালন পালন করেছিল। সে কাঁদল, আর্তরব করে উঠল, ‘ভাইয়েরা আমার, সহোদর আমার, আমাকে মাফ করিস। আমি তোদের জন্য কিছু করেছি কিনা সেটা আল্লাহ জানেন। কিন্তু ইয়াতিম অবস্থায় তোদের লালন পালনে আমার যেসব ত্রুটি বিচ্যুতি হয়েছে তজ্জন্য আমাকে মাফ করে দিস। আমি তোদেরকে মাফ করলাম, রাগে- গোস্বায়, ইচ্ছায়- অনিচ্ছায় হয়ত কত কথা বলে ফেলেছিস আমি কিছু মনে করিনি, মাফ করে দিলাম, আল্লাহ তোদেরকে ক্ষমা করবেন। এখন তোরা সবাই বড়, আমাকে ছাড়া পৃথিবীর পথে হাঁটতে তোদের আর কোন সমস্যা হবে না। তোদের প্রতি আমার অসিয়্যত, জান্নাতের প্রতি খেয়াল রাখিস, সেই জান্নাতটি হল আমাদের মা। এই অনন্তলোক থেকে জান্নাত কিনে নিস। আল্লাহ তোদের দেখবেন, তোদের মঙ্গল করবেন। দুঃখ করিস না, আমি তোদের অগ্রজ আমাকে তো আগেই যেতে হবে। তোদের হতভাগ্য ভাইকে মাফ করে দিস। আল্লাহ তোদের ইহকাল- পরকাল হেফাজত করবেন’।
তার স্বরণ হল, বন্ধু বান্ধবদের কথা। মনে পড়ল, বাল্য বন্ধুদের সাথে মাঠে- ঘাটে খেলার কথা। মনে হল মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু বান্ধব ও সহপাঠীদের কথা। তাদের সাথে কত হাসি আনন্দ কত আবেগ উচ্ছাসের সময় কেটেছে। সে কেঁদে উঠল, ‘মাফ কর বন্ধুরা, এজন্মে আর তোমাদের সোনামুখগুলি দেখব না। আমায় মাফ কর বন্ধুরা, আমিও তোমাদেরকে মাফ করলাম। আল্লাহ তোমাদের সকলের মঙ্গল করুন।
তারপর স্বরণ হল তার স্ত্রীর কথা, ফেরদৌসির কথা। সে হাসল, বন্ধু আমার, সখি আমার, জীবন সাথী আমার, তুমি সুখী হও, অনেক অনেক সুখী, এটাই আমার একান্ত কামনা, একান্ত ইচ্ছা। তুমি আমার ঘরে সুখী ছিলে না, এখন সুখী হও, অনেক সুখী, তোমার সুখেই আমার সুখ। খোদার কসম, তোমার সুখেই আমার আনন্দ। আজ আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব এই ভেবে যে, তুমি সুখী, তুমি আত্মতৃপ্ত। সাথী আমার, আমাকে ক্ষমা কর। তোমার প্রতি আমার যেযব অন্যায় রয়েছে, সে সবের জন্য আল্লাহ্র ওয়াস্তে আমি তোমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছি। এই পৃথিবীর বিদায়ি মুসাফিরকে তুমি দয়া করে ক্ষমা কর, চিরদুখি এক হতভাগ্য মানব সন্তানকে দয়া করে ক্ষমা কর। বন্ধু, তুমি তো আমার লাঞ্চিত ও বঞ্চিত জীবন সম্পর্কে কিছুটা হলেও জান, এখন প্রশ্নটা হল এমন ভাগ্যাহত বিপন্ন একটা বদনসিবকে মাফ না করে কী করবে বল? আর আমার প্রতি যদি তোমার কোন অন্যায় থাকে তা যত বড়ই হউক আমি ক্ষমা করলাম। তোমাকে আমি আল্লাহ্র আদালতে দাঁড় করাব না, আমাকেও তুমি দাঁড় করিও না। আকাশ বাসির দয়ার প্রতি তাকিয়ে দয়া করে আমাকে ক্ষমা কর। আমাদের মধ্যে যা কিছু ঘটেছে তজ্জন্য আমিও দায়ী নই তুমিও দায়ী নয়, দায়ী আমাদের নিয়তি। কাজেই আমরা একে অন্যকে ক্ষমা করব, কোন দাবী রাখব না। বন্ধু তুমি তো এপারের মত ওপারেও তোমার নও মুসলিম স্বামীর সাথে থাকবে। থাক, কারণ তুমি ঐ ব্যক্তির সাথেই সুখী। আমি আর তোমাকে চাই না, যাকে জীবনে পেলাম না তাকে মরনে আর চাই না। আমি থাকব আমার বাবার সাথে, তারপর আমার মা আসবেন, তারপর আমার মেয়ে আসবে। আমরা সবাই একসাথে থাকব, অনেক আনন্দ হবে আমাদের। সেখানে তোমার কোন প্রয়োজন পড়বে না। তুমি আসতে চাইলেও হবে না। তুমি থাকবে তোমার নতুন স্বামীর সাথেই। না না, আমি অভিমান করে বলছি না, যাকে এপারে পেলাম না তাকে ওপারে আমার কি দরকার, তুমিই বল। আমি সাদা মনেই বলছি, আমাদের এখানে তোমার ঠাই হবে না। আল্লাহ হাফিজ।
তার মনে পড়ল ইঞ্জিনিয়ারের কথা। স্বরণ হল বিয়ের দিন তার হাত ধরে কেঁদে উঠে বলেছিল, ‘আমার কোন অভিবাবক নাই বড় ভাই নাই, আপনিই আমার বড় ভাই’। সে কেঁদে উঠল, ‘বড় দুলা ভাই, আমার মধ্যে কোন দিন কৃত্রিমতা ছিল না। সে দিন চির মজলুম বঞ্চিত অভিভাবকহীন এক ইয়াতিম যুবক সত্যিকার অর্থেই আপনাকে বড় ভাই হিসাবে গ্রহণ করেদিল। আজ সে নিঃস্ব সর্বহারা হয়ে ধুঁকে ধুঁকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে। ভাই আমার, আমি তো আপনাকে অনেক গালাগালি করেছি, অনেক বদনাম করেছি, এজন্য আমি আপনার কাছে- আমার বড় ভায়ের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। এখন আপনি বড় ভাই হয়ে ওপারের যাত্রি চির দুঃখি আপনার ছোট ভাইকে কি করবেন? মাফ করবেন নাকি আল্লাহ্র আদালতে দাঁড় করবেন? তা আপনার ইচ্ছা, তবে আমার প্রতিশ্রুতি থাকল আমি আপনাকে আল্লাহ্র আদালতে দাঁড় করাব না। আমি সবাইকে মার্জনা করলাম। আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন।
তার স্বরণ হল, ফেরদৌসির বড় বোন- বড়াপার কথা। সে একদিন তাকে বলেছিল, ‘তুমি আমাদের ছোট ভাই, ছোট ভাইয়ের মতই থাকবে’। হাসান কেঁদে উঠল, ‘বড়াপা বড়াপা গো, একদিন আপনি আমাকে ছোট ভাই বলেছিলেন। সেদিন আমার অভিভাবকহীন পোর খাওয়া অতৃপ্ত আত্মাটা আনন্দে ভরে উঠেছিল, আমি খুব শান্তি পেয়েছিলাম। তবে আপনি কি আমাকে সত্যিই ছোট ভাই মেনে নিয়েছিলেন কিনা তা জানেন আপনি এবং জানে অন্তর্জামী। কিন্তু আমি যে আপনাকে ও আপনাদেরকে বোন হিসাবে মেনে নিয়েছিলাম এবং আপনার ও আপনাদের সন্তানদেরকে নিজের ভাগ্নে ভাগ্নি বা সন্তান হিসাবে মেনে নিয়েছিলাম এর সাক্ষি আপনার বোন আমার স্ত্রী ফেরদৌসি স্বয়ং। কারণ আমি নিজের ভাই বোনদেরকে যতটুকু ভালবাসতাম আপনাদেরকে তার চেয়েও আপন করে নিয়েছিলাম। ফেরদৌসি এর সাক্ষী থাকল। কাজেই এখন অন্তিম শয়নে শায়িত আপনার ছোট ভাই ক্ষমা ভিক্ষার হাত প্রসারিত করেছে, তাকে কি করবেন? আমাদের মধ্যে যা কিছু ঘটেছে তজ্জন্য আমিও দায়ী নই আপনারাও দায়ী নয়, দায়ী আমাদের কপাল। কাজেই এসব পিছনে নিক্ষেপ করে সামনে তাকান, সেই হতভাগার দিকে তাকান- যে সারাটা জীবন শুধু দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছে। পৃথিবীর কন্টকাকীর্ণ ও কাটা ঝোপ ঝাড়ে পথ চলে চলে সে ক্ষত বিক্ষত ও মুমূর্ষু হয়ে জগতের লাঞ্চনা ও বঞ্চনার ডালি মাথায় নিয়ে ধোকে ধোকে পৃথিবীর শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছে। তাকে কী করবেন, আপনার ভাই হলে কী করতেন? মন চাইলে ক্ষমা করবেন মন না চাইলে আল্লাহ্র আদালতে দাঁড় করবেন। কিন্তু আমার প্রতিশ্রুতি থাকল আমি আপনাকে ও আপনাদেরকে ক্ষমা করলাম। আল্লাহ্র আদালতে দাঁড় করাব না। আল্লাহ আপনাদেরকে ক্ষমা করবেন।
আরো অন্যান্য যারা আছেন, বরিশালি দুলাভাই, নুরানী আপা, নাজমা আপা, বজলু ভাই, এডি দুলা ভাই, হাফু আপা আরো যারা আছেন আমি সবাইকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। সবাইকে আমি সহোদর ভাই- বোন হিসাবে মেনে নিয়েছিলাম, আত্নারজন হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু নিয়তি আমাদের সাথে প্রতারণা করল। আমি জ্ঞাতে- অজ্ঞাতে আপনাদেরকে কষ্ট দিয়েছি। কাজেই সকলের সামনে আমি ক্ষমা ভিক্ষার হাত প্রসারিত করলাম, বাকীটা আপনাদের ইচ্ছা মাফ করবেন নাকি আল্লাহর আদালতে দাঁড় করবেন। কিন্তু আমি সবাইকে মাফ করলাম, কারো প্রতি আমার কোন দাবী নাই, অভিযোগ নাই, অভিমান নাই। লা তাসরীবাল ইয়াওমা- আজ আর কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আমার রুল সমাপ্ত হল। কেউ যেন আমাকে আল্লাহ্র আদালতে দাঁড় না করায়, আকাশবাসিকে সাক্ষী রাখলাম আমিও কাউকে আল্লাহ্র আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাব না। সেই রহমানের দোহাই দিয়ে আমি সকলের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলাম- যার রহম ব্যতীত কেউ পার পাবে না। আমার অন্যান্য আত্মিয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি সকলের কাছে ক্ষমা চাইলাম। আল্লাহুম্মা আমিন। বাতাস তুমি আমার বার্তা সকলের কানে পৌঁছে দাও। ইয়া আল্লাহ আমার আবেদন, আমার কাকুতি মিনতি তুমি প্রত্যেকের কানে পৌঁছে দাও, আমার প্রতি সকলের হৃদয়ে দয়া ও করুণার উদ্রেক করে দাও। সবাই যেন আমাকে মাফ করে। আর তুমি আমাকে মাফ করে তোমার সন্তুষ্টি ও নিয়ামত দান কর। ইন্নি ওজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযি ফাতারাস-সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানীফা, ওমা আনা মিনাল মুশরিকীন। আল্লাহুম্মা তাকাব্বালনী, ইন্নাকা মুজিবুদ দাওয়াত।
হাসানের চেতনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসতে থাকে। এতক্ষণ পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের দায়বদ্দতার প্রতি তার মনোযোগ নিবিষ্ট ছিল। সহসা তার মেয়ের কথা মনে পড়ল। সে বাচ্চাকে কোলে নেয়ার জন্য উঠতে চাইল, হাত বাড়াতে চাইল, গড়াতে চাইল, হামাগুড়ি দিতে চাইল, অনেক চেষ্টা করল কিন্তু এক ইঞ্চি এমনকি এক সুতাও নড়তে পারল না। তার শরীর সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেছে, দেহ মরে গেছে। কাঠের টুকরার মত একটা কংকাল দেহ নিশ্চল নিথর হয়ে পড়ে আছে। শুধু মেয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণে মনের ক্ষীণ চেতনাটুকু বাকী আছে।
লক্ষ কোটি বিচ্ছু যেন তার কলজেটা কামড়ে ছিড়ে ফেলল। সে আর্তনাদ করে উঠল, সেই আর্তনাদ স্বর্গ মর্ত পাতাল চাপিয়ে উঠল, এক ব্যর্থ জন্মদাতার হৃদয় নিঃসৃত অন্তিম হাহাকার অনন্ত কালের সাক্ষি হিসাবে ইথার তরঙ্গে বাজতে লাগল। তার দুর্বল ক্ষীণ কণ্ঠ শুধু তার কানেই বাজল, ‘হাসবুনাল্লাহু নি’মাল মাউলা ওয়া নি’মাল ওয়াকিল। ইয়া মুজীবুদ দাওয়াত, আমি তো আমার মনজিলে মাকসুদের শেষ ঘাটি অতিক্রম করছি, আমার সন্তানের কি হবে, মানুষ তো সন্তানকে রেখে যায় হর্ম প্রাসাদে বালা খানায় তখত তাউসের উপর, অন্তত একটা পর্ণ কুটিরে হলেও রেখে যায় কিন্তু আমি তো আমার সন্তানকে কবরস্থানে রেখে যাচ্ছি। মানুষ সন্তানকে ধন-সম্পদ, মণি-মানিক্য, হিরা-জহরত, প্রবাল আর বিত্ত বৈভবের উত্তরাধিকার দিয়ে যায় কিন্তু আমি কি আমার সন্তানকে গোরস্থানের উত্তরাধিকার দিতে যাচ্ছি? প্রথম পয়দায়েশের দিন থেকে অদ্যাবধি কোন বাবা কি তার সন্তানকে এমন অবস্থায় রেখে গেছে? তাহলে কি আমার সন্তানও আমার মত বদবখত---। এখন আমি মরে গেলে আমার সন্তান---
তার ক্ষীণ কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল, আর কথা বলতে পারল না। এক অভিশপ্ত জন্মদাতার অন্তিম বাৎসল্য মরিয়া হয়ে উছলে উঠে, খোদার আসন- আরশ কুরসি লওহ কলম ও স্বর্গ মর্ত পাতাল সমেত প্রচণ্ড টান মারে, ভূ-কম্পের মত কেঁপে উঠে সৃষ্টি জগত। তার শরীরটা কেঁপে উঠল, মাটি থেকে আধা ফুট উপরে লাফিয়ে উঠল। উরগ জাতীয় প্রাণীর ন্যায় শরীরটা মোচড়াল, মানব কষ্ট ও যাতনার সর্ব শেষ স্তরে উপনিত হল। সহসা বুকটা ধক করে উঠল, কলিজা ফেটে গেল, হৃদপিন্ডে রক্ত ক্ষরণ শুরু হল, সে অবশিষ্ট চেতনাটুকুও হারাল। তার দৈহিক চেতনা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হল। কিন্তু মেয়ের জন্য তার তীব্র মানসিক চেতনা আবার জেগে উঠল। সে আর্তনাদ করল কিন্তু তার কণ্ঠে কোন শব্দ বাজল না। মনের কথাগুলি গড়গড় শব্দে মুখ দিয়ে বেরুতে লাগল। সেই সাথে গালের দু’পাশ বেয়ে রক্ত ও লালা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে মেয়ের জন্য কিছুক্ষণ দোয়া করল, আল্লাহ্র হাতে মেয়েকে সমর্পন করল, পৃথিবীর সকল সুখ শান্তি তার ভাগ্যে লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রার্থনা করল। এরপর তার হুঁশ শূন্যের কোটায় চলে গেল। কখনো কিছুটা হুঁশ আসে, তখন ইস্তেগফার পড়ে, সুরা ইয়াসিন পড়ে। আবার চেতনা হারায় আবার হুঁশ আসে, আবার কালেমা পড়ে, ইস্তেগফার পড়ে, ইয়াসিন পড়ে, দরূদ শরীফ পড়ে বা মেয়ের জন্য দোয়া করে। এভাবে তার মানসিক চেতনা আলো আধারের মত চলতে থাকে। তার আত্মার আওয়াজ কখনো ডুবে যায় কখনো জেগে উঠে।
আজ সন্ধ্যার পর থেকে হাসানের বৃদ্ধা মায়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তিনি বেচইন হয়ে উঠেছেন, শরীর ছটফট করছে, মস্তিস্ক অকেজো হয়ে গেছে, কোন কিছু চিন্তা করতে পারছেন না। হৃদকম্প শুরু হয়েছে, এ সমস্যাটা ইতিপূর্বে তার কখনো ছিল না। হাত পা অবশ হয়ে আসছে, শরীরে কোন শক্তি নেই, দেহের জোড়াগুলি যেন ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু এক লহমা বসে থাকতে পারছেন না, অস্থির হয়ে উঠেছেন। ঘরে বাইরে উঠানে শুধু দৌড়াদৌড়ি করছেন। কোলের বাচ্চা হঠাৎ হারিয়ে গেলে মা যেভাবে পাগলের মত ছুটাছুটি করে তিনিও তেমনি ছুটাছুটি করছেন। রাতে খাওয়া তো দুরের কথা, নামাযে দাঁড়াচ্ছেন কিন্তু পড়তে পারছেন না, তাসবীহ নিয়ে বসছেন কিন্তু বসে থাকতে পারছেন না, তার শরীর কাঁপছে, অস্থির হয়ে বাড়ি শুদ্ধু হাঁটাহাঁটি করছেন, কিছুক্ষণ পর পর গুমরে কেঁদে উঠছেন। একটা ছেলেও বাড়িতে নাই যে কথা বার্তা বলে মনটা হালকা করবেন বা পরামর্শ করবেন, সবাই হাসানের খুঁজে বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে।
রাতের তৃতীয় প্রহর। তিনি আর ঘরে উঠানে স্থির হয়ে থাকতে পারছেন না, বারবার তার পা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বহির্বাড়ির উঠানে। বহির্বাড়ির উঠানে সেই জায়গাটাতে গিয়ে তার পা স্থির হয়ে যাচ্ছে যেখানে আজ থেকে বিশ বছর আগে হাসানের বাবাকে জানাজার গোসল দেয়া হয়েছিল। রাতের চতুর্থ প্রহরে তিনি আর কোথাও যেতে পারছেন না, তার পা এ জায়গাটুকুতে আটকে গেল। তিনি সেখানে পায়চারি করছেন আর এমনিতেই তার চোখ বেয়ে দর দর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তিনি কাঁদতে চান না তবুও কিছুক্ষণ পর পর সর্বরিক্তের মত আকুল হয়ে কেঁদে উঠছেন। সুবহে সাদিকের সময় তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, হাসানের বাবাকে গোসলের জায়গাটাতে বসে পড়লেন। তারপর মাটিতে হাত বুলাতে বুলাতে জার জার হয়ে কাঁদতে লাগলেন। তার কি হয়েছে, কি সমস্যা তিনি জানেন না, তবে তার মন বলছে কোথাও না কোথাও এমন কোন ঘটনা ঘটছে- যা শীঘ্রই তার মৃত্যুর কারণ হবে।
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবর, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ---- মসজিদের মিনার থেকে মহাপ্রভুর দরবারে হাজিরা দেয়ার শাশ্বত আহ্বান ভেসে এল। নিত্য দিনের অভ্যাস অনুযায়ী আযান শুনে হাসান নামাযের জন্য উঠতে চাইল আর সাথে সাথে শুরু হল খিচুনি, প্রচন্ড খিচুনি। সে বাবার কবরে উপুড় হয়ে পড়েছিল কিন্তু খিঁচতে খিঁচতে চিৎ হয়ে গেল এবং দেহটা মাটি থেকে আধা হাত উপরে উঠে গেল। ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ ধ্বনির সাথে সাথে খিচুনি বন্ধ হয়ে গেল। তার চেতনা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হল। এরপরেও মনের নিবন্ত উঠন্ত অবশিষ্ট চেতনা দিয়ে সে মুয়াজ্জিনের সাথে সাথে কালেমাগুলো আওড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে, তার ঠোঁট নড়ছে। সর্বশেষ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ তার ঠোঁট নড়ে উঠল আর সাথে সাথে তার দেহটা নিথর হয়ে গেল চিরদিনের জন্য।
চলে গেছে, চলে গেছে, চলে গেছে পৃথিবীর আপদ। আর কোন অবাঞ্চিত পৃথিবীর পথে হাঁটবে না, আর কেউ কারো বিরক্তির কারণ হবে না, আর কেউ কারো মাথা ব্যাথার কারণ হবে না। আর কেউ সত্য ন্যায় ও ইনসাফের জন্য কারো সাথে ঝগড়া করবে না। বাবার মৃত্যুর মাধ্যমে ১৯৮৬ তে যে আগ্নেয়গিরির উদ্ভব ঘটেছিল নিজের লাভায় জ্বলে পোড়ে ২০০৬ তে এসে তার পতন ঘটল। যে জনকের অস্তিত্ব থেকে পৃথিবীর আলোতে এসেছিল এক ভাগ্যাহত জাতক- ধরিত্রীর সঙ্কীর্ন পরিক্রমা শেষ করে তারই বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল সে অনন্ত কালের জন্য। আমরা তারই জন্য, তার দিকে সবাই প্রত্যাবর্তন করব।
রাতের চতুর্থ যাম অতীত। পূর্বাকাশের রক্তিম আভা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, পাখ পাখালির কূজন বাঁশঝাড় ও বন-বনানি মুখর করে তুলেছে। মুসুল্লিরা মসজিদে যাচ্ছে, কৃষক মাঠে যাচ্ছে, শিশুদের কান্না ও কলরবে ঘরগুলি সজীব হয়ে উঠেছে। যামিনী তার কালো বোরকা খোলে ফেলেছে, বিভাবরী শ্বেতশুভ্র ভূষণ পরিধান করছে। আবার পৃথিবী জীবন্ত হয়ে উঠেছে, একটি জীবন পতনের সাথে সাথে প্রকৃতিতে জীবন স্পন্দন জেগে উঠেছে, আবার পৃথিবী তার স্বমহিমায় ফিরে আসছে। প্রকৃতির স্পন্দনের সাথে সাথে বাচ্চাটার দেহেও স্পন্দন শুরু হয়েছে। দীর্ঘ সময় অবচেতন হয়ে পড়ে থেকে তার ক্লান্তি কেটে গেছে, তার চেতনা ফিরে এল, জীবন্ত হয়ে উঠল, সজাগ হয়ে কান্না শুরু করল। অনেক্ষণ শুয়ে শুয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদল, কান্নার শক্তিও তার নাই। বাব্বাকে ডাকল, আম্মু আম্মু বলে মাকে ডাকল, কিন্তু কেউ এল না, তাকে কোলে নিল না। তার বাবার দেহটা পড়ে আছে তার থেকে দু’তিন হাত দক্ষিণে। অসহায় হয়ে সে হামাগুড়ি দিয়ে বাবার কাছে গেল, বাবাকে ডাকল, তার নাকে- মুখে ও বুকে হাত মারল কিন্তু বাবা উঠল না, তাকে কোলে নিল না।
অসহায় শিশু কাঁদতে কাঁদতে পূর্বে গেল, আম্মু আম্মু বলে ডাকল, বাম হাতে ভর দিয়ে কোলে উঠার জন্য ডান হাত বাড়িয়ে দিল কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। আবার বাবার কাছে আসল ডাকল, নাকে- মুখে ও বুকে হাত মারল কিন্তু বাবা উঠল না। আবার কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিকে গেল, মাকে ডাকল, কোলে উঠার জন্য ডান হাত বাড়িয়ে থাকল কিন্তু শূন্য মাঠে তার ব্যর্থ হাহাকারের প্রতিধ্বনি তারই কানে বাজল। ফের বাবার কাছে এল, ডাকল হাত মারল কিন্তু বাবা ফিরেও তাকাল না। আবার কাঁদতে কাঁদতে পশ্চিমে গেল, মাকে ডাকল, কোলে উঠার জন্য হাত বাড়িয়ে থাকল কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না, কোলে নিয়ে আদর করল না। অসহায় শিশু আবার বাবার কাছে ফিরে এল, বাব্বা বাব্বা বলে ডাকল, চিৎকার করল, আর্তনাদ করল, বাবার নাকে- মুখে ও বুকে হাত মারল, তবুও বাবা উঠল না। নিরুপায় হয়ে বাচ্চাটা হাঁটুতে দাঁড়িয়ে বাম হাতে বাবার বুকে ভর দিয়ে ‘বাব্বা বাব্বা’ বলে ডাকতে লাগল আর সমানে বাবার নাকে- মুখে, মাথায় ও বুকে হাত মারতে লাগল। তবুও বাবা উঠল না, তাকে কোলে নিল না, আদর করল না। অবশেষে সে অধৈর্য্য হয়ে চরম উত্তেজনায় ডান হাত উর্ধ্বে নিক্ষেপ করে শরীর মোচড়িয়ে ‘বাব্বা’ বলে বিকট আর্তনাদ করে উঠল, সেই আর্তনাদ পাষাণ পৃথিবীতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রতিধ্বনি তুলে উঠে উর্ধ্বে, উর্ধ্বে, আরো উর্ধ্বে, শূন্যে, মহাশূন্যে, কেঁপে কেঁপে উঠে আরশে আজিম। সাথে সাথে আরশে মুয়াল্লা থেকে তিনি ভু-পৃষ্টে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলেন- যিনি স্বাধিষ্ট- বিশ্ববিধায়ক, কাদেরে মুতলাক।
সমাপ্ত
বাস্তুলোক নশ্বর, অবিনশ্বর শুধুই তোমার প্রতিপালকের অজুদ-যিনি মহিয়ান ও গরীয়ান। (আর- রাহমান, ২৬-২৭)।
দ্রষ্টব্যঃ
১। আমি আগেই বলেছি তৃতীয় পর্বে মিশ্রন থাকবে। যারা চিঠির একেবারে শুরু পর্বটা পড়েছেন- তাদের প্রায় সম্পূর্ণ কাহিনী জানা হয়ে গেছে।
২। ব্লগ থেকে কিছু দিন গায়েব থাকব, বইটা প্রকাশের চেষ্টা করব। যদি লাইগ্যা যায় তাহলে ‘পৃথিবীর পথে, প্রতিক্ষা, উত্তর বাসন্তী’ ইত্যাদি একটার পর একটা লাগতেই থাকবে আল্লাহ চাইলে।
৩। আর যদি না লাগে তবুও দুইটা গোলা লাগতেই হবে। একটা হল, ‘এক বিংশতির যিশু’ (সাম্ভাব্য নাম)। এটাতে আমার সামর্থানুযায়ি সবটুকু বিষ ঢেলে দিব, এই বিষে ফেরকাবাজ আলেম শ্রেণিটা মারা যাবে। আমি মরার আগে আল্লাহ, রাসুল, ইসলাম ও উম্মাহর দুষমন এই শ্রেণিটার মুখুস উন্মোচন করে তবেই দুনীয়া ছাড়ব। স্বরণ রাখবেন এরা মুসলমান নয়, বিস্তারিত ঐ বইয়ে খুজুন।
৪। দ্বিতীয় গোলাটি হল, ‘প্রজন্ম ৭১ বলছি’ রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংক্রান্ত এটাতে যত চেতনার মুখুস, দাজ্জালের মুখুস, ইসলামের উপর আরোপিত পর্দা ইত্যাদি উন্মোচন করা হবে। ওমা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।
৫। সবাই ভাল থাকুন, সুন্দর থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমি? বাদ দেন, কোন দিন ভাল ছিলামও না, থাকবও না। আশা শুধু ওপাড়ের, ওখানে ভাল থাকতে পারলে জন্ম ও জীবন ষোল আনা সত্য অন্যথায় ষোল আনাই মিছা। মায়াস- সালাম।
বিষয়: সাহিত্য
১৮৬০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এতে বুঝা গেল হাসান মাহমুদ মারা গেছেন। আপনি লিখেছেন সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তা শেষটা কি হল। এখানে দেখা যায় মেয়েটা হাসানের মাধ্যমে বাড়ীতে এসেছে। তা হলে আবার মেয়েটা তার মার কাছে কিভাবে গেল। হাসান কি এখনও জিবিত আছেন। আর হিন্দু ডক্টর সাহেবের সাথে কিভাবে ছাড়া-ছাড়ি হল। ও ঘরে কখন সন্তা হল। জানতে মন চায়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন